বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (প্রথম খণ্ড)/বৌদ্ধযুগ/ডাক
ডাকের বচন।
বৌদ্ধযুগ—ডাক—খৃঃ ৮ম-১২শ শতাব্দী।
আসামের বড়পেটার ৬।৭ মাইল দক্ষিণে বাউসী পরগণার মধ্যে লোহ নামক একখানি গ্রাম আছে। বড়পেটার লোকেরা এই গ্রামকে ‘ডাকের গ্রাম’ নামে অভিহিত করিয়া থাকে। আসামে প্রচলিত ডাকের বচনে এই কয়েক পংক্তি পাওয়া যায়,—
“লোহিডাঙ্গরা ডাকের গাওঁ।]
আসামবাসীরা বলিয়া থাকেন, এই ‘লোহ’ই সেই প্রাচীন ‘লোহিডাঙ্গরা’ নামের রূপান্তর। লোহগ্রামে এখনও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলি পুষ্করিণী আছে এবং সেই সকল পুষ্করিণীর পাড়ে প্রাচীন বসতির চিহ্ন দেখা যায়। এক সময় যে এই গ্রাম বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল, এবং একটা বড় রাস্তা এস্থান হইতে কোচবিহার পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এখনও তাহার চিহ্ন আছে। কথিত আছে, ডাকের পিতা জাতিতে কুম্ভকার ছিলেন। প্রথমে তাঁহার সন্তান ছিল না। কিছুদিন পরে মিহির নামক জ্যোতির্ব্বিদ্ কামাখ্যা দর্শনার্থ কামরূপ যাইবার পথে এই লোহগ্রামে উপস্থিত হন। ডাকের মাতা শাশুড়ীর আদেশে পুল্রকামা হইয়া তাঁহার সেবা করেন। মিহির সেবায় তুষ্ট হইয়া পুল্রবর দিয়া চলিয়া যান। যথাকালে ডাক ভূমিষ্ঠ হন। প্রবাদ এই, ডাক জন্মিয়াই মাতাকে ডাক দিয়া নবপ্রসূতি ও সদ্যঃপ্রসূত সন্তানের লালন-পালন সম্বন্ধে উপদেশ করেন—এই নিমিত্ত তাঁহার নাম 'ডাক' হয়।
"উপজিয়ে মায়কো দিলে ডাক।
সেই সে কারণে তার নাম থৈলা ডাক॥"
মিহির আর একবার লোহিডাঙ্গরা গ্রামে আগমন করেন এবং ডাকের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাইয়া পরম প্রীত হন। প্রবাদ এই যে, ডাক অল্প বয়সেই জলে ডুবিয়া মারা যান। ডাকের বচনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি আছে:—নীতি-প্রকরণ, রন্ধন-প্রকরণ, জ্যোতিষ-প্রকরণ, ক্ষেত্র-প্রকরণ, গৃহিণী-লক্ষণ, কৃষি-লক্ষণ, বৃষ-লক্ষণ, বর্ষা-লক্ষণ, পরিত্যাগ-কথন।
আসাম-প্রচলিত ডাকের জন্ম-সম্বন্ধীয় প্রবাদগুলি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য তৎসম্বন্ধে আলোচনা করা উচিত। জ্যোতিষ-সম্বন্ধে কৃতিত্বের নিমিত্ত ডাককে বরাহমিহিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করিয়া জনসাধারণের প্রবাদ রচনা করা আশ্চর্য্য নহে। খনার সম্বন্ধেও সেইরূপ প্রবাদ প্রচলিত আছে। প্রধান শিবভক্তকে শঙ্করের অবতার, কৃষ্ণভক্তকে চৈতন্যের অবতার প্রতিপন্ন করিয়া বহু কাহিনী এদেশে রচিত হইয়াছে। জ্যোতিষ সম্বন্ধেও ডাককে সেইরূপ বরাহমিহিরের অবতার কল্পনা করা অসম্ভব নহে। আসামী ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস লেখক শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ বেজবড়ুয়া এই সমস্ত উপাখ্যান নির্ব্বিচারে বিশ্বাস করিয়া বরাহমিহিরের সময়ানুসারে ডাকের সময়ও খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। বরাহমিহিরের সময় সম্বন্ধে বিস্তর মতভেদ আছে। জ্যোতির্ব্বিদাভরণের সময়নির্দ্দেশ অনুসারে তিনি ২৪ বিক্রম-সম্বতে বিদ্যমান ছিলেন। পৃথুস্বামিকৃত ব্রহ্মগুপ্তের টীকায় লিখিত আছে ৫০৯ শকে বরাহমিহির স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। হলমঞ্জরীতে বরাহমিহিরের সময় দ্বিতীয় বিক্রম-সম্বৎ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু বরাহমিহির স্বয়ং তাঁহার বৃহজ্জাতকে যে সময় নির্দ্দেশ করিয়াছেন আমরা তাহাই গ্রাহ মনে করি। ৪২৭ শকের শুক্ল প্রতিপদ মঙ্গলবার ধরিয়া তিনি অহর্গণ স্থির করিয়াছেন। ইহাই সম্ভবতঃ তাঁহার বৃহজ্জাতক রচনার সময়। অতএব উহা ৫০৫ খৃষ্টাব্দ হইল। ডাক যদি সত্য সত্যই ইহার বর-পুল্র হইয়া থাকেন, তবে তাঁহার সময় খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগ দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এই উপাখ্যান আমরা বিশেষ প্রমাণ ব্যতীত গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নহি। শাকদ্বীপি-ব্রাহ্মণগণের এক শাখার উপাধি মিহির ছিল। এই মিহির হইতে উদ্ভূত 'মির' ও 'মের' এই দুই উপাধিই এখনও তাঁহাদের মধ্যে প্রচলিত দেখা যায়। মিহির নামক জ্যোতির্ব্বিদ্ পাইলেই যে আমরা তাঁহাকে বরাহমিহির বলিয়া মনে করিব, তাহার কোন কারণ নাই। পরবর্ত্তী লোকেরা বরাহমিহির এবং এই উপাখ্যানোক্ত মিহিরকে অভিন্নব্যক্তি বলিয়া কল্পনা করিয়াছে; বিশেষ প্রমাণাভাবে তাহা কখনই গ্রাহ্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ এই উপাখ্যানে ডাককে কুম্ভকার জাতীয় বলা হইয়াছে; অথচ বাঙ্গালায় প্রচলিত প্রবচনে অনেক স্থানে “ফুট ভাষে ডাক গোয়ালে” এই পদ দৃষ্ট হয়। নেপালে যে 'ডাকার্ণব তন্ত্র' ও 'বজ্রডাক তন্ত্র' প্রভৃতি তন্ত্র প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে এবং যাহাতে ডাকের বচনের অনুরূপ প্রবচনমালা উদ্ধৃত পাওয়া যায়, তাহা ডাকিনী তন্ত্রের মতই বজ্রডাক সম্প্রদায়ের রচিত বলিয়া মনে হয়। ডাক শব্দ ডাকিনী শব্দের পুংলিঙ্গ এবং ডাক ও ডাকিনী বৌদ্ধ তান্ত্রিকের শ্রেণীবিশেষ হওয়াই অধিক সম্ভবপর। ডাক যদি প্রকৃতই কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম হইয়া থাকে, তবে তাঁহার জন্মস্থান বড়পেটা হওয়া আশ্চর্য্য নহে। প্রাচীন কালে জলপাইগুড়ী হইতে ব্রহ্মদেশের সীমান্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত জনপদ প্রাগ্জ্যোতিষপুরের অন্তর্গত ছিল, সুতরাং বর্ত্তমান বঙ্গদেশের অনেকাংশ প্রাগ্জ্যোতিষপুরের মধ্যবর্ত্ত ছিল। ডাকের বচন বাঙ্গালার ঘরে ঘরে প্রচলিত। পাল-রাজাদের সময় কামরূপ বঙ্গদেশেরই অন্তর্গত ছিল; পাল-রাজগণের প্রতিনিধি-রাজপুরুষের তাম্রশাসন ঐ দেশ হইতে পাওয়া গিয়াছে। এই কারণে ডাককে বঙ্গীয় মনীষিগণের মধ্যে গ্রহণ করায় কোন আপত্তি হইতে পারে না। চাঁদ সওদাগরের বাসস্থান বঙ্গদেশ এবং আসামের বহুসংখ্যক গ্রামে নির্দ্দিষ্ট হইতে আমরা দেখিতে পাই,—সেই সেই গ্রামে এখনও তৎসংক্রান্ত বহু প্রবাদ প্রচলিত আছে। ডাকের জন্মভূমি-সংক্রান্ত প্রবাদ সেইরূপ কল্পনা-মূলক কিনা তাহা বলা যায় না, কিন্তু যখন ডাকের জন্মস্থান বলিয়া অপর কোন গ্রাম এখনও দাবী করে নাই, তখন লোহগ্রামকে সেই গৌরব দিতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু এতদ্দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তদ্রূপ অন্যান্য কি কি কাহিনী প্রচলিত আছে তাহা না জানা পর্য্যন্ত আমরা নিঃসংশয় হইতে পারি নাই। বরাহমিহিরের উপাখ্যান সম্বন্ধে আমাদের আপত্তি আছে। ভাষার নমুনা দেখিয়া ডাক ও খনার বচনকে আমরা খৃষ্টীয় ৮ম-১২শ শতাব্দীর রচনা বলিয়া মনে করিয়াছি। (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ৩য় সং, ৭৮-৮৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। এই মত পরিবর্ত্তন করিবার যথেষ্ট কারণ এখনও পাই নাই। ডাকের বচনের অনেকাংশ অত্যন্ত দুর্ব্বোধ, যথাঃ–
"আদি অন্ত ভুঝসি।
ইষ্ট দেবতা যেহ পূজসি॥
মরণের যদি ডর বাসসি।
অসম্ভব কভু না খায়সি॥"
"বুন্দা বুঝিয়া এড়িব লুণ্ড।
আগল হৈলে নিবারিব তুণ্ড॥” ইত্যাদি।
ডাক ও খনার বচন শুধু বঙ্গদেশে নহে, এখনও উড়িষ্যায়ও প্রচলিত আছে। বহু-প্রচলন-হেতু ইহাদের ভাষা পরবর্ত্তী কালে যে অনেকটা পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই; তবে আদিম রচনার চিহ্ন এখনও অনেক স্থলে বিদ্যমান আছে।
সন্তান-জন্মের পর।জন্মমাত্র বলে ডাক।
পো এড়িয়া পোআতি রাখ॥[১]
ধুইআ পৌচ্ছআ দিহ কোলে।
যবে ফুল নাম্বিবেক ভালে॥
নাড়ি ছেদিআ দিহ জয়।
ডাক বলে এই হয়॥
অথ ধর্ম্ম-প্রকরণ।
ধর্ম্ম করিতে যে জন জানি।
পুখর দিআ রাখিও পানি॥
অশ্বখ রোপে বড় কর্ম্ম।
মণ্ডপ দেএ অশেষ ধর্ম্ম॥
অন্ন বিন্ন[২] নাহি দান।
ইহার পর ধর্ম্ম নাহি আন॥
অথ রন্ধন-প্রকরণ।
নিমপাতা কাসন্দির ঝোল।
তেলের ওপর দিয়া তোল॥
পলতা শাক রুহি মাছ।
বলে ডাক বেঞ্জন সাছ[৩]॥
মদ্গুর মৎস্য দাএ কুটিয়া।
হিঙ্গ আদা লবণ দিয়া॥
তেল হলদি তাহাতে দিব।
বলে ডাক বেঞ্জন খাব॥
পোনা মাছ জামিরের রসে।
কাসন্দি দিআ যে জন পরশে॥
তাহা খাইলে অরুচ্য পালাএ।
আছুক মানবের কথা
দেবের লোভ যাএ॥
ইচিলা[৪] মাছ তৈলে ভাজিয়া।
পাতি লেবু তাতে দিয়া॥
যাহাতে দেই তাতে মেলে।
হিঙ্গ মরিচ দিহ ঝোলে॥
চালু দিহ যত তত।
পানী দিহ তিন যত॥[৫]
ভাত উতলাইলে দিহ কাটী।
তবে দিহ জাল ভাটী॥[৬]
বড় ইতিলা দাএ কুটি।
হিঙ্গ দিয়া তেলে ভাজি।
উলটি পালটি দিহ পীট।
হই থাইলে যোজন দিট॥[৭]
রৌদ্রের বেলা বুনি আইসে।
আমন ভাত কাসন্দি চোষে॥
পোড়া মাছে লবণ প্রচুর।
আর বেঞ্জনে পেলাহ দূর।
পাকা তেতলি বৃদ্ধ বোয়াল।
অধিক করিআ দিহ জ্বাল॥
কাটী দিআ করিহ ঝোল।
খাবার বেলা মাথা নাহি তোল॥
বাপে পোয়ে কন্দল বাজে।পিতা-পুত্রের কলহ।
তা বিচারে অবুধ রাজে॥
শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ মারে।ব্রাহ্মণ-শূদ্রের বিচার।
কোন্ মূঢ়ে তা বিচারে॥[৮]
সজ্জন যবে গরু মারে।প্রায়শ্চিত্ত।
পরের নারী স্থাপ্য হরে॥
বার বৎসর ভিক্ষা মাগে।
শেষে ভ্রমিয়া নাহে গাঙ্গে॥
প্রায়শ্চিত্ত করিয়া যায়।
যাহার পাপ তাকে সি[৯] পায়॥
অথ বসতি-প্রকরণ।
আনহি বসত আনহি চাষ।
বলে ডাক তাহার বিনাশ॥[১০]
রাজার কাজ ষে না বোঝে।
সেই জন আপনি মজে॥
যথা রাজা পালে।
তথা বসতি ভালে॥
ধন সম্পদ ঠাকুরাল পাই।
নিত্য রাজা সেবিতে চাই॥
রাজা সেবিব এক মনে।
যেন রাজা ভাল জানে॥
যেন রাজা যেন দেশ।
তা দেখিয়া করিহ ভেশ॥
আনহি বসতি আনহি গোয়ালি।
হেন বসতের কি বাউলি॥[১১]
রাজ-কাজ যে না বুঝে।
তা না পাঠাব দেওয়ানের মাঝে॥[১২]
মনে যদি লই কসর।
পোখরি পাহাড়ে[১৩] তুলিও ঘর॥
অথ গৃহিণী-লক্ষণ।
মিঠ রান্ধে সরুআ কাটে।[১৪]
সে গৃহিণীতে ঘর না টুটে॥
যে কিছু মধুর বলে।
স্বামীর বোল শিরে ধরে॥
সুশীলা শুদ্ধ বংশে উৎপত্তি।
মিঠ বোল স্বামীতে ভকতি॥
তাহাকে ধর্ম্ম আপনি যুঝে॥[১৫]
রৌদ্রে কাঁটাকুটায় রান্ধে।
খড় কাঠ বর্ষাকে বান্ধে॥[১৬]
ফুট ভাষে ডাক গোয়ালে।
এ গৃহিণীতে ঘর না টলে॥
চড়কা পীড়ি চড়ক ধুতী।
রান্ধে বাড়ে গায় না লাগে কালী॥
স্বামীর সেবা সাঁজে বাতি।
বলে ডাক লক্ষ্মীর স্থিতি॥
আতিথ্য দেখিয়া মরে লাজে।
তবু তার পূজায় লাগে॥
হেট মুণ্ডে কাকেহো না চায়॥
যেন যায় তেন আইসে।
বলে ডাক গৃহিণী সেই সে॥
অথ কুগৃহিণী-লক্ষণ।
গৃহিণী হইয়া রোষে বোলে।
স্বামীর পীড়ি পায় টালে॥
ঘর নাশে অল্প কালে।
ফুট ভাষে ডাক গোয়ালে॥
প্রভাত কালে নিদ্রা যায়।
বাসি শয্যা সূর্য্য পায়॥
উদয় হৈলে ছড়া[১৭]
সাঁজ হৈলে ভাড়া[১৮]।
তা গৃহিণীর ধরিয়া মুখ পোড়া॥
যে গৃহিণী আয়ুদড়[১৯] মুণ্ডী।
খায় দায় না পালে হাণ্ডী[২০]॥
ফেলায় খায় সব প্রচুর।
বলে ডাক নিকলহ দূর॥
হেন স্ত্রীয়ে যাহার বাস।
খায় দায় উজাড়ে বাস॥
উচিত বলিতে পাড়ে গালি।
পোয়ে ঝিয়ে[২১] হয় বে-আলি[২২]॥
কান্দনা শুনিয়া বাহির হয়।[২৩]
নাটে গীতে ধাইয়া যায়॥
এ নারীতে যাহার বাস।
তাহার কেন জীবনের আশ॥
অতিথি দেখিয়া কোপ-মনে।
গালি দেয় অতিথ শুনে॥
ভাল দ্রব্য আপনে খায়।
বোল বলিতে উত্তর যুজে॥
ভাল বলিতে রোষ করে।
তাহার স্বামী কেন থাকে ঘরে॥
রৌদ্রে রান্ধে কাঠে খড়ে।
বর্ষাকালে চাল আচড়ে॥[২৪]
এক বলিতে দুবোল বলে।
স্বামীর শয্যা পায় টালে॥
কিছু বলিতে পাড়ে গালি।
তাহার স্বামী কেনে
নহে ভিখারী॥
অথ স্ত্রীদোষ-লক্ষণ।
অতি দীঘলী হয় রাণ্ডী[২৫]।
নির্দ্ধন হয়ে নাণ্ডা-মুণ্ডী[২৬]॥
পিঙ্গল আখি চপল মতি।
ওঠ[২৭] ডাগর অলক্ষণ জাতি॥
পেট পীঠ উচ ললাট।
তা দেখিয়া ছাড়িহ বাট॥
দেয়র বধে স্বামী মারে।
বলে ডাক আর কিবা করে॥
নাক বাজে যার নিদ্রা গেলে।
সবাকে রুষিয়া বোল বলে॥
ভূমি কাঁপে যার পাএর ঘায়।
আছুক স্বামীর কাজ * খায়॥
ঘরে স্বামী বাহিরে বৈসে।
চারি পানে চাহে মুচকি হাসে॥
হেন স্ত্রীয়ে যাহার বাস।
তাহার কেন জীবনের আশ॥
যাহার ঘরে নাহি ঢেঁকি মূষল।
সে বহু ঝির নাহিক কুশল॥
বলে ডাক শুন সার।
পরের ঘরে উপজে জার॥[২৮]
যত হয় কলা কাপাসে।
তত হয় সরিষা মাষে॥
যথা কলা কাপাসে বাড়ী
তথা লুব্ধ বহু ঝিয়ারী॥
ফুট ভাষে ডাক গোয়ালে।
তাহার নিকটে বসে অসতী॥
ঘরে আখা বাহিরে রান্ধে।
অল্প কেশ ফুলাইয়া বান্ধে॥
ঘন ঘন চাহে উলটিয়া ঘাড়।
বলে ডাক এ নারী ঘর উজার॥
পানী ফেলিয়া পানীকে যায়।[২৯]
পরপুরুষ পানে আড় চক্ষে চায়॥
বাতি বুলে গীত গায়।
তাক লইয়া ঘর কেনে॥
যে নারী দিনে নিদ্রা যায়।
গালি দিলে রোষ করিয়া যায়॥
চিড়িপো[৩৩] কাহাকে না পুছে।
ডাক বলে বিভা কৈলে মিছে॥
নিয়ড় পোখরী দূরে যায়।[৩৪]
পথিক দেখিয়া আড় চক্ষে চায়॥
পরপুরুষকে আড় চক্ষে চাহি।
পরসম্ভাষে বাটে রহি॥
এ নারী ঘরে না থুই।
রাণ্ডী হইয়া ভোগরাই[৩৫]॥
হাসিয়া চাহে আড় দৃষ্টি।
বলে ডাক সেই নষ্টী॥
যথা বাড়ী বাটে বাট।
যুবতী হইয়ে যায় হাট॥
পানী দেখিয়া তরাসে ধায়॥
সিয়া পাতে[৩৬] খায় দুধ।
বলে ডাক সে বড় অবুধ[৩৭]॥
যে নারী কাটন নাহি কাটে।
রাতি পোহাইলে
পোপানকে সাটে[৩৮]॥
কিছু বলিতে যায় রোষে।
ডাক বলে পুরুষ দোষে॥
বলে ডাক মে কি সাধবু তারে॥
মিছা কাজে গাছে চড়ন।
তাহার মরণ যখন তখন॥
যে পরের ঋণে লাগা হয়।
ব্রাহ্মণ হইয়া শৃদ্রাণীর খায়॥
বেশ্যা হইয়া লাজউলী[৩৯]।
মুখ পোড়াহ তার আগুন জ্বালি॥
চোর গাই বাঁঝি[৪০] ছাগলী।
ঘরে আছে দুষ্টা মেহলী[৪১]॥
খল পড়শী পো মুরুখ।
বলে ডাক এ বড় দুঃখ॥
বিনি চূণে গুয়া খায়।
ভাত হৈলে রোষ করিয়া যায়॥
ঘাট এড়িয়া অঘাটে নায়।
মাগ মরলে শ্বশুর বাড়ী যায়॥
সে কান্দিয়া রাত্রি পোহায়।
ঈশ্বরের[৪২] স্ত্রী সনে করে পরিহাস।
গাভুর বয়সে যাতে কাশ॥[৪৩]
গুরুজনকে করে উপহাস।
বলে ডাক তার নাই জীবনের আশ॥
না থুইব[৪৪] যে গুরু মারে।
না থুইব যে স্ত্রী জার করে॥
পরের বাড়ীতে যাহার বাড়ীয়ালী।
দুই স্ত্রীয়ে যথা কন্দলী॥
- ↑ সন্তানকে ত্যাগ করিয়া প্রসূতির প্রতি মনোযোগী হও।
- ↑ বিনা।
- ↑ সাছ=সাঁচা=সত্য।
- ↑ চিংড়ী।
- ↑ চাউল যত দিবে তাহার তিন গুণ জল দেওয়া উচিত।
- ↑ তখন জ্বাল একটু হ্রাস করিবে।
- ↑ এইরূপ হইলে, অর্থাৎ এই ভাবে প্রস্তুত হইলে, তাহা খাইলে চক্ষের দৃষ্টি এক যোজন পর্য্যন্ত যায়, অর্থাৎ চক্ষু ভাল হয়।
- ↑ বুদ্ধিহীন রাজাই পিতা-পুত্রের কলহের বিচার করিতে যান। শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে প্রহার করে, তবে এরূপ গুরুতর অপরাধ হয় যে, তাহা পার্থিব কোন বিচারকের পক্ষে বিচার করিতে যাওয়া মূর্থতা, অথবা বিচার না করিয়াই শ্রবণমাত্র তাহার শান্তি দেওয়া উচিত।
- ↑ সি=সে।
- ↑ এক স্থানে বাড়ী এবং অপর স্থানে কৃষিক্ষেত্র হইলে কৃষক নষ্ট হয়।
- ↑ এক স্থানে বাস করিবার ঘর এবং অন্য স্থানে গোয়াল, ইহা পাগলের বাস করিবার উপযুক্ত। অর্থাৎ নিজের ঘরের নিকট গৃহস্থ গোয়াল রাখিবে।
- ↑ তাহাকে রাজসভায় পাঠাইতে নাই।
- ↑ পাড়ে।
- ↑ সরুআ=সরু। যে গৃহিণী ছোট ছোট কাঠে অর্থাৎ অতি অল্প কাঠ খরচ করিয়া সুমিষ্ট রন্ধন করিতে পারেন।
- ↑ ধর্ম্ম তাহার হইয়া যুদ্ধ করেন, অর্থাৎ তাহার পক্ষ আশ্রয় করেন।
- ↑ বর্ষাকে=বর্ষার জন্য। বর্ষাকালের জন্ত খড় কাঠ তুলিয়া রাখে।
- ↑ সূর্য্যোদয়ের পরে ছড়া দেওয়া।
- ↑ ধান ভানা।
- ↑ আয়ুদড়, আউদড়=আলুলায়িত। আয়ুদড় শব্দ হইতে যদি উদ্লা শব্দ আসিয়া থাকে তবে তাহার অর্থ—অনাবৃত।
- ↑ হাণ্ডী পালন না করে অর্থাৎ যত্বপূর্ব্বক হাঁড়ীরক্ষা না করে।
- ↑ পোয়ে ঝিয়ে=পুত্র এবং কন্যার প্রতি।
- ↑ বে-আলি=বিরুদ্ধ।
- ↑ সুশীলা রমণী কান্না শুনিয়া উৎসুকভাবে বাহিরে আসিবেন না।
- ↑ কাঠ খড় রৌদ্রের সময় পোড়াইয়া বর্ষাকালে যে গৃহিণী চালের খড় জ্বালিয়া রাঁধে।
- ↑ রাণ্ডী=রাঁড়ী=বিধবা।
- ↑ নেড়া মাথা অর্থাৎ যাহার মাথায় অল্প কেশ থাকায় মাথা প্রায় কেশশূন্য।
- ↑ ওঠ=ওষ্ঠ।
- ↑ অপরের গৃহেই রমণীগণের স্বভাব নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা।
- ↑ পুনরায় বাহিরে যাইবার অভিপ্রায়ে তোলা জল ফেলিয়া দিয়া জল আনিবার ছলে বহির্গত হয়।
- ↑ ওড়ন=উত্তরীয় বসন।
- ↑ কাড়ে=বলপূর্ব্বক গ্রহণ করে।
- ↑ সানে—ইঙ্গিতে কথা বলে।
- ↑ ছেলেপিলে।
- ↑ পুকুর নিকটে, তথাপি জল আনিতে দূরে যায়।
- ↑ ভোগী।
- ↑ ছেঁড়া পাতে।
- ↑ অবোধ।
- ↑ পোপানকে=পোলাপানকে=সন্তানদিগকে। সাটে=শাসন করে।
- ↑ লজ্জাবতী।
- ↑ বন্ধ্যা।
- ↑ মহিলা।
- ↑ ঈশ্বর=গুরু।
- ↑ গাভুর=যৌবন। যৌবন সময়ে যাহার কাশের ব্যারাম হয়।
- ↑ থুইব=রাগিব
- ↑ যে জুয়া খেলে।
- ↑ গান্ধিপোকায় যে ধানকে চুষিয়া সার-শূন্য করিয়া ফেলে।
- ↑ বিচে=বেচে=বিক্রয় করে।
- ↑ ইহা বিক্রয় করিতে কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন নাই, অর্থাৎ যত শীঘ্র বিক্রয় হয় ততই মঙ্গল।