বড়দিদি/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 আজি চারি বৎসর হইল, ব্রজরাজবাবুর পত্নীবিয়োগ হইয়াছে— বুড়া বয়সের এ দুঃখ বুড়াতেই বোঝে। কিন্তু সে কথা যাউক— তাঁহার আদরের কন্যা মাধবী দেবী যে এই তার ষোল বৎসর বয়সেই স্বামী হারাইয়াছে— ইহাই ব্রজরাজের শরীরের অর্দ্ধেক রক্ত শুষিয়া লইয়াছে। সাধ করিয়া ঘটা করিয়া তিনি মেয়ের বিবাহ দিয়াছিলেন— নিজের অনেক টাকা,— তাই অর্থের প্রতি নজর দেন নাই, ছেলেটির বিষয়-আশয় আছে কি না, খোঁজ লন নাই, শুধু দেখিয়াছিলেন, ছেলেটি লেখাপড়া করিতেছে, রূপবান্‌, সৎ সাধুচরিত্র,— ইহাই লক্ষ্য করিয়া মাধবীর বিবাহ দিয়াছিলেন।

 এগারো বৎসর বয়সে মাধবীর বিবাহ হইয়াছিল। তিন বৎসর সে স্বামীর কাছে ছিল। যত্ন, স্নেহ, ভালবাসা সবই সে পাইয়াছিল।

 কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ বাঁচিলেন না। মাধবীর এ জীবনের সব সাধ মুছিয়া দিয়া, ব্রজরাজের বক্ষে শেল হানিয়া তিনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন। মরিবার সময় মাধবী যখন বড় কাঁদিতে লাগিল, তখন তিনি মৃদু-কণ্ঠে কহিয়াছিলেন, “মাধবি, তোমাকে যে ছাড়িয়া যাহিতেছি, এইটিই আমার সব চেয়ে দুঃখ। মরি, তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু তুমি যে আজীবন ক্লেশ পাইবে, এইটি আমাকে বড় বিচলিত করিয়াছে। তোমাকে যে যত্ন করিতে পাইলাম না—”

 দরবিগলিত অশ্রুরাশি যোগেন্দ্রের শীর্ণ বক্ষে ঝরিয়া পড়িল। মাধবী তাহা মুছাইয়া দিয়া বলিয়াছিল, “আবার যখন তোমার পায়ে গিয়া পড়িব, তখন যত্ন করিয়ো—”

 যোগেন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, “মাধবি, যে জীবন তুমি আমার সুখের জন্য সমর্পণ করিতে, সেই জীবন সকলের সুখে সমর্পণ করিও। যার মুখ ক্লিষ্ট মলিন দেখিবে, তাহারই মুখ প্রফুল্ল করিতে চেষ্টা করিও— আর কি বলিব, মাধবি—” আবার উচ্ছ্বসিত অশ্রু ঝরিয়া পড়িল— মাধবী তাহা মুছাইয়া দিল।

 “সৎপথে থাকিও— তোমার পুণ্যে আবার তোমাকে পাইব।”

 সেই অবধি মাধবী একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। ক্রোধ, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি যাহা কিছু তাহার ছিল, স্বামীর চিতাভস্মের সহিত সবগুলি সে ইহজন্মের মত গঙ্গার জলে উড়াইয়া দিয়াছে। এ জীবনের কত সাধ, কত আকাঙ্ক্ষা! বিধবা হইলে কিছু সে সব যায় না— মাধবী তখন স্বামীর কথা ভাবে। তিনি যখন নাই, তখন আর কেন? কাহার জন্য আর পরের হিংসা করিব! কাহার জন্য আর পরের চোখে জল বহাইব! আর এ সকল হীন প্রবৃত্তি তাহার কোন কালেই ছিল না; বড় লোকের মেয়ে— কোন সাধ, কোন আকাঙ্ক্ষাই তাহার অতৃপ্ত ছিল না— হিংসা-দ্বেষ সে কোন দিন শিখেও নাই।

 তাহার নিজের হৃদয়ে অনেক ফুল ফোটে, আগে সে ফুলে মালা গাঁথিয়া সে স্বামীর গলায় পরাইয়া দিত। এখন স্বামী নাই, তাই বলিয়া ফুলগাছটি সে কাটিয়া ফেলে নাই। এখনো তাহাতে তেমনি ফুল ফোটে, ভুমে লুটাইয়া পড়ে। এখন সে আর মালা গাঁথিতে যায় না সত্য, কিন্তু গুচ্ছ করিয়া অঞ্জলি ভরিয়া দীন-দুঃখীকে তাহা বিলাইয়া দেয়। যাহার নাই, তাহাকেই দেয়, এতটুকু কার্পণ্য নাই, এতটুকু মুখ ভারী করা নাই।

 ব্রজবাবুর গৃহিণী যেদিন পরলোক-গমন করেন, সেই দিন হইতে এ সংসারে আর শৃঙ্খলা ছিল না। সবাই আপনাকে লইয়া ব্যস্ত থাকিত; কেহ কাহাকে দেখিত না, কেহ কাহারো পানে চাহিত না। সকলেরই এক একজন ভৃত্য মোতায়েন ছিল, তাহারা আপন আপন প্রভুর কাজ করিত। রন্ধন-শালায় পাচক রন্ধন করিত, বৃহৎ অন্নসত্রের মত লোকে পাত পাড়িয়া বসিয়া যাইত। কেহ খাইতে পাইত, কেহ পাইত না। সে দুঃখ কেহ চাহিয়াও দেখিত না।

 কিন্তু যেদিন হইতে মাধবী তাহার ভাদ্রমাসের ভরা গঙ্গার মত রূপ, স্নেহ, মমতা লইয়া পিতৃ-ভবনে ফিরিয়া আসিল, সেইদিন হইতে যেন সমস্ত সংসারে নবীন বসন্ত ফিরিয়া আসিয়াছে। এখন সবাই কহে, বড়দিদি, সবাই বলে মাধবী। বাড়ির পোষা কুকুরটা পর্য্যন্ত দিনান্তে একবার বড়দিদিকে দেখিতে চাহে! এত লোকের মধ্যে সেও যেন একজনকে স্নেহময়ী সর্ব্বময়ী বলিয়া বাছিয়া রাখিয়াছে। বাড়ির প্রভু হইতে সরকার, গোমস্তা, দাস, দাসী সবাই ভাবে, বড়দিদির কথা, সবাই তাহার উপর নির্ভর করে; সকলেরই মনে মনে একটা ধারণা যে, যে কারণেই হউক, এই বড়দিদিটির উপর তাহার একটু বিশেষ দাবী আছে।

 স্বর্গের কল্পতরু কখনও দেখি নাই, দেখিব কি না তাহাও জানি না, সুতরাং তাহার কথা বলিতেও পারিলাম না! কিন্তু, এই ব্রজবাবুর সংসারবর্ত্তী লোকগুলা একটি কল্পতরু পাইয়াছিল। তলায় গিয়া হাত পাতিত, আর হাসিমুখে ফিরিয়া আসিত।

 এরূপ পরিবারের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ একটা নূতন ধরনের জীবন অতিবাহিত করিবার উপায় দেখিতে পাইল। সকলে যখন একজনেরই উপর সমস্ত ভার রাখিয়াছে, তখন সেও তাহাদের মতই করিতে লাগিল। কিন্তু অপরের অপেক্ষা তাহার ধারণা একটু ভিন্ন প্রকারের। সে ভাবিত, বড়দিদি বলিয়া একটি জীবন্ত পদার্থ বাটীর মধ্যে থাকে, সকলকে দেখে, সব আবদার সহ্য করে, যাহার যাহা প্রয়োজন, তাহা তাহারই নিকট পাওয়া যায়। কলিকাতায় রাজপথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নিজের জন্য নিজে ভাবিবার প্রয়োজনটা সে কতক বুঝিয়াছিল, কিন্তু এখানে আসিয়া অবধি সে একেবারে ভুলিয়া গেল যে, আপনার জন্য তাহাকে বিগত জীবনের কোন একটি দিনও ভাবিতে হইয়াছিল, বা পরে ভাবিতে হইবে!

 জামা, কাপড়, জুতা, ছাতি, ছড়ি যাহা কিছু প্রয়োজন, সমস্তই তাহার কক্ষে প্রচুর আছে। রুমালটি পর্য্যন্ত তাহার জন্য সযত্নে কে যেন সাজাইয়া রাখিয়া গিয়াছে। প্রথমে কৌতূহল হইত, সে জিজ্ঞাসা করিত, “এ সব কোথা হইতে আসিল?” উত্তর পাইত, “বড়দিদি পাঠাইয়া দিয়াছেন।” জলখাবারের থালাটি পর্য্যন্ত দেখিলে সে আজকাল বুঝিতে পারে, ইহাতে বড়দিদির সযত্নস্পর্শ ঘটিয়াছে।

 অঙ্ক কষিতে বসিয়া একদিন তাহার কম্পাসের কথা মনে পড়িল; —প্রমীলাকে কহিল, “প্রমীলা! বড়দিদির কাছ থেকে কম্পাস নিয়ে এস।”

 কম্পাস লইয়া বড়দিদিকে কাজ করিতে হয় না, ইহা তাহার নিকট ছিল না; কিন্তু বাজারে তখনই সে লোক পাঠাইয়া দিল। সন্ধ্যার সময় বেড়াইয়া আসিয়া সুরেন্দ্রনাথ দেখিল, তাহার টেবিলের উপর প্রার্থিত বস্তু পড়িয়া রহিয়াছে। পরদিন সকালে প্রমীলা কহিল, “মাষ্টার-মহাশয়, কাল দিদি ঐটে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

 তাহার পর মধ্যে মধ্যে সে এমন এক-আধটা জিনিস চাহিয়া বসিত যে, মাধবী সেজন্য বিপদে পড়িয়া যাইত। অনেক অনুসন্ধান করিয়া তবে প্রার্থনা পূর্ণ করিতে হইত। কিন্তু কখনও সে বলে নাই, “দিতে পারিব না!”

 কিংবা কখনও সে হঠাৎ হয়ত প্রমীলাকে কহিল, বড়দিদির নিকট হইতে পাঁচখানা পুরাতন কাপড় লইয়া এস; ভিখারীদের দিতে হইবে। নূতন পুরাতন বাছিবার অবসর মাধবীর সব সময় থাকিত না; সে আপনার পাঁচখানা কাপড় পাঠাইয়া দিয়া, উপরের গবাক্ষ হইতে দেখিত— চারি-পাঁচজন দুঃখী লোক কলরব করিতে করিতে ফিরিয়া যাইতেছে— তাহারাই বস্ত্রলাভ করিয়াছে!

 সুরেন্দ্রনাথের এই ছোট-খাট আবেদন-অত্যাচার নিত্যই মাধবীকে সহ্য করিতে হইত। ক্রমশঃ এ সকল এরূপ অভ্যাস হইয়া গেল যে মাধবীর আর মনে হইত না, একটা নূতন জীব তাহার সংসারে আসিয়া দৈনন্দিন কার্য্য-কলাপের মাঝখানটিতে নূতন রকমের ছোট-খাট উপদ্রব তুলিয়াছে।

 শুধু তাহাই নহে। এই নূতন জীবটির জন্য মাধবীকে আজকাল খুবই সতর্ক থাকিতে হয়, বড় বেশী খোঁজ লইতে হয়। সে যদি সব জিনিস চাহিয়া লইত, তাহা হইলেও মাধবীর অর্দ্ধেক পরিশ্রম কমিয়া যাইত; সে যে নিজের কোন জিনিসই চাহে না— এইটিই বড় ভাবনার কথা। প্রথমে সে জানিতে পারে নাই যে, সুরেন্দ্রনাথ নিতান্ত অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক! প্রাতঃকালে চা ঠাণ্ডা হইয়া যায়, সে হয় ত খায় না! জলখাবার হয়ত স্পর্শ করিতেও তাহার মনে থাকে না, হয় ত বা কুকুরের মুখে তুলিয়া দিয়া সে চলিয়া যায়। খাইতে বসিয়া অন্ন-ব্যঞ্জনের সে কোন সম্মানই রাখে না, পাশে ঠেলিয়া নীচে ফেলিয়া সরাইয়া রাখিয়া যায়; যেন কোন দ্রব্যই তাহার মনে ধরে না! ভৃত্যেরা আসিয়া কহে, “মাষ্টারবাবু পাগলা, কিছু দেখে না, কিছু জানে না— বই নিয়েই ব'সে আছে।”

 ব্রজবাবু মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করেন, চাকরির কোনরূপ সুবিধা হইতেছে কি না! সুরেন্দ্র সে কথার ভাসা ভাসা উত্তর দেয়। মাধবী পিতার নিকট সে সব শুনিতে পায়, সে-ই কেবল বুঝিতে পারে যে, চাকরির জন্য মাষ্টারবাবুর একতিল উদ্যোগ নাই, ইচ্ছাও নাই! যাহা আপাততঃ পাইয়াছে, তাহাতেই সে পরম সন্তুষ্ট।

 বেলা দশটা বাজিলেই বড়দিদির নিকট হইতে স্নানাহারের তাগিদ আসে। ভাল করিয়া আহার না করিলে বড়দিদির হইয়া প্রমীলা অনুযোগ করিয়া যায়। অধিক রাত্রি পর্য্যন্ত বই লইয়া বসিয়া থাকিলে ভৃত্যেরা গ্যাসের চাবি বন্ধ করিয়া দেয়, বারণ করিলে শুনে না— বলে, “বড়দিদির হুকুম।”

 একদিন মাধবী পিতার কাছে হাসিয়া বলিল, “বাবা, প্রমীলা যেমন, তার মাষ্টারও ঠিক তেমনি।”

 “কেন মা?”

 দু’জনেই ছেলে-মানুষ। প্রমীলা যেমন বোঝে না, তার কখন্‌ কি দরকার, কখন্‌ কি খাইতে হয়, কখন্‌ শুইতে হয়, কখন্‌ কি করা উচিত, তার মাষ্টারও সেই রকম, নিজের কিছুই বোঝে না— অথচ অসময়ে এমনি জিনিষ চাহিয়া বসে যে, জ্ঞান হইলে, তাহা আর কেহ চায় না।”

 ব্রজবাবু বুঝিতে পারিলেন না, মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

 মাধবী হাসিয়া বলিল, “তোমার মেয়েটি বোঝে কখন্‌ তার কি দরকার?”

 “তা’ বোঝে না?”

 “অথচ, অসময়ে উৎপাত করে ত?”

 “তা করে।”

 “মাষ্টারবাবু তাই করে—”

 ব্রজবাবু হাসিয়া বলিলেন, “ছেলেটি বোধ হয়, একটু পাগল।”

 “পাগল নয়। উনি বোধ হয় বড়লোকের ছেলে।”

 ব্রজবাবু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন করিয়া জানিলে?”

 মাধবী জানিত না, কিন্তু এমনি বুঝিত। সুরেন্দ্র যে নিজের একটি কাজও নিজ়ে করিতে পারে না, পরের উপর নির্ভর করিয়া থাকে, পরে করিয়া দিলে হয়, না করিয়া দিলে হয় না— এই অক্ষমতাই তাহাকে মাধবীর নিকটে ধরাইয়া দিয়াছিল। তাহার মনে হইত— এটা তাহার পূর্ব্বের অভ্যাস। বিশেষ এই নূতন ধরনের আহার-প্রণালীটা মাধবীকে আরো চমৎকৃত করিয়া দিয়াছে। কোন খাদ্যদ্রব্যই যে তাহার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারেনা, কিছুই সে তৃপ্তিপূর্বক আহার করে না— কোনটির উপরই স্পৃহা নাই, এই বৃদ্ধের মত বৈরাগ্য, অথচ বালকের ন্যায় সরলতা, পাগলের মত উপেক্ষা— খাইতে দিলে খায়, না দিলে খায় না— এ সকল তাহার নিকট বড় রহস্যময় বোধ হইত; একটা অজ্ঞাত করুণাচক্ষুও, সেই জন্য এই অজ্ঞাত মাষ্টারবাবুর উপর পডিয়াছিল। সে যে লজ্জা করিয়া চাহে না, তাহা নহে, তাহার প্রয়োজন হয় না, তাই সে চাহে না। যখন প্রয়োজন হয়, তখন কিন্তু আর সময়-অসময় থাকে না— একেবারে বড়দিদির নিকট আবেদন আসিয়া উপস্থিত হয়। মাধবী মুখ টিপিয়া হাসে, মনে হয়, এ লোকটি নিতান্ত বালকেরই মত সরল।

———