বড়দিদি/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

 কলিকাতার জনকোলাহলপূর্ণ রাজপথে পড়িয়া সুরেন্দ্রনাথ প্রমাদ গণিল! এখানে তিরস্কার করিবারও কেহ নাই, দিবানিশি শাসনে রাখিতেও কেহ চাহে না! মুখ শুকাইলে কেহ ফিরিয়া দেখে না, মুখ ভারি হইলেও কেহ লক্ষ্য করে না! এখানে নিজেকে নিজে দেখিতে হয়। এখানে ভিক্ষাও জোটে, করুণারও স্থান আছে, আশ্রয়ও মিলে, কিন্তু আপনার চেষ্টা চাই! স্বেচ্ছায় কেহই তোমার মাঝে ঝাঁপাইয়া পড়িবে না।

 খাইবার চেষ্টা যে আপনাকে করিতে হয়, আশ্রয়ের স্থানটুকু যে নিজেকে খুঁজিয়া লইতে হয়, কিংবা নিদ্রা এবং ক্ষুধার মাঝে যে একটু প্রভেদ আছে— এইখানে আসিয়া সে এইবার প্রথম শিক্ষা করিল।

 কতদিন হইল, সে বাড়ি ছাড়িয়াছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইয়া শরীরটাও নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া আসিয়াছে, অর্থও ফুরাইয়া আসিতেছে— বস্ত্রাদি মলিন এবং জীর্ণ হইতে চলিল, রাত্রে শুইয়া থাকিবার স্থানটুকুরও কোন ঠিকানা নাই— সুরেনের চক্ষে জল আসিল। বাটীতে পত্র লিখিতেও ইচ্ছা হয় না— বড় লজ্জা করে! এবং সকলের উপর যখন তাহার বিমাতার সেই স্নেহ-কঠিন মুখখানি মনে পড়ে, তখন বাটী যাইবার ইচ্ছা একেবারে আকাশ-কুসুম হইয়া দাঁড়ায়। সেখানে যে সে কখনও ছিল, এ কথা ভাবিতেও তাহার ভয় হয়।

 একদিন সে তাহারই মত একজন দরিদ্রকে কাছে পাইয়া বলিল, “বাপু, তোমরা এখানে খাও কি করিয়া?”

 লোকটা একরকম বোকা ধরনের— না হইলে উপহাস করিত! সে বলিল, “চাকরি করিয়া খাটিয়া খাই! কলিকাতায় রোজগারের ভাবনা কি?”

 সুরেন্দ্র বলিল, “আমাকে একটা চাকরি করিয়া দিতে পার?”

 সে কহিল, “তুমি কি কাজ জান?”

 সুরেন্দ্রনাথ কোন কাজই জানিত না, তাই সে চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল।

 “তুমি কি ভদ্রলোক?” সুরেন্দ্র মাথা নাড়িল।

 “তবে লেখাপড়া শেখনি কেন?”

 “শিখেছি।”

 সে লোকটা একটু ভাবিয়া বলিল, “তবে ঐ বড় বাড়ীতে যাও। ওখানে বড়লোক জমিদার থাকে— একটা কিছু করিয়া দিবেই।” এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।

 সুরেন্দ্রনাথ ফটকের কাছে আসিল। একবার দাঁড়াইল, আবার পিছাইয়া গেল, আবার ফিরিয়া আসিল— আবার গেল। সেদিন আর কিছু হইল না। পরদিনও ঐরূপ করিয়া কাটিল। দুই দিন ধরিয়া সে ফটকের নিকট উমেদারি করিয়া তৃতীয় দিবসে সাহস সঞ্চয় করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। সম্মুখে একজন ভৃত্য দাঁড়াইয়া ছিল। সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি চান?”

 “বাবুকে—”

 “বাবু বাড়ী নেই।”

 সুরেন্দ্রনাথের বুকখানা আনন্দে ভরিয়া উঠিল— একটা নিতান্ত শক্ত কাজের হাত হইতে সে পরিত্রাণ পাইল। বাবু বাড়ি নাই! চাকরির কথা, দুঃখের কাহিনী বলিতে হইল না, ইহাই তাহার আনন্দের কারণ। তখন দ্বিগুণ উৎসাহে ফিরিয়া গিয়া, দোকানে বসিয়া পেট ভরিয়া খাবার খাইয়া, খানিকক্ষণ সে মনের আনন্দে ঘুরিয়া বেড়াইল, এবং মনে মনে রীতিমত আলোচনা করিতে লাগিল যে, পরদিন কেমন করিয়া কথাবার্তা কহিতে পারিলে তাহার নিশ্চিত একটা কিনারা হইয়া যাইবে।

 পরদিন কিন্তু উৎসাহটা তেমন রহিল না। বাটীর যত নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল, ততই তাহার ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইতে লাগিল। ক্রমে ফটকের নিকট আসিয়া একেবারে সে দমিয়া পড়িল— পা আর কোন মতেই ভিতরে যাইতে চাহে না! আজ তাহার কিছুতেই মনে হইতেছে না যে, সে নিজের কাজের জন্যই নিজে আসিয়াছে– ঠিক মনে হইতেছিল, যেন জোর করিয়া আর কেহ তাহাকে পাঠাইয়া দিয়াছে। কিন্তু দ্বারের কাছে সে আর উমেদারি করিবে না, তাই ভিতরে আসিল। সেই ভৃত্যটার সহিত দেখা হইল। সে বলিল, “বাবু বাড়ি আছেন, দেখা করবেন কি?”

 “হাঁ।”

 “তবে চলুন।”

 এটা আরও কঠিন! জমিদারবাবুর প্রকাণ্ড বাড়ি। রীতিমত সাহেবী ধরনের সাজান আস্‌বাব-পত্র। কক্ষের পর কক্ষ, মারবেল-প্রস্তরের সোপানাবলী, ঝাড়-লণ্ঠন, লাল কাপড়ে ঢাকা প্রতি কক্ষে শোভা পাইতেছে, ভিত্তি-সংলগ্ন প্রকাণ্ড মুকুর— কত ছবি, কত ফটোগ্রাফ্‌। এ সকল অপরের পক্ষে যাহাই হউক, সুরেন্দ্রের নিকট নূতন নহে। কারণ, তাহার পিতার বাটীও দরিদ্রের কুটীর নহে; আর যাহাই হউক, সে দরিদ্র পিতার আশ্রয়ে এত বড় হয় নাই। সুরেন্দ্র ভাবিতেছিল– সেই লোকটির কথা, যাহার সহিত দেখা করিতে, অনুনয়-বিনয় করিতে যাইতেছে,– তিনি কি প্রশ্ন করিবেন, এবং সে কি উত্তর দিবে!

 কিন্তু এত ভাবিবার সময় নাই– কর্ত্তা সম্মুখে বসিয়াছিলেন; সুরেন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করিলেন, “কি প্রয়োজন?”

 আজ তিন দিন ধরিয়া সুরেন্দ্র এই কথাই ভাবিতেছিল, কিন্তু এখন সব ভুলিয়া গেল,— বলিল, “আমি–আমি–”

 ব্রজরাজ লাহিড়ী পূর্ব্ববঙ্গের জমিদার। মাথায় দুই চারিগাছা চুলও পাকিয়াছে–বাতিকে নহে, ঠিক বয়সেই পাকিয়াছিল। বড়লোক, অনেক দেখিয়াছিলেন; তাই চট্‌ করিয়া সুরেন্দ্রনাথকে অনেকটা বুঝিয়া লইলেন, কহিলেন, “হাঁ বাপু, কি চাও তুমি?”

 “কোন একটা–”

 “কি একটা?”

 “চাকরি–।” ব্রজরাজবাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “আমি চাকরি দিতে পারি এ সংবাদ তোমাকে কে দিল?”

 “পথে একজনের সহিত দেখা হইলে, আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সেই আপনার কথা–”

 “ভাল। তোমার বাড়ী কোথায়?”

 “পশ্চিমে।”

 “সেখানে কে আছে?” সুরেন্দ্রনাথ সব কথা বলিল।

 “তোমার পিতা কি করেন?”

 অবস্থাবৈগুণ্যে সুরেন্দ্র নূতন ধাঁচ শিখিয়াছিল— একটু জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল, “সামান্য চাকরি করেন।”

 “তাতে চলে না, তাই তুমি উপার্জ্জন করিতে চাও?”

 “হাঁ।”

 “এখানে কোথায় থাক?”

 “কোন নির্দ্দিষ্ট স্থান নাই— যেখানে সেখানে।”

 ব্রজবাবুর দয়া হইল! সুরেন্দ্রকে কাছে বসাইয়া তিনি বলিলেন, “তুমি এখনও বালক মাত্র। এই বয়সে বাড়ী ছাড়িয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছ বলিয়া দুঃখ হইতেছে। আমি নিজে যদিও কোনও চাকরি করিয়া দিতে পারি না, কিন্তু যাহাতে কিছু যোগাড় হয়, তাহার উপায় করিয়া দিতে পারি।”

 সুরেন্দ্রনাথ “আচ্ছা” বলিয়া চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া, ব্রজবাবু তাহাকে ফিরাইয়া বলিলেন, “আর কিছু তোমার জিজ্ঞাসা করিবার নাই?”

 “না।”

 “ইহাতেই তোমার কাজ হইয়া গেল? কি উপায় করিতে পারি, কবে করিতে পারি— কিছুই জানিবার প্রয়োজন বিবেচনা করিলে না?”

 সুরেন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। ব্রজবাবু সহাস্যে বলিলেন, “এখন কোথায় যাইবে?”

 “কোন একটা দোকানে।”

 “সেইখানেই আহার করিবে?”

 “প্রতিদিন তাহাই করি।”

 “তুমি লেখাপড়া কতদূর শিখিয়াছ?”

 “কিছু শিখিয়াছি।”

 “আমার ছেলেকে পড়াইতে পারিবে?”

 সুরেন্দ্র খুসি হইয়া কহিল, “পারিব।”

 ব্রজবাবু আবার হাসিলেন। তাঁহার মনে হইল, দুঃখে এবং দারিদ্র্যে তাহার মাথার ঠিক নাই! কেন না, কাহাকে শিক্ষা দিতে হইবে, এবং কি শিক্ষা দিতে হইবে, এ কথা না জানিয়াই অতটা আনন্দিত হওয়া তাঁহার নিকটে পাগলামি বলিয়া বোধ হইল। বলিলেন, “যদি সে বলে, আমি বি, এ ক্লাসে পড়ি, তখন তুমি কি করিয়া পড়াইবে?”

 সুরেন্দ্র একটু গম্ভীর হইয়া ভাবিয়া বলিল, “তা এক রকম হইবে–”

 ব্রজবাবু আর কোন কথা বলিলেন না। ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “বঙ্কু, এই বাবুটির থাকিবার জায়গা করিয়া দাও, এবং স্নানাহারের যোগাড় দেখ।” পরে সুরেন্দ্রের পানে চাহিয়া বলিলেন, “সন্ধ্যার পর আবার ডাকাইয়া পাঠাইব— তুমি আমার বাড়ীতেই থাক। যতদিন কোন চাকরির উপায় না হয়, ততদিন স্বচ্ছন্দে এখানে থাকিতে পারিবে।”

 দ্বিপ্রহরে আহার করিতে গিয়া তিনি জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধবীকে ডাকাইয়া কহিলেন, “মা, একজন দুঃখী লোককে বাড়ীতে স্থান দিয়াছি।”

 “কে, বাবা?”

 “দুঃখী লোক, এ ছাড়া আর কিছু জানি না। লেখাপড়া বোধ হয়, কিছু জানে, কেন না, তোমার দাদাকে পড়াইবার কথা বলাতে, তাহাতেই সে স্বীকার করিয়াছিল। বি, এ ক্লাসের ছেলেকে যে পড়াইতে সাহস করিতে পারে, অন্ততঃ তোমার ছোট বোন্‌টিকে সে নিশ্চয় পড়াইতে পারিবে। মনে করিতেছি সে-ই প্রমীলার মাষ্টার থাকুক।”

 মাধবী আপত্তি করিল না।

 সন্ধ্যার পর তাহাকে ডাকিয়া আনাইয়া, ব্রজবাবু তাহাই বলিয়া দিলেন। পরদিন হইতে সুরেন্দ্রনাথ প্রমীলাকে পড়াইতে লাগিল।

 প্রমীলার বয়স সাত বৎসর। সে বোধোদয় পড়ে। বড়দিদি মাধবীর নিকট ফার্ষ্টবুকের ভেকের গল্প পর্যন্ত পড়িয়াছিল। সে খাতাপত্র বই, শ্লেট, পেন্সিল, ছবি, লজেঞ্জেস্‌ প্রভৃতি আনিয়া পড়িতে বসিল।

 Do not move, সুরেন্দ্রনাথ বলিয়া দিল—“Do not move—নড়িও না।”

 প্রমীলা পড়িতে লাগিল, “Do not move—নড়িও না।”

 তাহার পর সুরেন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক হইয়া শ্লেট টানিয়া লইল— পেন্সিল হাতে করিয়া আঁক পাড়িয়া বসিল। প্রব্‌লেমের পর প্রব্‌লেম সল্‌ভ্‌ হইতে লাগিল— ঘড়িতে সাতটার পর আট্‌টা, তারপর নয়টা বাজিতে লাগিল। প্রমীলা কখনও এ পাশ কখনও ও পাশ ফিরিয়া, ছবির পাতা উল্টাইয়া শুইয়া বসিয়া লজেঞ্জেস্‌ মুখে পুরিয়া, নিরীহ ভেকের সর্ব্বাঙ্গ মসীলিপ্ত করিতে করিতে পড়িতে লাগিল, “Do not move– নড়িও না!”

 “মাষ্টার মশাই, বাড়ী যাই?”

 “যাও।”

 সকাল বেলাটা তাহার এইরূপেই কাটে। কিন্তু দুপুরবেলার কাজটা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। চাকুরির যাহাতে উপায় হয়, এ জন্য ব্রজবাবু অনুগ্রহ করিয়া দুই-একজন ভদ্রলোকের নামে খানকতক পত্র দিয়াছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ এইগুলিকে পকেটে করিয়া বাহির হইয়া পড়ে। সন্ধান করিয়া তাহাদের বাড়ির সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়। দেখে, কত বড় বাড়ী, কয়টা জানালা, বাহিরে কতগুলি ঘর, দ্বিতল কি ত্রিতল, সম্মুখে কোন ল্যাম্প-পোষ্ট আছে কি না! তাহার পর সন্ধ্যার পূর্ব্বেই ফিরিয়া আসে।

 কলিকাতায় আসিয়াই সে কতকগুলা পুস্তক ক্রয় করিয়াছিল, বাড়ী হইতেও কতকগুলা লইয়া আসিয়াছিল, এখন সেইগুলা সে গ্যাসের আলোকে অধ্যয়ন করিতে থাকে। ব্রজবাবু কাজকর্ম্মের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, হয় চুপ করিয়া থাকে, না হয়, বলে, ভদ্রলোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ হয় না।

———