বত্রিশ সিংহাসন/২
চিত্ররেখা দ্বিতীয় পুত্তলিকা
বলিল হে রাজন, তুমি এই সিংহাসনােপবেশনের যােগ্য পাত্র নহ। তুমি যেরূপ নীতি-বিরুদ্ধ কর্ম্ম করিতে উদ্যত হইয়াছ এমত কেহ কখন করে না। যিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য সর্ব্ব-গুলিস্কৃত তিনি এই সিংহাসনে বসিবার যােগ্য। রাজা কহিলেন বিক্রমাদিত্যের কি গুণ ছিল। পুত্তলিকা বলিতে লাগিল।
রাজা বিক্রমাদিত্য তাবৎ জম্বুদ্বীপের অধিপতি হইয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন পৃথিবীস্থ প্রজাবর্গ। কি অবস্থায় অবস্থিতি করিতেছে একবার স্বচক্ষে দেখা উচিত, অতএব তিনি দেশ ভ্রমণে প্রবৃত্ত হইলেন। এস্থলে ইহাও কথিত আছে এক যােগী তাহাকে যােগ সাধনের পরামর্শ দিয়া দেশ-ভ্রমণে প্রবৃত্ত করেন। যাহা হউক, রাজা বিক্রমাদিত্য স্বীয় অনুজ ভর্তৃহরির প্রতি রাজ্য সমপর্ণ করিয়া অতুল ঐশ্বর্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক কৌপীন ধারণ ও অঙ্গে ভস্ম লেপন করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।
উজ্জয়িনী নগরে এক ব্রাহ্মণ ক্ষুধা তৃষ্ণা পরিত্যাগ করিয়া ধূমপান পূর্ব্বক বহুকাল ঘােরতর তপস্যা করিতে ছিলেন। তাহাতে উপাস্য দেবতা তাহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাহাকে বর প্রার্থনা করিতে বলিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রথমতঃ বর গ্রহণে অসম্মত হইলেন। পরে দৈববাণী হইল যে, অমৃত গ্রহণ কর। তদনন্তর ঐ দেবতা মনুষ্যাকারে তৎসমীপে আবির্ভূত হইয়া তাহাকে একটী ফল সমপর্ণ পূর্ব্বক বলিলেন ইহা ভক্ষণ করিলে নর অমর হয়। ব্রাহ্মণ ফল পাইয়া পুলকিত-চিত্তে স্বগৃহে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক ব্রাহ্মণীকে ডাকিয়া তাহার হস্তে ঐ ফল প্রদান করিয়া বলিলেন হে ব্রাহ্মণি দেবতা আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া এই ফল দিয়াছেন এবং কহিয়াছেন যে নর ইহা ভক্ষণ করিবে সে অমর হইবেক। বিপ্রকান্তা ইহা শুনিয়া বিলাপ করিতে করিতে কহিলেন পূর্ব্ব জন্মে আমরা কি পাপ করিয়াছিলাম, তাহাতে এজন্মে অন্নাভাবে অস্থি চর্ম্ম সার হইয়াছে, এবং এই অবস্থায় চিরজীবী হইলে কত ক্লেশ ভােগ করিতে হইবে বলাযায় না, এক্ষণে আমাদের চিরজীবী হওয়া অপেক্ষা মরণ মঙ্গল, অতএব এ ফলে আমাদিগের কিছুই প্রয়ােজন নাই, তুমি রাজাকে এই ফল দিয়া তাঁহার নিকট হইতে কিঞ্চিৎ অর্থ লইয়া আইস, তাহা হইলে জঠরজ্বালা নিবারণের উপায় হইবেক।
সহধর্মিণীর এই বাক্য শুনিয়া ব্রাহ্মণ মনে মনে বিবেচনা করিলেন একথা প্রকৃত, আমাদের পক্ষে সংসার কেবল যন্ত্রণা মাত্র হইয়াছে, অতএব এ ফল ভক্ষণ করিয়া চিরজীবী হইলে বিপরীত ফলই হইবে। ইহা ভাবিয়া ব্রাহ্মণ রাজা ভর্তৃহরির সমীপে গমন করিলেন, এবং রাজদ্বারে উপস্থিত হইয়া দ্বারবানকে কহিলেন রাজাকে বল, এক ব্রাহ্মণ এক ফল লইয়া আসিয়াছেন। দ্বারপাল রাজার নিকটে সংবাদ করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণকে সভাতে আনয়ন করিতে অজ্ঞা দিলেন। ব্রাহ্মণ রাজসভায় উপনীত হইয়া ধর্ম্ম লাভ হউক বলিয়া রাজাকে আশীৰ্বাদ করিলেন, এবং রাজার হস্তে ঐ ফল প্রদান করিলেন। রাজা তাহা লইয়া ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন এই ফলের কি গুণ। ব্রাহ্মণ কহিলেন মহারাজ আমি বহুকাল তপস্যা করিয়াছিলাম, দেবতা তুষ্ট হইয়া বর স্বরূপ এই ফল আমাকে দিয়াছেন, ইহার নাম অমর ফল, ইহা ভক্ষণ করিলে যমদণ্ড হইতে নিষ্কতি হয়। কিন্তু আমি চির-দুঃখী, আমার অমর হওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। তুমি লক্ষ লক্ষ জীবের প্রতিপালন করিতেছ, অতএব তােমাকে এই ফল দিলাম, ভক্ষণ করিয়া চিরকাল সুখে রাজ্যভােগ কর এবং চিরকাল প্রজাগণ তােমার অধীনে থাকিয়া সুখভােগ করুক। রাজা ফললাভে অপরিসীম পরিতােষ প্রাপ্ত হইয়া ব্রাহ্মণকে এক লক্ষ মুদ্রা ও একখান গ্রাম পারিতােষিক প্রদান করিয়া বিদায় করিলেন।
রাজা মহিষীকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, সুতরাং স্ত্রৈণ বশতঃ বিবেচনা করিলেন আমি পুরুষ, হঠাৎ দুৰ্বল হইব না, কিন্তু রাজ্ঞী আমার জীবন-সর্ব্ব, তিনি খাইয়া চিরযৌবনা হইলে আমি সুখী হইব। ইহা ভাবিয়া অন্তঃপুরে গমন করিয়া রাণীকে ফল প্রদান করিলেন। রাণী সহাস্য বদনে জিজ্ঞাসিলেন মহারাজ এই ফল এত যত্ন করিয়া আনিয়াছেন, ইহার গুণ কি? রাজা কহিলেন সুন্দরি তুমি যদি এই ফল ভক্ষণ কর তবে সদা যৌবনবতী থাকিবে, আর দিন দিন তােমার রূপ লাবণ্য বৃদ্ধি হইবে, এবং যমের অধিকার হইতে মুক্ত হইবে। রাণী কহিলেন তবে আমি এই ফল ভক্ষণ করিব। তাহা শুনিয়া রাজা রাজসভায় প্রত্যাগমন করিলেন।
নগর পালের সহিত রাণীর প্রসক্তি ছিল, অতএব তিনি তাহাকে ডাকাইয়া তাহার হস্তে ফল দিয়া বলিলেন রাজা আমাকে এই ফল দিয়াছেন, যে ইহা ভক্ষণ করিবে সে অমর হইবেক, অতএব তােমাকে না দিয়া আমি এই ফল ভক্ষণ করিতে পারিনা, কেন না তুমি আমার প্রাণাধিক, তুমি যদি ইহা ভক্ষণ করিয়া অমর হও তবে অতিশয় আহলাদের বিষয়। ইহা শুনিয়া নগরপাল ফল গ্রহণ পূর্ব্বক স্বগৃহে প্রত্যা গমন করিল। এক বেশ্যা নগরপালের উপপত্নী ছিল, নগরপাল তাহাকে ঐ ফল দিয়া কহিল আমি তােমার জন্য অমর ফল আনিয়াছি, তুমি ভক্ষণ কর। এই বাক্যে বারবনিতা তাহার হস্ত হইতে ফল লইয়া তাহাকে বিদায় করিয়া দিল। পরে মনে মনে এই চিন্তা করিতে লাগিল আমি পূর্ব্ব জন্মে কত পাপ করিয়া ছিলাম, তাহাতে বারবধূ হইয়া চিরকাল পাপ কর্ম্মে দিন যাপন করিতেছি, যদি আমি অমর হই তবে আরাে কত কাল কত পাপ করিতে, হইবে। অতএব এই ফল রাজাকে দেওয়াই উচিত, তিনি চিরজীবী হইলে দেশের অতিশয় মঙ্গল হইবে,তাহাতে আমার পুণ্য হইয়া পূর্ব্বকৃত পাপ ধ্বংস হইতে পারিবে, এবং রাজা চিরকাল আমার প্রত্যুপকার স্বীকার করিবেন।
এই কল্পনা করিয়া বারাঙ্গনা রাজসভায় গিয়া রাজার হস্তে ঐ ফল সমপর্ণ করিল। রাজা ফল দর্শনে চমৎকৃত হইয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন আমি এই ফল রাণীকে দিয়াছিলাম, এই বেশ্যা ইহা কিরূপে প্রাপ্ত হইল। কিন্তু মনের কথা ব্যক্ত না করিয়া হাস্থ্য করিতে করিতে বারকান্তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন তােমাকে এ ফল কে দিয়াছে। বারাঙ্গনা কহিল আমি এই ফল নগরপালের নিকট প্রাপ্ত হইয়াছি। ইহা শুনিয়া রাজা তাহাকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিয়া বিদায় করিলেন। পরে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন হায় আমি যে রাণীকে পরম স্নেহাপদ জানিয়া আপন মন সমপর্ণ করিয়াছিলাম তাহার এই চরিত্র, রাণী আমাকে বঞ্চনা করিয়া নগররক্ষকের সহিত প্রণয় করিয়াছে। অতএব এরূপ সংসর্গে অবস্থান অপেক্ষা আমার পক্ষে নির্জন বন প্রয়াণ শ্রেয়স্কর। বারম্বার এই আক্ষেপ করিয়া রাজা বলিতে লাগিলেন আমার বুদ্ধিকে ধিক, আমি যদি আর রাজ্য করি তাহাকেও ধিক্, রাণীকেও ধিক্, কোটালকেও ধিক, বেশ্যাকেও ধিক, কামদেব যিনি এই সংসারের লােককে এরূপ দুর্ম্মতিতে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন সেই কামদেবকেও ধিক।
তদনন্তর ঐ ফুল হস্তে লইয়া রাজা মনে মনে বিচার করিতে লাগিলেন এ সংসারে তাবৎ বস্তুই অচিরস্থায়ী ও ক্ষণভঙ্গর, কালে কালে সকলেই লয় প্রাপ্ত হইবে। জন্ম গ্রহণ মাত্র সকলেই কাল গ্রাসে পতিত হইয়া রাছিয়াছে, এবং পরিণামে কিছুই সঙ্গী হয় না, তথাপি লােকে ভ্রান্তি প্রযুক্ত আমার আমার করিয়া বৃথা কাল ক্ষেপণ করে। এবং সকলেই সুখের ভাগী হইতে চাহে, দুঃখের ভাগী কেহই নহে। এই সংসার সমুদ্ররূপ, মায়া তাহার জল এবং লিসা তাহার মৎস্য, কিন্তু এই মৎস্য ধাৰণার্থ ধীবর কেহই নাই।
এই প্রকার চিন্তায় ব্যাকুলিত হইয়া রাজা ভর্তৃ-হরি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া রাণীকে ক্রোধাভাসে জিজ্ঞাসা করিলেন আমি তােমাকে যে ফল দিয়াছিলাম তাহা কি করিয়াছ। রাণী বলিলেন মহারাজ আমি| তাহা ভক্ষণ করিয়াছি। তখন রাজা তাহাকে ঐ ফল দেখাইলেন। রাণী ভয়ে বিবর্ণা ও কম্পান্বিতা হইলেন। তদনন্তর রাজা ঐ ফল হস্তে অন্তঃপুর হইতে বাহিরে আসিয়া তাহা ধৌত করিয়া আপনি ভক্ষণ করিলেন এবং রাণীর আচরণে মনে মনে অনেক অনুতাপ করিয়া অবশেষে রাজ্যপাঠ ও রাণীর প্রেমশ পরিত্যাগ করিয়া, কাহাকেও কিছু না বলিয়া, অর্থাদি না লইয়া, এক কালে মমতা- 1-শূন্য হইয়া সন্ন্যাসীবেশে বাটীর বাহির হইলেন।
এই সংবাদ দেশে দেশে এবং নগরে নগরে সর্বত্র। প্রচারিত হইল, এবং ক্রমে ক্রমে ইন্দ্রের কর্ণগােচর হইল। তাহাতে তিনি দেবগণের সহিত পরামর্শ করিয়া ভর্তৃহরির রাজ্য-রক্ষার্থ এবং প্রজার প্রতি কেহ অত্যাচার করিতে না পারে এই জন্য এক যক্ষকে প্রেরণ করিলেন। ঐ যক্ষ আসিয়া রাজ্যের প্রহরী স্বরূপ হইয়া থাকিল।
কিয়দিবস পরে রাজা বিক্রমাদিত্য যােগ-সাধন বা দেশ-ভ্রমণ সমাধা হইলে মনে করিলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে রাজ্য দিয়া আসিয়াছি, দেখি গিয়া, তিনি কিরূপ রাজ্য করিতেছেন। এই চিন্তা করিয়া রাত্রিকালে আপন নগরের নিকট উপস্থিত হইলেন। তাহাতে রাজ্য-রক্ষক যক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে এত রাত্রে নগরে যাইতেছ, তােমার নাম বল, নতুবা তােমাকে এখনি শমন-ভবনে প্রেরণ করিব। বিক্রমাদিত্য কহিলেন অমি রাজা বিক্রমাদিত্য, তুই কে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিস। যক্ষ কহিল ভর্তৃহরির রাজ্য রক্ষার্থ দেবরাজ আমাকে এখানে প্রেরণ করিয়াছেন,আমি এই রাজ্যের প্রহরী। রাজা জিজ্ঞাসিলেন ভ্তৃহরির কি হইয়াছে। যক্ষ কহিল কেহ তাহাকে ছলনা করিয়া এখান হইতে লইয়া গিয়াছে। রাজা হাস্য করিয়া কহিলেন তিনি আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা, আমার নাম বিক্রমাদিত্য। যক্ষ বলিল আমি তােমাকে চিনি না, যদি তুমি এ রাজ্যের অধিপতি রাজা বিক্রমাদিত্য হও তবে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমাকে পরাস্ত কর, তাহা হইলে নগরে প্রবেশ করিতে দিব, নতুবা দিব না। রাজা বলিলেন, আমি তােমাকে শঙ্কা করি না, যদি যুদ্ধ করিতে চাহ প্রস্তুত হও।
এই প্রকার উত্তর প্রত্যুত্তরের পর যুদ্ধারম্ভ হইল। রাজা যক্ষকে পরাভব করিয়া তাহার বক্ষঃস্থলে বসিলেন। যক্ষ কহিল রাজন, তুমি বর প্রার্থনা কর, আমি তােমার প্রাণ দান করিতেছি। রাজা এই বাক্যে হাস্য করিয়া বলিলেন আমি তােকে ভূমে নিক্ষেপ করিয়াছি, এবং মনে করিলে এখনি সংহার করিতে পারি, অতএব তুই আমাকে কি রূপে প্রাণ দান দিবি। যক্ষ কহিল তুমি আমাকে পরিত্যাগ কর, আমি যে প্রকারে তােমার প্রাণ রক্ষা করিব তাহা কহিতেছি। এই কথায় রাজা তাহাকে পরিত্যাগ করিলেন। যক্ষ কহিল তাবৎ পৃথিবীতে তােমর প্রতাপ ব্যাপ্ত হইয়াছে, এবং সকল রাজা তােমাকে শঙ্কা করে। কিন্তু তােমার রাজ্যে এক তৈলকার ও এক কুম্ভকার আছে, তাহারা তােমার প্রাণনাশের মন্ত্রণা করিয়াছে। তাহারা দুজন এবং তুমি এই তিনের মধ্যে যে ব্যক্তি দুই জনকে সংহার করিতে পারিবেক সেই ব্যক্তি নিৰ্বিঘে রাজ্য-ভােগ করিবেক। কুম্ভকার যােগী হইয়া অরণ্যে যােগ সাধন করিতেছে। তৈলকার পাতালে রাজ্য করিতেছিল এবং মনে মনে স্থির করিয়াছিল তােমাকে আর যােগীকে বিনাশ করিয়া ত্রিলােকের অধীশ্বর হইবেক। কিন্তু যােগী তাহাকে সংহার করিয়া তাহার শব শিরীষ বৃক্ষে লম্বমান করিয়া রাখিয়াছে। এক্ষণে মনে মনে এই স্থির করিয়াছে তােমাকে নষ্ট করিয়া তৈলকটাহে নিক্ষেপ পূর্ব্বক মহাদেবীর নিকট বলি দিয়া নিশ্চিন্ত রাজ্য ভােগ করিবেক। তুমি এ সকল বৃত্তান্ত কিছুই অবগত নহ, অতএব আমি তােমাকে সতর্ক করিলাম, ইহাতেই তােমাকে প্রাণদান দেওয়া হইল। তুমি এই দুই শত্রু হইতে আপনাকে সতত রক্ষা করি ও। সম্প্রতি তােমাকে আমি এক উপদেশ দিতেছি, ঐ যােগী তােমাকে ছলনাখ নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যাইবেক। নিমন্ত্রণ করিলে তুমি অবশ্যই যাইবে। কিন্তু যখন ঐ যােগী তােমাকে দেবীর সম্মুখে দণ্ডবৎ হইয়া প্রণাম করিতে বলিবেক তখন তুমি তাহা না করিয়া তাহাকে কহিও, আমি পৃথিবীর দণ্ডধর, কাহাকে কখন দণ্ডবৎ প্রণাম করি নাই, অতএব কি প্রকারে দণ্ডবৎ হইয়া প্রণাম করিতে হয় আমাকে দেখাইয়া দাও, আমি সেই প্রকার প্রণাম করিতেছি। ইহাতে যখন ঐ যােগী নতমস্তক হইয়া প্রণাম করিবেক তখন তুমি খজ দ্বারা তাহার মস্তকচ্ছেদন, করিও, আর দেবীর সম্মুখে প্রজ্বলিত অগ্নির উপর যে উত্তপ্ত তৈল-কটাহ আছে তাহাতে ঐ যােগীর শব এবং বৃক্ষ হইতে তৈলকারের শব আনিয়া উভয়কে নিক্ষেপ করিও।
এবংবিধ উপদেশ প্রদান পূর্ব্বকযক্ষ অন্তর্হিত হইল। রাজা আপন ভবনে আসিলেন। রাত্রি প্রভাত হইলে নগরে সংবাদ হইল রাজা বিক্রমাদিত্য স্বদেশে প্রত্যাগত হইয়াছেন। মন্ত্রী প্রভূতি তাবৎ কর্ম্মকারক আনন্দিত হইয়া রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। তাবৎ নগরে ও প্রত্যেক আলয়ে মঙ্গলাচরণ এবং রাজবাটীতে মহােৎসব ও বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল। এইরূপে কিয়ৎকাল অতীত হইলে এক দিবস এক যােগী রাজসভায় উপস্থিত হইয়া রাজাকে আশীৰ্বাদ পর্ব্বক তাহার হস্তে এক ফল প্রদান করিল। রাজা তাহা সহাস্য বদনে গ্রহণ করিলে, যােগী কহিল আমার কুটীরে যজ্ঞ হইতেছে, আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছি। রাজা নিমন্ত্রণ স্বীকার পূর্বক কহিলেন আমি সন্ধ্যার সময় তােমার আলয়ে উপস্থিত হইব, তােমার আশ্রম কোথায় বল। অনন্তর যােগী আপন বাসস্থানের পরিচয় দিয়া প্রস্থান করিল।
দিবাবসানে রাজা কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া খ্ড়গ চর্ম লইয়া একাকী যােগীর যাগ-ভূমিতে গমন করিলেন। যােগী তাহাকে দেখিয়া অভ্যর্থনা করিয়া কহিল মহারাজ দণ্ডবৎ হইয়া দেবীকে প্রণাম করুন। ভূপতি কহিলেন আমি রাজা, কখন কাহাকে দণ্ডবৎ হইয়া প্রণাম করি নাই, অতএব কি প্রকারে দণ্ডবৎ প্রণাম করিতে হয় আমাকে দেখাইয়া দাও। যােগী তাহা দেখাইবার জন্য সাষ্টাঙ্গে ভূমিষ্ঠ হইল। রাজা ঐ সময়ে যক্ষের উপদেশানুসারে খঙ্গ নিষ্কোষিত করিয়া তাহার শিরচ্ছেদন করিলেন। পরে বৃক্ষ হইতে তৈলকারের শব আনয়ন পূর্ব্বক ঐ শব ও যােগীর শব এই উভয়কে উত্তপ্ত-তৈলকটাহে নিক্ষেপ করিলেন। তাহা দেখিয়া দেবী কহিলেন বিক্রমাদিত্য তােমার সাহস ধন্য, এবং তুমি যে মাতা পিতার ঔরসে জন্ম গ্রহণ করিয়াছ তাহারাও ধন্য, আমি তােমার প্রতি প্রসন্ন হইলাম তুমি বর প্রার্থনা কর।
দেবী এই কথা বলিলে পর, তাল ও বেতাল নামে দুই মহাবীর উপস্থিত হইয়া রাজাকে কহিল মহারাজ আমরা আপনকার সেবার্থ আসিয়াছি, আমরা সৰ্বত্রগামী, জল স্থল আকাশ পাতালে বায়ুবেগে গমন করিতে পারি, অতএব যে মনস্কামনা থাকে বলুন, আমরা তাহা পূর্ণ করি। রাজা বলিলেন সম্প্রতি আমার কোন কামনা নাই, যদি তােমরা অঙ্গীকার কর এবং সেই অঙ্গীকার পালন কর, তবে আমি মহাদেবীর নিকট হইতে তােমাদিগকে চাহিয়া লই। তাল বেতাল কহিল যে আজ্ঞা মহারাজ। পরে রাজা দেবীর নিকট এই প্রার্থনা করিলেন যে, এই দুই বীরকে আমাকে দেউন। দেবী তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে দিলেন। পরে রাজা তাহা দিগকে কহিলেন, আমি যখন যে স্থানে তােমাদিগকে স্মরণ করিব তৎক্ষণাৎ তােমরা তথায় উপস্থিত হইও॥ তাল বেতাল কহিল যে আজ্ঞা মহারাজ, আমরা তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হইব। তদনন্তর রাজা। গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন।
চিত্ররেখা বলিল রাজা বিক্রমাদিত্যের এই রূপ সাহস ও এইরূপ কর্ম্ম ছিল, তাল বেতাল উভয়ে তাহার। আজ্ঞাকারী ছিল, এবং রাজা তাহাদিগকে যখন যেখানে স্মরণ করিতেন তখনি সেইখানে তাহারা উপস্থিত হইত। হে ভােজরাজ তুমি কদাচিৎ তাহার তুল্য নহ। যদি কোন ব্যক্তি তাহার ন্যায় কর্ম্ম করে তবেই সে সিংহাসনারূঢ় হইতে পারে। তুমি বলের অহঙ্কার করিওনা, তােমার তুল্য পৃথিবীতে কোটি কোটি মনুষ্য আছে।
এই কথা কহিতে কহিতে সে দিবস গত হইল। অতএব সে দিবসেও সিংহাসনােপবেশন করা হইল না। পর দিবস ভােজরাজ পুনর্ব্বার সিংহাসনারােহণার্থ পদ প্রসারণ করিলে