বত্রিশ সিংহাসন/২৬
বিদ্যাবতী ষড়্বিংশ পুত্তলিকা
কহিল মহারাজ আমি তোমাকে এক জ্ঞানের কথা বলি শ্রবণ কর। মনুষ্য জন্মকালে কিছুই সঙ্গে আনে না, এবং মৃত্যুকালে কোন দ্রব্য তাহার সঙ্গে যায় না। নরদেহ গ্রহণ করিয়া এই সংসারে সৎকর্ম্ম করিলে জীবন সার্থক হয়, এবং যে ব্যক্তি যেমন কর্ম করে সে সেই প্রকার ফলভোগী হয়। পরন্তু মনুষ্যের পরমায়ুঃ অল্প, অতএব ইহার মধ্যে এমত কর্ম্ম করা উচিত, যাহাতে মরণান্তে জগতে জাজ্বল্যমান যশঃ থাকে, ইহলোকে পরলোকে সুখলাভ হয়, আর পুনর্ব্বার মনুষ্যদেহ ধারণ করিতে না হয়। তুমি ইহা নিশ্চয় জানিও, পূর্বজন্মের সুকৃতি ও তপস্যা জন্য ইহজন্মে নরদেহ লাভ হইয়াছে, অতএব দান পরোপকার এবং দেবান করা অবশ্য কর্তৃব্য কর্ম্ম, তদ্ভিন্ন ভববন্ধনমোচনের অন্য কোন উপায় নাই। আমি এইক্ষণেই কহিলাম, মরণকালে কোন দ্রব্য মনুষ্যের সঙ্গে যায়না,এবং সৎকর্ম্ম করিলে চিরকাল নাম থাকে। তাহার প্রমাণ রাজা হরিশ্চন্দ্র, দাতা কর্ণ ও রাজা বিক্রমাদিত্য, বহুকাল হইল ইহার পরলোক গমন করিয়াছেন, মৃত্যুকালে কোন দ্রব্য সঙ্গে লইয়া যান নাই। কিন্তু তাঁহারা সংসারে আসিয়া দান পরোপকার। এবং ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। এই জন্যই তাঁহাদের নাম অদ্যাপি জগতে জাজ্বল্যমান রহিয়াছে, এবং এই জন্যই তাহারা চিরকাল বৈকুণ্ঠবাসী হইয়া রহিয়াছেন সন্দেহ নাই। ভোজরাজ কহিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য কি উত্তম কর্ম্ম করিয়াছিলেন তাহা বর্ণনা কর। বিদ্যাবতী কহিতে লাগিল।
এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য সভায় বসিয়া আছেন এমত সময়ে তাহার এক পরিচারিণী আসিয়া কহিল, মহারাজ পূজার সময় অতীত হইতেছে, আসিয়া পূজা ১৬ করুন। রাজা এই কথা শুনিয়া মনে মনে ভাবিলেন, দাসী যাহা বলিল তাহা যথার্থ, কেননা আমার পর- মায়ুঃ দিন দিন ক্ষয় হইতেছে, এ পর্যন্ত ধর্ম্ম কর্ম্ম ও দেবার্চনা করিতে পারি নাই। এক্ষণে রাজকার্যের মায়া পরিত্যাগ করিয়া যােগ সাধন করি, তাহা হইলে পরমার্থের কর্ম্ম হইবে। মনুষ্যের জীবন প্রভাতের শিশিরের ন্যায়, এই জীবনের ভরসায়। আমি প্রকৃত কর্ম্ম ভুলিয়া আছি।
এই সকল বিবেচনা পূর্ব্বক রাজা রাজ্যপাঠ ধনজন মিথ্যা জ্ঞান করিয়া, তপস্যা জন্য এক অরণ্যে প্রবেশ করিলেন। কিয়দূরে গিয়া দেখিলেন এক স্থানে কতিপয় তপস্বী মণ্ডলাকারে বসিয়া ধ্যানে মগ্ন আছেন, তাহার মধ্যে কেহ উৰ্দ্ধবাহু, কেহ অধঃশিরা, কেহৰ। পঞ্চাগ্নি জ্বলিয়া তপস্যা করিতেছেন। কেহবা আপ- নার শরীরের মাংস কাটিয়া অগ্নিতে আহুতি দিতেছেন। রাজা তাহাদের এই প্রকার তপস্যা দেখিয়া আপনিও তথায় যােগে বসিলেন। কয়েক দিবস অতীত হইলে, তপস্বীগণ অগ্নিতে আপন আপন দেহ আহুতি দিলেন। রাজাও তাহা দেখিয়া স্বীয় শরীর কাটিয়া অগ্নিতে দিতে লাগিলেন, পরিশেষে আপন শিরচ্ছেদন করিয়া অগ্নিতে সমর্পণ করিলেন।
তপস্বীগণ এই প্রকার বিলয় প্রাপ্ত হইলে পর, তত্রস্থ শিবালয় হইতে এক দুত নির্গত হইয়া একে একে সকল তপস্বীর ভস্ম লইয়া স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র রাশি করিল, তাহার পরে মহাদেবের স্থানে তৎসংবাদ কহিলে, তিনি আজ্ঞা করিলেন অমৃত দ্বারা তাহাদের প্রাণদান কর। দূত শিবাজ্ঞায় ভস্মে অমৃত প্রেক্ষণ করিতে লাগিল, তাহাতে সকল তপস্বী ভস্ম হইতে উঠিয়া শিবের ধন্যবাদ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু রাজার ভস্মে অমৃত প্রেক্ষিত হয় নাই, তাহাতে তপস্বীগণ একত্র হইয়া মহাদেবকে স্তুতি পূর্ব্বক বলিলেন, আপনি ভক্তের ঈশ্বর এবং অনাথের নাথ, যাহারা আপনার তপস্যা করিতেছিল তাহাদের জীবন দান করিলেন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে এক নৃপতি তপস্যা করিতে ছিলেন, তাঁহার প্রতি আপনার কি আজ্ঞা হইল। এই কথায় মহাদেব দূতগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। দূতগণ তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিয়া পুনর্ব্বার অমৃত আনয়নপূর্ব্বক রাজার প্রাণ দান করিল। রাজা প্রাণদান পাইয়া তৎক্ষণাৎ গাতলাখানপর্ব্বক করপুটে দণ্ডায়মান হইয়া মহাদেবের স্তুতি করিতে লাগিলেন। হে দেবাদিদেব, হে বিশ্বেশ্বর, আপনি সংসারের তাবৎ জীবের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করিতেছেন, আপনি ভিন্ন এই সংসার সমুদ্র পার হইবার আর কোন উপায় নাই। পৃথিবীতে আসিয়া যে ব্যক্তি আপনাকে জানিতে না পারে তাহার জন্ম গ্রহণ বৃথা। মহাদেব রাজার স্তুতি শুনিলেন। পরে আর আর তপস্বীগণ যে যাহা প্রার্থনা করিল তাহা তাহাকে দিলেন। তাহার বিদায় হইলে, পরমেশ্বর ক্ষিতীশ্বরকে কহিলেন তােমার কি অভিলাষ ব্যক্ত করিয়া বল। রাজা কহিলেন হে ত্রিদিবাধিপতে, আপনার কৃপাতে আমার সকলই আছে, এক্ষণে কেবল। এক প্রার্থনা এই, আমার আর মনুষ্য জন্ম গ্রহণ করিতে হয়। আপনি সকল তপস্বীকে উদ্ধার করিলেন, এই মহাপাপী দীন হীনকে মুক্তি পথ প্রদর্শনপূর্বক পরিত্রাণ করুন।
মহাদেব রাজার এই স্তুতিবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া সহাস্য বদনে কহিলেন তোমার তুল্য মনুষ্য কোন কালে জন্মে নাই। তুমি ধীর, বীর, দাতা, জ্ঞানী ও ধর্ম্মশীল। কলিকালে যে সকল নৃপতি জন্মিয়াছেন তুমি তাহাদের উদ্ধারকর্তা। অতএব আমি তোমাকে আজ্ঞা করিতেছি তুমি এখন গিয়া আনন্দে রাজ্য কর, যখন তোমার অন্তকাল নিকটবর্তী হইবে তখন তুমি আমার স্থানে আসিবে, তৎকালে আমি তোমাকে নির্ব্বাণপদ প্রদান করিব। রাজা বলিলেন হে দেবাধিপতে পৃথিবীতে বাস করিয়া,, আপনকার মহিমা জানা যাইতে পারো, অতএব আমাকে এখনি পরিত্রাণ করুন, নতুবা আমি আপনকার সমক্ষে প্রাণ ত্যাগ করিব। মহাদেব বলিলেন পরমায়ুঃ সত্ত্বে প্রাণত্যাগ করিলে যম তোমাকে সপর্শ করিবেনা, সুতরাং অবশ্য তোমাকে অবশিষ্ট পরমায়ু ভোগ করিতে হইবে। অতএব আমার বাক্য অবহেলন করিওনা, তুমি গাত্রোখানপূর্বক গমন কর। বলিয়া মহাদেব রাজার হস্তে এক কমল অর্পণ করিলেন, আর বলিলেন যখন এই কমল শুষ্ক হইবে তখন তুমি জানিবে তাহার ছয় মাস পরে তোমার মৃত্যু হইবে। এবং তখন তুমি আমার নিকটে আসিও। ইহা বলিয়া মহাদেব কৈলাস ধামে গমন করিলেন।
রাজা পুষ্প লইয়া স্বীয় রাজধানীতে আসিলেন। কয়েক বৎসর পরে ঐ কমল মলিন হইতে লাগিল। তখন রাজা বুঝিলেন ছয় মাস পরে তাহাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইবে। অতএব স্ত্রী পুত্র গণের ভরণ পোষণেপযুক্ত ধন রাখিয়া অবশিষ্ট তাবদ্ধন এবং রাজ্য সম্পত্তি ব্রাহ্মণগণকে উৎসর্গ করিয়া দিলেন। তদনন্তর রাজা সশরীরে স্বর্গে গমন করিলেন।
পুত্তলিকা কহিল, হে ভোজরাজ দেখ রাজা বিক্রমাদিত্য এই সকল কর্ম্ম করিয়াছিলেন, এবং জন্ম মৃত্যু উভয়কে চিনিয়াছিলেন। অতএব তুমি কেন ভান্ত হইতেছ। দেখ, এই পৃথিবীতে কাহারো চিরকাল বাঁচিবার ভরসা নাই, জন্ম মাত্রেই তাহার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু আসিয়াছে। দুঃখ সুখ পাপ পুণ্য সকলি শরীরের সঙ্গী, গুণ অগুণ জ্ঞান অজ্ঞান সর্ব্ব ঘটেই আছে, এবং নিরাকার এক ব্রহ্ম সকল জীরেতেই আছেন। তুমি এ সিংহাসনে বসিবার বাসনা পরিত্যাগ করিয়া, আপনাকে চিরস্মরণীয় করিবার উপায় দেখ। মনুষ্যের কীর্তিই চিরস্মরণীয় হইবার উপায়।
এই সকল কথায় সে দিবসও গত হইল। ভোজরাজ সিংহাসনোপবেশনে নিরাশ হইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। পরদিবস সুর্যোদয় হইলে স্নান অতএব পূজাদি করিয়া পুনর্ব্বার সভায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এবং সভাসদ গণকে বলিলেন এই সকল পুত্তলিকা আমাকে মিথ্যা কথা বলিয়া বঞ্চনা করিতেছে, আমি ইহাদিগের বঞ্চনায় আর ভুলিবনা। ইহা বলিয়া সিংহাসনারোহণার্থ পদ প্রসারণ করিলে