কুর্‌চি

অনেক কাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশন-ঘরের পিছনের দেয়াল-ঘেঁষা এক কুর্‌চি গাছ চোখে পড়ল। সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। চারি দিকে হাট বাজার; এক দিকে রেলের লাইন, অন্য দিকে গোরুর গাড়ির ভিড়, বাতাস ধুলোয় নিবিড়। এমন অজায়গায় পি. ডব্ল্যু. ডি র স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই একটি কুর্‌চি গাছ তার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয়ঘোষণা করছে— উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলের উপরে যাতে ছাড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা। কুর্‌চির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।

ভ্রমর একদা ছিল পদ্মবনপ্রিয়, ছিল প্রীতি কুমুদিনী-পানে।
সহসা বিদেশে আসি, হায়, আজ কি ও কূটজেও বহু বলি মানে!
—সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোকেব অনুবাদ।


কুর্‌চি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
যে ভ্রমর, শুনি নাকি, তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।
আমি সেই ভ্রমরের দলে। তুমি আভিজাত্যহীনা,
নামের গৌরবহারা; শ্বেতভুজা ভারতীর বীণা
তোমারে করে নি অভ্যর্থনা অলংকারঝংকারিত
কাব্যের মন্দিরে। তবু সেথা তব স্থান অবারিত
বিশ্বলক্ষ্মী করেছেন আমন্ত্রণ যে প্রাঙ্গণতলে
প্রসাদচিহ্নিত তাঁর নিত্যকার অতিথির দলে।
আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী। শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে; শুভদৃষ্টি কোনো সুলগনে
ঘটিতে পারে নি তাই, ঔদাস্যের মোহ-আবরণে
রহিলে কুণ্ঠিত হয়ে।

তোমারে দেখেছি সেই কবে
নগরে হাটের ধারে জনতার নিত্যকলরবে,
ইঁট-কাঠ-পাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে। সূর্য-পানে চাহিয়া দাঁড়ালে
সকরুণ অভিমানে; সহসা পড়েছে যেন মনে,
একদিন ছিলে যবে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে
পারিজাতমঞ্জরীর লীলার সঙ্গিনীরূপ ধরি
চিরবসন্তের স্বর্গে, ইন্দ্রাণীর সাজাতে কবরী;
অপ্সরীর মৃত্যলোল মণিবন্ধে কঙ্কণবন্ধনে
পেতে দোল তালে তালে; পূর্ণিমার অমল চন্দনে
মাখা হয়ে নিঃশ্বসিতে চন্দ্রমার বক্ষোহার-’পরে।
অদূরে কঙ্কররুক্ষ লৌহপথে কঠোর ঘর্ঘরে
চলেছে আগ্নেয় রথ, পণ্যরে কম্পিত ধরায়
ঔদ্ধত্য বিস্তারি বেগে; কটাক্ষে কেহ না ফিরে চায়
অর্থমূল্যহীন তোমা-পানে, হে তুমি দেবের প্রিয়া,
স্বর্গের দুলালী। যবে নাটমন্দিরের পথ দিয়া
বেসুর অসুর চলে, সেইক্ষণে তুমি একাকিনী
দক্ষিণবায়ুর ছন্দে বাজায়েছ সুগন্ধকিঙ্কিণী
বসন্তবন্দনানৃত্যে-অবজ্ঞিয়া অন্ধ অবজ্ঞারে,
ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে
হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত
ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজস্র অমৃত
করেছ নিঃশব্দ নিবেদন।

মোর মুগ্ধ চিত্তময়
সেইদিন অকস্মাৎ আমার প্রথম পরিচয়
তোমা-সাথে। অনাদৃত বসন্তের আবাহনগীতে
প্রণমিয়া, উপেক্ষিতা, শুভক্ষণে কৃতজ্ঞ এ চিতে
পদার্পিলে অক্ষয় গৌরবে। সেইক্ষণে জানিলাম,
হে আত্মবিস্মৃত তুমি, ধরাতলে সত্য তব নাম
সকলেই ভুলে গেছে, সে নাম প্রকাশ নাহি পায়
চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থে, পণ্ডিতের পুঁথির পাতায়;
গ্রামের গাথার ছন্দে সে নাম হয় নি আজো লেখা,
গানে পায় নাই সুর। সে নাম কেবল জানে একা
আকাশের সূর্যদেব, তিনি তাঁর আলোকবীণায়
সে নামে ঝংকার দেন, সেই সুর ধূলিরে চিনায়
অপূর্ব ঐশ্বর্য তার; সে সুরে গোপন বার্তা জানি
সন্ধানী বসন্ত হাসে। স্বর্গ হতে চুরি করে আনি
এ ধরা, বেদের মেয়ে, তোরে রাখে কুটির-কানাচে
কটুনামে লুকাইয়া, হঠাৎ পড়িস ধরা পাছে।
পণ্যের কর্কশধ্বনি এ নামে কদর্য আবরণ
রচিয়াছে; তাই তোরে দেবী ভারতীর পদ্মবন
মানে নি স্বজাতি ব’লে, ছন্দ তোরে করে পরিহার-
তা ব’লে হবে কি ক্ষুণ্ন কিছুমাত্র তোর শুচিতার।
সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি—
কুর্‌চি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।

শান্তিনিকেতন
১০ বৈশাখ ১৩৩৪