বনবাণী
সূচীপত্র | ||
ভূমিকা | ৫ | |
বনবাণী | ১১-৫৬ | |
বৃক্ষবন্দনা | ১৩ | |
জগদীশচন্দ্র | ১৬ | |
দেবদারু | ১৯ | |
আম্রবন | ২০ | |
নীলমণিলতা | ২৪ | |
কুরচি | ২৮ | |
শাল | ৩১ | |
মধুমঞ্জরী | ৩৫ | |
নারিকেল | ৩৯ | |
চামেলিবিতান | ৪২ | |
পরদেশী | ৪৭ | |
কুটিরবাসী | ৪৯ | |
হাসির পাথেয় | ৫৪ | |
নটরাজ-ঋতুরঙ্গশালা | ৫৭-১৪০ | |
বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ-উৎসব | ১৪১-১৫২ | |
নবীন | ১৫৩-১৭২ | |
বসন্ত-উৎসব | ১৭৩ | |
গ্রন্থপরিচয় | ১৭৭ | |
প্রথম ছত্রের সূচী | ১৯৫ |
বনবাণী ১৩৩৮ সালের আশ্বিন মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। বনবাণী, নটরাজ-ঋতুরঙ্গশালা, বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ-উৎসব, নবীন- কাব্যখানি এই চারি অংশে বিভক্ত ছিল; বর্তমান সংস্করণের সর্বশেষে ‘বসন্তউৎসব’ নূতন সংযোজিত হইল। মূল পাণ্ডুলিপি, পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন পাঠ এবং প্রথম মুদ্রণ মিলাইয়া বর্তমান মুদ্রণে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও রচনার স্থান কাল -সম্বন্ধীয় তথ্য সংযোজন করা হইল। বনবাণীর বিভিন্ন অংশের রচনা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কতকগুলি তথ্য নিম্নে সংকলিত হইল।
বনবাণী
‘শাল’ কবিতার ভূমিকায় এবং প্রথম স্তবকের শেষভাগে ‘কিশোর কবিবন্ধু’ ও ‘কিশোর বন্ধু’ বলিয়া যাঁহার উল্লেখ আছে, তিনি পরলোকগত কবি সতীশচন্দ্র রায় (বাংলা: মাঘ ১২৮৮-মাঘী পূর্ণিমা ১৩১০)। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য-বিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ইতিহাসের সহিত তাঁহার অচিরায়ু জীবনের ইতিহাস জড়িত, ইহা রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাতেই আভাসিত হইয়াছে।
‘কুটিরবাসী’ কবিতার ভূমিকায় ‘তরুবিলাসী’ ‘তরুণ বন্ধু’ বিশেষণে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক শ্রীতেজেশচন্দ্র সেনকে লক্ষ্য করা হইয়াছে।[১] পাণ্ডুলিপিতে এই কবিতার আরম্ভে অতিরিক্ত তিনটি স্তবক দেখা যায়-
বাসাটি বেঁধে আছ মুক্তদ্বারে
বটের ছায়াটিতে পথের ধারে।
সমুখ দিয়ে যাই- মনেতে ভাবি,
তােমার ঘরে ছিল আমারাে দাবি,
হারায়ে ফেলেছি সে ঘূর্ণিবায়ে
অনেক কাজে আর অনেক দায়ে।
এখানে পথে-চলা পথিকজনা
আপনি এসে বসে অন্যমনা
তাহার বসা সেও চলারই তালে,
তাহার আনাগোনা সহজ চালে।
আসন লঘু তার, অল্প বোঝা-
সোজা সে চলে আসে, যায় সে সোজা।
আমি যে ফাঁদি ভিত বিরাম ভুলি,
চূড়ার ’পরে চূড়া আকাশে তুলি।
আমি যে ভাবনার জটিল জালে
বাঁধিয়া নিতে চাই সুদূর কালে—
সে জালে আপনারে জড়াই ঠেসে,
পথের অধিকার হারাই শেষে।
নটরাজ-ঋতুরঙ্গশালা
‘নটরাজ-ঋতুরঙ্গশালা’ ১৩৩৩ সালে রচিত ও শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রথম অভিনীত হয়। উহাই ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে ‘বিচিত্রা’র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১৩৩৩ সালের অগ্রহায়ণ মাসে শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা কলিকাতায় ইহার পুনরভিনয় হয়; তখন উহার নাম দেওয়া হয় ‘ঋতুরঙ্গ’। অভিনয়পত্রীতে দেখা যায়, ‘বিচিত্রা’য় মুদ্রিত পাঠের উপর অনেক পরিবর্তন করা হইয়াছে, অনেক নূতন রচনা যোগ করা হইয়াছে। প্রধানতঃ সেই পাঠই ১৩৩৪ সালের পৌষ মাসে ‘মাসিক বসুমতী’তে ‘ঋতুরঙ্গ’ নামে মুদ্রিত।
বর্তমান গ্রন্থের পাঠ-প্রণয়ন-কালে কবি ‘বিচিত্রা’ ও ‘মাসিক বসুমতী’ উভয় পত্রিকায় প্রকাশিত দুইটি বিভিন্ন পাঠের নূতন এক সমন্বয় করিয়াছেন, সন্নিবেশক্রমেও বহু পরিবর্তন হইয়াছে।
বিচিত্রায় যে কবিতা ও গীতগুচ্ছ প্রকাশিত হয় তাহার রচনা প্রধানতঃ ১৩৩৩ সালের বসন্তঋতুতে। মাসিক বসুমতীতে প্রকাশকালে যে নূতন রচনাগুচ্ছ যোগ করা হয়, তাহার অধিকাংশই ১৩৩৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসে রচিত। নটরাজ কাব্যের বিভিন্ন রচনার সন্নিবেশে একমাত্র ভাবানুষঙ্গই অনুমৃত হইয়াছে, রচনাকাল দেখা হয় নাই। রচনাগুলির সন্নিবেশক্রম অনুসরণ করিয়া উহাদের রচনার কাল নিয়ে দেওয়া গেল।[২] কতকগুলি রচনার তারিখ জানা যায় নাই।—
মুক্তিতত্ত্ব। খসড়া: ১ চৈত্র [১৩৩৩]
উদ্বোধন। খসড়া: [২-৩ চৈত্র ১৩৩৩]
নৃত্য। মূল কবিতা[৩]: [২১-২৫ ফাল্গুন ১৩৩৩]
বৈশাখ। খসড়া: ১ চৈত্র [১৩৩৩]
বৈশাখ-আবাহন। প্রায় গ্রন্থের পাঠ: ২০ ফাল্গুন ১৩৩৩
কালবৈশাখী। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
মাধুরীর ধ্যান। ২০ ফাল্গুন ১৩৩৩
পরানে কার ধেয়ান আছে জাগি। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
ব্যঞ্জনা। খসড়া: ১ চৈত্র [১৩৩৩]
আষাঢ়। ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
লীলা। ১৫ ফাল্গুন ১৩৩৩
বর্ষামঙ্গল। খসড়া: ১ চৈত্র [১৩৩৩]
যায় রে শ্রাবণকবি। ২ চৈত্র [১৩৩৩]
শেষ মিনতি। মূল গান: ১৪ ফাল্গুন ১৩৩৩
শ্রাবণ সে যায় চলে পান্থ। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
শরৎ। ১ চৈত্র [১৩৩৩]
শাস্তি। প্রায় গ্রন্থের পাঠ: ২ চৈত্র [১৩৩৩]
শরৎ ডাকে ঘর-ছাড়ানো ডাকা। ১৩ অগ্রহায়ণ [১৩৩৪]
শরতের ধ্যান। মূল গান: ১৬ ফাল্গুন ১৩৩৩
শরতের বিদায়। খসড়া: ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
শিউলি ফুল, শিউলি ফুল। [২১-২৫ ফাল্গুন ১৩৩৩]
বিলাপ। বিচিত্রার পাঠ: ১৯ ফাল্গুন ১৩৩৩
পরিবর্তন:[অগ্রহায়ণ ১৩৩৪]
হেমন্তেরে বিভল করে কিসে। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার। ১৭ ফাল্গুন ১৩৩৩
হেমন্ত। [২৯ ফাল্গুন - ১ চৈত্র ১৩৩৩]
দীপালি। [২৫-২৮ ফাল্গুন ১৩৩৩]
শীতের উদ্বোধন। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
আসন্ন শীত। [চৈত্র ১৩৩৩ - ৭ বৈশাখ ১৩৩৪]
শীত। খসড়া: [২৯ ফাল্গুন ১ চৈত্র ১৩৩৩]
সর্বনাশার নিশ্বাসবায়। ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
স্তব। ১৮ ফাল্গুন ১৩৩৩
শীতের বিদায়। খসড়া: [৩-৯ চৈত্র ১৩৩৩]
লুকানো রহে না বিপুল মহিমা। ১৪ অগ্রহায়ণ [১৩৩৪]
আবাহন। ১৮ ফাল্গুন ১৩৩৩
বসন্ত। ২৮ ফাল্গুন ১৩৩৩
বসন্তের বিদায়। ২ চৈত্র [১৩৩৩]
প্রার্থনা। ২০ ফাল্গুন ১৩৩৩
অহৈতুক। ১৯ ফাল্গুন ১৩৩৩
মনের মানুষ। ৩ চৈত্র ১৩৩৩
চঞ্চল। বিভিন্ন খসড়া: ২৭ ফাল্গুন ১৩৩৩
উৎসব। খসড়া: ১৫ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪
শেষের রঙ। ২৯ ফাল্গুন ১৩৩৩
দোল[৪]। ২৮ ফাল্গুন ১৩৩৩
হৃদয় আমার, ঐ বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে
শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে[৫]
শিউলি-ফোটা ফুরালো যেই শীতের বনে
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন
নটরাজ কাব্যের কয়েকটি পাঠান্তর নিম্নে দেওয়া গেল।
। ১। শেষ মিনতি
কেন পান্থ, এ চঞ্চলতা,
শূন্য গগনে পাও কার বারতা।
নয়ন অতন্দ্র প্রতীক্ষারত
কেন উদ্ভ্রান্ত অশান্ত-মত—
কুন্তলপুঞ্জ অযত্নে নত,
ক্লান্ত তড়িৎবধূ তন্দ্রাগতা।
ধৈর্য ধরো, সখা, ধৈর্য ধরো—
দুঃখে মাধুরী হোক মধুরতর—
হেরো গন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর
মল্লিকা চরণতলে প্রণতা।
। ২। বিলাপ
আজি এ নূপুর তব যে পথে বাজিয়ে চল
চিহ্ন কেমনে তার আপনি ঘুচাবে বলল।
অশােকের রেণুগুলি
রাঙাইল যার ধূলি
সেখানে শিশিরে তৃণ করিবে কি ছলােছলে।
পাতা পড়ে, ফুল ঝরে, যায় ফাগুনের বেলা―
দখিনবাতাস যায় শেষ করি শেষ খেলা।
তার মাঝে অমৃত কি
ভরিয়া রহে না সখী।
স্বপনের মালা-সম তারাে স্মৃতি টলােমলাে।
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি
চিহ্ন আজি তারি আপনি ঘুচালে কি।
অশােকরেণুগুলি
রাঙালাে যার ধূলি
তারে যে তৃণতলে আজিকে লীন দেখি?
ফুরায় ফুল ফোটা, পাখিও গান ভােলে
দখিনবাযু সেও উদাসী যায় চলে।
তবু কি ভরি তারে
অমৃত ছিল না রে।
স্মরণ তারাে কি গাে মরণে যাবে ঠেকি।[৬]
প্রজাপতি, আপন ভুলি ফিরিস ওরে
ফুলের দলে দুলি দুলি কিসের ঘরে।
হাওয়ার বুকে যে চঞ্চলের গােপন বাসা
আকাশে তুই বয়ে বেড়াস তারি ভাষা-
অপ্সরী তার ইন্দ্রসভার স্বপ্নগুলি
পাঠালো তোর পাখায় ভরে।
যে গুণী তার কীতিভাঙার খেলা খেলে,
চিকণ রঙের লিখন মুছে হেলায় ফেলে,
সুর বাঁধে আর স্বর সে হারায় পলে পলে,
গানের ধারা ভোলা স্বরের পথে চলে—
ডানাতে তোর পড়ল ঝ'রে।
বৃক্ষরোপণ উৎসব শান্তিনিকেতনে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ৩০ আষাঢ় ১৩৩৫ সালে। শ্রীমতী প্রতিমা ঠাকুরকে কবি এই উৎসবের এইরূপ বর্ণনা দিয়াছিলেন—
এখানে হল বৃক্ষরোপণ, শ্রীনিকেতনে হল হলচালন।. তোমার টবের বকুলগাছটাকে নিয়ে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটা হল। পৃথিবীতে কোনো গাছের এমন সৌভাগ্য কল্পনা করতে পার না। সুন্দরী বালিকার সুপরিচ্ছন্ন হয়ে শাখ বাজাতে বাজাতে, গান গাইতে গাইতে, গাছের সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞক্ষেত্রে এল— শাস্ত্রীমশায় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন —আমি একে একে ছ’টা কবিতা পড়লুম— মালা দিয়ে, চন্দন দিয়ে, ধূপধুনে জালিয়ে তার অভ্যর্থনা হল।. তার পরে বর্ষামঙ্গল গান হল— আমি এই উপলক্ষ্যে ছোটো একটি গল্প[৭] লিখেছিলুম, সেটা পড়লুম। আমার বেশভূষা দেখলে নিশ্চয় খুশি হতে। একটা কালো রেশমের ধুতি, গায়ে লাল আঙিয়া, মাথায় কালে টুপি, কাধে জরি-দেওয়া কালো পাড়ের কেঁচানো লম্বা চাদর। [৯ শ্রাবণ ১৩৩৫]
নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায়। ২৬ শ্রাবণ [ ১৩৩৬]
আয় আমাদের অঙ্গনে। শান্তিনিকেতন ২ শ্রাবণ ১৩৩৬
বক্ষের ধন হে ধরণী, ধরাে। [ জুলাই ১৯২৮ ]
হে মেঘ,ইন্দ্রের ভেরী। [ জুলাই ১৯২৮]
সৃষ্টির প্রথমবাণী তুমি, হে আলােক। [ জুলাই ১৯২৮ ]
হে পবন, কর নাই গৌণ। [ জুলাই ১৯২৮ ]
আকাশ. তােমার সহাস উদার দৃষ্টি। [ জুলাই ১৯২৮ ]
প্রাণের পাথেয় তব পূর্ণ হােক। খসড়া: ১৩ জুলাই ১৯২৮
আহ্বান আসিল মহােৎসবে। শান্তিনিকেতন ১০ শ্রাবণ ১৩৩৬
কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে। শান্তিনিকেতন ১৩ শ্রাবণ ১৩৩৬
ঝড নেবে আয়, আয় রে আমার। শান্তিনিকেতন ৩ শ্রাবণ ১৩৩৬
‘নবীন’ ১৩৩৭ ফান্ধনে রচিত। চৈত্রমাসে কলিকাতায় উহার গীতাভিনয় উপলক্ষে উহা প্রথম পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। বনবাণীতে গ্রহণের সময় কবি অনেকগুলি পুরাতন গান ও তৎপ্রাসঙ্গিক কথাবস্তু বর্জন করিয়া এবং অন্যান্য পরিবর্তন করিয়া উহাকে নূতন আকার দেন। উক্ত প্রথম পাঠ পরপৃষ্ঠা হইতে সংকলিত হইল। কিন্তু, যে গানগুলি বনবাণী গ্রন্থের অন্তর্গত বা কবির অন্য সুপ্রচলিত গ্রন্থে প্রকাশিত, সেগুলির প্রথম ছত্রই কেবল দেওয়া গেল। ‘হৃদয় আমার, ঐ বুঝি তাের বৈশাখী ঝড় আসে’[৮] গানের পাঠান্তর হৃদয় আমার, ঐ বুঝি তাের ফানী ঢেউ আসে’ পুনমুদ্রিত হইল। বেদনা কী ভাষায় রে’ কবিকর্তৃক বনবাণী-সংস্করণে বর্জিত হইলেও, প্রথম প্রকাশিত নবীনের অঙ্গীভূত নবরচিত গান হিসাবে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হইয়াছে।
নবীন
প্রথম পর্ব
বাসন্তী, হে ভুবনমােহিনী
শুনেছ, অলিমালা? ওরা বড় ধিক্কার দিচ্ছে, ঐ ও পাড়ার মন্ত্রের দল- উৎসবে তোমাদের চাপল্য ওদের ভালো লাগছে না। শৈবালপুঞ্জিত গুহাদ্বারে কালো কালো শিলাখণ্ডের মতো তমিস্রগহন গাম্ভীর্যে ওরা নিশ্চল হয়ে ভ্রূকুটি করছে, নির্ঝরিণী ওদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে এই আনন্দময় বিশ্বের আনন্দপ্রবাহ দিকে দিগন্তে বইয়ে দিতে, নাচে গানে কল্লোলে হিল্লোলে কলহাস্যে— চূর্ণ চূর্ণ সূর্যের আলো উদ বেল তরঙ্গভঙ্গের ছন্দে ছন্দে বিকীর্ণ করে দিতে। এই আনন্দআবেগের অন্তরে অন্তরে যে অক্ষয় শৌর্যের অনুপ্রেরণা আছে সেটা ওদের শাস্ত্রবচনের বেড়ার বাইরে দিয়ে চলে গেল। ভয় কোরো না তোমরা; যে রসরাজের নিমন্ত্রণে তোমরা এসেছ, তাঁর প্রসন্নতা যেমন নেমেছে আমাদের নিকুঞ্জে অন্তঃস্মিত গন্ধরাজমুকুলের প্রচ্ছন্ন গন্ধরেণুতে তেমনি নামুক তোমাদের কণ্ঠে কণ্ঠে, তোমাদের দেহলতার নিরুদ্ধ নটনোৎসাহে। সেই যিনি সুরের গুরু তাঁর চরণে তোমাদের নৃত্যের অর্ঘ্য নিবেদন করে দাও।
সুরের গুরু, দাও গাে সুরের দীক্ষা
একটা ফর্মাশ এসেছে বসন্ত-উৎসবে নতুন কিছু চাই- কিন্তু, যাদের রসবেদনা আছে তারা বলছে, আমরা নতুন চাই নে, আমরা চাই নবীনকে। তারা বলে, মাধবী বছরে বছরে সাজ বদলায় না, অশোক পলাশ পুরাতন রঙেই বারে বারে রঙিন। এই চিরপুরাতন ধরণী সেই চিরপুরাতন নবীনের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়া জুড়ন না গেল।’ সেই নবীনের উদ্দেশে তোমাদের গান শুরু করে দাও।
আন্ গাে তােরা কার কী আছে
অশোকবনের রঙমহলে আজ লাল রঙের তানে তানে পঞ্চমরাগে সানাই বাজিয়ে দিলে, কুঞ্জবনের বীথিকায় আজ সৌরভের অবারিত দানসত্র। আমরাও তো শূন্যহাতে আসি নি। দানের জোয়ার যখন লাগে অতল জলে তখন ঘাটে ঘাটে দানের বোঝাই-তরী রসি খুলে দিয়ে ভেসে পড়ে। আমাদের ভরা নৌকো দখিন-হাওয়ায় পাল তুলে সাগর-মুখো হল, সেই কথাটা কণ্ঠ খুলে জানিয়ে দাও।
ফাগুন, তােমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি-যে দান
ভরে দাও একেবারে ভরে দাও, কোথাও কিছু সংকোচ না থাকে। পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া একই কথা। ঝর্নার তার এক প্রান্তে পাওয়া রয়েছে অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে, আর-এক প্রান্তে দেওয়া রয়েছে অতলস্পর্শ সাগরের দিকে— এর মাঝখানে তো কোনো বিচ্ছেদ নেই— অন্তহীন পাওয়া আর অন্তহীন দেওয়ার আবর্তন নিয়ে এই বিশ্ব।
গানের ডালি ভরে দে গাে উষার কোলে
মধুরিমা, দেখো, দেখো, চাঁদের তরণীতে আজ পূর্ণতা পরিপুঞ্জিত। কত দিন ধরে এক তিথি থেকে আর-এক তিথিতে এগিয়ে এগিয়ে আসছে। নন্দনবন থেকে আলোর পারিজাত ভরে নিয়ে এল— কোন্ মাধুরীর মহাশ্বেতা সেই ডালি কোলে নিয়ে বসে আছে; ক্ষণে ক্ষণে রাজহংসের ডানার মতো তার শুভ্র মেঘের বসনপ্রান্ত আকাশে এলিয়ে পড়ছে। আজ ঘুমভাঙা রাতের বাঁশিতে বেহাগের তান লাগল।
নিবিড় অমা-তিমির হতে
দোল লেগেছে এবার। পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝখানে দোল। এক প্রান্তে বিরহ, আর প্রান্তে মিলন, স্পর্শ করে করে দুলছে বিশ্বের হৃদয়। পরিপূর্ণ আর অপূর্ণের মাঝখানে এই দোলন। আলোতে ছায়াতে ঠেকতে ঠেকতে রূপ জাগছে— জীবন থেকে মরণে, মরণ থেকে জীবনে- অন্তর থেকে বাহিরে, আবার বাহির থেকে অন্তরে। এই দোলার তালে না মিলিয়ে চললেই রসভঙ্গ হয়। ও পাড়ার ওরা-যে দরজায় আগল এঁটে বসেই রইল— হিসেবের খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছে। একবার ওদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দোলের ডাক দাও।
ওরে গৃহবাসী, তােরা খােল্ দ্বার খোল্
কিন্তু, পূর্ণিমার চাঁদ-যে ধ্যানস্তিমিতলোচন পুরোহিতের মতো আকাশের বেদীতে বসে উৎসবের মন্ত্র জপ করতে লাগল। দেখাচ্ছে যেন জ্যোৎস্নাসমুদ্রের ঢেউয়ের চূড়ায় ফেনপুঞ্জের মতো— কিন্তু, সে ঢেউ-যে চিত্রার্পিতবৎ স্তব্ধ। এ দিকে আজ বিশ্বের বিচলিত চিত্ত দক্ষিণের হাওয়ায় ভেসে পড়েছে; চঞ্চলের দল মেতেছে বনের শাখায়, পাখির ডানায়; আর, ঐ কি একা অবিচলিত হয়ে থাকবে, নিবাতনিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্। নিজে মাতবে না আর বিশ্বকে মাতাবে, সে কেমন হল। এর একটা যা-হয় জবাব দিয়ে দাও।
কে দেবে, চাঁদ, তােমায় দোলা[৯]
আজ সব ভীরুদের ভয় ভাঙনো চাই। ঐ মাধবীর দ্বিধা-যে ঘোচে না। এ দিকে আকাশে আকাশে প্রগল্ভতা, অথচ ওরা রইল সসংকোচে ছায়ার আড়ালে। ঐ অবগুণ্ঠিতাদের সাহস দাও। বেরিয়ে পড়বার হাওয়া বইল যে- বকুলগুলো রাশি রাশি ঝরতে ঝরতে বলছে, যা হয় তা হোক গে, আমের মুকুল নির্ভয়ে বলে উঠছে, দিয়ে ফেলব একেবারে শেষ পর্যন্ত। যে পথিক আপনাকে বিলিয়ে দেবার জন্যেই পথে বেরিয়েছে তার কাছে আত্মনিবেদনের থালি উপুড় করে দিয়ে তবে তাকে আনতে পারবে নিজের আঙিনায়। কৃপণতা করে সময় বইয়ে দিলে তো চলবে না।
হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি
দেখতে দেখতে ভরসা বেড়ে উঠছে, তাকে পাব না তো কী! যখন দেখা দেয় না তখনো যে সাড়া দেয়। যে পথে চলে সেখানে যে তার চলার রঙ লাগে। যে আড়ালে থাকে তার ফাঁক দিয়ে আসে তার মালার গন্ধ। দুয়ারে অন্ধকারে যদি-বা চুপচাপ থাকে, আঙিনায় হাওয়াতে চলে কানাকানি। পড়তে পারি নে সব অক্ষর, কিন্তু চিঠিখানা মনের ঠিকানায় এসে পৌঁছয়। লুকিয়েই ও ধরা দেবে, এমনিতরো ওর ভাবখানা।
সে কি ভাবে, গােপন রবে লুকিয়ে হৃদয়-কাড়া
এইবার বেড়া ভাঙল, দুর্বার বেগে। অন্ধকারের গুহায় অগোচরে জমে উঠেছিল বন্যার উপক্রমণিকা, হঠাৎ ঝর্না ছুটে বেরোল, পাথর গেল ভেঙে, বাধা গেল ভেসে। “চরম যখন আসেন তখন এক-পা একপা পথ গুনে গুনে আসেন না। একেবারে বজ্রে-শান-দেওয়া বিদ্যুতের মতে, পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের বক্ষ এক আঘাতে বিদীর্ণ করে আসেন।
হৃদয় আমার ঐ বুঝি তাের ফাল্গুনী ঢেউ আসে।
বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে।
তােমার মােহন এল সােহন বেশে,
কুয়াসাভার গেল ভেসে—
এল তােমার সাধনধন উদার আশ্বাসে।
অরণ্যে তাের সুর ছিল না, বাতাস হিমে ভরা।
জীর্ণ পাতায় কীর্ণ কানন, পুষ্পবিহীন ধরা।
এবার জাগ্ রে হতাশ, আয় রে ছুটে
অবসাদের বাঁধন টুটে-
বুঝি এল তােমার পথের সাথি উতল উচ্ছ্বাসে।
উৎসবের সোনার কাঠি তোমাকে ছুঁয়েছে, চোখ খুলেছে। এইবার সময় হল চার দিক দেখে নেবার। আজ দেখতে পাবে, ঐ শিশু হয়ে এসেছে চিরনবীন, কিশলয়ে তার ছেলেখেলা জমাবার জন্যে। দোসর হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিল ঐ সূর্যের আলো; সেও সাজল শিশু, সারাবেলা সে কেবল ঝিকিমিকি করছে। ঐ তার কলপ্রলাপ। ওদের নাচে নাচে মর্মরিত হয়ে উঠল প্রাণগীতিকার প্রথম ধুয়োটি।
ওরা অকারণে চঞ্চল
আবার একবার চেয়ে দেখো- অবজ্ঞায় চোখ ঝাপসা হয়ে থাকে, আজ সেই কুয়াশা যদি কেটে যায় তবে যাকে তুচ্ছ বলে দিনে দিনে এড়িয়ে গেছ তাকে দেখে নাও তার আপন মহিমায়। ঐ দেখো ঐ বনফুল, মহাপথিকের পথের ধারে ও ফোটে, তাঁর পায়ের করুণ স্পর্শে সুন্দর হয়ে ওঠে ওর প্রণতি। সূর্যের আলো ওকে আপন ব’লে চেনে। দখিন-হাওয়া ওকে শুধিয়ে যায়, কেমন আছ। তোমার গানে আজ ওকে গৌরব দিক। এরা যেন কুরুরাজের সভায় শূদ্রার সন্তান বিদুরের মতো, আসন বটে নীচে, কিন্তু সম্মান স্বয়ং ভীষ্মের চেয়ে কম নয়।
আজ দখিন বাতাসে[১০]
কাব্যলোকের আদরিণী সহকারমঞ্জরীকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না। সে আপনাকে তো লুকোতে জানে না। আকাশের হৃদয় সে অধিকার করেছে, মৌমাছির দল বন্দনা করে তার কাছ থেকে অজস্র দক্ষিণা নিয়ে যাচ্ছে। সকলের আগেই উৎসবের সদাব্রতও শুরু করে দিয়েছিল, সকলের শেষ পর্যন্ত ওর আমন্ত্রণ রইল খোলা। কোকিল ওর গুণগান দিনে রাতে আর শেষ করতে পারছে না— তোমরাও তান লাগাও।
ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী[১১]
দীর্ঘ শূন্য পথটাকে এতদিন ঠেকেছিল বড়ো কঠিন, বড়ো নিষ্ঠুর। আজ তাকে প্রণাম। পথিককে সে তো অবশেষে এনে পৌছিয়ে দিলে। তারই সঙ্গে এনে দিলে অসীম সাগরের বাণী। দুর্গম উঠল সেই পথিকের মধ্যে গান গেয়ে। কিন্তু, আনন্দ করতে করতেই চোখে জল আসে-যে। ভুলব কেমন করে যে, যে পথ কাছে নিয়ে আসে সেই পথই দূরে নিয়ে যায়। পথিককে ঘরে আটক করে না। বাঁধন ছিঁড়ে নিজেও বেরিয়ে না পড়লে, ওর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঠেকাব কী করে। আমার ঘর-যে ওর যাওয়া-আসার পথের মাঝখানে; দেখা দেয় যদি-বা, তার পরেই সে দেখা আবার কেড়ে নিয়ে চলে যায়।
মাের পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার করুণ রঙিন পথ
তবু ওকে ক্ষণকালের বাঁধন পরিয়ে দিতে হবে। টুকরো টুকরো সুখের হার গাঁথব- পরাব ওকে মাধুর্যের মুক্তোগুলি। ফাগুনের ভরা সাজি থেকে যা-কিছু ঝরে ঝরে পড়ছে কুড়িয়ে নেব, বনের মর্মর, বকুলের গন্ধ, পলাশের রক্তিমা- আমার বাণীর সূত্রে সব গেঁথে, বেঁধে দেব তার মণিবন্ধে। হয়তো আবার আর-বসন্তেও সেই আমার-দেওয়া ভূষণ প’ড়েই সে আসবে। আমি থাকব না, কিন্তু কী জানি, আমার দানের ভূষণ হয়তো থাকবে ওর দক্ষিণ হাতে।
ফাগুনের নবীন আনন্দে
দ্বিতীয় পর্ব
বেদনা কী ভাষায় রে
মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে।
সে বেদনা সমীরে সমীরে সঞ্চারে,
চঞ্চল বেগে বিশ্বে দিল দোলা।
দিবানিশা আছি নিদ্রাহরা বিরহে,
তব নন্দনবন-অঙ্গন-দ্বারে, মনােমােহন বন্ধু,
আকুল প্রাণে
পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে।
বিদায়দিনের প্রথম হওয়াটা এবার উৎসবের মধ্যে নিশ্বসিত হয়ে এখনো কোকিল ডাকছে, এখনো বকুলবনের সম্বল অজস্র, এখনো আম্রমঞ্জরীর নিমন্ত্রণে মৌমাছিদের আনাগোনা, কিন্তু তবু এই চঞ্চলতার অন্তরে অন্তরে একটা বেদনা শিউরিয়ে উঠল। সভার বীণা বুঝি নীরব হবে, পথের একতারায় এবার সুর বাঁধা হচ্ছে। দূর দিগন্তের নীলিমায় দেখা যায় অশ্রুর আভাস, অবসানের গোধূলিছায়া নামছে।
চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন
হে সুন্দর, যে কবি তোমার অভিনন্দন করতে এসেছিল তার ছুটির দিন এল। তার প্রণাম তুমি নাও। যে গানগুলি এতদিন গ্রহণ করেছ সেই তার আপন গানের বন্ধনেই সে বাঁধা রইল তোমার দ্বারে; তোমার উৎসবলীলায় সে চিরদিন রয়ে গেল তোমার সাথের সাথি। তোমাকে সে তার সুরের রাখী পরিয়েছে; তার চিরপরিচয় তোমার ফুলে ফুলে, তোমার পদপাতকম্পিত শ্যামল শষ্পবীথিকায়।
বসন্তে বসন্তে তােমার কবিরে দাও ডাক
ওর ভয় হয়েছে, সব কথা বলা হল না বুঝি, এ দিকে বসন্তর পালা তো সাঙ্গ হয়ে এল। ওর মল্লিকাবনে এখনি তো পাপড়িগুলি সব পড়বে ঝরে, তখন বাণী পাবে কোথায়। ত্বরা কর্ গো, ত্বরা কর্। বাতাস তপ্ত হয়ে এল, এই বেলা রিক্ত হবার আগে তোর শেষ অঞ্জলি পূর্ণ করে দে; তার পরে আছে করুণ ধূলি, তার আঁচলে সব ঝরা ফুলের বিরাম।
যখন মল্লিকাবনে প্রথম ধরেছে কলি
সুন্দরের বীণার তারে কোমলগান্ধারে মিড় লেগেছে। আকাশের দীর্ঘনিশ্বাস বনে বনে হায়-হায় করে উঠল, পাতা পড়ছে ঝরে ঝরে। বসন্তের ভূমিকায় ঐ পাতাগুলি একদিন শাখায় শাখায় আগমনীর গানে তাল দিয়েছিল, তারাই আজ যাবার পথের ধূলিকে ঢেকে দিল, পায়ে পায়ে প্রণাম করতে লাগল বিদায়পথের পথিককে। নবীনকে সন্ন্যাসীর বেশ পরিয়ে দিলে; বললে, তোমার উদয় সুন্দর, তোমার অস্তও সুন্দর হোক।
ঝরা পাতা গাে, আমি তােমারি দলে
মন থাকে সুপ্ত, তখনো দ্বার থাকে খোলা, সেইখান দিয়ে কার আনাগোনা হয়; উত্তরীয়ের গন্ধ আসে ঘরের মধ্যে, ভুঁইচাঁপা ফুলের ছিন্ন পাপড়িগুলি লুটিয়ে থাকে তার যাওয়ার পথে; তার বীণা থেকে বসন্তবাহারের রেশটুকু কুড়িয়ে নেয় মধুকর গুঞ্জরিত দক্ষিণের হাওয়া; কিন্তু, জানতে পাই নে, সে এসেছিল। জেগে উঠে দেখি, তার আকাশপারের মালা সে পরিয়ে গিয়েছে- কিন্তু এ-যে বিরহের মালা।
কখন্ দিলে পরায়ে
বনবন্ধুর যাবার সময় হল, কিন্তু, হে বনস্পতি শাল, অবসানের দিন থেকে তুমি অবসাদ ঘুচিয়ে দিলে। উৎসবের শেষ বেলাকে তোমার অক্লান্ত মঞ্জরী ঐশ্বর্যে দিল ভরিয়ে। নবীনের শেষ জয়ধ্বনি তোমার বীরকণ্ঠে। সেই ধ্বনি আজ আকাশকে পূর্ণ করল; বিষাদের ম্লানতা দূর করে দিলে। অরণ্যভূমির শেষ আনন্দিত বাণী তুমিই শুনিয়ে দিলে যাবার পথের পথিককে; বললে, ‘পুনর্দর্শনায়।’ তোমার আনন্দের সাহস কঠোর বিচ্ছেদের সমুখে দাঁড়িয়ে।
ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল
দূরের ডাক এসেছে। পথিক, তোমাকে ফেরাবে কে। তোমার আসা আর তোমার যাওয়াকে আজ এক করে দেখাও। যে পথ তোমাকে নিয়ে আসে সেই পথই তোমাকে নিয়ে যায়, আবার সেই পথই ফিরিয়ে আনে। হে চিরনবীন, এই বঙ্কিম পথেই চিরদিন তোমার রথযাত্রা; যখন পিছন ফিরে চলে যাও সেই চলে-যাওয়ার ভঙ্গিটি আবার এসে মেলে সামনের দিকে ফিরে-আসায়, শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই নে- হায়হায় করি।
এখন আমার সময় হল[১২]
বিদায়বেলায় অঞ্জলি যা শূন্য করে দেয় তা পূর্ণ হয় কোন্খানে সেই কথাটা শোনা যাক।
এ বেলা ডাক পড়েছে কোন্খানে[১৩]
আসন্ন বিরহের ভিতর দিয়ে শেষ বারের মতো দেওয়া-নেওয়া হয়ে যাক। তুমি দিয়ে যাও তোমার বাহিরের দান, তোমার উত্তরীয়ের সুগন্ধ, তোমার বাঁশির গান, আর নিয়ে যাও এই অন্তরের বেদনা আমার নীরবতার ডালি থেকে।
তুমি কিছু দিয়ে যাও
খেলা-শুরুও খেলা, খেলা-ভাঙাও খেলা। খেলার আরম্ভে হল বাঁধন, খেলার শেষে হল বাঁধন-খোলা। মরণে বাঁচনে হাতে হাতে ধরে এই খেলার নাচন। এই খেলায় পুরোপুরি যোগ দাও; শুরুর সঙ্গে শেষের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলিয়ে নিয়ে জয়ধ্বনি করে চলে যাও।
আজ খেলা-ভাঙার খেলা খেলবি আয়[১৪]
বাজে করুণ সুরে, হায় দূরে
এই খেলা-ভাঙার খেলা বীরের খেলা। শেষ পর্যস্ত যে ভঙ্গ দিল না তারই জয়। বাঁধন ছিঁড়ে যে চলে যেতে পারল, পথিকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল পথে, তারই জন্যে জয়ের মালা। পিছনে ফিরে ভাঙা খেলনার টুকরো কুডোতে গেল যে কৃপণ তার খেলা পুরো হল না— খেলা তাকে মুক্তি দিল না, খেলা তাকে বেঁধে রাখলে। এবার তবে ধুলোর সঞ্চয় চুকিয়ে দিয়ে হালকা হয়ে বেরিয়ে পড়ো।
বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা[১৫]
এবার প্রলয়ের মধ্যে পূর্ণ হোক্ লীলা; সমে এসে সব তান মিলুক, শান্তি হোক্, মুক্তি হোক্।
ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক[১৬]
৩০ ফাল্গুন ১৩৩৭
- ↑ বনবাণী কাব্যের ভুমিকাটি তেজেশচন্দ্র সেনকে লেখা একখানি পত্রের পরিমার্জিত রূপ। দ্রষ্টব্য: ‘গাছপালার প্রতি ভালোবাসা’, প্রবাসী। বৈশাখ ১৩৩৪।
- ↑ বন্ধনীমধ্যে পরীক্ষপ্রমাণসিদ্ধ সময়ের উল্লেখ করা হইল। ২-৩ তারিখ=২ বা ৩ তারিখ। ২১-২৫ তারিখ =২১ হইতে ২৫ তারিখের অন্তর্বর্তী কোনো সময়।
- ↑ বিচিত্রার পাঠ। নতিবাচক ধুয়া অংশটি নাই।
- ↑ তুলনীয় গান: ওগো কিশোর আজি: গীতবিতান।
- ↑ পুরাতন রচনার নুতন রূপ;সুরও পৃথক।
তুলনীয়: শ্যামল ছায়া, নাই বা গেলে।
অথবা: শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাই বা গেলে।
—গীতবিতান। - ↑ রচনাকালে এবং বিচিত্রায় প্রকাশকালে বসন্তের গীতপর্যায়ে সন্নিবেশিত ছিল।
- ↑ বলাই:গল্পগুচ্ছ তৃতীয় খণ্ড।
- ↑ দ্রষ্টব্য: এই গ্রন্থের পৃ. ৭৪
- ↑ দ্রষ্টব্য; বসন্ত।
- ↑ দ্রষ্টব্য; বসন্ত।
- ↑ দ্রষ্টব্য; প্রবাহিণী বা দ্বিতীয় খণ্ড নবগীতিকা।
- ↑ দ্রষ্টব্য : বসন্ত।
- ↑ দ্রষ্টব্য : বসন্ত।
- ↑ দ্রষ্টব্য : বসন্ত।
- ↑ দ্রষ্টব্য: ফাল্গুনী
- ↑ দ্রষ্টব্য; বসন্ত।
প্রথম ছত্রের সূচী | ||
কবিতা॥ গান॥ শ্লোক | ||
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান | ১৩ | |
আকাশ, তোমার সহাস উদার দৃষ্টি | ১৪৭ | |
আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে | ১৫১ | |
আজি এ নূপুর তব যে পথে বাজিয়ে চল | ১৮১ | |
আন্ গো তোরা কার কী আছে | ১৫৭ | |
আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় | ১৬১ | |
আয় আমাদের অঙ্গনে | ১৪৫ | |
আলোকরসে মাতাল রাতে | ১৩৮ | |
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে | ৯৯ | |
আশ্রমসখা হে শাল, বনস্পতি | ১৭৩ | |
আহ্বান আসিল মহোৎসবে | ১৪৯ | |
এনেছে কবে বিদেশী সখা | ৪৭ | |
এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ | ৭১ | |
ঐ কি এলে আকাশপারে | ৮১ | |
ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম | ১১৪ | |
ওগো সন্ন্যাসী, কী গান ঘনালো মনে | ৮৭ | |
ওরা অকারণে চঞ্চল | ১৬৩ | |
ওরে গৃহবাসী, তোরা খোল্ দ্বার খোল্ | ১৬০ | |
ওরে প্রজাপতি, মায়া দিয়ে কে যে | ১৩৪ | |
কখন দিলে পরায়ে | ১৬৯ | |
কত না দিনের দেখা | ১৩২ | |
কুর্চি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা | ২৮ | |
কেন গো যাবার বেলা | ১০০ | |
কেন ধরে রাখা, ও-যে যাবে চলে | ১৬৬ | |
কেন পান্থ, এ চঞ্চলতা | ৯২,১৮১ | |
কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে | ১৫০ | |
কোন্ বারতার করিল প্রচার | ৮৩ | |
ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল | ১৭০ | |
গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব | ৮৬ | |
গানের ডালি ভরে দে গো উষার কোলে | ১৫৯ | |
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি | ১০২,১৮২ | |
চলে যায়, মরি হায়, বসন্তের দিন | ১৬৬ | |
জানি তুমি ফিরে আসিবে আবার, জানি | ১৩০ | |
ঝড় নেবে আয়, আয় রে আমার | ১৫২ | |
ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে | ১৬৯ | |
ডাকো বৈশাখ, কালবৈশাখী | ৭৫ | |
ডেকেছ আজি, এসেছি সাজি, হে মোর লীলাগুরু | ১১০ | |
তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে | ৮১ | |
তপোমগ্ন হিমাদ্রির ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করি চুপে | ১৯ | |
তব পথচ্ছায়া বাহি বাঁশরিতে যে বাজালো আজি | ২০ | |
তবে শেষ করে দাও শেষ গান | ১৬৭ | |
তুঙ্গ তোমার ধবলশৃঙ্গশিরে | ১২০ | |
তুমি কিছু দিয়ে যাও | ১৭০ | |
তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে, সুপ্ত রাতে | ১৬২ | |
তুমি সুন্দর, যৌবনঘন | ১৫৬ | |
তোমার আসন পাতব কোথায় হে অতিথি | ১২৪ | |
তোমার কুটিরের সমুখবাটে | ৪৯ | |
ধূসরবসন, হে বৈশাখ | ৭২ | |
ধ্যাননিমগ্ন নীরব নগ্ন নিশ্চল তব চিত্ত | ৬৯ | |
ধ্বনিল গগনে আকাশবাণীর বীন | ৯৪ | |
নমো, নমো, করুণাঘন, নমো হে | ৮১ | |
নমো, নমো, নমো। তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য | ১০৩ | |
নমো নমো, নমো নমো। তুমি সুন্দরতম | ১২২ | |
নমো নমো, নমো নমো। নির্দয় অতি করুণা তোমার | ১১৭ | |
নমো, নমো, হে বৈরাগী | ৭২ | |
নিবিড় অমা-তিমির হতে | ১৬০ | |
নির্মল কান্ত, নমো হে নমো | ৯৭ | |
নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর | ১৪৩ | |
নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ | ৬৬ | |
পরানে কার ধেয়ান আছে জাগি | ৭৮ | |
পাগল আজি আগল খোলে বিদায়রজনীতে | ৯৬ | |
প্রজাপতি, আপন ভুলি ফিরিস ওরে | ১৮২ | |
প্রত্যাশী হয়ে ছিনু এতকাল ধরি | ৩৫ | |
প্রাণের পাথেয় তব পূর্ণ হোক, হে শিশু চিরায়ু | ১৪৮ | |
ফাগুন, তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় | ১৫৮ | |
ফাগুনের নবীন আনন্দে | ১৬৫ | |
ফাল্গুনমাধুরী তার চরণের মঞ্জীরে মঞ্জীরে | ২৪ | |
বক্ষের ধন হে ধরণী, ধরো | ১৪৬ | |
বন্ধু, যেদিন ধরণী ছিল ব্যথাহীন বাণীহীন মরু | ১৬ | |
বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক | ১৬৭ | |
বাজে করুণ সুরে হায় দূরে | ১৭১ | |
বাতাসের চলার পথে যে মুকুল পড়ে ঝরে | ১৬৪ | |
বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী | ১৫৫ | |
বাসাটি বেঁধে আছ মুক্তদ্বারে | ১৭৭ | |
বাহিরে যখন ক্ষুব্ধ দক্ষিণের মদির পবন | ৩১ | |
বিদায় দিয়ো মোরে প্রসন্ন আলোকে | ১৬৭ | |
বেদনা কী ভাষায় রে | ১৯০ | |
ভ্রমর একদা ছিল পদ্মবনপ্রিয় | ২৮ | |
মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি | ৭৭ | |
মনে রবে কি না রবে আমারে | ১৩১ | |
মন্দিরার মন্দ্র তব বক্ষে আজি বাজে, নটরাজ | ৬৩ | |
ময়ূর, কর নি মোরে ভয় | ৪২ | |
মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে | ১৪৪ | |
মুক্তিতত্ত্ব শুনতে ফিরিস | ৬১ | |
মুখখানি কর মলিন বিধুর | ১২৯ | |
মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার | ১৬৩ | |
যাত্রাবেলায় রুদ্ররবে | ৯২ | |
যায় রে শ্রাবণকবি রসবর্ষা ক্ষান্ত করি তার | ৯১ | |
যখন মল্লিকাবনে প্রথম ধরেছে কলি | ১৬৮ | |
যেদিন ধরণী ছিল ব্যথাহীন বাণীহীন মরু | ১৬ | |
রঙ লাগালে বনে বনে | ১২৮ | |
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার | ১৩৭ | |
লুকানো রহে না বিপুল মহিমা | ১২২ | |
শরৎ ডাকে ঘর-ছাড়ানো ডাকা | ৯৭ | |
শিউলি ফুল, শিউলি ফুল | ১০১ | |
শিউলি-ফোটা ফুরালো যেই শীতের বনে | ১০৫ | |
শীতের বনে কোন্ সে কঠিন আসবে বলে | ১১৩ | |
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন | ১১৬ | |
শুনিতে কি পাস | ৮০ | |
শ্যামল কোমল চিকন রূপের নবীন শোভা | ১৬২ | |
শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে | ৯০ | |
শ্রাবণ সে যায় চলে পান্থ | ৯৩ | |
সন্ন্যাসী যে জাগিল ঐ, জাগিল ঐ, জাগিল | ১৩৫ | |
সমুদ্রের কূল হতে বহুদূরে শব্দহীন মাঠে | ৪০ | |
সর্বনাশার নিশ্বাসবায় লাগল ভালে | ১১৭ | |
সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা | ১৫৬ | |
সৃষ্টির প্রথম বাণী তুমি, হে আলোক | ১৪৬ | |
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো | ৯৯ | |
সে-যে কাছে এসে চলে গেল, তবু জাগি নি | ১৬৯ | |
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা | ১০৬ | |
হিমগিরি ফেলে নীচে নেমে এলে কিসের জন্য | ১১৯ | |
হিমালয়গিরিপথে চলেছিনু কবে বাল্যকালে | ৫৪ | |
হিমের রাতে ঐ গগনের দীপগুলিরে | ১০৯ | |
হৃদয় আমার, ঐ বুঝি তোর ফাল্গুনী ঢেউ আসে | ১৮৮ | |
হৃদয় আমার, ঐ বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে | ৭৪ | |
হে পবন, কর নাই গৌণ | ১৪৭ | |
হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরণীর ধ্যান-ভরা ধন | ১২৫ | |
হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি | ১৬২ | |
হে মেঘ, ইন্দ্রের ভেরী বাজাও গম্ভীর মন্দ্রস্বনে | ১৪৬ | |
হে সন্ন্যাসী, হিমগিরি ফেলে নীচে নেমে এলে | ১১৯ | |
হে হেমন্তলক্ষ্মী, তব চক্ষু কেন রুক্ষ চুলে ঢাকা | ১০৭ | |
হেমন্তেরে বিভল করে কিসে | ১০৩ |
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।