বনলতা সেন/শিকার
শিকার
ভাের;
আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নােনার গাছ টিয়ার পালকের মতাে সবুজ।
একটি তারা এখন আকাশে রয়েছে:
পাড়াগাঁয়ের বাসরঘরে সব চেয়ে গােধুলি-মদির মেয়েটির মতাে;
কিংবা মিশরের মানসী তার বুকের থেকে যে মুক্তা।
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল
হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি
তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনাে।
হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশােয়ালীরা
সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে—
মােরগ ফুলের মতাে লাল আগুন;
শুকননা অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনাে আগুন জ্বলছে তাদের;
সূর্যের আলােয় তার রঙ কুঙ্কুমের মতাে নেই আর;
হয়ে গেছে রােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে।
সকালের আলােয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ
ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতাে ঝিলমিল করছে।
ভাের;
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতাে অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে
অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে
সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভােরের জন্য অপেক্ষা করছিল
এসেছে সে ভােরের আলােয় নেমে;
কচি বাতাবি লেবুর মতাে সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে;
নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামল—
ঘুমহীন ক্লান্ত বিহুল শরীরটাকে স্রোতের মতাে একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
অন্ধকারের হিম কুঞ্ছিত জরায়ু ছিড়ে ভােরের রৌদ্রের মতাে
একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য;
এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সােনার বর্ষার মতাে জেগে উঠে
সাহসের সাথে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।
একটা অদ্ভুত শব্দ।
নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতাে লাল।
আগুন জ্বলল আবার—উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল।
নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরনাে শিশিরভেজা গল্প
সিগারেটের ধোঁয়া;
টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা;
এলােমেলাে কয়েকটা বন্দুক—হিম—নিঃস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।