বন-ফুল/দ্বিতীয় সর্গ

দ্বিতীয় সর্গ।


যেওনা! যেওনা!


দুয়ারে আঘাত করে কেও পান্থবর?
“কেওগো কুটীরবাসি! দ্বার খুলে দাও আসি।”
তবুও কেনরে কেউ দেয়না উত্তর?
আবার পথিকবর আঘাতিল ধীরে!
“বিপন্ন পথিক আমি, কে আছে কুটীরে?”

তবুও উত্তর নাই, নীরব সকল ঠাই—
তটিনী বহিয়া যায় আপনার মনে!
পাদপ আপন মনে, প্রভাতের সমীরণে
দুলিছে, গাইছে গান সর সর স্বনে!
সমীরে কুটীর শিরে, লতা দুলে ধীরে ধীরে
বিতরিয়া চারিদিকে পুষ্প-পরিমল!
আবার পথিকবর, আঘাতে দুয়ার পর—
ধীরে ধীরে খুলে গেল শিথিল অর্গল।
বিস্ফারিয়া নেত্রদ্বয়, পথিক অবাক রয়
বিস্ময়ে দাঁড়ায়ে আছে ছবির মতন।
কেন পান্থ, কেন পান্থ, মৃগ যেন দিকভ্রান্ত
অথবা দরিদ্র যেন হেরিয়া রতন!
কেনগাে কাহার পানে, দেখিছ বিস্মিত প্রাণে
অতিশয় ধীরে ধীরে পড়িছে নিশ্বাস?
দারুণ শীতের কালে, ঘর্ম্ম বিন্দু ঝরে ভালে
তুষারে করিয়া দৃঢ় বহিছে বাতাস!
ক্রমে ক্রমে হয়ে শান্ত, সুধীরে এগােয় পান্থ
থর থর করি কাঁপে যুগল চরণ—
ধীরে ধীরে তার পরে, সভয়ে সঙ্কোচ ভরে
পথিক অনুচ্চ স্বরে করে সম্বােধন।

“সুন্দরি! সুন্দরি!” হায়! উত্তর নাহিক পায়
আবার ডাকিল ধীরে “সুন্দরি! সুন্দরি!”
শব্দ চারিদিকে ছুটে, প্রতিধ্বনি জাগি উঠে,
কুটীর গম্ভীরে কহে “সুন্দরি! সুন্দরি!”
তবুও উত্তর নাই, নীরব সকল ঠাঁই
এখনো পৃথিবী ধরা নীরবে ঘুমায়!
নীরব পরণশালা, নীরব ষােড়শী বালা
নীরবে সুধীর বায়ু লতারে দুলায়!
পথিক চমকি প্রাণে, দেখিল চৌদিক পানে
কুটীরে ডাকিছে কেও “কমলা! কমলা!”
অবাক হইয়া রহে, অস্ফুটে কে ও গাে কহে?
সুমধুর স্বরে যেন বালকের গলা!
পথিক পাইয়া ভয়, চমকি দাঁড়ায়ে রয়
কুটীরের চারি ভাগে নাই কোন জন!
এখনো অস্ফুটস্বরে, ‘কমলা! কমলা!’ ক’রে
কুটীর আপনি যেন করে সম্ভাষণ!
কে জানে কাহাকে ডাকে,কে জানে কেন বা ডাকে
কেমনে বলিব কেবা ডাকিছে কোথায়?
সহসা পথিকবর, দেখে দণ্ডে করি ভর
‘কমলা! কমলা’ বলি শুক গান গায়!

আবার পথিকবর, হন ধীরে অগ্রসর
সুন্দরি! সুন্দরি বলি ডাকিয়া আবার!
আবার পথিক হায়! উত্তর নাহিক পায়,
বসিল উরুর পরে সঁপি দেহ ভার।
সঙ্কোচ করিয়া কিছু-পান্থবর আগুপিছু
একটু একটু ক’রে হন্ অগ্রসর!
আনমিত করি শিরে, পথিকটি ধীরে ধীরে
বালার নাসার কাছে সঁপিলেন কর।
হস্ত কাঁপে থর থরে, বুক ধুক্ ধুক্ করে
পড়িল অবশ বাহু কপোলর পর;
লোমাঞ্চিত কলেবরে, বিন্দু বিন্দু ঘর্ম্মঝরে
কে জানে পথিক কেন টানি লয় কর!
আবার কেন কি জানি, বালিকার হস্তখানি
লইলেন আপনার করতল পরি—
তবুও বালিকা হায়! চেতনা নাহিক পায়—
অচেতনে শোক জ্বালা রয়েছে পাশরি!
রুক্ষ রুক্ষ কেশ রাশি, বুকের উপরে আসি
থেকে থেকে কাঁপি উঠে নিশ্বাসের ভবে!
বাঁহাত আচল পরে, অবশ রয়েছে পড়ে
এলো কেশ রাশি মাঝে সপি ভান করে

ছাড়ি বালিকার কর, এস্ত উঠে পান্থবর
দ্রুত গতি চলিলেন তটিনীর ধারে,
নদীর শীতল নীরে, ভিজায়ে বসন ধীরে,
ফিরি আইলেন পুনঃ কুটীরের দ্বারে।
বালিকার মুখে চোকে, শীতল সলিল সেকে
সুধীরে বালিকা পুনঃ মেলি নয়ন।
মুদিতা নলিনী কলি, মরম হুতাশে জ্বলি
মূরছি সলিল কোলে পড়িলে যেমন—
সদয়া নিশার মন, হিম সেঁচি সারাক্ষণ
প্রভাতে ফিরায়ে তারে দেয়গো চেতন।
মেলিয়া নয়ন পুটে, বালিকা চমকি উঠে
একদৃষ্টে পথিকেরে করে নিরীক্ষণ
পিতা মাতা ছাড়া কারে, মানুষে দেখেনি হারে
বিস্ময়ে পথিকে তাই করিছে লোকন!
আঁচল গিয়াছে খ’সে, অবাক্ রয়েছে ব’সে
বিস্ফারি পথিক পানে যুগল নয়ন!
দেখেছ কভু কেহ কি, এহেন মধুর আঁখি?
স্বর্গের কোমল জ্যোতি খেলিছে নয়নে
মধুর স্বপনে মাথা, সারল্য প্রতিমা আঁকা
‘কে তুমি গো?’ জিজ্ঞাসিছে যেন প্রতিক্ষণে

পৃথিবী ছাড়া এ আঁখি, স্বর্গের আড়ালে থাকি
পৃথ্বীরে জিজ্ঞাসে ‘কে তুমি? কে তুমি’
মধুর মোহের ভুল, এ মুখের নাই তুল
স্বর্গের বাতাস বহে এ মুখটি চুমি!
পথিকের হৃদে আসি, নাচিছে শোণিত রাশি
অবাক্ হইয়া বসি রয়েছে সেথায়!
চমকি ক্ষণেক পরে, কহিল সুধীর স্বরে,
বিমোহিত পান্থবর কমলা-বালায়!
“সুন্দরি, আমিগো পান্থ, দিকভ্রান্ত, পথশ্রান্ত,
উপস্থিত হইয়াছি বিজন কাননে!
কাল হ’তে ঘুরি ঘুরি, শেষে এ কুটীর পুরী
আজিকার নিশি শেযে পড়িল নয়নে!
বালিকা! কি কব আর, আশ্রয় তোমার দ্বার
পান্থ পথ হারা আমি করিগো প্রার্থনা
জিজ্ঞাসা করিগো শেষে, মৃতে লয়ে ক্রোড়দেশে
কে তুমি কুটীর মাঝে বসি সুধাননা?”
পাগলিনী প্রায় বালা, হৃদয়ে পাইয়া জ্বালা
চমকিয়া বসে যেন জাগিয়া স্বপনে;
পিতার বদন পরে, নয়ন নিবিষ্ট ক’রে
স্থির হ’য়ে বসি রয় ব্যাকুলিত মনে।

নয়নে সলিল ঝরে, বালিকা সমুচ্চ স্বরে।
বিষাদে ব্যাকুল হৃদে কহে “পিতা—পিতা”
কে দিবে উত্তর তোর, প্রতিধ্বনি শোকে ভোর
রোদন করিছে সে ও বিষাদে তাপিতা।
ধরিয়া পিতার গলে, আবার বালিকা বলে
উচ্চৈস্বরে “পিতা-পিতা” উত্তর না পায়।
তরুণী পিতার বুকে, বাহুতে ঢাকিয়া মুখে।
অবিরল নেত্র জলে বক্ষ ভাসি যায়।
শোকানলে জল ঢালা, সাঙ্গ হ’লে উঠে বালা
শূন্য মনে উঠি বসে আঁখি অশ্রুময়!
বসিয়া বালিকা পরে, নিরখি পথিকবরে
সজল নয়ন মুছি ধীরে ধীরে কয়,—
“কে তুমি জিজ্ঞাসা করি, কুটীরে এলে কি করি
আমি যে পিতারে ছাড়া জানিনা কাহারে।
পিতার পৃথিবী এই, কোন দিন কাহাকেই
দেখিনি ত এখানে এ কুটীরের দ্বারে।
কোথাহ’তে তুমি আজ, আইলে পৃথিবীমাঝ?
কি ব’লে তোমারে আমি করি সম্বোধন?
তুমি কি তাহাই হবে, পিতা যাহাদের সবে,
মানুষ বলিয়া আহা করিত রোদন?

কিম্বা জাগি প্রাতঃকালে, যাদের দেবতা বলে
নমস্কার করিতেন জনক আমার?
বলিতেন যার দেশে, মরণ হইলে শেষে
যেতে হয়, সেথাই কি নিবাস তোমার?
নাম তার স্বর্গভূমি, আমারে যেথায় তুমি
ল’য়ে চল দেখি গিয়া পিতায় মাতায়!
ল’য়ে চল দেব তুমি আমারে সেথায়?
যাইব মায়ের কোলে, জননীরে মাতা ব’লে
আবার সেখানে গিয়া ডাকিব তাঁহারে!
দাঁড়ায়ে পিতার কাছে, জলদিব গাছে গাছে
সঁপিব তাঁহার হাতে গাঁথি ফুলহারে।
হাতে লয়ে শুকপাখী, বাবা মোর নাম ডাকি
‘কমলা’ বলিতে আহা শিখাবেন তারে!
লয়ে চল দেব, তুমি সেথায় আমারে!
জননীর মৃত্যু হ’লে, ওই হোথা গাছতলে
রাখিয়াছিলেন তাঁরে জনক তখন!
ধবল তুষার ভার, ঢাকিয়াছে দেহ তাঁর
স্বরগের কুটীরেতে আছেন এখন!
আমিও তাঁহার কাছে করিব গমন!”
বালিকা থামিল সিক্ত হয়ে আঁখিজলে

পথিকেরো আঁখিদ্বয়, হ’ল আহা অশ্রুময়
মুছিয়া পথিক তবে ধীরে ধীরে বলে!
আইস আমার সাথে, স্বর্গরাজ্য পাবে হাতে
দেখিতে পাইবে তথা পিতায় মাতায়।
নিশা হ’ল অবসান, পাখীরা করিছে গান
ধীরে ধীরে বহিতেছে প্রভাতের বায়।
আঁধার ঘোমটা তুলি, প্রকৃতি নয়ন ধুলি
চারিদিক ধীরে যেন করিছে বীক্ষণ—
আলোকে মিশিল তারা, শিশিরের মুক্তাধারা
গাছ পালা পুষ্প লতা করিছে বর্ষণ!
হোথা বরফের রাশি, মৃত দেহ রেখে আসি
হিমানি ক্ষেত্রের মাঝে করায়ে শয়ান,
এই লয়ে যাই চ’লে মুছে ফেল অশ্রুজলে
“অশ্রুবারি ধারে তাহা পূরেছে নয়ান!”
পথিক এতেক কয়ে, মৃত দেহ তুলে লয়ে
হিমানি ক্ষেত্রের মাঝে করিল প্রোথিত।
কুটীরেতে ধীরি ধীরি, আবার আইল ফিরি
কত ভাবে পথিকের চিত্ত আলোড়িত।
ভবিষ্যত কলপনে, কত কি আপন মনে
দেখিছে, হৃদয় পটে আঁকিতেছে কত—

দেখে পূর্ণচন্দ্র হাসে, নিশিরে রজতবাসে
ঢাকিয়া, হৃদয় প্রাণ করি অবারিত—
জাহ্ণবী বহিছে ধীরে, বিমল শীতল নীরে
মাখিয়া রজত রশ্মি গাহি কলকলে—
হরষে কম্পিত কায়, মলয় বহিয়া যায়
কাঁপাইয়া ধীরে ধীরে কুসুমের দলে—
ঘাসের শয্যার পরে, ঈষৎ হেলিয়া পড়ে
শীতল করিছে প্রাণ শীত সমীরণ—
কবরীতে পুষ্পভার, কেও বাম পাশে তার
বিধাতা এমন দিন হবে কি কখন?
অদৃষ্টে কি আছে আহা! বিধাতাই জানে তাহা
যুবক আবার ধীরে কহিল বালায়,—
“কিসের বিলম্ব আর? ত্যজিয়া কুটীর বার।
আইস আমার সাথে কাল বহে যায়!”
তুলিয়া নয়ন দ্বয়, বালিকা সুধীরে কয়,
বিষাদে ব্যাকুল আহা কোমল হৃদয়—
“কুটীর! তোদের সবে, ছাডিয়া যাইতে হবে
পিতার মাতার কোলে লইব আশ্রয়।
হরিণ! সকালে উঠি, কাছেতে আসিত ছুটি
দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে আঁচল চিবায়;

ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি, মুখেতে দিতাম তুলি
তাকায়ে রহিত মোর মুখপানে হায়!
তাদের করিয়া ত্যাগ যাইব কোথায়?
যাইব স্বরগ ভূমে, আহা হা! ত্যজিয়া ঘুমে
এতক্ষণে উঠেছেন জননী আমার—
এতক্ষণে ফুল তুলি, গাঁথিছেন মালাগুলি
শিশিরে ভিজিয়া গেছে আঁচল তাহার—
সেথা ও হরিণ আছে, ফুল ফুটে গাছে গাছে
সেখানেও শুক পাখী ডাকে ধীরে ধীরে!
সেথাও কুটীর আছে, নদী বহে কাছে কাছে
পূর্ণ হয় সবোবর নির্ঝরের নীরে।
আইস! আইস দেব! যাই ধীরে ধীরে!
আয় পাখী! আয় আয়! কার তরে রবি হায়
উড়ে যা উড়ে যা পাখি! তরুর শাখায়!
প্রভাতে কাহারে পাখি! জাগাধিরে ডাকি ২
“কমলা।” “কমলা!” বলি মধুর ভাষায়?
ভুলেযা কমলানামে, চলে যা সুখের ধামে
‘কমলা!’ ‘কমলা!’ ব’লে ডাকিস‍্নে আর।
চলিনু তোদের ছেড়ে, যা শুক শাখায় উড়ে—
চলিনু ছাড়িয়া এই কুটীরের দ্বার।

তবু উড়ে যাবি নেরে, বসিবি হাতের পরে?
আয় তবে, আয় পাখি, সাথে সাথে আয়,
পিতার হাতের পরে আমার নামটি ধ’রে—
আবার,—আবার তুই ডাকিস্ সেথায়।
আইস পথিক তবে কাল ব’হে যায়।”
সমীরণ ধীরে ধীরে, চুম্বিয়া তটিনী নীরে—
দুলাইতে ছিল আহা, লতায় পাতায়—
সহসা থামিল কেন প্রভাতের বায়?
সহসারে জলধর, নব অরুণের কর
কেনরে ঢাকিল শৈল অন্ধকার ক’রে?
পাপীয়া শাখার পরে, ললিত সুধীর স্বরে
তেমনি করনা গান, থামিলি কেনরে?
ভুলিয়া শোকের জ্বালা, ওইরে চলিছে বালা।
কুটীর ডাকিছে যেন ‘যেওনা— যেওনা!—
তটিনী তরঙ্গ কুল, ভিজায়ে গাছের মূল
ধীরে ধীরে বলে যেন ‘যেওনা! যেওনা—’
বনদেবী নেত্র খুলি—পাতার আঙ্গুল তুলি
যেন বলিছেন আহা—‘যেওনা— যেওনা!’—
নেত্র তুলি স্বর্গ পানে, দেখে পিতা মেঘ যানে
হাত নাড়ি বলিছেন ‘যেওনা!— যেওনা—’

বালিকা পাইয়া ভয়—মুদিল নয়ন দ্বয়
এক পা এগোতে আর হয়না বাসনা—
আবার আবার শুন!—কানের কাছেতে পুনঃ
কে কহে অস্ফুট স্বরে ‘যেওনা।— যেওনা—’