বরেন্দ্র রন্ধন/তৃতীয় অধ্যায়



তৃতীয় অধ্যায়।

ভাজি।

 উত্তপ্ত ঘূতে, তৈলে অথবা তদ্বৎ কোনও স্নেহ পদার্থে আনাজ, মৎস্য, মাংসাদি সিদ্ধ করাকে ভাজি বলা যাইতে পারে।

 ভজিতে সাধারণতঃ কোনরূপ ফোড়ণ ব্যবহৃত হয় না। ভাজিবার দ্রব্যটি কেবল নুণ হলুদ দ্বারা মাখিয়া লইয়া ভাজ হইয়া থাকে। তবে “স্থলবিশেষে কাঁচা বা শুক্না লঙ্কা এবং কদাচিৎ কালোজিরা মেথি বা সরিষা ফোড়ণ দেওয়া হইয়া থাকে। যথা শাক ভাজিতে কাঁচা লঙ্কা, কচুর ডাগুর ভাজিতে কাঁচালঙ্কা ও কালোজিরা, কুমড়া ভাজিতে লঙ্কা ও দুটো সরিষা গুঁড়া ফোড়ণ দেওয়া যায়। দুই এক ক্ষেত্রে পেঁয়াজকুচা ফোড়ণ দিতে হয়।

 ভাজিবার দ্রব্যে নুণ হলুদের সহিত একটু চিনি মিশাইয়া ভাজিলে স্বাদ ভাল হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আবার অতিরিক্ত গোলমরিচ বাটা বা লঙ্কা মরিচ বাটা, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা, অম্ল (তেঁতুলাদি) প্রভৃতিও মিশাইতে হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ভাজিবার পর কিছু সরিষা বাটা অথবা তিল-পিঠালী বা পোস্ত-পিঠালী বাটাও মিশাইতে হয়।

 আনাজ বুড়া হইলে একটু উত্তপ্ত জলে ভাপ দিয়া লইয়া ভাজিতে হয়। ফলা-আলু, কোবি প্রভৃতি সিদ্ধ করিয়া লইয়া ভাজাই প্রশস্ত।

 ভাসা তৈলে বা ঘৃতে অথবা অল্প তৈলে বা ঘৃতে উভয়বিধ ভাবেই ভাজা চলে। শেষোক্ত প্রকারে ভজিতে হইলে মধ্যে মধ্যে জলের ছিটা বা আছড়া দিয়া ভাজিতে হইবে। উভয়বিধ ভাজির স্বাদের অবশু তারতম্য হইবে। মুচমুচে করিয়া ভাজিতে ভাসা তৈলে বা ঘৃতে ছাড়িতে হইবে এবং নরম করিয়া ভজিতে হইলে অল্প ঘৃতে বা তৈলে ভাজিবে। আমাদের দেশে তৈল বলিতে সচরাচর সরিষার তৈলই বুঝায়, সুতরাং এতৎ গ্রন্থে ‘তৈল’ শব্দ সরিষার তৈল অর্থেই সর্ব্বত্র ব্যবহৃত হইয়াছে। যেখানে অপর বিধ তৈল ব্যবহৃত হইবে সেখানে তাহার নাম বিশেষ ভাবে লিখিত হইবে। ঘৃত বা তৈলউপযুক্ত ভাবে উত্তপ্ত না হইলে তাহাতে আনাজ মৎস্যাদি ভাজা কর্ত্তব্য নহে। তৈলাদি কাঁচা থাকিলে ভর্জ্জিত দ্রব্য জড়াইয়া বা ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং তৈল-প্যাচ-পেচে হইবে। আবার ঘৃত বা তৈল অধিক উত্তপ্ত হইলে তাহাতে ভজিবার দ্রব্য ছাড়িলে তাতিয়া বা জ্বলিয়া যাইতে পরে। সাধারণতঃ ঘৃত বা তৈলের গাঁজা মরিয়া ধোঁয়া বাহির হইতে আরম্ভ হইলেই তাহা ভজিবার পক্ষে উপযুক্ত হইয়াছে বুঝিতে হইবে। ঘৃত অপেক্ষা তৈল বিলম্বে তাতে।

 মটরের ডাইল বাটা, মাষকলাইর ডাইল বাটা, বুটের বেশম, তিল-পিটালী বাটা, পোস্তদানা-পিটালী বাট,মসিনা-পিটালী বাট, সরিষা বাটা, ময়দা প্রভৃতির আবরণে কোনও কোনও আনাজ পাট পাট করিয়া কুটিয়া ভাজিলে তাহার স্বাদ বেশ চমৎকার হইয়া থাকে। এবং ময়দা সুজী (এবং বৈদেশিক রন্ধনে ব্রেডক্রাম্ব) প্রভৃতির আবরণে মৎস্য মাংসাদি ভাজিলে তাহা অতি সুস্বাদু হইয়া থাকে। উপরে একটা আবরণ থাকা প্রযুক্ত ভর্জ্জিত দ্রব্যের রস শুষ্ক হইতে না পারিয়া তাহা সরস, কোমল ও সুস্বাদু হইয়া থাকে।

৩১ আলু ভাজি

(ক) ফলা-আলু ভাজি

 (১) আলু (খোসা সমেত) দুই ফাঁক বা বড় হইলে চারি ফাঁক করিয়া কুট। জলে সিদ্ধ কর। নুণ হলুদ ও একটু চিনি মাখিয়া ভাসা তৈলে বা ঘৃতে ভাজ। রুচী অনুসারে ইহার সহিত মরিচ গুঁড়া ও শলুপ শাকের কুচি মিশাইয়া ভাজিতে পার।

 লাল আলু এই প্রকারে ভাজিতে পার।

 (২) আলু সিদ্ধ করিয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুট। নুণ ও কিছু মরিচের গুঁড়া মাখিয়া ভাজ। ইহা দ্বারা ‘সিঙ্গাড়ার’ পুর হয়।

 (৩) আলু খোসা সমেত সিদ্ধ করিয়া লও। পরে খোসা ছাড়াইয়া গোটা বা বড় আলু হইলে দুই বা তিন খণ্ডে কুটিয়া লইয়া নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা বা মরিচ বাটা, কিঞ্চিৎ অম্ল যথা—নেবুর রস, তেতুল গোলা, দধি প্রভৃতি এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ পেঁয়াজ বাটা ও ঈষৎ আদা বাটা মাখ। অল্প ঘৃত শুক্‌না শুক্‌না করিয়া ভাজ। ইহাকে সচরাচর ‘আলুর দম’ কহে।

(খ) পাট-আলু ভাজি

 (১) আলুর খোসা ছাড়াইয়া পাৎলা পাৎলা চাকা বা পাট পাট করিয়া অথবা খরিকার আকারে মিহি করিয়া কুট। নুণ হলুদ মাখিয়া ভাসা ঘৃতে বা তৈলে মুচমুচে করিয়া ভাজ। ঘৃত বা তৈল কাঁচা থাকিলে আলু ছাড়িলে জড়াইয়া যাইবে।

 আনাজী কলা, মান, কুঁড়ী-কচু, লাল আলু প্রভৃতি এই প্রকারে পাট পাট বা মিহি করিয়া কুটিয়া ভাসা তৈলে বা ঘৃতে মুচমুচে করিয়া ভাজিবে।

 (২) অপেক্ষাকৃত পুরু পুরু পাট বা কুচো করিয়া কুটিয়া নুণ হলুদ ও একটু চিনি মাখিয়া অল্প তৈলে বা ঘৃতে জলের ছিটা মারিয়া মোলায়েম করিয়া ভাজ। রুচি অনুসারে হলুদের বদলে মরিচ গুঁড়া এবং শলুপশাক কুচি মিশাইতে পার।

 লুচী, পরোটা প্রভৃতির সহিত আলু এই প্রকারে ভাজিয়া খাইতে ভাল লোগে।

 (৩) বরেন্দ্রের লাল্‌চে আলু ভাজি—বরেন্দ্রের ছোট ছোট লাল্‌চে আলু (যাহার ডাক নাম নওগেঁয়ে আলু) দুই চারি ফাঁক করিয়া কুটিয়া নুণ, হলুদ ও কিঞ্চিৎ চিনি মাখিয়া অল্প তৈলে লঙ্কা, মেথি বা কালিজিরা ফোড়ণ দিয়া বা অমনি জল আছড়া দিয়া নরম করিয়া ভাজিবে। ইহাকে ছেঁচকীও বলিতে পার। এই আলুতে শ্বেতসারের (starch) ভাগ কম আছে এবং glutenএর ভাগ বেশী আছে বলিয়া ইহা লাল দেখায়।

৩১। আলুর বড়া ভাজি

 (ক) আলু সিদ্ধ করিয়া ছানিয়া লও। নুণ মরিচের গুঁড়া বা লঙ্কা বাটা এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ দুটো কালিজিরা বা মৌরী গুঁড়া মিশাও। কিছু চাউলের গুঁড়া ও কিছু ঘৃত (ময়ান) মিশাও। ঈষৎ জল মিশাইয়া আবশ্যক মত পাৎলা করিয়া লইয়া উত্তমরূপে ফেটাও। ভাসা তৈলে বড়া ভাজ।

 ওল, মান, লাল আলু, কুঁড়ি কচু, আনাজী কলা, খই প্রভৃতির এই প্রকারে বড় ভাজিবে।

 (খ) আলুর মাফিন (বৈদেশিক)—আলু সিদ্ধ করিয়া খোসা ছাড়াইয়া উত্তম রূপে চটকাইয়া লও। নুণ, মরিচ গুঁড়া বা লঙ্কা বাটা মিশাও। গোলাকার, ডিম্বাকার বা টিকলী প্রভৃতির আকারে গড়িয়া ময়দা বা সুজীর (কাট-খেলায় তা’ দেওয়া) অথবা ব্রেডক্রাম্বের উপর গড়াইয়া লইয়া তৈরে করিয়া ঘৃতে ভাজ। সিদ্ধ আলুতে যথেষ্ট আটা না থাকিলে ডিমের হরিদ্রাংশ মিশাইয়া লইয়া পরে গোল প্রভৃতি আকারে গড়িবে। ডুমুর, ইঁচড়, বাঁধা কোবি প্রভৃতির ‘মাফিন’ এই প্রকারে ভাজিবে। তাহাদের আটা বাঁধিবার জন্য ডিমের হরিদ্রাংশের সহিত কিছু ময়দা মিশাল দিতে হইবে।

৩২। বেগুণ ভাজি

 বেগুণেরঙ্গবিশিষ্ট বিচিশূন্য বৃহদাকার নূতন বেগুণই ভাজিবার যোগ্য। ‘শলিয়া’ বেগুণেও ভাজা মন্দ হয় না। বেগুণ চাকা চাকা, ফলা ফলা বা ডুমা ডুমা আকারে কুটিয়া নুণ হলুদ ও একটু চিনি মাখিয়া ভাসা তেলে বা ঘৃতে বেশ মোলায়েম করিয়া ভাজ।

 বোঁটাব দিকে বাধাইয়া রাখিয়া দুই বা চারি খণ্ড করিয়া চিরিয়া নুণ হলুদ ও একটু চিনি মাখিয়া ব্যাপারাদিতে লুচীর সহিত খাইবার জন্য বেগুণ ভাজা হইয়া থাকে।

 পাজের ফুল্কার (কলি) সহিত বেগুণ ভাজা যায়। বিবিধ শাকের সহিত বেগুণ ভাজা হয়। ফাল্গুন চৈত্র মাসে বেগুণ বুড়া হইলে এবং নূতন নিমপাতা বাহির হইলে তৎসহ ভাজা যায়। নূতন করিলার সহিতও এই প্রকারে ভাজিয়া খাইতে পার।

৩৩। বেগুণের বড়া

 বেগুণ পোড়াইয়া উত্তমরূপে ছানিয়া লও। নুণ লঙ্কা বাটা ও একটু চিনি মিশাও। দুই ভাগ বেগুণের সহিত একভাগ চাউলের গুঁড়া (সফেদা) মিশাইয়া এবং তাহাতে একটু তৈল ময়ান দিয়া উত্তমরূপে ফেনাও। ভাসা, তৈলে বড়ভাজ।

৩৪। পটোল ভাজি

 (ক) কচি পটোলের গায়ের সব্‌জা বটি দিয়া চাঁছিয়া উঠাইয়া ফেলিয়া দুই ফাঁক করিয়া কুট। অথবা পটোল একটু বড় হইলে পুনঃ তাহার মধ্যে তেড়চা ভাবে ভোট দিয়া চারি খণ্ড করিয়া লও। নুণ হলুদ ও একটু মিষ্ট মাখিয়া ভাসা ঘৃতে বা তৈলে ভাজ।

 (খ) অল্প তেলে বা ঘৃতে জলের ছিটা দিয়া মোলায়েম করিয়া পটোল ভাজিবে।

 ঝিঙ্গা, ধুমা, চিচিঙ্গা, কাকরী প্রভৃতির গায়ের সব্‌জা এই ভাবে তুলিয়া ফেলিয়া চাকা চাকা করিয়া কুটিয়া ভাসা বা অল্প তেলে ভাজিবে।

 কচি ঢেঁরস গোটা রাখিয়া গায়ের সব্‌জা তুলিয়া ফেলিয়া ভাজিবে।

৩৫। করিলা (উচ্ছে) ভাজি

 করিলা (উচ্ছে) ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া ভাসা বা অল্প তেলে ভাজিবে। অল্প তেলে নরম করিয়া ভাজিতে হইলে ঈষৎ পুরু পুরু করিয়া কুটিবে।

 করলা, শিম, কাঁকরোল, নারিকেল, ডুমুর কাঁটাগর প্রভৃতি এই প্রকারে ভজিবে। ডুমুর একটু ভাপ দিয়া লইবে।

৩৬। পল্‌তার বড়া ভাজি

 মসূর অথবা মটরের ডাইল ভিজাইয়া রাখিয়া গোটাকয়েক পল্‌তা পাতার সহিত একত্রে বাটিয়া লও। একটু নুণ মিশাইয়া ফেনাইয়া ভাসা ঘৃতে বা তৈলে বড়া ভাজ। ইহা রোগীর পথ্যরূপে ব্যবহৃত হয়।

৩৭। নারিকেলের বড়া ভাজি

 উত্তম ঝুনা নারিকেলের শাঁস ‘বিড়ালী’ বা ‘কোড়নার’ দ্বারা কুড়িয়া উঠাইয়া ভিজান আতপ চাউলের সহিত একত্রে বাট। দুই ভাগ নারিকেল কুড়ার সহিত এক ভাগ চাউল মিশাইবে। একটু নুণ ও মিষ্ট মিশাইয়া ফেনাইয়া ভাসা তৈলে বা ঘৃতে বড়া ভাজ। এতৎসহ একটু হলুদ ও দুটো মৌরী-গুঁড়া মিশাইতে পার।

৩৮। ফুলকোবি ভাজি

 হালি আনাজ ফুলকোবি ডালে ডালে কাটিয়া নুণ, হলুদ অথবা গোলমরিচ গুঁড়া ও একটু মিষ্ট দিয়া মাখিয়া অল্প ঘৃতে বা তেলে ভাজিবে। কোবি বুড়া হইলে পুর্ব্বে একটু ভাপ দিয়া লইবে।

 সালগম, ওলকোবি, গাজর, স্কোয়াস প্রভৃতি এই ভাবে ভাজিবে।

৩৯। ছাঁচি কুমড়া ভাজি

 কচি ছাঁচি কুমড়া ডুম ডুমা করিয়া কুট। নুণ হলুদ ও একটু মিষ্ট মাখিয়া অল্প তেলে ভাজ। লঙ্কা, মেথি অথবা দুটো সরিষা ফোড়ন দিয়াও ভাজিতে পার।

 শশা, কাঁচা তরমুজ, কাঁচা ফুটি, কাঁচা পেঁপে প্রভৃতি এই প্রকারে ভাজিবে।

৪০। মিঠা (বিলাতী) কুমড়া ভাজি

 কুমড়া ডুমা ডুমা করিয়া কুট। নুণ হলুদ মাখ। তৈলে লঙ্কা ও কালজিরা ফোড়ন দিয়া ছাড়। ভাজা হইলে একটু চিনি দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

৪১। ওলের ডাগুর (ডেগো) ভাজি

 বর্ষাকালে নূতন পাতা মেলিবার পূর্ব্বে ওলের যে মাইঝ ডাগুর বাহির হয় তাহাই ভাজিতে হয়। ডাগুরের উপরের ছাল ছুলিয়া ফেলিয়া সরু সরু করিয়া কুটিয়া ভাপ দিয়া লও। তেলে লঙ্কা ও কালজিরা ফোড়ন দিয়া ডাগুর ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ ও চিনি দাও। নাড়িয়া নসনসে গোছ করিয়া ভাজিয়া নামাও। খামা কচুর ডাগুর এই প্রকারে ভাজিবে।

৪২। সজিনা-শুটী ভাজি

 কচি সজিনা শুটীর গায়ের আঁশ তুলিয়া ফেলিয়া চারি আঙ্গুল পরিমিত লম্বা করিয়া কুটিয়া লও। একটু ভাপ দিয়া লও। তৈলে লঙ্কা ও সরিষার গুঁড়া ফোড়ন দিয়া শুটী ছাড়। আংসাও। নুন হলুদ দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

৪৩। সজিনা ফুল ভাজি

 ফুল একটু ভাপ দিয়া জল গালিয়া লও। বেগুণ ডুমাডুমা করিয়া কুট। তৈলে শুক্না লঙ্কা ও সরিষার গুঁড়া ফোড়ন দিয়া শাক বেগুণ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

৪৪। মটর শাক ভাজি

 লকলকে দেখিয়া মটর শাক বাছিয়া লও। তৈলে শুধু কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়া শাক ছাড়। আংসাও। নুণ, হলুদ ও একটু চিনি দিয়া ঢাকিয়া দাও। ইহাতে শাক নরম হইবে, না হইলে একটু জল দিয়া সিদ্ধ করিয়া শুকাইয়া নামাইবে। শাক অধিক ভাজিলে চিমড়া হইয়া যায় এবং তাহার রঙ্গ ও খারাপ হইয়া যায়। এই শাকের সহিত কচি বেগুণ ছোট ছোট করিয়া কুটিয়া মিশাইয়া ভাজিতে পার। এবং প্যাজের ফুল্কা (কলি) কুটিয়া মিশাইয়াও ভাজিতে পার। কাঁচা লঙ্কার সহিত প্যাঁজ ফোড়ন দিয়াও মটর শাক ভাজা যাইতে পারে।

 মুগ ও মাষকলাইয়ের ডালের খিচুড়ীর সহিত মটরশাক ভাজি খাইতে ভাল।

 ঢাকা (ঢেঁকী) শাক, শুশুনী শাক, বিবিধ ডাঁটা শাক, বিবিধ নটিয়া শাক প্রভৃতি এই প্রকারে ভাজিবে।

৪৫ বথুয়া শাক ভাজি

 তৈলে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়া নুমুণ হলুদ সহ বথুয়া শাক ভাজিবে। সলুপ শাকের সহিত মিশাইয়া বথুয়া শাক ভাজে, আবার তৎসহ পুনকা শাকও মিশাইয়া ভাজা হইয়া থাকে।

৪৬। খেঁসারীর শাক ভাজি

 খেঁসারী শাকের সহিত উত্তম কচি বেগুণ ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া মিশাইয়া নসনসে করিয়া ভাজিতে হয়। খেঁসারী শাক অম্লস্বাদ বিশিষ্ট সুতরাং ভাপ দিয়া জল চিপিয়া ফেলিয়া লইবে। তৈলে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়া শাক ও বেগুণ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ ও একটু মিষ্ট দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া বেশ নসনসে গোছ করিয়া নামাও।

৪৭। পাটের শাক ভাজি

 পাটের শাক ঘৃতে মুচমুচে করিয়া একটু নুণ সহ ভাজিবে।

৪৮। মেথি শাক ভাজি

 শাক বাছিয়া লও। বেগুণ ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। তৈলে কাঁচা বা শুক্না লঙ্কা ও মেথি ফোড়ন দিয়া শাক বেগুণ ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া ঢাকিয়া দাও। প্রয়োজন হইলে একটু জল দিবে।

 গিমা ও ব্রাহ্মী শাক এই প্রকারে ভাজিবে।

 মেথি শাক পাৎলা বুটের বেসম গোলায় বা মটর ডাইলবাটার গোলায় ডুবাইয়া ভাজিলে সুন্দর লাগে।

৪৯। বিলাতী কুমড়ার শাক ভাজি

 বিলাতী কুমড়ার জালি পাতা ও ডগা লও। তৈলে কাঁচা বা শুক্না লঙ্ক ফোড়ন দিয়া শাক ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া ঢাকিয়া দাও। আবশ্যক হইলে একটু জল দিবে। শুকাইয়া আসিলে কাঁচা লঙ্কা ও সরিষা একত্রে বাটিয়া মিশাও। নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

 সরিষার ফুল, তারামিরার ফুল, রাইসরিষার শাক, মূলার শাক (মূলার শাক কুচাইয়া লইবে) বাঁধা কোবি, ফুলকোবির পাতা (একটু ভাপ দিয় কুচাইয়া লইবে) প্রভৃতি এই প্রকারে সরিষা বাটা যোগে ভাজিবে।

৫০। ছাঁচি কুমড়ার শাক ভাজি

 ছাঁচি কুমড়ার বড় বড় বুড়া পাতাই খাইতে ভাল। পাতাগুলি ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া লও। তৈলে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়া পাতা ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া ঢাকিয়া দাও। আবশ্যক হইলে একটু জল দিবে। শুকাইয়া নরম হইলে তিল-পিঠালী বাঁটা অথবা সরিষা বাঁটা মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। আবার তিল বা সরিষা বাটা না দিয়া শুধু শুধুও ভাজিতে পার।

৫১। কলমী শাক ভাজি

 বর্ষার শুরুতে যখন কলমী শাকের নতি কেবল বাহির হইতে আরম্ভ হইবে সেই সময় কলমী শাকের কচি কচি ডগা ও পাতা সংগ্রহ পূর্ব্বক তেলে ভাজিয়া নূতন ঝাল-কাসুন্দীর সহিত মাখিয়া খাইবে।

 তেলে কাঁচা লঙ্কা এবং কালজিরা অথবা জওয়ান ফোড়ন দিয়া শাক ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া ঢাকিয়া দাও। প্রয়োজন হইলে কিছু জল দিবে। নরম হইয়া জল শুকাইলে নামাও।

৫২। মটরশুটি ভাজি

 শুটী হইতে মটর ছাড়াইয়া লও। ঘৃতে জিরা ও শুক্না লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মটর ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া ঢাকিয়া দাও। আবশ্যক হইলে একটু চিনি দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। মটর বেশী ভাজিলে চিমড়া হইয়া যায় সুতরাং ঢাকিয়া দিয়া ভাজাই ভাল। বুড়া কলাই হইলে পূর্ব্বে ভিজাইয়া রাখিবে বা একটু ভাপ দিয়া লইবে। ইহাতে শিঙ্গাড়ার পুর হয়।

 শিমের বীচি, বরবটির বীচি, বোড়া কলাই ও বুট পুর্ব্বে ভিজাইয়া রাখিয়া বা একটু ভাপ দিয়া লইয়া এই প্রকারে ভাজিবে।

৫৩। বৌ-ক্ষুদা বা ক্ষুদের পুড়পুড়ী

 ক্ষুদ ধুইয়া লও। ঘৃতে অথবা তৈলে তেজপাত, জিরা, লঙ্কা এবং রুচী হইলে দুটো গোটা গরমমশল্লা ও প্যাঁজ ফোড়ন দিয়া ক্ষুদ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া অল্প জল দাও। শুকাইয়া নামাও। সাবধান যেন ক্ষুদ গলিয়া না যায়। নামাইয়া একটু ঘৃত ও গরমমশল্লা বাটা মিশাও।

৫৪। পাট ভাজি

 ভিজান মটরের ডাইল মিহি করিয়া বাটিয়া তাহাতে কিছু আতপ চাউলের গুঁড়া, নুণ ও লঙ্কা বাটা মিশাইয়া জলসহ উত্তমরূপে ফেটাইয়া গোলা করিবে। অতঃপর বেগুণ প্রভৃতি পাৎলা পাট পাট করিয়া কুটিয়া তাহাতে ডুবাইয়া তুলিয়া ভাসা তৈলে সোণরা বর্ণে মুচমুচে করিয়া ভাজিয়া লইলে ‘পাটভাজি’ প্রস্তুত হইল।

 উত্তম গোলা প্রস্তুতের উপর পাটভাজার সাফল্য বহু পরিমাণে নির্ভর করে। প্রথমতঃ মটর ডাইল —অপর কোনও ডাইল বা বুটের বেসনের পাটভাজা এমনতর সুস্বাদু বা মুচমুচে হইবে না,—ঘণ্টা দুই ভিজাইয়া রাখিয়া পাটায় উত্তমরূপে বাটিয়া লও। তৎপর তাহাতে কিঞ্চিৎ আতপ চাউলের গুঁড়া মিশাও। ইহাতে পাটভাজার মোচকভাবের সাহায্য করিবে; কিন্তু যদ্যপি চাউলের গুঁড়া পরিমাণে বেশী হইয়া যায়, তবে পাটভাজা শিলা শিলা হইবে। তৎপর নুণ ও লঙ্কা বাটা মিশাইয়া ক্রমে একটু করিয়া জল মিশাইবে ও কাত দিয়া ফেনাইতে থাকিবে। উত্তমরূপে ফেনাইয়া ‘গোলা’ প্রস্তুত কর। গোলা যেন অধিক তরল বা অধিক গাঢ় না হয়, অর্থাৎ যাহাতে গোলায় বেগুণাদি ডুবাইলে তাহার গায়ে অত্যল্প বা অত্যধিক গোলা না লাগে। অত্যন্ত লাগিলে ভাজিলে ফুলিবে না, অত্যধিক লাগিলে ভাজিলে কেঁৎকেঁতে হইবে ও ভিতরে কাঁচা থাকিয়া যাইবে। আবার, উত্তমরূপ ফেনান না হইলেও ভাজিলে শিলা শিলা হইবে ও ভিতরে কঁচা থাকিয়া যাইবে। এই সময় আর এক বিষয়ে সতর্ক থাকিতে হইবে, যেন কোনও ক্রমে ডাইল বাটাতে তৈল সংস্পর্শ না ঘটে। তাহা হইলে কিছুতেই উহা আর ফেনান যাইবে না,—বাটা ছেকরা ছেকরা হইয়া এককালে সমস্ত নষ্ট হইয়া যাইবে।

 তৎপর, বেগুণ প্রভৃতি ভাজিবার দ্রব্য পাট পাট করিয়া কুটিয়া এই গোলায় চুবাইয়া তুলিয়া ভাসা তৈলে সোণার বর্ণে মুচমুচে করিয়া ভাজ। বেগুণাদি কুটা পাট পাট না হইলে তাহাতে গোলা লাগাইলে পিণ্ডাকৃত হইবে, সুতরাং ভাজিলে কদাপি মোচক হইবে না অথবা ভিতরের আনাজও সুপক্ব হইবে না। এই নিমিত্ত আনাজাদি সচরাচব পাৎলা পাট পাট করিয়া কুটিয়া লইয়া গোলায় ডুবাইয়া তুলিয়া ভাসা তৈলে ভাজা হয়, এই নিমিও ইহার নামও ‘পাট-ভাজি’ হইয়াছে।

 বেগুণ, বিলাতী কুমড়া, বিলাতী কুমড়ার ফুল, বক ফুল, কাঞ্চন ফুলের কলি, কচি পটোল, কচি গাব পাতা, কচি সেফালী পাতা, মেথি শাক, ফুলকোবি প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত কোমল আনাজেব দ্বারাই ডাইলের পাটভাজা ভাল হয়। অপেক্ষাকৃত কঠিন আনাজ হইলে ভাজিলে ভিতরে কাঁচা থাকিয়া যাইবে। তবেই দেখা যাইতেছে আনাজাদি পাট পাট করিয়া বানাইয়া লওয়ার কতটা প্রয়োজন। অবশ্য মেথি শাক, বিলাতী কুমড়ার ফুল, কাঞ্চন ফুল প্রভৃতি পাট পাট করিয়া বানাইয়া না লইলেও তাহা গোলাতে ডুবাইলে ঠিক পিণ্ডাকৃতি হয় না—তাহা কতকটা ‘স্পঞ্জের’ মত ‘ফারফুর’ গোছের হয়, সুতরাং ভাজিলে উত্তপ্ত তৈল ঐ ফাঁকে ফাঁকে প্রবিষ্ট হইয়া সর্ব্বত্র সমভাবে ভাজা হয়। আনাজের মধ্যে বেগুণ সর্বাপেক্ষা কোমল এবং সুলভও বটে, সুতরাং তদ্দ্বারাই সাধারণতঃ পাটভাজা হয় বলিয়া ‘পাটভাজি’র অপর নাম ‘বেগুণী’ হইয়াছে।

 ডাইলের দ্বারা আমিষের পাট ভাজা সুবিধা হয় না। সুজী, ময়দাদির দ্বারা এবং হালে ‘ব্রেডক্রাম্বের’ দ্বারা মৎস্যের ও মাংসের পাটভাজা হইয়া থাকে। কিন্তু তৎক্ষেত্রে তদ্বারা গোলা প্রস্তুত না করিয়া তাহা শুষ্ক অবস্থাতেই মৎস্য, মাংসাদির উপর ছিটাইয়া বা মাখিয়া দিয়া ভাজিতে হয়। এ সম্বন্ধে যথাযযাগ্য স্থলে আলোচনা করা যাইবে।

 কোনও প্রকার আনাজ ভিতরে না দিয়া শুধু ফেনান গোলা দ্বারা সুন্দর ‘বড়া’ ভাজা হইয়া থাকে। ইহা ছাড়া মটর, তিল ও পোস্ত প্রন্যতির গোলায় বিবিধ উপকরণ যোগে ফেনাইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘ফুল-বড়ী’ প্রস্তুত করিয়া শুকাইয়া রাখিয়া ভাজা যায়।

 ‘পাট’‘বড়া’ ভাজায় এই সমস্ত বিশেষ নটখট আছে বলিয়া এবং ইহাতে অনেকটা তৈল খরচ হয় বলিয়া ইহা সচরাচর গৃহস্থ বাটীতে ভাজা হয় না, জামাতা কিম্বা কোনও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বাটীতে অতিথী হইলে ‘পাট’ ভাজিবার আয়োজন হইয়া থাকে।

৫৫। বুটের বেসনের পাটভাজা

 বরেন্দ্রের পল্লী-গৃহে বুটের বেসনের পাট ভাজি তেমনতর সমাদর প্রাপ্ত হয় না। প্রথমতঃ বুটের বেসনে পাট ভাজিলে তেমনতর মোচক হয় না, দ্বিতীয়তঃ ইহা তথাতে তাদৃশ সুলভও নহে। পক্ষান্তরে সহর বাজারে ইহার যথেষ্ট আদর দেখিতে পাওয়া যায়। তথাতে বেসন সুলভ সুতরাং যদৃচ্ছা বাজার হইতে কিনিয়া আনিয়া অল্পায়াসে তদ্বারা পাট ভাজা যাইতে পারে। সুতরাং মটরের ডাইল বাটার পাট ভাজার ন্যায় ইহা সুন্দর মোচক না হইলেও অল্পায়াসে ভাজা যায় বলিয়া সহর বাজারে ইহারই অধিক প্রচলন। বুটের বেসম জলে গুলিয়া তৎসহ কিছু চাউলের গুঁড়া ও নুণ, লঙ্কাবাটা মিশাইয়া ফেনাইয়া লইয়া তাহাতে বেগুণাদি ডুবাইয়া তুলিয়া ভাসা তৈলে ভাজিবে। বুটের বেসমের দ্বারা এই ভাজা হয় বলিয়া ইহাকে সচরাচর ‘বেসন বা বেসম ভাজি’ কহে। এবং শুধু বেসমের বড়া ভাজিকে ‘ফুলুরী’ কহে। এতৎসহ পেঁয়াজ কুচা মিশাইয়া ভাজিলে তাহাকে ‘প্যাঁজের ফুলুরী’ কহে। বুটের বেসমের সহিত প্যাঁজ যেরূপ খাপ খায় মটর ডাইল বাটার সহিত সেরূপ খাপ খায় না। ক্ষুদ্র মৎস্যদিও বুটের বেসমের আবরণে ভাজিতে পার যায়।

৫৬। তিলের পাট ভাজি

 তিলঘষা জাঁতায় তিল ফেলিয়া ঘুরাইয়া তিলের খোসা উঠাইয়া ফেল, অথবা জাঁতা না থাকিলে মাটির ঝাঁঝরে তিল রাখিয়া হাতে ডলিয়া খোসা উঠাইয়া ফেল। পরিষ্কৃত তিল লইয়া আতপ চাউলের (ভিজান) সহিত একত্রে পাটায় বাটিয়া লও। দুই ভাগ তিলের সহিত একভাগ চাউল মিশাইবে। অথবা পূর্ব্বে তিল বাটিয়া লইয়া পশ্চাৎ তাহাতে চাউলের গুঁড়া মিশাইতেও পার। বাটনা যেন বেশ মিহি হয়। এক্ষণে নুণ লঙ্কাবাটা মিশাইয়া ক্রমে জল দিয়া ফেনাইয়া আবশ্যক মত গাঢ় করিয়া গোলা প্রস্তুত কর। চাউলের গুঁড়ার ভাগ বেশী বোধ হইলে কমাইয়া লইবে। শশা, ছাঁচিকুমড়া, বিলাতী (মিঠা) কুমড়া প্রভৃতি পাট পাট করিয়া কুটিয়া এই গোলায় ডুবাইয়া তুলিয়া ভাসা তৈলে মুচমুচে করিয়া ভাজ।

 পোস্তদানা বাটা, মশিনা বাটা প্রভৃতি দ্বারা এইরূপে ‘পাট’ ভাজিবে।

৫৭। সরিষার পাট ভাজি

 সরিষা মিহি করিয়া পাটায় বাটিয়া লও। কিছু চাউলের গুঁড়া, নুণ ও লঙ্কা বাটা মিশাইয়া জল দিয়া ফেনাইয়া গোলা প্রস্তুত কর। বেগুণ, শশা, মোচার কোমলাগ্রভাগ, ওলের ডাগুর, ধামাকচু এবং তাহার ডাগুর, সরিষার ফুল, তারামিরার ফুল প্রভৃতি এই গোলায় ডুবাইয়া তুলিয়া ভাসা তৈলে ভাজ।

৫৮। মাষকলাইর ডালের পাটভাজি

 মাষ কলাইর ডাইলের খোসা উঠাইয়া ফেলিয়া ভিজাইয়া রাখিয়া পাটায় বাটিয়া লও। কিছু চাউলের গুঁড়া, নুণ, লঙ্কা বাটা ও কিছু মৌরীর গুঁড়া মিশাইয়া জল দিয়া ফেনাইয়া গোলা করিয়া লও। বেগুণ প্রভৃতি ডুবাইয়া ভাসা তৈলে ভাজ। ইহার ‘বড়া’ ভাজাও অতি সুন্দর হয় এবং তাহা দইয়ে ভিজাইয়া ‘দই-বড়া’ প্রস্তুত হয়। (দই-বড়া’ দেখ)।

৫৯। ময়দার পাটভাজি

 ময়দায় তৈল বা ঘৃতের ময়ান দিয়া তৎসহ নুণ, লঙ্কা বাটা এবং রুচী অনুসারে দুটো কালজিরা (গুঁড়া) মিশাইয়া জল দিয়া ফেনাইয়া গোলা কর। শশা, ছাঁচিকুমড়া, বিলাতী কুমড়া, ফুলকোবি প্রভৃতি ইহাতে ডুবাইয়া তুলিয়া ভাসা ঘৃতে বা তৈলে সোণার বর্ণ করিয়া ভাজ।

 ময়দার আমিষ পাট ভাজি আমিষ অংশে লিখিত হইবে। আমিষ ভাজিকে অবশ্য পাট ভাজি বলা যায় না, তাহাকে ‘সুজী ভাজি’ বলা হয়। আবার ময়দার খোলায় প্রস্তুত শিঙ্গাড়া, কচুরী প্রভৃতিকেও পাটভাজা’ বলা যায় না, ‘পূরী’ বলা হয়; কেননা সে ‘খোলা’য় পূরিয়া পক্ব ‘পূর’ ভাজি, আর এ ‘গোলায়’ চুবাইয়া কাঁচা আনাজাদি ভাজি।

 ধান্যের খইয়ের গোলা প্রস্তুত করিয়া এই প্রকারে পাট ভাজিবে।

৬০। ডাইলের চাপড়ী ভাজি

 মটর বা খেঁসারীর ডাইল ভিজাইয়া রাখিয়া আধকচড়া করিয়া পাটায় বাটিয়া লও। নুণ, লঙ্কাবাটা মিশাইয়া হাতে করিয়া তাল পাকাও। কড়াইয়ে তৈল চড়াও। উত্তপ্ত হইলে কড়াইর কাণা ধরিয়া কাৎ কর। তলা হইতে তেল সরিয়া গেলে সেখানে ঐ তালপাকান বাটা ডাইল রাখিয়া দিয়া আঙ্গুলে চাপিয়া এক আঙ্গুল পুরু পিষ্টকাকারে চেপ্‌টা কর। অতঃপর কড়াই পুনঃ সোজা করিয়া উত্তপ্ত তৈল চাপড়ীর উপর ফেল। এক পিঠ ভাজা হইয়া চাপড়ী কঠিন হইলে উলটাইয়া দিয়া অপর পিঠ ভাজ। ইহা বহু ব্যঞ্জনের অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হয়।

ভাজি (আমিষ)

৬১। মাছ ভাজি

 সাধারণতঃ সর্ব্ব প্রকার মাছই নুণ, হলুদ দিয়া মাখিয়া ভাসা তৈলে ভাজা হইয়া থাকে। চুণা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ যথা মোয়া, পিয়ালী, খরিয়া, রাইখবিয়া প্রভৃতি গোটা রাখিয়া কুটিয়া লইয়া মুচমুচে করিয়া ভাজিতে হয়, এবং ইলিশ রোহিতাদি বড় বড় মৎস্য খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া লইয়া মোলায়েম করিয়া ভাজিতে হয়। এতন্মধ্যে ইলিশাদি কোমল মাছ সামান্য মাত্র ভাজিলেই যথেষ্ট হয় —কড়া গোছের করিয়া ভাজিলেই ইহাবা শক্ত হইয়া গিয়া অখাদ্য হয়। পক্ষান্তরে পাকা রোহিতাদি মৎস্য ঈষৎ কড়া করিয়া না ভাজিলে সুস্বাদু হয় না। কই মাছের উপরের রঙ্গ লালচেবর্ণ হইলে তবে ভাজা ঠিক হইয়াছে বুঝিয়া তৈল হইতে ছাঁকিয়া উঠাইতে হইবে, তাহা হইলে অভ্যন্তরে বেশ মোলায়েম ও গদগদে থাকিবে, কিন্তু ভাজা অধিক কড়া হইয়া মাছের রঙ্গ তামাটে বর্ণ হইয়া গেলে মাছ চিমড়া কাষ্ঠবৎ কঠিন হইয়া অখাদ্য হইবে। বৃহৎ জাতীয় মৎস্যগুলি অপেক্ষাকৃত পুরু ও বড় বড় খণ্ডে কুটিয়া লইতে হইবে।

 মাছ ভাজিবার তৈল উপযুক্তরূপে উত্তপ্ত না হইলে তাহাতে মাছ ছাড়া কর্ত্তব্য নহে। তৈল কাঁচা থাকলে তাহাতে মাছ ছাড়িলে মাছ ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং তেল-পেচপেচে হইবে এবং তাহার আস্বাদনও ছোবা ছোবা হইবে। আবার তৈল অধিক উত্তপ্ত হইলে তাহাতে মাছ ছাড়িলে মাছ ‘জ্বলিয়া’ যাইতে পারে। তৈল উপযুক্তরূপে উত্তপ্ত হইলে তাহাতে মাছ ছাড়িবামাত্র মাছের উপরিভাগ ঈষৎ কঠিন হইয়া অত্যন্তরের ‘রস’ নির্গমপথ রুদ্ধ করিবে এবং রোহিতাদি মৎস্যের উপরটা লালচে করিয়া ভাজিলে পুরু মৎস্য খণ্ডের অভ্যন্তর ভাগ সর্ব্বত্র সুপক্ব হইয়া এই রস পর্য্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হইবে, অথচ তাহা বহির্গত হইয়া যাইবে না, সুতরাং ভর্জ্জিত মৎস্য সুন্দর মোলায়েম, সরস ও সুতার বিশিষ্ট হইবে। কিন্তু এতদপেক্ষা অধিক ভাজা হইলে অর্থাৎ মাছের উপরের রঙ্গ তামাটে বর্ণ ধারণ করিলে, আর এ ভাব থাকিবে না, অত্যধিক তাপে রস উপিয়া বহির্গত হইয়া গিয়া অভ্যন্তর ভাগও শুষ্ক ও কঠিন হইয়া যাইবে, সুতরাং ভর্জ্জিত মৎস্য চিমড়া ও শেষ পর্যন্ত কাষ্ঠবৎ স্বাদবিশিষ্ট হইয়া অখাদ্য হইয়া যাইবে। মাছ একটু নরম থাকিলে অবশ্য ঈষৎ কড়া করিয়া ভাজিয়া খাওয়াই কর্তব্য।

 অন্যান্য ভাজার ন্যায় মাছ ভাজাও গরম গরম খাইবে।

 মোয়া, সাঁপুই, পুঠি, পিয়ালী, ফাসা, খরিয়া (খইরা), সুবর্ণ খরিয়া, রাইখরিয়া, এলঙ্গ, নছী (রুই, কাৎলা প্রভৃতির ছা), বাটা, ভাঙ্গন, খরসুল্লা, (পার্শে) ও ছোট ছোট কাঁকড়া ও চিঙড়ী প্রভৃতি চুণা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৎস্য গোটা কুটিয়া বা বড় হইলে খণ্ড খণ্ড করিয়া নুণ হলুদ মাখিয়া সুধু অথবা প্যাঁজ কুচা ফোড়ন দিয়া ভাসা তৈলে মুচমুচে করিয়া ভাজিবে। খরিয়া ও রাইখরিয়া মাছ বড় হইলে কাঁটা বহুল হয় সুতরাং তাহাদের ছোটই এই প্রকারে ভাজিয়া খাইতে ভাল। বড় খরিয়ামাছ সুজী মাখিয়া ঘৃতে ভাজিয়া খাইতেই ভাল।

 ফলুই, পাতাশী, পবা, বাঁশপাতা, টেঙ্গা, মেটর (সিলঙ্গ, আইড় প্রভৃতি বৃহৎ মৎস্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাচ্ছা) প্রভৃতি অপরাপর চুঁচড়া মাছ এমনিতর মুচমুচে করিয়া ভাজিয়া খাইতে তেমনতর স্বাদ হয় না, তাহা কিছু নরম তাকে ভাজিয়া খাইবে।

 অপেক্ষাকৃত বড় চিংড়ী, ইলিশ, কৈ, খলিষা, (তপসী), (সিল্লি), ভোল, ভেদা প্রভৃতি মাছ নরম তাকে ভাজিয়া খাইবে। ইলিশ মাছ যত নরম তাকে ভাজিয়া তুলিতে পার ততই ভাল। কৈ ঈষৎ কড়া করিয়া ভাজিবে।

 পানসে অথচ তৈলাক্ত বড় বড় মাছ যথা—বাচা, আইড়, বোয়াল, সিলঙ্গ, চিতল প্রভৃতিও নরম তাকে ভাজিয়া খাইবে। কিন্তু এ সমস্ত মাছ ভাজিয়া খাইতে তাদৃশ স্বাদ লাগে না।

 রুই, কাৎলা, বাউস, মৃগেল, মহাশোল, সারঙ্গ পুঁঠী, (ভেকুট) প্রভৃতি বৃহত্তর মৎস্য অপেক্ষাকৃত পুরু ও বড় বড় খণ্ডে কুটিয়া ভাসা তেলে লালচে করিয়া ভাজিয়া খাইবে।

 রুই, ইলিশ, কৈ, খইরা, এলঙ্গ প্রভৃতি মাছের ডিম নুণ হলুদ মাখিয়া তেলে ভাজা যায়, কিন্তু বড় বড় মাছের ডিম যেমন স্বতন্ত্র ভাজা যায় কৈ, খইরা, এলঙ্গ প্রভৃতি ছোট মাছের তাহা যায় না।

 ছাতিয়ান (টাকি), শোল, বাইম, গুঁচী, মাগুর, সিঙ্গী প্রভৃতি জিয়োল মাছ সচরাচর ভাজিয়া খাইতে দেখা যায় না,—পোড়াইয়া খাইতেই দেখা যায়। তবে ছাতিয়ান, শোল প্রভৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোনা ভাসা তেলে শুধু অথবা পেয়াজ কুচি সহ মুচমুচে করিয়া ভাজিয়া খাইবে। আবার এই সমস্ত পোনার নরম তাকে ‘পুড়পুড়ী’ রাঁধিয়া খাইতেও বেশ ভাল লাগে।

৬২। ক্ষুদ্র মাছের পুড়পুড়ী

 ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুণামাছ, সুবর্ণখরিকা মাছ অথবা শোল ছাতিয়ান প্রভৃতি মাছের পোনার এবং ছোট ছোট চিংড়ী মাছের ‘পুড়পুড়ী’ হইয়া থাকে। মাছ নুণ হলুদ দিয়া মাখ। অল্প তেলে লঙ্কা (অথবা কাঁচা লঙ্কা) ও রুচী অনুসারে পেঁয়াজ (কুচা বা চাকা) ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। মধ্যে মধ্যে জলের ছিটা মারিয়া নরম করিয়া ভাঙ্গা শুকাইয়া নামাও। এই পুড়পুড়ীর বিশেষতঃ চিঙড়ীমাছের পুড়পুড়ীর ‘পূর’ ভরিয়া শিঙ্গাড়া প্রভৃতি ভাজা খাইতে পার। (‘জলখাবার’—‘পুরী’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)

৬৩। কুচা চিঙড়ীর সহিত বিলাতী কুমড়ার শাক ভাজি

 বিলাতী (মিঠা) কুমড়ার কচি কচি ডগা ও পাতা বাছিয়া লও। কুচা চিঙড়ী কুটিয়া নুণ হলুদ মাখ। তেলে কাঁচা লঙ্কা ও পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। শাক ছাড়। আংসাও। পুনরায় কিছু নুণ, হলুদ ও কিছু লঙ্কা বাটা মিশাও। অল্প জল দাও। সিদ্ধ হইলে কিছু চিনি দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া শুকাইয়া নামাও।

 ইহা খিঁচুড়ীর সহিত এবং মুড়ী প্রভৃতি ভাজার সহিত খাইতে ভাল।

৬৪। সুজী দিয়া মাছ ভাজি

 আনাজাদি যেমন পাট পাট করিয়া কুটিয়া লইয়া মটর ডাইল বাটা, বুটের বেসম, তিল-পিঠালী বাটা, ময়দা প্রভৃতির আবরণে তৈলে ভাজা হইয়া থাকে মৎস্যও সেই রকম ময়দা বা সুজীর আবরণে ঘতে ভাজা হইয়া থাকে। কিন্তু মটর ডাইলবাটা প্রভৃতির যেমন তরল ‘গোলা’ প্রস্তুত করিয়া লইয়া আনাজাদি তাহাতে ডুবাইয়া তুলিয়া ভাজিতে হয় মাছের ‘সুজী-ভাজি’তে সেরূপ করিতে হয় না, ইহাতে ময়দা বা সুজী অথবা উভয় একত্রে সমপরিমাণে লইয়া কাটখোলায় চমকাইয়া ঈষৎ লাল্‌চে করিয়া ভাজিতে হয় এবং কাঁচা মৎস্যাদিতে ঝাল নুণাদি মাখিয়া ঐ চমকান শুষ্ক সুজীর উপর গড়াইয়া লইয়া ঘৃতে ভাজিতে হয়। (ইউরোপীয়গণ ক্রাম্ব্‌রুটীর গুঁড়া দ্বারা মৎস্য মাংসাদি মাখিয়া ভাজিয়া থাকেন। ইহা কলিকাতা বা অপর বড় সহরে যথেষ্ট পওয়া যায় সুতরাং সুজীর পরিবর্ত্তে ক্রাম্বরুটীর গুঁড়া দ্বারা ইচ্ছা করিলে মাছ মাখিয়া ভাজিবে।) সুজীর দ্বারা মাখিবার পূর্ব্বে বড় মৎস্য হইলে তাহা অপক্ষাকৃত পুরু ও বড় বড় খণ্ডে কুটিয়া লইয়া একখানা ভারী গোছের ছুরি বা কাটারী অথবা কাঠের হাতুড়ী বা তদ্বৎ কোনও অস্ত্রের দ্বারা একটু থুরিয়া বা ছেঁচিয়া লইবে। পাটার উপর মৎস্য খণ্ড রাখিয়া শিলের দ্বারাও বেশ ছেঁচিয়া লওয়া চলিতে পারে। তৎপর তাহাতে নুণ, (হলুদ), মরিচ গুঁড়া (অথবা লঙ্কা বাটা), আদা বাটা বা রস এবং রুচী অনুসারে পেঁয়াজ বাটা বা রস মাখিবে। কেহ কেহ এই সঙ্গে কিছু অম্লরস যথা—লেবুর রস, তেঁতুল গোলা, অথবা দধি প্রভৃতি মিশাইয়া থাকেন। কিছুক্ষণ ঢাকিয়া রাখিলে ঝাল নুণ, মাছের ভিতরে প্রবেশ করিবে। এখন একখানা রেকাবীতে কাটখোলায় চমকান ময়দা, সুজী বা ক্রাম্বরুটীর গুঁড়া বাখিয়া ঐ ঝালে নুণে মাখা মাছ তাহার উপর ফেলিয়া উল্‌টাইয়া পাল্‌টাইয়া মাছের গায়ে ময়দা, সুজী বা ক্রাম্বরুটীর গুঁড়া লাগাইয়া বা মাখিয়া লও, অতিরিক্ত সুজী হাতে ঝাড়িয়া ফেল। অতঃপর তৈয়ে করিয়া উত্তপ্ত ঘৃতে ভাজ। কড়াই অপেক্ষা তৈয়ে ভাজিলে সুবিধা এই হয় যে অল্প ঘৃতে এবং অল্প সময়ে অধিক মাছ ভাজা যায়।

 মাছ বেশ তাজা ও টাট্‌কা না হইলে তাহার ‘সুজী-ভাজা’ বড় সুবিধা হয় না।

 (ক) কই মাছ—অপেক্ষাকৃত পুরু ও বড় বড় খণ্ডে কুটিয়া লও। পেটী অপেক্ষা গাদার মাছেই এই ‘সুজী ভাজা’ উত্তম হয়। (ইউরোপীয়গণ মাছের মুড়া ফিছা কাটিয়া ফেলিয়া লম্বালম্বি ভাবে শিরদাঁড়ার উভয় পার্শ্ব দিয়া বড় বড় দুই ফালটার মাছ বিভক্ত করিয়া লয়েন, তৎপর প্রত্যেক ফালটা আবার আড়ভাবে তিন অঙ্গুলী পরিমিত চওড়া চওড়া খণ্ডে কুটিয়া লয়েন। প্রতি খণ্ডে গাদা পেটী উভয়ই থাকে।) এক্ষণে এই মৎস্য খণ্ড গুলি একটু থুরিয়া বা ছেঁচিয়া লও। নুণ, (হলুদ), মরিচ গুঁড়া, (পাকা রুইয়ে একটু লঙ্কা বাটাও দেওয়া যাইতে পারে), আদা বাটা বা রস এবং এবং রুচী হইলে পেঁয়াজ বাটা বা রস এবং কিঞ্চিৎ অম্লরস মিশাও। সুজীর বা ব্রেড ক্রাম্বের উপর ফেলিয়া উল্‌টাইয়া পাল্‌টাইয়া গায়ে সুজী বা ক্রাম্ব মাখিয়া লও। তৈয়ে করিয়া উত্তপ্ত ঘৃতে সোণার বর্ণ করিয়া ভাজ।

 বাউস, কাৎলা, মৃগেল, মহাশোল, সারঙ্গ পুঁঠী, (ভেটকী) এবং সামুদ্রিক ‘সিয়ার’ (সেকরেল) প্রভৃতি মৎস্য এই প্রকারে সুজী দিয়া ঘৃতে ভাজিবে। রুই প্রভৃতি মাছের ডিমও খণ্ডে খণ্ডে কুটিয়া এই প্রকারে সুজী দিয়া ঘৃতে ভাজিতে পার।

 (খ) চিংড়ী মাছ—বড় বড় বা মাঝারী গোছ মোচা বা গল্‌দা চিঙড়ী মছেরই ‘সুজী ভাজি’ ভাল হয়। বাগদা চিংড়ীর বা কুচা চিঙড়ীর সুজী ভাজা ভাল হয় না। খোলা ছাড়াইয়া চিঙড়ী মাছের মাথা কাটিয়া ফেল। একখানা ধারাল ছুরি দ্বারা, বুকের দিকটা বাধাইয়া রাখিয়া, পিঠের দিকটা লম্বালম্বি ভাবে ন্যাজের গোড়া পর্য্যন্ত চিরিয়া ফেলিয়া ভিতর হইতে কালো ‘রগ’টা বাহির করিয়া ফেলিয়া দাও। একখানা তক্তা বা পাটার উপর মাছটি বিছাইয়া একখানা ভারী গোছের ছুরি বা কাটারী বা শিলের দ্বারা মাছটি থুরিয়া বা ছেঁচিয়া লও। এই সময়, (হলুদ), গোল মরিচের গুঁড়া (বা লঙ্কা বাটা) আদা বাটা বা রস এবং রুচী অনুসারে পেঁয়াজ বাটা বা রস ও কিঞ্চিৎ অম্লরস (লেবুরস, তেঁতুল গোলা বা দধি) মিশাও বা খাওয়াও। অতঃপর সুজীর, ময়দার বা ব্রেড ক্রাম্বের গুঁড়ার উপর ফেলিয়া উল্‌টাইয়া পাল্‌টাইয়া মাছের গায়ে সুজী বা ক্রাম্ব মাখিয়া লইয়া তৈয়ে করিয়া ঘৃতে ভাজ।

 অবশিষ্ট চিঙড়ী মাছের মাথায় সুন্দর ঘণ্ট, কালিয়া প্রভৃতী রাঁধা যায়।

 (গ) ইলিশ মাছ—ইলিশমাছ চাকা চাকা করিয়া কুটিয়া (অথবা ইউরোপীয় ধরণে ফালটা কাটিয়া ও পশ্চাৎ খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া) তাহাতে নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা (অথবা গোল মরিচ বাটা) ও রুচী অনুসারে পেঁয়াজ বাটা বা রস (ইলিশ মাছে আদা পেঁয়াজ বাটা না দিলেই যেন ভাল হয়।) ও কিঞ্চিৎ অম্লরস মাখ। অবশেষে সুজী বা ব্রেডক্রাম্ব মাখিয়া তৈয়ে করিয়া ঘৃতে ভাজ। (ইউরোপীয়গণ নুণ, মরিচ গুঁড়া, এঞ্চবী সস, কিঞ্চিৎ অম্লরস [আদা পেঁয়াজাদির প্রয়োজন হয় না] ও তৎসহ একটা পক্ষী ডিম্বের শাঁস মিশাইয়া ‘গোলা’ প্রস্তুত করতঃ তদ্দ্বারা মাছ মাখিয়া লইয়া তৎপর তাহা ব্রেড ক্রাম্বের উপর গড়াইয়া লইয়া ঘৃতে ভাজিয়া থাকেন। মাছের গায়ের ‘চিকণাই’ টুকু অনেক সময়ে উঠাইয়া ফেলিয়া মৎস্য খণ্ডকে ‘গোলা’ মাখিবার উপযুক্ত করিয়া লয়েন।) ইলিশ মাছের ‘সুজী-ভাজা’ অপেক্ষা সরিষা বাটা দিয়া ভাজাই যেন অধিকতর সুস্বাদু হয়। তৎক্ষেত্রে সরিষা বাটা লইয়া তাহাতে কিছু চাউলের গুঁড়া, নুণ, হলুদ ও কাঁচা লঙ্কা বাটা মিশাইয়া ফেনাও। ইলিশ মাছ চাকা ইহাতে চুবাইয়া তুলিয়া তেলে ভাজ।

 ইলিশ জাতীয় অপরাপর মধুব ও নোণা জলের মাছ যথা খইরা, ফাঁসা, (এঞ্চবী) (সার্ডিন) প্রভৃতি, ইলিশ মাছের ডিম এবং বড় চিঙড়ী মাছের মাথা এই সকল প্রকারে ভাজা যাইতে পারে।

 (ঘ) কৈ মাছ—কৈ ভাজে গণ্ডাদশ মরিচ-গুঁড়িয়া আদারসে”। (কবিকঙ্কন চণ্ডী)। বড় বড় সুপুষ্ট দেখিয়া কৈ মাছ লও। গোটা রাখিয়া কুটিয়া লও। গায়ে দুই একস্থানে আড় ভাবে চির দিয়া লও, যাহাতে ঝাল নুণাদি ভিতরে প্রবেশ কবিতে পাবে। নুণ, (হলুদ), গোল মরিচ গুঁড়া, আদা বাটা বা রস, এবং রুচী অনুসারে পেঁয়াজ বাটা বা রস এবং কিঞ্চিৎ অম্লরস দিয়া মাছ মাখ। সুজী বা ব্রেড ক্রাম্বের উপর ফেলিয়া পালটাইয়া গায়ে সুজী বা ব্রেডক্রাম্ব মাখিয়া লইয়া ঘৃতে ভাজ। ইউরোপীয় ধরণে এরোরুট বা ডিমের শাঁস সহ গোলা প্রস্তুত করতঃ তাহাতে মাছ মাখিয়া লইয়া ব্রেডক্রাম্বে গড়াইয়া ভাজিলে উৎকৃষ্ট হইবে।

 ইলিশ মাছের ন্যায় কৈ মাছেরও সরিষা বাটা দিয়া ভাজি হইতে পারে।

 (ঙ) ভাঙ্গন মাছ—সুপুষ্ট দেখিয়া মাছ লও। গোটা রাখিয়া কুটিয়া গায়ে দুই একস্থানে আড়ভাবে চির দিয়া অথবা বড় হইলে খণ্ড খণ্ড করিয়া লও। নুণ, (হলুদ), গোল মরিচের গুঁড়া, আদা বাটা বা রস ও রুচী অনুসারে পেঁয়াজ বাটা বা রস ও কিঞ্চিৎ অম্নরস দিয়া মাছ মাথা সুজীর বা ব্রেডকাম্বের উপর ফেলিয়া পালটাইয়া মাছে সুজী বা ক্রাম্ব মাখিয়া লও। ভাজ। ইউরোপীয় ধরণে এরোরুট বা ডিমের শাঁস মিশাইয়া গোলা প্রস্তুত করতঃ তাহাতে মাছ মাখিয়া ব্রেডক্রাম্বে গড়াইয়া ভাজিলে উৎকৃষ্ট হইবে।

 খরসুল্লা, (পার্শে), (তপসী), সল্লি, ভোল, বাটা, নছী ও সামুদ্রিক সিয়ার বা মেকরেল, পমফ্রেট, সোল প্রভৃতি মাছ এই প্রকারে ঘৃতে ভাজিবে।

 (চ) চিতল মাছ—চিতল মাছের গাদার মাছ কাটিয়া লও। একধান লৌহ ঝিনুক বা ছুরি দ্বারা আঁচড়াইয়া গাদার অন্তর্নিবিষ্ট কাঁটা সমূহ উঠাইয়া ফেল। সামান্য একটু থুরিয়া লইয়া অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট বরফীর আকারে কুটিয়া লও। নুণ, লঙ্কা বাটা এবং ইচ্ছা করিলে আদা ও পেঁয়াজ বাটা ও কিঞ্চিৎ অম্লরস এবং বাঁধন স্বরূপ তৎসহ এরোরুট বা ডিমের শাঁস মিশাইয়া সুজী, ময়দা বা ব্রেডক্রাম্বের উপর গড়াইয়া লইয়া ঘৃতে ভাজ। ইহার দ্বারা পুনঃ সুন্দর কালিয়া রাধা যাইতে পারে।


৬৫। চিঙড়ী মাছের বড়া ভাজি।

 ‘সুজী ভাজিতে’ মাছ গোটা রাখিয়া কেবল একটু ছেঁচিয়া বা থুরিয়া লইতে হয়, বড়া ভাজিতে কাঁচা বা ঈষৎ কষান মাছ লইয়া মিহি করিয়া পাটায় বাটিয়া বা হামানদিস্তায় কুটিয়া লইতে হয়। তৎপর তাহাতে কিছু চাউলের গুঁড়া (বাঁধনের নিমিত), নুণ, হলুদ ও লঙ্কাবাটা এবং তৎসহ ইচ্ছা হইলে আদা ও পেঁয়াজ মিহি করিয়া বাটা মিশাইয়া এবং কিছু ঘৃতের ময়ান দিয়া উত্তম রূপে ফেনাইয়া লইবে। অবশেষে তদ্দ্বারা ভাসা তৈলে বা ঘৃতে বড়া ভাজিবে। চাউলের গুঁড়ার পরিবর্ত্তে বুটের বেসম মিশাইয়াও এই বড়া ভাজা যাইতে পারে।

 চিংড়ী মাছের সহিত ঝুনা নারিকেল কুড়া একত্রে বাটিয়া লইয়া এই প্রকারে বড়া ভাজিলে অতি সুস্বাদু হইয়া থাকে। নারিকেল মিশাইলে আর স্বতন্ত্র ঘৃতের ময়ান দিতে হইবে না, কেন না নারিকেল হইতেই যথেষ্ট তৈল বাহির হইয়া ময়ানের কাজ করিবে।

৬৬। কাঁকড়ার বড়া ভাজি।

 বড় দেখিয়া ঘৃতবিশিষ্ট কাঁকড়া লও। কলিকাতা অঞ্চলের ঘৃতবিশিষ্ট বৃহৎ নোণা কাঁকড়ার ন্যায় সুন্দর কাঁকড়া বরেন্দ্রে মিলে না। কাঁকড়ার পৃষ্ঠের ‘চাড়া’ অর্থাৎ খোলা ছাড়াইয়া ফেলিয়া ভাপ দিয়া লও। খোলার অভ্যন্তর হইতে শস্য ও ঘৃত বাহির করিয়া কাঁটাদি বাছিয়া ফেল। নুণ, লঙ্কাবাটা ও চাউলের গুঁড়া (বাঁধন), কিঞ্চিৎ ঘৃত ও রুচি অনুসারে আদা ও পেঁয়াজবাটা এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ নারিকেল কুড়া মিশাইয়া চট্‌কাইয়া লও। ফেনাইয়া ভাসা ঘৃতে বড়া ভাজ। অথবা ‘গোলা’ অপেক্ষাকৃত কঠিন হইলে তদ্দ্বারা টিকলি বা ইচ্ছামত অন্যবিধ আকারে গড়িয়া ব্রেডক্রাম্বের গুঁড়ার উপর গড়াইয়া তৈয়ে করিয়া ঘৃতে ভাজ। অথবা এই ‘পুরের’ সহিত পক্ষীর ডিমের শাঁস মিশাইয়া তাহা কাঁকড়ার খোলাতে ভরিয়া তদুপরি ব্রেডক্রাম্বের গুঁড়া ছড়াইয়া দিয়া তাহা উত্তপ্ত তেজালের মধ্যে রাখিয়া বেক’ বা পুট-পাক কর।

৬৭। রুই মাছের টিকলি ভাজি।

 চিংড়ীমাছের ন্যায় কাঁচা রুই মাছ মিহি করিয়া পাটাতে বাটিয়া লওয়া চলে না, সুতরাং রুইমাছ অল্প সিদ্ধ করিয়া বা তৈলে কষাইয়া লইয়া ভাঙ্গিয়া তাহার কাঁটা বাছিয়া ফেলিবে। অতঃপর তাহাতে নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা, কিঞ্চিৎ অম্লরস এবং ইচ্ছা হইলে তৎসহ আদা ও পেঁয়াজ বাটা মিশাইয়া এবং আঁটিয়া লইবার নিমিত্ত কিছু চাউলের গুঁড়া বা ডিমের ইয়োক মিশাইয়া চটকাইয়া মাখিয়া লও। অতঃপর তদ্দ্বারা টিকলির বা ইচ্ছামত অপর কোনও আকারে গড়িয়া ভাসা তৈলে বা তৈয়ে করিয়া ঘৃতে ভাজ। চিংড়ী মাছ বাটার ন্যায় রুই মাছ চটকাইয়া কাদা কাদা করিয়া লইলে তাহার দ্বারা ফেনান বড়াও ভাজা যাইতে পারে।

 ভাজা টিকলির সুন্দর কালিয়া রাঁধা চলে। কেহ আবার টিকলিগুলি পুনঃ বুটের বেসম বা ময়দা গোলায় চুবাইয়া তুলিয়া ভাজিয়া থাকেন।

 কাৎলা, বাউস, মৃগেল ও মহাশোল মাছের এইরূপে টিকলি ভাজা হইয়া থাকে।

৬৮। রুই মাছের তেলের বড়া ভাজি।

 উওম পাকা রুই মাছের পেটের মধ্যে যে তেল জন্মে তদ্বারা অতি সুন্দর বড়া ভাজা হইয়া থাকে। এই তেলের সহিত নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা এবং ইচ্ছা হইলে তৎসহ আদা ও পেঁয়াজ বাটা মিশাইয়া এবং চাউলের গুঁড়া বা বুটের বেসম মিশাইয়া আঁটিয়া লইয়া, ফেনাইয়া ভাসা তেলে বড়া ভাজ।

৬৯। খাসির তেলের বড়া ভাজি।

 খাসির তেল উত্তপ্ত জলে বসাইয়া নরম করিয়া লও। তৎপর তৎসহ নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা এবং ইচ্ছা হইলে আদা পেঁয়াজ বাটা মিশাইয়া এবং আঁটিয়া লইবার নিমিত্ত কিছু চাউলের গুঁড়া বা বুটের বেসম মিশাইয়া ফেনাইয়া লও। ভাসা তেলে বা ঘৃতে বড়া ভাজ।

৭০। পক্ষীর ডিম ভাজি।

 তৈয়ে করিয়া ঘি চড়াও। সাবধানে ডিম ভাঙ্গিয়া তাহার উপর ঢালিয়া দাও—যেন ডিমটি গলিয়া না যায়। ঈষৎ দঢ়াইলেই নামাইয়া লও। নুণ ও মরিচ গুঁড়া সহ খাও।

৭১। পক্ষীর ডিমের বড়া ভাজি।

 হাঁস, কাউঠা প্রভৃতির ডিম ভাঙ্গিয়া লইয়া তাহার শেতাংশ ও হরিদ্রাংশ আলাদা আলাদা করিয়া রাখ। শ্বেতাংশ একখানা কাটি বা খিলের কুঁচী দিয়া উত্তমরূপে শক্ত করিয়া ফেটাইয়া রাখ। হরিদ্রাংশের সহিত নুণ ও মরিচগুঁড়া এবং ইচ্ছা করিলে আদা ও পেয়াজের রস (বাটনা নহে) মিশাইয়া লইয়া শ্বেতাংশের সহিত মিশাও। তৈয়ে করিয়া ঘৃতে ভাজ। উত্তপ্ত হইলেই তাহার উপর ‘গোলা’ ছড়াইয়া বিছাইয়া দিবে। নিচের পিঠ অল্প দঢ়াইলেই তৎক্ষণাৎ তাহা জড়াইয়া ফেলিবে এবং জোড়ের মুখ তপ্ত তৈয়েব গায়ে চাপিয়া ধরিয়া আঁটিয়া লইয়াই নামাইবে। অধিকক্ষণ জালে রাখিলে তাহা চিমড়া ও কঠিন হইয়া গিয়া অখাদ্য হইবে।

৭২। পাঁটার মেটে ভাজি।

 পাঁটা, খসি ও ভেড়া প্রভৃতির মেটে, কলিজা, মধুকোষ ও মূত্রকোষ (Kidney) নুণ, হলুদ, মরিচ বা লঙ্কা বাটা, আদা বাটা এবং রুচী অনুসারে পেঁয়াজ বাটা এবং কিঞ্চিৎ অম্লরস ও চিনি দিয়া মাখিয়া লইয়া ঘৃতে ভাজ। অল্প জল দিয়া সিদ্ধ করিয়া লও। শুকাইয়া নামাও।

৭৩। পাঁটার মস্তিষ্ক ভাজি।

 পাঁটা, খাসি, ভেড়া প্রভৃতির মাথার ‘ঘি’ বা মস্তিষ্ক বাহির করিয়া ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া লও। চাকা চাকা করিয়া কুটিয়া নুণ, মরিচ গুঁড়া, আদার রস, পেঁয়াজের রস, কিঞ্চিৎ অম্লরস ও চিনি (এবং ডিমের শাঁস) দিয়া মাখিয়া সুজী, ময়দা বা ব্রেডক্রাম্বের উপর গড়াইয়া লও, স্বতে ভাজ।

৭৪। মেষের জিহ্বা ভাজি।

 মেষের জিহ্বা কাটিয়া সাফ করিয়া লও। জলে সিদ্ধ কর। উপরের ছাল উঠাইয়া ফেল। নুণ, মরিচ গুঁড়া, আদার রস, পেঁয়াজ রস, কিঞ্চিৎ অম্লরস ও চিনি (এবং ডিমের শাঁসের বাঁধন) দিয়া মাখিয়া সুজী, ময়দা বা ব্রেডক্রান্তের উপর গড়াইয়া লইয়া ঘৃতে ভাজ।

৭৫। মাংস ভাজি।

 মৎস্যের ন্যায় মাংস ও বিবিধ প্রকারে ভাজা যায়। এতৎসম্বন্ধে নিয়ে ‘কাবাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘পোড়া’মাংস রন্ধনের সহিত এক সঙ্গে বিস্তারিত লিখিত হইল। অনেকগুলি কাবাব বৈদেশিক হইলেও সকলগুলি সম্পূর্ণ বৈদেশিক বলিয়া বোধ হয় না। লিখিত ‘কাবাব’ রন্ধনপ্রণালী পর্য্যালোচনা কবিলে তাহা সর্ব্বত্র যে বরেন্দ্র রন্ধন প্রণালীর প্রতিকূল নহে তাহা প্রতিভাত হইতে পারে।

কাবাব (বৈদেশিক)

“বুভুজে দেবসাৎ কৃত্বা শূল্যমুখ্যঞ্চ হোমবান্।”—ভট্টিকাব্য।৪।৯

 ‘কাবাব’ নামটি বৈদেশিক হইলেও প্রাচীন ভারতবর্ষে মাংসের দ্বারা প্রস্তুত এবম্বিধ আহারীয় ভোজনের প্রথা অপ্রচলিত ছিল বলিয়া বোধ হয়। আমার কথার পোষকতায় ভট্টিকাব্য হইতে উপরি লিখিত শ্লোকার্দ্ধটি উদ্ধৃত করিয়া দিলাম। ভারতে মুসলমান আগমনের বহু পূর্ব্বে (খৃঃ সপ্তম শতাব্দে) ভট্টিকাব্য গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, সুতরাং তাহার উক্তি ‘বৈদেশিক’ ভাব প্রণোদিত বলিয়া মনে করিবার কারণ নাই। উদ্ধৃত শ্লোকার্দ্ধের অর্থ, “হোমকার্য্য সমাপনপূর্ব্বক (শ্রীরামচন্দ্র) শূলে এবং উবায় (স্থালীতে) সংস্কৃত বা পক্ব মাংস দেবতাদিগকে নিবেদন করিয়া (স্বয়ং) ভোজন করি লেন।” (জয়মঙ্গলের টীকা দ্রষ্টব্য)। পাঠক পাঠিকা লক্ষ্য করিবেন, হোমকারী অর্থাৎ পরমশুদ্ধাচারী দ্বিজাতি আর্যসন্তান, এমন কি বর্তমান ক্ষেত্রে স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র, শূল্য উখ্য ভেদে বিবিধ প্রকারে পক্ব মাংস আহার করিলেন। কেমন করিয়া আহার করিলেন?—না, দেবসাৎ কৃত্বা—দেবতাগণকে নিবেদন করিয়া আহার করিলেন। তাহা হইলেই দেখা যাইতেছে যে পরমনৈষ্ঠিক হিন্দুসন্তানের পক্ষেও তৎকালে শূল্য উখ্য ভেদে পক্ব মাংস অর্থাৎ বর্ত্তমানে যাহাকে কাবাবাদি বলা যাইতেছে তাহা ভোজন ত নিষিদ্ধ ছিলই না পরন্তু উহা দেবোদ্দেশে নিবেদন করাও প্রথা ছিল। বর্তমানকালেও ভারতের বহু প্রদেশে এমন কি নিজ বরেন্দ্রেও মাংসাহার প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত আছে এবং এই শ্লোকার্দ্ধে লিখিত শূল্য উখ্য ভেদে বিবিধ উপায়েই এখনও মাংস রন্ধন হইয়া থাকে। কিন্তু ইউরোপীয় এবং মুসলমানগণের মধ্যে মাংস রন্ধন বর্তমানে যেরূপ উৎকৃষ্ট হইয়া থাকে অম্মদ্দেশে তাদৃশ হয় না। আমরা এক্ষণে মাংস পাক একরূপ ভুলিয়া গিয়াছি বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সাধারণতঃ ‘কালিয়া’ ছাড়া অপর কোনও প্রকারে মাংস রন্ধনের চেষ্টা আমাদের মধ্যে আজিকালি আর বড় দেখা যায় না। এই নিমিত্ত এক্ষণে মাংস রন্ধন সম্বন্ধে লিখিতে হইলে বৈদেশিক রীতির আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। মুসলমানী ‘কাবাব’ ‘কোপ্তা’ অথবা ইংরাজী ‘রোষ্ট কটলেট’ ‘চপ’ ‘স্টেক’ প্রভৃতি বলিলে যাহা বুঝায় আমি তাহা ‘শূল্য’ ‘উখ্য’ ভেদে বিভাগ করিয়া এই ‘কাবাব’ অধ্যায়ের অন্তর্গত করিয়া এখানে লিপিবদ্ধ করিলাম।

 শিক-কাবাবাদি যে হিন্দুর অতি প্রাচীন নিজস্ব খাদ্য তাহার বিশেষ প্রমাণ পাণিনির ৪।২।১৭ সূত্র—“শুলোখাদ্ যৎ।” অর্থাৎ-“শূলে সংস্কৃতং শূল্যং মাংসম। উখ্যম্।”

 মৎস্য বা মাংসে আবশ্যকমত ঝাল, নুণাদি ও তৎসহ ধৃত মাখিয়া প্রদীপ্ত আঙ্গারের উপর ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝল‍্সাইয়া লইলেই ‘কাবাব’ প্রস্তুত হইল।

 মাংস ঘৃতে ভাজিয়া লইলেও অনেকস্থলে তাহাকে ‘ভাজি’ না বলিয়া ‘কাবাব’ বলা হইয়া থাকে। অতএব আমরা মোটামুটি দুই রকমের কাবাব পাইতেছি, প্রথম-আগুণে ঝল‍্সান কাবাব, দ্বিতীয়—ঘৃতে ভৰ্জ্জিত কাবাব। আগুণে ঝল‍্সান কাবাবে সচরাচর মাংস লৌহ শিকে বা শূলে ফুঁড়িয়া তবে আগুণের উপর ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝল‍্সান হইয়া থাকে, এই নিমিত্ত এই রকমের কাবাবকে ‘শূল্য’ বা ‘শিক্-কাবাব’ বলা হয়। দ্বিতীয় রকমের কাবাব কোন পাত্রে বা পাকস্থালীতে করিয়া ঘৃতে ভাজিতে হয় বলিয়া তাহাকে ‘উখ্য’ বা ‘হাঁড়ী-কাবাব’ বলা হইয়া থাকে।

 শূল্য বা শিক-কাবাব প্রকরণ ভেদে ইংরাজি গ্রিল‍্দানী প্রভৃতিতেও পাক হয় এবং উখ্য বা হাঁড়িকাবাব প্রকরণ ভেদে হাঁড়িতে, কড়াইয়ে, তৈয়ে বা ইংরাজি ফ্রাইপ্যানে ভাজা হইয়া থাকে।

 শূল্য এবং উখ্য এই উভয়বিধ কাবাবের প্রত্যেককে আবার তিন ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। প্রথম, গোটা পক্ষীব অথবা ছাগ বা মেষাদির গোটা রাঙ্গ বা পিঠের শির-দাঁড়ার মাংসের দ্বারা কাবাব।

 দ্বিতীয়, হাড়বিহীন কোমল মাংস অপেক্ষাকৃত বড় বড় খণ্ডে কুটিয়া লইয়া, তাবা কাবাব। (ইহা ভারি ছুরি, কাটারী বা ‘চপার’ অথবা কাষ্ঠেব হাতুড়ির দ্বারা একটু থুরিয়া বা ছেঁচিয়া লইতে হয়।)

 তৃতীয়, মাংসখণ্ড ধারাল কাটারীর বা চপারের দ্বারা সূক্ষ্ম কিমা করিয়া বা কুচাইয়া এবং তৎপর স্থলবিশেষে পুনরায় তাহা হামানদিস্তা বা পাটায় ফেলিয়া উত্তমরূপে পিষিয়া লইয়া তদ্বারা কাবাব।

 ‘শূল্য’ ও ‘উখ্য’ ভেদে এই ষড়বিধ কাবাবের রন্ধন-প্রণালী সম্বন্ধে নিম্নে লিখিত হইতেছে। এই ষড়বিধ কাবাব আবার বিভিন্ন প্রকারের মশল্লাদি ও পূর ভেদে এবং পাকপ্রণালীর কিঞ্চিৎ তারতম্যে বহু প্রকারের হইয়া থাকে। ‘পাকপ্রণালী’, ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ প্রভৃতি রন্ধন-গ্রন্থে তাহার তালিকা ও রন্ধনপ্রণালী বিস্ত‌ৃত ভাবে দেওয়া হইয়াছে। এই গ্রন্থে সেরূপ বিস্ত‌ৃত তালিকা না দিয়া দুই চারিট উদাহরণ সহ শুধু প্রধান প্রধান ছয় প্রকারের কাবাবের রন্ধনপ্রণালী লিখিত হইবে। আশা করি, তাহারই সাহায্যে বিবিধ প্রকারের কাবাব কি উপায়ে রাঁধিতে হইবে পাঠক পাঠিকা বুঝিয়া লইতে সক্ষম হইবেন।

ক। শূল্য।

(১) আস্ত বা গোটা মাংসের শূল্য বা শিক-কাবাব।

১। হংস শূল্য।

 একটি মারা গোটা পাতী হাঁস লইয়া উত্তপ্ত জলে ডুবাও। একটু পরে উঠাইয়া ঠাণ্ডা জলে ডুবাও। এখন সমস্ত পালক টানিয়া উপাড়িয়া ফেল। সাবধান, যেন হাঁসের গাত্র চর্মটি ছিঁড়িয়া বা উঠিয়া না যায়। তৎপর অভ্যন্তরের অন্ত্রাদি বাহির করিয়া ফেলিয়া হাঁসটি জলে ধুইয়া উত্তমরূপে সাফ করিয়া লও। ডানা ও পায়ের মাংস-শূন্য অগ্রভাগ কাটিয়া ফেলিয়া পায়ের অবশিষ্ট অংশ বাঁকাইয়া ডানার নিচে মাংসের মধ্যে ফুঁড়িয়া ঢুকাইয়া দাও, এবং ঠোট হইতে চক্ষু পর্য্যন্ত কাটিয়া ফেলিয়া মাথার অবশিষ্ট অংশ গলা সহ বাঁকাইয়া ডানার নিচে আটকাইয়া দাও। অতঃপর হাঁসের পেটের মধ্যে লম্বালম্বি ভাবে গলার দিক দিয়া একটি লৌহ শিক চালাইয়া দিয়া পেছন দিক দিয়া তাহার ডগা বাহির করিয়া রাখ। ইহাতে দুই হাতে শিকের দুই মুড়া ধরিয়া পক্ষীটি আগুণের উপর অনায়াসে ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝলসাইতে পারিবে।

 পাখীর গায়ে নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, আদা ও পেঁয়াজ বাটা বা রস ও কিঞ্চিৎ অম্লরস, চিনি ও পরিশেষে ঘৃত মাখিয়া প্রদীপ্ত গমগমে অঙ্গারের উপরে বা এক পার্শ্বে অতি নিকটে ধরিয়া অথবা শিকটি দুইটি আশ্রয় দণ্ডের উপর স্থাপন করিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝলসাও। মধ্যে মধ্যে পাখীটি ঘৃতসিক্ত করিবে, যেন ছেঁচড়া পোড়া হইয়া না যায়। প্রথমে আগুণের খুব সন্নিকটে ধরিয়া ঝলসাইবে। উপরে একটু লাল‍্চে হইলেই অপেক্ষাকৃত তফাতে ধরিয়া ঝলসাইবে। তাহা হইলে উপরিভাগ ঈষৎ কঠিন হইয়া অভ্যন্তরের রস নির্গম পথ রুদ্ধ করিবে এবং পরে তফাতে রাখিলে ধীরে ধীরে অভ্যন্তর ভাগ সুপ হইবে অথচ উপরে আর অতিরিক্ত পুড়িয়া যাইবে না। উপরন্তু পী আগুণের উপর হইতে সরাইয়া এক পার্শ্বে ধরাতে তাপে পক্ষীর গাত্র হইতে যে ঘি টপ টপ করিয়া গড়াইয়া পড়িবে তাহা আগুণের উপর পড়িয়া নষ্ট না হইয়া নিচে একখানা পাত্র রাখিয়া ধরা যাইবে। ঝলসান ঠিক হইয়াছে কিনা জানিবার জন্য একটি তীক্ষ্ণ লৌহ-শলাকা মধ্যে মধ্যে পাখীর গায়ে ফুঁড়িয়া দিয়া দেখিবে মাংস বেশ মোলায়েম হইয়াছে কি না। সরস রহিয়া সুপক্ব হইয়াছে বুঝিলে নামাইবে। শূল্যের রঙ্গ সুন্দর লালাভ করিবার প্রয়োজন হইলে এক খণ্ড উত্তপ্ত লৌহ এই সময়ে পক্ষীর গায়ের উপর দিয়া অথচ গাত্র স্পর্শ না করিয়া বুলাইয়া লইবে।

 হাঁসের ন্যায় অপরাপর পক্ষী, খরগোশাদি, হরিণ, পাঁঠা বা ভেড়ার রাঙ্গ ৰা শির-দাঁড়ার কোমল মাংসে শূল্য হইতে পারে।

 ‘ওয়ারেনের কুকিং পট’, ‘ইকমিক কুকার’ বা ‘জগে’ পক্ষী, খরগোশাদি গোটা বা খণ্ড খণ্ড করিয়া পুরিয়া নুণ, মরিচ গুঁড়া, আদা পেঁয়াজাদি বাটা সহ জলের ভাপের উত্তাপে ‘বেক’ বা পুট-পাক করিয়াও সুন্দর কাবাব রাঁধা যায়। গ্রিলদানীর ন্যায় এক প্রকার বেকিংপ্যানে বা পাত্রে করিয়া গোটা পরিষ্কৃত পক্ষী খরগোশাদি উত্তপ্ত তুন্দর বা তেজালের মধ্যে রাখিয়া ‘বেক’ বা পুটপাক করিলেও অতি সুন্দর কাবাব প্রস্তুত হইবে। তৎক্ষেত্রে পক্ষীর গায়ের উপর কিছু ময়দা পাৎলা করিয়া ছড়াইয়া লাগাইয়া দিতে হইবে। নুণ, মরিচ গুঁড়া, আদার রস ও পেঁয়াজের রসাদি ও ঘৃত দ্বারা অবশ্য তৎপূর্ব্বে পক্ষীটি মাখিতে হইবে।

ক। শূল্য।

(২) খণ্ড-মাংসের শূল্য বা ছেঁচা শিক-কাবাব।

 বড় পক্ষীর বুক, ডানা ও পায়ের মাংস অথবা হরিণ, মেষ, ছাগ, খরগোশাদির রাঙ্গ বা শির-দাঁড়ার কোমল মাংস অপেক্ষাকৃত বড় বড় খণ্ডে কুটিয়া লও। কাটারী, চপার বা কাঁষ্ঠের হাতুড়ি দ্বারা কিছু থুরিয়া বা ছেঁচিয়া চেপ্টা গোছের করিয়া লও। এই সময় নুণ, মরিচ গুঁড়া (বা লঙ্কা বাটা), আদা বাটা, পেঁয়াজ ও রশুন বাটা, কিঞ্চিৎ অম্লরস, চিনি এবং বাঁধন স্বরূপ কিছু চাউলের গুঁড়া, এরারুট বা পক্ষীর ডিমের শাঁস ও পরিশেষে মৃত মাংসে খাওয়াইবে। খানিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। অবশেষে এই মাংস খণ্ড গুলি শিকে ফুঁড়িয়া অথবা গ্রিলদানীর উপর রাখিয়া অমনি বা তদুপরি কিঞ্চিৎ ময়দা ছিটাইয়া দিয়া লৌহ শিক অথবা গ্রিলদানী গম‍্গমে প্রদীপ্ত অঙ্গারের উপর ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝাল‍্সাও। মধ্যে মধ্যে ঘৃত খাওয়াইবে, যাহাতে ছেঁচড়া পোড়া না হইতে পারে। মাংস প্রথমে আগুণের খুব নিকটে ধরিয়া ঝল‍্সাইবে পরে তফাৎ ধরিবে। সরস রহিয়া সুপক্ব হইলে নামাইয়া আহার কর।

 এই হইল সাদাসিদে ছেঁচা শিক কাবাব। যাঁহারা ইহা অপেক্ষা অধিকতর মশলাদার ছেঁচা কাবাব খাইতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা উপরি লিখিত মশল্লার সহিত অতিরিক্ত ধনিয়া বাটা, জিরা বাটা, তেজপাত বাটা, গরম-মশল্লা বাটা, জাফরান এবং ইচ্ছা করিলে, তৎসহ আরও দধি, মোয়া ক্ষীর, মালাই, বাদাম বাটা প্রভৃতি রুচী অনুসারে মাখিয়া লইতে পারেন। এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ সংযোগে এবং প্রণালীর কিঞ্চিৎ তারতম্যে বিভিন্ন রকমের ছেঁচা কাবাব রাঁধা যাইতে পারে। এই শ্রেণীর কাবাব গ্রিলদানীতে সাজাইয়াও আগুণে ঝল‍্সাইয়া লওয়া যাইতে পারে। যথা—

২। মটন চপ।

 মেষের ঘাড়ের বা পিঠের শির-দাঁড়ার (Saddle) উভয় পার্শ্বের কোমল মাংসের দ্বারাই উত্তম চপ প্রস্তুত হইয়া থাকে। এক একটী পাঁজড়ার হাড়ের সহিত নাতিবৃহৎ এক এক টুকবা মাংস বাধাইয়া রাখিয়া অপরাপর অতিরিক্ত হাড়াদি কাটিয়া ফেল। পাঁজড়ার যে হাড়টি অবশিষ্ট রহিল তাহারও দুই তিন আঙ্গুল পরিমিত রাখিয়া অবশিষ্ট কাটিয়া ফেল। এক্ষণে মাংস খণ্ডগুলি একখানা মজবুত গোছের কাপড়ে (ঝাড়নে) মুড়িয়া লইয়া কাটারী বা চপারের উল্টা পিঠ দিয়া বা কাঠের হাতুড়ি দ্বারা আবশ্যক মত থেঁৎলাইয়া লও। কাপড়ে মুড়িয়া লইলে থেঁৎলাইবার সময় মাংসখণ্ড গুলি ভিন্ন বা বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে না। নুণ, মরিচ গুঁড়া, একটু ওয়ারসেষ্টারসায়ার সস অর্থাৎ অম্নরস এবং ঘৃত বা তৈল (Salad oil) দ্বারা মাংস খণ্ডগুলি মাখিয়া ঢাকিয়া রাখ। অতঃপর একখানি গ্রিলদানীতে ঘৃত মাখিয়া প্রদীপ্ত গম‍্গমে অঙ্গারের উপর বসাও। তাতিলে মাংসখণ্ডগুলি তাহার উপর সাজাও। এক পিঠ ঝল‍্সান হইলে অপর পিঠ উণ্টাইয়া দাও। মধ্যে মধ্যে ঘি বা তৈল দ্বারা সিক্ত করিবে, যেন ছেঁচড়া পোড়া না হয়। সরস রহিয়া সুপক্ব হইলে উপরে কিছু ঠাণ্ডা জলের ছিটা দিয়া গ্রিলদানীর উপর রাখিয়াই গরম গরম পরিবেশন কর।

৩। পক্ষীর গ্রিল।

 পক্ষী রোষ্টের উপযোগী করিয়া প্রস্তুত করিয়া লও। পিঠের শিরদাঁড়া লম্বালম্বি ভাবে চিরিয়া ফেলিয়া পক্ষীটি মেলাইয়া রাখ। ভিতর হইতে বুকের হাড় খুলিয়া ফেল। পা দুখান ডানার নিচে রোষ্ট প্রস্তুতের সময় যেমন ভাবে গুঁজিতে হয় ঐ ভাবে গুঁজিয়া দাও। খবরদার যেন বুকের উপরের চাম‍্ড়া ছিঁড়িয়া না যায়। নুণ, মরিচের গুড়া, কিঞ্চিৎ অম্লরস, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা ও তৈল (সালাদ অয়েল) বা ঘৃত দ্বারা মাখিয়া থানিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। তৈয়ে বা ফ্রাই প্যানে ঘি তাতাইয়া তাহার উপর পক্ষীটি চিৎ করিয়া মেলাইয়া দাও। উপরে একখানা তাওয়া চাপা দিয়া তদুপরি একটা ভারি পদার্থ (যথা জলের কেট‍্লি বা লৌহ হামান দিস্তা) চাপাও। এক পিঠ আধভাজা হইলে উল্টাইয়া অপর পিঠ আধভাজা কর। অতঃপর প্রদীপ্ত গম্গমে অঙ্গারের উপব গ্রিলদানী বসাইয়া তাহার উপর ঐ আধভাজা পক্ষীটি রাখিয়া ঝল‍্সাও। মধ্যে মধ্যে ঘৃত সিক্ত করবে যেন ছেঁচড়া পোড়া না হয়। সরস রহিয়া সুপক্ব হইলে নামাও।

ক। শূল্য।

(৩) কিমা মাংসের শিক-কাবাব বা কোপ্তা।

 পক্ষী, শেষ অথবা ছাগ মাংসের কোমল অংশ লইয়া হাড়াদি বাছিয়া ফেল। (পক্ষীর বুকের মাংস এবং ছাগ মেষাদির রাঙ্গ ও শির-দাঁড়ার কোমল অংস লইবে।) কাটারী বা চপার দ্বারা উত্তমরূপে মাংস কিমা কর বা কুচাও। কিমা আরও মিহি করিতে ইচ্ছা করিলে মাংস পুনরায় হামানদিস্তায় বা পাটায় ফেলিয়া পিষিয়া লইবে। মাংস খুরার এক প্রকার কল পাওয়া যায়। তাহাতে.মাংসখও ফেলিয়া কল ঘুরাইলে মাংস সুন্দর খুরিত হইয়া বাহির হয়। তৎক্ষেত্রে আর কাটারী বা চপার দ্বারা খুরার প্রয়োজন হয় না।

 এক্ষণে নুণ, মরিচ বাটা বা লঙ্কা বাটা, আদা বাটা ও পেঁয়াজ ও রশুন বাটা এবং কিঞ্চিৎ অম্লরস ও চিনি দিয়া কিমা মাংস বেশ করিয়া চট্ কাইয়া মাখ ও অল্প চাউলের গুড়ায়, এরোরুটে বা ময়দায় ঘৃত ময়ান দিয়া তাহা কিমা মাংসের সহিত উত্তমরূপে মাখিয়া কিমা আঁটিয়া বা বাঁধিয়া লও। ডিম্বের ফেনান শাঁসের দ্বারাও কিমা মাংস উত্তম আঁটিয়া লওয়া চলে। খানিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। পরে এই কিমা মাংস লইয়া হাতে চাপিয়া ছোট, ছোট গোল গোল বা চেপ্টা চেপ্টা কোপ্তা বা টিকলি প্রস্তুত কর। এই টিকলি বা কোপ্তা গুলি লৌহ শিকে (শূলে) সারি সারি ফুঁড়িয়া গম‍্গমে প্রদীপ্ত অঙ্গারের উপর ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝল‍্সাও। মাংসে মধ্যে মধ্যে ঘৃত খাওয়াইবে যেন ছেঁচড়া পোড়া হইতে না পারে। সরস রহিয়া সুপক্ব হইলে নামাও।

 এই হইল সাদা সিদে কুচা বা কিমা শিক কাবাব। যাঁহারা ইহাপেক্ষা অধিকতর মশলাদার কাবাব খাইতে ইচ্ছা করেন তাহারা উপরি লিখিত মশলাব সহিত ধনিয়া বাটা, জিরা বাটা, তেজ পাত বাটা, গরম মশল্লা বাটা, জাফ‍রান, এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ আরও দধি, ভাজা মোয়া ক্ষীর, মালাই, বাদাম বাটা প্রভৃতি রুচি অনুসাবে মিশাইয়া কিমা মাংস ঝলসাইয়া লইত্বে পারেন। কিম কাবাবে বাটনা খুব মিহি হওয়া আবশ্যক নচেৎ তাহা কাঁচা থাকিয়া যাইবে, আবার কিমা মাংস অধিকতর মিহি হইলে তাহাতে কাঁচা বাট‍্না আদৌ না মিশাইয়া লঙ্কা, ধনিয়া, জিরা, তেজপাত ও গরম মশল্পাদি কাঠখোলায় বা ঘৃতে ভাজিয়া উত্তমরূপে পিষিয়া লইয়া কিমা মাংসের সহিত মিশান প্রশস্ত। পেঁয়াজ রশুন এবং বাদামও ঘৃত ভাজিয়া পিষিয়া লইয়া মিশাইতে হইবে।

 কিমা মাংসের দ্বারা ছোট ছোট কোপ্তা না গড়িয়া—বিশেষতঃ কিমা মাংস মাখা গিলা গোছ হইলে—উহা শিকের উপর মুঠা করিয়া চাপিয়া লাগাইয়া দিয়া সূতার দ্বারা বাঁধিয়াও ঝল‍্সান. যাইতে পারে। ইহাকে 'মুঠী-কাবাব’ বলে। এইরূপ প্রণালী এবং মশল্লাদি ভেদে বিভিন্ন রকমের কুচা বা কিমা শিক-কাবাব হইয়া থাকে।

খ। উখ্য।

১) গোটা বা আস্ত মাংসের উখ্য বা হাঁড়ী-কাবাব।

৩। পক্ষী রোষ্ট।

 এক মোটা সোটা কেপন মারিয়া উত্তপ্ত জলে ডুবাও। একটু পরে উঠাইয়া পুনঃ ঠাণ্ডা জলে ডুবাও। এক্ষণে পালক ধরিয়া টানিলে সহজেই সব পালক উপড়াইয়া যাইবে। সমস্ত পালক উপড়াইয়া ফেলিয়া পরে অভ্যন্তরের অন্ত্রাদি বাহির করিয়া ফেলিয়া পক্ষীটি জলে ধুইয়া উত্তমরূপে সাফ করিয়া লও। খবরদার যেন উপরের চামড়া ছিঁড়িয়া না যায়।

 এক্ষণে পা ও ডানার অগ্র ভাগ কাটিয়া ফেলিয়া অবশিষ্ট মাংস বিশিষ্ট পায়ের হাড় বাঁকাইয়া ডানার নিচে মাংসে ফুঁড়িয়া ঢুকাইয়া দাও। মাথা সহ গলার হাড় টুকু কাটিয়া ফেল। শীকার লব্ধ পক্ষী হইলে গলা কাটিয়া না ফেলিয়া কেবলমাত্র চক্ষু সমেত ঠোঁটটা কাটিয়া ফেলিয়া মাথাটা গলা বাঁকাইয়া ডানার নিচে আঁট‍্কাইয়া দিবে। সাবধান, যেন মাথার ঘি টুকু নষ্ট না হয়। এইরূপে পাদুটি এবং মাথা বাঁকাইয়া ডানার নিচে আবদ্ধ করিলে পক্ষীটি বেশ গোলগাল ধরনের হইয়া কাবাব পাকের উপযোগী হইবে।

 এক্ষনে উখায় বা হাঁড়িতে ঘি তাতাইয়া পক্ষী ছাড়। এপিট ওপিট, করিয়া কষাইয়া বেশ লাল‍্চে ধরনের কর। এখন অতিরিক্ত যি টুকু ঢালিয়া রাখিয়া হাঁড়িতে গরমজল (আন্দাজ মত) ঢালিয়া দাও। আদা চাকা, পেঁয়াজ চাকা, নুণ ও গোলমরিচের গুঁড়া ছাড়। সিদ্ধ হইলে একটু চিনি দাও। পরে উনান হইতে উঠাইয়া উনার এক পাশে ‘দমে’ রাখিয়া দাও। সুসিদ্ধ হইলে হাঁড়ি হইতে পক্ষীটি বাহির করিয়া পাঁচ টুকরা করিয়া (দুখানি পা, দুখানি ডানা ও বুক) কাটিয়া একখানা ডিসে বা পাত্রে সাজাও। তৎপর ঝোল টুকু জাল দিয়া কিঞ্চিৎ ঘন করিয়া ইহার উপর ঢালিয়া দিয়া খাইতে দাও। ওয়ারসেক্টরসায়ার সস্ এবং রাই সরিষার গুঁড়া সহ খাইতে ভাল।

 এই সাদাসিদা রোষ্ট’ (Roast) বা ‘হাঁড়ি-কাবাব' রোগীর পথ্যরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ইহা অবশ্য গুরু পাক করিয়া রাঁধাও চলে।

 গুরুপক্ব হাঁড়ি-কাবাব—উপরিলিথিত মত রোষ্টর উপযোগী করিয়া প্রস্তুত পাখীর পেটের মধ্যে নিম্নলিখিত ভাবে প্রস্তুত কোন একটা পুর (Stuffing) ভরিয়া দিয়া পাখীর চামড়া ভাঁজাইয়া ফুটোর মুখ বন্ধ করিয়া পিঠের উপর আঁটিয়া দাও এবং লেজের দিকে লেজটা ভাঁজ করিয়া ঐ দিকের ফুট বন্ধ করতঃ নিচের দিকে পাখীর গায়ে ফুঁড়িয়া গুঁজিয়া দাও পাখীতে নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা মাখিয়া কিছুক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। হাড়িতে ঘি চাপাও। তাতিলে পাখী ছাড়। এপিট্ ওপিট করিয়া লালচে রং করিয়া কষ। গরম জল (আন্দাজ মত) দাও। ছোট-এলাচী, দারুচিনি ও খান দুই তেজপাত ছাড়। সুসিদ্ধ হইলে হাঁড়ি হইতে পাখী নামাইয়া পাঁচ টুক‍রা করিয়া কাটিয়া একখানা ডিসে বা পাত্রে সাজাও। অতঃপর ঝোলে আমের ভিনিগার-চাটনি (অম্লরস) এবং তৎপর একটু ময়দা মিশাইয়া জাল দিয়া গাঢ় করিয়া লইয়া পাখীর উপর ঢালিয়া দিয়া খাইতে দাও।

 ব্রেজ (Braise)—একটী পাত্রে ঘি ছাড়িয়া তাতাও। ছোট এলাচি, দারুচিনি ও খান দুই তেজপাত, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা, একটু লঙ্কা বাটা ছাড়িয়া কষাও। আমের চাট‍্নি (অম্লরস) ও লবণ মিশাও। একটু ময়দা মিশাও। নাড়িয়া চড়িয়া উপরি লিখিত বিধানে পক্ব রোষ্টের ঝোল (Gravy) টুকু ইহার উপর ঢালিয়া দাও। ফুটিলে তন্মধ্যে রোষ্ট পাখীটি পাঁচ টুক‍‌রা করিয়া কাটিয়া ছাড়। সব বেশ মিশিয়া থক্ থকে গোছ হইলে নামাও ‘ব্রেজ' রাঁধিতে স্থালীর ঢাকনের উপরও প্রদীপ্ত কয়লা দেওয়া হইয়া থাকে। অল্প সাদা পোলাও রাঁধিয়া এই ব্রেজের সহিত একত্রে পরিবেশন করিবে।

 হাঁড়ী-কাবাবের গোটাকয়েক সাধারণ পূর বা ষ্টাফিং (Stuffing):

 (ক) কাঁচা আলু চাকা, কাঁচা পেঁয়াজ চাকা, আদা চাকা, নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, রাইসরিষার গুঁড়া ও লেবুর রস বা সির্কা সব এক সাথে মাখিয়া পাখীর পেটের মধ্যে পূরিয়া দাও। ইহার সহিত পাখীর মেটে প্রভৃতি কুচাইয়া মিশাইতে পার।

 (খ) আলু সিদ্ধ করিয়া ছানিয়া লও। নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, ওয়ারসেষ্টারসায়ার সস্ ও চিজের (পনিরের) গুঁড়া এক সঙ্গে বেশ করিয়া মাখিয়া পাখীর পেটের মধ্যে পূরিয়া দাও।

 (গ) বাদাম, পেস্তা, কিস‍্মিস্ কুচি কুচি করিয়া কাটিয়া লও। একটু জাফরান, ছোট এলাচীর গুঁড়া, দারুচিনির গুঁড়া মিশাও। পাউরুটী দুধে ভিজাইয়া চিপিয়া লইয়া নুণ ও গোলমরিচের গুঁড়া এবং উপরোক্ত সমস্ত উপকরণ সহ এক সাথে মাখিয়া পাখীর পেটের মধ্যে পূরিয়া দাও। ইহার সহিত ইচ্ছা করিলে চিজের গুঁড়া ও মিশাইয়া লইতে পার।—ইত্যাদি।

 বড় চিংড়ী এবং পাকা রুই প্রভৃতি মোটা মাছের এই সকল প্রকারে মাংসের ন্যায় হাঁড়ি-কাবাব রাঁধিতে হয়।

৪। পায়রার রোষ্ট (Roast.)

 পায়রার পালক, হাতে উপড়াইয়া ফেলিয়া পিছন দিকে একটু কাটিয়া অন্ত্রাদি বাহির করিয়া ফেল। তৎপর আগুনে একটু ঝলসাইয়া লইয়া অবশিষ্ট পালক পোড়াইয়া উঠাইয়া পাখীটি বেশ সাফ করিয়া লও। খবরদার যেন উপরের চামড়া ছিঁড়িয়া না যায়। এখন পা, ডানা এবং চোখ সহ মাথার ডগা টুকু কাটিয়া ফেলিয়া অথবা মাত্র চোখ দুটি তুলিয়া ফেলিয়া পা ও মাথা ডানার নিচে উপরি লিখিত বিধানে গুঁজিয়া দিয়া পাখীটি বেশ গোলগাল করিয়া রোষ্টের উপযোগী কর। এক্ষণে হাঁড়িতে ধৃত বা মাখন তাতাইয়া নুণ ও গোল মরিচের গুঁড়া মাখিয়া পাখী ছাড়। কম। সামান্য একটু জল দাও। ফুটিলে উনানের উপর হইতে সরাইয়া এক পার্শ্বে অল্প তাতে হাঁড়ি দমে বসাইয়া রাখ। মধ্যে মধ্যে দেখিবে যেন পুড়িয়া না লাগে। পাখী বেশ মোলায়েম হইলে পুনরায় উনানের উপর হাঁড়ি বসাইয়া বেশ করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া পাখীটির লাল‍্চে রং করিয়া নামাও। অতঃপর পাখীটি অপেক্ষাকৃত বড় হইলে দুই টুকরা করিয়া কাটিয়া লও। ঝোলের সহিত সামান্য একটু জল এবং ওয়ারসেষ্টারপায়ার সস্ মিশাও। জ্বাল দাও। কর্ত্তিত পক্ষীর টুকরা গুলি হাঁড়ির মধ্যে পুনঃ ছাড়িয়া নাড়িয়া চাড়িয়া শুকাইয়া নামাও।

 সরাইল, নারিয়াল (teal), হরিয়াল, ঘুঘু, স্নাইপ (চা), বগেরি, বটেরি, তিতির, বাটাম (plover), ডাহক প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট পক্ষীর রোষ্ট এই প্রকারে রাঁধিতে হয়। ইহার সহিত শুক্লা লঙ্কার গুঁড়া, ঘৃতে ভাজা পারুটীর গুঁড়া ও লেবুর রস মাখিয়া পাট আলু ভাজির সহিত খাইতে ভাল।

 পক্ষীর ডেভিল (Devil)-পক্ষীর গ্রিল বা হাঁড়ী-কাবাব ঘৃতে ভাজিয়া পক্ষীটি উঠাইয়া রাখ। এখন ঐ ঘৃতে তেজপাতা, গরম মশল্লা ও পেঁয়াজ কুচি ছাড়িয়া কষ। লাল‍্চে হইলে কিছু ময়দা ছাড়। নাড়িয়া চাড়িয়া একটু গরম জল দাও। ভাজা পক্ষী ছাড়। কিছু অমের ভিনিগার-চাট্ কিমা করিয়া মিশাও। নাড়। ঝোল গামাখা গামাখা হইলে নামাও। পায়রা, হরিয়াল, ঘুঘু, বটেরী, ডাহুক প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট শীকারলব্ধ পক্ষীরই ভাল ‘ডেভিল’ প্রস্তুত হয়।

৫। মুছল্লম কাবাব।

 বড় পক্ষী যথা হাঁস, কেপনাদি রোষ্টের উপযোগী করিয়া প্রস্তুত কর।

কাৱাণ্ট, কিস‍্মিস্, বাদাম, পেস্তা ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া কুচি কুচি করিয়া নুণ, গোল মরিচের গুঁড়া, পেঁয়াজ কুচি, গরম মশল্লার গুঁড়া, জাফরান সহ একত্রে পক্ষীর পেটের মধ্যে পুরিয়া বন্ধ করিয়া দাও। এক্ষণে পক্ষীটির হাঁড়ি-কাবাব রাঁধ। অন্য হাঁড়িতে ঘৃত জ্বালে চড়াইয়া গরম মশল্লা, আদা, পেঁয়াজ, একটু লঙ্কা বাটা ও নুণ ছাড়িয়া কষ। একটু দধি দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া তদুপরি রোষ্ট পক্ষীর ঝোলটুকু ঢালিয়া দাও। পুনঃ নাড়িয়া গোটা পক্ষীটি ছাড়। ঝোল বেশ থক‍্থকে গোছ হইয়া আসিলে নামাও।

 ইহা একটা মশলাদার গুরুপক্ব হাঁড়ি-কাবাবের উদাহরণ।

খ। উখ্য।

(২) খণ্ড-মাংসের হাড়ি কাবাব।

৬। কাটলেট (Cutlet.)

 ‘কাট‍্লেট’কে আমি খণ্ড-মাংসের হাঁড়ি-কাবাবের একটা সুন্দর উদাহরণ বলিয়া মনে করি। গৃহপালিত পক্ষীর এবং খরগোশ, হরিণ, ছাগ, মেষাদির শির-দাঁড়ার উভয় পার্শ্বের কোমল মাংসের কাট‍্লেটই অতি উৎকৃষ্ট হয়। কোমল পক্ষী পাঁচ বা সাত টুকরা করিয়া কাট,—বুক, দুখানা ডানা ও দুই বা চারি খণ্ড পা। নুণ, মরিচ গুড়া, (লঙ্কা বাটা), মিহি আদা বাটা, রশুন ও পেঁয়াজ বাটা, কিঞ্চিৎ অম্লরস ও চিনি এবং গুরুপক্ব করিলে ধনিয়া, জিরা ও গরম মশল্লা বাটা এবং বাঁধন দিবার জন্য পক্ষীর ডিমের শাঁস বা এরোরুট একত্রে মিলাইয়া রাখ। ডিমের শাস মিশাইলে ভাজা পর কাটলেটের চেহারা বেশ সুপুষ্ট দেখাইবে এবং উহার রঙ্গও বেশ স্বর্ণাভ হইবে। এক্ষণে মাংসখণ্ডগুলি একখানা সমতল মজবুত গোছর তক্তার উপর রাখিয়া কাটারি বা চপারের দ্বারা থুর। ঐ সঙ্গে মিশ্রিত মশলা মিশাও বা ‘খাওয়াও’। এইরূপ ভাবে থুরিবে যাহাতে মাংসখণ্ডগুলি এক আঙ্গুল পুরু চেপ‍্টা গোছের আকারের হয় অথচ তাহার কোন অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া না যায় এবং মশলাগুলি যাহাতে মাংসের গায়ে বসিয়া যায়। একখানা তৈ বা ফ্রাইপ্যানে ঘৃত তাতাইয়া কাট‍্লেট গুলি ভাজ। ভাজিবার পূর্ব্বে কাট‍্লেট গুলি কাটখোলায় ভাজা ময়দা, সুজি বা উভয় মিশ্রিত অথবা ব্রেডক্রাম্বের উপর গড়াইয়া লইবে এবং হাতে চাপড়াইয়া অতিরিক্ত ময়দা অথবা ক্রাম্ব কাটলেটের গায়ে বসাইয়া দিবে। কাট‍্লেট আর জলে সিদ্ধ করিবার প্রয়োজন হইবে না। থুরিয়া চেপটা গোছ করিয়া লওয়ার জন্য মাংসখণ্ডগুলি শুধু ঘৃতে ভাজিয়া লইলেই আহারের সম্পূর্ণ উপযোগী হইবে।

 ওয়ারসেষ্টারসায়ার প্রভৃতি সস্ মাখিয়া সিদ্ধ বা ঘিয়ে ভাজা ফল আলু ও ফুলকোবি, সালগম, মটরশুটি প্রভৃতির সহিত কাট‍্লেট খাইতে ভাল। এই পর্য্যায়ে ক্রাম্বচপ, পেপারচপ, গ্রেভি-কাট‍্লেট প্রভৃতি ফেলা যাইতে পারে।

 বড় চিংড়ী এবং পাকা রুই প্রভৃতি মোটা মাছের এই প্রকারে কাটলেট ভাজিবে। পাঠক পাঠিকা লক্ষ্য করিবেন, এই কাটলেটের সকিত দেশীয় ‘সুজী ভাজির’ কোনই পার্থক্য নাই। ইউরোপীয় রন্ধনে নুণ, মরিচ গুঁড়া, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটার সহিত কেবল অতিরিক্ত এঞ্চবী সস্ দেয়, এবং টোমেটো, ওয়ারসেষ্টারসায়াব প্রভৃতি সস অম্লরস রূপে মিশ্রিত করা হয় এবং বাঁধন স্বরূপ ডিমের শাঁস ব্যবহৃত হয় এবং পরিশেষে সুজীর পরিবর্ত্তে ব্রেডক্রাম্বের উপর গড়াইয়া লইয়া ভাজা হয়।

৭। ষ্টেক (Steak)

 পক্ষী, ছাগ, মেষ ও হরিণাদির মাংসের ষ্টেক ভাজা হইতে পারে। পক্ষী রোষ্টের উপযোগী করিয়া প্রস্তুত করিয়া বুকের হাড়ের উভয় পার্শ্ব হইতে তীক্ষ্ণ ছুরি দ্বারা চিরিয়া দুই খণ্ডে বিভক্ত কর। ডানা দুইটী এবং পা দুইটীর মধ্যস্থলে চিরিয়া ভিতরের হাড় বাহির করিয়া ফেল। এক্ষণে সমস্ত পক্ষীটি হাড় শূন্য হইয়া দুই টুকরায় বিভক্ত হইল। মেষাদির শির-দাঁড়ার বা রাঙ্গের অপেক্ষাকৃত বড় বড় মাংসখণ্ড লইবে। মাংসখণ্ড গুলি চপার দ্বারা আবশ্যক মত থুরিয়া লও। নুণ, মরিচ গুঁড়া, ওয়ারসেষ্টারসায়ার সস্, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা এবং ঘৃত বা Salad oil দ্বারা টুক্‌বাগুলি মাখ। তৈয়ে বা ফ্রাইপ্যানে ঘৃত তাতাও, তদুপরি মাংসখণ্ডগুলি মেলাইয়া দিয়া একখানা তাওয়া চাপা দাও এবং তাওয়ার উপর কোন ভারি জিনিষ, যথা ছোট জলের কেট‍্লি বা লৌহ হামানদিস্তা রাখিয়া আরও চাপিয়া দাও, অর্থাৎ যাহাতে মেলান মাংসখণ্ডগুলি ভর্জ্জিত হইবার সময় গুটাইয়া না গিয়া বেশ মেলান অবস্থাতেই থাকে। মাংসের জল মরিয়া গিয়া যখন নিচের দিকটা বেশ ভাজা ভাজা হইয়া আসিবে তখন উল্টাইয়া দিয়া পুনরায় ঐরূপ ভাবে চাপা দিয়া ভাজিবে। শোঁ শোঁ শব্দ ও ঘ্রাণের দ্বারা ভাজা ঠিক্ হইয়াছে কি না বুঝিয়া লইবে। অতঃপর নামাইয়া উপরে অর্দ্ধ ভাজা পেঁয়াজ কুচা ছড়াইয়া দিয়া ঝোল (Gravy) সহ পরিবেশন করিবে।

৮। কাটি-কাবাব বা কাবাব মির্জাফা

 গৃহপালিত পক্ষী বা মেসাদির কোমল মাংস হাড় শূন্য করিয়া ছোট ছোট ডুমাকারে কুটিয়া লও। নুণ, মরিচবাটা, (লঙ্কাবাটা), আদা বাটা, পেঁয়াজ ও রশুন বাটা, কিঞ্চিৎ অম্ল ও মিষ্টরস এবং ধৃত দ্বারা মাখ। গুরপক্ব করিতে হইলে এতৎসহ আরও জিরা বাটা, ধনিয়া বাটা, হলুদ, (জাফরান) প্রভৃতি মিশাইবে। ক্ষাণিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। কোমল মাংস ছোট ছোট খণ্ডে কুটিয়া লওয়া হয় বলিয়া ইহা আর খুবিয়া লইবার প্রয়োজন হয় না; তবে মাংস কিছু শক্ত বুঝিলে কাঁচা পেঁপের আটা একটুকু মাংসের সহিত মাখিয়া লইবে। অতঃপর মাংসখণ্ড গুলি সরু গোছেব লৌহশিকে ফুঁড়িয়া সারি সারি গাঁথিয়া গমগমে প্রদীপ্ত অঙ্গারের উপর ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ঝলসাও। মধ্যে মধ্যে ঘি খাওয়াইবে। সরস রহিয়া সুপক্ব হইলে নামাও।  শিকে মাংস খণ্ড গাঁথিবার সময় প্রতিখণ্ড এক এক চাকা আদা ও এব এক চাকা পেঁয়াজের সহিত পর পর গাঁথিয়া আগুণে ঝলসাইয়া লইলে তাহাকে ‘হোসেঙ্গা’ কাবাব কহে।

 (দ্রষ্টব্য -ভ্রমক্রমে খণ্ডমাংসের এই শূল্যটি উখ্যের অন্তর্গত হইয় লিখিত হইল।)

খ। উখ্য।

(৩) কিমা-মাংসের হাঁড়ী-কাবাব।

 এই পর্যায়ে ‘কোপ্তা’ বা ‘গুল’ কবাব, ‘টিকা’ বা ‘টিকলি’ কাবাব, ‘খাতাই’ কাবাব, ‘ছামি’ কাবাব এবং ইংরাজী ‘ক্রোকেটাদি’ ফেলা যাইতে পারে। শূল্য-কোপ্তাকে সাধারণতঃ ‘কাবাব-পরছন্দ’ কহে।

৯। কোপ্তা।

 হাড়শূন্য মাংস উত্তম রূপে কুচাইয়া অর্থাৎ কিমা করিয়া বা কলে পিষিয়া লও। রগাদি সব বাছিয়া ফেলিয়া দাও। নুণ, মরিচ বাটা,(লঙ্কা বাটা) এবং ইচ্ছা করিলে আদা বাটা, পেঁয়াজ ও রশুন বাটা, কিঞ্চিৎ অম্লরস, চিনি ও ঘৃত মাখ। কিছু ময়দা, এরোরুট বা চাউলের গুঁড়া মিশাইয়া বাঁধন দাও। ইচ্ছা করিলে ডিমের শাঁস দ্বারাও বাধন দিতে পার। ক্ষণিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। পরে হাতে চাপিয়া অপেক্ষাকৃত ছোট দলা বা গুল প্রভৃতি পাকাইয়া ঘৃতে ভাজ। মশলাদি মাখায় কিমা মাংস অধিক গিলা হইলে ফেনাইয়া ‘বড়া’ ভাজিতে পার। অথবা বুটের বেসম বা ময়দাদি একটু অধিক পরিমাণে মিশাইয়া শক্ত করিয়া লইয়া ‘টিকলি’ প্রভৃতি গড়িয়া ভজিবে। ইহাই হইল সাদাসিদা কোপ্তা।

 কোপ্তা অধিকতর মশলাদার করিতে হইলে ধনিয়াবাটা, জিরা বাটা, গরম মশল্লা বাটা, জাফরান বা হলুদ, দধি এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ আরও মোয়াক্ষীর, মালাই, বাদামবাটা প্রভৃতি মিশাইয়া লইয়া কোপ্তা ভাজিতে পার।

 গুরুপক্ব কোপ্তার উদাহরণ:

১০। খাতাই কাবাব।

 হাড়শূন্য মাংস কাটারি, চপার বা কল দ্বারা কিমা করিয়া লইয়া পুনরায় পাটায় বা হামানদিস্তায় ফেলিয়া মিহি করিয়া পিষিয়া লও। মাংসের রগাদি বাছিয়া ফেল। ঘৃতে পেঁয়াজ ও রশুন কুচি, আদা কুচি, গেটা লঙ্কা, ধনিয়া, জিরা, মরিচ, গোটা গরম মশল্লা, বাদাম, পেস্তা, কিস‍্মিস্ ভাজ। নামাইয়া সমস্ত মসল্লা পাটায় মিহি করিয়া পিষিয়া লও। নুণ, হলুদ বা জাফরান ও এই পিষা মশল্লা কিমা মাংসের সহিত উত্তমরূপে মিশাও। একটু চিনি ও অমরস মিশাও। কিছু ঘৃত ময়ান দেও। তৎপর এরোরুট, চাউলের গুঁড়া, ময়দা বা ডিমর ইয়োক্ মিশাইয়া সমস্ত বেশ করিয়া বাঁধিয়া বা আঁটিয়া লও। ক্ষাণিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। এক্ষণে এতদ্দ্বারা এক এক খানা দুই আঙ্গুল পুরু চেপ্টা গোছের প্রায় দুই ইঞ্চি ব্যাসের টিকা (টিকলি) বানাইয়া দিয়ে ভাজ। ফ্রাই প্যানে ঘি দিয়া কাঁচা ঘিতেই টিকা গুলি সাজাইবে। পরে আগুন ধরিয়া মন্দা আঁচে ভাজিবে। সোণার বর্ণ হইলে নামাও। উপরে কিছু গোলাপ জল ছিটাইয়া দিয়া খাইতে দাও।

 খাতাই কাবাবের ভিতর আবার পূর দেওয়া চলে।—কিছু মাংস খণ্ড লইয়া অর্দ্ধ সিদ্ধ কর। ছোট ডুমা ডুমা করিয়া কুট। অল্প ঘৃতে একটু জল আছড়া দিয়া মোলায়েম করিয়া ভাজ। জিরা, মরিচ, ভাজা ধনিয়ার গুঁড়া, চিজের (পনিরের) গুঁড়া ছাড়। নাড়িয়া চাড়িয়া শুক‍্না শুক‍্না করিয়া নামাও। ইহার দ্বারা ছোট ছোট গুলি পাকাইয়া খাতাই কাবাবে ষ্টাফিং বা পুর দিয়া ঘৃতে ভাজ। ইহাকে ‘পুরী-খাতাই’ কাবাব বলে।

 খাতাই কাবাবের মাংস অতিশয় মিহি করিয়া কিমা করিয়া লওয়া হয় বলিয়া ইহার সহিত যে মশল্লাদি মিশাইতে হয় তাহা ভাজিয়া মিহি করিয়া পিষিয়া লইয়া মিশাইতে হয়, নচেৎ ভাজিলে মাংস সুপক্ব হইলেও মশল্লাদি কাঁচা রহিয়া যায়।

 খাতাই কাবাবের সহিত এক সের মাংসে এক ছটাক হিসাবে বুটের বেসন মিশাইয়া লইয়া ভাজিলে তাহাকে ‘ছামি’ কাবাব বলা হয়।

১১। ক্রোকেট (Croquette.)

 মাংস জলে সামান্য মত সিদ্ধ কর। তৎপর মিহি করিয়া কিমা কর। এখন ঘৃতে পেঁয়াজ ছাড়িয়া লাল করিয়া কিমা-মাংস ছাড়। নাড়িয়া চাড়িয়া নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, রাই সরিষার গুঁড়া মিশাইয়া একটু জল দাও। খনিকটা ভিজান পাঁউরুটীর শাঁস মিশাও। টোমেটা বা ওয়ারসেষ্টারসায়ার সস্‌ মিশাও। অতঃপর ডিমের শাঁস দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া মাংস বাঁধিয়া বা আঁটিয়া লইয়া নামাইয়া লও! খবরদার ডিম দেওয়ার পর যেন বেশীক্ষণ জ্বালে না থাকে তাহা হইলে ডিম শক্ত হইয়া যাইবে। এক্ষণে ইহার দ্বারা এক একটি আঙ্গুল তিনেক লম্বা পাশ-বালিশের আকৃতি বিশিষ্ট ‘ক্রোকেট’ গড়িয়া তাহার গায়ে ডিমের ইয়োক্ মাখ। ব্রেডক্রাম্বে গড়াইয়া লইয়া ঘিয়ে ভাজ।

 ইচ্ছা করিলে কিছু বাদাম ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া ক্রোকেটের সহিত মিশাইয়া লইতে পার। এবং কাঁচা বাদাম এক ইঞ্চি লম্বা পাত্‌লা পাত্‌লা সরু সরু করিয়া কাটিয়া ঘৃতে ঈষৎ ভাজিয়া ভাজা ক্রোকেটের গায়ে ঘন করিয়া গুঁজিয়া দিয়া কদম্বফুলের আকৃতি বিশিষ্ট করিয়া পরিবেশন করিতে পার।

 বড় চিঙড়ী এবং পাকা রুই প্রভৃতি মোটা মাছেরও এই সকল প্রকারে টিক্‌লি, কোপ্তাদি ভাজা যায়। পূর্ব্ব-লিখিত টিক্‌লি রন্ধন প্রণালীর সহিত ইহার তুলনা করিলে উভয়ের পার্থক্য কমই লক্ষিত হইবে।