বরেন্দ্র রন্ধন/দ্বিতীয় অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়।
সিদ্ধ। (নিরামিষ)
আগুনের উপর হাঁড়ি করিয়া ফুটন্ত জলে চাউল, ডাইল, তরি-তরকারী, মৎস্য, মাংসাদি পাক করাকে সিদ্ধ করা বলা যাইতে পারে।
সিদ্ধ দ্রব্য শুধু শুধু খাওয়া চলে না, ঘৃত বা তৈল এবং নুণ মাখিয়া সাধারণতঃ খাইতে হয়। তাহা আরও সুস্বাদু করিতে হইলে তৎসহ কাঁচা লঙ্কা বা মরিচের গুঁড়া এবং স্থলবিশেষে সরিষা বাটা প্রভৃতি মাখিয়া লইতে হয়।[১]
আনাজ শ্রেফ, ফুটন্ত জলে সিদ্ধ না করিয়া ভাতের মধ্যে দিয়া অথবা গরম জলের তাপে সিদ্ধ করিলে অধিক সুস্বাদু হয়।
১১। ভাত, অন্ন বা ওদন
হাঁড়িতে জল দিয়া আগুণে ফুটাও। চাউল ছাড়। যতটা চাউল দিবে জল তদপেক্ষা তিন গুণ পরিমাণ থাকা চাই। সিদ্ধ হইলে নামাইয়া জল গালিয়া ফেলিয়া অন্ন লইবে।
১২। মাড়ে মাড়ে ভাত
আতপ চাউল জলে সিদ্ধ করিবে। উত্তম সিদ্ধ হইলে মাড় না গালিয়া তৎসহ অল্প খাইবে। এই ভাতে উপরিলিখিত বিধান অপেক্ষা কিঞ্চিৎ কম জল দিতে হইবে। সাধারণতঃ এই ভাতে ডাইল এবং আনাজ ফেলিয়া এক সঙ্গে সিদ্ধ করিয়া লওয়া হয়, এবং তাহারই সহ ঘৃত সৈন্ধব যোগে খাইতে হয়।
অগ্রহায়ণ মাসে নূতন আমন ধানের চাউল উঠিলে তাহার আতপ এইরূপ সিদ্ধ সহকারে খাইতে ভাল। সেই সমস্ত নূতন মূলা, নুতন কুমড়া-বড়ী (মটরের), নূতন আলু, নূতন শিম, নূতন বকফুল, নূতন বরবটী প্রভৃতি উঠে। এই সমস্ত আনাজ-সিদ্ধ সহকারে ধৃত সৈন্ধব ও মটর ডাইল সিদ্ধ দিয়া নুতন চাউলের মাড়ে মাড়ে ভাত মাখিয়া খাইতে উপাদেয়। নুতন মূলা ও মটরের কুমড়া-বড়ী তৈল, নুণ, লঙ্কা দিয়া মাখিতে হয়।
১৩। ফেণ-মুঠা
দেশী আমনের আতপ চাউল লও। ধোও। ঢেঁকীতে কুট। চালনীতে (আটা-চালায়) চাল। ছাঁকা গুঁড়া যাহা পড়িবে লইয়া একটু গরম জল মিশাইয়া মাখিয়া হাতে করিয়া চাপিয়া দলা পাকাও। দলা গরম জলে ফেলিয়া অর্ধ সিদ্ধ কর। বেশ আঠা আঠা গোছ হইলে জল হইতে উঠাইয়া বেশ করিয়া ঠাসিয়া মথিয়া লও। এখন পুনরায় হাতে করিয়া আঙ্গুলে চাপিয়া ‘মুঠা’ বানাও। এখন চালনীতে যে ক্ষুদ অবশিষ্ট আছে, তাহা লইয়া ভাত পাক কর। মুঠাগুলি তাহার মধ্যে ছাড়। সুসিদ্ধ হইলে মাড়ে মাড়ে ভাত নামাও। এই ভাত বেশী পরিমাণে ঘৃত এবং নুণ মাখিয়া খাইতে ভাল, এবং মুঠা ডাইল অথবা বেস্যরী প্রভৃতি সহ খাইতে ভাল। মুঠা গুড় দিয়াও . সাধারণতঃ খাওয়া হইয়া থাকে। অগ্রহায়ণ মাসে নুতন আমন ধান উঠিলে লুঠন ষষ্ঠীর দিনে এই ফেণ-মুঠা খাওয়া হইয়া থাকে।
১৪। ক্ষুদের জাউ
চাঊেলর ক্ষুদ বেশ করিয়া ধুইয়া হাঁড়িতে ক্ষুদ ও পরিমাণ মত জল দিয়া সিদ্ধ কর। সিদ্ধ হইলে ঘাঁটিয়া লইয়া নামাও। ইহার জল গালিতে হয় না। এক্ষণে শুকালঙ্কা পোড়াইয়া গুঁড়া,করিয়া লও এবং কালীজিরা. আধকচড়া করিয়া বাট। পরে উভয় তেল নুণ সহ একত্রে মিশাইয়া ক্ষুদের জাউর সহিত মাখিয়া খাও।
১৫। পর্য্যুষিত অন্ন
পর্যুষিত অন্ন বিবিধ উপায়ে প্রস্তুত ও বিবিধ উপকরণ যোগে ভক্ষণ করা বাঙ্গালা দেশের সর্বত্র প্রচলিত আছে। এতন্মধ্যে সচরাচর ব্যবহৃত দুই একটি সম্বন্ধে লিখিত হইল।
(ক) পান্তাভাত— অন্নে জল দিয়া কিছুক্ষণ রাখিয়া দিলে যখন তাহা কিঞ্চিৎ অম্লস্বাদবিশিষ্ট হইবে তখন তাহার সহিত নুণ, ছোট-পেঁয়াজ, ঝালকাসুন্দী প্রভৃতি মাখিয়া খাইবে। পান্তা ভাতের অন্ন জলকে ‘আমানি’ বলে।
কাঁচা আম দেওয়া মটর ডাইলের চড়চড়ী দ্বারা মাখিয়া অপর কোন প্রকার চড়চড়ী, কাঁটালের ঝাল, বেস্তরী প্রভৃতি সহও ইহা খাইতে ভাল। দুর্গোৎসবে বিজয়-দশমীর দিবসে দর্পণ-বিসর্জ্জনের পুর্ব্বে পাস্তাভাত ও নলের বেস্যরী দ্বারা ‘মা’র ভোগ দেওয়া হইয়া থাকে। খ) ঘোল পান্তা — উপরি-উক্ত বিধানে প্রস্তুত করিবে এবং উপরি-উক্ত উপকরণ যোগে খাইবে, কেবল অন্ন জলে না ভিজাইয়া ঘোলে ভিজাইরা রাখিবে এবং খানকত লেবুপাতা তন্মধ্যে গুঁজিয়া দিয়া উহার সুঘ্রাণ করিবে।
(গ) আম্বজল বা র্কাজি— একটি পাতিলে (হাঁড়িতে) পুরাণ চাউলের ঝরঝরে ভাত জল সহ রাখ, পাঁচ সাত দিবস পরে উহা বিলক্ষণ অম্লগন্ধবিশিষ্ট হইলে জলটুকু ছাঁকিয়া লইবে। অন্ননাশক, স্নিগ্ধকারক প্রভৃতি বহুগুণবিশিষ্ট বলিয়। এই জলের প্রসিদ্ধি আছে। পূর্ব্বে প্রতি গৃহস্থ-বাটিতে ‘আ্ব জলের পাতিল' রাখা রীতি ছিল, এবং নিত্য তাহাতে দুটি অন্ন রাখা হইত, একবার র্কাজি ছাঁকিয়া লইলে পুনঃ জল দেওয়া হইত। পাতিল কখন সাফ করা হইত বলিয়া বোধ হয় না।
(ঘ) কড়কড়া ভাত —শীতকালে নুতন আমনের উষ্ণা চাউলের ভাত পূর্ব্ব দিন পাক করিয়া শুকাইয়া রাখিয়া পরদিন তৈল, নুণ, কাঁচা লঙ্কা অথবা মরিচ-বাটা দিয়া মখিয়া খাইবে। চিতল, আইড, ঢাঁই প্রভৃতি তৈলাক্ত মাছের বাসী ‘সরপড়া’ ঝোলের সহিত ও এই ‘কড়কড়া’ ভাত খইতে ভাল।
১৬। মুগের ডাইল সিদ্ধ
একখান নেকড়াতে বালুতে ভাজা মুগের ডাইল যথেষ্ট ঢিলা করিয়। বাঁধিয়া ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ করিবে। সিদ্ধ হইয়া বেশ মাখনের মত হইবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাঁটি গাওয়া ঘৃত ও নুন মাখিয়া সরু উষ্ণা চাউলের ভাতের সঙ্গে খাইবে।
মশুরের ডাইলও এইরূপ ভাবে ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ করবে। জল না ফুটিলে ডাইল ছাড়িও না। তাহা হইলে ডাল সিদ্ধ হইবে না। মশুরের ডাইল সিদ্ধ করিলে কেমন এক রকম দুর্গন্ধবিশিষ্ট হয়, সুতরাং ইহা তৈল, নুণ, কাঁচা লঙ্কা ও পেঁয়াজ কুচি দিয়া মাখিয়া খাইতে হয়।
বালুতে ভাজা মাষকলাইর ডাইলও মুগের ডাইলের ন্যায় সিদ্ধ করিবে। কিন্তু ঘির পরিবর্ত্তে তৈল দিয়া মাখিবে।
১৭ (ক) মটর ডাইল সিদ্ধ
দেশী বা ছোট মটরের ডাইল নেকড়াতে ঢিলা করিয়া বাধিয়া ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ করিবে। ঘৃত, নুণ, কাচা লঙ্কা ও পেয়াজ কুচি যোগে নুতন আমন ধানের চাউলের মাড়ে মাড়ে ভাতের সহিত মাখিয়া এই ডাইল সিদ্ধ খাইতে ভাল।
খেসারীর ডাইলও এইভাবে সিদ্ধ করিয়া মাখিয়া খাইবে। কিন্তু, ঘৃতের পরিবর্ত্তে তৈল দিয়া মাখিলেই তাহার স্বাদ ভাল হইবে।
১৭ (খ) বাটা মটর ডাইল সিদ্ধ
দেশী মটর ডাইল ভিজাইয়া রাখিয়া বাটিয়া লও। হাতে করিয়া অপেক্ষাকৃত বড় বড় দলা পাকাইয়া ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ কর। ঘৃত, নুণ, কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া সরু আতপান্নের সহিত মাখিয়া একটু দধি সংযোগে খাইতে ইহা ভাল।
১৮। আলু সিদ্ধ
খোসা সমেত গোল আলু জলে অথবা ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ করিবে। খোলা ছাড়াইয়া ঘৃত (অথবা তৈল, নুণ ও রুচি অনুসারে কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া খাইবে। নুতন আলু সিদ্ধ খাইতে অধিকতর সুস্বাদু।
একখণ্ড নেকড়ায় আলু বাঁধিয়া জলে শিকি পূর্ণ হাঁড়ির উপর ঝুলাও। যেন আলু জলে না ঠেকে। এক্ষণে হাঁড়ির মুখ ঢাকিয়া দিয়া আগুণে বসাও। জল ফুটিয়া তাহার ভাপা উঠিয়া আলুতে লাগিয়া তাহা সিদ্ধ করিবে। এইরূপ সিদ্ধ করাকে ভাপে সিদ্ধ কহে।
ফুল কোবি, বাধা কোবি, ওল কোবি সালগম, গাজর, মূলা, কঁচা পাকা মিঠা কুমড়া, আনাজি কলা, লাল আলু, শালুক, বেত-আগা, মোচা, পাণিফল, প্রভৃতি আলুর ন্যায় সিদ্ধ করিয়া তে মাখিয়া খাইবে। মূলা তৈলে মাখিলেই ভাল হয়।
আম কড়ালী, পাকা আম, জলপাই, কঁচা তেঁতুল, আমড়া, আপেল, পিচফল প্রভৃতি ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ করিয়া চিনি দিয়া মাখিয়া খাও।
ওল খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া একটু সোডা বা চুণ মাখিবে। থাণিকক্ষণ পরে ধুইয়া ফেলিবে। এইরূপ করিলে ওলের মুখ ধরা দোষ অনেক নষ্ট হইবে। এক্ষণে জলে সিদ্ধ করিয়া জল গালিয়া ফেলিয়া তৈল, মুণ, কাঁচা লঙ্কা এবং সরিষা বাটা দিয়া বেশ চটকাইয়া মাখিবে। শুকনা ভাতের সহিত খাইবে। খবরদার, ওলের সহিত ঘৃত-সংযোগ হইলে মুখ ধরিতে পারে।
মান কচু, ঘট কচু, খামা কচু প্রভৃতি এইরূপে সিদ্ধ করিয়া তৈল, লুণ, কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া খাইবে। ইহাদের সহিত সরিষাবাঁটা মাখা আবশ্যক করে না।
খড়ের আগুণে মটরের কুমড়া বড়ি ঝাইয়া লইয়া ভাতে সিদ্ধ কর। তৈল, লুণ, কঁচা লঙ্কা মাখিয়া আতপ অন্নের সহিত বিশেষতঃ নূতন আমনের মাড়ে মাড়ে ভাতের সহিত খাইতে ভাল। (পোয়ও লিখিত হইয়াছে।)
খেসারির ডাইলের বড়ি এইরূপভাবে পাইবে।
২২। ঝিঙ্গা সিদ্ধ
কচি ঝিঙ্গা জলে অথবা ভাতে ফেলিয়া সিদ্ধ করিবে। পরে জল চিপিয়া ফেলিয়া ঘৃত কিম্বা তৈল, নুণ ও কাঁচা লঙ্কা দিয়া মাখিবে। ঘিয়ে মাখিলে লঙ্কা ইচ্ছা করিলে বাদ দিতে পার। পটোল, করিলা, শিম, বরবটী, মূলা, মটর শুটি, বকফুল প্রভৃতি সবজী এইরূপে সিদ্ধ করিবে। করিলা সিদ্ধ আলু সিদ্ধ সহ একত্রে মাখিয়া খাইতে মন্দ লাগে না।
২৩। লাউ-শাক সিদ্ধ
নূতন আমনের ভাতের মাড়ে লাউ শাক ও ডগা সিদ্ধ করিয়া তৈল, নুণ ও কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া খাইবে। ইহার সহিত বথুয়ার শাক ও শলুপের শাক মিশাইয়া সিদ্ধ করিলে স্বাদ উত্তম হয়। বথুয়া ও শলুপের পরিবর্ত্তে হেলেঞ্চার শাক মিশাইয়া সিদ্ধ করিয়াও লাউ শাক সিদ্ধ খাওয়া হয়।
হেলেঞ্চা 'ও বথুয়ার শাক আলাহিদা ভাবে সিদ্ধ করিয়াও খায়।
সিদ্ধ।—(আমিষ)
২৪। ইলিশ মাছ সিদ্ধ
ইলিশ মাছ কুটিয়া জলে বা ভাপে সিদ্ধ করিয়া তৈল, নুণ, কাঁচা লঙ্কা ও সরিষা বাটা দিয়া মাখিয়া খাইবে, কিন্তু কুমড়া পাতার সহিত সিদ্ধ করিলেই তাহার স্বাদ সমধিক বর্দ্ধিত হইয়া থাকে। পাতা একটু বুড়া দেখিয়া লইতে হয় এবং একটু অধিক তৈল দিয়া পাতার সহিত একত্রে মাছ মাখিয়া খাইতে হয়।
২৫। বাচা মাছ সিদ্ধ
বাচা মাছে একটু হলুদ মাখিয়া জলে সিদ্ধ করিয়া তৈল, নুণ, কাঁচা লঙ্কা ও সরিষা বাটা মাখিয়া খাইবে। তৈল একটু বেশী পরিমাণে দিবে।
আইড় প্রভৃতি মাছ ও এই প্রকারে সিদ্ধ করিবে।
২৬। রুই মাছ সিদ্ধ
রুই প্রভৃতি মাছ জলে সিদ্ধ করিয়া তৈল, মুণ, কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া খাইবে। সরিষা বাঁটা মাথা প্রয়োজন নাই।
ইলিশ,রুই, ভেটকী, মেকরেল, পমফ্রেট প্রভৃতি মাছ সিদ্ধ করিয়া ইউরোপীয় ধরণে নিম্নলিখিত মত নানাবিধ সস প্রস্তুত করতঃ তৎসহ খাইবে।
সস্
হলাণ্ডেজ সস্—একটী এনামেল করা লোহার হাঁড়িতে দুই টেবিলচামচ সির্কা ছাড়। নুণ ও গোল মরিচের গুঁড়া মিশাও। আগুণে ফুটাও। সির্কা অর্দ্ধেক হইয়া আসিলে নামাইয়া তাহাতে কিছু জল ও চারিটা ডিমের হরিদ্রাংশ বা ইয়োক এবং আধ ছটাক মাখন ক্রমে নাড়িয়া নাড়িয়া উত্তমরূপে মিশাও। পুনঃ হাঁড়ি জ্বালে চড়াইয়া খুব করিয়া নাড়িতে থাক। সস্ গাঢ় হইলে নামাও। খবরদার যেন তাপে ডিম শক্ত হইয়া না যায়। এই নিত্তি ‘বাইন-মেরী’ নামক পাত্রে পাক করা কর্ত্তব্য। এই সস্ রুই, ভেটকী, মেকরেল, পমফ্রেট প্রভৃতি সিদ্ধ মাছের সহিত খাইবে।
মেয়নেস সস্—চারিটা ডিম সিদ্ধ করিয়া তাহার কঠিন হরিদ্রাংশ লও। নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, রাই সরিষার গুঁড়া ও সূক্ষ্ম কুচি করা পেঁয়াজ ঐ ডিমের সহিত মিশাইয়া চট্কাইয়া লও। এক্ষণে ছটাক তিনেক সালাদ-অয়েল এই ডিমের উপর ধীরে ধীরে ঢাল এবং সমস্তটা খুব করিয়া মাড়। যত উত্তমরূপে মাড়িবে ততই ভাল হইবে। এই সময়ে দুইটা কাঁচা ডিমের হরিদ্রাংশও মিশাইবে। অতঃপর ইহার উপর কিছু ভিনিগার ঢালিয়া দিয়া পুনরায় খুব করিয়া ফেটাইবে। ইহা শ্বেতবর্ণ হইয়া যাইবে। এক্ষণে সমস্ত ছঁকিয়া কিছু মাখন অথবা দুগ্ধের ক্রিম্ মিশাইতে পার। এই সস্ বরফে ঠাণ্ডা করিয়া ঠাণ্ডা ভেটকী, ইলিশ প্রভৃতি মাছ সিদ্ধের সহিত বিশেষতঃ চিঙড়ী মাছের সহিত খাইতে হয়। ইচ্ছা করিলে সিদ্ধ ডিমের শ্বেতাংশ কিমা করিয়া এই সসের সহিত মিশাইয়া লইতে পারা যায়।
টার্টার সস্—মেয়নেস সস হইতে শক্ত সিদ্ধ ডিমের হরিদ্রাংশ বাদ দিয়া এবং শেষে দুগ্ধের ক্রিম মিশাইয়া লইলেই টার্টার সস্ হইল। টার্টার সসে রাই সরিষার গুঁড়া থাকা চাইই। ইলিশ মাছ সিদ্ধের সহিত ইহা খাইতে ভাল।
হোয়াইটসস্—কিছু ময়দা কাঠ খোলায় দুটো গরম মশল্লা সহ চম্কাইয়া লও। লাল্চে হইবার পূর্ব্বে নামাইয়া কিছু দুগ্ধ মিশাও। খুব করিয়া নড়িয়া মিশাইবে, যেন ময়দা গুটি না বাঁধে। গুটি বাঁধিলে ছাঁকনায় ছাঁকিয়া লইবে। এক্ষণে মৎস্য বা মাংসের সুরুয়া, কিছু মাখন, নুণ ও গোলমরিচের গুঁড়া মিশাইয়া জালে চড়াও। বেশ করিয়া নাড়িয়া গাঢ় হইলে ছাঁকিয়া কিছু দুধের ক্রিম মিশাইয়া মাছ বা পক্ষীর মাংস সিদ্ধের সহিত খাইবে।
পার্শলী শাকের কুচি এই সসের সহিত মিশাইলে ইহা ‘পার্শলী-সস্’ হইবে।
শক্ত সিদ্ধ ডিম কিমা করিয়া ইহার সহিত মিশাইয়া লইলে ইহা ‘এগসস’ হইবে।
কেপার (গোট বা কুচাইয়া) ইহার সহিত মিশাইলে ইহা ‘কেপারসস’ হইবে। তৎক্ষেত্রে, একটু চিনি মিশাইতে হইবে। মিণ্ট বা পুদিনা পাত-কুচি মিশাইলে ‘মিণ্টসস’ হইবে। সিদ্ধ পেঁয়াজ ছাঁকিয়া তাহার মাড়ি ইহাতে মিশাইল ‘ওনিয়ান সস’ হইবে। সাদা পিকল-কিমা বা চৌ-চৌ মিশাইলে ইহা ‘চৌ-চৌ-সস’ হইবে।
ইলিশ মাছ চৌ-চৌ—মাছ ভাপে সিদ্ধ করিয়া কাঁটা বাছিয়া ফেলিয়া একখানা ডিসে সাজাও। আদা চাকা, কাঁচা লঙ্কা চাকা, পেঁয়াজ চাকা, সিদ্ধ আলু চাকা, শশী চাকা বা সূতার মত করিয়া বানান মাছের সহিত সাজাও। এখন সির্কা ও নুণ মাছের উপর ঢালিয়া খাইতে দাও। কেহ, কেহ সির্কায় আদা, কাঁচা লঙ্কা ও শশা পূর্ব্বে একটু জ্বাল দিয়া লয়েন।
ব্রাউন সস্—হাঁড়িতে ঘি দিয়া তেজপাত পেয়াজ কুচি ও রশুন ছাড়। নাড়। লালচে রঙ্গ হইলে মাছের বা মাংসের সুরুয়া মিশাও। নুণ মরিচ গুড়, পার্শলী, সেলেরী প্রভৃতি বাগানের মশল্লা, সালগম ও গাজর কুচি ছাড়। সুসিদ্ধ হইলে নাড়িয়া নামাও। একটু কেরামেল (পোড়া-চিনির রঙ্গ) মিশাও। এক্ষণে হাঁড়িতে পুনঃ মাখন উঠাইয়া ময়দা ছাড়। লালচে হইলে ঐ পক্ব সুরুয়া ঢালিয়া দাও। গাঢ় হইলে নামাইয়া নেকড়ায় ছাঁকিয়া লও।
ইহার সহিত ইচ্ছানুসারে এঞ্চবী, টোমেটো প্রভৃতি সস্, আমের ভিনিগার চাটনী, কেপার, পিকল প্রভৃতি মিশাইয়া বিবিধ ঘ্রাণবিশিষ্ট করিতে পার।
২৭। পক্ষী সিদ্ধ (বৈদেশিক)।
একটি ইঁড়িতে কিছু জল দিয়া তাহাতে আদা চাকা, পেঁয়াজ চাকা, নুণ, তেজ পাত ও গোটা গোল মরিচ ছাড়িয়া সিদ্ধ কর। ফুটিলে মারা গোটা পাখী (সাফ করিয়া) তন্মধ্যে ছাড়। পাখী সুসিদ্ধ হইলে নামাইয়া জল হইতে উঠাইয়া রাখ। অবশিষ্ট জলটুকু নেকড়ায় ছকিয়া লও এবং তদ্বারা ‘হোয়াইট’ প্রভৃতি সস পাকাইয়া তৎসহ সিদ্ধ পক্ষী খাও।
২৮। পক্ষীর ডামপ্লিং (বৈদেশিক)।
এক্টি মারা গোটা পক্ষীর ভিতরের নাড়ী প্রভৃতি বাহির করিয়া এবং পালকাদি উপড়াইয়া ফেলিয়া উত্তমরূপে সাফ করিয়া লও। সাবধান যেন পক্ষীর গাত্রচর্ম্ম ছিঁড়িয়া না যায়। এক্ষণে একটি পাত্রে কিঞ্চিৎ মাখন বা ঘৃত দিয়া জ্বালে চড়াও, কিছু গোটা গরম মশলা ও কিসমিস ও বাদাম কুচা ছাড়, একটু ভাজা হইলে দুটো সরু চাউল ছাড়। নাড়িয়া চড়িয়া একটু জল দাও। নুণ, মরিচ গুঁড়া মিশাও। চাউল বারো আনা মত সিদ্ধ হইলে নামাইয়া পক্ষীর পেটের মধ্যে ভরিয়া দাও। চাউলে ঠিক যে পরিমাণে জল দিলে বারো আনা মত সিদ্ধ হইবে তদতিরিক্ত জল দিবে না। এক্ষণে জলে ময়দা মথিয়া তাহা পুরু করিয়া বেলিয়া লইয়া তাহার উপর পক্ষীটি রাখিয়া ঐ ময়দার খোলার দ্বারা.পক্ষীটি সম্পূর্ণরূপে ঢাকিয়া ফেল। এক খণ্ড পাৎলা গ্লোছ নেকড়া দ্বারা উহা উত্তমরূপে বাঁধিয়া হাঁড়ি করিয়া জলে সিদ্ধ কর। জলে কিছু আদা, পেঁয়াজ, নুন ও গোটা গোলমরিচ দিবে। বেশ সুসিদ্ধ হইলে নামাইয়া পক্ষীটি বাহির করিয়া লইয়া ‘হোয়াইট’ বা নিম্ন-লিখিত মত কোন এক প্রকার সস প্রস্তুত করিয়া তৎসহ আহার কর।
ব্রেড সস —একটি বড় সাদা পেঁয়াজ লও। খোসা উঠাইয়া ফেলিয়া অল্পক্ষণ উত্তপ্ত জলে চুবাইয়া তুলিয়া চারি টুকরা কর। ছয়টি গোলমরিচ, ছয়টি লবঙ্গ, এক গিরা জৈত্রী, ঈষৎ জায়ফলের গুঁড়া ও নুণ সহ একত্রে এক পোয়াটেক দুধের সহিত মিশাইয়া জালে চড়াও। সুসিদ্ধ হইলে নামাইয়া ছকিয়া লও। প্রয়োজন হইলে আরও দুধ মিশাইবে। এক্ষণে শুকনা পাঁরুটির গুড়া লইয়া ক্রমে নাড়িয়া নাড়িয়া এই দুধের সহিত মিশাও। যথেষ্ট পরিমাণে মিশন হইলে পুনঃ জালে চড়াও। সমস্ত নাড়িয়া মিশাইয়া নামাও। কিছু দুধের ক্রিম মিশাও।
আপেল সস —আপেলের (সিউফল) খোসা ছাড়াইয়া কুটিয়া লও। অল্প জলে একটু নুণ গোল মরিচের গুঁড়া, কিঞ্চিৎ আদা ও পেঁয়াজ সহ সিদ্ধ কর। নেকড়ায় ছাঁকিয়া মাড়িটুকু লও। দুধ, দুধের ক্রিম, মাখন ও কিঞ্চিৎ চিনিসহ পুনঃ জ্বালে উঠাইয়া নাড়িয়া গাঢ় করিয়া পক্ষীর উপর ঢালিয়া দাও। ব্রেড ও আপেল সসের সহিত পূর্ব্বলিখিত পক্ষী সিদ্ধ খাইতে পার।
হাড়িতে জল দিয়া তাহাতে মেষ অথবা ছাগ মাংস অথবা কোমল পক্ষীমাংস খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া ছাড়। নুণ, গোটা গোল মরিচ, আদা ও পেয়াজ মিশাও এবং ইচ্ছা করিলে তেজপাত ও দুই চারিট গোটা গরম মশল্লাও মিশাইতে পার। হাঁড়ি জ্বালে চড়াও। মাংস অর্দ্ধ সিদ্ধ হইলে সরু চাউল ছাড়। নুণ মাখন ও কিছু দুগ্ধ মিশাও। চাউল সিদ্ধ হইলে জাল হইতে হাড়ীী সরাইয়া উনানের পাশে দমে রাখ। জল শুকাইলে নামাও।
ইহা রোগীর পথ্যরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে।
মশল্প সংযুক্ত মাংসের যুষে ঘৃত সহ চাউল বা অন্ন এবং তৎসহ ভর্জ্জিত মৎস্য বা মাংস একত্রে পাক করাকে পলান্ন বা পোলাও বলা যাইতে পারে।
যাহারা মাংস খান না তাহারা শুধু মশল্পার যুষে ঘৃত সহ চাউল ও ভর্জ্জিত মৎস্য পাক করিয়া লয়েন। আঁষটে গন্ধবিশিষ্ট হয় বলিয়া সাধারণতঃ আবযুষের জলে মৎস্য ব্যবহৃত হয় না। তবে চিঙড়ী মৎস্যের যুষ হইতে পারে। যাহারা আবার মৎস্যও খান না তাহারা মৎস্যের পরিবর্তে ভর্জ্জিত আলু, কোবি, কড়াই শুঁটি, ছানা প্রভৃতি নিরামিষ সামগ্রী চাউলের সহিত একত্রে সাজাইয় মশল্পার যুষে পোলাও পাক করিয়া থাকেন। আবার মাংস মৎস্যাদির সহিতও আলু, কোবি, কড়াই শুঁটি প্রভৃতি আনাজ মিশাইয়া পোলাওয়ে দেওয়া হইয়া থাকে। মাংস, মৎস্য, ছানা ও আনাজ প্রভৃতি পূর্ব্বে ঘৃতে কষাইয়া লইতে হয় এবং চাউলও পূর্ব্বে ঘৃতে কষাইয়া লইলে ভাল হয়।
উপরি লিখিত তিন শ্রেণীর পোলাও ছাড়া আর এক শ্রেণীর পোলাও আছে, তাহাকে মিষ্ট পোলাও বলে। ইহার আবযুষ বা আখ্নির জল মিষ্ট স্বাদ বিশিষ্ট করিয়া লইতে হয় এবং তাহা কোনপ্রকার ফল (মেওয়া) সংমিশ্রণে সুগন্ধি ও সুস্বাদু করিতে হয় এবং উক্ত প্রকারের মেওয়া ঘিয়ে কষাইয়া লইয়া চাউলের সহিত সাজাইয়া রাঁধিতে হয়।
বাদাম, পেস্তা, কিস্মিস প্রভৃতি মেওয়া এবং দধি, মোয়া ক্ষীর, মালাই, বাদাম বাটা প্রভৃতি বিবিধ উপকরণ সংমিশ্রণে পোলাও আরও গুরুপক্ব করা যাইতে পারে। সুতরাং পোলাও মোটামুটি চারি শ্রেণীতে বিভক্ত হইলেও মশল্লা ও উপকরণাদি ভেদে ও পাকের তারতম্যে বহু প্রকারের হইয়া থাকে। এই গ্রন্থে সেই সমস্ত বিস্তারিত না লিখিয়া কেবল মোটামুটি চারি শ্রেণীর পোলাও রন্ধন সম্বন্ধে লিখিব।
পোলাওয়ে উত্তম মিহি পুরাতন আতপ চাউল এবং উত্তম ঘৃতের নিতান্ত আবশ্যক। বরেন্দ্রে বর্তমানে বাঁশফুল, ক্ষীরসাপাত, পরমান্নশালি, উকুনমধু, তিলকাপুর, চিনেশক্কর ও কাটারিভোগ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট সদগন্ধবিশিষ্ট মিহি আতপ চাউল সচরাচর পাওয়া যায়। ইহাদের দ্বারা উত্তম পোলাও রন্ধন চলিতে পারে। তবে সর্ব্বোৎকৃষ্ট পোলাও পাকে উৎকৃষ্ট মিহি পেশোয়ারি চাউলই প্রশস্ত। চিড়ার দ্বারাও সুন্দর পোলাও রাঁধা যায়।
পোলাও রঙ্গ করিতে গুঁড়া হলুদ বিশেষতঃ জাফরাণ ব্যবহৃত হইয়া, থাকে। জাফরাণ অমনি হাড়িতে দিতে হয় না। একটু ঘন দুগ্ধে বা দধিতে জাফরাণ ক্ষণিক ক্ষণ ভিজাইয়া রাখিয়া তাহার রঙ্গ এড়িলে তদ্বারা পূর্ব্বে উত্তমরূপে চাউল মাখিয়া লইতে হয় তবে পলান্নের রঙ্গ সমভাবে সুন্দর পীতাভ হইবে।
আবযুষের জল উত্তমরূপে প্রস্তুতের উপর পোলাওয়ের আস্বাদন প্রধানতঃ নির্ভর করে। সাধারণতঃ নিরামিষ এবং মৎস্যের পোলাওয়ে শুধু মশল্পাদির দ্বারাই আবযুষের জল প্রস্তুত হইয়া থাকে এবং মাংসের পোলাওয়ে মশল্লার সহিত কাঁচা মাংস-খণ্ড সিদ্ধ করিয়া আবযুষের জল প্রস্তুত করিতে হয়। তবে বড় চিঙড়ী মাছের মুড়া বা ছোট ছোট চিঙড়ী মাছের দ্বারা আবযুষের জল প্রস্তুত হইতে পারে। কেহবা ন্যাক্ড়ায় মশল্লা বাঁধিয়া তদ্বারা আবযুষের জল প্রস্তুত করিয়া থাকেন কেহবা তাহা না করিয়া মশল্লাগুলি এড়া ভাবেই জলে ছাড়িয়া সিদ্ধ করিয়া পশ্চাৎ সেই জল ছাকিয়া লয়েন। মাংসখণ্ডগুলি বা চিঙড়ী মাছ মশল্লার সহিত একত্রে জলে সিদ্ধ করিতে হয় এবং পশ্চাৎ সেই জল ছঁকিয়া লইতে হয়। আখনির জল পরিষ্কৃতভাবে ছাঁকা হওয়া প্রয়োজন নচেৎ পোলাও খিচখিচে হইবে।
ক। –মাংসের পোলাও।
একটা হাঁড়িতে গোটা ধনিয়া, গোটা জির, গোটা গোলমরিচ (কেহ বা সাধারণ জিরা ও মরিচের পরিবর্ত্তে সা-জিরা ও সা-মরিচ ব্যবহার করিয়া থাকেন) শুক্না লঙ্কা, (কেহ বা লঙ্কা ব্যবহার করা পছন্দ করেন না) গোটা পেঁয়াজ, আদা ছেঁচা ও গোটা গরম মশল্লা, নুণ ও একটু চিনি চাউলের পরিমাণ অনুসারে আন্দাজ মত লও। ৴৫ পাঁচ সের চাউলের পোলাও রাঁধিতে হইলে লঙ্কা ৴৹ এক ছটাক, ধনিয়া ৵৹ আধ পোয়া, জিরা ৴৹ এক ছটাক, গোলমরিচ ৴৹ এক ছটাক, আদা৵৹ আধ পোয়া, পেঁয়াজ ৵৹ আধ পোয়া, ছোট এলাচ দুই তোলা, লবঙ্গ দুই তোলা, দারচিনি ১০ আধ ছটাক, হিসাবে আখনির মশল্লায় লাগিবে। মাংস ছোট ছোট খণ্ড করিয়া চাউলের অৰ্দ্ধেক হিসাবে লও। হাঁড়িতে।৫ পনের সের মত শীতল জল দিয়া সমস্ত একত্রে জালে উঠাইয়া দাও। হাঁড়ির মুখ ঢাকিয়া দাও। সমস্ত বেশ সুসিদ্ধ হইলে অর্থাৎ তিন ভাগ জলের দুই ভাগ অবশিষ্ট থাকিলে এবং জলের রঙ্গ লালচে বর্ণ হইলে, নামাইয়া নেক্ড়ায় ছাঁকিয়া জলটুকু লও। ইহাই হইল আবযুষ বা আখনির জল। এক্ষণে আরও ২৷৷৹ সের মত মাংস অপেক্ষাকৃত বড় বড় খণ্ড করিয়া কুট। নুণ ও মরিচের গুঁড়া মাখিয়া ঘৃতে ভাজিয়া লও। চাউল ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া মেলাইয়া শুকাইতে দাও। শুকাইলে জাফরাণ দ্বারা উত্তম রূপে মাখিয়া রঙ্গ কর এবং সের করা বেশী কম পাঁচ ছটাক মত ঘৃতে ঈষৎ ভজিয়া লও। এই সময় চাউলের সহিত বাদামকুচা, পেস্তাকুচা ও কিস্মিস্ প্রত্যেকটি ৴৹ এক ছটাক পরিমিত হিসাবে মিশাইবে, অথবা বাদামাদি ঘৃতে ভাজিয়া লইয়া পশ্চাৎ মিশাইতেও পার। কেহ বা দুটো গরম মশল্লা এবং তৎসহ সা-জিরা ও সা-মরিচ গুঁড়া করিয়া কাপড়ে ছঁকিয়া লইয়া এই সময় চাউলের সহিত মিশাইয়া লয়েন।
এক্ষণে একটা বড় ডেক্চি বা তেজাল হাঁড়ির তলায় খানকয়েক তেজপাত বিছাইয়া তদুপরি ঐ চাউল সাজাও। একপরল চাউল সাজান হইলৈ— তদুপরি একপরল ভাজা মাংস সাজাও পুনরায় তদুপরি আর একপরল চাউল সাজাও পুনরায় তদুপরি একপরল মাংস সাজাও পুনরায় তদুপরি একপরল চাউল সাজাও। এক্ষণে সর্ব্বোপরি সাবধানে আবযুষের জল ঢালিয়া দাও। চাউলের মাথার উপর জল চারি আঙ্গুল মত উঁচা থাকা প্রয়োজন। হাঁড়ির মুখ ঢাকিয়া জালে বসাইয়া দাও। চাউল সিদ্ধ হইবামাত্র জালের উপর হইতে হাঁড়ি সরাইয়া উনানের এক পাশে মন্দা আঁচে দমে বসাইয়া রাখিবে। অল্প আঁচে ধীরে ধীরে সমস্তটা সুসিদ্ধ হইয়া যাইবে। ভাতের ন্যায় পোলাওর জল গালা যায় না, অল্প জলে সিদ্ধ করিতে হয়, সুতরাং জ্বাল হইতে না সরাইলে আঁচিয়া যাইয়া সমস্ত পোলাও এককালে নষ্ট হইয়া যাইবে। জল শুকাইয়া যাইয়া পোলাও সুসিদ্ধ অথচ ঝর্ঝরে হইলে নামাইবে।
মাংসের সহিত ইচ্ছ- করিলে আলু, কোবি, কড়াই শুঁটি, শালগম, পেঁয়াজ, আদা প্রভৃতি ঘৃতে করিয়া একত্র সাজাইয়া দিয়া পোলাও রাঁধিতে পার।
যাঁহারা অধিকতর গুরু পোলাও রাঁধিতে ইচ্ছা করেন তাঁহারা বাদামবাটা, পেস্তাবাটা, দুধ, দুধের সর, দধি, মালাই বা ভাজা মোয়াক্ষীর (গুঁড়ান), প্রভৃতি ভাজা চাউলের সহিত মিশাইয়া লইয়া পাক করিতে পারেন।
যাঁহারা অপেক্ষাকৃত লঘুভাবে পোলাও পাক করিতে চাহেন তাঁহারা জলে মাংসের সহিত অল্প পরিমাণে ধনিয়া, সা-জিরা, সা-মরিচ, আদা, পেয়াজ, নুণ ও সামান্য কিছু গোটা গরম মশল্লা একত্রে সিদ্ধ করতঃ আখনির জল প্রস্তুত করিয়া লইতে পারেন এবং চাউলে জাফরান এবং গরমমশল্লা প্রভৃতির গুঁড়া না মাখিয়া শুধু সের করা এক পোয়া মত ঘৃতে ভাজিয়া লইয়া এই আখনির জলে সিদ্ধ করিরা পোলাও পাক করিতে পারেন। এবং অল্প পরিমাণে বাদাম পেস্তাকুচি, কিস্মিস, আদা কুচি এবং পেঁয়াজ কুচি ঘৃতে ভাজিয়া পক্ব পোলাওয়ের উপর পশ্চাৎ ছড়াইয়া দিয়া লইতে পারেন।
আবার হাঁড়িতে ঘৃতে তেজপাত, সা-জিরা, সা-মরিচ ও গোটা গরম মশল্লা (ও ইচ্ছা করিলে পেঁয়াজ, আদা ও কিস্মিস) ফোড়ণ দিয়া তাহাতে চাউল ছাড়িয়া আংসাইয়া লইয়া নুণ সহ জলে সিদ্ধ করতঃ সাদাসিধে রকম ‘ঘি-ভাত’ রাঁধিতে পারেন।
মাংসের পোলাওয়ের সহিত মৎস্য বা মাংসের কালিয়া, কারি, কোর্ম্মা প্রভৃতি এবং কোপ্তা বা অপর কোন কিমা-কাবাব খাওয়া যাইতে পারে।
খ (১)—মৎস্যের পোলাও।
হাঁড়িতে গোটা ধনিয়া, গোটা জিরা, গোটা মরিচ (কেহবা সাধারণ জিরা মরিচের পরিবর্ত্তে সা-জিরা সা-মরিচ ব্যবহার করিয়া থাকেন) শুক্না লঙ্কা (কেহ কেহ ইহা বাদ দিয়াও থাকেন), গোটা পেঁয়াজ (মাছের পোলাওয়ে আদা না দিলেও চলে) গোটা গরমমশল্লা, নুণ ও একটু চিনি চাউলের পরিমাণ অনুসারে পূর্ব্ব লিখিত মত হিসাবে দিয়া উক্ত হিসাবানুরূপ শীতল জল দাও। হাঁড়ির মুখ ঢাকিয়া জালে উঠাইয়া দাও। জলের রঙ্গ লাল্চে হইয়া তিন ভাগের দুই ভাগ মত দাঁড়াইলে নামাইয়া ছাঁকিয়া জলটুকু রাখ।
চাউলের অর্দ্ধেক বা বারো আনা মত উত্তম পাকা রুই মাছ লইয়া অপেক্ষাকৃত বড় বড় মোটা মোটা খণ্ডে কুটিয়া নুণ হলুদ মাখিয়া ঘৃতে লাল্চে করিয়া ভাজিয়া রাখ।
উত্তম পুরাণ মিহি আতপ চাউল পরিষ্কার করিয়া ধুইয়া মেলাইয়া শুকাও। তৎপর জাফরান মাখিয়া সের করা পাঁচ ছটাক মত ঘৃতে ঈষৎ ভাজিয়া লও, কিছু গরমমশল্লা প্রভৃতির ছাঁকা গুঁড়া ও বাদাম পেস্তাকুচা ও কিস্মিস মিশাও।
একটি হাঁড়ির তলায় খানকয়েক তেজপাতা বিছাইয়া তদুপরি ঐ চাউল সাজাইয়া দাও। চাউলের উপর ভাজা মাছ সাজাও-পুনরায় চাউল সাজাও—পুনরায় তদুপরি ভাজা মাছ সাজাও-পুনরায় তদুপরি চাউল সাজাও এবং সর্ব্বোপরি আখনির জল সাবধানে ঢালিয়া দাও। জল চাউলের উপর চারি আঙ্গুল পরিমিত রাখিবে। হাঁড়ির মুখ ঢাকিয়া জালে উঠাইয়া দাও। চাউল সিদ্ধ হইবা মাত্র উনান হইতে হাঁড়ি উঠাইয়া উনানের এক পার্শ্বে অল্প আঁচে দমে বসাইয়া রাখ। সুসিদ্ধ হইয়া জল শুকাইয়া গেলে নামাও।
ভাজা মাছের সহিত ইচ্ছা করিলে লালচে করিয়া ভাজিয়া আলু, কোবি, কড়াই শুঁটী, বাঁধা-কোবি, শালগম পেঁয়াজ প্রভৃতি এক বা দুই প্রকারের আনাজ একত্রে সাজাইয়া দিয়া পোলাও পাক করিতে পার। রুচী অনুসারে ইহাও লঘু গুরুভেদে রাঁধিতে পার।
মাছের পোলাওয়ের সহিত মৎস্য বা মাংসের কালিয়া, কারি, কোর্মা, কিমা-কাবাব কিম্বা মাছের মুড়ী ঘণ্ট ডাইল খাইতে পার।খ (২)—চিঙড়ী মাছের পোলাও।
বড় বড় গল্দা বা মোচা চিঙড়ীর মুড়া কাটিয়া তদ্বারা মশল্লা সহযোগে আবযূষের জল প্রস্তুত করিবে। বড় চিঙড়ীর মাথা না পাইলে ছোট ছোট সমগ্র চিঙড়ীর দ্বারাই আখনির জল প্রস্তুত করিবে এবং বড় চিঙড়ীর শস্যাংশ নুণ হলুদ সহ কষাইয়া চাউলের সহিত সাজাইয়া উপরি লিখিত ভাবে প্রস্তুত আবযূষের জলের সহিত রুই মাছ বা মাংসের পোলাওয়ের ন্যায় পোলাও রাঁধিবে। রুচী অনুসারে ইহাও লঘু গুরু ভেদে পাক করিতে পার।
গ। নিরামিষ পোলাও।
পেঁয়াজ ও মৎস্য মাংসাদি বাদ দিয়া কেবলমাত্র মশলার দ্বারা ও ইচ্ছা করিলে তৎসহ আদা সংযোগে আখনির জল প্রস্তুত করিবে।
আলু, ফুলকোবি, বাঁধাকোবি, শালগম, স্কোয়াস, কড়াইশুটী, ছানা, ডাইলের পানিদলা বা ধোকা মধ্যে ইচ্ছা অনুসারে কোন এক বা একাধিক সামগ্রী লইয়া ঘৃতে লাল্চে করিয়া ভাজিয়া লও। তৎপর তাহা চাউলের সহিত পোলাওয়ের নিয়ম অনুসারে সাজাইয়া পোলাও পাক কর। ইহাও উপকরণের তারতম্যে লঘু গুরু ভেদে রাঁধিবে।
নিরামিষ পোলাওয়ের সহিত বিবিধ নিরামিষ ঝাল, কালিয়া, টিকলি কালিয়া, ভাজা, ডাইল প্রভৃতি খাইবে।
ঘ। মিষ্ট পোলাও।
আনারস ডুমা ডুমা করিয়া কাটিয়া লও। যাহাতে আনারসে মুখ না ধরে তজ্জন্য বলা বাহুল্য আনারসের চোকগুলি বাদ দিবে এবং নুণ মাখিয়া কিছুক্ষণ পরে ধুইয়া ফেলিয়া তাহার তদ্দোষ নষ্ট করিবে। আনারসের সহিত পরিমাণ মত চিনি, গোটা গরম মশল্লা, কাবাব-চিনি ও জায়ফল দিয়া জলে সিদ্ধ কর। সুসিদ্ধ হইলে ছাঁকিয়া জলটুকু লও। ইহাই হইল আবযুষের জল। এক্ষণে আরও আনারস খণ্ড লইয়া ঘৃতে ভাজিয়া রাখ।
চাউল ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া শুকাইয়া লও, তাহাতে জাফরান মাখিয়া ঘৃতে ভাজ। কিছু জায়ফল ও গরমমশল্পার গুঁড়া ও বাদাম পেস্তার কুচা ও কিসমিস মিশাও। হাঁড়িতে খানকত তেজপাত সাজাও—তেজপাতের উপর ক্রমে ঐ চাউল ও আনারস খণ্ড পরলে পরলে সাজাও। আখনির জল ঢালিয়া দাও। সিদ্ধ হইলে উনানের উপর হইতে সরাইয়া উনানের এক পার্শ্ব অল্প আঁচে দমে বসাইয়া রাখ। সুসিদ্ধ হইয়া জল মরিয়া গেলে নামাও। ইহার সহিত ঘৃতে ভাজা মোয়াক্ষীরের গুঁড়া মিশাইলে স্বাদ উৎকৃষ্ট হয়। কিছু গোলাপ জল উপরে ছড়াইয়া দিতে পার।
আপেল, থোবানি, আলুবোখার, পিচফল, আঙ্গুর প্রভৃতির দ্বারা এইরূপে পোলাও রাঁধিবে।
কমলু লেবুর পোলাও রাঁধিতে হইলে অর্দ্ধ সিদ্ধ পোলাওয়ে কমলা লেবুর রস চিপিয়া মিশাইতে হইবে এবং কমলা লেবুর কোয়া চাউলের সহিত একত্রে হাঁড়িতে সাজাইয়া দিতে হইবে। আখনির জলে কমলা লেবু না দিয়া তাহার শুষ্ক খোসা দিয়া সুগন্ধ করা যাইতে পারে।
বাদামের পোলাওয়ে বাদাম কুচি কিছু বেশী করিয়া মিশাইতে হইবে এবং বাদাম বাটিয়া অর্দ্ধ সিদ্ধ পোলায়ের সহিত মিশাইতে হইবে।
নারিকেলের পোলাওয়ে নারিকেলের দুগ্ধ এবং নারিকেল-কুড়া মিহি করিয়া বাটিয়া মিশাইতে হইবে। দহির পোলোওয়ে দহি মিশাইবে।
গোলাপী পোলাওয়ে গুলকন্দ দিয়া আখনির জল প্রস্তুত করিবে এবং পরিশেষে কিছু গোলাপ জল বা ঈষৎ গোলাপী আতর মিশাইয়া সুগন্ধী করবে। অপরাপর মিষ্ট পোলাওয়েও ইচ্ছা করিলে গোলাপ জল বা ঈষৎ গোলাপী আতর মিশাইতে পার।
- ↑ ইউরোপীয় রন্ধনে সিদ্ধ একটা প্রধান খাদ্য। মৎস্য এবং সব্জী ইউরোপীয়গণ সাধারণতঃ সিদ্ধ করিয়াই খান। তবে সচরাচর শ্রেফ্ সাদা জলে সিদ্ধ না করিরা মৎস্য অথবা মাংসের সুরুয়ায় সিদ্ধ করিয়া লন এবং সুইট অয়েল, ভিনিগার (সেরকা), মাখন, নুণ, মরিচের গুঁড়া রাইসরিষার গুঁড়া এবং সিদ্ধ ডিমের হরিদ্রা অংশ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার উপাদানের সংমিশ্রণে বিভিন্ন প্রকারের ‘সস্' প্রস্তুত করিয়া লইয়া সব্জী ও মৎস্যের সহিত মিশাইয়া আহার করেন। বিভিন্ন প্রকারের সসের নাম অনুসারে আহরীয় দ্রব্যের নামকরণ হইয়া থাকে।