বরেন্দ্র রন্ধন/প্রথম অধ্যায়
বরেন্দ্র রন্ধন।
প্রথম অধ্যায়
পোড়া।
নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একদা আহার করিতে বসিয়া ত্বদীয় প্রিয় বয়স্য গোপালকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “গোপাল, প্রথমে কি খাওয়া যায় বলত?” গোপাল সপ্রতিভভাবে উত্তর করিয়াছিল, “মহারাজ, আগে ‘পোড়া’ খান, পোড়া-মুখে সব ভাল লাগিবে।” গোপাল ইহা রহস্য করিয়া কহিলেও কথাটা একেবারে হাসিয়া উড়াইয়া দিবার নহে। আদিমকালে মনুষ্য-জাতি বোধ হয় সর্ব্বপ্রথম আহারীয় দ্রব্য পোড়াইয়া লইয়া ভক্ষণ করা ছাড়া অপর কোনরূপে রন্ধন করিয়া আহার করিতে জানিত না। পরে সম্ভবতঃ ক্রমে জলে সিদ্ধ প্রভৃতি করিতে শিখিয়াছিল। এই নিমিত্ত এই গ্রন্থে সর্ব্বাগ্রে ‘পোড়ার’ স্থান দেওয়া হইল।
শাক, তরকারী, মৎস্য, মাংস উনানের মধ্যে গরম ছাইয়ের উপর অথবা জলন্ত কাঠের অঙ্গারের উপর রাখিয়া বা ধরিয়া উলটাইয়া পালটাইয়া ঝলসানোকে 'পোড়া’ বলা যাইতে পারে।
পোড়াইবার কালে সাধারণতঃ ঝাল, নুণ এবং তৈল অথবা ঘৃত প্রভৃতির দ্বারা পোড়াইবার দ্রব্য মাখিয়া তবে পোড়াইতে হয় অথবা কখনও কখন পূর্ব্বে পোড়াইয়া লইয়া পশ্চাৎ ঝাল নুণ এবং তৈল বা ঘৃত প্রভৃতি মাখিয়া খাইতে হয়। স্থল বিশেষে পোড়াইবার দ্রব্যটা কলার পাতায় বা তদ্বৎ কোন পদার্থে জড়াইয়া পোড়াইয়া লইতে হয়। নিয়ে সাধারণতঃ যে সমস্ত দ্রব্য পোড়াইয়া খাইবার প্রথা এতদ্দেশে প্রচলিত আছে তাহাই লিখিতি হইল।
১। আলু পোড়া
গোল আলু, শাখালু, লাল-আলু, গড়-আলু, প্রভৃতি নির্ব্বাণোন্মুখ আথার উত্তপ্ত ছাইয়ের মধ্যে ফেলিয়া রাখিলে ধীরে ধীরে পুড়িয়া যাইবে।প্রয়োজন অনুরূপ পুড়িলে উঠাইয়া উপরের ছাই জলে ধুইয়া ফেলিবে ও খোসা ছাড়াইয়া সরিষাব তৈল, নুণ ও কাচা লঙ্কা মাখিয়া খাইবে।
২। কাঁঠাল বিচি পোড়া
খোসা সমেত কঁঠাল বিচি উপরোক্ত রূপে পোড়াইবে, পরে পোড়া খোসা ছাড়াইয়া ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া তৈল, নুণ ও কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া খাইবে। আবার খোসা ছাড়াইয়া কাঁঠাল বিচি কাঠ খেলার ভাজিয়া লইলেও বেশ হয়।
৩। মটরের ডাইল পোড়া
মটরের ডাইল জলে ভিজাইয়া রাখিয়া পাটায় বাটিয়া লও। একটু শুকনা শুকনা ভাবে বাটিয়ে লইবে। এক্ষ্ণে হাতে চাপিয়া অপেক্ষাকৃত বড় বড় গেছের দল পাকাও—কলপাতায় জড়াইয়া বাঁধ। আখার মধ্যে উত্তপ্ত ছাইয়ের মধ্যে রাখ। প্রয়োজনানুরূপ পুড়িলে উঠাইয়া উপরের ছাই ঝাড়িয়া ফেলিয়া ঘৃত অথবা সরিষার তৈল, মুণ ও কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া ভাতের সহিত খাও। আবার মটরের ডাইল-বাটার সহিত সরিষাবাটা ও -নারিকেল-কুড়া বাট ও নুণ মিশাইয়া উপরে নীচে কলাপাত দিয়া তাওয়ার উপর রাখিয়া চাপড়ী আকারে পোড়ান যায়।
৪। কুমড়া-বড়ি পোড়া
খড়ের আগুণে কুমড়াকড়ি ঝলম্বাইয়া লও। ফুটন্ত জলে ছাড়। সিদ্ধ হইলে নাম ইয়া জল চিপিয়া ফেলিয়া সরিষার তৈল, নুণ ও কাঁচা লঙ্কা মাখিয়া ভাতের সঙ্গে খাও। তৈল একটু পরিমাণে বেশী মাখিতে হয়।
৫। পটোল পোড়া
পটোল সিদ্ধ অপেক্ষা পোড়াইয়া খাইতেই ভাল। এক বা একাধিক পটোল লোহার সরু লম্বা গোছের শিকে ফুড়িয়া জলন্ত আখার মধ্যে দিয়া শিক ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া পোড়াও। পুড়িলে বাহির করিয়া শিক হইতে খুলিয়া সাফ করিয়া তৈল, নুণ ও কাচা লঙ্কা মাখিয়া খাও। ইচ্ছা করিলে অল্প কিছু পোড়াইয়া লইয়া পরে জলে বা ভাতে দিয়া সিদ্ধ করিয়া মাখিয়া খাইতে পার
৬। বেগুণ পোড়া
বেগুণ সাধারণতঃ সিন্ধ লুপেক্ষ পোড়াইয়া খাওয়াই প্রশস্ত। উত্তম বড় অথচ জালি দেখিয়া বেণ্ডন লও। গায়ে একটা ছেঁদা করিয়া একটু তৈল মাখাইয়া আবার উত্তপ্ত ছাইয়ে ফেলিয়া পোড়াও। পরে পোড়া অংশ তুলিয়া পরিষ্কার করিয়া ছানিয়া লও। তৈল (একটু বেশী পরিমাণে), নুণ ও কাঁচা লঙ্কা মাহিয়া খাও, ইচ্ছা করিলে তৎসহ আদা বাঁটা পেঁয়াজ বাটা মাখিয়া লইতে পার।
কেহ কেহ বেগুণের দুই পার্শ্বে দুইটা ছেঁঁদা করিয়া এক ছেঁদায় একটা কাঁচা লঙ্কা ও অপর ছেঁদায় এক কোয়া রশুন বা হিঙ পুরিয়া একটু তৈল মাখিয়া পোড়াইল লয়েন। পরে কাঁচা লঙ্কা ও রশুন বা হিঙ সহ ঐ পোড়া বেগুনে তৈল, নুণ, পেঁয়াজ ও আদার রস মাখিয়া খান।
বেগুণের পার্শ্বে ছেঁদা না করিয়া পোড়াইলে উহা সশব্দে ফাটিয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে। পটোলেরও তাহাই।
৭। আমলু শাক পোড়া
আমলুর শাক কলাপাতায় জড়াইয়া আখার মধ্যে ছাইয়ে ফেলিয়া পোড়াও। পরে পোড়া কলার পাতা ফেলিয়া দিয়া তৈল, নুণ, কাচা লঙ্কা ও সরিষা বাটা মাখিয়া খাও। কেহ কেহ তৈল, নুণ, কাঁচা লঙ্কা ও সরিষা বাটা দিয়া পূর্ব্বেই শাক মাখিয়া পোড়াইয়া লয়েন। এতৎসহ নারিকেল কুড় মিশাইয়াও পোড়ান যাইতে পারে।
৮। নারিকেল-কুড়া পোড়া
পোড়া। (আমিষ)
৯। টাকি (ছাতিয়ান) মাছ পোড়া
টাকি মাছের মুড়া ফিছা কাটিয়া ফেলিয়া এবং পেটের নাড়ী প্রভৃতি বাহির করিয়া ফেলিয়া আঁইষ্ উঠাইয়া সাফ করিয়া লও। এক্ষণে জ্বলন্ত কাঠের কয়লার উপর ধরিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া পোড়াইয়া লও। পরে মাছ পরিষ্কার করিয়া ফুটন্ত জলে হলুদ মিশাইয়া পুনঃ সিদ্ধ করিয়া লও। কাঁটা বাছিয়া ফেলিয়া তৈল (একটু বেশি পরিমাণে), নুণ ও কাঁচা লঙ্কা, মাখিয়া খাও।
শোল মাছও এইভাব পোড়াইতে হয়।
১০। ইলিশ মাছ পোড়া।
(ক) ইলিশ মাছের মুড়া ফিছা কাটিয়া ফেলিয়া এবং আইষ্ উঠাইয়া ফেলিয়া ছোট হইলে গোটা মাছ এবং বড় হইলে দুই বা তিন খণ্ড করিয়া লও। তৈল, নুণ, হলুদ, সরিষাবাটা ও কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়া উত্তমরূপে মাখ। কলাপাতা দিয়া উত্তম রূপে তিন, চারি পরল করিয়া জড়াইয়া বাধ। উনানের উত্তপ্ত ছাইএর উপর ফেলিয়া ধীরে ধীরে পোড়াও। পরে পোড়া কলাপাতা সাবধানে ছাড়াইয়া ফেলিয়া মাছ খাও।
(খ) মাছ খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া উপরি-উক্ত বিধানে মাখ। গাদা অপেক্ষা পেটীর মাছেই ইহা ভাল হয়। একখানা লোহার তৈ বা তাওয়ার উপর ২।৩ পরল কলার পাতা বিছাইয়া তদুপরি মাখা মাছ সাজাও। অপর এক খণ্ড কলাপাত দিয়া ঢাক এবং সমস্ত আর একখানি লোহার তাওয়া দিয়া ঢাক, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর বসাও এবং তাওয়ায় ঢাক্নার উপরও জ্বলন্ত অঙ্গার দাও। কিছুক্ষণ পরে মাছ বাহির করিয়া লইয়া খাও। ইহাকে ‘পাতাড়ি’ বলে।
(গ) উপরি-উক্ত বিধানে মাছ কুটিয়া ও মাখিয়া ছাঁচি কুমড়ার পাতা দিয়া জড়াও, তৎপর তাহা আবার কলাপাতায় উত্তমরূপে জড়াও। ভাত ঢালা গালায় কিছু ভাত ঢালিয়া সেই উত্তপ্ত ভাতের উপর পাতা-জড়ান ইলিশ মাছ রাখিয়া পুনরায় তদুপরি আরও উত্তপ্ত ভাত ঢালিয়া দাও। ভাতের উত্তাপে ইলিশ মাছ সুপক্ব হইবে। সাবধান, এরূপভাবে পাতা দ্বারা মাছ জড়াইবে যেন মাখা মাছের কোন অংশ গড়াইয়া বাহির হইয়া ভাতের উপর না পড়ে। তাহা হইলে ভাতের আঁষটে গন্ধ হইবে। পক্ষান্তরে ভাতের জলও যেন পাতার মধ্যে না ঢোকে। এই নিমিত্ত মাড় গালা ভাতের মধ্যে মাছ রাখিয়া এই 'পাতাড়ি' পাক করাই নিরাপদ। কুমড়া পাতা সহ মাছ একত্রে মাখিয়া খাইবে।
বাঁশপাতা, পবা, কৈ, টাকি এবং চিংড়ী মাছের উপরোক্ত প্রকারে পাতাড়ি রাঁধা হইয়া থাকে। কিন্তু তৎক্ষেত্রে কুমড়া পাতার পরিবর্ত্তে শুধু কলাপাতায় মাছ জড়াইবে।
(ঘ) একটী উত্তম ঝুনা নারিকেলের উপরের ছোবা উঠাইয়া ফেলিয়া মুখ একটু কাটিয়া ভিতরের জল বাহির করিয়া ফেল। এক্ষণে নুণ, হলুদ, কাঁচা লঙ্কা বাটা এবং সরিষা বাটা মাখান ইলিশ মাছ নারিকেলের ভিতরে পুরিয়া মুখ বন্ধ করিয়া দাও। নারিকেলের মালার উপর এক আঙ্গুল পুরু করিয়া মাটির লেপ দাও। অখার মধ্যে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর রাখ। এক পাশ পুড়িয়া মাটি লাল হইলে অপর পাশ উল্টাইয়া দাও। পরে আখার মধ্য হইতে বাহির করিয়া মাটি ছাড়াইয়া সাবধানে মাছ বাহির করিয়া লইয়া খাও।
চিংড়ী মাছও এইরূপে নারিকেলের মধ্যে পুরিয়া পোড়াইয়া খাইতে ভাল। (ঙ) গ্রিল (বৈদেশিক)—ইলিশ মাছের মুড়া ফিঁছা কাটিয়া ফেলিয়া লম্বালম্বি ভাবে চিরিয়া বা কাটিয়া দুই ফাল্টা কর। ফাল্টা বড় বড় হইলে তাহা অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট খণ্ডে কাটিয়া লও, প্রতি খণ্ডেই গাদা ও পেটীর মাছ থাকিবে। এক্ষণে নুণ, গোলমরিচের গুঁড়া, রাইসরিষার গুঁড়া, একটু চিনি, লেবুর রস অথবা সির্কা এবং এঞ্চবী সস্ দ্বারা মাছ মাখিয়া খানিকক্ষণ ঢাকিয়া রাখ। এক্ষণে ‘গ্রিলদানিতে’ ঘি মাখিয়া জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর বসাও। উত্তপ্ত হইলে মাছের টুক্রাগুলি তদুপরি সাজাইয়া দাও। ঝল্সাইতে থাক। মধ্যে মধ্যে একটু একটু ঘি দিবে—যাহাতে মাছ গ্রিল্দানির সহিত পুড়িয়া না ধরে। এক পিঠে হইলে অপর পিঠ উল্টাইয়া দাও। লাল্চে রঙ্গ হইলে নামাও।
লেবুর রস, গোলমরিচের গুঁড়া ও মাখন একত্রে গরম করিয়া এই মাছে মাখিয়া খাও।
শোল, টাকি, মাগুর প্রভৃতি মাছের এইরূপে ‘গ্রিল’ হইতে পারে।
(চ) স্মোক (বৈদেশিক)—উপর-উক্ত বিধানে সমস্ত মসলা দিয়া মাছ মাখিয়া পরে গ্রিল্দানিতে ঘি মাখাইয়া মাছ সাজাও। জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর কিছু করাতের গুঁড়া, ভিজা পোয়াল (বিচালি) বা গুড়ের মুড়কি প্রভৃতি দিয়া খুব ধোঁয়া কর। তদুপরি গ্রিল-দানি বসাইয়া দাও। সমস্তটা একটা কাঠেৱ প্যাক্বাক্স বা তদ্বৎ কোন ঢাক্নার দ্বারা ঢাকিয়া ফেল, যেন ধোঁয়া উত্তমরূপে ইলিশ মৎস্যে গায়ে লাগিতে পারে। এক পিঠ লাল্চে হইলে অপর পিঠ উল্টাইয়া দাও। পরে ইলিশ মাছ বাহির করিয়া খাও।
ইলিশ মাছের ডিম্বেরও গ্রিল্ এবং স্মোক্ হইয়া থাকে।
বাঁশপাতা, পবা, বাচা প্রভৃতি কোমল মাছের এইরূপে ‘স্মোক’ করা যাইতে পারে।
(ছ) বেক (বৈদেশিক)— ইলিশ মাছ ছোট ছোট টুক্রা করিয়া কাটিয়া লও। নুণ, গোল মরিচের গুড়া, লেবুর রস বা ভিনিগার, পার্সলী শাকের কুচি এবং একটু এঞ্চবী সস ও সালাদ অয়েল দিয়া মাছ মাখ। একখানি পাই-ডিসে ঘৃত মাখিয়া মাছ সাজাও। কিছু দুধের ক্রিম মিশাইতে পার। উপরে পার্মেসন চিজের গুঁড়া এবং ব্রেডক্রাম্ব ছড়াইয়া দাও। এক্ষণে ‘এই পাই-ডিস্টী একটী তুন্দরের বা তেজালের মধ্যে রাখিয়া মাছ বেক্ বা পুটপাক কর। তেজালের মধ্যে রাখিলে তাহার উপরে ও নীচে জ্বলন্ত অঙ্গার দিতে হইবে।
চিঙড়ী, রুই প্রভৃতি মাছেরও এই বা অন্য প্রকারে বেক্ হইতে পারে। দ্রষ্টব্য —‘পোড়া’ মাংস রন্ধন সম্বন্ধে ‘ভাজি’ অধ্যায়ে লিখিত হইবে।