বরেন্দ্র রন্ধন/পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়
মেথি পর্ব্ব
(২) চড়চড়ী (নিরামিষ)
এক বা একাধিক আনাজ, মৎস্য কিম্বা উভয় একত্রে তৈলে তেজপাত, লঙ্কা ও মেথি ফোড়ন দিয়া আসাইয়া নুণ, হলুদ সহ জলে সিদ্ধ করতঃ পশ্চাৎ তাহাতে কাঁচা লঙ্কা ও সরিষাবাটা মিশাইয়া শুক্না চড়চড়ে গােছ করিয়া নামাইলে ‘চড়চড়ী’ রাঁধা হইল।
একাধিক আনাজ বা মৎস্যাদির চড়চড়ীতে আনাজাদি একসঙ্গে না আংসাইয়া পৃথক পৃথক ভাবে পূর্ব্বে তেলে কষাইয়া লইতে হয়। আমিষ চড়চড়ীতে অতিরিক্ত পেঁয়াজ ফোড়ন দিলে আস্বাদন উৎকৃষ্ট হয়, এবং মােটা মাছের চড়চড়ীতে একটু শুক্না লঙ্কাবাটা মিশাইলে তবে তাহার স্বাদ ও রঙ সুন্দর হয়। সরিষাবাটা সর্ব্বশেষে মিশাইতে হইবে, অর্থাৎ চিড়চড়ী রন্ধন শেষ হইলে উনান হইতে নামাইবার অব্যবহিত পূর্ব্বে মিশাইবে। কাঁচালঙ্কা সরিষাবাটার সহিত একত্রে বাটিয়া মিশাইতে পার, অথবা গােটা রাখিয়া চিরিয়া আলাহিদা ভাবে পূর্ব্বেই ব্যঞ্জনে জল দেওয়ার পর ছাড়িয়া সিদ্ধ করিয়া লইতে পার। চড়চড়ীতে পিঠালি দিতে হয় না। নামাইয়া একটু সরিষার তেল মিশাইলে স্বাদ ভাল হয়। ছেঁচ্কীর ন্যায় চড়চড়ীতে লঙ্কা, মেথি ফোড়ন পড়ে, ছেঁচ্কীর ন্যায় চড়চড়ীর আনাজাদিও উত্তমরূপে কষাইয়া লইতে হয় এবং তৎবৎ শুকনা শুক্না করিয়া নামাইতে হয়; কিন্তু ছেঁচ্কীতে যেমন সচরাচর অপেক্ষাকৃত বুড়া গোছের আনাজ ছেঁচিয়া বা মিহি করিয়া কুটিয়া লইতে হয় চড়চড়ী বুড়া কচি উভয়বিধ আনাজেই রাঁধা চলে এবং তাহা অপেক্ষাকৃত বড় বড় ফলা ফলা করিয়া (ঈষৎ লম্বা ছাঁদে) কুটিয়া লইতে হয়। চড়চড়ীর আনাজাদি উত্তমরূপে কষান হইলেও ছেঁচ্কীর ন্যায় অতিরিক্ত কষাইতে হয় না। সুতরাং ছেঁচ্কী রাঁধিলে যেমন নসনসে গোছ হয়, চড়চড়ী তাহা হয় না, পরন্তু সরিষা বাটা মিশাইয়া শুকাইয়া লওয়া হয় বলিয়া ইহা চড়চড়ে গোছ হইয়া থাকে। তারপর ছেঁচ্কী যেমত এক প্রকার আনাজেই বা তৎসহ এক প্রকার মৎস্যযোগে সাধারণতঃ রাঁধা হইয়া থাকে, চড়চড়ী একাধিক আনাজ বা মৎস্য দ্বারা রাঁধা অতি সাধারণ। মেথি পর্ব্বে চড়চড়ীর বিশেষত্ব কাঁচা লঙ্কা ও সরিষা বাটা সংযোগে। এবং আমিষ চড়চড়ী হইলে তৎসহ পেঁয়াজ ফোড়নে।
বরেন্দ্রে কোন কোন ‘পোড়ায়’, ‘সিদ্ধে’ এবং ‘পাট ভাজিতে’, ‘অম্বলে’ (টকে) এবং ‘চাট্নীতে’ এবং সমস্ত ‘চড়চড়ীতে’ সরিষা বাটা সংযোগ করে তৎব্যতীত অপর কোনও ব্যঞ্জনে করে না। এবং দুই একটি ‘ভাজিতে’ বা ‘ছেঁচ্কীতে’, ‘শুক্তানিতে’ এবং ‘অম্বলে’ (টকে) সরিষা ফোড়নরূপে ব্যবহার করে। কাঁচা লঙ্কা সংযোগ সম্বন্ধেও প্রায় ঐ বিধি, কেবল কোনও কোনও ডাইলে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিতে হয়, এবং শুক্তানিতে কাঁচা লঙ্কা সংযোগ নিষিদ্ধ। পেঁয়াজ কাঁচা অবস্থায় কোনও কোনও ‘পোড়ায়’, ‘সিদ্ধে’, ‘সূপে’ এবং ‘কালিয়াতে’, ‘চাট্নীতে’ প্রযুয্য এবং ফোড়ন অবস্থায় কোনও কোনও ‘ভাজিতে’, ‘চড়চড়ীতে’, ‘ডাইলে’ এবং ‘কালিয়াতে’ দেয়। এই সকল নির্দ্দিষ্ট ব্যঞ্জন ব্যতীরেকে অপর কোনও ব্যঞ্জনে সরিষা, কাঁচা লঙ্কা ও পেঁয়াজের
প্রয়োগ অপ্রশস্ত। কিন্তু দক্ষিণ বঙ্গে ‘ঝালে’ এবং কালিয়াতে’ (এবং বৈদেশিক ‘কারিতে’) ও সরিষা বাটা দেয়।
চড়চড়ীর সহিত শুক্তানির সাদৃশ্য ঐ তেজপাত, মেথি, লঙ্কা ফোড়নে ও বাটা ঝাল বর্জ্জনে, কিন্তু পার্থক্য অতিরিক্ত সরিষা ফোড়নে কিন্তু তৎবাটা বর্জ্জনে। চড়চড়ীতে সরিষা সংযোগ একটি বিশেষত্ব কিন্তু সে সরিষা বাটা রূপে—কদাপি ফোড়ন রূপে নহে। আবার শুক্তানিতেও সরিষা সংযোগ একটি বিশেষত্ব, কিন্তু সে ফোড়ন রূপে—কদাপি বাটনা রূপে নহে। শুক্তানিতে তৎস্থলে পিঠালী, পোস্ত বা তিল-পিঠালী বাটা অথবা আদা বাটা (বা ছেঁচা) মধ্যে ক্ষেত্রানুসারে কোন একটি প্রযুক্ত। পক্ষান্তরে এ গুলি মধ্যে কোনটাই চড়চড়ীতে আদৌ মিশাইতে হইবে না। অপরন্তু শুক্তানিতে কাঁচা লঙ্কা অথবা পেঁয়াজ সংযোগ আদৌ করিবে না।
মেথি ফোড়ন দ্বারা পক্ব ব্যঞ্জন মাত্রেই বাটা ঝাল (জিরামরিচ বাটা, ধনিয়া বাটা, তেজপাত বাটা) দেওয়া অপ্রশস্ত, কেবল তাহাতে কিছু শুক্না লঙ্কা বাটা দেওয়ায় বাধার কারণ নাই। সুতরাং চড়চড়ী বা শুক্তানিতে (অথবা ‘ছেঁচকীতে’ বা ‘ঝোলে’) আদৌ বাটা ঝাল দিবে না। শুক্না লঙ্কা বাটাও সচরাচর আমিষ ব্যঞ্জনে বিশেষতঃ মোটা মাছের ব্যঞ্জনে অল্প পরিমাণে দেয়।
বিলাতী কুমড়া, গাভথোর এবং বোয়াল প্রভৃতি তৈলাক্ত মাছের চড়চড়ীতে ও অপরাপর ব্যঞ্জনেও বটে, দুটো কালজিরা অতিরিক্ত ফোড়ন দিবে। কাঁচা আম, আমড়া, তেঁতুল প্রভৃতি মিশাইয়া চড়চড়ী অম্লস্বাদবিশিষ্ট করা যাইতে পারে। আবার তিক্তস্বাদবিশিষ্ট চড়চড়ীও হইতে পারে।চড়চড়ীতে সচরাচর কোনও অনুষঙ্গ দেয় না।
আর এক রকম চড়চড়ী আছে তাহাকে ‘ঝাল-চড়চড়ী’ কহে। তাহা নামে চড়চড়ী হইলেও এবং দেখিতেও কতকটা চড়চড়ীর মত হইলেও
প্রকৃত পক্ষে ‘ঝাল’ অধ্যায় ভুক্ত। তাহাতে মেথির পরিবর্ত্তে জিরা ফোড়ন পড়ে এবং তাহাতে জিরা-মরিচাদি সর্ব্বপ্রকার বাটা ঝাল সংযোগ করা হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাতে সরিষা বাটা কিম্বা কাঁচা লঙ্কা মিশাইতে হয় না। আবার আমিষ ‘কালিয়া’ শুষ্ক করিয়াও ‘ঝাল-চড়চড়ী’ প্রস্তুত হয়।
৯৬। পাঁচ মিশালী সাধারণ চড়চড়ী
আলু, পটোল, বেগুন, ঝিঙ্গা, গভথোড়, শশা, ছাঁচি কুমড়া, বিলাতী কুমড়া, কাঁটাল বীচি, ডাঁটা, সজিনা শুঁটি, লাল আলু, মূলা, শিম, বরবটী, বীন, কলাইশুঁটি, কড়া ইঁচড়, ডুমুর, কাঁকরোল, পুঁই ডাঁটা, প্রভৃতি দ্বারা সাধরণতঃ পাঁচ মিশালী চড়চড়ী রাঁধা হইয়া থাকে। ইহা সওয়ার আধুনিক আনাজ ফুলকোবি, ওলকোবি, সালগম, স্কোয়াস প্রভৃতিও চড়চড়ীতে বেশ বাবহৃত হইতে পারে। তবে কাঁচা কলা, কচু প্রভৃতি সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয় না।
পাঁচ মিশালী চড়চড়ীকে অনেক সময়েই অম্লস্বাদবিশিষ্ট করা হইয়া থাকে। তৎক্ষেত্রে আম কড়ালি, আমড়া, বন কাঁটাল, কদম ফুল, অথবা তেঁতুল প্রভৃতি চড়চড়ীর সহিত মিশ দেওয়া হইয়া থাকে। করিলা প্রভৃতি তিক্তস্বাদ বিশিষ্ট আনাজ সাধারণত পাঁচমিশালী চড়চড়ীর সহিত ব্যবহৃত হয় না। তদ্বারা পৃথকভাবে তিক্ত চড়চড়ী রাঁধা হইয়া থাকে।
উল্লিখিত আনাজের মধ্যে চারি পাঁচ প্রকারের আনাজ বাছিয়া লইয়া ঈষৎ লম্বা ছাঁদে অথচ পাতলা গোছ করিয়া কুটিয়া লও। প্রত্যেক আনাজ আলাদা আলাদা ভাবে তেলে কষাইয়া তোল। কষান একটু ভাল হওয়া আবশ্যক অথচ অতিরিক্ত না হয়। অতঃপর তৈলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া কষান আনাজ ছাড়। ঈষৎ আংসাইয়া নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ইচ্ছা করিলে এই সময় কিছু শুক্না লঙ্কা বাটাও মিশাইতে পার। তবে তাহা আমিষ চড়চড়ীতে যেমন খাটিবে নিরামিষে তেমন খাটিবে না। সিদ্ধ হইলে একটু চিনি দিতে পার। শুকাইলে কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা (একত্রে বাটিয়া লইতে পার।) মিশাও। বেশ শুক্না শুক্না করিয়া নামাও। প্রকাশ থাকে যে চড়চড়ীতে যেটুকু জল দিলে আনাজ সিদ্ধ হইবে মাত্র সেইটুকু জল দিবে। অতিরিক্ত জল দিলে আনাজ অধিক নরম হইয়া যাইয়া চড়চড়ী কেঁৎকেঁতে হইবে—চড়চড়ে হইবে না। পাকা বিলাতী কুমড়া মিশ দেওয়া থাকিলে চড়চড়ীর স্বাদ উত্তম হয়।
৯৭। পাঁচ মিশালী মিহি চড়চড়ী
বিলাতী কুমড়া, আলু, পটোল, বেগুনাদির খোসা, বোঁটা প্রভৃতি যাহা ফেলা যায়, তদ্দ্বারা এই চড়চড়ী রাঁধা হয়। এই গুলি মিহি করিয়া কুটিয়া লইতে হয় বলিয়া এই চড়চড়ী দেখিতে ঘণ্টের মত হয়।
আলুর খোসা, কাঁচা বিলাতী কুমড়ার খোসা, পাকা বিলাতী কুমড়া, বেগুনের বোঁটা, পটোল, মোচার ভিতরের থোড় প্রভৃতি লইয়া মিহি করিয়া বানাইয়া লও। সব পৃথক ভাবে কষাও। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, কালজিরা, মেথি ফোড়ন দিয়া সমস্ত কষান আনাজ ছাড়। কিছু আংসাইয়া নুন, হলুদ ও লঙ্কা বাটা জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। সিদ্ধ হইলে চিনি দাও। শুকাইলে কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।
দ্রষ্টব্য—এই চড়চড়ীতে মেথির পরিবর্তে জিরা ফোড়ন ও পরিশেষে জিরা গোলমরিচের বাটা ঝাল ও মিশাইয়া ‘ঝাল-চড়চড়ী’ রূপে রাঁধিতে পার।
৯৮। বিলাতী কুমড়ার চড়চড়ী
ফোড়ন দিয়া কুমড়া ছাড়। মেথি বাদ দিতেও পার।) আংসাও। নুণ, হলুদ দিয়া জল দাও। ইচ্ছা করিলে কিঞ্চিৎ লঙ্কা বাটা মিশাইতে পার। সিদ্ধ হইলে অল্প চিনি দেও। শুকাইলে সরিষা বাটা ও কাঁচা লঙ্কা বাটা দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।
৯৯। শিম চড়চড়ী
শিম গুলি এক আঙ্গুল চওড়া করিয়া কুটিয়া লও। তেলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া শিম ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ জল দাও। সিদ্ধ হইলে চিনি দাও। শুকাইলে সরিষা বাটা ও কাঁচা লঙ্কা বাটা মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।
কাঁকরোল, ডুমুর, ঝিঙ্গা, মূলা, ফরাস বীন, ফুলকোবি প্রভৃতির ও স্বতন্ত্রভাবে এই প্রকারে চড়চড়ী হইতে পারে। মাষকলাই বড়ী ভাজিয়া ভাঙ্গিয়া ইহার সহিত অনুষঙ্গ ভাবে মিশান যাইতে পারে।
১০০। লাউ চড়চড়ী
লাউ ডুম ডুমা বা সরু সরু করিয়া কুটিয়া লও। বুড়া হইলে একটু ভাপ দিয়া লও। তেলে লঙ্কা, মেথি (কালজিরা) ফোড়ন দিয়া লাউ ছাড়। আংসাও। নুণ দিয়া ঈষৎ জল দাও। হলুদ না দিলেও চলে। একটু চিনি দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া কঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাও। শুকাইয়া নামাও। কেহ কেহ একটু ঝোল ঝোল রাখিয়াই নামাইয়া থাকেন।
১০১। শশা চড়চড়ী
শশা একটু লম্বা ছাদে কুটিয়া লও। বুকা ফেলিয়া দাও। নুণ, হলুদ মাখ। তেলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া শশা ছাড়। আংসাও। আবশ্যক হইলে পুনঃ একটু নুণ, হলুদ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে একটু চিনি দাও। শুকাইলে কাঁচালঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। ইহার সহিত ভাজা মাষকলাইর বড়ী ভাঙ্গিয়া অনুষঙ্গরূপে মিশাইতে পার।
১০২। সজিনা শুটী (খাড়া) চড়চড়ী
সজিনা শুটী গুলি আঙ্গুলের ন্যায় লম্বা রাখিয়া কুটিয়া লও। ভাপ দিয়া রাখ। তৈলে লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া শুটী ছাড়। আংসাও। নুণ, হলুদ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে একটু চিনি দাও। শুকাইলে কাঁচালঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।
ডাঁটা চড়চড়ীও এই প্রকারে রাঁধিবে।
১০৩। বিলাতী কুমড়া শাকের চড়চড়ী
বিলাতী কুমড়ার জালি পাতা ও ডগা বাছিয়া লও। তৈলে লঙ্কা ফোড়ন দিয়া শাক ছাড়। আংসাও। সিদ্ধ হইলে কাঁচালঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাও। শুকাইয়া নামাও।
চড়চড়ী (আমিষ)
আনাজের সহিত মৎস্য যোগে অথবা শুধু মৎস্য দ্বারা অতি উপাদেয় চড়চড়ী হইয়া থাকে। রুই, কাৎলা, বাউস, মৃগেল, মহাশোল, ভেটকী প্রভৃতি মোটা মাছের এবং মোয়া, পিয়ালী, পুঁটী, পাতাসী, রাইখরিয়া, বাটা, ছোট ছোট টেংড়া, আইড়, সিলঙ ও অন্যবিধ চূণা মাছের এবং ইলিশ, কৈ, খলিশ, চিংড়ী প্রভৃতি মাছের অমনি বা আনাজ সহকারে উত্তম চড়চড়ী হয়। তাহাতে পেঁয়াজ ফোড়ন দিলে আরও উপাদেয় হইয়া থাকে। এবং মোটা মাছের চড়চড়ীতে একটু শুক্না লঙ্কা বাটা মিশাইতে হয়।
রুই, ইলিশ, কৈ, পবা, বাচা, বাঁশপাতা, মোয়া, কাঁখ্লে, খরিয়া, রাইখরিয়া,বাটা, খলিশা, ফলি, চিতল, সিলঙ, আইড়, গুচা প্রভৃতি মাছের অমনি চড়চড়ী রাঁধিতে পারা যায়। ইহাতে পেঁয়াজ ফোড়ন না দিলেও চলে।
১০৪। রুই মাছের আনাজ যোগে চড়চড়ী
আনাজের মধ্যে কেবলমাত্র আলু, পটোল, মূলা ও বেগুনই সচরাচর রুই প্রভৃতি মোটা মাছের চড়চড়ীতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। তবে আজি কালি ফুলকোবি, ওলকোবি, কলাইশুটী, সালগম, স্কোয়াস প্রভৃতিও খুব ব্যবহৃত হইতেছে এবং তাহার দরুণ আস্বাদনও ভালই হইয়া থাকে। কিন্তু এই হালি আনাজ গুলির সহিত বড় বড় চিংড়ী, কাঁকড়া অথবা ভেটকী মাছের চড়চড়ীই যেন ভাল মজে। কই মাছ নাতিবৃহৎ হইলেই ভাল হয়। উত্তম পাকা রুই মাছের অমনি চড়চড়ী বা ‘ঝাল চড়চড়ীই’ উৎকৃষ্ট হয়।
মাছ নাতিবৃহৎ খণ্ডে কুটিয়া লও। নুণ হলুদ মাখিয়া তৈলে কষাইয়া রাখ। আনাজ সাধারণ চড়চড়ীর ন্যায় একটু লম্বা ছাঁদে কুটিয়া তেলে পৃথকভাবে কষাইয়া তোল। অতঃপর তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া পরে পেঁয়াজ ফোড়ন দাও। পেঁয়াজ ঈষৎ লাল হইলে কষান মাছ ও আনাজ ছাড়। নুণ হলুদ ও কিছু লঙ্কা বাটা অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া পুনঃ কিছু জল দাও। গোটা কাঁচা লঙ্কা চিরিয়া ছাড়। সিদ্ধ হইয়া জল শুকাইয়া আসিলে সরিষা বাটা মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া শুকাইয়া নামাও। একটু সরিষার তেল মিশাও। কাঁচা লঙ্কা কেহবা উপরোক্তভাবে আলাহিদা গোটা দেন, কেহবা সরিষা বাটার সহিত একত্রে বাটিয়া দেন।
কাৎলা, বাউস, মৃগেল, মহাশোল, ভেটকী, ইলিশ, কৈ প্রভৃতি মোটা মাছের আনাজ যোগে এই প্রকারে চড়চড়ী রাঁধিবে।
১০৫। ভেটকী মাছের চড়চড়ী
আলু, ফুলকোবি, কলাইশুটী, সালগম, ওলকোবি, স্কোয়াস প্রভৃতি মধ্যে
আলু, ফুলকোবি অথবা ওলকোবি অথবা সালগম এবং কলাইশুটী এবং স্কোয়াস লইয়া ঈষৎ লম্বা ছাঁদে বানাও। স্বতন্ত্রভাবে কষাইয়া রাখ। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, কালজিরা ও মেথি ফোড়ন দিয়া পরে পেঁয়াজ ফোড়ন দাও। পেঁয়াজ ঈষৎ লাল হইলে মাছ ছাড়। আংসাও। নুণ, হলুদ ও লঙ্কাবাটা দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া জল দাও। ফুটিলে কষাণ আনাজ ছাড়। গোটা কয়েক কাঁচা লঙ্কা চিরিয়া ছাড়। সিদ্ধ হইয়া জল শুকাইলে সরিষা বাটা দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। একটু সরিষার তেল মিশাও।
বড় বড় গলদা ও মোচা চিঙড়ী, কাঁকড়া এবং কোন কোন সামুদ্রিক মাছের এই প্রকারে ফুলকোবি কলাইশুটী দিয়া চড়চড়ী রাঁধিতে পার। চড়চড়ীর আনাজ, মৎস্য কোনটাই বরেন্দ্র-সুলভ নহে সুতরাং পূর্ব্বকালে ইহার প্রচলন ছিল না,—আজিকালি হইয়াছে। তবে রন্ধন-প্রণালী অবশ্য বারেন্দ্র বটে।
১০৬। চূঁচড়া মাছের চড়চড়ী
রুই মাছ চড়চড়ীর ন্যায় আলু, পটোল, বেগুন, মূল সহ চুঁচড়া মাছেরও অতি চমৎকার চড়চড়ী হইয়া থাকে। অধিকাংশ স্থলেই নানাবিধ চুঁচড়া মাছ এক সঙ্গে মিশাইয়া এই চড়চড়ীতে দেওয়া হইয়া থাকে। ক্ষুদ্র মাছে সাধারণতঃ শুক্না লঙ্কা বাটা দেওয়া যায় না। পেঁয়াজ ফোড়ন দিলে তবে স্বাদ উৎকৃষ্ট হয়। ছোট মাছ হইলে গোটা রাখিয়া কুটিয়া লইবে এবং মাছ ঈষৎ বড় হইলে আবশ্যকমত দুই বা তিন খণ্ড করিয়া লইবে।
আনজগুলি কুটিয়া পূর্ব্বে আলাদা আলাদা কষাইয়া লও। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়া নুণ, হলুদ মাখা মাছ ছাড়। (অধিক পরিমাণে মাছ হইলে পূর্ব্বে মাছগুলি তেলে কষাইয়া লইলে সুবিধা হয়)। আংসাও, কষাণ আনাজ ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। গোটা কয়েক কাঁচা লঙ্কা চিরিয়া ছাড়। সিদ্ধ হইয়া জল শুকাইয়া গেলে সরিষা বাটা দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। স্মরণ রাখিও এই চড়চড়ীতে অধিক জল দিলে মৎস্য গলিয়া গিয়া কেঁৎকেঁতে হইবে।
মোয়া, পুঁঠি, পিয়ালী, পাতাশী, রাইখরিয়া, বাটা, কাঁখলে, ফল্লি, খলিশা, গুচি, ছাতিয়ান, কুচা চিংড়ী এবং ছোট ছোট টেংড়া, সিল, আইড়, গুচা প্রভৃতি চুঁচড়া মাছ দ্বারা এই চড়চড়ী রাঁধা হয়।
১০৭। বিলাতী কুমড়া শাক দিয়া কুচা চিংড়ীর চড়চড়ী
বিলাতী কুমড়ার শাক, পুঁই শাক প্রভৃতির সহিতই কুচা চিঙড়ীর চড়চড়ী ভাল মজে। বিলাতী কুমড়ার কচি ডগা ও পাতা একটু লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। চিঙড়ী মাছ কুটিয়া নুণ হলুদ মাখ। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া চিঙড়ীমাছ ছাড়। অল্প আংসাইয়া শাক ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ ও ঈষৎ লঙ্কা বাটা দিয়া জল দাও। কাঁচা লঙ্কা চিড়িয়া ছাড়। সিদ্ধ হইলে ঈষৎ চিনি মিশাও। শুকাইলে সরিষা বাটা মিশাইয়া শুকনা শুকনা করিয়া নামাও।
ইহাতেও পেঁয়াজ ফোড়ন দিলে ভালই হয়। পুঁই শাকের চড়চড়ীও এই প্রকারে রাঁধিবে তবে তাহার সহিত ইচ্ছা করিলে, আলু, পটোল, বেগুন, শিম প্রভৃতি আনাজ মিশাইতে পার।
১০৮। মোয়া মাছ চড়চড়ী
শুধু মোয়া প্রভৃতি এক প্রকার চুণা মাছের উত্তম চড়চড়ী হয়। লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া নুণ হলুদ মাখান মোয়া মাছ ছাড়। আংসাও। আবশ্যক বোধ করিলে পুনরায় একটু নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। শুকাইলে কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা একত্রে মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া শুকাইয়া নামাও।
পিয়ালী, খরিয়া, সুবর্ণ খরিয়া, রাইখরিয়া, বাটা, খলিশা, ছোট ছোট কই, কাঁথ্লে প্রভৃতি মাছের এই প্রকারে চড়চড়ী রাঁধিবে। পাঁচ ফোড়ন দিবে না।
১০৯। সরিষা-ইলিশ বা ইলিশ মাছের সরিষাবাটা ঝোল
ইহা বরেন্দ্রের একটি অতি বিখ্যাত ব্যঞ্জন। ইহা খাঁটী চড়চড়ী হইলেও ঝোল ঝোল করিয়া রাঁধা হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত ইহাকে ইলিশ মাছের সরিষাবাটা ঝোল বলা হইয়া থাকে।
(ক) ইলিশ মাছ পেটী গাদায় বিভক্ত করতঃ একটু পুরু পুরু খণ্ডে কুটিয়া লও। নুণ হলুদ মাখ। তৈলে তেজপাত, মেথি, (কালজিরা,) লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। সামান্য মাত্র আংসাইয়া লইয়াই নুণ হলুদ ও কিঞ্চিৎ শুক্না লঙ্কা বাটা দিয়া জল দাও।
ইলিশ মাছ অধিক কষাইলে বা আংসাইলে যে বিস্বাদ হইয়া যায় ইহা লিখাই বাহুল্য। অনেকে এই ভয়ে মাছ আদৌ না আংসাইয়া ফোড়নের পর জল দিয়া ফুটিলে তখন তাহাতে কাঁচা ইলিশ মাছ ছাড়েন। আমার মনে হয় ইলিশ মাছ একটু পুরু করিয়া কুটিয়া তেলে অল্প আংসাইয়া লইয়া পাক করিলে তাহার আস্বাদনই বরং উত্তম হয়। তবে পাত্লা করিয়া কুটা ইলিশ মাছ না আংসাইয়া ঝোলে কাঁচা ছাড়াই কর্ত্তব্য।
গোটাকয়েক কাঁচা লঙ্কা চিরিয়া লইয়া ছাড়। মাছ সিদ্ধ হইলে সরিষা বাটা (অথবা বিলাতী রাই সরিষার গুঁড়া জলে গুলিয়া) মিশাও। অভিরুচীমত ঝোল ঈষৎ গাঢ় বা অপেক্ষাকৃত অধিক গাঢ় করিয়া নামাও।
(খ) মাছ কুটিয়া কাঁচা অবস্থাতেই নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা দিয়া মাখ। তৈলে লঙ্কা, মেথি, কালজিরা বা শুধু কালজিরা ফোড়ন দিয়া মাখা মাছ ছাড়। উল্টাইয়া পাল্টাইয়া অল্প আংসাইয়াই জল দাও। সাবধান বেশী আংসাইও না তাহা হইলে স্বাদ তিত হইবে। কাঁচা লঙ্কা চিরিয়া ছাড়। সিদ্ধ হইয়া ঝোল গাঢ় হইলে নামাও। কেহ কেহ ইহাতে কিছু পিটালী দিয়া ঝোল গাঢ় করিয়া থাকেন।
বাচা, আইড়, সিলঙ বা ঢাঁই, গুচা, রিঠা, টেংড়া, পবা, বাঁশপাতা, চিতল, ফল্লি, কই, বোয়াল প্রভৃতি মধুর জলের তৈলাক্ত মাছের এবং ভেটকী, সিয়ার বা সুর (মেকরেল), চাঁদা (পমফ্রেট) এবং ইলিশ জাতীয় অপরাপর নোণা জলের মাছের এই প্রকারে সরিষা বাটা ঝোল রাঁধিবে। এই সকল মাছে দুটো কালজিরা ফোড়ন দিলে ভাল হয়। তিনবার লঙ্কা সংযোগ হইতেছে বলিয়া এই ব্যঞ্জন (এবং অধিকাংশ আমিষ চড়চড়ীই) খুব ঝাল হইয়া থাকে, এই নিমিত্ত শুক্না লঙ্কা বাটা পরিমাণে কিছু কম করিয়া দিবে। ইহাতে কদাপি পেঁয়াজ ফোড়ন দিবে না।
পেঁয়াজ সংযোগে ইলিশ মাছ রাঁধিলে তাহার স্বাদ ভাল হয় না। খাঁটি কটু তৈল, কাঁচা লঙ্কা, মেথি ও সরিষা বাটা প্রভৃতিই ইলিশ মাছের জান; সুতরাং ইহাদের যোগে ইলিশ রাঁধিলে তাহার যেরূপ উপাদেয় আস্বাদন হইয়া থাকে আদা, পেঁয়াজাদি বা অন্যবিধ মশলাদি যোগে রাঁধিলে কদাপি সেরূপ হয় না।
ঢেঁকী বা মটর শাকের কচি ডগা বা পালঙ্গ শাকের যোগে ইলিশ ও কৈ প্রভৃতি মাছের সুন্দর সরিষা বাটা ঝোল হয়।
১১০। করলা দ্বারা মাছের তিত চড়চড়ী
{ ভ্যাদা ধদা বা লাঠা মাছ, পুঁটি মাছ, কই, খলিশা এবং রোহিতাদি বড় মাছের ছোট ছোট পোনা দ্বারা এই তিক্ত চড়চড়ী রাঁধা হইয়া থাকে। মাছ গোটা রাখিয়া কুটিয়া নুণ হলুদ মাখিয়া কষাইয়া রাখ। বড় বড় করোলা একটু লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া করোলা ছাড়। আংসাও। মাছ ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। শুকাইলে কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা একত্রে মিশাইয়া শুক্না করিয়া নামাও। কেহ কেহ পেঁয়াজও ফোড়ন দিয়া থাকেন।