বরেন্দ্র রন্ধন/ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়

মেথিপর্ব্ব

(৩) শুক্ত (নিরামিষ)

 ঘৃতে বা তৈলে (তেজপাত), লঙ্কা, মেথি এবং সরিষা (গুঁড়া বা গোটা) ফোড়ন দিয়া আনাজ, মৎস্য বা উভয় একত্রে আংসাইয়া নুণ হলুদ সহ জলে সিদ্ধ করতঃ পিঠালী, পোস্ত বা তিল-পিঠালী বাটা অথবা আদা ছেঁচা মিশাইয়া একটু ঝোল ঝোল রাখিয়া বা থক্‌থকে করিয়া নামাইলে যে ব্যঞ্জন প্রস্তুত হইল তাহাকে শুক্ত বা শুক্তানি বলা হয়।

 শুক্তা তিক্তস্বাদবিশিষ্ট ব্যঞ্জন। এই নিমিত্ত ইহাতে ব্যবহৃত ফোড়নাদিও তিক্তস্বাদবিশিষ্ট হইয়া থাকে। মেথি, সরিষা (গুঁড়া বা গোটা) অথবা ফুল কাসুন্দী এবং কখন কখন রন্ধনী ও কালজিরা ইহাতে ফোড়ন পড়ে। শুক্তানিতে জিরা বা পাঁচফোড়ন দেওয়া বরেন্দ্রে কৈ দেখা যায় না এবং বরেন্দ্রে ইহাতে কোনও প্রকার বাটা ঝালও পড়ে না। একমাত্র লঙ্কা ফোড়নের দ্বারাই ইহার যা কিছু ঝাল আস্বাদন করা হইয়া থাকে। শুক্তাতে বিশেষতঃ নিরামিষ শুক্তাতে হলুদও কম পড়ে এবং চিনি আদৌ ব্যবহৃত হয় না।

 আনাজি কল, গোল আলু, কাঁটালবীচি, শিম, বেগুন, মূল, ঝিঙ্গা, (তোরই), ধুমা, পটোল, শশা, ছাঁচিকুমড়া, পেঁপে, থোড় প্রভৃতি আনাজ এবং তিক্তস্বাদবিশিষ্ট আনাজ যথা করিলা, করিলাপাত, পাট (নালিতা) পাতা, শশাপাতা, শেফালীপাতা, পলতাপাতা, নিমপাতা, বেত আগা প্রভৃতি শুক্তানিতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। শুক্তানির তিক্তস্বাদে সাহায্য করিবার নিমিত্ত এই তিক্তস্বাদ সম্পন্ন কোন একটা আনাজ বা শাকপাতা উপরিলিখিত অপরাপর আনাজের বা মৎস্যাদির সহিত মিশাইয়া দেওয়া হইয়া থাকে। বিলাতী কুমড়া বা হালি আনাজ যথা ফুলকোবি প্রভৃতি সাধারণতঃ শুক্তানিতে ব্যবহার করা হয় না। আনাজগুলি ডুমা ডুমা বা নাতিবৃহৎ ভাবে কুটিয়া লইতে হয় এবং অল্প কষাইয়া ঝোল ঝোল রাখিয়া বা থকথকে গোছ করিয়া রাঁধিয়া নামাইতে হয়।

 ফুলবড়ী, মটরবড়ী, মাষকলাইবড়ী প্রভৃতি ভাজা এবং মটর বা খেঁসারী ডাইল বাটার চাপড়ী বা বড়া ভাজা, ঐ ডাইলের জলবড়া (পানিদলা) শুক্তানিতে অনুষঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এবং পিঠালী, তিল বা পোস্তদানা-পিঠালী বাটা এবং আদা ছেঁচা শুক্তা রন্ধনের শেষভাগে উপকরণরূপে মিশান হইয়া থাকে। সরিষা বাটা মিশান হয় না। নামাইয়া কিছু গাওয়া ঘি মিশাইতে হয়।

 মটরের ডাইলের চাপড়ী বা বড়া সহ যে সকল শুক্তা রাঁধা হয় তাহাতেই সচরাচর তিল বাটা মিশান হইয়া থাকে। আবার চাপড়ীর সহিত আদা বাটাও মিশান হইয়া থাকে। তিলবাটা মিশান স্থলে কোন কোন ক্ষেত্রে সরিষা ফোড়ন বাদ দেওয়া হয়। আমিষ শুক্তাতে তিলবাটা দেওয়া যায় না।

 মেথি পর্ব্বের অপরাপর ব্যঞ্জনের সহিত শুক্তানির কি সাদৃশ্য বা পার্থক্য তাহা চড়চড়ী অধ্যায়ে লিখিত হইয়াছে।

১১১। সাধারণ পাঁচ মিশালী বা সাদা শুক্তা

 উপরিলিখিত আনাজের মধ্যে ঋতু অনুসারে গুটি তিন চার আনাজ লইয়া নাতিবৃহৎ ছাঁদে কুটিয়া লও। তেলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ফোড়ন দিয়া ছাড়। সমস্ত আনাজ এক সঙ্গেই ছাড়িয়া আংসাইতে পার, কেবল বেগুন পরে ছাড়িবে। (ভাজিবার জন্য বৃহদাকার কোমল ‘মুক্তকেশী’ বা ‘লাফা’ বেগুন যাহা সচরাচর ব্যবহৃত হইয়া থাকে শুক্তানি প্রভৃতিতে তৎপরিবর্ত্তে কাঁটাবিশিষ্ট ক্ষুদ্র গৃহস্থী বা কড়ুই বেগুন ব্যবহার করিলেই ভাল হয়)। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে একটু পিঠালী বাটা মিশাইয়া ঝোল ঝোল বা অপেক্ষাকৃত শুক্‌না শুক্‌না করিয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 শুক্তানিতে সাধারণতঃ আনাজি কলা খুব বেশী পরিমাণে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ইহা লৌহ কড়াইয়ে কষাইলে প্রায়ই কালবর্ণ হইয়া যায় এবং তৎসঙ্গে সমস্ত ব্যঞ্জনের বর্ণও কাল্‌চে করিয়া ফেলে। এই নিমিত্ত আনাজি কলায় একটু হলুদ মাখিয়া ধুইয়া ফেলিয়া অথবা না ধুইয়াই আলাহিদা ভাবে তেলে কষাইয়া লইয়া পরে অপরাপর কষাণ আনাজের সহিত মিশাইলে ব্যঞ্জনের বর্ণ আর কালচে হইবে না। অথবা শুক্তা পিত্তলী কড়াইয়ে বাঁধিবে।

 পেঁপে পূর্ব্বে একটু ভাপ দিয়া লইতে হয়।

 এই সাদা পাঁচমিশালী শুক্তানির সহিত ফুলবড়ী, মটরের বড়ী বা মাষকলাইর বড়ী অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। বড়ী তেলে ভাজিয়া লইয়া ভাঙ্গিয়া (ফুলবড়ী ছাড়া) শুক্তানিতে জল দিয়া ফুটিতে থাকিলে অথবা তাহার কিছু পরে, ছাড়িবে। মটর বড়ী দিলে দুটো শলুপ শাক কুচাইয়া শুক্তার সহিত মিশাইবে।

১১২। সাদাসিদা শুক্ত-ঝোল

 উপরিলিখিত আনাজের মধ্যে শশা, ঝিঙ্গা ও করিলা এই তিনটী একত্রে লইয়া উপরিলিখিত মতে রাঁধিয়া একটু ঝোল ঝোল রাখিয়া নামাইলে যে সাদাসিদে শুকৎ-ঝোল প্রস্তুত হইল বরেন্দ্রে তাহার খুব চলন আছে।

 কেহ কেহ ইহার সহিত করিলার পরিবর্ত্তে বেত-আগা মিশাইয়া থাকেন এবং তৎসহ আরও গাভথোড় মিশান।

১১৩। বেত-আগার শুক্তা

 বেত-আগা, আনাজি কলা, ঝিঙ্গা ডুম ডুমা বা নাতিবৃহৎ ছাঁদে কুটিয় লও। মটরের ডাইল ভিজাইয়া রাখিয়া বাটিয়া নুণ মিশাইয়া ফেণাও। তৈলে তদ্দ্বারা ছোট ছোট বড়া ভাজ। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা গুঁড়া ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। নুণ ও সামান্য একটু হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে বা তাহার কিছু পরে, ভাজা বড়া ছাড়। সিদ্ধ হইয়া জল শুকাইয়া আসিলে তিল-পিঠালী বাটা মিশাও। থক্‌থকে হইলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 বড়া দেওয়া সত্বেও, তিল-পিঠালী বাটার পরিবর্ত্তে শুধু পিঠালী দিয়াও এই ব্যঞ্জন রাঁধা চলে।

 তিল-পিঠালী,—কিছু আতপ চাউল জলে ভিজাইয়া রাখিয়া ঘষা তিলের সহিত একত্রে মিহি করিয়া পাটায় বাটিয়া লইলেই ‘তিল-পিঠালী বাটা’ হইল। শুধু তিল-বাটা ব্যঞ্জনের সহিত সাধারণতঃ মিশান যায় না, তাহা তৈলাক্ত জন্য ব্যঞ্জনের আঁট বাঁধে না। এই নিমিত্ত তৎসহ দুটো ভিজান আতপ চাউল বাটিয়া লইতে হয়। পোস্তদানাও দুটো ভিজান আতপ চাউলের সহিত একত্রে বাটিয়া লইতে হয়।

 ডাইলের বড়া,—মটর বা খেঁসারীর ডাইল ভিজাইয়া রাখ। ঘণ্টা দুই পরে পাটায় মিহি করিয়া বাটিয়া লও। একটু নুণ মিশাইয়া ফেণাও। তেলে ছোট ছোট করিয়া বড়া ভাজ। অনেক ‘শুক্তায়’ এবং কোন কোনও ‘ঝালে’ ও ‘অম্বলে’ ইহা অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

১১৪। শশার শুক্তা

 মটর ডাল বাটিয়া তেলে চাপড়ী ভাজিয়া রাখ। শশা বড় বড় ডুমা ডুমা করিয়া অথবা একটু লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। বুড়া শশা হইলে একটু ভাপ দিয়া লইবে। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও সরিষার গুঁড়া ফোড়ন দিয়া শশা ছাড়। আংসাও। নুণ, হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে ভাজা চাপড়ী ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা করিয়া মিশাও। সিদ্ধ হইয়া জল শুকাইয়া আসিলে তিল-পিঠালী বাটা মিশাও। নামাইয়া একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 কচি ছাঁচি কুমড়ার এই প্রকারে চাপড়ী ও তিল বাটা দিয়া শুক্ত রাঁধিবে। চাপড়ীর পরিবর্ত্তে ডালের বড়া অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে। চাপড়ী ও বড়া না দিয়া শুধু তিল-পিঠালী বাটা দিয়াও এই শুক্ত রাঁধিতে পার। সরিষা ফোড়ন বাদ দিতেও পার।

 মটরের বড়ী ভাজা অথবা জল-বড়া (পানিদলা) অনুষঙ্গরূপে ব্যবহার করিলে তিল-বাটা দিবে না। পিঠালীও দিবে না। আবার কোনরূপ অনুষঙ্গ না দিয়াও শশা বা কুমড়ার শুক্তা রাঁধিতে পার। কেবল নামাইয়া গাওয়া ঘি মিশাইবে।

 ডাইলের চাপড়ী ভাজা,—মটর বা খেসারীর ডাইল ভিজাইয়া রাখ। ঘণ্টা দুই পরে আধকচড়া করিয়া বাট। নুণ ও লঙ্কা বাটা মিশাও। কড়াইয়ে তৈল জ্বালে উঠাইয়া কড়া একটু কাৎ করিয়া ধর। তৈল তলা হইতে সরিয়া গেলে ডাইল বাটা অনেকটা লইয়া হাতে করিয়া তাল পাকাইয়া কড়াইর তলাতে বা তলার নিকটে রাখ এবং হাতে টিপিয়া বা চাপিয়া দুই আঙ্গুল পুরু করিয়া পিষ্টকাকারে বিছাইয়া দাও। এক্ষণে কড়াই পুনঃ সিধা কর—গরম তৈল আসিয়া চাপড়ীর গায়ে পড়িবে। এক পিঠ ভাজা হইয়া কঠিন হইলে উলটাইয়া দিয়া অপর পিঠ ভাজিয়া লইবে। এই ভাজা চাপড়ী

অনুষঙ্গরূপে বহু ব্যঞ্জনে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ইহা অমনি গরম গরম খাইতেও মন্দ লাগে না। অধিক কড়া করিয়া চাপড়ী ভাজা কর্ত্তব্য নহে।

১১৫। বুড়া বা পুরু কুমড়ার শুক্তা

 বুড়া বা পুরু কুমড়া বা শশা ডুমা ডুমা বা ফলা ফলা করিয়া কুট। ভাপ দিয়া লও। তৈলে লঙ্কা, মেথি ও সরিষার গুঁড়া এবং শুকনা পাট (নালিতা) পাতা ফোড়ন দিয়া কুমড়া বা শশা ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। শুকাইলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 পাটপাত না কষাইয়া শুক্তানিতে জল দিবার পরও ছাড়িতে পার। এই শুক্তানিতে তিল বাটা দেওয়া দেখা যায় না।

১১৬। করিলার শুক্ত

 করিলা ও আনাজিকলা একটু লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। কলায় হলুদ মাখ। মটর ডালের চাপড়ী ভাজিয়া রাখ। তৈলে (তেজপাত), লঙ্কা, মেথি ও সরিষা ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড। অংসাও। মুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে ভাজা চাপড়ী ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা করিয়া মিশাও। সিদ্ধ হইলে তিল-পিঠালী বাটা মিশাও। নাড়িয়া চাড়িয়া থকথকে করিয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 তিল বাটা দিলে সরিষা ফোড়ন দেওয়া অনেকে প্রশস্ত মনে করেন না।

১১৭। আনাজিকলার শুক্ত

 কেবলমাত্র আনাজিকলা লইয়া ডুমা ডুমা বা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুট। হলুদ মাখ। তৈলে (তেজপাত), লঙ্কা, মেথি ও সরিষার গুঁড়া ও দুটো পাট (নালিতা) পাতা ফোড়ন দিয়া কলা ছাড়। আংসাও। নুণ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে তিল-পিঠালী বাটা দিয়া থক্‌থকে করিয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 কেহ কেহ কলা সিদ্ধ করিয়া এককালে গলাইয়া ফেলিয়া পরে তিলপিঠালী বাটা দিয়া শুকাইয়া বেশ নসনসে গোছ করিয়া নামান।

১১৮। করিলা পাতার শুক্তা

 মটর বা খেঁসারীর ডাইল বাটিয়া চাপড়ী ভাজিয়া লও। করিলা পাতা কুচাইয়া লও। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা (গুঁড়া) ফোড়ন দিয়া করিলা পাতা ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া অল্প জল দাও। ফুটিলে ভাজা চাপড়ী ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছাড়। সিদ্ধ হইলে তিল-পিঠালী বাটা মিশাও। থক্‌থকে গোছ হইলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 ডাইলের বড়া দিয়াও এই শুক্তা রাঁধিতে পার।

 মটরের অথবা মাষকলাইর বড়া ভাজা এই শুক্তের অনুষঙ্গরূপে ব্যবহার করিতে পার। তৎক্ষেত্রে তিল-পিঠালী বাটা মিশাইবে না এবং ফলা করিয়া কুটিয়া বেগুন অথবা শিম মিশাইতে পার।

১১৯। তিল শুক্তা

 শুক্‌না পাট (নালিতা) পাতা ভিজাইয়া রাখ। এই জল দিয়া তিল বাট। এতৎসহ দুই চারিটা নালিতা পাতাও বাটিয়া লইতে পার। একটু নুণ ও গাওয়া ঘি মিশাইয়া লও। ইহা আর রাঁধিতে হইবে না।

১২০। তিল-বেগুন

 বোঁটা বাধাইয়া লম্বালম্বি চারি ফাঁক করিয়া বেগুন কুট (বড় বড় বেগুন লইবে)। নুণ হলুদ মাখ। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া বেগুন ছাড়। আংসাও। নুণ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে তিল-পিঠালী

বাটা মিশাইয়া থকথকে করিয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও। বেগুনের সহিত করিলা (একটু লম্বা ছাঁদে কুটিয়া) মিশাইয়া এই শুক্ত রাঁধিতে পার।

১২১। করিলা-বেগুন

 ফাল্গুন চৈত্র মাসে বেগুন বুড়া হইলে করিলা, নিমপাতা, গিমা শাক প্রভৃতি কোনও একটা তিক্তস্বাদ বিশিষ্ট সবজীর সহিত রাঁধিয়া খাইতে হয়।

 বেগুন ও করিলা ডুমা ডুমা করিয়া অথবা একটু লম্বা ছাঁদে কুট। নুণ হলুদ মাখ। তৈলে তেজপাতা, লঙ্কা মেথি, ও সরিষা ফোড়ন দিয়া করিলা আংসাও। বেগুন ছাড়, আংসাও। জল দাও। ফুটিলে কষান মাষকলাইর বড়ী ভাঙ্গিয়া ছাড়। একটু পিঠালী দিয়া ঘন করিয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 কেহ কেহ পিঠালীর পরিবর্ত্তে একটু আদা বাটা মিশাইয়া থাকেন।

১২২। গিমা-বেগুন

 গিমা শাক বাছিয়া লও। বেগুন ডুমা ডুমা বা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। মটরের বড়ী ভাজিয়া রাখ। তৈলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা ফোড়ন দিয়া শাক ছাড়। আংসাও। বেগুন ছাড়, আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে ভাজা বড়ী ভাঙ্গিয়া মিশাও। সিদ্ধ হইলে সামান্য একটু পিঠালী দিয়া ঘন করিয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 পিঠালীর পরিবর্তে আদা ছেঁচা মিশাইতে পার। নিম বেগুন, মেথি (শাক) বেগুন প্রভৃতিও এই প্রকারে রাঁধিবে।

১২৩। করিলার রাউতা

 করলা বাকরিলা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। তৈলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি, রন্ধনী ও সরিষার গুঁড়া (সরিষার গুঁড়ার পরিবর্ত্তে ফুলকাসুন্দী হইলেই

ভাল হয়) ফোড়ন দিয়া করিলা ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে তিল-পিঠালী বাটা মিশাও। থকথকে হইলে নামাইয়া একটু আদা বাটা ও গাওয়া ঘি মিশাও।

 ঝিঙ্গা (তোরই), ধুমা, চিচিঙ্গা, কাকরী, শশা, কুমড়া প্রভৃতির এই প্রকারে ‘রাউতা’ রাঁধিবে। রন্ধনী ফোড়ন পড়াতে সাধারণ শুক্তা হইতে ভিন্ন প্রকারের হইল বলিয়া ইহার নাম রাউতা (?) হইয়াছে।

১২৪। করিলার তিতঝুরী

 এই ব্যঞ্জন কেবল পাকা করিলার দ্বারাই রাঁধিতে হয়। পাক করিলা সিদ্ধ করিয়া কুটিয়া লও। মটরের ডাইল বাটিয়া চাপড়ী ভাজিয়া লও। তৈলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা ফোড়ন দিয়া করিলা ছাড়, আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া সামান্য একটু জল দাও। ফুটিলে চাপড়ী ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা করিয়া মিশাও। নাড়। শুকাইয়া ঝুরঝুরে গোছ করিয়া নামাও। আদা বাটা ও একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

১২৫। চাপড় ঘণ্ট

 চাপড় ঘণ্ট বরেন্দ্রের একটি অতি বিখ্যাত ব্যঞ্জন। ইহা নামে ঘণ্ট হইলেও প্রকৃত পক্ষে ইহা শুক্তা পর্য্যায় ভুক্ত বটে। ইহার আনাজ ঘণ্টের আনাজের ন্যায় মিহি করিয়া কুটিয়া লইতে হয় এবং শেষ পর্য্যন্ত ইহা ঘণ্টের ন্যায় নসনসে গোছ করিয়া রাঁধা হয় বলিয়া ইহাকে ঘণ্ট বলা হইয়া থাকে। মটর ডাইলের চাপড়ী ভাজিয়া বহুল পরিমাণে এই ‘ঘণ্টে’ অনুষঙ্গরূপে মিশান যায় বলিয়া ইহার নাম ‘চাপড় ঘণ্ট’ হইয়াছে।

 করিলা, পটোল, কাঁটালবীচি, গাভথোড়, পেঁপে, কুমড়া, শশা, (কুমড়া শশার ন্যায় জলভাগ বহুল আনাজ ইহাতে কম ব্যবহার করাই প্রশস্ত)

কাঁকরোল, ডুমুর, কচি ঝিঙ্গা, বেগুন, আলু প্রভৃতি আনাজ ইহাতে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে করিলার তুল্য একটা তিত আনাজ ইহাতে থাকা চাইই। করিলা না পাওয়া গেলে করিলা, হেলঞ্চা অথবা শশার পাতা কুচাইয়া ব্যবহার করিবে। আলু বেগুন ইহাতে অভাব পক্ষে দিবে; আলু বেগুন ইহার সহিত তেমন খাপ খায় না। গাভথোড় চাপড় ঘণ্টের একটি প্রধান আনাজ।

 উপরি লিখিত আনাজের মধ্যে ঋতু অনুসারে গুটি চারি পাঁচ লইয়া মিহি করিয়া কুটিয়া লও। মটর বা খেঁসারীর ডাইল বাটিয়া চাপড়ী ভাজিয়া রাখ। তেলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। উত্তমরূপে আংসাইবে, তবে এই ব্যঞ্জনের স্বাদ উত্তম হইবে; নচেৎ ঘেৎঘেতে গোছ হইয়া যাইবে। তবে অবশ্য অতিরিক্ত আংসাইবে না। নুণ হলুদ দিয়া ক্রমে অল্পে অল্পে জল দিবে ও আংসাইবে। অবশেষে একটু বেশী জল দিবে। নাড়িয়া চাড়িয়া নসনসে করিয়া নামাও। আদা ছেঁচা ও একটু গাওয়া ঘি মিশাও। ইহাতে পিঠালী দিতে হইবে না।

 শুধু ডুমুর, কাঁকরোল বা পেঁপের করিলাপাতা যোগে অতি সুন্দর চাপড় ঘণ্ট হয়। পানসে স্বাদ বিশিষ্ট আনাজে চাপড় ঘণ্ট ভাল হয় না। ভোজন কালে খাঁটি সরিষার তৈল মিশাইয়া চাপড় ঘণ্ট খাওয়া অনেকে পছন্দ করেন।

১২৬। পল্‌তা নতীর ঝোল

 পল্‌তা নতী (ডগা), কচি আনাজি কলা, খোক্‌সা ডুমুর, কচি বেগুন, কচি গাভথোর ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। ঘৃতে তেজপাতা, এক আধটা লঙ্কা, দুটো মেথি ও দুটো সরিষা ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। নুন হলুদ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে অল্প পিঠালী দিয়া ঝোল ঘন করিয়া নামাও। ঈষৎ গাওয়া ঘি মিশাও। অনেকে ইহাতে সরিষা ফোড়ন এবং পরে পিঠালী বাদ দিয়া থাকেন। ইহা রোগীর পথ্যরূপে ব্যবহৃত হয়।

১২৭। তিত ডাইল

 মটর, খেঁসারী অথবা কাঁচা মুগ ও মাষ কলাইর ডাইলের ‘তিত ডাইল’ হয়। ডাইল হাঁড়িতে জলে সিদ্ধ কর। নুণ মিশাও। তৈলে তেজপাতা, (শুক্‌না বা কাঁচা) লঙ্কা, মেথি ও সরিষার গুঁড়া ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও। নামাইয়া একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 এই তিত ডাইলে শুকনা লঙ্কার পরিবর্ত্তে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিলেই অধিক সুস্বাদু হয়। ডাইল সিদ্ধের সময় করিলা, করিলাপাতা, শশাপাতা, সেফালীপাতা প্রভৃতি কোন একটা তিক্ত স্বাদ বিশিষ্ট সবজি মিশাইবে।


শুক্তা (আমিষ)।

১২৮। পবা (পবদা) মাছের শুক্ত-ঝোল

 পবা মাছ গোটা রাখিয়া কুটিয়া লও। নুণ হলুদ মাখ। তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা (আধকচড়া গুঁড়া হইলেই ভাল হয়) অথবা ফুলকাসুন্দী এবং শুক্‌না পাট পাতা বা অপর কোনও তিক্তস্বাদ বিশিষ্ট পাতা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। পুনরায় নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে ঝোল ঝোল রাখিয়া নামাও। আদা ছেঁচা মিশাও।

 এই শুক্ত-ঝোলের সহিত আনাজ ব্যবহৃত হয় না। ইচ্ছা করিলে তিক্তপাতা বাদ দিয়াও এই ঝোল রাঁধিতে পার।

 মেটর (অর্থাং আইড়, গুজা, সিলঙ প্রভৃতি বড় মাছের বাচ্ছা, বাঁশ পাতা, টেঙড়া, পাতাশী, মোয়া, খইর (খরিয়া), সাঁপুই, বাটা, নোছি (অর্থাৎ

রুই প্রভৃতি বড় মাছের বাচ্ছা, পিয়ালী প্রভৃতি ক্ষুদ্র মাছের শুক্ত-ঝোল রাঁধা যাইতে পারে। কিন্তু পবা মাছের শুক্ত-ঝোলের ন্যায় অপরাপর মাছের শুক্ত-ঝোলের তাদৃশ সুন্দর স্বাদ হয় না।

 এই ঝোল উত্তম গাওয়া ঘি ও লেবুর রসের যোগে গরম ভাতে মাখিয়া খাইতে ভাল।

১২৯। রুই প্রভৃতি মাছের শুক্ত-ঝোল

(মাছ গোটা রাখিয়া)

 (ক) নোছি বা অপর ক্ষুদ্র মাছ লইয়া গোটা বা দুই খণ্ডে কুট। অপেক্ষাকৃত বড় মাছের কাঁটাকুটি লইলেই চলিবে। অধিক মাছ লইতে হইবে না। আলু, আনাজিকলা, বেগুন, পটোল, ঝিঙ্গা, ডাঁটা প্রভৃতি ডুমা ডুমা বা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। আনাজ ও মৎস্য সমস্ত একসাথে জলে সিদ্ধ উঠাইয়া দাও। নুণ ও অল্প হলুদ দাও। সুসিদ্ধ হইলে পিঠালী দিয়া ঈষৎ গাঢ় করিয়া নামাও। তেলে মেথি ও সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া সমস্ত সম্বারা দাও। আদা ছেঁচা মিশাও। ইহার রঙ্গ সবুজ বর্ণ মত হইবে এবং যথেষ্ট ঝোল ঝোল থাকিবে। পূর্ব্ববঙ্গে এই শুক্তার বিশেষ চলন আছে।

 (খ) মাছ কুটিয়া নুণ হলুদ মাখিয়া তৈলে কষিয়া রাখ। গোল আলু, আনাজি কলা, বেগুন, পটোল, ঝিঙ্গা, ডাঁটা প্রভৃতি আনাজ ডুমা ডুমা বা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। আনাজি কলায় হলুদ মাখিয়া আলাহিদা তৈলে কষাইয়া রাখ। তৎপর তৈলে লঙ্কা (এক আধটা), মেথি ও সরিষার গুঁড়া ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। নুণ ও অল্প হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান মাছ ও আনাজি কলা ছাড়। সিদ্ধ হইলে একটু পিঠালী দিয়া ঝোল ঈষৎ গাঢ় করিয়া নামাও। আদা বাটা মিশাও। (ইহার মাছ গোটা থাকিবে)।

 বাউস, কাৎলা, সারঙ্গপুঁটি প্রভৃতির এই প্রকারে শুক্ত-ঝোল রাঁধিবে এবং ছোট ছোট কৈ, আইড় প্রভৃতিরও এই প্রকারে শুক্ত-ঝোল রাঁধা চলে।

১৩০। রুই (নহলা) মাছের শুক্ত

(মাছ ভাঙ্গিয়া)

 নোছি অপেক্ষা বড় অথচ পাকা মাছ অপেক্ষা ছোট এইরূপ নাতি ক্ষুদ্র রুই মাছকে বরেন্দ্রে ‘নহলা মাছ’ কহে। ইহার দ্বারাই উৎকৃষ্ট শুক্ত-ঝোল হয়। রোহিতের নহলা অথবা কালবাউস মাছেরই এই শুক্ত ভাল হয়। কাৎলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছের শুক্তা তাদৃশ স্বাদু হয় না। পাকা রুই বা অতি ক্ষুদ্র রুই অর্থাৎ নোছি মাছের শুক্তাও সুবিধা মত হয় না।

 মাছ সাধারণ ভাবে কুটিয়া লও। নুণ হলুদ মাখ। করিলা ও পটোল ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। করিলা বা কোনও একটা তিত স্বাদবিশিষ্ট সবজী মাছ-শুক্তে দিতে পারিলেই ভাল হয়। এবং পটোল না পাওয়া গেলে আলু, আনাজি কলা, পেঁপে, কাঁকরোল, বেগুনের দ্বারাও কাজ চলিবে। এই মাছের সহিত পেঁপের শুক্তা ভালই হয়। আনাজ তেলে কষাইয়া রাখ। পরে তৈলে তেজপাত, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা (আধ কচড়া গুঁড়া বা গোটা) অথবা ফুলকাসুন্দী ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। অধিক আংসান কর্ত্তব্য নহে। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান আনাজ ছাড়। সিদ্ধ হইলে হাতা বা ছুরনী দিয়া মাছ ভাঙ্গিয়া দাও এবং নাড়িয়া সব মিশাইয়া দাও। অল্প ঝোল ঝোল থাকিতে নামাইয়া আদা ছেঁচা মিশাও। ইহাতে পিঠালী দিবে না।

 একটু ঝোল ঝোল রাখিয়া এই শুক্ত নামান হইয়া থাকে, তবে মাছ নরমগোছ থাকিলে উহা কিছু বেশী আংসাইয়া এবং পশ্চাৎ শুক্‌না শুক্‌না করিয়া রাঁধিয়া নামাইবে।

 কৈ, সারঙ্গপুঁটি, আইড়, সিলঙ প্রভৃতি মাছের এই প্রকারে শুক্ত রাঁধিবে। কৈ মাছ অধিক ভাঙ্গিবে না-কাঁটা বহুল হইবে।

১৩১। বোয়াল মাছের শুক্ত

(ভাঙ্গিয়া)

 রুই মাছের শুক্তের ন্যায়ই ভাঙ্গিয়া শুক্ত রাঁধিবে। কেবল ফোড়নে দুটো কালজিরা অতিরিক্ত দিবে অথবা মেথি এককালে বাদ দিয়াও রাঁধিতে পার।

 আইড়, সিলঙ, ইলিশ এবং সামুদ্রিক ভেটকী, তুলদণ্ডী, সিয়ার বা সুর প্রভৃতি মাছের এই প্রকারে শুক্ত রাঁধিতে পার।