বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার/উপসংহার

উপসংহার।

 উপস্থিত বহুবিবাহনিবারণচেষ্টা বিষয়ে, আমি যে সকল আপওি শুনিতে পাইয়াছি, তাহাদের নিরাকরণে যথাশক্তি যত্ন করিলাম। আমার যত্ন কত দূর সফল হইয়াছে, বলিতে পারি না। যাঁহারা দয়া করিয়া এই পুস্তক পাঠ করিবেন, তাঁহারা তাহার বিবেচনা করিতে পারিবেন। এ বিষয়ে এতদ্ব্যতিরিক্ত আরও কতিপয় আপত্তি উপস্থিত হইতে পারে; সে সকলেরও উল্লেখ করা আবশ্যক।

 প্রথম;—কতকগুলি লোক বিবাহবিষয়ে যথেচ্ছাচারী; ইচ্ছা হইলেই বিবাহ করিয়া থাকেন। এরূপ ব্যক্তিসকল নিজে সংসারের কর্ত্তা; সুতরাং, বিবাহ প্রভৃতি সাংসারিক বিষয়ে অন্যদীয় ইচ্ছার বশবর্ত্তী নহেন। ইহারা স্বেচ্ছানুসারে ২। ৩। ৪। ৫ বিবাহ করিয়া থাকেন। ইহারা আপত্তি করিতে পারেন, সাংসারিক বিষয়ে মনুষ্যমাত্রের সম্পূর্ণ কর্ত্তৃত্ব ও স্বেচ্ছানুসারে চলিবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে; প্রতিবেশিবর্গের সে বিষয়ে কথা কহিবার বা প্রতিবন্ধক হইবার অধিকার নাই। যাঁহাদের একাধিক বিবাহ করিতে ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি নাই, তাহারা এক বিবাহে সন্তুষ্ট হইয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করুন; আমরা তাঁহাদিগকে অধিক বিবাহ করিতে অনুরোধ করিব না। আমাদের অধিক বিবাহ করিবার ইচ্ছা আছে, আমরা ভাহা করিব; সে বিষয়ে তাঁহারা দোষদর্শন বা আপত্তি উদ্যাপন করিবে কেন।

 দ্বিতীয়;—পিতা মাতা পুত্রের বিবাহ দিয়াছেন। বিবাহের পর, কন্যাপক্ষীয়দিগকে, বহুবিধ দ্রব্যসামগ্রী দিয়া, মধ্যে মধ্যে জামাতার তত্ত্ব করিতে হয়। তবে তত্ত্বের সামগ্রী ইচ্ছানুরূপ না হইলে, জামাতৃপক্ষীয় স্ত্রীলোকেরা অসন্তুষ্ট হইয়া থাকেন। কোনও কোনও স্থলে এই অসন্তোষ এত প্রবল ও দুর্নিবার হইয়া উঠে যে তদুপলক্ষে পুনরায় পুত্রের বিবাহ দেওয়া আবশ্যক হয়।

 তৃতীয়;—কখনও কখনও অতি সামান্য কারণে বৈবাহিকদিগের পরস্পর বিলক্ষণ অস্বরস ঘটিয়া উঠে। তথাবিধ স্থলেও পিতা মাতা, বৈবাহিককুলের উপর আক্রোশ করিয়া, পুনরায় পুত্রের বিবাহ দিয়া থাকেন।

 চতুর্থ;—কোনও কারণে, কোনও কোনও স্থলে, পুত্রবধূর উপর শাশুড়ীর বিষম বিদ্বেষ জন্মে। সেই বিদ্বেবুদ্ধির বশবর্ত্তিনী হইয়া, তিনি স্বামীকে সম্মত করিয়া পুনরায় পুত্রের বিবাহ দেন।

 পঞ্চম;—অধিক অলঙ্কার দানসামগ্রী প্রভৃতি পাওয়া যাইতেছে, এই লোভে আক্রান্ত হইয়া, কোনও কোনও পিতা মাতা কদাকারা কন্যার সহিত পুত্রের বিবাহ দেন। সেই স্ত্রীর উপর পুত্রের অনুরাগ জন্মে না। পরিশেষে পুত্রের সন্তোষার্থে পুনরায় তাহার বিবাহ দিতে হয়।

 ষষ্ঠ;—অন্য কোনও লোভ নাই, কেবল কুটুম্বিতার বড় সুখ হইবেক, এ অনুরোধেও পিতা মাতা, পুত্রের হিতাহিত বিবেচনা না করিয়া, তাহার বিবাহ দিয়া থাকেন। সে স্থলেও অবশেষে পুনরায় পুত্রের বিবাহ দিবার আবশ্যকতা ঘটে।

 যদি রাজশাসন দ্বারা বহুবিবাহ প্রথা রহিত হইয়া যায়, তাহা হইলে, পুত্রের বিবাহবিয়ে পিতামাতার যে স্বেচ্ছাচার আছে, তাহার উচ্ছেদ হইবেক। সুতরাং তাঁহাদেরও তন্নিবারণবিষয়ে আপত্তি করিবার আবশ্যকতা আছে। কিন্তু এপর্য্যন্ত, কোনও পক্ষ হইতে তাদৃশ আপত্তি স্পষ্ট বাক্যে উচ্চারিত হয় নাই। সুতরাং, ঐ সকল আপত্তির নিৱাকরণে প্রবৃত্ত হইবার প্রয়োজন নাই।

 বহুবিবাহপ্রথা নিবারাণার্থ আবেদনপত্র প্রদানবিষয়ে যাঁহারা প্রধান উদ্যোগী, কোনও কোনও পক্ষ হইতে তাঁহাদের উপর এই অপবাদ প্রবর্তিত হইতেছে যে, তাঁহারা কেবল নাম কিনিবার জন্য দেশের অনিষ্টসাধনে উদ্যত হইয়াছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, বিংশতি সহস্রের অধিক লোক আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করিয়াছেন। ইঁহারা সকলে এত নির্ব্বোধ ও অপদার্থ নহেন, যে এককালে সদস্য দ্বিবেচনাশূ্ন্য হইয়া, কতিপয় ব্যক্তির নামক্রয়বাসনা পূর্ণ করিবাব জন্য, স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর করিলেন। নিম্নে কতিপয় স্বাক্ষরকারীর নাম নির্দ্দিষ্ট হইতেছে; —

বর্দ্ধমানাধিপতি শ্রীযুত মহারাজাধিরাজ মহাতাপচন্দ্র বাহাদুর
নবদ্বীপাধিপতি শ্রীযুত মহারাজ সতীশচন্দ্র রায় বাহাদুর
শ্রীযুত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর (পাইকপাড়া)
শ্রীযুত রাজা সত্যশরণ ঘোষাল বাহাদুর (ভূকৈলাস)
শ্রীযুত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (উত্তরপাড়া
শ্রীযুত বাবু রাজকুমার রায় চৌধুরী (বারিপুর)
শ্রীযুত রাজা পূর্ণচন্দ্র রায় (সাওড়াপুলী)
শ্রীযুত বাবু সারদাপ্রসাদ রায় (চকদিঘী)
শ্রীযুত বাবু যজ্ঞেশ্বর সিংহ (ভাস্তাড়া)
শ্রীযুত রায় প্রিয়নাথ চৌধুরী (টাকী)
শ্রীযুত বাবু শিবনারায়ণ রায় (জাড়া)
শ্রীযুত বাবু শম্ভুনাথ পণ্ডিত

শ্রীযুত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীযুত বাবু রামগোপাল ঘোষ
শ্রীযুত বাবু হীরালাল শীল
শ্রীযুত শ্যামাচরণ মল্লিক
শ্রীযুত বাবু রাজেন্দ্র মল্লিক
শ্রীযুত বাবু রাজেন্দ্র দত্ত
শ্রীযুত বাবু নৃসিংহ দত্ত
শ্রীযুত বাবু গোবিন্দচন্দ্র সেন
শ্রীযুত বাবু হরিমোহন সেন
শ্রীযুত বারু মাধবচন্দ্র সেন

শ্রীযুত বাবু রামচন্দ্র ঘোষাল
শ্রীযুত বাবু ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল
শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ মল্লিক
শ্রীযুত বাবু কৃষ্ণকিশোর ঘোষ
শ্রীষুত বাবু দ্বারকানাথ মিত্র
শ্রীযুত বাবু দয়ালচাঁদ মিত্র
শ্রীযুত বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র
শ্রীযুত বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র
শ্রীযুত বাবু দুর্গাচরণ লাহা
শ্রীযুত বাবু শিবচন্দ্র দেব
শ্রীযুত বাবু শ্যামাচরণ সরকার
শ্রীযুত বাবু কৃষ্ণদাস পাল

 এক্ষণে অনেকে বিবেচনা করিতে পারিবেন, এই সকল ব্যক্তিকে তত নির্ব্বোধ ও অপদার্থ জ্ঞানকরা সঙ্গত কি না। বহুবিবাহ প্রথা নিবারণ হওয়া উচিত ও আবশ্যক, এরূপ সংস্কার না জম্মিলে, এবং তদর্থে রাজদ্বারে আবেদনকরা পরামর্শসিদ্ধ বোধ না হইলে, ইঁহারা অন্যের অনুরোধে, বা অন্যবিধ কারণ বশতঃ, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিবার ব্যক্তি নহেন। আর, বহুবিবাহপ্রধা নিবারিত হইলে দেশের অনিষ্টসাধন হইবেক, এ কথার অর্থগ্রহ করিতে পারা যায় না। বহুবিবাহ প্রথা যে, যার পর নাই, অনিষ্টের কারণ হইয়া উঠিয়াছে, তাহা, বোধ হয়, চক্ষু কর্ণ হৃদয় বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তি অস্বীকার করিতে পারেন না। সেই নিরতিশয় অনিষ্টকর বিষয়ের নিবারণ হইলে, দেশের অনিষ্টসাধন হইবেক, আপত্তিকারী মহাপুরুষদের মত সূক্ষদর্শী না হইলে, তাহা বিবেচনা করিয়া স্থির করা দুরূহ। যাহা হউক, ইহা নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে নির্দেশ করা যাইতে পারে, যাঁহারা বহুবিবাহ- প্রথা নিবারণের জন্য রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন, স্ত্রীজাতির দুরবস্থাবিমোচন ও সমাজের দোষসংশোধন ভিন্ন, তাঁহাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নাই।