বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার/সপ্তম আপত্তি
সপ্তম আপত্তি।
কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, ভারতবর্ষের সর্ব্বপ্রদেশেই, হিন্দু মুসলমান উভয়বিধ সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে, বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে, কেবল বাঙ্গালাদেশের হিন্দুসম্প্রদায়ের লোক, ঐ প্রথা রহিত করিবার নিমিত্ত, আবেদন করিয়াছেন। বাঙ্গলাদেশ ভারতবর্ষের এক অংশ মাত্র। এক অংশের এক সম্প্রদায়ের লোকের অনুরোধে, ভারতবর্ষীয় যাবতীয় প্রজাকে অসন্তুষ্ট করা গবর্ণমেণ্টের উচিত নহে।
এই আপত্তি কোনও ক্রমে যুক্তিযুক্ত বোধ হইতেছে না। বহুবিবাহ- প্রথা প্রচলিত থাকাতে, বাঙ্গলাদেশে হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে যত দোষ ও যত অনিষ্ট ঘটিতেছে; বোধ হয়, ভারতবর্ষের অন্য অন্য অংশে তত নহে, এবং বাঙ্গালাদেশের মুসলমানসম্প্রদায়ের মধ্যেও, সেরূপ দোষ বা সেরূপ অনিষ্ট শুনতে পাওয়া যায় না। সে যাহা হউক, যাঁহারা আবেদন করিয়াছেন, বাঙ্গলাদেশে হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে বহুবিবাহনিবন্ধন যে অনিষ্ট সংঘটন হইতেছে, তাহার নিবারণ হয়, এই তাঁহাদের উদ্দেশ্য, এই তাঁহাদের প্রার্থনা। এ দেশের মুসলমানসম্প্রদায়ের লোকে বহু বিবাহ করিয়া থাকেন; তাঁহারা চিরকাল সেরূপ করুন; তাহাতে আবেদনকারীদিগের কোনও আপত্তি নাই, এবং তাহাদের এরূপ ইচ্ছাও নহে, এবং প্রার্থনাও নহে, যে গবর্ণমেণ্ট এই উপলক্ষে তাঁহাদেরও বহুবিবাহের পথ রুদ্ধ করিয়া দেন। অথবা, গবর্ণমেণ্ট এক উদ্যমে ভারতবর্ষের সর্ব্বসাধারণ লোকের পক্ষে বিবাহবিষয়ে ব্যবস্থা করুন, ইহাও তাঁহাদের অভিপ্রেত নহে। বহুবিবাহসূত্রে স্বদেশের যে মহতী দুরবস্থা ঘটিয়াছে, তদ্দর্শনে তাঁহারা দুঃখিত হইয়াছেন, এবং সেই দুরবস্থা বিমোচনের উপায়ান্তর না দেখিয়া, রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন। স্বদেশের ও স্বসম্প্রদায়ের দুরবস্থা বিমোচন মাত্র তাঁহাদের উদ্দেশ্য। যদি গবর্ণমেণ্ট সদয় হইয়া তাঁহাদের আবেদন গ্রাহ্য করিয়া, এ দেশের হিন্দুসম্প্রদায়ের বিবাহবিষয়ে কোনও ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করেন, তাহাতে এ প্রদেশের মুসলমানসম্প্রদায়, অথবা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়, অসন্তুষ্ট হইবেন কেন। এ দেশের হিন্দুসম্প্রদায় গবর্ণমেণ্টের প্রজা। তাহাদের সমাজে কোনও বিষয় নিরতিশয় ক্লেশকর হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের যত্নে ও ক্ষমতায় সে ক্লেশের নিবারণ হইতে পারে না। অথচ সে ক্লেশের নিবারণ হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। প্রজারা, নিরুপায় হইয়া, রাজার আশ্রয়গ্রহণপূর্বক সহায়তা প্রার্থনা করিয়াছে। এমন স্থলে, প্রজার প্রার্থনা পরিপূরণকরা রাজার অবশ্যকর্ত্তব্য। এক প্রদেশের প্রজাবর্গের প্রার্থনা অনুসারে, তাহদের হিতার্থে কেবল সেই প্রদেশের জন্য, কোনও ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিলে, হয়ত প্রদেশান্তরীয় প্রজারা অসন্তুষ্ট হইবেক, এই আশঙ্কা করিয়া তদ্বিষয়ে বৈমুখ্য অবলম্বন করা রাজধর্ম্ম নহে।
এরূপ প্রবাদ আছে, ভারতবর্ষের ভূতপূর্ব গবর্ণর জেনেরেল মহাত্মা লার্ড বেণ্টিক, অতি নৃশংস সহগমনপ্রথা রহিত করিবার নিমিত্ত, কৃভসঙ্কল্প হইয়া, প্রধান প্রধান রাজপুরুষদিগকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই স্পষ্ট বাক্যে কহিয়াছিলেন, এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিলে, ভারতবর্ষের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যস্ত, যাবতীয় লোক যৎপরোনাস্তি অসন্তুষ্ট হইবেক, অবিলম্বে রাজবিদ্রোহে অভুথান করবেক। মহামতি মহাসত্ত্ব গবর্নর জেনেরেল, এই সকল কথা শুনিয়া, ভীত বা হতোৎসাহ না হইয়া কহিলেন, যদি এই প্রথা রহিত করিয়া এক দিন আমাদের রাজ্য থাকে, তোহা হইলেও ইরেজজাতির নামের,যথার্থ গেরিব ও রাজ্যাধিকারের সম্পূর্ণ সার্থকতা হইবেক। তিনি, প্রজার দুঃখদর্শনে দয়ার্দ্রচিত্ত ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, এই মহাকার্য্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন। এক্ষণেও আমরা সেই ইঙ্গরেজজাতির অধিকারে বাস করিতেছি; কিন্তু অবস্থার কত পরিবর্ত্ত হইয়াছে। যে ইঙ্গৱেজজাতি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, রাজ্য- ভ্রংশভয় অগ্রাহ্য করিয়া, প্রজার দুঃখ বিমোচন করিয়াছেন। এক্ষণে স্বতঃপ্রবৃত্ত হওয়া দূরে থাকুক, প্রজারা বারংবার প্রার্থনা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারে না। হায়!
"তে কেহ পি দিবসা গতাঃ”।
সে এক দিন গিয়াছে।
যাহা হউক, আবেদনকারীদের অভিমত ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিলে, গবর্ণমেণ্ট এতদ্দেশীয় মুসলমান বা অন্যান্য প্রদেশীয় হিন্দু মুসলমান উভয়বিধ প্রজাবর্গের নিকট অপরাধী হইবেন, অথবা তাহারা অসন্তুষ্ট হইবেক, এই ভয়ে অভিভূত হইয়া প্রার্থিত বিষয়ে বৈমুখ অবলম্বন করিবেন, এ কথা কোনও মতে শ্রদ্ধেয় হইতে পারে না। ইঙ্গরেজজাতি তত নির্ব্বোধ, তত অপদার্থ ও তত কাপুরুষ নহেন। যেরূপ শুনিতে পাই, তাঁহারা রাজ্যভোগের লোভে আকৃষ্ট হইয়া, এ দেশে অধিকার বিস্তার করেন নাই; সর্ব্বাংশে এ দেশের শ্রীবৃদ্ধিসাধনই তাঁহাদের রাজ্যাধিকারের একমাত্র উদ্দেশ্য।
এ স্থলে, একটি কুলীমহিলার আক্ষেপোক্তির উল্লেখ না করিয়া, ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। ঐ কুলীনমহিলা ও তাঁহার কনিষ্ঠা ভগিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইলে, জ্যেষ্ঠা জিজ্ঞাসা করিলেন, আবার না কি বহুবিবাহনিবারণের চেষ্টা হইতেছে। আমি কহিলাম, কেবল চেষ্টা নয়, যদি তোমাদের কপালের জোর থাকে, আমরা এ বারে কত কার্য্য হইতে পারি। তিনি কহিলেন, যদি আর কোনও জোর না থাকে, তবে তোমরা কৃতকার্য্য হইতে পারিবে না; কুলীনের মেয়ের নিতান্ত পোড়া কপাল; সেই পোড়া কপালের জোরে গত হবে, তা আমরা বিলক্ষণ জানি। এই বলিয়া, মৌনবলম্বনপূর্ব্বক, কিরৎক্ষণ ক্রোড়স্থিত শিশু কন্যাটির মুখ নিরীক্ষণ করিলেন; অনন্তর, সজলনয়নে আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, বহুবিবাহ নিবারণ হইলে, আমাদের আর কোনও লাভ নাই আমরা এখনও যে সুখভোগ করিতেছি, তখনও সেই সুখভোগ করিব। তবে যে হতভাগীরা আমাদের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে, যদি তাহারা আমাদের মত চিরদুঃখিনী না হয়, তাহা হইলেও আমাদের অনেক দুঃখ নিবারণ হয়। কিঞ্চিৎকাল, এইরূপ আক্ষেপ করিয়া, সেই কুলীনমহিলা কহিলেন, সকলে বলে, এক স্ত্রীলোক আমাদের দেশের রাজা; কিন্তু আমরা সে কথায় বিশ্বাস করি না; স্ত্রীলোকের রাজ্যে স্ত্রীজাতির এত দুরবস্থা হইবে কেন। এই কথা বলিবার সময়, তাঁহার ম্লান বদনে বিষাদ ও নৈরাশ্য এরূপ সুস্পষ্ট ব্যক্ত হইতে লাগিল যে আমি দেখিয়া, শোকাভিভূত হইয়া, অশ্রু বিসৰ্জন করিতে লাগিলাম।
হা বিধাতঃ! তুমি কি কুলীনকন্যাদের কপালে, নিরবচ্ছিন্ন ক্লেশ- ভোগ ভিন্ন, আর কিছুই লিখিতে শিখ নাই। উল্লিখিত আক্ষেপবাক্য আমাদের অধীশ্বরী করুণাময়ী ইংলণ্ডেশ্বরীর কর্ণগোচর হইলে, তিনি সাতিশয় লজ্জিত ও নিরতিশয় দুঃখিত হন, সন্দেহ নাই।
এই দুই কুলীনমহিলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই —ইঁহারা দুপুরুষিয়া ভঙ্গকুলীনের কন্যা এবং স্বকৃতভঙ্গ কুলীনের বনিতা। জ্যেষ্ঠার বয়ঃক্রম ১১।১২ বৎসর, কনিষ্ঠার বয়ঃক্রম ১৬। ১৭ বৎসর। জ্যেষ্ঠার স্বামীর বয়ঃক্রম ৩০ বৎসর, তিনি এপর্য্যন্ত ১২ টি বিবাহ করিয়াছেন। কনিষ্ঠার স্বামীর বয়ঃক্রম ২৫| ২৬ বৎসর, তিনি এপর্য্যন্ত ৩২ টির অধিক বিবাহ করেন নাই।