বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১
সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ঢাকা
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ | |
---|---|---|---|
১ | ঢাকার সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র | ১৯৭১ |
ঢাকা সেনানিবাস ও শহরে যা ঘটেছিল
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল আবু তাহের সালাহউদ্দীন[১]
অহিংসা ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় যে সকল ছোটখাটো গণ্ডগোল আরম্ভ হয় তাতে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণরূপ আওয়ামী লীগের উপর দোষারোপ করে এবং এই দোষ দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরকারের সহযোগিতায় ২৫শে মার্চ বাংলাদেশে সীমাহীন গণহত্যা চালায়। কিন্তু এই হত্যার পরিকল্পনা অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ব থেকে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর ছিল। তার কারণস্বরূপ-
যে কোন দেশে সেনাবাহিনীর সৈন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মোতায়েন করতে হলে তার মূল জায়গা অর্থাৎ যেখানে থেকে সৈন্য পাঠান হয় সেই জায়গায় প্রতিরক্ষার উপর প্রথম গুরুত্ব দিতে হয় এবং সেটা করতে পারলেই সেই জায়গা থেকে সরানোর আদেশ হয়। (এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পাকিস্তান সামরিক সরকার ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১ থেকেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। তাতেই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানী সামরিক সরকরের সুপরিকল্পনা ছিল)।
যেহেতু সীমান্ত এলাকায় শত্রুদেশের সৈন্যের সঙ্গে কোন ছোটখাট গোলাগুলি বিনিময় হয়নি বা দেশের জনসাধারণ ও খবরের কাগজে যুদ্ধের কোন হুমকির আভাসও পাওয়া যায়নি তথাপি পাকিস্তান সরকারের এরূপ সৈন্য মোতায়েনে (বিভিন্ন থানা পর্যায়ে) প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানী সামরিক সরকার বাংলাদেশের জনসাধারণের উপর গণহত্যার পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করেছিল।
১লা মার্চ, ৭১ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ জেনারেলগণ বিভিন্ন সময়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যাণ্টনমেণ্টে গিয়ে সম্মেলন করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন:
(১) লেঃ জেঃ টিক্কা খান, কমাণ্ডার ইস্টার্ন কমাণ্ড। (২) মেঃ জেঃ খাদেম হোসেন রাজা, জি-ও-সি, ১৪ ডিভিশন। (৩) জেনারেল অবদুল হামিদ খান, চীফ অব আর্মি স্টাফ। (৪) লেঃ জেঃ এ, এ, কে, নিয়াজী, কোর কমাণ্ডার। (৫) মেঃ জেঃ আকবর হোসেন, ডাইরেক্ট জেনারেল, ইণ্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স। (৬) মেঃ জেঃ ওমর, চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশন। (৭) মেঃ জেঃ কমর আলী মীর্জা, প্রাক্তন ডাইরেক্টর, মিলিটারী ইনটেলিজেন্স (তখন- ডাইরেক্টর সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট। (৮) মেঃ জেঃ মিঠ্ঠা খান, স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ কমাণ্ডার এণ্ড কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল। (৯) মেঃ জেঃ খোদা দাদ, এডজুট্যাণ্ট জেনারেল। (১০) মেঃ জেঃ গুল হাসান, চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ। (১১) মেঃ জেঃ রাও ফরমান আলী খান, সিভিল এফেয়ার্স এডভাইজার, গভর্নমেণ্ট অব ইস্ট পাকিস্তান। (১২) ব্রিগেডিয়ার আনসারী (মেঃ জেঃ আনসারী) (স্টেশন কমাণ্ডার, ঢাকা), (পরে-পি-ও-সি, ৯-ডিভিশন)। (১৩) মেঃ জেঃ নজর হুসেন শাহ। (১৪) মেঃ জেঃ কাজী আবদুল মজিদ। (১৫) লেঃ জেঃ পীরজাদা, (পি এস ও টু জেঃ ইয়াহিয়া খান। (১৬) মেজর জেনারেল জামশেদ। (১৭) মেঃ জেঃবাহাদুর শের।
সৈন্য বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করার পূর্বে কতকগুলো দিক চিন্তা করতে হয়, যেমন- সৈন্যদের থাকা, খাওয়া, বেতন, যানবাহন, যোগাযোগ ইত্যাদি। তাছাড়া ডাটা, ম্যাপ ইত্যাদি করতে হয়। পঁচিশে মার্চের গণহত্যা যদি হঠাত্ব হতো তাহলে পাকিস্তানী সৈন্যগণ ২৫ শে মার্চে বাংলাদেশে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একই সাথে একই সময়ে বাঙ্গালী সৈন্য, ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, তথা জনসাধারণের উপর আক্রমণ ও গণহত্যা চালায় কিভাবে? এতেই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তান সামরিক সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিল।
১৫ই মার্চ, ৭১-এ প্রেসিডেণ্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা, ক্ষমতা হস্তান্তর, অসহযোগ আন্দেলন প্রভৃতি সম্পর্কে প্রেসিডেণ্ট হাউসে (বর্তমান গণভবন) এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভায় আলোচনা করেন। অপরদিকে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে উপরোল্লিখিত জেনারেলদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্র চলত।
যেহেতু আর্মি ইনটেলিজেন্সে-এ ছিলাম ও সাধারণ পোশাকে কর্তব্য পালন এবং চলাফেরা করতাম, সেজন্যই আমি পাকিস্তান সামরিক সরকারের কার্যকলাপ অনুসরণ করতে পারি।
২৫শে মার্চের পূর্বেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে সমস্ত উচ্চপদস্থ বাঙ্গালী অফিসার ছিলেন, তাঁদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসারসহ কিছু বাঙ্গালী সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠায়। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সঙ্গে যে সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্য ছিলেন তাঁদেরকে নিরস্ত্র করা হয়। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সকল সৈন্যকে সীমান্ত এলাকায় প্রেরণ করে ভারতের হুমকির অজুহাতে।
যে সকল বাঙ্গালী অফিসারকে স্ব স্ব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ও কয়েকজনকে অন্য পদে দেওয়া হয়, তাদের পরিচয় যথাক্রমেঃ (১) মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ, চীফ অব জেনারেল স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি। তিনি ছিলেন ৫৭-ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের (ঢাকা) ব্রিগেড মেজর (ব্রিগেড মেজরের কাজ হচ্ছে ব্রিগেডের অপারেশন প্লান করা এবং পরিচালনা করা)। মেজর খালেদ মোশাররফকে পাঠায় কুমিল্লা ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টে এবং তদস্থলে একজন পাঞ্জাবী অফিসারকে নিয়োগ করে।
(২) ব্রিগেডিয়ার মজুমদার। তিনি চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের কমাণ্ডাণ্ট ছিলেন। তাঁকে ২২শে মার্চ ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে আসা হয় এবং গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ক্যাপ্টেন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর) বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ড'র।
(৩) লেঃ কঃ মাসুদুল হাসান খান। তিনি ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টে জয়দেবপুরে ছিলেন। তাঁকে ২২শে অথবা ২৩শে মার্চ ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে আসে এবং তাকেও গৃহবন্দী করে এবং তাঁর স্থলে লেঃ কঃ রকিবকে জয়দেবপুর ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টে পাঠায়। কারণ লেঃ কঃ রকিব ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন। ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টে কঃ তাজ মোহাম্মদকে নিয়োগ করে। ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টেই ঢাকায় ২৫শে মার্চের রাতে গণহত্যা চালায়। এছাড়াও কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসারকে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় রাখা হয়। তাদেরকে বাইরের যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়।
বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে কয়েকটি ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা। যেমন, প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে যশোর ক্যাস্টনমেণ্ট থেকে চৌগাছা (সীমান্ত এলাকা) পাঠায়। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে জয়দেবপুর থেকে তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এক কোম্পানী পাঠায় টাঙ্গাইল। উক্ত কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন মেজর শফিউল্লা (বর্তমানে লিগেডিয়াল চীফ অব বাংলাদেশ আর্মি)। অন্য একটি কোম্পানী পাঠায় ময়মনসিংহে। উক্ত কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম (বর্তনামে লেঃ কর্নেল)।
সৈয়দপুর অবস্থিত ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে সীমান্ত এলাকায় পাঠায়। কুমিল্লায় অবস্থিত ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে পাঠায় ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। উক্ত রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে ছিল চট্টগ্রামে। তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় মোতায়েন করে। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে (ন্যশনাল সার্ভিস ব্যাটালিয়ন, যার অধিকাংশই ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল) ২৫শে মার্চের পূর্বেই ঢাকায় নিরস্ত্র করে। এছাড়াও ৬০৪ ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রায় ২৫ জন বাঙ্গালীকে (যার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিলাম আমি নিজেই) নিরস্ত্র করা হয়। শুধুমাত্র আমার অস্ত্রটা নিতে তারা সাহস করে নাই। তাছাড়া ঢাকায় অবস্থানরত নিম্নপদের সৈন্যগণ-যেমন সিগনাল রেজিমেণ্ট, ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, ৬০৪ কম্বাইণ্ড ওয়ার্কশপ, ১৪৭ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপ, সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী, কম্বাইণ্ড অর্ডন্যান্স ডিপো, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, ট্রানজিট ক্যাম্প, ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্স ও পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সমস্ত সৈন্যদেরকে অতি কায়দায় ও চালাকি করে নিরস্ত্র করে। বাঙ্গালীকে কেন নিরস্ত্র করা হচ্ছে পাঞ্জাবীরা তার কারণসরূপ দেখায় যে, যারা বাঙ্গালী তারা বাঙ্গালী আইনশৃংখলা ভঙ্গকারী জনগণের উপর গুলি চালাতে সক্ষম হবে না। জনগণের উপর গুলি চালাতে আমাদের মায়ামমতা লাগা স্বাভাবিক। কাজেই পাঞ্জাবীদের হাতে অস্ত্র কম থাকায় আমাদের অস্ত্র নিয়ে আইন-শৃংখলা স্বাভাবিক ও আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে- এই কারণেই আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিচ্ছে।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন শাহেদ নসরুল্লাহ (ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) আমার অফিসে প্রায়ই দেখা করত ও আমার নিকট থেকে খবরাখবর নিত। শাহেদ নাসরুল্লাহ এভাবে আসা-যাওয়া করাতে আমাকে আমার অফিসার কমাণ্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেন জিজ্ঞাসা করেন যে ছেলেটি কে এবং কেন আসে। আমি আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দেই এবং জানাই যে, যেহেতু আমাকে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বের হতে দেওয়া হয় না সেজন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। পরে একদিন শাহেদ নাসরুল্লহ যখন আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তায় মেজর মনোয়ার হোসেনের হাওয়ালদার মোঃ আশরাফ তার ফটো তুলে নেয়।
পরদিন নসরুল্লাহ আমার নিকট এসে হাওলাদার কর্তৃক তার ফটো তোলার কাথা জানায়। আমি নসরুল্লাহকে সাহস দিয়ে বলি ওতে কিছু হবে না। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো যখন ঢাকায় আসে ও হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে থাকে তখন শাহেদ নসরুল্লাহসহ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র ও গণবিক্ষোভ মিছিল হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে পৌঁছে এবং ভুট্টোকে নিন্দা করে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়। ঐ মিছিলে শাহেদ নসরুল্লাহর শ্লোগান দেওয়া ফটোটি ‘দি পিপল’ পত্রিকায় দেখা যায়। পিপল পত্রিকায় নসরুল্লাহর ফটো দেখা মাত্র মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে ডেকে বলেন, যে ছেলেটি তোমার নিকট আসে ও তোমার আত্মীয়, সে তো একজন ছাত্রনেতা সে ছেলেটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তিনি পিপল পত্রিকাটির কপি এনে আমাকে দেখান। তখন আমি মেজর মনোয়ার হোসেনকে জানাই যে আমি সঠিক কিছু বুঝতে পারছি না, সে তো কোনদিন ছাত্ররাজনীতি করতো না। এর থেকে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে আরও বেশী সন্দেহের চোখে দেখেন।
এরপর ১৫ই মার্চ থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের ঢাকা আগমন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার অগ্রগতির কথা শুনে আমরা কিছুটা আশাবাদী হিলাম যে তারা সম্ভবত আওয়ামী লীগকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আমরা বাঙ্গালী অফিসাররাও পাঞ্জাবীদের মতিগতিকে তেমনভাবে লক্ষ্য করতাম না আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাবে মনে করে (আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীনের প্রেসনোটের উপর ভিত্তি করে)।
২৩শে মার্চ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ও গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় প্রত্যেক বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ২৪শে মার্চ সকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেণ্ট ওয়ালী খানসহ আরও কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতার ঢাকা ত্যাগ করে যাওয়ায় আমাদের মনে সন্দেহ হয় এজন্য যে, হয়তবা আলোচনা মোটেই ফলপ্রসূ হয় নাই।
২৫শে মার্চ আমি আকস্মিকভাবে বিকেল চারটায় ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বাইরে চলে যাই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। দুর্ভাগ্যবশত শহর থেকে আমার মেসে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বেজে যায়। আমি ক্যাণ্টনমেণ্টে এসে সোজা আমার কক্ষে না গিয়ে ডাইনিং হলে যাই। খাওয়ার টেবিলে পাঞ্জাবী অফিসাররা উপস্থিত ছিল। খাবার পর সাড়ে ন’টায় আমার কক্ষে যাই। সেখানে সিপাই মোশাররফ হোসেন (বাঙ্গালী) আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই সে আমার নিকট ছুটে আসে এবং জানায় যে, সে আমার জন্য বিকেল ৪টা থেকে অপেক্ষা করছে। একথা বলেই সে সঙ্গে সঙ্গে তার পকেট থেকে ছোট এক টুকরা কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়।
উক্ত চিঠিখানা লিখেছিলেন ৩১-ফিল্ড রেজিমেণ্ট আর্টিলারীর ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) খুরশীদ আলম চৌধুরী। তিনি লিখেছিলেন, ৩১-ফিল্ড রেজিমেণ্ট আর্টিলারীর কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল জাহেদ হাসান ঐদিন (২৫শে মার্চ) বেলা আড়াইটায় নির্দেশ দিয়েছেন অদ্য রাতে (২৫শে মার্চ) তার রেজিমেণ্টকে শহরে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শহরে আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে বলে জানান এবং আরও বলেন যে যদিও শন্তি-শৃংখলা রক্ষা করার জন্য শহরে যাওয়া হবে তবু একটা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সঙ্গে নিতে হবে। আরও বলেছিলেন যে, তার নির্দেশের পর কোন বাঙ্গালী অফিসার বা জোয়ানরা রেজিমেণ্ট এলাকা থেকে কোনক্রমেই বাইরে যেতে পারবে না (তখন থেকে যতক্ষন পর্যন্ত রেজিমেণ্ট শহরের উদ্দেশ্যে বের না হয়)। উক্ত ক্যাপ্টেন খুরশীদ আলম চৌধুরীর পক্ষে আমার নিকট চিঠিখানা এজন্যই পাঠানো সম্ভব হয়েছিল যে, তাঁর রেজিমেণ্ট এলাকা ও আমার মেস পাশাপাশি জায়গায় ছিল, মাঝখানে শুধু কাঁটাতারের বেড়া।
চিঠিখানা আমার হস্তগত হওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ অস্বস্তি বোধ করি। এমতাবস্থায় কি করা কর্তব্য সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি এবং আমার সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে। গভীর চিন্তার পর আমার পাশের কক্ষের বন্ধু ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মুস্তাফিজুর রহমান (তিনি আর্মি ইঞ্জিনিয়ার্সের ক্যাপ্টেন এবং বিমান বাহিনীর সঙ্গে ডেপুটেশনে ছিলেন এবং সেখানে সহকারী গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করতেন) এর নিকট যাই। মুস্তাফিজুর রহমান আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং আমরা দু’জনে মাঝে মাঝে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর আলোচনা করতাম। তাঁকে ক্যাপ্টেন খুরশীদ আলম চৌধুরীর চিঠিখানা সম্বন্ধে জানাই। দু’জনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে শহরে গিয়ে আওয়ামী ও ছাত্রলীগ নেতৃবর্গকে এ খবর পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেই। শেখ কামালের বিশিষ্ট বন্ধু শাহেদ নসরুল্লাহকে (ধানমন্ত্রীর বাসায়) প্রথমে খবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা শাহেদ নসরুল্লাহকে খবর দিলে সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট এ খবর অতিশীঘ্র পৌঁছাবে। মুস্তাফিজুর রহমান বললেন, তাঁর কয়েকজন ভাই, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেণ্ট জহুরুল হক হল) ও বিভিন্ন হলে রয়েছে, তাদেরকেও এ খবর জানালে ছাত্ররাও প্রস্তুতি নিতে পারবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা দু’জন তাঁর নিজস্ব টয়োটা গাড়ীতে শহরে রওনা হই (রাত প্রায় দশটা)। যখন আমাদের টয়োটা গাড়ী ৩১-ফীল্ড রেজিমেণ্টের গেটে পৌঁছে তখন আমরা দেখতে পাই যে, ৩১-ফিল্ড রেজিমেণ্টের গেট দিয়ে চীফ অব আর্মি স্টাফের পতাকাসহ ৪ তারকাবিশিষ্ট একখানা স্টাফ কার বের হচ্ছে। উক্ত গাড়ীতে জেঃ আব্দুল হামিদ খান, চীফ অব আর্মি স্টাফ, পাকিস্তান আর্মি এবং জেনারেল টিক্কা খান, কমাণ্ডার, ইস্টার্ন কমাণ্ড হিলেন। উক্ত গাড়ীর পিছনে প্রায় ৫০/৬০ খানা খোলাগাড়ী ছিল। কয়েকটি গাড়ীতে ভারী মেশীনগান লাগানো, কয়েকটি গাড়ীতে রিকয়েললেস রাইফেল লাগানো, কয়েকটি বড় বড় ট্রাকে পুরো যুদ্ধের পোষাক ও অস্ত্রসহ সেনা ছিল। আমরা রাস্তা নির্দেশের উল্টোপথ দিয়ে তাদেরকে পিছনে ফেলে আগে চলে যাই। তখন শহরে লোকজন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছিল। প্রথমে আমরা ধানমণ্ডি ২৬ নং সড়কে শাহেদ নসরুল্লাহর বাসভবনে গিয়ে বিস্তারিত জানাই এবং শেষ কামালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নিকট আমাদের খবর পৌঁছানোর কথা বলি। এছাড়া তাকে (নসরুল্লাহ) তার বাসা থেকে অন্যত্র চলে যাবার পরামর্শ দেই। কেননা মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট তার তুলে নেওয়া ফটো ও দি পিপল পত্রিকায় প্রকাশিত ফটো ছিল। আমাদের কথা শুনে শাহেদ নসরুল্লাহর পিতা খুবই চিন্তায় পড়েন। কিছুক্ষণ পর আমরা মুস্তাফিজুর রহমানের ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়ার জন্য মোহাম্মদপুরে যাই। তাদেরকেও আমরা বিস্তারিত খবর জানাই এবং সতর্ক হওয়ার জন্য অন্যান্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনকে খবর পৌঁছাতে বলি। সেখান থেকে আমরা ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে আসার পথে ফার্মগেট ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিলের মাঝে পড়ি। ছাত্ররা ফার্মগেটে প্রতিবন্ধকতা (ব্যারিকেড) সৃষ্টি করেছিল যেন শহরে সৈন্যবাহিনীর যে সমস্ত গাড়ী গিয়েছে তারা ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে আসতে না পারে। আমরা যখন মিছিলের মাঝে পড়ি তখন কয়েকজন ছাত্র আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমি সেনাবাহিনীর পরিচয় না দিয়ে বাঙ্গালী ও সাধারন মানুষ, গুলশানে বাসা আছে বলে জানাই। তখন তারা আমাদের গাড়ী চলার জন্য একটু জায়গা পরিষ্কার করে দেয় (তখন রাত প্রায় এগারটা)। ব্যারিকেড অতিক্রম করার পরই আমরা দেখলাম সেনাবাহিনীর ৪ খানা মেশিনগান লাগানো গাড়ী (বাতি নিভানো) কয়েকজন সৈন্য ফার্মগেটের দিকে ঠেলে নিচ্ছে। আমাদের গাড়ী একটু থামালাম। গাড়ী কয়েকখানা ফার্মগেটের কাছাকাছি গিয়েই ছাত্রদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু ছাত্র ও সধারণ মানুষ সেখানেই মারা যায়। তারপর আমরা ক্যাণ্টনমেণ্টে আমাদের মেসে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর আমি আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় আমার পিতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি এবং জানতে পারি যে চট্টগ্রামেও পশ্চিমা সৈন্যরা শহরে নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্মমভাবে গুলি করছে এবং হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। আমার পিতার সঙ্গে কথা শেষ করেই আমি ঢাকায় ধানমণ্ডিতে আমার মামা এডভোকেট জনাব আবু তাহের চৌধুরীকে টেলিফোন করি তাঁকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার খবর জানাই। রাত বারটা পর্যন্ত টেলিফোন যোগাযোগ ছিল, তার পরই আমাদের কানে অসংখ্য গুলির আওয়াজ আসে। মীরপুর, গুলশান ও এয়ার্পোট এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির আওয়াজ ও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এসময় পুরোদমে পাঞ্জাবীরা ঢাকায় নিরীহ ঘুমন্ত জনসাধারণের উপর আক্রমণ করে মেশিনগান দিয়ে নির্মমভাবে গণহত্যা শুরু করেছে। এভাবে সারারাত গণহত্যা চালায়। শেষরাতে সেনাবাহিনী ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে শহরে আক্রমণ চালায় এবং অসংখ্য বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ পাই। এভাবে আমি, ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মুস্তাফিজ, ক্যাপ্টেন এনামসহ আরো কয়েকজন সারারাত চিন্তিত থাকি ও অনিদ্রায় রাত কাটাই।
আমাদের বিল্ডিং-এ পাঞ্জাবী মেজর পীর কমরউদ্দিন (জি-এইচ-কিউ ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ইউনিটের অফিসার কমাণ্ডিং ছিলেন) সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাঁর বিছানাপত্রসহ সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বলেন, তিনি অফিসে যাচ্ছেন এবং অফিসেই থাকবেন। মেজর কমর পাঞ্জাবী হলেও আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু এবং একই সাথে ইনটেলিজেন্স কোর্স করি। আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই তাকে চিনতেন। তিনি চলে যাবার সময় অকথ্য ভাষায় আমাদেরকে কতগুলি কটুক্তি করেন ও আওয়ামী লীগকে গালিগালাজ করেন। আমাদেরকে সন্দেহ করে কিংবা ভয় করেই হয়তবা তিনি চলে যান। তাঁর এরূপ কটুক্তি ও গালাগালিতে আমরা সবাই ধারণা করি যে অন্যান্য পাঞ্জাবী অফিসারও বোধ হয় বাঙ্গালী অফিসার ও সৈন্যদের সঙ্গে অনুরূপ দুর্ব্যবহার করছে।
২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে সাতটায় আমি আমার অফিসে যাই। সেখানে মেজর মনোয়ার হোসেনসহ মেজর ফারুকী ও মেজর মীর্জা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা খুব আনন্দ ও হাসাহাসি করছিলেন এবং অতি খুশীতে মিষ্টি খাচ্ছিলেন। মেজর মনোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগের পতন ও বাঙ্গালীদের দমন করার কথায় মেতে ছিলেন। তাঁরা আমাকেও মিষ্টি খেতে বলেন। তখন আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও একটা মিষ্টি খেলাম, তারপরই আমি শহরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে যাবার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে বাইরে যাওয়া থেকে বঞ্চিত করেন এবং বলেন, শহরে অনেক বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী মারা গেছে। যেহেতু তুমি বাঙ্গালী, কাজেই তাদের মৃতদেহ দেখে তুমি স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে পারবে না, কাজেই তোমাকে এখন বাইরে বা শহরে যাবার অনুমতি দিতে পারি না। আমি অফিসেই বেলা প্রায় দু’টা পর্যন্ত বসে রইলাম। এসময় ইউনিটের বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী সৈন্য আমার নিকট এসে শহরে ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর জানায় এবং এমতাবস্থায় তাদের কি কর্তব্য তা আমার নিকট থেকে জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। আমি তাদেরকে কিছুটা সান্ত্বনা দেই ও আরও কিছু সময়ের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে বলি। তারপর আড়াইটার সময় আমি আমার মেসে খেতে যাই এবং খাবার পর কক্ষে প্রবেশ করলে আমার সিপাই মোশাররফ (যার নিকট একটা স্টেনগান থাকত) আমাকে জানায় যে তার নিকট থেকে পাঞ্জাবীরা স্টেনগানটি নিয়ে নিয়েছে। সিপাই মোশাররফের কাছ থেকে স্টেনগান কেড়ে নেয়ায় আমার একটু ভয় হয় এবং অত্যন্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। তার পরই আমাদের পাশের বাড়িতে মেজর মওলার (বাংগালী-১৪৯ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপের কমাণ্ডিং অফিসার) নিকট গিয়ে স্টেনগান কেড়ে নেয়ার কথা জানাই এবং আমরা যারা বাঙ্গালী ছিলাম সবাই নিরাপত্তার কথাও বলি। আমার কথা শুনে মেজর মওলা বলেন, বাঙ্গালীদেরকে পাঞ্জাবীরা মারবে না- মারতে পারে না। কিন্তু তবু আমরা তিনচারজন অফিসার রাতে তার বাসায় থাকা ও ঘুমানোর কথা বলি এবং আরও জানাই যে আমাদের ঘুমের সময় একজন অফিসার রাতে সব সময় পাহারা থাকবে। তিনি রাজী হলেন। আমি, ক্যাপ্টেন এনাম এবং মুস্তাফিজ ও মেজর ইকবাল তার বাসায়ই থাকি। কিন্তু সারারাত গুলির আওয়াজ এবং মীরপুর, গুলশান এলাকায় আগুন লাগানো দেখে আমাদের মোটেই ঘুম হয়নি।
২৭শে মার্চ, সকাল সাড়ে সাতটায় আমি অফিসে গেলে দেখতে পাই যে, তিনটা ই-পি-আর ট্রাক অসংখ্য রাইফেল ও অস্ত্রশস্ত্র (অস্ত্রগুলোতে অনেক লাল রক্ত লাগানো দেখতে পাই) নিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় ঢুকছে। আমার অফিসের অনেক বাঙ্গালী সিপাই আমাকে জানায় যে, ই-পি-আর ক্যাম্প এবং রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পে পাঞ্জাবীরা নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করে এবং বহু ই-পি-আর ও পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এ সময় আমি আমার শহরের আত্মীয়স্বজনের কোন খবরা খবর না পেয়ে খুবই চিন্তায় পড়ি এবং আমি মেজর মনোয়ার হোসেনকে কঠোরভাবে জানাই যে, যে কোন প্রকারে হোক আমাকে অন্তত আধ ঘণ্টার জন্য শহরে যেতে হবে। পরে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে শহরে যাবার অনুমতি দেন। অনুমতি পাওয়ার পর আমি সকাল দশটার সময় মেজর এম, এম, দৌল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারকে (জি-২ ইনটেলিজেন্স হেড কোয়ার্টার, ইস্টার্ন কমাণ্ড) সঙ্গে নিয়ে জীপে শহরে চলে যাই।
সেদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো কারফিউ ছিল না। আমরা যাবার পথেই দেখলাম অসংখ্য নারী শহর ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট এলাকা পার হবার পর আমরা স্বচক্ষে যা দেখলাম তা হলো?
ফার্মগেটের পরে আওলাদ হোসেন মার্কেটের সমস্ত কাঁচা ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট (কমপক্ষে ৬০/৭০ টি) জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ইস্কাটন রোডে আমার ভগ্নিপতি জনাব এস, আর, খান (সেকশন আফিসার, মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন)-বাসায় যাই। সেখানে তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঐ এলাকায় পাঞ্জাবীরা ২৫শে ও ২৬শে মার্চ রাস্তায় বাঙালী যাদেরকেই পেয়েছে তাদের সবাইকে জঘন্যভাবে হত্যা করে রাস্তার আশেপাশে মাটিতে চাপা দিয়েছে। ইস্কাটন রোড থেকে বের হয়ে যখন আমরা হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের কাছে পৌঁছলাম তখন ডানদিকে দি পিপল পত্রিকার অফিসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং অসংখ্য মৃত লাশ পড়ে রয়েছে এবং অনেক লাশ আগুনে জ্বলছো ঐ রাস্তা দিয়ে রাতে ট্যাংক চালানো হয়েছে। ট্যাংকের চেইন-এর ছক তখনো রাস্তায় ছিল।
সেখান থেকে আমরা হাতিরপুলে মেজর দৌল্লাহ সাহেবের বাসায় যাই। সেখানে মেজর দৌল্লাহ সাদেশের ছোট ভাই জনাব আসফউদ্দৌলাহ (বর্তমান জয়েণ্ট সেক্রেটারী, ওয়ার্কস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হল, যুগন্নাথ হল ও ঠাফ কোয়াটারে ঢুকে পাঞ্জাবীরা কিভাবে জঘন্যভাবে ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে তার বিবরণ দেন (২৫শে ও ২৬শে মার্চ জনাব আসফউদ্দৌলাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে তার শ্বশুর ভূগোল বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ নফিজ আহমদের বাসায় ছিলেন)। জনাব আসফাউদ্দৌলাহকেও পাঞ্জাবীরা হত্যা করার চেষ্টা করে কিন্তু ডঃ নফিস তাঁকে রক্ষা করেন। হাতিরপুল এলাকায়ও আমরা কিছু কিছু বাড়িঘর ভস্মীভূত দেখি এবং কয়েকটি লাশ রাস্তায় দেখতে পাই।
হাতিরপুল থেকে আমরা ধানমণ্ডি ১৪ নং সড়কে আমার মামা এডভোকেট জনাব আবু তাহের চৌধুরীর বাসায় যাই। মামার মুখে শুনতে পাই যে সেখানেও পাকিস্তানী বর্বর সেনাবহিনীর সৈন্যরা বহু লোককে গুলি করে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষণ করে, কতিপয় মেয়েকে গাড়ীতে তুলে ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে গেছে।
মামার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা নিউ মার্কেট হয়ে ইকবাল হলে রওনা হই। নিউ মার্কেটে বাজার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত অবস্থায় দেখি। আজিমপুর হয়ে যখন আমরা রেল ক্রসিং-এ পৌঁছি তখন সেখানে বেশ কিছু সংখ্যক লাশ দেখতে পাই। ইকবাল হলের গেটে ঢোকার পর মাঠের মধ্যে আমরা ১১ জনের মৃতদেহ একই লাইনে পড়ে রয়েছে দেখতে পাই। প্রত্যেকের চেহারাই ছাত্র বলে ধারণা হলো। হলের সমস্ত দরজা জানালার কাঁচ ভাঙ্গা অবস্থায় দেখি এবং দেয়ালে ট্যাংকের গোলা দাগ ও গর্ত দেখা যাচ্ছিল। হলের মধ্যে ঢুকে কয়েকটি কক্ষে তাজা লাশ পড়ে থাকতে দেখি।
এ সময় বহু লোক হলের ভেতর ঢুকে মৃত লাশগুলি দেখছিল। হল থেকে বের হবার সময় মাঠের মধ্যে কয়েকটি বিরাট গর্ত দেখতে পাই। জনসাধারণের মুখে শুনতে পাই যে, বহু ছাত্রকে হত্যা করে ঐ সমস্ত গর্তে কবর দেয়া হয়েছে। ইকবাল হল থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় এস এম হলের দেয়ালেও ট্যাংকের অনেক গোলার দাগ দেখতে পাই। এরপর আমরা জগন্নাথ হলের ভিতরে প্রবেশ করি। সেখানেও ইকবাল হলের মত একইভাবে মৃত লাশ ও গর্ত করা কবর দেখতে পাই। সেখানে কয়েকজন ছাত্র ও লোকের মুখে ডঃ জি সি দেবসহ শিক্ষক, ছাত্র ও রোকেয়া হলে নারী ধর্ষণের করুণ কাহিনী শুনতে পাই।
জগন্নাথ হল থেকে বের হয়ে রোকেয়া হলের পাশ দিয়ে রেসকোর্স অতিক্রম করার সময় রেসকোর্সের মাঝেখানে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় দেখি। হিন্দু মন্দিরে যে সমস্ত হিন্দু নরনারী ছিল তাদেরকে হত্যা করা হয় এবং তাদের কয়েকটি মৃতদেহ আমরা রাস্তা থেকেই দেখতে পাই।
রেসকোর্স থেকে হাইকোর্ট হয়ে গুলিস্তান এলাকায় যাই। গুলিস্তান থেকে নওয়াবপুর রোডে অনেক বাড়িঘরে আগুন জ্বলতে দেখি। আমরা গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) দিয়ে দৌল্লাহ সাহেবের এক ভাইয়ের বাসায় (উয়ারী) যাই। সেখানেও তার নিকট পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার ও গণহত্যার কাহিনী শুনি। সেখান থেকে ইত্তেফাক অফিসে আগুন জ্বলতে দেখি। তারপর আমরা পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসের সম্মুখে অফিসের সমস্ত কগজপত্র রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি এবং কিছু কিছু কাগজ বা অন্য কিছু পোড়া দেখতে পাই। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে মতিঝিল হয়ে আমরা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সম্মুখে যাই। তখন প্রায় বিকেল তিনটা বাজে। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার্স-এর মেজর এনামের মুখে আমরা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের যে বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারি তা হলোঃ
২৫শে মার্চ রাত বারোটার সময় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা পুরা যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের চতুর্দিক থেকে অতর্কিত হামলা করে এবং গুলি চালায়। পুলিশরাও বীরত্বের সাথে নিজেদের আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এভাবে সারা রাত উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালায়। এবং যুদ্ধে যখন পাক বাহিনী কোনক্রমেই পুলিশ দলের সঙ্গে জয়লাড করতে পারছিল না তখন ভোর চারটার সময় পাক হানাদার বাহিনী ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ চালায়। ট্যাংকের আক্রমণও বীর পুলিশ ভাইয়েরা প্রতিহত করে। ২৫শে মার্চ সারারাত ২৬শে মার্চ বিকাল ৪টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ ভাইয়েরা প্রচণ্ড যুদ্ধ করে।
বিকাল চারটার পর পুলিশ বাহিনীর গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে যায় এবং প্রায় সাতশ পুলিশ ভাই শহীদ হন। প্রায় সাড়ে তিনশ আত্মসমর্পণ করেন। বাকী সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যে সমস্ত পুলিশ ভাই শহীদ হন তাদের লাশ পাঞ্জাবীরা পুলিশ ক্যাম্পের মাঠে একটা বিরাট গর্ত করে কবর দেয়। মেজর এনামের মুখে বিস্তারিত খবর নিয়ে আমরা পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে যাই। সেখানে পাক হানাদার বাহিনী পিলখানার চতুর্দিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখায় আমরা কিছুই দেখতে পারিনি। সেখান থেকে আমরা বিকাল চারটার সময় ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে আসি।
ক্যাণ্টনমেণ্টে পৌঁছে আমি গোছল করি। বিকাল ৫টার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে, সেক্রেটারিয়েট অফিসের কয়েকজন পদস্থ কর্মচারী ৩টা বাসে পরিবারসহ ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে ময়মনসিংহ যাবার সময় (তাদের অধিকাংশই ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের অধিবাসী) পাঞ্জাবী ১৩এফ-এ রেজিমেণ্টে সৈন্যরা কুর্মিটোলা রেল স্টেশনের সম্মুখে যেখানে আর্মি ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল সেখানে উক্ত ৩টা বাস থামিয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত যুবতী মেয়েদেরকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখে এবং যুবক ও বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষদের মারধর করে তাদের বাস ছেড়ে দেয়। পরে যুবতী মেয়েদেরকে ক্যাণ্টমেণ্টে ১৯সিগনাল ব্যাটালিয়নে নিয়ে যায়। এবং পরস্পর শোনা যায় যে সেখানে মেয়েদেরকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করছিল। এ খবর পাবার পর আমি লেঃ কর্নেল তাজ মোহাম্মদকে জানাতে যাই। লেঃ কর্নেল তাজকে না পেয়ে লেঃ কর্নেল সিনওয়ারীর (জিএসও-১ ইনটেলিজেন্স, জেড কোয়র্টার, ইস্টার্ন কমাণ্ড) নিকট যাই। তাকে না পেয়ে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টার অফিসার মেসে যাই। সেখান থেকে টেলিফোনে মেজর হাজী মোঃ কেয়ানীকে (জি-২ ইনটেলিজেন্স ১৪ ডিভিশন) নারী ধর্ষণ ও অত্যাচারের কথা জানাই। আমার কথা শুনে মেজর হাজী কেয়ানী সাহেব অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তার করার কিছু নেই। কেননা ইতিপূর্বেও তিনি অনুরূপ কয়েকটি ঘটনার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, এ সমস্ত জঘন্য কার্যকলাপের জন্য কয়েকজন অফিসারই দায়ী। এবং বর্তমানে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যা তাঁর পক্ষে বা অন্য কোনো অফিসারের পক্ষেও আয়ত্তে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা কতিপয় অফিসারের দোষেই সৈন্যরা বেশী প্রশ্রয় পেয়েছে। তিনি আমার কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে আমার নিকট তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চান এবং আরও বলেন যে, আমি যেন লজ্জাজনক কথা বলে তাঁকে গুনাহগার না করি। মেজর হাজী মোঃ কেয়ানী সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা শেষ করে আমার মেসে ফেরার পথে শহীদ আনোয়ার বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এক ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডোর উপস্থিতিতে লেঃ জেঃ টিক্কা খানের ভাষণ শুনতে পাই। তখন বিকাল সাড়ে ছটা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম দুজন পাঞ্জাবীসহ জীপে আমার মেসে আসে। ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। তাকে নির্দেশ দিয়েছে সার্ভে অব পাকিস্তান-এ (বর্তমান সার্ভে অব বাংলাদেশ) গিয়ে চট্টগ্রামের মানচিত্র আনতে। আমি তাক চুপে চুপে বললাম আমার ইউনিটে যে সমস্ত বাঙালী রয়েছে তাদের সবাইকে পালিয়ে যেতে। এবং ফজলুল করিম আমাকে জানাল যে তার সাথে দুইজন পাঞ্জাবী রয়েছে কাজেই সে কি করে পালাবে! আমি তাকে মানচিত্র নিয়ে আসার পর সুযোগ মত দেখা করতে বললাম। ফজলুল করিম চলে যাবার পর আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে হঠাৎ এক ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডোর একত্রে উপস্থিত হওয়ার কারণ কি থাকতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারনা হলো যে, তাদেরকে হয়তো বা কোথাও পাঠানো হচ্ছে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর চট্টগ্রামের মানচিত্র সংগ্রহের কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে, চট্টগ্রামের যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা বোধহয় আমাদের বাঙ্গালীদের নিকট পরাজিত হয়েছে এবং সে জন্যই মানচিত্রের সাহায্যে রাতে প্যারাসুটে তাদেরকে চট্টগ্রাম পৌঁছাবে। ইতিপূর্বে সন্ধ্যা সাতটার সময় ক্যাপ্টেন এনামের কক্ষে রেডিওতে আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার) এর ভাষণ শুনতে পাই। বেতারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সমস্ত বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, বিমান বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও জনসাধারণকে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে চিরতরে এদেশ থেকে নির্মূল ও খতম করার আহ্বান জানান। এবং তিনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সিইনসি ঘোষণা করেন। এ খবর শোনার পর আমরা কয়েকজন অত্যন্ত আনন্দিত হই এবং অনেক মনোবল ফিরে পাই। আমরা বুঝতে পারলাম যে চট্টগ্রামে পাক বাহিনী পরাজিত হয়েছে এবং আমাদের পুরোপুরি দখলে রয়েছে। এর পর থেকে আমি কিভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব এবং কিভাবে ক্যাণ্টমেণ্ট থেকে বের হয়ে গিয়ে যুদ্ধ করব সে চিন্তাই করতে লাগলাম। রাত ৯টার সময় ক্যাপ্টেন এনামের মারফত একটি ভীতিজনক খবর শুনতে পাই। সেটা হচ্ছে: ৭ই ডিসেম্বর ’৭০ আমি এবং ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মুস্তাফিজ আমাদের মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের উপস্থিতিতে টেলিভিশনে দেশের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল দেখছিলাম। আওয়ামী লীগের পক্ষে সন্তোষজনক ফলাফলে পাঞ্জাবী অফিসাররা সকলেই কক্ষ থেকে কেটে পড়তে থাকে। ক্রমে ক্রমে সবাই কক্ষ ত্যাগ করলেও আমি এবং মুস্তাফিজ শুধু কক্ষে থাকি। রাত বারোটার সময় নায়েক পয়া খান (পাঠান) আমাদেরকে জানায় যে, মেস কমিটির সভাপতি মেজর রানার (পাঞ্জাবী) নির্দেশমত রাত বারোটার পর টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ করতে হবে। আমরা তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, সারা দেশের লোক টেলিভিশন দেখছে এমন কি প্রেসিডেণ্ট স্বয়ং টেলিভিশনে নির্বাচনের খবরা খবর নিচ্ছেন সেখানে আমরা রাত বারোটার পর খবর শুনলে তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। তাকে আরও বললাম যে, তার যদি কোনো অসুবিধা হয় তবে আমরা অন্য বেয়ারা রেখে তাকে তার কর্তব্যের অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে দেব। কিন্তু আমাদের কথায় কর্ণপাত না করে উক্ত নায়েক পয়া খান নিজেই টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পরক্ষণই লেফটেন্যাণ্ট মুস্তাফিজ টেলিভিশন অন করে। নায়েক পয়া খান দ্বিতীয়বার টেলিভিশন বন্ধ করলে লেফটেন্যাণ্ট মুস্তাফিজ পুনরায় অন করে। কিন্তু পয়া খান আমাদের তোয়াক্কা না করে তৃতীয়বারও টেলিভিশন বন্ধ করে। এবারেও মুস্তাফিজ টেলিভিশন অন করতে উদ্যত হলে পয়া খান মুস্তাফিজের হাত ধরে ফেলে। তখন আমি রাগান্বিত হয়ে পয়া খানের জামার কলার চেপে ধরে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দিলে সে দৌড়ে গিয়ে একটা ছোড়া নিয়ে এসে আমাদের গালাগালি করতে থাকে যে ‘শালা বাঙ্গাল লোককো খতম করেঙ্গে।’ এ সময় সেণ্ট্রি দৌড়ে এসে তাকে ধরে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন আমি আমার অফিসার কমাণ্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেনকে লিখিতভাবে এবং মেজর রানাকে মৌখিকভাবে জানাই। পরে ঘটনার তদন্ত চলে। লেঃ কঃ শরিফের সভাপতিত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বিস্তারিত বিবৃতিতে আমাকে এবং মুস্তাফিজকেই দোষী করা হয় এবং আমাদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা প্রাকাশ করে।
দ্বিতীয়ত, দেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আমাদেরকে হত্যা করার হুমকি দেখায়। মেজর রানা ক্যাপ্টেন এনামকে আরও বলেছিলেন যে, যেহেতু আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকে এমএনএ ও এমপিএ এবং অনেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থক সেহেতু আমি এবং মুস্তাফিজ দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থক সুতরাং আমাদের দুজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাত ৯টার সময় (২৭শে মার্চ ১৯৭১) ক্যাপ্টেন এনামের মুখে উপরোক্ত কথা শুনে আমি খুবই ঘাবড়ে যাই। কিছুক্ষণ পর আমি ক্যাণ্টমেণ্ট থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন এনামকেও আমার সঙ্গে পালানোর ইঙ্গিত দেই। কিন্তু সে নেতিবাচক জবাব দেয় এবং আমার কক্ষ থেকে তার নিজ কক্ষে চলে যায়। আমি চুপ করে মুস্তাফিজের কক্ষে গিয়ে তাকে আমার সঙ্গে পালানোর কথা বলি। সে পালানোর কোনো সিদ্ধান্ত রাতে নিতে পারলো না।
ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের কিছু কথা
সাক্ষাৎকারঃ এয়ার কমোডোর এম. কে, বাশার
২৫শে মার্চ বিকেল চারটার সময় বিশেষ বোয়িং তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তা প্রহরী নিয়ে বিমান বন্দরে অবতরণ করে। বিমান বাহিনীর দুইজন অফিসার (তন্মধ্যে একজন আমিও ছিলাম) এবং একজন টেকনিশিয়ানকে বোয়িংটির কাছে যেতে দেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনানিবাস থেকে টেলিফোনে নির্দেশ দেয়া হয় বোয়িং স্টার্ট করার জন্য। রাত আটটায় একটা প্রাইভেট গাড়ীতে করে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান (এ গাড়ির ড্রাইভার ছিল একজন কর্ণেল) ঢাকা সেনানিবাস থেকে সোজা বোয়িং-এ উঠে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমান চলে যায়। ঐ বিমানে প্রেসিডেণ্ট একা যান। প্রেসিডেণ্টের এভাবে চলে যাওয়াতে আমার ধারনা হল যে, হয়তো জেনারেল হামিদ খান ক্ষমতা দখল করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানকে বোয়িং-এ করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে জেনারেল হামিদ তখন ঢাকায় ছিলেন।
২৫শে মার্চ রাতে আমি বনানীতে আমার বাসায় ছিলাম। রাত বারটার পরে ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভোর রাত থেকে জনসাধারণ বনানীর ঐ পথ দিয়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে।
২৭শে মার্চ আমি অফিসে আসি। সেই সময়কার বেস কমাণ্ডার ছিলেন এয়ার কমোডোর জাফর মাসুদ, যিনি মিঠঠি মাসুদ হিসাবে বিমান বাহিনীতে পরিচিত ছিলেন। আমরা বাঙ্গালী অফিসাররা তাঁর সাথে দেখা করলাম এবং দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তাঁর সাথে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, নো ওয়ান উইল টাচ মাই মেন অর অফিসারস বিফোর দে কিল মি’। আমরা তাঁকে অনুরোধ করলাম তিনি যেন সবাইকে ডেকে সান্তনা দেন। এর মধ্যে ২৯শে মার্চ সেনাবাহিনী বিমান বাহিনীর কাছে বিমান সাহায্য চেয়ে পাঠায়। তিনি সে সাহায্য দিতে অস্বীকার করেন।
৩০শে মার্চ তিনি বেসের সাবাইকে ডেকে ভাষণ দেন। তিনি বললেন, “তোমরা সবাই জান যে সেনাবাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আমি বিমান সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছি। কিন্তু আমি কতদিন এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারব বলতে পারছি না। সমস্ত বাঙ্গালী পাইলটকে এসব মিশনে যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি এবং যে সমস্ত বাঙ্গালী টেকনিশিয়ানরা এ সমস্ত বিমানে কাজ করতে চায় না তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে যেতে পারে।”
এপ্রিল মাসের ৩/৪ তারিখে প্রথম বিমান হামলা চালানো হয় পাবনার আশেপাশে। এয়ার কমোডোরের নির্দেশ ছিল যদি কোথাও লোক জমায়েত দেখা যায় প্রথমে যেন ওয়ার্নিং শট করা হয় যাতে করে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অপরদিকে সেনাবাহিনীর নির্দেশ ছিল ম্যাসাকার করার জন্য। এ জন্য এয়ার কমোডোর জাফর মাসুদকে বদলি করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এর মধ্যে সমস্ত বঙ্গালী অফিসারকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়। আমরা ছুটি নিলাম। আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। জিয়াউর রহমানের ভাষণ আমরা শুনেছিলাম। লোকমুখে শুনলাম যে, ময়মনসিংহ এলাকায় প্রতিরোধ চলছে। তখন ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মির্জাকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। সেও ঠিকমত কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি তবে একটা থমথমে পরিবেশ সে লক্ষ্য করেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট কাদেরকে আগরতলাতে পাঠানো হয়। সে ভারতে গিয়েছিল এবং খালেদ মোশারফের বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিল। যখন সে ফিরে কুমিল্লা আসে তখন পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১২ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করলাম। নরসিংদী হয়ে লঞ্চে রওনা হলাম। লঞ্চ থেকে আমরা দেখলাম যে পাকবাহিনী একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সাথে আমাদের দেখা হয়। সে তার গ্রামের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের আরও কিছু কথা
সাক্ষাতকারঃ আবদুল করিম খন্দকার
ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ বাংলাদেশ ফোর্সেস
(জুন ৭১- ডিসেম্বর ৭১)
২৩শে মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ঢাকাতে এক আন্তঃসার্ভিসেস কুচকাওয়াজের আয়োজন করার কথা হয়েছিল। আমাকে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর ঐ প্যারেডের প্যারেড কমাণ্ডার-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাকজমকের সঙ্গে এই প্যারেড অনুষ্ঠানের কথা ছিল। ফেব্রুয়ারী মাসের ২৬ তারিখে হঠাৎ খবর পেলাম যে প্যারেড বাতিল করা হয়েছে। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। আমি আর্মি ডিভ হেডকোয়াটারে এসে কর্ণেল গীলের সাথে দেখা করলাম। সেখানে আরও কয়েকজন উচ্চ পদস্ত অফিসার ছিলেন, সবাইকে কেমন যেন এক অস্বস্তিকর আবস্থায় দেখলাম।
২৮শে ফেব্রুয়ারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটা বোয়িং ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরন করে। সেটাতে বেসামরিক পোশাকে সেনাবাহিনীর লোকজন ছিল।
১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে প্রত্যেক দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন আসতে থাকে এবং প্রত্যহ এর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
ঢাকা বিমান বন্দরে যেদিন থেকে বাঙ্গালী কর্মচারীরা কাজে যোগ দিতে বিরত থাকে সেদিন থেকে পাক সেনাবাহিনী বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রন নিজেদের কাছে রাখে এবং বিমানবন্দরে পজিশন নিয়ে থাকে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা শুনে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা এক উদ্বেগজনক অবস্থায় ছিল-তিনি কি বলবেন, কি করবেন। মিটিংয়ের পরে কোন গণ্ডগোল সৃষ্টি না হওয়ায় তারা একটু আশ্বস্ত হয়। সেদিন সমস্ত সেনাবহিনীর লোকজনকে জরুরী অবস্থা মোকবেলার জন্য সজাগ বা সতর্ক রাখা হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবার পর তারা তাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে লাগলো এবং বিমানবন্দর ও সেনানিবাসের চারদিকে এনট্রেন্সড পজিশন নিতে শুরু করে। এবং বাঙ্গালী ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস সৃষ্টি হতে শুরু হলো।
বিমান বাহিনীতেও শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কমাণ্ডোদের আনা হচ্ছিল। এয়ারফিল্ডের বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্গালীদের সরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা হয়।
২৮শে মার্চ আমি এমওডিসি কমাণ্ডারকে ডেকে যদি পারে ছুটি নিয়ে এবং অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যেতে বললাম। বেশ কয়েকজন এমওডিসি অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
২৮/২৯শে মার্চে বিমান বাহিনীর স্যাবর জেটগুলোতে রকেট লাগানো শুরু হয়- কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং যে সমস্ত জায়গায় প্রতিরোধ চলছে ঐ সমস্ত এলাকায় বোমা বর্ষণ করার জন্য। রকেট গান ফিট করার কাজে সে সময় বাঙ্গালীরা ছিল। কিন্তু ঐ দিন ঐ কাজে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা হয়। ২৯/৩০শে মার্চ বিমান বাহিনীর চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে বোমা বর্ষণের জন্য যায়। সেখান থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
২৫শে মার্চের ক্র্যাক ডাউন- এর পর আমি নিজেকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্য বলে মেনে নিতে পারছিলাম না।
আমি ২৯শে মার্চ ছুটির জন্য দরখাস্ত করলাম। দুই সপ্তাহের ছুটি দেয়া হয়েছিল। আমি ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মারগুবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং ৩রা এপ্রিল স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যোগাযোগ ব্যাবস্থার দরুন যেতে পারিনি।
১২ই মে তারিখে আমি, উইং কমাণ্ডার বাশার, ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট রেজা (অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইং অফিসার -বদরুল আলম আগরতলাতে পৌঁছি।
ঢাকার পিলখানার কথা
সাক্ষাৎকারঃ মেজর দেলোয়ার হোসেন
১৯-১১-৭৩
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ২২ বেলুচকে পিলখানাতে আনা হয়েছিল। তাদেরকে এখানে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছিল। এবং পিলখানার ইপিআর-এর সাথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ইণ্টারনাল সিকিউরিটি ডিউটি করার জন্য ভার দেয়া হয়েছিল। ওরা ওখানে আসাতে ইপিআরদের মাঝে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত হয়। ওদের এখানে আসাতে আমরা বুঝতে পারলাম যে হয়তো কিছু একটা ঘটতে পারে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাথেও আমার এব্যাপারে কথাবার্তা হয়েছিল।
২৫শে মার্চ বেলা একটার সময় মেজর জামিল (পশ্চিম পাকিস্তানী), জেনারেল স্টাফ অফিসার, হেড কোয়ার্টার ইপিআর আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠান। তিন ঘণ্টা পর্যন্ত আমি তাঁর অফিসে বসে অফিশিয়াল কথাবার্তা বলেছি। তারপর তিনি আমাকে বললেন যে, তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রহরী এসে আমাকে নিয়ে যায়।
রাত আনুমানিক বারোটার দিকে চারিদিকে থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। আমি অনুমান করেছি যে, ২২ বেলুচ বাঙ্গালী ইপিআরদের উপর আক্রমণ করেছে। আমাকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেদিকেও গুলি এসে পড়ছিল। রাত তিন-চারটার দিকে গোলাগুলি একটু কমে যায়। আমাদের যে সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তারা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম তারা অনেককে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। ২৬শে মার্চ ঠুসঠাস গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।
২৭শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আরেফ (পাঞ্জাবী), যে এই হেডকোয়ার্টারে কাজ করতো, আমাকে এসে বলল, “ইউ আর এ গাদ্দার, ইউর আংকেল ক্যাপ্টেন রফিক ইজ অলসো এ গাদ্দার। উই আর গোইং টু শট ইউ আউট বোথ।”
১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে এখানে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু কোন নির্যাতন চালানো হয়নি। পরে আমাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ রাতে বহু বাঙ্গালী ইপিআরকে হত্যা করা হয়। বন্দী অবস্থাতে অনেককে হত্যা করা হয়।
মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পিলখানার বাঙ্গালী ইপিআররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল প্যারেড গ্রাউণ্ডের মাঝখানে দণ্ডায়মান বটবৃক্ষের শীর্ষে। বাংলাদেশের সেনানিবাস সমূহের মধ্যে প্রথম জাতীয় পতাকা এখানে উত্তোলন করা হয়েছিল। ল্যান্স নায়েক বাশার এ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। পিলখানায় অবস্থিত প্রায় ২৫০০ বাঙ্গালী সৈন্যের ৬ শতাধিক রাতের অন্ধকারে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাকি সবাই বন্দী হয়। আর তাদের পাঠানো হয় নৃশংস অত্যাচার ও হত্যার বধ্যভূমি মোহাম্মদপুর বন্দী শিবিরে। পরবর্তী কালে জিসিও/এস সি ও এবং সুশিক্ষিত প্রায় ৭ শতাধিক বাঙ্গালী সৈনিককে হত্যা করা হয়েছিল বুলেট বেয়নেটের নির্মম আঘাতে। ঐ রাতে যারা পালাতে পেরেছিল তাদের অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। তারা প্রতি এলাকায় অমিতবিক্রমে পর্যুদস্ত করেছিল পাকিস্তানীদের প্রত্যক্ষ সম্মুখ যুদ্ধে।
বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বাহিনীর ১০০০-এর মত মুল্যবান জীবন স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিল। অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিন যাপন করছেন।
পিলখানার আরও কথা
সাক্ষাতকারঃ মোঃ আশরাফ আলী সরদার
১২-৪-১৯৭৪
২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল। ঐ দিন আমরা প্রস্তুত ছিলাম কোন একটা নির্দেশ পাবার অপেক্ষায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোন নির্দেশ পাইনি। তারপর ২৪শে মার্চ আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পিলখানার প্যারেড গ্রাউণ্ডের বটবৃক্ষের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এবং সে পতাকার উর্দুতে লেখা ছিল, “পশ্চিমারা আবি বাংলা ছোড়কে ভাগ যাও, নেহি ত এধারই তোম লোগ কো কবর বানায়েগা।”
পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ পতাকা দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং ঐ পতাকা নামিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। এই পতাকা উত্তোলনের সংবাদ সিগনাল-এর বেতার মারফত সমস্ত সেক্টর, উইং এবং চৌকিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং তারাও বিকেলে খবর দিল যে তারাও পতাকা উত্তোলন করেছে। যশোর থেকে বেতারে খবর আসল যে সেখানকার বাঙ্গালী ইপিআররা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সামরিক সালাম (গার্ড অব অনার) দিয়ে পতাকা উত্তোলন করেছে।
২৪শে মার্চ রাতে পিলখানায় অবস্থিত সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে নিরস্ত্র করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদেরকে বলে যে, শেখ সাহেবের ৭ই মার্চের ঘোষিত চার দফা ইয়হিয়া খান মেনেছে এবং শিগগিরই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। দেশে এখন শান্তি বিরাজ করছে। সুতরাং সবাই অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রাম করুন।
২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপরোক্ত ভূয়া আশ্বাসে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু যখন শুনতে পারলাম যে নরঘাতক ইয়াহিয়া তার দলবল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করেছে তখন আমি নায়েক সুবেদার শহীদ শমসুল হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি সেদিন কোয়ার্টার গার্ড ডিউটি অফিসার ছিলেন। তিনি আমাকে বাইরে গিয়ে সংবাদ নিতে নির্দেশ দিলেন। তখন রাত প্রায় আটটা। আমি সরাসরি ইকবাল হলে যাই। কিন্তু সেখানে কোনো ছাত্রনেতাকে পেলাম না। আমি সেখান থেকে সুবেদার শহীদ জহীরউদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে যাই। তাঁকে সমস্ত বিষয় অবগত করাই। তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করে নায়েক নূর হোসেনের সঙ্গে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা হন। তিনি আমাকে কি করতে হবে না হবে পরে জানাবেন বলে বললেন। আমি এবং হাবিলদার শহীদ বেলায়েত হোসেন রাত এগারোটা পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষায় সিগনাল ওয়র্কশপে বসে থাকি। আমরা দুজন আমাদের সিগনাল-এর লোকজনকে কিছু একটা খবর আসবে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। এবং ১৫ শাখার জনৈক সিপাহীকে এ সংবাদ পৌঁছে দেই। এছাড়া আমরা উভয়ে আমাদের অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত এনসিও শহীদ নায়েক হাসেমকে জিজ্ঞাসা করি যে, অস্ত্রাগারের কোনো ডুবলিকেট চাবি তৈরি হয়েছে কিনা যা আগে আপনাকে বলা হয়েছিল। তিনি বললেন যে, তার কাছে ডুপলিকেট চাবি আছে। এই সংবাদ আমরা শহীদ নায়েক সুবেদার শামসুল হক সাহেবকে কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে জানাই। তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে কোন রকম হামলা হলে প্রত্যেকে অনতিবিলম্বে অস্ত্রাগারে চলে আসবে। এখানে আমি উপস্থিত থাকব, তোমরা লাইনে গিয়ে বিশ্রাম নাও এবং দুজন প্রহরী নিয়োগ কর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সে সুযোগ আসেনি।
২৫শে মার্চ দিনগত রাত ১টা পাঁচ মিনিটে প্রথম গুলির আওয়াজ হয়। আমরা প্রত্যেকেই সামরিক পোশাকে ব্যারাকে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমাদের গ্রহরী আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে পশ্চিমারা আমাদেরকে আক্রমণ করেছে। তখন আমরা সবাই পূর্ব নির্দেশ মতো অস্ত্রাগারে যাবার জন্য বের হয়ে পড়ি। কিন্তু দেখতে পেলাম গুলির আগেই তারা সমস্ত পিলখানাকে অস্ত্রাগারসহ দখলে নিয়ে নিয়েছে। আমরা যখন বাইরে আসলাম তখন চারিদিক থেকে এলএমজি/ এসএমজি ব্রাশ ফায়ার আমাদের উপর আসতে থাকে। তখন আমরা অনন্যোপায় হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি। অল্প সংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকি সবাই বন্দী হয়ে যায়। রাত ৪টার সময় আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করায়।
৩ নং গেটে কর্তব্যরত কয়েকজন বাঙ্গালী ইপিআর পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। একজন লেফটেন্যাণ্ট সহ ৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানী বেলুচ রেজিমেণ্টের লোক নিহত হয়। এই খণ্ড যুদ্ধে বাঙ্গালীদের সঙ্গে কর্তব্যরত একজন পাঞ্জাবী ইপিআর মোহাম্মদ খানকেও হত্যা করা হয়। এই খণ্ড যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল গার্ড কমাণ্ডার নায়েক জহিরুল হক। সে তার সহকর্মীদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঢাকায় অবস্থিত সিগনাল- এর প্রধান বেতার কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেয়া হয় যে, উইং কমাণ্ডার লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল আবদুর রহমান আওয়ান আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে সমস্ত বেতার যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য। আমাদের কর্তব্যরত অপারেটররা সংকেতের সাহায্যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বাইরে কর্তব্যরত সেক্টর/উইং/বিওপি পর্যন্ত সমস্ত ইপিআরকে জানিয়ে দেন। ২৬ শে মার্চ সকাল দশটা পর্যন্ত আমাদের এইচ-এফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেট) চালু থাকে যার মাধ্যমে ২৬শে মার্চের ঘটনা নায়েক শহীদ বাশার বাইরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার শেষ সংবাদে চট্টগ্রামকে বলেছিলেন যে, আমাদের সবাই বন্দী হয়ে গেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর আমিও বন্দী হয়ে যাব এবং আর নির্দেশ দেবার সময় পাবনা। তোমরা সমস্ত পশ্চিমাদের খতম কর। চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার বাহার উক্ত সংবাদ সীমান্তের চৌকি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং আমাদের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সে বলেছে যে, আমি ঢাকা থেকে বলছি। সম্পূর্ণ ঢাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে এসেছে এবং ইপিআর- এর ডাইরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নেসার আহমদ বন্দী হয়েছেন। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়। এবং সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের বন্দী করে আমাকে রিপোর্ট দাও।
প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী
সাক্ষাৎকারঃ মোঃ আসমত আলী আকন্দ[২]
এস, আই অব পুলিশ, রমনা থানা, ঢাকা
১০-১-৭৪
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি রাজারবাগ রিজার্ভ অফিসে কাজ করছিলাম। আমাদের রিজার্ভ অফিসের বাইরে সহস্র বিক্ষুব্ধ জনতা বড় বড় গাছ ও ইট পাটকেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলো। সন্ধ্যার সময় এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিস আক্রমণ করবে। এ সংবাদ শোনার পর আমি রাত সাড়ে ন’টার সময় তেজগাঁও থানায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ঢাকা সেনানিবাসে পাক হানাদারদের মনোভাব কি তা জানাবার জন্য টেলিফোনে অনুরোধ করি। তিনিও পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ রিজার্ভ অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবানার কথা শুনেছেন বলে জানান। এরপর আমি তেজগাঁও আবার টেলিফোন করে জানতে পারি যে তখন পাক হানাদারদের প্রায় ৮০/৯০টি সশস্ত্র ট্রাক ও জীপ তাদের থানার রাস্তা ধরে রাজধানীতে প্রবেশ করতে তারা দেখেছেন। রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের ওপর পাক হানাদারদের এমন উলঙ্গ হামলার সংবাদ শুনে আমাদের আরআই একেবারে হতবাক হয়ে যান। এরপর আমরা পুলিশ রিজার্ভের অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজন মতো অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার জন্য রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের চারিদিকে পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত পরিবেশ একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলি। আমরা বাইরে অনেক দূর থেকে পাক হানাদারদের বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের শব্দ শুনছিলাম। আমরা শুধু পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করছিলাম। অয়ারলেস ও টেলিফোনের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সারা শহর অন্ধকার, নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ। আনুমানিক মধ্যরাতে পাক হানাদাররা প্রথম রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হাসপাতালের গেট (দক্ষিন দিক) থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। আমরা তার পাল্টা জবাব দেই। এবং পাক পশুদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ওরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ভারী অস্ত্র, শেল, কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমাদের ওপর সাংঘাতিকভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ হতে থাকে। আমরা প্রথমে আত্মসমর্পণ করিনি এবং আত্মসমর্পণ করার মতো কোনো দুর্বলতাও আমরা দেখাইনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের উদাত্ত আহ্বান অনুযায়ী আমরা আমাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তা দিয়ে সমস্ত পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। এবং এভাবে আমাদের সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে করতে আমরা জীবনদান করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তখন পাক পশুদের মোকাবেলা করছিলাম। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ওরা গভীর রাতে রিজার্ভ অফিসের উত্তর দিকে টিনশেড ব্যারাকে লাইট বোম ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল আমাদের এমন কতিপয় বীর সিপাহী নিদারুন ভাবে দগ্ধীভূত হয়ে শহীদ হন। অনেকে সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়ে সেখানেই মৃতবৎ পড়ে থাকেন। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে এবং সমস্ত ব্যারাক পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আমরা উপায়ান্তর না দেখে ছাদের উপর গিয়ে অত্মরক্ষা করতে থাকি। এবং পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি। আমরা ব্যারাকের চারিদিকে লেলিহান আগুনের শিখায় কিছুমাত্র দমে যাইনি। আর আমাদের মনোবল কোনো সময়ই দুর্বল হয়ে পড়েনি। ওদিকে কামান, শেল আর ট্যাংকের গর্জন ও বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ চলছিল। কামান ও শেলের প্রচণ্ড আঘাতে আমাদের কয়েকটি পাকা ব্যারাকের প্রাচীরঘেরা মটর ওয়ার্কশপ মাটিতে ধসে পড়ে। ফলে আমাদের বীর সিপাহীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ সুবিধামত স্থান গ্রহণ করে চারদিকে জ্বলন্ত আগুন, অবিরাম শেলিং ও কামানের গর্জনের মধ্যে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিল পাক পশুদের। আমাদের অনেক বীর সিপাহীকে প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হতে আমি দেখেছি স্বচক্ষে। এমনি ভাবে পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে করতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। ভোর হয়ে যায় এবং বেলা উঠে যায়। এরপর আমাদের গুলি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় দেখে আমরা আর কোন উপায়ান্তর পাই না। ইতিমধ্যে পাক হানাদারদের হাজারো হুমকির মুখেও আমাদের মনোবল এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েনি। তারা ব্যারাকে ঢুকে আমাদেরকে বন্দী করে এবং ছাদের উপর থেকে আমাদেরকে নিচে নামিয়ে এনে বুটের লাথি এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে সজোরে এলোপাতারি আঘাত করতে শুরু করে। আকস্মকৎ এক হানাদার পাক পশু হাতের বন্দুক দ্বারা আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলে আমার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে এবং তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তিন ঘণ্টা পড় আমি জ্ঞান ফিরে পাই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমআই, এএসআই, হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক, সিপাহীসহ আমরা প্রায় দেড়শত বীর যোদ্ধা পাক হানাদারদের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। ২৯শে মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব ই,এ, চৌধুরী রাজারবাগে আমাদের পুলিশ লাইনে আসেন এবং পাক হানাদারদের মেজরের সাথে কথোপকথনের পর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়- “আব তুমলোগ চালা যাও, আয়েন্দা কাল ভোর ছয় বাজে মিল ব্যারাকমে তোমলোগ রিপোর্ট করেগা, আওর উহাই তোমলোগ রাহেগা ইদার হামলোগকা জোয়ান রাহেগা।”
সাক্ষাৎকারঃ আঃ গণি তালুকদার[৩]
অফিস সহকারী (পুলিশ), রমনা থানা, ঢাকা (সদর)
৯-১-৭৪
সিপাহী আবদুল খালেক, মোজাম্মেল হক, মুখলেসুর রহমান, মির্জা মহিউদ্দীন এবং আরও অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীসহ আমরা ২৫শে মার্চ রাত দশটার সময় খাওয়া দাওয়া করে ১৪ নং ব্যারাকে বসেছিলাম। রাত পৌনে এগারোটার সময় ঢাকা পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার থেকে টেলিফোনে পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ ও ইপিআর হেড কোয়ার্টার আক্রমণের সংবাদ পাই। টেলিফোনে ইপিআর হেড কোয়ার্টার থেকে আমাদেরকে সশস্ত্রভাবে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী থাকতে বলা হয়। আমরা আমাদের ১৪নং ব্যারাকে মোট পঞ্চাশজন সিপাহী এএসআই, হাবিলদার ও সাধারণ সিপাহী উপস্থিত ছিলাম। এ সংবাদ দ্রুত রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের আরআই ও এসপি হেডকোয়ার্টারকে জানানো হয়। এ সংবাদ পেয়ে রিজার্ভ পুলিশের সকল অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই ডিউটিতে এসে সকল সিপাহী, সুবেদার, এএসআই, এসআই, হাবিলদার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী করেন এবং প্রত্যেককে ডিউটিতে মোতায়েন করেন। তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সুপার মিঃ শাহজাহান ও আরআই মিঃ মফিজউদ্দিন আমাদের এই সশস্ত্র প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দান করেন।
পুলিশ সুপার ও আরআই উভয়েই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দান করে নিজ নিজ দায়িত্বে চলে যান। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। আমরা সকল সিপাহী, হাবিলদার, সুবেদার, এএসআই, এসআই সবাই সশস্ত্রভাবে পজিশন নিয়ে হানাদার পাক বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকি। এসময় অয়ারলেস এবং টেলিফোন সব কিছু অচল করে দেয়া হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাইরে সহস্র ছাত্র-জনতা বড় বড় গাছ, লইটপোস্ট, ইট- পাটকেল ফেলে ব্যারিকেড তৈরী করে। রাজারবাগে প্রবেশ করার পথে পথে বহু প্রশস্ত ড্রেন কাটা হয় হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য। এভাবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ তৈরী করার মধ্য দিয়ে সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। পাক হানাদাররা রাত সাড়ে এগারটার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চারিদিক থেকে লাইট বোম মারতে মারতে অগ্রসর হয়। এর মধ্যে চলছিল বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ, কামান ও ট্যাংকের গর্জন। পাক হানাদারদের হামলার সাথে সাথে আমরা সবাই আমাদের সামান্য রাইফেল বন্দুক নিয়ে ওদের হামালার প্রাণপণ জবাব দিতে থাকি। ওরা আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখে এরপর যুগপৎ কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমরা টিকতে না পেরে ক্রমে পিছু হটতে থাকি। আমাদের আধিকাংশ বীর যোদ্ধা লড়তে লড়তে শহীদ হন। অনেকে দারুণভাবে আহত হয়ে মৃতবৎ সেখানেই পড়ে থাকেন। আর অনেকে আহত দেহ নিয়ে প্রাণরক্ষা করতে সমর্থ হন। পাক হানাদার পশুরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল ব্যারাকে লাইট বোমা ও প্রেট্রোল দ্বারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বহু আহত যোদ্ধা ঐ সকল ব্যারাকে আটকা পড়ে জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। আনুমানিক রাত তিনটার সময় অবিরাম গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে আমি আমার অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাই।
সাক্ষৎকারঃ শরীফ খান মোহাম্মদ আলী[৪]
আর্মড সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ
বিআরপি, রাজশাহী
৩-২৭৪
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সকাল থেকে আমাদের পুলিশ লাইনে নীরব, নিস্তব্ধ ও থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। স্পেশাল আর্ম ফোর্স-এ আমার লাইনে রাত আটটার বাইরের কর্তব্যরত সিপাহী বাদে আমি নাম ডাকার সময় মাত্র ত্রিশজন বাঙ্গালী সিপাহীকে উপস্থিত পেয়েছি। আমি কোন অবাঙ্গালী সিপাহীকেই লাইনে উপস্থিত পাইনি। ওরা সন্ধ্যার পরপরই আমার লাইন থেকে ডিউটি ত্যাগ করে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল তার কোনো হদিস পাইনি। নাম ডাকার সময় বিপুলসংখ্যক সিপাহীর এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ইতিহাসে আর ঘটেনি। ঢাকা জেলা রিজার্ভ লাইনের এ অবস্থা ছাড়া কেন্দ্রীয় লাইন থেকেও সেদিন সকল অবাঙ্গালী সিপাহী তাদের পদস্থ অফিসারদের নির্দেশ ও মর্যাদা একেবারে উলঙ্গভাবে, পুলিশের ইতিহাসে এই প্রথম, অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে সম্মিলিতভাবে একযোগে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। অবাঙ্গালী সিপাহীদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার পর আমরা আসন্ন বিপদের কথা বুঝতে পারি এবং আমার অধীন বাঙ্গালী সিপাহীদের হাতে অস্ত্র দিয়ে পুলিশ লাইনের সকল প্রবেশপথে তাদেরকে কড়া প্রহরায় নিযুক্ত করি। পুলিশ লাইনের চারটি প্রবেশপথে চারজন হবিলদারের সাথে ছয়জন করে সশস্ত্র সিপাহী মোতায়েন রাখি। আমি খুব চিন্তাযুক্তভাবে পুলিশ লাইনে টহলরত ছিলাম। আমি এক সময় দোতলা থেকে অস্ত্রাগারের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিলাম। এমন সময় অস্ত্রাগারের ভিতরের টেলিফোনটি বেজে উঠলে আমার কর্তব্যরত নায়েক চীৎকার করে আমাকে টেলিফোন ধরতে বলে। আমি দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরলাম। অস্ত্রাগারের সেই টেলিফোনে এর ভীতসন্ত্রস্ত কাঁদো কাঁদো কম্পিত কণ্ঠ চাপাচাপা অস্ফুট কণ্ঠে বলছিল “মিলিটারী হেডকোয়ার্টারে বহু সশস্ত্র আর্মি ট্রাক লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা এক্ষুনি রাজধানী আক্রমণ করতে যাচ্ছে”। সেই ভীত কণ্ঠ আরো বলছিলো- “ওদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ই-পি-আর হেডকোয়ার্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল।” এ কথা বলেই সেই কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেলো। “কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন”? আমি চীৎকার করে এসব প্রশ্ন করার সাথে সাথে টেলিফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সিপাহীরা টেলিফোনের এ মারাত্মক সংবাদ লাইনের সর্বত্র চীৎকার করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। এ সংবাদে সকল সিপাহী অস্ত্রাগারের দিকে ছুটে এসে টেলিফোনের সংবাদ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। এ সময় আমি লাইনে বসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের তৎকালীন আর-আই মিঃ মফিজউদ্দীনের সাথে তার বাসায় টেলিফোনে যোগাযোগ করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে বাঙ্গালী কণ্ঠ ভেসে আসা পাক সেনাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে সদম্ভে ধেয়ে আসার সংবাদ বিস্তারিত জানালে তিনি তৎকালীন পুলিশ সুপার ই, এ, চৌধুরী সাহেবকে সব কিছু জানাচ্ছেন বলে টেলিফোন ছেড়ে দেন। এদিকে আমার সিপাহীরা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারশত বাঙ্গালী সিপাহী বলছিলো “অস্ত্র দাও, অস্ত্র দাও। আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দাও, আমরা ওদের প্রতিরোধ করবো, প্রতিহত করবো।” শেষ পর্যন্ত অস্ত্রাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাবিলদার সহকর্মীরা বুকফাটা চীৎকারে রাজারবাগ কাঁপিয়ে তুলে বলছিলো “আমাদের হাতে অস্ত্র দাও, আমরা লড়বো, লড়তে লড়তে মরবো, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করবো ঐ বেঈমানদের বিরুদ্ধে কিন্তু পিছু হটবো না, হটবো না।” এরপর আমি রিজার্ভ ইন্সপেক্টর সাহেবের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে আমাদের ফোর্সের সুবেদার আবুল কাসেমকে এ সংবাদ জানালে তিনি লাইনে ছুটে আসেন। এর পরপরই আমাদের আর-আই সাহেব পুলিশ সুপার ই.এ চৌধুরীর সাথে আলাপ আলোচনা করে লাইনে এসে বলেন, “তোমরা ওদের রুখতে পারবে না কোন প্রকারেই, দেখ আমাদের নীরব থাকাই ভালো-।” কিন্তু তখন নীরব থেকে প্রাণ বাঁচাবার কোনো উপায় ছিল না। পুলিশ লাইনের সকল বাঙ্গালী সিপাহীই তখন অস্ত্র নিয়ে ওদেরকে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। সিপাহীরা বলছিলো, “আর-আই সাহেব আপনি অস্ত্রাগার খুলে দিন, আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিন, আমরা ওদের প্রতিরোধ করবো।” এরপর আর-আই সাহেব অস্ত্রাগারের চাবি দিয়ে দিলে বাঙ্গালী সিপাহীরা সবাই পাগলের মতো অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে যার যার প্রয়োজন মতো রাইফেল ও গুলি হাতে তুলে নেয়। এ সময় চারিদিক থেকে হাজারো জনতা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করে আমাদের অস্ত্রাগার থেকে বিনা বাধায় অস্ত্র নিয়ে যায়। এসময় আমাদের অফিসাররা বাইরে কর্তব্যরত ছিলেন। এ সময় সুবেদার ফোর্স আবুল কাসেম, আর ও হাফিজুর রহমান, সার্জেণ্ট মুর্তজা হোসেন, সুবেদার আবুল হাসেম, নায়েক মোহাম্মদ আলী (ফুটবল খেলোয়াড়) সবাই সশস্ত্রভাবে আমাদের সিপাহীদের সাথে মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরী ছিলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত সিপাহী লাইনের চারিদিকে মাটিতে শুয়ে, ছাদের উপর বসে থেকে, দাঁড়িয়ে থেকে, গাছের আড়ালে থেকে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষায় ছিলো। সেদিন হাবিলদার তাজু আহমেদ, হাবিলদার আবুল হোসেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড় নায়েক মোহাম্মদ আলী, হাবিলদার আতাউর রহমান, সিপাহী মোহাম্মদ আলী, আরও কতিপয় হাবিলদার, নায়েক ও সিপাহী এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ ফোর্সের সুবেদার খলিলুর রহমান মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে সবার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ লাইনের সবাইকে এ প্রতিরোধে বীরের মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওদের সকলকে সালাম।
আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে পজিশন নিচ্ছিলাম ওদের প্রতিরোধ করার জন্য। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো। টেলিফোনে এক ভীতসন্ত্রস্ত কম্পিত বাঙ্গালী সিপাহী কণ্ঠ বলছিলো, “ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট ফাঁড়ি থেকে বলছি একশত সশস্ত্র পাক আর্মির ট্রাক সেনানিবাস ছেড়ে সদর্পে রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে-”। এরপরই আরেক বাঙ্গালী পুলিশের কণ্ঠ টেলিফোন থেকে ভেসে আসলো, সেই মার্জিত কণ্ঠ বলছিলো, “তেজগাঁ থানার সামনে দিয়ে সশস্ত্র আর্মি ট্রাক রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে।” এরপর আমাদের ওয়ারলেসে এক পুলিশ কণ্ঠ বলে উঠলো, “ময়মনসিংহ রোড থেকে টহলরত অফিসার বলছি, পাক আর্মির বহু ট্রাক রমনা রেসকোর্স মাঠে এসে জড়ো হয়েছে।” কিছুক্ষণ পরই দেখলাম পাক পশুর একটি দল হাতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান নিয়ে সশস্ত্রভাবে চোরের মতো টিপে টিপে পা ফেলে আমাদের পুলিশের লাইনের উত্তর দিকের ব্যারাকের রাস্তা ধরে কিছুদুর এসেই আমাদের ব্যারাকের দিকে গুলি বর্ষণ করে। সাথে আমাদের রাইফেল গর্জে ওঠে। ওদের গুলিবর্ষণের জবাব দেই আমরা সম্মিলিতভাবে। পাক পশুদের প্রথম অগ্রগামী দলের কিছু সেনা মারা যায়। রাস্তায় ওদের লাশগুলো পড়ে থাকে। অবশিষ্ট পাক পশু বিপদ বুঝতে পেরে সেই অন্ধকারে আবার চোরের মতো পিছু হটে যায়। এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষিণ- পূর্ব কোনে হাসপাতালের দিক থেকে অবিরাম শেলিং করতে থাকে পাক পশুরা। এরপর তারা উন্মত্তের মতো শেলিং করতে থাকে আমাদের পুলিশ লাইনের বিল্ডিং-এর উপর, উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে। এভাবে তারা অবিরাম শেলিং করতে করতে পুলিশ লাইনের পূর্ব দিক থেকে ঢুকে পড়ে আমাদের এলাকার অভ্যন্তরে। আমাদের রাইফেলধারী বাঙ্গালী পুলিশ প্রহরী তখন প্রাণপণ প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল পাক পশুদের অবিরাম শেলিং- এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমাদের বহু সিপাহী পুলিশ লাইনের পূর্ব দিকে ওদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হন। অবশিষ্ট সিপাহীরা রাইফেল নিয়ে পিছু হটে আমাদের ব্যারাকের বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায় পজিশন নিয়ে ওদের প্রতিরোধ করতে থাকে। আমাদের সিপাহীদের প্রতিরোধ ও দৃঢ় মনোবলের সম্মুখে ওরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের পুলিশ লাইনের পূর্ব দিকের ব্যারাকে লাইট- বোম বৃষ্টির মত বর্ষণ করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করছিল। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের ব্যারাকের চারিদিকে আগুন ধরে যায়, অস্ত্রাগারের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যায়। দোতলার দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে আস্তে আস্তে। ওরা আমাদের আওতার বাইরে থেকে শেলিং করছিল, আর লাইট- বোম মারছিল আমাদের পুলিশ লাইনের একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে ওরা তখনও সাহস পায়নি। রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় ওরা মরিয়া হয়ে আমাদের ব্যারাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। অবিরাম শেলিং হচ্ছিল, আগুনের ভয়ংকর ফুলকি নিয়ে লাইট- বোমগুলি একের পর এক পড়ছিল আমাদের দিকে। চারিদিকে আমরা ট্যাংক ও কামানের কান ফাটা ভীষণ গর্জন শুনছিলাম। পাক পশুরা এভাবে অজস্র শেলিং ও কামানের গোলাবর্ষণ করতে করতে আমাদের আওতার ভিতর এসে গেলে আমাদের সিপাহীদের রাইফেলগুলো আবার গর্জে ওঠে। পশুদের কতিপয় আমাদের বীর নায়েক বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়ারের নেতৃত্বে, আমাদের সিপাহী কায়েস, সাত্তার, হাফিজ, নায়েক আঃ সুবহানের রাইফেলের গুলিতে মাটিতে পড়ে যায়। আর অবশিষ্ট পশুর দল পিছু হটে যায়। আমাদের বীর সিপাহীরা অবিরাম প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল, প্রাণপণে ব্যারাকের সেই জ্বলন্ত আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বীর সিপাহীরা বীরবিক্রমে প্রতিহত করছিল। উন্মুক্ত সেনাদের অগ্রগতিকে রুখে দিচ্ছিল নির্ভিক ভাবে। আগুন ক্রমে ক্রমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর দিকের ব্যারাকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় সেই ধেয়ে আসা ভস্মের মধ্যে আমাদের কতিপয় বীর সিপাহী প্রতিরোধ সৃষ্টি করার সময় অকস্মাৎ আটকা পড়ে নিদারুন ভাবে শহীদ হন। আর অবশিষ্ট সিপাহী আগুন ও শেলিং- এর মুখে আস্তে আস্তে পিছু হটতে হটতে আমাদের প্রধান বিল্ডিং-এর দিকে আসতে থাকে- আমাদের বীর সিপাহীরা তখনও প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল বীর বিক্রমে। মাইক্রোফোনে ওদের উন্মাত্ত গর্জন শুনছিলাম, “তোমলোগ সারেণ্ডার করো, হাতিয়ার দে দাও, নাই তো খাতাম কার দিওঙ্গা, তামা হো যায়েগা।”
আমাদের বীর সিপাহীরা ওদের মিথ্যা ভাঁওতায় কান না দিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিলো ওদের। কিন্তু আমাদের বীর সিপাহীরা ও আমাদের সকলের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের অস্ত্রাগারেও তখন প্রবেশ করার কোন উপায় ছিলো না। সেখানে ওরা গোলাবর্ষণ করছিলো উন্মত্তভাবে। আমি উপায়ান্তর না দেখে পিছু হটতে হটতে পুলিশ লাইনের দক্ষিন দিকে অবস্থিত ঘোড়ার আস্তাবলের পিছনের রাস্তা দিয়ে আমিনবাগের মধ্যে দিয়ে চলে এসে প্রাণ বাচাই। এরপর আমি গ্রামের দিকে গিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে ঝঁপিয়ে পড়ি।
ঢাকার মিরপুরে প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ মোহম্মদ আঃ সোবহান[৫]
ইন্সপেক্টর অব রিজার্ভ পুলিশ
বি-আর-পি, রাজশাহী
২৯-১-৭৪
আমার ওয়ারলেস সেটটি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রাজারবাগ অয়ারলেস কণ্ট্রোল রুম থেকে আর এক বাঙ্গালী পুলিশের কণ্ঠ ঘোষণা করলো, “অল অফিসার্স অফ এণ্ড অ্যাবভ র্যাংক অফ ইন্সপেক্টরস উইল প্রোসিড টু দেয়ার কোয়ার্টার্স।” হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের পশ্চিমের গেটে প্রহরারত বাঙ্গালী পুলিশের ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠ আমার অয়ারলেস সেটে বেজে ওঠার পর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কণ্ট্রোল রুমের অয়ারলেস থেকে সতর্কবাণী পাওয়ার পর আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে পরেছিলাম। এরপর বিএসপি, ইন্সপেক্টর সহ সকল পদস্থ বাঙ্গালী পুলিশ অফিসার যারা মিরপুর ও অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন সেকশন ও সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন, অয়ারলেস মারফৎ রাজারবাগ কণ্ট্রোল রুম থেকে উপরোক্ত নির্দেশ পাওয়ার পর সবাই হেড কোয়ার্টারে চলে গেলে আমি আমার এক প্লাটুন (৩৭জন পুলিশ) নিয়ে মিরপুর থানায় গিয়ে উঠি। সেখানে আমি মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে কর্তব্যরত সকল ফোর্সকেই জমায়েত দেখতে পাই। সারা মিরপুরে এ সময় থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। হঠাৎ পুলিশ (কমিশনার বিল্ডিং) কণ্ট্রোল রুম থেকে আবার অয়ারলেস সেটে বাঙ্গালী পুলিশের কম্পিত কণ্ঠ বেজে উঠলো। সেই কণ্ঠ বলেছিলো- “পাক আর্মি ভারি কামান, ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে আমাদের কণ্ট্রোল রুম ঘেরাও করে ফেলেছে। ওরা গোলাবর্ষণ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে আমাদিগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য- ওরা ভীষণভাবে ধেয়ে আসছে- তোমরা যে যেখানে থাক এগিয়ে এসো, আমাদের রক্ষা করো, বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও।” সেই কণ্ঠ বলে যাচ্ছিল-“রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকপশুদের হামলা হয়েছে, সেখানেই গোলাগুলি চলছে, আমাদের বীর পুলিশরা লড়ছে, সেখানকার অয়ারলেস বেইচ থেকে আমরা কোন শব্দ পাচ্ছি না, সব নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।” পরক্ষণেই আমরা ঢাকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে বৃষ্টির মতো লাইট-বোম উড়ছে। কামান, ট্যাঙ্ক আর গোলাবর্ষণের ভীষণ গর্জন শুনছিলাম, অসংখ্য মানুষের বুকফাটা অসহায় কান্নার রোল ভেসে আসছিলো। অস্থির অধীর ছাত্র জনতা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই অসংখ্য কামান, ট্যাংক ও গোলাবর্ষণের আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে দেখলাম আগুন আর আগুন, জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে, রাজধানী ঢাকা জ্বলছে। চোখ ফিরিয়ে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও ভীষণ গুলি আরম্ভ হয়ে গেছে, বাড়ি ঘর জ্বলছে। সেই ভয়াল ও ভয়ংকর গোলাবর্ষণও আগুনের লেলিহান শিখা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো, আমাদের ফোর্স সবই মিরপুর থানায় জমায়েত হয়েছিল। অর্ধেকের হাতে ছিল লাঠি আর অর্ধেকের হাতে ছিল সাধারণ রাইফেল আর বিশ রাউণ্ড গুলি। মিরপুর থানায় এভাবে বসে থাকলে সব এক সাথে ওদের ঘেরাওর মধ্যে পড়ে কুকুর-বিড়ালের মতো মরতে হবে ভেবে আমরা আমাদের ফোর্সকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পজিশন নিতে বলি আর আমার সিপাহীদের যাদের হাতে শুধু লাঠি ছিল তাদের চলে যেতে বলি আত্মরক্ষার জন্য। আমি আমার ফোর্স নিয়ে মিরপুর ইটখোলার ভিতরে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পালাই-নাই। কারণ পালাবার ইচ্ছা আমাদের ছিল না। আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলাম। সামান্য রাইফেল নিয়েই আমরা পশুদের প্রতিরোধ করবো। প্রতিহত করবো, লড়বো কিন্তু পিছু হটবো না। সারারাত আমি আমার সশস্ত্র ফোর্স নিয়ে সেই ইটখোলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে বসেছিলাম। আর ঢাকার আকাশে দেখছিলাম আগুনের লেলিহান শিখা, সকল নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সহিত পাক পশুদের কামান ও ট্যাংক যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা। রাত তিনটার সময় আমরা দেখছিলাম আমাদের চোখের সম্মুখে চারটি সশস্ত্র পাক সেনাদের ট্রাক চলে গেল। ট্রাকের পিছনে পিছনে যাচ্ছিল কামান বসানো ‘ডজ’। মিরপুর ইপিআর বাহিনীর সাথে আমরা পাক আর্মিদের এক ঘণ্টা তুমুল সংঘর্ষ দেখলাম। কামান ও ট্যাংকের কানফাটা গর্জনে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম পাক আর্মি সেই সশস্ত্র ট্রাকগুলো নিয়ে ফিরছে তার পিছনে আরও তিনটি ট্রাক আসছিল। ঐ অতিরিক্ত ট্রাকে ছিল সংঘর্ষে পর্যুদস্ত বাঙ্গালী ইপিআর বন্দীরা। আমাদের সম্মুখ দিয়েই পাক পশুদের সশস্ত্র ট্রাকগুলি ইপিআর বন্দীদের নিয়ে সদর্পে এগোচ্ছিল। আমি আমার সিপাহীদের ওদের ওপর গুলি বর্ষণ করতে নিষেধ করেছিলাম। ওদের গাড়ীগুলো এগোচ্ছিল-সবাই চলে গেল। পিছনে দুটি গাড়ী থাকতেই আমার এক সিপাহী হঠাৎ ওদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতেই ওরা সবাই ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে কুকুরের মতো। ভীষণ ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়ে যায় আমার সিপাহীদের উপর। আমাদের উপর পড়ছিল অসংখ্য গ্রেনেড, আরোও পড়েছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মতো অসংখ্য গুলি। আমরা আমাদের সামান্য রাইফেল নিয়েই পশুদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আমরা গুলিবর্ষণ করতে করতে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকি-আমাদের হাতে সামান্য রাইফেল থাকলেও ওরা রাতের কালো অন্ধকারে সেই ভারী কামান, ট্যাংক বহর ও অসংখ্য মেশিনগান, গ্রেনেড ও সশস্ত্র সৈন্য নিয়েও আমাদের সামনে সদম্ভে এগিয়ে আসতে সাহস পায় নাই। আমাদের দুর্জয় মানসিক শক্তির সামনে ওরা প্রথমত আসতে সাহস পায় নাই। সামান্য রাইফেল দিয়েই ওদেরকে প্রায় এক ঘণ্টা প্রতিরোধের পর আমি আমার ফোর্স নিয়ে পিছু হটছিলাম। আমার ফোর্স সব পিছনে চলে গিয়েছিলো। আমি আমার দুর্জয় সিপাহী নিয়ে একাই ওদের বিরুদ্ধে ফাইট দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ওরা নীরব-ওদের নীরবতা দেখে আমি ওদের ঘেরাওয়ের মাঝে পড়ে যাওয়ার ভয়ে পিছু হটে চলে আসি। পিছনে এসে দেখলাম এক প্রাসাদের ছাদের উপর এক বিদেশী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার গেটের সামনে যাওয়ার সাথে সাথে সেই বিদেশী ভদ্রলোক এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিল্ডিংয়ের পিছনে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু সে জায়গা নিরাপদ মনে না করায় আমরা সেই ভদ্রলোকের পরামর্শ অনুযায়ী তার বিল্ডিংয়ের পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার এক সিপাহীর কথামত আমরা সবাই নিকটবর্তী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মান্নান সাহেবের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট যত্ন করেন। আমরা তার বাড়িতে চা-নাস্তা খেয়ে তার ছাদের উপর গিয়ে দেখলাম পাক আর্মিরা ইটখোলার ভিতর ঢুকে আমাদিগকে সার্চ করছে, তখন ভোর হয়ে গিয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার তার বাসা থেকেই ধেয়ে আসতে থাকা পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে ফাইট দিতে বলেন কিন্তু আমার সিপাহীদের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং আমরা রাতের ফাইটে সাংঘাতিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় কল্যাণপুরের বাঙ্গালী এলাকায় চলে গিয়ে পুলিশের পোশাক ফেলে দিয়ে কলোনীর বাঙ্গালী ভাইদের দেওয়া ছেঁড়া লুঙ্গি গেঞ্জি পরে কল্যাণপুর কলোনীর ছাত্র-জনতার সাথে মিশে গিয়ে সেখানকার বাঙ্গালী জনতাকে সর্বতোভাবে সাহস দিতে থাকি। সকাল তখন দশটা বেজে গিয়েছিল। আমি আমার হাতে রাখা অচল অয়ারলেস সেটটা মেরামত করে সচল করে দিয়ে ঢাকার সব পুলিশ সেক্টর ডেড দেখলাম। মিরপুর থানার সহিত লাইন দিলাম, সেখান থেকে এক বাঙ্গালী কণ্ঠ ভেসে আসছিল- জোর করে স্বাভাবিক করা সেই কণ্ঠ বলছিলো, “মিরপুর থানা,” পরক্ষণেই এক অবাঙ্গালী পাকসেনা অয়ারলেস সেটে বলে ওঠে-কোন শালা কাহা তোম বোলতা হায়।” আমি বেশ বুঝতে পারি অয়ারলেসে বাঙ্গালী কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে পাক সেনাদের প্রভুত্ব বহাল রয়েছে। আমি এরপর আমার অয়ারলেস সেটটি অচল করে কল্যাণপুর কলোনীর এক বাঙ্গালীর বাসায় রেখে পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। মসজিদে জনতার ব্যাকুল চাহনী কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। নামাজ শেষে বের হয়ে এসে পাশের এক ছোট ঘরে বসে আছি এমন সময় দেখলাম অসংখ্য দাঙ্গাবাজ বিহারী লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, পিছনে পাকসেনাদের গাড়ী। বিহারীরা সেখানে এসেই বাঙ্গালী কলোনীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লুটপাট শুরু করে দিল। ইতিমধ্যে পাক সেনাদের গাড়ী দুটো বিহারীদের বাঙ্গালী কলোনীতে লুণ্ঠনে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আমরা বিহারীদের তাণ্ডবলীলা আর সইতে পারলাম না- আমি আমার সিপাহীদের পজিশন নিয়ে বিহারীদের উপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলে দুজন বিহারী গুলি খেয়ে পড়ে যায় আর সব বিহারী দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার মত কল্যাণপুর বাঙ্গালী কলোনী বেঁচে যায় বিহারী লুণ্ঠন থেকে। আমাদের গুলিবর্ষণে বাঙ্গালী কলোনীতে আসন্ন পাক ও বিহারীদের হামলা ও লুণ্ঠনের আশংকায় সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মতো পালাতে থাকে চারিদিকে। এরপর আমি মিরপুরের রাস্তার সামনে নদী পার হয়ে গ্রামের দীর্ঘ রাস্তা ধরে আমাদের সিপাহীদের নিয়ে অজানার পথে অদৃশ্য হয়ে যাই।
ঢাকা শহরে সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ (অবঃ) আনোয়ার হোসেন
অসহযোগ আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গলে ছিলাম।
২৫শে মার্চের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। আমার বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে কথা বললে তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেন। তারপর আমরা ১৬জন যুবক আলাপ-আলোচনা করে ২৭শে মার্চ সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাই। তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরীর কাছে এসে দেখি মুক্তিবাহিনী গঠন হয়েছে। সেখানে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সবাই ছিল। আমি দলের নেতৃত্ব হাতে নেই। আমরা ৩৫০ জনের উপরে ছিলাম। তেজগাঁ রেল লাইনের অপরদিকে ডিফেন্স নিয়ে ২৯শে মার্চ পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই। ১২৬ জন পাক সেনা হতাহত, ৩টি গাড়ী ধ্বংস এবং অনেক আহত হয়। বহু অস্ত্রও আমরা উদ্ধার করি। অস্ত্র দ্বারা আমরা পুনর্গঠিত ও নববলে বলীয়ান হই। ৩০শে মার্চ ঢাকার মহাখালীতে আমরা ১০জন রেকি করতে বের হই। আগে থেকে আমরা বুঝতে পারিনি যে পাকসেনারা এ্যামবুশ করে আছে। আমরা এ্যামবুশে পড়ে যাই। শামসুল আলম নামক একজন ইপিআর ওখানে শহীদ হন। বাকী নয়জন কোন রকমে বেঁচে আসি। সময় ছিল রাত সাড়ে দশটা। ৩১শে মার্চ সেকেণ্ড ক্যাপিটালে আসাদ গেটের নিকটে হাসপাতালের কাছে পাক সেনাদের অবস্থান ছিল। আমরা রাত ৩টায় আক্রমণ চালাই। এতে ৫জন পাক সেনা খতম হয়। আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ভোর পাঁচটায় পাকসেনারা ব্যাপক সেনা ও অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। ওদের সামনে টিকতে না পেরে পালাবার চেষ্টা করি। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বেশ কিছু শহীদ হন। আমিসহ সাতজন পাক সেনাদের হতে ধরা পড়ি। তারিখ ছিল ১লা এপ্রিল।
বংশাল ফাঁড়ির প্রতিরোধ[৬]
১৯৭১সালের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ংকরী রাত্রি, যার কথা বাংলাদেশের মানুষেরা কোনো দিনই ভুলতে পারবে না। ওরা ঢাকা শহরকে রক্তবন্যায় ভাসিয়ে দেবার জন্য অতর্কিতে নেমে এলো। ওরা জানতো, এদেশে ওদের পক্ষে কেউ নেই। সরকারী কর্মচারী থেকে রাস্তার পুলিশ পর্যন্ত, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে শহরের মেহনতী মানুষ আর গ্রামের কৃষক পর্যন্ত জনসাধারণের সমস্ত স্তর থেকে ওরা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই পশ্চিমী শাসক চক্রের জঙ্গী বাহিনী কোন রকম বাছ-বিচার না করে সর্বগ্রাসী আক্রমণ নিয়ে নেমে এসেছিল।
রাত বারোটার পর ঘড়ি দেখে কাঁটায় কাঁটায় একই সঙ্গে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, লালবাগ, পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে, পুলিশ ব্যারাকে এমনকি থানায় থানায় ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে আক্রমণ করে বসলো। সবাই জানে, একমাত্র বাজারবাগ পুলিশ লাইন ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে তারা কোনো প্রতিরোধ পায়নি, যেখানে গেছে সেখানেই অবাধে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এর ছোট্ট একটা ব্যতিক্রমও আছে। এই খবরটা কিন্তু খুব কম লোকই জানে।
নবাবপুর থেকে বংশালের রাস্তায় ঢুকলে বাঁয়ে নিশাত সিনেমা হল, ডাইনে দৈনিক সংবাদ অফিস, সেখান থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে বাংশাল ফাঁড়ি। কিছুসংখ্যক সৈন্য মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে এই ফাঁড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা নিশ্চিন্ত মনে রাত্রির নিঃশব্দতার বুকে আর্মি বুটের খট খট শব্দ হেনে ফাঁড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছিল। এখানে কারু কাছ থেকে যে প্রতিরোধ আসতে পারে এমন কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল, অবাধে ও স্বচ্ছন্দে তাদের হত্যালীলা চালিয়ে যাবে, একটা প্রাণীকেও রেহাই দেবে না। কিন্তু ফাঁড়িটার কাছে যেতেই এক পশলা বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি তাদের অভ্যর্থনা জানাল। ওরা ভীষণ চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। এটা কি একটা বিশ্বাস করবার মতো কথা। এক সামান্য ফাঁড়ির জনকয়েক পুলিশ, তাদের এত বড় সাহস হবে! কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, ওদের মধ্যে কয়েকজন সেই গুলিতে আহত হয়েছে। এরপর ফাঁড়ির ভেতর থেকে পরপর কয়েকবার রাইফেলের শব্দ শোনা গেল।
এবার দু’পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বংশালের পথে একটিও জনপ্রাণী নেই। ঘরে ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ। কারো কোন সাড়া-শব্দ নেই, শুধু ঘন ঘন মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দে বংশালের পথ আর দুই ধারের বাড়িগুলি থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। সৈন্যরা বেশ একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো।
ফাঁড়ির ভেতরে কে কোথায় আছে, কারা কি করছে- কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না। অপর পক্ষে অন্ধকার ফাঁড়িটার মধ্যে উপযুক্ত জায়গায় পজিশন নিয়ে প্রতিরোধকারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। রাস্তার আলোয় সৈন্যদের তারা ভালো করেই দেখতে পাচ্ছিল। ফলে এইবার ওরা বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারলো না, তখনকার মতো সেখান থেকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।
ফাঁড়ির মধ্যে প্রতিরোধকারীরা উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। আক্রমণকারীদের মধ্যে জনকয়েক সম্ভবত হতাহত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যদের তাদের কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি।
ফাঁড়ির পুলিশরা এভাবে একদল সশস্ত্র সৈন্যকে হটিয়ে দেবে, এটা সত্য সত্যই অভাবনীয়। আরও আশ্চর্যের কথা, তারা ফাঁড়ির মধ্যে থেকে মেশিনগান চালিয়েছিল। থানা বা ফাঁড়ির পুলিশদের হাতে কখনো মেশিনগান দেওয়া হয় না। একমাত্র বন্দুক ও রাইফেল তাদের সম্বল। এই সংকট মুহূর্তে এই মেশিনগান কেমন করে তাদের হাতে এলো?
বংশাল মহল্লার লোকের মুখে এর উত্তরটা আমি পেয়েছি। এটা শুধু ফাঁড়ির পুলিশদের কাজ নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই মহল্লারই সুপরিচিত নাদির গুণ্ডা তার কয়েকটি সাগরেদ। যোগ দিয়েছিল বললে কথাটা সঠিকভাবে বলা হবে না। কার্যত এই নাদিরের নেতৃত্বেই নাকি এই প্রতিরোধকে সংঘটিত করে সৈন্যদের হটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে ফাঁড়ির পুলিশেরা এ কাজ হাত দিতে সাহস করত না। আর মেশিনগানে? শুধু বংশাল মহল্লা নয়, পাশাপাশি মহল্লার অনেকেই এ কথা শুনেছিল যে সারা শহরের মধ্যে একটিমাত্র লোক আছে যার হাতে একটি মেশিনগান আছে। সেই লোকটি হচ্ছে নাদির গুণ্ডা নামে পরিচিত নাদির মিঞা। কি করে সে এই মেশিনগান সংগ্রহ করেছিল, একমাত্র সে-ই জানে।
প্রাক-স্বাধীনতার যুগে বিখ্যাত উর্দু লেখক কিষণচন্দর ‘তিন গুণ্ডা’ নামে এক অপূর্ব কাহিনী লিখেছিলেন। কাহিনীর সেই তথাকথিত গুণ্ডারা স্বাধীনতা আন্দোলন উপলক্ষে গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু সত্য সত্যই এরা কেউ গুণ্ডা ছিল না। সরকারী প্রচারণায় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই শহীদদের গুণ্ডা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
নাদির গুণ্ডার ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। সত্য সত্যই সে গুণ্ডামি করত। যেই পরিবেশে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই পরিবেশই তাকে এই পথে টেনে আনে। বয়স আর কত? ত্রিশের কোঠার নিচেই ছিল। এই বয়সেই সে গুণ্ডা নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। তবু সাধারণ গুণ্ডাদের চেয়ে সে স্বতন্ত্র ছিল। তার পরিচিত যারা, এর কথাটা তাদের জানা ছিল যে, অনেকে বিপদে-আপদে নাদির গুণ্ডার কাছ থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে।
এই সংসারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা বিশ্বাস করা কঠিন অথচ সত্য। নাদির গুণ্ডার জীবনে এমনি এক ঘটনা ঘটল। স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে লোকটা কেমন করে যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। আর সব কথা যেন ভুলে গেল সে। কেমন করে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের হাত থেকে মুক্ত করা যাবে- এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান, জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে বিভিন্ন মহল্লায় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত।
একটা বিষয়ে সে নিঃসন্দেহে ছিল যে, সত্য সত্যই ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে এই মেশিনগান আর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর এই নাদির গুণ্ডার প্রভাবে একই পথের পথিক আরও কয়েকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল।
পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকা নাদিরের মনকে বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি। ওদের সেই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা তাকে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত করে তুলেছিল। সারা শহরে হতাশা আর আতঙ্কের আবহাওয়া। তার মধ্যে দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সে প্রতিরোধের কৌশল ও সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তার এই সাহস আর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মহল্লার লোকেরা তাকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল।
তারা বলাবলি করত, এই শহরে নাদিরের মতো আরও গোটা কয়েক মানুষ যদি থাকত, তবে আমরা ওদের নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারতাম। নাদিরের নামটা মিলিটারি গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছতে দেরি হয়নি। তারা তন্নতন্ন করে তার সন্ধান করে ফিরছিল।
পঁচিশে মার্চের পর থেকেই লুণ্ঠনরত সৈন্যের দল ঘরবাড়ি-দোকানপাট ভেঙ্গেচুরে ইচ্ছামতো লুঠপাট করে চলেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শহরের গোটা কয়েক রেশনের দোকান লুট হয়ে গেল। শহরের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠল। এভাবে রেশনের দোকান যদি লুট হয়ে যায়, তবে খাবে কি তারা? শেষকালে কি না খেয়েই মরতে হবে? ভয়ে দিশেহারা মানুষ কি করবে পথ খুঁজে পায় না।
রেশন দোকানের মালিকেরা ভয়ে দোকান খুলতে চায় না। এই দুর্দিনে সর্বসাধারণের অবস্থা চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠল নাদির। কিছু একটা করতেই হয়। ঐ শয়তানেরা এসে রেশনের চাল লুট করে নিয়ে যাবে আর তারা অসহায়ের মতো হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে, এ কিছুতেই চলবে না। কিন্তু কি করতে পারে সে?
একদিন মহল্লার লোকেরা অবাক হয়ে দেখল নাদির আর তার দলবল তাদের রেশনের দোকান ভেঙ্গে বস্তা বস্তা চাল বের করে নিয়ে যাচ্ছে। শেষকালে নাদিরের এই কাজ! তারা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই তাদের আসল ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না। নাদির তাদের মুখের দিকে চেয়েই এই দুঃসাহসের কাজে হাত দিয়েছে। নাদির আর তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সেই চাল মহল্লার ঘরে ঘরে ভাগ করে দিল। পাড়ার লোকে তখনকার মত কিছুটা চাল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাতের কাজটা সেরে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল নাদির। তার মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। খবরটা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলিটারির জীপ তার সন্ধান নিয়ে ফিরছে।
এরপর দুঃসাহসী নাদির আর বেশীদিন কাজ করার সুযোগ পায়নি। এপ্রিলের মধ্যভাগে গ্যাদা নামে এক কুখ্যাত গুল্ডা তাকে মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দিল। গ্যাদা ইতিমধ্যেই মিলিটারীর দালালি করে আরো কয়েকজনকে ধরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া নাদিরের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। একবার নাদিরের গুলিতে জখম হয়ে তাকে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। তখন রাত অনেক হয়েছে। নাদির একটি জীপে করে আসছিল। আর্মানিটোলা ময়দানের কাছে এসে তার জীপটা একটা বাড়ির পাশে দাঁড়াল। ওরা আগে থেকেই তৈরী হয়ে ছিল। একটা সঙ্কেত পেয়ে মিলিটারীর লোকের বিদ্যুতগতিতে এসে তার জীপটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর তারা তাকে ধরে নিয়ে তাদের আস্তানায় চলে গেল। নাদির সেই যে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসবে না কোনদিন।
নরসিংদীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ[৭]
এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ।
ভারতীয় বেতার মারফৎ একটি সংবাদ প্রচারিত হলো- ঢাকা শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে কোন এক জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছে। খবরটা চাঞ্চল্যকর, বিশেষ করে ঢাকা জেলার লোকদের কাছে। দিনের পর দিন বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা জেলায় তাদের প্রতিরোধের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য ২৫শে মার্চ তারিখে সামরিক হামলার প্রথম রাত্রিতে রাজারবাগের পুলিশ ভাইয়েরা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এই কাহিনী অবিস্মরণীয়। তার দুই দিন বাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের সংগ্রামী ভাইয়েরা শুধুমাত্র গোটা কয়েক রাইফেলের উপর নির্ভর করে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত সৈন্যদলকে দুই দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিল শহরে ঢুকতে দেয়নি। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিক গ্রহণ করেছিল তারা সবাই তরুণ ও কিশোর; অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে একেবারেই কাঁচা। আমাদের এই সংগ্রামী ভাইদের জন্য ঢাকা জেলার মানুষ সঙ্গতভাবে গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু তারপর?
তারপর থেকে সারা ঢাকা জেলায় মুক্তিসংগ্রামীদের কোন সাড়া শব্দ নেই। ঢাকা জেলার মানুষ দুঃখ করে বলে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাই শুধু পেছনে পড়ে আছি।
কুড়ি কিলোমিটার দূরের সেই জায়গাটা কোথায় তাই নিয়ে বিতর্ক ও বাদানুবাদ চলে। দূরত্ব সম্পর্কে অনেকের সঠিক ধারণা নেই। কেউ বলে সাভার,
কেউ বলে নরসিংদী, আবার কেউ বলে জয়দেবপুর। আবার এমন লোকও আছে যারা এই ভারতীয় প্রচারণাকে একদম গাঁজাখোরি বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একে সত্যি বলে বিশ্বস করে। শুধু যে বিশ্বাস করে তাই নয়, নিজেদের কল্পনার সাহায্যে তাদের আরো দ্বিগুণ করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। ইতিপূর্বে নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী বোমারু বিমান বোমা ফেলেছে। এটা ভারতীয় বেতারের প্রচার নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা বোমাবিধ্বস্ত নরসিংদীর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে এসেছে।
বাইরের লোকে এটুকুই শুধু জানল, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় যুদ্ধ বেধেছিল এবং যুদ্ধের ফলাফল কি সেই সম্পর্কে কারো মনে কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাছাড়া নিত্যনতুন এমন সব চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে যে শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দুরের সেই সংঘর্ষ সম্পর্কে কে আর মাথা ঘামায়।
যারা বাইরের লোক তাদের কাছে ঘটনাটা ছোট হতে পারে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ঘটনাটা দারুণ উত্তেজনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। আমার এক বন্ধু তার নিজস্ব কাজে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেইজন্যই এই উল্লেযোগ্য ঘটনাটা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে পারছি। আজ সারা বাংলাদেশ জুড়ে এই ধরনের যে সমস্ত ঘটে চলেছে, তার কতটুকু খবরই বা আমরা রাখি।
পাকিস্তানের বোমারু বিমান ৪ঠা এপ্রিল ও ৫ই এপ্রিল পরপর দুই দিন নরসিংদীর উপর বোমা ফেলেছিল। তারপর দিন সাতেক কেটে গেল, ইতিমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য বা মুক্তিবাহিনী কেউ নরসিংদীতে প্রবেশ করেনি। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল পাকিস্তানী সৈন্যরা নরসিংদী দখল করবার জন্য ছুটে আসছে। গুজব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের দেখে এসেছে।
তাঁতের কাপড়ের হাট হিসেবে বিখ্যাত বাবুরহাট থেকে জিনারদী পর্যন্ত একটি রাস্তা চলে এসেছে। মাইল সাতেকের পথ, জিনারদী থেকে নরসিংদী তিন মাইল। সৈন্যরা এই পথ ধরে এগিয়ে আসছিল। তাদের দলে কয়েকশ’ সৈন্য। সৈন্যবাহিনীর ট্রাকগুলি একের পর এক মিছিল করে আসছিল। তাদের সঙ্গে মর্টার, রকেট, মেশিনগান- কোন কিছুরই আভাব নেই। মুক্তিবাহিনীর ‘দুষ্কৃতকারী’ লোকগুলিকে তারা নিঃশেষে খতম করবে, চূর্ণ করে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।
বাবুরহাট থেকে জিনারদী, মাঝখানে পাঁচদোনা গ্রাম। এই পাঁচদোনা গ্রামের কাছে সংঘর্ষটা ঘটেছিল, সেইদিন ১৩ই এপ্রিল। প্রথমে গোটা পাঁচেক সৈন্যবাহী ট্রাক। এই ট্রাকের কনভয় থেকে সৈন্যরা কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে। পথ জনশূন্য। তবে মাঝে মাঝে দুটি-একটি অতি সাহসী কৌতূহলী লোক ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। সৈন্যরা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছিল। হঠাৎ এক সময় শান্ত পল্লী- প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে গুডুম গুড়ুম পরপর তিনবার কামানের গর্জন শোনা গেল। অতি পরিচিত মর্টারের আওয়াজ। শুধু আওয়াজই নয়, একটা গোলার টুকরো ছিটকে এসে একটা ট্রাকের উপর পড়ল। ট্রাকের উপর সৈন্যদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এমন অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রান্ত হতে হবে এটা ওরা ভাবতে পারেনি। ওরা কি তার শত্রুপক্ষের কব্জির মধ্যে এসে পড়েছে? এই অচেনা-অজানা নির্বান্ধব দেশে তারা কি করে আত্মরক্ষা করবে? প্রতিপক্ষ সহজ নয়, ওরা মর্টার নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। ওদের সঙ্গে কত লোক আছে কে বলবে? এরা সংখ্যায় বড় কম হবে না তা না হলে এরা এভাবে আক্রমণ করতে সাহস করত না। যারা আক্রমণ করছে, তারা ঝোপঝাড়ের আড়ালে এমন সুকৌশলে অত্মগোপন করে আছে যে, রাস্তা থেকে তাদের কোন মতেই দেখা যায় না। ট্রাক নিয়ে সেই দিকে এগোবার উপায় নেই, যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু সেটা কোনমতেই নিরাপদ নয়। ওদের সঙ্গে শুধু মর্টার নয়, মেশিনগানও আছে। একপশলা বৃষ্টির মত কয়েক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি ট্রাকের উপর এসে পড়েছে। প্রথম পর্যায়েই সৈন্যদের কয়েকজন মারাত্মকভাবে জখম হয়ে পড়েছে। সৈন্যরা আর দেরী না করে আনুমানের উপর নির্ভর করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে লাগল। তাদের মেশিনগানও অবিরাম কাজ করে চলেছে।
এইভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের গোলাগুলির বর্ষণ চলল, একে রীতিমতো যুদ্ধ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। এই কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে পাক সৈন্যদের নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মর্টার আর মেশিনগানের গোলাগুলিতে তাদের তিন ট্রাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। এদের সংখ্যা প্রায় একশো, অপরপক্ষে অদৃশ্য গেরিলা বাহিনীর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না। তবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, গেরিলা বাহিনীর লোকেরা বড় কম নয়। অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা যথেষ্ট শক্তিশালী। এরপর আরও কিছুদূর এগোতে গেলে ওদের ফাঁদের মধ্যে সবশুদ্ধু আটকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় বাবুরহাটের দিকে ফিরে যাওয়াটাই ওরা সঙ্গত বলে মনে করল।
অদৃশ্য মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি বর্ষণ করে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত এটা ওদের চাল। ওরা প্রলোভন দেখিয়ে আরও দুরে সম্পূর্ণ ওদের আয়ত্তের মধ্যে টেনে নিতে চাইছে। পাক-সৈন্যরা আপাতত বাবুরহাটে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। প্রথম তিনটা ট্রাক একেবারে অচল হয়ে গেছে। নিহত ও জখমী সৈন্যদের দেহ অন্যান্য ট্রাকে বোঝাই করা হলো। এবার ওদের এই শোকের মিছিল ফিরে চলল বাবুরহাটের দিকে। অচল ট্রাক তিনটি এই যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাস্তার উপর পড়ে রইল। বেশ কিছুদিন সেগুলি ঐভাবে পড়ে ছিল।
বেলা বেশী নেই, এই অবস্থায় আর বেশী দুর এগোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ওরা স্থির করল কাল বাবুরহাট থেকে আবার নতুন করে অভিযান শুরু করতে হবে। প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবস্থা সুবিধাজনক বলে মনে হলে ঢাকা থেকে আরও বেশী সৈন্য আনাবার প্রয়োজন হতে পারে।
এবার মুক্তিবাহিনীর কথায় আসা যাক। যাদের তীব্র আক্রমণে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত পাকসৈন্যদল নিদারুন ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তারা সংখ্যায় ছিল মাত্র বারো জন। তাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল শুধুমাত্র একটি মর্টার আর একটি মেশিনগান। এদের মধ্যে কেউ মারা যায়নি, শুধু দু’জন জখম হয়েছিল।
ওদের ঘাঁটি থেকে কয়েক মাইল দূরে। কোথায় সেই ঘাঁটি এই কথাটা একমাত্র তারাই জানে। ওরা সেই ঘাঁটি থেকে জোয়ান ছেলেদের নিয়ে বসল। আর তাদের পরিকল্পনাটা ওদের কাছে খুলে বলল। ছেলেরা শুনে উল্লাসে আত্মহারা হয়ে বলল- আমরাও থাকব আপনাদের সঙ্গে। আমরাও এখানে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার কথা ভাবছিলাম। আপনাদের কয়জন লোক চাই বলুন।
না, না আমাদের যা প্ল্যান তাতে এই বারোজনই যথেষ্ট। তার বেশী লোক নিতে গেলে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আপনারা শুধু চারদিক লক্ষ্য রাখবেন। দেখবেন ওরা যেন হঠাৎ আমাদের চমকে দিতে না পারে। এমন আরও অনেক কাজ আছে, যা আপনারা করতে পারেন। করতে পারেন নয়, করতেই হবে আপনাদের। আপনারা না করলে কে করবে!
ওরা বলল, আপনারা যা বলবেন আমরা তাই করতে রাজী আছি।”
কিন্তু বুড়োদের মনে একটা খটকা লেগেছে। একজন প্রশ্ন তুলল, এরা যদি আপনাদের এখানে এসে এই সমস্ত গোলমাল বাধিয়ে বসে, তাহলে ওরা আমাদের উপর বদলা নেবে। আমাদের ঝাড়ে-গুষ্টিতে শেষ করবে।
“এই অবস্থায় কি করতে বলেন আপনি” একজন প্রশ্ন করল।
বুড়ো আসল শয়তান! প্রথমেই মুখ খুলতে চায় না, পরে সবার চাপাচাপিতে বলে ফেলল। কথাটা ভাল শোনায় না। তাহলেও অনুপায় হয়ে বলতে হচ্ছে।
আমরা বাধা দিলে ওরা তা মানবে না, ওদের যা করাবার তা করবেই। এই অবস্থায় এদের ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া নিজেদের বাঁচাবার আর কোন পথ দেখছি না। শুধু আমার জন্য বলছি না। আমি এই অঞ্চলের সবাইর কথা ভেবেই বলছি। এমন একটা কথা কেউ মেনে নিতে পারে না। হাজার হোক, এরা তাদেরই দেশের ছেলে, তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছে। এদের কি ধরিয়ে দেওয়া যায়! এদের কি শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া যায়!
ইতিমধ্যে খবরটা ছেলেদের কাছে পৌঁছে গেছে। ওরা দল বেঁধে বুড়োদের সামনে এসে চড়াও করল, কোনরকম ভূমিকা না করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, যদি কোন বেঈমান ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করে, তাহলে আমরা তাকে কেটে কুচোকুচো করে ফেলব। বুড়োরা সবাই চুপ। এবার আর কারো মুখে কোন কথা শোনা গেল না। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা ছেলেদের সাহায্য নিয়ে সমস্ত অঞ্চলটা ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা করে দেখল। তার পরের দিন তাদের পরিকল্পনানুযায়ী তারা সেই দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এই বারোজন বীর দেশপ্রেমিকের নাম আমরা জানি না। কিন্তু এই বারোজনের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানকার মানুষ এদের কথা ভুলতে পারবে না।
পরদিন পাক-সৈন্যদল তাদের পথের বাধা দূর করার জন্য বাবুরহাট থেকে দূরপাল্লার কামান দেগে এই গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিবর্ষণ করে চলল, কয়েক ঘণ্টা ধরে এই গোলা বর্ষণ চলল। কিন্তু যাদের লক্ষ্য করে তারা গোলা ছুঁড়ছিল, তারা তখন থেকে বহু দূরে, তাদের ধরাছোঁয়ার নাগালের বাইরে নতুন অঞ্চলে নতুন খেলায় মেতে উঠেছে।
- ↑ ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে ক্যাপ্টেন পদে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন।
- ↑ ১৯৭১ সালের পূর্বে রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের প্রোসিডিং সেকশনে এ-এস-আই হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
- ↑ ১৯৭১সালের ২৫শে মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রাজারবাগ (রিজার্ভ) পুলিশ লাইনে ওয়ারলেস অপারেটর ছিলেন।
- ↑ ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হাবিলার মেজর হিসেবে কর্মরত ছিল।
- ↑ মোহাম্মদ আবদুস সোবহান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আর্মড সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে মিরপুর দশ নম্বর সেকশনে জরুরী টহলে গিয়েছিলেন।
- ↑ শারদীয় কালান্তর, সেপ্টেম্বও ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত সত্যেন সেন রচিত “নাদির গুণ্ডা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।
- ↑ সত্যেন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ (আগষ্ট ১৯৭১) নামক গ্রন্থের “ওরা বারো জন” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।