বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/২

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ চট্টগ্রাম

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২। চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ ………………………… ………………১৯৭১

সেদিন চট্টগ্রামে যেমন করে

স্বাধীনতা লড়াই শুরু হয়েছিল

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান[]

 ৩রা মার্চ, ১৯৭১ সাল। সময় সকাল সাড়ে নয়টা। এই প্রথম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে প্রথম প্রকাশ্য আলোচনা। এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটছিল। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসাররা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের সবার মনেই একটি চিন্তাই পাক খেয়ে ফিরছিল- কি করা যায়? কি করবো? বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে তাঁরা বার বার ছুটে আসছিলেন মেজর জিয়ার কাছে। মেজর জিয়া তখন ছিলেন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বাঙ্গালী অফিসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।

 এরপর এলো ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বল্লেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।

 ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অফিসাররা একে অস্ত্র তুলে নেবার অহ্বান বলেই মনে করলেন।

 পরদিন ৮ই মার্চ। আবার সেই সকাল। ওরা দুজন সবার অলক্ষ্যে আবার উঠে এলেন ছাদে। মেজর জিয়াউর রহমান আর ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। বিদ্রোহ ঘোষণা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দুজনে আলোচনা করলেন। ঠিক হলো বিদ্রোহ ঘোষণার জন্যে উপযুক্ত মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

 কিন্তু কখন আসবে সেই উপযুক্ত মুহুর্ত? কখন? কবে? এঁরা জানতেন এই বিশেষ মুহুর্তটি আসবে তখনই যখন তাদের বিদ্রোহের সমর্থনে পূর্ন আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে জনসাধারণ। এই মুহুর্তটি আসবে তখনই যখন শত্রুও বর্বরতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমান সবার সামনে তুলে ধরা যাবে। এদিকে ইয়াহিয়া বসলো মুজিবের আলোচনায়। ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বাংঙ্গালী অফিসাররা রুদ্ধশাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন আলোচনার ফল কি হয়? আলোচনার অন্তরালে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের এক জঘন্যতম চক্রান্ত। সে চক্রান্ত বাঙ্গালীদের উপর হামলার। সে চক্রান্ত বাংলাদেশের উপর বর্বর অভিযানের।

 আলোচনা চলছিল। আর এদিকে আসছিল জাহাজ বোঝাই সৈন্য। বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। জাহাজ বোঝাই যে সব সৈন্য আসছিল তাদেরকে দ্রুত বিভিন্ন স্থানে নিয়োগ করে পাঠানো হচ্ছিল।

 এমনি সময় ডাক এলো লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর কাছ থেকে ১৭ই মার্চ রাত সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে সামরিক আইন সদর দপ্তরে তার ডাকে প্রথম গুপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হইল- চারজন সামরিক বাহিনীর বাঙালী অফিসারের মধ্যে। এরা চারজন হচ্ছেন লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান, নোয়াখালীর মেজর আমীন আহমদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ।

 ঃ কি মনে করছো? বৈঠকের শুরুতেই কর্নেল চৌধুরী পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মেজর

 জিয়াকে।

 ঃ ওদের ভাবগতি দেখে পরিস্কার মনে হচ্ছে ওরা হামলা চালাবে।

 কর্নেল বললেন তাঁরও তাই ধারনা। কিন্তু কি করা যায়? সবারই মনে এই প্রশ্ন। এক- বিদ্রোহ। কর্নেল চৌধুরী সুস্পষ্ট ভাবে বল্লেন, সশস্ত্র অভ্যুত্থানই একমাত্র পথ। তিনি প্রথম বাঙ্গালী সামরিক অফিসার যিনি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আহ্বান জানালেন।

 সশস্ত্র অভ্যূত্থান। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘সিপাহী বিদ্রহের’ পর আর এক নতুনতর সিপাহী বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী। সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছাড়া বিকল্প কিছু আর নেই।

 ওরা চারজন বাঙালী অফিসার বসলেন বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রণয়নে। ঠিক হলো ক্যাণ্টনমেণ্টের স্টেশন কমাণ্ডার একমাত্র বাঙ্গালী ব্রিগ্রেডিয়ার এম, আর, মজুমদারকে এ পরিকল্পনা থেকে বাইরে রাখতে হবে। ঠিক হলো। লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর নেতৃত্বেই তারা বিদ্রোহের প্রস্তুতি চালিয়ে যাবেন।

 এদিকে পাকিস্তানি হামলার প্রস্তুতি চলছিল পুরোদমে। বাঙালী অফিসারদের উপর তাদের সজাগ দৃষ্টি হয়ে উঠছিল আরও প্রখর। আর এরাও পাল্টা গোয়েন্দা বৃত্তি চালিয়ে সংগ্রহ করছিলেন পাক সেনাদের তৎপরতা। এরই মধ্যে কুমিল্লা থেকে বিস্তারিত খবর আসতে লাগল।

 কমাণ্ড ব্যাটালিয়ানকে আনা হল চট্টগ্রামে। তাদেরকে রাখা হতে লাগল শহরের অবাঙ্গালীদের বাড়ি বাড়ি। চট্টগ্রামের ২০তম বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরাও প্রতি রাতে সাদা পোষাকে অসামরিক ট্রাকে করে বেরিয়ে যেত শহরে। তাদের কাজ ছিল অবাঙালীদের সাথে মিলে লুটপাট করা।

 বাংলাদেশের উপর বর্বর হামলার প্রস্তুতি দেখতে এলেন পাক সেনাবাহিনীর জেনারেল হামিদ খান ২১শে মার্চ চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে তাকে আপ্যায়িত করা হলো মধ্যাহ্ন ভোজের। এই মধ্যাহ্ন ভোজেই পশ্চিমা সামরিক অফিসারদের কানাঘুষা আর জেনারেল হামিদের একটি ছোট্ট উক্তিতে বাঙালী অফিসাররা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন দিন ঘনিয়ে এসেছে। হামলা অত্যাসন্ন।

 মধ্যাহ্ন ভোজে জেনারেল হামিদ বাঙালী অফিসারদের যেন চিনতেই পারেননি। তার যত কানাঘুষা আর কথাবার্তা চলছিল পশ্চিমা অফিসারদের সাথে।

 কি এত কানাঘুষা? কিসের এত ফিসফাস? সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল মেজর জিয়ার মন। কৌশলে একজনের সাথে কথা বলতে বলতে গিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল হামিদের ঠিক পিছনে। দাঁড়ালেন পেছন ফিরে। কথা বলতে লাগলেন সংগীটির সাথে আর দু’কান সজাগ রাখলেন জেনারেল হামিদের কথার দিকে।

 জেনারেল হামিদ তখন কথা বলছিলেন ২০তম বালুচ রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফাতমীর সাথে। অনেক কথার মধ্যে অকেটা যেন সামরিক নির্দেশের মতই কর্নেল ফাতমীকে বলে উঠলেন জেনারেল হামিদ- দেখ ফাতমী, অভিযান (এ্যাকশন) খুব দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে হতে হবে। আমাদের পক্ষে কেউ যেন হতাহত না হয়।

 আঁতকে উঠলেন মেজর জিয়া। একি? কি হতে যাচ্ছে? ঐ দিনই বিকেলে তিনি সস্ত্রীক এক সৌজন্য সাক্ষাতে গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাসায়। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন জেনারেল হামিদের সফরের উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সে তথ্য ছিল অজানা তিনি শুধু বল্লেন, ওরা আমাকে বিশ্বাস করে না। তিনি জানালেন, জেনারেল হামিদ যখন অপারেশন রুমে ছিলেন তখন তাঁকে সে ঘরে ঢুকতেই দেয়া হয়নি।

 ঃ কি বুঝলেন? জানতে চাইলেন মেজর জিয়া।

 ঃ মনে হচ্ছে সামথিং ফিশি।

 জিয়া বল্লেন, ফিশি নয়- বিরাট কিছু। বিরাট এক চক্রান্তে মেতেছে ওরা। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মেনে নিলেন সে কথা। পরদিন ২২শে মার্চ। রাত ১১টায় চট্টগ্রাম ই-পি-আর সেক্টর দফতরের এডজুট্যাণ্ট ক্যাপ্টেন রফিক এসে দেখা করলেন মেজর জিয়ার সাথে তিনি সরাসরি বল্লেন, সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের বিদ্রোহ ঘোষণা করতেই হবে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আপনি বিদ্রোহ ঘোষণা করুন। ই-পি-আরদের সাহায্য পাবেন। মেজর জিয়া তাঁকে তাঁদের পরিকল্পনার কথা জানান। ই-পি-আর এর সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। ২৫শে মার্চে ব্যাপক রদবদল ঘটে গেল ক্যাণ্টনমেণ্টের প্রশাসণ ব্যাবস্থায়।

 ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে এলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল আনসারি, মেজর জেনারেল মিঠা খান, লেঃ জেনারেল খোদাদাদ খান প্রমুখ। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। সেই সাথে নিয়ে গেলেন মেজর আমিন আহমদ চৌধুরীকেও। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের স্থানে আনসারী নিযুক্ত হলেন ষ্টেশন কমাণ্ডার। কর্নেল শিগারী দায়িত্ব নেন ই-পি-আর এর সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে।

 এই রদবদলে আশংকিত হয়ে ওঠেন বাঙালী সৈনিক ও অফিসাররা। এই দিনই গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন লেঃ কর্নেল চৌধুরী।

 এদিকে চট্টগ্রাম শহরে উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছিল প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে পৌঁছতে না পারে তার জন্য রাস্তায় রাস্তায় তৈরী করা হচ্ছিল ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিস্কারের কাজে লাগানো হল। বাঙালী সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চলল এই ব্যারিকেড সরাবার কাজ। রাত ১১টায় অফিসার কমাণ্ডিং জানজুয়া আকস্মিকভাবে মেজর জিয়ার কাছে নির্দেশ পাঠালেন এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য। এই আকস্মিক ও রহস্য জনক নির্দেশের অর্থ তাঁর কাছে বোধগম্য হলনা। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় জানজুয়া নিজে এসে তাকে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোল শহর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বন্দরের দিকে রওয়ানা করে দেন কিন্তু রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে যেতে তার দেরি হচ্ছিল। আগ্রাবাদে যখন একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে তখনই পেছন থেকে ছুটে আসে একটি ডজ গাড়ী ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গাড়ী থেকে নেমেই আসেন মেজর জিয়ার কাছে হাত ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে।

 ঃ পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরের বহু লোক হতাহত হয়েছে। খালেকুজ্জামানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর থেকে কথা কয়টি ঝরে পরে। কি করবেন জিয়া ভাই, এখন? মাত্র আধ মিনিট। গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মেজর জিয়া তারপর বজ্যনির্ঘোষে বলেন উঠেন- উই রিভোল্ট।

 সাথে সাথে তিনি খালেকুজ্জামানকে তিনি ফিরে যেতে বলেন। বললেন, ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য অলি আহমেদকে নির্দেশ দিতে। আর সেই সাথে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতারের।

 খালেকুজ্জামান দ্রুত ফিরে গেলেন ষোল শহরের দিকে। আর মেজর জিয়া ফিরে এলেন ট্রাকে। যে পশ্চিমা সামরিক অফিসারকে তার সাথে দেওয়া হয়েছিল, তাকে বললেন, হুকুম বদলে গেছে। বন্দতে যেতে হবে না। আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে ক্যাণ্টনমেণ্টে। বাঙালী সৈন্য যারা তার সাথে যাচ্ছিলেন তাঁদেরকে ইশারায় বললেন। রাইফেল লোড করে রাখতে প্রয়োজন হতে পারে।

 তাঁরা ফিরে আসেন ব্যাটালিয়নে। এসেই তিনি সাথের পশ্চিমা অফিসারকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি এখন আমাদের হাতে বন্দী। অফিসারটি আত্মসমর্পণ করলে তিনি ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকের পশ্চিমা নৌ-সেনাদের দিকে রাইফেল তাক করে তাদেরকেও অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। হকচকিত পশ্চিমা সেনারা সবাই অত্মসমর্পণ করে।

 এরপর তিনি একাই গাড়ি নিয়ে ছুটে যান অফিসার কমাণ্ডিং জানজুয়ার বাড়ি। কলিং বেল টিপতেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসেন জানজুয়া। আর সামনেই মেজর জিয়াকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন। তার ধারণা ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জিয়া বন্দরে বন্দী রয়েছে। জানজুয়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে ষোলশহরে ফিরে আসেন মেজর জিয়া। পথে অফিসার্স মেসে মেজর শওকতকে তিনি সব কথা বলতেই মেজর শওকত উৎফুল্ল হয়ে উঠেন এবং বিদ্রোহে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করে দ্রুত ব্যাটালিয়নে চলে আসেন।

 এরপরই মেজর জিয়া টেলিফোনে স্থানীয় জননেতা ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করেন। কিন্তু কাউকেই পান না। তখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটরকে জানালেন সবাইকে টেলিফোন করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বিদ্রোহ ঘোষণার কথা জানাতে। অপারেটর সানন্দে তাঁর সে নির্দেশ জানাতে রাজী হন।

 তিনি লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীকেও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁকেও পাননি। পরে শুনেছিলেন এই রাতেই পাকিস্তানী সৈন্যরা গুরুতর অসুস্থ এম, আর, চৌধুরীকে হত্যা করেছিলো।

 শুরু হয়ে গেল বিদ্রোহ। রাত তখন দুটো। ব্যাটালিয়নের আড়াইশোর মত বাঙ্গালী সৈন্যকে একত্রিত করে তাঁদেরকে সব কথা বলেন মেজর জিয়া। সবাই একবাক্যে এই বিদ্রোহের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। তাঁরা জানান, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা জান দিতে প্রস্তুত। কিছু সৈন্য ষোলশহরে রেখে বাকী সবাইকে নিয়ে মেজর জিয়া বেরিয়ে পড়েন কালুরঘাটের পথে। এদিকে ই-পি-আর এর জোয়ানরাও লড়াই শুরু করেছিলেন। কালুরঘাটে পরদিন তাঁদের সাথে বেশকিছু পুলিশও যোগ দেন।

 ২৬শে মার্চ সকাল। আগের রাতে ঢাকা শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাজধানীর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। আর সেই আনন্দে সকাল হতেই পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সদর দফতরে চলছিল মিষ্টি বিতরণ আর অভিনন্দন বিনিময়ের পালা। কিন্তু মুহূর্ত কয়েক পরেই তাদের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যায়। মিষ্টি হয়ে যায় বিস্বাদ। চট্টগ্রামের যুদ্ধের খবর যখন তাদের কাছে পৌঁছলো তখন এক দারুন সন্ত্রাসে আঁতকে উঠলেন তারা।

 চট্টগ্রাম। পাকিস্তানীদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো চট্টগ্রাম। ২৭শে মার্চ সকালেই বিমান বোঝাই হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে গেল পুরো দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ন। চট্টগ্রামে যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীর জন্য মিঠা খানকে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। বাঙ্গালী সৈন্যরা গুলি করে, সে হেলিকপ্টারটি ফুটো করে দেয়। একই সাথে বিমানে করে নামানো হতে লাগলো দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটালিয়নকে। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাবরকে নিয়ে আসা হয় বন্দরে। এতে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ডেস্ট্রয়ার, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্কও লাগানো হয় এই যুদ্ধে। জাহাজের গান থেকেও গোলা নিক্ষেপ হতে থাকে শহরের দিকে।

 এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হবে না একথা বাঙ্গালী সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাবার আগেই বিশ্ববাসীর কথা জানিয়ে যাবার জন্য মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। কি জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসীকে বেতার মারফৎ? এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন- আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু পনের মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তার মানসিক অবস্থা বুঝাবার নয়। বিবৃতি লেখার ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিল শব্দচয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে।

 প্রায় দেড় ঘণ্টা মোসাবিদার পর তিনি তৈরী করেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি। নিজেই সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজীতে পাঠ করেন।

 ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাটে থেকে তাঁরা চট্টগ্রামের যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁদের সাথে যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো ২০তম বালুচ রেজিমেণ্ট, কুমিল্লা থেকে নিয়ে যাওয়া ৫৩-ব্রিগেড। আর নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো কমাণ্ডো, যারা অবাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে ঘাঁটি গেড়েছিল।

 এদেরকে ছাড়াও চট্টগ্রামের এই যুদ্ধে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে লাগানো হয়েছিলো কোয়েটা থেকে নিয়ে আসা ১৬শ ডিভিশন ও প্রথম কমাণ্ডো ব্যাটালিয়নকে।

 ৩০শে মার্চ সকালে মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র) থেকে আর এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমাণ্ডার ঘোষণা করেন।

 এই দিনই দুটি পাকিস্তানী বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে বেতার কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

 ১১ই এপ্রিল কলুরঘাট এলাকা থেকে অবস্থান সরিয়ে নেয়ার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এ যুদ্ধ চলে রামগড়, রাঙ্গামাটি এলাকায়। যুদ্ধ চলে কক্সবাজারের পথে, শুভপুরে। যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই দলে দলে জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্ররা এসে যোগ দিয়েছে বাহিনীতে। অস্ত্র ধরেছে, ট্রেনিং নিয়েছে, বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে।

 ৩০শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাবার পর ৩রা এপ্রিল রাত সাড়ে ন’টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন একটি গোপন এলাকা থেকে চালু করা হয় আর একটি বেতার কেন্দ্র। ‘আমার সোনার বাংলা’ দিয়ে করা হয় এই কেন্দ্রের উদ্ধোধন। এই গানটি গাইবার জন্যে সে রাতে সেখানে এসেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন পুলিশ সুপার জনাব রহমানের তিন মেয়ে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের ঘটনা ও প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এনামুল হক চৌধুরী[]

৭-১১-১৯৭৩

 ২৪শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, কর্নেল হামিদ হোসেন শিগরী, ক্যাপ্টেন মোহসিন (এডজুট্যাণ্ট) চট্টগ্রাম বন্দরে ‘এম, ভি, সোয়াত’ জাহাজের অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ খালাসের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দিতে চলে যান। আমাকে নির্দেশ দিয়ে যান ব্রিগেডিয়ার আনসারী, হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে আসার পর তাঁকে জীপযোগে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠিয়ে দিতে।

 হেলিকপ্টার যখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবতরণ করে তখন আশ্চর্যের সাথে দেখতে পাই লেফট্যানেণ্ট জেনারেল আবদুল হামিদ খান (সি-ও-এস, পাকিস্তান আর্মি), জেনারেল নওয়াজেশ, জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (জি-ও-সি, ১৪-ডিভিশন, ঢাকা) এবং ব্রিগেডিয়ার আনসারী এরা সবাই হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে এসেছেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আনসার সেই হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম বন্দরে চলে যান। তাদেরকে দেখার সাথে সাথে আমরা সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম কারণ তাদের আগমন অপ্রত্যাশিত ছিল।

 জেনারেলদের আগমনের সাথে সাথে ২০-বালুচের সি-ও লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল ফাতমী ই-বি-আর-সি ‘তে আসেন। চা পানের পর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা ২০-বেলুচের সি-ওর সাথে ২০- বালুচ অফিসে চলে যান। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই যে, স্টার-প্লেট ছাড়াই তিনি গাড়িতে করে ছদ্মবেশে ২০ বালুচের অফিসে চলে যান। ই-বি-আর-সি অফিসার মেস-এ আমরা লাঞ্চ পার্টির ব্যাবস্থা করি। সেখানে প্রায় ৩০/৪০ জন অফিসার উপস্থিত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও ব্রিগেডিয়ার আনসারির জন্য আমরা প্রায় ১ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার তিনটার সময় পোর্ট থেকে আমাকে টেলিফোনে পার্টি শুরু করার নির্দেশ দিলেন।

 পার্টি হৈ-হুল্লোড় এবং আনন্দের সাথে শুরু হয়ে যায়। কথা প্রসংগে জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা মেজর মং কেও (এস-এস-ও) কে জিজ্ঞেস করেন যে অবসর জীবনে তিনি কি করবেন। তিনি বললেন, দেশের এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বাইরের কিছু চিন্তা করা সম্ভব নয়। খাদেম হোসেন রাজা বললেন, থিংস আর গোইং টু বি নরমালাইজড ভেরী সুন। ডু-নট অরি। প্লান ফর ইওর ফিউচার।

 খাদেম হোসেন রাজা আমাদেরকে বললেন। দিস আনসারটেইনটি ইজ গোইং টু বি ওভার ভেরী সুন। ওয়ার্ক হার্ড। ডিভোট ইওর টাইম ফর ট্রেনিং।

 ব্রিগেডিয়ার মজুমদারও বেলা পৌনে চারটার দিকে হেলিকপ্টার যোগে ব্রিগেডিয়ার আনসারী, ক্যাপ্টেন মোহসিনসহ ই-বি-আর-সিতে আসেন। খাওয়া শেষ করার পর ব্রিগেডিয়ার মজুমদার আমাকে বলেন যে বিশেষ কারণে তিনি ঢাকা চলে যাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, “লুক আফটার ইওরসেল্ফ”

 তার সাথে ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী (এ-আর-ও-পি) মেডিক্যাল চেক আপ-এর জন্য ঢাকা আসেন। সব জেনারেল একই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান।

 ২৪শে মার্চ বিকেলে ই-বি-আর-সি তে থমথমে ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। আমাদের পেরিমিটার গার্ড এর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

 ২৫শে মার্চ সকালে কর্নেল এম, আর, চৌধুরী (চীফ ইন্সট্রাক্টর, ই-বি-আর-সি) আমাকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জোয়ানদেরকে দিয়ে দিতে বললেন। সমস্ত জোয়ানদের বিভিন্নভাবে অরগানাইজ করা হয়।

 এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ষোলশহরে অবস্থিত অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বিশেষ কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। ই-বি-সি থেকে দেড়শত রাইফেল তারা ধার চেয়েছিল। আমরা ঢাকা থেকে স্যাংশন পেয়ে তাদেরকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেই। অষ্টম বেঙ্গলের কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আজ নেবেন কাল নেবেন বলে আর নেন নাই। অষ্টম বেঙ্গলের কিছু সৈন্য এ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে পাকিস্তানে চলে যায়। যাবার প্রস্তুতি হিসেবে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ী জমা দিতে হয়েছিল। খুব কম অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ি বাকি সৈন্যদের কাছে ছিল।

 ২৫শে মার্চ সকাল থেকেই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় জনসাধারণ ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে শুরু করে। বায়েজীদ বোস্তাম থেকে ব্যারিকেড পরিস্কার করার জন্য ই-বিআর-সিকে নির্দেশ দেয়া হয়। সাথে বেলুচ রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানীও ছিল।

 লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল এম,আর, চৌধুরীকে ব্যারিকেড পরিস্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সাথে ক্যাপ্টেন আজিজ ব্যারিকেড পরিস্কারের কাজ তদারক করছিলো।

 সকাল ১১টা থেকে চারটে পর্যন্ত সকল সৈন্যসামন্ত নিয়ে মাত্র ২০০ গজ রাস্তা পরিস্কার করা হয়। বহু কষ্টে বায়েজিদ বোস্তামীর রাস্তার মোড় পর্যন্ত যান। সৈন্যদেরকে সেখানেই দুপুরের খাবার দেয়া হয়।

 বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বেসামরিক ট্রাক যেগুলো আমাদের সৈন্য নিয়ে ব্যারিকেড পরিস্কারের কাজে যাচ্ছিল সমস্ত ড্রাইভার ট্রাক ফেলে পলায়ন করেন।

 বায়েজীদ বোস্তামের মোড়ে বিপুল জনসমাবেশ হয়েছিলো। তারা ড্রাম দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল। এবং সেখানে দাড়িয়ে বক্তৃতা করছিল। শ্লোগানে শ্লোগানে সে এলাকাকে তারা মুখরিত করে তুলেছিল।

 জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য বাধ্য হয়ে কর্নেল এম, আর, চৌধুরী নির্দেশে এক রাউণ্ড গুলি ছোড়া হয়। এতে তিনজন লোক আহত হয় একজনের অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর সামনের দিকে অগ্রসর না হয়ে এম, আর, চৌধুরী সৈন্যসামন্ত নিয়ে সেনানিবাসে ফিরে আসেন।

 এরপর কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর সাথে আমার দেখা হয়। তিনি অত্যান্ত দুঃখের সাথে বলেন যে, এই গুলিটি শুধু পাকিস্তানীদের দেখাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম।

 সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমাদের এক কোম্পানীকে জেটি এলাকায় যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। মেজর কামাল মেহের (পাঞ্জাবী) ক্যাপ্টেন আজিজ কোম্পানীকে নিয়ে জেটিতে রওনা হয়ে যান।

 ২১শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ই-বি-আর সির বাঙ্গালী অফিসারদেরকে ডেকে চট্টগ্রাম শহরকে পুরো নিয়ন্ত্রনে আনা এবং বাঙ্গালীদের যেন অযথা হয়রানি, দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দিলেন। তদানুসারে আমরা সমস্ত অফিসার সৈন্যদের নিয়ে শহরে যাই। আমি নিজে অয়ারলেস কলোনীতে যাই। সেখানে ক্যাপ্টেন রফিকের (এডজুট্যাণ্টট, ই-পি-আর) সাথে দেখা হয়। তার সাথে চট্টগ্রামের ডি-সি এবং এস-পিও ছিলেন। রাত আটটার দিকে অয়ারলেস কলোনীতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বহু কষ্টে ই-পি-আর ও বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। তার জন্য ডি-সি, এস পি খুব আনন্দিত হন এবং বলেন, যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা থাকলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারন করত।

 পথে আমি নৌবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানী জোয়ানদেরকে হাতে অস্ত্রশস্ত্রসহ দেখতে পাই। অয়ারলেস কলোনীতেও তাদেরকে দেখা গিয়েছিল। তা আমি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বলি। তিনি বললেন যে এরপর নৌবাহিনীর কোন লোককে শহরে দেখা যাবে না।

 কর্নেল এম, আর, চৌধুরী সেদিন বড় অসুস্থ ছিলেন। তার দুদিন আগে হাতে ব্যাথা পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি বড় খারাপ আমাদেরকে সাবধানে থাকতে হবে। এই সময় ঢাকা থেকে ক্যপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী টেলিফোনে চারদিকে খেয়াল রাখতে বলেন। টেলিফোনটি এম,আর, চৌধুরীকে দিতে বলেন। এম, আর, চৌধুরী টেলিফোনে কথোপকথনের পর আমাকে বলেন পরিস্থিতি বড় খারাপ, আমাদেরকে অত্যন্ত সতর্কের সাথে থাকতে হবে।

 ২৫শে মার্চ রাতে মেসে যাবার পর কর্তব্যরত অবস্থায় ক্যাপ্টেন মোহসিন আমাকে বললেন, তার মেয়ে বড় অসুস্থ। আমি যদি তার জায়গায় ডিউটি করি তাহলে রাতে তিনি বাসায় থাকতে পারেন। আমি তাতে সম্মত হলাম।

 অফিসে আসার পর ক্যাপ্টেন মোহসীন সব বুঝিয়ে দেন। এই সময় মেজর বেগ আসেন, তিনি কড়া নির্দেশ দিয়ে যান যে আজকের পরিস্থিতি খুব খারাপ। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সারারাত ডিউটি করতে হবে।

 কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর সাথেও আমার দেখা হয়। তিনি বললেন আমি খাবার জন্য মেসে যাচ্ছি, এবং আমার কক্ষে থাকব। প্রয়োজন হলে আমার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করবে। তবে পরিস্থিতি খারাপ।

 রাতে শহর থেকে অনেক টেলিফোন পাই। বন্ধুবান্ধবরা পরিস্থিতি কেমন জিজ্ঞেস করছিলো। তাদেরকে বললাম যে, তারা যদি কিছু জানে তাহলে আমাকে যেন জানায়।

 রাত সাড়ে এগারটার দিকে অষ্টম বেঙ্গল থেকে মেজর মীর শওকত আলী টেলিফোনে বললেন, ইবি-আর সি-ও যত গাড়ি আছে সবগুলোই যেন তাদের জন্য সত্বর পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এমভি-সোয়াত থেকে সত্বর অস্ত্রশস্ত্র আনলোড করতে। কিছুক্ষন পর তিনি টেলিফোনে বললেন। তার অধিনস্থ সকলে গাড়ির জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

 আমি বললাম, গাড়ির জন্য খবর দেয়া হয়েছে। দু’তিন মিনিট তিনি আবার টেলিফোনে বললেন। ব্রিগেডিয়ার আনসারী তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। যদি পাঠাতে আমি দেরি করি তাহলে আমার অসুবিধা হবে।

 আমি জবাব দিলাম। গাড়ি যাচ্ছে। এই সময় চট্টগ্রাম শহর থেকে স্ট্যাণ্ডার্ড ব্যাঙ্ক-এর ভাইস চেয়ারম্যান এম, এ, কাদের আমাকে টেলিফোনে বললেন। ঢাকার কোন খবর পেয়েছেন। আমি বললাম না তিনি বললেন ঢাকায় পুলিশ ই-পি-আর এর উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালিয়েছে। তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। ঢাকার বাঙ্গালী সামরিক বাহিনীর লোকেরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।

 টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অপারেটর সে সময়ে বাঙ্গালী ছিল, তাই কোন অসুবিধা হয়নি। আমি তাদের সবাইকে বললাম। আপনি কর্নেল এম,আর, চৌধুরীর সাথে কথা বলুন। কাদের সাহেব ও এম, আর, চৌধুরী যখন কথা বলছিলেন তখন আমি অপারেটর কে বলি তাদের কথোপকথন আমাকে মনিটর করতে।

 কথা শেষ আমি বললাম, স্যার আমি সব শুনেছি। তিনি বললেন, বাকি যতসব অস্ত্রশস্ত্র আছে সমস্ত জোয়ানদেরকে দিয়ে দিতে। তিনি সত্বর অফিসে আসছেন বলে জানালেন। আমি সুবেদার মেজর, নায়েক সুবেদার, কোয়ার্টার মাস্টার ও অন্যান্যদেরকেও ডেকে অস্ত্রশস্ত্র কোটে থেকে নিয়ে নিতে নির্দেশ দেই। তারা নির্দেশ নিয়ে বাইরে যাবার সাথে সাথে দেখতে পাই ২০-বালুচ থেকে অনেক গুলো গাড়ি আসছে। গাড়িগুলো আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে শহরের দিকে যেতে দেখতে পাই। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে সব গাড়ি থেমে যায়। আমি বাইরে এসে দেখতে পাই গাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন নিচে নামছে। কোয়ার্টার গার্ড থেকে গার্ড কমাণ্ডার থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বলে যে, ২০ বেলুচের সমস্ত লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গাড়ি থেকে নামছে। আমি তাকে বললাম তুমি চলে যাও। সে যাওয়ার সাথে সাথে কোয়ার্টার গার্ডের লোকজনকে স্ট্যাণ্ড টু সতর্ক করা হয়।

 অল্পক্ষণের মধ্যে ২০-বালুচের লোকেরা কোয়ার্টার গার্ড-এর রক্ষীদের উপর হামলা চালায়। মুহুর্তের মধ্যে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়।

 তখন হামিদ হোসেন শিগরী আমাকে টেলিফোন করে জানতে চান কোথা থেকে এ গোলাগুলি হচ্ছে বা কেন হচ্ছে। আমি বললাম, আমি কিছু জানি না। তবে বেলুচ রেজিমেণ্টের লোকেরা আমাদের লোকদের উপর গোলাগুলি ছুড়ছে। তিনি বললেন, “ডু-নট ওরি। আই উইল ট্রাই টু কনট্রোল দি সিচুয়েশন ইফ নিডেড। আই উইল শেড মাই ফর বেঙ্গল রেজিমেণ্ট। দেয়ার ইজ নো ডিফারেন্স বিটুইন মাই সন এ্যাণ্ড ইউ ক্যাপ্টেন এনাম। আই উইল বি দি ফার্স্ট ম্যান টু টেক ইউ আউট ফ্রম দি ডিউটি রুম।

 চারিদিক থেকে রাইফেল, এল-এম, জি, ২” মর্টারের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকে দু-ঘণ্টার মত। তারপর গর্জে ওঠে ৩” মর্টারের আওয়াজ।

 কর্নেল শিগরীর আবার টেলিফোন পাই। তিনি বললেন, কে যে আমার বাসার চতুর্দিকে গুলি ছুড়ছে কিছুক্ষণ পর দু-তিন মিনিটের বিরতি হয়।

 তিনি পুনরায় টেলিফোনে বললেন, “ইজ ইট এডভাইজ্যাবল ফর মি টু কাম টু অফিস এণ্ড টেক ইউ আউট? আমি জবাব দিলাম গোলাগুলি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আসা উচিৎ নয়।” তার সাথে সাথে পুনরায় সবরকমের গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল। সাথে সাথে ট্যাংকের গর্জনও শোনা গেল। আমি যে ডিউটি রুমে ছিলাম, পাশে ৩” মর্টারের গোলা পড়ে। দরজা-জানালার চতুর্দিক দিয়ে অনবরত গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। আমি বাধ্য হয়ে টেলিফোনটি নিয়ে জমিনের উপর অবস্থান নিয়ে শুয়ে থাকি। কর্নেল শিগরী আবার টেলিফোনে বললেন যদি কোন অফিসার আসে তাহলে তাকে কর্নেল শিগরীর সাথে কথা বলতে দেয়ার জন্য। আমাকে বললেন, তোমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি সত্বর আসব। কিন্তু তারপর তার নিকট থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

 কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি কিছুটা কমে যায়। বাহির থেকে কে যেন বলছিল আমার রুমে বহু লোক আছে সাথে সাথে আমি পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন আনোয়ারের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে উচ্চকণ্ঠে বললাম আমার কাছে আসতে। আমাকে বলা হল বাইরে আসার সাথে সাথে হ্যাণ্ডস আপ করিয়ে তার নিকট যেতে বলা হয়। দেখা হওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন আনোয়ার বলে, ডু-নট ওরি। ইউ আর নট এ প্রিজনার অব ওয়ার। ফ্যাক্ট ইজ দ্যাট ইউ আর আনডার মাই কমাণ্ড।

 আমি তাকে কর্নেল শিগরীর সাথে কথা বলতে বলি। সে আমার কথামত কর্নেল শিগরীর সাথে আমার ডিউটি রুম থেকে কথা বলে। সে আমাকে সাথে করে ডিউটি রুম থেকে কথা বলে। সে আমাকে সাথে করে ডিউটি রুম থেকে কোর্ট এ নিয়ে যায় আর বলে, ভাগতে চেষ্টা করলে বিপদ হবে সাথে সাথে তিনজন প্রহরী আমার জন্য মোতায়েন করা হয়।

 সেখানে দেখতে পাই বাঙ্গালী সৈনিকদের মৃত্যুর আর্তনাদ। কেউ বাবারে মারে বলে চিৎকার করছে। কেউ পানির জন্য কাতরাচ্ছে। কেউ যন্ত্রনায় ছটফট করছে। আর সাথে সাথে দেখতে পাই পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ সমস্ত লোকদেরকেও বেয়নেটের গুতো দিচ্ছে আর বলছে। বাংগালীকা জান বহুত ছখত হায়। আর ইয়ে শালা মরতা ভি নেহি হায়। মূমুর্ষ বাঙ্গালী সৈন্যদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন যথেচ্ছ চলছিল। যারা মূমূর্ষ অবস্থায় ছটফট করছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের গলার উপর বুট দিয়ে চেপে ধরেছে, যাতে তাড়াতাড়ি তারা মারা যায়।

 আমাকে প্রহরারত এক প্রহরী বলে আপ আগার অর্ডার দেতে হাম ভি ইয়ে করনে ছাকতা। লেকিন ইয়ে আচ্ছা নেহী হায়। এক মুসলমান দুসরা মুসলমানকো খামাখা মার রাহা হায়। খোদা কি কসম হাম অভিতক এক গুলি ভী নেহী মারা।” সাথে সাথে আমাকে বলে “লেফটেন্যাণ্ট আবু তালেব (বাঙ্গালী-আর্মি এডুকেশন কোর) সাব জিন্দা হায়। উসকো যব বেয়নেট কররা থা উস টাইম পর হাম উনকো বাচা দিয়া। উস দিন এমতেহানমে সাব নে হামে পাশ করায়া। ইস লিয়ে হামনে ইয়ে কিয়া। আখের হাম কমাণ্ডো হায়। সাব নয়া নয়া সাদী কিয়া। হামনে ঊনকো বিবি পড় বড়া এহসান কিয়া।” এই সৈন্যটি আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছিল। আমিও তাকে অনুরোধ করেছি আমার কাছে থাকতে। সে বলে, “ছোবাহ তক হাম জিন্দা রাহেগা তো আপ ভী জিন্দা রাহেগা।”

 ভোর হওয়ার সাথে সাথে ট্যাঙ্কের গর্জন বেশী বাড়তে থাকে। ব্যারাকের উপর ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। চারিদিকে পাহাড়ের উপর তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা পড়তে থাকে আর চতুর্দিকে বাঙ্গালী আহত সৈন্যদের গোংড়ানি ও আর্তনাদ পুরো এলাকায় এক বিভীষিকা এবং বীভৎসতা সৃষ্টি করেছিলো। তারপর দেখা গেল বহু বাঙ্গালী সৈন্যকে চতুর্দিক থেকে বেয়নেটের মুখে ধরে আনা হচ্ছে আর তাদেরকে ই-বি-আর-সি স্কুল কক্ষে ঢুকানো হচ্ছে। একদল ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আর কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে বড় লাঠি নিয়ে ঢুকতে দেখি। আর সাথে সাথে তাদের বেদম মারপিট শুরু হয়ে যায়। তারা যখন ভীষণ আর্তনাদ শুরু করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাইরে আসে। বাহির থেকে ভেতরে দু-তিন রাউণ্ড গুলি ছোড়ার সাথে সাথে আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যায়।

 আমার সামনে যে সব সিপাহীকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিলো। তাদেরকে বাঁধা হয়। ভোর সাতটার দিকে একজন সুবেদার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে “খাজানা (ট্রেজারী) কিধার হায়।” আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখাবার সাথে সাথে সুবেদার আমার উপর স্টেনগান উঠিয়ে বলে, ছহি ছহি বাতাও কিধার হায়। কারন দুদিন আগে দেড় লাখ টাকা সিপাহীদের বেতন বাবদ ঢাকা থেকে ই-বি-আর সিতে পাঠানো হয়েছিল।

 কিছুক্ষণের মধ্যে সুবেদার একটি হাবিলদারকে নির্দেশ করে বলে, সাব কো ভী বাঁধো। হাবিলদার একটা রশি নিয়ে আসে। আমি দুই হাত পিছু করার সাথে সাথে সে আমাকে বেশ শক্তভাবে বেঁধে ফেলে। আমি বলি, ওস্তাদ বহুত জেয়াদা টাইট হায়, সে বলে সাব আপকা বাজু বহুত মোটা হায়। আমি হাসতে হাসতে বলি, হামতো গামা নেহী হায়। যাক সে আমার বাঁধন একটু শিথিল করে, কিছুক্ষণ পর আমার কমাণ্ডো প্রহরীটি বাঁধন খুলে নামেমাত্র বেঁধে দেয়।

 এই সময় আমাদের সুবেদার মেজর রুহুল আমিন, নায়ক সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফুলকেও বেঁধে আনা হয়।

 কিছুক্ষণ পরে সুবেদার রহমানকে বেঁধে আনা হয়। তাকে আমি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখলাম। একটা গুলি তার পেটে ঢুকে অপর দিকে বের হয়ে যায়। রক্ত পড়ছিল। তাকেও বেঁধে রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে চা, পরাটা, হালুয়া, খাচ্ছিল। কমাণ্ডো প্রহরীটি আমার জন্য চা আনতে যাওয়াতে তাকে অপমান করা হয়। সে এসে বলে সময় সবকিছু করে।

 আমার সামনের লোকদেরকে খালি চা দেওয়া হয়। তার বিষ মনে করে ক্ষেতে ইতস্ততঃ করে। আমি একটু মুখে নিয়ে বলি, খেয়ে ফেল, কোন অসুবিধে হবে না। কিন্তু সুবেদার মেজর ও নায়েক সুবেদার লুৎফর রহমান তাতেও চা স্পর্শ করলেন না।

 পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ই-বি-আর-সি পাহাড়ের নিচে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পাহাড়ের উপর ৩” মর্টার আর ট্যাংক দিয়ে অনবরত গোলাবর্ষন করতে থাকে। উপর থেকে প্রত্যুত্তরে দু-চারটি গুলিও আসতে থাকে।

 ২৬শে মার্চ বেলা এগারটার দিকে আমাদের কোয়ার্টার গার্ড থেকে পলাতক একটি বাঙ্গালী সৈন্য ইবি-আর সি ফুটবল মাঠের ড্রেন থেকে অকস্মাৎ তিনটি গুলি ছুড়লে প্রায় ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। প্রায় ১২/১৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। তারপর সে পালাতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সৈন্যটি তাদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে।

 ২৬শে মার্চ ভোর ৭টার দিকে পাক সৈন্যরা যেসব লোকদেরকে রাত্রে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিলো তাদেরকে একটি ট্রাকে ভর্তি করতে দেখতে পাই। আমার সামনে দিয়েও শ’খানেকেরও উপর লাশ নিয়ে যেতে দেখতে পাই। প্রত্যেক লাশকে চারজন সৈন্য হাত পা ধরে মরা কুকুরের মত নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সৈন্যকে কয়েকটি লাশ মাটিতে ছেঁচড়িয়ে নিয়ে যেতে দেখতে পাই।

 এই সময় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী জুনিয়র অফিসারকে দেখতে পাই। তারা আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখে দুঃখ প্রকাশ করে। একজন ২০-বেলুচের লেফটেন্যাণ্ট কোয়ার্টার মাস্টার কেঁদে ফেলেছিল।

 বেলা তিনটার দিকে কর্নেল ফাতমী (২০ বেলুচের কমাণ্ডিং অফিসার) ই-বি-আর-সি এলাকাতে আসেন এবং আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে মনঃক্ষুন্ন হন। তিনি এক হাবিলদারকে আমার বাঁধন খুলে দিতে নির্দেশ দিলেন। আমি লেফটেন্যাণ্ট আবু তালেবের কথা বলাতেও তিনি তার বাঁধন খুলে দিতে নির্দেশ দেন। অনুরোধ করাতে সুবেদার মেজর রুহুল আমীন ও নায়েক সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফর রমানের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আর লুৎফর রহমানকে বলেন। তুমি একটি মেগাফোন নিয়ে যে সমস্ত লোক পাহাড়ের উপর বা অন্যান্য জায়গায় আছে তাদেরকে আত্মসমর্পন করতে আহ্বান জানাও। তারা যদি খালি হাতে হাত উঁচু করে আসে তাহলে তাদেরকে কেউ মারবে না। পরক্ষনে তিনি সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যের হাতের বাঁধন খুলে এক জায়গায় একত্রিত করতে নির্দেশ দেন। তাই করা হল। আমাকে বলেন যে তুমি গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পার। তবে তাদের উপর আর কোন অত্যাচার করা হবে না।

 আমি গিয়ে সকলকে একত্র করে তাই বললাম। ৫০০/৬০০ জন বাঁধা অবস্থায় ছিল। পুনরায় কর্নেল ফাতমীর সাথে দেখা করলে তিনি আমাকে বলেন, “এ্যানি হয়ার ইউ ওয়াণ্ট টু গো ইউ ক্যান গো। ইফ ইউ ওয়াণ্ট টু স্টে ইন অফিসার মেস, গো এহেড। বেটার গো হোম।”

 আমি অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ পেলে তাদরকেও ছেড়ে দেয়া হবে।

 আমি দুজন সিপাহী নিয়ে মেসে টাকা আনতে যাই। ওখানে প্রহরারত হাবিলদার পাঞ্জাবী ভাষায় আমার প্রহরারত সিপাহীদের বলল, সাহেব যখন ভেতরে যাবে তখন তাকে হত্যা কর। আমি শুনতে পেয়ে একটু সামনে যেয়ে আবার ফিরে এসে বললাম। ওস্তাদ আব লোগ কোকাকোলা ফাণ্টা পিয়া। হামারা নাম পর পিলে। হামে এক বাদ ইয়াদ আয়া, কর্নেল সাব নে বাতায়া সি-এম-এইচ ছে ডাক্তার লে কর জখমী কো পহেলা দেখনে কি লিয়ে। হাম ফের থোর বাদমে আয়েঙ্গে। এ যাত্রা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই।

 তারপর আবার কর্নেল ফাতমীর সাথে দেখা হয়। আমি তাকে বলি, আমার লোকজনের খাবারের কোন ব্যবস্থা আছে? তিনি বলেন। আমাদের লোক নিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করুন। না হয় তারা কষ্ট পাবে।

 তিনি আরো বলেন ই-বি-সি-র সামনে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী থাকবে না। রাত্রে তাদের কোন অসুবিধা হবে না। এখানে বলা যেতে পারে ই-বিআর-সির সামনের জায়গাটা হল বায়েজিদ বোস্তাম ও বেসামরিক লোকদের বাড়িঘর। লোকজনকে একত্র করে পুনরায় আমি তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য বলি। আর বলি, আমাকে, লেফটেন্যাণ্ট তালেব, সুবেদার মেজর রুহুল আমীন ও নায়েব সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফর রহমানকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমরা বাইরে যাচ্ছি। বাকিদেরকে ঢাকা থেকে ক্লিয়ারেন্স পেলে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে ই-বি-আর-সির সামনে রাত্রে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য থাকবে না।

 ই-বি-আর-সি থেকে বের হওয়া কষ্টকর ছিল। চারদিক থেকে এখনো এলোপাতাড়ি গোলাগুলি চলছিল। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে বহু কষ্টে ই-বি-আর-সি এলাকা থেকে বের হতে সক্ষম হই।

 ই-বি-আর-সির বাইরে একটি ফ্লাটে আমাদের চারজন অফিসার ছিলেন। আসার পথে তাদেরকে বাইরে নিয়ে আসতে যাই। আমাকে দেখে তারা যেন আকাশ থেকে পড়ছেন বলে মনে হল। দেখার সাথে সাথে তারা ই-বি-আর-সির ভেতরের অবস্থা জানতে চান। আমি উপরে বর্ণিত দু-একটি কথা বলার সাথে সাথে তাদেরকে আমার সাথে আসতে বলি। সেখানে ছিলেন মেজর রেজাউল রহমান (মেডিক্যাল স্পেশালিষ্ট) মেজর আশরাফ (রেডিওলজিষ্ট), ক্যাপ্টেন বাশার (আর্মি সাপ্লাই কোর) ও ক্যাপ্টেন মোহসীন (এডজুটট্যাণ্ট, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট)।

 তাদের মধ্যে একজন বলেন, আমরা তো মনে করছিলাম। ই-বি-আর-সিতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ফাকা আওয়াজ করেছে। জবাবে আমি বলি, এক হাজারেরও অধিক লোককে তারা বেয়নেট বুলেট ও অন্যান্য মরনাস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

 এ কথা শোনা মাত্রই মেজর রেজাউল রহমান সকলকে তৎক্ষণাৎ আমার সাথে শহরের দিকে চলে যেতে বলেন। পরিবারের সকলকে নিয়ে আমরা যাযাবারের মত শহরের দিকে রওনা হই।

 চট্টগ্রাম শহরে আসার পর দেখি শহরবাসীরা ছোট ছোট অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মারমুখী হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। আমি আমার এক আত্মীয় বাড়িতে রাত দশটায় যাই এবং সেখানে রাতযাপন করি।

 সকালে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে জনাব এম, আর সিদীকির সাথে কথা হয়। তিনি আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত ই-পি-আর এর কমাণ্ড নিতে বলেন।

 আমি কয়েকজন ছাত্রের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হই এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র) যাই। সেখানে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূইয়া ই-বি-আর সি ছেড়ে চলে আসলে। সে জবাবে বলে, কোন উপায় না দেখে আতুগোপন করছি। বেশী কিছু না বলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা বললাম। সে আমাকে যাওয়ার জন্য বলল। আমি বললাম, আমি কোরবানির বকরা তাই যাচ্ছি। ছাত্রদের সাথে গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে ইপিআরদেরকে সংগঠিত করি।

 আমি ইপিআরএর লোকদেরকে যুদ্ধ করার জন্য এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ইবিআরসির ঘটনাবলীর কথা বলাতে তারা একযোগে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাদের দৃঢ় শপথ ঘোষণা করল।

 ই-পি-আরীদের নিয়ে কোথায় কি করতে হবে পরিকল্পনা করার পর আমি পুনরায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করি। দেখা না পেয়ে বেতার কেন্দ্রে একদিনের মত কাজ করি। বাইরে যাবার পর দেখি চারদিকে লুটপাট, মারামারি চলছে। একজন ছদ্মবেশী ভূয়া ক্যাপ্টেন তার নাম নাসির। তার সাথে কোতয়ালী থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র বাহির করতে যাই। সেখানে প্রহরারত প্রহরীদের দেখি। নাসিরের হাবভাবে মনে হল যে সেনাবাহিনীর লোক নয়। তদুপরি থানা থেকে ১০/১৫ হাজার টাকা চাওয়াতে মনে আরো সন্দেহ হয়। চট্টগ্রামে আরো দুদিন ছোটখাটো অপারেশন করার পর আমি ফেনীর পথে রওনা হই এবং ফেনী, নোয়াখালী, মাইজদী, লাকসাম, কুমিল্লার মিয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম এলাকার সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব নেই। ফেনীতে হেডকোয়ার্টার ছিল। পুলিশ ইপিআর, আর্মি মুজাহিদ ইউ-ওটি সি ও ছাত্রদেরকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হই। সেখানে জনাব খাজা আহমদ, জনাব জরুহুল কাইয়ূম এম-সি-এ কে ভারত থেকে আমাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে অনুরোধ করি। তারা তাদের চেষ্টা চালান। দুদিন পর বেলুনিয়ার এসডিও ও বি-এস-এফ কমাণ্ডারের সাথে আমাদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে জনাব খাজা আহমদ, জনাব জহুরুল কাইয়ুম, জনাব আবুদর রশিদ, এম সি এ উপস্থিত ছিলেন। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন তাদেরকে জানাই এবং বিএসএফ কমাণ্ডার সবকিছু দিতে স্বীকার করেন।  আমরা বাংলাদেশ থেকে ভারত সীমান্ত রসদপত্র রাখার ব্যবস্থা করাই। সেদিন সব ব্যবস্থা করা হয়। তার সাথে সাথে বার্টার সিস্টেমে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস তারা দেবেন বলেও স্বীকার করেন।

 আমরা আমাদের এলাকাটাকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত রাখার জন্য চতুর্দিকে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি তৈরী করি। যে সব রাস্তা দিয়ে হানাদার বাহিনীর চলাচল করার সম্ভাবনা ছিল সেসব রাস্তার গুরত্বপূর্ণ সেতুগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। যেমন, চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম রাস্তার ডাকাতিয়া নদীর উপর বড় সেতু হরিকোট পুল, ফেনী-লাকসাম রেলওয়ে রাস্তার বড় সেতু পরিকোট ব্রীজ। নোয়াখালীরও অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পরিকোট ব্রীজের সত্বর মেরামতের কাজ দেখার জন্য কুখ্যাত টিক্কা খান পরিদর্শনে এসেছিল।

 লাকসামে আমাদের অবরোধ প্রতিহত করতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মারমুখি হয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় চারদিন অনবরত যুদ্ধের পর আমাদেরকে লাকসাম ছাড়তে হয়।

 লাকসাম-নোয়াখালীর প্রবেশপথে খণ্ড খণ্ড বহু যুদ্ধ হয়। যার নেতৃত্ব করার জন্য সুবেদার লুৎফরকে ভার দেয়া হয়েছিল। বহুদিন খণ্ডযুদ্ধ চলার পর ভারী আধুনিক অস্ত্রের অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হই।

 সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে ভারত থেকে মাঝে মাঝে এম সি এ নুরুল হক যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন। তাকে দেখে আমাদের লোকজন দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করার মনোবল পেতে।

 সমুদ্রপথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমন প্রতিহত করতে চারদিক দিয়ে বহু বাঙ্কার তৈরী করা হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের শক্তিশালী অবরোধ দেখে নোয়াখালী থেকে ফেনী না এসে লাকসাম থেকে ফেনীর পথে রেল পথে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হয়। পরিকোট পুলের নিকটে প্রায় একদিন যুদ্ধ চলে। তাদের ত্রিমুখি আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের লোকজন পিছু হটতে আসে। আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঐ দিনই পাকিস্তানী সেনাদেরকে তিন দিকে আটক করে রাখে- নোয়াখালীর পশ্চিম দিকে, ফেনীর উত্তর দিকে ও বুরবুরিয়া ঘাট এলাকায়।

 পশ্চিম পাকিস্তানীরা একদিন গুণবর্তীতে অপেক্ষা করার পর অতর্কিতে ফেনীর তিন দিক ঘিরে ফেলে। আমাদের লোক মারমুখি হয়ে বার ঘণ্টার মত তাদেরকে বহু কষ্টে ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু তাদের ভারি আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে ফেনী ছাড়তে বাধ্য হয় এবং ভারতের সীমান্তে গিয়ে একত্রিত হয়। তখন ছিল মে মাস।

 একিনপুরে আমরা সবাই একত্রিত হই। একিনপুর থেকে ৪ কোম্পানী সৈন্য নিয়ে শুভপুর বুরবুরিয়া ঘাট মুহুরী নদী ও ছাগলনাইয়া ফ্রণ্টে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাই। পাক সেনাবহিনী একদিন অতর্কিতে ছাগলনাইয়ার বাঙ্কার তৈরী করে অপেক্ষা করছিলাম। তাদের কিছুসংখ্যককে মুহরী নদী পার হতে দেই এবং অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালানো হয়। অনেক পাকসৈন্য নিহত হয়। এমনকি তাদের লাশ নেবার জন্য কোন লোক দেড় দিন পর্যন্ত আসে নাই। বাধ্য হয়ে সকল সৈন্যসামন্ত নিয়ে ভারতে আসতে হয়। আমরা ১নং সেক্টরে প্রথম পর্যায়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত হই। আমার কিছুসংখ্যক লোক খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করে।

স্বাক্ষরঃ এনামুল হক চৌধুরী
৭-১১-৭৩

ক্যাপ্টেন শমসের মুবিনের

দৃষ্টিতে চট্টগ্রামের প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরী

২০-১০-১৯৭৩

 মার্চের ২২ তারিখে ক্যাপ্টেন হারুন (এসিস্ট্যাণ্ট উইং কমাণ্ডার, ই-পি-আর) কাপ্তাই থেকে এসে আমাকে বলল যে আমাকে মেজর রফিকের (এডজুট্যাণ্ট, ই-পি-আর) বাসায় যেতে হবে। ২২শে মার্চ রাতে আমি, ক্যাপ্টেন হারুন, মেজর খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন অলি মেজর রফিকের বাসায় গেলাম।

জনাব কায়সার এম-পি এ এবং ডাক্তার মান্নান এই দুজন আওয়ামী লীগ কর্মীও সেখানে ছিলেন। আমরা স্থির করলাম যে, এখানে আলাপ-আলোচনা করা নিরাপদ নয়, তাই আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। যাবার সময় আমরা খুব সতর্ক ছিলাম যে কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কিনা।

আমরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের তাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তারা বললেন যে, শেখ সাহেব রাজনৈতিক সমাধানের আশা করছেন। আমরা বললাম যে, আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনাদের পক্ষ থেকে যদি ঠিক সময়ে কোন সাড়া বা আভাস পাই তাহলে আমরা কিছু একটা করতে পারি।

আমরা বুঝতে পারলাম যে তাদের কোন প্রস্তত্ততি নেই। আমরা বললাম যে আমরা মানসিক দিক থেকে প্রস্বত্তত আছি। আপনারা ঢাকা থেকে খবরাখবর নিয়ে আগামীকাল আমাদের জানাবেন।

২৩শে মার্চ মেজর রফিক আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে বললেন। কিন্তু কিছু একটা হবে কিনা তিনি তখনও জানেন না। আমাদের আলাপ-আলোচনার কথা মেজর জিয়াউর রহমানকে জনালাম। তাকে আমরা আবার আশ্বাস দিলাম যে আমরা সবসময় তার সাথে থাকব। এর আগে লেঃ মাহফুজকে পরিস্থিতি অবগত করানোর জন্য মেজর জিয়াউর রহমান আমাকে বলেছিলেন। আমি তাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম যে আমাদেরকে পাকিস্তানীরা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে দেখছে। আমরাও তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মেজর জিয়াউর রহমান বলেছেন যে সিটিং ডাক-এর মত না থেকে নিরস্ত্র করতে আসলে তা প্রতিহত করবেন। মাহফুজ বলল যে পরিস্থিতি এত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে কিনা? তারপর সে বলল যে আচ্ছা ঠিক আছে।

২৪শে মার্চ মেজর রফিক আমাকে বলল যে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের কোন সিদ্ধান্ত এখনও আমাদেরকে জানাননি। ২৪শে মার্চ রাতে খবর পেলাম যে জনগণ রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করছে। এম ভি সোয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করতে জনগণ বাধা দিচ্ছে। জেটি থেকে সেনানিবাস পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে সেনাবাহিনীর লোকজন চলাফেরা করতে না পারে। এখবরটা আমি জিয়াউর রহমান সাহেবকে পাঠালাম।

আমাদের সৈনিকদের মাঝে একটা আতংক দেখতে পেলাম। কি হবে? কি করতে হবে না হবে? বাইরের ঘটনাবলীতে সৈনিকরাও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল। আমি সারারাত সজাগ ছিলাম। ২৪শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুইজন মেজর জেনারেল চট্টগ্রামে ইবিআর সি-তে এসেছিলেন। ঐদিন জানতে পারলাম দুজনের সাথে করে ব্রিগেডিয়ার মুজমদারকে (ই-বি-আর-সি কমাণ্ডার মার্শাল ল এডমিনিসট্রেটর) ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরটা জিয়াউর রহমানকে জানাই। আমাদের সি-ও লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল জানজুয়া বললেন যে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়নি। তিনি বার বার বলছিলেন যে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের জায়গায় ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়।

[]  ২৫শো মার্চ ব্রিগেডিয়ার আনসারী আমাদের সি-ওকে নির্দেশ দিলেন যে আমরা যেন ব্যারিকেড পরিষ্কার করি। “অল ব্যারিকেডস মাস্ট বি ক্লিয়ার এ্যাট এনি কষ্ট” - এটা ব্রিগেডিয়ার আনসারীর ম্যাসেজ ছিল। এ্যাট এনি কষ্ট শব্দটার উপর আমাদের সি-ও খুব এ্যামফ্যাসিস করছিলেন। ষোলশহর রেলক্রসিং এর উপর ওয়াগন দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল। ঐ ব্যারিকেড সরাতে পুরো একটা কোম্পানী ডিটেইল করা হল। সুবেদার খালেককে বললাম। যে এ ট্রেনের ওয়াগন যেন বিকেল চারটার আগে সরানো না হয়। কমাণ্ডিং অফিসার আমাদের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরকে ডেকে ঐ ওয়াগনগুলোর ঢাকা ব্রেক ভাঙ্গতে শুরু করলেন। জনসাধারন খুব হৈ হুল্লোড় করছিল। বিকেল পর্যন্ত ঐ ব্যারিকেড সরানো হল। বায়েজীদ বোস্তাম পর্যন্ত সমস্ত ব্যারিকেড পরিস্কার করতে নির্দেশ দেয়া হল। আমরা আশা করছিলাম যে আওয়ামী লীগ হাই কমাণ্ড থেকে কোন নির্দেশ পাব। আমি মেজর রফিকের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। তিনিও বললেন যে কোন নির্দেশ তিনিও পাননি। তিনিও প্রস্তুত আছেন।

 আমরা ব্যারিকেড পরিস্কার করতে গেলাম। ২৫শে মার্চ রাত ৯টা নাগাদ সমস্ত ব্যারিকেড পরিস্কার করা হল। জনসাধারণ আমাদেরকে খুব বাধা দিচ্ছিল। “আপনারা এসব করবেন না। আপনাদেরই ক্ষতি হবে।” জনসাধারন এসব বলছিল। আমরা বললাম যে আমাদের নিজেদের ইচ্ছায় আমরা কিছু করছি না। আমরা শুধু নির্দেশ পালন করছি। তদুপরি অন্য কোন নির্দেশও আমরা পাচ্ছি না। কমাণ্ডিং যে কোন উপায়ে হোক ব্যারিকেড ক্লিয়ার করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

 ষোলশহর থেকে বায়েজীদ বোস্তামী পর্যন্ত ডিউটি দেবার জন্য আমাদের উপর নির্দেশ দেয়া হল। আমরা যখন ডিউটি করছিলাম। তখন বালুচ রেজিমেণ্টের ৫টা গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে চলে গেল। ঐ সব গাড়ীতে গোলাবারুদ ও এমুনিশেনও ছিল।

 রাত সাড়ে এগারটায় লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল জানজুয়ার সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম পোর্ট এ ডিউটি করতে খবর দিতে বললেন। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রীকে বলতে বললেন যে ভয়ের কোন কারন নাই। জিয়াউর রহমান ২৬শে মার্চ সকালে চলে আসবে।

 রাস্তায় ছেলেরা একটা গর্ত করেছিল। সেই গর্তটা ভরাট করতে আমাকে বলা হল। আমি জিয়াউর রহমানের স্ত্রীকে এ খবর বললাম। জিয়াউর রহমানকেও এ খবর জানালাম।

 রাত বারটায় আমি ষোলশহর ক্যাণ্টনমেণ্টের গেটে গেলাম। সেখানে গিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বৃষ্টির মত গুলি হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন অলিকে টেলিফোনে জানালাম যে ক্যাণ্টনমেণ্টের ভিতরে ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না সেখানে ঠিক কি হচ্ছে। ক্যাপ্টেন অলি আমাকে সঠিক খবর নেবার চেষ্টা করতে বললেন এবং তাকে জানাতে বললেন। এমন সময় কিছু বাঙ্গালী সৈন্যকে গেটের দিকে আসতে দেখলাম। তারা আমাকে বললেন যে, স্যার বেলুচ রেজিমেণ্ট আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে এবং আমাদের অনেককে মেরে ফেলেছে। কর্নেল এম, আর, চৌধুরীকেও (ই-বি-আর-সি চীফ ইন্সট্রাক্টর) মেরে ফেলেছে। আমি সংগে সংগে তাদেরকে গাড়িতে উঠালাম এবং আমার সাথে ষোলশহরে এইটথ বেঙ্গলে নিয়ে আসলাম।

 এইটথ বেঙ্গল-এ এসে শুনলাম যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে এটা করা হয়েছে। মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি বললেন যে এখন থেকে তিনিই হচ্ছেন ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডিং অফিসার। তিনি আরো বললেন যে গোলাগুলির খবর তিনি শুনেছেন। এ খবর শোনার পর তিনি ব্যাটালিয়ন এর কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়াসহ অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের গ্রেফতার করেছেন। পরে ওদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপর মেজর জিয়াউর রহমান আমাকে ব্যাটালিয়ন এর সবাইকে এক জায়গায় একত্রিত করতে বললেন। সবাইকে এক জায়গায় একত্রিত করা হল। তার পর মেজর জিয়াউর রহমান টেবিলের উপর উঠে বক্তৃতা করলেন। তিনি বললেন, “আজ থেকে আমি অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অফিসার আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সংকল্প ঘোষণা করলাম। এবং আমার নির্দেশেই সবকিছু চলবে। আপনারা সবাই আমার সাথে থাকবেন। এখন এখানে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা সবাই কালুরঘাটের দিকে যাব, সেখানে গিয়ে আমরা সবকিছু রিঅর্গানাইজ করব এবং আমাদের পরবর্তী কর্মস্থল নির্ধারণ করব।”

 ২৬শে মার্চ ভোরে আমরা কালুরঘাটের আর একটু দুরে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে আমরা বিশ্রাম নিলাম এবং রিঅর্গানাইজেশন করলাম। ২৬শে মার্চ এভাবে কেটে গেল।

 ২৭শে মার্চ সন্ধার সময় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন যে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত আছি। আপনারা যে যেখানে আছেন, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে বললেন। তিনি বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোর সাহায্য এবং সহযোগিতা কামনা করলেন। দেশবাসীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে বললেন।

 ২৮শে মার্চ সারা দিন আমি ঐ ভাষণ বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ি।

 চট্টেশ্বরী রোডে অপারেশনঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের এ্যমবুশ করেছিল। আমরা ১০ জন ছিলাম। আমরা ওদের এ্যামবুশ কাউণ্টার করেছিলাম।

 ২৯শে মার্চ আসকের দীঘি অপারেশনঃ প্রায় ১২ ঘণ্টা এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়।

 ৩০শে মার্চ বাকুলিয়া গ্রাম অপারেশনঃ এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটো গেরিলা কমাণ্ডোকে হত্যা করা হয়।

 এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে কালুরঘাট ব্রীজ অপারেশন চালানো হয়। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে আমি গুরতররুপে আহত হই। আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তারপর আমাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। বন্দী শিবিরে রাখা হয়। এবং অশেষ নির্যাতন করা হয়। প্রত্যহ আমাকে মারধর করা হত। ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে আমাকে রাখা হয়। আমার সাথে আরো অনেক বন্দি ছিল। এদের কাউকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জুন মাস পর্যন্ত আমার উপর অত্যাচার চলে। নভেম্বর মাসে আমার বিরুদ্ধে চার্জশীট আনা হয়। বলা হয়েছিল আমাকে কোর্ট মার্শাল করা হবে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করে। আমি মুক্ত হয়ে যাই।

 এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে কালুরঘাটে এসে গ্রামে আমরা শপথ গ্রহণ করলাম। শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমানঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। এমন কি যদি প্রয়োজন হয় দেশের জন্য আমরা প্রাণ দেব।

 আমাদের ব্যাটালিয়নের হেডকোয়ার্টার ছিল গ্রামে। ৩০শে মার্চ বাকুলিয়া গ্রামে অপারেশন চালিয়ে আমরা দুটো কমাণ্ডোকে হত্যা করি।

 চকবাজারে আমরা প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করেছিলাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটে যাই।

 চট্টগ্রাম কালুরঘাটের যুদ্ধঃ ১১ই এপ্রিল সকাল ৮টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভীষণ আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। আমি এবং মেজর হারুন আমাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায়  ৩৫ জন। ওদের সংখ্যা ছিল ১০০-এরও উপর। আমাদের একজন সিপাহী এই যুদ্ধে মারা যায়। মেজর হারুন ব্রীজের উপর আহত হন। আহত হবার পর অতিকষ্টে তাকে পুলের ওপর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে নির্দেশ দিলাম। আমাকে একজন সৈন্য চলে যেতে বলল। আমি বললাম যে তোমরা যাও আমি আসছি। আমি রয়ে গেলাম। হঠাৎ আমি নিজেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘেরাও অবস্থায় দেখলাম। অন্য সবাই পুলের অপর পারে চলে যেতে সক্ষম হয়। আমি ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে চারদিকে চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখলাম। তারপর একটা গুলি এসে আমার কোমরে লাগে এবং আমি গুরুতররুপে আহত হয়ে পুলের উপর পড়ে গেলাম। আমি ভাবতে লাগলাম যে শত্রুরা আমাকে ধরে ফেলবে। আমি ওদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যা করে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে স্থির করলাম। কিন্তু স্টেনগানটা দুরে ছিল। তাই এটা সম্ভব হল না। আমি ভাবছিলাম ওরা আমাকে ধরে মেরে ফেলবে কিন্তু শত্রুরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে। তারপর আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়।

স্বাক্ষরঃ শমসের
বাংলাদেশ আর্মি

চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার হারুন আহমেদ চৌধুরী[]

১৭-১-১৯৭৫

 ২২শে মার্চ আমি চট্টগ্রামে আসলে ক্যাপ্টেন রফিক আমাকে বললেন, ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট অনেক বাঙ্গালী অফিসার আছেন, তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেশের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর এবং বিদ্রোহ সম্পর্কে কথাবর্তা চালাও। আমি ক্যাপ্টেন রফিকের কথামত ২৩শে মার্চ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মেসে যাই এবং আমার কোর্স মেট ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কঃ) ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (বর্তমানে মেজর) লেঃ মাহফুজুর রহমান (বর্তমানে মেজর), লেঃ শমসের মুবিন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর) এর সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলি। মেজর শওকত তখন মেসে ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি সিনিয়র, সেহেতু তার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাইনি।

 উপরে বর্ণিত তরুণ অফিসারবৃন্দকে নিয়ে আমি ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় সন্ধায় আসি এবং সেখান থেকে ক্যাপ্টেন রফিকসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এর অধ্যাপকের বাসায় পৌঁছাই তখন রাত অনুমান সাড়ে ন'টা। আমার নিজের একটি ভক্সওয়াগান গাড়ি ছিল। ঐ গাড়িতে করে আমরা গিয়েছিলাম। ঐ সভাতে এমপিএ আতাউর রহমান কায়সার, ডাঃ মান্নানসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। সভায় দেশের সর্বশেষ অবস্থা, আমাদের ক্ষমতা, পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। সামরিক বাহিনী গতিবিধি দেখে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, পাকিস্তানী সেনারা সত্তুর বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে একটা কিছু করতে যাচ্ছে। সভায় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের তরুন অফিসারবৃন্দের সঙ্গে আমাদের ই-পি-আর বাহিনীর অফিসারবৃন্দের (২জন) মাঝে সমঝোতা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যদি পাক বাহিনী আক্রমণ করে আমরা বাঙ্গালীরা একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়বো এবং সমুচিত জবাব দেব।

 ২৪শে মার্চ সকালে আমি কাপ্তাই চলে যাই। যাবার পূর্বে আমি এবং ক্যাপ্টেন রফিক আর একবার মিলিত হই। কথা হয় যে, পাকিস্তানীরা যদি আক্রমণ করে অথবা ইঙ্গিত দেয় তাহলে আমরা বিদ্রোহ করবো এবং ক্যাপ্টেন রফিক আগে বিদ্রোহ করলে সে আমাকে খবর দেবে। রফিক আরও বললো যে, আমি ইন্সপেকশনের নামে পাঞ্জাবীদের অস্ত্রের ফায়ারিং পিন অকেজো করে দিয়েছে এবং তুমিও তোমার উইং-এ তাই করো। আমি রাজী হলাম। আমাকে তিনি কোড ওয়ার্ড দিলেন, “ব্রিং সাম উড ফর মি”- অর্থ হলো চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমাকেও বিদ্রোহ শুরু করতে হবে। এবং সমস্ত অবাঙ্গালীদের বন্দী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে মিলতে হবে।

 ২৪শে মার্চ খুব ভোরে আমি কাপ্তাই চলে গেলাম। আমার উইং-এ সুবেদার মেজর ছিল (বাঙ্গালী) নজমুল হক। সুবেদার মেজর আমাকে সব খবরাখবর এনে দিত। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অবাঙ্গালী এন-সিও এবং জে-সি-ওরা রাতে গোপনে মেজর পীর মহম্মাদের (উইং কমাণ্ডার) বাসাতে সলাপরামর্শ করতো। আমি সবসময় সতর্ক থাকতাম এবং বুঝতে পারতাম উইং কমাণ্ডার এবং অবাঙ্গালীদের মনে আক্রমাণাত্মক প্রস্তুতি চলছে। আমি ভিআইপি রেস্ট হাউসে থাকতাম। ২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ফারুক বান্দরবন থেকে উইং হেডকোয়ার্টারে আসে। ক্যাপ্টেন জায়দী আমার অনুমতি নিয়ে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় কাপ্তাইতে আসেন। ক্যাপ্টেন ফারুক এবং ক্যাপ্টেন জায়দী আমার রুমে জায়গা নিলেন। আমরা তিনজন কথাবর্তা বলে রাত ৯-৩০ থেকে ১০টার দিকে ঘুমতে যাই। এমন সময় আমার অর্ডারলি দরজা ধাক্কা দেয় এবং আমার টেলিফোনের কথা বলে। আমি টেলিফোনে যেয়ে শুনলাম যে লাইন কেটে গেছে। তবে অপারেটর বলল, ক্যাপ্টেন রফিক কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি রুমে ফিরে যাই এবং মিনিট দশেক পর আবার টেলিফোন আসে। টেলিফোন ধরে জানলাম এম, আর, সিদ্দিকী। জনাব সিদ্দিকী বলেন, ২০-বালুচ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে আক্রমণ করেছে। শহরে খুব গোলমাল, আপনি বিদ্রোহ করেন এবং চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। আমি রফিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। তিনি বললেন, “রফিক যুদ্ধ করছে, সে এখানে নাই। এরপর আবার টেলিফোন পেলাম, করেছেন জনাব এম, আর, সিদ্দিকী। জনাব সিদ্দিকী বলেন, “রফিক যুদ্ধ ময়দানে তবে একটি কোড ওয়ার্ড পাঠাতে বলেছেন, সেটি হলো, ব্রিং সাম উড ফর মি।” তখন আমি অবস্থাটা বুঝলাম। তখনই আমার রুমে এসে পোশাক পরি এবং সিদ্ধান্ত নিই অবাঙ্গালীদের নিরস্ত্র করবো এবং চট্টগ্রামে রওয়ানা হব। পোষাক পড়ার সময় অবাঙ্গালী অফিসার জেগে যায় এবং তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে আমি পোশাক ক্যান পরছি। “লাইনে কিছু গোলমাল, এখনই ফিরে আসবো, তোমরা ঘুমাও”- এই কথা বলেই আমি চলে যাই। গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় এক অবাঙ্গালী এন-সিও আমার দিকে আসে, এবং বলে স্যার, লাইনে গোলমাল। তখন এনসিওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমি লাইনে যাই। লাইনে পৌঁছে আমি সুবেদার মেজরকে ডাকি এবং সমস্ত কথা বলি। তাকে বলি, “কোতে চাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। বাঁশী বাজালে কোত খুলে দেবেন।” ঐ রাতে গার্ড কমাণ্ডার ছিলো একজন পাঞ্জাবী। তাকে ডেকে আমাদের দোতালায় সমস্ত এন-সিকে ডাকতে বললাম। আমার সাথের এনসিওকে তার আগেই উপরে পাঠিয়েছিলাম। গার্ড কমাণ্ডার উপর তলা থেকে নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমি বন্ধি করি এবং অস্ত্র কেড়ে নেই। আমার কথামত কোয়ার্টার গার্ডের বাঙ্গালী সৈনিকরা সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় সিঁড়ির মুখে পজিশন নিতে থাকে। হুইসেল দেই, সমস্ত বাঙ্গালী সৈনিকদের উপর হতে নিচে নেমে আসতে বলি এবং অবাঙ্গালীদের উপরে থাকতে বলি। কোন অবাঙ্গালী নামার চেষ্টা করলে গুলি করার হুকুম দেই। বাঙ্গালীরা প্রস্তুত ছিল, তাই হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাঙ্গালীরা নীচে নেমে আসে। কোত খুলে দেওয়া হয় এবং সকলের হাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলে দেওয়া হয়। আমি তখন উইং কমাণ্ডার মেজর পীর মহাম্মাদকে নিরস্ত্র করতে গেলাম। কাপ্তাইতে তখন কতগুলো পয়েণ্ট ছিল, যে পয়েণ্টে আমাদের ই-পি আর বাহিনীর ৪/৫ জন পাহারায় থাকতো। উইং কমাণ্ডারের বাসার সামনেই একটা পয়েণ্ট ছিল। সে পয়েণ্টের গার্ড ছিল অবাঙ্গালী। আমি তখন পয়েণ্টের গার্ডটিকে নিরস্ত্র করি এবং তারপর মেজর পীর মহাম্মদের বাসায় যাই। মেজর পীর মহাম্মদ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। ডাকাডাকিতে উঠলেন এবং তিনি আমাকে পোষাক পড়া দেখে ঘাবড়ে গেলেন। তিনি আসলে বললাম, “আপনি বন্দী। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি উইং-এর দায়িত্ব নিয়েছি।” মেজর পীর মহাম্মাদ অস্ত্র ধরার চেষ্টা করলেন। আমি হুঁশিয়ার করে দেই, “অগ্রসর হলে মৃত্যু।” তাকে বললাম, “ঘরে থাকেন, কোন অসুবিধা হবে না আপনার।” এই বলে বাইরে গার্ড রেখে আবার রুমের দিকে যাই। রুমে পৌঁছে দেখলাম ক্যাপ্টেনদ্বয় উঠে বসেছে। তাদেরকে বললাম, “তোমরা বন্দী। এদেশ স্বাধীন।” পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জায়দী উঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই তাঁকে বন্দী করে ফেলি। ক্যাপ্টেন ফারুক পাঠান ছিল। সে খুশি হয়ে বললো। “ভালই হলো আমি তোমার অনুগত হয়ে বাংলাদেশের সেবা করবো।” রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে। হাজার হাজার জনতা পথে নেমেছে। আমি ই- পিআর কোম্পানীর ৪/৫ জনকে উইং হেডকোয়ার্টারের রেখে বাকী সবাইকে নিয়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হই। যাবার পূর্বে অয়ারলেস মারফত আমার অবশিষ্ট কোম্পানীগুলোকে মেসেজ পাঠাই যে, সমস্ত অবাঙ্গালীদের বন্দী করে কাপ্তাইতে একত্রিত হয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হও।

 ২৬শে মার্চ আমি যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭/৮ মাইল দুরে ছিলাম তখন দেখলাম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কয়েকজন সৈন্য পটিয়ার দিকে দৌঁড়াচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম পাক বাহিনী আক্রমণ করেছে এবং মেজর জিয়া সহ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বিদ্রোহ করেছে। তারা পটিয়াতে একত্রিত হবে। আমি অগ্রসর হলে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ পাই। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বললেন, “ক্যাপ্টেন রফিক শহরে যুদ্ধ করছে আমরা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল পটিয়াতে একত্রিত হবো তারপর আবার শহরে এসে পাল্টা আক্রমণ চালাবো।” আমাকে তার সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে থেকে গেলাম। এরপর মেজর জিয়ার কমাণ্ডে কাজ করতে থাকি। পটিয়াতে আমরা সবাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শপথ নেই। কালুরঘাটে পাকবাহিনী ব্যাপকভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ১১ই এপ্রিল পাকসেনারা চারদিক থেকে বৃষ্টির মত গোলা ফেলতে থাকে।

 ঐ তারিখে আমি এবং শমসের মবিন চৌধুরী গুরুতররূপে আহত হই। আমাকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। ডাঃ নূর হোসেন (অস্ত্র বিশেষজ্ঞ) পটিয়াতে আমার অস্ত্রোপাচার করেন। তারপর আওয়ামী লীগের লোকজন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিয়ে ফিরতে থাকে। ইতিমধ্যে কালুরঘাটের পতন ঘটে। মালুরঘাট নামক স্থানে খৃস্টান মিশনারী হাসপাতালে পুনরায় আমার অস্ত্রোপচার করে সেখান থেকে কক্সবাজারের উখিয়া নামক স্থানে সমসের আলম চৌধুরীর বাড়িতে রাখেন। সমসের আলম চৌধুরী সাহেব আমাকে ওষুধপত্র দিয়ে এবং সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। ফকরুদ্দিন (আমার ব্যাটসম্যান) সব সময় সঙ্গে ছিল। খামারবাড়ি নামক স্থানে থাকা অবস্থায় পাঞ্জাবীরা আমাদের খোঁজে আসে। তখন আমাকে স্ট্রেচারে করে সবাই বার্মা চলে যায়। বার্মা রিফুইজি ক্যাম্পে সবাই আশ্রয় নিই। সেখানে চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। বার্মা থেকে পালিয়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে টেকনাফে আসি। টেকনাফে এসে বেশকিছু ই-পি-আর ছেলে পেলাম এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্যরাও ছিল। আমি ওখানে থেকে যাই এবং আবার যুদ্ধে নেমে পড়ি।

 ১১/১২ ই ডিসেম্বর কক্সবাজারে ভারতীয় সেনাবাহিনী নামলে আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেই এবং দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই।

স্বাক্ষরঃ হারুন আহমেদ
১৭-১-৭৫

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ক্যাপ্টেন ভূইয়া

মেজর এম, এস, এ, ভুইয়া।[]

 ২৬শে মার্চ দুপুরে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে আলাপের সময় আমি জানতে পারি যে, একটি বেতার- কেন্দ্র আমাদের দখলে রয়েছে। ২৮শে মার্চের সন্ধ্যা থেকে ২৯শে মার্চের রাত পর্যন্ত আমি এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে ছিলাম। আমার সে সময়কার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রুপায়নই এ আলেখ্য।

 বলা বাহুল্য বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র এবং পরে মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে পরিচিত এই ঐতিহাসিক বেতার কেন্দ্রটি গোড়াতে খোলা হয়েছিল চট্টগ্রামে।  বেতার-কেন্দ্রটি খোলা হয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। ২৮শে মার্চ সকালে কালুরঘাটে মেজর জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে চট্টগ্রাম শহরে ফেলার পথে আমি প্রথমবারের মতো বেতার কেন্দ্রটিতে প্রবেশ করি। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঐ বেতার কেন্দ্রে কর্মরত স্টাফের সাথে আমার পরিচয় হয়। সেখানে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লেফটেন্যাণ্ট শমশেরের সাথেও আমার দেখা হলো লেফটেন্যাণ্ট শমশের সে সময়ে বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের লিখিত ভাষণ বারবার প্রচার করছিলেন।

 সেদিন পশ্চিম কমোডোর মমতাজের বাসা আক্রমণের পর আমি বেতার কেন্দ্রে ফিরে আসি এবং লেফটেন্যাণ্ট শমশেরের স্থলাভিষিক্ত হই। মেজর জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী লেফটেন্যাণ্ট শমশের সে সময়ে কালুরঘাটে ফিরে যান।

 বেতার কেন্দ্রে অবস্থানকালে সেখানে আমার কাজ ছিল ঐ বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের চারদিকে মোতায়েন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কমাণ্ড করা ঐ কেন্দ্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং বেতার কেন্দ্র প্রচারিতব্য সংবাদ, বুলেটিন ও নানা কথিকা পড়ে সে-সব এ্যাপ্রুভ করে দেওয়া। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বেতার-কেন্দ্রে থাকাকালীন আমাদের সাথে যারা কাজ করতেন তাদের বেতার কেন্দ্রের অভ্যন্তরে আসা যাওয়ার অনুমতি দিয়ে আমি ৭টি 'পাস' ইস্যু করেছিলাম। প্রথমে ৬টি এবং পরে ১টি পাস ইস্যু করা হয়েছিল। মেজর জিয়ার নির্দেশ ছিল কোন সংবাদ বা কথিকা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার করার আগে অবশ্যই তা কোন অফিসারকে পড়ে চেক করে দিতে হবে। লেফটেন্যাণ্ট শমশের বেতার কেন্দ্র থেকে কালুরঘাট চলে যাবার সময় মেজর জিয়ার এই নির্দেশের কথা আমাকে বলে গিয়েছিলেন। সে সময় বেতার কেন্দ্র থেকে আমি যেসব সংবাদ এবং কথিকা পাঠ করেছি তার সবগুলোতেই আমি আমার ইনিশিয়াল দিয়েছি। বলা বাহুল্য, এসব কাজ করার সময় আমার মনে এক অসাধারণ বিপ্লবী চেতনার জন্ম হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সে সময় আরব জাহানের প্রখ্যাত গেরিলা নেতা ইয়াসের আরাফাতের কর্মধারা ও জীবন-চেতনা আমাকে অনুপ্রানিত করে তুলেছিল। তাঁর কথা তখন আমার বারবারই মনে পড়তো, মনে পড়তো তাঁর বিপ্লবী-সংস্থা 'প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রণ্ট'-এর কথাও। মনে আছে, একটি কথিকায় লেখক-প্রদত্ত নামটি কেটে দিয়ে তার ওপর আমি লাল কালিতে আমাদের সংগ্রামী-সংস্থার নাম দিয়েছিলাম 'বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রণ্ট'। পরবর্তীকালে সাংবাদিকরা এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘মুক্তিফৌজ'।

 ২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় লেফটেন্যাণ্ট শমশের ও আমি অনেক্ষণ আলাপ আলোচনার পর ব্লাক আউট ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিই। সে অনুসারে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ব্লাক আউট পালনের ঘোষণাও প্রচারিত হয়। বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী যথারীতি ব্লাক আউট পালিতও হয়েছিল। বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আরেকটি গুরুত্বপুর্ন নির্দেশে সবাইকে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে ক্যাপ্টেন মুহসিন, ক্যাপ্টেন মুখলেস, ক্যাপ্টেন ইনাম, ক্যাপ্টেন ওয়ালী, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া ও অন্যান্যের কাছে রিপোর্ট করার আহবান জানানো হয়েছিল। অবশ্য এই ঘোষণায় কোনো জায়গার নাম উল্লেখিত হয়নি।

 আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ঘোষণায় বলা হয়েছিলঃ 'নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদীঘির ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন। এই ঘোষনায় রিপোর্ট করার স্থান হিসাবে লালদীঘির ময়দান এর উল্লেখ ছিল কারণ ২৯শে মার্চ সকালে দেখা গেল যে চট্টগ্রাম কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোড ধরে হাজার হাজার লোক নিজ নিজ বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ২৮-২৯শে মার্চ রাতে পি, এন, এস, জাহাঙ্গীর যুদ্ধজাহাজ থেকে পাঞ্জাবীরা চট্টগ্রাম শহরে অত্যাধিক শেলিং করেছিল। শেলিং এর দরুন কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়। আগুনের ফুলকিতে মনে হয়েছিলো চট্টগ্রাম শহরে বুঝি পাইকারী ধ্বংসলীলা চলছে। এ অবস্থা দেখে বেসামরিক লোকেরা যার হাতে যে বন্দুক বা অন্য অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে তখন নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ ছিল না, তাই তারা অসংঘবদ্ধভাবে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছিল। ঐসব লোকদের আবার একত্রিত করে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবী বেতার থেকে অস্ত্র নিয়ে লোকদের আবার একত্রিত করে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবী বেতার থেকে অস্ত্র নিয়ে লালদীঘির ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ প্রচারিত হয়েছিল। সত্বর তাদের এক জায়গায় জমায়েত করতে হলে এ ধরনের ঘোষণা প্রচার ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বলা বাহুল্য, এই ঘোষণা এ-সময়ে বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত কয়েকজনের সাথে আলোচনা করেই প্রচারিত হয়েছিল।

 ঘোষণাটি কয়েকবার প্রচারিত হবার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ডক্টর এ, আর, মল্লিক আমাকে টেলিফোন করেন। লালদীঘির ময়দানে একত্রিত হওয়ার এই ঘোষণা সম্পর্কে তার সাথে আমার অনেক আলাপ হয়। তিনি আমাকে অবিলম্বে এই ঘোষণা প্রচার বন্ধ করতে বলেন। তিনি যুক্তি দেন যে, এই ঘোষণামতে যদি সবাই গিয়ে লালদীঘির ময়দানে একত্রিত হয় তাহলে হানাদাররা নিশ্চয় এই জমায়েতের ওপর পি,এন,এস জাহাঙ্গীর জাহাজ থেকে শেলিং করবে, এমনকি হাওয়াই হামলাও করতে পারে। ডক্টর মল্লিকের এই যুক্তিপূর্ন উপদেশে আবার আমাকে বেতার মারফত ‘লালদীঘির ময়দানে’ একত্রিত হওয়ার ঘোষণাটি বাতিল করে দিতে হয়।

 দুনিয়ার ইতিহাসে যেসব সশস্ত্র বিপ্লব হয়েছে তাতে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রথমে অর্গানাইজ করা হয়েছে এবং পরে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, হয়েছে বিপ্লব। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে ব্যাপারটি ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এক্ষেত্রে প্রথমে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, পরে হয়েছে সংগঠন- আমরা প্রথমে বিদ্রোহ করেছি, পরে শুরু করেছি বিদ্রোহীদের সংগঠন। ২৬শে মার্চ ভোরে যে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে তা আমরা অনেকেই ২৫শে মার্চের মধ্যরাতেও জানতাম না।

কুমিরার লড়াই[]

মেজর এম, এস, এ ভূঁইয়া

 ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যার আগেই ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করব; কিন্তু শত্রুর শক্তি বৃদ্ধির জন্যে কুমিল্লা থেকে যে ২৪নং এফ, এফ (ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স) এগিয়ে আসছে, তাকে বাঁধা দেওয়াই প্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো।

 তখন বিকেল ৫টা। ২৪নং এফ, এফ-কে প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আর ই-পি-আর এর মাত্র ১০২ জন যোদ্ধা সমবায়ে সংগঠিত দল নিয়ে এই অভিযানে আমরা বের হলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিমা হানাদার সৈন্যদলের মোকাবিলা করার জন্যে আমাদের সম্বল মাত্র একটি এইচ-এম-জি কয়েকটি এল-এম-জি আর বাকিসব রাইফেল। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পুরো একটি সুসংগঠিত ব্যাটালিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ঝুঁকি যে কি বিরাট এবং তার পরিণাম যে কি মারাত্মক হতে পারে সেদিন তা আদৌ উপলব্ধি করতে পারিনি তা নয়; আসলে মনটা ছিল তখন প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত: দেশের মুক্তি কামনায় উত্তপ্ত; ক্ষোভে, ক্রোধে, আবেগে উত্তেজিত। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করে পরিকল্পনা করার আদৌ অবসর ছিল না তখন। অন্য কিছু সম্বল না থাকলেও যুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে জিনিসের প্রয়োজন হয় সেই সাহস, সেই উদ্দীপনা, সেই উদ্দীপ্ত প্রাণের আকাঙ্খা ছিল আমাদের সম্বল। আমাদের এই অপরিমেয় মনোবল ও দুর্জয় আত্মবিশ্বাস সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি দিয়েছিল। এছাড়া ছিল পরম করুনাময়ের অপার করুনা যা বারবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে আমাদেরকে সাফল্যের স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। আজ আমার এ প্রত্যয় দৃঢ়তা লাভ করেছে যে, সত্য ও ন্যায়ের সেই পবিত্র চিরদিনই অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে এভাবেই সাহায্য করে থাকে।  আগেই খবর পেয়েছিলাম, শত্রুবাহিনী ফেনীর কাছে শুভপুরের ব্রীজ পেরিয়ে এগিয়ে এসেছে। অতএব, যত দ্রুত তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমার কথামত আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী ৫টি সাধারণ পরিবহণ ট্রাক এনে হাজির করলেন। তখন আমার সৈন্যবাহিনী ও জনসাধারণের প্রত্যেকেই যেন একটা যুদ্ধাংদেহী ভাব। তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন অনেকদিনের পুঞ্জীভূত বেদনা বঞ্চনা, ক্ষোভ, আক্রোশ বিদ্রোহের আগুনে ফুঁসে উঠেছে এবং তা দুর্জয় সংগ্রামের মাধ্যমেই যেন স্ফুরিত হতে চায়। চবিবশ বছরের পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের শাসন শোষণ ও অত্যাচার-উৎপীড়নের জগদ্দল পাথরকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলতে আজ সবাই যেন বদ্ধপরিকর।

 আমি আমার ক্ষুদ্র দলের ১০২ জন যোদ্ধাকে ৪টি ট্রাকে উঠালাম এবং বাকি ট্রাকটিতে কয়েকটি গুলির বাক্স উঠিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটি মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে চললাম। উদ্দেশ্যঃ এগোনোর সাথে সাথে পথের দুপাশে এমন একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজে নেওয়া যেখান থেকে শত্রুর উপর সাফল্যের সাথে প্রচণ্ড আঘাত হানা যায়। শুভপুরে সেদিন আমাদের যাত্রাপথের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমিয়েছে। তাদের মধ্যে কল-কারখানার শ্রমিকই বেশী। মুখে তাদের নানান শ্লোগান। হাজার কণ্ঠের সেই শ্লোগান আকাশ বাতাশ মুখরিত করে তুলেছিল। গত রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বর্বর বাহিনী কর্তৃক অতর্কিত আক্রমন, নির্মম হত্যা, পাশবিক অত্যাচার, বিশেষত: বেঙ্গল রেজিমেণ্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যে কোনোভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখনই তারা দেখতে পেল খাকি পোশাক পরা বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর এর জওয়ানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু তার শ্লোগান দিতে লাগল। জয় বাংলা, বেঙ্গল রেজিমেণ্ট জিন্দাবাদ, ই-পি-আর জিন্দাবাদ। এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈন্যদেরকে কি দিয়ে এবং কিভাবে সাহায্য করতে পারবে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত।

 আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলো তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। এমন সময় একজন বুড়ো লোক তার পথের পাশের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিল। বললোঃ স্যার আমি গরীব মানুষ কিছু দেওয়ার মত আমার ক্ষমতা নাই। এই নিন আমার দোকানের সিগারেট (সিগারেট ৩ কার্টুন ছিল); আপনার জওয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন। বৃদ্ধের এই সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। আর একজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এল। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো।

 আন্তরিকতা ও ভালবাসার সেই উপহার আমাদের মনকে আনন্দে উদ্বেল করে তুলেছিল। কেমন করে কি ভাবে তারা সেসব জিনিস যে সেদিন সংগ্রহ করেছিলেন তা ভাবলে আজও বিস্মিত হই।

 সন্ধ্যা তখন ৬টা। আমরা কুমিরায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য স্থানটি খুবই উপযুক্ত বিবেচিত হল। পথের ডাইনে পাহাড় এবং বামদিকে আধ মাইল দুরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা আছে এবং শত্রুকে এগুতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তার পিছনে একটি খাল ছিল। ঐ খাল থেকে ৫০০/৬০০ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকে আমি পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। খালটি একটি পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাধা নয়। তবু এটা পিছনেই রাখলাম। উদ্দেশ্য ছিল যদি বর্তমান পজিশন শত্রু আমাদেরকে ছাড়তে বাধ্য করে তখন খালের পারে পজিশন নিতে পারব। এটা ছিল আমার বিকল্প পরিকল্পনা। জমিনের স্বরুপ দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি করে নিলাম। আমার তিনজন প্লাটুন কমাণ্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী এইচ-এম-জি'টা ডানে পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। স্বয়ং ই-পি-আর  সুবেদার সাহেব ভারী মেশিনগানটির সংগে রইলেন। কারণ এই ভারী মেশিনগানটিই আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচেয়ে বড় সম্বল। আমি বামদিকের কয়েকটি এল-এম-জি'র পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশমত সবাই মাটিতে পজিশন নিয়ে নিল। পজিশনের অবস্থাটা হল অনেকটা ইংরেজী U (ইউ) এর মত। অর্থাৎ ডানে বায়ে এবং পিছনে আমাদের সৈন্য। যেদিক থেকে শত্রু এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা সাঁড়াশির হারের মত খোলা।

 কুমিরা পৌঁছেই মোটর সাইকেলযোগে একটি লোককে আমরা পাঠিয়েছিলাম শত্রুর অগ্রগতি সম্পর্কে খবর নিতে। এই মধ্যে সে খবর নিয়ে এসেছে যে শত্রু আমাদের অবস্থানের আর বেশী দুরে নেই। মাত্র চার পাঁচ মাইল দুরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ী চালিয়ে আসছে। যে লোকটিকে পাঠিয়ে ছিলাম সে পাঞ্জাবীদের নিকটে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে আমাকে জানালো যে পাঞ্জাবীদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কি যেন একটা কাঁধের উপর তাও কালো। তখন আমার সন্দেহ রইল না যে ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে।

 আমাদের অবস্থানের ৭০/৮০ গজ দুরে বড় একটি গাছ ছিল। জনসাধারণের সাহায্যে গাছের মোটা ডালটা কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলা হলো। গাছের ডাল দিয়ে আমাদের সুন্দর একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি হয়ে গেল। জনসাধারণ রাস্তার আশপাশ থেকে কিছু ইট এনে ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাখল।

 এত অল্প সময়ে জনসাধারণ কিভাবে গাছের ঐ মোটা ডালটা কেটে ফেলল এবং ইট সংগ্রহ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করলো আজ তা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। সৈন্যদের জানিয়ে দেওয়া হলো যে শত্রুসৈন্য যখন ব্যারিকেড সাফ করার জন্য গাড়ী থেকে নামবে এবং সাফ করার জন্য একত্রে জমা হবে তখন সকলে একযোগে শত্রুর উপর গুলি ছোড়া শুরু করবে। বিশেষ করে ভারী মেশিনগান দ্বারা অবিরাম গুলি ছুড়বে।

 প্রায় এক ঘণ্টা সময় আমাদের প্রতীক্ষার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধা তখন ৭টা। আমরা শত্রুবাহিনীর অপেক্ষায় উৎপেতে রইলাম। আমাদের সামনে শত্রবাহিণীর উপস্থিতি প্রায় আসন্ন বলে মনে হলো। আরো কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পরই সম্মুখসমরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ এলো। শত্রুবাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ব্যারিকেড দেখে সামনের গাড়ি গুলো থেমে গেল। কিছুসংখ্যক সিপাহী গাড়ী থেকে নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। এবং কেউ কেউ ইটগুলো তুলে দুরে ফেলে দিতে লাগলো। পিছনের গাড়ীগুলোও তখন সেই দিকেই এগিয়ে আসছিল।

 সন্ধ্যা তখন সোয়া সাতটা। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত এমনি সময়ে আমাদের ডানদিকের ভারী মেশিনগানটি গর্জে উঠল। শুরু হল শত্রনিধন পালা। চারদিক থেকে কেবল গুলির আওয়াজই শোনা যেতে লাগল। বারী মেশিনগানটি থেকে তখন মাঝে মাঝে ট্রেসার রাউণ্ড বের হচ্ছে। উহ্ সে কি দৃশ্য। শত্রুকে এত কাছাকাছি অতর্কিত অবস্থায় পেয়ে আমার মন খুঁশিতে নেচে উঠল। মনে মনে বললাম- তোমরা (পাঞ্জাবীরা) এতদিন মনে করতে বাঙ্গালীরা যুদ্ধ করতে যানে না। এখন যুদ্ধক্ষেত্রেই বাঙ্গালীরা তোমাদেরকে জানিয়ে দেবে তারা যুদ্ধ করতে যানে কিনা। হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করাই ছিল আমাদের লক্ষ। আমাদের আকস্মিক আক্রমনে তারা তখন হতকচিত। তাদের সামনের সৈন্যগুলির অনেকেই আমাদের গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাদের মৃত্যুকাতর আর্তনাদ আমাদের কানে আসছিল। যারা দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিল তাদের তাদের অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই শত্রুদের পিছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামলে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারি থেকে অবিশ্রাম গুলিবর্ষণ শুরু করল। এবার উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই লেগে গেল। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও শত্রুরা আমাদের ব্যুহ ভেদ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেল। আমাদের মেশিনগান নিউট্রালাইজ করার জন্য প্রচুর পরিমানে আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করল। কিন্তু আল্লার মেহেরবানীতে শত্রুর সকল প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেল। প্রায় দু'ঘণ্টা প্রানপন লড়ে তারা শেষ পর্যন্ত দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণে ভঙ্গ দিল।  ঘণ্টা দুয়েক এই লড়াই চলেছিল। উভয় পক্ষের গোলাগুলির শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। প্রথম দিনের লড়াইয়ে অর্থাৎ ২৬ তারিখের রাতেই শত্রুবাহিনীর ভীষন ক্ষতি হয়েছিল। শত্রুবাহিনীর কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ও একজন লেফটেন্যাণ্টসহ বিভিন্ন পক্ষের ১৫২ জন সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারিয়েছিল। আমরা শত্রুদের দু'ট্রাক এম্যুনিশন কবজা করি; আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের চৌদ্দজন বীর সৈনিক শাহাদাৎ বরণ করেন।

 কুমিল্লায় লড়াই চলেছিল সর্বমোট তিনদিন। শত্রু এই সময়ের মধ্যে তাদের আর্টিলারি ও মর্টার দিয়ে বারবার আক্রমণ চালিয়েছিল আমাদের বাহিনীর উপর। আবশেষে ২৮ তারিখে তারা ত্রিমুখি আক্রমন চালায়। পিছন থেকে তারা নৌবাহিনীর সাহায্যে আক্রমণ চালায়। সাগর থেকে গানবোট দিয়ে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। রাতের আঁধারে শত্রুরা পাহাড়ের উপর অবস্থিত টি,বি, হাসপাতালের নিকটে মেশিনগান বসায়। ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে আমাদের সৈণ্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে ২৮ তারিখে কুমিরা পাকিস্তানী সৈন্যের দখলে চলে যায়। কুমিরা পতনের পর হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়। তারা অগ্রসর হওয়ার সময় রাস্তার দুপাশে অবস্থিত সমস্ত গ্রাম ও হাটবাজার জ্বালিয়ে দেয় এবং সামনে যাকে দেখে তাকেই গুলি করে হত্যা করে। লোকমুখে শুনেছি কুমিরা পতনের পর রাস্তার দু'পাশে কয়েকদিন ধরে আগুন জ্বলেছিল।

 আমরা মনে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কুমিরার যুদ্ধটাই একমাত্র প্রথম যুদ্ধ, যেখানে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও তৎকালীন ই-পি-আর বাহিনী সম্মিলিতভাবে হানাদার বাহিনীর উপর এক প্রচণ্ড আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে ২৪ নং এফ-এফ'এর একটা পুরো কোম্পানী একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। একথা আমি জানতে পেরেছিলাম ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কাছে। তিনি কুমিরার যুদ্ধে ২৪ নং এফ-এফ’এ কর্মরত ছিলেন।

চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকার: লেঃ কর্নেল মাহফুজুর রহমান[]

২৫-৮-৭৩

 Thursday, the 25th March 1971. All offers of 8 E. Bengal were ordered by Lt Col Abdur Rashid Janjua, CO of the Bn, to clear the barricades made by the public in different areas of the city of Chittagong. A complete passenger train was brought by the public in the darkness of last night and put on the main road railway junction as barricade at Sholashahar near our battalion location. One of the full company under Capt (now Major Sadeq Hossain and almost all offrs of the battalion incl Lt Col Janjua were there on the road railway junction to remove the train.

 All civ public from around and labors of the local Indutri9es assembled there and started shouting not to remove the barricade. Capt. Ahmed Din (one of the Pakistani offr) got annoyed and said-"the only medicine to stop these bastards is firing." Lu Col Janjua was worried to the extreme to remove the barricades so that 20 Baluch from the Cantt can rush for the help in case of any danger. IIc probably could not believe his own battalion even.

 With lot of efforts, however, the train was removed. It took us about 5-6 hrs to do that. More than hundred vehs got jammed on both side of the road because of the trainbarricade. Public did not retaliate much with us probably thinking that we belonged to the E Bengal Regiment They were not very happy either with us. Some of the young students standing at a distance asked Maj (now Col) Shawkat- “Are not you in our group?” They probably expected E Bengal Regiment to join the public then and there, Major (now Col) Shawkat gave a little smile and replied-"Let the time come you will see."

 We could smell the overall situation all around was getting worse. Public were shouting all over the city. Procc3ssions were marching, barricades were made to stop communication. Most of the shops were closed, Groups of people were sitting here and there and discussing god knows what. One of the company of 8E Bengal under Sub Abdul Quader was sent along with a company of 20 Baluch to Chittagong Jetty to unload the arms- ammunitions freshly brought by SHAMS form Pakistan. Army was trying to unload the ship. But the public did not allow him to do that. We felt that a serious incident will happen.

 I myself with Lt. (now Captain) Shamsher Mobin Chowdhury were3 detailed in the evening with a company to guard the sholashahar Cantonment road by night so that no more barricades were put there. 2/Lt. Mohammed Humayun (Pak Offr) was also with me. Sometime at 11 o'clock night, while having rest with the coy at K- Rahman's COCA COLA factory, I received a tel call from the city. An unknown person in a panic and hurry was trying to pass an important message to some of his relative in the factory and asked my identity. I was no duty here3, 1 replied. The man thought me as one of the Police guard there in the factory and said- “we have received a telephone call now from Dacca that firing has started there, Pakistanis have started killing the public en mass and all are trying to face them." I thanked the unknown man for giving me such an information in telephone and dropped the receiver.

 As we approached a liule towards our unit at Sholashahar I found Subedar Sabed Ali Sarkar rushing towards me and whispered in Bengali to reach the unit line immediately. I understood the rest. Rushed with my troops at sholashahar and found Major (now Brig) Ziaur Rahman getting all of our troops closed together in the line.

 It took about an hour to get all the scattered troops from different places together. Maj (now Brig) Ziaur Rahman took over the Command of 8E Bengal and addressed the troops for few minutes- Tigers, Pakistanis have started killing Bengalis en mass they have already disarmed some of the E Bengal battalions, they have decided to kill all of us. They already trapped me but luckily I was saved. We will have to organize quickly and face them at any cost to save the country, are you all ready to do that with me? We all agreed and promised by the name of Allah to do that.

 One company of 8E Bengal had already moved few days ago as advance party to Kharia Cantt. In Pakistan. One company had to come from 5th, 6th and 7th E Bengal battalions in Pakistan. About a company strength troops had gone on privilege leave before they were proceeding to kharia; and a total of about 250 troops were available with 8E Bengla at that moment. Few months ago. On 30th October 1970 the battalion was born at sholashahar. As the unit was due for moving to kharia, all arms ammunitions, equipments. Stores, vehi8cles etc were kept ready there. This battalion borrowed some 150 rifles of 303 type form EBRC, one 106 mm RR and two 3 inch mortars form 20 Baluch without any ammunition for the training purpose only. Which luckily remained with the battalion. The sholashahar market where the battalion got raised was not an ideal place at all to defend it by staying there. Moreover, it was not possible for the battalion to operate conventionally at that very moment without having anything. So the decision was taken to leave the arca for the time being to organize somewhere outside the city and operate unconventionally

 At 2 O'clock morning, we left the unit line with all troops and arms-ammunitions available with the unit, crossed the Kalurghat road railway bridge and bade a temporary hide-out in the village. Next morning we got Capt. (now Major) IIarun Ahmed Chowdhury who escaped along what maximum of his IPR troops, arms, ammunitions form 17 wing Captain and joined us. It was God's mercy that we got such a huge number of arm-ammunition and readymade troops Many MCAs, leaders. well wishers met us there. A rough plan was made and in the darkness of the evening we kicked off for the city again.

 I took a temporary shelter with my company in a village on the other side of the Kalurghat railway bridge. Entered the city in complete disguise of a street beggar along with one of my sepoy and located the important positions held by the enemy in the city. Some of the high hills and the building s were under enemy's hand where they had been continuously firing from. Many of the high hills and building s were still unoccupied by anyone. Students were driving the hoodless vehicles at the maximum possible speed pointing their shot guns, 22guns outside. They were collecting food etc in Awami league offices and distributing them to many student fighters. Ansars Plices, Mujahids, Ex-defence personnel's etc.

 On 29th March 71. I was ordered to take defence on both side3 of the Kalurghat bridge and it was complete by that day. In the afternoon, one of the Pakistani C-130 flew over the bridge giving a doubtful look. We heard at night that some of the commando paratroopers were brought from Comilla and landed at Chittagong airport. At 8 O'clock night a motor launch approached our defence towards the bridge with a very powerful searchlight on. I told my troops not to open fire unless they were ordered. The steamer after having an over all look from a distance for half an hour got a side of the bank of the river and after sometime left the place. We did not know what had happened Whole night the troops remained awake in a suspense. Early in the morning at 0430 hrs we heard some firing sound very close to my defence.

 Early in the morning on 30th March 71, a civilian named Mohammed Asal approached me and started shouting 'En' 'En' Major (now Bring) Ziaur Rahman was with me, looked at my face and told to take a pl and face them. Having a big commander with me, I felt much courage to go for the first operation myself. Took a mixed pl of E Bengal an EPR in an army vehicle and started. The civilian guide Mohammed Asaf led us to such a place where the whole pl of mine came straight under en fire. We jumped out of the vehicle and took shelter behind some cover of houses and bushes. After approaching a little ahead we could locate the en posn. It was a triple storied big building of Agriculture department where the ends had taken shelter and started firing form.

 En had located my pl and opened up with MG and LMGS. The whole pl of mine is now on the forward edge of the small built up arca hardly 400-500 yds away from the en building. Once I tried to get a little more closer, the en MG opened up and I fell flat on the ground behind a small tree, it could not hit me. Sep Noor Mohammed of EPR with his LMG No. 2 started following me in the front behind the cover of the fold of tc3h land. En now opened up with all of his weapons. Along with civilian Asaf I crawled a little more ahead behind a sand dump and now the building was under my SMGs. range. The building was now almost encircled from three sides at a distance of 100-200 yd. Exchange of fire started between my pl and the en. It was easy for us to locate the en inside the building through the glass panes form 1" floor to 2nd floor. Suddenly a Rocket Launcher was fired from the building and that below a small mango tree behind which Sepoy Noor Mohammed of my pl was firing from his LMG. Miraculously the LMG No.1 and No.2 were not hit immediately after that another Rocket Launcher was fired now on my position which, God knows how, slipped on the top of the sand dump and burst behind me. I fell back and now started using my Rocket Launcher towards the building and that became very effective. At 1030 hrs. Two cn Sabre Jets arrived over my posn. Staffed and bombed the Radio Chittagong which was about 1000 yds in front of my present location and was occupied by our troops under sub sabed Ali Sarker.

 We could not capture the building during day time, immediately after the last night we encircled the building and started guarding it so that en cannot escape. No firing was there at night. Early in the morning nest day. I took the platoon and charged inside the building and found the following inside it:—

 Five en dead bodies, a half- dying Lance Naik who died later on and an alive but severely injured sepoy named Mohammed Akbar. When asked he said that he belonged to Ilamza Company of 3rd SSG (Command) battalion. A pl of 30 men under command Capt. Sajjad came at night and occupied the building with a view to blow up the Kalurghat railways bridge. The rest of the en fled a way in the darkness of the night leaving the following things behind:—

 MG 1A3 one LMG 7.62 Chinese- One G-3 Rifles-two, SMG-one, SMG 7.62 Chinese- two,40 mm Rocket Launcher-there with Rockets, Wireless set GRC-9 one, complete with all accessories. 7mm Walther pistol- one, vary light pistols- two, commando knife- onc, commando belts-7 pairs, commando boots-7 pairs, commando barels-8, 7.62 ammunitions-2,000 in belts and magazines and huge quantity of explosives.

 Thousands of public got together in the building and started cheering us. We collected all those captured arms and ammunitions and brought to my defence, unfortunately, en Sep Akbar also died on the way out of severe pain. The Chawkidar of the same agriculture building and the other public took those en dead bodies and buried them on the North-East corner of the building. In the afternoon Major (now Brig) Ziaur Rahman paid a visit to my defense. He was very glad to know about our success in 1st operation and to see the huge number of captured arms-ammunitions.

 Simultaneously, the battle was continuing in the city also. Capt. (now Major) Harun Ahmed Chowdhury and Lt. (now Capt.) Shamsher Mobin Chowdhury had a toughest battle at Chawkbazar in the entrance of the city where the 20 Baluch had used the tanks also. Many important places were coming under our occupation one by one. I extended my defence line further ahead from front of Radio Chittagong upto the river Karnaphuli occupying Ispahani, Lever Bros, FIDC etc. on 2nd April 71, en first time used 3 inches mortar on my defence. They burnt hundred of houses, shops ctc. by using the Phosphorus.

 I was ordered to shift my defence and occupy the Chittagong-Kaptai road junction facing Chittagong Cantonment. A complete village covering about a mile-long distance was occupied by one of my company. Chittagong Cantonment was a mile in front and Radio Chittagong was behind my defence. This defence of mine was strong cnough undoubtedly but the line of communication form the main defence at Kalurghat upto my position was too far and there was a big gap behind my position. I had been blocking the en from the front for two days alright, but I felt those were en's secondary attacks or false attacks. On 7th April en attacked Sub Sabed Ali's position at Radio Chittagong with a complete battalion and occupied it.

 Major (now Col) Shawkat, Who had been guarding the longest coastal areas en's landing from the ship and approaching from behind, fell back today and took over the command of half lost Kalurghat defence. I contacted him and asked for the help IIe gave me a new plan to take main defence at Madanaghat Bridge on the road Chittagong- Kaptai and to operate 2 miles ahead of the main defence in front of the enemy. One of the Ex Corporal Karim, a brave man, joined me with about a company strength of mixed troops. I made my permanent and strong defence on both sides of the Madanaghat bridge and started pushing the en from the front. Side and the rear.

 Major (now Col) Shawkat gave me a task to raid the en's one of the strong post at montec tannery 2 miles ahead of my defence at 1 night on 9th April 71, with which he wanted to coordinate a mortar fire support to me and one of his operation over the cn's position at Kalurghat. There was a village named Baniapara and Chowdhurypara very closed to the en defence which had to be used as hide-out and forming up place. The village was about 500 yds long and 200 yds wide and all around it was big open gap which was covered by en's fire from Montee tannery. It was not possible to cross that open gap and occupy the village during day time. I took a strong platoon and occupied it before 1 night on 8th April 71 and kept sitting for the whole day and praying for the evening to come. Thank god, en could not locate us, otherwise he could easily have encircled and killed us. In the evening we got closed to the tgt at a distance of 50-100 yds. We say a military car arrived with some 10-12 soldiers and started disembarking. As it was not possible for me to recede the tgt during day time I could not correctly locate the en disposition and assess their strength. I did not enter the buildings for physical assault. But we opened up with al weapons at a time. I had a Bihari L/Nk Salahuddin, whom I used to suspect, played an important role in that operation by using 83 mm Blendicide against that en mil dodge and the buildings. We fell back quickly within 45 minutes. Immediately after that our Morter opened up and started firing from Kalurghat. We came to a safety distance and observed the shells bursting more or the Kalurghat Bridge on en position and recaptured it. L/Nk Naib Ali became first Shahid of 8 E Bengal in that operation at Chittagong.

 En tried his best to capture both Kalurghat and Madanaghat on 9" and 10" April 71 with more than a bn str but failed. On 11". PNS JAHANGIR and a regiment of field artillery started tremendous pounding from morning simultaneously on both the bridge. A Coy of 31 Punjab was pushing me frontally from the main rd ChittagongKaptai axis. It become very difficult to hold them anymore. I had to bring a pl?rom the depth, other side of the bridge, and put in front. It cannot be expressed the amount of fear we had because of the en by shelling. En pressed harder on the Kalurghat bridge and captured it. Capt. (now Capt) Shamsher mobin Chowdhury fighting gallantly got hit and caught by the Pakistanis.

 I was told to hold my position for sometime till the main bulk of our force could withdraw at a safer distance. I was now alone holding Madanaghat Bridge with 2 coy str. At 1400 hrs en started pounding again from JAHANGIR tremendously this time around the bridge and on my defence. More than a coy on the other side of the bridge and less than a coy was on the en's side of the bridge towards Chittagong city. I got another brave civilian of that area named abdas on the other side of the bridge and told him not to leave the place until I came back. Once IK crossed the bridge and came to my forward line, the en attacked the position and covered the bridge by fire.

 If I had allowed the en to come a little more ahead, we would not have ever crossed the river then. En arty was shelling on our rear now to block the withdrawal. Many thanks to god, a furious storm started and I thought it an opportunity and let my forward troop fall back by country boats through river making a long detour. After two hrs we could come on the other side of the river and joined my main defence without any casualty. It was not possible to remain this side of the river bank also, as the bridge was intact and the en shelling was still continuing, so I decided to withdraw and take an alternate defence at a suitable place few miles in the rear. Suddenly, I remembered Abbas and thought, probably the area was shattered by the en shelling and he must have left long ago. But still I felt deeply to have a look to that area along with Ex-Corporal Karim and my batman Sep Manik Mia of 17 Wing EPR. It was beyond our imagination to see the brave man still standing like a solid rock by the side of main road with his vehicle and waiting for us. He was with me throughout the liberation war in many risky places. He accepted that as best award.

 I took another temporary defence at Noapara College, few miles away from Madanaghat, by the 1” night same day. En did not cross the bridge at night Next morning on 14th April, I received more troops from here and there who had been deserting from the battle and put them in my defence. One of them was Havilder Arab Ali who was the driver of Brig MR Majumder. IIe escaped from the Pakistani cell at Chittagong Cant. Was mercilessly beaten and half dead.

 The greatest blunder I made there I left my troops under a senior JCO of EPR there and went to the rear at Kaptai with Ex Corporal Karim to know the location of our main bulk of force who left Kalurghat yesterday. After reaching at Kaptai I came to know the our forces had already left for Rangamati for onward proceed to Kahgrachhari. I found my troops running scatteredly. En had already attacked my position and shattered everything. Out of about 2 coy str I could collect hardly 2 scattered Pls and with that I started withdrawing in search of our main force in the rear.

 I reached Khagrachhari on 13th April 71 and met with all officers and troops. Major (now Brig) Ziaur Rahman, who had been holding many en fronts like Shobhanpur-Chhagalnaiya rd, Karcrhat-Chittagong rd, Nazirhat-Chittagong rd and also our front, came there at Khagrachhari and gave us a new plan to hold Rangamati front by the axis river Chengi. We all came back to Mahalchhari on 14th April and made our Tac HQ. Troops were reorganized and distributed for different places. Major (now Brig) Ziaur Rahman took Capt. (now Major) Khalequzzaman, Capt. Aftab Quader and a pl and left for Ghagra RH on 15th April 71. I took a pl along with Sub Khairuzzaman of EPR. Ex Corporal Karim, two civil offr-one was Mr. Ishaque a Chemical Engineer of KPM and the other was Mr. Murree of Chandraghona an International Football Player, two brave students-one was Farooque Ahmed and the other was Shawkat Ali (both of them Lt. now) and left for Burighat bazaar short of Rangamati Sub. Abdul Mutaleb with a pl left for Kutukchhari short of Rangamati by rd. For few days we had been raiding, ambushing and harassing the en around Rangamati. On 17th April, an cn pl in motor launch bumped into Capt (now Major) Khalequzzaman and Capt. Aftab Quader's island blindly and suffered by casualty. On 18then with a coy str in 2-3 launches encircled Capt: Khalequzzaman's island, pounded heavily and attacked. L/Nk Munshi Abdur Rob of 8 E Bengal died gallantly in that operation. En contacted Mizos and had complete control over them during last few days. They reached around Mahalchhari our Tac HQ and started operating. We were called back and asked to guard the Tac IIQ.

 On 27th April, en about 2 coy str along with more than thousand Mizos concentrated near our Tac IIQ. Unluckily one of our recce patrol bumped into their hide out. Finding on other alternative, en had to launch an unplanned attack on Capt. (now Major) Khalequzzaman's Coy, ahead of Tac IIQ. Major Shawkat sent me with a pl to reinforce Capt. Khaleq. By the time I reached there found Capt. Khaleq's Coy was more or less encircle. I blindly dashed with my pl and occupied Capt. Khaleq's Coy left over trenches and opened up. My right sec under Sub. Saqbed Ali fell just on the nose of the en but made a good effort to let Capt. Khaleq to extricate safety with some of his troops. T fell with two Secs under the direct frontal fire of the en. Hundreds of Mizos in green camouflaged uniform running in front towards us through jungle. Sep (now Nk) Razzaque LMG man of left See killed many in front but finished his all ammunitions and started shouting. Only one LMG of right see now was still continuing. But still en was probing forward having lot of cas. I shouted for my left sec comd to pull back followed by right Sec. Once we fell a little back. Major Shawkat opened up the MG from Tac IIQ on to the en. I pulled my pl intact luckily and joined Maj Shawkat. Sub. Loni mia of EPR one of my sec comd showed extraordinary bravery in this operation. En kept his momentum and now started pounding with 3 inch mortars heavily at our Tac HQ. We did not have a single 2 inch mortar even to retaliate. We could see the pak troops kicking the Mizos form the rear to advance. We had to hold a wider frontage to stop en advance by running from left to right and encouraging own troops. It was our misfortune Capt Aftab Quader got a burst on his left chest which pierced through the right and died with few seconds. We lost another of the bravest soldier. His dead body was sent along with two students (now Lt) Shawkat and Farooq through en hy fire to Ramgarh and buried respectfully in front of the post office. Immediately after the 1st night we pulled back. The Tac IIQ. Which we had been holding for half a month, we saw burning.

 On 28th April, we reached Guimara via Khagrachhari and took another defence. Next day, we got signal to fall back to Ramgarh, as because the en was pushing own forces from Karerhat-Nazirhat sides simultaneously towards Ramgarh. On 30th Col (now Gen-retd) MAG Osmany paid an honorable visit there, met our troops and ordered to hold Ramgarh for 24hrs. Capt (now Major) Oli Ahmed with his Coy was In defence at Chikanchhara 5 miles ahead of Ramgarh and I took my Coy and took defence as reserve at baganbari BOP a mile short of Capt Oli's position. En attacked Capt Oli's position with a bn supported by arty. He resisted the en with maximum of his effort effectively and fell back to Ramgarh. En now was in my front and started driving having a continuous interval, in the process he also suffered a good number of casualty. On 2 May 71, from 10 o'clock morning till 3 o'clock evening, we had been vengaging and holding the en too right. Then they started using the arty heavily. Many of the en shells landed very close to us, but we were miraculously saved. Once at Mahamuni Buddha Mandir, 2 miles ahead of Ramgarh, one of my pl along what me got stuck and could not be extricated while falling back in leap frog manner, one of Sub Loni mia's, Sub Anwar of 8 E Bengal came out daringly with his LMG straightway on the road and gave me covering fire and by that only the pl come out Now we were under observation of our own MG at Ramgarh. Once we got a side Major Shawkat opened up with MG for last. We left Ramgarh alos, last piece of land of Bangladesh, and crossed over to Sabrum in the evening.

স্বাক্ষরঃ
২৫-৮-৭৩

চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রাসঙ্গিক কথা

॥ চরম আঘাতের সেই রাত॥

 ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। বৃহস্পতিবার।

 অন্যান্য দিনের মতো সকাল ৭টায় আমি অফিসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পশ্চিম পাকিস্তানী মেজর ইকবাল বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, “মিঃ রফিক, আপনাকে দারুণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনেক খাটুনি গেছে আপনার ওপর দিয়ে। কক্সবাজার গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিন না কেন? ইচ্ছা হলে আজই যেতে পারেন। আমি কমাণ্ডিং অফিসারকে বলে দেব।”

 এটা ঠিক, গত কয়েক বছরের মধ্যে আমি কোন ছুটি নেইনি। বিশ্রামের আমার খুবই প্রয়োজন ছিলো। তবু মেজর ইকবালের সেদিনের অস্বাভাবিক পীড়াপীড়ি আমার ভালো লাগলো না, বরং আমার সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করলো। তাঁকে আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম, “ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু স্যার, আপনি তো জানেন গত জানুয়ারী থেকে সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে।”

 “ওকথা বাদ দিন। আমি কমাণ্ডিং অফিসারকে বুঝিয়ে বলতে পারবো। আমার বিশ্বাস, তিনি ছুটি মঞ্জুর করবেন।” মেজর ইকবাল তবু বলে চললেন।

 মেজর ইকবাল যে কমাণ্ডিং অফিসারের একজন প্রিয়পাত্র তা আমরা সবাই জানতাম। আমাকে চট্টগ্রাম শহরের বাইরে এবং আমার সৈন্যদের সংস্পর্শ থেকে দুরে রাখার জন্যে মেজর ইকবালের এ প্রচেষ্টা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি তাঁর কথায় তাল না দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, “আপনি বোধকরি জানেন, গতকাল পোর্ট এলাকায় জনতার ওপর সৈন্যরা গুলি চালিয়েছে অনেক লোক মারা গেছে।”

 “অনেক নয়’- যেন তেমন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন, “মাত্র একজন কিংবা দু'জন আহত হয়েছে।”

 এরপর তিনি মুখে কৌতুহলোদ্দীপক হাসি ফুটিয়ে বললেন, “শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক পদক্ষেপের প্রতিবাদে আগামী ২৭শে মার্চ হরতাল ডেকেছেন।”

 “আমি এখনো শুনিনি তবে পোর্ট এলাকায় যে সৈন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তার শব্দ আমাদের অফিসে বসেও শোনা গেছে।”

 সেদিন বেলা ২টায় আমি ই-পি-আর সদর দফতর ত্যাগ না করা পর্যন্ত মেজর ইকবাল সারাক্ষণ আমাকে ছায়ার মতো অনুসরন করলেন।

 ইয়াহিয়ার সাথে মীমাংসায় পৌঁছা গেছে বলে এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে নির্ভরযোগ্য কোন মহল থেকে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলো না। সরকারী বেতারে একটা রাজনৈতিক ফয়সালার আভাস দেয়া হয়। কিন্তু এ খবরের ওপরও নির্ভর করা গেলো না। বাসা থেকে সেই মুহুর্তে আমি আমার সদর দফতরে টেলিফোন করে সকল সৈন্যকে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলাম। তারপরে বাড়ির লনে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম।

 চট্টগ্রামে বেল ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে ডাঃ জাফর আমার বাসায় এলেন। লনে বসে আমরা সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু তখনো ঢাকার কোন নির্ভরযোগ্য খবর আমরা পাইনি। রাত ৮টার দিকে ডাঃ

[] জাফর ঢাকার কোন সংবাদ এসেছে কিনা জানার জন্য আওয়ামী লীগ অফিসে দিকে গেলেন। আমি আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে নিয়ে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়ার জন্য বাসার ভিতরে গেলাম। খাওয়া কেবল শুরু করেছি, এমন সময় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীসহ ডাঃ জাফর আবার ফিরে এলেন। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট।

 “মনে হচ্ছে আলোচনা ব্যার্থ হয়েছে। প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া গোপনে করাচী চলে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে পড়েছে বলে খবর এসেছে।” তারা দু'জনই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এতো উত্তেজিত ছিলো যে তাদের মুখ দিয়ে যেন কথা সরছিলো না।

 “আপনি কি সত্যি সংবাদ বলছেন?” তবু আমি ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম।

 “হ্যাঁ। ঢাকা থেকেই আমরা এ খবর পেয়েছি। খবর পেয়েই আমাদের দল জনাব সিদ্দিকীর বাসায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে জনাব সিদ্দিকী আমাদেরকে অবিলম্বে আপনাকে ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে বলেছেন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আপনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতগুলো কথা বলে উভয়ে একটু থামলেন এবং গভীর আশা নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাদের দু'জনকেই বিষন্ন দেখাচ্ছিল। আমি শুনতে পেলাম, কে যেন খুব নিচু গলায় বলল, “এবার আপনার পালা।”

 তখনও আমরা হাত ভাতের থালায়। মুহুর্তের জন্য আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। ওদিকে আগ্রহী আগন্তুকদের স্থির দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ।

 সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তারা ভয়ানক কিছু ঘটাবে। সব চাইতে খারাপ কিছুর কথাই এখন আমাদের ভাবা উচিত। ৩রা মার্চ থেকেই ওরা নির্বিচারে বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে শুধু ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম পোর্টে ২০ জনেরও বেশী লোক নিহত হয়েছে। আরো খবর পেয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্বত্রই ওদের হত্যাকাণ্ড চলছে- ঢাকা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহীসহ আরো অনেক জায়গায় গুলি চলেছে। ২৫শে মার্চ সন্ধায়ও এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম ই-পি-আর- এর দুটি ওয়্যারলেস সেটই ঢাকার পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলো না। এমন কোন দিন ঘটেনি। সন্দেহ আগে আগে থেকেই গভীরতর হয়ে উঠেছিল।

 এসব দ্রুত আমার মানসপটে ভেবে উঠলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে জেনেছি, ওদেরকে কোন জায়গায় একবার লেলিয়ে দেয়া হলে হেন নৃশংসতা নেই যা ওরা করতে পারে না। ইয়াহিয়ার আকস্মিক ঢাকা ত্যাগ, আলোচনা ব্যার্থ হওয়া এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে সেনাবাহিনীর বের হওয়া- সবকিছু মিলিয়ে একটা বেপরোয়া হত্যালীলার সুস্পষ্ট আভাস পাচ্ছিলাম। আরো আশংকা করছিলাম, সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালী সৈন্যরাও ওদের হাত থেকে নিস্তার পাবে না।

 এ সময় নিজের ভেতর থেকেই আমি যেন এক অলৌকিক সাহস অনুভব করলাম। মনে হলো আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে আমার নিজের জীবন এবং আমাদের অন্যান্যের জীবন রক্ষার জন্য এ পশুশক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এর পর আমি 'হয় স্বাধীনতা অর্জন, না হয় ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে মৃত্যু' এ ধরনের এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। ডাঃ জাফরকে বললামঃ “আমাদের ষোলশহর এবং ক্যাণ্টনমেণ্টে গিয়ে বাঙ্গালী সৈন্যদেরকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলুন। তারপর রেলওয়ে হিলে আমার সদর দফতরে দেখা করবেন।”

 খাওয়া থেকে উঠেই আমি হালিশহরে ই-পি-আর সদর দফতরে ফোন করলাম। সেখানে বাঙ্গালী জেসিও'রা আমার নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তাঁদেরকে বললাম, “এক্ষুনি সব ফাঁড়িতে দ্বিতীয় সাংকেতিক বার্তাটি পাঠিয়ে দিন। অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের রুম থেকে বের হতে দেবেন না। নৌ-বাহিনী সদর দফতরের দিক থেকে হামলা হতে পারে। সেদিকে প্রতিরক্ষামূলক কিছু সৈন্য মোতায়েনের ব্যবস্থা করুন। আমি আসছি।

 রাত তখন ৮টা ৪৫মিনিট। আমি শেষবারের মত আমার সারসন রোডস্থ বাসভবন ত্যাগ করলাম। আমাদের প্রথম লক্ষস্থল অয়্যারলেস কলোনীর দিকে আমাদের গাড়ী ছুটে চললো। আমার পাশে ড্রাইভার কালাম এবং পেছনের সিটে দুজন রক্ষী। তীব্র উত্তেজনায় সবাই ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো। রাস্তা জনমানবশূণ্য। আমাদের গাড়ী যতই অয়্যারলেস কলোনীর কাছাকাছি এগোচ্ছিলো, উত্তেজনা ততই বাড়ছিলো। একটা সরু রেল ক্রসিংয়ের ওপর আসতেই জীপ একটু লাফিয়ে উঠলে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এখান থেকে আমি অয়্যারলেস স্টেশনের এ্যানটিনা দেখতে পাচ্ছিলাম। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসাবে আয়্যারলেস স্টেশনের চারদিক ছিল কাটা তারে ঘেরা। যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য আমি ড্রাইভারকে গাড়ী আস্তে চালাতে বললাম। আমাদের এখানকার সাফল্য ছিলো অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যান্তরীণ নিরাপত্তামূলক ডিউটিতে নিযুক্ত ই-পি-আর-এর একটি প্লাটুনের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের ৪ জনকে ওদেরকে নিরস্ত্র করতে হবে। আমার রেকর্ড অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন হায়াত এবং সুবেদার হাসমত এই প্লাটুনের কমাণ্ডে ছিলেন। বাকী সেনারা সবাই ছিলো বাঙ্গালী। আমাদের জানামতে এখানে আরো তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো। অনুরুপভাবে নগরীর অন্যান্য এলাকাতেও ই-পি-আর প্লাটুন অবস্থান করছিলো। তবে অয়্যারলেস কলোনীর এই প্লাটুনটিই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের কমাণ্ডে ডিউটিরত ছিলো।

 গেটে পৌঁছতেই প্রহরারত শাস্ত্রী জীপ থামিয়ে দিলো। বাঙ্গালী শাস্ত্রী প্রহরারত ছিলো। সে আমার জীপটি ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো। আমরা ক্যাপ্টেন হায়াতের রুমের সামনে গিয়ে জীপ থামালাম। সেখানেও একজন শাস্ত্রী পাহারা দিচ্ছিলো।

 সাবধানে আমি হায়াতের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, হয় সফল হবো, না হয় আমার মাথা ভেদ করে একটা বুলেট বেরিয়ে যাবে। শেষেরটি সত্যি হলে চট্টগ্রামের ই-পি-আর সেনা পরিচালনা করতে আর কোন বাঙ্গালী অফিসার থাকবে না। এই চিন্তা আমাকে কিছুটা বিহবল করে তুললো ক্ষণিকের জন্য।

 আমি খুব আস্তে দরজায় নক করলাম এবং বন্ধুসুলভ গলায় বললাম, “হ্যালো হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?”

 এই কেবল শুয়েছি স্যার। আমার গলার স্বর চিনতে পেরে সে আলো জ্বালালো। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে আমি দেখলাম বালিশের তলা থেকে কি যেন একটা নিয়ে সে তার শোবার পোশাকের নিচে রাখছে। দরজা খোলার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো।”

 “সব ঠিকঠাক হ্যায়” জবাব দিয়েই সে দরজা খুললো।

 “প্লিজ ভেতরে আসুন স্যার, এবং “

 তার কথা শেষ না হতেই আমি ষ্টেনগান তার বুকের ওর ধরে বললাম, আমি দুঃখিত হায়াত, তোমাকে গ্রেফতার করতে হচ্ছে। হঠাৎ সে তার পিস্তল বের করার উদ্যোগ নিতেই ড্রাইভার কালাম দ্রুত এগিয়ে আসে এবং দুজনেই হায়াতের মাথায় আঘাত করি। সাথে সাথে আমরা তার হাত ও মুখ বেধে ফেললাম এবং টেলিফোনের তার কেটে দিলাম। তারপর পাশের ব্যারাকে ঘুমন্ত সুবেদার হাসমতকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালাম। সুবেদার হাসমত চোখ মুছতে মুছতে উঠে এসে স্যালুট দিয়ে দাড়াতেই কালাম এবং অন্য প্রাহরীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাসমতকে আটক করে তার হাত ও মুখ বেঁধে ফেলা হলো।  হায়াতের রুমের সামনে দাড়ানো শাস্ত্রীটি এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে এইসব অদ্ভুত ঘটনা দেখছিল। হঠাৎ কি মনে করে সে একটি টিলার দিকে দৌঁড় দিলো। কালাম ফিসফিস কণ্ঠে বললে, ও পশ্চিম পাকিস্তানী এবং পর মূহুর্তেই একটি বুলেট সাঁ করে চলে গেলো। আমরা নীচু হয়ে বসে পড়লাম। ব্যারাকগুলো থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে পড়তে লাগলো। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় আমি বললাম, শাস্ত্রী ভুল করে গুলি ছুঁড়েছে। তারপর সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাড়ানোর নির্দেশ দিলাম। অন্য তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পন করলো। যে শাস্ত্রী গুলি ছুড়েছিলো সে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেলো। এই প্লাটুন থেকে আমি ১০ জন সেনাকে রেলওয়ে হিলে আমার সম্ভাব্য সমর-দফতর রক্ষা করার জন্য পাঠালাম। অন্যদেরকে হালিশহরে আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন দিকে কয়েকজন বার্তাবাহককে পাঠালাম এবং চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য সবাইকে অবিলম্বে হালিশহরে আমার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিলাম।

 অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি দুঃসাধ্য কাজ সমাধা হলো। ড্রাইভার কালাম এবং দুজন প্রহরীকে ধন্যবাদ, তারা জীবন বিপন্ন করে এ কাজে সহায়তা করেছে।

 রাত সাড়ে নটায় আমরা হালিশহরে পৌঁছলাম। ড্রাইভার কালামকে সতর্ক করে আলো নিভিয়ে দিয়ে গাড়ী আস্তে চালাবার নির্দেশ দিলাম। হালিশহরে জেসিও এবং এনসিওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তিনটি অস্ত্রাগাড়ের সবকটিই অমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলো। বাঙ্গালী সেনারা যার যার অস্ত্রাগারের সামনে অস্ত্র ও গুলির জন্য সমবেত হয়েছে। মাত্র একমাস আগে আমরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে বিপুল পরিমান চীনা হাতিয়ার ও গোলাগুলি পেয়েছিলাম। এগুলো মিলিয়ে আমাদের মজুত ছিলো উদ্বৃত্ত, যা পরে খুবই কাজে লেগেছিলো।

 হালিশহরের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ন। এখানে ছিল প্রায় ৩০০ পশ্চিম পাকিস্তানী-ই-পি-আর সৈন্য। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো সিনিয়র জেসিও এবং এনসিও। নিঃশব্দে এদের পরাভুত করতে হবে কেননা আমার সদর দফতরের চারপাশের এলাকায় ছিলো অবাঙ্গালীদের ঘন বসতি। এছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক কমাণ্ডো সেসব অবাঙ্গালীর সঙ্গে বসবাস করছে বলে আগেই খবর পেয়েছিলাম এবং কমাণ্ডো ও অবাঙ্গালীরা সবাই ছিলো পুরোপুরি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কাজেই এখানে কোন শব্দ হলে গোটা ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে যাবে।

 অস্ত্রাগার আমাদের কব্জায় থাকায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম। শুধু একটি মাত্র বিপদ ছিলো, কেউ যদি গোপনিয়তা ফাঁস করে দেয় তাহলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে কিংবা নৌবাহিনী সদর দফতর থেকে পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের প্রচেষ্টা বানচাল করতে ছুটে আসতে পারে।

 আমরা প্রথমে সমগ্র এলাকা ঘেরাও করে ফেললাম যাতে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাতে না পারে। এরপর শুরু হলো শত্রুসৈন্যদের গ্রেফতারের পালা।

 মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনেক বাঙ্গালী জেসিও এবং এনসিওকে সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে চট্টগ্রামের ই-পি-আর সদর দফতরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মোতায়েন করা হয়েছিলো। চট্টগ্রামের ই-পি-আর কমাণ্ডার ছিলেন লেঃ কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ। নিজেদের অবস্থান সুদৃড় করার জন্য ঢাকার নির্দেশে তিনি এই ব্যবস্থা করছিলেন।

 এইসব বদলী ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে আমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলাম। পরে দেখলাম যে, এটা আমার পরোক্ষ উপকারেই লেগেছে। কারণ, এক জায়গায় এতগুলো শত্রুসৈন্য পাওয়া কম সৌভাগ্যের কথা নয়।

 আমি কৌশলে অস্ত্রাগারে বাঙ্গালীদের মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। দিনের বেলা আমি শুধু বাঙ্গালী সেনাদের চুলকাটা, পোশাক ও আচরণ পরীক্ষা করে দেখতাম। এদেরকে সংশোধনের অছিলায় শাস্তি হিসাবে অস্ত্রাগার প্রহরার অতিরিক্ত ডিউটি দিতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাতের এই ডিউটি পড়তো। ফলে অস্ত্রাগারের কাছে আর কোন পশ্চিম পাকিস্তানীর থাকার দরকার হতো না। আমার এই ব্যবস্থা খুবই কাজে লেগেছিলো। তখন রাত ১০টা। আমি আমার অফিসের বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। ভীষণ ক্ষুধা বোধ করছিলাম। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। পানি পর পর দুগ্লাস খেয়ে দেখলাম। সৈন্যদের ইতিমধ্যে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়ে গেলো। নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে কোন হামলা হলে তা প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুন এর মধ্যেই সেদিকে পাঠানো হয়েছিলো। আমি পশ্চিম পাকিস্তানি সবচাইতে সিনিয়র জেসিও সুবেদার মেজর ইতবার-এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

 কোনরূপ সন্দেহ না করেই সুবেদার মেজর আমার অফিস রুমে প্রবেশ করলেন। আমি তাকে বসতে বললাম। তারপর বললাম, “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন। শহরে কি ঘটেছে জানেন কিছু?”

 “না স্যার”- সরলভাবেই তিনি জবাব দিলেন। আসলেও তিনি কিছু জানতেন না। তিনি শুধু দেখছেন যে, সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে এবং তিনি এটাকে আমার নেতৃত্বে অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ডিউটির অঙ্গ বলে মনে করেছিলেন। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ গণহত্যা পরিকল্পনার কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করায় ব্রিগেডিয়ারের নিচের পদের খুব কমই এ ব্যাপারে জানতে পারে। মাত্র কয়েকজন লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল এ ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন। এ কড়াকড়ি গোপনিয়তা প্রকারান্তরে আমাদেরই কাজে লেগেছিলো।

 সুবেদার মেজর হঠাৎ চোখ কচলে দেখলেন পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে চারজন সৈন্য বেরিয়ে এসে রাইফেলের বেয়োনেট তাঁর বুকের ওপর ধরেছে। আমি তখন দৃড়কণ্ঠে বললাম, “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। চীৎকার কিংবা পালাবার চেষ্টা করলেই প্রাণ হারাবেন।”

 তাঁর হাত বেধে বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। এভাবেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সকল পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে গ্রেফতারের পালা শেষ হলো। এ গোপনীয়তা রক্ষা না করলে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যেতো। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সুদৃড় হবার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীর লোকেরা আমাদের আক্রমণ করে বসতো।

 এর কিছু পরেই ই-পি-আর সিগন্যাল কোম্পানীর দায়িত্বে নিয়োজিত অবাঙ্গালী জেসিও সুবেদার মোবিনকে আমার কক্ষে ডাকলাম। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ই-পি-আর সেনারা কিছু একটা ঘটেছে বলে আচ করে ফেলে। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের আর কিছু করার ছিলো না। কেননা, গোটা এলাকা আমাদের সৈন্যরা আগেই ঘেরাও করে ফেলেছিলোঃ

 সুবেদার অফিসে ঢুকতেই দেখি সে খুব অতঙ্কিত। ঠিক এ সময়ে মেজর ইকবালের টেলিফোন এলো। আমি রিসিভার তুলে ধরতেই ওপাশ থেকে তিনি বললেন, হ্যালো রফিক এতো রাতে ওখানে কি করছেন?

 “এখানকার গার্ডরা সতর্ক আছে কিনা, দেখতে এসেছি।”

 “আচ্ছা। মুহুর্তের জন্য তিনি থামেন, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করেন, সুবেদার মোবিন কোথায়?”

 “তিনি হয়তো রুমে ঘুমাচ্ছেন। কথা বলবেন তাঁর সাথে?”

 “হ্যা, দয়া করে টেলিফোনটা তাকে দিন না।”

 “আমি এক্ষুনি তার কাছে লোক পাঠাচ্ছি। তিনি এলেই আপনাকে ফোন করতে বলবো।” সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি আরো কিছুক্ষন তার সাথে আলাপ চালিয়ে যাই, সৈন্যরা ডিউটি দিচ্ছে কিনা তা কয়েকটি জায়গায় দেখে এসেছি, সবকিছু ঠিক আছে।”

 এরপর হঠাৎ তার প্রশ্ন শুনে ধাক্কা খেলাম। “কিন্তু ক্যাপ্টেন হায়াতের টেলিফোন কেউ ধরছে না কেন?”  “ওহ! ওর টেলিফোনটা খারাপ। এইমাত্র ওর ওখান থেকে এলাম। সুন্দর এক কাপ চা খাওয়ালো।”

 “ইয়ার! কভি হামকো ভি লে চলো চায়ে পিনে কে লিয়ে। মেজর ইকবাল বললেন।”

 “কালকেই নিয়ে যাব।”

 এরমধ্যে চারজন সিপাই সুবেদার মোবিনকে বেধে ফেললো। বাইরের কেউ জানতেও পারলো না আমার রুমে কি ঘটছে। মেজর ইকবাল টেলিফোন রেখে দিলেন। আমি একটি বেয়োনেট চেয়ে নিয়ে সুবেদার মেজরের গলায় ধরে বললাম, আমার অধীনে এতদিন কাজ করে নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি কেমন। এখনই মেজর ইকবালের সাথে আপনাকে কথা বলতে হবে- আমি যেভাবে বলবো ঠিক সেভাবেই জবাব দিয়ে কথা না বললে মেরে ফেলবো। বুঝতে পারছেন?

 ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার কথায় তিনি সম্মতি জানালেন। আমি ইকবালের নম্বরে ডায়েল করে সুবেদার মোবিনের কানের কাছে রিসিভার ধরলাম। ওপাশের কথা শোনার জন্য আমি মাথা নীচু করে রিসিভারের কাছে কান রাখলাম।

 “হ্যালো স্যার, আমি সুবেদার মোবিন বলছি।”

 “মোবিন সাহেব, আপনার কাছে আর কেউ আছে কি? মেজর ইকবাল প্রশ্ন করেন। আমি মাউথ পিসে হাত চাপা দিয়ে মোবিনকে বলতে বললাম। বুলন এখানে কেউ নেই। সুবেদার আমার নির্দেশ মত তাই বললেন।

 “কিন্তু ক্যাপ্টেন রফিক তো ওখানে ছিলেন, কোথায় গেলেন তিনি। এবারও আমি টেলিফোন চেপে ধরে তাকে যেভাবে বলতে বললাম তিনি সেভাবেই জবাব দিলেন, ক্যাপ্টেন রফিক এই মাত্র সুবেদার মেজর ইতবারকে নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন।”

 “কোই গড়বড়?”

 “না স্যার। সব কুছ ঠিকঠাক হ্যায়। সুবেদার মোবিন অত্যান্ত অনুগত জবাব দিলেন।

 “বহুত আচ্ছা! আজ রাতের জন্য আপনিই ডিউটি অফিসার। টেলিফোনের পাশেই অপেক্ষা করবেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।”

 “ঠিক হ্যায় স্যার-”

 বিরাট একটা দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। বন্দী সুবেদার মোবিনের প্রহরায় একজন বাঙ্গালী জেসিওকে রাখা হলো যাতে সে আবার টেলিফোনে কিছু উল্টাপাল্টা বলতে না পারে।

 রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনিয়র বাঙ্গালী জেসিও সুবেদার জয়নাল খবর দিলেন যে, কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শহরে ই-পি-আর এর সকল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আটক করতে সক্ষম হলাম। সীমান্ত ফাড়িগুলোতেও আমার সাংকেতিক বার্তা দুটি পৌঁছে গেছে বলে খবর পেলাম। বার্তা দুটি পেয়েই রাত ৮টা ৪০মিনিট থেকে ৯টা ৩০মিনিটের মধ্যে তারা সব ফাড়ির পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাভুত করা হয়। ২৪শে মার্চের রাতে যখন আমি দ্বিতীয় বার্তাটি স্থগিতে রাখতে বলি, সে নির্দেশ পাওয়ার আগেই প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী কয়েকটি ফাঁড়িতে বাঙ্গালী সেনারা কাজ সমাধা করে ফেলে। পরে অবশ্য দ্বিতীয় বার্তাটি স্থগিত হয়ে গেলে তারা আর চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয়নি।

 ২৫শে মার্চ রাতে দ্বিতীয় বার্তায় চুড়ান্ত নির্দেশ লাভের পর অনেক সেনাদলই চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয়ে পড়ে।  এদিকে চট্টগ্রাম শহরের বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলো খবর পেয়ে লড়াই কেন্দ্রগুলোর দিকে এগোচ্ছিলো। শুধু বিমানবন্দরের প্লাটুনটির সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। এটা আমার জন্য খুবই বিপদের কারণ ছিলো। কেননা, পরিকল্পনা মোতাবেক শত্রুরা যাতে বিমান বন্দর ব্যাবহার না করতে পারে তার দায়িত্ব ছিলো এই প্লাটুনের ওপর। এখান দিয়ে সৈন্য আনা-নেয়া বন্ধ করতে পারলে বিমান বন্দর, পোর্ট এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতরসহ সমগ্র এলাকায় আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজতর হতো। বিমানবন্দরের টেলিফোন এক্সচেঞ্চ অপারেটরকে গোপনে চবিবশ ঘণ্টা লাইন চালু রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার পরই নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের সৈন্যরা গোপনে বিমানবন্দরে গিয়ে পুরো প্লাটুনের লোকদের গ্রেফতার করে ফেলে। ফলে এখানে আমাদের বড় একটা ক্ষতি হয়ে যায়।

 উপকূলীয় বাধ বারবার শত্রু সৈন্যর চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুনকে পাঠানো হলো। একটি কোম্পানী রেলওয়ে হিল প্রতিরক্ষার দায়িত্বে রইলো। প্রায় ১০০ সৈন্যকে দুই অথবা তিনজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে আগ্রাবাদ রোড এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে লড়াইয়ের জন্য মোতায়েন কর হলো। বাকী সৈন্যদের হালিশহরেই সংরক্ষিত রাখ হলো- যাতে কোথাও বিপদ দেখা দিলে তারা সেদিকে যেতে পারে। রামগড়ের সৈন্যদের কাছে পাঠানো বার্তায় তাদেরকে ফেনী নদীর ওপর শুভপুর সেতু ধ্বংস করে সেখানে একটি কোম্পানীকে প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থায় অবস্থান গ্রাহণ করতে এবং অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে প্রধান সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসতে বলা হয়েছিলো।

 হালিশহর ত্যাগের আগে বন্দীদের একটি ভবনে কঠোর প্রহরাধীনে রাখার এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে রাত ১১টা ৪৫মিনিটের মধ্যে আমি রেলওয়ে হিলের সদর দফতরে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছে নৌ-বাহিনীর সদর দফতর, পোর্ট এলাকা এবং বিমানবন্দরের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকার সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টার এবং ষোলশহরে মোতায়েন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বাঙ্গলী সৈন্যরা ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করতে সক্ষম হবে। রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের কমাণ্ডে ছিলেন লেঃ কর্নেল চৌধুরী এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এ দুজায়গায় বাঙ্গালী সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০০০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো আনুমানিক ৪০০।

 রাত তখন ১১টা ৩০ মিনিট। হঠাৎ ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের বাঙ্গালী সৈন্যদের ওপর হামলা চালালো। অস্ত্রাগারের গার্ডদের হত্যা করে প্রথমে তারা সেগুলো দখল করে। অন্যান্য বাঙ্গালী সৈন্য তখনও ঘুমিয়ে ছিলো। অস্ত্রাগার দখলের পরই পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্বিচার হত্যালীলায় মেতে ওঠে। সে রাতে তারা এক হাজারেরও বেশি বাঙ্গালী সৈন্যকে হত্যা করে। এরপর তারা বাঙ্গালী সৈন্যদের আবাসিক কোয়ার্টারগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং অস্ত্রের মুখে যাকে পায় তাকেই হত্যা করতে থাকে। নারী ও শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে মারা হয়।

 এই হত্যালীলা থেকে যেসব বাঙ্গালী সৈন্য জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলো তারা চারদিকে দৌড়াতে শুরু করে। কেউ কেউ আমার দফতরে এসে সেই লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেয়। অন্যারা ষোলশহরস্থ ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দিকে ছুটে যায়। এই রেজিমেণ্টের অধিকাংশ অফিসার এবং সকল সৈন্য ছিলো বাঙ্গালী।

 কিছুসংখ্যক সৈনিক ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে ষোলশহরে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সঙ্গে রাত প্রায় একটার দিকে যোগাযোগ করে সেনানিবাসে আক্রান্ত বাঙ্গালী সৈনিক এবং তাদের পরিবারবর্গের প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে যাবার জন্য তাদেরকে অনুরোধ জানায়। সেই ভয়াবহ রাতে বাঙ্গালী অফিসার ক্যাপ্টেন এনাম সেনানিবাস থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।  ইতিমধ্যে রেলওয়ে হিলে প্রতিরক্ষায় আমার ই-পি-আর প্লাটুনগুলোকে সুসংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে এই পাহাড়েরই একটিন আবাসিক ভবনের নিচতলায় আমার সদর দফতর স্থাপন করলাম।

 এই ভবনে রেলওয়ে অফিসারদের কয়েকটি পরিবার বাস করতেন। রেলওয়ে হিলে অবস্থান নিতেই সেখানকার অফিসার এবং তাদের পরিবারবর্গ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তারা গাড়ি থেকে আমাদের জিনিসপত্র নামাতে পাহাড়ের উপর আত্মরাক্ষামুলক ট্রেঞ্চ খুড়তে, নতুন টেলিফোন লাইন স্থাপন করতে এবং আমাদের সৈনিকদের খাবার তৈরীতে প্রভূত সাহায্য করেন।

 আগেই কোথায় কোথায় ট্রেঞ্চ খুড়তে হবে তা দেখে রেখেছিলাম এবং কয়েকজন জেসিওকে স্থানগুলো গোপনে দেখিয়েছিলাম। সৈনিকরা যথাস্থানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে কিনা তা দেখার জন্য রেলওয়ে হিলের চারদিক ঘুরলাম। পূর্বনির্ধারিত পাহাড়ের ঢালে ৩ ইঞ্চি মর্টার স্থাপন করা হলো। রেলওয়ে হিলে আরও কয়েকটি ভবনে বহুসংখ্যক অফিসার তাদের পরিবারবর্গকে অন্য কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। আমাদের কথামত অফিসারদের পরিবারবর্গকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হলেও অধিকাংশ রেলওয়ে অফিসার এবং তাদের বয়স্ক পুত্রসন্তান ও পুরুষ আত্মীয়রা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সাহায্য করার জন্য পাহাড়েই থেকে গেলেন। ইতিপূর্বে খবর পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের সকল সীমান্তবর্তী ফাড়ির ই-পি-আর সৈনিকরা অবাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে আমার সঙ্গে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে কেবলমাত্র নৌ-সদর দফতর এবং সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র চট্টগ্রাম শহর এলাকা, হালিশহরস্থ ই-পি-আর লাইন এবং ই-পি-আর সদর দফতর তখন আমাদের পূর্ন নিয়ন্ত্রনে। আমি ভেবেছিলাম ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সৈনিকদের নিয়ে মেজর জিয়া এবং লেঃ কর্নেল চৌধুরী সেনানিবাস আক্রমণ করবেন এবং আক্রমণে নিশ্চয়ই তারা সফলতা অর্জন করবেন। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কাযক্রম গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাত ৮টা ৩০ মিনিটে যখন আমি সারসন রোডের বাসভবন ত্যাগ করি তখনই ডাঃ জাফর এবং জনাব কায়সারকে বলেছিলাম ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে তারা যেন খবরটি জানিয়ে দেন। তারা আমার যুদ্ধ শুরু করার কথা এই রেজিমেণ্টকে জানিয়েছিলেন। বলা প্রয়োজন যে, ঐ রাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হালিশহর এবং চট্টগ্রাম নগরীর অন্যান্য এলাকার ৫০০ অবাঙ্গালী সৈনিক, জেসিও এবং কয়েকজন ই-পি-আর অফিসারকে আমরা নিরস্ত্র করতে পেরেছিলাম। আমার অধীনস্থ ই-পি-আর সৈনিক ও জেসিওদের সাহসিকাপূর্ণ কার্যক্রমের পূর্ণ গোপনীয়তা সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্যই অবাঙ্গালী সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়েছিলো।

 প্রাথমিক সাফল্যের পর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে দিকে আমি ৮ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সৈনিকদের সাফল্যের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম নিশ্চয়ই তারাও ২০ বালুচ রেজিমেণ্টাক ইতিমধ্যে নিরস্ত্র করতে পেরেছেন। প্রথমিক সাফল্যের পর পরই সদর দফতর এবং বিমানবন্দর দখলের জন্যে আমি আমার সীমান্ত ফাঁড়ির ই-পি-আর সৈনিকদের আগমন অপেক্ষায় উন্মুখ ছিলাম।

 ইত্যবসরে আমি বেতার কেন্দ্র, টেলিফোন একচেঞ্জ আক্রমণ ও দখল করার উদ্দেশ্যে আমার সৈন্যদের পাঠালাম। আমার এই রেলওয়ে হিল দফতরের ঠিক উল্টোদিকেই ছিলো নৌ-বাহিনীর যোগাযোগ কেন্দ্র। এখান থেকে পরিস্কার দেখা গেলো কয়েকজন পাকিস্তানী নৌ-সেনা ওখানে ঘোরাফেরা করছে। ঠিক এই সময়ে নৌ-বাহিনীর একটি গাড়ি আগ্রাবাদের দিকে এগিয়ে গেলো। আমার মর্টার জেসিও সুবেদার আইজুদ্দিন গাড়ি দেখেই তাঁর অবস্থান থেকে দৌড়ে এসে বললো, “স্যার, গাড়িতে কয়েকজন নৌ-সেনা রয়েছে। দেবো নাকি শেষ করে?”  আমি বললাম, “না, এখন নয়। এটা বোধ হয় পর্যবেক্ষণ গাড়ী। রাস্তা পরিস্কার আছে কিনা দেখার জন্য এসেছে। মনে হয় সৈন্যদের আরো বড় দল এই রাস্তায় আসবে। সেই লক্ষ্যবস্তই হবে আমাদের জন্য উত্তম। একসংগে অনেক লোককে পেয়ে যাবো।” একটু পরেই আরেকটি গাড়ি একই পথে চলে গেলো। কিন্তু সৈন্যদের বড় দলটি আর এলো না। মিনিট দশেক পর দুটি গাড়ীই ফিরে এলো এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে চলে গেলো।

 পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলাম, প্রথম গাড়িতে করে মেজর জিয়া পোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। তার কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এম, ভি, সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টে আনার জন্য তিনি রওনা হয়েছিলেন। ষ্ট্যাণ্ডার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ নিউ মার্কেট শাখার ম্যানেজার জনাব কাদের যখন আমার বার্তা নিয়ে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দফতরে যান তার আগেই মেজর জিয়া বার্তাটি পান। খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে থামানোর জন্য পোর্টের দিকে রওনা হয়ে যান। ২৫শে মার্চ রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরা এই মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের ওপর হামলা চালায়। ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্য ও অফিসারবৃন্দ তখনো এ খবর জানতে পারেননি। পুর্বে উল্লেখিত দ্বিতীয় গাড়িতে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। আগ্রাবাদ পর্যন্ত গিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানালে মেজর জিয়া ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট লাইনে ফিরে আসার এবং তার অফিসারদের সঙ্গে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। মেজর জিয়াকে বহনকারী প্রথম গাড়িটি দেখেই নায়েব সুবেদার আইজুদ্দিন উত্তেজিত হয়ে আক্রমন করতে চেয়েছিলো। রেলওয়ে হিলের পাশের এই সড়কের অনেকখানি আমাদের এল-এম-জি এবং রকেট লাঞ্চারের সুনির্দিষ্ট আওতার মধ্যে ছিল। আমরা ধৈর্য্য না ধরলে মেজর জিয়া এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বহনকারী গাড়ি দুটি রকেট লাঞ্চারের গোলায় উড়ে যেতো। আরো বড় শিকারের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম বলেই অলৌকিকভাবে সেদিন তারা দুজন বেঁচে গিয়েছিলেন।

 ইউনিট লাইনে ফিরে মেজর জিয়া এবং তার অফিসাররা কমাণ্ডিং অফিসারসহ অবাঙ্গালী অফিসারদের গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেন। অবাঙ্গালী অফিসারদের গ্রেফতার পর্ব শেষ হবার পরই তাদের কাছে ক্যাণ্টনমেণ্টের হত্যাকাণ্ডের খবর পৌঁছে।

 ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন অফিসার পরে স্বীকার করেছিলেন, “ক্যাণ্টনমেণ্টের ঘটনার ব্যাপারে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। রেজিমেণ্টের তরুন অফিসারদের কয়েকজন তখনই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সৈনিকদের জীবন রক্ষায় ছুটে যেতে চান। অন্যরা ২১০ বালুচ রেজিমেণ্টকে আক্রমন করাকে আত্মঘাতী হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এই মতপার্থক্যের ফলেই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই পর্যায়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে যাওয়া কিংবা ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা বোকামি হবে। এরপর ঐ রাতেই আমরা ষোলশহর ত্যাগ করে পটিয়ার দিকে অগ্রসর হই।”

 এদের এই পদক্ষেপ সম্পর্কে আমি আগে কিছুই জানতাম না। ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারে যাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম সেই ডাঃ জাফর ফিরে এলে সব জানতে পারলাম। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি এদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি?”

 “আপনার খবর তো ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পৌঁছে দিয়েছি। তবু তারা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি” - ডাঃ জাফর জবাব দিলেন।

 “দয়া করে এক্ষুনি যান, গিয়ে ওদেরকে থামান। এখন সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ওদের সাথে সম্মিলিতভাবে বাকী জায়গাগুলোও আমরা মুক্ত করতে পারবো। আজকের রাতই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।”

॥সশস্ত্র প্রতিরোধ॥

 চট্টগ্রাম, ২৬শে মার্চ। আমার দফতরে টেলিফোনে খবর এলো যে পাকিস্তানী সেনারা নৌ-ঘাঁটি থেকে অগ্রসর হয়ে হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের ওপর আক্রমন চালিয়েছে। ই-পি-আর ট্রাপস এই আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রদের প্রচুর হতাহত হয়। পাকিস্তানীরা হালিশহরে কোন বাধা আশা করেনি। সংগঠিত প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য তারা প্রস্বত্ততই ছিলো না। তাদের অগ্রবর্তী দলটি হালিশহরের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখীন হতেই আমাদের সৈনিকরা পাকিস্তানীদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। পাকিস্তানীরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বহু সংখ্যক হতাহত হলো। অবশেষে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এ সময়ে অপর এক টেলিফোনে জানলাম, ৮০ থেকে ১০০টি যানের বিরাট একটি কনভয় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে মেজর বাহার চট্টগ্রাম টেলিফোন অপারেটরকে একথা জানালে সে তৎক্ষণাৎ আমাকে তা অবহিত করে। সংবাদ পাওয়ার পরপরই আমি পাকিস্তানী কলামটিকে এ্যামবুশ করার জন্যে একজন জেসিওর নেতৃত্বে হালিশহর থেকে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠালাম। হালকা মেশিনগান এবং ভারী মেশিনগান ছাড়াও কোম্পানীটির সাথে ছিলো ৩” মর্টার ও রকেট লাঞ্চার। অপারেশনাল কমাণ্ডার সুবেদার মুসা যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে টেলিফোন করে বললেন। আমাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করবেন স্যার।

 সকল দেশবাসী আপনাদের জন্য দোয়া করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যান, মাতৃভূমিকে মুক্ত করুন। আমার গলার স্বর ছিলো আবেগে উদ্বেলিত।

 কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী শত্রপক্ষে ছিলো ২৪ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং তাদের সঙ্গে ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী একটি দল। ২৬শে মার্চ রাত ১টার দিকে তারা চট্টগ্রামের পথে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট ত্যাগ করে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দুরত্ব একশ মাইলের কিছু বেশি। তাদের পথে বহুসংখ্যাক কালভার্ট এবং ছোট ছোট সেতু ছিল। সৈন্য চলাচলে বাধাদানের জন্যে পূর্বেই জনসাধারন এগুলোর অধিকাংশ ভেঙ্গে ফেলেছিলো। তাই পাকিস্তানী কলামটিকে অনেক ক্ষেত্রে মুল রাস্তা ছেড়ে ঘুড়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। একই সাথে ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের সৈনিকরা সেতুগুলো মেরামতও করে চলছিলো। যা হোক, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শুভপুরে সেতুর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে রাখা হয়েছিলো। কুমিল্লাস্থ ৫৩ ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি নিজেই সমগ্র কলামের নেতৃত্বে ছিলেন। শুভপুর সেতু রওনা হলেন এবং পিছনে রেখে গেলেন মর্টার এবং ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটকে। তাদের বলে গেলেন সেতু মেরামত করতে তারা যেন অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দেয়। সুর্য তখন অস্তপ্রায়। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি এবং তার বাহিনী চট্টগ্রাম থেকে ১৪ মাইল দূরে কুমিরায় পৌছে গেলেন।

 এদিকে ইপিআর সেনারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রাস্তার পূর্ব পাশের একটি উচু জায়গায় এ্যামবুশ করে বসেছিলো। রাস্তার পশ্চিমে কিছু দুরেই সাগর। উচু জায়গাটি থেকে রাস্তা এবং সাগর বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। বড় সেতুগুলোর কষ্টসাধ্য বাধা পেরিয়ে আসতে পেরে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি খুব খুশী ছিলেন কারণ সেতুগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হলে তাদের পক্ষে সেতু পার হওয়া সম্ভব হতো না। সমস্যার মুহুর্তে সেনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন এবং তারপরই নামতে পারবেন বাঙ্গালীদের শায়েস্তা করতে। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি জীবনের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। ইপিআর সেনাদের এ্যামবুশে তিনি এবং তার প্রায় অর্ধেক সৈন্য দিশেহারা হয়ে পড়লো।

 এই এ্যামবুশে পাক সেনাদের হতাহতের খবর পরে পাওয়া গিয়েছিলো। লাইট মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলির শিকার হয়েছিলেন ২৪ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল শাহপুর খানসহ প্রায় ৭০ জন পাকসেনা। ধ্বংসপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি জীবন বাঁচাবার জন্যে তখন প্রাণপণে ছুটেছিলেন পাহাড়ের দিকে। কয়েকজন সঙ্গীও তাকে অনুসরন করলো। ভীতসন্ত্রস্ত সৈনিকরা হাতিয়ার, যানবাহন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ফেলেই প্রাণপণে ছুটছিলো। শত্রুপক্ষের পিছনের অংশ যারা আমাদের অস্ত্রের আওতার বাইরে ছিলো তারা সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলো। এক ঘণ্টারও বেশী সময় এই গুলি বিনিময় চললো। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীদের মর্টার বহর শুভপুর সেতু অতিক্রম করে তাদের অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দিলো। এই সময় আমাদের সেনারা প্রায় ৩ মাইল সরে এসে পরবর্তী অবস্থানে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ইপিআর-এর ৫ জন গুরুতরভাবে আহত হয়।

 কুমিল্লায় শত্রুর বিরুদ্ধে ইপিআর সেনাদের এই এ্যামবুশ ছিলো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই প্রথম সরাসরি আক্রমণ। কুমিরার ঘটনার গুরুত্ব এতই সুদুরপ্রসারী ছিলো যে, এই ঘটনা পাকিস্তানী সৈন্যদের চট্টগ্রামে অবাধে কিছু করার মূল পরিকল্পনা ব্যাহত করে দেয়। চট্টগ্রামে শত্রুদের লোকবল পর্যাপ্ত ছিলো না বলে কুমিল্লা থেকে লোকবল বৃদ্ধি ছিলো একমাত্র ভরসা। এই এ্যামবুশের পরে আমরা একটি অয়্যারলেস বার্তা শুনে ফেলি। চট্টগ্রামের জনৈক কমাণ্ডার ঢাকায় ৯৪ ডিভিশনের কর্নেল ষ্টাফ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়েছে। সীতাকুণ্ডের দক্ষিণে বাকি সৈন্যরা আটকা পড়ে আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করছি। জরুরি ভিত্তিতে বিমানে করে হতাহতদের সরাবার ব্যবস্থা করা দরকার।

 কুমিল্লায় আমারও কিছু লোক হতাহত হয়েছিলো। আমারও প্রয়োজন ছিলে নতুন সৈন্যের, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের। সেই মুহূর্তে সীমান্ত এলাকা থেকে যে সব ইপিআর সৈন্য আসছিলো তারাই ছিলো আমার প্রধান ভরসা।

 ২৬শে মার্চ ভোর নাগাদ ক্যাপ্টেন হারুন শহরের পাঁচ মাইলের মধ্যে এসে পড়লেন। তাঁর সৈন্যরা উচ্চ কণ্ঠে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে আসছিলো। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে এসেই থামতে হলো তাদেরকে। কয়েকজন সৈন্যকে শহর ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে যেতে দেখা গেলো। কিছুক্ষণের জন্য ক্যাপ্টেন হারুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন “শত্রুরা কি তাহলে পুরোপুরি শহর দখল করে ফেলেছে?” এই ভাবনা তাঁকে কিছুটা হতবুদ্ধি করে দেয়। পরে দেখা গেলো যে, এরা বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টার এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক। তারা সবাই পটিয়ার দিকে যাচ্ছিলো। শহরে ঢোকার আগে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি কালুরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁকে কালুরঘাট এলাকাতেই থাকতে বলা হলো। ফলে পূর্ব পরিকল্পান অনুযায়ী শহরের যুদ্ধে আমার সঙ্গে যোগ দেয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না।

 কক্সবাজারে ইপিআর কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার মফিজ। তিনি দুটি ইপিআর কোম্পানী নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য কক্সবাজার ত্যাগ করেছিলেন। তাকেও কালুরঘাট এলাকায় থামিয়ে সেখানেই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। তিনি পরে আমাকে বললেন। আপনার সাথে যোগ দিতে পারিনি এটা আমার ত্রুটি ছিলো না। মেজর জিয়া আমাকে কালুরঘাটে থামিয়ে দিয়েচিলেন। আমি তাকে আপনার নির্দেশের কথা জানালে তিনি আমাকে জানান শহরে কেউ নেই। অবশ্য পরে দেখা গেলো আপনি তখনো শহরে যুদ্ধ করে চলেছেন।

 আমরা তখনো শহর ছাড়িনি। বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিলো। কিন্তু ঘটনাবলী শহরের পরিস্থিতিকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তা মোটেই আমার জন্য অনুকুল ছিলো না।

 কক্সবাজার এবং কাপ্তাই থেকে যে সৈন্যরা আসছিলো কালুরঘাট ব্রিজের কাছে তাদের থামিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। কুমিরায় প্রধান সড়ক বরাবর প্রচণ্ড সংঘর্ষের দরুন রামগড়ের সৈন্যরা আসতে পারছিলো না। শহরে যে ক'জন সৈন্য ছিলো শুধু তাদের সম্বল করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর গত্যন্তর ছিলো না। নৌ- বাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো।

 বেলা ৯টা নাগাদ অনেক উঁচু দিয়ে শহরে হেলিকপ্টার ঘোরাঘুরি শুরু করলো। কয়েক জায়গায় জনসাধারণ সেগুলোর দিকে বন্দুকের গুলি ছুড়লো। বিরাটাকায় সি-১৩০ বিমানগুলো ঢাকা থেকে সৈন্য আনতে থাকলো। অসহায়ভাবে তবু আমরা সেই অবস্থান আকড়ে রইলাম। আমাদের প্রচেষ্টা ছিলো, ক্যাণ্টনমেণ্ট এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে শত্রুদের বেরোতে না দেয়া। কিন্তু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়ায় এবং ৮ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট শহর ত্যাগ করায় ওদিক দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেরোনো সহজতর হয়ে উঠেছিলো। ঘটলোও তাই। ট্যাংকের ছত্রছায়ায় ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে পড়লো।

 নৌ-বাহিনী সদর দফতরের পাকিস্তানী সৈন্যরা অবশ্য তখনো আটকা অবস্থায়। সমগ্র আগ্রাবাদ রোডের গুরুত্বপূর্ন স্থানগুলো ছিলো ইপিআর সৈন্যদের দখলে। হালিশহরের কাছে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলে শত্রুপক্ষের একটি লোকের পক্ষেও চলাচল করা সম্ভব ছিলো না। এমনিভাবে ওদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা আমরা অনেকখানি ব্যাহত করতে পেরেছিলাম।

 চট্টগ্রামে পাকিস্তানীদের সাহায্যার্থে বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য ২৬শে এবং ২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে এসে পৌঁছায়। বিমানবন্দর থেকে পাকসেনারা আগ্রাবাদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক শেনাদের অপর একটি গ্রুপ হালিশহর ইপিআর সদর দফতরের দিকে অগ্রসর হয়। হালিশহরে আমরা ইপিআর বাহিনী আগে থেকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলেছিলো।

 কুমিরার সংঘর্ষ মারাত্মক হয়ে পড়ে। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সৈন্যদের মনোবল এতই ভেঙে পড়েছিলো। যে, তাদের পক্ষে আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিলো না। এই সময় হেলিকপ্টার যোগে জেনারেল মিঠঠা খান কুমিল্লায় উপস্থিত হন এবং সৈন্যদের প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে এক জঘণ্য মিথ্যা ভাষণে বলেনঃ “হিন্দুদের প্ররোচনায় বাঙ্গালীরা তোমাদের অফিসার, সৈন্য এবং তাদের পরিবার পরিজনকে হত্যা করে চলছে। তোমরা তাদের রক্ষা না করলে তারা সকলেই প্রাণ হারাবে। প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য তোমরা সামনে এগিয়ে যাও। খুনের বদলে খুন। ইসলাম এবং পাকিস্তানকে তোমরা রক্ষা কর।” প্রতিশোধ গ্রহনের এই তীব্র হলাহল পাকিস্তানী সৈনিকদের মনে ব্যাপক জিঘাংসা সৃষ্টি করে।

 মূল সড়ক পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হওয়ায় ব্রিগেডিয়ার শফি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটি কলামকে সেনানিবাসে ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। অপর কলামকে উপকূল রেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে বাধের উপর তরিত অবস্থান গ্রহনকারী আমাদের সৈন্যদের ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন।

 সন্ধা হয়ে আসে। মাঝে মাঝেই উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় চলছিলো। সংঘর্ষ এলাকা থেকে জনসাধারন ক্রমশঃ দুরে সরে যেতে থাকলেও এলাকার তরুনরা আমাদের সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে খাবার এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে থাকে। এমনকি তারা হতাহতদের নিরাপদ স্থানে সুচিকিৎসার ব্যাবস্থাও করতে থাকে। সৌভাগ্যের বিষয় ছিলো তাদের অনেকেই শত্রুসৈন্যদের কাছাকাছি থেকে তাদের প্রতিটি অবস্থানের খবরাখবর আমাদের সর্বরাহ করে চলছিল।

 উপকূল বরাবর শত্রুসৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়েই আমরা আরেকটি এ্যামবুশের আয়োজন করি। পাকিস্তানীরা আমাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। এই দ্বিতীয় এ্যামবুশেও শত্রুসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। ভীত পাকিস্তানীরা তাদের মৃত সঙ্গীদের ফেলেই নানা দিকে দৌড়াতে থাকে। অনেকেই পথ ভুলে গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়লে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেই প্রাণ হারায়।  ইতিমধ্যে ইপিআর কোম্পানীর গোলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। অপরদিকে হালিশহর সদর দফতরেও বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করার মতো গোলাগুলি আর তেমন ছিলো না। এই পরিস্থিতিতে আমি কুমিরার কোম্পানীকে পেছনে সরে শহরের উপকণ্ঠে নতুন প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বললাম। স্থানটি হালিশহরে আমাদের অবস্থানের নিকটেই ছিলো। আমরা তীব্রভাবে গোলাগুলি এবং নতুন সৈন্যের প্রয়োজনীয়তার অভাব অনুভব করি। অথচ সেই মুহুর্তে এগুলো সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য ছিলো। এদিকে রাঙ্গামাটি থেকে আগত ইপিআর সেনারা ক্যাণ্টনমেণ্টের অদূরে বাধাগ্রস্ত হয় এবং রামগড় এলাকার অপর দুটি ইপিআর কোম্পানীও মুল সড়ক পথ ধরে অগ্রসর হতে পারছিলো না। এ সময় আমার সামনে দুটি বিকল্প পথই খোলা ছিলো। হয়, ক্যাণ্টনমেণ্টের অস্ত্রাগার দখল করা অথবা সরবরাহের জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ করা। অন্যসব সম্ভাবনা ব্যার্থ হলে চূড়ান্ত পন্থা হিসাবে শেষেরটিই বিবেচনা করা যায় বলে মনে করলাম। আমি প্রথম পন্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেই এবং তখনই রামগড়ের একটি কোম্পানীকে মাঠের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছনে অবস্থানকারী আমাদের সেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। অপর কোম্পানীটিকে শুভপুর সেতু এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে বললাম যাতে সড়ক পথে কুমিল্লা থেকে নতুন কোনো পাক সৈন্য চট্টগ্রাম আসতে না পারে।

 ২৬শে মার্চ সন্ধা সাড়ে ৮টার দিকে নৌ-বাহিনীর যোগাযোগা ঘাঁটিতে পাক সৈন্যদের আনাগোনা লক্ষ করা গেলো। রেলওয়ে পাহাড়ে আমার ট্যাকটিক্যাল হেড কোয়ার্টার থেকে পাশের একটি মসজিদে তাদের আনাগোনা পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো। কয়েকজন বেসামরিক ব্যাক্তিও তাদের সঙ্গে মসজিদে যোগ দেয়। এই সময়ই হালকা মেশিনগান নিয়ে অবস্থানকারী আমার একজন সিপাই যে মুহুর্তে ট্রেঞ্চ থেকে মাথা তুললো অমনি একটি বুলেট তাকে আঘাত করলো। গুলিটি আসে মসজিদের দিক থেকে। সাথে সাথে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহয্যে ব্যাপকভাবে গুলি চালাতে শুরু করলো। কামানের গোলা আমাদের চতুর্দিকে পড়তে থাকে। বিস্ফোরিত গোলার মারাত্মক টুকরোগুলো ভয়াবহরূপে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রুদের একটি দল টাইগার পাস ঘাটি থেকে আক্রমন চালায়। অবশ্য এই আক্রমন সাথে সাথেই প্রতিহত করা হলো। কিছুক্ষণ পর অপরদিক থেকেও হামলা হতে থাকে। তবে দুটি হামলাই সামনের দিক থেকে আসছিলো বলে ওরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বরং পাকিস্তানিরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। সামনে অগ্রসর হতে ব্যার্থ হয়ে তারা পিছু হটে গিয়ে তাদের সুদৃঢ় ঘাটি থেকে আমাদের অবস্থানের ওপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকলো।

 অনুরুপভাবে আমাদের হালিশহর অবস্থানের ওপর কয়েক দফা হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই শত্রুসেনারা হটতে বাধ্য হলো। ২৬শে এবং ২৭শে মার্চের মধ্যবর্তি রাতকে মনে হচ্ছিলো এ রাত যেন আর পোহাবে না। গুলির শব্দে গোলার বিস্ফোরনে সমস্ত শহর কেঁপে কেঁপে উঠছিল বারং বার।

 এ সময় আমার অবস্থানের পেছনেই ট্যাংকের আওয়াজ পেলাম। অন্য কোনো ভাবে আমাদের অবস্থান দখল করতে না পেরে শত্ররা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। রেলওয়ে হিলে আমাদের অবস্থান শত্রুদ্বারা ঘেরাও আসন্ন হয়ে উঠলো। অথচ কোনো ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র আমাদের ছিলো না।

 প্রায় দু'ঘণ্টা পর কামানের গোলা বর্ষণ একটু কমে এলো। এ সময় আহত সৈনিককে আমার কমাণ্ড পোস্টে নিয়ে আসা হলো। সে ছিলো বয়সে তরুন। কাদামাটি লাগা কাপড়চোপড় রক্তে ভেজা। বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়েছিলো। দারুন কষ্টে নিঃশ্বাস টানতে গিয়ে আস্ফুট কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো “কখন আমার মৃত্যু হবে?” তার দৃষ্টিতে ছিলো সারা বিশ্বের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। এরপর সে আর কিছু বলতে পারে নি। আরো অনেকের মতই নিভৃত যন্ত্রনায় সেও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলো।

॥ ঘেরাও॥

 ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে নৃশংস অভিযানের প্রাথমিক সাফল্যে উৎফুল্ল ইয়াহিয়া তার বাহিনীকে ব্যাপক গণহত্যার ছাড়পত্র প্রদান করেন। পাকসেনারা তাদের অভিযান এলাকাগুলোতে প্রাণী বলতে যা কিছু পেয়েছে তাই নিধন করেছে এবং এসব স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে অবলিলাক্রমে। কিন্তু তবুও লোক এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু এই প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা ছিলো দুঃসাধ্য, কারণ অস্ত্র চালনায় জনসাধারণের একদিকে যেমন কোন ট্রেনিং ছিলো না। তেমনি তাদের অস্ত্রগুলোও ছিলো পুরোনো আমলের। এদিকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আমাদের বাঙালী সৈনিকরা যেখানেই সংগঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছেন সেখানেই শুরু হয়েছে কামান, ট্যাংক আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা শক্র পক্ষের সম্মিলিত আক্রমন। এই ধরনের বারংবার হামলার মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের গোলাবারুদের মজুতে টান পড়ে।

 এই অবস্থায় রেলওয়ে হিলের অবস্থান ত্যাগ করার জরুরী প্রয়োজন দেখা দিলো। তখন চারদিকেই শুক্রসেনা। ক্রমাগত ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কামানগুলো আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদেরকে ব্যাস্ত রাখে। এই সঙ্কটময় অবস্থায় আমি আমার সৈন্যদের কোতয়ালী থানা এলাকার দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিই এবং সেখান থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছনে সকলকে একত্র হতে বলি। গুলি বর্ষনের ছত্রছায়ায় যখন সকলেই স্থান ত্যাগ করে চলে যায় তারপরই আমি ঘাটি ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াই। একজন তরুন কলেজ ছাত্রও আমার সাথে ছিলো। আমরা চলছিলাম কিন্তু মুখে কোন কথা ছিলো না। সমস্ত সকালটি ছিলো কুয়াশাচ্ছন্ন। বিমূড় বিষন্নতায় সমস্ত শহর যেন আচ্ছন্ন। রাস্তাঘাট ছিলো জনমানবশূন্য, মনে হচ্ছিলো মৃতের নগরী। শত শত বছর পরে মাটির তলা থেকে খুড়ে যেন নগরটিকে আবিস্কার করা হয়েছে। দূরে বন্দরে জাহাজের মাস্তল, ক্রেন, ওধারে অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম সবকিছুই একটির পর একটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। ভরাক্রান্ত হৃদয়ে পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই সা করে একটি বুলেট আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো। সাথে সাথে আমরা নীচু হয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দেই।

 কদমতলী রেলক্রসিংয়ের কাছে নৌ-সেনাদের দুটি ট্রাক এ সময় অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করছিলো। আমি নিঃশঙ্কচিত্তে সামনে এগোচ্ছিলাম। কোন দেশ কি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না? বহির্জগতের কোন দেশ কি জানে না বাংলাদেশে এখন কি ঘটছে? আমাদের বেতার ঘোষনা কি তারা শুনেছে? এমনি নানা কথার ভীর আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কদমতলীর কাছাকাছি এসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে যখনই রাস্তা পেরুতে গেছি তখনই দুটি গাড়ীর হেডলইটের তীব্র আলোয় আমার চোখ ঝলসে যায়। দুটি গাড়ি থেকেই সৈন্যরা লাফিয়ে নামতে থাকে। আমি সামনে একটি প্রাচীর দেখে সেটি পার হওয়ার জন্য দৌড় দিই শত্রুসৈন্যরাও গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি এসে আমার ডান হাতে ধরা এষ্টেনগানে লাগলে প্রচণ্ড ধাক্কায় সেটি ছিটকে পড়ে। আমি মুহুর্তে দেয়ালের উপর লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড বেগে ওপাশে গিয়ে পড়ি। তারপর লাফিয়ে হামাগড়ি দিয়ে আবার কখনো দৌড়ে চলতে থাকি। পেছনে শুনতে থাকি নৌ-সেনাদের এলোপাথার গুলিবর্ষনের শব্দ। তাদের দুঃখ, শিকার তাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো।

 আমার বাম উরুতে তখন ভয়ানক যন্ত্রনা হচ্ছিলো, ভীষন রক্ত ঝরছিলো এবং ট্রাউজারের একটি অংশ হাটু পর্যন্ত ছিড়ে ঝুলছিলো। দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়ার সময়ই বোধ হয় কিছুতে লেগে এই জখম হয়েছে। কোতয়ালী থানায় পৌঁছে দেখি আমার লোকেরা সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে। ৩” মর্টারগুলো তখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে পড়েছিলো। কারন ওগুলোর কোনো শেল অবশিষ্ট ছিল না। পেট্রোলের অভাবে আমাদের কয়েকটি গাড়িও ফেলে আসতে হলো। আমি টেলিফোনে জনাব সিদ্দিকীতে মর্টারগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িসহ কাউকে পাঠাতে বললাম এবং সৈন্যদেরকে পুর্ব পরিকল্পিত জায়গায় গিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। আমাদের আশা ছিলো সেখান থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টের ওপর আক্রমন চালিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে প্রচুর গোলাগুলি উদ্ধার করতে পারবো।

 আমাদের ভিন্ন রাস্তায় অগ্রসর হতে হলো। ক্যাণ্টনমেণ্ট ও শহরের মধ্যবর্তী প্রধান শহরটি তখন শত্রুকবলিত। আমরা কিছু লোক গাড়িতে এবং কিছু লোক পায়ে হেটে গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হলাম। চকবাজারের কিছু সামনে শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছতেই দেখলাম আমার একজন ইপিআর সিপাই পায়ে হেটে শহরের দিকে ফিরছে। ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? আমি চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম। বিষন্ন কণ্ঠে সে জবাব দিলো আপনার কাছেই স্যার। সে আরো বললো, আপনি ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছনের এলাকায় গিয়ে আমাদের একত্র হওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু একজন অফিসার অন্যপথ দিয়ে সৈন্যদেরকে নিয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে চলে গেছেন। আমি আবার চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম। কোন অফিসার?

 “আমি তার নাম জানি না স্যার।”

 জনাব হান্নান এবং ডাঃ জাফরকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের সেনাদের কালুরঘাট সেতুর দিকে নিয়ে গিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধ করলাম তারা যেন জিয়াকে বলেন, আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে যাতে ওরা শহরে আমার সাথে যোগ দিতে পারে। তদনুসারে ডাঃ জাফর, জানাব হান্নান, নগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব মান্নান, জানাব কায়সার এবং আরো কয়েকজন কালূরঘাটের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। গোমদণ্ডী স্টেশনের কাছে তারা মেজর জিয়া, মেজর শওকত এবং অন্য কয়েকজন অফিসারের সাক্ষাৎ পান। আমার সাথে শহরের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য তারা জিয়াকে আমার সৈন্যদের ছেরে দিতে বলেন। মেজর জিয়া জবাব দেন যে, তার সেনাবাহিনী পূনর্গঠননের পরই তিনি আমার সংগে যোগ দেবেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ফিরে এসে আমাকে সব কথা জানালেন। অবশ্য মেজর জিয়া এবং তার সংগের অন্য অফিসাররা শহরের লড়াইয়ে আর আসতে পারেন নি।

 ঢাকা থেকে তখনও বিমান বোঝাই করে সৈন্য আনা হচ্ছিলো। প্রধানতঃ কুমিল্লার ৫৩ বিগ্রেড থেকে এবং অন্যান্য স্থান থেকেও পাক সৈন্যরা চট্টগ্রামের পথে এগিয়ে আসছিলো। শহরের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিলো। এদিকে বাংলাদেশের পতাকার বিক্রি বেড়ে গেলো বহুগুণ। সর্বত্র নীল আকাশের নিচে নতুন জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা গেলো। কিন্তু ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে শত্রুসৈন্যরা বেরিয়ে সবাইকে সেগুলো নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করতে লাগলো। যদিও প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে গ্রথিত বাংলাদেশের পতাকার ছাপ তারা কোন দিনই মুছে ফেলতে পারেনি।

 ক্যাণ্টনমেণ্টের অদূরে ইপি-আর সৈন্যরা আমার কথা অনুযায়ী নতুন সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমার সৈন্যদের কালুরঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কথা তারা তখনো জানতে পারেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টের ওপর যে হামলা পারিচালনার পরিকল্পনা আমি ইতিপূর্বে করেছিলাম তা ভেস্তে গেলো।

 এমতাবস্থায় আমি অস্ত্র এবং গোলাবারুদের জন্যে ভারতে যাবার নিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম, ৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে ভারতে একবার যেতে পারলে সেখান থেকে নিশ্চয়ই অস্ত্র, গোলাগুলি এবং জরুরী জিনিসপত্র সংগ্রহ করা যাবে এবং এরপর রামগড় থেকে কিছু সৈন্য নিয়ে এসে ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমন করতে পারবো। অস্ত্রের জন্য ভারতে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে আমি সীমান্ত রক্ষীদের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে রাখার জন্য অয়্যারলেসে রামগড়ে একটি বার্তা পাঠালাম। আমার ভারত পৌঁছানোর পর আলোচনা শুরু করতে যাতে দেরি না হয় সেজনই আগে থেকে এ ব্যবস্থা করলাম।

॥ সরবরাহের অভাব॥

 ২৮শে মার্চ ভোর নাগাদ শত্রুপক্ষ ক্যাণ্টনমেণ্ট এবং নৌ-বাহিনীর ঘাটির মধ্যবর্তী প্রধান সড়কের টাইগার পাস এলাকা দখল করে নেয় এবং নগরীর কেন্দ্রস্থলে সার্কিট হাউসে তাদের সদর দফতর স্থাপন করে। কুমিরায় যে শত্রুদলটিকে আমরা প্রতিহত করেছিলাম তারাও এসে ক্যাণ্টনমেণ্টের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। আমাদের সেখানকার সৈন্যরা সরে এসে হালিশহরের প্রধান প্রতিরক্ষাব্যূহে অবস্থান নেয়। হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ দু'ভাবে কাজে লাগছিলো। প্রথমত, এই প্রতিরক্ষা ছিল বিমানবন্দর, নৌ- বাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট এলাকায় শত্রুদের জন্য আসার পথে হুমকিস্বরুপ। দ্বিতীয়ত, শত্রুদের প্রধান অংশে আঘাত পরিচালনার জন্যও দৃঢ় ঘাঁটি হিসেবে এটা কাজে লাগছিলো। পথিমধ্যে ইপি-আর সৈনিকদের কালুরঘাটে আটকানো না হলে পোর্ট, বিমানবন্দর এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর আক্রমন এবং দখল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো এবং তাহলেই যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যেতো। পোর্ট এলাকা থেকে শত্রু সৈন্যরা দিনের বেলায় কয়েকবারই আগ্রাবাদ রোড পরিস্কার করে টাইগার পাস দিয়ে নৌ-ঘাঁটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু তীব্র প্রতিরোধের মুখে প্রত্যেকবারই তাদের পিছু হটতে হয়। শত্রুরা হয়তো মরিয়া হয়ে অগ্রসর হলে সড়কটি দখল করতে পারতো। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় এই ধরনের সংঘর্ষে লোকক্ষয় ছিলো অবশ্যম্ভাবী। লোকক্ষয় এড়ানোর জন্যেই তারা সাময়িকভাবে এই প্রচেষ্টা স্থগিত রেখে কুমিল্লা থেকে অগ্রসরমান সৈন্যদের দেওয়ান হাট উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

 দামপাড়া পুলিশ লাইনের বাঙালী পুলিশরাও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু সৈন্যদের প্রতিরোধ করছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পুরো ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা বেশীক্ষণ টিকতে পারেনি। সংঘর্ষে বহু বাঙালী পুলিশ হতাহত হয়। শত্রুদের ক্রমাগত চাপের মুখে বাঙালী পুলিশদের স্থানটি পরিত্যাগ করতে হয়।

 পরদিন ২৯শে মার্চ। সকালে শত্রুসেনারা আগ্রাবাদ রোড অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং একটি দলকে তারা মাদারবাড়ী ও আইস ফ্যাক্টরী সড়ক হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়। নিউমার্কেটে অবশ্য আমাদের লোক ছিলো না তকে আমি এক প্লাটুন শক্তিসম্পন্ন একটি দলকে (প্রায় ৩০জন) ঐ এলাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান কোর্ট ভবন দখলে রাখার জন্য পাঠিয়েছিলাম।

 শত্রুদের আরেকটি দল ষ্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের নৌ-ভবন থেকে বেরিয়ে পি, আই, এ অফিসের নিকটবর্তী একটি লেনের মধ্য দিয়ে ডিসি হিলের দিকে এগোতে থাকে। কয়েকজন পথচারী তাদের সামনে পড়লে পাকিস্তানীরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর একস্থানে থেমে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং দ্রুতগতিতে পাহাড়ের উপর উঠে সমগ্র এলাকাটি বিনা বাধায় দখল করে নেয়। কোর্ট বিল্ডিং-এ তখন আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষমান। তারা গভীরভাবে সাহায্যের প্রত্যাশা করছিলো। এবং সাহায্য করলেই যে কোন মূল্যে তারা শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পারতো।

 এইদিন বিকালে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি জাকির হোসেন রোডে একটি এ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য মেডিকেল কলেজে ফোন করে। এ পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ আমাদের সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনে ছিলো। কলেজের নিকটেই গুরুত্বপূর্ন স্থান প্রবর্তক হিলে আমাদের কিছু সৈনিক মোতায়েন ছিলো। আমাদের আহত সৈনিকদের নিয়ে মেডিকেল কলেজের ডাক্তার, নার্স এবং ছাত্রছাত্রীরা সকলেই দিনরাত ব্যস্ত ছিল।

 পূর্ব কথিত এ্যাম্বুলেন্সটি ফিরে আসতেই ডাক্তার এবং নার্সরা দ্রুত বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই বেরিয়ে আসে একদল শত্রুসৈন্য, হাতে তাদের উদ্যত হাতিয়ার। ক্ষিপ্ততার সাথে তারা হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। সন্ধা নাগাদ আরো একদল শত্রু সৈন্য এসে অবস্থান রত সৈনিকদের সাথে যোগ দেয়। কর্মচঞ্চল হাসপাতাল ভবন এবং পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকায় নেমে আসে এক বিষণ্ণ নীরবতা।  হালিশহর এবং কোর্ট ভবন, এ দুটি স্থানে তখনো আমাদের সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিলো। তা ছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে আমাদের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দলগুলো তখনো শত্রুসেনাদের মোকাবিলা করছিলো। কিন্তু শেষে কুমিল্লা থেকে নতুন শত্রুদল দেওয়ানহাট ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছে গেলে আগ্রাবাদ এলাকা থেকে আমাদের সৈন্যদের হালিশহর ঘাটিতে সরে আসা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা ততক্ষণে গ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেকে সরাসরি সীমান্তের দিকেও চলে যায়। সকলেই কেমন যেনো হতাশ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ ঠিকই ভেবেছিলো যে, কোনোরূপ সাহায্য ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ আমাদের পক্ষে দেরি হবে। কারণ ইতিমধ্যেই তারা দেখছে আমাদের সৈন্যরা ভীষণ অসহায় অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ করছিলো। আমাদের গোলাগুলির সরবরাহ ছিলো খুবই কম। একজন সৈনিকের হাতের অস্ত্র অকেজো হয়ে গেলে তাকে নতুন অস্ত্র না দেয়া পর্যন্ত সেই সৈনিকটিই অকেজো হয়ে পড়ে। কেউ আহত হলেও তার প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা তাকে অন্যত্র স্থানান্তরের তেমন কোন ব্যাবস্থা আমাদের ছিলো না। এমনকি একপর্যায়ে প্রয়োজনীয় পানি ও খাদ্য সরবরাহেরও কেউ ছিলো না। আমার ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টারে অয়্যারলেস কিংবা আধুনিক কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় বিভিন্ন রনাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈনিকদের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখতে পারিনি। ফলে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত হওয়া এবং সে অনুসারে নতুন নির্দেশ দেওয়াও সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া যাতায়েতের জন্য যানবাহন সমস্যাও ছিলো প্রকট। আমরা যোগাযোগ এবং পরিবহনের অভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি বেশী। কুমিরায় আমাদের অবস্থান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ একজন সংবাদ বাহকের মারফত তিন ঘণ্টা পর পাই। সংবাদ পাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি নতুন কিছু সৈন্য কুমিরার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কুমিরার দুই মাইল দুরে পৌঁছানোর পূর্বেই কুমিরার পতন ঘটে। আমাদের সৈন্যরা ততক্ষনে হালিশহরের দিকে ফিরে আসতে থাকে। আরেকটি সংকট ছিলো ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত্রু সৈন্যদের সাথে যখন অব্যাহতভাবে নতুন নতুন সৈন্য এবং অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ যোগ হচ্ছিলো, আমি তখন অসহায়ভাবে তা দেখছিলাম। একইভাবে দল বেধে আমাদের সামরিক লোকজনও শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।

 আমি যে কয়জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম তার সঙ্গে একজনও নতুন সৈনিক কিংবা একটি মাত্র বুলেটও যোগ করতে পারিনি। ক্রমাগত শত্রু সৈন্যর মোকাবেলা করে আমাদের সৈন্যরা ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো। অনেকেই ২৫ তারিখের রাত থেকে এ পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্যেও চোখ বন্ধ করতে পারেনি। আমার রেলওয়ে হিলের ঘাঁটি সার্কিটহাউস এলাকা, মেডিকেল কলেজ, ডি সি হিল এবং হালিশহর ও কোট বিল্ডিংয়ের যুদ্ধে আমি নতুন সৈন্য ও অস্ত্র সরবরাহ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় হতাশ হয়েছি বারবার। আর এই প্রত্যাশা যুদ্ধের সেই পর্যায়ে আমার সৈন্যদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে সাময়িকভাবে।

॥ চট্টগ্রাম শহরে চূড়ান্ত লড়াই॥

 ৩০শে মার্চ। শহরে তখন কারফিউ চলছে। খুব ভোরে এক ভদ্রলোক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে অস্থিরভাবে অনবরত টেলিফোন করছিলেন। একটু আগে জানালা দিয়ে তিনি নারকীয় দৃশ্য দেখেছেন। একটি গাছের ওপর বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। কয়েকজন পাকসেনা কিশোর বয়সের একটি ছেলেকে সেই পতাকাটি নামিয়ে ফেলতে বলে। ছেলেটি অনিচ্ছাস্বত্বেও গাছ বেয়ে উপরে উঠে এবং পতাকাটি খুলে আস্তে আস্তে ভাজ করতে থাকে। ঠিক এ সময়ে নিচ থেকে সৈন্যরা অত্যন্ত সুস্থ মস্তিস্কে তার দিকে রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ ছেলেটি বৃন্তচ্যুত ফুলের ন্যায় নিচে পড়ে যায়। সৈন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে এবং সে স্থান ত্যাগ করে।

 কোনো এ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কেউ কিশোরটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। হাসপাতালের সবকটি গাড়িই পাকিস্তানী সৈন্যদের বহন করছিলো। বস্তুত পুরো হাসপাতালটিই মিলিটারী ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিলো। বাঙালী ডাক্তার, নার্স এবং অধিকাংশ রোগী ইতিমধ্যেই হাসপাতল ত্যাগ করেছেন। আর রক্তপিপাসু দানবদের হাত থেকে পালাতে যারা একেবারেই অসমর্থ তারা অসহায়ভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।  প্রতিদিনের ব্যস্ত বিপণী কেন্দ্র নিউমার্কেট এলাকা সেদিন একেবারে চুপচাপ। দুপুরের মধ্যে পাকসেনারা পোর্টের দিক থেকে বরফকল সড়ক হয়ে এখানে পৌঁছে যায় এবং সদরঘাট, রেলওয়ে ষ্টেশন এবং ষ্টেডিয়ামের দিকে তারা অগ্রসর হতে থাকে। ছোট একটি দল কোর্ট হিলের দিকেও পা বাড়ায়। কিন্তু হিলে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যদের বুলেট বৃষ্টিতে পাকিস্তানীদের পিছু হটে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়।

 একই দিন হালিশহরেও সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ চলতে থাকে পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে কামান দেগে চলছিলো। নৌ-বাহিনীর সবগুলো কামানই তখন সক্রিয় ছিলো ক্রমাগত দীর্ঘ ৬ঘণ্টা যাবত তারা হালিশহরের ওপর গোলাবর্ষণ করে। কামানের ছত্রছায়ায় শত্ররা হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইপি-আর সেনাদের দুঃসাহসী পাল্টা আক্রমনের মুখে অগ্রগতি লাভে ব্যার্থ হয়ে শত্রুরা বিমান বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। আধ ঘণ্টার মধ্যে দুটি বিমান চলে আসে। এবং বেলা সড়ে বারোটা থেকে আমাদের অবস্থানের উপর ক্রমাগত বিমান হামলা চালাতে থাকে। আমাদের কোন বিমানবিধ্বাংসী হাতিয়ার ছিলো না। সেই সময় নিজেদের কোন বিমান থাকারও কথা নয়। তাই শত্রু বিমানগুলো আকাশে তাদের পূর্ন আধিপত্য বিস্তার করে নির্বিঘ্নে আমাদের ওপর বোমা বর্ষণ করতে থাকে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো রনাঙ্গনের ওপর আঘাত হানতে থাকলো। পরিস্কার রৌদ্রকরোজ্জল দিনে শত্রুর বিমানগুলো একটার পর একটা ট্রেঞ্চ দেখে দেখে ষ্ট্যাম্পিং করে চলছিলো। আমাদের বীর সেনানিরাও প্রাণপনে ঘাটি আকড়ে লড়াই করতে থাকলো। লড়াই করতে করতে অনেকেই ট্রেঞ্চের মধ্যে মৃত্যুবরন করলো। আহতও হলো অনেক। কিন্তু অবিরাম বোমা বর্ষনের ফলে তাদের অপসারণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধরত বাকী সৈন্যরাও বুঝতে পারলো তাদের আর বেশীক্ষন হালিশহর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। গোলাগুলির মজুতও নিঃশেষ প্রায়। তারা রাইফেলের ওপর বেয়োনেট লাগিয়ে নিচের শত্রুদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলো।

 বিকালের মধ্যে শত্রুরা হালিশহর দখল করে নিলো। হাতাহাতি যুদ্ধ চলছিলো আধঘণ্টার মতো। শত্রুসৈন্য সংখ্যাধিক্যের ফলে চুড়ান্ত ফলাফল কি হবে তা বোঝা গিয়েছিলো। আমাদের সৈন্যরা পেছনে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের একস্থানে অবস্থান গ্রহন করলো। সহযোগীদের লাশও ফেলে আসতে হলো।

 হালিশহর পতনের পর শত্রুদের পুরো দৃষ্টি পড়লো কোর্ট হিলের ওপর। এটাই ছিলো শহরে আমাদের সর্বশেষ ঘাটি, সর্বশেষ আশা। বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থানটির ওপর কয়েকবারই হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের সৈন্যরা তা প্রতিহত করে! এরপর এলো ট্যাংক বহর। অগ্রবর্তী ট্যাংকটি পাকা রাস্তা বেয়ে ওপরের দিকে উঠতেই আমাদের সৈন্যদের ট্যাংকবিধ্বংসী শেলের আঘাতে তা অকেজ হয়ে পড়লো। ট্যাংকটি অকেজো হয়ে থেমে পড়লে পেছনে অন্যান্য ট্যাংক এবং পদাতিক সৈন্যরা কিছুটা থমকে দাড়ালো। এ সময় সম্ভবত আমাদের শক্তির পরিমাপ করছিলো। ইতিমধ্যে অবশ্য শত্রুপক্ষ আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিলো। আমাদের সৈনিকদের তখন গোলাবারুদ নিঃশেষ প্রায় এবং বাইরের সাথে সকল প্রকার সংযোগও প্রায় সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলো। অদুর ভবিষ্যতে নতুন করে কোনো সাহায্য লাভের সম্ভাবনাও ছিলো না।

 ২রা এপ্রিল ভোরে শত্রুরা আবার হামলা শুরু করলো। হামলা ছিলো সুপরিকল্পিত। মাত্র ৩০জন সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো পাকিস্তানীদের পুরো একটি ব্যাটালিয়ন। দুটি কোম্পানী মিলে প্রথম আঘাত হানলে তা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করা হয়। এরপর আরো জোরদার হামলা চলতে থাকে। দুটি সংরক্ষিত কোম্পানী এবার অন্য দিক থেকে আক্রমন শুরু করে। মারাত্মক গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় এরা একটু একটু করে পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এদিকে আমাদের প্রতিরোধকারী সৈন্যদের গোলাগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। একমাত্র ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রটিও অকেজো হয়ে পড়ে। পদাতিক বাহিনীর আগে আগে এ সময় দুটি ট্যাংক উপরে উঠে আসে। বলতে গেলে অলৌকিকভাবে সেদিন আমাদের সৈনিকদের প্রায় সবাই সে অবস্থান ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো। এভাবেই কোর্ট হিলের পতন ঘটলো এবং সাথে সাথে অনির্দিষ্টকালের জন্য চট্টগ্রাম নগরীও আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো। তখন সময় ছিলো বেলা সাড়ে ১২টা। মাত্র ৩০জন ইপিআর-এর দুর্জয় সৈনিক শত্রুপক্ষের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য শক্তির অব্যহত শেলিং এবং উপর্যুপরি আক্রমনের মুখে ৩ দিনেরও বেশী সময় তাদের অবস্থান আগলে রেখে ছিলো। কাজেই এই পরাজয় তাদের অদম্য সাহস ও বিক্রমের মহিমাকে ম্লান করে দিতে পারে না।

॥ ভারতের সাথে যোগাযোগ॥

 এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই আমি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সংগে যোগাযোগ করার জন্য রামগড় যাই। সেখান থেকে সাবরুম গেলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বি এস এফ) অফিসাররা আমার সঙ্গে কথা বলেন এবং অবিলম্বে আগরতলার নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজনবোধে ভারতীয় রাজধানীতে যাওয়ার ব্যবস্থাও তারা করে রাখেন।

 ২রা এপ্রিল আমি আগরতলা পৌঁছালে সরাসরি আমাকে বিএসএফ-এর সিনিয়র অফিসার মিঃ কালিয়ার অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি তার কাছে আমাদের লড়াইয়ের অবস্থা বর্ণনা করে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ জানালাম। মিঃ কালিয়া অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বিধায় আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর ছিলো না। আমাকে আগরতলার এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সেখানেই এক কক্ষে আমি সারাদিন রইলাম। সেখানে সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন ভারতীয় অফিসার পর্যায়ক্রমে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারা আমার কাছে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান, তাদের শক্তি, কোন ধরনের অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন। তারা আমার অতীত জীবন এবং কি কারণে আমি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলাম সে বিষয়েও প্রশ্ন করলেন, ঘটনাবলী সম্পর্কে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতা অর্জনে আমরা কি কি উদ্যোগ নিয়েছি তাও জানতে চাইলেন।

 এদের সেঙ্গে আমার আলোচনা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন এবং আন্তরিকতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারা খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবে এদের আলোচনার ধারা থেকে আমি বুঝতে পারি, এরা সকলেই ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং বি এস এফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের লোক। পরের দিন নেতৃস্থানীয় ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হলো। বিকালের দিকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন সিং-এর সঙ্গে আমি বৈঠকে মিলিত হলাম। তার আচরনও ছিলো বন্ধুসুলভ। তার কাছেও আমি অস্ত্রশস্ত্র এবং কিছু জরুরী জিনিসপত্রের জন্য অনুরোধ জানাই।

 মুখ্যমন্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, দিল্লী থেকে জবাব এলেই তিনি আমার জন্য কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ সময় আমাকে দরকার হলে দিল্লী যাবার জন্যও প্রস্তুত থাকতে বলা হলো।

 পরদিন চট্টগ্রাম জেলার কয়েকজন রাজনৈদিক নেতা আগরতলা পৌঁছলেন। তাদের নিয়ে আমি পুনরায় শ্রী শচীন সিং-এর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে, ৯২তম বি এস এফ ব্যাটালিয়ন থেকে জরুরী ভিত্তিতে আমি কিছু অস্ত্রশস্ত্র পেতে পারি। আমার অন্যন্য জিনিসপত্রের চাহিদা সম্পর্কেও তাকে অবহিত করতে বললেন। আমি তার কামরার এক কোনায় বসে প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যে প্রয়োজণীয় জিনিসপত্রের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ফেলি। আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে সেটি তুলে দিয়ে আমি তখনই চট্টগ্রামের পথে আগরতলা ত্যাগ করলাম। পথে ৯২তম বি এস এফ এর কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল ঘোষের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তিনি ততক্ষনে আমাকে কয়েকটি লাইন মেশিনগান, রাইফেল, হ্যাণ্ডগ্রেনেড এবং কিছু গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য তার ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দিয়ে ফেলেছেন এবং সেগুলো ইতিমধ্যেই সাবরুম থানায় পৌঁছানো হয়ে গিয়েছিলো। জিনিসগুলো আমাকে দেয়ার জন্যে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে বি-এস-এফ এর ক্যাপ্টেন মেহেক সিংকে আমার সঙ্গেই পাঠানো হয়।  চট্টগ্রাম শহরের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানীরা গ্রামাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানীদের একটি কলাম হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, নারায়ণহাট এবং হিয়াকু হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই, এবং কক্সবাজারের দিকেও একটি করে কলাম অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় আমরা গ্রামাঞ্চলের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রন বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত নিই। এ উদ্দেশ্য সাধন কেবল শত্রু সৈন্যদের শহরাঞ্চলে কোণঠাসা করে রাখার মাধ্যমেই সম্ভব ছিলো। এভাবে সুসংগঠিত গেরিলা যুদ্ধেও মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শত্রুর শক্তিক্ষয় করে তাদের উপর চুড়ান্ত আঘাত হানাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। এটা আমাদের কাছে পরিস্কার ছিলো যে, এই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাদেরও হারাতে হবে অসংখ্য অমূল্য জীবন। আমাদের সামনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ব্যাতীত অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা ছিলো না। এ জন্য অবশ্য জনসাধারণকে ও সীমাহিন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

 রামগড় থেকে দুটি ইপি আর প্লাটুনকে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ছয় মাইল দুরে ভাটিয়ারি এবং ফৌজদার হাটের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহনের জন্য পাঠানো হয়েছিলো। অন্য দুটি ইপি আর প্লাটুনকে ফটিকছরি হাটহাজারী হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে সহযোদ্ধাদের সাহায্যে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন হারুন এবং আরো কয়েকজন অফিসার ৬টি কোম্পানী নিয়ে কালুরঘাট সেতুর নিকটেই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিলো। ঠিক এ পর্যায়ে চৌঠা এপ্রিল আমরা ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রথম সরবরাহ পাই। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এ সময় আমাদের পুরো বাহিনীকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সদস্যদের গুরুত্বহীন স্থান থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধ ফ্রণ্টগুলোতে পাঠানো হল। ক্যাপ্টেন মতিন এবং লেফটেন্যাণ্ট এজাজের নেতৃত্বে এরুপ দুটি কোম্পানী ভারতীয় এলাকা দিয়ে। শতাধিক মাইল দুরে চট্টগ্রাম সেক্টরকে শক্তিশালী করার জন্য সেখানে পৌঁছে। আমাদের দলের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ এদের একটি কোম্পানী ভাটিয়ারী অভিমুখে রওয়ানা হয়। এবং অন্য একটি কোম্পানীকে নিয়ে আমি হিয়াকু, ফটিকছড়ি হয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে অগ্রসর হই। এটা ছিলো এক কষ্টসাধ্য অভিযাত্রা। রাস্তা ছিলো অত্যান্ত খারাপ। যান্ত্রিক কনভয় বলতে ছিলো দ্বিতীয়। বিশ্বযুদ্ধকালের কয়েকখানী জীপ, আর এই জীপ গুলোকে প্রায় অর্ধেক পথই আমাদের ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। আমাদের এই চলাচলের খবর গোপন রাখার উপায় ছিলনা। কারণ, যেমন দিনের বেলায় আমাদের চলতে হচ্ছিলো। তেমনি আবার ভারতের পথে পলায়নপর ভীতসন্ত্রস্ত অসংখ্য জনসাধারণ একই পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। যদিও আমরা সবাই বেসামরিক পোষাকে ছিলাম। এবং অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম, তথাপি শত্রুকবলিত একটি শহরের দিকে কিছুসংখ্যক লোকের সুসংগঠিত হয়ে চলার ভাব দেখে আশঙ্কা ও হতাশায় নিমজ্জিত লোকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চর হয়। আত্মসন্তুষ্টি লাভের জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক সংখ্যর চেয়ে কয়েকগুন বাড়িয়ে শহরের দিকে তাদের যাত্রার কথা যেভাবে বলাবলি করছিলো সে খবর দ্রুত শত্রু ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়।

 নারায়ণহাটে পৌঁছে আমরা সন্ধার পরবর্তী যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। রাতের সামান্য আহার গ্রহণ করি। নারায়ণহাট থেকে আমাদের মুক্তি সেনাদের নাজিরহাট পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়। আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন অন্যদিকে নৌকাগুলোরও কোন ছই ছিলো না। ক্লান্তিতে অবসাদে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষণ পর মুষল ধারায় বৃষ্টি নেমে আসে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজে উন্মুক্ত আকাশের নীচে শীতে কাপতে থাকি। নাজিরহাট পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেল। এখানেই খবর পেলাম ক্যাণ্টনমেণ্টের নিকট আমাদের যে সেনাদল ছিলো শত্রুর আক্রমণে তারা পিছু হটে হাটহাজারীর দিকে চলে গেছে। নাজিরহাট পৌঁছেই আমাদের জন্য একটি সম্ভাব্য ঘাঁটি খুজে বের করার উদ্দেশ্যে দ্রুত পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করি। খোজাখুজির পর কয়েক মাইল দূরে উদালিয়া চা বাগানই উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে দিকে রওয়ানা হলাম। বাগানের ম্যানেজার আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানালেন। সকল প্রকার সাহায্যের তিনি ব্যাবস্থা করেছিলেন। সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণীর একটি বিচ্ছিন্ন ছোট পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে উদালিয়া চা বাগান। সৈন্যদের এখানে ছোট ছোট দলে ভাগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, খাবারের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজের ভার দেয়া হলো। এ্যাকশন গ্রুপকেও সদা প্রস্তুত রাখা হলো, যাতে তারা স্বল্পকালীন সময়ে শত্রুর মোকাবিলায় দ্রুত রওয়ানা হতে পারে। প্রয়োজনবোধে বিকল্প ঘাঁটি স্থাপনের স্থানটিও দেখে রাখা হয়। রক্ষাব্যূহ নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে এই স্থানের দায়িত্ব লেফটেন্যাণ্ট এজাজের ওপর ন্যস্ত করে আমি কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হই।

 কালুরঘাটের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে অধিকাংশই ছিলো ইপিআর সৈনিক। প্রাথমিক পর্যায়েই আমি যখন চট্টগ্রাম শহরে পাকসেনাদের সংগে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। তখনই আমার সংগে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের সীমান্ত ফাড়িগুলো থেকে আগত ইপিআর সৈনিকদের অগ্রযাত্রা মেজর জিয়া থামিয়ে দেন। ইপি আর সৈনিকদের তিনি কালুরঘাটে রেখে দিয়েছিলেন। ৮ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের কিছু সৈন্যকেও এখানে রেখে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে কালুরঘাটে তখন ৬টি কোম্পানী ছিলো যার সৈন্য শক্তি ছিলো প্রায় এক হাজার।

 আমি যখন চট্টগ্রাম শহর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নতুন লোকবল ও অস্ত্রবলের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলাম তখন আমারই নির্দেশে আগত ইপি-আর সেনাদের কালুরঘাটে আটকে রাখা হয়। আমাদের সৈন্যদের কালুরঘাটে না থামিয়ে আমার সঙ্গে শহরের যুদ্ধে যোগ দিতে দেয়া হলে আমরা সাফল্যের সাথে নৌ-বাহিনীর সদর দফতর, বিমান বন্দর এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করতে পারতাম। এর ফলে পাকিস্তানীরা আর নতুন সৈন্য আনতে পারত না এবং আমরাও সেখানে তাদেরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধের ইতিহাস হতো সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

 কি কারণে জানিনা, কালুরঘাট যুদ্ধ হয়েছিলো দুই সপ্তাহ পরে এবং এই দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের এখানকার সৈন্যরা প্রায় কোন কাজেই লাগেনি। আমাদের তরুন অফিসাররা দুর্জয় মনবল এবং অদম্য সাহসের সংগে এখানে লড়াই করলেও সৈন্যরা কিন্তু যোগ্য সিনিয়র অফিসারের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছিলো। অবশ্য আমাদের সিনিয়র অফিসারদের সংখ্যাও তখন খুব বেশী ছিল না। এদের মধ্যে আবার মেজর শওকত কক্সবাজার চলে গিয়েছিলেন। ভূল খবরের ভিত্তিতেই এটা হয়েছিল। তারপর তিনি নিজেই কক্সবাজার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কালুরঘাটে আমাদের সৈন্যদের সাথে যোগ দেন।

 এখানে অমাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিলো না। ৩০৩ রাইফেল ছাড়া আর ছিল কয়েকটি হালকা মেশিনগান এবং দুটি ৩” মর্টার। ইপি-আর মর্টার জেসিও দুটি মর্টার দিয়েই অবিশ্বাস্য কাজ করেছিলেন। মাত্র কয়েক রাউণ্ড মর্টার শেল দিয়েই তিনি শত্রু সৈন্যদের একাধিক জায়গায় ব্যস্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি একাই দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে মর্টার দাগতে থাকলে আমাদের মর্টারের সংখ্যা ঠিক কত পাকিস্তানীরা তা অনুমান করতে ব্যার্থ হয়। আমাদের প্রতিরোধের দুর্জয়তায় শত্রুরা বারবারই পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পরিশেষে প্রায় দুসপ্তাহ পরে ১১ই এপ্রিল কালুরঘাটের যুদ্ধ চুড়ান্ত রুপ নেয়। কালুরঘাট সংঘর্ষে আমরা কেবল সৈনিকই হারাইনাই দুজন অফিসারও সেই সংকটকালে আহত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হারুন গুরুতর অবস্থায় বার্মায় আশ্রয় নিলেন, আর লেফটেন্যাণ্ট শমসের মবিন গুরুতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হলেন।

 কালুরঘাট অবস্থান পরিদর্শনের পর আমি আবার রামগড় হয়ে ঘুরে কুমিরার দিকে অগ্রসর হই। কুমিরার সৈন্যদের জন্য আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র লাভের উদ্দেশ্যে রামগড়ে আমাকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। রামগড়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হলে তাকে আমি কালুরঘাট অবস্থানের আসারতার কথা বলি। তারপর কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সোজা কুমিরার পথে রওনা হই। কুমিরায় তখনো আমাদের সৈন্যরা

শত্রুর সাথে মরণপণ লড়ে যাচ্ছিল।

॥ প্রথম বাংলাদেশ সরকার॥

 ৪ঠা এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের পতন ঘঠলে পাকিস্তানীরা ক্রমান্বয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ই এপ্রিলের মধ্যে সেতুর নিকট তারা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে। এই সময় শত্ররা ছিলো আক্রমণমুখী এবং আমাদের ভুমিকা ছিলো আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী আত্মরক্ষমূলক অবস্থানে থাকতে থাকতে আমাদের সৈন্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলছিলো।

 ১১ই এপ্রিল সকাল ৮টায় শত্রুপক্ষের গোলন্দাজ বাহিনী কালুরঘাট অবস্থানের ওপর আক্রমন শুরু করে। নৌ-বাহিনীর কামানগুলো থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন হারুন এবং লেফটেন্যাণ্ট শমসের সেতুর পশ্চিম পার্শ্বে (শহরের দিকে) অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আমাদের প্রধান অবস্থান ছিলো সেতুর পূর্ব পার্শ্বে।

 কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুদের গোলাবর্ষণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই গোলাবর্ষনের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীরা সম্মুখযুদ্ধেও প্রস্তুতি নিয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ট্রেঞ্চ থেকে হারুন শত্রুপক্ষের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করে শমসেরকে বলল তোমার বাইনোকুলারটা দাও তো। ওদের অবস্থানটা দেখি। কথা শেষ না হতেই হারুন তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল। তীব্র যন্ত্রনায় হারুন কুকড়ে যাচ্ছিলো। লাইট মেশিনগানের এক ঝাক গুলি তাকে বিদ্ধ করেছে। দুজন ছাত্র তাড়াতারি হারুনকে ধরে সেতুর গোড়ায় নিয়ে এলে সে নিজেই প্রায় দৌড়ে সেতু পার হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে যায়। তাকে একটি মাইক্রোবাসে পটিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর অল্পক্ষন পরেই শমসেরের হাটুতে গুলি লাগলে সেও অচল হয়ে পড়ে। তখন তার প্রায় চারপাশেই লড়াই চলছিলো। শমসের শত্রুদের হাতে বন্দি হয়। দুজন অফিসারকে হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। তারা ঘাঁটি ত্যাগ করে পিছনে হটতে শুরু করে। সেদিন বিকাল নাগাদ কালুরঘাটে অমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং আমাদের সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পথ ধরে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

 পথে মহালছড়িতে হঠাৎ পাকিস্তান বাহিনীর কমাণ্ডো কোম্পানীর সাথে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। পাক বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী মিজোরাও ছিল। পাকিস্তান সরকার এইসব মিজোদের আশ্রয় এবং ট্রেনিং দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতায় সহায়তা করতো।

 উদালিয়া চা বাগানে আমাদের যে কোম্পানী ঘাঁটি স্থাপন করেছিলো পাকিস্তানীদের তীব্র আক্রমণে তাদের সে এলাকা পরিত্যাগ করতে হয়। ওদিকে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের কুমিরায় তখন প্রচণ্ড লড়াই চলছিলো। চট্টগ্রামের দিকে শত্রুও অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের যে সৈন্যরা সেখানে অবস্থান গ্রহন করেছিলো শত্রু বাহিনী পর্যবেক্ষণ বিমানের সহযোগিতায় তাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণে আমাদের পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরো রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আমাদের সৈন্যরা সীতাকুণ্ডুতে সরে আসে। শত্রু সৈন্যের আগমন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যেই সেখানে আমাদের অল্প কয়েকজন সৈন্য থেকে যায় এবং এই অবসরে বাঙালী সৈন্যরা তাদের সীতাকুণ্ডু ঘাটি সুদৃঢ় করে গড়ে তোলে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিলের মধ্যে শত্রুরা আমাদের সীতাকুণ্ডু অবস্থানের ওপর আঘাত হানে। তারা গোলান্দাজ বাহিনীর সহায়তায় কয়েক দফা হামলা চালায়। নৌ-বাহিনীর কামানগুলো তখন ব্যাপক ভাবে গোলাবর্ষণ করছিলো। তবুও আমাদের সেনারা পাল্টা আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে।

 বাংলাদেশে প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় আমবাগানে বাঙালীর জীবনে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা ঘটে যায়। দিনটি ছিল এপ্রিলের ১৭ তারিখ। ঐদিন সকাল আনুমানিক ৮টায় জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্ণেল (অবঃ) এম,এ,জি ওসমানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা বৈদ্যনাথ তলা এসে পৌঁছান। নেতৃবর্গের বসার জন্য পাশের গ্রামগুলো থেকে কিছুসংখ্যক চেয়ার জোগাড় করা হলো। সেসব চেয়ারের অধিকাংশের হাতল ছিল না। বেলা ১১টার মধ্যে অন্যান্য নেতারা পৌছে গেলেন। পাশ্ববর্তী এলাকার লোকজন এবং জনা পঞ্চাশেক বিদেশী সাংবাদিকও সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা আম্রকাননে উপস্থিত হলেন। এদের সমানেই সেদিন গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শেখ মুজিবের নামানুসারে এ জায়গাটির নামকরন করা হয় মুজিবনগর। শেখ মুজিবর রহমানের নাম ঘোষনা করা হয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন উপ-রাষ্ট্রপতি এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাক সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী। ইপিআর এর একটি প্লাটুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

 এদিকে ১৮ই এপ্রিল শত্রু বাহিনী আমাদের সীতাকুণ্ড অবস্থান ছত্রভঙ্গ করে দিলে এখান থেকে আমাদের সৈন্যদের মিরেশ্বরাইতে পশ্চাদপসরণ করতে হলো। আমরা জানতাম মিরেশ্বরাইতেও আমরা অলপ কিছু দিনের জন্য থাকতে পারবো, তারপর আবার সরে যেতে হবে। এই দুঃখজনক অবস্থা কতদিন চলবে তা কারো জানা ছিল না। সৈন্যরাও ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলছিল। কোন অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান হয়ে উঠছিলো। লোকবল এবং বিপুল অস্ত্রবলের সাহায্যে শত্রপক্ষ প্রতিটি যুদ্ধেই ইচ্ছামতো ফলাফল নির্ধারণ করে চলছিল। এই সংকটময় দিনগুলোতে আমাদের সবচাইতে বেশী দরকার ছিল কিছু ভাল অস্ত্রের। চিরাচরিত পন্থায় যুদ্ধ হচ্ছিল। অস্ত্রবল বৃদ্ধি করতে না পারলে আমাদের জয়ের কোন আশাই ছিল না। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলাদেশ বাহিনীর কলকাতাস্থ সদর দফতরটি ছিল রণাঙ্গন থেকে বহুদূরে। সম্ভবতঃ এই দূরত্বের কারণেই যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের চাহিদা সম্পর্কে সদর দফতর কিছুটা উদাসীন ছিলেন। একদিকে আমাদের সামরিক দফতর থেকে বলা হতো যেভাবেই হোক ঘাটি দখলে রাখার জন্য দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা কর। আবার উন্নত ধরণের অস্ত্রশস্ত্র চাইলে জবাব পেতাম, এটা তো গেরিলা যুদ্ধ, ভারী অস্ত্রের তেমন প্রয়োজন নাই। ওই জবাব গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত বই পড়া জবাব, না, ভারতের কাছে থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহে সরকারের অক্ষমতা তা আমরা জনতাম না। গেরিলা যুদ্ধে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন নেই। এই উক্তিটি যে কত অসার, সে সময়ের পৃথিবীর অন্যান্য যেসব দেশে গেরিলা যুদ্ধ চলছিল, সেসব যুদ্ধ পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায়। তাছাড়া আমরা শুধু গেরিলা যুদ্ধ করছিলাম না। সাথে সাথে প্রচলিত ধারার লড়াইও আমাদের করতে হচিছল। দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে আমাদের সৈন্যরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে শত্রপক্ষের অগ্রাভিযান প্রতিরোধেরও চেষ্টা করছিল। প্রচলিত প্রথার এই যুদ্ধের পাশাপাশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছোট ছোট গেরিলা দলকেও বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হচ্ছিল।

 একাত্তরের যুদ্ধের এই বৈশিষ্ট অনেকেই পরিস্কারভাবে বুঝতে পারেননি। তাই আমাদের সরকার এবং সামরিক হেডকোয়ার্টারের কাছে আমাদের সুবিধা অসুবিধাও বোধগম্য হয়নি। সবচাইতে নাজুক অবস্থা ছিল হতো। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা বলছি। তখন আমি সৈন্য নিয়ে মিরেশ্বরাই এলাকায় শত্রর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ৩” মর্টার গোলার ঘাটতি ছিল আমাদের এবং শত্ররা তখন আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের ওপর কামান দেগে চলছিলো। শত্রশু গোলায় আহত একজন সৈনিক আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি আমাদেরকে কামানের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের কামান ব্যবহার করছেন না কেন? এ প্রশ্নের আমি কোন জবাব দিতে পারিনি। তবু আমার আশা ছিল, শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য আমি পাবোই। এটা আমার দুরাশা ছিল কিনা বলতে পারিনা। পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র পাওয়ার ইঙ্গিতের উপর ভিত্তি করেই আমি যোদ্ধাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

 শেষ পর্যন্ত যখন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিল না এবং যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া যাচ্ছিল না সে অবস্থায় সৈন্যদের ঘাঁটি আগলে থাকার নির্দেশ দেয়া আমাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। এতদসত্বেও, আমি আমার বাহিনীকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাদের অবস্থান রক্ষা করতে বাধ্য করছিলাম। এ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। কোন কোন সময় মনে হয়েছে সৈন্যদের আমরা গিনিপিগের মতো ব্যবহার করছি। ট্রেঞ্চ বসে থেকে কেউই প্রাণ হারাতে চায় না। তারা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু প্রচলিত যুদ্ধের সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছিল।

 ২০শে এপ্রিল পাক-সেনাদের দুটি ব্যাটালিয়ন সর্বশক্তি দিয়ে মিরেশ্বরাইয়ের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। চুড়ান্ত আঘাত হানার পূর্বে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই পাক কামানগুলো আমাদের অবস্থানের উপর আঘাত হেনে চলছিলো। মাটি খোড়ার সরঞ্জমাদি এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র না থাকায় তেমন শক্তিশালি বাংকারও আমরা তৈরী করতে পারিনি। অনেক সময়ই সৈন্যদের বেয়োনেট দিয়ে মাটি খুড়তে দেখেছি। উপরের আচ্ছাদন তৈরীর জিনিসপত্রও ছিল না। তাই আমাদের ব্যাংকার এবং ট্রেঞ্চগুলো কামানের গোলায় ভেঙ্গে পরছিলো। খোলা জায়গায় আমাদের সৈন্যরা শত্রুর সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছিলো। যা আশংকা করেছিলাম, শত্রুরা এই সময় এয়ার বার্স্ট শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা এই ধরনের হামলার সাথে পরিচিত ছিল না। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অবস্থান থেকে তারা হটতে শুরু করে। শত্রুপক্ষেও হতাহত কম হচ্ছিল না। পরপর তিন দফা আক্রমণে ওদেরকে শতাধিক সৈন্য হারাতে হয়। আমাদের ট্যাংকবিধ্বংসী গোলায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহী আটটি যান প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ জ্বলতে থাকে। মটরযানে অবস্থানরত বেশকিছুসংখ্যক সৈন্যও জ্বলন্ত দগ্ধ হয়। সন্ধার অন্ধকারে আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী অবস্থান মস্তাননগরে প্রতিটি রক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। এই সময়ে শত্রুপক্ষেও আক্রমনকারী সৈন্যদের সাথে কয়েকটি ট্যাংক এসে যোগ দিলে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়ে ওঠে।

 আমাদের সৈন্যরা মস্তাননগরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পূর্বেই সেখানে শত্রুর কামানের গোলা এসে পড়তে থাকে। বাঙ্গালী সোনদের তখন খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা যাচ্ছিল না। এমনকি গোলাগুলির যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছিলো। তবু তারা শেষ গুলিটি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘাটি আগলে থাকে। শত্রুরা তখন ট্যাংক সামনে নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মস্তাননগরের অবস্থান টিকিয়ে রাখা দুস্কর হয়ে উঠলে আমি করেরহাটের কয়েক মাইল দক্ষিণে হিংগুলী এলাকায় সৈন্যদের নিয়ে যেতে মনস্থ করি। এখানে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি খাল থাকায় শত্রুদের দ্রুত আগ্রগমন সম্ভব ছিল না। অগ্রসরমান শত্রুর ট্যাংকের অগ্রযাত্রা থামাতে হলে খালের উপর প্রধান সেতুটি ধ্বংস করা দরকার।

 তখন প্রায় মধ্যরাত। আমাদের সৈন্যরা সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। তবু তারা দ্রুত হিংগুলীতে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়ে তোলে এবং পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাতে কারো চোখে ঘুম ছিল না। পাকিস্তানীরা সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিল। হিংগুলীর অদুরেই আমরা তাদের যানবাহন এবং ট্যাংকের আওয়াজ পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি সেতুটি ধ্বংসের কাজে হাত দিলাম। আমাকে সহায়তা করছিলো বি এস এফ এর মেজর প্রধান।

 রাত ৭টা নাগাদ সেতুটি ধ্বংস করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো এবং মেজর প্রধান সেই রাতেই সাবরুমের পথে রওনা হয়ে গেলেন। আমি তিরিশ সেকেণ্ডের একটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিই। এক এক করে সেকেণ্ড অতিবাহিত হয়, তারপর মিনিট, কিন্তু বিস্ফোরণ আর ঘটলো না। আসলে ফিউজটি খারাপ ছিল। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত যে একটি ফিউজ ছিল তাও দেখা যায় অকেজো। ভোর হতে আর মাত্র দুঘণ্টা বাকী। এরই মধ্যে সেতু আমাদের ধ্বংস করতেই হবে। তখন আমার সামনে হিংগুলির ২৫মাইল দুরের রামগর থেকে ফিউজ নিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। ট্যাংক এবং অন্যান্য গাড়ি ক্রমশ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিল। রাত ৩টা। আমি তখন মরিয়া হয়ে ফিউজের জন্য খবর পাঠালাম। আমাদের নিজস্ব কোন বিস্ফোরনের মজুত ছিল না। ফলে সম্পূর্ণভাবে বি এস এফ এর উপর নির্ভর করতে হতো।

 রাতে আমরা দ্রুত হিংগুলি ঘাটিতে অবস্থান করছিলাম। ভোরে আবার তার পূনর্বিন্যাস করার দরকার হবে। ভয় ছিল এই পুনর্বিন্যাসের আগেই শত্রুরা এসে না পড়ে। সেতু ধ্বংস করা যায়নি। ট্যাংক এসে পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ইতিমধ্যে রামগড় ফেরার পথে মেজর প্রধান খবর পান যে, সেতুটি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এই সংবাদ পেয়ে তিনি দ্রুত কয়েকটি ফিউজ নিয়ে পুনরায় আমাদের হিংগুলি অবস্থানে আসেন। রাত তখন পোনে ৪টা। এসময় রামগড়ের দিক থেকে আমার দিকে অগ্রসরমান একটি জীপের আলো আমার নজরে পড়ে। মেজর প্রধান জীপ থেকে দৌড়ে এসে আমাকে একটি ফিউজ দিয়ে বলেন, এটা আশা করি কাজ করবে। না সেটাতেও কোন কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ ফিউজ কাজ হলো। কর্ণবিদারী বিস্ফোরণের আওয়াজ কয়েকমাইল দূর থেকেও শোনা গেল। সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়াতে অমাদের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। আমরা দু'জনে আনন্দে বলে উঠলাম “চমৎকার”।

 শত্রুসৈন্যদের মুল দল তখন মাত্র মাইলখানেক দুরে। এদের পেছনেই ছিলো আর্টিলারী। দিনের প্রথম আলোয় আমরা তাড়াতাড়ি ঘাটি পুনর্বিন্যাসের কাজে হাত দিই।

 এই সংকটময় মুহুর্তে কুমিল্লা সেক্টর থেকে পাওয়া আমাদের একটি নিয়মিত কোম্পানীকে অন্য এক যুদ্ধ ফ্রণ্টে চলে যেতে হয়। আমার কাছে হিংগুলিতে তখন একশর বেশী লোক ছিল না, যাদের অধিকাংশ ইপি আর পুলিশ ও মুজাহিদ। আমাদের সৈন্যদের বেশীরভাগই মহালছড়ি এবং নরায়ণহাট এলাকার সংঘর্ষে ব্যাপৃত ছিল। আমাদের হিংগুলীর অগ্রবর্তী অঞ্চল ছিল প্রায় তিন মাইল বিস্তৃত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা করা অপরিহার্য। কুমিল্লা সেক্টরের কোম্পানীর কাছে কিছু ভাল অস্ত্র ছিল তা তারা নিয়ে গেছে। আমাদের ছিল মাত্র দুটি লাইট মেশিনগান। বাকীগুলো ছিলো সবই সেকেলে ৩০৩ রাইফেল। একটি ৩” মর্টার পাওয়া গেলেও সেটি আপন খেয়ালে চলতো। আমি বুঝতে পারছিলাম মাত্র একশ সৈন্য নিয়ে দুই ব্যাটালিয়ন শত্রুসৈন্যকে নিশ্চয়ই বেশীক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নারায়ণহাটে সৈন্য চেয়ে আমি যে খবর পাঠিয়েছিলাম তাদের আসতে অন্তত দুদিন লাগবে। এখানে আমাকে এই দুইদিন শত্রুদের ঠেকাতে হবে। শত্রুরা আমার আসল শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও আভাস পেলে তৎক্ষনাৎ আক্রমন করে বসতো। সেতুর পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকা পর্যন্ত প্রায় সমতল। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট ঢিবি, টিলা। সৈন্য চলাচলে এগুলো আড়াল হিসেবে কাজে লাগছিলো। এই সমতল এলাকাটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় দুই মাইল। সেতুর পশ্চিম দিকের এলাকা একেবারে সমুদ্র উপকুল পর্যন্ত আমাদের অরক্ষিত রাখতে হচ্ছিল। সৈন্যসংখ্যা বেশি না থাকায় আমি জনা তিরিশের মত লোক নিয়ে তাদের দুভাগে ভাগ করি। এরপর দুদলকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাঠাই। উদ্দেশ্য ছিল, তারা এমনভাবে চলাচল করবে যাতে দুর থেকে শত্রুরা বুঝতে পারে যে, দুটি অঞ্চল জুড়েই আমরা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সামনে এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় শুয়ে পড়ে এবং এমনভাবে হামাগুড়ি দিয়ে কোন মাঠ কিংবা ঝোপের পেছনে চলে আসতো যাতে শত্রুরা তাদের পেছনে হটে যাওয়া দেখতে না পায়। এখান থেকে উঠে আবার একটু প্রকাশ্যভাবেই আরেক যায়গায় যেতে থাকে। গোপনে পিছন থেকে এবং প্রকাশ্যে সামনের দিকে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকবার করে চলে। এতে শত্রুদের ধারনা জন্মায় যে এক একটি স্থানেই পঞ্চাশ ষাটজন করে বাঙ্গালী সেনা রয়েছে। অথচ আমাদের ছিল মাত্র পনেরজনের মতো। বিকাল পর্যন্ত আমরা কাজটি চালিয়ে যেতে থাকি। দূর থেকে কেউ এ দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত মনে করবে সেতুর উভয় পার্শ্বে আমাদের পনের শত থেকে দুই হাজার সৈন্য প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করছে।

 এই অবস্থায় আমাদের বাদবাকী সৈন্যরা সেতুর নিকট রাস্তা কভার করে সুবিধাজনক স্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলতে থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। পদ্ধতিটি কিছু সময়ের জন্য অবশ্যই কাজে লেগেছিলো। রাতে আমাদের সাড়া সম্মুখভাগ জুড়ে শত্রুর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়। দুই দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তবু তারা এগিয়ে এসে আক্রমণ করলো না। এদিকে আমার দলেও নতুন সৈন্য এসে পৌঁছায়নি। এ সময় এক নতুন বিপদ দেখাদিলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুলসংখ্যাক সৈন্য এসে পড়ায় শত্রুরা প্রতিটি রণাঙ্গনে আরো বেশী করে সৈন্য পাঠাতে লাগলো। ১২০ এম এম মর্টারসহ আধুনি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি পুরো ব্যাটালিয়ন ফটিকছড়ি, নাড়ায়ন হাট দিয়ে হিয়াকুর দিকে এগোয়। এদের অগ্রাভিযানের ফলে হিয়াকু এবং করেরহাট হিংগুলী এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের সকল সৈন্য আটকা পড়ার আশংকা দেখা দেয়। এই অবস্থায় আমি নারায়নহাট থেকে সৈন্য পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করি।

॥ রামগর ভস্মীভূত॥

 ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানীদের হাতে করেরহাটের পতন ঘটে। তারপর তিন দিক থেকে রামগড় অভিমুখে অগ্রসর হয়। করেরহাট রামগড় সড়কে একদল, নারায়ণহাট হিয়াকু রামগড় পথে দ্বিতীয় দল এবং মহালছড়ি রামগড় সড়ক ধরে তৃতীয় দল অগ্রসর হতে থাকে। করেরহাট থেকে রমগড় যাওয়ার পথে পাহাড়গুলো দখল করার জন্য পাকিস্তানীরা পূর্বদিকে এগুচ্ছিলো। ফেনী নদীর শুভপুর সেতুর দিকেও কিছুসংখ্যক শত্রুসেনা অগ্রসর হচ্ছিলো। পক্ষকাল পরে এই সেতুর কাছেই এক রক্তক্ষয়ী লড়াই সংঘটিত হয়।

 করেরহাট এবং রামগড়ের মাঝামাঝি স্থানে ছোট বাজার হিয়াকু। শত্রুরা কিভাবে যেন জেনেছিলো আমরা রামগড়েই চট্টগ্রাম সেক্টরের সদর দফতর স্থাপন করেছি। কথাটি আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ নয়। এখানে আমাদের কিছু জ্বালানী এবং খাদ্য মজুদ ছিলো। আরো ছিল আমাদের আহতদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী একটি হাসপাতাল। এছাড়া ছিল ছোট্ট একটি ট্রেনিং ক্যাম্প। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে আমরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের ট্রেনিং দিচ্ছিলাম। তবে প্রয়োজনে এখান থেকেও সবকিছু সরানোর প্রস্তুতি আমাদের ছিলো। রামগড় অবশ্য আমাদের মান সম্মানেরও প্রতীক হয়ে উঠছিলো। কারণ এটাই ছিলো আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বশেষ মহকুমা সদর দফতর। তাই আমরা স্থানটি প্রতিরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এজন্য আমরা কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে ফেলি। সীমিত সম্পদ ও শক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে যতদূর সম্ভব ব্যাপক এলাকা জুড়ে সম্ভাব্য শত্রু হামলার স্থানগুলোতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলি।

 রণকৌশলগত দিক থেকে তখন হিয়াক্কু এবং করেরহাটের মধ্যে আমাদের কোন সৈন্য রাখার উপযোগিতা ছিলো না। সৈন্যদের এখানে শত্রুবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিলো। তাই সকল দিকের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে হিয়াকু এলাকায় সমাবেশ করেছিলাম।

 অন্য পথে আরো পূর্বে মহালছড়িতে আমাদের সৈন্যদের ওপর ইতিমধ্যে শত্রুরা হামলা চালিয়েছিলো। আমাদের বাহিনী তখন আরো সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র চেয়ে বারবার খবর পাঠাচ্ছিলো। কিন্তু আমরা তাদের কিছুই পাঠাতে পারিনি।

 এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ডের মতো কিছু একটা গঠন করেন। রণাঙ্গণের কমাণ্ডাররা কিন্তু সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ড থেকে কোন আদেশ পাননি। বস্তুত: অভিযান সংক্রান্ত কোন আদেশই তাদের ছিল না। যে কোন মূল্যে শত্রু আক্রমন প্রতিহত করতে হবে। আমাদের প্রতি এটাই ছিল সেই বিমুর্ত হাই কমাণ্ডের একমাত্র নির্দেশ। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্রের সাথে এই আদেশের কোন সম্পর্ক ছিল না। শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য হয়তো বিলম্বিত করা যায়। কিন্তু প্রাণঘাতী লড়াইয়ের ময়দানে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ ছাড়া শত্রুকে দমন করার চিন্তা আকাশ কুসুম স্বপ্নমাত্র। কেউ কেউ এই যুক্তি অনুধাবন না করেই খামখেয়ালী এবং অসঙ্গত আদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অচিরেই আমাদের সৈন্যরা এই অদৃশ্য কমাণ্ডের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং এর আসল অস্তিত্ব সম্পর্কেই সকলের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়।

 পাকিস্তানীরা মহালছড়ি আক্রমন করেছিলো ২৭শে এপ্রিল। এখানে ছিলো প্রায় তিন হাজার সৈন্যর দুটি মিজো ব্রিগেড এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নিয়মিত কমাণ্ডো কোম্পানী। আমাদের সৈন্যদের পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধের ট্রেনিং ছিল না। অস্ত্র ও রসদপত্রেরও অভাব ছিল। তাই মহালছড়িতেও আমাদের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তানীরা মিজোদের সামনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে একটির পর একটি হামলা চালাতে থাকে। প্রথমে প্রতিবারই তাদের সে হামলা ব্যার্থ হয়ে যায়। হামলায় মিজোরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পেছন থেকে পাকিস্তানী কমাণ্ডদের চাপের ফলে মিজোরা পেছনেও সরতে পারছিলো না। এমন কি কমাণ্ডোরা অস্ত্র দিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছিলো যে, কোন মিজো পালাতে চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করা হবে। যুদ্ধ গড়িয়ে চলে  মিজোদের কয়েকটি ছোট ছোট দল কোনক্রমে কয়েকটি টিলা পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর সুবিধাজনক স্থান দখল করে নেয়। এদের এই জায়গা থেকে আমাদের অবস্থান এবং রামগড় অভিমুখী সড়ক পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো।

 যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে ওঠে। আমাদের সৈন্য সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বেশি শত্রুসৈন্য বাঙ্গালী সৈন্যদের প্রায় ঘিরে ফেলে। তরুন অফিসার ক্যাপ্টেন কাদেরকে আমরা এখানেই হারাই। প্রচণ্ড ঝুকি নিয়ে একটা সুবিধাজনক স্থান দখল করার জন্য সে এগিয়ে গিয়েছিলো যাতে বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণে সে সাহায্য করতে পারে। কাদের সফল হয়েছিলো, কিন্তু তারপরই লাইট মেশিনগানের এক ঝাক গুলিতে তার দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বীরের মত মৃত্যু বরণ করেছিলো ক্যাপ্টেন কাদের। এই যুদ্ধে প্রথম একজন অফিসার হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনবল ভেঙ্গে পড়েছিলো। দু'জন মাত্র শওকত ও ফারুক (পরে দুজনই সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হয়েছিলেন। এবং সিপাই ড্রাইভার আববাস শত্রুদের গুলিতে বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহ উদ্ধার করে আনে। রামগড়ে আমরা যথাযোগ্য ধর্মীয় ও সামরিক মর্যাদায় কাদেরের মৃতদেহ দাফন করি।

 এপ্রিলের ২৯ তারিখে হিয়াকুর কাছে যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের অবস্থানস্থলের সামনের জায়গাটি ছিলো খোলা, কিন্তু দু'পাশে ছোট ছোট টিলার ওপর ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলের আড়াল দিয়ে শত্রুরা আমাদের পেছনে চলে আসতে পারতো। সে পরিস্থিতিতে সরবরাহ ঘাটি রামগড় থেকে আমাদেরকে সম্পূর্ন বিচিছন্ন হয়ে পড়তে হতো। আমাদের কাছে তখন রান্না করার মত কিছু ছিল না। অধিংকাশ খাবারই আসত রামগড় থেকে। দিনটি ছিল পরিস্কার। ভোর থেকেই আমাদের অবস্থানের ওপর মর্টার সেলিংয়ের মাধ্যমে কয়েক দফা হামলা হয়। বোমাবর্ষনের ছত্রছায়ায় আমাদের দিকে অগ্রসরমান শত্রুর অগ্রভাগে ছিলো প্রায় দুইশত স্থানীয় দালাল। খোলা মাঠ দিয়ে দুই কোম্পানী পাকসেনা এগিয়ে আসছিলো ওরা একশত গজের মধ্যে আসতেই আমাদের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। এই আকস্মিক হামলায় মুহুর্তের মধ্যে ওরা ভয় ও আতংকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ দুই ঘণ্টার অবিরাম লড়াইয়ে আমাদের কয়েকজন হতাহত হবার পর অবশেষে আমাদের সৈন্যদেরকে চিকনছড়ার দিকে পশ্চাদপরসণ করার নির্দেশ দেয়া হলো।

 হিয়াকুর পতনের পর রামগড়ের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। সবচাইতে বিপজ্জনক ব্যাপার ছিলো শত্রুরা আমাদের অসামরিক ব্যাক্তিদের বিশেষ করে বড় বড় শরনার্থী দলের ভারত গমনের পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো। সে সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ধুলিময় রাস্তা ধরে নারায়ণহাট থেকে হিয়াকুর এবং তারপর রামগড় হয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাবরুমে গিয়ে আশ্রয় নিচিছল। কিন্তু হিয়াকুর পতনের পর সে পথ বন্ধ হয়ে গেলো।

 করেরহাটের পতনের পর বুঝতে পারি বর্তমান ধারায় যুদ্ধ করে আমরা কিছুই করতে পারবো না। আমরা আমাদের বাহিনীকে সুসংগটিত করে তুলতে পারছিলাম না। এই বাহিনীতে ছিলো বিভিন্ন ধরনের লোক ইপি আর পুলিশ আনসার, মুজাহিদ, সামরিক বাহিনীর লোক এবং মাত্র সপ্তাহ খানেকের ট্রেনিংয়ের পর রণাঙ্গনে নামিয়ে দেয়া নতুন মুক্তিযোদ্ধা। এইসব দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ শৃঙ্খলার অভাব ছিলো আমাদের বিপর্যয়ের একটি কারণ। আমাদের সকল সৈন্যকে একটা নিরাপদ শিবিরে নিয়ে তাদের জন্য বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাহলে তাদেরকে নিয়েই আবার একটা সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত বাহিনী গড়ে তোলা যেতো। আমাদের অধিকাংশ সৈন্যকেই ইতিমধ্যে অপুষ্টিরও শিকার হয়ে পড়তে হয়েছিলো।

 সেই উদ্দেশ্যে ভারতীয় সীমানার ছয় মাইল ভেতরে হরিনায় একটা গোপন শিবির স্থাপন করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের থেকে আমরা কয়েকটি তাবু পেয়েছিলাম। রামগড় থেকে কিছু কিছু জিনিস এখানে নিয়ে আসা হলো। শিবিরের জন্য যে হাসপাতালের ব্যাবস্থা করেছিলাম। যুদ্ধে আহতদের সেখানে আনা হয়। এরপর যুদ্ধ থেকে একটু অবকাশ পেলেই নতুনভাবে আমাদের বাহিনী সংগঠনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়।

 মুজিব নগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তখন অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। কাজটি ছিলো খুবই দুঃসাধ্য। বাংলাদেশ বাহিনী একটা উল্লেখযোগ্য পরিমান এলাকায় তাদের দখল প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে কেউ আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশের যে কোন একটি অঞ্চলে যতদুর সম্ভব সৈন্যদের জড়ো করে সেই এলাকা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। সময় নষ্ট না করে সেই সময়ই এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু দেখা গেছে কর্তৃপক্ষ সকল ফ্রণ্টেই যুদ্ধ করতে আগ্রহী এবং যুদ্ধ করে জয়ী হতেও চাইছিলেন। আমাদের সৈন্যসংখ্যা এবং তাদের পরিমানের প্রেক্ষিতে রণকৌশলগত দিক থেকে এ ব্যবস্থা ছিলো অবাস্তব। সব জায়গায় যুদ্ধ করার দরুন সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আমাদের সেনাদের বিচ্ছিন্ন এবং স্থানীয়ভাবে লড়ে যেতে হয় এবং এই লড়ে যাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো লক্ষ্যহীন। তাই একটির পর একটি এলাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে।

 ৩০শে এপ্রিল মহালছড়ির সৈন্যরা রামগড় এসে পৌঁছে। এখান থেকে সকালে ছোট ছোট দলে হরিনা শিবিরের দিকে অগ্রসর হয়। ওদের আসার আগে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে রামগড় ছেড়ে যেতে প্রস্তুত থাকার আদশ দিয়েছিলেন। এই আদেশে বোঝা গিয়েছিলো, হাই কম্যাণ্ড আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতে অসমর্থ। তখন সাহায্য ব্যতিরেকে মাত্র তিনদিনের বেশী যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। কিন্তু অবাক কাণ্ড ৩০শে এপ্রিল রাতেই আরেকটি নতুন আদেশ পেলাম। বাংলাদেশ সরকারের জন্য রামগড় রক্ষা কর। ইতিমধ্যে চিকনছড়া থেকে আমরা সৈন্য সরিয়ে এনেছি। হরিনায় আমাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য রামগড়ের বাইরে কিছু সৈন্য রেখেছি। যাতে শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য তারা বিলম্বিত করতে পারে। শত্রুবাহিনী রামগড়ের মাত্র কয়েক মাইলের মধ্যে এসে পড়েছে। আমাদের সৈন্যদের অর্ধেক তখন হরিণার রাস্তায়।

 অবশ্য সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর রামগড় প্রতিরক্ষার জন্য উপস্থিত যাদেরকে পেলাম সবাইকে জড়ো করা হলো। পাকিস্তানী সৈন্য যাতে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে না পড়ে তা প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলও সাবরুমে চলে এল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিলো। গুজব রটেছিলো যে, রামগড় প্রতিরক্ষায় ভারতীয় সৈন্যরাও অংশ নিতে পারে। কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটেনি।

 ১লা মে থেকে শত্রুরা রামগড়ের আশপাশের এলাকার ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। একটি দল মূল সড়ক ধরে অগ্রসর হচ্ছিলো। অন্য একটি দল রামগড়ের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে। এই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যে কিছুটা জায়গা একেবারে খোলা এবং সমতল। ১লা মে দিবাগত রাতে এই পাহাড়ে গোপনে শত্রুসমাবেশ ঘটেছিলো।

 ২রা মে সকালে পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে রামগড়ের ওপর আক্রমণ শুরু করে। কামানের প্রচণ্ড গোলার ছত্রছায়ায় তারা সড়কপথে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে দেয়। শেলের আঘাতে আমাদের বাংকারগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এদিকে সেই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যবর্তী স্থানটিতে ধোঁয়ার জাল সৃষ্টি করা হয়। এবং ধোঁয়ার আড়ালে শত্রুদের দ্বিতীয় দলটি রামগড়ের মধ্যভাগের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক আগে শত্রুরা শহরটির মধ্যাঞ্চলের ওপর চুড়ান্ত আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এরপর এক ঘণ্টারও বেশী সময় আমাদের সৈন্যরা শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে এবং পরিশেষে গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা অন্ধকারের আড়ালে পশ্চাদপসরন করে।  ওদিকে সাবরুমের সকল বেসামরিক বাসিন্দাকে ইতিপুর্বেই আরো অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হয়েছিলো। সারা তল্লাট জুড়ে বুলেট ছুটছিলো। ভারতীয় এলাকার বাড়িঘর এবং গাছপালায় গিয়ে গুলি লাগছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিণীও (বি-এস-এফ) ইতিমধ্যে যার যার ট্রেঞ্চের ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। তবে তারা সবকিছু অবলোকন করছিলো মাত্র।

 এ সময় শত্রুর একটি অয়্যারলেস বার্তা আমরা শুনতে পাই। ওতে বলা ছিল “রামগড়ের বিদ্রোহী হেডকোয়ার্টার দখল করেছি।”

 ২রা মে'র এই রাতে শত্রুরা রামগড়ের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র বাজার এলাকা জ্বলে ওঠে। ঊর্ধ্বমূখী ধোয়ার কুণ্ডলী আর অগ্নিবলয়ের ভেতর দিয়ে দুরে তখন পাহাড় শ্রেণীর অস্পষ্ট রেখা চোখে পড়ছিলো সেখানেই আমাদের স্বপ্নের সেই দেশ যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে চলেছি, অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কিন্তু কতদিন এ যুদ্ধ চলবে তা আমরা কেউ জানতাম না।

॥ শুভপুর সেতুর যুদ্ধ॥

 রামগড় হারানোর বিপর্যয়ে আমাদের তখন মনমরা অবস্থা। হরিনায় বিকল্প সদরদফতর স্থানপন করতে পারলেও ভারতের আশ্রয়ে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এ কথা যেনো কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। রামগড়ে আমাদের একটা সান্তনা ছিল যে, সেটা আমাদের নিজেদের দেশ। সেখানকার সবকিছুই আমাদের। কিন্তু হরিণা ভারতীয় এলাকা দুটির মধ্যে বিরাট পার্থক্য আমাদের সব স্বপ্ন বুঝি ভেঙ্গে গেলো। আমাদের কেউ কেউ শিশুর মত কেঁদেছিলো। মানসিক আঘাতে পাথর হয়ে যাওয়া অনেককে দেখেছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে পা দুটি যেন টেনে নিয়ে হরিণার দিকে চলছে। কাধে ঝুলছে পুরনো দিনের হাতিয়ার এবং গুলিশুন্য থলে।

 এরপর প্রধান সড়কে শুভপুর সেতুর কাছে মারাত্মক লড়াই আসন্ন হয়ে ওঠে। ভারতীয় বি এস এফ বাহিনীর সহযোগিতায় সেতুর একটি অংশ আমরা এর আগে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এখানে আমাদের দলে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র একশর মত। এদের অধিকাংশই ছিল আবার সতদিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। সেতু প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পড়েছিলো ই পি আর সুবেদার ফখরুদ্দিনের ওপর। আমাদের লক্ষ্য ছিল শত্রুরা যাতে এই গুরুত্বপূর্ন সেতু ব্যবহারের সুযোগ না পায় এবং ঢাকা ও কুমিল্লার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে না পারে।

 করেরহাটের পতনের পর সেতুর উত্তর দিক থেকে আমরা সৈন্য প্রত্যাহার করে সেতুর দক্ষিন দিকে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি। আমরা জানতাম সেতুটি দখল করার জন্য শত্রুরা মরিয়া হয়ে উঠবে। করের হাটে তারা কামান মোতায়েন করেছিলো, কয়েকটি ট্যাংকও নদীর পার পর্যন্ত চলে এসেছিলো। দূর থেকে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা এসে আমাদের ওপর পরছিলো। ট্যাংকগুলো অগ্রসর হয়ে আমাদের একটির পর একটি ব্যাংকার ধ্বংস করে চলছিলো। আমাদের ট্যাংক বিধ্বংসী কয়েকটি ছোট হাতিয়ার থাকলেও তখন তার কোন শেল আমাদের কাছে ছিল না।

 ট্যাংক ও কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানীরা কয়েকবারই নদী পার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দুবার তাদের সৈন্যরা নদীপথে মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে দু'দিকের গুলির মধ্যে পড়ে যায়। পরিস্কার দিনের আলোয় তাদেরকে দেখে দেখে আমরা গুলিবিদ্ধ করতে থাকি। অনেকটা যেন বেশ আরামের সাথে টার্গেট প্র্যাকটিস করার মতো এভাবে দুকোম্পানীরও বেশী সৈন্য আমরা নির্মূল করি। তাদের লাশগুলো নদী দিয়ে ভাসতে ভাসতে সাগরের দিকে চলে যায়। এই ভাবে লোকক্ষয়ের পর শত্রুরা নদী পার হয়ে সেতু দখলের চেষ্টা ত্যাগ করে।  ওদিকে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে আগত পাকসেনাদের নিকট ফেনী শহরের পতন ঘটে। ১১ই মে'র মধ্যে তারা শুভপুর সেতুর কাছে এসে পড়ে।

 পাকিস্তানীদের এই কলামে শত্রুদের আনুমানিক দুটি ব্যাটালিয়ন ছিলো। পক্ষান্তরে সেতুর কাছে একশ- এরও কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তখন চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তত। পরের দিন শুরু হয় যুদ্ধ।

 ১২ই মে সকাল থেকে করেরহাটের কমাণ্ডগুলো আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে নদীর পাড়ে শত্রু ট্যাংকগুলোকে ও দেখা যায়। পাকিস্তানীরা আমাদের অবস্থানের উত্তর এবং পশ্চিম দিকে ধূম্রজালের সৃষ্টি করে। সকাল ১১টায় পশ্চিম দিকের সেই ধোয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে দুটি কোম্পানী প্রথম হামলা শুরু করে। কিন্তু বেশকিছু পরিমান ক্ষতি স্বীকার করে তাদেরকে পিছু হটতে হয়। তারপর কিছু সময় সব চুপচাপ। বেলা ৩টার দিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষনের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার হামলা শুরু হয়। দুটি শত্রু ব্যাটালিয়নকেই হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়। দিনের বাকী সময়টুকু আমাদের সেনাদেরকেও প্রচণ্ডতম গোলাবর্ষণের মোকাবিলা করতে হয়। প্রায় অর্ধেক মুক্তিযোদ্ধাই তখন শেলের আঘাতে আহত। সরাসরি আঘাতে বাংকারগুলো ধসে পড়লে অনেকেরই জীবন্ত সমাধি ঘটে। আমরা হতাহতদের সড়াতে পর্যন্ত পারছিলাম না। নতুন সৈন্যও যোগ হচ্ছিলো না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্য কিংবা পানির মুখ দেখেনি। বেলা ৫টার দিকে কামানের গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়। শত্রুরা তখন আমাদের অবস্থান থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে। শুধু একটি মেশিনগান এবং দুটি লাইট মেশিনগান দিয়ে আমরা এদের মোকাবিলা করছিলাম। ট্যাংকের আঘাতে অস্ত্রগুলো ধ্বংশ হওয়ার পুর্বক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো সমানে শত্রু নিধন করে চলে। এরপর আমাদের সৈন্যরা শুধু ৩০৩ রাইফেল দিয়ে গুলি চালাতে থাকে। অচিরেই হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানীদের তুলনায় সংখ্যায় আমরা ছিলাম খুবই কম। আমাদের যেসব সেনা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলো তারা শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে পেরেছিলো। এদের অধিকাংশই ছিলো গুরুতর আহত, কিন্তু তবু তাদের মনোবল ভেঙে পড়েনি।

 তখন সন্ধ্যা হয় হয়। শুভপুর সেতুর অদুরে ভারতের শ্রীনগর সীমান্ত ফাড়ি। এখান থেকে একটি কাচা রাস্তা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আগরতলা অভিমুখী প্রধান সড়কে গিয়ে মিশেছে। এই সন্ধ্যায় রাস্তাটিতে অন্য কোন লোক ছিল না। শুধু রনাঙ্গন ফেরত কিছু লোক নিঃশব্দে হেটে চলছিলো। এদের মধ্যে কেউ হাটছিলো লাঠিতে ভর দিয়ে, কয়েকজনকে আবার সহযোদ্ধা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে আমাদের একজন অফিসারের সাথে তাদের দেখা হলে জনৈক মুক্তিযোদ্ধা তার বাম হাত তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। তার ঝুলন্ত ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছিলো। শেলের বিচ্ছুরিত টুকরোয় এটি প্রায় দু ভাগ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু কুঁকড়ে যাচ্ছিল। তবু সে মুখে একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে অফিসারকে “জয় বাংলা” বলে শুভেচ্ছা জানায়। তারপর সে অন্যদের সাথে সামনে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে যায়।

চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধঃ

সাক্ষাৎকার: লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী বীর উত্তম

 প্রঃ কখন কিভাবে আপনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন?

 উঃ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে আমাকে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে পোষ্টিং দিয়ে পাঠানো হয়। মার্চ ৭১ এর প্রথম ভাগে আমি ছুটিতে ছিলাম। ১৫ই মার্চ এর দিকে যখন অসহযোগ আন্দোলন খুব জোরদার হচ্ছিল এবং ইতিপূর্বে ৭ই মার্চ ৭১ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

[] সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন, তখন থেকেই আমরা বাঙ্গালী সৈন্যরা চিন্তা করছিলাম যে একটা গণ্ডগোল বাধাবে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন তখন কর্নেল জানজুয়া। মেজর জিয়াউর রহমান (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন এই ব্যাটালিয়ানের সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। জেনারেল জিয়া এবং আমি ছাড়াও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে আরো কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার ছিলেন। ১৫ই মার্চ ৭১-এর দিকে আমি এই ব্যাটালিয়নে যোগদান করি। ২৫ শে মার্চ, ৭১ রাতে যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখন স্বভাবতঃই আমি বাঙ্গালী হিসেবে আমার যা কর্তব্য সেটাই করেছি। এতে জড়িয়ে পড়ার মত কিছুই নেই। একটা কর্তব্য ছিল। সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যরই কর্তব্য ছিল এটা। সবাই এতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিছু কিছু সৈন্য হয়তো সুযোগ পাননি কিংবা কিছুসংখ্যক সৈন্য আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের যেহেতু বাঙ্গালী ব্যাটালিয়ন ছিল সেই জন্য আমরা ধরা পড়িনি। আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। ২৫শে মার্চ’ ৭১ রাতে যখন জেনারেল জিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে পাঠানো হলো মূলত সেই সময় থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের পক্ষ থেকে শুরু হয়।

 উক্ত দুর্যোগের রাত প্রায় ১১-৩০ মিনিট সময়ে আমরা টেলিফোনে জানতে পারলাম যে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতঃই আমরা ধরে নিলাম ঢাকায় যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে, নিশ্চয় এটা সারা বাংলাদেশব্যাপী শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ সেনাবাহিনী তো মাত্র এক জায়গায় তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করে না; এ জাতীয় পরিকল্পনা সব জায়গাতেই একই সময়ে কার্যকর করাই স্বাভাবিক। আমাদের কর্তব্য আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। কারণ ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আন্দোলন যে রুপ নিচ্ছিল, সে সবে যখনই আমাদের নিযুক্ত করা হতো ব্যারিকেড সরানোর জন্য কিংবা জনগণকে হটানোর জন্য, তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে কাজ কখনো ঠিকমতো করতাম না। কার্যত আমরা সেই চুড়ান্ত অসহযোগের সময় থেকেই আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন জানাতে শুরু করি। কাজেই ২৫শে মার্চ ৭১ রাতে যখন হানাদার বাহিনী বাঙ্গালী হত্যাকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন আমাদেরও তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া বাদে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না।

 বাঙ্গালী হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার খবর দিয়ে সম্ভবত আমাদের কাছে প্রথম টেলিফোন করেছিলেন চট্টগ্রামের হান্নান ভাই (চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি)। সম্ভবত তিনিই চট্টগ্রামে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

 আগেই বলেছি, জেনারেল জিয়া এবং আমি একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম। তিনি যেহেতু আমার চাইতে সিনিয়র ছিলেন, সেহেতু তিনিই আমাদের কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমি তার দুনম্বর হিসেবে কাজ করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্যায়ে আমরা যে একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম, এটা অনেকেই হয়তো জানেন না। বেশীরভাগ জনসাধারণের ধারণা আমরা আলাদা ছিলাম। আমরা একই সঙ্গে ছিলাম এবং একই সঙ্গেই বিদ্রোহ করেছিলাম। জেনারেল জিয়াউর রহমানও তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেনঃ “আমি বিদ্রোহ করে পোর্ট থেকে ফিরে এসেই শওকতের কাছে এলাম, এবং শওকত আমার সাথে হাত মিলালো।

 প্রঃ এই যে দুঃসাহসিক কাজ আপনারা করলেন, এর পিছনে অন্যন্য ক্যাণ্টনমেণ্টের বাঙ্গালী সৈন্যদেরও পূর্ন সমর্থন ছিল এবং তারাও আপনাদের মত এগিয়ে আসছিলেন, এটা আপনারা বুঝেছিলেন কি?

 উঃ এটা আমি বলতে পারবো না। কারণ রাজনীতিতে আমি কখনো জড়াতাম না। কিন্তু এটা রাজনীতি ছিল না। এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। এতে জাতির জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া অন্যান্য সেক্টর থেকে বাঙ্গালী সৈন্যরা এগুচ্ছিলেন কিনা সে তথ্য আমাদের জানার উপায় ছিল না। সে তথ্য জানা না জানার গুরুত্ব দেয়ার সময়ও তখন আমাদের ছিল না। এমনকি তখন আমার বাবা মা ছিলেন আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে কুমিল্লায়। তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তা করার অবকাশও তখন আমাদের ছিল না। কাজেই তাৎক্ষনিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। অবশ্য আমরা ভেবেছি অন্য সবাইও হয়ত আমাদের মত এগিয়ে আসছিলেন। শুধু ক্যাণ্টনমেণ্টেই নয়, আমরা মনে করেছি সমস্ত বাঙ্গালীই এই যুদ্ধে ছিলেন। কারণ এটা ছিল বাঙ্গালী জাতির প্রশ্ন, বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।

 প্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা বেতারে কখন প্রচারিত হয়েছে বলে আপনি বলতে চান?

 উঃ এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলতে থাকে যে জেনারেল জিয়া করেছেন, না আওয়ামী লীগ করেছেন। আমার জানামতে সবচাইতে প্রথম বোধ হয় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইয়ের কণ্ঠই লোকে প্রথম শুনেছিলেন। এটা ২৬শে মার্চ' ৭১ অপরাহ্ন দু'টার দিকে হতে পারে। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রর প্রেরক যন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরা দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পাননি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল। তা'হলে আমি বলব যে, চট্টগ্রামের হান্নান ভাই সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতা যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়।

 প্রঃ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়াউর রহমান কি পরিস্থিতিতে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সংগঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষনা পাঠ করলেন?

 প্রঃ ২৫শে মার্চ ৭১ রাতে ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়ার পরই আমরা চট্টগ্রামে আমাদের অধীনস্থ সমস্ত ব্যাটালিয়নকে হাতে নিয়েছিলাম। আমরা ভেবে দেখলাম যে, নতুন পাড়া ক্যাণ্টনমেণ্টে পাকিস্তান বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ট্যাংক ছিল। আমরা ছিলাম ষোলশহরে মাত্র দু'মাইল দুরত্বে। আমরা দেখলাম, আমাদের হাতে কোনও ট্যাংক ছিল না। এবং কোন অস্ত্রশস্ত্রও আমাদের অর্থাৎ ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের হাতে ছিল না। ইতি পূর্বেই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পাকিস্তানে চলে যাবে বলে অধিকাংশ অস্ত্রই পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের হাতে শুধু ছিল কিছু রাইফেল এবং এল এম জি ধরনের স্বল্পসংখ্যক অস্ত্র। ভারী কোনও অস্ত্র ছিল না। আমার সাথেই জেনারেল জিয়া আলাপ করলেন। আমরা আলাপ করে দেখলাম যে আমরা যদি ষোলশহর বিল্ডিং এর ভিতর অবস্থান করি এবং এই অবস্থায় যদি ট্যাংক আসে, তাহলে আমরা ট্যাঙ্ক ঠেকাতে পারব না। কারণ ট্যাঙ্ক ঠ্যাকানোর মত কোন অস্ত্রই আমাদের হাতে ছিল না। ট্যাঙ্ক থেকে দু তিনটা গোলা ছুড়লেই আমাদের অনেক সৈন্য মারা যাবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের ঐ এলাকা থেকে বাইরে চলে যাওয়া উচিৎ এবং নিরাপদ দুরত্বে থেকে হেডকোয়ার্টার বেস বানানো উচিত। এ ছাড়া আমাদের অধীনস্থ জোয়ানতের শপথ নেয়া উচিত। শপথ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে তারপর যুদ্ধে যাওয়া উচিত। আমরা সোজা প্রথমে গেলাম কালূরঘাট। সেখানে ভোররাতের দিকে আমরা মার্চ করে গেলাম। তখন খুব কুয়াশা ছিলো এবং আল্লাহর কি ইচ্ছা সেদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ' ৭১ এর সকার ৮টা কি ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। কালুরঘাটে পৌঁছে আমরা সবাই কনফারেন্স করলাম। এতে কিছু বি ডি আর অফিসার এবং জোয়ানও ছিলেন। এই কনফারেন্সে সিদ্ধন্ত নেয়া হল যে, আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম রক্ষার জন্য পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন চালাব। আমাদের আক্রমনের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল পোর্ট এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন। এই তো গেল ২৬শে মার্চ ৭১-এর কথা। ঐদিন আমরা খোজখবর নিয়েছিলাম কোথায় কি ঘটেছিলো। আমি একখানা জীপ নিয়ে পুরা শহর ঘুরে দেখলাম। আমি টহল দেয়ার সময় আগ্রাবাদের মোড়ে আমার জীপের ওপর একটি এল এম জি বার্ট ফায়ার এলো। আমি কোনও প্রকারে জীপ ঘুরিয়ে ফেরত গেলাম এবং জেনারেল জিয়াকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করলাম এবং সেভাবে আমাদের দলকে নিয়োজিত করলাম।

 ২৭শে মার্চ' ৭১ মনে হয় জোনরেল জিয়া বুঝতে শুরু করলেন যে বেতারে একটা ঘোষণা প্রচার করা দরকার। ঐ তারিখেই সন্ধ্যায় কালূরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে এটা করলেন তিনি। বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও ঐ সময় খুব তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম, আতাউর রহমান খান কায়সার, হান্নান ভাই এবং এম আর সিদ্দিকী। তারাও সম্ভবত: সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কিছু প্রচারিত হওয়া উচিত। অপরদিকে জেনারেল জিয়া কি বলবেন তার একটি খসড়াও প্রস্তুত করে নিলেন। ২৭শে মার্চ ৭১ সন্ধ্যার পর চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারিত হল। জেনারেল জিয়ার (তৎকালীন মেজর) ভাষণ।

 প্রঃ আপনার কমাণ্ডে সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ কোথায় এবং কখন সংঘঠিত হয়েছিল।

 উঃ প্রথম ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল কালুরঘাটে ১১ই এপ্রিল,' ৭১। ঐ সময় জেনারেল জিয়া আমার সাথে ছিলেন না। তিনি ৩০শে মার্চ ৭১-এর পরই রামগড় চলে গিয়েছিলেন।

 এই যুদ্ধ পরিচালনা আমার কমাণ্ডে হয়। সৈন্য ছিলেন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বি ডি আর এবং স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী যেমন ছাত্র, শ্রমিক এবং অন্যান্য যারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এমন কিছু লোকজন। আমার পক্ষে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর দুটি ব্রিগেড। এ ছাড়া কর্ণফুলীতে তাদের যে নৌ জাহাজ ছিল সেটি তারা শংখনদী হয়ে কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে এসে ওখান থেকে নেভাল গান দিয়ে আমাদের এলাকায় বম্বিং শুরু করেদিয়েছিল। তাদের ব্রিগেডের যে আর্টিলারী ছিল সেই আর্টিলারী দিয়েও তারা বম্বিং করতে থাকে ১০ই এপ্রিল, '৭১ থেকে। ১১ই এপ্রিল তাদের কিছু সৈন্য মহিলার পোশাক এবং কিছু সৈন্য সিভিল এর পোশাক পরে জয়বাংলা বলতে বলতে আমাদের দিকে অথাৎ কালুরঘাটের পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চট্টগ্রামে আমাদের পক্ষে এবং তাদের বিপরীতে ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন, শমসের মবিন চৌধুরী, লেঃ মাহফুজ এবং অন্য কয়েকজন অফিসার। এই অবস্থায় আমাদের লোকজন প্রথকে বুঝতে পারেননি তারা পাকিস্তানী। যখন শত্রু জয়বাংলা বলতে বলতে একেবারে কালুরঘাটের পুলের ওপর চলে এলো, তখনই মাত্র আমাদের লোকজন বুঝতে পারলেন যে তারা সিভিলিয়ান বা মহিলা কেউ নন। তখন আমাদের পক্ষ ফায়ার করতে শুরু করলেন। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন হারুন এবং শমসের মবিন আহত হলেন। মাহফুজ চলে আসতে পেরেছিলেন। কালুরঘাট ছেড়ে আমরা পটিয়ার দিকে চলে এলাম।

 প্রঃ তখন আপনারা মোট কতজন ছিলেন?

 উঃ আমরা প্রায় সাড়ে তিনশ'র মত ছিলাম। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলাম। ব্রিগেডিয়ার মিঠঠা খান হেলিকপ্টার থেকে ওদের পক্ষে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল (পরে জেনেছি)

 প্রঃ এই যুদ্ধে আপনাদের প্রধান অস্ত্র কি ছিল?

 উঃ আমাদের কিছু রাইফেল ছিল, কিছু এল এম জি এবং দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার ছিল। এই মর্টার দু'টির কোনও অবলোকন ব্যাবস্থা aiming sight ছিল না। আন্দাজে ছুঁড়তে হত।

 প্রঃ আপনাদের পক্ষে হতাহত কেমন হয়েছে?

 উঃ আমাদের পক্ষে তেমন হতাহত হয়নি, ওদের পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছিল তাও বলা মুস্কিল, তবে সংখ্যা অনেক বেশী ছিল। ইতিপূর্বে ৮ই এপ্রিল আর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তখন পাকবাহিনীর একটি দল কালুরঘাটের প্রায় এক মাইল উত্তরে একটি কৃষি ভবন দখল করে নিয়েছিল। পাকবাহিনীর শক্তি ছিল একটি প্লাটুন। পাকসেনারা ওখানে এসে পড়ায় শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কয়েকজন অফিসারকে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহের ওপর আক্রমন চালাবার জন্য বললে কেউ তখন এগুতে উৎসাহিত হলেন না। তবে আমার কথা মোতাবেক লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী কিছু সৈন্য নিয়ে আক্রমন পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেননি। উপরন্তু এই আক্রমন পরিচালনাকালে নায়েক নায়েব আলী পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এমনি অবস্থায় আমি নিজে মাত্র ১০জন সৈন্য নিয়ে ৯ই এপ্রিল হাওলাদার হামদু মিঞা, নায়েক তাহের এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কয়েকজন বি-ডি-আরসহ সকলা ৮-৩০ মিঃ সময়ে কৃষি ভবনে অবস্থানরত পাক ঘাটি আক্রমন করি। আমার আক্রমনে প্রায় ২০জন পাকসেনা (১জন ক্যাপ্টেন ও ১জন সুবেদারসহ) নিহত হয় এবং তারা ঐ পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়।

 প্রঃ তারপর?

 উঃ তারপর আমি কালুরঘাট ব্রীজের চট্টগ্রামের দিক পুনর্দখল করেছিলাম। ১০ই এপ্রিল' ৭১ খবর পেলাম পাক সেনাবাহিনী পটিয়ার কালাপুলের দিক থেকে আমাদের ওপর আক্রমন করার চেষ্টা করছে। আমি তখনই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীকে কিছু সৈন্য দিয়ে পটিয়ায় কালাপুলে পাঠালাম। ১১ই এপ্রিল ভোরবেলা আমি নিজে পটিয়ায় কালাপুলের অবস্থা যানতে পেলাম। ঐ তারিখ সকাল ৮-৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালি আমাকে খবর পাঠালেন পাক সেনারা প্রায় সাত থেকে আটশত সৈন্য নিয়ে কালুরঘাট আক্রমন করেছে; ক্যাপ্টেন হারুন গুরুতররূপে আহত, লেঃ শমসের মবিন চৌধুরীর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংবাদ পেয়ে আমি ওয়ালিকে বললামঃ “আমাদের লোকদের একত্রিত করবার চেষ্টা কর, পরিস্থিতি ভালভাবে জেনে নাও, আমি আসছি”। সকাল ৯টার দিকে আমি কালুরঘাট এসে পৌঁছাই। ওখানে গিয়ে আমি মেজর জিয়ার সাথে অয়ারলেসে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম।

 পরে আমি তাদের সবাইকে পিছনে সরে আসতে বললাম। লেঃ মাহফুজকে মদনঘাট ডিফেন্সে অবস্থান করতে বললাম যতক্ষণ না আমার কালূরঘাটের ডিফেন্সের সবাই পিছু হটতে পারে। আমরা সবাই কালুরঘাট থেকে পটিয়াতে একত্রিত হলাম। এবং সেখান থেকে সবাই বান্দরবন রওনা হই। আমার সাথে সৈন্য ছিল প্রায় ৪৫০জন (তৎকালীন ইপি আর পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টসহ)।

 আমরা ১২ই এপ্রিল বান্দরবান পৌঁছেছিলাম। ঐ তারিখেই কাপ্তাই হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছি। রাঙ্গামাটিতে আমরা ডিফেন্স নেবার পর মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টর স্থাপন করলাম। লেঃ মাহফুজ শত্রুর ওপর আঘাত হেনে চলেছিল। কিন্তু পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমন টিকে থাকা দুরুহ বুঝে পাশ্ববর্তী নোয়াপাড়া নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়। সেখান থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে সার্থকভাবে ডিফেন্স নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করলেন। শেষ পর্যন্ত আমার নির্দেশ মোতাবেক ১৪ই এপ্রিল লেঃ মাহফুজ তার ২০০ এর কিছু বেশী সৈন্য নিয়ে মহালছড়িতে আমার সঙ্গে মিলিত হন। ছুটি ভোগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের (আর্টিলারী) আমার কাছে ঐ তারিখে আসেন। বঙ্গ সন্তান সাহসী বীর ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরকে মেজর জিয়া আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাকে আমার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অফিসারের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিতে পাঠালাম।

 আমার রক্ষাব্যূহকে যেসব স্থানে অবস্থান দিলাম সেগুলি ছিলঃ

 ১। ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির খাগড়াতে।

 ২। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে বুড়িঘাটে।

 ৩। লেঃ মাহফুজের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির বরকলের মধ্যস্থলে।

 ৪। সুবেদার মুত্তালিবের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির কুতুবছড়ি এলাকাতে।

 অপরদিকে ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি শহরে পৌঁছে যায়। রাজা ত্রিদিব রায় পাকবাহহীকে আহবান করে আনলেন।

 ১৬ই এপ্রিল এর মধ্যে আমাদের সবাই নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন ওয়ালিকে মেজর জিয়ার নির্দেশানুযায়ী রামগড় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ঐদিন ক্যাপ্টেন কাদের তার বাহিনী নিয়ে খাগড়া রেস্ট হাউজে একজন অফিসারসহ এক প্লাটুন পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ক্যাপ্টেন কাদের পাকবাহিনীর অফিসারসহ প্রায় ২০জন পাক সৈন্যকে নিহত করতে সমর্থ হন। বাকী সৈন্য পালিয়ে যায়। অপরদিকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ক্যাপ্টেন কাদের নিরাপদে তার ঘাটিতে ফিরে আসেন। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনীর প্রায় ২০জন সৈন্য একটি লঞ্চযোগে রেকি করতে বেরিয়েছিল। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ওত পেতে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরই পাকসেনারা বুঝতে পেরেছিল যে তারা মুক্তিবাহিনীর রক্ষাব্যুহের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাক সেনারা গুলি ছোড়া শুরু করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তবুও চুপ করেছিলেন। সম্পূর্ন লঞ্চটি তার এলাকায় চলে আসা মাত্রই তিনি গুলি চালানো শুরু করলেন। এতে লঞ্চসহ অধিকাংশ পাকবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েকজন পালাতে সমর্থ হয়েছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২জন মাত্র আহত হয়েছিলেন।

 ১৮ই এপ্রিল পাক সেনারা দু'টি লঞ্চ ও একটি স্পীডবোটে সৈন্য নিয়ে চিঙ্গী নদী দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। লেঃ মাহফুজের কিছু সৈন্য হঠাৎ গুলি ছুড়ে বসেন।

 পাক সেনারা কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে দূরে গিয়ে ডিফেন্স নিয়ে লেঃ মাহফুজের ওপর আর্টিলারী আঘাত হানতে থাকে। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে লেঃ মাহফুজের কোন ক্ষতি হয়নি। তবে, পাক সেনাদের কিছু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তাদের চাপ আমাদের ওপর ক্রমে বাড়তে থাকে।

 ১৮ই এপ্রিল বিকেল ৩টায় সুবেদার মুত্তালিব তাঁর দল নিয়ে কুতুব ছড়িতে পাকবাহিনীর ৬ টি চলমান সৈন্যভর্তি ট্রাকের উপর এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশ ৩০ থেকে ৪০ জন পাকসেনা নিহত ও দুই- তিনটি গাড়ী দ্বংস হয়।

১৯ শে এপ্রিল ৩ টায় পাক সেনাদের একটি বড় রকমের দল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর ওপর বুড়িঘাটে ব্যাপকভাবে আক্রমন করে। পাক সেনারা ঐ সময় একটি জীপ থেকে তিনটি মর্টার ছুড়েছিল। তাদের বাহিণী ব্যাপকভাবে আক্রমন চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান কিছুতেই থাকতে পারছিলেন না। তখন ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রব (৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট) অটোমেটিক হাতিয়ার মেশিনগান হাতে তুলে নিয়ে বললেনঃ 'আমি গুলি চালিয়ে যাচ্ছি আপনি বাকী সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটে যান'। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান প্রায় ১০০ মুক্তিবাহিনী নিয়ে নিরাপদে পিছু হটলেন। কিন্তু ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রব পাকবাহিনীর শেলের আঘাতে প্রাণ হারালেন। সেদিন মুন্সী আবদুর রব মুন্সীকে সরকার বীর শ্রেষ্ঠ উপাধি দিয়েছিলেন। ২০শে এপ্রিল লেঃ মাহফুজ ঐ স্থানে যান এবং মুন্সীর ছিন্ন দেহের অংশবিশেষ এবং কিছু গোলাবারুদ নিয়ে ঘাটিতে ফিরে আসেন।

 ঐ দিনই আমি লেঃ মাহফুজকে বরকলে পাঠিয়েছিলাম মিজো উপজাতিকে আমাদের স্বার্থে কাজ করার পক্ষে মত বিনিময়ের জন্য। লেঃ মাহফুজ বহু কষ্টে সুবলম পর্যন্ত পৌঁছে খবর পেলেন যে, পাকিস্তানীরা মিজোদের ইতিমধ্যেই হাত করে নিয়েছে। আমি আরো খবর পেলাম পাকবাহিনী মিজোদের নিয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি কোম্পানী বন্দুকভাঙ্গা নামক স্থানে লেঃ মাহফুজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংঘর্ষে পাকসেনারা পিছু হটে চলে যায়। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি।

 ২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনীর প্রায় ২০০ সৈন্য রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি ক্যাপ্টেন কাদের এবং লেঃ মাহফুজকে পাঠালাম প্রতিরোধ করার জন্য। ২৪মে এপ্রিল কুতুবছড়ি নামক স্থানে অফিসারদ্বয় পাক বাহিনীর মুখোমুখি হন। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী বেশ কিছু ক্ষতি স্বীকার করে।

 ২৫শে এপ্রিল খবর পেলাম চিঙ্গী নদী এবং নার্নিয়ার চর বাজার হয়ে পাকবাহিনী মহালছড়ি অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। মাহলছড়ি আমাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ছিল।  ২৬শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদের, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও লেঃ মাহফুজকে কিছুটা পিছিয়ে যেতে বললাম। ঐ তারিখেই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে নানিয়ারচর বাজারে বড় পাহাড়ের ওপর ডিফেন্স নিতে বলেছিলাম। কারণ ঐ পথই পাক সেনাদের অগ্রসর হওয়ার সম্ভাব্য এলাকা ছিল। লেঃ মাহফুজকে ডিফেন্সে রাখলাম রিজার্ভে পাল্টা আক্রমণের জন্য এবং প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন জামানকে সাহায্যের জন্য। ক্যাপ্টেন কাদেরকে পাঠালাম সড়ক পথে পাকবাহিণীর গতিপথ রুদ্ধ করার জন্য।

 ২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা হাবিলদার তাহের সিপাহী বারী এবং করপোরাল করিমের সংগে ৮/১০ জন লোক দিয়ে রেকি পেট্রোলে পাঠালাম। এই দলটি ভুলবশতঃ মিজোদের আড্ডায় ঢুকে পড়েছিল। সৌভাগ্যবশত মিজোরা তখন একটি হাতি কেটে খাওয়াতে ব্যাস্ত ছিল। রেকি পার্টি পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়। আমাদের দলটি পরে হেডকোয়ার্টার মহালছড়িতে পৌছে। ঐ তারিখ বেলা ১২-৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর অবস্থানের ওপর মিজোর আক্রমন চালিয়েছিল।ফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। আক্রমনের চাপ বাড়তে থাকে মিজোদের পক্ষ থেকে। মিজোর ছিল সংখ্যায় অনেক। এই অবস্থায় আমি লেঃ মাহফুজকে প্রায় ১০জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের সাহায্যে পাঠিয়েছিলাম। লেঃ মাহফুজ ওখানে পৌঁছেই ডিফেন্স নিয়ে লক্ষস্থলে আক্রমন চালাতে থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার সার্থীদের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পথে পিছু হটে আসেন। আধ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ে লেঃ মাহফুজ ১৫০জন মিজোকে হত্যা করেছিলো। কিন্তু অপর পক্ষে সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে অসংখ্য মিজো সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সমনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। লেঃ মাহফুজকে মিজোরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান লেঃ মাহফুজকে উদ্ধার করে আনার জন্য অগ্রসর হলেন। আমরা তখন হেডকোয়ার্টারের চারপাশে ডিফেন্স পাকা করছিলাম। এমনি পরিস্থিতিতে ২৭শে এপ্রিল অপরাহ্ন ৩টায় পাকবাহিনীর ১১ এবং পাঞ্জাবের ২টি কোম্পানী সহযোগে প্রায় এগার শত মিজো ব্যাপকভাবে আমাদের ওপর আক্রমন চালায়। পাকবাহিনী ৬টি মর্টার দিয়ে আক্রমন চালাতে থাকে। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। আমি করার জণ্য আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। পাক সেনারা মিজোদের নিয়ে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে। অথচ আক্রমন প্রতিহত করার জন্য উপযোগী কোনও ভারী মর্টার আমার কাছে ছিল না। মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও সামান্য হালকা মেশিনগান দিয়ে আক্রমন চালালাম। ক্যাপ্টেন কাদের তার এলাকাতে যুদ্ধ করতে করতে শত্রর গুলিতে শহীদ হলেন। বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যে সওকত ফারুক ও সিপাহী ড্রাইভার রামগড় রেখে বাকী সৈন্যরা আমার কাছে চলে আসেন। আমরা তখন এমনি এক অবস্থায় ছিলাম। যখন আমার সমস্ত বাহিনী নিয়ে ঐ পরিস্থিতিতে পিছু হটা সম্ভব ছিল না। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমন চালিয়ে যেতে হয়েছিল। ঐ তারিখে রাতের আধারে মহালছড়ি ছেড়ে সমস্ত সৈন্য নিয়ে আমরা খাগড়াছড়ি নামক স্থানে এসে পৌঁছলাম এবং ডিফেন্স নিলাম।

 ২৮শে এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে আমি মেজর জিয়ার সাথে আয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমাদের অবস্থার কথা বর্ননা করলাম। ঐদিন পাকবাহিনীর একটি দল আমাদের অবস্থান দেখে গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুইমারাতে ডিফেন্স নিলাম। আমাদের তখন শক্তি ছিল প্রায় ৪৫০জন। আমি মানিকছড়ির রাজার সংগে দেখা করলাম। রাজা আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি খবরাখবর দিলেন। সমগ্র মগ উপজাতি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। চাকমা উপজাতিদেরও হয়ত আমাদের সাহায্যে পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিবিদ রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। মিজোরা বেশ কিছু আগেই আমাদের শক্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাস মগ উপজাতি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে। ২৯শে এপ্রিল রাতে মেজর জিয়া আমাদের রামগড়ে চলে আসতে বললেন। কারণ ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর একটি দল করেরহাট-হিয়াকুল হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অপর দল শুভপুর ব্রীজে ক্রমাগত আঘাত হানছিল। আর একটি দল আমাদের পিছু পিছু আসছিল গুইমরা রামগড়ের পথে। মেজর জিয়া করেরহাটে ক্যাপ্টেন ওয়ালীকে পাঠালেন এবং আমাদের চলে আসতে বললেন। আমর ২৯শে এপ্রিল রওয়ানা হয়ে রাত ২টায় সমস্ত সৈন্য নিয়ে রামগড়ে পৌঁছলাম। ৩০শে এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরবর্তী কালে জেনারেল) এম, এ, জি ওসমানী রামগড়ে আমাদের দেখে গেলেন এবং চট্টগ্রামের সমস্ত খবরাখবর নিলেন। কর্নেল ওসমানী খুব খুশী হলেন। আমাকে নির্দেশ দিলেন যে কোন প্রকারেই অন্তত: আরো দুদিন রামগড়কে মুক্ত রাখার জন্য, যাতে করে নিরীহ জনতাসহ সবাই নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিতে পারি।

 আমি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, সুবেদার মুত্তালেব এবং লেঃ মাহফুজকে তাদের বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালীর সাহায্যার্থে হিয়াকুলে পাঠালাম পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেড তিন দিক থেকে রামগড় আক্রমন করে। ২রা মে আমাদের রামগড় হারাতে হয়। ঐদিনই আমরা সবাই ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সময় তখন সন্ধ্যা ৬টা।


  1. ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৮ বেঙ্গলের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসাবে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন, পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল এবং রাষ্ট্রপতি। লেখাটি ২৬শে মার্চ, ১৯৭২ সংখ্যার ‘দৈনিক বাংলা থেকে সংকলিত।
  2. ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  3. বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত
  4. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন
  5. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে নয়মাস' গ্রন্থ, ঢাকা, ১৯৭৪- থেকে সংকলিত
  6. ‘মুক্তি যুদ্ধের' নয়মাস গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
  7. ১৯৭১ সালে লেফটেন্যাণ্ট পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাতকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  8. মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম রচিত 'লক্ষ প্রানের বিনিময়ে' গ্রন্থ, ১৯৮১ থেকে সংকলিত। ১৯৭১ সালের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম ক্যাপ্টেন পদে সাবেক ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন।
  9. ১৯৭১ সালের মার্চে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি শামসুল হুদা চৌধুরী রচিত 'একাত্তরের রণাঙ্গন' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।