বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১০

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ অঞ্চলে সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ঠাকুরগাঁ-দিনাজপুর
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন
১২-৬-১৯৭৪

 ২৫শে মার্চের বিকালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, পিলখানা হইতে প্রেরিত বেতার সংকেত কিছুই আমাদের কানে পৌঁছে নাই। হঠাৎ মাঝরাতে কি এক জরুরী ডাকে আমাদের নবম শাখার ছোট কর্তা ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম এক প্লাটুন লোক নিয়ে দিনাজপুর গেলেন। সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গে কি যেন আলোচনা হইল। ভোর রাত্রে সদলবলে তিনি ফিরিয়া আসিলেন। ২৬শে মার্চের ভোর। আসিয়াই ক্যাপ্টেন ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত তামাম জুনিয়র কমাণ্ডারগণকে অফিসে ডাকিয়া পাঠাইলেন। জরুরী সভা করিয়া সরকারের আদেশ সবাইকে জানাইয়া দিয়া হাজির রিজার্ভ কোম্পানীসহ বাকি সবাইকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত হইতে আদেশ দিলেন। উপস্থিত সকলেই “বহুত আচ্ছা সব” বলিয়া যে যার কাজে লাগিয়া পড়িল।


 এদিকে উইং অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ হুসেন সীমান্ত পরিদর্শনে পঞ্চগড়ের দিকে বাহিরে ছিলেন। তাহাকে বিশেষ করিয়া ডাকিয়া পাঠান হইল। সকলেই রণ সাজে সজ্জিত হইয়া গভীর আগ্রহে বসিয়া আছে। ঠাকুরগাঁ টাউন ততক্ষণে ফাটিয়া পড়িয়াছে, জনতার বান ডাকিয়াছে, রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। ইট পাথর ও অন্যান্য জিনিস দিয়া শত শত গাছ কাটিয়া। উইং হেডকোয়ার্টারে আত্মরক্ষামূলক সামরিক ব্যুহ রচনা করিয়া পাহারার বন্দোবস্ত করা হইল। এমন সময় প্রায় ৯ টার দিকে মেজর আসিলেন, আবার জরুরী সভা বসিল। খামাখাই ছুতানাতায় নেহাৎ ভাল মানুষ বলিয়া সুপরিছিত মেজর বিষম রাগত হইয়া উঠিলেন। সবার প্রতি, আর রিজার্ভ কোম্পানির অধিনায়ক সুবেদার হাফিজকে তো একেবারে হাজতে দিবেন বলিয়া শাসাইলেন। তাহার অপরাধ কোম্পানী রণপ্রস্তুতি নিতে একটু দেরী করিয়া ফেলিয়াছে। মওকা বুঝিয়া ক্যাপ্টেনও এক ধাপ আগ বাড়িলেন-বলিলেন, “ও দিন ভুল যাও -আওয়ামী লীগ-মীগ নেহী চলে গা৷” তাহাদের মনের খবর পাওয়া গেল। আমরা চুপচাপ শুধু নীরব শ্রোতা। দীর্ঘশ্বাসটি পর্যন্ত না ফেলিয়া কাজ করিয়া যাইতে লাগিল আমাদের লোক। তবে বাঙ্গালী সৈনিকদের অবস্থাটা বেশ গভীরভাবে আঁচ করিতে পারিল। ডাক-তার না থারিলেও বাতাস যেন কানে কানে চুপে চুপে সব খবর দিয়া যাইতে লাগিল। এমনিভাবে সমুদয় বাঙ্গালী সৈনিকের মন পুরাদস্তুর বারুদের ঘর হইয়া উঠিল। অপেক্ষা একটু মাত্র ইঙ্গিতের কিন্তু আমি লোকদিগকে সান্তনা দিতে লাগিলাম।


 এদিকে কালবিলম্ব না করিয়াই বড় কর্তার আদেশে টাউনে পেট্রল পাঠানো হইল, আর কারফিউ জারী থাকিল দিন-রাত। কিন্তু হাজার হাজার বিক্ষুদ্ধ জনতা সকল আদেশ অমান্য করিয়া শভাজাত্রা বাহির করে এবং নানা জায়গায় বেরিকেড স্থাপন করিয়া চলিল। মেজর ও ক্যাপ্টেন আমাকে সঙ্গে নিয়া শহরে গেলেন এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা নেন। সেইদিন বেলা দশ ঘটিকার সময় মিছিলের উপর গুলি চালানো হয়। ফলে রিকশাওয়ালা মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আমাদের লোক আরও খাপ্পা হইল; আমি তাহাদিগকে সান্তনা দিয়া আমার কয়েকজন সহকর্মীসহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ করিলাম এবং সকল আলোচনা গোপন রাখা হইল।  আবার সেই দিনই (২৬শে মার্চ) দিবাগত রাত্রে বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন নজির আহমেদ সুবেদার আতাউল হকসহ ৩০ জনের একটি প্লাটুন সেক্টর সদর দিনাজপুর হইতে আমাদের সাহায্যার্থে ঠাকুরগাঁ আসিয়া হাজির হইলেন। এই দলে পশ্চিমারা ছিল প্রায় ডজন খানেক। আমাদের হেডকোয়ার্টার সংরক্ষণ ও টাউন পেট্রল ডিউটি সমানে চলিতে লাগিল। প্রায় এক কোম্পানী লোক ইহাতে নিয়োজিত রহিল। ২৭তারিখ আবার ঠাকুরগাঁ টাউন রক্তে রঞ্জিত হইল আমাদের নির্মম গুলির আঘাতে। এই একটি নিষ্পাপ শিশু নিহত হইল। আমাদের ডিউটি চলিতে লাগিল। ইতিমধ্যে জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, তাহারা ততক্ষণে টাউন ছাড়িয়া পলাইতে শুরু করিয়াছে।

 আমি সেই দিনই সুবেদার হাফিজ, সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান, হাবিলদার আবু তালেব ও নায়েক আব্দুল হাকিমকে নিয়া এক গোপন আলোচনা সভায় বসিয়া সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন ভোর ৬টায় পশ্চিমাদের উপর আমাদের তরফ হইতে আক্রমণ চালানো হইবে। কিন্তু হায়, পরিকল্পনা অনুসারে সুবেদার হাফিজ যখন পশ্চিমানিধনে উদ্যত হইলেন তখন জনৈক বাঙ্গালী হাবিলদারের অসহযোগিতার দরুন তাহা বাধাপ্রাপ্ত হইয়া সেই দিনকার মহত আক্রমণ স্থগিত রহিল। আমরা বিশেষ চিন্তিত হইলাম, কারণ, একেত শুরুতেই বাধা আসিল, দ্বিতীয়তঃ যদি আমাদের উদ্দেশ্য ফাঁস হইয়া যায় তবে আর রক্ষা থাকিবে না।

 খোদার উপর ভরসা করিয়া সেই দিন চুপ থাকিলাম। কিন্তু সহকর্মীদেরকে নির্দেশ দিলাম সকলেই যেন জরুরী নির্দেশের অপেক্ষায় সব সময় সজাগ থাকে। এই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আমাদের কর্মসূচী জানিবার জন্য বার বার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু তাহাদেরকে বলি যে সুযোগ আসিলেই তাহা করা হইবে এবং আপনারা সজাগ থাকিয়া আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিবেন।

 ২৮শে মার্চ ভোরেও বিশেষ কারণে পরিকল্পনামাফিক আমাদের পশ্চিমাদের উপর আক্রমণ চালানো সম্ভব হইল না। মনটা একেবারে বিগড়াইয়া গেল। খোদা না করুন আমাদের পরিকল্পনা ফাঁস হইয়া গেলে এর পরিণাম কি হইবে! আবার ঐদিকে আমাদের পাঞ্জাবী মেজর ও ক্যাপ্টেনসহ পশ্চিমাদের তৎপরতা বেশ বাড়িয়া উঠিল। আমরা সরকারী কার্যের মধ্য দিয়া খুব সতর্ক থাকিলাম। সেই দিন রিজার্ভ কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার হাফিজ সেইদিনকার মত টাউন ডিউটি শেষ করিয়া ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ বিছানায় শুইয়া নানা চিন্তায় মগ্ন। প্রোগ্রাম মাফিক তার পরবর্তী ডিউটি ছিল পরদিন অর্থাৎ ২৯শে মার্চ সকাল পৌনে সাতটায়, কিন্তু সেই দিন হঠাৎ করিয়া বিকাল পৌনে চারটায় তাহাকে জরুরী পেট্রলে পাঠানো হয় ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর হাইরোড পর্যবেক্ষণ ও পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। মেজর হুসেন নিজে তাহাকে পেট্রল সম্বন্ধে বিস্তারিত বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। সুবেদার হাফিজ প্রভুর ইশারায় বলিতে গেলে আদেশ বর্হিভূত কাজ করিয়া অনেক দূর পথ অগ্রসর হইলেন। ফলে পথিমধ্যে দিনাজপুর হইতে পলায়নপর বাঙ্গালী ইপিআর জোয়ানদের নিকট জানিতে পারেন সেই দিন দুপুরেই দিনাজপুর সেক্টর হেডকোয়র্টার কুটিবাড়ীতে বাঙ্গালী ইপিআর লোকদের সঙ্গে আর্মি ও ইপিআরের পশ্চিমাদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হইয়া গিয়াছে। এক নিমেষে মনে মনে তিনি নিজ কর্তব্য স্থির করিয়া সাত তাড়াতাড়ি উইং সদরে ফিরিয়া আসেন। তখন সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। আসিয়াই তিনি মাগরেবের নামাজের জন্য আমাকে মসজিদে উপস্থিত পান এবং উপরোক্ত বিষয় অবহিত করেন। অপরদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্বস্তসূত্রে জানিতে পারিলাম রাত্রি পৌনে ১১টায় উইং-এর শেষ পেট্রল লাইনে ফিরে আসার পরপরই বাঙ্গালীদের উপর হামলা শুরু করার নির্দেশ এবং আমাকে গ্রেফতার করার আদেশ সৈয়দপুর আর্মি হেডকোয়ার্টার দিয়া দিয়াছে। অতএব আমার বাসায় সুবেদার হাফিজ, ৮ উইং-এর সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিয়ুর রহমান ও আরও জন তিনেক জোয়ন একত্রিত হইয়া মিনিট কয়েকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিপ্লব ঘটাইবার এবং সেই রাতেই। এমন সময় উইং কমাণ্ডার হইতে আদেশ আসিল সব হাতিয়ার ম্যাগাজিনে জমা দিতে হইবে। মুহূর্তে খানদের চক্রান্ত সম্বদ্ধে আমার দ্বিধা দূর হইল। আমি আরও শক্ত হইয়া বাঙ্গালী সহকর্মীদিগকে অস্ত্র জমা না দিবার নির্দেশ দিলাম। পরম পরিতোষের বিষয় কসলেই একবাক্যে আমার আদেশ মান্য করিল এবং হাতিয়ার জমা দেওয়া হইল না একটিও। বিপ্লব করিতেই হইবে, অথচ এদিকে অসুবিধা ছিল ঢের। গোটা এক প্লাটুন টাউনে গিয়াছে পেট্রলে, বাকী সব লোক উইং সদরের চতুর্দিকহ পরিখা-বিবর ঘাঁটিতে ডিউটিরত। লাইনে হাজির লোক খুব কম, আবার ওদের সঙ্গে উঠাবসা-শোয়ার ব্যবস্থা। তথাপি কমাারগণ নির্দেশ মাফিক আপন-আপন গ্রুপের লোকজনদের গোপনে ইশারায় সব বলিয়া দিলেন। অতি সতর্কতার সহিত প্রস্তুতি চলিল। প্রচুর উৎসাজ-উদ্দীপনা থাকা সত্ত্বেও অনেককেই এই সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িতে দেখা গেল। তবে মঙ্গলময়ের আশীর্বাদপুষ্ট হইয়া সুবেদার হাফিজ খুবই সক্রিয় ছিলেন। তিনি উইং-এর পুরা রক্ষাব্যূহ ঘুরিয়া প্রতিটি মরিচায় যাইয়া প্রতিটি বাঙ্গালীর কাছে পৌঁছাইয়া দিলেন অপারেশনের নির্দেশ এবং বাহিরে পেট্রল পার্টির সাথে যোগাযোগ রাখা হইল। খোদাকে ধন্যবাদ কেহ সেই দিন না বলে নাই, যদিও মনে মনে ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল অনেকেই।

 রাত ১০টা ১৮ মিনিট। চারিদিকে অন্ধকার, থমথমে ভাব। সুবেদার হাফিজের হস্তস্থিত ঠোট্ট স্টেনগানটা হঠাৎ গর্জিয়া উঠিল। মেজর আর ক্যাপ্টেনের দেহরক্ষীদলের অধিনায়ক হাবিলদার মোহাম্মদ জামান বুকে গুলিবিদ্ধ হইয়া পরকালের যাত্রী হইল তাহারই গার্ড-রুমের বিছানায়। ইশারা বুঝিয়া পর মুহূর্তে আরও অনেক ক্ষধার্ত হাতিয়ার গর্জিয়া উঠিল একসঙ্গে। বেশ কয়জন পশ্চিমা পরপারর যাত্রী হইল। আমাদের লোক ‘জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়া বিজয়বার্তা ঘোষণা করিল। থামিয়া সারা রাত ধরিয়া ফায়ার চলিল, যদিও আমার মতে আদৌ এর দরকার ছিল না। ঐদিকে গোলাগুলির ফাঁকে এক সময়ে বর্ডার কোম্পানীগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হইল সব পশ্চিমা খতম করতঃ সামান্যসংখ্যক লোক পিছনে রাখিয়া অধিকাংশকে ঠাকুরগাঁ পাঠাইয়া দিতে। রাতের অন্ধকারে তেতলা দালান, বাসাবাড়ী ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে চতুর্দিকে লোক ছড়াইয়া ছিল, তাই একেবারে পশ্চিমা নিধন পর্ব শেষ হইল না। অধিকন্তু নানা সুযোগে নানা জায়গায় কিছুসংখ্যক পশ্চিমা হাতে অস্ত্র তুলিয়া নেয়। তাই আরও কিছুটা সময় লাগিল আমাদের। এই এলোপাতাড়ি পাতলা ফায়ারের ভিতর দিয়া আমাদের বাঙ্গালী পরিবারগুলিকে শহরে স্থানান্তরিত করিয়া দিলাম। শহরবাসীরা প্রথমে গোলাগুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়া পড়িলেও অনতিবিলম্বে আমাদের বিজয় সংবাদ শ্রবণে হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ সমবেত কণ্ঠে 'জয় বাংলা' ধ্বনিসহ বিভিন্ন শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তুলিল এবং তাহারা বিভিন্ন প্রকারে আমাদের সাহায্য করিতে লাগিল। সেই দিন ভোররাত্রে বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন নজীর আহমদ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ও তাহার স্ত্রীকে নিয়া ছদ্মবেশে পলায়ন করিতে থাকেন সম্ভবতঃ সৈয়দপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পদব্রজে সামান্য কিছু দূর যাওয়ার পরই ক্ষীপ্ত জনসাধারণের হাতে মারা পড়েন। ওদিকে সেইদিন ভোররাত্রেই ৮-উইং হইতে আসা সুবেদার আতাউল হক শহীদ হন। এই বিপ্লবে তাহার ভূমিকা অতি প্রশংসনীয়। তাঁহারই যোগসূত্র ক্রমে সেই রাত্রে ই হাজার হাজার লোক টাউনে বাহির হইয়া পড়ে এবং তাহারা আমাদের সহযোগিতা পাইয়া আবার শতগুণ উৎসাহে মাতিয়া উঠে এবং আমাদের সাহায্যার্থে আগাইয়া আসে।

 ২৯শে মার্চ সকালবেলা সামান্য গোলাগুলি চলিতে লাগিল। অবশিষ্ট খানরা দালানকোঠায় থাকিয়া ফায়ার করাতে তাহাদিগকে কাবু করা গেল না। আমরা ছাত্র, জনসাধারণ ও স্থানীয় বিভিন্ন বিভাগের নিম্নপদস্থ কর্মচারী বিশেষ করিয়া ওয়াপদা বিভাগের লোকদের সহায়তায় ছাউনি হইতে আমাদের প্রয়োজনীয় সব হাতিয়ার, গোলাগুলি ও অন্যান্য বহু জিনিসপত্র অন্যত্র সরাইয়া নিলাম।

 ২৯শে পার হইয়া ৩০শে মার্চের সকাল। আমি সুবেদার মতিউর রহমানকে এক প্লাটুন লোকসহ ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারকে শত্রুমুক্ত করার নির্দেশ দিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার দলবল নিয়া অগ্রসর হইলেন কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টার পর খানদের ব্যূহ ভেদ করিতে না পারিয়া ফেরত চলিয়া আসিলেন। তখন সুবেদার হাফিজ তাহার কোম্পানীর কিঞ্চিদধিক এক প্লাটুন লোক নিয়া ঝাঁপাইয়া পড়েন এবং বিকাল প্রায় তিনটা নাগাদ তেতালা দালানের শেষ দুশমনটি পর্যন্ত খতম করিয়া তাহা পরিষ্কার করেন। তাহারই আদেশে প্লাটুন কমাণ্ডার বজল আহমদ চৌধুরী একদল লোক নিয়া উইং অধিনায়কের বাসভবন মুক্ত করেন। মেজর হোসেন এই সময়ই নিজ বাসভবনে নিহত হন। একই সময় যুগপৎ আক্রমণ করিয়া নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান পাক আর্মির গেরিলা সুবেদার ও তাহার সঙ্গীদের খতম করিয়া জেসিও মেস পরিষ্কার করেন। পাবলিকের সহায়তায় অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত মৃতদেহ অন্যত্র সরাইয়া দাফন করিয়া ফেলা হয়। আর এদিকে দ্রুতগতিতে লাইনের ভিতরকার সবকিছু যথাসম্ভব গোছগাছ করিয়া নিয়া হেডকোয়ার্টারের চতুর্দিকে দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করা হইল। সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে তাঁহার নিজস্ব ডি কোম্পানী ব্যতীত আরও কিছু আসার-মুজাহিদ এই প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে মোতায়েন রহিল।

 ওদিকে স্থানীয় এম-সি-এ জনাব ফজলুল করিমের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁ শহরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হইল। আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ স্বেচ্ছায়ই তাহারা গ্রহণ করিলেন। তাহাদের কর্তব্য ঠিছল শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং প্রয়োজনমত যুদ্ধরত লোদের নানা কাজে সাহায্য করা। ছাত্র- জনতা আমাদের পার্শ্বে থাকিয়া যে সাহায্য করিয়াছে তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। স্থানীয় নারী সমাজ পর্যন্ত এই সংগ্রামে প্রচুর সাহায্য ও সমর্থন দিয়াছে। ঐ দিন (৩০শে মার্চ) সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তস্থ কোম্পানীসমূহের লোকজন ঠাকুরগাঁয় আসিয়া সমবেত হয়। আমাদের জোয়ানরা ও স্থানীয় জনসাধারণ আমাকে মেজর পদে বরিত করিয়া যুদ্ধের পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করিলেন। বৃদ্ধ বয়সে ঘোর দুর্যোগের সময় এত বড় দায়িত্ব আমাকে বহন করিতে হইল। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নাম স্মরণ করিয়া জনসাধারণের শুভাশীষ নিয়া আমি আমার ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠন করিয়া আগামী দিনের জন্য সকলকে তৈয়ার করিতে লাগিলাম এবং সামান্য ভাষণের মাধ্যমে আমরা সমবেতভাবে শপথ নিলাম।

 এই দিন বিকালেই সুবেদার আবদুল খালেকের নেতৃত্বে আমাদের দুই কোম্পানী এবং এক কোম্পানী মুজাহিদকে সাধ্যানুযায়ী সুসজ্জিত করিয়া ঠাকুরগাঁর ২৩ মাইল আগে ভাতগাঁও পুল প্রতিরক্ষার্থে পাঠানো হয়। নায়েক সুবেদার বদিউজ্জামানের অধীনে আমাদের সি কোম্পানীকে এক কোম্পানী মুজাহিদসহ দেবীগঞ্জে পাঠানো হইল। হাবিলদার নুর মোহাম্মদের অধীনে এক প্লাটুন ইপিআর এবং এক প্লাটুন মুজাহিদ শিবঞ্জ বিমান বন্দর প্রতিরক্ষার জন্য পাঠানো গেল। বাকী সদর কার্যালয়ের সঙ্গে এক কোম্পানী অতিরিক্ত হিসাবে রাখা হইল। সে রাতেই আনসার-মুজাহিদ ভাইয়েরাও অধিক মাত্রায় আসিয়া একত্রিত হইতে লাগিল। সহকারী আনসার এ্যাডজুটেণ্ট (মহকুমা) জনাব কবির তাহাদিগকে পুনর্গঠন করিয়া আমার পার্শ্বে থাকিয়া অনেক সাহায্য করিতে লাগিলেন। আমরা সীমান্ত এলাকাকে দুইটি সাব সেক্টরে ভাগ করিয়া সুবেদার আবুল হাশেম ও নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীকে যথাক্রমে পঞ্চগড় সাবসেক্টর ও রুহিয়া সাবসেক্টরের দায়িত্বভার অর্পণ করি এবং নিম্নোক্ত বিষয়গুলি তাহাদের দায়িত্বের অন্তর্গত করিয়া দিইঃ (১) সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা আঞ্চলিক আনসার-মুজাহিদদের সহযোগিতায়; (২) এলাকায় জনসাধারণের এবং সরকারী বেসরকারী সম্পত্তির নিরাপত্তা বিদান করা; (৩) আনসার মুজাহিদদের পুনর্গঠন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং ছাত্রদের সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; (৪) বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সদর কার্যালয়ে অবহিত করা; (৫) বন্ধুরাষ্ট্রের যে কোন সাহায্যের জিনিসপত্র সমিতির মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের তদারক করা; (৬) রণাঙ্গনের খবর কতিপয় নির্দিষ্ট লোককে জ্ঞাত করানো। এমনিভাবে সবরকম আদেশ উপদেশ দিয়া তাহাদেরকে নিজ নিজ জিম্মাদারী এলাকায় মোতায়েন করা হইল।

 ইতিমধ্যে হেডকোয়ার্টার এবং বর্ডারের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত বিপ্লব অপারেশনের বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট আসিয়া পৌঁছিল। হিসাবে দেখা গেল, এই অপারেশনে বর্ডারে আমাদের একজন মাত্র লোক আহত হইয়াছে। সে হাবিলদার আব্দুল আজিজ। হেডকোয়ার্টারে চারজন ঘোরতর জখম ও দুই জন শহীদ। জখমী (১) হাবিলদার দীন মোহাম্মদ (২) সিপাহী ওলিউল্লাহ ভূঞা (৩ সিপাহী আবু তাহের (৪) একজন মুজাহিদ কমাণ্ডার এবং শহীদ (৫) সুবেদার আতাউল হক (৬) ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন। এই সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে আমরা এক মেজর ও এক ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ১১৫ জন খান সেনাকে খতম করি-যাহাদের অধিকাংশই ছিল কমিশনড, জুনিয়র কমিশনড ও নন কমিশনড অফিসার এবং বয়সে প্রবীণ, অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব ও সামরিক প্রশিক্ষণে নিপুণ আর সর্বোপরি এই এলাকার রাস্তাঘাট ও অবস্থান এবং আমাদের বৈশিষ্ট্য সমন্ধে ছিল বিশেষ ওয়াকিফহাল। তাই সার্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইহা আমাদের পক্ষে ছিল এক বিরাট সাফাল্য। পশ্চিমা হতাহতদের মধ্যে ছিল ইপিআর-এর ১০৪, আর্মির ৮ এবং বিমান বাহিনীর ৩ জন।

 ৩০শে মার্চ হইতেই সকল গ্রামেগঞ্জে, স্কুল কলেজে যুবকদের সামরিক শিক্ষা চলিতে লাগিল। আমার ব্যাটালিয়ন ছাড়া একদিনের মধ্যেই এক ব্যাটিলিয়ন আনসার ও এক ব্যাটালিয়ন মুজাহিদ পুনর্গঠিত হইল। এক ব্রিগেডের মত শক্তি নিয়া (অবশ্যই শুধু সংখ্যানুপাতিক) আমরা বিখ্যাত সৈয়দপুর শত্রু ছাউনি আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করিলাম। এই দিকে দিনাজপুর হইতেও সাহায্য পাইবার আশ্বাস পাইলাম। পরিকল্পনা অনুসারে ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদদের মিলিত বাহিনীকে প্রয়োজনভিত্তিক প্লাটুন ও কোম্পানী পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হইল বিশেষ করিয়া সৈয়দপুর- ঠাকুরগাঁর মধ্যে যোগাযোগকারী বিভিন্ন রাস্তার উপর অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ডাইনে বীরগঞ্জ, শালবাগান, ভাতগাঁ এবং বাঁয়ে খানসামা, দেবীগঞ্জ, জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ী প্রভৃতি স্থানে অনেকগুলি রক্ষাব্যূহ তৈয়ার করিয়া আরও অগ্রসর হইবার প্রয়াস পাইলাম। অবশ্য স্থানগুলি ছিল একে অন্য হইতে বহু দূরে এবং যোগাযোগের দিক দিয়া একেবারেই বিচ্ছিন্ন। না ছিল কোন পজিশন অন্য পজিশনের বদলী বা অবস্থান- প্রস্থানের কিছুই জানিত না। অথচ আধূনিক সমরে এ রীতি সম্পূর্ণ অচল। খাদ্য এবং অন্যান্য সামরিক সরবরাহের ব্যাপারও ছিল সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের উপর নির্ভরশীল। কাজেই অনাহার- অর্ধাহার ছিল নিত্যসঙ্গী।

 ইতিমধ্যে সৈয়দপুরে ৩নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করিলাম, তবে মাত্র তাহাদের সি কোম্পানীর লোকজন সেখানে ছিল। তাঁহারাও ততক্ষণে খানদের দ্বারা একবার আক্রান্ত হইয়া বিধ্বস্ত অবস্থায় সেখান হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। তাহাদের কোম্পানীর লোকজন পুরা ছিল না এবং তাহার নেতৃত্ব দিতেছিলেন ক্যাপ্টেন আশরাফ। যাহাই হউক, তাহাদের সহযোগিতায় সৈয়দপুরের দিকে অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি চলিতে লাগিল। পিছনের দিকে পূর্বে কথিক হাবিলদার নূর মোহম্মদের নেতৃত্বাধীন প্লাটুনদ্বয় ঠাকুরগাঁ বিমানবন্দরের হেফাজত করিতে লাগিল এবং তথাকার ম্যানেজার আতাউর রহমান ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বিমানবন্দরকে নানা উপায়ে শত্রুর ব্যবহারের অনুপযুক্ত করিয়া ফেলা হইল।

 ৩১শে মার্চ। বন্ধুরাষ্ট্রের ৭৫ নং বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডার কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করিলাম। তিনি সব রকম সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। পহেলা এপ্রিল রাত্রে কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবকে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি পরিদর্শন করাইলাম, তিনি আমাদের কাজের বিশেষ প্রশংসা করতঃ তাঁহার নিজের কিছু পরিকল্পনা ব্যক্ত করিলেন। আমরা তাঁহার উপদেশ মত নিজ বাহিনীকে সৈয়দপুরের আরও কাছাকাছি নিয়া যাইবার পরিকল্পনা নিলাম। ২রা এপ্রিল হঠাৎ আমরা পুরানো কমাণ্ডিং অডফিসার পাক আর্মির অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম, টি হুসেন আমার সহিত দেখা করিয়া আলাপচারী হইলেন। তাঁহার প্রাথমিক আলাপের অবিকল উদ্ধৃতি নিন্মে দেওয়া হইলঃ “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনি আপনার লোকজনসহ দেশের মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়াছেন তাহা সত্যি অদ্ভুত। আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে কাজ করিবার সুযোগ দিবেন কি।” আমি আনন্দের সঙ্গে তাহাকে গ্রহণ করিলাম ও আমাদের কমাণ্ডিং হিসাবে নিযুক্ত করিলাম।

 এক্ষণে আমরা আরও নতুন উদ্যম নিয়া কাজ করিতে লাগিলাম। পরদিন ৩রা এপ্রিল আমরা দিনাজপুর গেলাম এবং সেখানকার সরকারী ও বেসরকারী নেতা ও কর্মচারীবৃন্দকে নিয়া একটি সভা করিয়া আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়া আলোচনা করিলাম। পরিকল্পনা মাফিক ঐদিন ৩রা এপ্রিল ঠাকুরগাঁর রক্ষাবূহ্য উঠাইয়া ফেলা হয় আর সুবেদার হাফিজকে তাহার ডি কোম্পানীসহ সবার আগে দশ মাইল তে- রাস্তার মোড়ের প্রায় দেড় মাইল পূর্বে দিনাজপুর - সৈয়দপুর প্রধান সড়কের উপর করা হইল। সেখানে গিয়া তাঁহারা ক্যাপ্টেন আশরাফের ৩ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি কোম্পানী সহিত মিলিত হন। তাহারা মিলিভাবে সৈয়দপুরগামী সড়কে অক্ষরেখা ধরিয়া সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ৪ঠা এপ্রিল তাহারা ভূষির বন্দরে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। আবার ঐ দিন দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁ ইপিআর, আর্মি, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়া একটা যৌথ কমাণ্ড গঠিত হইল। আর ভাতগাঁও পুলের নিকট একটি জরুরি সভা ডাকিয়া তাহাতে যৌথ কমাণ্ডের অধীনে সৈয়দপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইল।

 ৫ই এপ্রিল ৮ উইং দিনাজপুরের সুবেদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী ইপিআর ৯ উইং-এর একটি ইপিআর প্লাটুনসহ সৈয়দপুর- নীলফামারী সদর রাস্তায় সৈয়দপুরের অদূরে দারোয়ানির নিকট প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। উক্ত তারিখে ভূষির বন্দরে আমাদের সঙ্গে শত্রুদের সংঘর্ষ হয় এবং তাহারা পালাইয়া যায়। সেইদিনই আমাদের বাহিনী একনাগাড়ে প্রায় ১০ মাইল আগাইয়া চম্পাতলী নামক স্থানে গিয়া পৌঁছে। তখন রাত্রি ১১টা। একেত অপরিচিত স্থান, তদুপরি গাঢ় অন্ধকার ও মুষলধারে বৃষ্টি। যাহা হউক ভোর পর্যন্ত প্রতিরক্ষার অনেকটা ব্যবস্থা হইয়া গেল। কিন্তু ৬ই এপ্রিলের সূর্য উঠিতে না উঠিতেই দুশমনরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। তারপর ‘ইয়া আলী' হুঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইপিআর ও রেজিমেণ্টের জোয়নরা মিলিতভাবে পাল্টা ‘ইয়া আলী' বলিয়া সিংহনাদে দুশমনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। বঙ্গশার্দুলের থাবায় নয়জন খানসেনা প্রাণ হারায়, বাকী ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় প্রাণ নিয়া পলাইয়া যায়। খানিক পরে ক্যাপ্টেন আশরাফ পরামর্শ সভা ডাকিলেন, জানা গেল তার কাছে গোলাবারুদ একেবারেই কম, কোনমতে সেদিনকার মত চলিতে পারে। তিনি সেইদিনই সন্ধ্যা পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ততক্ষণ আর অপেক্ষা করিতে হইল না। হঠাৎ করে শুরু হইল শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীল অজস্র শেলিং, পিছনে আসিল কয়েকটি ট্যাঙ্ক, সঙ্গে ৮১ মিলিমিটার মর্টার। অনেকক্ষণ সংঘর্ষ চলিল। উভয় পক্ষেই হতাহত হইল এবং ছত্রভঙ্গ হইয়া অনেক লোক দলত্যাগী হইবার সুযোগ পাইল। আমরা ভূষির বন্দর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পজিশন নিলাম। পরদিন সেখানে তুমুল যুদ্ধ হইল। আমাদের নিকট ভারী এবং প্রতিরোধক অস্ত্র না থাকায় আবার পশ্চাতে আসিতে বাধ্য হইলাম।

 এই সময় সুবেদার হাফিজ কোম্পানীর অধিকাংশ দেবীগঞ্জ হইয়া খানসামায় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। ওদিকে নীলফামারী রাস্তায় মজিদ কোম্পানীর সঙ্গে ৭ এবং ৮ এপ্রিল দুশমনদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেখানে আমাদের তিনজন শহীদ কয়েকজন আহত ও বহু হাতিয়ারপত্র খোয়া গেলেও দুশমনরাও বিশ-পঁচিশ জন হতাহত নিয়া অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইখানেও ট্যাঙ্ক এবং গোলন্দাজ হামলার মোকাবিলা করিতে না পারিয়া ক্যাপ্টেন আশরাফ, সুবেদার মেজর আব্দুর রব, ক্যাপ্টেন নজরুল হক এবং আমার উপস্থিতিতে ৪ঠা এপ্রিল ভাতগাঁয়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলাম এবং পিছনে হাটিয়া দশ মাইল ষ্ট্যাণ্ডে শক্ত করিয়া ঘাঁটি গাড়িলাম।

 ১০ই এপ্রিল সকাল ৯ ঘটিকায় শত্রুরা ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বহর নিয়া আমাদের উপর ভীষণ আক্রমণ চালাইল। প্রথম বার আমরা তাহাদের আক্রমণ প্রতিহত করিলাম। দ্বিতীয় বার বেলা ২ ঘটিকার সময় আক্রমণ চালায়। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে আমাদের দুইটি ছয় পাউণ্ডার গান-ই নষ্ট হইয়া যায়। তুমুল যুদ্ধের পর এখানে আমাদের চারজন লোক শহীদ হয় এবং কিছু লোক আহত হয়। ফলে আমাদের লোক দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া দিনাজপুরের লোক দিনাজপুরের দিকে ঘাঁটি পরিবর্তন করে ও ঠাকুরগাঁয়ের লোক ভাতগাঁও পুলের নিকট দৃঢ় অবস্থান নেয়। দশ মাইল স্ট্যাণ্ডের যুদ্ধে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হইল, কেননা বাহির হইতে অনেক গোলাবারুদ আমরা এখানে আনিয়া জমা করিয়াছিলাম এবং আমাদের কাছে থাকা কয়েক শত রাইফেল বন্দুকও সেখানে রাখা ছিল। সকলেরই ধারণা ছিল আমাদের এই স্থান ছাড়িতে হইবে না কিন্তু ট্যাঙ্ক বহরের আক্রমণের চাপে ঐ স্থানও ছাড়িতে হইল। লোকের মনোবল যথেষ্ট ছিল কিন্তু ভারী অস্ত্র না থাকায় আবার সরিয়া আসিতে হইল।

 আমরা আবার ভাতগাঁয়ের পুলের নিকট শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করিলাম। মেজর এম. টি, হোসেনসহ কর্নেল কোন কাজে আসিল না। আমি ব্যানার্জী সাহেবকে বলিয়াছিলাম যে, ভাতগাঁয়ের পতন হইলে আমাদের লোকজনের মনোবল নষ্ট হইবে এবং ঠাকুরগাঁ শহরকে রক্ষা করা সম্ভব হইবে না। তাই যেভাবেই হউক ভাতগাঁওকে রক্ষা করিতে হইবে। আমরা দুইজনে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করিবার জন্য অনেক টেষ্টা নিলাম কিন্তু কিছুই হইল না। বিহারের প্রধানমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর আমাদিগকে যে কোন সাহায্য দিতে আশ্বাস দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা পাইতে অনেক দেরী হইয়া গেল।

 ১৩ই এপ্রিল ভাতগাঁয়ে সম্মুখ সমরে না আসিয়া খান সেনারা রাস্তা ধরিয়া পিছন দিক হইতে আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা নিল। শত্রুদের পরিকল্পনা আমরা অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। খানসামায় তখন আমাদের কোন লোক ছিল না। তাই আমরা তাড়াহুড়ো করিয়া গোপনে সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে এক কোম্পানী সেখানে পাঠাইলাম। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় তাহার কোম্পানী বীরগঞ্জ হইতে পদব্রজে অগ্রসর হইয়া খানসামায় পৌঁছে। শত্রুসেনারা দুইটি কোম্পানী যখন নদী পার হইতেছিল তখন তাহারা সুযোগ বুঝিয়া তাহাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাইয়া তাহাদের ৮ বালুচ ডি কোম্পানীকে সম্পূর্ন রূপে পর্যদুস্ত করিয়া দেয়। প্রচুর হতাহত করা ছাড়াও তাহারা দুশমনের নিকট হইতে ১০ গাড়ী মালামাল হস্তগত করে যাগার মধ্যে অনেক গোলাবারুদ, ৭৫টি বিছানা, প্রচুর রেশন, পাকের সরঞ্জাম, একটি অয়ারলেস সেট, একটি মোটর সাইকেল ও আরও বিবিধ দ্রব্যাদি ছিল। সুবেদার হাফিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্বই ছিল এই কোম্পানীর সাফল্যের কারণ। শত্রুর এই আক্রমণ প্রতিহত করিয়া পাল্টা তাঁহাদের যে ক্ষতি সাধন করা হইয়াছিল তাহাতে শত্রুর মনোবল যথেষ্ট ক্ষুন্ন হইয়া যায়, ফলে তিনদিন পর্যন্ত শত্রুদের তরফ হইতে আর কোন সাড়াশব্দ ছিল না এবং পশ্চাৎ আক্রমণ হইতেও আমাদের ঘাঁটি মুক্ত রহিল।

 ১৭ই এপ্রিল আমি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের তিন সদস্যের একটি দলকে নিয়া ভোর পাঁচটায় রওয়ানা হই সীমান্তের দিকে তাহাদিগকে গন্তব্য স্থানে পৌঁছাইয়া দিতে। মেজর এম, টি, হোসেন সাহেব থাকিলে রণাঙ্গনের দায়িত্ব নিয়া। আমি প্রায় দুপুর তিনটায় রুহিয়া পৌঁছি এবং ঠাকুরগাঁও কমাণ্ড পোস্টের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করি কিন্তু কোন সাড়া না পাইয়া আমার মনে সন্দেহ জাগে এবং আমি তাড়াতাড়ি পঞ্চগড় কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে চলিয়া আসি। এখানে আমাদের অল্পসংখ্যক লোককে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞেসাবাদে জানিতে পারি ভাতগাঁও ঘাঁটিতে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে। মেজর এমটি হোসেনের কোন খবর নাই, তবে শুনিলাম, তিনি একটি বড় বাস ও একটি জীপ নিয়া অর্ধ লক্ষ টাকাসহ ভারতে চলিয়া গিয়াছেন হাতিয়ার ও গোলাবারুদ আনার জন্য। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি আর দেশে ফিরিয়া আসেন নাই। যাহাই হউক ভাতগাঁও ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিল নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেকের উপর। তাহার নিকট সমস্ত ঘটনা জানতে পারিলাম। তিনি জানাইলেন শত্রুরা সকাল আটটার সময় প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ চালায় ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে। তাহারা প্রথমে কান্ত মন্দিরের পাশ দিয়া ঢুকিয়া সোজা বীরগঞ্জ দখল করিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের জোয়ানদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাহা ভঙ্গুল হইয়া যায়। এরপর শত্রুরা শক্তি বৃদ্ধি করতঃ দ্বিতীয় দফা আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনীও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বাধা দেয় এবং প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরিয়া তুমুল সংঘর্ষের পর আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া অনেকে দলত্যাগী হইয়া ভারতের দিকে চলিয়া যায় এবং অনেকে পিছনে পচাঁগড় হইয়া জমায়েত হইতে থাকে। এখানে আমাদের ৩ জন শহীদ হন। তাহারা বীরবিক্রমে লড়াই করিয়া শত্রুপক্ষের অন্ততঃ ২৫/৩০ জনকে নিহত ও ১৫/২০ জনকে আহত করেন। সিপাহী আবদুল মান্নান, সিপাহী গুল মোহাম্মদ ভূঞা ও হাফিজ আবদুর রহমান এই যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন। আহতদের মধ্যে সিপাহী আবদুল মন্নান আহত অবস্থায় শত্রুর হস্তে বন্দী হয়বর্বর পশুরা তাহাকে গুলি করিয়া মৃত মনে করিয়া পুকুরে ফেলিয়া দেয়। স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় এবং তাহাদের প্রাণভরা সেবা ও দয়া ময়ের কৃপায় সে সুস্থ হইয়া উঠে ও অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি তেতুঁলিয়াতে আমাদের সাথে যোগদান করে। বাকী দুইজন শাহাদৎ বরণ করিয়া অমর হইয়া আছেন।

 অন্যদিকে খানসামাতে ১৩/১৪ তারিখের সংঘর্ষে হাফিজ কোম্পানী পাক আর্মিকে তিনদিন পর্যন্ত জব্দ করিয়া রাখিলেও আমাদের ভাগ্যলক্ষ্মী প্রসন্ন ছিল না। একেত খানরা মার খাইয়া ততক্ষণে ভারী মর্টার ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়া আসিল, তদুপরি সেইদিন একই সময়ে খবর পাওয়া গেল ভাতগাঁয়ের প্রধান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। তাই ডি কোম্পানীও খানসামা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল। তবে এই কোম্পানী ঐ স্থানে মোতায়েন থাকায় ভাতগাঁও শত্রুর পাশ অথবা পশ্চাৎ আক্রমণ হইতে নিশ্চিতভাবে রক্ষা পাইয়াছিল।

 এই কোম্পানীর পশ্চাদপসরণের সঙ্গে সঙ্গে জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ী, দেবীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের ছোট ছোট রক্ষাব্যূহগুলিরও পিছু হটিতে বাধ্য হইল। এইভাবে শত্রুসেনার অগ্রাভিযান আর আমাদের পশ্চাদপসরণের পালা চলিতে থাকিল। তবে সান্ত্বনা এই হতাহতের দিক দিয়া শত্রুসংখ্যা বরাবরই ভারী ছিল। আমরা দিনব দিন হাতিয়ার আর গোলাবারুদ হারাইয়া দুর্বল হইতে থাকিলাম- স্বাধীন এলাকার পরিধিও কমিয়া আসিতে লাগিল, জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িল- খাদ্য সরবরাহও আমাদের প্রায় বন্ধ হইয়া আসিল। আমরা প্রমাদ শুনিলাম এবং আরও পিছে হটিয়া আসিলাম।

 প্রায় ২০/২১ দিন মুক্ত থাকার পর ঠাকুরগাঁয়ের পতন হইল। স্থানীয় জনসাধারণ শহর ছাড়িয়া গ্রামে ও ভারতে আশ্রয় নিতে লাগিল। সামরিক নিয়মে সামরিক বাহিনী কোন স্থান ছাড়িয়া দেয় আবার কোন স্থান দখল করে এবং তাহা পরিকল্পনা মাফিক হইয়া থাকে। আমাদেরও তেমন পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইতে পারে নাই। যাহা হউক, যতদূর সম্ভব গোলাবারুদ, রেশনপত্র সঙ্গে নিয়া গিয়াছি কিন্তু আরও সরকারী বেসরকারী জিনিস নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল। মেজর এম, টি হোসেনের অনুপস্থিতিতে আবার আমাকেই দায়িত্বভার নিতে হইল। আমি সুবেদার হাশেম, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমানকে আরও ২২ জন লোকসহ মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়া ঠাকুরগাঁ পাঠাইলাম ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা ও মূল্যবান গহনাপত্র যাহা পাওয়া যায় তাহা নিয়া আসার জন্য। তাহারা ঠাকুরগাঁ আসিয়া স্টেট ব্যাঙ্কের সীলমোহর যুক্ত একত্রিশ বাক্স টাকা লইয়া পঁচাগড়ে ফিরিয়া আসিয়া একটি গাড়ীতে বোঝাই অবস্থায় আমার কাছে অর্পণ করে। আমি ১২ জন লোকের একটি গার্ড দিয়া রেশনের গাড়ীতে ঐ গাড়ীটিও রাখিয়া দিই। কিছু দিন পরে এই টাকা ক্যাপ্টেন নজরুল, জনাব সিরাজুল ইসলাম এমসিএ, জনাব আবদুর রউফ এমসিএ-দের উপস্থিতিতে কর্নেল ব্যানার্জীর হেফাজতে রাখি এবং পরে অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী সাহেব স্বয়ং আসিয়া ঐ টাকা মুজিবনগরে নিয়া যান। আমিও তাঁহার সঙ্গে যাই টাকা জমা দিতে। সেখানে প্রায় ১ কোটির মত টাকা ছিল যাহার হিসাব অর্থমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়।

 ১৭ই এপ্রিল নাগাদ আমাদের কোম্পানীগুলি বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হইতে পঞ্চগড়ে আসিয়া পৌঁছিল। তাহারা পরস্পরের সহযোগিতায় সেখানে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করিতে শুরু করিল। ১৭ এবং ১৮ তারিখ বিভিন্ন কোম্পানীর বেশ কিছু লোক যাহারা নানাস্থানে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল অথবা আটকা পড়িয়াছিল পঞ্চগড় আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাদের লোক নতুন উৎসাহ নিয়া কাঞ্চন নদীর তীরে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণে তৎপর হইল। ১৮ তারিখ ছোট ছোট কয়েকটি দল আগে পাঠাইলাম, অনেক দূর আগাইয়াও শত্রুর কোন আনাগোনা দেখা গেল না। আমাদের প্রায় ১০৬ টি পরিবার ছেলেমেয়েসহ ছিল। এই সুযোগে তাহাদিগকে সরাইয়া নিরাপদ স্থানে নিবার ব্যবস্থা করিলাম। চিকিৎসাধীন কিছু রোগী এবং আহতকেও হাসপাতালে স্থানান্থরিত করা হইল। এই সময় আমাদের কাছে কোন ডাক্তার ছিল না। একমাত্র কম্পাউণ্ডার মনসুরই ছিল আমাদের প্রধান অবলম্বরন এবং তাহার সঙ্গে কয়েকজন নার্স ছিল। কম্পাউণ্ডার মনসুর বিপদের সময় যে কাজ করিয়াছেন, যেভাবে রোগীদের সেবাযত্ন নিয়াছেন তাহা সত্যিই প্রশংসনীয়।  পরের দিন ২৯শে এপ্রিলের দুপুর। আমার সহকর্মী কমাণ্ডারদের নিয়া নতুন পরিকল্পনা সম্বদ্ধে আলোচনার্থ সবেমাত্র ডাকবাংলায় বসিয়াছি এমন সময় হঠাৎ কয়েকটি গোলার শব্দ শোনা গেল। আমার আলোচনা স্থগিত করতঃ বাহির হইয়া পড়িলাম। অবস্থা আঁচ করিতে না করিতেই আরও কয়েকটা শেল আমাদের ডাইনে- বাঁয়ে- পিছনে আসিয়া পড়িল, বুঝিতে বাকী রহিল না দুশমনের প্রত্যক্ষ আক্রমণ অত্যাসন্ন। কমাণ্ডাররা যে যার স্থানে চলিয়া গেলেন। ইতিমধ্যে দুশমনের একটি গোলা আমাদের একটি গাড়ীর উপর আঘাত করিল এবং তাহাতে আগুন ধরিয়া গেল। গাড়ীটিতে খানসামায় দুশমনদের নিকট হইতে আটককৃত গোলাবারুদ রক্ষিত ছিল, উহার পাশ্বেই আমার জীপগাড়ীটিও ছিল, কোনমতে তাহা সরাইয়া নিতে সক্ষম হইলাম। আমরা শত্রুর আক্রমণের জবাব দিতে লাগিলাম। চার ঘণ্টা ঘণ্টা ধরিয়া চলিল, সুবেদার আবুল হামেশসহ কয়েকজন আহত হন। ইহাদেরকে পরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবশেষে ট্যাঙ্কসহ শত্রুবাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে এবং আমরা পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হই। এইবার আরও হাতিয়ার গেল, গোলাবারুদ গেল, বাহিনীর বহু লোক পালাইয়া গেল। নায়েক সুবেদার খালেক ও সুবেদার হাফেজ সাহসে ভর করিয়া ঐ দিন সন্ধ্যায়ই কিছু লোকজনসহ ভজনপুর গিয়া পৌঁছিলেন। এপ্রিলের ২০ তারিখের ভোর হইতে না হইতে তাহারা ভজনপুরে ঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু করিয়া দিলেন। আমি তাহাদেরকে যথারীতি উপদেশ দিয়া নানা জরুরী কাজে ও বিচ্ছিন্ন লোকদেরকে জড় করার উদ্দেশ্যে পিছনে গেলাম। এই দিকে দুশমনরাও অতি তাড়াতাড়ি জগদল এবং ওমরখানায় তাহাদের শক্ত ঘাঁটি গাড়িয়া বসিল। ওমরখানা পর্যন্তই শেষ ঘাঁটি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।

 তারপর ঐ মাসের অর্থাৎ এপ্রিল মাসের এক শুভক্ষণে জানিতে পারিলাম যে স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হইয়াছে। এমতাবস্থায় মে মাসের ৮ তারিখ আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রধান তদানীন্তন কর্নেল এম এ জি ওসমানী আমাদেরকে ভারতের কদমতলায় ডাকিয়া পাঠান। সেখানে এক জরুরী সভা হইল। তাহাতে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং কয়েকজন ভারতীয় অফিসার। মুক্তিবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে যুদ্ধের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করিলেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনা অনুসারে আমাদিগকে নির্দেশ দান করিলেন। আমরাও আমাদের অভাব অভিযোগ জ্ঞাপন করিলাম, তিনি যথাসাধ্য পূরণ করিবার আশ্বাস দিলেন। উক্ত সভায় তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল হক সাহেবকে আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার অর্পণ করিলেন। তরপর ঐ দিনই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ভজনপুর ঘাঁটিতে আগমন করিলেন। তাহার দর্শন লাভে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমরা আরো সতেজ হইলাম, তার উপদেশের মাধ্যমে পথের দিশা পাইলাম। অধিকন্তু তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল সাহেবকে আমাদের অধিনায়ক রুপে নিয়োগ করায় আমরা আরো উৎসাহিত হইলাম। এর কিছুদিন পর প্রধান সেনাপতি আবার ভজনপুর আসিলেন, সঙ্গে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। ইহাতে জোয়ানরা খুব খুশী হইল, তাহাদের মনোবল দৃঢ়তর হইল। ততক্ষণে ভারত হইতে অপ্রচুর হইলেও বিভিন্ন রকম সাহায্য আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। অতএব মুক্তি সংগ্রামীদের মনোবল ঊর্ধ্বমুখী হইয়া উঠিল ৷

 ৯ই মে ক্যাপ্টেন নজরুল আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করিলেন এবং আমি তাহার সহকারী হিসাবে কাজ করিতে লাগিলাম। এ সময় দুশমনরা ওমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করিয়া ফেলিয়াছে। তাই আমরা আমাদের মূল ঘাঁটি ভজনপুরের ৩/৪ মাইল আগে মাগুরমারী ও ময়নাগুড়ি নামক স্থানে দুইটি পোষ্ট খুলিয়া দুইটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল পাঠানোর ব্যবস্থা করিলাম। ২৬শে এপ্রিল হাবিরদার দেওয়ানের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ছোট দল প্রথম ওমরখানার কাছে মাগুরমারীতে পাঠানো হইয়াছিল। তাহারা দুশমনের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিত এবং পিছনে আমাদেরকে খবর দিত। ৩০শে এপ্রিল শত্রুদের হঠাৎ আক্রমণে এই ছোট দলের ২ জন শহীদ এবং অন্য ২ জন গুরুতরভাবে আহত হইয়া হাসপাতালে নীত হয়। যাহা হউক, মাগুরমারীতে ক্রমান্বয়ে লোকসংখ্যা বাড়াইয়া শেষ পর্যন্ত দেড় কোম্পানীর মত করা হয়। এর এক কোম্পানী নতুন সি কোম্পানী নাম নিয়া নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীর নেতৃত্বে দুশমনের ওমরখানা ঘাঁটির সন্নিকটে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। ২রা মে হইতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ তাহারা সেখানে অবস্থান করে এবং দুশমনদের শতাধিক সৈন্য ও চার পাঁচখানা গাড়ী ধ্বংস করাসহ অশেষ ক্ষতি সাধন করিয়া তাহাদিগকে নির্বাক নিবীর্য করিয়া রাখে। আমার হিসাব মতে সিপাহী আবুল হোসেন একাই সত্তর জনের মত শত্রুসোন খতম করিয়াছে। তবে এই দলকে বহু কষ্টের মধ্যে দীর্ঘ দুই মাস কাটাইতে হইয়াছে, কেননা উন্মুক্ত আর নীচু জায়গায় পজিশন থাকা বিধায় দিনের বেলা এরা সামান্য নড়াচড়া পর্যন্ত করিতে পারিত না- শুধু রাত্রেই এদের খাওয়ার সুযোগ ঘটিত। আমি মাঝে মাঝে এই কোম্পানীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতাম। কোন কোন সময় আমি দেখিয়াছি বৃষ্টির মত গোলাগুলির মধ্যেও হাজী মুরাদ আলী তাহার লোজনের তদারকি করিয়া ফিরিতেছেন। আমার মতে হাজী মুরাদ আলীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই এই ক্ষুদ্র দলটি নির্ভীক সৈনিকের ভূমিকা পালন করিতে অনুপ্রাণিত হইয়াছিল।

দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের ঘটনাবলী

সাক্ষাৎকারঃ নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ আনসার আলী

১৯-১১-১৯৭৩

 ২৫শে মার্চ থেকেই দিনাজপুর শহরে ছাত্র- জনতার মিছিল বের হতে শুরু করে। ২৬শে মার্চ সকালেই আমরা সামরিক শাসন জারী করার কথা শুনি। এটা শুনে আমাদের সাথের পশ্চিম পাকিস্তানীরা আনন্দিত হয়েছিল এবং বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলছিল। ২৬শে মার্চ বেলা দশটার দিকে আমি ৩০/৪০ জন লোক নিয়ে নিউ টাউনে ডিউটি করতে যাই।

 ২৭শে মার্চ ১/২ টার দিকে বিহারীরা প্রায় ১২/১৩ জন বাঙ্গালীকে হত্যা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

 ২৭শে মার্চ বেলা ১২/১ টার সময় তিনজন মেজর, কর্নের এবং দুই/তিনজন ক্যাপ্টেনসহ পশ্চিম পাকিস্তানীরা এক বৈঠক করে। বেলা সাড়ে তিনটার সময় বৈঠক শেষ হয়। শেষ হবার পর ঢাকার সাথে যোগাযোগকারী সিগন্যাল সেটের কমাণ্ডারকে জীপে উঠিয়ে নেয় এবং তার বাসার দিকে রওয়ানা হয়। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ১৫/২০ জন বাঙ্গালী ছিল। কোয়ার্টার মাষ্টার আবু সাইদ খোন্দকার, হাবিলদার ভুলু এবং প্লাটুন হাবিলদার নাজিমও ছিল। বাকি সবাইকে ডিউটিতে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা এক জায়গায় একত্রিত না থাকে। জীপটা যখন অফিস থেকে রওয়ানা হয় সেই সময় আমাদের ৬- পাউণ্ডার প্লাটুন হাবিলদার নাজিম উদ্দিন ঐ জীপে লক্ষ্য করে গোলা বর্ষণ করে। কিন্তু গুলীটা জীপে না লেগে অফিসের কর্নারে লেগে যায়। তখন চারিদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যা করা হয়। জনগণ হেডকোয়র্টারে এসে অস্ত্রশসস্ত্র নিয়ে যায়। সেক্টর হেডকোয়ার্টারের একটু দূরে সার্কিট হাউসে ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের প্রায় ১৫০ জন সৈন্য রিজার্ভ ছিল।

 কাঞ্চন নদীর ওপারে গিয়ে আমরা অবস্থান নিতে শুরু করি। অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নদীর ওপারে গিয়ে আমরা রিজার্ভে ১৫০ জনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই। এই সংঘর্ষ দুই তিন দিন চলেছিল।

 এপ্রিলের ৩ তারিখে ২/৩টা জীপে করে সার্কিট হাউস থেকে তারা পলায়ন করে দক্ষিণ দিকে পার্বতীপুর যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। মোহনপুরের আগে যাওয়ার পর সুবেদার শুকুর সাহেবের কোম্পানী তাদেরকে বাধা দেয়। তারা আবার দিনাজপুরে ফিরে আসে, ফিরে আসার পর শালবাগানে তাদের অনেককেই জনসাধারণ এবং বাঙ্গালী ইপিআর মেরে ফেলে। কর্নেল তারেক রসুল জীপ নিয়ে পার্বতীপুর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।  ২৭শে মার্চ দিনাজপুরের সীমান্ত এলাকায় সমস্ত বিওপিতে সংবাদ পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে যত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর ছিল সবাইকে হত্যা করা হয়।

 এপ্রিল মাসে দিনাজপুর টাউন শত্রুমুক্ত হবার পর পুলিশকে দিনাজপুর শহর হস্তান্তর করে আমাদের কিছু লোক পার্বতীপুরের দিকে এবং কিছু লোক সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হয়ে যায়।

 এপ্রিল মাসের ১২/১৩ তারিখে সৈয়দপুরের ছুি দূরে পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পশ্চাদপসরণ করি।

 পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৫ এপ্রিল তারিখে দিনাজপুর শহর পুনরায় দখল করে নেয়।

দিনাজপুর জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আরব আলী

......১৯৭২

 ২৫শে মার্চের পাকবাহিনীর পৈশাচিক ঘটনার কথা আমরা ২৬শে মার্চ সকাল বেলা জানতে পারি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এই দিন থেকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনসাধারণ খানসেনা আসার সম্ভাব্য সকল রাস্তায় বেরিকেড রচনা করে। এই সময় জনসাধারণ ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং জনসাধারণের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে দেখা যায়। চারিদিকে একটা মার- মার, কাট- কাট অবস্থার সৃষ্টি হয়।

 ২৭শে মার্চ পাঞ্জাবী বাহিনী দিনাজপুর কুটিবাড়ী ইপিআর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে এবং সমস্ত ইপিআরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। এই সময় ইপিআররা পাঞ্জাবীদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষ মর্টার ও কামান মারতে থাকে। আমরা বর্ডার থেকে মুহুর্মুহু কামানের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। এই সময় দেখতে পাই হাজর হাজার নিরীহ শহরবাসী ভারতের দিকে রওনা দিচ্ছে। এই সময় আমি আমার উপরস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে পাক পাক হিলি বর্ডারে যোগাযোগ করি।

 ২৯শে মার্চ ভোরে ভাইগর বিওপিতে অবস্থানরত একজন পাঞ্জাবী ইপিআর হাবিলদার ও একজন নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই দুইজনকে খতম করে আমি রুধরাণী বিওপিতে চলে যাই। সেখানে অবস্থানরত একজন পাঞ্জাবী হাবিলদার ও একজন সিপাইকে জিন্দা বন্দী করি। এরপর আমি রাণীনগর প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। এখানে একজন পাঞ্জাবী ল্যান্স নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং একজন সিপাইকে জিন্দা বন্দী করে তাকে পাবলিকের হাতে তুলে দিই। পরে জনসাধারণ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।

 ফুলবাড়ী সংঘর্ষে ঃ ২৯শে মার্চ উপরোক্ত ঘটনার পর আমি আমার সমস্ত জওয়ানদেরকে একত্রিত করি। ফুলবাড়ি আসার দুই মাইল দূরে থাকতে খবর পাই যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা দিনাজপুর থেকে ইপিআর- এর হাতে মার খেয়ে পার্বতীপুর যাবার জন্য ফুলবাড়ীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই কথা শোনার পরপরই ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। খবর নিয়ে জানতে পারি যে ফুলবাড়ী থেকে ইপিআররা পাকবাহিনীর গতিরোধ করেছে। এই খবর পাবার পর খুব তাড়াতাড়ি আমি আমার জওয়ানদেরকে নিয়ে ফুলবাড়ী যাবার পথে হাসপাতালের কাছে রোড ব্লক করলাম। আমরা পজিশন নেবার পরপরই পাঞ্জাবীরা অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটতে আরম্ভ করে এবং কিছু সৈন্য গাড়ী ফেলে কোনাকুনি মাঠের মধ্য দিয়ে পার্বতীপুরের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তাদের পিছু নেই এবং আক্রমণ চালাই। এই যুদ্ধে ফুলবাড়ী বাজারের মোড়ে ৭ জন খান সেনার লাশ পাওয়া যায়। একজন সিগন্যাল ম্যানকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং সঙ্গে ২ টা চাইনিজ মেশিনগান ও ৫টা রাইফেল আমরা হস্তগত করি। এই সময় ১ টা জীপ ও ২ টা ডজ গাড়ী আমাদের হাতে আসে।

 পার্বতীপুরে বিহারীদের লুটপাট ও সংঘর্ষঃ অতঃপর এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে আমরা জানতে পারি যে পার্বতীপুরের বিহারীরা নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে ব্যাপক হারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে। তারা নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মভাবে হত্যা করছে। এই খবর পাবার পর আমি আমার প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুরের নিকটে গ্রামগুলির নিরাপত্তা বিধানের জন্য যাই। আমরা যাবার পর প্রায়ই বিহারীরা আমাদের উপরে গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে এবং সুযোগ বুঝে লুটপাট চালাতে থাকে।

 ১০ই এপ্রিল স্থানীয় হাজার হাজার লোক এসে আমকে জানায় যে বিহারীরা অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছেছে। কাজেই তাদের যে কোন প্রকারে শায়েস্তা করতে হবে। তখন আমি হাজর হাজার জনতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমার বাহিনী নিয়ে পার্বতীপুরের বিহারীদের উপার ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রথম দিকে বিহারীরা আমাদের প্রতি গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে থাকে। বিহারীরা এই সময় লাইন ধরে য়ৈদপুরের দিকে যেতে থাকে। হিংস্র জনতা পলায়নরত বিহারীদের উপর চড়াও হয় এবং যাকে যাকে পায় পিটিয়ে মেরে ফেলে। ঐদিন আনুমানিক প্রায় ৪০০/৫০০ লোক মারা যায়। এই সময় পার্বতীপুর পুরাপুরি আমদের আয়ত্তে এসে যায়।

 ১১ই এপ্রিল সৈয়দপুর থেকে ৩ টনী ৩টা গাড়ী, ২টা জীপ বোঝাই খানসেনা পার্বতীপুর আসে এবং আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলা বর্ষণ করতে থাকে ঐদিন সন্ধ্যার পর উভয় পক্ষ থেকে গোলাগুলি বন্ধ করা হয়। এই সময় আমাদের কাছে গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। সারা রাত্রি আমরা বহু জায়গায় যোগাযোগ করেও কোন গোলাবারুদ জোগাড় করতে পারিনি।

 ১২ই এপ্রিল সকাল ৮টার সময় সেনারা পুনরায় আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই সময় তারা মর্টার থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর আমরা আর টিকতে পারি না, বাধ্য হয়ে পিছু হটতে থাকি। এখানে আমার একজন সিপাই মারা পড়ে এবং খোলাহাটিতে ৩নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের কাছে যাই এবং তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। কিন্তু সে জানায় যে, তার কাছে তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নাই। তখন বাধ্য হয়ে আমরা ফুলবাড়ী হেডকোয়ার্টারে চলে যাই। অতপরঃ আমি ফুলবাড়ী ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওখান থেকে আরও জওয়ান ও আনসার নিয়ে আমি ১৫ই এপ্রিল পুনরায় পার্বতীপুরের দিকে যাত্রা করি। এবং আমরা পার্বতীপুরের আগের রেল স্টেশন ভাবানীপুরের হাওয়া গ্রামে ডিফেন্স করি।

 ১৬ই এপ্রিল খান সেনারা পার্বতীপুর থেকে ১টা ট্যাঙ্কসহ ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে সকাল ১১ টার দিকে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ১ ঘণ্টা প্রবল যুদ্ধ চলার পর খান বাহিনীর ট্যাঙ্কের গোলার মুখে পরপর আমার ৩ জন আনসারসহ ৫ জন সিপাই মারা যায়। এই সময় আমার সিপাই মোঃ হোসেনের মাথার উপর ১টা মর্টারের গুলি এসে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ীর দিকে যাত্রা করি এবং এই সময় আমাদের পিছু পিছু খানসেনারা ফুলবাড়ীর দিকে যাত্রা করে।

 ঐ দিনই বিকাল প্রায় ৫টার দিকে খানসেনারা ফুলবাড়ীতে আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এই সময় তারা ট্যাঙ্ক, মর্টার, কামান, মেশিনগান ব্যবহার করে। রাত ৮টা পর্যন্ত খানসেনাদের সঙ্গে চলে যাই। এই সময়ও আমাদের মনোবল অটুট থাকে।

 ১৮ই এপ্রিল খানসেনারা হিলি আক্রমণ করে। এখানে ভীষণ যুদ্ধের পর আমরা ভারতের দিকে চলে

যাই।

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার বাসারতউল্লাহ

১৬-১১-১৯৭৪

 ২৫শে মার্চ আমি দিনাজপুর ৪নং সেক্টর কুটিবাড়ীতে ৮নং উইং- এর 'সি' কোম্পানীতে ছিলাম। আমরা তখন উইং হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। ৮নং শাখার কমাণ্ডার ছিল মেরজ আমীন তারিক (পাঞ্জাবী)। সহ উইং কমাণ্ডার ছিল বাঙ্গালী নজরুল ইসলাম এবং অপরজন পাঞ্জাবী ছিল। উইং হেডকোয়ার্টারে ‘সি' কোম্পানী ছিল। কামণ্ডার ছিল আতাউল হক। 'বি' কোম্পানী হিলি এলাকাতে ছিল, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার আবদুস শুকুর। ‘এ’ কোম্পানী ছিল চাপাসারে, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার আখতারুজ্জামান। 'ই' কোম্পানী ছিল বিরলে, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার বাদশা আহমদ (বিহারী)।

 দিনাজপুর সার্কিট হাউসে বেলুচ রেজিমেণ্টের এক প্লাটুনের কিছু বেশী পুরা আধুনিক অস্ত্রে জানুয়ারী থেকে অবস্থান করছিল। পাক আর্মির ৩ জন অয়ারলেস সেট নিয়ে উইং হেডকোয়ার্টারের মধ্যে থাকতো। ৩ জন আর্মির মধ্যে একজন বাঙ্গালী সিগন্যালম্যান ছিল। আমি ওখানে গেলে তারা কথাবার্তা বন্ধ করে দিত। বাঙ্গালী অপারেটরটি অপর দুজন পাঞ্জাবীকে ২৮তারিখ দুপুর তোমরা অগ্রসর হও আমি যাচ্ছি', এই বলে আমাদের সিগনাল সেণ্টারে আসে এবং বলে 'যদি পাকিস্তানীদের আক্রমণ করতে হয় তবে এখনই কারো, পাকসেনারা কিছুক্ষণের মধ্যে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে।' আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমণের।

 হাবিলদার ভুলু মিয়া, নায়েক সুবেদার মোসলেম, সুবেদার মোমিনুল হক এদের নেতৃত্বে ২৮শে মার্চ রবিবার প্রায় ২টা ৪৫মিনিটে উইং- এর সকল অবাঙ্গালী ইপিআরদের উপর আক্রমণ করি। আমরা উইং এবং সেক্টর হেডকোয়ার্টার দখল করে নিই সন্ধ্যার মধ্যে। সকল অস্ত্র আমরা আমাদের আওতায় নিয়ে আসলাম। ঐ তারিখেই পাকসেনারা আমাদেরকে আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

 ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কুটিবাড়ীতেই (উইং হেডকোয়ার্টার) ছিলাম। সীমান্ত এলাকার কোম্পানীগুলো কুটিবাড়ীতে চলে আসে। ৩১শে মার্চ বিকাল থেকে হাবিলদার নাজিমউদ্দিন ৬ পাউণ্ডার ছুড়তে থাকে পাক ঘাঁটির উপর। একই সাথে আমরা ব্যপকভাবে আক্রমণ করি। ঐ তারিখ রাতেই পাকসেনারা দিনাজপুর থেকে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পার্বতীপুরের দিকে যায়। পথে বহু পাকসেনা জনতার হাতে নিহত হয়।

 নায়েক সুবেদার কাউসারের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন রংপুরের বদরগঞ্জ পৌঁছায়। সৈয়দপুর থেকে পাকসেনারা যাতে দিনাজপুরে না আসতে পারে সেজন্য বদরগঞ্জে ডিফেন্স নিই। আমাদের সামনে নদীর পাড়ে এক প্লাটুন মত বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অংশ ছিল।

 অনুমান ৮/৯ ই এপ্রিল বদরগঞ্জের পতন ঘটে পাক বাহিনীর হাতে। আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ীতে আসলাম। ওখানে সুবেদার শুকুর সাহেব তার ফোর্স নিয়ে আগে থেকেই ছিল। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কিছু সৈন্যও ছিল। পরদিন আমরা দিনাজপুর চলে আসলাম। এরপর কাউঘর মোড়ে যাই। হাবিলদার আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে ঐ মোড়ে ডিফেন্স নিই। নায়েক সুবেদার মোমিনুল হক সাপোর্ট প্লাটুন নিয়ে আমাদের পিছনে থাকলো। ফুলবাড়ী- দিনাজপুর সড়কে আমরা ডিফেন্স নিলাম। এখান থেকে শিয়ালগাজী মাজারের পার্শ্বে নায়েক সুবেদার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিই।

 ১৩ই এপ্রিল সাড়ে ১২ টার সময় রাজবাড়ীর দিক থেকে শহরের পূর্বপাশ দিয়ে সৈয়দপুর-দিনাজপুর রাস্তার বাম দিক থেকে পাকবাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক নিয়ে। পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে এখানকার বিভিন্ন আমাদের লোকেরা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটতে থাকে। সন্ধ্যার পূর্বেই পাকসেনা দিনাজপুর শহর দখল করে নেয়। শহর পতনের পর আমরা নদীর অপর পাড়ে আশ্রয় নিই। আমরা বিরল সীমান্তের দিকে অগ্রসর হই। বিরলে (ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৬ মাইল ভিতরে) ডিফেন্স নিই। বিরলে ২০০ মত ইপিআর আসে।

 ১৭/১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী আমাদের বিরল ডিফেন্সের উপর আক্রমণ চালায়। মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামীর লোকেরা আমাদের অবস্থানগুলো পাকবাহিনীর কাছে প্রকাশ করে দেয়। এই যুদ্ধে বিরলের পতন ঘটে। এখান থেকে কিশোরীগঞ্জ এলাকাতে ডিফেন্স নিই।

 ২০/২১শে এপ্রিল পাকসেনা আমাদের কিশোরীগঞ্জ ডিফেন্স আক্রমণ করে। কিশোরীগঞ্জের পতন ঘটলো পাকবাহিনীর হাতে। আমরা আরও পিছু হটলাম। একদম সীমান্ত বরাবর আমরা ডিফেন্স লাগালাম। পাকসেনারা কিশোরীগঞ্জ থেকে মাইকযোগে আমাদের গালাগালি করতে থাকে। ৮নং শাখার সহকারী উইং কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন চিমা, নায়েক সুবেদার নিয়ামতউল্লা আমাদের গালাগালি করতে থাকে। পাকসেনারা প্রতিটি জায়গা দখলের পর আগুন লাগিয়ে সমগ্র এলাকা ধ্বংস করে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তারা হাজার হাজার মণ চাউল পুড়িয়ে দেয়।

 অনুমান ২৪শে এপ্রিল ফ্লাগ মিটিং হয়। সেখানে পাকসেনারা ইপিআরদের হ্যা ওভার করার জন্য জানায়। ২৫/২৬শে এপ্রিল রাধিকাপুরে এবং আমাদের অবস্থানের উপর বিমান হামলা চালায়। বিএসএফ অবস্থানের উপরও বোমা ফেলে। আমরা ভারতে আশ্রয় নিলাম এক আমবাগানে। আমাদের সাথে প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। ডামিলগাঁও যাই, সেখানে সকল অস্ত্র জমা দিই। ট্রেনিং ক্যাম্প খুলে দেওয়া শুরু হয়। দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে থাকি।

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আহম্মদ হোসেন

১৮-১১-১৯৭৪

 আমি একাত্তরের মার্চে ৯নং উইং হেডকোয়ার্টার ঠাকুরগাঁতে ছিলাম। উইং- এর অধীনে ৫টি কোম্পানী ও একটি সাপোর্ট ছিল। হেডকোয়ার্টারে ছিল 'ডি' কোম্পানী, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার এম এ হাফিজ। রুহিয়াতে ছিল ‘এ’ কোম্পানী, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার কালা খান (পাঞ্জাবী)। 'বি' কোম্পানী ছিল চিলাহাটিতে, কমাণ্ডার ছিল একজন বিহারী। 'সি' কোম্পানী ছিল তেতুঁলিয়ায়, কমাণ্ডার ছিল (ভারপ্রাপ্ত) পাঞ্জাবী নায়েক সুবেদার মীর্জা খান। 'ই' কোম্পানী ছিল পঞ্চগড়ে, কমাণ্ডার ছিল নায়েক সুবেদর আবদুল খালেক। উইং কমাণ্ডার ছিল মেজর মোহাম্মদ হোসেন। সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড ছিল ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। নির্বাচনের পর থেকেই আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলাপ- আলোচনা করতাম।

 ২৫শে মার্চের রাতে ‘ডি’ কোম্পানী উইং হেডকোয়ার্টারে ছিল। আমাদের উইং হেডকোয়ার্টারে ম্যাগাজিনের সঙ্গে মুজাহিদের জন্য একটি ম্যাগাজিন ছিল। ৫ জন পাকসেনারা দায়িত্বে থাকতো। পাক বিমান বাহিনীর চারজন লোকও থাকতো। যারা সকল বিমানের গতিবিধি লক্ষ্য করতো এবং ঢাকা সেনানিবাসে রিপোর্ট করতো।

 ২৬শে মার্চ আমরা ঢাকায় পার্ক আক্রমণের খবর পেলাম।

 ৭ই মার্চের পর থেকে আমাদের আই- এস- ডিউটি বেড়ে যায়। তখন থেকেই অস্ত্র আমাদের সঙ্গে থাকতো। ২৩শে মার্চ থেকেই কয়েকবার আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়ে নেবার চেষ্টা হয়। কিন্তু আমরা অস্ত্র কোতে জমা দিইনি।

 আগে থেকেই জেনেছিলাম ২৮শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তাই আমরা সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে ২৮শে মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় উইং হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত সকল অবাঙ্গালী ইপিআর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আই- এস ডিউটির জন্য আগে থেকেই উইং- এর চারপাশে বাঙ্কার তৈরী ছিল।

 সুবেদার হাফিজ প্রথম উইং কমাণ্ডার ও সহকারী উইং কমাণ্ডারের গার্ডের উপর গুলি ছোড়েন। ২৫শে মার্চ ১০টার কিছু আগে আমরা ক'জন যেমন- আমি, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান, বজল আহম্মদ চৌধুরী, সুবেদার এম এ হাফিজ এবং আতাউল হক মিলে সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন সাহেবের বাসাতে গিয়েছিলাম আলাপ- আলোচনার জন্য। তখনই হাবিলদার আবু তালেব আমাদের কাছে এসে খবর দেয়, সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিনকে বন্দী করতে আসছে পাকসেনারা ৪ জন। আমরা তখনই বেরিয়ে আসি এবং যার যার অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সুবেদার হাফিজ তখনই চাইনিজ মেশিনগান নিয়ে মেজর সাহেবের বাংলোতে যান এবং গুলি ছোড়েন। তারপর সারারাত ধরে উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। কোতের দায়িত্বে ছিল সব অবাঙ্গালী। ২৯শে মার্চ সুবেদার আতাউল হক ভুল বুঝাবুঝির জন্য বাঙ্গালীদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপঃ

 ২৯শে মার্চ ভোরবেলা সুবেদার আতাউল হক ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন কি অবস্থা, এমন সময় সিদ্দিক নামে এক সিপাই বাঙ্কার থেকে উঠে এসে সুবেদার আতাউল হক সাহেবের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সিপাই সিদ্দিক ভেবেছিল সুবেদার হয়তো কিছু বলবেন না। সুবেদার আতাউল হক সম্পূর্ণ নতুন, সবাইকে চিনতেন না ফলে সিদ্দিককে বিহারী মনে করেন এবং উর্দুতে 'তুমি এখনও বেঁচে আছ' বলেই স্টেন তোলে। সিদ্দিকও সাথে সাথে রাইফেল তুলে গুলি চালায়। সুবেদার আতাউল হক ওই গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।

 অবাঙ্গালী ইপিআর থাকতো প্রধানতঃ তিনতলার উপর এবং কোয়ার্টার গার্ডে। এর ফলে তাদেরকে আয়ত্তে আনা কঠিন ছিল। ১লা এপ্রিল বেলা ৪টার মধ্যে আমরা উইং সম্পূর্ণ দখল করতে সক্ষম হই। অবাঙ্গালী ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম এবং ক্যাপ্টেন নজির আহমদ পালাতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েন এবং সবাই মৃত্যুবরণ করেন।

 ২রা এপ্রিলের মধ্যে সীমান্তের সমস্ত ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টারে চলে আসে সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন সাহেবের নির্দেশক্রমে। আমাদের আনসার- মুজাহিদও এসে জমায়েত হয়।

 সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে আমরা একটি কোম্পানী সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হই ৩রা এপ্রিল। ৪ঠা এপ্রিল ভূষিরবন্দরে পুলের পাশে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করি।

 ২৯শে মার্চ আমরা খবর পেলাম ৮/১০ টি ট্রাক করে পাকসেনা ঠাকুরগাঁ- এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা তখনই যার যার মত পজিশন নিয়ে তৈরী থাকলাম। দেখলাম সত্যই তারা আসছে। কিছুক্ষণ পর সকাল ৯টার দিকে জানলাম তারা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক। ক্যাপ্টেন আশরাফ সুবেদার মেজর খবর দেন আমরা শিবগঞ্জে বিমানবন্দরে আইএস ডিউটি করতে যাচ্ছি। কাজিমুদ্দিনের সন্দেহ হয়, তাই পুনরায় একটি সিপাইকে মোটর সাইকেল যোগে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বলেন। ক্যাপ্টেন আশরাফ নিজের সকল জোয়নকে দেখিয়ে বলেন আমরা সবাই বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক। সিপাই ফিরে এসে সুবেদার মেজরকে রিপোর্ট করলে ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে শিবগঞ্জে চলে যান। সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন অনেক অনুরোধ করেন তাদের সাথে কাজে যোগ দেবার জন্য। কিন্তু ক্যাপ্টেন আশরাফ বিশ্বাস করতে পারেননি সব ঘটনা। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে শিবগঞ্জে পৌঁছালে তাঁর বেঙ্গল- এর ৩/৪ জন জোয়ানের দেখা পান। তারা উপরে পাকবাহিনীর আক্রমণের ঘটনার কথা জানায়। এই ৪ জন বলে, আমরা ২০/২৫ জন ছিলাম। কিন্তু দশমাইল নামক স্থানে পাঞ্জাবীরা আমাদের ঘেরাও করে। আমরা ক'জন পালাতে পেরেছি; অবশিষ্টদের খবর জানি না।' ক্যাপ্টেন আশরাফ তখন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বীরগঞ্জে থেকে যান। আমরা সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে বীরগঞ্জে উপস্থিত হলে ক্যাপ্টেন আশরাফের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সুবেদার হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন আশরাফ আলোচনা করেন। সৈয়দপুরের পথে ভূষিরবন্দর পুলের পাশে পৌঁছাই। পুলের বাম পাশে সৈয়দপুর- দিনাজপুর রাস্তায় আমরা এবং ডান পাশে ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করলেন।

 ৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী ১১টি গাড়ী নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৩য় বেঙ্গল প্রথমে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়ে। পাকসেনারা সামনে অগ্রসর না হয়ে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়।

 ৫ই এপ্রিল তারিখে আমরা আরও ৬ মাইল সামনে চম্পাতলী নামক স্থানে যাই এবং রাতের মধ্যে ডিফেন্স নিই।

 ৬ই এপ্রিল পাকসেনারা সেনানিবাস থেকে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমাদের রাইফেলের আয়ত্তের মধ্যে আসলে আরম্ভ করি। দুই- তিন ঘণ্টা উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলে। পাকসেনারা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সেনানিবাসে চলে যায়।

 ঐ তারিখেই বেলা আড়াইটা- তিনটার দিকে পাকসেনারা একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তখন সৈয়দপুর থেকে দুই মাইলের ভিতর। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকবাহিনীর আক্রমণে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পিছু হটতে থাকি। বামদিকে নীলফামারীর দিকে পিছু হটি। ৩য় বেঙ্গল এখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

 পাকসেনারা অগ্রসর হতে থাকে। বাড়ীঘরে সব আগুন লাগাতে থাকে। সুবেদার হাফিজ আমাদের নিয়ে রাত ১১টায় দারয়ানী স্টেশনের পশ্চিম পাশে এক গ্রামে আকবর আলী চেয়ারম্যানের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। আমরা তখন ৭০/৮০ জন ছিলাম। সেই রাতে আকবর আলী সকলের খাবারের ব্যবস্থা করেন। রাতে ওখানে থাকি।

 ৭ই এপ্রিল আমরা খানসামা নামক স্থানে গেলাম। সেখানে থেকে খবর পেলাম নীলফামারীর ৮নং শাখার যে কোম্পানী ছিল তারা পাকবাহিনী কবজায় চলে যায়। খানসামাতে নদীর পাড়ে আমাদের ৯নং উইং- এর একটি প্লাটুন আগে থেকেই ডিফেন্সে ছিল। আমরা এই প্লাটুনের সাথে একত্রিত হই। প্লাটুনকে রেখে আমরা বীরগঞ্জে চলে আসি। সেখানে ৮ নং শাখার সুবেদার মেজর রব সাহেবের নির্দেশক্রমে খানসামাতে আমরা ডিফেন্স নিই এবং খানসামাতে অবস্থানরত দশমাইল স্ট্রং ডিফেন্স পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

 ১০ই এপ্রিল পাকসেনারা দশ মাইল ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করে। দশ মাইলে আমাদের বাহিনী টিকতে ব্যর্থ হয। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পাকসেনারা ভাতগাঁও নামক স্থানে আস। ভাতগাঁওতে আমাদের ডিফেন্সের পতন ঘটে।

 ১০ই এপ্রিল রাতে আমরা খানসামা ছেড়ে দেবীগঞ্জ পৌঁছাই। ১১ই এপ্রিল সেখানে আমাদের উইং- এর একটি কোম্পানী ও একটি প্লাটুন ছিল। আমরা দেবীগঞ্জ পথের পাশে ডিফেন্স নিলাম। ঠাকুরগাঁও থেকে খবর পেয়ে আমরা ১৩ই এপ্রিল ঠাকুরগাঁ পৌঁছাই। সেখান থেকে আমরা বীরগঞ্জ পৌঁছাই।

১৩ই এপ্রিল তারিখের খানসামাতে পাকবাহিনীর সামনেই আমরা প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করি। রাত ৩টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ফায়ারিং চলে। সকাল ৮টায় আমরা পাকবাহিনীর মেশিনগানের অবস্থান জানতে পারি। আমি ২” মর্টার দিয়ে মেশিনগানের উপর গোলা ছুড়তে থাকি। পাকবাহিনী বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালাতে থাকে। বহু পাকসেনা এখানে নিহত হয়। এখানে আমরা পাকবাহিনীর ঘাঁটি দখল করে নিই। দুই ট্রাকভর্তি পাকবাহিনীর মালামাল উদ্ধার করি।  ১৪ই এপ্রিল আমরা এই এলাকা দখল করে অসতর্ক অবস্থায় বসেছিলাম। সেই সময় হঠাৎ করে পাকসেনারা নীলফামারী থেকে এসে আমাদের উপর আক্রমণ করে বসে। আমরা হঠাৎ আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। সবাই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পিছু হটতে থাকি এবং ১৬ই এপ্রিল পঞ্চগড় পৌঁছাই। তখন আমরা ৫০/৬০ জনের মত ছিলাম। পঞ্চগড়ে ঠাকুরগাঁ থেকে সুবেদার মেজর কাজিমদ্দিন সমস্ত গোলাগুলি, রেশন এবং সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছিল। ১৭ই এপ্রিল আমরা এখানে ডিফেন্স নিই। তখন আমাদের কাছে একটি মেশিনগান ছিল। ১৯শে এপ্রিল পাকসেনারা আমাদের উপর আক্রমণ করে। ৯টায় এখানে ২/৩ ঘণ্টা যুদ্ধ হবার পর আমরা পিছু হটে ভজনপুর নামক স্থানে চলে যাই। এখানে নদীর পাড়ে ২০শে এপ্রিল সকালে ডিফেন্স নিই। অন্যান্য স্থান থেকে টহল দিয়ে বেড়াতো। আমরা ভজনপুর থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পাকবাহিনীর উপর হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ চালাতে থাকি। ৮ নং শাখার পতন ঘটলে ক্যাপ্টেন নজরুল আমাদের এখানে আসেন। তিনি দায়িত্ব নেন আমাদের। কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এবং এম এ জি ওসমানী আসেন এবং ভাষণ দেন। আমরা পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পাকসেনাদেরকে খতম করতে এগিয়ে যাই। ভজনপুর সব সময় মুক্ত ছিল। আমরা বাংলাদেশের মাটিতে থেকেই দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি।

সশস্ত্র প্রতিরোধে ঠাকুরগাঁ- দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ নায়েব সুবেদার আবু তালেব শিকদার

১৬-৭-১৯৭৪

 ইপিআর- এর ৯নং শাখা ঠাকুরগাঁতে ছিল। উইং কমাণ্ডার ছিলেন মেজর মোহাম্মদ হোসেন (পশ্চিম পাকিস্তানী), সহকারী উইং কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন ক্যাপ্টেন নজীর আহমদ (বাঙ্গালী)।

 ২৬শে মার্চ সকালবেলা সামরিক বিধি জারী হওয়ার পর প্রায় ১০/১২ হাজার লোক ঠাকুরগাঁ ইপিআর হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করার চেষ্টা করে। বাঙ্গালী ইপিআররা জনসাধারণকে সেখান থেকে চলে যেতে বলাতে তারা চলে যায়। ঠাকুরগাঁ শহরে কারফিউ জারী করা হয়। ২৭শে মার্চ একজন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর ঠাকুরগাঁ শহরে একজন রিকশাওয়ালাকে গুলি করে তহ্যা করে। ২৮শে মার্চ একজন দোকানদারের ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

 ২৮শে মার্চ বিকেল ৬টার সময় আমরা গোপন সূত্রে জানতে পারলাম যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের বাঙ্গালী জেসিওদের গেফতার করবে রাত ১২ ঘটিকার সময়। ২৮শে মার্চ রাত আটটায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে আমরা খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য। রাত ৯টার সময় সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরদের অস্ত্র জমা দেবার জন্য মেজর মোহাম্মদ হোসেন নির্দেশ দেন। আমরা রাত ১০-৩০ মিনিটে বাঙ্গালী সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন এবং সুবেদার হাফিজ ও অন্যান্য বাঙ্গালী জেসিওদের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে খতম করা হয়। ওদের প্রায় ৭০/৮০ জন ছিল। বেলুচ রেজিমেণ্টের একজন সুবেদার এবং কিছু সৈন্যও ছিল। এয়ার ফোর্সের কয়েকজন সৈনিক ছিল। রাত ১১টার সময় আমরা বাঙ্গালী ইপিআর কোতে ও ম্যাগাজিন ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিই।

 ২৯শে মার্চ বেলা তিনটার সময় মেজর মোহাম্মদ হোসেনকে তার বাসভবনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবার পরিজনসহ ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ঐ দিন রাত্রে পালিয়ে সৈয়দপুর যাবার চেষ্টা করলে স্থানীয় জনসাধারনের হাতে সে খোচাবাড়ি এলাকাতে ধরা পড়ে। জনগণ বাঙ্গালী ইপিআরদের কাছে তাঁকে ও তার পরিবারবর্গকে সোপর্দ করে। ঘটনাস্থলে সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।  ২৯শে মার্চ ঠাকুরগাঁর অধীনে সমস্ত বিওপির (৩৪টা) সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক বাঙ্গালী ইপিআর বিওপিতে থেকে বাকি সবাই ঠাকুরগাঁও এসে একত্রিত হয়।

 ৩০শে মার্চ সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআর সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে ভাতগাঁও পুলে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। ঐদিনই দিনাজপুরের কুঠিবাড়ী থেকে ৮নং উইং- এর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম, সুবেদার মেজর এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম টি হোসেন, ক্যাপ্টেন আরশাদ (৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট) ভাতগাঁও পুলের কাছে আসেন। এখানে সবাই কনফারেন্স করেন।

 ৩০শে মার্চ বিকেলে সবাই সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ভূষিরবন্দর ব্রীজে আমরা ডিফেন্স তৈরী করি। ৩১শে মার্চ সৈয়দপুর থেকে বেলুচ এবং পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের কিছু সৈন্য আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ভূষিরবন্দরে প্রায় দুই ঘণ্টা ওদের সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। তারা আবার সৈয়দপুর চলে যায়। আমরা ভূষিরবন্দর থেকে একটু এগিয়ে চম্পাতলীতে ডিফেন্স তৈরী করি।

 ১লা এপ্রিল সকালবেলায় চম্পাতলীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানীরা মিডিয়াম গান ব্যবহার করে। ১২টা পর্যন্ত আমাদেরকে ওখান থেকে হটাতে না পেরে বেলা দুইটার সময় তারা ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। বিকেল ৬টা পর্যন্ত তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলে। কিছুসংখ্যক বাঙ্গালী ইপিআর সেখানে শাহাদাৎ বরণ করেন। পাকিস্তানীদের দুটো ট্যাংক আমরা ৬-পাউণ্ডার গোলার সাহায্যে ধ্বংস করতে সমর্থ হই। আমরা পিছিয়ে এসে ভূষিবন্দরে ডিফেন্স তৈরী করি।

 ২রা এপ্রিল আমাদের কিছু বাঙ্গালী ইপিআর নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সৈয়দপুর থেকে দুই মাইল আগে তাদের সাথে সারাদিন তুমুল যুদ্ধ চলে। রাত্রিবেলা বাঙ্গালী ইপিআরা সেখান থেকে ঠাকুরগাঁ এসে একত্রিত হয়! ৩রা এপ্রিল ভূষিরবন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধ চলে। রাতে আমরা দশমাইলে গিয়ে ডিফেন্স তৈরী করি।

 ৫ই এপ্রিল পাকিস্তানীদের সাঁজোয়া এবং গোলন্দাজ বাহিনী দশমাইলে আমাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। দশ মাইলে অনেক বাঙ্গালী ইপিআর শাহাদাৎ বরণ করেন। অনেকেই আহত হন। কুঠিবাড়ীর বাঙ্গালী ইপিআররা আবার দিনাজপুরের দিকে চলে যায়। ঠাকুরগাঁর বাঙ্গালী ইপিআররা আবার ব্রীজে অবস্থান নেয়।

 ৭ই এপ্রিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ভাতগাঁর উপর হামলা চালায়। এখানেও বাঙ্গালী ইপিআর হতাহত হয়। পেছন থেকে কোন সাহায্য না পাওয়াতে আমরা সেখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হই। পঁচাগড়ে গিয়ে আমরা একত্রিত হই এবং সেখানে ডিফেন্স তৈরী করি। ১৪ই এপ্রিল পঁচাগড়েও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ করে এবং আগুনে বোমার সাহায্যে পঁচাগড় শহরকে সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়। পঁচাগড় থেকে বাঙ্গালী ইপিআররা অমরখানাতে গিয়ে শেষ ডিফেন্স তৈরী করে। সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিজ্ঞা নেয়া হয় যে একটা লোক জীবিত থাকা পর্যন্ত এখান থেকে কেউ পিছু হটবে না। আল্লাহর রহমতে দেশ স্বাধীন হবার পূর্ব মুহূর্তে পর্যন্ত অমরখানা আমাদের দখলে থাকে।

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ খন্দকার আবদুস সামাদ

২২-৭-১৯৭৪

২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে আমি দিনাজপুর জেলার পঁচাগড় থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ছিলাম। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন ঢাকায় সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণের খবর পাই তখনই থানার ৫ জন অবাঙ্গালী সিপাইকে নিরস্ত্র করে ঠাকুরগাঁ জেলখানায় পাঠিয়ে দেই। থানার বাঙ্গালী সিপাহীরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সহযোগিতা করে। এপ্রিলের প্রথমেই থানা ক্যাম্পাসে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ইপিআর ও পুলিশ একযোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ করে। ঠাকুরগাঁ উইং হেডকোয়ার্টার থেকে বাঙ্গালী ইপিআরগণ তাদের অস্ত্রাদি নিয়ে পঁচাগড় চলে আসেন। থানার রাইফেলগুলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দেয়া হয়। পচাঁগড় থানা ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার ব্যাপারে আমি নিজেও সক্রিয় ছিলাম। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু ছিল।

 এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিনাজপুর- পঁচাগড় রাস্তায় ভাতগাঁও নামক স্থানে একটি পুলে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র- জনতা ছিল। সৈন্যদের ভারী অস্ত্রের মোকাবেলা করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে এসে পঁচাগড়ে ডিফেন্স দেয়। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে পঁচাগড় প্রবেশে বাধা দেয়া। ঐ সময়ই নিরাপত্তার জন্য আমি আমার পরিবারের লোকজনকে ভারত সীমান্তের কাছে ভিতরগড় নামক স্থানে স্থানান্তরিত করি। আমি নিজে পঁচাগড়েই অবস্থান করতে থাকি।

 ২১শে এপ্রিল সৈন্যরা গোলাবর্ষণ করতে করতে পঁচাগড়ে ঢুকে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষ হবার পর সৈন্যরা পঁচাগড় থানা বাজারটি সম্পূর্ণ পুড়িয়া দেয়। বহু লোক মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রুপ হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতে প্রবেশ করে।

মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর[]

 গভীর রাত্রিতে ওরা দিনাজপুর শহরে এসে ঢুকল। এ রাত্রি সেই ২৫-এ মার্চের রাত্রি, যে রাত্রির নৃশংস কাহিনী পাকিস্তানের ইতিহাসকে পৃথিবীর সামনে চির-কলঙ্কিত করে রাখবে।

 ওরা সৈয়দপুর থেকে এসে অতি সন্তর্পণে শহরের মধ্যে ঢুকল। শখানেক পাঞ্জাবী সৈন্য। শহরে ঢোকার মুখে প্রথমেই থানা। সৈন্যরা প্রথমে থানা দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। তারপর তারা তাদের পূর্ব- নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে শহরের টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। সেইদিনই শেষ রাত্রিতে দিনাজপুরের বিখ্যাত কৃষক নেতা গুরুদাস তালুকদার এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক তাদের হাতে গ্রেফতার হলেন। এমন নিঃশব্দে ও সতর্কতার সঙ্গে এ সমস্ত কাজ করা হয়েছিল যে, শহরের অধিকাংশ লোক তার বিন্দুমাত্র আভাস পায়নি। পরদিন সকাল বেলা তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে জানল, পাকসৈন্যরা তাদের দিনাজপুর শহর দখল করে নিয়েছে। আরও শুনল, বেলা ১১টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ আদেশ ঘোষণা হচ্ছে। দিনরাত অষ্টপ্রহর ধরে কারফিউ চলবে। শহরের রাজপথ জনশূন্য, কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নেই। সবাই যে যার ঘরে মাথা গুজে বসে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জল্পনা- কল্পনা করে চলেছিল। সারাটা দিন এইভাবে কাটল কিন্তু রাত্রি বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলির মনের পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল, তারা মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা” ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। শহরে যে- সব জায়গায় মেহনতী মানুষদের বাস, সেই সব জায়গা থেকেই সবচেয়ে বেশী আওয়াজ উঠছিল। দম বন্ধ করা সেই ভয় ও দুর্ভাবনার বোঝাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ প্রাণ খুলে তার প্রাণের কথা বলতে চাইছিল। রেল চলাচল, ডাক, টেলিগ্রাফ, সবকিছু বন্ধ অথচ খবরগুলি যেন বাতাসে উড়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন করে সেই সমস্ত সংবাদ এল কেহই তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না, কিন্তু ২৭তারিখের মধ্যেই এ কথাটা মোটামুটি সবাই জেনে ফেলেছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। শহরের লোকদের চাঞ্চল্য আর উত্তেজনা তাদের ভয়কে ছাপিয়ে উঠেছে। এটা সবাই তীব্রভাবে অনুভব করছে যে, এই মুক্তিসংগ্রামে সকলেরই যোগ দেওয়া উচিত, কিন্তু সাধারণ মানুষ, নিরস্ত্র মানুষ, তারা কি করে জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে।  ২৬-এ মার্চ থেকে ২৮-এ মার্চ পর্যন্ত একটানাভাবে দিনরাত কারফিউ চলছিল, মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছে। এদিকে পাক- সৈন্যরা নিশ্চিন্তে ছিল না। জনসাধারণ জানুক আর না-ই জানুক এক মহাসঙ্কট সৈন্যদের মাথার উপর খড়গের মত ঝুলছিল। এক প্রবল বিরোধী শক্তি উদ্যত হয়ে আছে, যে কোন সময় তা এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। দিনাজপুরে ইপিআর বাহিনীর পাঁচশ জওয়ান আছে। সৈন্যদের সংখ্যা মাত্র একশ। এখানে আপাতত তারা শান্ত হয়ে আছে বটে, কিন্তু তাদের মনোভাব অজানা হয়। পূর্ববঙ্গে সর্বত্র এই ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহীদের পক্ষে প্রধান শক্তি। কাজেই সময় থাকতেই এদের নিরস্ত্র ও বন্দী করে ফেলা দরকার। প্রয়োজন হলে এদের কচুকাটা করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। কিন্তু মাত্র একশ সৈন্য ইপিআর- এর পাঁচশ জওয়ানকে নিরস্ত্র করবে অথবা বন্দী করবে, অথবা কচুকাটা করবে; এটাইবা কেমন করে সম্ভব? সৈন্যদের নেতৃস্থানীয়রা বুদ্ধি করল, এক্ষেত্রে সরাসরি বল প্রয়োগ না করে ওদের কৌশলে ডেকে এনে ফাঁদে ফেলতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে একটা বড় রকম ভোজের আয়োজন করে তারা ইপিআর বাহিনীর জওয়ানদের সাদর আমন্ত্রণ জানাল। সৈন্যদের পক্ষ থেকে হঠাৎ এমন আদর- আপ্যায়নের ঘটা দেখে ইপিআর বাহিনীর লোকেরা মনে মনে হাসল। ওদের মতলবখানা বুঝতে কারও বাকী ছিল না। ওরা এই ক'দিন ধরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়ে চলেছিল। এবার আর দেরী না করে তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল।

 আমন্ত্রিতেরা সদলবলে তাদের ঘাঁটি থেকে দিনাজপুর শহরে চলে এল। তারা ২৮-এ মার্চ বেলা ২টায় ‘জয় বাংলা' ধ্বনিতে সারা শহর মুখরিত করে শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝটিকার বেগে আক্রমণ করল। হঠাৎ এভাবে আক্রান্ত হয়ে উদভ্রান্ত পাক- সৈন্যদের অধিকাংশ ‘সার্কিট হাউসে গিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। অন্যান্যরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শহরের নানা জায়গায় আশ্রয় নিল। কিন্তু শহর থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইপিআর বাহিনীর যোদ্ধারা আর শহরের মানুষ এই পলাতক দস্যুদের সেই সমস্ত আশ্রয় থেকে টেনে টেনে বার করতে লাগল। তাদের খতম করে ফেলতে খুব বেশী সময় লাগল না। কিন্তু সার্কিট হাউসের মধ্যে অবরুদ্ধ পাক সৈন্যরা ৩০ মার্চ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করে চলেছিল। এই তিন দিনের যুদ্ধে তাদের মধ্যে মাত্র সাতজন ছাড়া আর সবাই মারা পড়ল। ৩১ই মার্চ তারিখে সেই সাত জন সৈন্য মরিয়া হয়ে একটা গাড়ি নিয়ে অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। এইভাবে তারা মৃত্যুর গহবর থেকে প্রাণ বাঁচাল। শোনা যায় ঐ গাড়ির মধ্যে কর্নেল তারেকও নাকি ছিলেন।

দিনাজপুর জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধের আরও বিবরণ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর এ রব ডি-এ-ডি)

২৪-২-১৯৭৯

 From 9.3.71 Major Amin Tarique, 8 Wing Comd, changed the Bengali Guard Comd, Kote and Magazine NCOS and detailed Punjabi in their Place. Ile deputed few Beharis of EPR to act as security against 3 Bengali Army officers, sectors SM (me) and against Bengali ICOs, NCOs. These actions created a commotion among us. Capt Nazir Ahmed and Capt Nazrul Haque both being Bengali were QM and Adjt respectively in these days. I reported all these happenings to Adju and QM.

 When 8 wing kote, magazine NCOs and guard comd were changed, I with Ataul Haque (shaheed), N/ Sub Lutfur Rahman, N/ Sub Moazzem Hossain. Sector QM / Hav Khandaker Abu Sayed, QM / Hav Bhulu Miah of 8 wing, Hav Nazim of sector antitank platoon and with more NCOs and few others made plan that in case of untoward happenings sector SM (A Rab) will supply keys which he had kept earlier to open kotes and magazines gor getting arms and/ammos. Our plan for action was confined within few pers through whom men kept organised for any eventuality.

 On 17.3.71 Sector comd ordered QM capt Nazir Ahmed to make over all granade, Chinese arms to 26 FF Regt coys, who were at Dinajpur circuit house. In turn QM Capt ordered sector QM/Hay kh Abu Sayeed to hand over, but he did not make over.

 In the 2nd week of March 71 some non- Bengali JCOS/NCOS and ORs were closed from BOPs to Wing /Sector HQ to increase the non-Bengali strength and arms were issued to them for whole time. On 18.3.71 QM/Hav kh Abu Sayeed were ordered to hand over the key of sector armoury to N/Sub-QM Mohd Ibrahim (non- Bengali), but he did not hand over, rather he issued all Chinese arms to all Bengali family pers for which he was charged on 24.3.71 Finding the situation becoming aggravated day-by-day, I drew up a plan to face sudden untoward incidents, if any, and face the enemy.

 As arms and ammo control were out of our hand, one day during my talk with Col. I played tricks with him stating that his non-Bengali securith could not get truc political situation report from town as they were unable to mix-up with locals. So some trusted Bengalishould be deputed for this job who could mix-up with political parties and students freely and may bring correct information, Sector Comd having confidence on me, accepted my suggestion and asked me to depute 2/3 trusted Bengali boys for the job. Accordingly I deputed L/NK Abul Mannan, L/NK Motahar and Sepoy Mustifizur Rahman telling them to report to Sector Comd direct. I advsed them that during their report they would state that Awami League volunteers, students and N.A.P workers were being trained by Indian agents at dead of night in Rajbari mango garden and in other jungles outside the town and they had been issued wityh arms/ammos and they might suddenly attack EPR sector HQ, officers club and their bunglows. My motive behind this briefing to security team was that on hearing these reports C.O. most likely would call me and other officers and would ask far action. In that case my advice would be to dig out all round defence in lines, club and officer's bunglow and there should be dawn to dusk `stand to posn'.so arms/ammos may remain in our hand in spite of kotes and amgs being with the Punjabis. Sector Comd accepted my advice and ordered for implimentation. Immeditely I did the work as per plan and by the grace of Almighty Allah not a single Bengali EPR lost their lives without battle. Also lives of MNAS/MPAs and students leaders were saved.

 On 18.2.71 Sector Comd insisted D. C., Dinajpur, Mr. Faizuddin Ahmed to promulgate carfew in Dinajpur but D.C.declined to do it. Officers of 26 FF coys, and EPR non-Bengali officers on DC's refusal to impose carefew were trying to cause riots through their agents, mostly Beharies so that Army may get a chance to overrule D. C. and promulgate carfew. I managed to meet Prof Yousuf Ali in the house of Mr. Zaman (prop. Friends Electrical Stores) and a relation Bangobandhu and informed the situation. I informed the Awame League MNAs and other leaders through various Sources.  On 19/20th March 71 Capt Adjt Nazrul Haque was removed and Capt Javed Feroz (Punjabi) posted as Adjt. Bengali suppt pl comd N/Sub Moazzem Hossain was changed by a Behari Comd. Due to all these happenings Bengali EPR pers at some stage became frustrated. Noticing this I informed them not to get nervous or frustrated rather remain organized and alert and wait for the time without exposing themselves first to be victimised.

 On 23.3.71 at about 09-30 hrs, over telephone Sector Cond oredred me to arrange `Bara Khana' and variety function for the troops. At about mid day sector Comd again ordered to invite 26 IF Regi pers in Bara Hhana. At about 1600 hrs through my intelligence information reached me that a plan was made that during `Bara Khana' half of The FF Regt pers would take food wth us and the rest suddenly would appear with arms and capture our kote magazine. At once I communicated this to my trusted Bengali troops to remain alert. By the grace of Allah, nothing happened in that night and the invited left the lines after taking their Khana smoothly, though some of them came with rifle.

 On 24.3.71 mental unrest among us was created by the ugly activities of the pak force in the shape of blank firing creating tension in the town. On and from 23rd March 71 I increased my night sentries with necessary instruction to keep watch over the movement of Pak army.

 On the 24th of March 71 we saw the pak army placing some automatic weapons in the Circuit house compound at Dinajpur facing our lines. This activity on the part of the Pak army created tension.

 On 25th night at about 01-30 hrs I got up from sleep and sat for Tahajjat prayer and hardly I could finish it when I got a telephone call from my Adji Capt Zaved Feroz (punjabi), who asked me to report at the sector Comd residence in uniform. I got perplexed. However, I put on my uniform and took my revolver and loaded it with view to shoot at least two in the event of any attempt upon my life. As soon as I came out of my gate I saw a jeep coming and when the jeep stopped before me at my gate. I saw two non-Bengalce escorts sitting inside the jeep. I boarded on the jeep and while I was passing by the residence of D. C. Dinajpur, I found the D. C's bunglow encircled by the pak army with automatic weapons. After reaching the residence of sector Comd I saw all of our officers holding a conference and among them there were Bengalee officers, viz QM.. Capt Nazir Ahmed, Capt Nazrul Haque, Asstt wing Comd, 8 Wing and Medical Officer Maj M.II. Choudhury and at the presence of my officers there, my mental unrest to some extent minimised. After my arrival there, Sector Comd informed me that in Dacca, Chittagong, Rajshahi, Khulna and other districts innumerable cases of arson, looting and molestation of women and all sorts of unsocial activities have occurred due to the failure of civil adm. So for the greater interest of public and the state, the Army and the EPR have taken over the the adm. of the country i. e. E. pak, now Bangladesh, from mid night. The Sector Comd asked me to inform lines over telephone asking them to assemble in the Recreation Room where he intended to address them. Accordingly, we all reached the EPR lines and the Sector Comd talked to men and talked to men and passed order to post pickets at the key points of the town, but it was found that most of the comds were non-Bengalees. While I was going to retire, I got another telephone call from circuit house where army HQ was located asking me to reach there. On arrival at the circuit house I found Sector Comd, security Officer Maj Raja Siddique and Maj Durrani who received me with a similing face and asked me to write down in Bengali an order of curfew to be imposed in the Dist. I obeyed and I was detalied to announce it in my languae. During announcement I was escorted by the said officers in four jeeps and a guard of II Regt behind me. Announcement started at 03-00 hrs and ended at 09-30 hrs. After it, I was ordered to take rest ofr the day.

 On 26.3.71 throughout the day Army and EPR patrolled the town and its suberbs and few standing pickets were posted for 24 hrs. Road blocks and obstacles were put up by the public for which army opened fire and killed several pers. At night, Army and EPR non-Bengalee officers arrested public leaders including Guru Das Talukder, Baroda Chakravarty and others and some Hindu merchants including Sogunlal Lahia and put them into jail.

 On 27.3.71 I was called by 8 Wing Comd and Adjt and was ordered to accompany the publicity officer to help him during announcement in the town. I carried out the order and returned from announcement at about 11-30 hrs when sector Comd oreered me to close all the available pers in the lines as he intended to address them. The sector Comd addressed the force repeating the speech of president Yahya Khan accusing Awami League and Banga Bandhu.

 After this, QM Capt. Nazir Ahmed and sub Ataul Haque with one platoon were sent to Thakurgaon. I felt the absence of Sub Ataul IIaque very much as he was one of my ringt hand in the liberation struggle of Dinajpur. N/Sub Lutfar Rahman who was picket comd at Balubari was threatened by sector Comd unnecessarily on the Plea that he had instigated public to attack our 21/C's residence. This was a pretext to remove him and to put a non-Bengali comd in his place. At about mid day some Behari came to Sector Comd and reported that Bengalees were assembling near Kanchan River and in other outlying areas of town to attack the Beharis. I went with patrol party and on return reported to the Sector Comd that this was false. Throughout the day Army and EPR patrolled the town. A 12 year old was killed by the army in Balubari area while he was crossing the road.

 On 27.3.71 in the evening the Sector Comd tried to go to Rangpur Brigade to bring some more army at the instigation of his non-Bengalee officers but he failed to go due to heavy road block. On return, he sent patrol party who killed about 14 Santals who were residing near that road block.

 On 27/28th night pak army called some of their enlisted mebn from their housed including brother of Habib, Chairman of Chehelgazi Union Council and killed them. Dead bodies lay scattered in three places i.e. in Rajbari jungle, four bodies were near Fulhat Bridge and about 8/9 bodies were thrown in the dithch of WAPDA band. During daytime people became very much panicky seeing these dead bodies.

 In the meantime source report reached me that all the M.N.As and M.P.As and prominent town leaders would be called in a conference in the evening in Dinajpur Army IIQ and after conference during a tea they would be killed. After it, leaders in jail would be dealt with and after at about 17-00 hrs attack would be lunched against Bengalee EPR. All available M.N.As/M.P.As were told not to attend the conference through our source.

 At about 10-30 hrs on 28.3.71 (Sunday) Hav Nazim came to me with tears in his eyes. He was ststing that about 200 men were killed by Pak army last night and some dead bodies were lying near his house and informed me that he had been asked by 8 Wing QM IIav Muslim Ali and Sector QM Ilav Khandaker Abu Sayed to contact me for the instruction as to what step we should take now. I told him to wait for our zero hour and in case if I was unable to reach them, they should not wait for the order order but go ahead with the plan (i.e., our time was 1600hrs). It may be mentioned that Subedar Badsha Ahmed (Behari) was called from his border coy (Biral). Though 28.3.71 was Sunday yet Sector Comd and other non-Bengalee officers held a meeting in the office upto 1400 hrs. After meeting, an order was passed to provide one Pl to subedar Badsha Ahmed for outside use with arms and weapons as per his demand. There was an army signal set in EPR line since the arrival. of army in Dinajpur and NCO In-charge (Punjabe) was called to circuit house and on return to line he asked his Bengalec operator to close the set. Due to the demand of one PI str by Sub Badsha Ahmed along with 3" Mor, MMG and LMG and removal of wireless set from line we were compelled to shift our 'H' hour one hour and 15 minutes ahead of our schedule time. As soon as officers left the office, arms Behan to be issued to the men of Sub Badsha Ahmed PI and with these arms men were deployed as per plan. Hardly our men could reach their position when first fire came from circuit house and we responded with 3" Mor and MGS, LMGS from our posn to that and another party started dealing with non-Bengalee LPR pers who had already made a plan to kill us along with their W/Pak brothers. By this time heavy shelling and LMG fire from both sides was in full swing. Firing was so intense and heavy that I could not instantly reach my R.V as my quarter was situated in between circuit house and EPR lines. Firing continued throughout the night with intermittent break. During this break I managed to reach R.V and directed the operation. One M.M.G. 1x3"Mor was placed on the Kanchan bridge to cover any enemy approach through ferry ghat and RLY bridge. In the meantime all our heavy arms and ammo were removed to the circuit house on gun point by Cap Adji Ahmed were removed to the other side of the river with the help of local public. Our MO with his family, Capt Nazrul IIoque with his family and wife of Capt Nazir Ahmed were removed to the circuit house on gun position on roof of Mission building which was at a distance of 200/250 yds from our posn. In the meantime I sent instructions to all border coy comds and their BOPS to start operation aganist the enemy and join with us leaving 2 men in each BOP and they did it.

 On 29.3.71 when fight started Hav Bulu Miah, Hav Kalam (Suppt Comd), Hav Sobhan, Hav Idrish, Hav Abdur Rahim (Shaheed), N/Sub Lutfar Rahman, Hav Nazim A/Tk Comd- all of 8 Wing, L/Nk Abul Kalam, Sepoy Awal, Sector QM/IIav kh Abu Sayed, 8 Wing QM/Hav Muslim Ali and L/Nk Motahar and Nk A. Aziz played a major role in this fight in different front. Prompt and active response from the younger generation of Dinajpur was spontaneous and encouraging.

 On 30.3.71 whole day with intermettent break fight between pak junta and EPR was severe. Both used 3" morters and MGs and EPR who had a 6 pounder anti- tank gun used maximum. This weapon had a very bad effect on the Pak army. They presumed that Indian Army tank entered into Dinajpur town to help EPR. In the meantime a good number of police from the town and subers, Ansars and Mujaheeds joined with us and this had increased our morale. Opreation aganist the non-Bengalee LPR in border and camp areas was almost complete by the 30th evening.

 By the evening of 30th March 71 we removed our extra arms/ammo and other heavy stores opposite to Kanchan river and establised our main rear HQ there. Enemy tried to attack our main rear HQ from two sides i.e. from the side of Chehel Gazi Mazar and Ghugu Danga side but failed and sustained heavy casualties.

 On 30 March 71 night at about 20-00 hrs when I was drafting few messages for our outlying coys Mr. Abdur Rahim M.C.A and Shah Mahatab Uddin M.C.A came to our help. We got all kinds of help including food etc. from the public and it was very commendable.

 9 Wing of Thakurgaon also started action throughout their wing and broder as per our earlier plan.

 During 30th night fight was on. As our all the Bengali coy and pl comds were in border except N/Sub Lutfar Rahman, the leadership upto 30th midday at different front was given by our valiant NCOs.

 By the carly morning of 31 Mar. 71 Sub A Majjid, N/Sub Amir Ali Sk, N/Sub Moazzem Hossain, N/Sub Mir Mokaddas, N/Sub Mominul Haque with their troops joined with us. Now with the full strength of about 400/500 men we gave a heavy thrust on the enemy. Sub Sukur who was Coy Comd advanced towards Parbatipur.

 On 29/30th night reinforcement with field guns were sent from Sayedpur to help Pak troops at Dinajpur but they could not reach due to heavy road blocks, obstacles and resistance by our force and local youths. By the mid-day of 31 st Mar 71 enemy had sustained heavy casualty and finding to material help from Sayedpur Cantt, our Sector Comd Col Quraishi, 21/C Major Zubairi. Capt javed Feroz. Capt Chema, all of EPR, with Major Durrani and Lt Khokar of 26 FF Regt withdrew through Fulbari road where they were intercepted by coy of Sub Sukkur near Fulbari bridge and fight continued for some time. During this fight both the side sustained loss and the enemy changed their route. When they reached near Mohanpur bridge they got another beat by our force and withdrew through Rajbari- Raninagar road to Sayedpur leaving behind their deads and few transport they had with them including jeep of Col Quraishi. In the meantime enemy field gun started firing on us (EPR) from Bhushir Bander area and as such we could not chase the enmy futher. Those shots fell on EPR lines, D.C's ground and police lines.  The whole night of 30/31 Mar. 71EPR re-inforcement continued their covering fire but finding no reply from the retreating enemy our forces gradually advanced towarda 10 miles (T junction), Raninagar Bhushi arca keeping a PI under Comd of N/Sub Lutfar Rahman on the right of Rajbari dighi to meet enemy in case of their advance through jungle. We covered all the approach roads of Dinajpur town with 1 PI under comd of Hav Bulu Miah in new town area where Beharis had their concentration with arms, keeping another detachment under comd of N/Sub Mominullah in Mohanpur bridge area, and one more near Kanchan RIY station.

 By the 31st midday we cleared the town from the enemy. From circuit house where the enemy had their IIQs we recovered 5 students, some police, 5EPR jawans dead bodies and one truck-load ration, one truck-load ammo with some arms beddings left by enemy. Hav A Sobhan who led one pl from Kutibari EPR HQs to the town recovered 1x 3" Mor and 2 Chinese M.G. left by enemy from the roof of circuit house. At new town Sub/Maj Osman Gani joined with Bulu Miah's force from Parbtipur.

 On 31 Mar. 71all the EPR troops and nearly 150/200 police, Ansar and Jujaheeds who had joined us took defensive posn. At about 0900 hrs Dinajpur jail gate Was opened and all the political leaders including Mr. Gurudas Talukder, Baroda Bhusan Chakravarty, Sagun Lal Lohiya and some other men including students were released. After clearing the enemy we brought whole town and villages under our control. Bangladesh flag started flying on all public and private buildings. SDO and other police and civil officials who hid themselves for fear of life were asked to reach town and resume their dutics.

 On 30/31st evening Maj M.H. Chy, Capt- Nazrul Haque, Mr. Faizuddin Ahmed, DC. Mr. Ilashcm SP, Mr. IIannan Chy, Dist. Judge, Mr. Shahadat IIossain Ex-En, Road and Mr. A Rouf Ex-En, Building, Dinajpur were rescued with their family members by our patrol party of Hav Idris and taken to our rear HQs at Kanchan Rly station. Previously we had information that these officers had been killed by Pat army on 28/29 when they were under their custody.

 Although most of the BOPS of 9 Wing started their operation by 29th Mar. 71 on having our information but 9 Wing HQs started their operation on 30th limitedly. After eleminating their Punjabi Wing Comd and other non-Bengali pers they were hesitating for any futher action. On hearing this I sent a written order from my rear HQ on 30th at 1300 hrs through a motor cycle courier who was sent by Sub/Maj Kazimuddin for futher instruction. In that oreder I asked him to cover probable enemy approach from Rangpur and Sayedpur via Khanshama and Debiganj route.

 During Thakurgaon operation our QM. Capt Nazir Ahmed (Bengali) was killed by public when he made a frantic effort to save Capt. Navid Alam (Punjabi) and his wife, claming her to be his sister. Sub Ataul Haque, L/Nk joinal Abedin were also killed by the same.

 On 30/31 (exact date not remembered) our Head Assit N/Sub Taluker, signal Sub Majid, Hav/Asstt Kashem Mondal and other family pers for whom we were anxious came and joined us from their hideout. N/Sub Asst Talukder was given the responsibility to protect the Kutibari SHQ/WHQ lines. On 1.4.71 entire force was deployed on different strategic routes.

 From 1.4.71 to 4.4.71 Dinajpur town and its suberb was thorouhgly combed out of Pakistani army and non-Bengali EPR elements. In this combing operation police helped us. All the shops, bazars, Banks and Offcers started functions; public transport started Plying.

 On 1.4.71 I moved my HQ to town area leaving Capt Nazrul Haq at rear. On arrival at town I extended our defence futher to: a.From 10miles to further ahed near Bhusir Bandar bridge. b. From Rajbari area to Shibpur Nala to stop enemy advance from Parbatipur and Sayedpur. c. From Ananda Nagor to Chirir Bandar area to stop enemy advance by train and Fulbari route. Sub Sukkur (B Coy of Hilli) made an attack on Parbatipur along with one coy of 3. EB Regt who joined with them.

 On 3/4th Apr. onc pl of Capt Asharf, 3rd EB Regt who were sent by their CO from Sayeedpur to recee the Shibganj airport (Thakurgaon) joined with us after a great persuation. After recee when they were returning to Sayedpur trouble started and they were stuck up at Thakurgaon.

 From 2/3rd Apr. 71 to 4/5th Apr. 71 when our all the border people reached Dinajpur we reorganised our pl/coy and deployed them in different fronts Dinajpur Dist.

 All the public leaders including MNAS/MPAS, general public and student community rendered all possible help to us. The contributions of Mr. A Rahim MPA, Mr. shah Mahatab Uddin, MNA, Mr. Azizur Rahman, MNA, Haji Danesh, Gurudash Talukder, Sagunlal Lohia and other leaders during this period are beyond description.

 On 3/4th Apr. 71 T, Sub Major Kazimuddin, Capt Nazrul Haque, Captain Asharaf 3rd EBR. Major M.H. Chowdhury and Major M.T. Hossain (rtd) who joined with us held a meeting at Bhatgoan Bridge and discussed our future poan of action.

 Having an exprienced and renowed officer like Major M T Hossain we set up an unified operational command keeping him as our head. Then we jountly prepared operational plan to disturb enemy concentration through fignting patrol. According to plan (1) one coy under comd of Sub A Majid (8 wing) was sent to Nilfamary. N/Sub Amir All Sheikh, and N/Sub Moazzem Hussain were with their pl comd and Hav Abul Kalam (now Sub) was with his suppt arms comd. (2) Capt Asraf of 3d EBR with I coy of 3 LBR along with JCOS Sub Abdullah and N/Sub Nasir, 2 coys of EBR under comd of sub Ilafiz with 2 anti-tank guns under comd of Ilav Nazim were deployed in Bhusir Bandar Bridge. Here over all comd was under Capt Asharf. (3) one coy with N/Sub Kawser and N/Sub Zaidul Hussain was sent to Badargonj area where Capt Anwar of 3d EPR with 2 pl strength joined with our troops.

 Over a pl strength under N/Sub Lurfar Rahman and Hav Kibria was deployed on Rajbari and Raninagar road to stop enemy infiltration through the jungle road into Dinajpur town. Capt Nazrul Ilaque was made the operational Commander for EPR troops Sub Maj Osman Gani who joined with us from Parbatipur remained in rear HQ for adm arrangement. I was holding the comd of Dinajpur and its suberb including Raninagar arca. From 2/3rd Apr. 77/78 BSP officers used to meet us and rendered valuable suggestion. We requested them for support arms but due to obvious reason they could not give it except small arm. Two 30 EBR coy under Major Nizam were sent to Ghoraghat area on a exercise plea. One coy of 3rd was at parbatipur and one coy with Capt Anwar and their Sub/ Maj IIarish had sustained a heavy loss at Sayed, but their Major force remained at Pulbari area. One coy plus str of EPR under comd of Sub Khaleque was deployed in Bhatagaon Bridge area.

 Nilfamari fight: On 6th and 7th April, 71 coy of Sub A Majid of 8 wing had a tough fight with enemy who used tank and field guns. In this fight enemy lost 7/8 pers. We lost one EPR jawan and two Ansars and Hav Ishaque of EPR was wounded. During fight our I M.G (Vickar) and one 3" Mor were damaged by arty fire due to use of tank and arty our troops could not stay but withdraw to Debeganj. When enemy entered Nilfamari town they set fire on public houses on both the sides of road and killed innocent people. After Debiganj fight our troops fell back to rear IIq.

 Badarganj fight: On 8th Apr. there was heavy fight with Pakistani army during whole day. Due to espionage by anti-Awami League elements of Badarganj enemy had carly information about our movement in that arca. Suddenly our men were ambushed by enemy but still our troops gave gallant fight. S.P., Rangpur, first came to recee the area with a Capt of Cav. Regt who acted as driver of SP. but could not bluff the eye of EPR who recognised the Capt. The Capt was killed and the S.P. was taken into custody. During this fight, Capt Anowar sustained injury on leg. Our two sepoys and one driver deid. Enemy loss could not be ascertained. From Badarganj our troops were withdrawn to Fulbari defence posn. From Fulbari EPR troops of N/Sub Kawser moved to Mohanpur Bridge and took defence posn and N/Sub Mominul Ilaque shifted his pl to Kawgaon area.

 Bhushir Bandar: On 7th and 8th there was heavy fight with enemy. In this fight also losses. Capt Ashraf who was overall comd deserted us. After the of Bhushir Bandar our troops took next defensive posn at 10 Miles (T. Junction). From here one road leads to Dinajpur (distance 10 miles) and another to Takurgaon Sub Division. IIere I took over the comd on 8th April.

 From 8th evening enemy started shelling on our posn by field guns. On 7/8the April B.B.C team of Nikolas Tomalin, Alan Ileard and Mark Taly visited this area.

 10 Miles (t. Junction); After withdrawal from Bhushir Bandar on 8th April 71 our troops (exclusively EPR) with some strength took defensive position in 10 Miles area. I took over the command there on the 8th in absence of Capt Nazrul with N/Sub Matiar Rahman (Suppl comd), 9 wing, N/Sub Goran 9wing, N/Sub Rowshan 9 wing, N/Sub Mir Mokaddes Ali 8 wing, Hav Kalam and Nk Hakim (3" Mor comd). My defence was from famous Kantanagar Mandir area to Nashirpur jute research farm arca. Distance was about 10/12 miles but strength was nearly two coys. Raninagar- Rajbari road was being defnded by N/Sub L Rahman and Hav Kibria.  During Nilfamari, Bhushir Bandar and Badarganj fight we lost our 3" motors and machine gun and I had only 2X3" mor, two MGs and two antitank guns, which were not sufficient to fight against arty and tank attack. 2 miles ahead of 10 Miles I sent a fighting patrol to delay enemy advance.

 From 9.4.71 morning enemy started pounding our posn by arty guns which continued whole day night and next day on 10.4.71 they attacked us from three axis and fight continued upto 15.00 hrs after which we could not stop the enemy advance. In this fight we lost about ten pers. Among them L/Nk A Sattar and L/Nk Mustafizur Rahman's name could be re4membered. 8 person sustained shell wound. We withdrew to Kharal P.S. side. We had second defence in Tobacco Co. WAPDA colony and rice mill area. This rear defence help up the enemy and they did not advance futher. While we were fighting the liberation war at 10 Miles, most of the MNA/MPAs excepting Mr. Rahim, MPA and destrict officials left Dinajpur and entered into India which affected the morale of our troops. For want want of heavy weapons we started loosing the battle now.

 An import bridge called Bhatagaon Bridge about 10 miles away from `T Junction in between Dinajpur-Thakurgaon road and its northern area which was the probable approach of Pak enemy from Sayedpur bifurcating 10 Miles defence was being defend by the following 9 and 8 wing J.C.Os and N.C.Os 1) N/Sub Motiur Rahman, 2) N/Sub Mond. 6) Hav. A. Hakim, 7) Hav. Nazimudddin under overall command of Sub. maj (D.A.D. Rtd) A. Rab of Dinajpur sector. Sub-major (D.A.D. Rid) Kazimuddin was commanding the rest of the 9 wing E.P.R. force in Thakurgaon area.

 With the fall of 10 Miles and Bhatgaon bridge area on 10 April 71, 9 wing contingent withdrew to Thakurgaon area. For some times they resisted the Pak army advance from Khansama and Debiganj area. After the fall of 10 Miles defence Bhatgaon and Thakurgaon tactical contact between Dinajpur and Thakurgaon force was cut off.

 Fall of Dinajpur Town: on 14.4.71 there was a full in fight from both the sides I took right upto Rajbari. With me one pl of Sub Abdullah and one pl of Sub Nasir Ahmed of Khoshaldanga hat near Biral. On 14.4.71 after 7/8 hrs fight enemy entered Dinajpur town at about 15.00 hrs with tank and arty through two sides. In this fight we lost five pers of whom the name of IIav Miah IIossain could be remembered. We had posn to the right of Dinajpur-Sayedpur road, withdrew to Baragam border side. Troops who were on the left side of the road, withdrew to Biral border. At about 01- 00 hrs I with some men reached Baragram area. Some villagers gave us shelter and food for the night. Opposite to Baragram was BSI camp named Amlia. With the fall of Dinajpur enemy entered the town, set fire on almost all the wayside shops and houses and killed men. All our troops moved to bordering BOPS towards various directions. Rest of our men reached by 14 th evening through various routes to Baragram BOP.

 Fight in Biral area: with the fall of Dinajpur town our forces were divided into two axis i.e., one portion of the force had to retreat towards border of Baragram, Khanpur, Mohanpur and Amlia (Indian B.O.P) side and another portion retreated towards Biral border where we had already rear head quarter under command of Capt. (now Lt. Col) Nazrul IIaque and Sub Maj (now D.A.D) Osman Ghani. Biral is situated in the western side of Kanchan river. Peoples of the locality rendered all possible help to our troops. In village Tefra about 100 families of us were accommodated in Hajibari with food and other help by villagers.

 Enemy launched attack with the support of artillery on Biral area on 16th 17th April, 71 at about 14-00 hrs. A tough fight continued for over 3/4 hrs. and enemy occupied Brial by the evening but sustained heavy casualty. During the fight our Ilav. Nesar Ali of Ex-E.P.R. became Shaheed.

 After the fall of Biral our troops retreated towards Panchpara village, extreme border of Bangladesh. Here our troops were exhausted and tired and to some extent disappointed for want of heavy and medium arms and ammunitions, transport, rations and treatment for the injured persons. Thanks to B.S.F. and Indian political leaders who boosted our morale and rendered all possible help. Thus we got ready ourselves for an attack on Pak enemy. After Biral enemy captured Kishorganj B.O.P. which was next to Brial towards Indian border, Radhikapur. Our plan was now to drive out enemy from Kishorganj and Panchpara area.

 As per approved plan on 2nd May `71 at dawn our troops attacked Kishorganj B.O.P. area from three axis and there was a good battle. Students of Dinajpur also took part in the fight and both the side sistained good casualties. Enemy oped long range weapons from Biral approximately 15 miles away from border and approximately 10 miles from Kisorgonj B.O.P. Most of the enmy bombs fell on the refugee camps established by the Indian Govt. at the Radhikapur. One died on the spot and several got injured in the camp. This was willfully done by the enemy. So the Indian authority put pressure on Mukti Bahini to stop their fight agaist pak army. After tough fight Kishorganj was recaptured by our E.P.R. forces, Ansars, mujaheeds and students in the evening of the same day and enemy retreated towards Birol.

 On 3rd May 71 Major Bedi of B.S.F. came to Radhikapur and advised Sub Maj Osman Ghani not to launch any frontal attack on Pak army which may cause heavy disadvantage in the training of Mukti force. To train future M.P this was most necessary. After this tactical action of M.1. was confined to raids, ambush and guerilla activities. In these actions our scpoy Tuta Mia became Shaheed.

 Next day on 4th May 71 pak officers arranged a flag meeting with Indian B.S.F and told them that Bengali E.P.R troops had killed over 50 pakistani soldiers during yesterday's fight and had requested Indian B.S.F officers to handover the Bengali E.P.R. troops to them who had taken shelter in India. B.S.F. officers flatly denied that any Bengali E.P.R troops had been staying in and Indian territory. Thereafter we continued regular raid, ambush and guerilla fight against Pak army till June 1971.

 Troops under command of sub Major A. Rab who had withdrawn towards Baragram, Khanpur and Amlia border were recoganised and put on protective standing patrol around the area to stop further enemy advance.  A company strength of 3rd Bengal Regt under command of Major Nizam (who was later on killed by own troops at Fulbari) and Capt. Anwar (now Col) joined with E.P.R. troops of Fulbari and IIilli area. After the fall of IIilli arca they withdrew to Inedian Hilli side.

 At Indian Hilli our forces closed at Kurmail technical school and Subra area where E.P.R. troops of former E.P.R. 7 wing of Noagaon and a small contingent of E.P.R 6 wing (Chapai Nawabganj) joined with the forces of E.P.R.E.P.R., Ansar, Mujaheed and students. It is to be mentioned that contingent of 3rd E.B.R. under command of a Sub. (name not remembered) and N/Sub Nasir Mia who were with me at 10 Miles arca were also with me and remained active in Borsgram area.

 From Kurmail and Subra area regular raids and ambushes continued around the Hilli, Mohanpur bridge, l'ulbari. Panchbibi. Joypurhat (Bogra) Dhamurhat parshipara area of Noagaon sub-division along with the Noagaon E.P.R. forces, Mr. M. A. Jalil, Mr. Baitullah M.N.A., Jahangir M.N.A and Amjad Hossain of Noagaon came to this area and opened 2/3 youth camps and Sayed Ilyder Ali M.N.A. and Prof. Abu Sayeed M.N.A. of Sirajganj opened two youth camps to train guerillas for future fight. With the 7 wing EPR one Lt. (discharged) Idris B.U. who was sbsequently promoted to Captain, joined the liberation war. He was a great brave fighter.


  1. 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” থেকে সংকলিত।