বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১১
সশস্ত্র প্রতিরোধঃ রাজশাহী
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
---|---|---|
১১। রাজশাহী জেলায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ | বাংলা একাডেমির দলিলপত্র | ১৯৭১ |
নওগাঁ রাজশাহীর সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগ্রেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী[১]
মার্চ মাসে (১৯৭১) আমি রাজশাহীর নওগাঁওয়ের বিডিয়ার (তৎকালীন ইপিআর)- এর ৭নং উইংয়ের সহকারী উইং কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ১৮ই মার্চ মেজর নাজমুল হক (বাঙ্গালী) সাহেব উইং কমাণ্ডার হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ঐ পদে এর আগে একজন পাঞ্জাবী অফিসার বহাল ছিলেন। নাজমুল হক সাহেব সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নওগাঁওতে আসেন এবং দায়িত্ব বুঝে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাঞ্জাবী অফিসারটি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে কিছুটাটালবাহানা শুরু করেন। কিন্তু সেই সময় সেই এলাকায় গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আমার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দরুন পাঞ্জাবী মেজর আকরাম দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হন।
মেজর আকরাম ২৩শে মার্চ ঢাকার পথে ক্যাপ্টেন নবীদ নামে সেই উইংয়ের আর একজন পাঞ্জাবী অফিসারসহ রওনা হন কিন্তু পথিমধ্যে ফেরীর লোকজন নগরবাড়ী ঘাটে তাদেরকে পার করতে অসম্মতি প্রকাশ করায় তারা ফিরে আসতে বাধ্য হন। ফেরত আসার পর আমি তাদের কে নিরাপত্তার অজুহাতে আমার বাসার উপরের তলায় প্রকৃতপক্ষে নজরবন্দী করে রাখি। এবং একই অজুহাতে নিচে সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করি।
২৩শে মার্চ এবং ২৫শে মার্চের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার উইং-এর কমপক্ষে ১০০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর; জেসিও এবং অফিসারদেরকে আয়ত্তে ফাঁদ রচনা করি। কেননা; আমি বুঝতে পারি যে তারা সবাই উইং হেডকোয়ার্টারে টালবাহানা করে একত্রিত হবার চেষ্টা করছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রক্ষিতে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ২৪শে মার্চ আমি উইং-এর উপপ্রধান হিসাবে অধিকাংশ অস্ত্রগারের পাঞ্জাবী প্রহরী অধিনায়কদের সরিয়ে ফেলি এবং বেশীর ভাগ বাঙ্গালীকে নিয়োগ করি।
২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমরা বাইরের কোন খবর পাইনি। ২৬শে মার্চ ভোর ছয়টায় সুবেদার মেজর চুপি চুপি আমার বাসার এসে বলে যে আমাকে কে যেন ঢাকা ইপিআর অয়ারলেস স্টেশন থেকে ডাকছে, এবং তার মনে হচ্ছে ঢাকায় কিছু একটা ঘটেছে।
অয়ারলেসে কথা বলার সময় একজন বাঙ্গালী ইপিআর সিগন্যালার আমাকে বলল যে ঢাকায় গত রাতে রাজারবাগ পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালিয়েছে এবং পিলখানার ইপিআর বিদ্রোহ করেছে এবং তারা অধিকাংশ ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে, আপনারা যে যেখানে আছেন আপনাদের নিজেদেরও কাজ শুরু করুন। কিন্তু আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে পরিচয় দিতে অসম্মতি জানায়। যদিও এ খবরের সত্যতা প্রমাণ করার কোন উপায় ছিল না তথাপি কিছু সত্য থাকতে পারে এ কথা মনে করে নিজে বিদ্রোহ করতে মনে মনে স্থির করি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর শুনতে চাইলে কোন জবাব পাওয়া গেল না। বেশ কিছুক্ষন পর বলা হয় ইয়াহিয়া খান ভাষণ দেবেন। কিছুক্ষণ পর ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনা গেল এবং সামরিক নির্দেশনাবলীও প্রচার করা হল।
বিদ্রোহের দাবানল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে বিহারী-বাঙ্গালী দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল; বিশেষ করে সান্তাহারে - যেখানে ছয় হাজার বিহারী বাস করত। আমরা দাঙ্গা বন্ধ করতে ছেষ্টা করছিলাম এবং এ নিয়ে মেজর নাজমুল হকসহ কিছু স্থানীয় এমসিএ এবং এসডিওর সাথে আমরা বৈঠক করি এবং যাতে লোকের মনে কোন সন্ত্রাসের সৃষ্টি না হয় তার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়ার ভাষণ এবং সামরিক নির্দেশনাবলী শুনে আমাদের সেদিন ক্ষোভ এবং ভীতির সঞ্চার হয়।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় যখন সন্ধ্যার সময় বেতার কেন্দ্র খুলি তখন হঠাৎ করে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষনা করা হল। মনে সাহস হল যে অন্ততঃপক্ষে একজন অধিনায়ক হিসাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব নিয়েছেন। সকলের মনে সাহসের সঞ্চার হল এবং আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোপুরিভাবে ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম।
আমি আমার অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার অফিসে স্থাপন করলাম এবং মেজর নজমুল হকসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা শুরু করলাম। আমাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে ছিল (কে) অয়ারলেস স্টেশন সারাদিন খোলা থাকবে এবং ইপিআর- এর ১৭উইং-এর খবরাখবর মনিটর করা হয় এবং সেগুলো অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে জানানো; (খ) নিজের হেডকোয়ার্টার থেকে কোন কথাবার্তা না বলা; শুধু শুনা; (গ) পুলিশের অয়ারলেসগুলোতেও মনিটরিংয়ের ব্যাবস্থা করা এবং সগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করা; কেননা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অবস্থা ছিল না; (ঘ) টেলিফোন ডিপার্টমেণ্টকে বলা হয় যেন বগুরা এবং যে সমস্ত রাস্তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আসার সম্ভাবনা আছে সে সমস্ত জায়গায় অন্ততঃপক্ষে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত কয়েকটা প্রধান জায়গার সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখে এবং সেখানকার স্থানীয় ছাত্রনেতা অথবা আওয়ামী লীগ নেতা যেন আমাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত রাখে তার ব্যবস্থা করে; (ঙ) সমস্ত গাড়ী বাস ট্রাক রিকুইজিশন করা হল; (চ) ছাত্রদের মধ্য থেকে ভলাণ্টিয়ার নেয়া হল এবং কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ডাকা হল যেমন জনাব বয়তুল্লাহ (বর্তমান ডেপুটি স্পীকার) এবং ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আবদুল জলিল কে ডাকা হল; (ছ) ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হল এবং তাদেরকে রাইফেল দেয়া হল; (জ) অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ স্টোর থেকে সরিয়ে কিছু কিছু মাটির নিচে রাখা হল যাতে করে জঙ্গী বিমানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; (ঝ) প্রধান হেডকোয়ার্টার-এর কিছু দূরে পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হল এবং খবরাখবর সরবরাহের জন্য রানার নিয়োগ করা হল; (ঞ) এবং স্থির হল যে এবং নওগাঁ কে আপাততঃ আমাদের রিয়ার হেডকোয়াটার করা হবে যেহেতু এটা হবে শত্রুবাহিনীর জন্য দূর্গম স্থান; (ট) এদিকে আমি ৬নং উইং ইপিআর যেটা রাজশাহী ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অধীনে নওয়াবগঞ্জে অবস্থিত ছিল তাদেরকে অয়ারলেসে বাংলায় কিছু নির্দেশাবলী দিতে শরু করলাম। সেই উইংয়ে কোন বাংগালী অফিসার ছিল না। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিল। ২৬/২৭শে মার্চের রাত্রের গোলযোগের পর তারা উইং হেডকোয়ার্টার ছেড়ে রাজশাহীতে পালিয়ে আসে। সেই সুযোগে আমি সমস্ত উইং-এর লোকজনকে নওয়াবগঞ্জে একত্রিত হতে বলি এবং বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেন সেখানে উপস্থিত হয় তার নির্দেশ দিই; (ঠ) সেখানে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সরিয়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় রাখার নির্দেশ দিই। দেশের পরিস্থিতি সমন্ধে তাদের অবহিত করা হয় এবং তাদের উপর বিওপিতে হামলা হবার সম্ভাবনা আছে সেকথাও অবহিত করি।
২৭শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুতি চলে এবং রাজশাহী সেক্টরের নওগাঁ এবং নওয়াবগঞ্জের সমস্ত ইপিআরকে এক জায়গায় নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে একত্রিত করা হয়। ২৭শে মার্চ আনুমানিক বেলা ১১ টার সময় আমাকে পুলিশের অয়ারলেসযোগে রাজশাহীর ডিসি ডাকেন। তার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন যে; রাজশাহী পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট ঘেরাও করে আছে এবং পুলিশদের আত্নসমর্পন করতে আদেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত নয়। তিনি এবং এসপি তাদের সাথেই আছেন। যদি সম্ভব হয় কিছু ইপিআর-কে এর লোক যেন সাহায্যে এগিয়ে আসে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আর আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ লাইনের উপর আক্রমন চালাবে এবং তার মর্টর ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে বললাম কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে ৬০ মাইল কাচা রাস্তা (নাওগাঁ থেকে রাজশাহী) যাওয়া সম্ভব? এ কথা শেষ হতে না হতে ডিসি অয়ারলেস ছেড়ে দিলেন এবং আমি অপারেটরের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে বলছিল; গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে-এরপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অনেক চেষ্টার পরও কোন খরব পাওয়া গেল না। এ দিকে আমরা খবর পেলাম যে বগুড়ার আর্টিলারী রেজিমেণ্ট-এর একটা ব্যাটারী আছে যেটাকে এখন অভ্যান্তরীন নিরাপত্তা ডিউটির জন্য মুভ করানো হয়েছে এবং তারা সেখানকার গালর্স স্কুলে অবস্থান করছে।
প্রতিরোধের পরিকল্পনা: আমি মেজর নজমুল হক সহ পরিকল্পনা করলাম যে ২৮শে মার্চ প্রথমতঃ এক কম্পানী ইপিআর ফোর্স নাটোরের রাস্তা দিয়ে সারদায় পাঠাব ক্যাডেট কলেজের এ্যাডজুট্যাণ্ট মেজর রশিদের কাছে। এবং রংপুর থেকে রাজশাহী যাবার রাস্তা বগুড়ায় বিচ্ছিন্ন করে দেব। অন্যথায় মেজর রশীদ তার ফোর্সসহ ঢাকা থেকে রিইনফোর্সমেণ্ট নিয়ে রাজশাহী আসার রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দেবে।
২৮শে মার্চ বিকেলে আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার লোকজন নিয়ে বগুড়ায় পৌছে গেলাম যার দুরত্ব আনুমানিক ৩০ মাইল। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড থাকাতে আমাকে সকাল দশটায় রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পৌছতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি শহরের লোকজন নেই বললেই চলে। সব মিলে হাজার খানেক লোক হবে কি না সন্দেহ। পরিবার বলতে কারুরই ছিল না। একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল এবং গাড়ীর আওয়াজ শুনে এবং লাইট দেখে সবাই পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেও এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে স্থানীয় লোকের সামান্য গোলাগুলি হয়েছিল; সন্ধ্যা হতে না হতেই শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল এবং শহরের রাস্তাগুলো ছিল ব্যারিকেডপূর্ণ।
বগুড়ায় সংঘর্ষঃ আমি প্রথমে পুলিশ লাইনে গেলাম। সেখানে একজন বেশ সাহসী রিজার্ভ পুলিশ ইন্সপেক্টার এবং শ” দুয়েক পুলিশ দেখতে পেলাম। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তারা অনেকটা সাহস পেল এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদেরকে জ্ঞাত করল। আমি জানতে পারলাম যে তারা (আর্টিলারী ব্যাটারী) আপাততঃ রংপুর থেকে কোন ফ্রেশ সাপ্লাই পাচ্ছে না যেহেতু রাস্তাঘাট বন্ধ। তবে তারা প্রায়ই গ্রামের পথে গাড়ী নিয়ে যায় এবং তরিতরকারী এবং মাংস সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমার জানা ছিল যে আর্টিলারী ব্যাটারীতে ৫০/৬০ জনের বেশী লোক হতে পারে না এবং তাদের ততোটা সম্মুখ সমরে অবতীর্ন হবার নিপুণতা নেই। সেই হেতু প্রথমতঃ পরিকল্পনা করলাম যে গ্রামে যাবার পথে অথরা পেট্রলিং-এর সময় তাদেরকে এ্যামবুশ করা সহজসাধ্য হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯/৩০শে মার্চ রাতে একটাএ্যামবুশ পার্টি পাঠালাম। এতে ছিল নওগাঁ থেকে আসা কয়েকজন ছাত্র ও ইপিআর ও পুলিশের লোকজন। তিনখানা ৩ টনী গাড়ীসহ সেনাবাহিনীর কয়েকজন কমপক্ষে এক প্লাটুন পেট্রলিংয়ে বের হয় এবং রাস্তার মধ্যে আমাদের লোকজন তাদের কে এ্যামবুশ করে। তিনটা গাড়ি বিধ্বস্ত হয়। তিনটা অয়ারলেস সেট দখল করা হয় এবং ২৩জন নিহত হয়। বাকি লোক ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রংপুরের দিকে পশ্চাদপসরন করে। এই এ্যামবুশে আমাদের সৈনিকদের মনোবল অনেক বৃদ্ধি পায়।
বগুড়াতে তখন একটা এ্যামুনিশন ডাম্প ছিল; যেটা একজন ক্যাপ্টেন কমাণ্ড করছিল। ওখানে মাত্র ২০/২৫ জন সৈনিক প্রহরা দিচ্ছিল। আমি সবাই কে একত্রিত করে কিভাবে এ্যামুনেশন ডাম্প দখল করতে হবে; বিশেষ করে এর চরিদিকে ঘেরাও করে তাদেরকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করতে হবে তার ব্যবস্থা করি। ঘেরাও করার জন্য গ্রাম থেকে কিছু লোক যোগাড় করা হল। এবং এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ঘেরাও করে গলোবারুদ বের করে নেয়ার জন্য নির্দেশনাবলী দিয়ে আমি আমার সুবেদার সাহেব কে রেখে নওগাঁ চলে 'আসি; যেহেতু আমার সেখানে যাবার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এ্যামুনেশন ড্যাম্প ঘেরাও করা হয়েছিল এবং ক্যাপ্টেনতার লোকজন সহ আত্মসমর্পণ করে। অধিকাংশ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে নিয়ে যায় এবং বাকিগুলো পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
বগুরা থাকাকালীন সময়ে অয়ারলেসে মেজর শফিউল্লাহর সাথে আমার কথা হয়। তিনি বললেন যে; কিশোগঞ্জের কাছে দ্বিতীয় ইষ্ট বেংগল নিয়ে যমুনা নদীর কাছে তিনি আছেন; আমরা যেন ওখানে গিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করি। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন; উত্তরাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার। সেখান থেকে একজন লোক পাঠিয়েছিলাম তাঁর কাছে। কিন্তু খবর পাওয়া গেল তিনি সিলেটের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন।
নওগাঁতে মেজর নজমুল হকসহ আবার পরিকল্পনা শুরু করলাম। এদিকে খবর পাওয়া গেল যে; ইপিআর কোম্পানী রাজশাহীর পথে মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটা রাজশাহীর নিকটবর্তী আড়ানী নামক রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ২৫ পাঞ্জাবের এক কোম্পানীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে-২৯/৩০ মার্চ রাতে তাদের সাতে কয়েকহাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং গ্রামের লোক গোগ দিয়েছে। এই পাকিস্তানী কোম্পানীটি পাবনা থেকে পশ্চাদপসরণ করে তাদের নিজের ব্যাটালিয়ন-এর দিকে পদব্রজে রাজশাহী আসছিল। কোম্পানিটি সম্পূর্নরূপে ঘেরাও হয়ে যায় এবং ইপিআর কোম্পানী তাদের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টার এর গোলা বর্ষন করতে শুরু করে। শত্রবাহীনী দিশেহারা হয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং অনেকক্ষণ গোলাগুলি বিনিময় হয়। শেষ রাতের দিকে শত্রুবাহীনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং প্রাণ বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে। কিন্তু গ্রামের লোক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় সবাই ধরা পড়ে এবং তারা গ্রাম বাসিদের হাতে নিহত হয়। মেজর আসলাম এবং ক্যাপ্টেন রেজা (উপ অধিনায়ক) মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয় এবং আড়ানী স্টেশনের কাছে নিহত হয়।
শত্রুবাহিনীর মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই সুযোগে আমি এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে নওগাঁ থেকে ৩১শে মার্চ রাজশাহীর পথে রওয়ানা হই। নওয়াবগঞ্জের উইংগকে নির্দেশ দিই তারা যেন নওয়াবগঞ্জ থেকে পদব্রজে অগ্রসর হয় এবং শত্রুও মোকাবেলা করতে যেন প্রস্তুত থাকে। অনেক ব্যারিকেড অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত রাজশাহীর অদুরে নওহাটা (মত্রঘাটি হতে মাত্র দুই মাইল দূরে) আমি আমার লোকজন নিয়ে অবস্থান নেই এবং অন্যদিকে অগ্রসরমান নওয়াবগঞ্জের ইপিআর উইং (যেখানে ৫০০সশস্ত্র লোক ছিল)-এর সাথে যোগাযোগ করি।
সেই রাতে আমি কিছু লোক নওহাটায় রেখে রাজশাহী থেকে ছয় মাইল দূরে খরচক্কা (রাজশাহী- নওয়াবগঞ্জ রাস্তার উপর) নামক স্থানে ইপিআর-এ অগ্রসরমান লোকদের সাথে দেখা করি এবং সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে আমার অধীনে নিয়োজিত করি। সেই রাতে ২৫পাঞ্জাবের একটি পেট্রল বাহিনী তিনখানা গাড়ী নিয়ে সেই রাস্তায় আসে এবং আমাদের বাহিনী অতর্কিতে তাদেরকে এ্যামবুশ করে। আমরা ওদের ৭ জনকে নিহত এবং একজনকে জীবিত ধরতে সক্ষম হই। সেই বন্দীর কাছ থেকে জানা যায় যে ক্যাপ্টেন সালমান নামক এক অফিসার তাদের পেট্রল পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং একটা প্লাটুন পেট্রলিংএ এসেছিল। ওদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আহত-নিহতদের অধিকাংশকে নিয়ে চলে যায়। এতে আমাদের লোকজনের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। এবং আমার লোকজন ত্বরিত বেগে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। ১লা এপ্রিল ভোর ছটার মধ্যে আমরা রাজশাহী শহরের অদূরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি। আমাদের পেট্রল বাহিনী নিয়োগ করি খবরাখবর আনার জন্য। আমার পূর্বদিকে মেজর রশীদের নেতৃত্বে যে সমস্ত লোকজন পাঠানো হয়েছিল তাদের সাথেও যোগাযোগ করি এবং তাদেরকে বলা হয় যেন তারা সারদা থেকে অগ্রসর হয়ে রাজশাহীর পূর্বদিকে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে।
এদিকে আমার সশস্ত্রবাহিনীর সংখ্যা পুলিশ; আনসার মুজাহিদ; ছাত্র; ইপিআর মিলে একহাজারের ওপরে পৌছে যায়। শত্রুবাহিনী রাজশাহীর চারিদিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ আরো শক্তিশালী করে এবং তাদের স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র প্রধান পথে মোতায়েন করে। শত্রুবাহিনী আমাদের শক্তি এবং সংখ্যা নির্ণয় করতে সক্ষম হয় এবং তাদের জংগী বিমান ঢাকা থেকে সাহায্যের জন্য আসে। ১লা এপ্রিল থেকে ৫ই এপ্রিল প্রত্যহ দু'একবার করে বিমান হামলা চলে; কিন্তু রাজশাহীর চতুর্দিকে আম্রকুঞ্জ থাকায় এবং তার নীচে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি হওয়ায় শত্রুবাহিনীর বিমান গুলো আমাদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারেনি এবং আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে বেসামরিক অনেক লোকজন মারা যায় এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
৩রা এপ্রিল ভারত থেকে বিএসএফ-এর একজন লেঃ কর্নেল সেন এবং মেজর ত্রিবেদী নামে দুজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে আসেন এবং আমার কি সাহায্যের প্রয়োজন জিঞ্জেস করেন। আমি তাদেরকে কিছু আর্টিলারী ফায়ার-এর সাপোর্ট দিতে বলি তাদের সীমানা থেকে। সীমান্ত নিকটে থাকায় এটা সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি জানালেন যে, এটা তারা দ্বারা সম্ভব নয়; তবে তিনি কর্তৃপক্ষকে বলবেন তবে যদি কোন রাইফেল এলএমজি চান দিতে পারি। কিন্তু ইমি তাকে বললাম যে; এখন আমার কাছে ১২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার;একশোর উপর এলএমজি-এমজি এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আছে। তাই আমার এগলো দরকার নেই। বিমান হামলা মোকাবেলা করার জন্য ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে সাহয্য করতে অনুরোধ করলাম। আমি তাকে আরো বললাম যে ৬ই এপ্রিল আমি রাজশাহী আক্রমণ করব বলে স্থির করেছি; সে দিন যেন আমাকে আর্টিলারী ফায়ার সাপোর্ট দেয়া হয়।
রাজশাহী যুদ্ধঃ আমার পরিকল্পনা ছিল শহরের দক্ষিন দিক থেকে আক্রমন চালানো এক ব্যাটালিয়ন নিয়ে। আর কিছু লোক উত্তর পশ্চিম দিকে শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু গোলাগুলী করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে ব্যাটালিয়নকে দক্ষিণ দিকে মুভ করিয়ে আনি এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিই; ইদিকে জানতে পারলাম বন্ধুরাষ্ট থেকে সাহায্য পাবার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা কখনো আসেনি।
আক্রমন শুরু হয় ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা-৭টার দিকে। শত্রুবাহিনী আমাদের উপর প্রবল গোলাবর্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গুলি বর্ষন করতে শুরু করে। অদম্য সাহস মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মুখে ঠেলে নিয়ে যায় এবং শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে তারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা লড়াইয়ের পর রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর চতুর্দিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করে ফেলে। পশ্চিম সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সংখ্যক লোক নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৩০/৩৫ জন হতাহত হয়। রাজশাহী পুলিশ লাইন প্রভৃতি জায়গা থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করি। রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে প্রায় তিন হাজার অস্ত্র তিন লাখ গুলি উদ্ধার করা হয়। বাকি শত্রুবাহিনী তাদের ছাউনি পশ্চাদপসরণ করে এবং সেখানে একত্রিত হয়ে আরো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বৃহা তৈরি করে। ছাউনির চারিদিকে মাইন পুর্তি রাখে এবং কাঁটা তারের বেড়া দিতে শুরু করে। শহরের লোকের মনে উল্লাসের সৃষ্টি হয়। এবং আমাদের পূর্ববর্তী কর্মসুচী ঐ ছাউনি দখল করার কাজে নিযুক্ত হয়। এদিকে শত্রুবাহিনী বিমান হামলা আমাদের উপর অব্যাহত থাকে।
৭ই এপ্রিল থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত আমরা শত্রুবাহিনীর ছাউনির অতি নিকটে চতুর্দিকে থেকে ঘিরে ফেলি এবং ছাউনির ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে পৌছে যাই। কিন্তু শত্রুবাহিনীর মাইন এবং কাঁটা তারের বেড়া ডিংগিয়ে ভিতরে গিয়ে আক্রমণ চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। শত্রবাহিনী সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্কবিধবংসী কামান; তিন ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি বাইরের দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখে। সেই সময় আমরা জানতে পারি সেখানে শত্রুবাহিনী ২৫০থেকে ৩০০সৈন্য আছে। বাকি নিহত; আহত অথরা নিখোঁজ। আরো জানতে পারি য়ে তাদের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল শফকত; বেলুচ; সিতারা-ই-জুরাত যিনি ৭ই এপ্রিল আমাদের সাথে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন; এবং তাকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচণ্ড আক্রমনের সম্মুখে শত্রুবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেংগে যায়। শত্রুবাহিনী সে এলাকায় সমস্ত বিহারীকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে তাদেরকে সাহয্যে করতে নির্দেশ দেয়।
এদিকে আমরা ছাউনি দখল করার শেষ প্রচেষ্টায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করি। তখন খবর পাওয়া গেল যে; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ডিভিশন সৈন্য নগরবাড়ী ঘাটে অবতরন করার চেষ্টা করছে হেলিকপ্টার; ষ্টীমার ফেরীর মাধ্যমে। অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রিইনফোর্সমেণ্ট-এর কথা শুনে সকলের মনোবল ভাংগতে শুরু করে। কিন্তু সকলকে আশ্বাস দিয়ে আমি বলি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারা যেন তাদের কাজ চালিয়ে যায়।
আমি দুটো কোম্পানী সেখান থেকে উঠিয়ে নগরবাড়ীর দিকে অগ্রসর হতে নির্দশ দিই। ১১ই এপ্রিল বিকেল বেলায় আমাদের বাহিনী যখন পাবনার অনতিদূরে পৌছে তখন পাবনা শহরের উপর শত্রুবাহিনীর মর্টর এবং আর্টিলারী ফায়ার হচ্ছিল। তখন ঐ দুই কোম্পানী মুলাহলী নামক স্থানে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ি হয়নি। তারা শত্রুবাহিনীর জংগী বিমানের হামলা এবং আর্টিলারীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্যদের বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করে।
এদিকে আমি ১২ই এপ্রিল সকাল বেলায় আমার সেনাবাহিনীর মনোবল অটুট রাখার জন্য নিজে এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে পাবনার পথে অগ্রসর হই এবং বাকি সংগ্রামী সৈনিকদেরকে ছাউনির উপর তাদের চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিই। ১০ মাইল পথ অতিক্রম করার পর আমি খবর পেলাম যে শত্রুবাহিনী অতি নিকটে পৌঁছে গেছে এবং আসার পথে প্রধান রাস্তার দু পাশে বাড়ীঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং আমি নিজেও তার ধোয়া দেখতে পেলাম। এমতাবস্থায় আমি সারদা এবং রাজশাহী যাওয়ার মোড়ে আমার শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি।
১২ই এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে আমাদের প্রতিরক্ষার এক হাজার গজ দূরে রাস্তা কেটে দেয়া হল এবং বড় গাছ কেটে ব্যারিকেডের মধ্যে বুবিট্র্যাপস ও কিছু মাইন দু পাশে পুতে রাখলাম। ১২ই এপ্রিল সন্ধ্যা নাগাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছাল এবং ব্যারিকেড সরাতে চেষ্টা করল। বুবিট্র্যাপ ফেটে বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ করা হল। সারা রাত দু'পক্ষের তুমুল লড়াই চলে এবং সারদার কাছে সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক এ;বি;সিদ্দিকী যাকে আমি ’বীর বিক্রম (মৃত্যুর পর) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর ১৩ই এপ্রিল ভোরের দিকে পাক সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং অবস্থান করতে থাকে। আমার সৈন্যরা তখনও মনোবল অটুট এবং শহরের চারিদিকে প্রতিরক্ষ্য ব্যূহ অব্যাহত রাখে। ছাউনি দখল করার জন্য তখনও তাদের চাপ অব্যাহত রাখে।
১৩/১৪ই এপ্রিল রাত দুটোর দিকে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনী বিপুলভাবে গোবর্ষণ শুরু করে। যতই ভোর হতে থাকে আমার লোকদের সাথে আমার অয়ারলেস এবং টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্য আমার সৈন্যদের ওপর ঝঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমার সৈন্যদের অপসারিত করা হয় এবং তারা নওয়াবগঞ্জের দিকে সরে আসে।
নওয়াগঞ্জের প্রতিরোধঃ বেলা প্রায় দুই ঘটিকায় সময় আমি আমার এক হাজার সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র ৩ শত জনকে খুঁজে পাই এবং তাদের নিয়ে রাজশাহী এবং নওয়াবগঞ্জের মাঝখানে গোদাগাড়ী নামক স্থানে আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ পুনরায় তৈরি করি। এটা রাজশাহী থেকে ১৮ মাইল এবং নওয়াবগঞ্জ থেকে ১২মাইল দূরে ছিল। রাজশাহীর যুদ্ধে আমার ৩৫/৪০ জন নিহত হয়। এতে আমার সৈন্যদের মনোবল একেবারে ভেংগে পড়ে।
আমার সাথে নুরুল ইসলাম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৫ই এপ্রিল সে ভারতে চলে যায় এবং ১৬ তারিখ সে আমাকে এসে খবর দেয় যে মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা প্রশাসক এবং বিএসএফ-এর কমাণ্ডার আমার সাথে জরুরী কাজে দেখা করতে চান এবং তিনি আমাকে সাহায্য দিতে প্রস্তুত আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নুরুল ইসলাম নামের সেই ছাত্রটির সাথে ১৬ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদে ওদের সাথে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু এতে কোন ফলই হল না। কোন সাহায্যই পাওয়া গেল না। নিরাশ হয়ে ফিরে আসলাম।
১৭ই এপ্রিল সকালের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের অবস্থানের উপর এবং নওয়াবগঞ্জ শহরের উপর হামলা চালাল। জংগী বিমানের সাহায্যে রকেট এবং মেশিনগানের প্রচণ্ড হামলা চালায়; কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেংগে নওয়াবগঞ্জ পৌঁছতে তখনও সক্ষম হয়নি।
২১শে এপ্রিল খুব ভোরের দিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হল আমাদের অবস্থানের উপর এবং শত্রুবাহিনী আক্রমন চালাল। আমাদের প্রতিরক্ষ্যা বৃহৎ শত্রুবাহিনী ভেদ করতে সক্ষম হল বেলা দশটার দিকে। প্রতিরক্ষা ব্যূহের নিকটেই ছিল পদ্মা নদী। সেখানে আমার সাবেক ইপিআর- এর দু খানা স্পীড বোট ছিল; যাতে করে আমি লড়াই চলাকালে ভোরের দিকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নদী পার করে বাংলাদেশের ভেতরেই চর এলাকায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। শত্রুবাহিনী ত্বরিত গতিতে নওয়াবগঞ্জসহ প্রায় সমস্ত এলাকাই; নওয়াবগঞ্জের চর এলাকা ছাড়া শত্রুকবলিত হয়। সেখানেই আমার সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি।
ক্ষোভে; দুঃখে এবং হতাশায় আমি যখন নিমজ্জিত তখন বিএসএফ-এর কয়েকজন লোক আমাকে খবর দিল যে; আমাকে মেজর দারাস বলে একজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে চান। অগত্যা তার সাথে দেখা করতে গেলাম। সে আমাকে বললো; আমি যেন আমার সমস্ত জিনিস এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদসহ লালগোলায় (মুর্শিবাদ) পৌঁছে যাই। ২২শে এপ্রিল আমি আমার তিন হাজারে উপর রাইফেল; স্টেনগান; এল-এম-জি এবং গোলাবারুদ নিয়ে লালগোলায় পৌঁছালাম। পৌঁছুতে না পৌঁছুতে বিএসএফ- এর দু'খানা ট্রাক এসে আমাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেল। তবে সামান্য কিছু রাইফেল আমাদের কাছে রেখে গেল।
এদিকে আমাকে খবর দেয়া হল যে কর্ণেল ওসমানী আমাদের সাথে বালুর ঘাটে (দিনাজপুর) ২৩শে এপ্রিল দেখা করতে চান। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা সেখানে পৌছলাম এবং এই প্রথম এম-সি এর সাথে দেখা হয়। কর্নেল ওসমানী সেদিন আমাকে সে এলাকার অধিনায়ক নিযুক্ত করেন এবং বলেন যে বিএসএফ আমাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ খাদ্য প্রভৃতি দিয়ে সাহায্য করবে।RE-ORGANISATION OF TROOPS AT RAJSHAHI
(FROM the diary of brig. Gyas uddin chowdhury, BB Psc(Rtd) then Maj. Gyas:the
Comd. of rajshahi sub-Sector-20-1983)
After the force battle on 13 and 14 April with pak army at rajshahi town I pulled back my troops towards Nawabganj and took up a strong defence at Gdagari area. at that time I had with mc 6 Win (Battalion)of EPR intact and some elements of 7 Wing (Battalion) who came with me from Nawgaon and those who followed me from Charghat company of thes wing. In addition approximately 200 volunteer freedom fighters stayed with the troops rest of whom left after loosing the tial battle at rajshahi. The pak force which recaptured Rajshahi from us after consolidating the position for Nawabganj on 17 april. On the way they met with pockets of resistance and went back to Rajshahi On night of 20/21 april; Pack army made a desparate attempt and contated own troops at night on forward position around Godagari. In the very early hour they launched an attackwhich was a dawn attack. I was expecting such an action from them. On 20 April I ferried across river padma opposite Godagari with 300(there thousands)303 rifles; 96 Bretta guns and 3 lacs of ammunition which I collected from rajshahiarmoury between 07 April and 13 April when rajshahi town was under my captivity. Ialso sent across 48 LMGs;4 vicar machine guns:6 3" morters; which were surplus in 6 wing Hqs as they were switching over from 3" two 81 mm morters and new machine guns(latest AMerican version) and 1400 rounds of morter shells. In addition Ihad many other types of explosives and armaments which I collected mainly from EPR sector after in fell during the battle with occupation forces of 6 wing Hqs located at located at Nawabganj wich remained Liberated till 21 Aprill and acted as our firm base.
The troops who were in defence at that time had 60 LMGs; 6x81mm morters; 10x2" mors; 6xLirat (an old model of British rocket launcher) and personalweapons; ammunitions and grenades with eah fighting members. Pak army always used unconventional and most brutal technique of assault by opening their fire of automatic weapons to all the built up areas and huts of the village; and firing with flame thrower so that the whole built up area is demolished and burnt to ashes thus not providing any shelter to freedom fighters and RR shells for softening the position prior to launching an attack. In 3 weeks time our freeedom fighters already got enough battle inoculation and gave a tough fight to the assaulting troops of pak army at Godagari. I started pulling back my troops in phases in a planned way across river Padma with the help of number of speed boats of EPR; available forpatrolling by evening of he day on 21 april we withdrew alongwith all weapons and equipments on the other side of Padma just opposite to Godagari Police station. We just had 7 minor casualty.But the casualty of local people was quite heavy. I saw 24/25 injured persons being ferried across and 2/3dead bodics lying around the market arca. We also carried sufficient amount of rice and pulse from the LSD godown located at Godagari. During enemy attack from 17 April to 21 April the occupation army used in average 3 air sortiesevery day of F-86(sabre) jest in our defence. They used mostly MGs and rockets against our troops; beside hitting the civilian population and killing the
innocent persons.সারদা ও অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আলী মোহাম্মদ মকিবর রহমান সরকার
০৬-০৬-১৯৭৩
২৫শে মার্চের ঘটনায় আমরা বিস্মিত হয়ে পড়ি এবং পশ্চিমা শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অস্ত্রে জবাব অস্ত্র দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই।
সারদায় অস্ত্র সংগ্রহঃ সারদা পুলিশ একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল মিঃ বরুয়াকে সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান কে সম্পাদক করে এবং আমি স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসাবে থেকে একটি মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। সেই মুহূত্বে আমাদের সঙ্গে পুলিশের কিছু অংশ; ইপিআর, আনসার; মুজাহিদ; ছাত্র; অধ্যাপক সব মিলে বিরাট এক মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। সারদা ক্যাডেট কলেজ থেকে ৩০৩ মার্কা রাইফেল এবং পুলিশ একাডেমি থেকে ৬০০/৭০০ রাইফেল ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করি এবং সারদা ও রাজশাহী রোডে বাঙ্কার করে পজিশন নিয়ে থাকি।
রাজশাহীতে ইতিমধ্যে পাক সেনারা অবস্থান করছিল। আমরা একটি কোম্পানি নিয়ে রাজশাহী অভিমুখে যাত্রা করি। কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা শুনতে পাই যে; নাটোর হয়ে আর একটি ব্যাটালিয়ন ঢাকা- পাবনা-নগরবাড়ী পথে রাজশাহীর দিকে আসছে। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের প্রতিরোধের জন্য পাঠান হয়।
আমরা প্রথম পাবনার মুলডুলিতে পাকসেনাদের সম্মুখীন হই। সংঘর্ষে পাকসেনাদের বিপুল ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটি। রাজশাহিতে অপর দল যেটি ছিল তাদের সঙ্গে পাক সেনাদের নিয়মিত যুদ্ধ হচ্ছিল। সংঘর্ষে সমস্ত পাকসেনা খতম হয়।
১২ এপ্রিল রাজশাহী সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়। অপর দলটি যেটি মুলাডুলিতে পিছু হটছিল নাটোরে গিয়ে পুনরায় পজিশন নেয়। সেখানেও ব্যাপক শেলিং-এর সামনে টিকতে না পেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আমরা পিছু হটি। সেখান থেকে আমরা বানেশ্বরে (রাজশাহী) ডিফেন্স নিই। পাক আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন ৭৫ মিলিমিটার কামান এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমন করে।
ইতিমধ্যে আমরা খবর পেলাম আড়ানীতে ২০/২৫ জন পাক সেনা গ্রামে ঢুকে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করছে এবং ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছে। খবর পেয়ে আমি একটি ছোট সেকশন নিয়ে গ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হই। গ্রামে গিয়ে শুনলাম নদীর অপর পাড়ে পাক সেনারা পজিশন নিয়ে আছে। আমরা ফায়ারিং শরু করি। বহুক্ষন ফায়ারিং-এর পর অপর পক্ষ থেকে কোন জবাব না আসায় আমি বিস্মিত হই। পরে সেখানে গিয়ে দেখলাম তারা ক্যামোফ্লেজ' করে পালিয়েছে। পাকসেনারা কলাগাছ কেটে তাতে খাকী কাপড় পরিয়ে এবং কাঠের তৈয়ারী রাইফেল হাতে দিয়ে নদীর পাড়ে আমাদের দিকে মুক করে রেখে দিয়েছে। আমরা ভাবছিলাম পাকসেনারা তাদের অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিয়ে আছে।
আড়ানী ব্রিজে প্রতিরোধঃ আমরা হতাশ হয়ে আমাদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে আড়ানী ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ করে থাকি। রাত্রি ৪টার দিকে বুঝতে পারলাম ব্রিজের উপর দিয়ে কিছুলোক যাচ্ছে। হল্ট বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফায়ারিং শুরু করে। আমরা পাল্টা জবাব দিই। কিছুক্ষন উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হয়। ৫/৭ মিনিট পর ব্রিজের উপরে পাকসেনারা সম্পূর্ন স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরা সেখানে ৪টি পাক সেনার লাশ উদ্ধার করি। বাকি দই চারজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
বানেশ্বরের যুদ্ধ ও সারদায় গণহত্যাঃ আমরা সবাই রওনা হযে ১৩ই এপ্রিল তারিখে বানেশ্বরের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেই। বানেশ্বরে পাকসেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমাদের মুক্তি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেক মুক্তিসেনা শাহাদৎ বরন করেন। বানেশ্বর এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সারদার পতন হয়। সারদায় পাক আর্মি চলে আসায় বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৫০০/২০০০ লোক নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকসেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং ৭০০/৮০০ লোককে নৃশংসভাবে গুলি করে পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। ওই দলের মধ্যে থেকে আমরা মাত্র তিন-চারজন বেঁচে ছিলাম। পাক সেনাবাহিনী সন্ধ্যার দিকে রওনা হয় এবং রাজশাহী দখল করে নেয়।
সশস্ত্র প্রতিরোধ-রাজশাহী-বগুড়া-পাবনা
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান বীর বিক্রম
২৪-১২-১৯৭৩
২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় উইং কমাণ্ডার অভ্যান্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির জন্য তিনটি প্লাটুন তৈরি করে রাখার নির্দেশ দেন। রাত আট ঘটিকার সময় উইং হাবিলদার মেজর সৈয়দুর রহমান (পাঠান) কে পুরো উইংকে ফল ইন করার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন তিনটি প্লাটুন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকে।
২৬শে মার্চ সকাল বেলায় কোয়ার্টার গার্ড কমাণ্ডার মুজিবর রহমান বাংলাদেশে পতাকা কোয়ার্টার গার্ডে গার্ড অব অনার দিয়ে উত্তোলন করে। ২৬শে মার্চ সকাল ৭ঘটিকার সময় মেজর নজমুল হক; ক্যাপ্টেন গিয়াস; মেজর আকরাম ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আফজাল উইং-এ আসেন এবং সুবেদার মেজর আবদুল লতিফ মোল্লাকে পুরো উইংফল-ইন করার নির্দেশ দেন। ফল ইন করা হয়। মেজর নজমুল হক বললেন যে, যা করার আমি সব করব।
২৬শে মার্চ সকাল ৮/৯টার সময় ১০০থেকে ১৫০জন লোক মাইক নিয়ে আমাদের অফিসের সম্মুখে এসে ৭ই মার্চে শেখ সাহেবের টেপ রেকর্ডকৃত ভাষণ বাজাতে শুরু করে এবং শ্লোগান দিতে থাকে। মেজর নজমুল হক অফিসের সম্মুখে হৈচৈ গণ্ডগোল না করার জন্য জনতাকে নির্দেশ দেন। আনুমনিক ১০/১১টার সময় কোয়ার্টার গার্ডের সেণ্ট্রির উপর হঠাৎ একটি গুলি আসে। এটা শোনার পর চতুর্দিক থেকে ফাঁকা আওয়াজ শুরু হয়। ১০ মিনিট গোলাগুলি চলে। উল্লেখ্য যে ২৫শে মার্চ রাতে আমরা তিনটা বাংগালী প্লাটুনকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করে রাখি (ক্যাপ্টেন গিয়াসের গোপন নির্দেশে) মারত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে আশংকায়। ক্যাপ্টেন গিয়াস আমাকে এবং সুবেদার মনোয়ার আলীকে অফিসে ডেকে গোপনে বলেন যে; বাঁচার জন্য আপনারা তৈরি থাকুন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ। এই কথা বলে তিনি ভেংগে পরছিলেন। গোলাগুলীর পর মেজর আকরাম বেগ মেজর নজমুল হককে অনুরোধ করেন যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে যেন তিনি একটা ব্যারাকে হেফাজতে রাখেন। তখন সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে একটি ব্যারাকে প্রহরী মোতায়েন করে রাখা হয়। তাদেরকে ব্যারাক থেকে বের হয়ে না আসতে নির্দেশ দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের পরিবারবর্গকে জেসিও মেসে রাখা হয় এবং বাংগালী ইপিআর তাদের পাহারা দেয়। মেজর নজমুল হকের নর্দিশে তাদের অস্ত্রশস্ত্র অফিসে জমা করানো হয়। অফিসের চতুর্পার্শ্বে বাংগালী ইপিআর প্রহরী লাগানো হয়। বেলা বারটা-১টার সময় বিপুল জনতা অফিসের সামনে হাজির হয়। তারা ক্যাপ্টেন গিয়াসকে বলে যে; শান্তাহারে বিহারী অস্ত্র নিয়ে বোয়ালিয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা এগিয়ে আসুন।
২৭শে মার্চে মেজর নজমুল হকের নির্দেশে তিনটি প্লাটুন তিনটি অয়ারলেস সেট সহ শান্তাহার অভিমুখে আমার নেতৃত্বে রওনা হয়। শান্তাহারে দেখি চারিদিকে শুধু ধোয়া আর আগুন; গোলাগুলীর আওয়াজ। আমি অয়ারলেসে নওগাঁতে মেজর নজমুল হকের সাথে যোগাযোগ করি; বাঙ্গালী ও বিহারী বহু মৃতদেহ উদ্ধার করি এবং পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তে নিয়ে আসি। মেজর নজমুল হক ১৪৪ ধারা জারী করেন। সীমান্তের বিওপিগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ৩০শে মার্চ ক্যাপ্টেন গিয়াস; হাবিলদার আলী আকবর (বর্তমানে নায়েক সুবেদার); এবং আমি বগুড়া অভিমুখে রওনা হই। বগুড়ার রেলওয়ের স্টেশন মাস্টারকে নওগাঁতে টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতে অনুরোধ করি। এরপর আমরা বগুড়া পুলিশ লাইনে যাই। হাবিলদার আলী আকবরকে পুলিশ লাইনে রাখা হয় ও তার সাথে ২৫ জন ইপিআর দেওয়া হয়। হাবিলদার আলী আকবরকে পুরোপুরি কমাণ্ড দেয়া হয়। আমি ক্যাপ্টেন গিয়াসসহ নওগাঁতে ফিরে আসি।
৩০শে মার্চ আমি এক প্লাটুনসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে পৌছাই। হাবিলদার আলী আকবর ২৫জন ইপিআর; কিছু পুলিশ; ছাত্রসহ মুজিবর রহমান মহিলা মহাবিদ্যালয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপর আক্রমন চালায়। মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ওদের ক্যাম্প ছিল। এক রেজিমেণ্ট ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে ওরা সজ্জিত ছিল। রাত চার ঘটিকার সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী অয়ারলেস স্টেশনে ও এতিমখানার পার্শে পেট্রল ডাম্পে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে তারা ৩০/৩২ টা গাড়ী নিয়ে রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়।
১লা এপ্রিল বেলা ৯টার সময় হাবিলদার আলী আকবর আড়িয়াল বাজারে এ্যামুনিশন ডিপোর উপর আক্রমণ চালায় এবং ক্যাপ্টেন নূর আহম্মদসহ ২৩ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের পরিবারবর্গকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলে। তাদের পরিবারবর্গকে সে নিজের হেফাজতে রেখে হাজতে নিয়ে আসে। এই আক্রমন তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। ঐখানে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন নায়েক সুবেদার আবুল কাশেমসহ এক প্লাটুন বাঙ্গালী সৈন্য ছিল। তাদেরকে পরে ডেকে আনা হয়।
ঐ অ্যামুনিশন ডিপোতে ৯২ কোটি টাকার অস্ত্রশস্ত্র ছিল। ৮০ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ বগুড়াতে নিয়ে আসা হয়। এবং পুলিশের হেফাজতে দেয়া হয়। মেজর নজমুল হক উক্ত সংবাদ পেয়ে বগুড়াতে আসেন এবং হাবিলদার আলী আকবরকে এই দুঃসাহসিক অভিযানের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানান। তিনি আমাকে বলেন যে এত অল্প লোক নিয়ে এত বড় একটা আক্রমন চালানো কখনো সম্ভব ছিল না।
বগুড়া জেলা স্কুলে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। হাবিলদার আলী আকবর ছেলেদেরকে দিবারাত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে সকল এমসিএ; ডিসে এবং সংগ্রাম পরিষদের কর্মীগণ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। স্থানীয় প্রশাসন আমাদের থাকা খাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত করার জন্য এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের আর- আই হাতেম আলী; তার অধঃস্তন কর্মচারীবৃন্দ; এমসিএ ডাক্তার জাহিদুর রহমান; ডাক্তার গোলাম সরওয়ার; এডভোকেট গাজিউল হক; এমসিএ মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী প্রমুখ। ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক দলের কর্মীগণ এ কাজে সহযোগিতা করেন।
ইতিমধ্যে মেজর নজমুল হক কিছু লোক বাঘাবাড়ি ঘাটে পাঠাবার নির্দেশ দেন। কিছু লোক সিরাজগঞ্জে এবং কিছু লোক মহাস্থানে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে শুনতে পেলাম দিনাজপুরের ঘোরাঘাট থেকে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার; ক্যাপ্টেন শওকতের চিঠি এবং একজন এমসিএসহ হাবিলদার ও দুইজন নায়েক একটা জীপে এ্যামুনিশন নেয়ার জন্য বগুড়াতে এসেছেন। এমসিএগণের পরামর্শ ও মেজর নজমুল হকের আদেশক্রমে তাদেরকে ট্রাক ও জীপে আর্মস ও গোলাবারুদ দেয়া হয়। পরে সুবেদার প্রধান পুনরায় অস্ত্র নিতে আসে। ৮ ট্রাক অস্ত্র ও দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার তাদেরকে দেয়া হয়।
হাবিলদার আলী আকবরকে মহাস্থানে পাঠানো হয়। পরের দিন তাকে আবার ডেকে পাঠানো হয়। আলী আকবরকে হেডকোয়ার্টারে (বগুড়া) রেখে আমি বাঘাবাড়ি ঘাটে ডিফেন্সে যাই। এবং সিরাজগঞ্জের এসডিও জনাব সামসুদ্দিন; শাহজাদপুরের এমসিএ আব্দুর রহমান; শাহজাদপুরের প্রিন্সিপাল তাসাদ্দক হোসেন এবং আরো অন্যদের সহিত আমার নিজজ্ঞানে পরামর্শ করে আলী আকবরকে আনার জন্য বগুড়া পাঠাই। দুদিন পর আলী আকবর বগুড়া হতে এসে আমার সাথে বেড়াতে যোগদান করে। পাইকড়াহাটে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করা হয়। পরের দিন তাকে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য সাথিয়া থানায় (পাবনা) পাঠাই। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী নগরবাড়ী থেকে (১০ ই এপ্রিল) পাবনা অভিমুখে যাত্রা করে। পরদিন আলী আকবর ফেরত এসে বলল যে গতকাল (১৩ এপ্রিল) পাক সেনাবাহিনী পাবনায় প্রবেশ করেছে এবং লোকমুখে জানা গেছে তাদের এক ডিভিশন সৈন্য এ্যাডভান্স করছে। ১৩ ই এপ্রিল পাবানার ডিসি; এসপি নদী পার হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে গেছেন। পাবনা পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র ও এ্যামুনিশন আর আইয়ের নিকট থেকে টিপু বিশ্বাস নিয়ে গেছে। তখন আলী আকবর কে পুনরায় নাকালীয়া বাজারে পাঠাই। নাকালীয়াতে চেয়ারম্যান (নক্সালপন্থী) তাকে সেখানে থাকতে বাধা দেয় এবং এখানে থাকতে দেব না বলে হুমকি দেয়। পরদিন সকালে এসে আলী আকবর আমাকে এসব জানায়। ঐ এলাকায় জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগপন্থী কিছু লোক আমাদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করতো।
আমি আলী আকবরের সাথে পরামর্শ করি কিভাবে আক্রমন পরিচালনা করা যায়। তারিখ ছিল ১৪ই এপ্রিল। আলী আকবরকে নির্দেশ দিই বগুড়াতে গিয়ে মেজর নজমুল হকের সাথে পরামর্শ করে ফেরত আসতে। ১৭ এপ্রিল আলী আকবর ফেরত আসে। এক প্লাটুন সৈন্যসহ তাকে নগরবাড়ী এবং পাবনা রাস্তার মধ্যে পাকসেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিই। আলী আকবর ১৭ই এপ্রিল রাত্রে সেখানে যায়।
আমি জানতে পারলাম যে আমাদের যে; আমাদের সুবেদার মেজর আবদুল লতিফ মোল্লা ১৭ই এপ্রিল বাঘাবাড়ি ঘাটে এসেছেন। আমি তার সাথে দেখা করতে যাই। ২০শে এপ্রিল আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে পৌছাই এবং দেখতে পাই হাবিলদার আলি আকবর এক আহত সৈনিককে নিয়ে ঘাটে রেখেছে। আলী আকবর বলল যে; ১৯শে এপ্রিল পাইকড়হাটে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ পাকসেনা অগ্রসর হচ্ছিল। সেই সময় সে পাকসেনাদের উপর গুলী ছোড়ে। পাকসেনাদের ৬ গাড়ী নষ্ট হয়েছে এবং বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে। তার পক্ষেও অনেক হতাহত হয়েছে এবং ছত্রভঙ্গ হয়েগেছে। আহত হাবিলদার আবদুল আলীকে নিয়ে আমরা শাহজাদপুর হাসপাতালে আসি। সেখানে তার উপর অস্ত্রোপচার করা হয় স্থানীয় ডাক্তারদের দ্ধারা। এরপর হাবিলদার আলী আকবর সিরাজগঞ্জের এসডিও-র সাথে যোগাযোগ করে। ছত্রভঙ্গদের আমি একত্রিত করার চেষ্টা করি কিন্তু তা করতে পারিনি।
আমি তার পর ৩নং সেক্টরে যোগ দিই। সেখান থেকে আমাকে কোম্পানী কমাণ্ডার বানিয়ে সিলেটের আসালংবাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার; হাবিলদার মোহাম্মদ ফসিউদ্দিন
০২-০৫-১৯৭৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইপিআর-এর ৬নং উইং ছিল। ২৪শে মার্চ থেকে আমাদের কিছু লোককে বাইরে অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ডিউটির জন্য পাঠানো হয়। এই উইং এর কমাণ্ডার; সহকারী উইং কমাণ্ডার; ক্যাপ্টেন সিদ্দিকও আর একজন ক্যাপ্টেন মেস কমাণ্ডার থেকে সুবেদার মেজর পর্যন্ত সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। বাঙ্গালীদের বদলী করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা হয়। ২৫শে মার্চ থেকে বাংগালী ইপিআদের কাছে থেকে অস্ত্র নেবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাঙ্গালীদের সন্দেহ জাগায় অস্ত্র জমা দিতে তারা অস্বীকার করে। জনসাধারণ আমাদের উপর হামলা চালাবে এই অজুহাতে আমরা অস্ত্র জমা দিই নাই।
২৫শে মার্চ বিকেলে সেক্টর হেডকোয়ার্টার রাজশাহী থেকে ১৫/১৬ জন বাঙ্গালী ইপিআর একজন সিকিউরিটিসহ নবাবগঞ্জে আসে। মাঝে মাঝে তারা গোপনে বৈঠক করতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাতে তিনজন ক্যাপ্টেনসহ আনুমানিক ২৫/৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর রাত প্রায় দেড় ঘটিকায় সময় রহনপুর প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে আক্রমন চালায়। রহনপুর ক্যাম্পের বাঙ্গালী ইপিআররা তাদের জীবন রক্ষার্থে ওদের উপর পাল্টা আক্রমন চালায়। ওদের তিনজন আহত হয়। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানীরা রহনপুর বাজারে কিছু নিঃসহায় লোককে গুলী করে হত্যা করে। ২৬শে মার্চ দিনে নবাবগঞ্জ ক্যাম্পের সমস্ত বাঙ্গালীকে নিরস্ত্র অবস্থায় তিন চারবার ফলইন করানো হয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী অস্ত্রসহ বাইরে গণ্ডগোলের অজুহাতে ক্যাম্পের আশেপাশে থাকে। আমাদেরকে ফল-ইন করিয়ে উইং কমাণ্ডার বলেন যে; আমরা যদি বাইরের জনসাধারণের সাথে সহযোগিতা করি তাহলে আমাদের কঠিন সাজা দেয়া হবে এবং গুলি করে হত্যা করা হবে। কথা প্রসংগে পশ্চিমা সুবেদার মেজর দাদু খান বলে যে তোমাদেরকে ট্যাঙ্কের সাহায্যে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হবে।
২৬শে মার্চ দিনের বেলা আমরা চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ইপিআর অয়ারলেসে খবর পাই যে ঢাকাতে বাঙ্গালী ইপিআরদের কে খতম করা হয়েছে। বাইরে যারা আছে তাদেরকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্ক করে দয়া হয়।
২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় আমরা কয়েকজন বাঙ্গালী এসসিও হাবিলদার মোস্তফা কামাল; হাবিলদার জমজম আলী হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান; হাবিলদার সৈয়দ আলী তালুকদার এবং কিছুসংখ্যক নায়েক সিপাহী পশ্চিম পাকিস্তানী কয়েকজন এনসিও-র সাথে আলাপ করছিলাম। হঠাৎ ব্যাটালিয়ন হাবিলদার মেজর গুলজার খান পশ্চিম পাকিস্তনীদের চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে আসেন। তাদের এহেন আচরনে আমরা সন্দিগ্ধ হলাম। আমরা আরো সতর্ক হই। কিছুক্ষন পর রাজশাহী সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে একটি মেসেজ আসে। সেটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত অফিসার এবং জোয়ানদের পরিবারকে রাজশাহীতে সরিয়ে ফেলার জন্য এবং বাঙ্গালীদের খতম করে রাজশাহীর দিকে যাবার জন্য। আমাদের বাঙ্গালী অপারেটর এই মেসেজ সমস্ত বঙ্গালীদের জানিয়ে দেয়। এই মেসেজ অফিসারের হাতে পড়ার সাথে সাথে আমাদের উপর হামলা শুরু হয়। গোলাগুলির মধ্যেই তিনজন অফিসার পরিবারসহ পালিয়ে রাজশাহীর দিকে চলে যায়। প্রায় দুই ঘণ্টা গোলাগুলীর পর পরিস্থিতি বাঙ্গালীদের আয়ত্তে আসে এবং অস্ত্রসহ পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে বন্দী করা হয়। গোলাগুলিতে তাদের কিছু লোক মারা যায়; কিছু আহত হয়। আমাদের একজন সামান্য আহত হয়।
ক্যাম্পকে সম্পূর্নরূপে নিজ দায়িত্বে আনার পর বাইরে জনসাধারণ কে খবর দেয়া হয়। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ২/৩ হাজার লোক ক্যাম্পে আসে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। সারা রাত ক্যাম্পের বাইরে এবং ভিতরে চতুর্দিকে ডিফেন্স করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্য। তখন রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট ছিল। আমরা সীমান্তের সমস্ত বিওপিতে অবাঙ্গালীদের গ্রেফতার করে কিছু লোক বিওপিতে থাকি; বাকি সবাই উইং হেডকোয়ার্টারে সমবেত হবার জন্য অগ্রসর হই। ২৭ মার্চ বিকালে ৫ ঘটিকায় আমরা রাজশাহীর বাঙ্গালীর ইপিআর এবং বাঙ্গালী পুলিশদের জীবন রক্ষার্থে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হই। রাজশাহীর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানীরা সমস্ত গোলাবারুদ এবং বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। সেক্টর হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন ইসহাক সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে সতর্ক করে দেন এবং বলেন যে; তোমাদের সাথে আমি অনেক দিন যাবৎ আছি এখানে অনেক কিছু খেয়েছি। তিনি সবাইকে আত্মরক্ষার জন্য দুই মিনিটের মধ্যে চলে যেতে বলেন। ঠিক ঐ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানীরা গোলাগুলি এবং আগুন জ্বালানো শুরু করে দেয়।
নবাবগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে গোদাগাড়ীতে কিছুসংখ্যক লোক ডিফেন্স তৈরি করে। রাত্রে পাকিস্তানিরা আমাদের উপর আক্রমন চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। আমরা আস্তে আস্তে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকি গোলাগুলী চলতেই থাকে। রাজশাহীর কাছিয়াডাঙ্গাতে ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁ থেকে এসে আমাদের সাতে মিলিত হন। সেই সময় আমাদের কোন অফিসার না থাকায় তিনি নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী কোর্ট স্টেশনের নিকট ডিফেন্স থাকাকালীন আমাদের একজন নায়েক আবদুল মালেক শহীদ হন। ক্যাপ্টেন গিয়াস সাহেবের নেতৃত্বে আমরা রাজশাহী শাহর দখল করে নেই। এরপর রাজশাহী সেনানিবাস দখলের জন্য সাঁড়াশী অভিযান শুরু হয়। প্রায়ই আমাদের উপর বিমান হামাল হত-দিনে ৩/৪বার করে। ১৩ই এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত আমরা সেনানিবাসের কিছু জায়গা দখল করে নেই। এই অভিযানে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অধকাংশই নিহত হয়।
রাজশাহী দখলের পরই খবর আসে যে ঢাকা থেকে বিপুল সৈন্য আরিচাঘাট- নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহীর দিকে আগ্রসর হচ্ছে। তাদের পথে বাধা দেয়ার জন্যে আমাদের কিছু লোক-আনসার; মোজাহিদ; পুলিশ ঐদিকে এগিয়ে যায়। নগরবাড়িতে আমাদের লোকের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। আমাদের লোক পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানীদের রাজশাহী পৌছা পর্যন্ত রাস্তার কয়েক জায়গায় আমাদের লোকের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংখ্যায় তারা অধিক থাকায় বহু হতাহতের পরও তারা রাজশাহী পৌছে যায়- বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের সুশিক্ষিত গোলন্দাজ বাহিনী তাদের অনেক গাড়ী ধ্বংস করে। তাদেরও অনেক হতাহত হয়। ১৩ই এপ্রিল শেষ রাতে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর মরণপণ আক্রমন চালায়। আর্টিলারী; পদাতিক এবং বিমান হামলা চলে সম্মিলিতভাবে। তাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা আত্মরক্ষার জন্য পিছু হটতে বাধ্য হই।
পুনরায় আমরা সমবেত হই-চাঁপাইনবাবগঞ্জে। গোদাগাড়ীতে পুনরায় ডিফেন্স নিই। ২২শে এপ্রিল ভোর বেলায় পাকিস্তানীরা আমাদের উপর হামলা চালায়। এখানে পাকিস্তানীদের প্রায় ১৫০টি কনভয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমন চালায়। পরপর কয়েকবার আমাদের উপর পাল্টা আক্রমন হয়। আমাদের বহু লোক এখানে শহীদ হয়।
২৩শে এপ্রিল ভোরে আমরা পদ্মা নদী পার হয়ে হাকিমপুর, পোলাডাঙ্গা এবং সাহেবনগর চরে গিয়ে সমবেত হই। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে সমস্ত লোক পোলাডাঙ্গা ক্যাম্পে একত্রিত হয়।
কানুপুরের যুদ্ধ[২]
রাজশাহী-একাত্তরের ২৯শে এপ্রিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে একদল গেরিলা নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানাধীন পাগলঅ নদীর ওপার থেকে নদী পার হয়ে কানুপুর যাত্রার জন্য তৈরি হয়। রাত তখন নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট; দুর্লভপুর গেরিলা শিবির থেকে বায়রন তার দল নিয়ে যত্রা শুরু করে। সাথীদের সকলের চোখে মুখে যেন কিছুটা নৈরাশ্যের ছাপ। হয়তো মনে হচ্ছিল এই দুঃসাহসিক অপারেশন বুঝি কেউ আর ফিরে আসবে না। পরক্ষণেই তাদের আবার মনে হয়েছে যেমন করেই হোক তাদের এ অপারেশনে সাফল্যলাভ করতেই হবে। কারণ দখলদার নরঘাতক ইয়াহিয়া বাহিনীর কবল থেকে মুক্তির আশায় বাংলাদেশের মানুষ দিন গুনছে। দুটিমাত্র ছোট নৌকা তাদের সম্ভল; অস্ত্রশস্ত্র নৌকায় রাখা আর গেরিলারা নৌকায় ভেসে চলেছে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে পশুহত্যার উল্যাসে। রাত পৌনে এগাটা। শেষ হলো জলে ভাসা। কানুনপুরের কাছে এক আখক্ষেতে নৌকা রাখা হয়। নৌকায় রাখা অস্ত্র তারা হাতে তুলে নেয়। আবার শুরু হয় যাত্রা। এক বুক পানি ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছে। খানিকটা দূর ঘুরে কানুনপুর গ্রামটাকে পেছনে ফেলে এক আম বাগানে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রত্যেককে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়। তারা যখন আম বাগান প্রবেশ করে তখন শিবগঞ্জের খানসেনাদের ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ভেসে আসছিল মুহুর্মুহু গোলাগুলির আওয়াজ। পদপ্রদর্শক ছিল ১১ বছরের একটি বালক; এর নাম জানা যায়নি। প্রথমে যদিও এই বালকের ওপর ভরসা করা যায়নি; কিন্তু সে ভুল ভাঙতে খুব দেরি হয়নি। সে অত্যন্ত গেরিলাদের এগিয়ে নিয়ে গেল-পাঞ্জাবী আর রাজাকারদের ট্রেঞ্চ ও বাংকারগুলো খুব কাছ থেকে দেখিয়ে দিল। ক্রলিং করে গিয়ে পাহারারত রাজাকারকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে গলা টিপে হত্যা করে অস্ত্র কেড়ে নেয় এগারো বছরের বালকটি। এরপর শুরু হয় গেরিলাদের কাজ। অন্যান্য গেরিলারা তড়িৎবেগে দলের নেতার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ আরম্ভ করে দেয়। যে বাংকারে পাঞ্জাবী ছিল সেখানে গ্রেনেড চার্জ করা হয়। বাংকারে তখন তিনজন পাঞ্জাবী ঘুমুচ্ছিল। মাত্র কয়েক সেসেণ্ড। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে বাংকার ধসে পড়ে। পাশের বাংকার গ্রেনেড চার্জ করে হত্যা করা হয় চারজন রাজাকারকে। নিকটে এক বাড়ীতে দু’জন রাজাকার ও তিনজন দালাল ছিল। তারা পালিয়ে পাঞ্জাবীদের কাছে খবর নিয়ে যাচ্ছিল। হাতের রাইফেল তাদের লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠে। অব্যর্থ লক্ষ। মহুর্তে লুটিয়ে পড়ে পাঁচজন মীরজাফর। ইতিমধ্যে পাঞ্জাবীরা টের পেয়ে যায়। প্রায় এক কোম্পানী পাঞ্জাবী ও রাজাকার আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। আখক্ষেতে নৌকায় রেখে আসা হয়েছিল দু জনকে; তারা তাদের সাথীদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের জন্য খানসেনাদের লক্ষ্য করে গোলাগুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। ফলে খানসেনারা হকচকিত হয়ে পড়ে। খানসেনারা ভালভাবে কিছু বুঝতে পারার আগেই গেরিলারা নৌকায় ফিরে শিবিরে ফিরে যায়। কানুপুর অপারেশনে বায়রনের গেরিলা দল একটি এলএমজি; দুটি চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে।
- ↑ ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি তাঁর মেজর থাকাকালীন সময়ে গৃহীত। এই প্রকল্পের জন্য তাঁর ২০-৯৮৩ তারিখে লিখিত ইংরেজী প্রতিবেদনের প্রথমাংশ প্রাসঙ্গিক বোধে এই সাথে সংযোজন করা হলো। প্রতিবেদনের বাকী অংশ ১০ম খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে।
- ↑ দৈনিক বাংলা ২১শে মার্চ ১৯৭২-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত