বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১২

সশস্ত্র প্রতিরোধ: বগুড়া

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১২। বগুড়ায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ ................................ ........................
১৯৭১

বগুড়ার ছাত্র জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ[১]

 বাংলাদেশের প্রতিরোধ সংগ্রামে বগুড়ার ছাত্রসমাজ সারা দেশের ছাত্রদের মুখ উজ্জ্বল করে তুলেছে। বগুড়ার ছাত্ররা এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাদের ছাত্র পতাকাকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যারা এই মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করবেন তাদের এই সত্যটি অবশ্যই স্বীকৃত দিতে হবে। শুধু কলেজের ছাত্ররাই নয় দলে দলে স্কুলের ছাত্ররাও শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পথ নেমে এসেছে। যুদ্ধবিদ্যায় অশিক্ষিত এ কাঁচা বয়সের ছেলেরা একমাত্র দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে অকৃতভোয়ে প্রাণ নিয়েছে; প্রাণ দিয়েছে।

 দেশকে মুক্ত করতে হলে শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে; ছাত্ররা এই সত্যটিকে ভাল করেই বুঝতে পেরেছিল। তাই মার্চের প্রথম থেকে তারা পাড়ায় পাড়ায় প্যারেড আর রাইফেল চালানোর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছিল। ছোট ছোট ছেলেরাও এই ট্রেনিং- এ অংশ নিত। এই ট্রেনিং-এর মধ্য দিয়ে শুধু হাত নয়, হাতের চেয়েও বড় কথা, তাদের মনটাও সংগ্রামের জন্য দেরী হয়ে উঠছিল। এটা শুধু কথার কথা নয়, তারা কার্যক্ষেত্রে এই কথাটিকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছে।

 সারাটা মাস ধরে মিছিলের পর মিছিল চলেছিল। ছাত্রদের মিছিল; শ্রমিকদের মিছিল; চাকুরেদের মিছিল; সাধারণ মানুষের মিছিল-মিছিলের আর শেষ নেই। বগুড়ার আকাশ বাতাস মিছিলের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে দিয়ে এল ২৫শে মার্চ; সেই অবিস্মরণীয় ২৫শে মার্চ। অবশ্য বগুড়া শহরে এই দিনটিতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।

 ২৬শে মার্চ সন্ধ্যেবেলায় ছাত্রদের মিছিল পথে বেরোল; তারই পাশাপাশি লাল ঝাণ্ডাকে সামনে নিয়ে শ্রমিকদের মিছিল চলে এল। ছাত্র আর শ্রমিকদের শ্লোগানে শ্লোগানে বগুড়া শহরের রাজপথে আর অলি-গলি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আসন্ন ঝাড়ের আভাস পেয়ে তাদের মনে আশংকা-মিশ্রিত উত্তেজনা।

 খবর এসেছে ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ভেঙ্গে গেছে। এবার এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে; সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঘটনার গতি প্রবাহে এক ভীষন সংগ্রামে অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়বে।

 সেই দিন রাত দুটোর সময় খবর এসে পৌছাল; রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে একদল সৈন্য বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এর তাৎপর্য সুস্পষ্ট; ওরা ওদের হিংস্র থাবা বিস্তার করে আক্রমণের জন্য ছুটে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামকে অংকুরেই চূর্ন করে ফেলবার জন্য ওরা ওদের এই অভিযান শুরু করেছে।

 খবরটা দেখতে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসল। ইতিমধ্যে পথে আওয়াজ উঠেছে- প্রতিরোধ চাই; প্রররোধ। ছাত্র আর শ্রমিকদের মিছিল বেরিয়ে গেছে। তারা সারা শহরের পথে পথে ঘুরে প্রতিরোধ সংগ্রামের আওয়াজ তুলেছে। সেই আওয়াজে ঘরের মানুষ ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে।

 শত্রুদের প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করার মত অস্ত্র কোথায়? ছাত্রেরা দল বেঁধে থানায় গিয়ে সেখান থেকে সমস্ত রাইফেল বের করে নিয়ে এল। শুধু তাই নয়; শহরে যার যার হাতে যত বন্দুক ছিল; তোর সবাই তাদের হাতে চলে এসেছে। এ অবস্থায় কোন দিকে থেইে তারা ভাধা বা আপত্তি পায়নি। সবাই যে যার বন্দুক তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ছাত্রেরা সেই সমস্ত অস্ত্র নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। এই ক'দিনে তারা রাইফেল চালানোর ব্যাপারে যে ট্রেনিং পেয়েছে তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। তা হোক; সংগ্রামে নেমে এসেছে; এখন আর অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার সময় নেই, তাদের যতটুকু বিদ্যা সেই টুককেই কাজে লাগাতে হবে।

 সারা শহরের পথি বহু ব্যারিকেড গড়ে উঠেছে। এই ব্যারিকেড গড়ে তোলার ব্যাপারে শত শত হাত অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে। ছাত্র আর শ্রমিকরা সবাইর আগে; সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। বড় বড় গাছ কেটে শহরের প্রবেশ মুখ-বন্দ করে দেয়া হচ্ছে। কাজের বিরাম নেই। এইভাবে রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়ে এল; তখনও কাজ চলছে। হ্যা; সকল দিক দিয়ে ওদের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিত হবে; ওদের আক্রমণকে অচল করে ফেলতে হবে।

 সৈন্যরা মহাস্থানগড় হয়ে বগুড়া শহরের দিকে মার্চ করে চলে আসছিল। ওরা সকালবেলা বগুড়া শহরের সামনে এসে পৌছল। শহরে ঢোকার একমাত্র পথ সুবিলখালের পুল। ওরা সেই পথ দিয়েই চলে এল। ছাত্র আর শ্রমিকরা সেখানে হানাদার শত্রু সৈন্যদের দৃষ্টির আড়ালে পজিশন নিয়ে দাড়িয়েছিল। সৈন্যরা ব্যারিকেড সরিয়ে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আসছিল। গোপন আশ্রয়ের আড়াল থেকে ছাত্র আর শ্রমিকরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। হানাদার সৈন্যরা কালিতলাহাট হয়ে ঝাউতলা রোড ধরে বড়গোলা মোড়ে আসে। এখানে আগে থেকেই অনেক ছত্র পজিশন দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যরা এখানে এসে পৌছবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল গুলিবর্ষনের সম্মুখীন হোল। ফলে এখানে একজন কর্ণেলসহ ১১জন সৈন্য মারা যায়। সৈন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। একই ভাবে পাক সৈন্যরা অনেকক্ষণ ধরে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। বেলা যখন সাড়ে বারোটা তখন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র টিপু শত্রুসৈন্যের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মাড়া যায়। দুটি ইউনাইটেড ব্যাংক অফিসের দোতলায় দাঁড়িয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। মাত্র পনের বছর তার বয়স। বগুড়া শহরের স্কুলের ছাত্রদের সে ছিল নেতা। সবাই তাকে চিনত জানত; সবাই তাকে ভালবাসত। গত এক মাসের মুক্তি আন্দলোনে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসের পরিচয় দিয়ে সে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছিল। বীর কিশোর টির যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিল। শুধু সে-ই নয় তারই মত বগুড়ার আরও কয়েকটি বীর সন্তানকে সেদিন এই মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছে।

 আজাদুর রহমান নামে এক তরুন ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং বিল্ডিং-এ আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করছিল। শত্রুদের গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। আজাদ একটি প্রেস চালাত; তারই সাথে সাথে লেখাপড়াও করত। বগুড়ার মানুষ এই সমস্ত বীর শহীদের কথা ভুলে যেতে পারেনি। আরও একজন শহীদের নাম এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। তার নাম হিরু। এই হিরুও সেদিন তাদের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিল। হিরু কিন্তু একজন বিহারীর সন্তান। বগুড়ার বিহারী কলোনীতে তার জন্ম; সেইখানেই সে বাস করত। তাহলেও জন্মভূমি বাংলাদেশকে সে তার মাতৃভূমি বলে মনোপ্রাণে গ্রহন করে নিয়েছিল এবং এই মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে সে শাহাদৎ বরণ করল। বিহারী কলোনীর মধ্যেই হিরুর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়।

 টিটু, আজাদুর রহমান ও হিরুর মৃত্যুর পর পাক সৈন্যরা দু'ভাগে ভাগ হয়ে দক্ষিণ দিকে এগুতে থাকে। একদল ঝাউতলার মধ্যে দিয়ে যায়; আর একদল যায় রাজাবাজার দিয়ে। এরা রেল লাইনের কাছে এসে গেলে ছাত্ররা ওদের চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এইভাবে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যরা বেলা দেড়টার সময় পেছনে হাটতে থাকে। সৈন্যরা তাদের মনের ঝাল মেটাবার জন্য বেশ কিছু লোককে ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তারা ওদের সবাইকে গুলি করে মারে এবং তাদের মৃতদেহ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। এছাড়াও এরা রেল লাইনের কাছে পাচঁজন হোটেলের বয়কে মেরে ফেলেছিল।

 তার পরদিন ২৭শে মার্চ তারিখে সৈন্যরা বগুড়ার কটন মিল মহিলা কলেজ; নাইট কলেজ আযিযুল হক সরকারী কলেজের পুরাতন ভবন এবং বেতার ভবন দখল করে সেসব জায়গায় ঘাটি গেড়ে বসল। তারপর তারা মহিলা কলেজ ও রেস্টহাউসের চারতলা বাড়ি থেকে মর্টার শেল রকেট এবং মেশিনগানের সাহায্যে শহরের উপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে সারাটা দিন কাটল। তার পরদিনও তারা শহরের লোকদের উপর নানাভাবে আক্রমন চালিয়ে যেতে লাগল।

 মোঝে মাঝে এখানে-ওখানে ছাত্রদের সঙ্গে গুলি বিনিময় চলছিল। দুপুর বেলা সৈন্যরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যায় এবং সেখান থেকে লোককে ধরে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে কিছু লোককে মেরে ফেলা হয়। এরা বাকী লোকদের সঙ্গীন উঁচিয়ে প্রাণের ভয় দেখিয়ে ব্যারিকেড সরিয়ে নেবার কাজে লাগায়। বেলা ৩টার সময় এই সৈন্যরা হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরীর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় ম্যাচ ফ্যাক্টরীরর ভেতর থেকে ওদের উপর গুলিবর্ষণ হতে থাকে। সৈন্যরা প্রতিহিসংসার বশবর্তী হয়ে হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই আগুন সঞ্চিত বারুদের গাদায় গিয়ে লাগতেই এক বিরাট অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। এবং নিকটবর্তী বাড়ীগুলোতে আগুন ধরে যায়।

 বেতার ভবনের পেছন দিককার পাড়াটা বৃন্দাবনপাড়া নামে পরিচিত। সৈন্যরা ২৯শে মার্চ তারিখে সেই পাড়ার উপর গিয়ে হামলা করে। সেখান থেকে তারা চাল হাল থেকে শুরু করে মোরগ; খাসি গরু পর্যন্ত লুটপাট করে নিয়ে আসতে থাকে। এরা সেখানে ঘরে ঘরে আগুন দিয়ে মজা দেখে এবং মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। এর ফলে সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ছাত্রজনতা এদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমন চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধদের মধ্যে কলিমুদ্দীন নামে এক পুলিশ ও একটি চাত্র নিহত হন। এই কুলিমুদ্দীনই সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমন পরিচালনা করছিল।

 পরদিন ৩০শে মার্চ তারিখেও এরা আগেকার মতই চারদিকে এলোপাতাড়ি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। সেদিনও রাত্রিবেলায় তারা রেস্ট হাউসের উপর থেকে মর্টার শেল; বোমা ও রকেট ছুড়ে শহরের নানান জায়গায় অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। ফলে কিছু লোকও মারা য়ায়। কিন্তু ওরা অস্ত্রের দাপটে যতই প্রতাপ দেখাক না কেন; ওদের মনোবল ক্রইে কমে আসছিল। এই ক'টি দিনে ছাত্র ও সাধারন মানুয়ের আক্রমণের ফলে ওদের চল্লিশজন সৈন্য মারা গেছে। এমন যে হতে পারে এটা ওরা ভাবতেই পারেনি। এইভাবে যদি মৃত্যুর হার বেড়ে চলতে থাকে; তবে আর কিছু দিনের মধ্যেই সম্পূর্নভাবে বিনাশ হয়ে যেতে হবে। ওদের মনে ত্রাসের সঞ্চার হচ্ছিল বুঝতে পারছিল যে তারা ওদের সঙ্গে উঠতে পারছে না। তাই শেষ পর্যন্ত ওরা শহর থেকে পাত্তা গুটিয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করল। তার পরদিনেই ওরা চোরের মত চুপিচুপি শহর ছেড়ে চলে গিয়ে রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে যাত্রা করল। ওরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল তার চারদিকের গ্রামগুলিতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল।

 এই পলাতকের দল যখন কাটাখালিতে পৌছাল তখন স্থানীয় ছাত্ররা ওদের পথরোধ করার জন্য কাটাখালি পুলটাকে ভেঙ্গে ফেলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওদের ভাগ্য ভাল সময়ের অভাবে ছাত্রেরা একটুর জন্য তাদের কাজটাকে শেষ করতে পারেনি।

 সৈন্যরা কাটাখালি থেকে মানে মানে প্রাণ নিয়ে সরে পড়তে পারল বটে; কিন্তু আরও কিছুদূর এগোবার পর ওদের বাধা পেয়ে থমকে দাড়াঁতে হোল। জায়গাটার নাম গোবিন্দগঞ্জ। এখানে বহু স্থানের ছাত্র আক্রমণমুখী হয়ে ওদের পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। কি দুঃসাহসী এই ছাত্রের দল। আগ্নেয়াস্ত্র বলতে অতি সামান্যই ওদের কাছে ছিল। আর যা ছিল তা হচ্ছে লাঠি-সোটা বর্শা বল্লম এই সমস্ত হাতিয়ার। তাই নিয়ে ওরা মেশিনগানের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল। এই সংঘর্ষে অনেক ছাত্র হতাহত হোল। কিন্তু সৈন্যরাও অক্ষত অবস্থায় চলে যেতে পারেনি। ওদের মধ্যে সাতজন ছাত্রদের হাতে ধরা পড়ল। বাকী সবাই প্রাণ নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল।

 এদিকে বগুড়া মিলিটারী ক্যাম্পে আর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে চলেছিল। ক্যাম্পটা বগুড়া শহর থেকে আট মাইল দূরে। ক্যাম্পে সৈন্যদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল বাঙ্গালী। কিন্তু অফিসাররা সবাই পাঞ্জাবী; অফিসাররা বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে রেখেছিল। আর তাদের মধ্যে যারা তাদের নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল; তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

 ব্যাপারটা ক্যাম্পের বিতরে ঘটলেও এই খবর চাপা রইল না, দেখতে দেখতে সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। খবর পেয়ে ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এল। শুধু শহরের ছাত্ররা যে এল তাই নয়, চারদিককার গ্রামাঞ্চলের বহু ছাত্র এসে সেখানে জমল।

 ক্যাম্পের ভিতরে অবরুদ্ধ বাঙ্গালী সৈন্যদের এই দুর্দশার কথা জানতে পেরে গ্রামাঞ্চলের লোকদের মধ্যে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ক্যাম্পে পাঞ্জাবী অফিসারদের খতম করে দেয়ার জন্য তারাও এসে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিল। খালি হাতে আসেনি কেউ; যে যার হাতিয়ার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কৌতূহলী দর্শক নয় তারা; জীবন পণ করে লড়াই করতে এসেছে। শেরপুর; নন্দীগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল হতে হাজার হাজার লোক এসে ক্যাম্পটাকে ঘেরাও করে ফেলল।

 লোকসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০ হাজার উঠে পড়ল। পর পর ক'দিন তারা এই অবরোধ চালিয়ে গেল। ছাত্ররা অফিসারদের আত্মসমর্পণ করার জন্য আহবান জানাল। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজী হতে চায় না। তারা ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষের উপর ভরসা করে শক্ত হয়ে বসে রইল। ইতিমধ্যে এই খবর ঢাকায় গিয়ে পৌছেছে ঢাকা থেকে উড়ে এল বোমারু বিমান জনতাকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়তে লাগল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। মানুষ ক্ষেপে আগুন হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার উত্তেজিত জনতার চাপে অফিসারদের বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হোল। পরে এই অফিসারদের বগুড়ার রেলগেটে এনে গুলি করে মারা হয়।

সশস্ত্র প্রতিরোধ বগুড়া

সাক্ষাৎকার: গাজীউল হক

২১-০৮-৮৩

 ১৯৭১ সাল। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা। এমদাদুল হক নামে এক তরুন এসে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। এক্ষুনি থানায় যেতে হবে; জরুরী খবর আছে। খবর এসেছে পাকসেনা বগুড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। দু'মিনিটে তৈরি হয়ে নিলাম। চিন্তা ভাবনার ফুরসৎ নেই। ছুটতে হলো ডাঃ জাহিদুর রহমান (এমপি) তাঁর বাড়িতে দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। ডাকতেই নেমে এলেন। তাকে নিয়েই ছুটতে ছুটতে থানায় হাজির হলাম।

 আধো আলো আধো অন্ধকার বগুড়া কোতাওয়ালী থানার আঙ্গিনায় ২০/২৫ জন লোক দাড়িয়ে। সামনে এগিয়ে এলেন মকবুল সাহেব (ইণ্টেলিজেন্স ব্যাঞ্চের অফিসার) তিনি জানালেন অয়ারলেসে খবর এসেছে পাকসেনারা রাজারবাগ এবং পীলখানা আক্রমন করেছে। রাজারবাগ এবং পীলখানায় প্রতিরোধ চলছে। এদিকে রংপুর থেকে পাকিস্তানী সৈন্য বগুড়ার দিকে এগিয়ে আসছে।

 নিজেকে ভীষণ অসহায় বোধ করছিলাম। আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলাম না। কোন রাজনৈতিক দলের নেতাও নই। সুতরাং এ অবস্থায় আমার দায়িত্ব কতখানি বুঝতে না পেরে বিব্রত বোধ করছিলাম। ডাঃ জাহিদুর রহমানের অবস্থাও আমার চাইতে বিশেষ সুবিধেয় নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি সম্পূর্ন নতুন। ৭০ সালেই নির্বাচনের আগে সক্রিয় রাজনীতেতে এসছেন এবং পার্লামেণ্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবুও কর্তব্য সমন্ধে যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলেন; বললেন; এখন সকলকে ডেকে সিদ্ধান্ত নেবার সময় নেই। প্রতিটি মুহুর্তই মূল্যবান। সুতরাং আপনাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। “মকবুল সাহেব; অফিসার ইন-চার্য নিজামউদ্দিন সাহেব এবং থানার অন্যান্য পুলিশ কর্মচারীগণেরও একই মত। সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেললাম। হঠাৎ যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো “অল রাইট; আই এসিউম দি কমাণ্ড। উই শ্যাল রেসিস্ট দি পাকিস্তানী আর্মি।”

 কিছুক্ষনের জন্য আলোচনা হলো বগুড়া থেকে আট মাইল দক্ষিণে আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট। রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট উত্তরে। মকবুল সাহেব বললেন; আড়িয়াতে পাকসেনার সংখ্যা খুব বেশী নয়। সুতরাং তারা হঠাৎ কিছু করবে না। তাছাড়া; অয়ারলেসে খবর এসেছে রংপুর থেকে পাক আর্মি আসছে। মনে পড়লো ২৫শে মার্চের সন্ধ্যার সময় ছত্রলীগের সামাদ এবং ছাত্র ইউনিয়নের রেজাউর রহমান ডিংগুর নেতৃত্বে বগুড়া আড়িয়া সড়কের মাঝখানে কটকির সংকীর্ণ পুলের উপর গাছ কেটে ফেলে এবং ইটের স্তূপ সাজিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিলো। সুতরাং শহরের উত্তরে বগুড়া-রংপুর সড়কের ব্যারিকেড দিতে হবে। ব্যারিকেড বাধা পেলে হয়তো রাতে তারা আর এগুবে না। শহরবাসীদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অন্ততঃ সকাল পর্যন্ত সময় চাই। (আমাদের চিন্তায় ভুল ছিলো না সেটা পরে প্রমাণিত হয়েছে। শহর থেকে তিন মাইল উত্তরে মাটিডালীতে ব্যারিকেড দেখে পাকিস্তানী সেনারা রাতে শহরে ঢুকতে সাহস করেনি)।

 দারোগা নিজামউদ্দিন এবং নুরউল ইসলাম তিনজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে রাইফেল হাতে নিৰ্দেশমত আজাদ গেস্ট হউসের ছাদে ঘাঁটি গাড়লেন। পাকিস্তানী সেনা রেললাইন পার না হওয়া পর্যন্ত তারা আক্রমণ চালাবেন না এই নির্দেশ তাদের দেয়া হলো পুলিশ ফোর্সের অন্যান্যদের অস্ত্রশস্ত্র পুলিশ লাইনে পাঠিয়ে দিলাম। মকবুল সাহেব চলে গেলেন অয়ারলেসে আর কোথাও যোগাযোগ করা যায় কিনা সে চেষ্টা চালাতে।

 থানা থেকে বেরোতেই দেখি থানার গেটে ২০/২৫ জন ছাত্র-যুবক জমায়েত হয়েছে। খবর তারাও পেয়েছে। তাদের নিয়ে ডাঃ জাহিদুর রহমান এবং আমি ছুটলাম উত্তর দিকে। যত দ্রুত সম্ভব মাটিডালী পৌঁছতে হবে। ব্যারিকেড দিয়ে প্রথম বাধার সৃষ্টি করতে হবে। শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শ্লোগান উঠলো। জাগো জাগো বীর বাঙ্গলী জাগো জয় বাংলা; বীর বাঙ্গালী হাতিয়ার ধরো; পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করো।

 ছুটছি, রীতিমতো দৌড়াচ্ছি। পাকিস্তানী সেনারা যে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে সে রাস্তা দিয়ে ছুটছি। পাগলের মতো চীৎকার করছি সবই ঘুম থেকে জেগে উঠুন। পাকিস্তানী সেনারা আসছে। যাদের বন্দুক আছে, তারা বন্দুক হাতে বেরিয়ে আসুন। পাকিস্তানী সেনাদের ঠেকাতে হবে।

 মাটিডালী এসে পৌছলাম। শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। শ্লোগান দিতেই মুস্তাফিজুর (বাবু) সহ অনেকেই রাস্তায় বেরিয়ে এলো। ব্যারিকেড দেবার কথা বলতেই ১৫/২০ খানা কুড়াল নিয়ে গাছ কাটা শুরু হয়ে গেলো। রাস্তার দুপাশের লোকজনদের বাড়ী ছেড়ে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো (পাক সেনারা ব্যারিকেড দেখে ওখানকার অনেক বাড়ীই পুড়িয়ে দিয়েছিলো)। একট বিরাট গাছ রাস্তা জুড়ে পড়ার পর আবার ছুটলাম শহরের দিকে। মাটিডালিতে তখন আরো গাছ কাটা এবং ব্যারিকেড রচনার কাজ চলছে।

 ২৬শে মার্চের ভোর। পূর্ব আকাশে সূর্য মাত্র উকি দিয়েছে। ডাঃ জাহিদুর রহমানের বাড়ীতে সামনে রাস্তায় মাহমুদ হাসান খান একা দাঁড়িয়ে আছেন। মাহমুদ হাসান খান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর সবাই কোথায়? জিজ্ঞেস করতে ঘাড় নেড়ে জানালেন; জানেন না শুধু বললেন হাবিবুর রহমান (এমপি) আত্মসমর্পন করার পক্ষপাতী। (পরবর্তীকালে হাবিবুর রহমান পাক সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের সহযোগিতা করেছিলেন)।  “না তা চলবে না।” ডঃ জাহিদুর রহমান রীতিমতো ক্রুদ্ধ। মামুদুল হাসান খানকে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পাঠিয়ে ডাঃ জাতিদুর রহমানসহ দু'খানা সাইকেলে ছুটলাম পুলিশ লইনের দিকে। পথে দেখা করলাম জেলা প্রশাসক খানে আলম খান সাহেবের সঙ্গে; দেখলাম ভীষণ উদ্ধিগ্ন। বললেন সম্মুখযুদ্ধে ওদের সাথে পারবেন না। গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন। আপনদের সাফল্য কামনা করি ।  এরপর পুলিশ লাইন। পুলিশ লাইনের মকবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। জানালেন অয়ারলেসে কুষ্টিয়া ছাড়া আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। কুষ্টিয়ার শেষ খবর হানাদার বাহিনী কুষ্টিয়া আক্রমণ করেছে। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

 রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে পুলিশ লাইনে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। স্থির হলো ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পুলিশ লাইনে তারা প্রস্তুত থাকবেন। সেকেণ্ড লাইন অব ডিফেন্স।

 শহরে যখন ফিরে আসি তখন সকাল সাতটা। রাস্তায় লোক নেমে পড়েছে। কিন্তু অস্ত্রের সংখ্যা অতি নগণ্য। একনলা, দোনলা বন্দুক এবং টু-টু রোব রাইফেলসহ মাত্র আটাশটি। শুধু আজাদ গেস্ট হাউসের ছাদে দারোগা নিজামউদ্দীন এবং তার সঙ্গীর কাছে পাঁচটি ৩০৩ রাইফেল। যে দুরন্ত সাতাশটি ছেলে আমার সঙ্গে ২৬শে মার্চের ভোরে অকুতোভয়ে হানাদার বর্বর পাক বাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছিলো; তাদের সকলের ভাল নাম হলো; (১) এনামুল হক তপন (২) আব্দুল জলিল (৩) এমদাদুল হক তরুন (৪) নূরুল আনোয়ার বাদশা; (৫) শহীদ টিটু; (৬) শহীদ টিটলু; (৭) শহীদ মোস্তাফিজ (ছনু);(৮) শহীদ আজাদ; (৯) শহীদ তারেক (১০) শহীদ খোকন পাইকাড়; (১১) সালাম (স্বাধীনতার পরে আততায়ীর হাতে নিহত); (১২) বখতিয়ার হোসেন বখতু (আর্ট কলেজের ছাত্র); (১৩) খাজা সামিয়াল (১৪) মমতাজ (বর্তমানে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক); (১৫) রাজিউল্লা (১৬) টি এম মূসা (পেস্তা) (১৭) নান্না (১৮) সৈয়দ সোহরাব; (১৯) শহীদ বকুল (২০) বুবলা (২১) জাকারিয়া তালুকদার (২২) মাহতাব (২৩) টাটরু (২৪) বুলু (২৫) বেলাল (২৬) এ কে এম রেজাউল হক (রাজু); (২৭) ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ।

 কালীতলা থেকে রেল লাইনের দু'নম্বর ঘুমটি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দেয়ালের আড়ালে ছোট ছোট দলে ভাগ করে এদের দাঁড়াবার নির্দেশ দিলাম। কিন্তু এই নির্দেশ ভেঙ্গে টিটু, হিটলু এবং মুস্তাফিজ বড়গোলায় ইউনাইটেড ব্যাংক (বর্তমানে জনতা ব্যাংক)-এর ছাদে ঘাঁটি গেড়ে প্রতিরোধ করে এবং সেখানেই তারা শহীদ হন। তপন, সামিয়াল এবং বখতু ও জলিলসহ চারজনের একটি দল কলীতলার মুখে প্রথম প্রতিরোধের জন্য ঘাটি গাড়লো। প্রত্যেককে নির্দেশ দিলাম গুলী করার সঙ্গে সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে এক আড়াল থেকে সরে যেতে হবে অন্য আড়ালে। যুদ্ধ চলাকালীন যোগাযোগ রক্ষা; সংবাদ আদান-প্রদান এবং নির্দেশ পৌছানোর দায়িত্ব নিলো একরামুল হক স্বপন, মঞ্জু (শহীদ আজাদের ভাই), ছাত্র লীগের সামাদ, বিলু (মরহুম আকরব হোসেন আকন্দ সাহেবের ছেলে), সৈয়দ কেরামত আলী গোরা (পরবর্তী কালে পাক সেনাদের হাতে নিহত হন) এবং আবু সুফিয়ান (পরবর্তিকালে পাক সেনাদের হাতে শাহাদাত বরন করেন) সত্যি বলতে কি আমার নিজেকে একজন সেনাপতি সেনাপতি মনে হচ্ছিলো। আমার সেই নির্বোধ সেনাপতির ভূমিকার কথা মনে হলে এখন হাসি পায়।

 ২৬শে মার্চের সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পাক সেনা সুবিল পার হয়ে বগুড়া শহরে ঢুকলো। সুবিল পার হবার আগে মাটিডালি; বৃন্দাবনপাড়া এবং ফুলবাড়ী গ্রামের কিছু কিছু বাড়ী তারা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিলো। শহরে ঢুকবার পর পাক সেনাদল রাস্তার দু'পাশ দিয়ে দুটো লাইনে এগুতে শুরু করে। সুবিল (করতোয়ার একটি খাল) পার হবার পর কোন প্রতিরোধ না পেয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই তারা এগুচ্ছিলো। রাস্তা জনশূন্য; কোন বাধা নেই। কিন্তু কালীতলাহাট পার হবার পরপরই দেয়ালের আড়াল থেকে তপনের হাতের বন্দুক আচমকা আগুন ঝরালো। অব্যর্থ নিশানা। লুটিয়ে পড়লো একজন পাকসৈন্য। তপনই বগুড়ার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা যার অস্ত্র বগুড়ার মাটিতে প্রথম পাক সেনার রক্ত ঝরালো। গুলি করেই তপন এবং তার সঙ্গীরা স্থান ত্যাগ করে আর এক দেয়ালের আড়ালে চলে যায়। হঠাৎ আঘাত পেয়ে বিচলিত পাক সেনা এলোপাতাড়ি গুলী চালাতে চালাতে এগিয়ে চলে। জামিলের বাড়ি পার হতেই আবার রাস্তার দু'পাশে দেয়ালের আড়াল থেকে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠলো। এখানে দজন পাকসেনা গুরুতর জখম হয়। কিন্তু বগগোলা পার হবার পর প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলো পাকসেনা। ঝাউতলা বোম্বে সাইকেল স্টোরের পাশ থেকে গুলী করে সরে যাবার সময় গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো আজাদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে বগুড়ার মাটিতে আজাদই প্রথম শহীদ। উক্ত পাকসেনা রাস্তার পাশের ছোট চায়ের দোকানের ঝাপ তুলে দুটো কিশোর কর্মচারীকে গুলী করে মারলো।

 পাকসেনারা রেল লাইনের দু'নম্বর ঘুমটির কাছে আজাদ রেস্ট হাউসের ছাদ থেকে দারোগা নিজামউদ্দীন, দারোগা নুরুল ইসলাম এবং তাদের সহযোগীদের ৩০৩ রাইফেল গর্জে উঠলো। সম্মুখ দিক এবং দু' পাশ থেকে আক্রান্ত হয়ে হানাদার সৈন্যরা থমকে দাঁড়ালো। কিছুটা পিছু হটে এলো তারা। এমনি সময়ে বড়গোলার ইউনাইটেট ব্যাঙ্কের ছাদের ওপর থেকে তিনটি বন্দুক গর্জে উঠলো। উৎসাহের বলে নির্দেশ অমান্য করে সকলের অজান্তে ব্যাঙ্কের ছাদে পজিশন নিয়েছিলো টিটু, হিটলূ এবং মুস্তাফিজ(ছ)। দু'জন পাকসেনা জখম হলো। পেছন দিকে থেকে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে হানাদার সেনাদল বিচলিত হয়ে পড়ে। পিছু হটে দ্রুত তারা ব্যাঙ্ক ভরনটি ঘিরে ফেলে। টিটু, হিটলূ এবং ছনু সরে যাবার সুযোগ পেল না। শহীদ হলো বগুড়ার আর তিনটি দামাল ছেলে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ বর্বরহানাদার সেনারা দ্রুত পিছু হটে শহর ছেড়ে গেলো। সুবিলের উত্তর পাড়ে পূর্ব বিভাগের ডাকবাংলা এবং মহিলা কলেজে অবস্থান নিলো তারা।

 রাস্তায় বের হয়ে এলো বগুড়া শহরের লোক। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনে আমাদের ছেলেরা প্রাণ দিয়েছে। সেজন্যে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু তার সঙ্গে মিলে আছে জয়ের আনন্দ, এক অভূতপূর্ব আশ্বাদ। বর্বর হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করেছি আমরা। তাদের হটিয়ে দিয়েছি, জয়ী হয়েছি।

 ২৬শে মার্চেরই অপরাহ্ণে একরামুল হক স্বপন; ফজলার রহমান (ফুলবাড়ী) এবং চন্দন এসে খবর দিলো যে তারা একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন যোগাড় করেছে। সুতরাং বুলেটিন সাইকক্লোস্টাইল করে বিলি করা যায়। বুলেটিনের খসড়া দিলাম। এক পাতার বুলেটিন সন্ধ্যের সময় শহরে ছাড়ানো হলো। হেডলাইন ছিলো “প্রথম দিনের যুদ্ধে বগুড়াবাসীর জয়লাভঃ পাঁচজন পাকসেনা নিহত”। এরপর ছিলো এক সর্বাত্মক যুদ্ধের আহবান। সবশেষে ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নির্দেশ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। মাটিডালিতে যখন ব্যারিকেড দিয়ে ফিরে আসিছিলাম তখন দত্তবাড়ীর সম্মুখে অয়ারলেস অফিসের একজন লোক ডাঃ জাহিদুর রহমানের হাতে একটা কাগজ দিয়ে যায়। মেসেজটি রাতে পেয়েছিলো বলে জানায়। লাল কালিতে লেখা। যতদূর মনে হয় বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়াবে? “এটি আমার নির্দেশ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। শত্রুসৈন্য আমাদের আক্রমন করেছে। বাংলার মানুষ তোমরা যে যেখানে আছ; যার হাতে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে রুখে দাড়াও। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় না পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে”। এই নির্দেশটিও বুলেটিনে জুড়ে দিয়েছিলাম। বুলেটিন অবশ্য আমাদের তরফের ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করিনি। কারন ভেবেছিলাম তাতে সাধারণ মানুষ ভয় পেতে পারে। এর পর থেকে প্রতিদিন আমরা বুলেটিন বের করতাম। এমন কি প্রচুর গোলাবৃষ্টির মধ্যেও স্বপন ডিকটেশন নিত। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বুলেটিন সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপা হয়ে শহরে ছড়ানো হতো। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বুলেটিন বের হতো। বুলেটিনের বিশেষ দায়িত্ব ছিলো একরামুল হক স্বপন; চন্দন ধলু এবং সৈয়দ কেরামত (গোড়া)-এর ওপর।  ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় বাদুড়তলার একটি বাড়ীতে যুদ্ধ পরামর্শ সভা বসলো। আলোচনা শেষে জনাব মোখলেসুর রহমানের প্রস্তাবক্রমে পাঁচ সদস্যের একটি হাই কমাণ্ড করা হলোঃ

 (১) গাজীউল হক (অদলীয়); সর্বাধিনায়ক; (যুদ্ধের দায়িত্ব)

 (২) ডাঃ জাহিদুর রহমান (আওয়ামী লীগ) (খাদ্য এবং চিকিৎসার দায়িত্ব)

 (৩) জনাব মাহমুদ হাসান খান (আওয়ামী লীগ) প্রশাসন

 (৪) জনাব মোখলেসুর রহমান (মোজাফফর ন্যাপ); যোগাযোগ

 (৫) জনাব আব্দুল লতিফ (কম্যুনিস্ট পার্টি) প্রচার। ২৬শে মার্চ রাতেই আমরা সুবিলের দক্ষিণ পাড়ে ঘাটি স্থাপন করলাম।

 ২৭শে মার্চ সকাল আটটা। সুবিলের উত্তর পাড় থেকে পাকসেনারা গুলীবর্ষণ শুরু করে। পাল্টা জবাব দেয় আমাদের ছেলেরা। এই দিন ঝণ্টু; মাহমুদ; ডঃ টি; আহমদের ছেলে মাসুদ; গোলাম রসুল; বিহারীর ছেলে (নামটি মনে নেই); রশীদ খানের ছেলে গুলার; রেডিও; রফিকুল ইসলাম লাল; শহীদ আবু সুফিয়ান রানা এবং আরো অনেকে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডঃ জাহিদুর রহমান পুলিশ লাইন থেকে বাহিনীর ৬০ জনের এক দলকে নিয়ে এলেন। ৩০৩ রাইফেল হাতে আমাদের ছেলেদের পাশাপাশি তারাও অবস্থান নিলেন। দুই পক্ষে প্রচণ্ড গোলাবৃষ্টি হলো। গোলাবৃষ্টির মধ্যেই হানাদার বাহিনী সড়ক ধরে এগিয়ে এসে শহরের উত্তর প্রান্তে কটন মিল দখল করলো। (তখন বগুড়া শহরের উত্তর সীমার প্রান্তে ছিল কটন মিল)। পুলিশ এবং আমাদের ছেলেদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে শহরের ভিতরে বেশী এগিয়ে আসতে পারলো না হানাদার। এদিনের যুদ্ধে পাকসেনারা ভারী মেশীনগান ব্যবহার করে এবং মর্টারের গোলাবর্ষন করে। বিকেল তিনটার মর্টারের গোলার আঘাতে শহীদ হলো তারেক; দশম শ্রেণীর ছাত্র। মৃত্যুর সময়েও তার হাতে ধরা ছিলো একটি একনলা বন্দুক। তারেকের রক্তে ভিজে গিয়েছিলো আমার বুক। মনে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধড়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম।

 ২৭শে মার্চ বিকেলে বাদুড়তলায় একটি খাদ্য ক্যাম্প বসানো হলো এবং তার সঙ্গে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রও খোলা হলো। খাদ্য ক্যাম্পের দায়িত্ব নিলেন মিউনিসিপ্যাল কমিশনার জনাব আমজাদ হোসেন এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য মোশারফ হোসেন মণ্ডল; বাদুড়তলার আবু মিয়া, আবেদ আলী; মজিবর রহমান এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতেন। প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শহীদ ডাঃ কছিরউদ্দীন তালুকদার সাহেব। তিনি এক সময়ে বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ঐ সময়ে বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে যেভাবে তিনি এগিয়ে আসেন একজন চিকিৎসক হিসাবে তা বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনযোগ্য। তাঁর বাড়িটিও আমাদের শেলটার হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পাক সেনা বাহিনীর হাতে তিনি শাহাদৎ বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বগুড়ায় প্রয়াত প্রবীণতম মুসলিম লীগ নেতা ডাঃ হাবিবুর রহমানও সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেন। ২৭শে মার্চ রাতে খবর পলাম একজন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করছেন।

 ২৮শে মার্চের সকাল। কটন মিলের গেস্ট হাউসের ছাদে পাকসেনারা মেশিনগান বসিয়েছে। তখনো গোলাগুলি শুরু হয়নি। মেশিনগানের পাশে দু জন পাকসেনা দাঁড়িয়ে। একজন পাকসেনা ছাদের রেলিং এ ভর দিয়ে কি যেন দেখছে। দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে দুরন্ত ছেলে তপন রাইফেল তুললো। অব্যর্থ লক্ষ্য। ছাদের ওপর থেকে পাকসেনাটি ছিটকে পড়লো মাটিতে। পিছু হটে তপন লাফিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের নর্দমায়। নর্দমার দেয়াল ঘেষে সরে এলো আড়ালে।  শুরু হলো এলোপাতাড়ি গোলাবৃষ্টি। ২৮শে মার্চে মুক্তিসেনারাও দলে বারী। মিণ্টু, ডিউক লিয়াকত (পরে রাজাকার হয়ে যায়), আব্দুর রহমান, মামুন (হক সাহেবের কম্যুনিষ্ট পার্টির), হারুন (ব্যাঙ্ক অফিসার), ধুলু বজলু, মুকুল, সাত্তার রশীদ (রশীদ গুণ্ডা নামে খ্যাত ছিলো) এবং গ্রাম থেকে প্রায় শ'খানেক বন্দুকসহ এসে যোগ দিয়েছে। প্রচণ্ড প্রতিরোধ সত্বেও ভারী মেশিনগানের গুলী এবং মর্টারের গোলাবর্ষণের আড়াল নিয়ে বেলা সাড়ে তিনটার পর পাকসেনারা ক্রল করে শহরে ঢুকতে শুরু করলো। প্রচণ্ড প্রতিরোধের মধ্যেও তা এগিয়ে চললো। বেচলা ডোবার একটু পর পাকসেনারা রেল লাইন পার হয়ে থানার মোড়ে পৌছালে। হতাশ হয়ে গেলাম এবার বগুড়ার পতন নিশ্চিতপ্রায়। জলিল বিড়ি ফ্যাক্টরীর পিছনে একটি ছোট বাড়ীতে ছাত্রলীগের সামাদ, মাসুদ, সৈয়দ কেরামত আলী গোরা আমরা কয়েকজন জড়ো হয়েছি। মাসুদকে দেখে একটি ঘটনা মনে হয়ে গেলো। ২০শে মার্চের রাতে মাসুদ এবং মুস্তাফিজুর রহমান পটল আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো স্টেডিয়ামের কাছে তাদের তৈরী বোমার কার্যকারিতা দেখাবার জন্যে। দুটি বোমা ফাটানো হলো। সে কি বিকট আওয়াজ। কিন্তু হতাশ হলো সবাই দেয়ালে একটুও চিড় পর্যন্ত ধরেনি ধ্বনি ধ্বনিসর্বস্ব বোমা।

 ঘটনা মনে আসতেই মাসুদের কাছে জানতে চাইলাম সেই বোমা আছে কিনা। সামাদ জানালো ২৩টি বোমা আছে। সামাদ এবং মাসুদ ছুটলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতবোমা দুটো নিয়ে এসে হাজির। বললাম যেমন করেই হোক দত্তবাড়ীর উত্তরে যে কোন জায়গায় রাস্তার ওপর এই বোমা দুটো ফাটাতে হবে। এবং কিছু মুক্তি সেনা কাছাকাছি জায়গায় ফাকা গুলী ছুড়বে এবং সরে পড়বে।

 শেখ ইনসান হাজী সাহেবের বাড়ীর উত্তর ধারে বোমা দুটি ফাটানো হলো। সে কী বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এলাপাতাড়ি, কিছু একনলা দু'নলা বন্দুকের গুলীর আওয়াজ পেছন থেকে আক্রান্ত হয়েছে ভেবে সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে হানাদার সেনারা ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর দ্রুত পিছু হটে কটন মিলের গেস্ট হাউসে এবং সুবিলের উত্তর পাড়ের ঘাটিতে ফিরে গেলো। সেদিনের মতো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এক অনাড়ি মূর্খ সেনাপতির রণকৌশলে বগুড়া শহর সেদিন পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো।

 ২৮শে মার্চ রাতে সুবেদার আকবরে নেতৃত্বে ৩৯ জন ই;পি;আর এর একটি দল বগুড়া পৌছায়। অস্ত্র বলতে তাদের রাইফেল; কয়েকটি গ্রেনেড এবং তিনটি এল;এম;জি। বিনা খবরে ওরা পৌঁছায়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সন্দিহান হই। পুলিশ লাইনে ওদের নিরস্ত্র করে নওগাঁয় মেজর নজমুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি ই,পি,আরদের কাজে লাগাতে বললেন এবং ৩০শে মার্চ নিজে বগুড়া আসবেন বলে জানালেন।

 ২৯শে মার্চ। সকাল বেলায় বিস্ময়ে দেখলাম রাতে অন্ধকারে হানাদার পাক সেনা কটনমিলের গেস্ট হাউস ছেড়ে সুবিলের উত্তর পাড়ের ঘাটিতে ফিরে গেছে। নিশ্চই গুপ্তচর মারফত তারা ই,পি,আরদের পৌছানোর খবর পায়। সকাল ৯টায় সুবেদার আকবার এবং মাসুদ রেকীকরতে বের হলে। বেলা ১১টায় ইপিআর-এর কয়েকজন একটি এল,এম,জি পাকসেনাদের দিকেমুখ করে কটন মিলের ছাদে বসালেন। বেলা আনুমানিক বারোটার সময় পাক সেনারা বৃন্দাবনপাড়া প্রাইমারী স্কুলের ঘাঁটি থেকে মর্টারের আক্রমন শুরু করে। এইবার আমাদের তরফ থেকেও তিনটি এল,এম,জির মুখ দিয়ে পাল্টা জবাব গেলো, সন্ধ্যার সময়ে দুপক্ষের গোলাগুলি বন্ধ হয়। করিম হাওলাদার নামে একজন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

 ৩০শে মার্চ। বেলা ৯টায় জেলা প্রশাসক খানে আলম সাহেব খবর পাঠালেন মেজর নজমুল হক এসেছেন। দেখা হলো মেজর নজমুল হকের সঙ্গে। মাঝারি গড়নের শ্যামল রঙের একহারা চেহারা। সর্বাঙ্গ একটা দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ। সংক্ষেপে তার কাগজে সব রিপোর্ট করলাম। শেষে বললাম 'যুদ্ধ করা আমার কাজ নয়। আমি যুদ্ধের কৌশল জানিনে। আজি এসেছেন। এখন দায়িত্ব আপনার।  মেজর নজমুল মৃদুস্বরে বললেন, “দায়িত্ব আমাদের সকলের। পলিটিক্যাল হাই কম্যাণ্ডের নিযুক্ত সর্বাধিনায়ক হিসেবে আপনিই কাজ করবেন। আমি আপনার সাহায্যের জন্য রইলাম।”

 অদ্ভুত ভালো লেগেছিলো এই মানুষটিকে। নিরহঙ্কার। কোন দিন ভুলতে পারবো না স্বাধীন বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা অতুলনীয় সাহস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

 ৩০শে মার্চ বেলা দশটায় পাকসেনারা মর্টারের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তি সেনারাও পাল্টা জবাব দেয়। বেলা ১টা নাগাদ হঠাৎ পাক সেনারা গোলা বর্ষণ বন্ধ করে।

 বেলা আড়াইটায় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী জিন্নাহর বাসায়(নিলিন্দার গ্রামে) হাই কমাণ্ডের বৈঠক। বৈঠকে আলোচনা শুরু হয়েছে। হঠাৎ উড়োজাহাজের আওয়াজ পাওয়া গেলো। জিন্নাহ এসে খবর দিলো বেশ নীচু দিয়ে দুটো উড়োজাহাজ ছুটে আসছে। একটু পরেই মেশিনগানের গুলীর আওয়াজ এবং তার পর পরই বোমা বর্ষণ শুরু হলো। সবাই বিচলিত হয়ে পড়লাম।

 বোমাবর্ষণ বন্ধহবার পর ঘুরে দেখলাম বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কোন লক্ষ্যেই আঘাত করতে পারেনি। মুক্তিসেনাদের মনোবল আরো চাঙ্গা হয়ে গেছে। মেজর নজমুল হক সার্কিট হাউসে কণ্ট্রোল রুম বসালেন। সন্ধ্যায় শহীদ খোকন পাইকাড় এবং সালাম একটা খাকী ফুলপ্যাণ্ট এবং খাকী শার্ট তৈরি করে এনে দিলো। তাদের জেদে পরতে হলো তাই। ষোলকলা পূর্ণ হলো যখন তপন এসে একটা রিভলবার ঝুলিয়ে দিলো কোমরে। হাসি পাচ্ছিল। সর্বাধিনায়ক, সেনাপতি, জেনারেল-এ জেনারেল অব ড্রিমল্যাণ্ড।

 ৩১শে মার্চ। দিনের বেলা দু'পক্ষই নীরব। খবর এলো ক্যাপ্টেন আনোয়ার এবং ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছে এবং ঘোড়াঘাটে অবস্থান করছেন। ৩১শে মার্চ রাতে অসীম সাহসী সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে মুক্তি সেনারা মহিলা কলেজের ঘাটিতে গ্রেনেড চার্জ করলো। পেট্রোলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে গড়িয়ে দেয়া হলো পাক সেনাদের ঘাঁটির দিকে। পাক সেনাদের ঘাঁটি থেকে লক্ষ্যবিহীন গুলীর শব্দ শোনা গেলো। তারপর অন্ধকারে মোটর কনভয়ের শব্দ। কিন্তু বোঝা গেলো না। ভোরে দেখা গেলো পাক সেনা বগুড়া ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে রংপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে গেছে।

 ১লা এপ্রিল। সকালেই সারা শহর রাষ্ট্র হয়ে গেলো হানাদার বাহিনী পালিয়েছে। সারা শহরে আনন্দের ঢেউ। হরিগাড়ীর গোপন আড্ডা থেকে সার্কিট হাউস কণ্ট্রোলরুমে এসেছি। সুবেদার আকবর এসে দাঁড়ালেন। স্যার আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণ করবো, অনুমতি চাই। কিছু জানি না বুঝি না। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, ‘চলুন'।

 ৩৯জন ইপিআর, ৫০জন পুলিশ বাহিনীর লোক এবং ২০ জন মুক্তিসেনা। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম- এই তিন দিক থেকে ঘেরাও করা হলো। দু'পক্ষ থেকে গুলীবৃষ্টি চলছে। এরই মধ্যে বিমান আক্রমণ শুরু হলো। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে গ্রামের হাজার হাজার লোক টিনের ক্যানেস্তারা পেটাতে শুরু করলো। বোমাবর্ষণ বন্ধ হবার পর আবার কিছুটা এগুলাম। কিন্তু পাক সেনারা অবিরাম গুলী চালিয়ে যেতে লাগলো। অবশ্য তাদের সুবিধে ছিলো। ক্যাণ্টনমেণ্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে আমাদের একটা ফাঁকা মাঠ পাড়ি দিতে হয়। সেদিন ছিলো দক্ষিণের জোর হাওয়া। গ্রামের লোকদের অনুরোধ জানানো হলো তারা ক্যাণ্টনমেণ্টের দক্ষিণ দিক থেকে মরিচের গুঁড়ো ছাড়তে পারে কিনা। ব্যস আর বলতে হলো না। কোথা থেকে এত মরিছের গুঁড়ো ভেসে এলো তা বলা কঠিন। ক্যাণ্টনমেণ্ট-এর ৫০০গজ উত্তরে আমাদের চোখমুখ জ্বলতে লাগলো। বেলা তখন আড়াইটা। আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট সাদা পতাকা উড়লো। আনন্দের আতিশয্যে রাইফেল হাতে লাফিয়ে অসীম সাহসী যোদ্ধা মাসুদ। আর তৎক্ষনাৎ শত্রুর নিক্ষিপ্ত শেষ বুলেটটি তাকে বিদ্ধ করলো। শহীদ হলো নির্ভীক সেনা, বগুড়ার এক বীর সেনানী। যুদ্ধে জয় হলো। পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। বন্দী সেনাদের এবং আটান্ন ট্রাক ভর্তি এম্যুনিশন নিয়ে ফিরলাম। কিন্তু চোখের জল বাধা মানছিলে না। মাসুদকে হারিয়ে এলাম চিরদিনের জন্যে। সেদিনই ঘোষণা করেছিলাম আড়িয়ার নাম হবে ‘মাসুদনগর’। রাতে ২১ টি গান স্যালুটের মাঝে মাসুদকে কবরে সমাহিত করলাম। দেখলাম ডাক্তার জাহিদুর রহমানের দু'চোখেও জলের ধারা নেমে এসেছে।

 আড়িয়ার ক্যাণ্টনমেণ্ট একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেন নূর) সহ ৬৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এরমধ্যে ছিল ২১ জন পাঞ্জাবী সৈন্য। জনতার ক্রুদ্ধ আক্রমণের হাত থেকে এদের রক্ষা করতে পারিনি। জেলখানার তালা ভেঙ্গে ওদের বের করে নিয়ে এসে কুড়ুল এবং বঁটি দিয়ে কুপিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে ওদের হত্যা করে। বাঙ্গালী সৈন্য যারা ছিলো তাদের নজরবন্দী করে রাখা হলো। আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট কিছু চাইনীজ রাইফেল ও গুলী পাওয়া যায়। ৫৮ ট্রাক ভর্তি এম্যুনিশন পাই, কিন্তু তা ব্যবহারের অস্ত্র ছিলো না। অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বললেন, সেগুলো ছিলো ১০৫ গান এবং আর-আর-এর এম্যুনিশন।

 ২রা এপ্রিল। পাবনার এস-পি জনাব সাঈদ এলেন এবং কিছু রাইফেলের গুলি নিয়ে যান। তাঁকে বললাম যেমন করে হোক ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সাহেবকে বগুড়া নিয়ে আসতে।

 ৩রা এপ্রিল। জনাব কামরুজ্জামান, শেখ মনি এবং তোফায়েল আহমদ বগুড়া এসে উপস্থিত হলেন। ডাঃ মফিজ চৌধুরীকে সঙ্গে দিয়ে তাদের সীমান্ত পার করে দেরাব ব্যবস্থা করলাম। জনাব শেখ মনির কাছেই জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু পাক সেনাদের হাতে বন্দী।

 ৪ঠা এপ্রিল। বগুড়া আওয়ামী লীগের জনাব আব্দুর রহিম তালুকদার জীপ নিয়ে ক্যাপ্টেন মনুসর আলীকে নিয়ে বগুড়া পৌঁছালেন। তার সঙ্গে জনাব আবু সাঈদ এম-পি। মনসুর ভাইকে বিশেষ করে অনুরোধ করলাম যাতে প্রোভিশানাল গভর্নমেণ্ট-এর নাম ঘোষনা করেন। মনে আছে একটা সিগারেটের প্যাকেটের সাদা অংশে বি-এস-এফ-এর কর্নেল মুখার্জীকে লিখেছিলাম মনসুর ভাইকে নিরাপদে তাজউদ্দীনের কাছে পাঠানোর জন্যে।

 ৫ই এপ্রিল। মেজর নজমুল হক বগুড়া এলেন। জেলা প্রশাসক জনাব খানে আলমের কুঠিতে আলোচনা সভা বসলো। মেজর নজমুল হক জানালেন যেমন করে হোক ১০৫ কামান এবং আর-আর জোগাড় করতে হবে। তিনি বললেন হিলিতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার চাটার্জীর সঙ্গে দেখা করতে। তার সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হলো, যদি কোন প্রকারে আমরা রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করে উত্তরাঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমন ঠেকাতে পারবো।

 ৬ই এপ্রিল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি এবং জাহিদুর রহমান হিলি যাই। পশ্চিম হিলিতে গেলে আমাদের দু'জনকে এক প্রকার নজরবন্দী করে রাখে সারাদিন। সন্ধ্যায় জানালো রাত তিনটায় ব্রিগেডিয়ার চাটার্জী আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। রাত তিনটায় ব্রিগেডিয়ার চাটার্জী সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাদের দু'পেটি ৩০৩ রাইফেলের গুলী দিয়ে বিদেয় দিলেন এবং ১৬ই এপ্রিল হিলিতে তার সঙ্গে আবার দেখা করতে বললেন। জানালেন তিনি ভারত গভর্নমেণ্টকে আমাদের অবস্থা জানিয়ে অস্ত্র সাহায্য করতে অনুরোধ জানাবেন।

 ৭ই এপ্রিল। প্রায় খালি হাতেই বিকেল বেলা আমি এবং ডাঃ জাহিদুর রহমান হিলি থেকে ফিরলাম। মুক্তিসেনারা সাগ্রহে আমাদের প্রতীক্ষা করছিলো। কিন্তু আপাতত কোন সামরিক সাহায্য না পাওয়ার কিছুটা হতোদ্যম হলো বলতে হলো। বলতে ভুলে গেছি, ২রা এপ্রিল থেকেই মুক্তি সেনাদের কয়েকটি ক্যাম্পে ভাগ করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং- এর ব্যবস্থা করেছিলাম। করোনেশন স্কুলে একটি ক্যাম্প, সেণ্ট্রাল হাই মাদ্রাসার একটি ক্যাম্প এবং জিলা আনসার অফিসের মাঠে একটি ক্যাম্প। ইপিআর বাহিনীর ব্যবস্থা করেছিলাম এডওয়ার্ড পার্কের কম্যুনিটি সেণ্টার হলের একে তলায়। কণ্ট্রোল রুম শিফট করেছিলাম দোতলায়। বগুড়া সার্কিট হাউসে প্রশাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। জনাব এম আর আখতার মুকুলকে কেরোসিন, ডিজেল এবং পেট্রোল-এ পারমিট ইস্যু করার দায়িত্ব দেয়া হয়। খালি হাতে ফিরে আসার খবর জেনে মুকুল একান্তে ডেকে নিয়ে বললো, “শালা সেরেছে। এবার আস্তানা গুটাও। পাকিস্তানী খুনীরা এবার তোমার জন্যে ট্যাংক নিয়া আইবো। এদিকে তোমার মুক্তি সেনাদের থামাও। এর কোন শৃঙ্খলা মানে না। এরাই এখন প্রব্লেম। দেখলাম তাই। মুক্তি সেনাদের মধ্যে একদল ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। এদের নিয়ন্ত্রন রাখাই মুশকিল। তাছাড়া পাকসেনা সরে যেইে দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। দুষ্কৃতকারীরাও সুযোগ নেবার চেষ্টায় আছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে শেষ চেষ্টা চালালাম।

 ৮ই এপ্রিল থেকে ১৩ই এপ্রিল বিশেষ কোন ঘটনা ঘটালো না। ১৩ই এপ্রিল সিরাজগঞ্জের মহকুমা অফিসার শহীদ শামসুদ্দীন সাহেব দেখা করলেন এবং সিরাজগঞ্জ-নগরবাড়ীর ডিফেন্সের ব্যবস্থাও বগুড়া থেকে করতে অনুরোধ জানালেন।

 ১৪ই এপ্রিল, হিলি থেকে একটা খবর আসে। যেসব এম্যুনিশন আড়িয়া যুদ্ধে পাওয়া গেছে তার নমুনা নিয়ে অতি অবশ্য হিলিতে দেখা করতে হবে। ১৪ই এপ্রিল রাতে সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে মুক্তি সেনার একটি দল নগররাড়ী প্রতিরক্ষার জন্য পাঠানো হলো।

 ১৬ই এপ্রিল, জনাব এম, আর, আখতার মুকুল, জনাব আসাদুজ্জামান, মজিবুর রহমান এমপি, ডাঃ জাহিদুর রহমান এমপি এবং দু'জন ইপিআরকে সাথে নিয়ে এম্যুনিশনের নমুনাসহ বিকেল বেলা হিলি পৌঁছে। সেদিন বিকেলেই কর্নেল ব্লিস এম্যুনিশনগুলো পরীক্ষা করেন। ঐদিন রাতেই আমাদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে কোলকাতা যেতে বলা হয়। ১৭ই এপ্রিল ভোরে আমরা কোলকাতা রওয়ানা হই। ১৯শে এপ্রিল সন্ধ্যায় লর্ড সিনহা রোডে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান এবং পার্লামেণ্ট সদস্য জনাব আবদুল মান্নান এবং আবদুস সামাদ-এর নিকট বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করি।

 ২২শে এপ্রিল বগুড়া শহরের পতন ঘটে।


  1. ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” থেকে সংকলিত