বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১৩

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ পাবনা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৩। পাবনা জেলায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ গ্রন্থ ..........
১৯৭১

পাবনা শহরে পুলিশ ও জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ[]

 ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ২৫শে মার্চ তারিখে পাবনা শহরে এসে ঢুকে পড়ল। শহরের মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। শিগগিরই এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটে যাবে। তারা মনে মনে এই আশঙ্কা করছিল। কিন্তু সেই ঘটনা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে, সেটা তারা ভাবতে পারেনি। এই তারিখেই ঢাকা শহরে আক্রমণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেটা গভীর রাত্রিতে। ওরা ২৫শে মার্চ শেষ রাত্রিতে পাবনা শহরে এসে হামলা করল।

 শহর থেকে মাইল চারেক দূরে হেমায়েতপুরের কাছে ইপসিক-এর অফিস। পাক সৈন্যরা সেখানেই এসে ঘাঁটি গেড়ে বসল। তারপর সেখান থেকে কিছু সৈন্য শহরে এসে ট্রেজারী দখল করে নিল। তাছাড়া ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র দখল করে বসল। তারা সারা শহরে কারফিউ জারী করে দিয়েছিল।

 হামলাকারী সৈন্যরা শহরে এসেই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম,এল,এ আমিনুদ্দীন সাহেব ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী এবং আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করল। যারা ওদের তাতে ধরা পড়ল, শেষ পর্যন্ত তাদের সবাইকে ওদের গুলির শিকার হয়ে মরতে হয়েছিল। এর কয়েকদিন আগেই শহরের ডি,সি ও এস,পি, স্থির করছিলেন যে শহর আক্রান্ত হলে তাঁরা প্রতিরোধ দেবেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রেরনা ও উৎসাহ পেয়ে পুলিশ ব্যারাকের ১০০ জন সশস্ত্র পুলিশও মনে মনে প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল। যতক্ষন শক্তি আছে, ততক্ষণ এই শহরকে তারা পশ্চিমাদের হাতে ছেড়ে দেবে না। যেটুকু শক্তি আছে, তাই নিয়েই ওদের বিরুদ্ধে লড়বে।

 ২৭শে মার্চ তারিখে সৈন্যরা পুলিশ ব্যারাকে যায়। এবং পুলিশদের অস্ত্রগার তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশরা এতে অসামর্থ্য জানায় এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে ডি,সি, তাদের অস্ত্রাগার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। তাঁর এই আদেশ কিছুতেই তারা অমান্য করতে পারবে না। এই নিয়ে দু’পক্ষে প্রথমে বাক-বিতণ্ডা এবং পরে গুলিবর্ষন চলে। তখন বলা শেষ হয়ে এসেছে। এই যুদ্ধে তিনজন সৈন্য মারা যায়। পাক সৈন্যরা বাহাদুর পুলিশ ভাইদের হাতে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু এ শিক্ষাও ওদের পক্ষে যথেষ্ট হয়নি। সেই রাত্রিতে তারা নতুনভাবে আক্রমণ করবার জন্য তোড়জোড় চালাতে লাগল। রাত যখন সাড়ে চারটা তখন ওরপা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে অতর্কিতে পুলিশ ব্যারাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু পুলিশ ভাইয়েরাও আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল। সৈন্যরা যে আবার ফিরে এসে আক্রমন করবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। এবার আর ব্যারাকে নয়, ব্যারাক ছেড়ে নিকটবর্তী বাড়িগুলির ছাদে এবং পথের মোড়ে মোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আড়াল নিয়ে হামলাকারী শত্রুদের জন্য বাঘের মত ওত পেতে বসে ছিল। তারা তো ছিলই, জেলখানার পুলিশ ভাইয়েরাও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। এইভাবে সারাটা রাত তারা শত্রুর জন্যে মৃত্যু ফাঁদ সাজিয়ে বসে ছিল। রাত সাড়ে চারটার সময় দু’পক্ষ সংঘর্ষ ঘটল। সৈন্যদের পরিবর্তে পুলিশরাই প্রথম আক্রমণ করল। এইভাবে অতর্কিত চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ইয়াহিয়ার সুশিক্ষিত সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে গেল। এই সংঘর্ষ ২১ জন সৈন্য নিহত হবার পর বাকী সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালাল। পুলিশদের মধ্যে একজনও মারা যায়নি। সাবাস! পাবনার পুলিশ ভাইয়েরা।

 ২৭শে মার্চ তারিখে পাবনা শহরের বুকে এ লড়াই শুরু হয়েছিল। ২৭শে থেকে ২৯শে, এই তিন দিন ধরে লড়াই চলল ২৬শে আর ২৭শে এই দুইদিন ওরা শহরর উপর কারফিউ জারী করেছিল। তা সত্বেও ঐ অবস্থাতেই শহরের যুবক ও ছাত্ররা ২৬শে মার্চ সারাদিন আর সারারাত প্রতিরোধের জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। ঐ একটি দিনের মধ্যে তারা বেশ কিছু অস্ত্র হাত করে নিয়েছিল। সেই একটি দিনে কারফিউ আইন ভঙ্গকারীদের মধ্যে ৮/১০ জন সৈন্যদের গুলিতে মারা গিয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধকারীদের মনোবল তাতে একটুও ভঙ্গে পড়েনি।

 পাবনা শহরের প্রতিরোধের ব্যাপারে ডি,সি-র প্রথম থেকেই সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ সাহেব আর তিনি মিলিটারীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলবার জন্য ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করে চলেছিলেন। তাঁরা দুইজন চর-অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং প্রতিরোধের ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন। মানুষ ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়েই ছিল। তাঁদের এই আহবানে উৎসাহিত হয়ে দলে দলে কৃষক এই হামলাকারী শত্রুদের খতম করে দেবার জন্য শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগল।

 ২৮শে মার্চ। ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করে নিয়ে পাহারা দিয়ে চলেছিল। চরের কৃষকরা ছুটতে ছুটতে এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলল। তাদের হতে লাঠিসোটা, বর্ণা -বল্লম ধনুক, তীর- ধনুক আরও কত রকমের হাতিয়ার। ব্যারাক থেকে সকল পুলিশ চলে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাছাড়া শহরের যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এসে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল। শেষ পর্যন্ত জনতা প্রায় ১৫ হাজারে এসে দাঁড়াল। তাদের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে সারা শহর কেঁপে উঠল, থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অবরুদ্ধ পাক সৈন্যদের মন। এবার দু'পক্ষে গুলিবর্ষণ চলল। সৈন্যদের হাতে মেশিনগান ও উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। পুলিশরা শুধু রাইফেল নিয়েই লড়ছিল। জনতার মধ্যে যাদের হাতে বন্দুক ছিল, তারাও সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সৈন্যরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সুরক্ষিত আশ্রয়ে থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিল। কাজেই সংখ্যায় কম হলেও তাদের খতম করে ফেলা সহজ কাজ ছিল না-ওদের মেশিনগানের অবিরল গুলিবর্ষণকে ভেদ করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতই দুঃসাহসের কাজ। সেই কারণেই অনেকক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। হাজার হাজার জনতা এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোন কার্যকর সাহায্য করতে না পারলেও তাদের আকাশ-ফাটানো জয়ধ্বনি পাক-সৈন্যদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে তুলেছিল। তারা হতবুদ্ধির মত হয়ে গিয়েছিল। তাই উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র হাতে থাকলেও তারা তাদের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেনি। এমনিভাবে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে এক এক করে তাদের ২৭ জনই মারা গেল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

 জয়োল্লাসে মেতে উঠল সারা শহরের মানুষ। বুড়ো থেকে বাচ্চারা পর্যন্ত আনন্দধ্বনি করতে করতে ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল। যে সমস্ত সৈন্য ট্রেজারী ও শহরের অন্যান্য জায়গায় মোতায়েন ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতি-আক্রমণের সূচনাতেই তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নিহত হয়েছে, বাকী সবাই পালিয়ে গিয়েছে। সারা শহরের পথে পথে জনতার বিজয় মিছিল চলছে।

 শহর থেকে শত্রুসৈন্যরা নিহত ও বিতাড়িত হলেও শহর বিপদমুক্ত নয়। শহর থেকে মাইল চারেক দূরেই ইপসিক-এর অফিস বাড়িতে শত্রুসেনারা মূল বাহিনীর অধিকাংশ ঘাটি করে বসে আছে। তাদের সংখ্যা দেড়শতের মত। সংখ্যার দিক দিয়ে যাই হোক না কেন অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। শহরকে বাঁচাতে হলে তাদের রাহুগ্রাস থেকে শহরকে মুক্ত করতে হবে। একট কথা মনে রাখতে হবে, যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে যারা উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে, পাবনা জেলায় সেই ইপিআর বাহিনীর কোন অস্তিত্ব ছিল না। পুলিশ ভাইয়েরাই এখানকার একমাত্র সশস্ত্র যোদ্ধা কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে তারা খুবই দুর্বল। হামলাকারী পাক সৈন্যদের মূল ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দেয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এক্ষেত্রেও জনতাই সামনে এগিয়ে এল।  পাবনা শহরের লড়াইয়ের খবরটা শহরের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইরে গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন কৃষক সমিতির লোকেরা শহরকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছিল। তারা দলে দলে এসে শত্রুপক্ষের মূল ঘাঁটিকে ঘেরাও করে ফেলল। রাত্রির অন্ধকারে ঘটনাটা এমন দ্রুতভাবে ঘটে গিয়েছিল যে, ওরা কৃষক- জনতার এই অবরোধ থেকে বেরিয়ে পড়বার মত সময় বা সুযোগ পায়নি। পুলিশ ভাইয়েরাও এ আক্রমণে কৃষকদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিল। তারা শত্রুপক্ষের মেশিনগানের পাল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ দিয়ে চলেছিল।

 অবরোধকারীদের প্ল্যান ছিল এই যে, তারা এইভাবে দিনের পর দিন বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়ে ওদের না খাইয়ে মারবে। কৃষক জনতার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় কুড়ি হাজারে এসে দাঁড়াল। মুক্তিবাহিনীর এই বিরাট সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এবং তাদের উম্মাত্ত গর্জন শুনে অবরুদ্ধ পাক সৈন্যরা এগিয়ে এসে আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না। দু'পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে গুলি বিনিময় করে চলেছিল।

 সময়ের সাথে সাথে অবরোধকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে পাক সৈন্যরা এটা নিশ্চতভাবে বুঝে নিয়েছিল যে এই সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তারা বেতারযোগে ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত অবস্থাটা খুলে জানাল। জানাল। জানার যে, তাদের জীবন বিপন্ন, অবিলম্বে সাহায্য দরকার।

 খবর পাঠাবার কিছুকাল বাদেই আকাশে জেট বিমানের ঘোর গর্জন শোনা গেল। শব্দ শুনে চমকে উঠে সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেই বিমান সমস্ত অঞ্চলটা প্রদক্ষিণ করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। একটু বাদেই প্রচণ্ড বিস্ফোরন শব্দ। সেই হিংস্র যন্ত্র-দানবটা জনতার ভীর লক্ষ্য করে একর পর এক বোমা ফেলে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত চীৎকার আর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। শুধু বোমা ফেলা নয়, প্লেনটা মাঝে মাঝে বাজপাখির মত ছোঁ মেরে নীচে নেমে আসছে, আর এক এক পশলা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে চলে যাচ্ছে। বোমারু বিমানের এই অতর্কিত আক্রমণে কিছুসংখ্যাক লোক হতাহত হোল, জনত ইতস্তত ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে লাগল। অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা এই সুযোগে অবরোধের বেড়া ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রান নিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তাদের সঙ্গী সবাই পালিয়ে যেতে পারেনি। অবরোধ ভেঙে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র যোদ্ধা তখনও তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছুসংখ্যাক সৈন্যকে হতাহত অবস্থায় রণক্ষেত্রে ফেলে রেখে অবশিষ্ট পাক বাহিনী এই মৃত্যুর ফাঁদ থেকে পালিয়ে বাঁচল।

 এইভাবে শত্রুসৈন্যদের বিতাড়িত করে জয়োন্মত্ত কৃষক-জনতা উল্লাসধ্বনি করতে ফিরে এল। মুক্ত নগরী পাবনা উৎসবমুখর হয়ে উঠল। কিন্তু পরদিন এই উৎসবের আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে বিষাদের এক কালো ছায়া নেমে এল। এই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ সাহেব ২৯শে মার্চ তারিখে হঠাৎ করোনারী থ্রম্বসিস রোগে মারা গেলেন। এ সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধাবস্থায় কঠিন পরিশ্রম ও দারুন উত্তেজনাই তাঁর এই অকালমৃত্যুকে ডেকে এনেছিল। একথা বললে ভুল হবে না যে, পাবনা শহরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়ে গেছেন, আমজাদ সাহেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

 কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধের এইখানেই ইতি নয়। বিতাড়িত পাক-সৈন্যরা তাদের ইপসিকের ঘাঁটি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। উদভ্রান্ত ও দিশেহারা পলাতক সৈন্যদের পালাবার পথে পর পর দু'বার -প্রথম দাশুরিয়া পরে মুলাডুলিতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। এই দুই জায়গাতেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটেছিল। দুই সংঘর্ষের ফলে অবশিষ্ট পাকবাহিনীর প্রায় সবাইকেই প্রাণ দিতে হলো, কেবলমাত্র চারজন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।

সিরাজগঞ্জ এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ মোজাফফর হোসেন
২৫-০৮-১৯৭৩

 ২৫শে মার্চের ঘটনা। রাত একটার দিকে মহকুমা প্রশাসক জনাব শামসুদ্দিন সিএসপি (শহীদ) আমাকে সংগ্রাম পরিষদে জানালেন, পুলিশ, আনসার বাহিনীর যত অস্ত্র আছে সব তোমাদের জন্য দেব প্রতিরোধের জন্য।

 ২৬শে মার্চ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ছুটি ভোগরত পাক বাহিনীর সেনা আনসার, পুলিশ, ছাত্র, সাধারন লোক, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সব মিলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় অস্ত্র রাইফেল, বন্দুক টু-টুবোর রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে নামা হয়।

 বগুড়ার আড়িয়ার বাজারে আগে থেইে পাক ঘাঁটি ছিল। মার্চে মাসের শেষের দিকে সাধারণ লোক সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক-বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩০ জনের মত পাকসেনা ছিল। আকাশে থেকে বিমান আক্রমন চালায় পাকবাহিনী। ওদের গুলী এসে লাগে। গোলার ডাম্পে তাতে আগুন লেগে বিমান বাহিনীর গুলীতেই বেশ পাকসেনা খতম হয়। তারপর জনসাধারন ঢুকে পড়ে অনেককে আত্মসমৰ্পন করায়, অনেককে হত্যা করে পিটিয়ে।

 আমি এবং এসডিও শামসুদিন সাহেব এদিন বগুড়া গিয়ে সেখানকার মুক্তিবহিনীর মধ্যে সমঝোতা করে কিছু অস্ত্র এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রায় ২০ জন এবং ইপিআর-এর প্রায় ৩০ জন নিয়ে সিরাজগঞ্জ চলে আসি। তখন আমাদের কাছে ছিল চাইনিজ রাইফেল ৭টি, মাক-৪৬টি, রাইফেল ৫/৬টি।

 ২৬শে মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তখন আমাদের খাওয়া, থাকা, বেতন, দেওয়া যাবতীয় ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ করতে থাকে।

 সিরাজগঞ্জ যমুনার পড়ে আমরা ৬/৭টি ছোট ধরনের কামান পেতে রাখি, যার দূরত্ব এক মাইলের মত। এই কমানগুলি তৈরি করেছিল আমাদের স্থানীয় লোক আবুল মিস্ত্রী।

 এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম টাঙ্গাইলের ঘাটে ৭টি লঞ্চ গেছে পাক বাহিনীকে নিয়ে যাবার জন্য। আমি তিনজন ছেলে এবং কিছু অস্ত্রসহ স্পীডবোট নিয়ে টাঙ্গাইল ঘাটে পৌছে ফাঁকা আওয়াজ করে সারেংদের আটকিয়ে ১১টি লঞ্চসহ সিরাজগঞ্জ ফিরে আসি।

 বাঘাবাড়িতে প্রতিরোধঃ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি প্রায় ১৫০ জন ছেলেসহ আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ডিফেন্স দিই। আমার সাথে লতিফ মীর্জা, গোলাম কবরিয়া, সোহরাব হোসেনও ছিল। পরদিন ইপিআর, আনসার, পুলিশ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে প্রায় ১০০ জন যোদ্ধা আমার ওখানে পাঠিয়ে দেন এসডিও সাহেব।

 বাঘাবাড়ীতে নদীর পাড়ে ২ মাইলব্যাপী ২০০ গজ পরপর পাকা মরিচা খনন করে সেখানে ডিফেন্স নিয়ে থাকি। তার পরদিন এসডিও সাহেব নিজে আমাদের ডিফেন্স আসলেন প্রায় ৫০ জন ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক নিয়ে।

 আরিচা ঘাট রক্ষা করার জন্য প্রায় ১০০ জন বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইপিআর বাহিনীর লোক নিয়ে আমি এবং এসডিও সাহেব অগ্রসর হই। কাশিনাথপুর পৌছালে শুনলাম আরিচার পতন ঘটেছে। তখন আমরা কাশীনাথপুরে জঙ্গলের ভিতর আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করি। ওখান থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পাক ঘাঁটি আছে। শুনলাম (গ্রামের নাম মনে নেই)। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেবের কমাণ্ডে আমরা ১০০ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে পাক ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিই। একদল আক্রমণ চালাবে, একদল গাড়ী ধ্বংস করবে এবং একদল ব্রিজ ধ্বংস করবে একই সময়ে। আমরা আক্রমন করি রাত ২টার দিকে। একই সাথে ব্রিজ ধ্বংস, ৫টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে শুনলাম। পরদিন ভোর বেলা আমরা ফিরে আসি। আমাদের একজন ইপিআর জোয়ান গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। তাকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই।

 এপ্রিল মাসের ২৫তারিখের দিকে এসডিও সাহেব ফিরে আসলেন বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে। তিনি আবার গেলেন বাঘাবাড়ী ঘাটে। আমিও গেলাম এসডিও সাহেবের সাথে। তার পরদিন পাকবাহিনী দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ করে কাশীনাথপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। একজন হাবিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্যাম্পের। আমাদের জোয়ানরা বিশ্রাম করছিলো, ঠিক এসই সময় শত্ররা মর্টার আক্রমণ চালায় চারদিক থেকে। ৩০/৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ওখানে শহীদ হয় বাকিরা পালিয়ে যায় অস্ত্র ফেলে। পাকসেনারা আমাদের প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি ১৫ জন উদ্ধার কর্মী নিয়ে পরদিন চারদিকে খুঁজতে লাগলাম আমাদের বাহিনীর লোকদের। ২ জন আহত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ৮/১০ জন অন্যান্য জোয়ান নিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাটে চলে আসি। আমাদের ডিফেন্স আরও জোরদার করি।

 মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লতিফ মীর্জাকে বাঘাবাড়ী ঘাটের দায়িত্ব দিয়ে আমি এবং এসডিও সাহেব অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যাই। সিদ্ধান্ত হয় ৪ কোটি টাকার অস্ত্র কেনা হবে। পশ্চিম দিনাজপুরে ভারতীয় কর্নেলের সাথে দেখা করেন আমাদের এসডিও সাহেব। যাবার পথে হিলি সীমান্তে ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমাদেরকে খুব বেশী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পাবেন না জানান। তারপরই আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দিনাজপুর যাই। এসডিও সাহেব অস্ত্র কিনতে চান। কর্নেল সাহেব জানান, এভাবে অস্ত্র বিক্রী করা যায় না। এসডিও সাহেবের না-খাওয়া, না ম্নান অবস্থা অহোরাত্র চিন্তায় মাথা প্রায় খারাপ ছিল। তাই কর্নেল সাহেব অস্বীকার করলে এসডিও সাহেব খুব রাগারগি করেন। বাকবিতণ্ডা হয়। কর্নেল সাহেব পাক স্পাই মনে করে আমাদের দু’জনকে বন্দী করেন। আমি কোনরকমে খবর পাঠিয়ে কংগ্রেসনেতা এবং ছাত্রনেতার কাছে আমাদের অবস্থা জানাই। ছাত্রনেতা এবং কংগ্রেস এমপিদের প্রচেষ্টায় আমরা মুক্তি পাই। তারপর ফিরে আসি বাঘাবাড়ী ঘাটে।

ফিরে শুনলাম সিরাজগঞ্জ বাঙ্গালী-বিহারী মারামারি হয়েছে। বিহারীদের নিরাপত্তার জন্য এসডিও সাহেব সকল বিহারীকে গ্রেফতার করে জেলখানাতে নিয়ে আসেন। এসডিও সাহেব ও আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ফিরে যাই আবার।

মে মাসের ২০তারিখের দিকে বাঘাবাড়ী নদীর অপর পারে পাক বাহিনী বাংকার করা শুরু করে। আমরা আক্রমন করি। ক্রমাগত চারদিন পর তারা বিমান হামলা চালায় আমাদের উপর।

২৩/২৪ তারিখের দিকে আমরা পিছু হটে উল্লাপাড়া চলে আসি। আমরা প্রায় ১৫০ জন ছিলাম তখন। বাকি বাহিনীকে সিরাজগঞ্জে পাঠানো হয়। আমরা মোট প্রায় ৪০০ জন ছিলাম।

আমরা উল্লাপাড়া থেকে ২/৩ দিন রাতে অকস্মাৎ বাঘাবাড়ী ঘাটে পাক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেতাম।

ঘটনা প্রতিরোধঃ মে’র ২৫ তারিখে পাক বাহিনী উল্লাপাড়া আক্রমণ করলে আমরা ঘটনা (সলপ) ব্রিজে আসি। আমরা সলপ স্কুলে আশ্রয় নিই। এসডিও সাহেব এবং লতিফ মীর্জা আমাদের সাথে। ওখান থেকে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকেরা বলে, “আমরা শেষ পর্যন্ত মারা যাবো, শেষবারের মত স্ত্রী- ছেলেমেয়েদের দেখতে দিন৷” এসডিও সাহেব প্রত্যেককে ২০০/৩০০/১০০ টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নায়েক মহিউদ্দীন আমাদের ছেড়ে গেলেন না।  শেষ সময় আমরা ১০০ কজন ছিলাম ঘটনাতে। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব নিজে কমাণ্ডিং অফিসার। ৪/৫ দিন আমরা না খেয়ে।

 সিদ্ধান্ত হয়, এসডিও সাহেব ৪০ জন ছেলে নিয়ে অস্ত্রসহ সিরাজগঞ্জ যাবেন সিরাজগঞ্জ রক্ষার জন্য। এখানে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমরা ৫০/৬০ জন থাকবো ঘাটনাতে। পাক বাহিনীকে বাধা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ এসে শেষযুদ্ধ হবে। সেই মত এসডিও সাহেব চলে যান। আমি, লতিফ মীর্জা, রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেও সাধারণ সম্পাদক সামাদ থাকলো ঘাটনাতে। আমি এবং লতিফ মীর্জা ১০ জনের খাবার যোগাড় করে ঘাটনা ব্রজে রওনা হই। কারণ ওখানে সামাদের নেতৃত্বে ১০ জন যোদ্ধা ছিল পাহারায়। আমরা খাবার পৌছলে দেখতে পেলাম একটি ট্রেন আসছে ঈশ্বরদী থেকে। আমাদের খাওয়া হলো না। খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ১২ জন দু’দিকে ডিফেন্স নিই। আমাদের ২টি এলএমজি এবং ১০টি চাইনিজ রাইফেল ছিল। ট্রেন ব্রিজের কাছে আসলে দেখলাম গাড়ীটি পাকসেনাতে ভর্তি। ওর মইন সরাচ্ছে আর অগ্ররস হচ্ছে। পাক-সেনারা নেমে এখানে-ওখানে ঘোরাফিরা করছে। মিস্ত্রীরা লাইন সারছে। ক্রমশ ৪০/৫০ জন পাকসেনা ব্রিজের এক স্থানে একত্রিত হতে থাকে। পাকসেনাদের সাথে বেসামরিক পোশাকে অনেক বিহারীকে দেখলাম। ৪০/৫০ জন একস্থানে হলে আমি ফায়ার ওপেন করতে বলি; সাতে সাথে ১০টি চাইনিজ রাইফেল ও ২টি এলএমজি গর্জে ওঠে। ক্রস ফায়ারের সাথে সাথে সবকটি সৈনিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকিরা সব ট্রেনে উঠে ট্রেনটি পিছনে নিয়ে গিয়ে অনবরত মেশিনগান এবং মর্টার দিয়ে বৃষ্টির মত গোলা ছুড়তে থাকে। ৩ ঘণ্টা গুলি ছোড়ার পর আমরা জঙ্গল থেকে বের হই। আমরা ক্লোজ রেঞ্জে থাকায় আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ১ মাইল দূরে যে আমাদের ক্যাম্প ছিল সেখানে গোলা পড়ায় আমাদের ছেলেরা সব পালিয়ে যায়-মনে করে আমরা সব মারা গেছি। রাতে কিছুদূর এসে দেখলাম যে বাইনোকুলার ফেলে এসেছি। ১০ জনকে রেখে আমি এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মহিউদ্দীনকে নিয়ে ঘটনা ব্রিজে যাই বাইনোকুলার খুঁজতে। সেখানে পৌছে দেখলাম একটি নৌকা করে কিছু পাকসেনা পার হচ্ছে। কৌতুহল বশে বাইনোকুলার খোঁজা বাদ দিয় পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কি হয় দেখার জন্য। দেখলাম ৪ জন পারে নামলো। অকস্মাৎ অন্ধকারে তারা হারিয়ে যায়। আমরা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর পাতার মচমচ শব্দ শুনতে পেলাম এবং ছায়ার মত আমাদের দিকে আসছে দেখলাম। আমাদের হাতের দুটি চইনিজ এসএমজি একসাথে গর্জে ওঠে। পতনের শব্দ পেলাম। পাল্টা কোন গুলি হয় না, বুঝলাম সব খতম। তার পরপরই নদীর অপর পার থেকে ঝাঁক ঝাঁক গুলি আসতে লাগলো। আধ ঘণ্টা পর গুলি বন্ধ হলে ক্রলিং করে পালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে আর সব সার্থীদের সাথে মিলিত হই। ক্যাম্পে এসে শুনি আমাদের ছেলেরা সব পালিয়েছে। লোকজন অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, জিনিসপত্র লুট করেছে। নাম সংগ্রহ করে চারজনকে ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়-দু ঘণ্টা ধরে বৃষ্টির মত মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালায়। গুলি বন্ধ হলে আমরা পালিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে রওনা হই।

হজাদপুরসহ অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ আবদুর রহমান, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য
১২-১১-১৯৭৩

 ২৫মে মার্চ দিনগত রাত দুটোর সময় শাহজাদপুর থানার ওসি আমার কাছে একজন পুলিশ পাঠিয়ে সংবাদ দেন যে, “ঢাকায় সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ হয়েছে এবং ইয়াহিয়া কানকে বন্দী করে রাওয়ালপিণ্ডি পাঠিয়েছে। আপনি অবিলম্বে থানায় এসে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করুন।” আমি ভেবে দেখলাম এ সংগ্রামের কেবল শুরু-অনেকদিন চলবে। কাজেই উত্তেজিত না হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। থানায় গিয়ে দেখি অনেক আওয়ামী লীগ কর্মীও এস গেছেন। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হোল, আমাদের প্রথম কাজ যোগাযোগের ব্যবস্থা বন্ধ করা। সেই অনুযায়ী বাঘাবাড়ীর ফেরী বন্ধ করার দায়িত্ব দিয়ে আবুল হোসেন চৌধুরীকে পাঠানো হোল। আমি উল্লাপাড়া ও তার পরবর্তী এলাকার কাজকর্ম তদারক করার জন্য মোটর সাইকেলযোগে সেদিকে রওনা দিলাম। উল্লাপাড়ার জনপ্রতিনিধি (এম-পি-এ) এলাকায় অনুপস্থিত থাকেন এবং রায়গঞ্জ থানার প্রতিনিধিও তাড়াশে থাকেন বিধায় ঐ এলাকার জরুরী দায়িত্ব পালক কর্তব্য মনে করে আমি ঐদিকে রওনা দিই। প্রথমে আমি সরাসরি রায়গঞ্জ থানায় যেতে চাই। কিন্তু ঐ এলাকার রাস্তার বড় বড় গাছ থাকায় রায়গঞ্জ থানা পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ার জন্য কিছু আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে সমস্ত বিষয় আলোচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করে ফিরে আসি। উল্লাপাড়া থানার এসে সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে ফিরে আসি। আমার এই কয়েক ঘণ্টার সফরে জনসাধারণের যে আন্তরিকতা দেখেছি তার তুলনা হয় না।

 সম্ভব ২৯/৩০ মার্চ আমি বঙ্গবন্ধুর শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনামা পাই। আমি এটি অনুবাদ করার ও ছাপানোর ব্যবস্থা করি। ছাপানোর দায়িত্ব এককালীন কনভেনশন লীগ নেতা ও পার্লামেণ্টারী সেক্রেটারী ও পরবর্তী কালের জেলা শান্তি কমিটির প্রধান মৌলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া সাগ্রহেই নিয়ে ছিলেন ও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন।

 এই সময়ে শাহজাদপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয়। শাহদাজপুরের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ কর্মীদের ও সরকারী কর্মচারীদের মিলিত সভায় সাতজন সদস্য সমবায়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। আমি ঐ সভায় সভাপতিত্ব করি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি নির্বাচিত হই। এই কমিটির সদস্যগণ ছিলেনঃ (১) জনাব আবদুর রহমান (এম,পি,এ)-সভাপতি (২) জনাব আবদুল লতিফ খান (৩) জনাব আবুল হোসেন চৌধুরী (৪) তাহাজ্জাদ হোসেন (অধ্যক্ষ) (৫) বাবু ননী-গোপাল সাহা (৬) সি- আই, পুলিশ ষ্টেশন, (৭) ও-সি, পুলিশ স্টেশন।

 শাহজাদপুরে স্বাধীনতা যুদ্ধের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব এই কমিটির উপর থাকলেও অন্যান্য অত্যন্ত জরুরী কাজের জন্য কয়েকটি উপ-কমিটিও গঠন করা হয়। খাদ্য সবরাহের দায়িত্ব দেওয়া ছিল ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় এম,এল,এ জনাব আবু মোহম্মদ ইউনুস সাহেবের উপর। টাকা-পয়সা সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল বাবু বিনোদবিহারী জোয়ারদারের উপর। প্রচারের দায়িত্ব ছিল জনাব আব্দুল গফুর সবরতের উপর।

 আমরা প্রথম থেকেই আমাদের অস্ত্রের অপ্রতুলতার কথা জানতাম। ইতিমধ্যে সংবাদ পেলাম যে বগুড়ার নির্মীয়মাণ ক্যাণ্টমমেণ্ট ওখানকার মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেছে। আমি রেড়ার জনপ্রতিনিধি এম-এন- এ জনাব আবু সাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উভয়ে কয়েকজন কর্মীসহ বগুড়া গেলাম। এটা এপ্রিলের ৪ তারিখ। ওখানে গিয়ে ঐদিন লোক ও অস্ত্র না পেয়ে আমাদের কর্মীদের চান্দাইকোনা রেখে আমি ও আবুল চৌধুরী ফিরে এলাম। এলাকার কাজের জন্য আমাকে ফিরে আসতে হোল। আমি ফিরে এসে নগরবাড়ী এলাকার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা দেখতে গেলাম। কারণ ঐ সময় নগরবাড়ী রক্ষা করা না গেলে আমাদের বাঘাড়াবীতে রক্ষার প্রচেষ্টার কোন মানেই থাকবে না। নগরবাড়ীতে কোন জনপ্রতিনিধি না থাকায় আমার পক্ষে ঔ স্থানের কাজকর্ম বাদ দিয়ে আসা সম্ভব হোল না।

 নগরবাড়ীতে আমি নিয়োজিত থাকায় বগুড়াতে আমি না যেতে পেরে আবুল চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালাম। সেখান থেকে আমাদের খুব সামান্য অস্ত্রই দেয়া হয়েছিল। যাই হোক নগরবাড়ীতে আমাকে এবং ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) নজমুল হুদাকে সব সময় একসঙ্গে পরামর্শ করেই কাজ করতে হোত। পাবনা থেকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল। আমি ও ক্যাপ্টেন হুদা প্রথমেই স্পীডবোট নিয়ে সমস্ত নদী এলাকা ঘুরে দেখলাম। দেখলাম যে, পাক-বাহিনী নগরবাড়ীতে সরাসরি না এসে নগরবাড়ীর ৮/৯ মাইল দক্ষিণ দিক দিয়েও পার হয়ে নগরবাড়ী-পাবনার পাকা রাস্তায় উঠতে পারে। আমরা সেজন্য ঐ সমস্ত জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে আসি।

 ৯ই এপ্রিল বেলা ৪টার দিকে পাক-বাহিনী বিমান আক্রমণ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।কয়েকজন আহত হয়। বিমান আক্রমণের কথা আমরা এতটা ভাবি নাই। সতর্কতার কোন উপায়ও ছিল না। কারণ, পাবনা গিয়ে আমি ও ক্যাপ্টেন হুদা মেশিনগান নিয়ে আসি। পরে দেখা গেল তার পিন ভাঙ্গা। এর দুই দিন আগে ঈশ্বরদী থেকে একটা হাত-সাইরেন আনা হয়েছিল। সন্ধ্যার পর দেখা গেল তার এমন একটা পার্টস কেউ ভেঙ্গে রেখেছে যে বাজানো যায় না।

 ক্যাপ্টেন হুদা বারে বারেই অস্ত্রের কথা বলছিলেন, কিন্তু পাবনা ও বগুড়া ছাড়া কোথাও আমার চেষ্টা করার জায়গা ছিল না। তৎকালীন ডি-সি জনাব নুরুল কাদের খানের মাধ্যমে চেষ্টা করে কুষ্টিয়া থেকে কিছু আনসার আনা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিনের বিমান আক্রমণের পরই তারা চলে যায়।

 পরদিন ১০ই এপ্রিল সকালে আবার বিমান আক্রমণ হয়। ঐদিন আমাদের কেহ হতাহত হয়নি। কয়েকজন গ্রামের লোক মারা গিয়েছিল কিন্তু আমাদের সমস্ত বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।

 বাঘাবাড়ী প্রতিরোধঃ শাহজাদপুর এসে আমি বাঘাবাড়ীতে প্রতিরক্ষা গড়ার চেষ্টা নেই। এই সময় সিরাজগঞ্জে তৎকালীন এস-ডি-ও জনাব জনাব শামসুদ্দিন আসেন এবং যুদ্ধের প্রদান কাজকর্ম তিনি উপস্থিত থেকে করান। তিনি অবশ্য পরে শাহজাদপুরে ছিলেন না, মাঝে মাঝে আসতেন।

 নগরবাড়ী থেকে আসার পর আমি বগুড়ার সাথে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ইপিআর আসে। তাদের নিয়ে প্রথমে বেড়া যাই। পরবর্তী সময়ে জনাব শামসুদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন রাতে আমরা নগরবাড়ীতে অবস্থানরত পাক বাহিনীকে আক্রমণ করার প্রোগ্রাম করি। কিন্তু অনেকের, বিশেষ করে ট্রাক ড্রাইভারের অসহযোগিতার জন্য ঐ আক্রমণ সফল হয় নাই। আমরা নিজেরা প্রায় দুই ঘণ্ট ধাক্কিয়েও ট্রাক সচল করতে পারি না। অতঃপর ভীষণ বৃষ্টি ও বাতাসে খেজুরপাতার পার্টিতে খোলা ঘরে মাটিতে শুয়ে থেকে ঠাণ্ডায় যখন হাত-পা হিম হয়ে এসেছিল তখন আমরা কোনক্রমে রাত ৪টায় বেড়া সিএণ্ডবি ডাকবাংলোয় চলে আসি। ঘণ্টাখানেক পর সমস্ত বাহিনীও বৃষ্টিতে ভিজে ফিরে আসে। আরও কয়েকটি আক্রমণের চেষ্টা আমরা করলেও নানা ত্রুটির জন্য তা সফল হয় নাই।

 অবশেষে ১৯শে এপ্রিল পাক বাহিনীই বেড়ার ডাব-বাগানে অবস্থানরত আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। উভয় পক্ষেই প্রচুর ক্ষতি হয়। পরের দিনই বাঘাবাড়ীতে অবস্থানরত আমাদের সংগৃহীত ও সিরাজগঞ্জের সশস্ত্র বাহিনী ঐ স্থান ত্যাগ করে। তার পরদিন আমার কাছে খবর আসে যে, ডাব-বাগানে আমার পক্ষে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের কবরও দেওয়া হয় নাই। আমি দুজন কর্মী নিয়ে অমনি রওনা দিই। কিন্তু বেড়া পৌঁছার পর ঐ স্থানের কর্মীরা আর আমাদের অগ্রসর হতে দেয় নাই।

 ২২শে এপ্রিল পাক বাহিনী বাঘাবাড়ীতে এসে শাহজাদপুরকে লক্ষ্য করে শেল মারতে থাকে এবং বাঘাবাড়ী ও শাহজাদপুরের পতন হয়।

মুক্তিপাগল এক সরকারী অফিসার[]

 তিনি শুধু একজন মহকুমা প্রশাসক বা সিএসপি অফিসারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্রসেনা, এক নির্ভীক যোদ্ধা। মুক্তি সংগ্রাম শুরুর সেই প্রথম ক্ষণেই সিরাজগঞ্জে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার নেতৃত্ব দিয়েছেলেন মুক্তিপাগল এই বীর সেনানী। শুধু সিরাজগঞ্জেই নয়, সারা উত্তরবঙ্গই উত্তাল হয়ে উঠেছিল তাঁর সেই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায়। সবাই তাঁকে ভূষিত করেছিল কর্নেল উপাধিতে। সবাই তাঁকে ডাকতো কর্নেল শামসুদ্দিন বলে। নাম ছিল তাঁর এ, কে, শামসুদ্দিন।

 শামসুদ্দিন তখন ছিলেন সিরাজগঞ্জের এসডিও। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার মিথ্যা প্রলোভনে এদেশের মানুষকে মাসের পর মাস সন্দিগ্ধ রেখে সেই পঁচিশে মার্চের যে ভয়াল রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা তাদের হিংস্র বিষাক্ত থাবা মেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গ্রামবাংলার সাড় সাত কোটি মানুষের ওপর, সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনে এদেশের অসহায় মানুষের পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম যারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন জনাব শামসুদ্দিন তাদের অন্যতম।

 শুধু রুখে দাঁড়িয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি-তিনি রীতিমত গড়ে তুলেছিলেন এক বিরাট সংগঠন। সামান্য মাত্র অস্ত্র সম্বল করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সম্মুখযুদ্ধে। বাংকারে বাংকারে নিপুণ যোদ্ধার মত অস্ত্র হাতে নিয়ে চালিয়েছিলেন লড়াই, শত্রুর সাথে মোকাবিলায় দেখিয়েছেন চমৎকার নৈপুণ্য, দিখিয়েছেন পারদর্শিতা।

 বাঘাবাড়ীর প্রতিরোধঃ শত্রুবাহিনীর অগ্রাভিযানের বিরুদ্ধে বাঘাবাড়ীতে যে প্রচণ্ড প্রতিরোধ তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা এক অস্মিরনীয় ঘটনা। হানাদাররা ৯ই এপ্রিল নদী পার হয়ে চারদিকে যখন হত্যা ও ধ্বংসের হাহাকার তুলে এগিয়ে চলছিল উত্তরবঙ্গের শহর-বন্দরের দিকে তখন এই বাঘাবাড়ীতেই তাদেরকে বাধা দেন জনাব শামসুদ্দিন তাঁর সামান্য সামর্থ্য, সামান্য শক্তি নিয়ে। একদিন দুইদিন এভাবে একটানা পাঁচদিন তিনি এই প্রতিরোধ এড়াবার জন্য হানাদার বাহিনী গতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল।

 সোজা পথে সিরাজগঞ্জে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে তারা শুরু করেছিল বোমাবর্ষণ। ২৬মে এপ্রিল সিরাজগঞ্জবাসীদের ওপর নেমে আসে হানাদারদের এই বর্বর অভিশাপ। আর এই বিমান হামলারই আবরণে সুযোগ বুঝে ২৭মে এপ্রিল তারা ঢুকে পড়ে শহরে।

 জনাব শামসুদ্দিন এই সময়ে চলে যান চর এলাকায়। চর এলাকার অধিবাসীদের নিয়েই তিনি চেষ্টা করতে থাকেন একটি সশস্ত্র দল গঠনের। চেষ্টা করতে থাকেন অস্ত্র সংগ্রহের। এই অস্ত্র সংগ্রহের জন্যেই তিনি ঘুরতে থাকেন এখানে-ওখানে। তিনি যান টাঙ্গাইলে। যোগাযোগ স্থাপন করেন সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।

 আর এই ঘোরাঘুরিই তাঁর কাল হোল। সর্বনাশা মৃত্যু যেন দুই ব্যাগ্র হাত মেলে বসেছিল তাঁকে ছিনিয়ে নিবার জন্য। আর সেই কঠিন মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেবার জন্যেই বুঝি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মে মাসের গোড়ার দিকে। এসেছিলেন তিনি গোপনে। এসেছিলেন কর্তব্যের ডাকে। এ কর্তব্য ছিল তার পরিবারের।

 কিন্তু গোপনে এলেও গোপন তিনি থাকতে পারেননি। ১৭ই মে তিনি ধরা পড়ে যান খানসেনাদের হাতে। তার পরের ইতিহাস বর্বর খানসেনাদের নারকীয় নির্যাতনের ইতিহাস। তার পরের ইতিহাস ক্যাণ্টনমেণ্টের একটি ছোট্ট সেলে অমানুষিক নির্যাতনে তাঁর মৃত্যুবরণের ইতিহাস। বাঘাবাড়ী-সিরাজগঞ্জে যিনি ছিলেন খানসেনাদের ত্রাস সেই প্রতিভাধর তরুণ বাঙ্গালী অফিসারকে হাতের মুঠোয় পেয়ে বুঝি উল্লাসে নেচে উঠেছিল হানাদারদের চোখ।

 অত্যাচার-নিয়াতনে অর্ধমৃত জনাব শামুদ্দিনের ওপর শেষবারের মতই তাদের আক্রোশ মিটিয়ে নেবার জন্যেই বোধ হয় ২৯শে মে বিকেলে সেলের ভেতরে তার ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছেল মেজর সরফরাজের জল্লাদ দল-ক্র্যাক পার্টিকে। নিষ্ঠুর এক পৈশাচিকতা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জনাব শামসুদ্দিনের ওপর। মৃত্যুপথযাত্রী এই অসহায় মানবসন্তানের ওপর তারা তাদের আক্রোশ মিটিয়েছিল সর্বশক্তি দিয়ে।

 এ অত্যাচার আর তিনি সইতে পারেননি। মৃত্যুর প্রান্তে পৌছে সেলের মধ্যে তাঁরই সাথে আটক সিলেটের এক ভদ্রলোকের কোলে মাথা রেখে তিনি খেতে চেয়েছিলেন এক ফোঁটা পানি।


  1. ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ‘পাবনার মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক অংশ থেকে সংকলিত।
  2. দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারী ১৯৭২-এ মনজুর আহমদ প্রদত্ত প্রতিবেদন।