বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১৪
সশস্ত্র প্রতিরোধঃ বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুর
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
---|---|---|
১৪। বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুর জেলায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র | ১৯৭১ |
সশস্ত্র প্রতিরোধে বরিশাল
সাক্ষাৎকারঃ মেজর মেহেদী আলী ইমাম[১]
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আমি আমার বাড়ী মঠবাড়িয়ার দাউদখালীতে ছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সমস্ত পরিস্থিতি আমি রেডিও থেকে শুনতাম। সব সময় আশংকার মধ্যে ছিলাম পাকসেনারা কখন আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে চলে এল ২৫শে মার্চের কালরাত্রি। রেডিও ও অন্যান্য খবর মারফত বুঝতে পারলাম ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় পাক মিলিটারীরা নিরীহ জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি এসব খবর শোনার পর ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া থেকে লঞ্চযোগে বরিশালের পথে রওয়ানা হলাম।
২৭শে মার্চ সকাল ১০-১১টায় বরিশাল শহরে পৌঁছলাম। বরিশাল শহর তখন গরম। শহরের ছেলেরা রাইফেল, লাঠি, বল্লম এবং অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে বরিশাল শহর পাহারা দিচ্ছিল। লোকের মুখে জানতে পারলাম একজন মেজর জলিল এখানে এসেছেন এবং স্থানীয় এম-সি-এ নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় কণ্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে এবং সেখানেই মেজর জলিল আছেন। আমি এ খবর পেয়ে বেলা ১২টার সময় নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় গেলাম। সেখানে অত্যন্ত ভীড়। ভীড় ঠেলে ভেতরে গেলাম। সেখানে মঞ্জুর ভাই, মেজর জলিল, স্থানীয় এম-সি-এ আমু ভাই, শামসু মিয়া, মহিউদ্দিন ভাই, বারেক (এঁরা সবাই এম-সি-এ ছিলেন) এবং আরো অনেক স্থানীয় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন। সবাই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় তা ভাবছিলেন। আমি মেজর জলিল, মঞ্জুর ভাই এবং অন্যান্যের সাথে দেখা করলাম। মেজর জলিলের সঙ্গে আমার আগে আলাপ ছিল না। তিনি আমার সম্পর্কে প্রথমে খোঁজখবর নিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন থানা দখল করে নেবার জন্য।
২৭শে মার্চ রাতে আমরা প্রতিটি থানাতে অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালাম যেসব বাঙ্গালী সৈনিকরা ছুটিতে আছেন তাদের পাঠিয়ে দেবার জন্য এবং মুজাহিদ, আনসার, উৎসাহী যুবক, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বরিশালে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম এবং আসতে না পারলে সেখানেই ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে বলা হল। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ট্রেনিং-এর জন্য দিতে বলা হল। প্রতিটি থানা আমাদের নির্দেশ জেনে নিয়ে কাজ শুরু করে দিল। আমরা মেজর জলিলের নির্দেশে জায়গায় জায়গায় যুবকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করলাম।
২৭মে মার্চের রাতে নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাড়ীতে সব আওয়ামী লীগ নেতা ও অন্যান্য দলের নেতাদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মেজর জলিলকে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক করে কাজ শুরু করে দিলাম। দক্ষিণাঞ্চলের এলাকা বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা নিয়ে গঠিত ছিল। এসপিদের নির্দেশ দেয়া হল সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে দিয়ে দেবার জন্য। এস-পি’রা নির্দেশ মেনে নিয়ে সমস্ত অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দেন।
সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করা হয়। খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি গ্রুপ গঠন করা হয় যাদের কাজ ছিল সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য খাবার যোগাড় করে দেয়া। ট্রান্সপের্টগুলি আমাদের কাজের জন্য নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বেসামরিক শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ও একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ডেপুটি কমিশনার, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও অন্যদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত হয়েছিল। এছাড়া বরিশাল শহরের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এগুলি ছিল বেলস পার্ক, সদর গার্লস হাইস্কুল, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী (কমাণ্ডো ট্রেনিং-এর জন্য), মাধবপাশা ও প্রতাপপুর। অন্যান্য থানাগুলিতেও এরূপ অনেক ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এসব কেন্দ্রে হাজার হাজার যুবক দেশকে মুক্ত করার জন্য ট্রেনিং নিতে শুরু করে। বেলস পার্কে সর্ববৃহৎ ট্রেনিং কেন্দ্র ছিল। এখানে হাজার হাজার যুবক ট্রেনিং নিতে থাকে এবং এদের অনেককে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়। আমি সমস্ত ট্রেনিং কেন্দ্রের উপর নজর রাখতাম। ক্যাপ্টেন হুদা মেজর জলিলের সাথে থাকতেন এবং অন্যান্য দিকগুলির উপর নজর রাখতেন।
অয়ারলেসের মাধ্যমে আমরা পূর্বেই চাঁদপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট ইত্যাদি স্থানে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। চাঁদপুর থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালেন পাকসেনা যে কো মুহুর্তে চাঁদপুর আক্রমণ করতে পারে। তিনি আমাদের কিছু লোক পাঠাতে বললেন। মেজর জলিলের নির্দেশে আমি প্রায় ১০০ জন যুবককে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ চাঁদপুরে পাঠিয়ে দিলাম। ফরিদপুর, পটুয়াখালী বাগেরহাট, খুলনা পিরোজপুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও আমি প্রায় এক হাজার জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে শত্রুর আক্রমণকে রুখবার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। এছাড়াও বিভিন্ন থানা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরো ৫০০ জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ শত্রুদের রুখবার জন্য পাঠিয়ে দিই। ব্রজমোহন কলেজের কেমিস্ট্রির একজন অধ্যাপক এবং বিজ্ঞান বিভাগ ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় আমরা হ্যাণ্ড গ্রেনেড, মলোটভ ককটেল ইত্যাদি হাতবোমা তৈরী করতে শুরু করে দিলাম এবং এগুলি বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। বরিশাল-পটুয়াখালী যেহেতুে নদী প্রধান ছিল, সেহেতু শত্রুরা গানবোট নিয়ে আমাদের আক্রমণ করবে এ সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। তাই গানবোট ধ্বংস করার জন্য 'রকেট' ধরনের বোমা তৈরী করার চেষ্টা করি। এতে কিছুটা সফল হলেও আমরা তা কার্যকর করতে পারিনি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করেছে। পাকসেনাদের তুলনায় আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুবই কম। সেজন্য অন্য কোথাও থেকে অস্ত্র যোগাড় করা যায় কিনা চিন্তা করতে থাকি। বন্ধুদেশ ভারত থেকে অস্ত্র যোগাড় করার জন্য দক্ষিণাঞ্চল কমাণ্ডের প্রধান মেজর জলিল আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে ভারতে পাঠান। অস্ত্রশস্ত্র যোগার করা ছাড়াও অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ করাও প্রয়োজন ছিল। আমরা চিন্তা করে দেখলাম পাকিস্তানীদের সাথে এ অবস্থাতে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। তবুও বরিশালের সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্ব ছিল। আমরা বরিশালকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। সেজন্য ঢাকা থেকে বরিশাল আসার পথের উপর ২টি সড়কসেতু ধ্বংস করে দিই। ঢাকা থেকে বরিশালের সরাসরি রাস্তাযোগে কোন যোগাযোগ না থাকলে এই সড়কসেতু ২টি উড়িয়ে দেয়াতে শত্রুদের বরিশাল যাবার পথে বাধার সৃষ্টি হয়। ফেরীগুলি নষ্ট করে দেয়া হয়। পাকসেনারা যাতে বিমানে করে নামতে না পারে তার জন্য রহমতপুর এয়ার বেইসে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। কালিজিরা নদীতে শত্রুদের বাধা দেবার জন্য শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। শত্রুরা যাতে নদীপথে আসতে না পারে তার জন্য বরিশাল থেকে ৫/৭ মাইল দূর পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় বাংকার খুঁড়ে নদীপথের উভয় দিকে শত্রুদের অগ্রগতিকে বাধা দেবার জন্য বেশ কয়েকটি অবস্থান গড়ে তুলি।
অন্যদিকে, খুলনা হয়ে শত্রুরা যাতে বরিশালে ঢুকতে না পারে তার জন্যও ঝালকাঠিতে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য আমি সেখানে যাই। খুলনা থেকে বরিশালে নদীপথ আসতে হলে গাবখান চ্যানেল হয়ে আসতে হবে। তাই গাবখানের উভয় পাশে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করি এবং মধ্যে একটি ‘ফ্ল্যাট’ রেখে দিই যাতে শত্রুদের গানবোট না আসতে পারে। শত্ররা নদীপথে পার না হতে পারলে নদীর এক পাড়ে নামবে, তখন আমরা আক্রমণ চালাব। এটা ছিল পরিকল্পনা। এরপর যাই পিরোজপুর। পিরোজপুরে লেঃ জিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়। মেজর জলিল তাকে পিরোজপুরের ভার দিয়ে আমাকে নিয়ে বাগেরহাটে যান। বাগেরহাটের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলি এবং পরিকল্পনা নিই খুলনা বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয়ার জন্য। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩/৪ এপ্রিল রাতে বেতার কেন্দ্রে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাই এবং ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলনা বেতার কেন্দ্র মুক্ত রাখতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকসেনাদের প্রবল চাপে খুলনা বেতার কেন্দ্র বেশীক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। খুলনা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধে আমাদের তিনজন শহীদ হন। পাকসেনাদের ৩৫ জনের মত হতাহত হয়। আমরা বাগেরহাটে ফিরে আসলাম।
বাগেরহাটে এসে প্রথতে খুলনার এম-সি-এ জনাব রহমান, ছাত্রনেতা টুকু এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। যোগাযোগ করে আমরা রূপসা নদী পার হয়ে রাতের আঁধারে খুলনা শহরের পিছন দিক দিয়ে গিয়ে গোল্লামারীতে অবস্থিত খুলনা বেতার কেন্দ্রের নিকটে কলাবাগানে ২টি প্লাটুনকে অবস্থান নিতে বলি। খুলনা থেকে গোল্লামারী আসার পথে একটি ব্রিজ ছিল। সেই ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ নেয়ার জন্য আর একটি ছোট গ্রুপকে নিযুক্ত করি। বয়রাতে কিছু ইপিআর ছিল। তাদের বলা হয় আমরা যখন গোল্লামারী বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব তখন তারা যেন সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে খুলনা শহরের নিকটস্থ গ্রামের দেশপ্রেমিক যুবকদের (নক্সালদের) সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা আমাদের আক্রমণে সাহায্য করার জন্য একসাথে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একসাতে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করব।
পরিকল্পনামত ৩/৪ এপ্রিলের রাত ৯টার সময় গোল্লামারীতে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। গোল্লামারীতে অবস্থিত পাকসেনাদের সাহায্য করার জন্য সার্কিট হাউস থেকে আরও সৈন্য ১টা জীপ ও ২টা ডজে করে গোল্লামারীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আগে থেকেই গোল্লামারী-খুলনার মধ্যে আবস্থানরত এ্যামবুশ পার্টি পাকনেসাদের গাড়ীর উপর গ্রেনেড, হাতবোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। জীপ এবং ডজ দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাক-সেনারা টিকতে না পেরে ব্রীজ এবং বেতার কেন্দ্র ছেড়ে শহরে পালিয়ে যায়।
বয়রাতে অবস্থানরত ইপিআররা শত্রুদের উপর কোন কারণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি। সেজন্য আমরা খুলনা শহর দখল করতে পারিনি। বেতার কেন্দ্র চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এ আক্রমণে শত্রুদের ৭৯ জন হতাহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজর ছিলেন। আমাদের পক্ষে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হাবিব নামে জনৈক তরুণ ছাত্র ছিল, সে আক্রমণের পূর্বে তার পিতার রিভলবার চুরি করে এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। তার বয়স কম দেখে আমি তাকে আক্রমণে অংশগ্রহন করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার চোখে ফাঁকি দিয়ে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধের পরে তাকে মৃত অবস্থায় দেখি। শহীদদের মধ্যে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ই-এম-ই”র সৈনিকও ছিলেন।
পরদিন শত্রুরা খুলনা শহর থেকে মর্টারের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং ৩০-এম-এম-জি থেকে আমাদের উপর মুষলধারে গুলি চালাতে থাকে। আমরা চিন্তা করে দেখলাম শত্রুদের বিরাট শক্তির সাথে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। সেজন্য কৌশলগত কারণে ৫ই এপ্রিল রাতে শত্রুসৈন্যের প্রচণ্ড চাপের মুখে টিকতে না পেরে ফিরে বাগেরহাটে চলে আসি। আমাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণকে আমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে জ্ঞাত করা এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত করা। সেটা আমরা করতে পেরেছিলাম।
বাগেরহাটের তৎকালীন এস-ডি-ও পরিস্থিতির জন্য ভীত ছিলেন। তিনি আমাদের ঠিকমত সাহায্য দিতে পারছিলেন না। বাগেরহাট শহরে অবস্থান নিয়ে থাকা ঠিক হবে না, কেননা শত্রুরা আমাদের অবস্থানের কথা জেনে ফেলেছিল। তাই বাগেরহাটের ছেলেরা বলে খান জাহান আলী সাহেবের দরগার পাশে অবস্থান নিলে ভাল হবে। তাদের একটা বিশ্বাস ছিল দরগার কাছাকাছি অবস্থান নিলে শত্রুরা আক্রমণ করতে পারবে না। সেজন্য আমি বাগেরহাটে দরগার পাশে অবস্থান নিই। বাগেরহাটের এম-সি-এ আবদুর রহমান অনেক সময় আমাদের কোন নির্দেশ না নিয়ে অনেক কাজ করে ফেলতেন। আমি খবর পাই খুলনার এম-সি-এ শেখ আবদুল আজিজ সাহেব বাগেরহাটে এসেছেন। তার সাথে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।
একদিন খবর পাই একটা জাহাজে কিছু হাতিয়ার আছে যার কথা পাকসেনারাও জানেনা এবং জাহাজটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। এ খবর আমাকে দেন মংলা পোর্টের একজন কাস্টম অফিসার। সে হাতিয়ার যোগাড় করার জন্য আমি দুটি স্পীডবোট নিয়ে সুন্দরবন হয়ে ঘুরে মংলা পোর্টে যাই। পোর্টে গিয়ে একটা স্পীডবোট পরিত্যক্ত জাহাজটির কাছে যায়। আমি অন্য স্পীডবোটটি থেকে শত্রুদের উপর নজর রাখি। আগের স্পীডবোটটি যখন কয়েক বাক্স মাল নামিয়েছে, হঠাৎ করে গানবোট থেকে পাকসেনারা গোলা ছুঁড়তে থাকে আমরা কোনরকমে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পরে বাক্স খুলে দেখতে পাই, সেগুলি বন্দুকের গুলি বাগেরহাট থেকে আসার পথে দেখতে পাই চার নৌকা বোঝাই চাল চুরি হয়ে গেছে। আমরা তার অধিকাংশই উদ্ধার করে বাগেরহাটে নিয়ে আসি। গুলি নিয়ে স্পীডবোটে করে পালিয়ে আসার সময় বৈঠাঘাটা থানাতে আশ্রয় নিই। এখানে শুনতে পাই, পাকসেনারা নদীপথে গানবোটের সাহয্যে পাহারা দিচ্ছে। আমি এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে বাগেরহাটে ফিরে আসি। একদিন রাতে দালাল রজব আলী ও তার সঙ্গীরা আমাদের বাগেরহাট দরগা অবস্থানে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়। আমরা হামলা প্রতিহত করি। রজব আলী ও তার দলবল রাতের অন্ধকারে আমাদের কাছে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন উপায়ে বাধার সৃষ্টি করত।
নানারকম সুবিধা অচলাবস্থা ও সাময়িক হতাশার জন্য বাগেরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক হতাশার সৃষ্টি হয়। আমি তাদের মধ্যে হতাশার ভাব দূর করে মুক্তিবহিনীকে সংগঠিত করে তুলি। তারপর মেজর জলিল আমাকে পিরোজপুর ও বাগেরহাটের ভার দেয়া হয় এবং আমাকে বরিশালে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সেখানে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। তারপর আমি বরিশালে এসে আগেকার তৈরী বাংকার এবং অন্যান্য স্থানে অবস্থান নিই এবং বরিশাল শহর ও অন্যান্য এলাকায় যাতে শত্রুরা প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য শক্তিশালী ব্যূহ তৈরী করতে থাকি। বরিশাল থেকে বেশ কিছুদূরে জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পারে বাংকার খুঁড়ে শত্রুর অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে থাকি। ঢাকা এবং ভোলা থেকে রাত্রে পাকসেনারা আসতে না পারে তার জন্য জুনাহারে অবস্থান নিই। পূর্বেই বলেছি বরিশাল হল নদীপ্রধান। স্থলপথে পাকসেনাদের বরিশাল আসা অসম্ভব ছিল। যেদিক দিয়েই শত্রুসেনারা বরিশালের দিকে আসুক না কেন তাদের নদীপথ হয়েই আসতে হবে। পটুয়াখালী তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। সেদিক দিয়ে পাকসেনাদের আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না, খুলনা হয়ে এতদূর ঘুরে পাকসেনারা আসবে সেটাও সম্ভব নয়। তবুও বরিশাল থেকে কিছু দূরে আমরা বাংকার খুঁড়েছিলাম পাছে খুলনার দিক থেকে কোন আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। তবে অস্ত্রের অভাবে সেখানে কোন অবস্থান নেওয়া হয়নি। জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পারে অবস্থান নেওয়ার পর শত্রুরা যাতে অতি সহজে নদীপথে বড় স্টীমারে না আসতে পারে তার জন্য ২টা স্টীমার ব্যারিকেড করে নদীর মধ্যে আড়াআড়িভাবে রেখে দেয়া হয়। আমি জুনাহারে প্রথমে ৯০জনকে ৯০টি রাইফেল দিই। এর মধ্যে ৫০টি ৩০৩ রাইফেল ছিল, বাকি ৪০টি ছিল মান্ধাতা আমলের। মেজর জলিল ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে অস্ত্রের জন্য ভারত থেকে ৫০টি এস-এম-জি, ২০০টা ৩০৩ রাইফেল, ১৫টি এস-এল-আর, ৩০০টা ৩৬-হ্যাণ্ড গ্রেনেড ও কিছু এনারগা গ্রেনেড ও লাঞ্চার নিয়ে আসেন। তবে এসব অস্ত্রের কোন শক্তি ছিল না পাকসেনদের গানবোট ধ্বংস করার। এসব অস্ত্র নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মেজর জলিলের হাতে তুলে দেন। মেজর জলিল এসব অস্ত্রের মধ্যে আমাকে ২টা এস-এল-আর, ৪টা এনারগা গ্রেনেড ও ৩০টি মান্ধাতা আমলের রাইফেলের পরিবর্তে ৩০৩ রাইফেল ৩০টি দেন। ইতিপূর্বেই পাক বিমান বাহিনী বরিশাল শহরে এসে ২টা স্যাবর জেটের সাহয্যে স্ট্র্যাফিং করে। বিমান বাহিনীর বুলেটবৃষ্টির ফলে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এত ৩০/৪০ জন নিরীহ লোক মারা যায়।
এ বিমান আক্রমণের ফলে জনসাধারণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং প্রাণভয়ে অধিকাংশ লোকই শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বরিশাল একরকম জনশূন্য হয়ে পড়ে। বিমান হামলার বেলস পার্কে অল্পের জন্য মেজর জলিল রক্ষা পান।
বিমান হামলার পর প্রয়োজনীয় মজুত রিজার্ভ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী ও অন্যান্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। বরিশাল শহরের উপর আক্রমণ অত্যাসন্ন ভেবে আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পেট্রোল যোগাড় করার জন্য ২৪শে এপ্রিল সন্ধ্যায় স্পীডবোটে করে ভোলায় যাই। বহুকষ্টে সামান্য পেট্রোল সংগ্রহ করে পরদিন সকালে ফিরে আসি।
আমি যখন কণ্ট্রোল রুমে বসে আছি তখন হঠাৎ বরিশালের ২০ মাইল দুরে নান্দিনাবাজারে অবস্থানরত আমাদের পার্টি খবর জানায় ৪টি গানবোট ও অন্য দুটি বোটে করে পাকসেনারা যতদূর সম্ভব বরিশালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা বরিশাল আক্রমণ করতে পারে। আমি তৎক্ষনাৎ জুনাহারে আমাদের অবস্থানের দিকে চলে যাই। জুনাহারে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি পাকসেনারা আমাদের উপর হামলা শুরু করে দিয়েছে। আমি জুনাহারের তালতলী নদীর পারে আমার অবস্থানে গিয়ে দেখি সেখানে অবস্থানরত সেনারা ভয় পেয়ে গেছে। আমি তাদের সাহস দিয়ে সংগঠিত করি। শত্রুসেনারা বাধা পেয়ে দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নদীর উপর ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখা ২টি স্টীমারের উপর হামলা চালায়। ১টি স্টীমার গোলা মেরে পুড়িয়ে এবং অন্যটি ডুবিয়ে দিয়ে তারা তালতলী নদীর ভেতরে ঢুকে পড়ে।
আমাদের হাতে ভারী অস্ত্র না থাকার ফলে আমরা গানবোটগুলি ধ্বংস করে দিতে পারিনি। আমি দ্রুত ১টি নৌকায় করে তালতলী নদী পার হবার চেষ্টা করি। এ সময় শত্রুসেনারা আমার নৌকার উপর হামলা চালায়। এতে নৌকার মাঝি আহত হয়। আমি দ্রুত নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং পার হতে সক্ষম হই।
শত্রুসেনারা সে সময় আমার উপর মেশিনগানের গুলি চালাতে থাকে। আমি চরে ধানক্ষেতে প্রায় ১ ঘণ্টা পড়ে থাকি। তারপর আস্তে আস্তে ক্রলিং করে মূল অবস্থানে ফিরে আসি।
শত্রুদের গানবোট ধ্বংস করার জন্য আমার বাহিনীর ইপিআর-এর হাবিলদার আবদুল মান্নান অতি সাহসিকতার সাথে খুব নিকট থেকে ১টি গানবোটের উপর হামলা চালায়। এতে গানবোটের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ১২টা পর্যন্ত মুষলধারে উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে হেলিকপ্টারে আরও ১০০-এর মত খানসেনা তালতলী পাড়ে নামানো হয়। সন্ধ্যার দিকে আমরা অবস্থান তুলে নিই। পাকসেনারা আশেপাশের গ্রামগুলি উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরদিন ২৬শে এপ্রিল পাকসেনারা বরিশাল শহরে প্রবেশ করে এবং যুদ্ধের সময় যথেষ্ট গোলাগুলি ক্ষয়ের ফলে পাক সেনারা বরিশাল শহরে ক্ষতি করতে পারেনি। ইতিমধ্যে সংঘর্ষের সময় বরিশাল শহরের লোকেরা নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যায়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ২৫ জন মারা যায়। আমাদের কেউ মারা যায়নি।
বরিশালে প্রতিরোধের বিবরণ
সাক্ষাৎকারঃ মহিউদ্দীন আহমদ, প্রাক্তন এম-টি
২৮-০৮-১৯৭৩
২৫মে মার্চের ঘটনা আমি জানতে পারি টেলিফোনযোগে রাত সাড়ে নটা-দশটার দিকে। আমরা মঞ্জুর ভাই সহ বসলাম আলাপ-আলোচনার জন্য। অয়ারলেস মারফত আমরা বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে ঢাকার পুরা খবর পেলাম। রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই পাকসেনা আসার আগেই আমরা সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র তথা অস্ত্র আমাদের হাতে নিয়ে আসবে।
মার্চ মাসের শুরু থেকেই আমিসহ আমার দলের লোকজন বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে জনমত গঠন করে। পাক-আক্রমণ ঘটলে যেকোন জবাবের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সমগ্র বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানা, উইনিয়ন, গ্রামে সভা করে বেড়াই। মানুষ প্রস্তুত ছিল যেকোন অবস্থার জন্য।
২৬শে মার্চ আমি এবং নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মিলে পুলিশ লাইনে পুলিম রিজার্ভ ফোর্সের সামনে বক্তৃতা করি। তারা সবাই হাত উঠিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত বলে জানায়। এস-পি'র সাথে আলাপ-আলোচনা করি। আমরা সমস্ত জেলার দায়িত্ব নিই। পাকসেনা ওয়াপদা কলোনীতে কিছু ছিল, তারা আমাদের ফোন পেয়ে পালিয়ে যায়।
২৭শে মার্চ আমরা এসপি'র কাছে থেকে চাবি নিয়ে ট্রাকে করে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাই। লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী কাশীপুর, মঞ্জুর সাহেবের বাসাতে অস্ত্রশস্ত্র রাখি এবং ছাত্র, পুলিশ, আনসার, সাধারণ লোক, ছাত্রলীগ কর্মী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, শ্রমিক সব মিলে ৪/৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করি। ২৭/২৮শে মার্চ থেকে পুলিশ লাইনে এবং বেলস পার্কে (বঙ্গবন্ধু পার্ক) আর্মস ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। উজিরপুর থানাতে মেজর জলিলের বাড়ী। জনসভা করে বের হওয়ার সময় মেজর জলিলের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সে আমাদের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বলে, “আমি ছুটিতে আছি, যদি কোন কাজে লাগে ডাকবেন।” ২৮শে মার্চ আমরা চিঠি পাঠিয়ে মেজর জলিলকে নিয়ে আসি এবং কাজে লাগাই। আমরা ডিসির বাংলোতে আলাপ-আলোচনা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এম-পি-সিভিল প্রধান; মহিউদ্দীন আহমদ এম-পি খাদ্য এবং যোগাযোগ; আমির হোসেন আমু, এম-পি-সাহায্য; আমিনুল হক চৌধুরী-বিচার বিভাগ; এম-পি সার্জেণ্ট ফজলুল হক, মেজর জলিল ও এস-পি-ডিফেন্স; আবদুল মালেক খান, আওয়ামী লীগ সভাপতি-অর্থ বিভাগ; সর্দার জালাল, এডভোকেট ইউসুফ, হুমায়ুন এমপি-প্রচার বিভাগ; কাজী মহিউদ্দিন-নদীপথ যোগাযোগ; হেমায়েত উদ্দীন এডভোকেট-সমন্বয় বিভাগ। প্রত্যক বিভাগের সাথে ডিসি, এসপি, এডিসি, যাবতীয় বিভাগীয় প্রধানরা সম্পাদক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ডিসি ছিলেন হাবিবুর রহমান, এমপি ফখরুদ্দিন আহমেদ, এডিসি কাজী আজিজুল ইসলাম (শহীদ), অতিরিক্ত জেলা পুলিশ প্রধান গোলাম আহমদ (শহীদ), জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমত আলী, আনসার এ্যাডজুটেণ্টরাও আমাদের সহযোগী ছিলেন। তালতলী, সাগরদি, কাশীপুর এলাকা, লাকুটিয়া ইত্যাদি স্থানে ডিফেন্স দেওয়া হয়। শহরের ভিতরেও আমাদের গোপন সেল ছিল।
ইতিমধ্যে ঢাকা, খুলনার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শরণার্থী তথা আহত লোক আসা শুরু করে। তাদেরকে কলেজসহ বিভিন্নস্থানে রাখার ব্যবস্থা করি এবং পরে তাদেরকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা আমি নিজে করি। ফোন মারফত আমাদের বাগেরহাট, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর ইত্যাদি স্থানের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মঞ্জুর সাহেব (এমপি) আগরতলা যান। তিনি আগরতলা থেকে ফিরে আবার কলকাতা যান অস্ত্রের জন্য। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে ডিফেন্সের। আমি ১৫০ জনের মত যোদ্ধাকে অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ সহ লঞ্চযোগে চাঁদপুর পৌঁছি মিজানুর রহমান চৌধুরীর অনুরোধে। এই বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস আক্রমণ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। আমাদের বাহনীর ৩০ জনের মত শহীদ হয় ওখানে।
বাগেরহাটেও আমরা পাঠিয়েছিলাম ৬০ জনের মত যোদ্ধাকে। খুলনার যুদ্ধে আমাদের ৩/৪ জন শহীদ হন। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি ছিল যারা মোটরসাকেল এবং মোটর সহযোগে যোগাযোগ রাখতো। প্রতি থানাতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। থানার সাথে আমাদের সব সময় যোগাযোগ থাকতো। বরিশালের সকল মহকুমায় আমরা নির্দেশ এবং যোগাযোগ রাখতাম। ২৬শে এপ্রিল বরিশালের পতন ঘটে পাক বহিনীর হাতে। ইতিমধ্যে এপ্রিল মাসের ১০/১২ তারিখে এবং ১৯/২০ তারিখে পাক বিমান দু'বার হামলা চালিয়ে আমাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয় এবং বোমার আঘাতে ২০ জনের মত লোক মারা যায়। বহু আহত হয়। পথিমধ্যেও বহু লোক মারার যায়। মঞ্জুর সাহেবের কথা মত মেজর জলিল এবং ক্যাপ্টেন হুদাকে অস্ত্রের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। মঞ্জুর ভাই ইতিমধ্যে ২২ এপ্রিল কিছু অস্ত্র নিয়ে বরিশাল আসেন।
২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা থেকে পাকসেনারা শেলিং করতে করতে আসে মুলাদির দিক থেকে। খুলনার দিক থেকেও আসতে থাকে। ফরিদপুর থেকেও স্থলবাহিনী মার্চ করে আসতে থাকে। ৪টি জেট অনবরত বোমা ফেলা শুরু করে। পর মুহুর্তে ৬টি হেলিকপ্টারযোগে অসংখ্য ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। মঞ্জুর তখন তালতলী (উত্তর দিকে) ও আমি দক্ষিণ দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করি। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন ফিরুর গুলি লাগে। পাশাপাশি মঞ্জুরও ছিল। মঞ্জুর আমাকে মেসেজ দেন ফোর্স নিয়ে লাকুটিয়া রওয়ানা হবার জন্য। আমি নিজে বাহিনীর ডাক্তারসহ লাকুটিয়া রওনা হই। কিন্তু অনবরত বোমা ফেলার জন্য লাকুটিয়া না যেতে পেরে সরদার জালাল, আমিনুল হক চৌধুরী এবং কিছু ছেলে নিয়ে কাশীপুর ক্যাম্পে চলে যাই। এর আগেই অবস্থা বুঝতে পেরে শহর থেকে বেসামরিক লোকদের সরে যেতে বলি। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকেও চলে যেতে বলি। সরদার জালালকে রুহাতে (গ্রাম) রেখে একটি জীপ নিয়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বিকাল ৫টার দিকে শহরে চলে আসি অবস্থা দেখার জন্য। শহরে ঢোকার সময় গ্রামসংলগ্ন রাস্তার দু'পাশে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে পজিশন নিয়ে থাকতে দেখি। আমি কিছু মুক্তিবাহিনীকে নদীর ওপারে (কীর্তনখোলার ওপারে পজিশন নিয়ে গানবোটে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করতে বলি।
শহর তখন শূন্য। কিছুক্ষণ পরপরই আবার ব্যাপকভাবে বোমা ফেলা শুরু হয়। আমি ও ড্রাইভার দু'জন বাংকারে আধ ঘণ্টা বসে থাকি। বোমা ফেলা একটু কমলে গাড়ী নিয়ে রুহা গ্রামে রওনা হই। ছত্রীসেনা নেমে গিয়েছিল। তারা আমার গাড়ী লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আমরা অল্পের জন্য বেঁচে যাই। রুহা গ্রামে পৌঁছালে মঞ্জুরের মেসেজ পেলাম যে আমাদের লাকুটিয়া ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তিনি স্বরূপকাঠির দিকে যোদ্ধা নিয়ে রওনা হয়েছেন। আমাকে রাতেই তার সাথে দেখা করতে বলেন। রাতেই কিছু যোদ্ধা, জালাল আহমেদসহ রওনা হয়ে পরদিন ভোরবেলা স্বরুপকাঠি (থানা) গিয়ে পৌঁছাই। ২৬ তারিখে রাত ৩টার দিকে কাউখালীতে মঞ্জুরের সাথ আলাপ করি। আমরা ওখান থেকে গানবোটের শেলিং শুনতে পাচ্ছিলাম।
২৭শে এপ্রিল রওনা হয়ে আমরা ৩টি বড় লঞ্চে বহু পরিবারসহ (২০০/৩০০) সুন্দরবন হয়ে হাসনাবাদ পৌঁছাই ২৯শে এপ্রিল। বিশ্রাম সিংহ তখন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রধান ছিলেন। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন। কলকাতার বালিগঞ্জে মঞ্জুরসহ মন্ত্রী পরিষদের সাথে দেখা করে আলাপ-আলোচনা করি বরিশালের সব কথা বলি। জেনারেল ওসমানীর সাথেও ওখানে সাক্ষাৎ হয়। বিশ্রাম সিংহ মিঃ মুখার্জী, নেভাল কমাণ্ডার কে,বি, সিংহ- এদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। এদের আন্তরিকতা ও সাহায্য-সহানুভূতি ভোলা যায় না।
১লা মে থেকে ৭ই মে পর্যন্ত হাসনাবাদ, ব্যারাকপুর পাগলের মত আমি এবং মঞ্জুর ঘোরাঘুরি করে দুই লঞ্চ আধুনিক অস্ত্র, ওষুধ, ড্রাই ফুডসহ কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস সরকারী চুক্তি ছাড়াই কামাণ্ডার মুখার্জী, কে,বি, সিংহ, বিশ্রাম সিংহ গোপনে আমাদের হাতে তুলে দেন। ৬/৭ দিন আমাদের ছেলেদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে প্রতি গ্রুপকে বিভিন্ন অস্ত্রে বিশেষ শিক্ষা দিই। আমরা নিজেরাও শিক্ষা নিই। আমি, মঞ্জুর, সরদার জালাল, প্রায় ৮০ জন যোদ্ধা, মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান, লেঃ নাসের সহ ২টি লঞ্চ ভর্তি অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে বরিশালের দিকে রওনা হই। ৪০ হর্স পাওয়ারের স্পীডবোটও ছিল আমাদের সাথে।
দুপুর ২টার দিকে আমরা হাসনাবাদ থেকে রওনা হই। ২টি ভারতীয় নেভাল শীপ আমাদের পৌঁছে দিয়ে সালাম করে চলে য়ায়। একটি লঞ্চে মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান এবং অন্যটিতে আমি, মঞ্জুর, লেঃ ময়নুল ছিলাম। আমরা সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করি। খুলনা জেলার সুন্দরবন এলাকায় গাবুরিয়া ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনীর নিকটে তিনটি পাক গানবোট আমাদের আক্রমণ করে। আমরাও পাল্টা আক্রমণ করি। এক ঘণ্টা যাবৎ দু'পক্ষে গোলাগুলি হয়। আমাদের আক্রমণে একটি গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন ওরা দূরে চলে গিয়ে কামান ছুড়তে থাকে। রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। আমাদের দু'টি লঞ্চে পিছনে যে পেট্রোল ছিল তাতে শেল পড়ে আগুন লেগে যায়। ওখানে আমাদের কয়েকজন যোদ্ধা শহীদ হয়। আমরা পানিতে ঝাঁপ দিই। আমরা কিছু সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠি। ওয়াপদা বাঁধে উঠে পজিশন নিই। কিছু মুক্তিযোদ্ধাসহ আমি এবং মঞ্জুর পিছু হঠতে থাকি। পাকসেনারা অনবরত শেল ফেলতে থাকে গ্রামের দিকে। আমরা যে কোন স্থানে তার কিছুই বুঝছিলাম না।
গাবুরিয়া ইউনিয়নের ঐখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খবর দিয়ে পাক গানবোট নিয়ে আসে। তখন ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঠের ভিতর আমি নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে হারিয়ে ফেলি। আমি এবং আবুল হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছিন্নভাবে একদিকে এগোতে থাকি। ভোরবেলা সর্দার জালাল, কানু, মকসেদ আলী, বাদল, ফিরোজসহ কিছু লোককে মাঠের মধ্যে দেখতে পাই এবং তাদের সাথে মিলিত হই। আমরা ১৭ জন লোক। আর কারো কোন খোঁজ পাইনি। একদিকে বিদ্যুৎ, সার্চ লাইটের আলো, অন্যদিকে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ক্রলিং করে এগোচ্ছিলাম। আমরা ১৭ জনই কমবেশী আহত ছিলাম। আমরা ১৭ জন গ্রামের দিকে রওনা হচ্ছিলাম। বৃষ্টি তখন সমানে হচ্ছে। আমরা পাইকগাছা থানার ভিতরে মদিনাবাদ গ্রামে কয়রা ইউনিয়নে পৌঁছাই। আমরা আমাদের পরস্পরের নাম বদল করি। গ্রামের অবস্থাও বুঝি যে তা আমাদের পক্ষে হবেনা। মওলানা সালাম ওখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। মওলানা আবদুস সালাম তার দলবল এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘেরাও করে বন্দী করে ফেলে।
প্রতিরোধ-বরিশাল
সাক্ষাৎকারঃ আবদুল করিম সরদার, প্রাক্তন এম-পি
২২-১০-১৯৭২
২৬শে মার্চ কটকস্থল নামক স্থানে পাক-বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর এক প্রচণ্ড যুদ্ধে পাক-বাহিনীর ৭ জন নিহত ও বহু আহত হয়। অপরপক্ষে মুক্তিবাহিনীর ৩ জন (পরিমল, আবুল হাশিম ও মোশাররফ) শহীদ হয়। জুলাই মাসের শেষের দিকে কোদালদহে এক যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
প্রতিরোধ-বরিশাল
সাক্ষাৎকারঃ ডাঃ মোহাম্মদ শাহজাহান
....... ১৯৭২
মার্চ মাসে আমি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় ছিলাম। ২৫শে এপ্রিল, ১৯৭১-এ পাকিস্তান সেনবাহিনী বরিশাল দখল করে নেয়। বরিশাল শহরের ৪ মাইল দূরে লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করা হয়। ২৫শে এপ্রিল পাকসেনা বাহিনীর গুলিতে কামাল নামে একজন ছাত্র আহত হয়। আমাকে এসে খবর দেয়া হল। তখন সেখানকার হাসপাতালের সমস্ত ডাক্তার ভয়ে পালিয়ে যায়। আহত ছাত্রটিকে লাকুটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমি এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লাকুটিয়া ঘাঁটিতে গেলাম।
বরিশাল শহরের পতনের পূর্বে মেজর জলিল সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন। তিনি, লেফটেন্যাণ্ট হুদা এবং আরো কয়েকজন তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবহিনীর লোক ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। মেজর জলিল তখন বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এর আগে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। তিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন।
লাকুটিয়াতে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে আমরা সেখান থেকে মাধবপাশা চলে গেলাম। আমরা প্রায় ৩০ জন লোক ছিলাম। তাদের মধ্যে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, লেঃ নাসিরও ছিলেন। মাধবপাশা থেকে আমরা মামুদকাঠিতে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম। এখানে আমরা শপথ গ্রহণ করি যে, আমরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব। এখানে বসে আমরা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। দুটো ছেলেকে খবর আনার জন্য বরিশাল শহরে পাঠানো হয়।
আমরা পুলিশের এস-পি'র লঞ্চে করে সুন্দরবনের দিকে রওনা হলাম। ২৭শে এপ্রিল দুপুরের দিকে সুন্দরবনে ঢুকলাম। ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে ছিলাম। সুন্দরবন, শরণখোলা, বুড়িগোয়ালিনী হয়ে ১লা মে ভারতীয় সীমান্ত হিংগলগঞ্জে পৌঁছালাম। সেদিনই ভারতের হাসাবাদে চলে গেলাম কালিন্দী নদীর মধ্য দিয়ে।
এখানে এসে মেজর জলিল, লেঃ হুদা এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। বরিশাল শহরের পতনের ৪/৫ দিন পূর্বে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তাঁরা ভারতে গিয়েছিলেন। তারা ভারতের কাছ থেকে বেশ অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে দিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, এ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনের কোন এক জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করা হবে।
৬ই মে দুটো লঞ্চে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করা হল। আহত কামাল এবং লেঃ হুদাকে হাসনাবাদে আরো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য রেখে আসা হল। আমরা দুপুরের দিকে রওনা হলাম। আমরা হিংগলগঞ্জে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সন্ধ্যার দিকে কৈখালীর সীমান্ত ঘাঁটির কাছে একটা খালের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমাদের বড় লঞ্চটা আগে ছিল এবং মেজর জলিলের লঞ্চটা ২৫/৩০ গজ পিছনে ছিল। লঞ্চ-এর সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল। বড় লঞ্চে আমি, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এমপি মহিউদ্দিন, সেকেণ্ড লেঃ নাসির এবং আরো অনেকে ছিল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল এবং বৃষ্টি হচ্ছিল। বুড়িগোয়ালিনীর কাছে কপোতাক্ষ নদীতে পাকিস্তানীদের দুটো গানবোট ছিল। আমরা গানবোটগুলো প্রায় ৫০ গজের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। তখন গানবোট থেকে আমাদের লঞ্চের উপর সার্চলাইট ফেলা হল এবং ১টা সিগন্যাল ফায়ারও করা হল। লঞ্চটাকে নদীর পারে লাগিয়ে আমরা ছোট-খাট অস্ত্র এবং কিছু গুলির বাক্স নিয়ে নদীর পাড়ে লাফিয়ে পড়লাম। পিছনের লঞ্চ থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। তখন গানবোটগুলো আমাদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমরা বাঁধের অপরদিকে গিয়ে বসে পড়লাম। এখান থেকে আমরা কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণ করি এবং পেছনের লঞ্চের কাছে যাবার চেষ্টা করি। রাত তিনটা পর্যন্ত গানবোটের সাথে আমাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়। আমরা লঞ্চ থেকে নামার ঘণ্টাখানেক পরে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
আমরা ১৪/১৫ জন পেছনের লঞ্চের দিকে এগুতে লাগলাম, কিছুদূর গিয়ে আমি এবং আর একজন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র মইনুল পথ হারিয়ে ফেলি। পথ হারিয়ে আমরা আবার পেছনের দিকে যেতে শুরু করি। কিছুদূর গিয়ে একটা ডিংগী নৌকা দেখতে পেলাম। আমরা নৌকায় উঠলাম। কিন্তু নদীর মধ্যে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের উপর গানবোট থেকে সার্চলাইটের আলো এসে পড়ল। আমরা নদীতে লাফিয়ে পড়লাম এবং সাঁতরে নদীর অপর পাড়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে একজন লোকের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তখন ভোর হয়ে গিয়েছিল। সে এলাকাটি ছিল মুসলিম লীগের সমর্থকদের। পথে আমরা কয়েকবার মুসলিম লীগের দালালদের হাতে ধরা পড়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। অবশেষে আমরা আবার ভারতে চলে যেতে সমর্থ হই।বরিশাল রণাঙ্গনে[২]
পাকসৈন্যরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাদারীপুর শহর দখল করে নিয়েছিল। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ওরা মিলিটারী ভ্যান নিয়ে বরিশাল জেলার সীমানায় এসে প্রবেশ করল। খবর পেয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী গৌরনদী থেকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। এদের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্যায় অভিজ্ঞ কেউ ছিল না- সকলেই কাঁচা, সকলেই অনভিজ্ঞ। মাস খানেকের রাইফেল ট্রেনিং আর নির্ভীক দেশ প্রেম, এই টুকু কেউ সম্বল করে তারা এই দুর্ধর্ষ শত্রুদের মোকাবিলা করতে চলেছে।
বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তরেখায় ভুরপাটা গ্রাম। পাক-সৈন্যবাহিনী বেলা এগারোটার সময় এই ভুরপার্টার সেতু পেরিয়ে ইল্লা গ্রামের দিকে চলে এসেছে। দু'পাশের গ্রামবাসীদের মনেও আতঙ্কের সঞ্চার করে ভ্যানগুলি গর্জন করে ছুটে আসছে। রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার সবকিছুই আছে তাদের সঙ্গে। কুড়ি-পঁচিশটা রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ-বিদ্যায় অশিক্ষিত একদল তরুণ তাদের প্রতিরোধ করতে চলেছে।
মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু'টি তরুণ এই সীমান্তে এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করে চলেছিলেন। দু'জনেই কলেজের অধ্যাপক। মতৃভূমির স্বাতীতার জন্য অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে এসেছেন। আজ সকল কর্তব্যের বড় বর্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়া। শত্রুসৈন্যরা যে বরিশাল জেলার মাটির উপর এসে গেছে, এখবরটা তখনও তাঁরা জানতে পানেনি। আক্রমণ আসন্ন, ভুরপাটা গ্রামের সেতুটিকে এখণই ভেঙ্গে ফেলা দরকার। সেতুটাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাঁরা দু'জন রিকশাযোগে ভুরপাটা গ্রামের দিকে চলেছিলেন। ইল্লা গ্রামে এসে পৌঁছতেই মিলিটারী ভ্যানের গর্জন শুনে চমকে উঠলেন তাঁরা। সরে পড়ার সময় ছিল না, কয়েক মুহুর্তের মধ্যে দ্রুতবেগে ছুটে আসা ভ্যানগুলি তাঁদের দৃষ্টিগোচরে এসে গেল। তার ঠিক সেই সময় একটা বুলেট তাঁদের দু'জনের মাঝখান দিয়ে রিকশার গা ভেদ করে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দ'জন রিকশা থেকে পথের দু'পাশে ছিটকে পড়লেন। বরিশাল জেলার বুকে শত্রুপক্ষের এই প্রথম গুলিবর্ষণ।
তাঁরা দু'জন হামাগুড়ি দিয়ে উঁচু সড়ক থেকে নীচে নেমে এলেন। তাঁদের ভাগ্য ভাল, তাঁরা শত্রুদের নজরে পড়ে যাননি। তাঁরা গুণে গুণে দেখলেন। ১০টা ভ্যন, তার পেছনে একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়ি। ভ্যানগুলি সম্ভবত গৌরনদীকে লক্ষ্যকরে ছুটে চলে গেল। এঁরা দু'জন গ্রামের পথ ধরে পেছন পেছন ছুটলেন।
বার্থী গ্রামের সামনে গিয়ে ভ্যানদুটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একদল সৈন্য ভ্যন থেকে নেমে গ্রামের ভেতর ঘুরে ঘুরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে চলল। যাকে সামনে পেল তাইে মারল। তখন কালীপূজার সময়। ওরা পূজাবাড়িতে গিয়ে পূজায় রত দু'জন পুরোহিতকে হত্যা করল। এই 'পবিত্র' কর্তব্য সুসম্পন্ন করে ভ্যানগুলি আবার তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করল।
বার্থী থেকে মাইল দুই দূরে কটকস্থল নামে একটি গ্রাম। মুক্তিবাহিনীর যে যোদ্ধারা শত্রুসৈন্যদের প্রতিরোধ করবার জন্য গৌরনদী থেকে যাত্রা করেছিল, তারা সেই সময় এই কটকস্থল গ্রামে পথের ধারে বসে বিশ্রাম করছিল। ভ্যানগুলি এগিয়ে আসতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দু'পক্ষ পরস্পরকে দেখতে পেল। পাক-সৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে প্রথমেই গুলি ছুড়ল। প্রতিপক্ষ যে কোন সময় তাদের উপর এসে চড়াও হতে পারে, এমন একট অবস্থার জন্য মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল না। সেজন্য তাদের মূল্যও দিতে হয়েছিল। কিন্তু একটু বাদেই তারা তাদের পজিশন নিয়ে নিল। তারপর পরস্পর অজস্র ধারায় গুলি বিনিময় চলল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। কিন্তু পাক-সৈন্যরা যখন ভারী মেশিনগান ব্যবহার করতে শুরু করল, তখন রাইফেল সর্বস্ব মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সামনে আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীনও ছিল না। তারা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ পেছনে ফেলে রেখে গ্রামের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কটকস্থল গ্রামের যুদ্ধের দিন কয়েক পরে। গৌরনদী পাক-সৈন্যদের দখলে এসে গিয়েছে। এখানকার ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়ে এবার তারা বরিশাল শহর দখলের অভিযানের জন্য তৈরী হচ্ছে। অপর দিকে বরিশাল শহরে মুক্তিবাহিনীও চুপ করে বসে নেই। হামলাকারী শত্রুদের প্রতিরোধ করবার জন্য তারা তাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে চলেছিল।
বরিশাল শহরের মুক্তিবাহিনী গৌরনদীর মুক্তিবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশী শক্তিলালী। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ও অস্ত্রবলের দিক দিয়েই নয়, তাদের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকও ছিল। ছাত্র ছাড়াও বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইপিআর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি নিয়ে এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল।
মুক্তিবাহিনীর নেতারা প্রতিরোধ-প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে এসে এক নতুন রণকৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে হবে। সি-এণ্ড-বি রোড বরিশাল শহরকে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। শত্রুরা এই পথ দিয়েই বরিশাল শহর আক্রমণ করতে আসবে। তাদের গতিপথকে রুদ্ধ করে দেবার জন্য এবং তাদের অচল করে ফেলবার জন্য ইতিপূর্বে এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর নির্দেশে সেই সমস্ত গ্রামের লোকেরা উদ্যোগী হয়ে সেই কাজে হাত দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী শেষ মুহূর্তে হঠাৎ তাদের এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে এক নতুন রণকৌশল নিয়ে শত্রুপক্ষের জন্য এক মায়ার ফাঁদ পেতে বসল। দেখতে দেখতে সমস্ত ব্যারিকেডগুলিকে সরিয়ে নিয়ে এই রাস্তাকে যানবাহন চলবার পক্ষে সুগম করে দেওয়া হোল। শত্রুরা যাতে বিনা বাধায় এবং নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসতে পারে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বরিশাল শহলে আসতে হলে পর পর দুটো নদী পেরিয়ে আসতে হয়। প্রথমটা শিকারপুরের নদী, দ্বিতীয়টা দোহারিকা নদী। এই দুয়ের মাঝখানে দশ মাইল স্থলপথ। এইখানে মায়ার ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। পথে কোথাও কোন বাধা পাওয়া যাবে না, কোন ব্যারিকেড সরিয়ে আসতে হবে না, কোন ভেঙ্গে ফেলা পুল সারাই করে নিতে হবে না এমন কথা পাক-সৈন্যরা ভাবতেও পারেনি। এমন সহজ সুগম পথ পেয়ে তাঁরা মহাখুশী। তাদের সৈন্যবাহী গাড়িগুলি স্বচ্ছন্দে শিকারপুরের নদীর পার পর্যন্ত চলে এল।
ফেরী বোটে করে এই নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতে হবে। ওরা উল্লাসিত হয়ে দেখল ফেরীবোটের মাথায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। ফেরীবোটের লোকেরা ওদের আসতে দেখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলে জয়ধ্বনি তুলল। তখনকার মত দুর্দিনে এমন সাদর সংবর্ধনা পাবে, এটা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। আনন্দে ডগমগ হয়ে ওরা ফেরীবোটের সাহায্যে নদী পার হতে লাগল। মুহূর্তের জন্য তাদের মনে এই সন্দেহ জাগেনি যে, এই ফেরী বোট যারা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা সবাই মুক্তিবাহিনীর লোক; মুহূর্তের জন্যও তারা ভাবতে পারেনি যে তারা ইতিমধ্যেই প্রতিপক্ষের রচিত মায়ার ফাঁদে পা দিয়ে বসেছে।
এমনি করে ক্রমে ক্রমে নববই জন সৈন্য আর চালকসহ ন'খানা গাড়ি পারি দিয়ে ওপারে গিয়ে উঠল। এখানেও কোন বাধা নেই, ওরা স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলল। একটু দূরে গিয়েই ওরা থামল। তাদের গোয়েন্দারা চারদিকটা ভাল করে পরীক্ষা কারে দেখে নিল-না, কোথাও কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। সবাই গ্রামে ঢুকে পড়ল, নিঃশঙ্কচিত্তে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পেছনে পড়ে রইল ন’খানা মিরিটারী ভ্যান ও তাদের চালকরা। সৈন্যদের মধ্যে কেউ কেউ গৃহস্তদের দিয়ে ডাব, নারিকেল, কলা এবং নানারকম খাদ্য আনাতে লাগল, তারপর সেইখানেই তাই দিয়ে ভোজের উৎসবে মেতে গেল। কেউ কেউ গৃহস্থদের ভয় দেখিয়ে হাঁস-মুরগী, খাসি ইত্যাদি এনে জড়ো করতে লাগল। আবার আর একদল গৃহস্থবধূদের কাছে সোনাদানা, গয়না যা পেল সবকিছু লুটে-পুটে আনতে লাগল। এই শান্ত, ঠাণ্ডা আর ভেড়ার মত নিরীহ মানুষগুলি এর প্রতিবাদে একটি কথাও বলল না। ওরা তখনকার মত যুদ্ধবিগ্রহের কথা ভুলে গিয়ে ভোজের উৎসবে মেতে গেছে, সৈনিকের শৃঙ্খলাবোধ হারিয়ে ফেলেছে। খেয়ে-দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আরামে এলিয়ে দিয়েছে দেহ। এমন সময় হঠাৎ একই সঙ্গে বহু রাইফেলের আওয়াজ শান্ত প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সৈন্যরা। তাদের উপর বৃষ্টিধারার মত গুলিবর্ষণ চলছে। শুধু রাইফেলের আওয়াজ নয়, তারই সাথে সাথে শত শত দৃপ্তকণ্ঠের 'জয় বাংলা' ধ্বনি আকাশ বাতাস মুখরিত করে চলেছে। অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে হতে ওদের অনেক সময় কেটে গেল। অস্ত্র চালাতে গিয়েও প্রতিপক্ষের দেখা পেল না, ওরা গোপন আশ্রয়ের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে একটানা গুলিবর্ষণ করে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনির উত্তরে আহত ও মুমূর্ষ পাক-সৈন্যদের আর্তনাদ শোনা যেতে লাগল। পুরা এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আর কোন সাড়াশব্দ শোনা গেল না, শান্ত প্রকৃতি আবার শান্ত হয়ে গেছে। পাক- সৈন্যদের দুর্বল প্রতিরোধ কোন কাজেই আসেনি সেই যুদ্ধে একটি মুক্তিযোদ্ধাও মারা যায়নি।
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। হামলাকারী পাক-সৈন্যরা বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার নানা জায়গায় ঘাঁটি করে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এই নৃশংষ মানুষ শিকারীর দল গ্রামের পর গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, লোকের যথাসর্বস্ব লুটপাট করে নিচ্ছে, আর যেখানে বিন্দুমাত্র বাধা পাচ্ছে, সেখানে ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। এ এক অসহনীয় অবস্থা। গ্রামের লোক ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই অসহায় আর নিরুপায় মানুষগুলি কি করবে, কোথায় যাবে পথ খুজে পাচ্ছে না।
গৌরনদী থানায় যে-মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল ইতিমধ্যে ভেঙে-চুরে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে।
এই অবস্থায় জনকয়েক তরুণ কর্মী আবার নতুন করে মুক্তিবাহিনীকে গড়ে তোলবার জন্য আলাপ- আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে এবার শুধু গৌরনদী থানা নয়, বরিশাল জেলার গৌরনদী আর ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া ও কালকিনী এই তিন থানার কর্মীরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। সেই সময় গৌরনদী থানার পূর্ব-নবগ্রামের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।
পূর্ব-নবগ্রামটি বরিশাল জেলা আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তস্থলে অবস্থিত। পূর্ব-নবগ্রামের উত্তর দিকে একটি সরু খাল তার গা ঘেঁষে চলে গেছে। এই খালের অপর পারে ফরিদপুর জেলার নবগ্রাম। পূর্ব- নবগ্রাম থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে মেদাকুল, এখানে পাক-সৈন্যরা ঘাঁটি করে বসে আছে। এটি একটি নমঃশূদ্র অঞ্চল। এখানকার লোকদের মধ্যে অধিকাংশ কৃষক হলেও শিক্ষিত সম্প্রদায়ও আছে। তাদের মধ্যে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও আছে। মাত্র মাইল দেড়েক দূরে শত্রুদের ঘাঁটি। এখানকর বসিন্দারা প্রতিমুহূর্তেই ওদের আক্রমণের আশঙ্কা করছিল। বাইরের কোন কিছু আভাস না পেলেও কয়েকদিন থেকে এদের ভেতরে ভেতরে একটি প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল।
সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক সিদ্ধেশ্বর সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা স্থির করেছিল, যদি সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে তারা ওদের বিরুদ্ধে একহাত দেখে নেবে। পূর্ব-নবগ্রামের শিক্ষিত তরুণ ও সাধারণ কৃষকরা এই উদ্দেশ্যে সংকল্পবদ্ধ হয়ে একজোট হয়ে দাড়িয়েছিল। বরিশাল আর ফরিদপুরের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা ছেলেবেলা থেকেই লাঠি, সড়কি, লেজা ইত্যাদি অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। পূর্ব-নবগ্রামের যেসব তরুণরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে তারাও এ বিষয়ে আনাড়ি নয়, তারাও এখানো এই সমস্ত অস্ত্র চালনার অভ্যাসটা হারিয়ে ফেলিনি। এই সুঃসাহসী তরুণরা সঙ্কল্প নিয়েছিল যে, যদি সুযোগ পাওয়া যায়ঃ তাহলে সড়কি, লেজা ইত্যাদি অস্ত্র নিয়েই ওদের রাইফেলের সঙ্গে মোকবিলা করবে। প্রবীণ সিদ্ধেশ্বর সরকারের উদ্যোগে এবং অর্থব্যয়ে এই সমস্ত অস্ত্র তৈরী হচ্ছে। উত্তেজনায় সারাটা গ্রাম গরম হয়ে উঠেছে। রাইফেলের বিরুদ্ধে সড়কি আর লেজা- এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
এরা উপযুক্ত সুযোগের জন্য প্রতীক্ষা করছিল। সেই সুযোগ একদিন এসে গেল। ১৩ই মে তারিখে মেদাকুলের ঘাঁটি থেকে মাত্র চারজন সৈন্য পূর্ব-নবগ্রামে এসে প্রবেশ করল। সাধারণ রাইফেল নয়, ওদের সঙ্গে একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলও ছিল। এখানকার গ্রামাঞ্চলে আসার পর থেকে পাক-সৈন্যরা এ পর্যন্ত কোন দিক থেকেই কোন বাধা পায়নি। গ্রামে ঢুকেই ওরা প্রথমে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে গিয়ে হামলা করল। সিদ্ধেশ্বর সরকার বাড়ি ছিলেন না, তিনি তখন এদের উপযুক্ত অভ্যর্থনার জন্য উদ্যোগ আয়োজনে অন্যত্র ব্যস্ত। সরকারবাড়িতে যা কিছু মূল্যবান জিনিস পেল তা লুটপাট করে নিয়ে ওরা খালের ওপারে নবগ্রাম গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে লুটপাট করতে গেল। বিশ্বাস-বাড়ির চিলেকোঠাটা ছিল এখানকার ছাত্রদের বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরী করবার ল্যাবরেটরী। দু'টি ছেলে সেখানে বসে তাদের সংগ্রহীত যৎসামান্য রাসায়নিক মাল-মশলা দিয়ে হাতবোমা তৈরি করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল পাশ করা ডাক্তার। সৈন্যরা বিশ্বাস-বাড়ি আক্রমণ করতে আসছে এ-সংবাদ পেয়ে তারা তাদের তৈরি কতকগুলো হাতবোমা নিয়ে বিশ্বাস-বাড়ির কাছে একটা ঘন গাছপালায় ঢাকা ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। সৈন্যরা তাদের নাগালের মধ্যে আসতেই তারা তাদের লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটা হাতবোমা ছুড়ল। বিস্ফোরণের শব্দে গ্রামের শান্ত আবহাওয়া কেঁপে উঠল। ভয়ে কেঁপে উঠল পাকিস্তানী সৈন্যরা। ওরা প্রাণের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বসে ছুটল। কিন্তু ইতিমধ্যে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব-নবগ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশ ফাটানো গর্জনধ্বনি করতে করতে ছুটে আসছে।
এইভাবে আক্রান্ত আক্রমণকারী সৈন্যরা অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করতে করতে পেছনে হটে যেতে লাগল। যেকোন ভাবেই হোক, এখন ওদের মেদাকুলের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ওদের গুলিবর্ষণকে অগ্রাহ্য করে ক্রমেই কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘেরাও করে এসেছে। সৈন্যরা কোন দিকে লক্ষ্য রাখবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। তাছাড়া তাদের ঘন ঘন 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে ওরা মাথা ঠিক রাখতে পারছিল না। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন দুঃসাহসী মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে একেবারে সামনে এসে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজন মাত্র হাত দশেক দূর থেকে একজন সৈন্যকে তাক করে তার হাতের সড়কি ছুঁড়ল। অব্যর্থ লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে দানবের মত বিরাট দেহ সেই পাঞ্জাবী সৈন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
যে দুঃসাহসী যুবক সড়কিটা ছুড়েছিল, তার নাম অমূল্য মল্লিক। ইতিমধ্যে আর একজন সৈন্য এগিয়ে এসে অমূল্যকে লক্ষ্য করে তার হাতের রাইফেলটা তুলেছে। অমূল্যকে রক্ষা করার জন্য মধ্যবয়সী দেবেন সরকার দু’লাফে সামনে এগিয়ে এল। সেই পেছন থেকে জাপটে ধরল সেই সৈন্যটিকে, কিন্তু ততক্ষণে সেই রাইফেলের গুলি তার লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছেছে। গুলিবিদ্ধ অমূল্য মল্লিক চিরতরে চোখ বুজল, তার মাতৃভূমির বুকে শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে প্রফুল্ল সেই সৈন্যের হাত থেকে সেই মৃত্যুবর্ষী রাইফেলটাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই লেজার ঘায়ে সেই সৈন্যটির ভবলীলা সাঙ্গ হোল।
চারজন সৈন্যের মধ্যে বাকি রইল দুইজন। ওরা পেছন দিকে ছুটতে ছুটতে সামনে একটা খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খালের পাড়টা খাড়া, তার মধ্যে নেমে পড়া সহজ কিন্তু সেখান থেকে ওঠাটা সহজ নয়। তাছাড়া একগলা জলে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের রাইফেল চালাতে পারছিল না। এই মরণের ফাঁদ থেকে ওরা উঠতে পারল না, মুক্তিযোদ্ধাদের সড়কির ঘায়ে সেইখানেই তাদের সলিল সমাধি ঘটল।
বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার যে কর্মীরা সম্মিলিতভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছিল, পূর্ব-নবগ্রামের এই প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে তাদের প্রথম থেকেই যোগাযোগ ছিল। পাক-সৈন্যদের নিধন পর্বের মধ্য দিয়ে তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। ইতিমধ্যেই পূর্বোক্ত তিনটি থানার কর্মীদের নিয়ে মুক্তিফ্রণ্ট সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এই তিনটি থানা থেকে পঞ্চাশ জনের মত তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিখিয়েছে। এদের মধ্যে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান সকল সম্প্রদায়ের লোক আছে। ছাত্রও আছে, কৃষকরা আছে। আরও অনেক লোক দলে আসবার জন্য উন্মুখ। কিন্তু এ বড় কঠিন জিনিস, অনেক দেখে শুনে, ভেবে- চিন্তে লোক বাছাই করতে হয়। ফ্রণ্টও গঠিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারাও সামনে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু না আছে অস্ত্র, না আছে ট্রেনিং। পূর্ব-নবগ্রামে যাই হোকনা কেন, ওদের বিরুদ্ধে সত্য সত্যই তো আর সড়কি আর লেজা নিয়ে লড়াই করা চলবে না। চাই রাইফেল, নিদেনপক্ষে বন্দুক। যে করেই হোক তা সংগ্রহ করতে হবে। মুক্তিফ্রণ্টের সেক্রেটারী জনৈক তরুণ অধ্যাপক। এক বিরাট দায়িত্ব তাঁর মাথার উপর এসে পড়েছে। চারজন পাক-সৈন্যকে এভাবে খতম করতে পারার ফলে পূর্ব-নবগ্রাম ও নিকবর্তী গ্রামগুলিতে উৎসাহ ও আনন্দের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা একটুকু সময়ের জন্যই; পরমুহূর্তেই সকলের মনে পড়ল যে সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই এত সহজে হজম করে নেবে না। মাত্র দেড় মাইল দূরে ওদের ঘাঁটি, ওরা এক্ষণি সদলবলে এসে হানা দেবে এবং কঠিন হাতে এ প্রতিশোধ নেবে। ওদের প্রতিহিংসার আগুনে পূর্ব-নবগ্রাম আর নবগ্রাম এই দু'টি গ্রাম পুড়ে ছাই হবে যাবে। এরপর এখানে একটি জনপ্রাণীকেও ওরা বেঁচে থাকতে দেবে না। এ অবস্থায় প্রাণে বাঁচতে হলে এক্ষুণি, এই মুহুর্তে কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে। একটি জায়গা আছে বটে, সেটা হচ্ছে এখানকার বিল অঞ্চল। সেই বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে ডাঙা থেকে বহুদূরে বিক্ষিপ্তভাবেই ছড়িয়ে আছে বিল এলাকার ছোট ছোট গ্রামগুলি। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে ঝড়ের এই প্রথম ঝাপটাটা হয়তো সামলে নেওয়া যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা টের পেলেও ওখানে যেতে সাহস করবে না। বেশী চিন্তা করবার সময় নেই, যা করবার এই মুহূর্তেই করতে হবে। দেখতে দেখতে সমস্ত এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে গেল।
ওরা যা ভেবেছিল তাই ঘটল, খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই হিংস্র পাক-সৈন্যরা শস্যে ক্ষেতে পঙ্গপালের মত এসে ছেয়ে ফেলল, গ্রামের পর গ্রামে হানা দিয়ে চলল। পাশাপাশি ক'টা গ্রাম ওরা একেবারে উচ্ছন্ন করে দিল।
এত বড় ঘা খেয়েও মুক্তিফ্রণ্টের লোকদের মনোবল কিন্তু ভাঙেনি। একটা জিনিসের দিকে তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল, যে চারজন পাকিস্তানী সৈন্য এখানে নিহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রাইফেল ছিল। সেই চারটা রাইফেলের মধ্যে একটি ছিল চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। এই অস্ত্রটি দুর্লভ। এই অস্ত্রটিকে হাত করতে পারলে শুধু সেটা দিয়েই বহু কাজ হাসিল করতে পারা যাবে। আপাতত তাদের হাতে রাইফেল বা বন্দুক জাতীয় একটিও অস্ত্র নেই। ওই চারটি রাইফেল এই গ্রামেই আছে, ওইগুলিকে বের করে হস্তগত করতে পারলে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে-খড়ির কাজ শুরু হতে পারবে।
সবাই যখন জান-প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত, মুক্তিবাহিনীর সেক্রেটারি তখন সেই রাইফেলগুলির সন্ধানে উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। হাতে সময় নেই, শত্রু সৈন্যরা যেকোন সময় এসে পড়তে পারে, তার আগেই এই অস্ত্রগুলিকে খুঁজে বের করতে হবে। অস্ত্রগুলির সম্পর্কে প্রথমে কেউ কোন কথা বলতে চায় না। বহু মিনতি আর রাগারাগির পর অবশেষে একটি একটি করে সব কটির সন্ধান পাওয়া গেল। সবচেয়ে আনন্দের কথা, সেই চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটিকেও পাওয়া গেছে। মুক্তিপ্রণ্টের সেক্রেটারি উত্তেজনা আর উল্লাসে অধীর। আর চিন্তা নেই, এবার এই ক'টিকে পুঁজি করেই তারা কাজ শুরু করে দেবেন।
আরও আনন্দের কথা এই যে, রাইফেলগুলির সাথে এক পেটিভর্তি বুলেটও পাওয়া গেছে, যার অভাবে রইফেলগুলি অচল হয়ে থাকত। অস্ত্রগুলি যাদের হাতে এল, তাদের কিন্তু রাইফেল চালনা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। কারও কাছ থেকে এ বিষয়ে সাহায্য নেবো, এমন লোকও হাতের কাছ নেই। কিন্তু তাতেও তারা ঘাবড়াল না। তাদের উৎসাহ অদম্য। সারারাত জেগে রইফেলগুলিকে নিয়ে নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে রাইফেল থেকে গুলি ছুড়বার কৌশলটা বেরিয়ে এল। এ তাদের কাছে এক মহা-আবিস্কার।
সাফল্যের পর সাফল্য। ভাগ্যলক্ষ্মী তাদের উপর সুপ্রসন্ন হয়ে তাঁর ভাণ্ডারের বন্ধ দরজাটা এবার তাদের সামনে খুলে ধরেছেন। ইতিপূর্বে মার্চ মাসে গৌরনদী থানা এলাকায় যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল তাদের হাতে বেশকিছু রাইফেল আর বন্দুক ছিল। সেই মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশ কে কোথায় চলে গেছে তার কোন পাত্তা নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো বর্ডারের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। কিন্তু তাদের অস্ত্রগুলিকে কোথায় রেখে গেছে তারা? শোনা যায়, এই অঞ্চলেই কোথায় নাকি লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। নবগঠিত মুক্তিফ্রণ্ট তার জন্মের পর থেকেই এই নিরুদ্দেশ অস্ত্রগুলির অনুসন্ধান করে চলেছিল। অবশেষে সেই পুরানো দলের একটি ছেলের সাহায্য নিয়ে সেই মহামূল্য গুপ্ত সম্পদগুলিকে আবিষ্কার করা গেল। সহজ ব্যাপার নয়, রাইফেল আর বন্দুকে মিলিয়ে সতেরখানা। নিহত পাকসৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া চারটি রাইফেল আর এই সতেরখানা, মোট একশখানা। মুক্তিবাহিনী এখন একশটি অস্ত্রের অধিকারী। অস্ত্রের সাথে সাথে বেশকিছু বুলেটও পাওয়া গেছে। তাই দিয়ে অনেকদিন কাজ চলবে। একটা নিরালা জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে এক মাসের ট্রেনিং দওয়ার ব্যবস্থা করা হতে লাগল। বহু খোঁজাখুজঁরি পর ট্রেনিং দেওয়ার জন্য একজন প্রাক্তন সৈনিকের সন্ধান পাওয়া গেল। অনেক সাধ্য-সাধনাকরে রাজী করান গেল তাকে। আপাতত প্রথম রাউণ্ডে তাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি ক'টা গ্রাম একেবারে জনমানবশূন্য। ট্রেনিং এর জন্য গোপন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করবার মত নিরালা জায়গাও মিলল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এই যে, পঞ্চাশটি তরুণ এক মাস কাল ধরে ট্রেনিং নেবে, তারা খাবে কি? এই দুঃসময়ে যারা তাদের অর্থ দিয়ে খাদ্য দিয়ে সাহার্য্য করতে পারত, তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রাম থেকে পালিয়ে বিল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য মুক্তিফ্রণ্ড অর্থ সাব-কমিটি ও খাদ্য সাব-কমিটি গঠন করেছিল। তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না বটে কিন্তু এই কঠিন সময়ে যথাশক্তি চেষ্টা করেও তারা তাদের দায়িত্ব পূর্ণ করে উঠতে পারছিল না। তা সত্ত্বে এক মাস ধরে এই ট্রেনিং চলল। প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবকের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও দৃঢ়সংকল্প এই অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। সত্য কথা বলতে কি, তারা অধিকাংশ সময়ে আধ-পেটা খেয়ে এবং সময় সময় না খেয়েও এই সামরিক ট্রেনিং নিয়ে চলেছিল।
প্রাথমিক প্রস্তুতি সমপন্ন করে মুক্তিবাহিনী এবার কাজে নামল। তারা প্রথমে সমাজ-বিরোধী শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে নামল। তারা এই সমস্ত দালাল ও দুর্বৃত্তদের নামের একটি কালো তালিকা তৈরী করে নিয়েছিল। পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। ১২ই জুন তারিখে মুক্তিবাহিনী গইলা অঞ্চলের দুইজন কুখ্যাত দালালের বাড়িতে হামলা করল। এদের হাতে প্রথম বাড়িতে আরজান ও তার দুই ছেলে এবং দ্বিতীয় বাড়িতে গইলার প্রতাপশালী চেয়ারম্যান আফতাবুদ্দিন মুন্সী নিহত হোল।
এইভাবে বিভিন্ন স্থানে দালাল হত্যার পর সারা অঞ্চল সাড়া পড়ে গেল। লোকে বুঝল, সামরিক সরকার মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে তাদের দালালদের রক্ষা করতে অসমর্থ। অবস্থা দেখে অন্যান্য দালালরাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তাদের অনেকের কাছ থেকে মুক্তিফ্রণ্টের নেতাদের নামে চিঠি আসতে লাগল। কালো তালিকার কথাটা সকলের কাছেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত দালালরা তাদের সেই সমস্ত চিঠিতে এই মিনতি জানাত যে, তাদের নাম যেন ওই কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিফ্রণ্ট যদি তাদের রেহাই দেন, তাহলে তারা মুক্তিফ্রণ্টকে অনেট টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে।
এইভাবে দালালদের দমন করে মুক্তিবাহিনী এবার তাদের আসল কাজে নামল।
ইতিমধ্যে একটা অনুকূল যোগাযোগের ফলে মুক্তিবাহিনীর শক্তি আশাতীতরূপে বেড়ে গিয়েছিল। আপনা থেকে একটা বিরাট সুযোগ তাদের হাতে এসে গেল। মুক্তিফ্রণ্ট তাদের সংগ্রাম শুরু করবার কিছুটা আগে আর একটি ছোট দল অনুরূপ আদর্শ নিয়ে কার্যক্ষেত্রে নেমে গিয়েছিল। দলটি ছোট হলেও গুণের দিক দিয়ে উন্নত পর্যায়ের। দলের নেতার নাম হেমায়েতউদ্দীন। হেমায়েতউদ্দীন প্রাক্তন সৈনিক। ২৫-এ মার্চ ঢাকায় যখন প্রথম আক্রমণ শুর হোল, সেই সময় হেমায়েতউদ্দীন ঢাকাতেই ছিলেন। তার কিছু আগেই তিনি কি করে একটা মেশিনগান ও একটা সাবমেশিনগান যোগাড় করে নিয়েছিলেন, একমাত্র তিনিই তা জানেন। এ ছাড়া কয়েকটি রাইফেলও তাঁর হাতে এসে গিয়েছিল। ঢাকার হামলার পর এই দুটি ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীন চলে এলেন ফরিদপুরে। এখানে এসেই তিনি জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেমে গেলেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁর ছোট্ট দলটি গড়ে উঠল। তাঁর এই বাহিনীতে মাত্র ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। ৪ জন প্রাক্তন সৈন, আর ৩ জন বেসামরিক লোক। মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রাথমিক অবস্থায় অস্ত্রবলের দিক থেকে এরা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া এই দলে ছিল যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত ৪ জন সৈন্য। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি দলের নেতা হেমায়েতউদ্দীন। পরিচালনা শক্তি, বুদ্ধি ও সাহসের দিক দিয়ে তাঁর তুলনা কমই মেলে। মুক্তফ্রণ্টের বহু ভাগ্য, এক বন্ধুর মধ্যবর্তিতায় তাদের সঙ্গে হেমায়েতউদ্দীনের যোগাযোগ ঘটল এবং কিছুদিনের মধ্যে এই দুই দল পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেল। মুক্তিফ্রণ্ট হেমায়েতউদ্দীনকে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার বা সেনাপতির পদে নির্বাচিত করল। অস্ত্রশক্তির দিক দিয়ে এবং সামরিক শিক্ষাব্যবস্থার দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনী এবার থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।
মুক্তিফ্রণ্টের এই বাহিনীতে যোগ দেবার আগে হেমায়েতউদ্দীন তাঁর এই ছোট্ট দলটিতে নিয়ে নিজের বুদ্ধি অনুসারে কাজ করে চলেছিলেন। কোন রাজনৈতিক দলের লোক নন তিনি। তাহলেও সারা প্রদেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তারপর বর্বর পাকসৈন্যদের নৃশংস অত্যাচার তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। যে করেই হোক এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে- এই প্রতিজ্ঞা তার ধ্যান, জ্ঞান আর জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল।
এইভাবে মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীনের এই ছোট্ট দলটি একান্তভাবে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করেই কাজে নামল। ৯ই মে তারিখে তাঁরা ফরিদপুরের কোটালিপাড়া থানা আক্রমণ করেছিলেন। থানায় সশস্ত্র পুলিশরা ছিল, দু'চারজন মিলিটারির লোকও ছিল। কিন্তু মেশিনগানের গুলিবর্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করবার মত হিম্মত তাদের ছিল না। তারা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থানা ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল। হেমায়েতউদ্দীন সেখানে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি পেয়ে গেলেন।
পাক-সৈন্যরা একটার পর একটা অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। তাদের অধিকার পাকাপোক্ত হয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুসলিম লীগ-পন্থী ও জামাত-পন্থী দালালের দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। গুণ্ডা ও লুটেরার দলও তাদের সঙ্গে হাত মিলাল। হেমায়েতউদ্দীন প্রধান রোখ পড়ল এদের উপর। তিনি বললেন, এই ঘরের ইঁদুরগুলিকে খতম করতে না পরলে মুক্তিসংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই প্রথমেই এদের শায়েস্তা করতে হবে। এ শুধু কথার কথা নয়, তিনি যা বললেন তা কাজেও পরিণত করে চললেন। অদ্ভূত তাঁর সাহস, প্রকাশ্য দিবালোকে এক হাট লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি এই সমস্ত দেশদ্রোহী দালালদের উপর কড়া দাওয়াই প্রয়োগ করতেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
কিছু দিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হয়ে উঠল, দালালদের হৃৎকম্প জাগল। ওদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষও চুপ করে বসে ছিল না। মুক্তিবাহিনীকে চূর্ণ করে দেবার জন্য তারা সদলবলে তৈরী হচ্ছিল। প্রধানত এই উদ্দেশ্যে তারা কোটালীপাড়া থানায় তাদের মূল ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। সৈন্যরা একা, তাদের সঙ্গে ছিল পুলিশ আর রাজাকার বাহিনী।
এদিকে মুক্তিবাহিনীও তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এবার তাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। এতদিন তারা এখানে ওখানে ছোটখাট আক্রমণ চালিয়েছে, কিন্তু এরা দস্তুরমত যুদ্ধ। মুক্তিফ্রণ্টের গোয়েন্দা বিভাগের চরেরা সংবাদ নিয়ে এসেছে যে, সৈন্য পুলিশ আর রাজাকার মিলিয়ে বেশ বড় একটা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। একটা সুখবর, ওদের সঙ্গে মেশিনগান নেই। একমাত্র রাইফেলের উপরই তাদের নির্ভর। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হাতে আছে একটা মেশিনগান আর একটা সাব-মেশিনগান। তাছাড়া রাইফেল তো আছেই। মুক্তিফ্রণ্ট সিদ্ধান্ত নিল, আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ নয়, আগ বাড়িয়ে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে হবে। ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের চমকে দিতে হবে। তারিখটা ছিল ১৪ই জুন। গভীর রাত্রিতে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নৌকাযোগে শত্রুদের মূল ঘাঁটি কোটালিপাড়া তানার দিক যাত্রা করল। তাদের ছোট ছোট এক-মাল্লাই নৌকাগুলি রাত্রির অন্ধকারে অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ঠিক সেই রাত্রিতেই পাক-সৈন্য বাহিনীও আক্রমণশূলক পরিকল্পনা নিয়ে রাত্রির অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির দিকে এগিয়ে আসছিল। এই দুই দল হরিণাহাটি নামক গ্রামের কাছে এসে পরস্পরের সম্মুখীন হোল।
ওদের আটখানা বড় বড় ছিফ নৌকা ছপ্ ছপ্ করতে করতে এগিয়ে আসছে। নৌকাগুলির মধ্যে সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকাররা মিলিয়ে প্রায় দু'শো জন লোক ছিল। মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট নৌকাগুলি প্রথমে ওদের নজরে পড়েনি। ফলে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা প্রথমে আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গেল। এ রকম আকস্মিক আক্রমণের জন্য ওরা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কামাণ্ডার হেমায়েতউদ্বীনের দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ও সাব-মেশিনগান দু'টি একই সঙ্গে ছিপগুলিকে লক্ষ্য করে অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করে চলেছে। ওরা একটু বাদেই প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে তার প্রত্যুত্তরে রাইফেল চালাতে লাগল। কিন্তু ওদের মনোবল আগেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাছাড়া ওদের পুলিশ আর রাজাকারদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলতে কোন কিছু ছিল না। তারা সবাই যে যার প্রাণ বাচাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অপর দিকে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান আর রাইফেলগুলি ওদের উপর অশ্রান্তভাবে মরণ-আঘাত হেনে চলেছে। এই প্রবল আক্রমণের মুখে ওরা সংখ্যায় বেশী হোলেও বেশীক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারল না। ওরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য নৌকা থেকে খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকার সবাই এই একই পন্থা অনুসরণ করল। এইভাবেই হরিণাহাটি যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল, মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনিতে হরিণাহাটির নৈশ আকাশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলল।
যুদ্ধের ফলাফল দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। এত বড় সাফল্যের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পরদিন সকালবেলা নৌকার মধ্যে ও জলের ওপর শত্রুপক্ষের ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া গেল। ১৮ জন তাদের হাতে বন্দী হয়েছে। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র একজন মারা গেছে। তার নাম ইব্রাহিম। মুক্তিবাহিনী ওদের নৌকার ভেতর থেকে ৫টি রাইফেল ও বেশকিছু বুলেট উদ্ধার করল।
এ-সম্বন্ধে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে, শত্রুরা পর পর দু'বার ঘা খেয়ে ক্ষান্ত থাকবে না, তাদের আক্রমণ আসন্ন। সেজন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। পরদিন ১৬ই জুন তারিখ মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি খালের পূর্বদিকে কোদালধোয়া গ্রামে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল। কিন্তু এই সংবাদটা শত্রুদের অগোচর রইল না। খবর পাওয়াটা গেল তারা সেদিনই তাদের বর্তমান ঘাঁটির দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের লঞ্চ সেখান থেকে এক মাইল দূরে পয়সারহাট বাজারে এসে ভিড়েছে। শত্রুদের লঞ্চ এই খালের উপর দিয়ে আসবে। মুক্তিযোদ্ধারা খালের দু'পাশে স্থানে স্থানে পজিশন নিয়ে তৈরি হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এইভাবে ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেল, কিন্তু সেই লঞ্চটির আর দেখা নেই। শেষে খবর পাওয়া গেল যে, ওরা পয়সারহাট বাজারে খানাপিনার উৎসবে মেতে গেছে। এই বাজারে যে-সমস্ত খাদ্র-দ্রব্য মেলে ওরা তা জবরদস্তি করে লুটেপুটে নিচ্ছে।
কমাণ্ডার হেমায়েতউদ্দীন স্থির করলেন, মুক্তিবাহিনীর একটা দল এখানেই মোতায়েন থাকবে। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি দু’মাইল পথ এগিয়ে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে লঞ্চসহ শত্রুদের ঘেরাও করে ফেলবেন। এই পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর দল সবেমাত্র কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে, এমন সময় শত্রুসৈন্যবাহী লঞ্চটা তাঁদের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। জায়গাটা এমন যে, সেখানে দাঁড়িয়ে পজিশন নেওয়ার খুবই অসুবিধা। কিন্তু উপায়ন্তর না থাকায় সেখানেই তাদের পজিশন নিতে হোল। শত্রুরা তাদের দেখতে পেয়েছে এবং দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। মুক্তিসেনাদের মেশিনগান ও রাইফেলের গুলিও তার প্রত্যুত্তর দিয়ে চলল। তাদের প্রবল গুলিবর্ষণের ফলে লঞ্চটা জায়গায় জায়গায় ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রুরা তাদের লঞ্চ নিয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দেবার চেষ্টা করছিল। কমাণ্ডার হেময়েতউদ্দীন পলায়মান লঞ্চের পেছনে পেছনে ধাওয়া করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই লঞ্চ তাঁদের আক্রমণের নাগালের বাইরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘণ্টা দেড়েক ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। তাতে হানাদারদের মধ্যে ছয়জন সৈন্য নিহত ও অনেক সৈন্য আহত হয়।
সেইদিনই বিকালবেলা দু'দল পাক-সৈন্য দু'দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে মুক্তিফ্রণ্টের ঘাঁটি কোদলধোয়া গ্রামটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে। একটি দল মাদরীপুর থেকে স্পীডবোট বোঝাই করে আসছিল। তারা অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসছিল বটে, কিন্তু তাদের দালালদের মুখে মুক্তিবাহনীর মেশিনগানের শক্তির পরিচয় পেয়ে তারা আর বেশীদূর এগুতে ভরসা করল না। শেষ পর্যন্ত তাদের মনের ক্ষোভ মেটাবার জন্য তারা পীড়ারবাড়ি গ্রামে হামলা করে, সেখানকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে গেল। অপরদিকে গৌরনদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থেকে চারটি স্পীডবোট বোঝাইকরে বহু পাক-সৈন্য আর একদিক দিয়ে কোদালধোয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সামনে এগিয়ে গিয়ে এই হানাদার শত্রুদের প্রতিরোধ করে দাঁড়াল। দু'পক্ষে প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুদের পয়সাহাট থেকে আট মাইল দূরে তাড়িয়ে দিয়ে জয়-গৌরবে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে নয়জন পাক-সৈন্য মারা যায়।
গৌরনদীর প্রতিরোধ[৩]
২৫শে এপ্রিল। মিলিটারী আসছে, গৌরনদীর সর্বত্র রব উঠল। সকাল থেকে চারখানা লেলিকপ্টার বেশ উঁচু দিয়ে বার বার মাদারীপুর থেকে যে রাস্তা গৌরনদীর বুক চিরে বরিশালের দিকে চলে গেছে তার উপর দিয়ে উড়ছে। ওদিকে বরিশাল শহরের চার মাইল উত্তরে জুনাহারে প্রচণ্ড গোলা বিনিয়ম হচ্ছে মুক্তি বাহনীর সাথে। কামানের গর্জন, গানবোটের শেলিং আর মর্টারের শব্দে থেকে থেকে খেঁপে উঠছে। অপর দিকে খবর পাওয়া গেল, মাদারীপুর দুদিন পূর্বে পাকবহিনী দখল করে নিয়েছে এবং আজকেই সড়কপথে দস্যুরা গৌরনদী হয়ে বরিশাল যাবে। কি করা যায় ভাবছে কৃষক-শ্রমিক আর রাজনৈতিক কর্মীরা। মুহূর্তের মধ্যে স্থির করে নিল তারা। যে করে হোক হানাদারদের বাধা দিতে হবে। অন্তত বাধা দেয়ার চেষ্টা করতেই হবে?। বীর যোদ্ধারা জানতো, সম্মুখযুদ্ধে কয়েকটা ৩০৩ রাইফেল আর পাঁচ-দশ রাউণ্ড করে গুলি দিয়ে ভারী অস্ত্রের সামনে কিছুই করা যাবে না। তবুও সাধারণ মানুষ যাতে ভেঙ্গে না গড়ে বা ভুল না বোঝে তার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তাই তারা সকাল থেকে গৌরনদীর উত্তরে কটকস্থল নামক স্থানে পজিশনে রইল। ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে তবুও শত্রুর সাথে দেখা নেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। রৌদ্রের প্রখরতায় পিপাসাকাতর হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের গোপন অবস্থান থেকে (সিএণ্ডবি সড়কের পাশে) কয়েক গজের মধ্যেই সাধারণ কৃষক জহরউদ্দীন মোল্লার বাড়ী। তাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পানি খাওয়ার জন্য জহর মোল্লার আঙ্গিনায় বিরাট বটগাছটার ছায়ায় বসলো। ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে আর জহরউদ্দীন মোল্লা পানি ঢেলে দিচ্ছে। যেখানে বসে মুক্তিকামী ভাইয়েরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তার থেকে কয়েক গজ উত্তরে একটা উঁচু পুল রয়েছে। এত উঁচু যে পুলের অপর দিক থেকে কিছুই দেখা যায় না। দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। হঠাৎ করে শব্দ না করে একটা গাড়ী এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। পরপর আরও কয়েকটা একেবারে গুনে গুনে চল্লিশটা। বর্বর সেনারা গুলি চালালো। বসা অবস্থায়ই শহীদ হলেন চারজন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ হলো জহরউদ্দীন মোল্লা ও তার ছেলে মোবারক মোল্লা। মুক্তিবাহিনীর হাতে সেদিন খতম হল দু'জন খানসেনা।
সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মুক্তিবাহিনী কয়েক দিনের মধেই আবার একত্রিত হল। এই একত্রিত করার পেছনে যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ছিল তারা হলেন এস, এম রকিব, অধ্যাপক এনায়েত, সেণ্টু ও আরও কয়েকজন। তাদের প্রচেষ্টায় ২৪টা রাইফেল ও তিনশত রাউণ্ড গুলি দিয়ে প্রথম দল গঠন করা হয়। পরে এই দল মিলিত হয় গোপালগঞ্জের হেমায়েতের সঙ্গে।
গৌরনদীর প্রতিরোধ সংগ্রামে আরও যাদের নাম অম্লান তাদের কথা কিছু লিখতেই হবে। এই দলটি সরিকলে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি খসরুর পার্টি নামে পরিচিত ছিল। এরা বয়সে তরুণ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রণিত হয়ে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল। এরা সাধারণত হিট এ্যাণ্ড রান করে অনেক অস্ত্র পাক সৈন্য, পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বহু দালাল এদের হাতে নিহত হয়েছে। এরা নিজ হাতে অস্ত্র তৈয়ারও করত। আজও সরিকলবাসী আলমের কথা ভোলেনি। নিজের তৈরি বোমার আঘাতেই আলম শহীদ হয়েছেন সরিকলের শামসু মিয়ার বাড়িতে। জনতার প্রতিরোধ শক্তিশালী, দূর্জয়। তার প্রমাণ গৌরনদীর বাকহি। বাকাইর বীর জনতা বল্লম দিয়ে মেরেছিল চার- চারটে তরতাজা পাঞ্জাবী দস্যুকে। কেড়ে নিয়েছিল চারটে চায়না রাইফেল।
সেদিন ছিল ১৪ই মে। একদল খানসেনা বাকাই গ্রামে ঢুকে পড়েছে। যেভাবে হোক তাদের রূখতেই হবে। তাই প্রস্তুত হয়ে গেল গ্রামবাসী। হাতে বল্লম ও রামদা। কয়েকজন গ্রামবাসী যেখান দিয়ে খানসেনারা আসবে সেই পথের ধারে একটি গর্তের মধ্যে আত্মগোপন করে রইল। কিছুক্ষনের মধ্যেই খানসেনারা কাছে এসে গেল। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি বল্লম নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করলো। বল্লম একেবারে হানাদার চারটের বক্ষভেদ করে দিল। তারপর টুকরো টুকরো করে চড়িয়ে দিল সে মৃতদেহ চারটি। খানসেনারা ওর পর থেকে আর ঢোকেনি বাকাই গ্রামে।
খুলনার প্রতিরোধ যুদ্ধ[৪]
খুলনার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব
২৫শে মার্চ। পরিস্থিতি গুরুতর, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। আবহাওয়া ক্রমেই যেন ভারী হয়ে আসছে। খুলনার রাজনৈতিক নেতারা অবস্থাটা বুঝবার জন্য ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করছিলেন। কিন্তু রাত্রি আটটার সময় ফোনের যোগাযোগ একবারেই বন্ধ হয়ে গেল। তখনি তাঁদের মনে সন্দেহ জাগল ঢাকার অবস্থা ভাল নয়, একটা কিছু অঘটন ঘটতে চলেছে।
কর্মীদের চোখে ঘুম নেই। রাত্রি ১২টার সময় একটা ঘোষণার শব্দ শুনে তারা মকে উঠল। শুধু তারাই নয়, যারা শহরের ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসেছে। সরকারী ঘোষণাকারীরা সারা শহরে ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে প্রচার করে ফিরছে যে, আগামীকাল ২৬শে মার্চ সকাল পাঁচটা থেকে সারা শহরে ৭২ (বাহাত্তর) ঘণ্টা পর্যন্ত কারফিউ জারী করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে যদি কেউ ঘর ছেড়ে পথে বেরোয় তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে।
অনেকেই অনুমান করল, ঢাকা শহরে অথবা আর কোথাও অবশ্যই একটা কিছু হয়ে গেছে এবং তার জের সারা প্রদেশময় ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু প্রথম আক্রমণ করেছে কারা পাস্তিানির জঙ্গী বাহিনী না মুক্তিকামী জনগণ?
ইতিমধ্যে সবার অগোচরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সেটা ঘটেছে কারফিউ জারী করার বেশ কিছু আগেই। এটা একটা আশাতীত সুখবর। আজই রাত্রিতে ইপিআর বাহিনীর জনৈক পাঞ্জাবী অফিসার তাঁর কয়েকটি প্রিয়-পাত্রকে এই বলে হুঁশিয়রী দিয়েছিলেন ইপিআর এর লোকদের সামনে এক ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও আর দেরী না করে এখনি পালিয়ে যাও। স্থানীয় ইপিআর বাহিনীতে প্রায় তিন শত জন লোক। খবরটা তারেদ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে ইপিআর লাইন খালি হয়ে গেল। তারা রাতের অন্ধকারে সেই স্থান ত্যাগ করে সুশৃঙ্খলভাবে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিল। আপর দিকে কারফিউ জারী হবার পর অবস্থা সঙ্গীন বুঝতে পেরে শহরের পুলিশরাও তাদের ব্যারাক ছেড়ে পালিয়েছে।
গভীর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সেই রাতটা কেটে গেল। পরদিন সকালে কি ঘটনা ঘটে দেখবার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন কারো চোখে ঘুম নেই। স্বধীনতার সংগ্রাম কি তবে সত্য সত্যই শুরু হয়ে গেছে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কে কোথায় আছে তাও ভালভাবে জানে না, অথচ অবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। সাধারণ মানুষ তো তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। কারফিউ শুরু হবে কাল সকাল পাঁচটায়। অথচ মিলিটারীর লোকেরা ইতিমধ্যে সারা শহরের পথে পথে টহল দিয়ে ফিরছে। ওরা নিশ্চয়ই সব কিছু চোখে চোখে রাখছে। এখন বাইরে চলাচল করতে হোলে সতর্কভাবে ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে।
বেশ কিছু খোঁজাখুঁজির পর তিনজন এক জায়গায় মিলিত হলেন। একজন আওয়ামী লীগের, একজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ও একজন ছাত্রলীগের নেতা। ইতিমধ্যে একটা খবর তাঁদের কাছে এসে পৌছেছে যে, ইপিআর বাহিনীর সমস্ত লোক ইতিপূর্বে তাদের জায়গা ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে পালিয়েছে। সংবাদটা সুসংবাদ। তাঁরা তিন জনে বসে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। নিজ নিজ দলের মতামত নেওয়ার মত সময় ছিল এখন সমন একটা সময়, যখন ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক, যা করবার নিজেদের দায়িত্বেই করতে হবে। এই পরিকল্পনা নিয়ে এই তিন জন অতি সঙ্গোপনে শহর ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে চলে গেলেন।
ইপিআর বাহিনীর পলাতক লোকেরা দৌলতপুর থেকে চার মাইল দূরে রংপুর, শাহপুর, লতা প্রভৃতি প্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। গ্রামবাসীদের ঘরের দরজা তাদের জন্য অবারিত, তারা নিতান্ত আপনজনের মত তাদের নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। এতো যে বিপদের আশংকা আছে, এ কথাটা কি তাদের জানা ছিল না? ছিল বৈকি। কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হলে দুঃখ আর বিপদ আর মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে। এই পলাতকের দল প্রাণ বাচানোর জন্য পালিয়ে এসেছিল একথা সথ্য, কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিমা শাসকদের জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। যদি প্রাণ দিতে হয়, প্রাণ দেবে। সারা বাংলাদেশের মানুষ যে অনেক আশা করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই পালিয়ে আসার সময় তারা যত বেশী সম্ভব রাইফেল, কার্তুজ আর গোটা কয়েক লইট মেশিনগান সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
যে তিনজন স্থানীয় নেতা এদের সন্ধানে শহর থেকে চলে এসেছিলেন তাঁরা এদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন। পরামর্শ করলেন এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই বাহিনী অবিলম্বে দ্রুত মার্চ করে খুলনা শহর দখল করে নেবে।
ইপিআর আর পুলিশ মিলে এই বাহিনীতে শ'তিনেক লোক ছিল, তাছাড়া তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক সাধারণ লোকও ছিল। যে তিন জন রাজনৈতিক নেতার কথা আগে বলেছি, তাঁরা প্রথম থেকেই এদের সঙ্গেই ছিলেন এবং এই বহিনীকে সংগঠন করা আর এই আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করবার পেছনে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রংপুর, শাহপুর ও লতা এই তিনটি গ্রামের মাঝখানে আড়ংঘাটা ময়দান। এরা সুশৃঙ্খলভাবে সেই ময়দানে জমায়েত হোল, তারপর শহর দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। বেশ কিছুদূর এগিয়ে আসার পর তেলিগাতি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রথম মোকাবিলা করল।
কলেজের কাছে পঁচিশ/ত্রিশ জন পাক-সেন্য পাহারা দিচ্ছিল। সে কথাটা এদের অজানা ছিল না। তারা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে অভিসন্তর্পণে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এভাবে আচমকা আক্রান্ত হয়ে পাক-সৈন্যদের সেই ছোট দলটি কিছুটা দিশাহার হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের গুলিবর্ষণের পর তারা কুড়িটি মৃতদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। সেই সংঘর্ষে এ পক্ষের মাত্র দু'জন পুলিশ মারা গিয়েছিল।
এরা পালিয়ে যাওয়ার ফলে একটা ট্রাক ও গোটা কয়েক জীপ মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেল। প্রায় পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধা এই গাড়িগুলিতে চেপে পলাতক শত্রুর পেছনে পেছনে ধাওয়া করে এগিয়ে চলল। মুক্তিবাহিনীর বাকি যোদ্ধারা যানবাহনের অভাবে পায় হেঁটে আসছিল। তারা কিছুটা পেছনে পড়ে গেল।
মুক্তিবাহিনীকে বাধা দেয়ার জন্য প্রায় আড়াইশ' পাক-সৈন্য দৌলতপুরের ‘বৈকালী' সিনেমার কাছে অপেক্ষা করছিল। মুক্তিবাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে তারা পাবলিক লাইব্রেরি ও গার্লস কলেজে ঘাঁটি করে বসল। এবার দু'পক্ষের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত সংঘর্ষ ঘটল। নিউজপ্রিণ্ট পেপার মিলের সামনে কিছুসংখ্যক ই,পি,আর,— এর লোক মোতায়েন করা ছিল। তারা এসে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিল। শুধু তারাই নয়, নিউজপ্রিণ্ট পেপার মিলের একদল শ্রমিকও তাদের সঙ্গে এসে সামিল হোল। এবার মুক্তিবাহিনী এক নতুন কৌশল গ্রহণ করল। দু'পক্ষের যখন যুদ্ধ চলছে তখন মুক্তিবাহিনী পেছন দিককার অংশটা প্রতিপক্ষের দৃষ্টির আড়ালে বিল অঞ্চল দিয়ে ওদের পেছনে দিক দিয়ে হানা দিল। হঠাৎ এভাবে দু'দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে পাক সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করল। এই সংঘর্ষের ফলে তাদের বেশ কিছু লোক মারা গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী উল্লাস-ভরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে গার্লস কলেজ ও পাবলিক লাইব্রেরি দখল করে নিল।
কিন্তু এই তো সবে সূচনা। আসল যুদ্ধের তখনও অনেক বাকি।
একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণকারী জঙ্গী বাহিনী, অপরদিকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ। এ নহে কাহিনী, এ নহে স্বপন, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য মারতেও জানে, মরতেও জানে। খুলনা শহরের রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে তারা এই সত্যটিকে প্রমাণিত করেছিল। এই যুদ্ধ একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা পর্যন্ত চলেছিল।
মুক্তিবাহিনীর এই প্রবল একটানা আক্রমণের সামনে প্রতিপক্ষ শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারত না। যথেষ্ট সৈন্য থাকলেও এবং উন্নততর আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হলেও নৈতিক দিক থেকে এরা ছিল দুর্বল। কিন্তু বাইরে থেকে আর একদল সৈন্য এদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ফলে ওদের শক্তি আশাতীতভাবে বেড়ে গেল। খুলনার রক্ষা ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে তোলবার জন্য ২৪-এ মার্চ তারিখে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে যানবাহন ও আধুনিক সমরোপকরণে সজ্জিত এক বিরাট সৈন্যবহিনী রওনা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিনা বাধায় আসতে পারেনি। পথের মাঝখানে দেশপ্রেমিক জনতা তাদের রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা প্রথম বাধা পায় যশোর জেলার অন্তর্গত নওয়াপাড়া গ্রামে।
এখানে ই,পি,আর-এর কোন সশস্ত্র লোক ছিল না। তবু দুঃসাহসী পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই দুর্বল ও ভঙ্গুর বাধাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে হামলাকারীর দল তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল। ওরা দ্বিতীয়বার বাধা পেলো খুলনা জেলার ফুলতলা অঞ্চলে। মুক্তিবাহিনী এদের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করবার জন্য তাদের বাহিনীর একটি অংশকে পাঠিয়েছিল। ফুলতলা অঞ্চলে দু'পক্ষের সংঘর্ষ ঘটল। সেখানে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলেছিল। এদের এই প্রবল আক্রমণের ফলে যশোর থেকে আগত পাক-সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ভোগ করার পর মধ্যপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
একটা অংশ তাদের হতাহত সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যশোরের দিকে ফিরে চলে গেল। কিন্তু বৃহত্তর অংশটি খুলনা শহরে রণক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলল। এদের সঙ্গে ছিল পঁয়ত্রিশটি গাড়ি বোঝাই সৈন্য, আর ষোলটি কামান সজ্জিত জীপ। ফুলতলা থেকে খুলনা শহর ষোল মাইল দূরে, পথের মাঝখানে সংগ্রামী জনতা বহু বাধা ও ব্যারিকেডের সৃষ্টি করে তুলেছিল, যার ফলে এই ষোল মাইল পথ অতিক্রম করতে এদের আঠারো ঘণ্টা সময় লেগেছিল।
যশোরের সৈন্যদল এসে পৌঁছবার পর পাক-সৈন্যবহিনীর শক্তি বহু পরিমাণে বেড়ে গেল। শুধু সৈন্য-সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, এরা ষোলটা মর্টার নিয়ে এসেছে। অপর দিকে খুলনা শহরের শ্রমিক ভাইয়েরা দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে চলেছে। এরা মৃত্যুভয় ভুলে গিয়ে উন্মত্তের মত যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে।
যখন দু'পক্ষে প্রবল হানাহানি চলছে, তখন হঠাৎ দেখা গেল পাক-সৈন্যবাহিনী একটু পেছনে চলে গিয়ে শ্বেতপতাকা তুলে ধরেছে। তার মানে এরা আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। থেমে গেল যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা জয়োল্লাসে মেতে উঠল। তারা নিশ্চিন্ত মনে পাক-সৈন্যদের বন্দী করবার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু এটা যে ওদের ছলনা মাত্র, একটু বাদেই তা বুঝতে পারা গেল। ওরা অপ্রস্তুত অবস্থায় কাছে এগিয়ে আসতেই জঙ্গীবাহিনীর মেশিনগানগুলি তাদের লক্ষ্য করে একসঙ্গে গর্জে উঠল। ফলে মুক্তিবাহিনীর বহু লোক হতাহত হল। ওদের মর্টারগুলি একসঙ্গে অনর্গল অগ্নিগোলক উদগীরণ করে চলেছে। এর প্রত্যুত্তর দেবার মত উপযুক্ত অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল না। সেই অগ্নিবর্ষণের ফলে তারা পতঙ্গের মত পুড়ে ছাই হতে লাগল। এরপর তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর উপায় রইল না। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। এই যুদ্ধে বহু পাক-সৈন্য হতাহত হয়। তাদের মধ্যে একজন মেজর মারা যান এবং খুলনা সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার কর্নেল শামস গুরুতরভাবে আহত হন।
খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব
খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়ে গেলেও ছাত্ররা প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত হয়নি। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত তারা গোপনে নানা জায়গায় পজিশন নিয়ে পাক-সৈন্যদের উপর ইতস্তত চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলিয়ে যাচ্ছিল। এইভাবে তারা বেশ কয়েকজন সৈন্যকে হত্যা ও জখম করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই গুপ্ত আক্রমণ চালাবার কালে কোন ছাত্র মারা যায়নি বা শত্রুর হাতে ধরা পড়েনি।
২৮শে মার্চের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়নি। শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ করবার জন্য তারা বাগেরহাটে গিয়ে মিলিত হোল। বাগেরহাটে প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল ইপিআর ও পুলিশের লোকদের নিয়ে এক মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। খুলনা থেকে যারা বাগেরহাট গিয়েছিল তারা মেজর জলিলের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিল। ফলে এদের সংখ্যা দাঁড়াল সাতাশ। মেজর জলিল কোন দিকে নতুন করে আক্রমণ করা যায় সেই পরিকল্পনা রচনা করে চলেছেন।
খুলনা শহর শত্রুপক্ষের অধিকারে থাকলেও সেখানকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী শত্রুদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে গোপনে কাজ করে চলছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাঁদের প্রাণপ্রিয় শহরটিকে তাঁরা শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবেন, এই আশা বা পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। তবু শত্রুপক্ষকে অতিষ্ঠ করে তোলবার জন্য এবং প্রচারকার্যে সুযোগ লাভের জন্য আরও একটা ঘা মারবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এটিকে খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব বলা চলে। শত্রু অধিকৃত শহরের বুকের উপর দাঁড়িয়ে যে নতুন আক্রমণ চালানো হয়েছিল, তা থেকে তাঁদের দুঃসাহস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়।
জনৈক সুপরিচিত স্থানীয় নেতা এই পরিকল্পনাটি রচনা করেন এবং তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেন। তিনি খুলনা শহর থেকে চলে গেলেন বাগেরহাটে। তারপর সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে তাঁর এই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে পরামর্শ করলেন। মেজর জলিল তাঁর এই পরিকল্পনাকে অনুমোদন ও সমর্থন করার পর তিনি তার বাহিনী থেকে ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
এই মুক্তিযোদ্ধারা রাত্রির অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে খুলনা শহরে এসে প্রবেশ করলেন। পাক সৈন্যবাহিনীর কর্তারা এমন যে ঘটতে পারে সে কথা কল্পনাও করতে পারেনি। যুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েই এই দুঃসাহসিক কাজে পা বাড়িয়েছিল। গভীর রাত্রিতে তারা শহরের বেতার ঘাঁটি আক্রমণ করল, তারা স্থায়ীভাবে বেতার ঘাঁটি নিজেদের দখলে রাখতে পারবে, এই দুরাশা তাদের ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি দিনের জন্য হলেও তারা এটাকে নিজেদের দখলে রাখবে এবং এর মধ্য দিয়া সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছ স্বাধীন বাংলার বাণী ছড়িয়ে দেবে।
সে সময় আঠারো জন পাক-সৈন্য বেতার ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা 'আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের আঠারো জনকেই খতম করল। পাহারাদার পাক-সৈন্যরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নিজেরাই গুলি চালিয়ে বেতার ঘাঁটির ট্রান্সমিটারগুলিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। ফলে বেতার ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এল বটে, কিন্তু তারা তাকে তাদের কাজে লাগাতে পারল না। বেতার ঘাঁটি দখল করার ফলে তাদের হাতে একটা মেশিনগান, ছয়টা গ্রেনেড এবং আরও কিছু অস্ত্রশস্ত্র এসে গিয়েছিল।
রাতটা কেটে গেল। ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুপক্ষকে মোকাবিলা করবার জন্য শহরের এক প্রান্তে প্রতিরোধ ঘাঁটি তৈরী করে অপেক্ষা করছিল। এই শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে বা হটিয়ে দিতে পারবে না, একথা তারা ভাল ভাবেই জানতে, কিন্তু যাবার আগে তাদের একটু শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে।
সকাল হতে না হতেই পাক-সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণ করাবর জন্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে এল। প্রথমে তিন লরী বোঝাই সৈন্য, তারপর কতকগুলি খালি গাড়ি, অবশিষ্ট সৈন্যরা মার্চ করে আসছে। ওরা নাগালের মধ্যে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি লরীকে লক্ষ্য করে ছ'টি গ্রেনেড ছুড়ল। এই গ্রেনেডগুলিকে তারা বেতার ঘাঁটির মধ্যে পেয়েছিল। অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রেনেড। গ্রেনেড ছোড়ার ফলে তিন লরী বোঝাই সৈন্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।
এই মারাত্মক দুর্ঘটনার ফলে তাদের পেছনে যে সৈন্যরা আসছিল, তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর ওরা বুঝতে পারল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আর গ্রেনেড নেই, এবার নিশ্চিন্ত মনে এগোনো যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় এদের সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশী। তাদের হাতে মাত্র একটি মেশিনগান, বাকী সবই রাইফেল। এ অবস্থায় দু'পক্ষে বেশীক্ষণ লড়াই চলতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আশাতীত সাফল্যের ফলে খুবই খুশী হয়েছিল। এবার তারা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দ্রুত সরে পড়বার জন্য চেষ্টা করল। পাক-সৈন্যরা তাদের এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাদের খতম করে দেবার জন্য দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হোল। তাদের একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ কাটিয়ে তাদের ঘেরাও করে ফেলবার জন্য চেষ্টা করছিল। মুক্তিবাহিনীর নেতা বুঝতে পারলেন তাঁরা এক ভীষণ সংকটজনক অবস্থায় এসে পড়েছেন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে গাড়ি আছে, আর তাদের পায়ের উপর নির্ভর করে ছুটতে হবে। এ অবস্থায় এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ কথা নয়। যদি বাঁচতে হয় তবে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, কিছ সংখ্যক লোকের মায়া ছেড়ে দিয়ে বাকি সবাইকে বাঁচাতে হবে।
দু'পক্ষের মাঝখানে তখনও কিছুটা ব্যবধান ছিল। নেতা নির্দেশ দিলেন; কয়েকজনকে প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। বাকি সবাই যতক্ষণ নিরাপদে পালিয়ে যেতে না পারে, ততক্ষণ এরা যতই বিপদ ঘটুক না কেন, পেছনে হটবে না, সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে। এর নাম সুইসাইড স্কোয়াড। এভাবে আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত আছে কারা, তিনি আহবান জানালেন। একটু সময় সবাই চুপ করে রইল, তারপর সামনে এগিয়ে এল ছ'জন। নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আর সকলের আত্মরক্ষার সুযোগ করে দেবে।
এই রণকৌশল সার্থক হোল। সেদিনকার সেই ছ'জন মুক্তিযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে শত্রুদের হাতে ধরা পড়ল। বাকী সবাই নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করে চলে এল। এইভাবেই খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল।মঙ্গলা পোর্টের বাহাদুর শ্রমিক ভাইয়েরা
খুলনা জেলার মঙ্গলা পোর্ট। চালনার মতই এই বন্দরেও দেশ-বিদেশের জাহাজ যাতায়াত করে। রফতানির মাল জাহাজে ওঠে, আর আমদানির মাল জাহাজ থেকে নামে। কিন্তু অন্যান্য বন্দরের মত এখানে জাহাজ ভিড়াবার জন্য ডক ইয়ার্ডের ব্যবস্থা নেই। জাহাজগুলিকে মুরিং বয়ার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে মালপত্রের ওঠানামা চলে।
মঙ্গলা পোর্ট খুলনা শহর থেকে বহু দূরে। জলপথ ছাড়া সেখানকার সঙ্গে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে মঙ্গলা পোর্টে যেন সব কিছু থেকে এক প্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। সারা প্রদেশজুড়ে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলছে। কিন্তু এখানে তেমন কোন আন্দোলন নেই। তাহলেও এই বাংলাদেশের যেখানেই যত দূরেই থাকুক না কেন অন্দোলন প্রতিটি বাঙ্গালীর মনে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। মঙ্গলার অধিবাসীরাও এই বিষয়ে একেবারে উদাসীন হয়ে থাকতে পারে না। আমি এখানে বিশেষ করে নীচের তলার সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। মঙ্গলা বন্দরের শ্রমিক ভাইয়েরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে পারল না। এই নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে নানারকম জল্পনা কল্পনা করে, কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের কি করণীয় থাকতে পারে তা তারা ভেবে পায় না।
ক'দিন হয় একটা ফ্ল্যাট এখানে এসে পাড়ে ভিড়েছে। সবাই লক্ষ্য করেছে, এই ফ্ল্যাটটার মধ্যে দশ- বারো জন পাঞ্জাবী সৈন্য আছে। এক এক করে ক'টা দিন কেটে গেল, কিন্তু ফ্ল্যাট যেমন ছিল তেমনি আছে।
এমন তো কখনও হয় না। এই সৈন্যগুলি এখানে বসে বসে করছে কি! ওদের নিশ্চই কোন খারাপ মতলব আছে।.......
শ্রমিক ভাইয়েরা অতি সতর্কভাবে ওদের হাল-চাল আর গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। তারা দেখেছে, ফ্ল্যাটের সেই সমস্ত সৈন্যরা বড় হুঁশিয়ার, ওরা পালা করে সারা রাত জেগে পাহারা দেয়। ওটা কি শুধু আত্মরক্ষার জন্যই, না, এর পেছনে আরও কিছু আছে? শুল্ক অফিসে অনুসন্ধান নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাওয়া গেল। এই ফ্ল্যাটে নাকি অনেক গোলাগুলি মজুদ করা আছে। এই সৈন্যরা তারই জিম্মাদার।
খবরটা পেয়ে শ্রমিকরা অধীর হয়ে উঠল। এমন চমৎকার মওকা খুব কমই পাওয়া যাবে। এই সময় আক্রমণ করতে পারলে অতি সহজেই ওদের সব ক'টাকেই খতম করে দেয়া যাবে আর তারই সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে গোলা-গুলি উদ্ধার করা যাবে। এইভাবে একবাণে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কেমন করে এই কাজ হাসিল করা যাবে?
অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে একটা পথ পাওয়া গেল।
এখানে বসে কোন কিছু করা যাবে না, মুক্তিবাহিনীকে খবর দিতে হবে। তারা অবশ্যই এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেই। কিন্তু কোথায় আছে মুক্তিবাহিনী, তারা কেমন করে তাদের সন্ধান পাবে? একজন বলল, সে শুনেছে, বাগেরহাট শহর এখনও নাকি মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। খবরটা সত্য কিনা, জোর করে বলা যায় না। তাহলেও একবার সেখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখা দরকার। তার এই প্রস্তাবটা সবাই একবাক্যে সমর্থন করলো।
বাগেরহাট শহর এখান থেকে বত্রিশ মাইল দূরে। বর্তমানে নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। যদি যেতে হয় এক্ষুনি যেতে হবে, একটুও দেরী করলে চলবে না। অবস্থা অত্যন্ত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, পরে এমন সুযোগ নাও মিলতে পারে। যেমন প্রস্তাব তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন শ্রমিক নৌকা পথে বাগেরহাট রওয়ানা হয়ে গেলো।
খবরটা মিথ্যে নয়। মুক্তিবাহিনী এখনও বাগেরহাট শহর অধিকার করে বসে আছে। বরিশালের প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল এই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এবং তিনিই ছিলেন তাদের পরিচালক। মঙ্গলার শ্রমিক ভাইয়েরা বাগেরহাট শহরে পৌঁছে তাঁর সাথে দেখা করল। তারা যে উদ্দেশ্যে সেখানে এসেছিল তা সিদ্ধ হোল, মেজর জলিল তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন।
তার দু'দিন বাদে মঙ্গলার ঘুমন্ত অধিবাসীরা গভীর রাত্রিতে চমকে উঠে শয্যা ছেড়ে উঠে বসল। মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে চলেছে। ভয়ে কেঁপে উঠল তাদের মন। তবে কি বর্বর পাক-সৈন্যরা বাঙলার উপর হামলা করেছে? উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় সবাই ঘর ছেড়ে ছুটে এল বাইরে। পরে খবর শুনে আশ্বস্ত হোল, না পাক-সৈন্যরা নয়, তাদের অতি প্রিয় মুক্তিবাহিনী সেই ফ্ল্যাটের সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেছে।
সব কটা সৈন্যকে ওরা নিঃশেষ করে দিয়েছে। আরও জানা গেল, ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে অনেক অস্ত্র ও গোলা-গুলি উদ্ধার করা গেছে।
খুলনা জেলার সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার[৫]: মোমিন উদ্দিন আহমেদ, প্রাক্তন এম-পি
৮-৬-১৯৭৬
১৮৭১ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে বয়রা গ্রামে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ই-পিআর-রা ৩০৩ রাইফেল ও শটগান নিয়ে পাক-ফৌজের বিরুদ্ধে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ হয় যশোর রোডে। যুদ্ধে ২টি ট্রাক ধ্বংস হয় এবং পাক-সৈন্যরা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
এর পরের সংঘর্ষ হয় দৌলতপুরের মিনাক্ষী সিনেমা হলের সম্মুকে ২০শে মার্চ তারিখে। রাস্তার দু'পাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাক ফৌজের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা তখন ট্রাকে করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। আক্রান্ত পাকসেনারা রিকয়েললেস গান দিয়ে রশীদ বিল্ডিং ধ্বংস করে। সে সময় ঐ ভবনের ৩ জন লোক নিহত হয়।
এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে পাকসেনারা ট্রাকে করে যশোর থেকে খুলনা অভিমুখে অগ্রসর হয়। খুলনার রেডিও ষ্টেশন তখন পাক-সৈন্যদের দখলে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও ষ্টেশনের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা রেডিও ষ্টেশনের ভিতর থেকে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এভাবে এক রাত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে কিছু মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়। যশোর থেকে ট্রাকে করে আগত পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা আস্তে আস্তে বিলের দিকে পিছু হঠে। যুদ্ধে পাক ফৌজের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। খুলনা রেডিও ষ্টেশনকে রক্ষার জন্য যশোর থেকে পাক-সৈন্য তিন দফা আসে। ৭ তারিখের পর পাক-সেনারা দৌলতপুরের রঘুনাথপুর গ্রামে হামলা করে। সেখানে তারা বহু লোককে হত্যা করে।
খুলনা জেলার তেরখাদা থানায় মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সেখানে প্রায় দুই হাজারের মতো মুক্তি সেনা ছিল। তারা তেরখাদা থানাকে সব সময়ের জন্য মুক্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিল। ফহমউদ্দিন নামে একজন তহশিলদারের নেতৃত্বে ঐ ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। আব্দুল হামিদ মোল্লা নামে এক ব্যক্তি পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে। পরে দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা নিহত হয়।
ফরিদপুরের প্রতিরোধ[৬]
আকস্মিকভাবে পঁচিশে মার্চ গভীর রাতে রাজধানীতে পাক-হানাদার বাহিনীর হামলার খবর, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের কথা এবং বঙ্গবন্ধু শখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা ছাবিবশে মার্চ সকাল বেলায়ই পেয়ে গেলাম। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফরিদপুরের পুলিশ ব্যারাক এবং বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ফদিপুরের প্রাথমিক প্রবেশদ্বার গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও আনসার সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে উঠল এবং ঢাকা-ফেরত কিছু ইপিআর এসে এতে যোগদান করলেন। সর্বস্তরের জনগণের সমর্থনে আমরা উৎসাহিত বোধ করলাম। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে গোয়ালন্দঘাটে ছাত্রজনতার এই প্রতিরোধ শুধুমাত্র রাইফেল, বন্দুক এবং মনোবলকে সম্বল করে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য এবং আজও ভাবতে অবাক লাগে যে এটা হল সুসজ্জিত পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষখেকো বাঘের সামনে অবোধ বালকের নুড়ি হাতে খেলা করার মত। এ সকল আয়োজনের ভিত্তি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত জনতার দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় এভাবে জনতার প্রতিরোধের সাড়া পড়ে গেল। তখন প্রয়োজন দেখা দিল সুসমন্বয় ও প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদানের। খুব সম্ভব ২৯শে মার্চ তদানীন্তন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য কে, এম, ওবায়দুর রহমানকে আহবায়ক করে এডভোকেট আদেলউদ্দিন, ইমামউদ্দিন আহমেদ, শামছুদ্দিন মোল্লা, সৈয়দ হায়দার হোসেন, মোশাররফ হোসেন, নূরুন্নবী, কাজী খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান খান, গৌরচন্দ্র বালা, ফিরোজার রহমান, আমিনউদ্দিন, মোখলেসুর রহমান প্রমুখ স্থানীয় জননেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নাসিরুদ্দিন মুসা, শাহ আবু জাফর, কবিরুল আলম, সালাউদ্দিন আহমদ, আবু সাঈদ, আতিয়ার প্রমুখ ছাত্র ও জনপ্রতিনিধিমূলক নেতা ও কর্মীদের নিয়ে জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সার্বিকভাবে ফরিদপুরের প্রশাসন ও তদারকি কাজ পরিচালনা করতে থাকে। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন তখন এ, এন, এম ইউসুফ এবং পুলিশ সুপার ছিলেন নূরুল মোমেন খান। পরবর্তীকালে ফরিদপুরে পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশের পরেই তাঁরা ধৃত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ প্রায় নয় মাস কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করেন। ফরিদপুরের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকের মধ্যে বিশেষ করে লিয়াকত আলী হোসেন, আব্দুস সালাম মিয়া, আজম আমীর আলী, আনম আবদুস সোবহান, মিছির কর্মকার, আতাহার হোসেন, শামসুল হক, তারাপদ ঘোষ এবং অনেকের কথা স্মরণ করা যায়। এছাড়াও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরের প্রত্যেক মহকুমায় স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। রাজবাড়িতে মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেন, মোসলেম আলী মৃধাসহ জননেতা ডা. এস, এ, মালেক, ওয়াজেদ চৌধুরী, নূরুল ইসলাম, মরহুম আবদুল জলিল, আবদুল হাই, চিত্তবাবু, আলী আক্কাস এবং স্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুল জব্বার, নাজিবর, ফজলু, রেজা, তাপস প্রমুখ।
ফরিদপুর জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটির মূল ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের ডাক বাংলো ঝিলটুলীতে এবং সেখান থেকে প্রত্যেকটি মহকুমায় যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত এ দিনগুলো ছিল ফরিদপুরের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সময়কাল। ফরিদপুরের প্রতিরোধের সেই সাতাশটি দিন মনে হোত আমরা সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক ভূখণ্ডে বাস করছি। কোথাও কোন স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়নি। এ যেন জনতার স্বতঃস্ফূর্ত নতুন জীবনের পথে স্বাভবিক পথ চলা। ঢাকা থেকে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট পাক-হানাদার বাহিনীর অনেক কুর্কীতি শুনতে পেলাম এবং ফরিদপুরে আমরা আতংকিত হলাম। সম্ভবতঃ ১লা এপ্রিল তারিখে প্রয়াত নেতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীর পথে ফরিদপুর পৌঁছালেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে পরের দিন চলে গেলেন। ১৭ই এপ্রিল বাংলার মাটিতে মেহেরপুরে মুজিবনগরে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক ঘোষণার কথা জানতে পারলাম এবং ফরিদপুরকেও আমরা তখন মুক্ত এলাকার একটা অংশ হিসেবে গর্ব অনুভব করলাম। আমরা তখন ফরিদপুরে স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতাম। সে সময় ফরিদপুরবাসীদের সার্বিক সুখ-দুঃখ এক উচ্ছ্বাসময় শিহরণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। কখন হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে সেটাই ছিল সার্বক্ষণিক চিন্তা। দেশের অন্যান্য জায়গায় পাক-বাহিনীর নারকীয় অমানবিক দস্যুতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের বেশী ভয় ছিল প্যারাট্রুপ হানাদার বাহিনী নামলে প্রতিরোধ করার কোন অস্ত্র আমাদের হাতে ছিল না। নদীপথে গোয়ালন্দঘাট, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর ছাড়াও স্থলপথে পাংশা ও কামারখালীতে প্রতিরোধ গড়ে তোরা হয়, যাতে করে কুষ্টিয়া কিংবা যশোর হয়ে আক্রমণের সম্ভাবনা প্রতিহত করা যায়। দিবারাত্র চব্বিশ ঘণ্টা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের কণ্ট্রোল রুম কর্মব্যস্ত থাকতো এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিক তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হোত। ফরিদপুর ছিল ভারত অভিমুখে শরণার্থীদের অনেকেরই মাঝপথ। অনেক নেতা ও কর্মী ঢাকা থেকে ভারত যাওয়ার পথে ফরিদপুরে বিশ্রাম নিয়ে যশোর হয়ে চলে যেতেন। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অনেক নেতৃবর্গই ফরিদপুরে অবস্থান নিলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর শহর থেকে লোকজন পরিবার-পরিজনসহ গ্রাম এলাকায় চলে যেতে লাগলেন। একটা আসন্ন সংঘাতের মুখোমুখি আমরা প্রশাসন কর্মকর্তা ও প্রতিরোধে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা শহরে রয়ে গেলাম। আমরা শহরের প্রবেশের বিভিন্ন এবং রাস্তার উপর ব্যারিকেড তৈরী করলাম। ২১শে এপ্রিল ভোর রাতে হানাদার বাহিনী সুসজ্জিত গানবোট দিয়ে প্রথমে গোয়ালন্দঘাট আক্রমণ করল। আমাদের প্রতিরোধের কর্মীরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু দূর থেকে অবিরাম মর্টার-এর শেল বর্ষণের মধ্যে সকাল নয়টায় হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দঘাট দখল করল এবং একই সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ছত্রী বাহিনী অবতরণ করতে লাগলো। নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ফরিদপুর শহর ত্যাগ করতে লাগলাম।
আমি সকাল দশটার দিকে ইপিআর-এর একজন প্রতিরক্ষা কর্মী সদস্য কবিরুল আলমকে সঙ্গে নিয়ে নড়বড়ে একটা জীপে করে কামারখালীর দিকে রওয়ানা হলাম এবং কে, এম, ওবায়দুর রহমান নগরকান্দা হয়ে গোপালগঞ্জের দিকে রওয়ানা হলেন। অন্য নেতৃবৃন্দও বিচ্ছিন্নভাবে শহর ত্যাগ করলেন।
ফরিদপুর শহরে প্রাথমিক প্রতিরোধ[৭]
২৬শে মার্চ রাত প্রায় ২/৩টার দিকে কোতোয়ালীর ও-সি আমাদের বাসায় আসেন। বাবা তখন এমএনএ আদিলউদ্দিন আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি এসে জানালেন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ এবং ফরিদপুরের দিকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পাক-বাহিনী আসছে। এ অবস্থায় ও-সি সাহেব থানার চাবি আব্বাকে দিয়ে সরে যেতে চাইলেন। তখন আব্বা এ অবস্থায় থানার দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইলেন না। এরপর আব্বা এবং আমি ডি-সি সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। ফরিদপুরের ডি-সি তখন জনাব এ, এম, এন, ইউসুফ। এস-পি ছিলেন মিহির সাহেব। উভয়কে আমরা ডি-সি সাহেবের বাসার অফিসে দেখতে পাই। ডি-সি সাহেবের সাথে ঢাকা এবং ফরিদপুরের অবস্থা নিয়ে আলাপ হয়। তিনি বললেন, এখনও যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে আর্মি আসছে। তারা আজকেই শহরে এসে পৌঁছাবে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের শহর থেকে সরে যাওয়াটাই উচিত। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সাথে যোগাযোগ করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তখন তিনি গাড়ী পাঠালেন তাদেরকে আনার জন্য। জনাব শামসুদ্দিন মোল্লা (এমএনএ), জনাব হায়দার হোসেন (এমপি) এরা সবাই আসলেন। পরিস্থিতি জানার পরে আপতত শহর থেকে সরে যাওয়ার জন্য সকলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর আমি একটি জীপসহ বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন দলের ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ঢাকার ঘটনা জানাই এবং যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ফরিদপুরের দিকে সেনাবাহিনী আসার পথে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এতে ঐ সময়ে অনেকেই ব্যাপারটিকে অবাস্তব মনে করে প্রতিরোধে অংশীদার হতে চাইলেন না। কিন্তু সৈয়দ নাসির হোসেন আহমেদ, জামাল ও আরো কয়েকজন মিলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে সেনাবাহিনীর পথ রোধ করতে হবে। তখন গাড়ি নিয়ে আমরা দরবেশের পুলের ওপারে গিয়ে গ্রামবাসীদের ডেকে জড়ো করলাম এবং ঢাকার পরিস্থিতি ও পরিকল্পনাও জানানো হলো। এখানে গ্রামের লোকদের গাছ কাটার জন্য প্রচুর উৎসাহ দেয়া হয়। তারা নিজেরাই কুড়াল নিয়ে গাছ কাটতে শুরু করলো। এবং পরামর্শ দেয়া হলো যে, আর্মি এলে যেন তারা গ্রাম থেকে সরে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে তারা ২০/২৫টি গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। তারপর আমরা শহরের একটু বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি পাক-সেনা শহরে ঢোকার আশঙ্কায়, কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলো পাক-সেনাবাহিনী আসার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। পরদিন হঠাৎ চট্টগ্রাম বেতারের জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় আমরা সবাই খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি এবং ডি-সি সাহেবকে অনুরোধ করি শহরের প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে। এ ব্যাপারে সামর্থ্য এবং মওজুদ অস্ত্রের পরিমাণ জানতে চেষ্ঠা করি। কিন্তু পুলিশ বাহিনী সোনাবহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে। আমরা এই সময় জানতে পারি যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের জনগণ এবং পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ আছে। ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এবং ঢাকায় অবস্থানরত ফরিদপুরবাসীরা ফরিদপুর আসতে শুরু করে। তাদের মুখে ঢাকার সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী শুনে আমাদের মধ্যে প্রতিরোধস্পৃহা আরো বেড়ে ওঠে। তখন আমরা কোনরকম প্রতিরোধের তৎপরতা না দেখে শহরের কতিপয় তরুণের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫ জন ছাত্র নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, পাকিস্তান সেনাবহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পদ্ধতি হবে গেরিলা যুদ্ধ এবং অবিলম্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়া উচিত এবং এ প্রশিক্ষণে ষোল বছরের ঊর্ধ্বের সকল সুস্থ লোকের অংশগ্রহণে আহ্বান জানানো উচিত। এই বৈঠক চলাকালে আমাদের সাথে যোগাযোগ এবং উৎসাহিত করেন নৌ বাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্য জনাব হাবিবুর রহমান। তিনি নিজেকে কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের একজন ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচয় দেন। এই সিদ্ধান্ত হবার পর শহরে মাইকযোগে ঘোষণা করা হয় যে, প্রতিরোধের যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য সামরিক ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং রাজেন্দ্র কলেজ প্রাঙ্গণে সকলকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সেই সাথে আরো ঘোষণা করা হয় যে, ছুটিরত পাক বাহিনীর বাঙালী সৈনিক ভাই এবং প্রাক্তন সৈনিক ভাইদেরও কলেজ প্রাঙ্গণে আসার জন্য বলা হচ্ছে। এই ঘোষণার পর প্রায় দু'শো লোক কলেজ ময়দানে হাজির হয়। এদের মধ্যে ছুটিরত এবং প্রাক্তন পাক-সেনাবাহিনীর সংখ্যাও ছিল প্রায় ৬/৭ জন। স্টেডিয়ামের একটি রুমকে এই প্রশিক্ষণের হেডকোয়ার্টারে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথমে কলেজের ইউ-ও-সি ইউনিটের ডামি রাইফেল এবং পুলিশ লাইন থেকে রাইফেল এনে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ফরিদপুর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটি নাম দিয়ে এই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করা হয়।
ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সাইক্লোস্টাইল প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এসব প্রচারপত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কি করে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন করার জন্য পাটচাষ বন্ধ করা ইত্যাদি। এই পর্যায়ে আমাদের ধারণা হয় এই যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং সকল বাঙালী শিক্ষিত যুবকই পাক-সেনাবাহিনীর বুলেটের লক্ষ্য হবে। আমাদের ট্রেনিং চলাকালে কুষ্টিয়া এবং যশোরের প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি এবং অস্ত্রের জন্য মেজর ওসমানের সাথে যোগাযোগ করি। তাঁর নির্দেশ অস্ত্র আনার জন্য যশোরে দুইজন সদস্যকে পাঠান হয়। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তাদের অস্ত্র দেয়া হয়নি। ইতিমধ্যে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, এপ্রিলের প্রথম দিকে জয়দেবপুর থেকে পাক-সেনাবাহিনীর সদস্য হেমায়েত উদ্দিন তার তিন সদস্য সিপাহীসহ বেশকিছু গোলাবারুদ, গ্রেনেড, এস-এম-জি, চাইনিজ রাইফেল সহ পদ্মার চরে অবস্থান করছে বলে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক ভূঁইয়া ইকবাল আমাদের খবর দেন। আমরা কয়েকজন সদস্য পাঠিয়ে তাদেরকে স্টেডিয়ামে নিয়ে আসি এবং আমাদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনে তাকে শরিক হতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি একদিন পরে শহরের অন্যত্র অবস্থান করতে থাকেন। আমরা কামারখালী, গোয়ালন্দ এবং ভাংগা পর্যন্ত স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে আমাদের প্রচেষ্টাকে জড়িত করার চেষ্টা করতে থাকি। দ্বিতীয়বার অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যশোর লোক পাঠানো হয়। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়। রাজেন্দ্র কলেজ এবং স্টেডিয়ামের মাঠে আমাদের ট্রেনিং অব্যাহত থাকে এবং ক্রমেই ট্রেনিং গ্রহনকারীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। আমাদের এই প্রচেষ্টার দু’টি উল্লেখযোগ্য দিক ছিলঃ (১) জনগনের মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য প্রচারকাজ চালানো; (২) ফরিদপুর শহর এবং আশেপাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা। অস্ত্র না পাওয়াতে এবং দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহনের পরিকল্পনা কারনে ২২শে এপ্রিল পাক-সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করার মুহূর্তে আমরা শহর ত্যাগ করি এবং ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ি। আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথীরা অস্ত্র যোগাড় করতে না পেরে ভারতে চলে যান এবং ট্রেনিংশেষে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। অনেকে ফরিদপুরের গ্রামাঞ্চল থেকেই রাজাকর এবং পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।
- ↑ ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
- ↑ “প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ' গ্রন্থ থেকে সংকলিত
- ↑ দৈনিক বাংলা, ২৪ মার্চ, ১৯৭২-এ প্রকাশিত মহীদ সেরনিয়াবাত রচিত প্রতিবেদনের অংশ।
- ↑ প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ থেকে সংকলিত
- ↑ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত
- ↑ সাপ্তাহিক 'চিত্রবাংলা' ৩জুন, ১৯৮৩-এ প্রকাশিত শরীফ আফজাল হোসেন-রচিত প্রতিবেদনের অংশ।
- ↑ প্রতিবেদনটি জানুয়ারী, ১৯৮৪-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ কামাল-এর কাছ থেকে সংগৃহীত।