বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/১৫

সশস্ত্র প্রতিরোধ: পত্র-পত্রিকার আলোকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা মার্চ-জুন, ১৯৭১
 

পাক মিলিটারী তাণ্ডবে বাঙ্গালীর রক্ত ঝরছে

 কলকাতা, ২৬শে মার্চ (ইউ,এন আই)- শেখ মুজিবর রহমান এক বার্তায় আজ বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে করছে। এক গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবরের প্রচারিত বার্তা এখানে শোনা গেছে। এই গোপন বেতার কেন্দ্রটি চট্টগ্রাম অথবা চালনায় অবস্থিত বলে মনে করা হচ্ছে।

 ঐ বার্তায় বলা হয়েছে, গতকাল রাত ১২টায় সময় পিলখানা ও রাজারবাগে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলসের ঘাঁটি আক্রমণ করে বহু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। ঢাকাতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনী সঙ্গে পাক-বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সাধারণ অসম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ যে কোন মূল্যে শত্রুকে বাধা দেবে। স্বাধীনতার জন্য এই সংগ্রামে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করুন।

-যুগান্তর,২৭ মার্চ, ১৯৭১ 

কুমিল্লায় সংঘর্ষ

 বেসরকারী সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, কুমিল্লায় সৈন্যবাহিনী ও যুক্তিসংগ্রামী জনগনের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলস বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী জনগনের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। সৈন্য বাহিনীর গুলিতে কিছু লোক আহত হয়েছে। কুমিল্লার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে প্রকাশ।

 মুক্তিফৌজকে সাহায্য করুনঃ ভারত-পাক সীমান্তে সংগৃহীত একটি বাংলা ইস্তাহারে বলা হয়েছে যে, ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করেছে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে।

 বেতার কেন্দ্রের ঘোষক শত্রুর সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

 বেতারে বলা হয়েছে, ঝড়ের বেগে মুক্তিফৌজ এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও শ্রীহট্টের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। অনুগ্রহ করে তাঁদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সাহায্য করুন। আমরা সম্পূর্ন স্বাধীন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুন। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করুন। ঢাকা কেন্দ্র ছাড়া আর সকল কেন্দ্রের রেডিও শুনুন। জয় বাংলা। গনমুক্তিবাহিনীর পক্ষে জনাব শেখ সাহেব।

-যুগান্তর, ২৮ মার্চ, ১৯৭১ 

ওরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন-আরও গুলিগোলা চাই

(রাজনৈতিক সংবাদদাতা)

 দু’দিনের লড়াইয়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক লক্ষ লোক মারা গিয়েছেন বলে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ভারত সরকারের দফতরগুলিতে খবর পৌঁছেছে। বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে যেসব খবর আসছে তার সারমর্মঃ মুজিবর রহমানের সমর্থক পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর লোকজনদের গুলি ফুরিয়ে এলেও তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।

 লড়াই এখনও সবচেয়ে বেশি চলছে ঢাকা এবং রংপুরে। এই দুই এলাকায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষও সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় লড়াই চালাচ্ছেন। পাক সেনাবাহিনী ও এই দুই এলাকায় ট্যাঙ্ক নিয়ে নেমেছে। তারাও ট্যাঙ্ক থেকে অবিরাম গুলি চালাচ্ছে।

 পূর্ব পাকিস্তানের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ওপরের কয়েকটি ব্রিজও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা উড়িয়ে দিয়েছেন। এই দুটি সড়কই ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম এবং যশোরের যোগাযোগ রক্ষা করত। এই দুটি সড়ক দিয়ে এইদিন সেনাবাহিনীর গাড়ি এগোতে পারেনি। এছাড়া মুজিবর রহমানের সমর্থকরা বিভিন্ন রাস্তায় সৈন্যদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার জন্য নানারকমের প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছেন। বহু এলাকায় রাস্তা খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে।

 শনিবার সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ওপারের লোকেরা এসে এপারে গুলি চেয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন যে তাঁদের গুলি ফুরিয়ে যাচ্ছে। গুলিগোলা না পেলে আর লড়াই চালাতে পারছেন না। কিন্তু তাদের সবাইকেই এপার থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে একজন এসডিও-ও গুলি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে মার্চ, ১৯৭১

আওয়ামী লীগের নেতারা এপারে

তাঁদের আবেদনঃ অস্ত্র চাই

 আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা সোমবার ওপার থেকে এপার এসেছেন। সকলেরই একই লক্ষ্য-ভারত থেকে অস্ত্র সাহায্য সংগ্রহ করা। এদের মধ্যে একজন আছেন নবনির্বাচিত পাক জাতীয় পরিষদের সদস্য। তিনি মালদহ জেলা সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছেন।

 এদিকে, মুক্ত কুষ্টিয়ায় এইদিন পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে নিয়েই আওয়ামী লীগের শাসকরা ট্রাঙ্ক টেলিফোনে ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছেন। সোমবার দুপুরেই মুক্ত কুষ্টিয়ার প্রধান পরিচালক ডাঃ আসাবুল হক টেলিফোনে শ্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরও আবেদন ছিলঃ আপনারা অবিলম্বে সাহায্য পাঠান।

 ডাঃ হক জানান, এখন কার্যত হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ সৈন্যদের আক্রমন করছে। এত মানুষ এসে লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে যে, সেনাবাহিনী মেশিনগান চালিয়েও মেরে শেষ করতে পারছে না। তিনি জানান, কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, খুলনায় এইদিন হাজার হাজার মানুষ বল্লম ও সড়কি নিয়ে এসে সেনাবাহিনী ঘাঁটি আক্রমন করেছে। হাজার হাজার মেরেছেও। কিন্তু তাঁরা পিছিয়ে যাননি। তিনি জানান, সোমবার রাত্রিতেই বৃহত্তম আঘাত হানা হবে ঘাঁটিগুলির উপর।

 কুষ্টিয়া মিলিটারী ব্যারাককে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সৈন্যদের বলা হয়েছে আত্মসমর্পন করতে। ডাঃ হক জানান, পাবনায় ও সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা করেনি। ফলে তাদের সবাইকে মরতে হয়েছে। জনতা আহত পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বিজয়োল্লাস করেছে।

 ডাঃ হক বলেনঃ কত হাজার হাজার মানুষে যে ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে তার কোনও গুণতি নেই। কিন্তু তবু মানুষ মরতে ভীত নয়।

 তিনি যশোর থেকে খবর পেয়েছেন যে, সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়েছে। খুলনায় সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।

 স্টাফ রিপোর্টার জানান, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের বহু কর্মী এবং মুক্তিসেনা সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিম বঙ্গে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে সাহায্য চাইছেন।
-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ মার্চ, ১৯৭১

সীমান্তের চারদিক থেকে

 [আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি, নিজস্ব সংবাদদাতা স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সীমান্ত থেকে অজস্র সংবাদ পাঠাচ্ছেন ওখানকার মুক্তিযুদ্ধের। সব মিলিয়ে একসঙ্গে তা প্রকাশিত হল সংক্ষেপে। সব সংবাদেরই বক্তব্য, পাক ফৌজ ভেঙ্গে পড়ছে, মুক্তিফৌজ দখল করে চলেছে একের পর এক এলাকা।]

 গেদে থেকেঃ কুষ্টিয়ার লড়াই-এ মুক্তিফৌজকে সাহায্যের জন্য হাজারে হাজারে অসামরিক নাগরিক পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়ার দিক থেকে ছুটে যান। হারডিঞ্জ সেতু পার হবার সময় শত্রু বাহিনী বোমারু বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। বোমায় সেতুর একাংশ বিধ্বস্ত হয় এবং শতখানেক স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাণ হারান।

 পাবনায় শত্রুবাহিনী ওই একই নারকীয় দৃশ্য তৈরি করেছে। তবে রক্ত দিয়ে তাদের মূল্য দিতে হয়েছে। শেষ শত্রুসৈন্যও জনতার রোষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

 মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার ভারতের জনগণকে তাঁর অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রংপুর আমাদের মুক্তিফৌজের দখলে এসেছে।

 খুলনায় নারী ও শিশুদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বর্বর, অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে-মুক্তি ফৌজের নেতা বার বার তার উল্লেখ করেন।

 তিনি বলেন, রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, আমরা তা জানি। কিন্তু আমাদের মাবোন, ছেলেমেয়েদের উপর এই নৃশংস অত্যাচার চলবে-তা আমরা ভাবতে পারিনি।

 মেখলিগঞ্জ থেকেঃ বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ এবং বগুড়া শহরে দখলদার পাকিস্তানী ফৌজ ও বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর মধ্যে প্রতি মহল্লায় তুমুল লড়াই চলছে।

 দখলদার বাহিনী রংপুর শহরে ট্যাঙ্ক নামিয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুর জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে মুক্তি ফৌজ পচাগড়ে অবরুদ্ধ দুই কোম্পানী পাকিস্তানী ফৌজকে পর্যুদস্ত করে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়েছে এবং এই লড়াইয়ে অধিকাংশ পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে। রংপুর ও দিনাজপুর জেলার সীমান্ত ফাঁড়ি এখনও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী ফৌজকে পরাজিত করে রাজশাহী শহরকে মুক্ত করেছে।

 ইতিমধ্যে এপার বাংলার কাছে ওপার বাংলার তরুন ছাএদের আর্ত আবেদনঃ আমাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করুন। হলদিবাড়ি সীমান্তে গতকাল চারজন ছাত্রপ্রতিনিধি আসেন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য।

 দিনাজপুর শহরে মুক্তিফৌজের শক্তিবৃদ্ধির জন্য সীমান্ত বাঙ্গালী ইপিআর সীমান্ত চৌকি ছেড়ে চলে গিয়েছে। দিনাজপুরের পথে পথে পশ্চিমী ফৌজ প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন। ঘোড়াঘাট ও হিলির মধ্যে পশ্চিমী ফৌজের একটি ট্রাক রাস্তায় ওপর একটি গর্তে পড়ে উলটে যায়। প্রচুর ফৌজ আহত হয়। হিলি এলাকায় ভারত-পাক সীমান্তের কাছে দুটি অবাঙ্গালী পশ্চিমী ফৌজের মৃতদেহ দেখা গিয়েছে। দুজন পশ্চিমী ফৌজ প্রানভয়ে ভারতের এলাকায় ঢুকে পড়ে। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

 সোমবার মুক্তিফৌজের তাড়া খেয়ে প্রায় ২০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সপরিবারে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। এরা ভারতীর সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করেছে।

 অন্যদিকে পশ্চিম দিনাজপুরের দিক থেকে আওয়ামী লীগের দুজন বিশিষ্ট নেতাও এপার আসেন। জলপাইগুড়ি শহরে এরা পৌঁছালে তাদের বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়।

 পাকিস্তানী জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা মুহম্মদ আবিদ আলী বাংলাদেশে অবিলম্বে সাহায্যের জন্য আর্ত আবেদন জানিয়েছেন।

 হাসনাবাদ থেকেঃ সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরা সীমান্তে খবর সাতক্ষীরা আদালত ভবন থেকে ক্রুদ্ধ জনতা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলে পুড়িয়ে দিয়েছে। সাতক্ষীরার পাঞ্জাবী মহকুমা শাসককে জনতা স্বগৃহে অন্তরীণ করে রেখেছে।

 সীমান্ত আজ মুছে একাকার হয়ে গেছে। এপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ এসে সীমানার এপারে দাঁড়াচ্ছে। ওপারের মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছে মুখোমুখি। আজ আর কেউ কারও কাছে অপরিচিত নয়।

 সোমবার সীমন্ত পার হয়ে অনেকখানি ঢুকে গিয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। কথা হল বহু মানুষের সঙ্গে। সকলের মুখে এক কথা, শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য আমাদের অস্ত্র দিন।

 অস্ত্র আর অস্ত্র। ওপার বাংলার মানুষ এপার বাংলার মানুষের কাছে আজ শুধু একটি জিনিসই চান। শুধু নৈতিক সমর্থন নয়, অস্ত্র না পেলে আমরা লড়ব কি করে। এই তাদের বক্তব্য।

 খুলনা থেকে দু’দিন হেঁটে আজই ফিরেছেন এমন একজনের সঙ্গে দেখা হল। সমস্ত রাস্তা বন্ধ। খুলনায় এখনও চলছে জোর লড়াই। সেখানে মুক্তিফৌজ ৪০০ পাঞ্জাবী সৈন্যকে নিহত করেছে। একটি তিনতলা বাড়ীতে কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য আশ্রয় নিয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তাদের ঘেরাও করে। সাদা পাতাকা উড়িয়ে পাঞ্জাবী সৈন্য আত্মসমর্পন করে।

 যশোর থেকে সদ্য প্রত্যাগত একটি যুবকের কথাঃ যশোরের পথে বেশীদূর এগুতে পারলাম না। পথে পথে মৃতদেহ। দূরে গুলির শব্দ ধোঁয়া আর ধোঁয়া।

 আগরতলা থেকেঃ গতকাল চট্টগ্রাম দখলদার সৈন্য অবতরণে অসামরিক জনগন বাধা দিলে তাদের ওপর জাহজের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে বহু লোক মারা যায়।

 ইপিআর-এর ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে দখলদার ফৌজরা গ্রেফতার করেছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের যেসব বাঙ্গালী ফৌজ ওই বাহিনী থেকে সরে আসতে পারেননি তাদের হয় গ্রেফতার করা হয়েছে অথবা নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়েছে।

 স্বাধীন বেতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের জনগনের সমর্থনের সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে।

 পাক বিমানবহর হেলিকপ্টারে করে সন্দ্বীপে ফৌজ নামাবার চেষ্টা করছে; নৌকা করে যশোরেও সেনা পাঠাবার। স্বাধীন বেতার কেন্দ্র আজ দুপুরে ওই খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গে জানান, মুক্তিফৌজ তীব্র প্রতিরোধ করছে। এযাবৎ দুজায়গায়ই পাক বিমানবহরের চেষ্টা প্রতিহত হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ মার্চ, ১৯৭১

বাংলাদেশ প্রায় পুরোই মুক্তিফৌজের কব্জায়

 আগরতলা, ৩০শে মার্চ (পিটিআই/ইউএনআই)-পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে শ্রীহট্ট পর্যন্ত সমগ্র এলাকাটি বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কর্তৃক অধিকৃত হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদটি আজ সকালে জানা যায়। এখানে শ্রুত এই বেতার ঘোষণায় বলা হয় যে, সমগ্র এলাকায় এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।

 বাঙলার রাজধানী ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চল শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে আসায় পাকবাহিনী সর্বত্র পশ্চাদপসরণ করছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার দাবী জানিয়েছে। ঢাকার আশেপাশে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ বেতারে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে তাঁদের সাফল্য প্রত্যক্ষ করার জন্য আহবান জানিয়েছেন।

 মুক্তিফৌজ ঢাকা দখলের পর অবশিষ্ট হানাদারদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়ছেন। ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট ও বিমানঘাঁটি দখলের জন্য তীব্র লড়াই চলছে। পাক-বিমান বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে বোমাবর্ষণ করছে।

 চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বন্দর আর এখন ব্যবহার করা যাবে না বলে জানা গেছে।

 চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোহর, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, শ্রীহট্ট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি মুক্তিফৌজের পূর্ণ দখলে রয়েছে। বরিশাল, পাবনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বজেলা ফরিদপুরের কোন খবর পাওয়া যায়নি। মুক্তিফৌজ এখন বাংলার জলপথও সম্পূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। মুক্তিফৌজ প্রথম হানাদারদের উপর মর্টার ব্যবহার করেছেন বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার স্বাধীন বেতার কেন্দ্র ঘোষনা করেছে মুক্তিফৌজ ঢাকা শহর দখল করে নিয়েছে।

 বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ ঘোষণা করেন যে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ স্থান এখন তাঁর মুক্তিফৌজের দখলে রয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তথা বিশ্ববাসীকে তা দেখে যাবার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ছয়টি বেতার কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি এখন মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলা ভাষায় এক বিশেষ ঘোষণায় তিনি বলেন যে, মুক্তিফৌজ বিপুল সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থান এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 পাকিস্তান রেডিওর প্রচারণাকে মেজর জিয়া ডাহা মিথ্যা কথা বলে বর্ণনা করেন। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত দশজন পাঠান গতকাল সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম দিনাজপুরের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। চট্টগাম জ্বলছেঃ চট্টগ্রাম শহর জ্বলছে। মুক্তিফৌজ সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে হাতে হাতে লড়াই করছেন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ট্যাংক ব্যবহার করছে।

 শহরের প্রধান অংশ এখন মুজিবের বাহিনীর হাতে রয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামে বিমান থেকে সৈন্য নামান হয়েছে। জাহাজ থেকে আজও গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। এই বন্দর শহরে এখন প্রবল লড়াই চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, বন্দরটিকে ব্যবহারযোগ্য করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

 দিনাজপুরে প্রবল লড়াইঃ রাধিকাপুর থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, রবিবার সারারাত ধরে দিনাজপুর শহর এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোতে প্রবল লড়াই চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। বোমা ও মেশিনগানের শব্দে রাধিকাপুর ও সংলগ্ন গ্রামের জনসাধারণকে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হয়েছে।

 রাজশাহী ও খুলনাঃ রাজশাহী ও খুলনাতে কয়েক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য বিমানে নামানো হয়েছে। রাজশাহীতে মুক্তিফৌজের প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।

 উভয় স্থানে মুক্তিফৌজ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। একটি মাত্র স্থানে বিদেশী সৈন্যরা সীমাবদ্ধ ছিল। রাজশাহীর গোদাগাড়ি ঘাট পর্যন্ত এখন মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে আছে। তাঁরা রাইফেল বাহিনীর সদর দপ্তর পুনরায় দখল করেছেন।

 আজ সকালে উপরোক্ত স্থানে পুনরায় সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলের ও পুলিশের সাহায্যে শেখ মুজিব বাহিনীর লড়াই অব্যাহত রয়েছে। রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে। পশ্চিমা পাঞ্জাবী মহকুমা অফিসার নিহত হয়েছে। খুলনার টেলিফোনে এক্সচেঞ্জকে পাক-সৈন্যরা ধ্বংস করেছে।

 ক্যাণ্টেনমেণ্ট দখলের চেষ্টাঃ কুমিল্লা ও যশোহর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখলের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য মার্কিন স্যাবর জেট থেকে বোমাবর্ষণ করছে বলে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও মুক্তিফৌজ এই ক্যাণ্টনমেণ্ট দুটিকে দখলে রেখেছেন।

 ঢাকাতে তীব্র সংঘর্ষঃ ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট বিমানবন্দর এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে প্রবল লড়াই চলছে। পরে ঢাকা শহর মুক্তিফৌজ দখল করেছেন বলে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র ঘোষণা করেছেন।

 কৃষ্ণনগর থেকে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, ঢাকা কর্পোরেশন অফিস এখন মুক্তিফৌজের দখলে। প্রশাসক মেজর এস এ খান নিহত।

 মুর্শিদাবাদ জেলার ভারতীয় সীমান্ত গ্রাম ভগবানগোলার বিপরীত দিকে পাক-সীমান্ত প্রহরারত ২০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী প্রহরী মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হয়েছে।

 রাতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধঃ নদীমাতৃক পূর্ববাংলার জলপথে রাত্রে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম সরকার’ এক নির্দেশ জারী করেছেন।

 মুক্তিফৌজের আক্রমণে বিছিন্ন ও পর্যুদস্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা যাতে পালাতে না পারে তার জন্যই এ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে।

 রংপুরঃ সমগ্র রংপুর শহর মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রংপুর-কোচবিহার এলাকায় পাকিস্তানী রাইফেলের টহল মুক্তিফৌজের নির্দেশ বন্ধ করা হয়েছে।

 আখাউড়াঃ আখাউড়াতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ছয়জন অফিসার নিহত হয়েছেন। সেখানকার আশেপাশে এখনও যুদ্ধ চলেছে।

 করাচীর ভাষ্যঃ করাচীর সরকারী সূত্রে বলা হয়েছে যে,বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে মাঝে মাঝে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় আছেন সে সম্পর্কে আজ কিছুই বলা হয়নি। পাকিস্তান রেডিও থেকে পূর্ববঙ্গের অবস্থাকে ‘সম্পূর্ণ শান্ত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

-যুগান্তর, ৩১ মার্চ, ১৯৭১

সকল রণাঙ্গনেই পাকফৌজ গা বাঁচিয়ে চলছে

 মঙ্গলবার মধ্যরাত্রিতে বঙ্গ রণাঙ্গনের সমগ্র পরিস্থিতি মুক্তিফৌজের অনুকূল-বিভিন্ন খণ্ডের রণক্ষেত্রে মুক্তিফৌজ প্রচণ্ডভাবে আঘাত হেনে চলেছে।

 বাংলাদেশের দূরবিস্তৃত অধিকাংশ রণাঙ্গনেই পাকিস্তানী স্থলবাহিনী কোনরকমে গা বাচিয়ে চলছে এবং অনন্যেপায় হয়ে বিমান বাহিনীকে ডেকে আনছে এবং তারাও নির্বিচারে সামরিক প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা চিন্তা না করে বোমাবর্ষণ করে ঘাঁটিতে ফিরে যাচ্ছে। দিল্লির প্রতিরক্ষা অনুশীলন সংস্থার বিশেষজ্ঞরা সমগ্র রণাঙ্গনের চিত্রটি এভাবে একেঁছেনঃ

 পূর্ব রণাঙ্গনঃ কুমিল্লা থেকে শ্রীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ সীমান্তবর্তী সব কয়টি ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। তাদের বিমানধ্বংসী কামান হানাদার পাক বিমানকে বার বার তাড়িয়ে দিয়েছে। এই রণাঙ্গনেরই অন্তর্ভুক্ত আখাউড়ায় মঙ্গলবার সকালে পাক বিমান প্রচণ্ডভাবে বোমাবর্ষণ করেছে।

 মঙ্গলবার সবচাইতে নৃশংস সংগ্রাম চলেছে চট্টগ্রাম-এর সঙ্গে কেবলমাত্র তুলনা চলতে পারে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর রাজপথের লড়াই। পাকিস্তানী বিমানবন্দর এলাকায় বোমাবর্ষণ করেছে, যুদ্ধজাহাজ গোলা ছুঁড়েছে। চট্টগ্রাম জ্বলছে।  উত্তর-মধ্য রণাঙ্গনঃ উত্তর-মধ্য রণাঙ্গনে ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে।

 দক্ষিণ রণাঙ্গনঃ দক্ষিণ রণাঙ্গনে বিপন্ন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য মধ্য রণাঙ্গন থেকে সৈন্য পাঠান হচ্ছে। নদী-নালা, খাল-বিল আকীর্ণ রণাঙ্গনে তারা রাত্রির অন্ধকারে চুপি চুপি অগ্রসর হচ্ছে।

 মুক্তিফৌজের কমাণ্ড চারিটি রণক্ষেত্রের সংগ্রামরত সৈন্যদের মধ্যে নিখুঁত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা পর্যন্ত উপকূল বরাবর বিস্তৃত দক্ষিণ রণাঙ্গনের পূর্ব প্রান্ত চট্টগ্রামের দিকে জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য পাঠানো হয়েছে পশ্চিম প্রান্ত খুলনা থেকে।

 দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন; দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণে খুলনা-যশোর খণ্ডে মঙ্গলবার তেমন কোন বড় লড়াই হয়েছে বলে মনে হয় না। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখলের জন্য সোমবার প্রচণ্ড লড়াই হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত উভয় পক্ষই আগামী দিনে তীব্রতর দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

 দূরবিস্তৃত চারটি রণাঙ্গনের সর্বত্র আক্রমণোদ্যোগ এখন মুক্তিফৌজের হাতে, পশ্চিম রণাঙ্গন বাহিনী সর্বত্র আত্মরক্ষা করে চলছে।

 মুক্তিফৌজের স্থলসেনার অবিরাম চাপে বিব্রত পশ্চিম পাকিস্তানী স্থলবাহিনী বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কিন্তু তার ফলে পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে যাওয়ার তেমন নেই।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মার্চ, ১৯৭১

ইয়াহিয়া ফৌজের ‘বিদ্রোহী’ সেনাকে গুলি করে হত্যা

শুভ্রাংশু গুপ্ত

 মেহেরপুর (কুষ্টিয়া), ৩১ মার্চ-ইয়াহিয়া ফৌজের বিপুলসংখ্যক সেনা মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে অস্বীকার করেছেন। এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েন। পুলিশ লাইনেও এই শহরের একটি স্কুলগৃহে এরা ‘বিদ্রোহী’ সেনাদের প্রায় দুশোজনকে তাদের দলপতির নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

 বঙ্গবন্ধু মুজিব কোন এক গোপন ঘাঁটিতে সপরিবারে আছেন। এখানে বঙ্গবন্ধু দু’জন সহকর্মী-আবু আহমেদ আফজল রসিদ এবং মঃ সহীউদ্দিন আমাকে এই সংবাদ দেন। তারা বলেন, মুজিবর রহমানের গ্রেফতার এবং তাঁর পুত্রের হত্যার সংবাদ সম্পূর্ণ তৈরী করা। বঙ্গবন্ধু তাঁর গোপন ঘাঁটি থেকে সর্বদাই এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবর তখন আত্মপ্রকাশ করবেন বলে মুজিবের ওই সহকর্মীদ্বয় জানান।

 ওই দুই নেতা জানান, পাবনা, দিনাজপুর, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়ার প্রায় পুরো অঞ্চল এখন আওয়ামী লীগের দখলে। মঃ রসিদ জানান, তাঁরা বিপুল অস্ত্রশস্ত্রের মজুত উদ্ধার করেছেন। সেগুলির বেশির ভাগই চীনের তৈরি। তার মধ্যে হালকা মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, দুটো কামান ও প্রায় পঞ্চাশটি মিলিটারি ট্রাক রয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ এপ্রিল, ১৯৭১

যশোরের বোমাবর্ষণ

 বনগাঁ, ৩১ শে মার্চ-সারা যশোর শহর দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনের আভা সন্ধ্যায় হরিদাসপুর থেকেও দেখা গেছে। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট পুর্নদখলের উদ্দেশে আজ বেলা সাড়ে বারটা নাগাদ পাক সামরিক বাহিনী ৫ খানি বিমানে করে ছত্রীসৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে দেয়। এরপর বিমান বাহিনী থেকে কিছু সময় পর পর বোমাবর্ষণ করা হতে থাকে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত বোমাবর্ষণ চলছে বলে জানা গেছে।

 পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের তীব্র লড়াই চলছে। একদল সৈন্য শহরাঞ্চলে মর্টারের সাহায্য আক্রমণ চালায়। শহরে বহু বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করছে, কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

 আজ সকালের দিকে হরিদাসপুর সীমান্ত এলাকায় ৫ জন পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্যের মৃতদেহ এবং একটি কাটা মুণ্ডু দেখতে পাওয়া যায়। এখানে সন্দেহ করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মধ্যে হত্যা করে এই মৃতদেহগুলি এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

 খুলনায় এক খবরে প্রকাশ যে, খালিশপুরে একটি চটকল ডিনামাইট উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং রূপসা নদীর ধারে তীব্র সংঘর্ষ চলেছে।

 আজ সকালে মুক্তিফৌজের লোকেরা বেনাপোল চেকপোস্টে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে দেয়। সরকারী সূত্রে জানা গেছে যে, মোট ৩২ জন পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্য এই সীমান্ত পার হয়ে আত্মসমর্পন করেছে।

 আগরতলা, ৩১শে মার্চ (পিটিআই)- রাজশাহী, খুলনা ও আরও কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানী স্যাবর জেট আজ বোমাবর্ষণ করেছে। পাক বিমান বাহিনীর এই হানায় বহু নিরস্ত্র লোক নিহত হয়েছে।

 রাজশাহী, যশোর, খুলনা, কুমিল্লা ও ঢাকাতে তীব্র লড়াই চলছে।

 ঢাকা বিমানবন্দরের আশেপাশে মর্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। কামান থেকেও পাক সৈন্যরা গোলাবর্ষণ করছে। চট্টগ্রামে দুর্ভেদ্য দুর্গঃ যুদ্ধরত চট্টগ্রামের কয়েকস্থানে প্রত্যেকটি গৃহ একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে, পাক-সৈন্যরা কোথাও ঢুকতে পারছে না। রংপুর ও কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিফৌজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 ঢাকাতে ৩০ হাজার নিহত; ২৫ শে মার্চ থেকে দু’দিনে ঢাকা ও শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে ত্রিপুরায় আগত পাক-সাংবাদিকরা জানান।

-যুগান্তর, ১ এপ্রিল, ১৯৭১

স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে পাক ফৌজের সর্বাত্মক অভিযান

 পরাস্ত, বিপর্যস্ত পাক দখলদার বাহিনী এখন মরিয়া হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণ-জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে। বিস্তীর্ণ রণাঙ্গনে দিশেহারা পাক-সেনাদল প্রধানত শহরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট। সর্বত্র পাক-বাহিনীর নগ্ন বীভৎস আক্রমণ। বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে নাপাম বোমা, ট্যাংক থেকে বর্ষিত হচ্ছে গোলা, আর সেই সঙ্গে উপকূলবর্তী এলাকায় জাহাজ থেকেও ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ছে গোলা। বৃহস্পতিবার প্রায় সারাদিন স্যাবার জেট নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এর মুখোমুখি মুক্তিফৌজের প্রতিরোধ আরও তীব্র, সংহত। নতুন নতুন মুক্তাঞ্চল তৈরি হচ্ছে। ঢাকার কাছে জয়দেবপুরের অস্ত্র-কারখানা মুক্তিফৌজের দখলে। এক কথায় বলা যেতে পারে; পাক-সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন আছে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায়। আর চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুর, যশোর, রাজশাহী ও কুমিল্লার শহরাঞ্চলে। অন্যদিকে মুক্তিফৌজের আওতায়ঃ ময়মনসিংহ জেলা পুরোপুরি, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীর অধিকাংশ। ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের শহর এলাকার বাইরে সর্বত্র। যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা জেলার পশ্চিমবঙ্গ-সীমান্তবর্তী এলাকা।

 মঙ্গল ও বুধবার-দু’দিন ধরে জঙ্গীশাহী পশ্চিম পাকিস্তানে সিংহল ও চীনের মধ্য দিয়ে বিমানে, জাহাজে প্রচুর সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী আমদানী করেছে।

 বিভিন্ন রণাঙ্গনে সংগ্রামরত মুক্তিফৌজের ইউনিটগুলিকে একই কমাণ্ডের অধীনে আনা এবং পরস্পরের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।

 সারাদিন ধরে মুক্তিফৌজ ও পাক-দখলদার বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও খুলনায়। ক্যাণ্টেনমেণ্ট ও বিমানঘাঁটি বাদ দিয়ে যশোরের সর্বত্র মুক্তিফৌজের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ। মুক্তিফৌজের আক্রমণে পিছু হটার আগে যশোর শহরে পাক-বাহিনী আগুন লাগিয়ে দেয়। ক্যাণ্টনমেণ্ট-এর পাক-সেনাদের আজ বিমান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয়েছে।

 কুমিল্লায় প্রচণ্ড গোলাগুলি বর্ষণ করেও মুক্তিফৌজকে কাবু করতে পারেনি। মেঘালয়ের সমীপবর্তী শ্রীহট্ট শহরেও পাক-সেনারা আজ প্রচণ্ড দাপটে আক্রমণ চালায়। এখানে পূর্ব পাক রাইফেল বাহিনী মুক্তিফৌজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলেছে।

 রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্টের মুক্তিফৌজের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ। খাদিমনগরে পূর্ব পাক রাইফেলস-এর ৬০০ জনকে শ্রম-শিবিরে আটক রাখা হয়েছে। আসাম থেকে পাওয়া খবরে প্রকাশ, রাজশাহী ও নবাবগঞ্জে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ফলে মুক্তিফৌজের সহায়ক পুলিশ বাহিনীর ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৭০ জন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। চট্টগ্রামে পূর্ব পাক রাইফেল-এর সদর দফতরটি পাক-সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ এপ্রিল, ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধারা যশোর দখল করেছে

(নিজস্ব সংবাদদাতা)

 বনগাঁ, ১লা এপ্রিল-আজ বেলা ২টার পরেই বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ সমগ্র যশোহর শহর দখল করে নিয়েছে। পাক-সেনাবাহিনী শহরের তিন মাইল দূরে ক্যাণ্টনমেণ্টের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

 বিশেষ নির্ভরযোগ্য সূত্রে আজ সন্ধ্যায় এখানে ঐ খবর পাওয়া গেছে। প্রকাশ যে, সকালে মুক্তিফৌজ যশোর সেণ্ট্রাল জেলের গেট খুলে ১০০০ বন্দীকে মুক্ত করে দেয়।

 আজ বনগাঁ স্টেশনে সাদা পোশাকে একজন পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্য জনতার হাতে ধরা পড়ে। তাকে জেল হাজতে রাখা হয়েছে। ঐ সৈনিকটি নাকি বলেছে যে, খুলনায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যশোহর ক্যাণ্টনমেণ্টের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। খুলনা থেকে বারবার সাহায্য চেয়ে যশোহর থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন তারা ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ঢাকা থেকে নাকি তাদের বলা হয়েছে-যে যেভাবে পার, প্রাণ বাঁচাও। ঐ নির্দেশ পাবার পর সৈনিকটি সাদা পোশাকে কোনমতে বনগাঁয় এসেছে।

-যুগান্তর, ২ এপ্রিল, ১৯৭১

বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তর এলাকা মুক্তিফৌজের দখলে

 ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলা শহরগুলির ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকা ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী সামরিক ঘাঁটিগুলি ছাড়া বাংলাদেশের সব এলাকা পাক সামরিক শাসনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, শহর ও জনপদে উড়ছে স্বাধীন বাংলার জয় পতাকা। দলে দলে পাঠান সৈন্য আত্মসমর্পন করেছে, অনেকে মুক্তিসেনাদের তাড়া খেয়ে শূন্য হাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আত্মসমর্পণ করেছে।

 কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর একে একে মুক্তিফৌজের দখলে চলে আসছে। তবে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে পাকফৌজের আক্রমণ বন্ধ হয়নি এবং ঐ আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য স্বাধীন বাঙলা সরকার সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় দেশ ও জাতিগুলির কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে।

 সীমান্ত শহর হাসনাবাদ থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছেন, গত রাত্রে যশোহর জেলার মাগুরায় প্রায় ৩৫০ জন পাক-সৈন্য বিনা যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে।

 সৈন্য দলটি ১৩টি গাড়ী যোগে যশোহর অভিমুখে যাওয়ার সময় মুক্তিফৌজের বহু লোক ও আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক তাদের ঘিরে ধরে।

 চারদিন তীব্র যুদ্ধ চলার পর গতকাল পাক-সৈন্যদল ক্যাণ্টনমেণ্টে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলে যশোর শহর মুক্তিযোদ্ধাদের করতলগত হয়।

 কৃষ্ণনগর (নদীয়া) থেকে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, রাজশাহীতে এখনও যুদ্ধ চলেছে। এখানে দুইজন মেজর সহ অন্তত একশ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। প্রকাশ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের পরিচালনা করছেন বেঙ্গল রেজিমেণ্টর একজন কর্নেল। জানা গেছে, তারা শতাধিক রাইফেল শত্রুদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

 রাজশাহী ও লালমনিরহাটে এখন তীব্র লড়াই চলছে। গত কয়েকদিন ধরে এই দুইটি অঞ্চল পাক সৈন্যদের দখলে আছে।

 এক সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম পাকিস্তান রেজিমেণ্টর অধিকাংশ সৈন্যই প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

 আবার বোমাবর্ষণঃ মুক্তিফৌজের করতলগত ছোট ছোট শহরগুলি পুনদর্খলের জন্য পাক-সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠেছে। আজ বিকেলে পাক বিমান বাহিনী আবার বাংলাদেশের কয়েক স্থানে বোমা বর্ষণ করেছে। এইসব স্থানের নাম পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুর।

 সীমান্ত অঞ্চল থেকে এখানে প্রাপ্ত প্রকাশ, পাকিস্তানী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর মোতায়েনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিমানযোগে আধা-সামরিক বাহিনী (সীমান্ত স্কাউট ও রেঞ্জার্স) আমদানী করছে। মুক্তিফৌজ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করায় পাকিস্তানীরা তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রচুর গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্য আমদানীর কথা বিবেচনা করছে।

 পাক-সৈন্যদের আত্মসমর্পণঃ রায়গঞ্জ (পঃ দিনাজপুর), ২রা এপ্রিল-সীমান্তের অপর পার থেকে গতকাল নির্ভরযোগ্য সূত্রে এখানে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ময়মনমসিংহ ও শ্রীহট্ট সম্পূর্ণভাবে নিজ দখলে রেখেছে। ঐসব স্থানে পাক-সৈন্যরা বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে এবং ঢাকা ও রাজশাহীতে এখনও তীব্র যুদ্ধ চলছে বলে ঐ সূত্র থেকে বলা হয়েছে।

 পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে গতকাল প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, পাক-সৈন্যরা ৩১শে মার্চ সন্ধ্যায় দিনাজপুর শহরে নিউ টাউন ও রাজবাড়ীতে পরাজিত হয়েছে। দিনাজপুর ও ফুলবারায় সৈয়দপুর থেকে যে সমস্ত পাক-সৈন্য এসেছিল, তারা হয় নিহত নয়তো বন্দী হয়েছে। রাজশাহী জেলায় চাপাইনবাবগঞ্জে যেসব সৈন্য পাঠানো হয়েছিল, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত নয়তো বন্দী হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট শহরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে এবং পাক-সৈন্যরা সেখানে আত্মসমর্পণ করছে।

 মৌলভীবাজারে ১৪০ জন পাক-সৈন্য নিহতঃ আগরতলা থেকে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট জেলার মহকুমা সদর মৌলভীবাজারে যুদ্ধ চলছে এবং এখানে ১৪০ জন পাক-সৈন্য নিহত হয়েছে। শহরটি এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যদের সাহায্য আরও সৈন্য প্রেরণের চেষ্টা চলছে। সৈন্যরা চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে।

 রংপুরে তুমুর লড়াইঃ শিলিগুড়ি, ৩রা এপ্রিল-সৈয়দপুর, পার্বতীপুর ও রংপুর পাক-সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই চলছে। সঈদপুর থেকে দিনাজপুর এই ২৪ মাইল এলাকায় অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। রংপুরের পাঁচ মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন একশো পাকসেনাকে খতম করে দিয়েছে। ক্যাপ্টন নোয়াজেশের নেতৃত্বে ওরা লড়াই করছেন। এখানে ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের এক হাজার নতুন লোক এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

 কয়েদী মুক্তিঃ মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুর জেলাটি মুক্ত করে দিয়েছে। এখানকার কয়েদীরা বেরিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। এদের মধ্যে দু’জন ভারতীয় ছিল। এরা ভারতে পালিয়ে এসেছে বলে জনরব।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ এপ্রিল, ১৯৭১

উওরাঞ্চলের চারটি জেলা মুক্তিফৌজের দখলে

 দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট-বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এই চারটি জেলা সম্পূর্ণরূপে মুক্তিফৌজের দখলে এসেছে বলে সীমান্তের ওপার থেকে শিলং-এ কাল খবর পৌঁছেছে। এই জেলাগুলোতে পাকিস্তানী সৈন্য সম্পূর্ণরূপে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকার মধ্যে আটকা পড়েছে।

 এদিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা চালনা থেকে খুলনা শহর পর্যন্ত মধুমতি সদীর দু’তীরে গানবোট থেকে গোলা ছুঁড়ে নির্বিচারে গ্রামবাসীদের হত্যা করছে। সরবরাহ পথ যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সেই জন্যই এই মরণপণ চেষ্টা। বোমা বর্ষণে বহু লোক নিহত হয়েছে।

 পাক বিমান ধ্বংসঃ পাক বিমান বাহিনী বগুড়া ও শ্রীহট্ট থেকে মুক্তিফৌজকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য কাল বোমা বর্ষণ করে। সোমবার রাত্রে রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধারা একটি স্যাবারজেট বিমান ধ্বংস করে। এই বিমানটি একটি খাদ্যবাহী হেলিকপ্টারকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছিল।

 যশোর শহরেও তুমুল সংঘর্ষ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে শহরটি পুনদর্খলের পর শহরটি যাতে আবার হাতছাড়া না হয় তার জন্য পাক সৈন্যরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এখনও হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট ঘেরাও করে রয়েছে।

 পাকিস্তানী বিমান বাহিনী কাল ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জ, বগুড়া এবং রাজশাহীতে ব্যাপকভাবে বোমাবর্ষণ করে। প্রায় একপক্ষকালীন যুদ্ধের সর্বশেষে যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে বলা হয়েছে যে, স্থলপথে যাতায়াতের সমস্ত সংযোগস্থান মুক্তিফৌজের দখলে রয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুর, শ্রীহট্ট ও খুলনায় অবস্থিত পাক সৈন্যরা আত্মরক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। এক ডিভিশনেরও বেশী সৈন্য ঢাকায় নিযুক্ত করা হয়েছে এবং অবশিষ্টদের কুমিল্লা এবং যশোরের ক্যাণ্টনমেণ্ট শহরে হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, যশোর, কুমিল্লা এবং ঢাকার সামরিক ঘাঁটিগুলি ছাড়া অবশিষ্ট এলাকাগুলি দখলে, নয়তো সেগুলিকে অব্যবহার্য করে দেওয়া হয়েছে।

 পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সন্নিকটে রংপুরে এবং সৈয়দপুরে আজও প্রচণ্ড লড়াই চলছে। রাজশাহীতে পাক সৈন্য মুক্তিফৌজের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। আরো সৈন্য ও রসদ আমদানীতে মুক্তিফৌজ বাধা সৃষ্টি করছে।

 সমগ্র খুলনা জেলা মুক্তঃ খুলনা শহর এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় পাক সৈন্যর ওপর মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। জেলার অন্যান্য সমস্ত অঞ্চলই এখন মুক্ত। মুক্তিফৌজ যশোর এবং খুলনায় মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী রাস্তাটি নষ্ট করে দেওয়ার প্রায় এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্য বেষ্টিত হয়ে পড়েছে।

 কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ মুক্তঃ সংবাদে প্রকাশ, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। পল্লী অঞ্চল মুক্তিফৌজের সম্পূর্ণ দখলে রয়েছে। শ্রীহট্ট ও কুমিল্লা শহরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

-যুগান্তর, ৫ এপ্রিল, ১৯৭১

 বাংলাদেশ-পূর্ব রণাঙ্গনঃ পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৪৮০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথটি নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে শ্রীহট্ট শহরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে ঢাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ পাঠানো অসম্ভব করে তুলেছে। সোমবার শ্রীহট্ট খণ্ডে জোর লড়াই চলেছে।

 মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমানক্ষেত্রটি দখল করেছে। ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের হাতে। সংলগ্ন নতুন জেলা টাঙ্গাইলের অবস্থাও তাই। মুক্তিফৌজ কুমিল্লা শহরও দখল করেছে। পাক ফৌজ শহর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ময়নামতী ক্যাণ্টনমেণ্টে।

 বাংলাদেশ-পশ্চিম রণাঙ্গণঃ পশ্চিম রণাঙ্গনের কুষ্টিয়ায় সোমবার প্রচণ্ড লড়াই চলছে। যশোহরের চাচড়ার মোড় পুনর্দখলের জন্য জোর লড়াই শুরু হতে চলেছে। খুলনায়ও চলছে উভয়পক্ষে মরণপণ সংগ্রাম।

 বাংলাদেশ-উত্তর রণাঙ্গণঃ সোমবার উত্তর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ একটি সাফল্য অর্জন করেছে-তারা হানাদার বাহিনীর হাতে রংপুর শহরটি ছিনিয়ে নিয়েছে, তিস্তা সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্র অকেজো করে দিয়েছে। সামরিক দিক থেকে এ সাফল্যের তুলনা নেই। মুক্তিফৌজ তিস্তা সেতু উড়িয়ে দিয়ে স্থলপথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণের শেষ পথটি ছিন্ন করে দিয়েছে। দিনাজপুর শহর আগেই মুক্ত হয়েছে। রাজশাহীতেও জোর লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজের সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদাররা কোণঠাসা। বগুড়া ও পাবনা জেলার মুক্তি সংবাদ শেষ রাত্রে এসেছে।

 বাংলাদেশ-দক্ষিণ রণাঙ্গণঃ দক্ষিণ রণাঙ্গণে চট্টগ্রামে আবার প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে হানাদার ও মুক্তিফৌজে। পাক বিমান বোমা ফেলছে চট্টগ্রামে শহরে। নোয়াখালী জেলার নানা অঞ্চলেও উভয় পক্ষ মুখোমুখি। বরিশাল জেলায় লড়াই হঠাৎ প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে।

 পূর্বাঞ্চল রণাঙ্গনঃ আগরতলা, ৫ এপ্রিল-বড় বড় শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল এখন মুক্তাঞ্চল। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের তিনজন মেজর সম্মিলিতভাবে এই যুক্তাঞ্চলের প্রশাসন ভার গ্রহন করেছেন। তাদের সাহায্য করছেন অসামরিক অফিসার ও আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা। মুক্তাঞ্চলের শ্রীহট্ট এলাকার অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ, ময়মনসিংহ এলাকার মেজর সফিউল্লা ও চট্টগ্রামে এলাকার মেজর জিয়াউর রহমান।

 দিন কয়েক আগে মেজর জিয়াউরই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন মেজর জিয়া বলে।

 গত শনিবার শ্রীহট্ট এলাকার কোন এক স্থানে মেজর মোশাররফের সদর দফতরে তিন মেজর এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে স্থির হয়ঃ যতদিন না জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে এই ত্রয়ীই সেনাবাহিনী পরিচালনা করবেন।

 শ্রীহট্ট খণ্ডের অধিনায়ক মেজর মোশাররফ ইউ এন আইয়ের প্রতিনিধিকে বলেনঃ স্বাধীনতা ঘোষনার সময় মুক্তিফৌজে পুরোদস্তর সৈন্যের সংখ্যা ছিল হাজার কয়েক মাত্র। এখন তা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে নিয়মিতভাবে সামরিক তালিম দেওয়া হচ্ছে।

 মুক্তিফৌজের রণনীতি প্রসঙ্গে মেজর বলেন, মুক্তিসেনাদের সংঘবদ্ধ করা ও তাদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলাই বাংরাদেশেরএকন সবচেয়ে জরুরী। শত্রুপক্ষের শক্তি কোন এলাকায় কি রকম সে-সকল খোজখবর নেওয়ার পর হানা হবে আঘাত। মেজর মোশাররফ জানান, বিভিন্ন জায়গায় লড়াই করা মুক্তিফৌজ হানাদারদের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। আরও অস্ত্রশস্ত্র দখল ও অস্ত্রাগারগুলির উপর আক্রমণ চালাবার জন্য গেরিলা বাহিনী গঠন করা হবে।

সমুদ্রবক্ষে পাক সাবমেরিনের বাঙালী নাবিকদের বিদ্রোহ

 তউলন (ফ্রান্স), ৫ এপ্রিল-পাকিস্তানী সাবমেরিন ‘মনগ্রো’র বাঙালী নাবিকরা ‘বিদ্রোহ’ করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তৎপরতার সঙ্গে তা দমন করা হয়। ৪৫ জন নাবিকের মধ্যে ১৩ জনকে ফেলে রেখে সাবমেরিনটি এখান থেকে যাত্রা করে। সাবমেরিনটি এখান থেকে করাচির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। বাঙালী নাবিকরা সেটি থামাবার চেষ্টা করে।

 ১৩ জন নাবিক সুইজারল্যাণ্ডের দিকে যাত্রা করেছেন বলে জানা গিয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সাবমেরিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। তবে মনগ্রো’র আশেপাশে জাহাজগুলির নাবিকেরা তাতে মহুর্মুহু চিৎকার শুনতে পান। মনগ্রো’র নিকটবর্তী দক্ষিন আফরিকার একটি সাবমেরিনের একজন অফিসার বলেন, আমি মনে করেছিলাম, বুধবার রাতে তারা পরস্পরের গলা কাটছিল।

- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ এপ্রিল, ১৯৭১

গুরুত্বপূর্ণ রেলশহর পাবর্তীপুর মুক্ত

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

 ৬ এপ্রিল-উত্তরখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ রেলশহর পাবর্তীপুরে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। আজ ভোর না হতেই মুক্তিফৌজের পাবর্তীপুর অভিযান শুরু হয়েছিল। দুই হাজারের মত মুক্তিফৌজ বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাবর্তীপুরের ওপর। অবশেষে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন শত্রু হাত থেকে। পাবর্তীপুর আজ স্বাধীন, শত্রুমুক্ত।

 পাবর্তীপুর দখলের আগে এই শহরের দু’মাইল দূরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে বসে মাঝে মাঝেই গুলির শুনছিলাম। তিনটায় আওয়ামী লীগ নেতা মহম্মদ আনোয়ার তখন দুটি স্টেনগান দেখিয়ে বলেন যে, ওই দুটি তারা পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। আলোচনার কিছু পরেই পাবর্তীপুর থেকে জয়ের খবর আসে। মুক্তিফৌজের মেজর মনসুন আলি ছুটে এসে ওই খবর দেন। আওয়ামী লীগের আর একজন নেতা এম এ কুদ্দুসকে জিজ্ঞসা করলাম, ‘পাবর্তীপুর দখল’ — একথা বলছেন কেন? তিনি বললেন, এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি দখলের জন্য গত রাত্রি থেকে পাক সেনারা চেষ্টা করছিল। তারা এই শহর দখলের মরিয়া হয়ে ওঠে।

 বিকালে দিনাজপুরে ও বগুড়া থেকেও মুক্তিফৌজের জয়ের খবর আসে। ওই দুই স্থানে পাক সৈন্যবাহিনী প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করে।

 আরও খবরঃ রাজশাহী, ফরিদপুরের যে ক’টি জায়গা পাক সেনারা দখল করে রেখেছে মুক্তিফৌজ তাও দখলের চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হল যে, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর ও পাবনার অধিকাংশ অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলেই।

পূর্ব রণাঙ্গনের খবর

 চট্টগ্রাম জলধার ক্ষতিগ্রস্তঃ আগরতলা, ৬ এপ্রিল-সীমান্তের ওপার থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর এসেছে, তিন দিন আগে মুক্তিফৌজ চট্টগ্রাম শহরের পশ্চিমাংশে কোর্ট এলাকায় অবস্থিত ওয়াটার ওয়ার্কস এর জলাধার ও পাওয়ার হাউস ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছেন। এই এলাকায় পাক বাহিনী দিনরাত্র ঘাঁটি আগলাচ্ছিল।

 চট্টগ্রাম শহরের ডাকঘর ও বিমানবন্দর এলাকা সম্পূর্ণরূপে পাক দখলদারদের হাতে। বন্দর এলাকা পরিত্যক্ত জনমানবশূন্য।

 সারা নোয়াখালী জেলা, নোয়াখালীর লাগোয়া কুমিল্লার কিছু অংশ এবং চট্টগ্রাম জেলা এখন সম্পূর্ণভাবে পাক সৈন্য মুক্ত। এসব মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশে সরকারের অধীনে অসামরিক প্রশাসন ফিরে আসছে।

 আবার স্বাধীন বাংলা বেতারঃ “স্বাধীন বাংলা বেতার” কেন্দ্র আবার ফিরে এসেছে। মঙ্গলবার শর্ট ওয়েভে এর অনুষ্ঠান শুরু হয়। তবে ঘোষণাগুলি একরকম শোনাই যায়নি। আগে এই কেন্দ্রটি ছিল চট্টগ্রামের কাছে, পরে পাক ফৌজ-এর তোপের মুখে উড়ে যায়। নতুন জীবন ফিরে পেয়ে স্বাধীন কেন্দ্রটি ঘোষণা করেছে দু’এক দিনের মধ্যেই মিডিয়াম ওয়েভ-এ অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে।

 সোমবার শিলং-এ সন্ধ্যা ছটায় ৮১ থেকে ৮২ মিটারে (শর্ট ওয়েভ) অনুষ্টান শোনা যায়। প্রচারিত গানগুলির মধ্যে “আমার সোনার বাংলা” তো ছিলই, উপরন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা” গানটি শোনা যায়।

 এই বেতার বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির জন্য এবং জয়ের জন্য প্রার্থনা করতে আহ্বান জানিয়েছে। ধিক্কার দিয়েছে বিশ্বাসঘাতক জঙ্গী স্বৈরতন্ত্রকে যারা দেশব্যাপী রক্তস্রোতের জন্য দায়ী। আর শেষে সাড়ে কোটি মানুষের হয়ে সমস্ত বিশ্বের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির জন্য আবেদন জানিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা,৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সোমবার জয়-বাংলার জয়ের পালা

 রংপুর, কুমিল্লা ময়মনসিংহ মুক্ত, তিস্তা সেতু ধ্বংসঃ সোমবার জয় বাংলার শুধু জয়ের মালা, একটার পর একটা জয়ের পালা জয় রংপুর শহর-অধিকৃত। জয় কুমিল্লা শহরেও-মুক্ত। শ্রীহট্টের বিমানক্ষেত্রও মুক্তিফৌজের করারত্ত। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরে মুজিব সেনারই জয়জয়কার। সংগ্রামী সেনারাই দিন এই প্রথম সব রণাঙ্গন মিলিয়ে একটি যুক্ত কমাণ্ড গড়ে তোলার পথে পা বাড়ান। এই উদ্যোগ হানাদার হটানোর লড়াইয়ে শেষ রাউণ্ডের প্রস্তুতি।

 মুক্তিফৌজ হানাদারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সাঁজোয়া গাড়ি, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নরসিংদী (ঢাকা থেকে ১৪ কি.মি.) অভিযানে এগিয়ে চলেছেন। শ্রীহট্ট শহরের একাংশ এবং ছাউনি এলাকা বাদে পাবনা ও বগুড়ার প্রায় সব অঞ্চলই হানাদারমুক্ত।

 পাকফৌজ ও হানাদার বিমান বাহিনীর তৎপরতা রোধের জন্য মুক্তিসেনারা পোড়ামাটি নীতি অনুসারে তিস্তা সেতু ধ্বংস করেছেন। অকেজো করে দিয়েছেন লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্র, উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথের (৪৮০ কিলোমিটার) বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানী ফৌজ গর্তে তাড়া খাওয়া সাপের মত ছড়িয়ে পড়েছে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও শ্রীহট্ট আর মার খাওয়া সাপের মতই ছোবল মারছে যত্রতত্র, যা পাচ্ছে তাই ধ্বংস করছে কামান দিয়ে, মেশিনগান দিয়ে, পেটরোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে। অত্যাচার চালাচ্ছে বিশেষ করে নারীদের ওপর।

 রংপুর পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের দরুণ লড়াই হয়েছে। দু’পক্ষের হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিফৌজই জয়ী। দখলদারদের হাত থেকে তাঁরা রংপুর শহর পুনর্দখল করেছেন। রংপুর শহরের কাছেই তিস্তা সেতু মুক্তিফৌজ সেটি ধ্বংস করে দিয়েছেন। লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্রটিও তারা অকেজো করে দিয়েছেন। সেতুটি ধ্বংসের ফলে পাকিস্তানীর পালাবার পথ নেই। অন্য সমস্ত পথ মুক্তিফৌজ আগেই বন্ধ করে দিয়েছেলেন।

 শ্রীহট্টেও পাকফৌজের সরবরাহের পথগুলি একে একে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও তারা প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন। সবত্রই মুক্তিফৌজ দখলদারদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশী। ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথ এখন ব্যবহারের অযোগ্য। শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমানক্ষেত্রটি মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর দখল করে নিয়েছেন। শ্রীহট্টের শহর ছাড়া ওই জেলার কোথাও পাকফৌজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। হরিপুর (ভারত সীমান্ত থেকে ২৯ কি.মি.) পাকিস্তান পেটরোল লিঃ এর তৈলকেন্দ্রটি মুক্তিফৌজ শনিবার উড়িয়ে দিয়েছিলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

 লালমনিরহাট পাকফৌজের দখলে আছে। পাক বিমান বাহিনীর মদতে তারা সেখানে আছে। আনন্দবাজারের সংবাদদাতা কোচবিহার থেকে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানীরা লালমনিরহাট প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে। কোচবিহারে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার উদ্বাস্তু এসেছেন। তারা সবাই মুসলমান।

 বাংলাদেশের তিন সেনাপতিঃ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা ও শহর ছাড়া প্রায় সবটাই এখন মুক্তিফৌজের দখলে ও প্রশাসনে। এই প্রশাসনে তিনটি সেকটরের নেতৃত্ব করছেন তিনজন সেনাপতি। এরাই মিলিতভাবে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আওয়ামী লীগের অনুগত অসামরিক অফিসার ও কর্মচারীরা এদের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছেন।

 এই তিন সেনাপতি হলেন মেজর খালেদ মুশাররফ (শ্রীহট্ট সেকটর), মেজর সফিউল্লা (ময়মনসিংহ) ও মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম)। জিয়াউরই মেজর জিয়া নামে অস্থায়ী সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন।

 গত শনিবার শ্রীহট্টের কোন এক জায়গায় মেজর মুশাররফের সদর দফতরে ওরা তিনজন মিলিত হয়েছিলেন এবং ঠিক করেছেন যে, যতদিন না জাতীয় পরিষদের বৈঠক বসে এবং জাতীয় সরকার গঠিত হয় ততদিন তারা মুক্তিফৌজ ও প্রশাসন পরিচালনা করবেন।

 মেজর মুশাররফ সাংবাদিকদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা নিজে সঙ্গে থেকে দেখান এবং জানান যে, পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছেন। মুক্তিফৌজ বাংলাদেশে কত জনপ্রিয়, সাংবাদিকেরা তা নিজেদের চোখেই দেখতে পান। বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিফৌজের নতুন স্বেচ্ছাসেবকের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে-তাও তাঁরা দেখেন।

 যশোরে সংঘর্ষঃ যশোর শহরের সর্বত্র নিজেদের কর্তৃত্ব দাবির জন্য হানাদার বাহিনী সোমবার রাত্রে মুক্তিফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বলে পাওয়া গেছে। যশোর-ঢাকা সড়ক ও যশোর-বেনাপোল সড়কে দোতলা তেতলা বাড়িগুলি দখল করে হানাদাররা মেশিনগান ও মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করে চলেছে।

 যশোরের এই খবর ছাড়াও ইউ এন-আই-পি টি আই জানান যে, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম শহরে পাকবাহিনীর উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন। কুমিল্লা থেকে বহু হানাদার হটে গিয়ে এখন ময়নামতীর ছাউনি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। মুক্তিফৌজ আঘাত করেই সরে পড়ার নীতিকে আক্রমণ চালিয়েছিল।

 কলকাতার খবর পাওয়া যায়, চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনার বেতার কেন্দ্রগুলি এখন মুক্তিফৌজের হাতে। তবে হানাদাররা যন্ত্রপাতি নষ্ট করে যাওয়ায় বোধহয় প্রচার বন্ধ আছে। বন্দরগুলি সম্পূর্ণ নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য মুক্তিফৌজ প্রস্তুত হচ্ছেন

 মজুদ খাদ্য ফুরিয়ে আসছে বলে হানাদাররা এখন ভেঙ্গে পড়চে। রংপুর এমনকি ঢাকাতেও পাকসেনারা সরবরাহের সংস্থানে খুবই বিপন্ন বোধ করছে। মৌলবীবাজার ও বাহ্মণবাড়িয়ার বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল-এর সেনারা একটি কমাণ্ডের অধীনে নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করে নিচ্ছে।

 হানাদাররা ঢাকা-কুমিল্লা এবং ঢাকা-শ্রীহট্টের মধ্যে সড়ক ও রেলসংযোগ খোলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, এর ফলে সেনা চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। হানাদাররা দু’এক জায়গায় সংযোগ পুনরায় চালু করলেও মুক্তিবাহিনী আবার অন্যত্র এই সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছে। অতর্কিত আক্রমণে সমশেরনগরের কাছে মুক্তিফৌজ হানাদারদের বহু গাড়ি ও অস্ত্র দখল করে নিয়েছেন। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি হেলিকপ্টার মুক্তিসেনারা গুলি করে ফেলে দিয়েছেন।

 পাকফৌজ ট্রেনের উপর গেরিলা আক্রমণঃ মোগলহাট, রংপুর (বাংলাদেশ)-লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের দিকে একটি ফৌজী রেল-ইঞ্জিন এগোবার পথে মুক্তিফৌজের গেরিলাদের বোমার ঘায়ে জখম হয়ে ফিরে যায়। লালমনিরহাটকে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। লালমনিরহাট-রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন। পাকমিলিটারী বোঝাই একটি ট্যাঙ্ক এই পথে এগোতে গিয়ে অবরোধের মুখে উল্টে যায়। ২০/২৫ জন ফৌজ আহত হয়েছে। রংপুরে কোনও বিমানবন্দর নেই, আছে শুধু হ্যালিপ্যাড ফলে আকাশপথে জঙ্গী-বাহিনী কোন সুবিধা করতে পারছে না। সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। পশ্চিমী ফৌজ ক্যাণ্টনমণ্টে অবরুদ্ধ।

 আজও রংপুর ও লালমনিরহাটে মিলিটারী লুণ্ঠন ও হত্যা চালায় ব্যাপক। গত তিনদিনে ৪৭ বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুরের ডি সি সৈয়দ আমিজ আহাসান ও এস পি আর বারিককে আজ তাদের বাড়ি থেকে ফৌজ ক্যাণ্টনমেণ্টে ধরে নিয়ে গিয়েছে। তাদেরও হত্যা করা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সংগ্রামের তৃতীয় সপ্তাহের সূচনায় পাকফৌজের পাল্টা অভিযান

তবু মুক্তিফৌজেরই প্রাধান্য

 সমগ্র উত্তরখণ্ড এবং পশ্চিমখণ্ডেরও বৃহদংশ করায়ত্ত, মুক্তিবাহিনী এই এই দাবিপত্রটি হাতে নিয়ে বাংলদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তৃতীয় সপ্তাহে পদার্পণ করল। কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ন বিমানঘাঁটিটি দখলের জন্য বৃহস্পতিবার রক্তক্ষয়ী লড়াই চলে। সর্বশেষ সংবাদ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের চতুর্থ বেংগল রেজিমেণ্টরই প্রাধান্য। এই ক্যাণ্টনমেণ্টটি এখন সম্ভবত ফৌজের হাতে। ময়নামতী ছাউনি এলাকায় ঢুলুপাড়া বিমান ক্ষেত্রটি কার্যত মুক্তিফৌজের নিন্ত্রয়ণে।

 কলকাতায় জলপাইগুড়ি থেকে প্রাপ্ত একটি প্রকাশ, উত্তরখণ্ডে সৈয়দপুর মুজিব সেনার অধিকারে এসে গেছে। এই ছাউনিতে দুটি ট্যাংক অধিকৃত, ২০০ দখলদার সেনা নিহত। কিন্তু ফৌজী গোলায় আর বোমায় চারপাশের গ্রামের প্রায় পার হাজার লোকের প্রাণ গেছে।

 আর একটি খবর-রাজশাহী শহরের পতন। শুধু শহর নয়, রাজশাহী সেনা ছাউনিও শত্রুমুক্ত যশোরে ফৌজী বাহিনীর অবস্থা সঙ্গীন। মুক্তিবাহিনী লড়াই জোরদার করার তোড়জোড় করছে। এখানে পাকসেনার দল অবরুদ্ধ ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে জানা যায়। সৈন্যরা বন্দী হয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

 এদিনের খবরের বিপরীতে চিত্রও আছে। দখলদার বাহিনী বসে নেই। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে তাদের রনংদেহি মূর্তি দেখা গেছে। নতুন রণসম্ভার এবং মারণাস্ত্রে বলীয়নে পিণ্ডি ফৌজ শ্রীহট্ট, যশোর, কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুর এলাকায় বহুমুখী অভিযান চালায়। একটি বাহিনী যশোর অঞ্চল থেকে এগিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্ট করে চুয়াডাঙ্গা দিকে। আর একটি উত্তর থেকে নেমে আসে দিনাজপুর অভিমুখে, গোয়ালন্দঘাট থেকে তৃতীয় একটি সেনাদলকে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হতে হতে দেখা যায়। পদ্মা দিয়ে পিণ্ডি ফৌজ গোয়ালন্দঘাটে নতুন সৈন্য আর সাজসরঞ্জাম নামাতে পেরেছে। লড়াই চলছে প্রচণ্ড, তবে হানাদার সেনাদল কোথাও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। পাক বিমান বাহিনী এদিনও রাজশাহী, শ্রীহট্ট, নারায়ানগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। তারা চারদিন কামানের গোলা ছড়িয়ে গোয়ালন্দ রসদ নামায়। কিন্তু বাধা পায় প্রবল। মুক্তিফৌজ যেন অগণিত যোদ্ধা দিয়ে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর রচনা করে রেখেছিল।

 দিনাজপুর শহরের দশ মাইল দূরে ভীষণ সংঘর্ষ চলছে-অন্তত সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সংবাদ ছিল এই। পরে আরও খবরে জানা যায়। চিরিরবন্দর পোরের কাছে বাধা পেয়ে তারা পিছু হটে যায়। চুয়াডাঙ্গা এলাকাতেও সংগ্রাম তীব্র। শোনা গেছে শুধু কামানের আওয়াজ, দেখা গেছে খালি ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ভারত সীমান্ত নিকটবর্তী এই অঞ্চলে মেজর এম এ ওসমানের নেতৃত্ব মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের সম্মান বাঁচাতে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। চালনার খাল দিয়ে হানাদারদের রণতরী চালানোর চেষ্টা মুক্তিফৌজ এদিন বার বার ব্যর্থ করে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা খুলনা আর যশোর শহরে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি শহরই হাজার হাজার মুক্তিফৌজ বস্তুত ঘিরে রেখেছে। খুলনা এলাকার শিল্পাঞ্চল দখলের জন্য প্রবল সংগ্রাম চলেছে। এই অঞ্চলে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসিরুদ্দীন।

দুর্গ দখলের অভিযানে সেনাপতির সঙ্গী বেগম ওসমান

 যশোর, ৮ এপ্রিল-যশোর দুর্গ দখলের জন্য দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা দূরবর্তী চারটি কোণ থেকে রণাঙ্গনের দিকে কদমে কদমে এগিয়ে চলেছে। বুধবার শেষ রাতে তাঁদের এই অভিযান শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশাল বাহিনীর অধিনায়ক মেজর ওসমান। পাশে থেকে শক্তি যোগাচ্ছেন সহঅধিনায়কা বেগম ওসমান। দুর্বার বেগে এগিয়ে চলা এই বাহিনীর মুখে ধ্বনিঃ চলো, চলো দুর্গে চলো।

 দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গ দখলের জন্য মুক্তি সংগ্রামীদের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। নিজেরা কারফু জারি করেছেন প্রয়োজনীয় এলাকায়। সন্দেহজনক ও অচেনা মুখ দেখলেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। বাইরের কয়েকজন বেঈমান ধরা পড়ায় তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। পরিখা খোঁড়া হয়েছে বিশেষ বিশেষ জায়গায়। বিবর ঘাঁটিও হচ্ছে অগ্রবর্তী অঞ্চলে। দুর্গের চারদিকে বেষ্টনী রচনা করে ওয়ারলেস সংযোগ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন রণকৌশলে শত্রুবাহিনীকে শেষ আঘাত হানার জন্য সব ব্যবস্থাই পাকা। সর্বাধিনায়কের নির্দেশ পাওয়া মাত্র ঝটিকা গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মুক্তি সেনারা এখন তৈয়ার।

 অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী ফৌজের নাভিশ্বাস উঠেছে। মরণ কামড় দেওয়ার জন্য তারা দুর্গের আশপাশে চালাচ্ছে পোড়ামাটি নীতি। গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ দিন সকাল থেকেই দাউ দাউ করে ঘরবাড়ি পুড়তে দেখা যায়। চাঙ্গুটিয়া, আরিফপুর, পতেঙ্গালি প্রভৃতি এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত। এছাড়া গুদাম, দোকানপাট লুঠ করেছে মিলিটারি সমর্থক আর একদল পশ্চিমী ঠ্যাঙাড়ে দল। হত্যা, হামলায় বিতাড়িত হয়ে হাজার হাজার শরণার্থ ভারতে এস আশ্রয় নিচ্ছেন। আরও বহু শরণার্থ ভারত প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।

—আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ এপ্রিল, ১৯৭১

ঝিকরগাছায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের প্রচণ্ড লড়াই

 ঝিকরগাছা রণাঙ্গন, (যশোর), ৯ই এপ্রিল-পাকিস্তানী বাহিনী আজ ঝিকরগাছা পর্যন্ত রণক্ষেত্র বিস্তৃত করেছে। কামান ও ৬ ইঞ্চির মর্টার নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজ ভোরে মালঞ্চ গ্রামের উপর নতুন আক্রমণ চালানেচালানে মুক্তিফৌজ গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। গ্রামটি তারা ছেড়ে দিলেও তাদের মেশিনগানের গুলীতে প্রায় একশ’ পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।

 মালঞ্চ গ্রাম ছেড়ে মুক্তিফৌজ এখন একদিকে যশোর রোডের উপর লাউজানি লেভেল ক্রসিং গেটে এবং অন্যাদিকে ঝিকরগাছা বাজারের উত্তর দিকে কপোতাক্ষ নদের পূর্ব পাড়ে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে ‘ব্যাক টু দি ওয়াল’ লড়াই আরম্ভ করেছে।

 সকালের দিকে পাকিস্তানী বাহিনী যখন যশোহর রোড ধরে ঝিকরগাছার দিকে এগোচ্ছিল, সে সময় মুক্তিফৌজ লাউজান ক্রসিং গেট বরাবর মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চির মেশিনগান মর্টার দিয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণ রোধ করে। কিন্তু পাকবাহিনী তখন যশোহর রোডের উপর তাদের একটি দল রেখে উত্তর দিকে চষা মাঠের মধ্য দিয়ে কাটাখাল পেরিয়ে ঝিকরগাছা বাজারের উপর মর্টারে গোলা ছুড়তে আরম্ভ করে।

পদ্মার তীরে নতুন যুদ্ধ ফ্রণ্ট

 শুক্রবার ভোর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ হানবার চেষ্টা করছে। গতকাল রাত থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা ঢাকা জেলার পশ্চিমাংশে পদ্মা তীরবর্তী আরিচাঘাট, শিবালয় প্রভৃতি স্থানে জমায়েত হয়। এ খবর বাংলাদেশের। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের কমাণ্ডের মুক্তিফৌজ সদস্যরা ফরিদপুরের কাছে পদ্মার তীরে বাঙ্কার তৈরী করে সারারাত ধরে পাহারা দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের জলপথে সেনা জমায়েত এই প্রথম হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে আরো একটি নতুন যুদ্ধফ্রণ্ট পদ্মা নদীর উত্তর দিক বরাবর এবং দক্ষিণ তীরের কিছু অংশে গড়ে উঠলো।

 আজ সকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা জেলার আরিচাঘাট ও শিবালয় থেকে গোয়ালন্দ ও নগরবাড়ীর দিকে নদী অতিক্রম করে বারবার যাবার চেষ্টা করে। নদী পারাপার কালে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের দীর্ঘ লড়াই হয়। সারাদিন লড়াইয়ের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যমুনা নদী পার হয়ে নগরবাড়ীতে নামতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কমাণ্ডের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গায় রাতের দিকে খবর আসে গোয়ালন্দের তীর বরাবর ফরিদপুরের দিকে পাকিস্তানী সেনারা এগুতে থাকলে বাংকারের ভেতর থেকে মুক্তিফৌজ আপ্রাণ চেষ্টায় তাদের অগ্রগতিকে প্রতিহত করেন। নদী পারাপারের সময়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা মর্টার ও বিমানের সাহায্য নেয়। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা গোয়ালন্দের দিকে নামতে সক্ষম হয়নি।

যুগান্তর, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১

হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে মরিয়া পাক-বিমান

শহরে শহরে মুক্তিসেনার প্রতিরোধ

 অদম্য মুক্তিফৌজের প্রবল প্রতিরোধের ফলে পাক সেনাবাহিনী দিশেহারা। এখন বর্ষার আগে শেষ ভরসা শুধু আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ। স্বাধীনতার যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ যে সমস্ত এলাকা দখল করে নিয়েছিল, তার কিছু কিছু অংশ পুনদর্খলের মরীয়া চেষ্টায় এদিন পাকস্থলবাহিনীকে অবিরাম মদত দিয়েছে বিমানবাহিনী।

 মুক্ত শহর রাজশাহীতে শুক্রবার পর্যন্ত মোট গোলাবর্ষণ হয়েছে ১৫ বার। লক্ষ্যস্থল ঠিক না রেখে হানাদার বিমান এলোপাতাড়ি বোমা ফেলেছে রংপুর, শ্রীহট্ট, দিনাজপুর, ফেনী, হরিপুর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া এবং আরও কয়েকটি জায়গায়। তৎপর মুক্তিফৌজের তাঁরা বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি, তবে অসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে নিহতদের সংখ্যা অনেক।

 ঢাকা থেকে শুরু হয়েছে দ্বিমুখী আক্রমণ। শহর থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে মানিকগঞ্জের দিকে একটি সেনাদলকে অগ্রসর হতে দেখা গেছে। আর একটি সেনাদল ময়মনসিংহের দিকে। উদ্দেশ্য, নদীপথে পুরো দখল রাখা। টাঙ্গাইলের উত্তরে একটি সেনাদলকে আক্রমণ করেছে মুক্তিফৌজ। শেষ খবরে জানা যায়, সেখানে লড়াই চলছে তুমুল।

 পাবনায় আরেকটি বড় রকমের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। যমুনা পেরিয়ে পাবনা অভিমুখী একটি পাকসেনাদলের গতি আটকে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। স্বাধীন বাংলা বাহিনীর দক্ষিণে-পশ্চিমে এলাকার পরামর্শদাতা ডঃ আশাবুল হক জানিয়েছেন যে, ঐ অঞ্চলে পাক স্থলবাহিনীকে সাহায্য করছে নৌজাহাজ ও বিমান-গোলাবর্ষণে, বোমাবর্ষণে। কিন্তু মুক্তিফৌজ অস্ত্রশক্তিতে হীনবল হয়েও হানাদারদের গতি রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।

 দিনাজপুরে প্রবল সংগ্রামের খবর আছে, এই শহরটি পুনর্দখল করার জন্য পাকফৌজ ট্যাংক আমদানি করেছে। রংপুরে অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করার জন্য চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছে মুক্তিফৌজ। আওয়ামী লীগের সূত্রে জানা যায়, এই এলাকার সবটাই এখন মুক্তিফৌজের দখলে। কুষ্টিয়ার জঙ্গলগাছিতে পাকফৌজ নতুন করে আক্রমন চালিয়েছে।

 কুমিল্লাঃ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব খণ্ডে কুমিল্লা শহর ও ক্যাণ্টনমেণ্ট প্রচণ্ড লড়াই চলছে। বিমান বন্দরটি এখন হানাদারদের দখলে। ঢাকা থেকে তাই রোজ সৈন্য আসছে। আসছে খাবার-দাবার। কুমিল্লা থেকে পাকসৈন্য জাঙ্গালিয়া রোড ধরে চাঁদপুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়ত তারা নদী ধরে কুমিল্লা যাওয়ার পথটি আবার চালু করার জন্য নতুন করে চেষ্টা চালাবে।

 কুমিল্লা শহর থেকে কয়েক হাজার অধিবাসী পালিয়ে গিয়েছে। পাকসৈন্যরা অবাধ্য অধিবাসীদের শায়েস্তা করতে ওই অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজীপুর, বিবিরবাজার ও তরুণপুর।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১

কামানে বিমানে আগুয়ান হানাদার বাহিনী বনগাঁ সীমান্তের কাছাকাছি

 নাভারন (যশোর), ১০ এপ্রিল-আজ ভোরের দিকে পাকিস্তানী ফৌজ যশোর দুর্গ থেকে বেরিয়ে সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে এগোয়। মুক্তিফৌজ তাদের প্রবল বাধা দেয়। হানাদাররা কামান, মেশিনগান, মর্টার নিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। দু’খানা জঙ্গী বিমানও ছাতার মত তাদের উপর মাথায় উপর দিয়ে পাহারা দিয়ে যায়। বোমাও ফলে মুক্তিফৌজের লক্ষ্য করে। মুক্তিসেনারাও তার পাল্টা প্রতিরোধের জোর করে। পাকসেনারা তখন গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাদের অত্যাচারে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়ের আশায় ছোটেন। দখলদার বাহিনী এরপর ঝিকরগাছা পর্যন্ত এগিয়ে কামান দাগতে থাকে। তারপর হানা দেয় সীমান্তের কাছাকাছি। আগের দিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটে যাওয়ার পর মাঝেমাঝে গুলির আওয়াজ ছাড়া রাতে দুই তরফে সামনা-সামনি লড়াই হয়নি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির পর আজ আবার রণাঙ্গন মুখর হয়ে ওঠে। তখন ভোর সারে চারটা। কামান গর্জন করতে থাকে। মর্টারের গোলার ঘন ঘন আওয়াজ এপার থেকে স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা তিনটি লাইনে ঝিকরগাছার দিকে এগোতে থাকে। মাঝের লাইন থাকে যশোর রোডে। আর বাঁ দিকে পাশের রেলপথ বেয়ে এবং ডানদিকে মাঠের মাঝ দিয়ে দুটি লাইনে হানাদাররা হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। পাকিস্তানী সেনাদের সারবদ্ধ এই অগ্রগতির আকার ইংরেজি ‘ভি’-এর মত।

দিনাজপুর শহরের কাছে প্রচণ্ড লড়াই

 নগরবাড়ি (ঢাকা-পাবনা-বগুড়া রোড) সন্ধ্যার পর দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি সামরিক বাহিনী দখল করে নিয়েছে। প্রচণ্ড লড়াই চলছে। পাক সামরিক বাহিনী ট্যাংকও ব্যবহার করছে। বহু লোক হতাহত হয়েছে। পাক সামরিক বাহিনী বিহারী মুসলমানদের রাইফেলস দিয়ে কাজে লাগাচ্ছে।

 দিনাজপুর শহরের তিন মাইল দূরে রাণীগঞ্জে পাক সামরিক বাহিনী এসে গিয়েছে। মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড বাধা দিয়ে যাচ্ছে। শহরের দক্ষিণে আত্রাই নদী পার হয়ে এখন কাঞ্চন নদীর তীরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। পাক বাহিনী তিনটি রেজিমেণ্টই ব্যবহার করছে। গতকাল রাত্রে পাবনায় ছয় পাউণ্ড ওজনের মর্টার ব্যবহার করেছে। এখানে ঢাকা-পাবনা রোডের উপর এখনও যুদ্ধ চলছে।

 পদ্ম নদীতে জলযুদ্ধঃ গৌহাটি, ১০ এপ্রিল-খুব বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া সংবাদে প্রকাশ, পাবনা শহরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য পদ্মা নদীতে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। দ্বিতীয় দিনের এই জলযুদ্ধে একদিকে মুক্তিফৌজের দেশী দ্রুতগামী নৌকা আন অন্যদিকে পশ্চিম পাকসৈন্যর গানবোট।

 পূর্ব রণাঙ্গনে পাক আক্রমণঃ আগরতলা, ১০ এপ্রিল-ছাউনিতে বন্দী পাক সেনাদল মুক্তিযোদ্ধাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পূর্ব রণাঙ্গনের এক বিরাট এলাকায় নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে। সর্বশেষ যে খবর পাওয়া গিয়েছে, তাতে জানা যায় যে, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং শ্রীহট্ট প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১

হারাগাছ ও তিস্তা সেতু এলাকা মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে

 উত্তরাঞ্চলের কোন স্থান, ১০ই এপ্রিল-গত রাত্রে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী তীব্র লড়াইয়ের পর হারাগাছ এবং তিস্তা সেতু এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখলে এনেছে। পাকহানাদাররা এই যুদ্ধে দু’কোম্পানী সেনা নিয়োগ করেছিল, তারা এখন মৃত ও আহত সেনাদের ফেলে রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে চম্পট দিয়েছে। মুক্তিফৌজ এই যুদ্ধে কিছু অস্ত্রশস্ত্র, একটি জীপ এবং রসদও দখল করেছে।

 হারাগাছ ও তিস্তা সেতু অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলে আসায় রংপুর লালমনিরহাট ক্যাণ্টনমেণ্ট দুটির মধ্যে সরবরাহ পাঠাবার পথ বিছিন্ন হয়ে গেছে। পাক হানাদারদের এখন বিমানে সরবরাহের উপর নির্ভর করতে হবে।

 রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্টকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করার উদ্দেশ্য মুক্তিফৌজের সেনারা ছোট দলে ভাগ হয়ে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি রেল সেতু ও একটি চলাচলের সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। এই সেতুগুলি রংপুরের সঙ্গে কুড়িগ্রামের যোগাযোগ রক্ষা করতো।

 মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণঃ ইয়াহিয়া বাহিনীর একটি দল কয়েকটি ট্রলিযোগে লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের দিকে অবস্থা পর্যক্ষেণ করতে যাচ্ছিল, পথে মুক্তিফৌজ আচমকা দলটির ওপর হানা দিয়ে কয়েকজন হানাদারকে খতম করে, বাকী হানাদাররা লালমনিরহাটের দিকে পালায়।

 আত্মবলি দল গঠিতঃ আরও আশার কথা মুক্তিফৌজ এই অঞ্চলে ছোট ছোট আত্মবলি দল সংগঠন করেছে। এই দলগুলি ইতিমধ্যেই শত্রু-অধিকৃত এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই আত্মবলি দলগুলির নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেও সক্ষম হয়েছে। মুক্তিফৌজ এসব এলাকা সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্য কুড়িগ্রামের দিকে পথে পথে পরিখা খনন করছে। মুক্তিফৌজের কাছে খবর এসেছে যে, রংপুরের দিকে আগুয়ান পাক হানাদার বাহিনী রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্টের ওপর মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণ আটকে দিতে পারে।

 প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনী গত বৃহস্পতিবার রাত্রে ভারী মর্টার চালিয়ে হারাগাছ ও তিস্তা সেতু এলাকায় আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু শত্রু বিমানাক্রমণের আশঙ্কায় শুক্রবার ভোরের দিকে জঙ্গলে আত্মগোপন করে।

 হারাগাছ হচ্ছে তিস্তা নদীর একটি ফেরীঘাট, এটি সামরিক দিক থেকে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে লালমনিরহাটের ক্যাণ্টনমেণ্টের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এই ফেরীঘাট দিয়ে পাকসেনা রংপুর থেকে যায়।

 রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর দলগুলির মধ্যে এখন যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। মুক্তিফৌজ এ অঞ্চলে প্রথম দিকে যে রকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মুক্তিবাহিনী সাধারণ যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে সেনাদের সুশিক্ষিত করে তোলায় শেখ মুজিবর বাহিনীর সমরসাধ্য এখন পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 পাক বাহিনী পর্যুদস্তঃ দিনহাটা থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, তিনি রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী সফর করেন। মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টন আবুল হোসেন তাঁকে জানান, গতকাল তুগ্রাইহাটের মুক্তিফৌজের সঙ্গে এক সংঘর্ষ পাকহানাদার ফৌজের এগারজন সেনা নিহত হয়। এ জায়গাটি কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৪ মাইল দূরে। একজন মুক্তিসেনা আহত হয়ে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে ভর্তি হন। পাক সেনা দলটি জীপে করে কুড়িগ্রাম যাওয়ার পথে তুগ্রাইহাটের কাছে মুক্তিফৌজ তাদের বাধা দেয়। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পাকদল চম্পট দেয়।

 রংপুরের দিকে মুক্তিফৌজঃ ইপিআরের জনৈক নায়েক ভূরুঙ্গামারীতে বলেন, মুক্তিফৌজ সৈয়দপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করার পর রংপুরের দিকে এগিয়ে চলেছে খবর পেয়ে লালমনিরহাট থেকে একদল পাকহানাদার সেনা রংপুর রওয়ানা হয়।

 আওয়ামী লীগ নেতাদের সংবাদ অনুযায়ী, গতকাল তিস্তা সেতুর কাছে এক সংঘর্ষে ছ’জন পাকসেনা নিহত হয় এবং দুটি মর্টার ও চৌদ্দ বাক্স গোলাগুলি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। অস্ত্রশস্ত্রগুলি কুড়িগ্রামে মুক্তিফৌজের কর্মকেন্দ্রে আনা হয়েছে। আওয়ামী নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, দু’একদিনেই সমগ্র জেলা থেকে পাকসৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

 রাজশাহী থেকে কুমারেশ চক্রবর্তী লিখছেনঃ সমগ্র রাজশাহী জেলা এখন প্রায় বিল্পবী মুক্তিফৌজের দখলে। এই জেলার প্রধান চারটি মহকুমার মধ্যে নবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ সম্পূর্ণরূপে মুক্তিবাহিনীর দখলে। আর সদর মহকুমার মধ্যে একমাত্র ক্যাণ্টনমেণ্টের কিছু অংশ ছাড়া সম্পূর্ণ সদরে স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পাচ্ছে। ক্যাণ্টনমেণ্টেই রাজশাহীর একমাত্র মিলিটারী ঘাঁটি।

-যুগান্তর, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১

HEAVY FIGHTING CONTINUES

PAK FORCES CAPTURE PABNA TOWN

 The recapture of the whole of Lalmonirhat-Mughallhat area including the cantonment and the airbase in the northern sector was the most significant score of the Bangladesh Liberation Army on Sunday, report PTI and UNI. Another victory, though small in dimension, was a crushing defcat on the pak troops near Tangail.

 The West Pakistan Army had, however, recaptured Pabna towon on the day. Massive air support was given to the troops in Dinajpur, Goalanda, Rajshahi, Kustia And Jessore Where the Pakistan Air Force planes bombed several times to shatter the resistance of the Muti Fouz. Chittagong outskirts were also bombed.

 Menwhile, heavy fighting was reported to be going on in Dacca wher the liberation gorces embraked upon a big operation Dacca drive by opening a new front near Narsingdi. Repeated assaults were also made to occupy or immobilise the Dhulupara airfield in Comilla. Heavy lighting also Hared up near the Hardinge (Sara) Bridge.

 Engaged as they are in fighting. The Mukti Fouj have been consolidatin their position in the already liberated zones such as Sylhet, Mymensingh and parts of Comilla.

 In the Lalmonirhat Encunter two companies or Pakistan Army Were Exterminated and quite a few of them while runnin marked or in civil dress were butchered by the local people.

 The Mukti Fouz also inflicted a crushing defeat on pakistani Army column near Tangail, a sub-divisional town in Mymensingh district, close to Dacca. the defeated Pakistani troops fled in disarray. The Pakistani Army command had sent this column to dislodge the Mukti Fouz from Tangail and ultimately recapture Mymensingh, under the control of the freedom fighter.

 In Dacca, the liberation army on Sundy launced a storng offensive, operation Dacca by opening a new front near Narsingdi, and engaged them on the Pakistani Army at Tarapur.

 Pkistan Army columns, however, moved out of Dacca for apturing Narsingdi Crossing the Demra river. Pakistani troops took positions for the assault on the strong Liberation force units.

 The Pakista troops appeared to be making cautious moves for the assault, and have entrenched themselves at a distance of eight kms from the liberation Army formations at Narsingdi. The Pak Army is meantime reported having occupied Munsiganj, 25 miles west of Dacca.

 RAJSHAHI: The liberation forces also made a determined effort to eject Pakistani troops from the cantonment three km from Rajshahi. The offensive followed reports that abut 1,000 troops had crossed the Jamuna and were near Pabna town in their march towards Rajshai.

 Bitter fighting between the West Pakistani marauders and the Liberation forces was going on near hardinge (sara) Bridge on Sunday, according to Dr. Ashabul Huque, Advuser, South-west command of the Liberation army. He said to a army agency on trunk telephone from kushtia that the west Pakistani Army and Air Force shelled and bombed the bridge. Fighting was also going on in Kumarkhali area. Eight miles east of kushtia.

 The West Pakistani Army Were now entirely trapped in Rangpur town with the Lalmonirhat air field. Teesta Bridge and haragachi ferry ghat under complete control of the Liberation forces. The major poration of the Mukti Fouj at Lalmonirhat have also started for Rangpur town.

 The whole of Rangpur district, excepting the town and the cantonment and Saidpur was now under the control of the Mukti Fouj. Meanwhile, Two companies of the Pakistani Army, which tried to proceed to Dinajpur, were ambushed and they had to fall back to the Rangpur base.

 SYLHET: In Sylhet the Liberation Army has consolidated its hold on the town recapturing the radio and railway stations.

 Sylhet town continud to be deserted on the third day with the civilians fleeng to villages. The town continued to be will-guarded by a Liberation Army unit who on Saturday ambushed and killed a reconnoitering pary of 12 West Pakistanis.

 Barring the northern parts of Comilla which are under the Mukti Fouz, the Pakistan Army hold the comilla airfield and cantonment. But as the freedom figters hold the supply routes to the garrison in Comilla and Sylhet supplies can be made only by air which is very difficult during the storm season of April-May. The situation will become more difficult during the coming month.

 The control of the entire contryside comprising the districts of Comilla, Sylhet and Mymensingh by the Liberation Army means control of the food-producing regions. The area also produces Pakistan bulk tea.

 PABNA CAPTURE: The jPabna town was captured by a detachment of about 100 troops sent from Dacca two days ago.

 Pakistani troops went on the Teesta Bridge region. Hundreds of huts were set on fire and people killed indiscriminately.

 Streams of evacuees from Pabna are crossing to this side through Karimpur border of Nadia district, Krishnanagar relief sources said.

 Reports have come in frpm several parts of Bangladesh of heavy stafing and bombing by Pakistani planes. Ther was heavy bombing at Kushtia, Jessore, Rajshahi, Sylhet, Dinajpur and Feni.

 Pakistani 52-53 bombers also ombed the outskirt of chittagong, and battery mortars and thanks were also used. The bombing in this area appears to be aimed at making way for army engineers to repair the vital Comilla-feni-Chittagong road link, cut off earlier by liberation force.

 GOALANDA BOMBED: A report received at Chuadanga in kushti district said Pakistani planes bombed and starafed Goalanda about 2 p.m on Sunday. About 200 Pakistani paratroopers reportedly landed at Goalanda two days ago.

 Bombing is said to have taken a coniderable toll of lives in Goalanda. A large number of houses were destroyed.

-Hindusthan Standard.12th April 1971

রাজশাহী শহরের প্রশাসনভার মুক্তিফৌজের হাতে

 রাজশাহী, ১২ এপ্রিল-নাটোরের কাছে মুক্তিসেনার হাতে একশ পাকফৌজ আজ খতম হয়েছে। রাজশাহী শহরের ক্যাণ্টনমেণ্ট এখন পরিত্যক্ত। মুক্তিসেনারা আজ সেখানে গিয়ে পরিখাগুলি তন্ন তন্ন করে খোঁজ ও তিনজন পাক সৈন্যকে খুঁজে বের করে খতম করে।

 মুক্তিফৌজ রাজশাহী শহরের অসাময়িক প্রশাসনের ভার নিয়েছে। দোকানপাট খোলার জন্য তারা আবেদন জানিয়েছে। কিছু কিছু দোকানপাট ইতিমধ্যে খুলেছে। হানাদাররা যাতে রাতে হানা না দিতে পারে তার জন্য শহরে কারফুজারী করা হয়েছে।

 রাজশাহী ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে উৎখাত হয়ে পাকফৌজ এখন রাজশাহী শহরের এক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে আটক রয়েছে। মুক্তিফৌজ পাকসেনাদের পরিত্যক্ত ছাউনির বাংকারের ভিতর হোসপাইপ দিয়ে জল ঢেলে ঢেলে পরীক্ষা করে দেখছে শত্রু লুকিয়ে আছে কিনা। আজ সকালে রাজশাহী শহরের ওপর আবার পাকিস্তানী বিমান হানা দেয়। তারা বিমান থেকে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে নাগরিক ও মুক্তিফৌজের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করে।

 ওদিকে নগরবাড়ী দিয়ে একদল পাকফৌজ নাটোরের দিকে এগুতে থাকে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে মুক্তিফৌজ তাদের বাধা দেয়। সেনাবাহিনী নৌকায় করে নদী পার হবার চেষ্টা করে। চারপাশ থেকে কয়েক হাজার মুক্তিফৌজ ওদের ওপর আক্রমণ হানে। প্রবল আঘাতে শত্রুরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশের কপালে জোটে সলিল সমাধি। বাকি সেনারা গ্রামের পথ ধরে নাটোরের দিকে এগুতে থাকে। মুক্তিসেনারা পথে তাদের বাধা দেয়। এদিকে রাজশাহী জেলায় ঝড়-বৃষ্টি নেমে গিয়েছে। পাকফৌজ এর ফলে বিপন্ন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা,১৩ এপ্রিল,১৯৭১

ঢাকার উপকণ্ঠে লড়াই, দিনাজপুর আবার মুক্ত-

হানাদারদের হাওয়াই হামলা

 বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনে কুমিল্লার বেষ্টিতপ্রায় পাকফৌজেকে মুক্ত করতে আর সরবরাহ সড়ক পুনরুদ্ধার করতে হানাদার বাহিনী বুধবার গোমতী নদী অতিক্রম করে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। তাদের সহায়তা করে চারটি জঙ্গী বিমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কসবা শহর এবং তার আশেপাশে পাক বিমান বোমা-বৃষ্টি করে চলে যায়।

 কসবা রেল স্টেশন আর বাজার ত্রিপুরা সীমান্তের খুব কাছে। পাকফৌজের লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ আখাউড়া- বাহ্মানবাড়িয়া এলাকা পুনরুদ্ধার। আখাউড়া রেল জংশন এখনও মুক্তিফৌজের হাতে। তাদের আর একটি লক্ষ্য, ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত সেনাদের সঙ্গে সংযোগ সাধন এবং শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ অঞ্চলের মুক্তিফৌজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।

 উত্তর খণ্ডে মুক্তিফৌজ দিনাজপুর শহরসহ তাদের মুক্ত ঘাঁটিগুলি আগলে রাখে। আগের দিন রাত্রে তীব্র সংগ্রামে বহু পাকসৈন্য হতাহত হয়। এবং দিনাজপুর আবার বাংলা বাহিনীর অধিকারে আসে। রেডিও পাকিস্তান অবশ্য পাল্টা দাবী জানিয়ে বলছে যে, দিনাজপুর থেকে বিদ্রোহীদের তারা সরিয়ে দিয়েছে।

 এদিন সকালে মুক্তিফৌজ খাস ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ মাইল দূরে সাভারে একটি পাক বাহিনীর উপর প্রবল আঘাত হানে তাহেরপুরের আওয়ামী লীগ সূত্রে এই খবর পাওয়া যায়। এই এলাকাকে ঢাকার উপকণ্ঠে বলা যায়। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ তীব্র লড়াই চলেছে। মুজিব বাহিনী সারা ব্রিজ দখলে রেখেছে এবং ভেড়ামারা, কুমারখালী আর শিলাইদহ এলাকায় হানাদারদের হটিয়ে দিয়েছে। কুষ্টিয়া শহরে এদিনও বোমাবর্ষণ হয়। প্রবল ধারায় বর্ষণ চলেছে, তবু গোয়ালন্দ এখনও সংগ্রামী সেনাদেরই হাতে। নগরবাড়ী ১৫০ পাকসৈন্যকে তারা ঘিরে ফেলেছে। ওদিকে পাকফৌজ ঢাকা থেকে বেরিয়ে নরসিংহীর দিকে এগিয়ে যায় এবং তীব্র সংঘর্ষের পর এই বড় বানিজ্য বন্দরটি দখল করে। মুক্তিফৌজ এখল গ্রামাঞ্চলে।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লায় বোমাবর্ষণ করা হয়। শ্রীহট্ট শহর পুনর্বার মুক্ত কিন্তু আজ একটি প্রেতনগরী মাত্র। ঘরে ঘরে রাজপথে স্তূপীকৃত শব, কুড়িদিনের লড়াই-এ নিহতদের সংখ্যা অন্তত আট হাজার।

 রংপুরের শহরগুলির হানাদার ফৌজের হামলায় অন্তত দু’শ সাঁওতাল অধিবাসী নিহত হন। ফৌজী দস্যুরা তাদের গ্রামগুলিতে লুটতরাজ চালায়। আমাদের বালুরঘাট সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, আজ এখানে ফুলবাড়িতে প্রচুর বিমান হামলা হয়।

 শিকারপুর থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ থেকে নদীয়ার সীমান্ত দিয়ে এখানে পাঁচ হাজার উদ্ধাস্তু এসেছে। আগরতলা শ্রীহট্ট থেকে আজ কয়েকজন ব্রিটিশ চাকর এসে পৌঁছান। তাঁরা বলেন শ্রীহট্ট জেলা সম্পূর্ণ মুক্তিফৌজের দখলে। তাঁরা আরও বলেন, শ্রীহট্টের, শ্রীহট্টের কোথাও সামরিক শাসনের অস্তিত্ব নেই।

-আনন্দবাজার পত্রিকা,১৫ এপ্রিল, ১৯৭১

Army keeps up pressure on Sylhet, Comilla

Bid to capture Rajshahi foiled

 Agartala, April 15 (UNI/PTI)- Consolidating their gains in the first three weeks of the war for the liberation of Bangladesh, the liberation forces today frustrated the Pakistan Army’s continued bed to eject freedom fighters from important fowns in the western and eastern sectors.

 In the eastern sector, the We3st Pakistanis kept up pressure on Sylhet. Chandpur and Comilla apparently aiming to kate communication links with Dacca and Chittagong.

 The Mukti Fauj, which fought a grim battle to check the adbance of the Pakistani troops towards Rajshahi throughout the day, were successful in holding the troops at bay on the outskirts of the town, according to reports from across the border.

 The freedom fighter also silenced the Pakistani guns across the Ujaneshwar bridge over river Titas and sent the troops fleeing. The Pakistan army had made a determined bed to cross the river and capture Brahmanbaria which is under the control of the liberation forces.

 With skies remaining cloudy over most parts of Bangladesh, the Pakistani air action was limited to Mymensingh town,

 Contrary to their earlier claims, the Pakistani troops were bolding only tghe northern portion of Sylhet town today while the liberation forces withdrew to the south bank of the Surma river.

 The Mukti Fouj also destroyed the bridge over the Kattakhali river and at Kumardaha and retained theircontrol over Bogra.

 The border town of Kasba was beavily shelled by thePakistgani Army which was using inland waterways to fihgt the liberation forces.

 While Kushtia remained under the control to the liberation forces, an armoured column sent form Rangpur to relieve the pressure on beleagured Pakistani troops in Dinajpur reached the town today and engaged the freedom fighters who were resolutely holding out.

A report received tonight form Chaudanga in Bangladesh said heavy fighting was raging at Iswardy close to the Hardinge Bridge.

 Fierce fighting was also going on in the Gangasagar area in the Comilla sector. The Pakistan Army used heavy artillery guns, booms of whih could be heard in Agartala.

 According to an Agartala report the Army was making a desperate bid to capture Akhaura, an important railway junction town in the Comilla sector.

-Hindusthan Standard, 16 April, 1971.

রণাঙ্গনের খবর

 বাংলা বাহিনী দিনাজপুর রণাঙ্গনে বড় রকমের সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা গতকাল দিনাজপুর শহর থেকে পাক সাঁজোয়া বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছেন। বাংলা বাহিনীর এই আক্রমণে পাক বাহিনীর বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া রংপুর শহরের বীরগঞ্জে বাংলা বাহিনীর হাতে পাক-বাহিনী পর্যুদস্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকাতে পাক বিমান বাহিনী প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে এবং মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়েছে। রংপুরের উপকণ্ঠে পাকফৌজ দু’শ সাঁওতালকে হত্যা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দেয়া হয়।

 সিলেট শহরটি মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে। খবরে প্রকাশ, শতাব্দীর পুরোনো হযরত শাহ জালালের (রঃ) মাজারের উপর পাক বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে। আকাশবাণীর খবর প্রকাশ, বিদেশী চা-বাগানের মালিকগণ জানিয়েছেন যে, সমগ্র সিলেট থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জায়গায় পাক সামরিক শাসনের কোন অস্তিত্ব নাই। তারা আশঙ্কা করেছেন যে শীঘ্রই হয়তো বড় রকমের লড়াই বাধতে পারে।

 রণাঙ্গের দায়িত্বভারঃ গত ১৪ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ঐতিহাসিক বেতার ভাষণে পাঁচজন সেনাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করেন। এই পাঁচজন সেনাধ্যক্ষ স্বাধীন বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। মেজর জলি কে বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী; মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট, কুমিল্লা; মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী; মেজর সফিউল্লাহকে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং মেজর এম এ ওসমানকে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর রণাঙ্গন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

 সারা ব্রীজের যুদ্ধঃ ১৫ই এপ্রিল। খবরে প্রকাশ, অদ্য রাজশাহীর ঐতিহাসিক সারা ব্রীজের দখল নিয়ে বিপ্লবী মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানী হানাদার জঙ্গী বাহিনীর মধ্যে সমস্ত দিন ধরে তুমুল লড়াই চলে। বিপ্লবী মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী নিদারুণ মার খেয়ে অবশেষে পালাতে বাধ্য হয়, কিন্তু পালাতে গিয়ে বর্বর বাহিনীর কয়েকশত বর্বর পদ্মাগর্ভে পড়ে ডুবে মারা যায়। এবং মুক্তবাহিনী সগৌরবে সারা ব্রীজের দখল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন।

 তিনটি বিমান ধ্বংসঃ বরিশাল, ১৬ই এপ্রিল। স্বাধীন বাংলার বেতারে প্রকাশ, গত ১৬ই এপ্রিল বিপ্লবী মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাক হানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। এই সময় পাক বিমানবাহিনীর তিনখানা বিমান ছত্রভঙ্গ পর্যুদস্ত শত্রুবাহিনীকে সাহায্যকল্পে এগিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র পাল্টা আক্রমণের মুখে তিনখানা বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। এই নিয়ে মোট ১৭ খানা বিমান ধ্বংস হয়।

 মুক্তিবাহিনীর সাফল্যঃ বরিশাল, ১৬ই এপ্রিল। সংবাদে প্রকাশ, রংপুর-তিস্তা রেলসড়কের উপর বাংলা মুক্তিবাহিনী পশ্চিমা বাহিনীর একটি ট্রেনে আক্রমণ চালায়। বেশ কয়েক ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর পাকবাহিনী পরাস্ত হয়। এ যুদ্ধে ২০ জন পাক সেনা নিহত হয়।

 সর্বশেষ সংবাদঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিকটে “তিতাস সেতু” নিয়ে বাংলা বাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। বর্তমানে সেতুটি বাংলা বাহিনীর দখলে রয়েছে।

 বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে তুমুল সংঘর্ষ চলেছে। এছাড়া ঢাকার আশেপাশে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পাক সৈন্যের আক্রমণ মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ করেছে। উজিরনগর এখন বাংলা বাহিনীর দখলে রয়েছে। পাক বিমান বাহিনী ময়মনসিংহ, ফেনী, আশুগঞ্জ, সীতাকুণ্ডে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গার পাক বাহিনীর হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ময়মনসিংহ-কুমিল্লার ৯০০ কিলোমিটার পথে তুমুল যুদ্ধ চলেছে।

-বাংলাদেশ, ১মবর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১

আখাউড়া দখল নিয়ে জোর লড়াই

 লামাকামুরা, ১৭ এপ্রিল-আখাউড়া রেল স্টেশন দখল নিয়ে পাকফৌজের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জোর লড়াই চলেছে। প্রতিরোধের মুখে পাক-বাহিনী এখন মরিয়া। কুমিল্লা এবং ভৈরববাজার অঞ্চলে তাদের প্রচণ্ড আক্রমণে বহু লোক মারা যায়। উজানীশাতে গত তিনদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তা ব্যর্থ করে দিতে না পেরে এখন তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকে হেলিকপ্টার ও স্টীমারে সৈন্য নিয়ে যাচ্ছে।

 আজ বিকালে মগরাতেও তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। লড়াই চলছে গঙ্গা সাগরেও। পাকসেনারা সর্বত্রই পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে। তারা ধানক্ষেতে একরকম রাসায়নিক বোমা ফেলছে, ফলে চাষ আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

 ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে বহু উদ্ধাস্তু চলে এসেছে। আজ পর্যন্ত এদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার। এর মধ্যে আগরতলার শরণার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার।

পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ গেরিলা কায়দায় লড়ছে।

 মেহেরপুর, ১৭ এপ্রিল-পাকফৌজের কামান ও বোমাবর্ষণের মোকাবিলার করার জন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ সম্পূর্ণ গেরিলা কায়দা অবলম্বন করছে। রণকৌশল হিসাব তারা শহরগুলি থেকে অসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে সমস্ত অসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 মুক্তিফৌজ শহরের গোপন জায়গাগুলিতে লুকিয়ে থেকে শত্রুর উপর অতর্কিতে হানা নীতে অবলম্বন করেছে। ইতিমধ্যের মুক্তিযোদ্ধাদের সমরকৌশল ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে। আজ সন্ধ্যার কুষ্টিয়া শহরে পাকফৌজ ঢুকলে গড়াই নদীর পূর্ব দিক দিক থেকে মুক্তিফৌজ অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে হানাদাররা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাত্রিতে উভয়পক্ষের জোর লড়াই চলেছে।

 মুক্তিফৌজের জনৈক মুখাপত্র বলেন, কটি বিমান বিধ্বংসী কামান এবং কয়েকটি ফাইটার ও বোমারু বিমান পেলে তাঁরা শত্রুকে সহজেই হটিয়ে দিতে পারেন। নচেৎ তাঁদের গেরিলা যুদ্ধ নীতি অব্যাহত রাখতে হবে।

পাকফৌজের কুড়িগ্রামের দখলের চেষ্টা প্রতিহত

 কুড়িগ্রাম (বাংলাদেশ)- কুড়িগ্রাম থেকে ২৩ মাইল মত দূরে তোগরিহাটে গতকাল মুক্তিফৌজ ও পাকফৌজের মধ্যে জোর লড়াই হয়। পাঁচজন পাক সেনা নিহত ও আটজন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। মুক্তিফৌজ কিছু অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। এই লড়াইয়ে উভয় পক্ষই মর্টার, মেশিনগান এবং রাইফেল ব্যবহার করে। পরে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। রেল লাইনের ধারে বেশ কয়েকটি বাড়িতে পাকসেনারা লুটপাট চালায় ও আগুন লাগিয়ে দেয়। মুক্তিফৌজের নেতৃত্ব দেন শ্রীবোরহানুদ্দিন ও শ্রীমেহের আলী মণ্ডল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যুদ্ধবিরতি থাকার পর পাকসেনারা কুড়িগ্রাম দখলের যে দ্বিতীয় চেষ্টা চালায়, মুক্তিফৌজ তা ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের চুয়াডাঙ্গা দখল, আখাউড়ায় পাল্টা আক্রমণ

 আগরতলা, ৮ই এপ্রিল (ইউএনআই)-মুক্তিফৌজ আজ অপরাহ্নে পাকসৈন্যদের দ্বারা অধিকৃত রেল জংশনের ওপর প্রচণ্ড রকমের পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবের সৈন্যরা জংশনের ওপর অবিশ্রান্ত মর্টারের গোলাবর্ষণ করেছে।

 কৃষ্ণনগর থেকে পাওয়া এক খবরে প্রকাশ, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে চুয়াডাঙ্গা খণ্ডের ওপরও আজও প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। গত রাত্রে পাকবাহিনী মুক্তিফৌজের আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ইউএনআই-র খবর, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ তীব্র সংঘর্ষের পর কুষ্টিয়া জেলার সদর শহর চুয়াডাঙ্গা আবার দখল করে নিয়েছে। আজ রাত্রে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে তাঁরা এটা জানিয়েছেন। মুক্তিফৌজ চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রান্তে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ মাথাভাঙ্গা সেতুটিও দখল করেছে।

 কৃষ্ণনগর থেকে পিটিআই’র খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা মেহেরপুর দখলের জন্য অভিযান শুরু করেছে এবং পরবর্তী সৈন্যরা মেহেরপুর থেকে চার মাইল দূরে আমজুফিতে পৌঁছেছে। আমজুফি থেকে ভারত সীমান্ত সাত মাইল দূরে। আমজুফি থেকে তারা মেহেরপুরের ওপর গোলাবর্ষণ করছে।

 এর আগের এক খবরে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানীরা কাল আখাউড়া রেল জংশন দখল করার পর আজ সকাল দশটার সময় হাওরী নদী পার হয়ে শহরে পৌঁছায়। শহরে ঢুকেই তারা ঘরবাড়ী এবং বাজারে আগুন লাগাতে থাকে। ভারত সীমান্ত থেকে আগুনের শিখা দেখা যেতে থাকে। ভারতীয় সীমান্ত এখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে।

 আগরতলা থেকে খবর পাওয়া গেছে যে, পাকিস্তানীরা এখন আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যে রেলপথ মেরামত করতে শুরু করেছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বন্দুক দেখিয়ে কাজ করতে বাধ্য করছে। পাকিস্তানী আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত মুজিবের অনুবর্তীরা আখাউড়া পর্যন্ত ট্রেন চালু রেখেছিলেন। কাল রাত্রে পাকিস্তানীরা আখাউড়া স্টেশনে ঢোকার আগে স্টেশনের সমস্ত কর্মচারীরা আগরতলায় চলে গেছে।

 বরকল জলাধার ধ্বংস করার চেষ্টাঃ শিলং থেকে নীলকমল দত্ত জানাচ্ছেন যে, মুক্তিফৌজের তৎপরতা রোধে পাকিস্তানীরা ক্রমাগত নোয়াখালী জেলার ফেনী ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর বরকল জলাধারের ওপর বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে। চট্টগ্রামের পাবর্ত্য অঞ্চলের কাপতাইর ওপরও তারা বিমান থেকে রকেট ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। এখানে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখলের জন্য কাপ্তাই ও কুমিরা অঞ্চলের ওপর তারা ছত্রীসৈন্যও নামিয়েছে।

 লাকসাম অঞ্চলে মেজর জিয়ার অধীন মুক্তিফৌজের একদল পাক-সৈন্যের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়।

 সারা সেতুর কাছে প্রচণ্ড লড়াইঃ ভেড়ামারা থেকে আগত পুনর্গঠিত মুক্তিফৌজের আরেকটি দল পাক-বাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থা বিকল করে দিয়েছে। এই পাকবাহিনী পাবনা থেকে পাকসি-কুষ্টিয়া সড়কের দু’ধারে আক্রমণ চালাতে চালাতে কুষ্টিয়ার দিকে এগিয়ে আসছিল।

 হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজ কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত পাক বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং গড়াই নদীর পূর্ব ধার থেকে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমান শত্রুসৈন্যদের গতিও প্রতিহত করেছে। সংবাদে আরো জানা গেছে যে, হাজার হাজার যুবক বাংলাদেশ সরকারের পুনর্গঠিত সেনাবাহিনীতে যোগদান করছেন।

 পাবনা-কুষ্টিয়া সংযোগ পথ বিচ্ছিন্নঃ গৌহাটি থেকে পাওয়া পিটিআই’র খবরে প্রকাশ, আজ মুক্তিফৌজ এক ত্বরিত আক্রমণে পাবনা ও কুষ্টিয়ার মধ্যবর্তী পাকফৌজের সংযোগ রক্ষার ও সরবরাহের পথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সীমান্তের ওপার থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এখানে এই সংবাদ পৌঁছে। মুক্তিফৌজের এই সাফল্যের বিস্তারিত সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি।

 ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া থেকে আগত শরণার্থীদের মুখে সেখানে পাকফৌজের নিষ্ঠুর অত্যাচারের নানা কাহিনী শোনা যাচ্ছে। তারা কুষ্টিয়া শহরের নিকটবর্তী গ্রামগুলির তিন হাজারেরও বেশী ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। পাকফৌজ পৌঁছানোর আগেই গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ফরিদপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজের প্রচণ্ড বাধার ফলে পাকফৌজের অগ্রগতি সম্ভব হয়নি।

 দিনাজপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণাধীন হিলি থেকে পাঁচশ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ীতে এক গ্যারিসন পাকফৌজ দেখা গেছে।

 ভারত সীমান্ত থেকে সাত মাইল দূরে লড়াইঃ আজ রাত্রে ভারতের সীমান্তবর্তী শহর কৃষ্ণনগরে খবর পৌঁছায় যে, ষাটটি সামরিক গাড়ীতে চেপে পাকফৌজ মেহেরপুর প্রবেশ করে এবং প্রবেশকালে দু’দিকে বেপরোয়াভাবে অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করে ও গ্রামগুলিতে আগুন জ্বালায়।

 এখন মুক্তিফৌজ ও পাকফৌজের মধ্যে লড়াই চলছে ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে এবং কৃষ্ণনগর-করিমপুর সড়ক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

-যুগান্তর,১৯ এপ্রিল, ১৯৭১

মেহেরপুর আবার মুক্ত, শালুটিকরও বাংলাফৌজ নিয়ে নিল-

সোমবার সাফল্যের পর সাফল্য

 মুক্তিফৌজের পক্ষে সোমবার সাফল্যের পর সাফল্য। আধুনিকতম মারণাস্ত্রে বলীয়ান পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সংঘবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে মুক্তিফৌজ এদিন বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে নিয়েছে। রবিবার দিন যুদ্ধের অবস্থা অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় আজ মুক্তিবাহিনী নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে তীব্র আক্রমণে নাজেহাল করেছেন হানাদার সৈন্যদের। শ্রীহট্ট শহরের অদূরে শালুটিকর বিমানবন্দরে গত কয়েকদিন ধরে দুই পক্ষের মরীয়া আক্রমণ চলছিল। পাকফৌজ সেখান থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতা শ্রী ধ্রুব মজুমদার জানাচ্ছেন, প্রায় ১৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছে মুক্তিফৌজের কাছে, ওদিকে হতাহতের সংখ্যা অনেক। শালটিকর থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে খাদিমনগরে উপস্থিত হয়ে তিনি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল পেয়েছেন। পাকবাহিনী এখন বিমানবন্দর থেকে হটে গিয়ে শেষ লড়াই চালাচ্ছে। এখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে বৃটিশরাই একটি বিমানবন্দর বানিয়েছিল এবং পাকিস্তানী সরকার সেটিকে আধুনিক রূপ দিয়েছিল।

 এদিন দুপুরের দিকে খবর আসে যে, ভারতের সীমান্তবর্তী মেহেরপুর পাকফৌজ দখল করে নিয়েছে। সন্ধ্যার পর আবার আনন্দ সংবাদ। মুক্তিবাহিনী এখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে হানাদারদের। মেহেরপুর ট্রেজারির একজন কর্মী ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেবার পর জানান যে, পাকফৌজ মুসলিম লীগের সহায়তায় শহরটি লুটপাট করে অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। পরে তারা মুক্তিবাহিনীর তাড়া খেয়ে বাধ্য হয়। চুয়াডাঙ্গা শহরটি এখন মুক্তিসেনার দখলে। শহরের বাইরে যুদ্ধে চলছে।

 আর একটি বড় জয় পূর্ব খণ্ডে কসবায়। আমাদের সাংবাদিক তুষার পণ্ডিত জানাচ্ছেন, আগরতলা থেকে ২০ মাইল দূরে ভারত সীমান্তের কমলাসাগরের ওপাশে কসবায় পাকবাহিনী ক’দিন ধরে ছাউনি গেড়েছিল। এই সমৃদ্ধ গ্রামটিতে পাকফৌজ যথেচ্ছ লুটতরাজ ও অগ্নিকাণ্ড চালিয়েছে। এদিন ভোর তিনটের ক্যাপ্টন গাফ্ফারের নেতৃত্ব মুক্তিফৌজ অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দেড়শ শত্রুসৈন্য নিহত করে অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছেন। ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ মন্ত্রী তফাজ্জল আলীর বাড়িতে পাকফৌজ থানা গেড়েছিল। মুক্তিবাহিনী সেই বাড়িটিও উড়িয়ে দেন। এই শহরের বাড়িতে বাড়িতে যে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানো হয়েছিল স্বাধীন বাহিনীর সেনারা সেই সব পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। সমস্ত গ্রামবাসীরাও আবার আস্তে আস্তে এখানে ফিরে আসছে।

 আখাউড়া রেল স্টেশনের কাছেও প্রবল যুদ্ধ চলছে। এখানে দখলদার বাহিনীরাই ফাঁদে আটকা পড়ার অবস্থা। আগরতলা থেকে দশ মাইল দূরে সিঙ্গুর বিল সেতুটি মুক্তিফৌজ উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও পাকফৌজ কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন।

 হার্ডিঞ্জ বা সারা সেতু এলাকায় লড়াই এখন তুমুল। ফেনীর কাছে এক আকস্মিক সংঘর্ষ দেড়শত পাকফৌজ নিহত হয়েছে। এখানে পাক বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে বিস্তর। রংপুর লালমনিরহাটের মধ্যে সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগের ব্যবস্থাও আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুক্তিফৌজের তৎপরতায়। ঢাকা শহরের আশেপাশে এবং টাঙ্গাইলেও অবিরাম লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে।

 আজ পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলি বস্তুত জনশূন্য। সেনাবাহিনী অধিকৃত খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে, এই শহরের প্রায় তিন হাজার অধিবাসী গ্রামে চলে গেছেন।

 রংপুর অঞ্চলে ঠাকুগাঁও ও দিনাজপুর থেকে উত্তর অগ্রসরমান একটি পাক বাহিনীকে মুক্তিফৌজ প্রবলভাবে বাধা দেয়।

- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ এপ্রিল, ১৯৭১

বাংলাদেশে লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্যায়

মুক্তিফৌজের সাঁড়াশী আক্রমণে পাকবাহিনী পর্যদস্ত

 ২১শে এপ্রিল-গতকাল বিকেলে বাংলাদেশে লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। এতদিন যা হচ্ছিল, তা হল মুক্তিফৌজ কর্তৃক পাকিস্তানী সৈন্যের প্রতিরোধ করা এবং তা ছিল একরকম বিচ্ছিন্নভাবেই। অর্থাৎ মুক্তিফৌজ তেমন সংগঠিত ছিল না। বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে যুদ্ধনীতি অনুযায়ী সমঝোতাও ছিল না। কিন্তু গতকাল থেকে মুক্তিফৌজ পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত হয়ে যুদ্ধনীতি অনুযায়ী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে মুক্তিফৌজের সংগ্রামীরা অনেক অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। তাদের প্রথম পাল্টা পশ্চিম সেক্টর থেকেই শুরু হল এবং ক্রমে অন্যান্য সেক্টরও এই পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ হবে।

 গতকাল বিকেলেই মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী বুড়িপোতা, গবীপুর ও দৌলতপুর দিয়ে তিন পথে এক সঙ্গে সাঁড়াশী আক্রমণ চালিয়েছে। এই সাঁড়াশী আক্রমণের উদ্দেশ্য হলমেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল দখল করা এবং মেহেরপুর থেকে সাত মাইল দূরে আমঝুপিতে পাকসৈন্য যে ঘাঁটি স্থাপন করেছে তাকে দখল করা এবং যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করা। আজ সকাল পর্যন্ত খবর নিয়ে জানা গেছে যে, মুক্তিফৌজ ইতিমধ্যেই কোর্ট এলাকা দখল করে নিয়েছে এবং মুক্তিফৌজের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করেছে এবং পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। মুক্তিফৌজের জনৈক মুখপাত্র জানিয়েছেন।

 মুজিবনগর আক্রমণের চেষ্টা ব্যর্থঃ এদিকে গতকাল মঙ্গলবার পাকিস্তানী সৈন্যরা মুজিবনগর আক্রমণের চেষ্টা ও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বিকেল থেকে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় এবং রাস্তাঘাট চলাচলের পক্ষে সুবিধাজনক না হওয়ায় পাকবাহিনীর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।

 মুজিবনগরে মুক্তিফৌজ ট্রেনিং ক্যাম্পঃ গতকাল বাংলাদেশের মুজিবনগরে মুক্তিফৌজের ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছে এবং আজ সকাল থেকে তার কাজ শুরু হয়েছে। এই ক্যাম্পে ২০০ জন করে শিক্ষার্থীকে সমরশিক্ষা দেওয়া হবে এবং শিক্ষা শেষে তাদের লড়াইয়ে পাঠানো হবে।

আরও কয়েকটি অঞ্চলে মুক্তিফৌজের সাফল্য

কসবা স্টেশন ও পাকশি সেতু পাক হানাদার কবল মুক্ত

 আগরতলা, ২২ শে এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী আজ ভোরের দিকে আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপখণ্ডে কসবা রেল স্টেশনটি পাকিস্তানী সৈন্যদের কবল থেকে মুক্ত করে নিয়েছেন। ময়মনসিংহ আর শ্রীহট্ট শহরটি অবশ্য গতকাল আবার পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলে গেছে। সীমান্তের ওপার থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে এই তথ্য জানা গেছে বলে ইউএনআই জানিয়েছেন। কৃষ্ণনগর থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডের অধিনায়ক মেজর এম এ ওসমান চৌধুরীর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে যে, মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পাকশী সেতু থেকে পাক সৈন্যদের হটিয়ে দিয়েছেন। উত্তর পাকশী সেতু থেকে শুরু করে দক্ষিণে শিবতলা, বড়বাজার ও ঝিকরগাছা লাইন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করে নিয়েছেন।

 যশোরের পাকসৈন্যরা এখন কেবল ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকাতেই আবদ্ধ আছে। সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা আজ বাংলাদেশের এক অজ্ঞাত স্থানে তাঁদের রাজধানীতে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে কতকগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

 ময়মনসিংহের পতন- ট্যাঙ্কযোগে পাকসৈন্যযোগেঃ ইউএনআই জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে মধুপুর ক্যাণ্টনমেণ্টে সৈন্য আমদানীর পর ময়মনসিংহের পতন ঘটে। ময়মনসিংহের পতনের ফলে গত ২৭ দিনের যুদ্ধের অবশ্য কোন হেরফের হয়নি। খবরে প্রকাশ, কতকগুলি ট্যাংক ইউনিট ঐ সৈন্যদের নিয়ে আসে। ঢাকা থেকে রংপুর, পূর্ব দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম অঞ্চলে ও ট্যাংক ইউনিট পাঠান হয়েছে।

 শ্রীহট্টের সড়ক পথ মুক্তিফৌজ বিনষ্ট করে দিয়েছেন বলে ঐ পরিত্যক্ত শহরটির উপর দখল নেবার জন্য বিমান থেকে বহু সংখ্যক পাকসৈন্য নামান হয়েছে।

 কসবা, আখাউড়া ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মুক্তিফৌজ রাত দুটোর কিছু আগে তিন ইঞ্চি মর্টার দিয়ে পাক সৈন্যদের উপর আচমকা আক্রমণ চালান এবং তাদের সঙ্গে ছয় ঘণ্টা লড়াই করেন। কবসার যুদ্ধে মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর কয়েকজন অফিসার সহ অন্তত ৫০ জনকে গ্রেফতার করেন। পাক সৈন্যরাও মর্টার আর হালকা ফিল্ড গান থেকে গুলি চালায়।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১

ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরে পাক আক্রমণ প্রতিহত

 কৃষ্ণনগর, ২৪শে এপ্রিল মুক্তিফৌজ আজ বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ খণ্ডে ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি যে জেলায় সেই ফরিদপুরে মুক্তিফৌজ একটি পাকিস্তানী সৈন্যদলের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াইয়ে নিযুক্ত আছেন। এই সৈন্যদলটি গতকাল গোয়ালন্দঘাটে এসে নামে। তারা রাজবাড়ির দিকে অগ্রসর হলে তাদের সেই অগ্রগতি প্রতিহত করা হয়।

 পাকসৈন্যরা কামারখালীতে নদী পার হবার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেন।

 ময়মনসিংহ শহরে পাক সৈন্যদল ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এখন প্রচণ্ড লড়াই চলছে। কুষ্টিয়ায় পাকসৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে যুদ্ধ চলছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

 ময়মনসিংহে প্রচণ্ড যুদ্ধঃ সীমান্তের ওপার থেকে খবর এসেছে যে, বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডে ময়মনসিংহে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছে। পাকসৈন্যদের একটি অগ্রবর্তী দল গতকাল ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে এবং ডেপুটি কমিশনারের বাংলা ও বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে তুমুল লড়াই হয়।

 মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ থেকে ৬ মাইল দূরে মধুপুর থেকে আগত আর একটি পাকসৈন্যদলের সঙ্গে এখন ও লড়াই করেছেন।

-যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১

বেনাপোলে মুক্তিফৌজের হাতে পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী ঘায়েল

 বেনাপোলে, ২৫ এপ্রিল আজ যশোর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের মূল ঘাঁটি দখল করতে এসে হানাদার দলের গোলন্দাজ বাহিনী ঘায়েল হয়। মুক্তিসেনাদের প্রচণ্ড পাল্টা আঘাতে তারা আধুনিক সমর সরঞ্জাম ফেলে পালায়। কিছু চীনা অফিসার পাকবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছিল, তারাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বাংলা বাহিনী দখলদারদের ঘাঁটিতে গিয়ে চীনের প্রচুর উন্নত অস্ত্রশস্ত্র পায়।

 বনগাঁ থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বেনাপোলে মুক্তিফৌজ ও পাক সৈন্যের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজ পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্রগতি সাফল্যের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছে। ২৫ জনের বেশী মুক্তিসেনাকে বেনাপোল থেকে এনে বনগাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও আহত সৈনিককে নিয়ে আসা হচ্ছে।

 ময়মনসিংহে বোমাবর্ষণঃ দলু (বারেঙ্গাপাড়া) ২৫এপ্রিল পাকিস্তান বিমান বহরের বিমানগুলি গতকাল সকালে ময়মনসিংহ শহরে বোমাবর্ষণ করে। এই নিয়ে পরপর তিনদিন ময়মনসিংহ শহরে হাওয়াই হামলা হল। গারুয়াপাড়া সীমান্ত থেকে বোমাবর্ষণের শব্দ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ থেকে সদ্য আগত শরণার্থীরা জানান বৃহস্পতিবার থেকে পাক সৈন্যদল শহরটি প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। এইসব শরণার্থীরা শুক্রবার সন্ধ্যায় শহর থেকে পালিয়ে এসেছেন।

 পাকসৈন্যদের একটি ময়মনসিংহ এর শহররতলিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঘাঁটি স্থাপন করেছে।

—আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১

IN SYLHET FRONT PAK ARMY FAILS TO BREAK RESISTANCE

 AGARTALA, Aril 26: The Liberation Force of Bangladesh for the forth day today valiantly defended Sylhet’s Sherpur Ferry Ghat despite Pakistan air fore strikes early in the day in support of a ground column.

 Reports from across the border said the Pakistani army column which had moved from Sylhet earlier this week could not break the resistance of the Liberation Force despite persistent staffing and bombing of Ferry Ghat by PAF Planes.

 Sherpur Ferry Ghat on the Khushiara river is the only connecting ink between Sylhet and Akhaura in the Comilla sector.

 Meanwhile four Mkuti Fouj men were injured when PAF shelled Golapganj, 13 km east of Sylhet town where the Mukti Fouj guerillas had earlier liquidated a Pakistani detachment of 22 soldiers in an ambush within their firing range.

 Pakistani troops, using gunboats were nearing Barisal town, shelling and burning villages on both sides of the madhumati. The gunboats entered through the Bay of Bengal into the Madhumati which has innumerable tributaries touching the entire district. This important district with population of 30 lakh had so far remained untouched by fighting between the Pakistan army and the Liberation Force.

 Freedom fighters using guerilla tactics reportedly attacked the radio station in Khulna, which is held by the Pakistan army. In Chittagonjg sector, Pakistan army columns are trying hard to restore communications between Chittagong and Comilla and Chittagong and Sitakund. The road and rail links in this area have been disrupted by the Liberation Force.

 Fifty Pakistani troops were killed today by a guerilla squad of the Liberation Army on the bank of Titas river near Sabaepur. Mukti Fouj sources from across the border said.

 The Pakistani troops were busy preparing themselves for the day’s routine. when the guerillas stealthily entered the camp and killed them in a surprise attack.

 In Dacca area the Pakistani troops were being harassed by guerillas of the Liberation force.

 The Pakistani army was reported to be withdrawing from Panchagarh near the Indian border after leavin behind some armed irregulars. Pakistani troops were also withdrawing from Nilphamari.

 Near Laksham railway station in Comilla sector, Liberation Force ambushed a Pakistani army column, which was moving towards Chittagong and killed a number of Pakistani in the encounter.

 The Pakistan army after heavy bombing raids and artillery attack has succeeded in wrestling control of Mymensingh and Bogra towns from the Liberation Force.

 Reports from Bangladesh today said that Mymensingh fell to the Pakistanis yesterday after heavy fighting lasting over a week. Before the Pakistani columns entered this strategic town outlying areas were pounded by their air force and shelled by heavy artillery and mortars.

 Armoured columns moving in from Santahar and Gorahghat took Bogra in an attack without much opposition as the freedom fighters withdrew in the face of superior fire power. The Pakistani columns from Bogra were on the move towards Jamalpr on the north-west, reports said.

 The Mukti fouj last night swooped on the Pakistan border outpost of Ichakhali on the western side of river Bhairab in Kushtia district and hoisted the Joy Bangla flag on it. They then dug trenches around the outpost and demolished bridge over the river Bhairab.

 From early this morinig the Liberation Forces shelled the Pakistan army post at Meherpur town about two miles from Ichakhali compelling them to shift the post to a bamboo grove in village Mayamari, about five miles from Meherpur.

- Hindusthan Standard, 27 april, 1971

পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা

 আগরতলা ২৭ শে (পি, টি. আ) - বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ পশ্চিম ও পুর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে গুপ্ত ও গেরিলা আক্রমণ যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন, ওদিক পাকিস্তান জঙ্গী বাহিনী আজ উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে আসামের কাছাড় জেলার সংলগ্ন শ্রীহট্ট সীমান্তের দিকে নতুন অভিযান শুরু করেছে।

 বাংলাদেশ থেকে আজ রাত্রে যে সংবাদ পাওয়া যায় তাতে বলা হয় যে, মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ের পর পাকবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা নদী সমক্ষে হাজির হয়েছে।

 কিন্তু শ্রীহট্টের দিক থেকে পাকফৌজের যে দলটি ব্রাক্ষণবাড়িয়া দিক থেকে অভিযান কারী অপর একটি ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আশায় এক সপ্তাহ পুর্বে রওয়ানা হয়েছিল, তারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ শেরপুর খেয়াঘাট দখলের জন্য মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে আটকে আছে।

 সংবাদ এ-ও জানা যায় যে, পাক বিমানবাহিনীর বারবার বোমাবর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসসাধন এবং দুরপাল্লার কামান দাগানো সত্ত্বেও মুক্তিফৌজ শ্রিহট্টের মাইল পনের দূরে অবস্থিত শেরপুরে পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন এবং তাদের আক্রমণে পাক জঙ্গী ফৌজ বহু সংখ্যায় হতাহত হয়েছে।

 উপকূলবর্তী শহরগুলি দখলের চেষ্টাঃ প্রকাশ, মধ্য রণাঙ্গনে পাকিস্তানী ফৌজ বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে যমুনার উভয় তীর ধরে অভিযান চালিয়েছে। নদী তীরবর্তী শহরগুলির পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার জন্যই তাদের এই উদ্যম। পাক বিমানবাহিনী আজকে বগুড়ার পূর্বদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করেছে। বিশেষ করে যমুনার পশ্চিম উপকূলবর্তী সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর ও হরিপুর শহর কয়টি বিধ্বস্ত হয়।

 জামালপুরে তুমুল সংগ্রামঃ পূর্ব তীরে ময়মনসিংহের দিক থেকে অভিযানরত পাকিস্তানী ফৌজ জামালপুরে ঢুকছে। ওখানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রাম চলেছে এখন অবধি। সংবাদে বলা হয় যে, ঢাকা, মধুপুর ও কিশোরগঞ্জ থেকে পাকফৌজের যে দলটি ময়মনসিংহের ওপর জড়ো হয়েছিল, এক্ষণে তারা ঐ শহরে সদর কার্যালয় স্থাপন করেছে।

 বরিশাল শহর এখনও মুক্তিফৌজের হাতে: দক্ষিন রণাঙ্গনে এখন পর্যন্ত বরিশাল শহরটি মুক্তিফৌজের করায়ত্ত। ফরিদপুর থেকে অভিযানরত পাকবাহিনীকে গেরিলারা বরিশালের পথে অনেক জায়গায় সংগ্রামের মুখে ফেলেন। নদী তীর বরাবর পাকিস্তানী গানবোট ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময়ের সংবাদও পাওয়া গেছে।

 সৈন্যরা চট্টগ্রামে শ্রমিক পাচ্ছেনাঃ চট্টগ্রামে পাকবাহিনী নাকি ১৩০০০ বন্দর শ্রমিকের মধ্যে বন্দুক দেখিয়ে মাত্র ১৪০০ জনকে জরুরী মালপত্র উঠানো নামানোর কাজে সংগ্রহ করতে পেরেছে। অধিকাংশ বন্দর ও ডক শ্রমিক পকিস্তানী সৈন্যদের গুলি এড়িয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

 চৌকি দখলের চেষ্টা বানচালঃ শিলিগুড়ি থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দিনাজপুরে কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এই এলাকাটি পশ্চিম দিনাজপুরে রাধীকাপুর সীমান্ত শহর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। সীমন্তের ওপর থেকে এই খবর পওয়া ঘেছে।

 মুক্তিফৌজের অতর্কিত আঘাতঃ শিলং থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বিরাট এক অঞ্চল জুড়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্তা আরও জোরদার করে তুলেছে। কয়েকটি এলাকায় আজ পাকবাহিনীর উপর তারা অতর্কিত আঘাত হেনেছে। বগুড়া শহরের দক্ষিণ-পূর্বে শেরপুর এলাকায় মুক্তিফৌজে পাক বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য করতোয়া নদী পার হওয়ার সময় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। নিকটবর্তী কাজিপুর এবং হরিপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে।

 কুমিল্লা ফ্রণ্টে গঙ্গাসাগর এবং ইমামবাড়ী ষ্টেশনের মধ্যবর্তী একটা এলাকায় মুক্তি সংগ্রামী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বহু সংখ্যক পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

 কুচবিহার থেকে প্রাপ্ত একটি খবরে জানা গেছে, হানাদারের কুড়িগ্রাম দখলের চেষ্টা মুক্তিবাহিনী বানচাল করে দিয়েছেন। একটি পাক অগ্রবর্তী বাহিনীর পাঁচজন সৈন্যকে মুক্তি সংগ্রামীরা গুলি করে মেরেছেন এবং ধরলা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই পাক সৈন্যেরা হাতে তৈরী নৌকাতে করে ধরল নদী পার হচ্ছিল।

 পাক বিমান ভূপাতিতঃ শিলং থেকে পিটিঅই জানাচ্ছে, খাসি পাহাড়াঞ্চল ও মেঘালয়ের সীমন্তবর্তী বাংলাদেশের শ্রীহট্ট ফ্রণ্টে একদল মুক্তি সংগ্রামী আজ সকালে একটি পাক জঙ্গী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। বিমানটি হরিপুরে সার কারখানার দিকে যাচ্ছিল।

- যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

গোয়ালন্দে অনূন্য একশ পাকসৈন্য নিহত

 মুজিবনগর, ৩০শে এপ্রিল (ইউএনঅই)- গতকাল বুধবার ফরিদপুরের নিকট গোয়ালন্দে একটি যুদ্ধে অনূন্য ১শ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি স্টীমার নিমজ্জিত হয়েছে বলে আজ এখানে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। এই যুদ্ধে প্রায় ৯ ঘণ্টাকাল আক্রমন করলে এই যুদ্ধ শুরু হয়।

 সংবাদ জানা যায়, শেখ মুজিবুরের জন্মস্থানকে ধূলিসাৎ করা হয়েছে- শুধু কুকুর ও সেন্যরা সেখানে অবস্থান করেছে।

 শহরে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ীঘর ভূমিসাৎ করা হয়েছে এবং পাইকারী বাজারটি লণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়েছে। ঐ দিনই ফরিদপুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গুরুত্বপূর্ণ পাট ব্যবসায় কেন্দ্র ভাঙ্গাতে ও যুদ্ধ হয়। প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা মুল্যের পাট বিনষ্ট করা হয়েছে।

 ফেনি শহরের নিকট একশ’ পাকসৈন্য নিহতঃ চট্টগ্রাম রণাঙ্গনের কোন এক স্থান থেকে মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন যে, গত মঙ্গল বার নোয়াখালী জেলার ফেনী শহরের শুভপুর সেতুর জন্য সংগ্রামে প্রায় একশ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মেজর রহমান সফররত জনৈক ইউএনঅই’র প্রতিনিধিকে লিখিতভাবে জানান যে,২৭শে এপিল এক ব্যাটালিয়ান পাকিস্তনী সৈন্য শুভপুর সেতু আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করে। শত্রুসৈন্যরা ট্যাংক এনে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গোলাগুলি চালায়। শুভপুর সেতুর নিকট পাকিস্তানীরা ফেনী নদী অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজের আব্দুল আজিজ নামে জনৈক সিপাই এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে হত্যা করেন। মেজর রহমান আরও জানান যে, কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য কোরূপে সেতু অতিক্রম করলে মক্তিফৌজ শত্রুপক্ষের অক্রমণ প্রতিরোধ করে। সেতুটি এখনও মক্তিফৌজেরই হাতে রয়েছে।

মুক্তিফৌজের পাল্টা আক্রমনে ছদ্মবেশী পাক-হানাদাররা পর্যুদস্ত

 বয়ড়া সিমান্তে, ৩০শে এপ্রিল- আজ বিকালে বেনাপোলের সাদিপুরে একদল পাকিস্তানী হানাদার মুক্তিফৌজের ছদ্মবেশে হাত উঁচু করে এগিয়ে এসে মুক্তিফৌজের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণে বাংলা বাহিণী পাঁচজন হানাদার কে খতম ও কয়েকজনকে জখম করেন। অন্যদিকে, মহেশপুরেও মুক্তিবাহিনী ঝটিকা আক্রমণে দখলদারদের কাছ থেকে একটি ছোট ঘাটি ছিনিয়ে নেন।

এদিন বেলা তিনটা নাগাদ সাদিপুর মুক্তিফৌজ যখন টহল দিচ্ছিলেন, তখন তারা দেখতে পান সামনে দিয়ে একদল লোক মুক্তিফৌজের বেশে এগিয়ে আসছে। তাদের বুকে বড় ব্যাজ, বড়বড় হরফে লেখা ইপিআর। আর ঊর্ধ্ববাহু এই ছদ্মবেশীরা অনেকটা কাছে এগিয়ে এলে তাদের পিছন থেকে হানাদাররা হঠাৎ মুক্তিফৌজকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। মুক্তিফৌজ সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমন চালাতে থাকেন। আধ ঘণ্টা লড়াইয়ে হানাদারের কয়েকজন নিহত ও অহত হওয়ার পর তারা সরে পড়ে। সাদিপুরের ১৮ মাইল উত্তরে মহেশপুরে বেলা ১২ টা নাগাদ যখন মুক্তিফৌজ ঝটিকা গতিতে দখলদারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েণ, তখন দু’জন পাঠানের প্রাণ হারাবার পর তারা ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়।

নোয়াখালী ও কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ককেন্দ্র মুক্তিফৌজের দখলে

 বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালী মুক্তিফৌজের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে সব খবর মঙ্গলবার পওয়া গেছে, তাতে প্রকাশ, প্রচণ্ড সংগ্রামের পর মুক্তিফৌজ নোয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযোগস্থল ছাগলনাইয়া অধিকার করেছেন, বাহাদুরাবাদ ঘাট ও চিলমারী ঘাটের (যথাক্রমে ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলা) কয়েকটি জলযান দখল করে সরিয়ে নিয়ে গেছেন, পাকবাহিনীর বহু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে তাদের অনেককে হতাহত করেছেন। ছাগলনাইয়ার যুদ্ধে শ’ তিনেক এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের ওপর মীরবাজারের যুদ্ধে শ’ দেড়েক পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে।

 এদিকে যুগান্তরের জলপাইগুৱিস্থিত সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে সেখানে খবর পৌছেছে যে, লালমনিরহাটের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর মেজর এজাজ খানকে মুক্তিফৌজের গেরিলারা মেরে ফেলেছেন। মেজর এজাজ ছিলেন পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল রিয়াজ খানের ছোট ভাই। তার স্মরণে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ লালমনিরহাট ও কাউনিয়ার মধ্যবর্তী তিস্তার রেল সেতুটির নামকরন করেছেন এজাজ সেতু।

 আগরতলা থেকে পিটিআই খবর দিয়েছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে নোয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযোগ কেন্দ্রে ছাগলনাইয়াতে তিন দিন ধরে পাকিস্তানী ফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রামের পর মুক্তিফৌজ সোমবার ঐ যায়গাটি দখল করে নেন। নোয়াখালী আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক ছাগলনাইয়াতে মুক্তিফৌজের এই সাফল্যের বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলেন, ঐ যুদ্ধে অন্ততঃ ২১জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মক্তিফৌজ মেশিনগান, রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক প্রভৃতি প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলি পলায়মান পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। তাছাড়া গত ১লা মে নোয়াখালীর ফেনাঘাটা সেতুর কাছে মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো বাহিনীর আক্রমনে আরও পাকিস্তানী সেন্য নিহত হয়েছে।

 উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনেঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে লালমণিরহাটের কাছে দলহাটিতে (তালাহাটি?) মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

-যুগান্তর, ৫ মে, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি, আখাউড়ায় জোড় লড়াই

 আগরতলা, ৬ মে- বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিফৌজের তৎপরতা দারুণ বেড়ে গিয়েছে। মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমনে পাক-বাহিনী নাজেহাল। বহু পাক-সেনা নিহত হয়েছে। বহু যায়গায় পাক-সেনা পিছু হটেছে। বৃহস্পতিবারও আখাউড়ায় দুই পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। মুক্তিফৌজ এখানে পাক-বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতে পেরেছে। আখাউড়ার কাছেই গঙ্গাসাগর ও উজানিশর সম্পূর্ণভাবে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিফৌজের একজন কমাণ্ডার জানিয়েছেন, আখাউড়ার যুদ্ধে ১২০ জন পাকসেনা খতম হয়েছে। পাকসেনাবাহিনী আখাউড়া ও কুমিল্লার মধ্যে সরাসরি সড়ক পথে সংযোগ স্থাপনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩৩ জন পাক সেনা। মুক্তিফৌজ এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রেল সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুরেও পাক-বাহিনীর উপর মুক্তিফৌজ গেরিলাবাহিনী বার বার আক্রমণ চালায়।

 বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে কুড়িগ্রাম ও লালমণিরহাটে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই হয়। গেরিলা আক্রমণে পাক-বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয়। লালমনিরহাটে ২৯জন পাক-সেনা নিহত হয়। দিনাজপুর জেলায় ঘোড়াঘারি ও প্রেমতলাতে মুক্তিফৌজের হাতে চারজন পাক সেনা খতম হয়েছে।

 বরিশালেও মুক্তিফৌজের সাফল্য অব্যাহত। এখানে দ্বারকাপুরে পাক-সেনা বোঝাই একটি নৌকা মুক্তিফৌজ ডুবিয়ে দিয়েছে। ফলে বহু পাক-সেনার সলিলসমাধি ঘটেছে। ময়মনসিংহের উত্তর-পূর্বে আলমপুরে পাক-সেনা ও মুক্তিফৌজের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়েছে।

 মুক্তিফৌজের আক্রমণে নাজেহাল পাক-সেনাদল শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জের পশ্চিমে ২টি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়।

 গত দুদিন ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করার পর আজ পাক-বাহিনী চট্টগ্রামের দক্ষিণে কক্সবাজার দখল করে নেয়। কক্সবাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে।

 গেরিলা তৎপরতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পাক-সেনা কর্তৃপক্ষ পশ্চিমাঞ্চলের চিলাতহ শহরে কারফিউ জারি করেছে।

 দেবগ্রামে মুক্তিফৌজ ও পাক-সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়। এখানে প্রায় ১০০জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। ধরমানি চা বাগান এলাকা থেকে প্রায় ৮০০ জনের এক পাক-সেনাদলকে মুক্তিফৌজ তীব্র আক্রমণ চালিয়ে হটিয়ে দিয়েছে। এখানে প্রায় ২০০ জন পাক-সেনা মারা গিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মে, ১৯৭১

বিভিন্ন সেনাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের আচমকা আক্রমণ

 কলকাতা, ৭ মে (ইউএনআই)- সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রনাঙ্গনে মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে কমাণ্ড আক্রমণে প্রায় ১৫ জন পাক ফৌজ খতম হয়েছে। এরমধ্যে ময়মনসিংহে কালুমাখানায় পাকবাহিনীর আচমকা আক্রমণ করে কমাণ্ডোরা ৮ জনকে হত্যা করে এবং ৩০ টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।

 এর পরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে রংপুরে। এখানে সরাই নামক স্থানে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে অন্ততঃ ৭ জন সৈন্যকে হত্যা করে।

 শ্রীহট্ট অঞ্চলের বিবির বাজার ও কাজিপুরে জোড় সংঘর্ষ হয়। হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

 সেতু ধ্বংসঃ রংপুরের আমরখানা, মোগলাহাট, লাবলাহাট ও তুগরাইহাট অঞ্চলে মুক্তিফৌজ গেরিলা আক্রমণ চালিয়েছে। তারা ঐ জেলার বাজানপুর সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। দক্ষিন -পূর্ব রনাঙ্গনের রাদমপুর ও বরিশালের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পটুয়াখালির অঞ্চলে ও এখানে সেখানে যুদ্ধ চলছে।

 উত্তর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের সাফল্যঃ জলপাইগুড়ি থেকে যুগান্তরের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেঃ মুক্তিফৌজ বিগত ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর রনাঙ্গনে নেকীপাড়া, ডানাকাটা এবং বড়শশী সীমান্ত ফাঁড়িগুলি দখল করে নিয়েছেন। তারা ভালাগঞ্জ থেকে পচাঁগড় পর্যন্ত ২০ ব্যাসার্ধের মধ্যে পাক সৈন্যদের চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছে। বহুসংখ্যক মুক্তিফৌজ এখন তেঁতুলিয়ায় গেরিলা যুদ্ধে ট্রেনিং নিচ্ছেন।

প্রখ্যাত খেলোয়াড়ের মুক্তিফৌজে যোগদান

 নয়াদিল্লী, ৭ই মে (ইউএনআই) এখানে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশের খ্যাতনামা ফুটবল খেলোয়াড় ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছেন। তিনি এখন বাংলাদেশর কোন এক স্থানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে আছেন। ক্যাপ্টেন আহমদ মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করেছেন।

আখাউড়ায় প্রচণ্ড লড়াইঃ ১৫০ পাক সেনা নিহত

 আগরতলা, ৮ মে শনিবার সারাদিন ধরে বাংলাদেশের নানাস্থানে মুক্তিফৌজ ও পাক হানাদারদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলে। লড়াই সবচেয়ে তীব্র আকার ধারন করে আখাউড়ায়। এখানে মুক্তিফৌজের আক্রণে ১৫০ পাক- সেনা নিহত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম রনাঙ্গনে মুক্তিফৌজ বারবার অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। মুক্তিফৌজের একজন কমাণ্ডার জানান, উত্তর- পূর্ব রনাঙ্গনে তারা চীনা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। চীনা পদ্ধতি হলঃ শত্রুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে সীমাবদ্ধ অঞ্চলে আবদ্ধ রাখা।

 পশ্চিম রণাঙ্গনের রংপুর, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলার শনিবার উভয় পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই চলে। রাজশাহী জেলার মোহনপুরে চারজন পাক-সেনা নিহত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, নতুন কায়দায় যুদ্ধ শুরু করে মুক্তিফৌজ গেরিলা বাহিনী সর্বত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পাক বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। গত দু’দিন নানা স্থানে রেল লাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

 রংপুর জেলার মোগলহাটে ৩০ জন ও কুড়িগ্রামে ৭ জন পাক- সেনা গতকাল মুক্তিফৌজের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে রিজভি নামে একজন পাক-ক্যাপ্টেনও আছে। কুড়িগ্রামে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীর একজন সেনা মানওয়ার আলিকে বন্দী করেছে। তার গায়ে গুরুতর নীতেআগাতের চিহ্ন ছিল। মোঘলহাটে মুক্তিফৌজ দুজন পাক গুপ্তচরকে গুলি করে হত্যা করেছে। একজন গুপ্তচরকে বন্দী করা হয়েছে তার নাম মহম্মদ মণ্ডল। কুষ্টিয়া, যশোর ও রংপুর এলাকয় মুক্তিফৌজ পাক সেনাবাহিনীর গাড়ীগুলির উপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালালে প্রচুর পাকসেনা নিহত হয়।

 বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যাবস্থা চালুঃ ইউএনআই জানাচ্ছে, বাংলাদেশের রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। মুক্তিফৌজ ওই সমস্ত এলাকা থেকে উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছেন।

-আন্দবাজার পত্রিকা ৯মে, ১৯৭১

কুমিল্লা ও আখাউড়ায় তিনদিন তুমুল লড়াইঃ

তিনশ’পাকসেনা খতম

 আগরতলা, ৯ই মে (ইউএনআই) আখাউড়ায় মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর আজ তিনদিন ধরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। এই যুদ্ধেবাংলাদেশের সেনাবাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত পাকবাহিনীর প্রায় দু’শ সেনা নিহত হয়েছে বলে মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে। কোহিমায় শ্রুত স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে, আখাউড়া ও কুমিল্লা খণ্ডে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের হাতে তিনশ পাক হানাদার নিহত হয়েছে। বেতারে আরও বলা হয়, বিপুল সংখ্যায় সেনা খতমের ফলে পাকবাহিনীর বেলুচি সৈন্যদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। উক্ত সুত্রে প্রকাশ, মুক্তিফৌজের দু’জন সেনা নিহত, তিনজন আহত এবং দু’জন নিখোঁজ হয়েছেন।

 পাক হানাদার বাহিনী আখাউড়া- আগরতলা চেক পোস্টের এক হাজার গজের মধ্যে এসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী চেকপোস্টের কাছেই ঘাঁটি আগলে রয়েছে, তাই এই জায়গাটিই পাক বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্য। বাংলাদেশের সূত্রে প্রকাশ, পাক বাহিনী তিন কোম্পানী সেনার দ্বারা অর্ধ চন্দ্রাকৃতি ব্যুহ রচনা করে মুক্তিফৌজের এক কোম্পানী সেনাকে চেকপোষ্ট এলাকা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছ। আখাউড়া শহরে অতিরিক্ত এক কোম্পানী পাকসেনা মোতায়েন রাখা হয়েছে।

 নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ত্রিপুরা- বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবার প্রয়াসে পাকবাহিনী বিপুলসংখ্যক সেনাদল নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেছে। এই উদ্দেশ্যেই তারা রামগড় দখলের পর আজ হঠাৎ আখাউড়া ও বিবিরবাজার এলাকায় আঘাত হেনেছে।

 একটি বড়সড় পাকবাহিণী আখাউড়া শহর থেকে এগিয়ে আগরতলা চেকপোস্ট থেকে মাইল খানেক দূরে জাঘীশার সেতুর কাছে উপস্থিত হয়েছে। বিপরীত দিকে, আজ সকালে মুক্তিফৌজ আগরতলা চেকপোষ্টের আড়াই মাইল দূরে ফকিরমুড়া সীমান্ত ফাড়িটি দখল করে নিয়েছে। সকাল থেকেই আখাউড়ার রাজাপুর অঞ্চলে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই চলতে থাকে।

 কুমিল্লা খণ্ডে লড়াইঃ সীমানার এপারে দাঁড়িয়েও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কামানের গোলার শব্দ চারদিকে কাঁপিয়ে তুলছে। ওদিকে আগরতলা থেকে ৬ মাইল দূরে আখাউড়া উপখণ্ডে এখনও যুদ্ধ চলছে। মুক্তিফৌজের গেরিলা কমাণ্ডোরা সাফল্যের সঙ্গে শত্রুসৈন্যদের প্রচুর সংখ্যায় হতাহত করেছেন। তবে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রবল গোলাবর্ষণের মুখে তাঁরা ফকিরমুড়া থেকে প্রথম পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। আগে ৭ই মে মুক্তিবাহিনী গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুসৈন্যদের কসবা ও আখাউড়ার মধ্যবর্তী রাজাপুর গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে দেন।

 কৃষ্ণনগরের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে কুষ্টিয়া খণ্ডে ৭ই মে মুক্তিফৌজ আর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে গুলি বিনিময়ে অন্তত ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে ও বাংকার বিধ্বস্ত হয়েছে। রাত ১টা থেকে এক ঘণ্টা ধরে এই গুলী বিনিময় চলে।

 আজ সকালে সীমান্তের অপর পারের এক খবরে বলা হয়েছে যে, মুক্তিফৌজ গত শক্রবার থেকে মেহেরপুর উপখণ্ডে ভৈরব নদীর পূর্বতীরে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাটির উপর শেল বর্ষণ করছে। মুক্তিফৌজের তরফের কেউ হতাহত হননি।

 মুক্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণকারীরা গতকাল সন্ধ্যায় ভৈরব নদীর পশ্চিমতীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্ত স্থান থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করেন। মুক্তিফৌজের গেরিলারা গতকাল রাত্রে দক্ষিন-পশ্চিম খণ্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে জয়রামপুরের কাছে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে দর্শনার দিকে ট্রেনচলাচল বন্ধ হয়ে গেছ এবং পাকিস্তানের রসদ সরবরাহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

 বাংলাদেশের কোনো এক স্থান থেকে খবর পাওয়া গেছে যে, ২৫শে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং ৩০,০০০ সৈন্য আহত হয়েছে বলে বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট নেতা জানিয়েছেন।

-যুগান্তর, ১০ মে, ১৯৭১

বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ

 কৃষ্ণনগর, ১১ মে- বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে আজ মুক্তিফৌজ ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চালায়। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজ কমাণ্ডোরা রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলহাট ও অমরখানায় পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে যায়। মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো দলের আচমকা থানায় মোগলহাটে বহু পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়।

 দিনাজপুর জেলায় মুক্তিফৌজ পার্বতীপুর-সান্তাহা রেল রুটে পঞ্চবিবি ও জয়পুরহাট শহরে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে সাতজন পাকসেনা নিহত হয়। সেখানে মুক্তিফৌজ রেলওয়ে সিগন্যাল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়। নিকটবর্তী উরি রেলসেতুটিও বিধ্বস্ত। হিলির পাঁচ মাইল উত্তরে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটির কাছে গেরিলারা একটি ডিজেল ইঞ্জিন ও কয়েকটি বগি উড়িয়ে দেয়।

 পটুয়াখালী, ভোলা ও বরিশালে মুক্তিফৌজ সক্রিয়, তৎপর। দক্ষিণ-পূর্ব রনাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ফেনী এলাকায় শোভাপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে বহু পাকসৈন্য খতম হয়।

 মুক্তিফৌজ কমাণ্ডোরা কুড়িগ্রামে পাকিস্তানী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজের ১২ জন বন্দী জওয়ানকে ছাড়িয়ে আনে। ধরলা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমাণ্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে কমাণ্ডো দল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ভর্তি তিনটি জীপ আটক করে।

 আখাউড়া চেকপোস্ট থেকে মুক্তিফৌজ সরে গিয়েছে; আগরতলার খবর পাঁচদিন ধরে হানাদার বাহিনীকে বাধা দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চেকপোস্ট থেকে আজ বিকালে সরে গিয়েছে। মুক্তিফৌজ মহল থেকে বলা হয়েছে, সরে আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা ডজনখানেক পাকসেনাকে খতম করে। মুক্তিফৌজের একজন কমাণ্ডার জানান, রণকৌশলের অঙ্গ হিসাবেই এই পশ্চাদপসারণ।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ মে ১৯৭১

মুক্তিফৌজ এখনো প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন

 মুজিবনগর, ১৩ই মে (নিজস্ব প্রতিনিধি)- দক্ষিণ-পূর্ব রনাঙ্গনে কুষ্টিয়া জেলার দামুড়হুদা থানার অন্তর্গত কুতুবপুরে মুক্তিফৌজ ও পাক-সৈন্যের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে। কুতুবপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিফৌজ লক্ষ্য করেন যে, পাক-সৈন্যের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মুক্তিফৌজের আক্রমণে বহু পাকসৈন্য নিহত হয়। কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও মুক্তিফৌজের দখলে এসেছে। পাক-সৈন্যরা বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

 ইউ-এন আই’র সংবাদে প্রকাশ, মেঘালয়ের মুক্তপুরের বিপরীত দিকে অবস্থিত জয়ন্তিপুরে পাকসৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে আজ আবার প্রবল গোলাগুলি বিনিময় হয়েছে।

 বালকের কৃতিত্বঃ রানাঘাট, ১৩ই মে- গত রবিবার মুক্তিফৌজ ইছাখালীতে যে আটজন পাকসেনাকে মেশিনগানের গুলিতে খতম করতে সক্ষম হয় তার মূলে ছিল জনৈক গ্রামবাসী বালকের কৃতিত্ব। মেহেরপুর থেকে ওই গ্রামে এসে পাকসেনারা গ্রাম ঘুরে দেখে এক গাছতলায় ছ’জন অপেক্ষা করতে থাকে ও অপর দু’জন গাছে উঠে বাইনোকুলার দিয়ে গ্রামের চার ধার লক্ষ করছিল। সেই ঘটনা উক্ত বালকের নজরে পড়ে। সে তৎক্ষনাৎ মুক্তিফৌজের ট্রেঞ্চে গিয়ে সেই সংবাদ দিলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত তাদের আক্রমণ করে। এই সংবাদ জানা গেছে সদ্য আগত ই-পি-আর বাহিনীর জনৈক কর্মীর পিতার কাছ থেকে।

-যুগান্তর, ১৪ মে, ১৯৭১

গেরিলা আক্রমণে রেলপথ ও সেতু ধ্বংস, তামাবিল হাতছাড়া

 রায়গঞ্জ, ১৪ মে-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গত ৩ দিনে দিনাজপুর জেলায় রেলের ওপর কয়েক দফা গেরিলা আক্রমণ চালান বলে এখানে খবর পাওয়া গিয়াছে। গতকাল রাতে কমাণ্ডোরা হিলির কাছে চারখাই ও ডাঙ্গাপাড়া স্টেশনের মধ্যে রেলপথ উড়িয়ে দেন। বুধবার তাঁরা ধামাইরহাটের কাছে একদল পাকসেনার ওপর গুলি চালিয়ে ৪ জন সৈন্যকে খতম করেন। মুক্তিসংগ্রামীরা মঙ্গলবার জয়পুরহাটের কাছে ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেন এবং একটি পাওয়ার হাউস ধ্বংস করেন। তাছাড়া পাঁচবিবি স্টেশনের কাছে রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়।

 দু’শরও বেশী খানসেনা খতমঃ আগরতলা, ১৪ মে আজ গভীর রাত্রে মুক্তিফৌজের সূত্রে পাওয়া খবর, চট্টগ্রাম ও ফেনীর মধ্যে শুভপুর এলাকায় মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধে গতকালণ ২০০ জনেরও বেশী খান-সেনা খতম হয়েছে।

 কৃষ্ণনগরের খবরঃ স্বল্পবিরতির পর মুক্তিফৌজের গেরিলা ও কমাণ্ডোরা বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলির ওপর আবার আক্রমণ করেছেন।

 সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজের গেরিলারা গতকাল রাতে উত্তর পশ্চিম খণ্ডে কড়িগ্রামে পাকবাহিনীর ওপর দুবার আক্রমণ চালান। ৪ জন পাকসৈন্য নিহত এবং ৬জন আহত হয়। কিছু অস্ত্রশস্ত্রও গেরিলারা দখল করেছেন।

 মুক্তিফৌজের একদল কমাণ্ডো ১২ মে রাতে কুষ্টিয়া জেলায় মেহেরপুর থেকে ৩ মাইল দূরে কালাচাঁদপুরে রাস্তার ওপর একটি বড় কালভার্ট উড়িয়ে দেন।

 এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের উঃ পঃ সীমান্ত প্রদেশ থেকে আধা-সামরিক বাহিনীর লোকদের এনে পাকবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর একটি ব্যাটালিয়ানকে মোতায়েন করা হয়েছে। মেহেরপুর সীমান্তের পশ্চিম দিকে দৌলতদারের গ্রামে এবং চুয়াডাঙ্গা শহরে পাকসৈন্যদের একটি বিরাট দল ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে ৬০ টি ট্রাক।

 চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে পাকসেনাদের নৃশংসতাঃ কৃষ্ণনগরে আগত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছন, পাক টহলদার বাহিনী রোজ মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে ওঁৎ পেতে থাকে। তারা বেপরোয়াভবে নিরস্ত্র লোকদের হত্যা করে মৃতদেহগুলি গর্তে ফেলে দেয়। পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গা মহকুমার দুটি গ্রাম বাদে আর মব এলাকা তছনছ করে দিয়েছে। ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যামন তাদের দৈনন্দিন কাজ। পাকস্তানী বর্বররা বহু তরুণীকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। মেহেরপুরে দুটি গ্রামে হানা দিয়া পাক সেনারা ১২ জনকে হত্যা করেছে। প্রকাশ, মুক্তিফৌজ বিভিন্ন অঞ্চলে এর আগে যেসব পরিখা খুঁড়েছিলেন, নিহত ব্যক্তিদের মৃতদেহ ফেলে পাকসেনারা সেগুলি ভরে তুলছ।

 তামাবিল হাতছাড়াঃ ডাওকি থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়- তিনদিন প্রবল প্রতিরোধের পর মুক্তিফৌজ আজ তামাবিল থেকে হটে গিয়েছে। তামাবিল এখন পাকবাহিনীর দখলে। তামাবিল শ্রীহট্ট খণ্ডে বাংলাদেশের শেষ চেকপোষ্ট এবং ডাওবি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে।

 আজ বেলা দেড়টা নাগাদ মুক্তিফৌজ সুবিধাজনক স্থানে সরে যান। পাকসেনারা তামাবিল দখলের পর বাংলাদেশের পতাকা ফেলে দিয়ে পাকিস্তানী পতাকা তোলে।

-আন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ মে ১৯৭১

শুভপুর সেতুর দখল নিয়ে প্রচণ্ড লড়াই, দুশো পাক সৈন্য নিহত

 আগরতলা, ১৬ ই মে-দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার সংযোগরক্ষাকারী ফেনীর গুরুত্বপূর্ণ শুভপুর সেতুটির দখল নিয়ে মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইতে পাকবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্যের অন্ততঃ দুশোজন প্রাণ হারিয়েছে। গত দুদিন ধরে এখানে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

 বিলম্ব প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, গত ১৪ই মে মুক্তিফৌজের সঙ্গে ট্যাঙ্ক ও ভারী কামানের লড়াইয়ের পর পাকবাহননী এখানকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি দখল করে। এই যুদ্ধে মুক্তিফৌজের ৩৮ জন মারা যান। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীর সৈন্যদের বিপুল সংখ্যায় খতম করেছ।

 রাজশাহী অঞ্চলে মুক্তিফৌজ তিনজন পাকিস্তানকে শেষ করেছে। বরিশালে মুক্তিফৌজ এক পাক শিবিরের উপর হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ে এবং একজন অফিসার ও পাঁচজন সৈন্যকে খতম করে।

 ১১টি রেলসেতু ধ্বংসঃ পাকবাহিনী যাতে এগুতে নাপারে সে জন্য মুক্তিফৌজ গত দু’দিনে রংপুরের কাকিনা অঞ্চলে ১১ টি রেলসেতু ধ্বংস করেছে।

-যুগান্তর, ১৭ মে ১৯৭১

কমাণ্ডোদের চোরাগোপ্তা আক্রমণে বহু পাকসৈন্য খতম

বহরমপুরে (পঃবঙ্গ), ১৭ মে (পি টি আই) গতকাল মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা রাজশাহীতে আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে অন্তত ২৫ পাকিস্তানী সামরিক শিক্ষার্থীকে খতম করেছে। আহত করেছে ৭০ জনকে। ওপার বাংলাদেশ থেকে পাওয়া এক খবরে আজ বলা হয়েছে যে, কমাণ্ডোরা মর্টার ও হালকা মেশিনগান নিয়ে আকস্মিকভাবে রাজশাহী পুলিশ লাইনে হানা দিলে উক্ত সামরিক শিক্ষার্থীদের মৃত্যু ঘটে। তাছাড়া একটি পাকিস্তানী ট্রাক ও প্রচুর পরিমাণ গোলা-বারুদ ও ধ্বংস হয়। পাকিস্তানী সেনারা পাল্টা মর্টার ও ভারী কামান দাগালে কমাণ্ডোরা পালিয়ে যায়। তাদের কোনও ক্ষতি হয়নি।

 আগরতলা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা গতকাল ও আজ বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব খণ্ডে বিভিন্ন সৈন্য ঘাঁটিতে হানা দিয়ে ৬টি জল ও স্থলচর ট্রাক দখল করেছেন। তাছাড়া, একটি ট্রাক ধ্বংস করে প্রায় ৮০ জন সেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিফৌজের সহিত সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ মহলের সুত্র থেকে পাওয়া আরও সংবাদে জানা গিয়েছে যে, কুমিল্লা জেলার কসবায় মুক্তিফৌজের সহিত সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ মহলের সুত্র থেকে পাওয়া আরও সংবাদে জানা গিয়েছে যে, কুমিল্লা জেলার কসবায় মক্তিফৌজ তিনটি পাকিস্তানী সামরিক ট্রাক দখল করে নিয়েছেন। হঠাৎ হানা দিয়ে কমাণ্ডোরা একজন ক্যাপ্টেন সমেত ২৮ জন সৈন্যকে খতম করেছেন।

 শ্রীহট্ট সেক্টরে ৬০ জন সৈন্যসহ একটি ট্রাক ধ্বংস হয়েছে এবং ৩টি ট্রাক কমাণ্ডোদের দখলে এসেছে। তবে শেষোক্ত ক্ষেত্রে কোনও সৈন্যহানি না হলেও পলায়নপর সৈন্যরা প্রচুরসংখ্যক মাঝারি মেশিনগানের বুলেট ও কয়েকটি বন্দক ফেলে রেখে যায়। ঐ একই সুত্রে জানা যায় যে, মক্তিযোদ্ধারা লাকসাম-নোয়াখালী রোডে রাখীর কাছে একটি সেতু উড়িয়ে দেন।

 ইতিমধ্যে আগরতলা থেকে আর একটি খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনারা সীমান্ত পেরিয়ে যাবার সময় দু’টি পরিবারের ১৩ ব্যাক্তিকে গুলি করে খুন করেছে।

 পি-টি-আই’র এক খবরে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে রংপুর খণ্ডে স্বধীনতা যোদ্ধারা রামনগর এলাকায় একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে একজন পাকিস্তানী মেজরকে সাবাড় করেন। এই আক্রমণে কয়েকজন পাকসৈন্য আহত হয়। লালমনিরহাট এলাকায় মুক্তিফৌজ হাতবান্দা ও বাউরার মধ্যে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়।

 ফেনীর দক্ষিণে পাক-সেনদের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ পি-টি-আই’র খবরে আরও জানা যায়, যে কুমিল্লা খণ্ডে মুক্তিফৌজ ফেনির ২০ কিলোমিটার দক্ষিনে একটি স্থানে একটি পাকিস্তানী সেনাদলের উপর আক্রমণ চালালে সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। গঙ্গাসাগর এলাকাতেও পাক-সেনাদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের গুলি বিনিময় হয়।

 আগরতলা থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছেঃ সীমান্তের ওপর থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়েছে যে, মাধবপুর-শ্রীহট্ট সড়কে মুক্তিফৌজদের গেরিলা বাহিনী গত ক’দিনে পাকসেনাদের দুটি কনভয়ের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১২০ জন পাকসৈন্যকে খতম করেছেন। প্রথম কনভয়টি আক্রান্ত হয় শ্রীহট্টের নালুয়া গ্রামের নিকট। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এই আক্রমণে প্রায় ৭০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়।

-যুগান্তর, ১৮ মে ১৯৭১

এক সপ্তাহের লড়াইয়ে আরও সহস্রাধিক শত্রুসৈন্য নিহত

 আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট- কুমিল্লা, চট্টগ্রাম-নোয়াখলী, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গণে দিনের পর দিন পাক-ফৌজের উপর গেরিলা কৌশলে চোরাগোপ্তা কখনো ঝটিকা বা অতর্কিত হামলা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে গত এক সপ্তাহে অন্তত আরো এক সহস্র পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।

 গত ৯ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউড়া সাব-সেক্টর এবং বিবিরবাজার এলাকায় পাকফৌজের উপর এক অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী আক্রমণের ফলে পাকহানাদার বাহিনীর ৩ শত সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্য বিবিরবাজার থেকে সোনামুড়া সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী সাফল্যের সাথে তাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করে দেয়।

 একই দিনে মুক্তিবাহিনী রংপুর জেলার দুর্গাপুর থানায় পাকফৌজের একটি ঘাঁটির উপর আকস্মিক হামলা চালায়। গেরিলা কৌশলের আক্রমণে পাক-ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং এলোপাতাড়ি গোলাগুলী ছুড়তে থাকে। কিন্তু তবুও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ। মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক-ফৌজের ৬ জন সৈন্য প্রাণ হারায়।

 মুক্তিফৌজ মেহেরপুরের উপকণ্ঠে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে পাক-হানাদার ঘাঁটির উপর শেষ বর্ষণ করে। অন্যদিকে ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্তস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ বেশ কয়েকজন জল্লাদবাহিনীর সৈন্যকে হত্যা করে।

 মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দক্ষিণ- পশ্চিম খণ্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে জয়রামপুরের কাছে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দর্শনার দিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং পাকবাহিনীর রসদ সরবরাহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

 গত ১০ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউড়া সেক্টরে পাক-ফৌজের উপর আকস্মিকভাবে এক বিরাট হামলা চালায়। এই সেক্টরের প্রচণ্ড লড়াই য়ে ৪ শত খান সেনা খতম হয়েছে। এ ছাড়া পাক-ফৌজের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার হস্তগত করেছে।

 এদিকে সিলেট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তেলিপাড়া এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক ফৌজের প্রচণ্ড লড়াই বাধে। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানটি পূর্ণদখল করার জন্য পাক ফৌজ প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। এই সংঘর্ষে ১২জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে দুজন অফিসারও আছে।

 ইয়াহিয়া-টিক্কার জল্লাদ বাহিনী কুমিল্লা জেলার তিতাস প্লাণ্টটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প-কারখানাগুলো অচল হয়ে পড়েছে।

 মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর সেতুতে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর উপর এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাদেরকে দিশেহারা করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও ৬০ জন পাকফৌজের ৭টি গাড়ীতে অগ্নিসংযোগ এবং তিনটি বাংকার ধ্বংস করে দেয়া হয়।

 মুক্তিবাহিনী গত মঙ্গলবার রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলাই ও ওমর থানায় পাকসৈন্য ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমন চালায়। মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে মোগলহাট পাকফৌজ হতাহত হয়। দিনাজপুরে মুক্তিবাহিনী পার্বতীপুর-সান্তাহার রেল-রুটে এবং পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট শহরে পাকফৌজের ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে ৭ জন পাক হানাদার খতম হয়েছে।

 মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা কুড়িগ্রামে পাকঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজের হাতে বন্দী ১২ জন মুক্তিসেনাকে ছিনিয়ে আনে। এছাড়া ধারলা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমাণ্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

 গত ১২ মে মুক্তিবাহিনী কসবা অঞ্চলে পাকফৌজের উপর হামলা চালান। মুক্তিবাহিনী এখানে দু’মুখী এমন আক্রমন চালান যে পাকপৌজ দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে এই ভয়াবহ আক্রমণে একশত ২৭ জন পাকফৌজ নিহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজরও ছিলেন।

-জয়বাংলা,১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯ মে ১৯৭১

মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা নাজেহাল

 আগরতলা, ১৮ই মে (পিটিআই)- গতকাল কুমিল্লা জেলায় মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো আক্রমণে আড়াই শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিফৌজের জনৈক কমাণ্ডার জানান, পাকসেনাদের কয়েকটি দল যখন লাকসাম থেকে ফেনী যাচ্ছিল, সেই সময় তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমন চালানো হয়।

 ইউ-এন-আই জানাচ্ছেঃ গত রবিবার সকালে মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা রাজশাহীতে পাক-বাহিনীকে আক্রমণ করলে প্রায় ৫০জন পাকসৈন্য নিহত হয় বলে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে। প্রায় চারঘণ্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে মুক্তিফৌজের হতাহতের সংখ্যা খুবই নগণ্য। গত চারদিনে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা বাহিনী হানা দেয়। শিবগঞ্জ থানা এলাকায় সোনামসজিদে পাক বাহিনীর ওপর গেরিলারা আক্রমণ করলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং ৫জন আহত হয়। পাক-বাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগের মুসলীম লীগ ও জামাতে ইসলামীর ১১ জন সদস্য মনাকশায় মুক্তিফৌজের হাতে প্রাণ হারায়।

-যুগান্তর, ১৯ মে, ১৯৭১

গেরিলা বাহিনীর হাতে ৬১ জন পাকসেনা খতম

 কৃষ্ণনগর ২০ শে মে (পিটিআই)- বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকসৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের গেরিলাবাহিনীর সংঘর্ষে অন্তত ৬১ পাকসৈন্য খতম হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গিয়াছে। আজ সকলে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় মুক্তিফৌজ কমাণ্ডাদের আক্রমণে দু’জন পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।

 জলপাইগুড়ি থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছন যে, উত্তরবঙ্গে মুক্তিফৌজ আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং পাঁচগড় ও অমরখানায় পাকবাহিনীর ওপর বেশ কয়েকবার অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছে। পাকসৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, পাকসেনারা দিনাজপুরের বিভিন্ন পুকুরে সাঁতার শিখছে। ঠাকুরগাঁয়ে অবস্থিত পাক সেনারা একটি গীর্জা বাড়ীকে রান্নঘরে রূপান্তরিত করেছে।

-যুগান্তর ২১ মে ১৯৭১

ঢাকায় গ্রেনেড আক্রমণের কথা পরোক্ষে স্বীকার

 নয়াদিল্লী, ২১মে (পি টি আই) - বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক খোদ ঢাকা শহরের বুকে গেরিলা আক্রমণ চালাবার যে সংবাদ ইতিপূর্বে ভারতে এসে পৌছেছিল পাকিস্তান পরোক্ষে তা স্বীকার করেছে। আজ সকালে পাক বেতার থেকে বলা হয়, সামরিক আইন প্রশাসক এ বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, নাশকতার কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ওই ঘোষনায় আরও বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে কাউকে হাতগ্রেনেড ছোড়ার সময় ধরা হলে তাকে ওই শাস্তি দেওয়া হবে।

 পাক কর্তৃপক্ষের ওই সতর্কীকরণে আরও বলা হয়েছেঃ শান্তিপ্রিয়, নাগরিকদের মনে অভাব ও ভীতির অবস্থা সৃষ্টির জন্যই ঢাকায় এই হাত বোমা ছোঁড়ার ঘটনা ঘটছে। নাশকতার কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ধরিয়ে দিলে পুরষ্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

 বেতার ঘোষণায় আরও বলা গয়েছে যে ঢাকা শহরে গ্রেনেড ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দশ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সপ্তাহের গোড়াতে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো দল ঢাকায় গভর্নরের বাসভবন, সিভিল সেকরেটারিয়েট ও নিউ মার্কেটে মুসলিম কমারশিয়াল ব্যাংকের ওপর হানা দিয়েছে।

-আন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে মে, ১৯৭১

স্টীমার আটক করে ১৭ জন পাকিস্তানীর প্রাণদণ্ডাদেশ

 রাওয়ালপিণ্ডি, ২৩ মে (এ,পি) বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ যাত্রীবাহী স্টীমার রকেটটি আটক করেছে এবং গণআদালতে বিচার করে ষ্টীমারের অবাঙ্গালী যাত্রীদের ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। গতকাল কূটনৈতিক মহলইে খবর দিয়েছে।

 তাঁরা বলেছেন, সেনাবাহিনী যদিও বলছেন সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ করা হয়েছে তবু ওখানে যে এখনও প্রতিআক্রমণ চলছে এটাই তার বড় প্রমাণ।

 ওই মহলেরই খবরঃ এই ধরনের ঘটনাগুলি ওখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছ। কোন রাজনীতিক সামরিক শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না এবং যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী পূর্ববাংলায় অসামরিক কাজকর্মে লিপ্ত তাঁরা ও নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত।

 ওয়াকিবহাল মহলের খবরঃ মুক্তিবাহিনী মে মাসের গোড়ার দিকে স্বীমারটিকে আটক করে। স্টীমারটি ঢাকা ও খুলনার মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, খুলনাই শেখের নিজস্ব অঞ্চল।

 তাঁরা কালিয়া থানার জয়নগর হাইস্কুলে আয়োজিত গণআদালতে ১৭ জনকে বেছে নিয়ে বিচার করেন। একজন প্রতক্ষদর্শীর খবর, ১৭ জনের মধ্যে ১২ জনের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪মে, ১৯৭১

নারায়ণগঞ্জ শহরে মুক্তিফৌজ গেরিলা ‘সক্রিয়’

 আগরতলা ২৩ মে (পি টি আই)- সীমান্তের ওপার থেকে এখানে বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ শহরে মুক্তিফৌজ গেরিলারা ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠছে। জানা গেল, মুক্তিফৌজ গেরিলাদের হাতবোমায় সম্প্রতি ইনল্যাণ্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি টারমিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকায় শাহজাহানপুর কমাঞ্জেরা পাকসেন্য বোঝাই ২টি জীপ উড়িয়ে দেয়।

 আর এক মহল থেকে এই মর্মে খবর পাওয়া গিয়াছে সামরিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অবাঙ্গালী তাঁবেদাররা সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে লক্ষীনারায়ণ কটন মিলের বহুসংখ্যক কর্মীকে খুন করেছে। মিলের ম্যানেজার ও মেডিক্যাল অপিসারও রেহাই পাননি।

-যুগান্তর, ২৪মে, ১৯৭১

জীবন দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ

 মুজিবনগর, ২৪মে (পি টি আই)- ওরা পশ্চিম বাংলাদেশের রংপুর শহরের পাঁচজন ছাত্র। তাঁরা দেখেছেন, পাকসেন্যরা তাদের মা-বাবাকে হত্যা এবং নারীদের শ্লীলতাহানি করছে। তাঁরা সংকল্প করলেন, যেভাবেই হোক এই নারকীয় হত্যার প্রতিশোধ তাঁরা নেবেন। তাঁরা মরণপণ করে একটি কমাণ্ডো দল গঠন করলেন। শত্রুখতম করাই হল তাঁদের লক্ষ্য।

 মুক্তিফৌজ থেকে তাঁরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও হাতবোমা সংগ্রহ করলেন। অদিতমারি ও লালমনিরহাটের মধ্যবর্তী রেল লাইনের একাংশকে তারা উড়িয়ে দিলেন। ঠিক সে সময় পাকসৈন্যবাহী একটি ট্রেন পুরো বেগে ঐ লাইনে যাচ্ছিল।

 ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয় এবং বহু পাকিস্তানী সৈন্য নিহত কিংবা আহত হয়। কিন্তু দু’জন কমাণ্ডোকে গুলী করে হত্যা করে।

 দু’জন সহকর্মীকে হারিয়ে বাকী তিনজন কমাণ্ডোর সংকল্প আরোও দৃঢ় হল। তাঁরা লালমনিরহাট বিমানঘাঁটির দিকে রওয়ানা হলেন। তাঁরা দেখলেন একটি পাকিস্তানী জেট বিমান নামছে। একজন হাল্কা মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়লেন। বাকী দ’জন বিমানঘাটি লক্ষ করে বোমা নিক্ষপ করলেন। বিমানঘাঁটির বেশ ক্ষতি হয়েছে।

 এবারও তাঁরা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেন না। পাকসৈন্যরা দ’জনকে গুলি করে মারল। আহত অবস্থায় আর একজন কোনও প্রকারে পালিয়ে একটি গ্রামে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। গ্রামের এক বৃদ্ধ আহতকে সেবা ও করেছিলেন, কিন্তু পরে তার মৃত্যু ঘটে।

-যুগান্তর, ২৫মে, ১৯৭১

খোদ ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর হামলাঃ এক সপ্তাহে

আরো ৬ শত শত্রুসৈন্য খতম

 গত এক সপ্তাহের সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর হাতে আরও ৬ শতাধিক শত্রুসৈন্য প্রাণ হারায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় গভর্নর হাউস, দৈনিক পাকিস্তান, সেক্রেটারীয়েট ভবন ও নিউ মার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে হাতবোমা দিয়ে আক্রমন চালায়।

 কুমিল্লা- চট্টগ্রামের সংযোগকারী শুভপুর সেতু দখলের জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গত ১৪ ই ও ১৫ই মে-র লড়াইয়ে প্রায় দু’শ খানসেনা খতম হয়েছে। রাজশাহী শহরের কালীহাটায় পুলিশ লাইনে গেরিলারা দখলদার সৈন্যদের উপর হামলা চালায়। ১৬ই মে মুক্তিবহিনীর কমাণ্ডোরা বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বিভিন্ন সৈন্য ঘাঁটিতে হামলা চলিয়ে ৬টি স্থল ও জলযান দখল করে নিয়েছে। এছাড়া একটা ট্রাক ধ্বংস করে প্রায় ৮০ জন সৈন্যকে খতম করা হয়। কুমিল্লা জেলার কসবায় মুক্তিফৌজ ৩টি পাকিস্তানী সামরিক ট্রাক দখল করে নেয়। এই হামলায় একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৮ জন সৈন্য খতম করা হয়। উত্তরপশ্চিমে রংপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী রামনগর এলাকায় একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে একজন মেজরসহ কয়েকজন পাকফৌজ হতাহত করে।

 মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তাছাড়া সড়কের সেতুগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। গত ১৭ই মে দিনাজপুর জেলার হাতীডাঙ্গায় মুক্তিবহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণে ক্যাপ্টেন পদতুল্য একজন অফিসারসহ ৩৫জন পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চল সেক্টরের আখাউড়ায় এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে গত ১৯শে মে ও ২০শে মে ৪০ জন শত্রুসেনাকে খতম করেছে। এছাড়া ঐদিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার ব্রাহ্মণপাড়া ও জীবনগরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনার মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী দুটি সড়কের কালভার্ট উড়িয়ে দেয়। গত ১৯ শে মে কুষ্টিয়া জেলার কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত ফাড়িটি দখল করে।

 গত ১৮ই মে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডোরা দক্ষিণে রেলপথ উড়িয়ে দেয়। গেরিলারা যশোরের একটি রেলসেতু ধ্বংস এবং খুলনার একটি রেল ষ্টেশনের ক্ষতি সাধন করেছে। ময়মনসিংহ সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তিলাকালীতে এক প্লাটুন পাক সৈন্যের ওপর হামলা চালায় এবং উক্ত এলকার একটি সেতু ধ্বংস করে। সিলেট জেলার শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছে। সাতক্ষীরা মহকুমার ভোমরায় মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকফৌজ দিশেহারা ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঐখানে বেশকিছু সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়েছে। গত ১৯শে মে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনাদের গেরিলারা আকস্মিক হমলা চালিয়ে রংপুর ও সৈয়দপুরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কসেতু উড়িয়ে দেয়। বগুড়া জেলার জয়পুরহাটের কাছে মুক্তিবাহিণী ৩৪ জন পাকসেনাকে খতম করে। এছাড়া তারা অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ৩টি ট্রাক দখল করে।

-জয়বাংলা, ১মবর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ২৬ মে, ১৯৭১

তামাবিল ঘাঁটি আবার মুক্তিফৌজের দখলে

 ডাউকি (মেঘালয়), ২৬মে (ইউএনআই ও পি টি আই)- আজ ৬ঘণ্টা তুমুল লড়াই-এর পর মুক্তিফৌজ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ভরতীয় সীমান্ত সংলগ্ন তামাবিল ঘাটি থেকে হটিয়ে দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা হটে যাবার পর মুক্তিফৌজের সেনানীরা তামাবিল ঘাঁটির উপর বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। এখান থেকে ঐ পতাকা দেখা যায়। প্রকাশ ঐ ঘাটি থেকে মুক্তিফৌজের সেনারা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছেন। মুক্তিফৌজ মহলের খবরে জানা যায় তামাবিলের লড়াইয়ে পাকিস্তানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

 গতকাল মাঝরাত্রি থেকে লড়াই শুরু করে এবং আজ সকাল ৬টায় লড়াই শেষ হয়। গত ১৪মে পাকিস্তানী সেনার ঐ ঘাঁটিটি দখল করে নিয়েছিল। তামাবিল ঘাঁটি ছেড়ে পালাবার আগে পাকিস্তানী সেনারা তাদের পক্ষের নিহতদের মৃতদেহগুলি নিয় চলে যায়। প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনারা পিছু হটে শ্রীপুর চা বাগানের দিকে চলে গেছে।

 গত রাতে দিনাজপুরে মুক্তিফৌজের আক্রমণে ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকিস্তানী সেনারা যখন দুটি মিলিটারী ট্রাকে করে ফুলবাড়ি এলাকা যাচ্ছিল তখন মুক্তিফৌজ অতর্কিত তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।

 মুক্তিফৌজের সেনানীরা দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও এলাকায় সেতাবগঞ্জ ও পীরগঞ্জের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে অন্যান্য এলাকায় মুক্তিফৌজ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম এলাকার কুলাঘাটের কাছে গত রাত্রি থেকে মুক্তিফৌজ ও পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭শে মে, ১৯৭১

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের সফল সংঘর্ষ

 কলকাতা, ২৭শে মে (ইউ, এন, আই)- বাংলাদেশের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে মুক্তিফৌজ তিনদিন ধরে পাক হনাদার বাহিনীর সঙ্গে সফল সংঘর্ষ চালাচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে, রাজশাহী খণ্ডে আহত পাকসেনা বোঝাই দুটি নৌকা আক্রমণ করে চারজন শত্রুসেনাকে খতম করেছে। মহেরপুর, বগুড়া, মোগলহাট এবং বরিশালেও সংঘর্ষ বাধে। পাকসেনা খতমের হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। খুলনা জেলায় পাকবাহিনীর তাঁবেদার লাগিয়ে ফসল কাটাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে পাকসেনাদের অত্যাচার ও হত্যালীলা বৃদ্ধির পথে। সম্প্রতি ত্রিশ হাজার সাঁওতাল বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।

 বাংলাধেশের মুক্তিফৌজ আজ বিকালে শ্রীহট্টের শ্রীপুর চা-বাগান থেকে পশ্চিমা পাক হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করছে। এই সংঘর্ষে বেশকিছু সংখ্যক পাক সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী দুই ট্রাক ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছে বলে বাংলাদেশের সূত্র জানা গেছে। শ্রীপুর চা বাগান বাংলাদেশের তামাবিলের চার কিলোমিটার দক্ষিণে। গতকাল মুক্তিফৌজ তামাবিল সীমান্ত ফাঁড়িটি দখল করার সময় বিপুল সংখ্যক পাক ফৌজ নিহত হয়।

 শিলিগুড়ি নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, গতকাল দিনাজপুর জেলার পঁচাগড় থানা এলাকার অমরখানা সীমান্ত চৌকির দিকে আগুয়ান একদল পাকসেনার ওপর মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা পচণ্ড আক্রমণ চালায়।

 ভরতীয় সীমান্তের গ্রাম চাউলহাটির বিপরীত দিকে এখান থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে এই অমরখানা অবস্থিত। মুক্তিফৌজের আঘাতে চারজন পাকসেনা মারা পড়ে।

-যুগান্তর, ২৮ মে, ১৯৭১

GUERILLA ACTIONS INTENDIFIED

150 PAK TROOPSKILLED

MUJIBNAGAR (Bangladesh), May 28 - About 150 West Pakistani armymen were killed in a bitter fight with the Mukti Font on the Dharla river in th Rangpur sector early this week, reports PTI. reports available here said that tje Pakistani Army shelled Mukti Fouj position on the north bank of the Dharla river and tried to cross over to the other said. The Mukti Font offered stiff redidtance abd foiled the attempts of Pakistan Army to cross river, inflictibng heavy csualt on the enemy.

 In another incident in the sylhet sector in May 26, the Mukti font ambushed a convoy killing 25 Pakistani troops and injuring 14 others. One truck and one jeep were damaged. The Mukti Fouj also raided Rema tea estate in the same sector. Pakistani troops took their heels leaving two vehicles which were captured by the liberation forcer.

 Two Pakistni solders were killed when the student - fighter of the mukti Fouj lobbed a grenad on them in sumbrum area of chittgong on the night of May 23. on the same night the Mukti Fouj destroyed a bridge on the Muhuri river near Chhagalnaiya.

 In Mymensing, the Mukti Fouj attacked Pakistani army poisitionat at Bhotikhli and belew up a bridge at Joynaiapur in Sylhet clor.

 In Comilla sector, the freedom fighters raided Bajitpur police station and took away all armd from the armony there.

 There was heavy fighting between the Pakistani toorps and the Mukti Fouj in Pateswari Ghat in Rangpur. Casualty, if any, was not know.

 Our shillong office adds the biggest bridge on the Dawk-Sylhet road, sari bridge, has been blown off yesterday by valian Mukti Fouj Commandos after a free fight with the pakistani troops.

 Pak troops are now completely out off from the mainland of Sylhet, Official source said here that concentration of Pakistani troops were seen in Goalpara- an East Pakistan border.

 Dhruba Majumdar at Dawki writes, Tamabil and Sripur, two strongholds of the Pakistani army were captured by the Multi Fouj after a heavy battle. Jayantapur about 18 miles from the international border also fell in the hands of the Mukti Fouj after a grim fight today. the Mukti Fouj has began their attack on the Pakitani Army at Hairpur about 10 miles from the border.

 The situation of the Libaration war in the Sylhet sector of Bangladwesh remaind very fluid on Friday. The Pak army were in the Sylhet sector of Bangladesh remained very fluid on Friday. The Pak army were losing grounds and the Mukti Fouj went on winning but none of them could be sure about how of thge acquired territory they will be able to retain.

-Hindusthan standard, 29 May, 1971

মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণে শত্রুসৈন্য অতিষ্ঠ

 আগরতলা, ২৯ শে মে (পিটিআই)- মুক্তিফৌজের গেরিলা ও কমাণ্ডোরা ও শ্রীহট্ট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী সেক্টরে পাকসেনাদের ঘাটিগুলির উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন। আজ এখানে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, শ্রীহট্টে মুক্তিফৌজের আচমকা আক্রমণে ৪০ জন পাকসেনা খতম হয়, তিনটি মোটরযান বিধ্বস্ত হয় এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ মুক্তিফৌজের হস্তগত হয়। প্রকাশ, দু’জন পাক অফিসার ও ৭০ জন পাকসৈন্য মারা গেছে।

 মুক্তিফৌজের গেরিলারা গত ২৫ শে মে রাত্রিতে কুমিল্লা সেক্টরে সৈদামানিতে পাকসৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান এবং ২৫ জন পাকিস্তানীকে খতম করেন। এই আক্রমণে ১৪ জন পাকিস্তানী আহত হয় ও একটি পাকিস্তানী জীপ ও একটি ট্রাকবিধ্বস্ত হয় এবং ধর্মনগরে দুটি বিনষ্ট হয়।

 নোয়াখালী জেলার ফেনী এলাকায় মুক্তিসেনারা পাকন্যৈদের তিনটি ঘাটির উপরও আক্রমণ চালায়। বহু পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়।

 মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা যশোর এলাকার উথালিতে দুটি রেলসেতু এবং রংপুর সেক্টরে হিলি ও সান্তাহারের মধ্যে ১ টি রেলসেতু উড়িয়ে দেন। রংপুর জেলার তাজপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিসেনাদের সংঘর্ষ হয়।

 মুজিবনগর থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছে, মুক্তিফৌজের গেরিলা সৈন্যরা উত্তর ও পশ্চিম রণাঙ্গনে বিগত ৪ দিনে কয়েকটি সড়কপথ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় কয়েকটি স্থানে পাকসৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

 কয়েকবার আচমকা আক্রমণে তাঁর অন্ততপক্ষে ৮১ জন পাকসৈন্যকে খতম করেন।

 মুক্তিসেনারা বিরল ও কাঞ্চনপাড়া স্টেশনের মধ্যে রেল-লাইন বিধ্বস্ত করে দেন। পশ্চিম রণাঙ্গনের তুলাই ও কিশোরীপুরের মধ্যেও তাঁরা রেলপথ অকেজো করে ফলেন। রংপুর সেক্টরে পাকসৈন্যবাহিনীর একখানি ট্রেন আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনখানি স্বর্ণমতির দিক যাচ্ছিল। এই ঘটনায় অন্তত ১০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

-যুগান্তর, ৩০ মে, ১৯৭১

‘আমরা ক্ষান্ত হব না’: গৌরকিশোর ঘোষ

 বুধবার হঠাৎ যখন তাদের সঙ্গে দেখা হল, তখন বেলা সাড়ে চারটা; গরমে গলগল করে ঘামছি; ওরা, মুক্তিফৌজের শ্রান্ত সৈনিকেরা খোলা জীপ নিজেদের ঘাটিতে ফিরে আসছেন, সারারাত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করে। আগের রাতে আমার পৌছতে দেরি হয়েছিল, তাই ওদের সঙ্গে নিতে পারিনি।

 দেখে আশ্চর্য লাগে, পাকিস্তান সরকারের এত সোচ্চার প্রচারের পরও বেনাপোলে পাকিস্তানের ঘাঁটির শীর্ষে এখনও বাংলাদেশের জয়বাংলা পতাকা পতপত করে উড়ছে।

 দিনের বেলা এলে ছবি নিতে পারতেন। মুক্তিফৌজের ঘাঁটিতে একজন বললেন। বললেন, তাঁদের যারা মনে করছেন আমরা শেষ হয়ে গেছি, আমরা এখনও শেষ হইনি। মাতৃভূমির দখল নেবার আগে আমরা ক্ষান্ত হব না।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মে, ১৯৭১

MUKTI FOUJ KILLS 100 PAKISTANI SOLDIERS

 MAY 30- With its intrnsified cimmando activity, the Mukti Fouj continued to harass the Pakistani Army during the past 48 hours. At several places from feni in the south to Ashuganj in the north, the Mukti Fouj inflincted heavy casulties on Pakistani troops. according to the reports available acroos the border, Besides, 100 Pakistani sollders, including 40 officers, were ambushed and killed by Mukti Fouje.

 The freedom fighters also blew up three rail and one road bridges, damaged railway engine, and destroyed two moptors and several vehicles.

 Rail communication from Comilla to Ashuganj is still disrupted after the successful demolition of the rail bridge at several places.

-Hindusthan Standard, 31 May, 1971

ভারতীয় এলাকায় পাকসেনাদের গোলাবর্ষণ অব্যাহত

 কলকাতা, ৩ জুন- পাকস্তানী সেনারা ভারতীয় এলাকার মধ্যে অসামরিক অঞ্চলসমূহ যথারীতি গোলাগুলি বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউএনআই জানাচ্ছে গতকাল কোচবিহার জেলার সীমান্তবর্তী চারটি গ্রামে পাকসেনাদের গোলাবর্ষণে একজন গ্রামবাসী আহত হয়। গত চারদিন ধরেই পাকসেনারা এই গ্রামগুলিতে প্রচুর গোলাগুলি চালাচ্ছে। ফলে এক বিরাটসংখ্যক মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

 আসামের গোয়ালপাড়া জেলার সোনাহাট ও তৎসন্নিহিত গ্রামগুলিতে গত রাতে পাকসেনারা কামান থেকে গোলা চালায়। সরকারী সূত্রের রিপোর্টে জানা যায় যে গতকাল সকাল সকাল ১১টা থেকেই পাকসেনারা ঐ অঞ্চলে মারাত্বকভাবে গুলি চালাতে শুরুকরে এবং আজ সকাল পর্যন্ত চালায়।

 মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বহু পাকসৈন্য খতমঃ সীমান্তের ওপর থেকে জলপাইগুড়িতে প্রাপ্ত সংবাদে বলা হয় যে, গত ২৪ ঘণ্টয় বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী উত্তর রনাঙ্গনে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। কোচবিহারের অপর পারে ভুরুঙ্গামারির সীমান্ত চেকপোষ্ট থেকে তাঁরা ইয়াহিয়া বাহিনী উত্তর রণাঙ্গনে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। কোচবিহারের অপর পারে ভুরুঙ্গামারির সীমান্ত চেকপোস্ট থেকে তাঁরা ইয়াহিয়া বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এখানকার যুদ্ধে কমপক্ষে সাতজন খান সেনা নিহত হয়।

 চিলাহাটি ও ডোমার ও এর মধ্যে তিস্তার উপর এবং কাকিনা ও ভূষিরবন্দর- এর মধ্যে সানায়াজনসন নদীর উপর মোট ৩ টি সেতু মুক্তিসেনারা ধ্বংস করে দেয়। ফলে লালমনিরহাটের দিকে পলায়নপর খানসেনাদের একটি দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দিনাজপুর জগদলে আগুয়ান পাক সেনাদলকে মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দেয় এবং ঠাকুরগাঁ পাওয়ার হাউসটি ক্ষতিসাধন করে। এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে বহু পাকসেনা নিহত হয়েছে। রংপুর জেলার ডিমলা ও বয়রাতে ইয়াহিয়ার সাতজন গুপ্তচরকে মুক্তিযোদ্ধারা খতম করে এরা মুসলিম লীগ ও জামাত-ই ইসলামী দলের লোক বলেও প্রকাশ।

-কালান্তর, ১জুন, ১৯৭১

চুকনগরে পাকসৈন্যের বেপরোয়া গুলি

 হাকিমপুর ৩১ মে (সংবাদদাতা)- পাকিস্তানী সামরিক বর্বরতা অবশেষে সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। গত ২০ মে খুলনার বৈঠাঘাটা, ফকিরহাট, রামপাল, নকিপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় লক্ষের মত অসহায় মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসার সময় চুকনগরে বর্বর বাহিনী তাঁদের ওপর মেশিনগান দিয়ে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে সেখানে বহুসংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়।

 ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, খুলনার দক্ষিণাঞ্চল থেকে আনুমানিক দেড় লক্ষ মানুষ সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গত ১৯মে কয়েক হাজার নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চুকনগরের নিকটবর্তী নদীর ওপরে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পদব্রজে রওয়ানা হয়ে যায়। চুকনগরে তারা মিলিটারীর সম্মুখীন হয়ে। সে সময় পিছনে যারা তাঁরা মেশিনগানের শব্দ শুনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। চুকনগরের বাজারের বিভিন্ন ঘরগুলোতে শরণার্থীরা আশ্রয় নিলে বর্বর বাহিনী সেখানে গিয়ে ঘর থেকে বের করে তাদের অনেককে হত্যা করে।

 সীমান্ত অতিক্রম করার পর শতাধিক আহতকে হাকিমপুরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। ২২ তারিখে গুলিতে আহত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড়শত বলে হাকিমপুরের মুক্তিফৌজের চিকিৎসক জানান।

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা

 আগরতলা, ১জুন (ইউএনআই) মুক্তিফৌজ গেরিলা বাহিনী শ্রীহট্ট সেক্টরের তেলিপাড়া ও আখাউড়ার মধ্যে সংযোকারী রেল সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছে। গেরিলা বাহিনী এই স্টেশন দ’টি দখলের জন্য পাকফৌজের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।

 একটি পাকিস্তানী জীপগাড়ির ওপর গেরিলা বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে শত্রুপক্ষের ২ জনকে খতম করে। কুমিল্লা সেক্টরে গেরিলাবাহিনী রেল ইঞ্জিন ও ওয়াগনকে লাইনচ্যুত করে দিতে সক্ষম হয় বলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধাদের সংবাদে প্রকাশ। ময়মনসিংহ সেক্টরে গেরিলা বাহিনী পাকফৌজের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ৭ জন পাকসৈন্যকে সশস্ত্র অবস্থায় গ্রেফতার করে। পাক ঘাঁটির পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে গেরিলারা সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

-কালান্তর, ২, জুন ১৯৭১

কমাণ্ডো আক্রমণে পাকসৈন্য মরছে

 আগরতলা ৩রা জুন (ইউএন আই) বিভিন্ন স্থানে পাকসৈন্যের ওপর মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো আক্রমণে আবার জোরদার হয়ে উঠছে। গজারিয়া, চাঁদহাট, রাজানগর ও ফরিদপুর এলাকায় মক্তিফৌজের আক্রমণে পাকসৈন্য নাজেহাল হয়েছে।

 বগুড়া অঞ্চলে পয়লা জুন মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যের একটি সাঁজোয়া গাড়ী দখল করে নেন। ঐ গাড়ীতে তিনটি রেডিও সেট ও ছয়টি স্টেনগান ছিল। একজন কমাণ্ডারের গাড়ী ও মুক্তিফৌজ দখল করে নেন। পশ্চিম বগুড়ার আর একস্থানে আক্রমণ চালিয়ে তাঁরা কয়েকজন পাকসৈন্যকে খতম করেন। আর একটি সংঘর্ষে পাকিস্তানের টহলদার বাহিনীর সাতজন সৈন্য নিহত ও দুজন আহত হয়।

 আসাম সংলগ্ন কানিরঘাটে মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রবল লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজের এই শক্তঘাটিতে পাকিস্তানকে ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়োগ করতে হয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে গত ২৪ঘণ্টায় মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠছে। কোচবিহারের বিপরীত দিকে অবস্থিত ভূরুঙ্গামারী চৌকি থেকে পাকসৈন্যদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 চিলহাটি ও ডোমারের মধ্যবর্তী তিস্তাসেতু এবং কাকিনা ও ভূষিরবন্দরের মধ্যবর্তী সানিয়াজানা সেতুকে মুক্তিফৌজ উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা কাকিনাতে আটক হয়ে পড়েছে। তাদের লারমনিরহাটে ফিরে যাবার পথ নেই।

 দিনাজপুরের জগদলে গেরিলা বাহিনী পাকসৈন্যের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। প্রচুর পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। ঠাকুরগাঁয়ের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও মুক্তিফৌজে নষ্ট করে দিয়েছেন। রংপুরজেলার ডিমলা ও বাউরাতে মুসলিম লীগের সাতজন পাকিস্তানী গুপ্তচরকে মুক্তিফৌজ খতম করেন।

 গত সপ্তাহে মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো আক্রমণে ফেনী এলাকায় চারজন অফিসারসহ শতাধিক পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও জগন্নাথদিঘীর মধ্যবর্তী কোন একস্থানে সোমবার মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যের একটি জীপের ওপর আক্রমণ চালান। বিধস্ত জীপের ৪জন আরোহী নিহত হয়। পয়লা জুন কসবা ও আখাউড়ার মধ্যবর্তী গঙ্গাসাগরের কাছে মুক্তিফৌজের আক্রমণে কয়েকজন পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। ত্রিপুরার সাক্রমের বিপরীত দিকে অবস্থিত চট্টগ্রামের রামগড় এলাকায়ও কয়েকটি সংঘর্ষ হয়েছে।

- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ জুন, ১৯৭১

GUERILLA TACTICS OF MUKTI FOUJ

PAYING DIVIDENDS

 AGARTALA, JUNE - 4 By ther use of guerilla tactics, the Mukti Fouj commando, who engaged the Pak army in several places in Chittgong hill tracts, Noakhali, Comill, Saldanadi, Gangasagar and Akhaura sectors at Saldanadi. Among those Pak troops killed, one was a Major Doorani who took active part in mass killing in Comilla town in the months of Margh and April.

 Other reports available from across the border say, Pak trops are gradually losing confidence in the so-called peace commitees fromed earlier by it in various parts of Bangladesh Pak troops have killed at least five peace committee members at Laksham and lieni.

 On June 2. the Army is also reported to have killed a foreigner Mr. P.J. Chalmers, who was looking after Nalua tea estate in sylhet Earlier. Pak troops killed 20 labourers of the labourers of the garden. The Pak army officials demanded tea, ration and fuel for the troops from Mr. Chalmers who was running short of finance and faced serious economic crisis in the present doldrums in the country, expressed his inability to meet the demands.

 Agenceies add: Four Pakistanis, including an officer, were killed and severel others injured by the Mukti Fouj in an exchange of fire yesterday near lchakhali village off Meherpore town in south-western Bangladesh.

 The Mukti Fouj are laying mines near culverts, bridges and on metalled roads in this sector. In Faridpur, the liberation forces damaged a bridge and destryed an army post.

 The freedom fighters are in full control of villages in the Rangamati area, six miles north of Patnitola an army patrol was also fired upon by the freedom fighters yesterday.

 In Sylhet sector, the libaration forces are reported to have demaged two bridges and attacked an army position at Sarlbagh. They also opened fire on a Pakistani army position near thge border in Shamshernagar area.

 In Rangpur sector, the freedom fighters destroyed two army gunboard and demaged a railway bridge in Sirjagnj area.

 In Comilla sector, the freedom fighters attacked in army position near colonel Bazar and killed 25 solders.

 Our Cooch Behar Correspodent says that the Pak army started firing on the Gitaldaha border outpost in India from the Moghalhat border. The Border security Force returned the fire and the exchange continued for an hour.

 A few Pakistani morter shekks landed on Indian treeitory at Lalgola in Murshidabad district tody as fighting broke out between the Mukti Fauj and the Pakistani army at Kanthabarti area of Bangladesh. It is oficially learnt at Baharampur.

Hindusthan Standard, 5 June, 1971

পাকসৈন্যরা মুজিবনগর দখলে ব্যর্থ

 কৃষ্ণনগর, ৫ই জুন— সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা মুজিবনগর দখল করতে এলে গত দু’দিনে মুক্তিফৌজের হাতে ৩৫জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। মুজিবনগর দখলের এই লড়াইয়ে পাকসেনা নাজেহাল হয়ে এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। যাবার সময় তারা তাদের হতাহত সহকর্মীদের নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে চলে যায়। যাবার সময় তারা তাদের হতাহত সহকর্মীদের নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে চলে যায়। মুক্তিফৌজের কেউ হতাহত হয়নি।

 কার্ফু করে গ্রেফতার ও হত্যাঃ এদিকে পাকসৈন্যরা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় খণ্ড খণ্ড এলাকা ধরে কার্ফু জারী করে দিচ্ছে। এবং তারপর বাড়ী বাড়ী তল্লাশী চালিয়ে যুবকদের ধরে এনে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। এ খবরটি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র।

 -যুগান্তর, ৬ জুন, ১৯৭১

মুক্তিযুদ্ধ চলছে

 রায়গঞ্জ, ৬ই জুন (পি টি আই)- দিনাজপুরের পাক হিলি এলাকায় মুক্তিফৌজের গেরিলারা সম্প্রতি বিজুল শিবির আক্রমন করেন। ৫ জন পাকসৈন্য নিহত এবং অন্য দু’জন আহত হয়। দিনাজপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজ বাগজানা পাক সামরিক ঘাঁটিতে তৎপরতা চালিয়ে ৬০ জন পাকসৈন্য খতম করেন। ৪ জনকে বন্দী করা হয়েছে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে।

 কুষ্টিয়ায় গত কয়েকদিনের কলেরায় প্রায় ২০ জন পাকসৈন্য খতম হয়েছে। কলেরা মহামারী জেলার পাকসৈন্যদের মনে প্রবল ভীতির সঞ্চার করেছে।

 শরণার্থী সেবাদলঃ বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে ৬০ জন শরণার্থী যুবক কলকাতায় সমাজসেবা সম্পর্কে ট্রেনিং লাভ করছেন। গান্ধী শান্তি সংস্থা ঐ শরণার্থী যুবকদের প্রাথমিক চিকিৎসা, নাসিং, আহার তৈরী ও বণ্টন এবং স্বাস্থ্য সম্পর্ক ট্রেনিং দিচ্ছেন। এই যুবকরা বিভিন্ন শিবির খোলা হবে বলে শান্তি সংস্থার জনৈক মুখপাত্র জানান। পুর্বাঞ্চলে শরণার্থী যুবকদের জন্য ছয়টি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হবে বলে শান্তি সংস্থার জনৈক মুখপাত্র জানান। পুর্বাঞ্চলে শরণার্থী যুবকদের জন্য ছয়টি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হবে আশা করা যায়।

 নৌকার মধ্যে ৩ হাজার শরণার্থীঃ ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদ সীমান্তে ইছামতী নদীর ওপর দেশী নৌকার মধ্যে প্রায় তিন হাজার শরণার্থী বাসকরছেন।

-যুগান্তর, ৭ জুন ১৯৭১

মুক্তিফৌজের ব্যাপক ও প্রচণ্ড আক্রমণে বহু পাকসৈন্য খতম

 আগরতলা, ৮ই জুন (পি টি আই)- বাংলাদেশের পুর্বাঞ্চলে কুমিল্লা জেলার সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কসবা এলাকায় মুক্তিফৌজ আবার নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে। আজ এখানে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, গতকাল মুক্তিফৌজ মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে তেত্রিশজন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং পাকসৈন্যরা কসবা থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকসৈন্যদের জন্য যুবতী নারী সংগ্রহ করে দেওয়ার অপরাধে মুক্তিফৌজ ৬জন পাক দালালকেও গুলি করে হত্যা করেছে।

 মুক্তিফৌজ গেরিলাবাহিনীও গতকাল কসবার নিকটবর্তী গঙ্গাসাগরে ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে ২৮ জন পাকসৈন্য খতম করে।

 আরও দক্ষিণে মুক্তিফৌজ গতকাল নোয়াখালী জেলার চাঁদগাজী, ছাগলনাইয়া, বান্ধুরা, আমতলী ও জগন্নাথদিঘী এলাকায় তাদের তৎপরতা বিস্তৃত করে এবং পাকসৈন্যদের পশ্চাদপসরণ করে ফেনী শহরে সরে যেতে বাধ্য করে।

 রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এই সকল অঞ্চলে মুক্তিফৌজ কমাোবাহিনীর সঙ্গে দু’দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। ফেনী শহরের উপকণ্ঠে মুক্তিফৌজের গেরিলা দল লুকিয়ে থেকে অতর্কিত সাফল্যের সঙ্গে এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে আক্রমণ করে। পাকসৈন্যরা ঐ সময় একটা ছোট নদী পার হচ্ছিল গেরিলাদের আক্রমণে সাতজন পাকসৈন্য এবং অপর কয়েকজন আহত হয়।

 রংপুর জেলায়ও তৎপরতাঃ কোচবিহার থেকে পিটিআই জানাচ্ছেন যে মুক্তিফৌজ গতকাল রাতে বাংলাদেশের রংপুর জেলার নাগেশ্বরী থানার এলাকাধীন মুকসী গ্রামে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে অন্যূন বারজন পাকিস্তানী সৈন্য খতম করেছে। আজ এখানে সংবাদ পাওয়া গেছে যে, ঐ অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগরত একটি পাকিস্তানী সেন্য খতম করেছে। আজ এখানে সংবাদ যে, ঐ অঞ্চলের গ্রামে গামে অগ্নিসংযোগরত একটি পকিস্তানী টহলদার বাহিনীর সৈন্যদের ওপরই মুক্তিফৌজ এই আক্রমণ চালায়। মুক্তিফৌজ ভূরুঙ্গামারীতে একটি পাকঘাঁটির ওপর হানা দিয়ে দুজন পাকসৈন্যকে গুরুতরভাবে জখম করেছে। মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যদের সঙ্গে গুলী বিনিময় করে এবং তাহাতে কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। এই সকল অভিযানে মুক্তিফৌজের মাত্র দু’জন আহত হয়েছে।

 মুজিবনগর থেকে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে যে, রবিবার রাতে রাজশাহী খণ্ডে মুক্তিফৌজ অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে জনৈক মেজরসহ ৪৯ জন পাকিস্তানী সেনাকে বন্দী করেছে।

-যুগান্তর, ৯ জুন, ১৯৭১

MUKTI FOUJ INTENSIFIES

GUERILLA ATTACKS

 MUJIBNAGAR, JUNE 9- Freedom fighters have intensified their guerilla attacks on the West Pakistani army detachments and patrol and on bridhes in Bangladesh, says UNI.

 In the Jessore sector an army lieutenant was mobbed and killed a few dys ago near Faridpur. The freedom fighter ambushe an army contingent near chuadnga on June 6. One jinior commissioned officer was killed and eight soldiers were injured in this engagement. Guerillas also fired upon some Pakistani troops near Jessore on June 7.

 Freedom fighters destroyed two bridges between Panchgarfh and Ruhcal and inflicted heavy casualities on the army in Rangpur sector. Army also suffered casualties in an attack by the freedom fighters with mortars and small arms about 15 miles of Patnitala.

 The guerillas have also been active in the areas north-west of river Dharala. They shot dead two Pakistani agenst in the Tetulya area.

Heavy rains hane rendered the unmetalled roads and tracts unit for vehicular traffic in several areas of Est Bengal. There was an exchange of fire between Punjabi and Pathan soldiers in the Comilla area.

 PTI says Several west Pakistani solders were killed in a bitter clash between the Mukti Fouj and the Army personnel in Bhurungamari in Rangpur area yesterday.

 In Khul the liberation force destroyed nine enemy bankers at Kaliganj and killed eight sokders entrenched there the reports said.

 In Mymensingh, the Mukti Fouj raided Sibpore village on receipt of information about the prsence of Pakistani army supporters and killed six of them in a sudden swoop yesterday. A Pakistani post at Barengapara was attacked by the liberation force and in the resultant clash the army suffered heavy casulties.

 The Mukti Fouj raded a position at Jayantiapur. A Pakitani offcer was blown to pieces in a mine explosion there. Five Pak army personnel were killed at Chhotolekhan, when the Mukti Fouj commandos attacked them.

Hindusthan Standard, 10 June, 1971

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মাটি থেকে পাক হানাদারদের

উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর

 কলকাতা, ১০ জুন- গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে চার দিনব্যাপী সফরের পর আজ মুজিবনগরে প্রত্যাবর্তন করে বলেছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মাটি থেকে পাক হানাদারদের উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর।”

 ঐ সফরের সময় তিনি মুক্তিফৌজ নিয়ন্ত্রিত কতিপয় শিবির পরিদর্শন করেন। তিনি জানান, ঐ শিবিরসমূহে তিনি “তরুণ মুক্তিযোদ্ধেদের মধ্যে অদম্য মনোবল ও। নমনীয় দৃঢ়তা” পরিলক্ষিত করেছেন। এই খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচার করেছে।

 পাক স্বাগত কেন্দ্র গুলি বন্দী শিবিরের সঙ্গে তুলনীয়ঃ আকাশবাণী’র খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্র বাংলাদেশের পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক (শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য) প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ‘স্বাগত কেন্দ্র’গুলিকে বন্দী শিবিরের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

 তিনি জানান, সম্প্রতি ভারতের পথে আসার সময় বহুসংখ্যক শরণার্থীকে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ জোর করে ঐ স্বাগত কেন্দ্র গুলিতে নিয়ে গেছে।

 ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিকের অধিকাংশ বাঙালী কর্মচারী ছাঁটাইঃ ঢাকা থেকে পাকসামরিক কর্তৃপক্ষের তত্বাবধানে প্রকাশিত ইংরাজী দৈনিক মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার অধিকাংশ বাঙালী কর্মচারীকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ প্রচার করেছে। পাক অধিকৃত বাংলাদেশে সামরিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ঐ সকল পত্রিকার কোন গ্রাহক নেই। সামরিক কর্তারা পত্রিকার ২০০০ কপি কিনে নেন, মাঝে মাঝে সেনাদের মধ্যে বিমান থেকে ওগুলো ফেলে দিওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ নিরপেক্ষ কোন বেসামরিক পাঠক নেই।

 পাক নৃশংসতার বিরুদ্ধে ডন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদকের কণ্ঠস্বর করাচীর ডন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক জনাব আলী জাফরী আজ লণ্ডনে বাংলাদেশে সংঘটিত পাক নৃশংসতার বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ জানিয়ে জনসাধারণের কাছে এই মর্মে আবেদন জানিয়েছেন যে, তাঁরা যেন ইংল্যাগু ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী টেষ্ট ম্যাচগুলি বয়কট করেন।

 জনাব আলী জাফরী ইতিপুর্বে পাকিস্তানে ব্যক্তি স্বাধীনতা অপহরণের প্রতিবাদে পাক নাগরিত্ব বর্জন করেছিলেন।

 চুয়াডাঙ্গায় পাকসেনাদের মধ্যে”সেম সাইড” কলকাতা, ১০ জুন বাংলাদেশের গেরিলাবাহিনীর তৎপরতা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। গেরিলাদের হাতে মার খেয়ে পাক হানাদাররা নিজেদের মধ্যে সেম সাইড করে বসছে। চুয়াডাঙ্গার কাছে দুই দল পা সৈন্যের পরস্পর সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আজ সন্ধ্যায় ঐ সংবাদের কথা উল্লেখ করে চুয়াডাঙ্গার শেয়ালমারীতে গেরিলা বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের সংবাদ দিয়েছে।

 প্রকাশ, গত ৫ জুন শেয়ালমারীতে মাইন বিস্ফোরণে ২ টি সামরিক ট্রাক ধ্বংস হয়ে ২৯ জন পাকহানাদার নিহত এবং ৪ জন আহত হয়। হানাদাররা জীবননগরের দিকে যাচ্ছিল। ঐ মাইন বিস্ফোরণের শব্দে ভীত পাক হানাদাররা জীবননগর দর্শনা থেকে ঘটনাস্থলে দিক আসে। দুই পক্ষেই পরস্পর মুক্তিসেনা বলে ভুল করে এবং পরস্পরের উপর গুলি চালাতে থাকে। ফলে ১৩ জন পাকহানাদার নিজেদের গুলিতেই আহত হয়।

-কালান্তর, ১১ জুন, ১৯৭১

পাক হানাদারদের উপর মুক্তিফৌজের আক্রমণ

 কলকাতা, ১১ জুন- মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতায় চট্টগ্রাম শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাক সেনারা প্রতিদিনই নাজেহাল হচ্ছে। আজ সন্ধায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত সংবাদে বলা হয়েছে যে সম্প্রতি গেরিলা বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের নিউ সার্কেট, খাতুনগঞ্জ, চট্টেশ্বরী রোড, চকবাজার, লারদেঘীর মাঠে প্রভৃতি স্থানে গ্রনেডে ও হাতবোমা সহ আক্রমণ চালায়। চকবাজারে ২ জন পাক হানাদার নিহত হয়েছে।

 সংবাদে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম এখন পরিত্যক্ত নগরী। দোকানপাট বন্ধ। শতকরা মাত্র ১৫ জন লোক দৈনন্দিন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য পথে বেরুচ্ছেন। বেলা ৩টার পর রাস্তায় কাউকে খুব কম দেখা যায়। বন্দর এলাকায় মাত্র ৫০ জন কাজ করছে। চট্টগ্রামের হাজী এলাকায় দ্বিতীয় ক্যাণ্টনমেণ্টে স্থাপন করা হয়েছে। বাগানাবাজার ও আঁধারমানিক অঞ্চলে ২ টি পৃথক আক্রমনে গেরিলারা ৪০ জন পাকসৈন্যকে খতম করেছে। শ্যামপুরে ৮ জন দৌলতপুর-চাঁদিরহাটে ৪০ জন কুমিল্লার হরনপুর, হৃদয়পুরে ১৩ জন এবং যশোহর রণাঙ্গনে ১৫ জন পাক হানাদার গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে। রামগড় থেকে গড়েরহাটের পথে ৩ জন পাক সামরিক অফিসার নিহত হয়েছে।

 গেরিলা বাহিনী মুসলিম লীগের দালালসহ পাক দালালদেরও বিভিন্ন স্থানে খতম করে চলছেন। জাকিগঞ্জে ৪ জন দালাল নিহত এবং ১জন গ্রেফাতার হয়েছে। মুক্তিসেনারা জাকিগঞ্জের পুলিশ স্টেশন দখল করেছেন এবং জাকিগঞ্জে পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছেন। কালিগঞ্জের মুসলিম লীগ চেয়ারম্যান অলি মণ্ডলকে মুক্তিসেনারা খতম করে দিয়েছেন। ছাগলগঞ্জ বাজারে ১ দালালকে বন্দী করা হয়েছে এবং যুবতীকে উদ্ধার করা হয়েছে। সিলেট সেক্টরে মুক্তিফৌজের হাতে একটি রেলসেতু ধ্বংস হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে।

 আগরতলা থেকে ইউ-এন আই জানাচ্ছেনঃ সম্প্রতি একদল সাংবাদিক বাংলাদেশের দক্ষিণ রনাঙ্গনে সফরে গিয়েছিলেন। মুক্তিফৌজের জনৈক মেজর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, মুক্তিফৌজে বর্তমান পাকহানাদারদের উপর পাল্টা আক্রমন শুরু করেছে এবং সর্বত্র পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

 উক্ত মেজর সাংবাদিকদের আরো জানিয়েছেন যে দক্ষিণ রণাঙ্গনে পাঠন ও বালুচ সেনারা নিরস্ত্র বাংলাদেশ নাগরিকদের উপর গুলি করতে অস্বীকার করায় তাঁদের অন্যত্র বদলী করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রায় ৪০০ জন বালুচ সেনাকে জাহাজে পশ্চিম পকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

 পাঞ্জাবী ও পাঠান সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষঃ গত ৪ জুন কুমিল্লা সেক্টরে পাক সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী ও পাঠানদের মধ্যে এক সংঘর্ষে ৩৫ জন নিহত হয়েছে।

-কালান্তর, ১২ জুন, ১৯৭১

কুমিল্লা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা

 আগরতলা, ১১ই জুন (পি, টি, আই) বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কুমিল্লা শহরটি গতকাল দখল করে। আবার স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছে। এই সঙ্গে নানা অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা ও তীব্রতর হয়ে উঠছে। ইউএন আই জানাচ্ছেন সারা বাংলাদেশ জুড়ে শেখ মুজিবের মুক্তিফৌজ গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলে সীমান্তের ওপারে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে খবর এসেছে। পাক সামরিক প্রশাসন শহরে ৭১ ঘণ্টার সামরিক আইন জারী করে নির্বিচারে অধিবাসীদের বন্দী করেছে।

সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে, মুক্তিফৌজ পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, হাবিব ব্যাঙ্ক লিমিটেড, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক, জজ কোর্ট এবং টাউন হল ভবনে গ্রেডে আক্রমণ চালায়। গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা শহরের দক্ষিণাঞ্চলে একটি রেল ইঞ্জিন উড়িয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

 মুক্তিবাহিনীর সূত্র থেকে জানা যায় যে গত ৬ ই জুন মুক্তিফৌজ চট্টগ্রাম জেলায় সৌলাৎপুরে পাকসেনা সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৩৬ জন শত্রুসেনাকে খতম করে। ৫ ই জুন শ্রীহট্টের তেলিপাড়া খণ্ডে মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে পাকবাহিনী আক্রমণের চাপে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পশ্চাদপসারণ করে, তবে পালাবার সময় তারা জীবন ও সম্পত্তির বেশ ক্ষতি করে যায়। গত ৩রা জুন লাকসাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী হঠাৎ একটি আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীর অনেককে খতম করেছে। শত্রুপক্ষের বেশকিছু মিজো এবং চাকমা সেনাও নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী তবলছড়িতে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়। এই অঞ্চলে পাকসেনাদের অমানুষিক অত্যাচার সত্বেও বাঙ্গালী অধিবাসীরা দৃড় মনোবল নিয়ে তাদের মোকাবেলা করছেন, মহিলা এবং কিশোরীরাও মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।

 কুমিল্লা জেলার ননীপুর ও ফকিরহাটে গুপ্তস্থান হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজের গেরিলা দল ২০ জন পাকসেনাকে খতম করে। মিয়ার বাজারে ও মুক্তিফৌজের হাতে পাক হানাদার বাহিনীর আটজন মারা পড়ে। এখানে তিন ঘণ্টা লড়াই চলে। পাকসেনারা মর্টার ও মেশিনগানে চালিয়ে মুক্তিফৌজের পাঁচজন যোদ্ধাকে আহত করে। শ্রীহট্ট জেলার মির্জাপুরে মুক্তিবাহিনী মেশিনগান ও মর্টার চালিয়ে পাকসেনাদলের একজন অফিসার ও দশজন সৈন্যকে হত্যা করে।

 দিনাজপুরেও গেরিলা তৎপরতাঃ রায়হগঞ্জ, ১০ জুন গেরিলা ইউনিট দিনাজপুরে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপর হয়ে উঠছে। ছোট ছোট দল গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজ পাক দখলদার বাহিনীকে যথেষ্ট বিব্রত করে তুলেছে। কয়েকদিন আগে ঠাকুরগাঁও মহকুমা এলাকায় রুহিয়া রেল স্টেশন থেকে ১ ফার্লং দক্ষিনে ৫০ ফুট দীর্ঘ রেল লাইন মুক্তিফৌজ ডিনামাইট দয়ে উড়িয়ে দেয়। পাক সেনবাহিনীর লোকেরা গুলি চালাতে থাকে। মুক্তিফৌজ গেরিলারা পিছন থেকে পাক সৈন্যদের আক্রমণ করে ৭ জনকে হত্যা করে। ওই এলাকার মঙ্গলপুর ও বাজানহারের মধ্যবর্তী একটি রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেয় এবং রুহিয়া থেকে ৪/৫ মাইল দূরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সেতুও তারা উড়িয়ে দেয়। বোচাগঞ্জ, পীরগঞ্জ ও রাণীশংকৈলে গেরিলা বাহিনী বেশ কয়েকজন পাক সেনাদের তাঁবেদার গুপ্তচরকে খতম করে।

-যুগান্তর, ১২ জুন, ১৯৭১

গেরিলা আক্রমণে বাংলা বাহিনীর অপূর্ব সাফল্য

 বর্তমানে মুক্তিফৌজ তাদের গেরিলা আক্রমণে বাংলাদেশের সর্বত্র পর্যুদস্ত করেন। গত সপ্তাহে বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী বহু পাকসৈন্যকে হতাহত করেন। গত ৬ই জুন মেহেরপুরের নিকটে ইছাখালিতে এক গেরিলা যুদ্ধ মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ চারজনকে খতম করেন। যশোহর এলাকায় মুক্তিবাহিনী মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে পাকবাহিনীর ১ টি শিবির অতর্কিতে আক্রমণ করে কমপক্ষে ২০ জন পাকসৈন্যকে হত্যা ও অনেককে হতাহত করেন তাদের ক‘খানা গাড়ী ও বহু সংখ্যক ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন। কালাচাঁদপুরের দিকে পাকসেনার অগ্রতির এক খণ্ড যুদ্ধে মুক্তিফৌজ তাদের ১ জন লেঃ কর্নেলকে আহত করেন। এই যদ্ধে বাংলা বাহিনী ১টি সেতু ও পাকসেনার ১টি ঘাঁটি ধ্বংস করেন।

 বগুড়া জেলার রাঙ্গামাটি এলাকা এখন সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রনাধীন। সিলেটের সরলবাগে বাংলাবাহিনী পাকসেনার ১ টি ঘাঁটি দখল করে ও এর সন্নিকটে ২ টি গানবোট বিনষ্ট করেন। সিরাজগঞ্জে তারা একটি রেল সেতু সম্পূর্ণরুপে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হন। দিনাজপুর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৭৫ জন পাকসেনাকে হত্যা, বহু জনকে আহত ও ১৪ জনকে বন্দী করে। উত্তরাঞ্চলে উলিপুরে মুক্তিযোদ্ধারা এক ঝটিকা আক্রমণে ৪০ জন পাকসৈন্য কে হত্যা করেন। এছাড়া খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাতে কদিনের যুদ্ধে তারা প্রায় দুশো-এর অধিক পাকসৈন্য হত্যা করেছেন।

-বাঙ্গবাণী,১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, ১৩ জুন, ১৯৭১

মেহেরপুরের পাকবাহিনীর এক সৈন্য খতম

 কৃষ্ণনগর ১৩ জুন (পি, টি, আই) মুক্তিফৌজ গতকাল বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম খণ্ডে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানী ফৌজের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। মেহেরপুরের অদূরে তারা পাক ফৌজের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছে। সীমান্তের অপর পর থেকে এখনে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ভারতের গোদাডাঙ্গার বিপরীত দিকে ভোমরার নিকটে এবং পেট্রাপোলের বিপরীত দিকে বেনাপোলের নিকটে নীতেগত অব্যাহত আছে। তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজ মেহেরপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালি সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছে। ঐ অঞ্চলে মর্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে তারা পাকফৌজের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছে। আহত কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্যকে তাদের সাথীরা সরিয়ে নিয়ে গেছে। খবরে প্রকাশ, পাক সৈন্যরা এখান থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ- পশ্চিম বাংলাদেশের প্রাগপুর এলাকায় ২৫টি বাড়ীতে। আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এবং পাঁচজনকে হত্যা করেছে।

যুগান্তর, ১৪ জুন ১৯৭১

MUKTI FOUJ ACTIVE ON WIDE FRONT IN BANGLADEHSH

 MUJIBNAGAR, JUNE 15- The Mukti Fouj gurikkas have active on a wide front in Bangladesh since June 10 as the Pakistani troops continued their atrocities on unarmed civilians, according to authoritative reports reaching here tonight say agencies.

 The guerillas have occupied the border outpost at Baragapara, Mymenshingh district after an encounter with the troops. The also exploded a bomb in a hotel in Dacca city, causing injuries to some collaborators of the Pakistani army.

 A Pakistani border outpost in the district of Rajshahi was attacked by the freedom fighters on June10. The next day the liberation forces fired upon an army contingent near Thakurgaon, and also in the Rangpur and Gaibandha.

 In the Chilmari area the guerillas destroyed an Army jeep killed the solders travelling in it. They uprooted the railway track in the Hitibandha area and damaged telephone lines between Rangpur and Gaibandha.

 In the Sylhet sector, the guerillas shelled an Army position in the Baragram area, inflicting several casualties on the Pakistani troops.

-Hindusthan Standard, 19 June, 1971

চট্টগ্রাম এলাকায় মুক্তিফৌজের তৎপরতা

 আগরতলা, ১৯ জুন (পিটিআই)- সীমান্তের অপর পার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনী চট্টগ্রামের পশ্চিমাঞ্চল বিভিন্ন স্থানে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদে জানা যায় যে জুয়ালগঞ্জে গেরিলাদের আক্রমণে পাকিস্তানী সেনাদলের একজন মেজর নিহত হয়েছেন।

 মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনী নোয়াখালী- চট্টগ্রামে খণ্ড শুভপুর এলাকায় শত্রুসৈন্যর অবস্থানস্থলের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে। এর ফলে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য আহত হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ জুন ১৯৭১

মুক্তিফৌজের ভয়ে পাকসৈন্য সদা-সন্ত্রস্ত

 মুজিবনগর ২২ জুন (পিটিআই) বাংলাদেশর বিভিন্ন খণ্ডে মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর টহলদার দলগুলি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছ। মুক্তিফৌজ কমাণ্ডার জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসার বলেছেন যে মুক্তিফৌজ যে মুহূর্তে আচমকা আক্রমণ চালাতে পারে মনে করে পকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল যতদুর সম্ভব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করেছে। মুক্তিফৌজ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য পাকসৈন্যরা সময় সময় অসামরিক ব্যক্তির ছদ্মবেশে চলাফেরা করে থাকে। সৈন্যবাহিনী যখন সৈন্য ও সরবরাহ নিয়ে নদী পারাপারের জন্য বোট ব্যবহার করে তখন গেরিলাদের আক্রমন রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নদী ও খালের উভয় তীরের রক্ষী মোতায়েনের ব্যবস্থা করে।

 ভেড়ামারায় ২০ জন পাকসৈন্য নিহতঃ কৃষ্ণনগর ২২ শে জুন কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার মহিষকুণ্ডি অঞ্চলে এক কোম্পানী পাকসৈন্যর ওপর আক্রমন চালিয়ে মুক্তিফৌজ অন্ততঃ ২০ জন পাকসৈন্যকে হত্যা ও বেশ কিছুকে জখম করেছে বলে আজ সংবাদ পাওয়া গেছে। স্থানটি কৃষ্ণনগর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ভারত মেঘনা সীমান্তের বিপরীত দিকে। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদ জানা যায় যে, পাকসৈন্যরা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে পালিয়ে যায়।

 মুক্তিফৌজ গত রবিবার মেহেরপুরের কছে একটি সৈন্যবাহী ট্রাকের উপর গোলাবর্ষণ করে এবং উহার ফলে প্রায় ২৪ জন পাকসৈন্য নিহত অথবা আহত হয়। ঐ দিনই মেহেরপুরের প্রায় ১৫ মাইল উত্তরপূর্বে একটি অঞ্চলে মুক্তিফৌজ একটি সৈন্যঘাঁটির ওপর গুলিবর্ষণ করে। এই আক্রমণে ১১ জন পাকসৈন্য খতম হয়।

 রংপুরে লালমনিরহাট খণ্ডে মুক্তিফৌজ একটি সৈন্য শিবিরের ওপর আচমকা আক্রমন চালিয়ে কিছু অস্ত্রশস্ত্র গেলাবারুদসহ একটি ট্রাক দখল করে। এই আক্রমণে যে সকল পাকসৈন্য আহত হয় তাদের মধ্যে একজন আফিসারও আছেন।

-যুগান্তর, ২৩ জুন, ১৯৭১

খান সেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমন তীব্রতর হয়েছেঃ

আরও সাত শতাধিক সৈন্য খতম

 স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের খবরে প্রকাশ, হানাদারবাহিনী বাংলাদেশে যে বর্বরোচিত ও সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে তারই অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের সমর্থকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাও রেহাই পাননি। গত সাতদিন চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে প্রায় একশত ৫০ জন পাক হানাদার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং বহু স্থান থেকে পাকসেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র জানিয়েছে। সমগ্র পূর্ব রণাঙ্গনে গেরিলাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজারে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। এদিকে মর্টার ও মেশিনগানসহ আক্রমন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছেন।

 স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা গত ১৯শে জুন সিলেট সেক্টরে একটি এলাকায় পাক-হানাদারদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে ১৩ জন পাকসেনাকে খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৩ জন পাকসেনাকে আটক করেছেন। এর আগেরদিন এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী সিলেটের কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে ২২তম রেজিমেণ্টের একজন সৈন্যকেও আটক করেছেন।

 মুক্তিবাহিনী রংপুরের বজরাপাড়ায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমন চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করে ছেড়েছেন। এই আক্রমণে অনেক খানসেনা হতাহত হয়েছে। সেই দিনই পাকসেনারা মৃত সৈন্যদের লাশ ও আহত সৈন্যদের নওগাঁয় নিয়ে যায়। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ দু’জন পাকসেনাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধার গ্রেফতার করেছেন। কয়েকদিন আগে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা ঠাকুরগাঁয়ের কাছে মর্টার ও মেশিনগান থেকে মুক্তি ছাউনির উপর আচমকা গুলি চালায়। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পয়েছে। গত দু’সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে অধিকসংখ্যক গাড়ী ও সৈন্য নিয়ে পাকসেনাদের চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে মেহেরপুর এলাকায় এক দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩০ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন, সেখানকার কুতুবপুরে মুক্তিবাহিনী খানসেনাদের ওপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১০ জন খানসেনাকে হত্যা করেন। গত ১৫ই জুন নাজিরাকোনায় এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে আক্রমন করে মুক্তিবাহিনীর অসমবাহিনীর যোদ্ধারা ২০ জন দুশমন সৈন্যকে খতম করেছেন।

 স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, সাতক্ষীরার নিকট দুশমন সৈন্যদের ঘাঁটির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন চালিয়েছেন। এ এলাকায় কয়েকটি আউটপোষ্টেও আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমন চালিয়ে দস্যু সৈন্যদের আনেককেই হতাহত হয়েছেন।

 গত ১২ই জুন ভোমরা সেক্টরের কলারোয়ায় মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমন চালিয়ে খানসেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহিনী ঐ দিন রাতে আরেক অভিযানে ৬০ জন খানসেনাকে হত্যা করেছেন। কলারোয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও তথাকথিত শান্তি কমিটির প্রেসিডেণ্ট ওয়াজেদ আলী চৌধুরীকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা খতম করেছেন।

 মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশ দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে খানসেনার উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে মেহেরপুরের নিকটে এক প্লাটুন খানসেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহর থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছেন। এতদাঞ্চলে মর্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনী শত্রুসেনাদের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে নিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পদস্থ অফিসারও রয়েছে।

-জয়বাংলা ১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, ২৫ জুন,
১৯৭১

MUKTIFIUJ KILLS 60 PAK SOLDIERS IN TWO DAYS

 JUNE,-27- The Mukti fouj which has recently intensified its guerilla activities throughout the eastern sector have killed at least 60 Pak soldiers and captured some arms during the past two days, according to reports received from across the border, with their active and surprise attacks, the commandos are harassing the Pak troops and their agents everywhere in the eastern sector, the guerillas are now the headachc of islamabad’s army and have Toiled the latter’s plan to set up rail communication between Dacca and Chittagong.

 Whatever the Pakistani president, Gencral Yahya Khan, might say to the world about the return of refugees, his armed forces in Bangladesh have been keeping the people there terrorised by killing, burning houses and harassing women folk as before to maintain the rate of exodus of Bengalis, The Pak Army’s attitude only suggests that islamabad’s plan of driving out hindus and progressive muslims remains unchanged which is evident from the uninterrupted heavy influx of evacuees in to Tripura.

 Meanwhile, reports PTI the Mukti Fouj gurillas had killed five Pak soldiers including an officer when they ambushed a jeep carrying the Pakistani personnel to Chuadanga town in Kushtia district in the south western sector of Bangladesh yesterday. The army jeep was badly damaged.

- Hindesthan Standard, 28 June, 1971