বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/৩০
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী
১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধু এভেনিউ (তদানীন্তন জিন্নাহ এভেনিউ)-এর আলফা ইনসিওরেন্স অফিসের দোতলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের খাস কামরায় বসে আছি। আরো আছেন রাজশাহীর জনাব কামারুজ্জামান এম, এন, এ সাহেব এবং বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মী। মধ্যমণি বঙ্গবন্ধু নিজে। আলোচ্য বিষয় দলীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। হালকা পরিবেশ। বেলা তখন প্রায় ১০টা। টেলিফোন বেজে উঠলে শেখ সাহেব ধরলেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে আলাপ করছেন। প্রায় ২/৩ মিনিট পরে ফোন ছেড়ে দিয়ে বললেন, এপিপি থেকে ফোন এসেছিল। ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। ভারতীয় সেনা লাহোর শহরের উপকণ্ঠে শালিমার বাগান পর্যন্ত এসেছে এবং এর সঙ্গে অন্যান্য ফ্রণ্টেরও কিছু কিছু প্রাথমিক খবর। তিনি বললেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন তারপরেই বলে উঠলেন ‘দেশটাকে বাঁচানো যায়। একটা বড় সুযোগ এসে গেছে। ‘আমরা যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেই’ বলে তিনি কিছুক্ষন থামলেন। যাহোক, তিনি খুবই উত্তেজিত অথচ পরিবেশটা এই আলোচনার উপযুক্ত নয়। হেনা ভাই (কামারুজ্জামান) আমার চোখের দিকে তাকালেন। ইতিমধ্যে শেখ সাহেব বাথরুমে গেছেন। তিনি বললেন যে, নেতা খুবই উত্তেজিত, কথাবার্তা অসংলগ্ন হচ্ছে। তাকে এখান থেকে সরাতে হবে। শেখ সাহেব ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে হেনা ভাই এবং আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে প্রায় এক রকম জোর করে নীচে নিয়ে এলাম। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। তার জীপে ৩২নং রোডের বাড়ীতে এসেই তাজউদ্দিন সাহেবকে ফোনে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলেন। আমরা মোট চারজন। তাকে আমরা তিনজনই বুঝাতে চেষ্টা করলাম আপনার কথা আমরা বুঝতে পারছি কিন্তু এ রকম একটা কাজ করতে যাওয়ার আগে অনেকগুলো দিক খুবই গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করতে হবে তবে মনে হয় এখন তার উপযুক্ত সময় নয়। দেশবাসী এটার জন্য প্রস্তুত নয়। এটাই বঙ্গবন্ধুর নিকট প্রকাশ্য স্বাধীনতার কথা আমি প্রথম শুনতে পাই।
১৯৬৬ সাল।পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের চলাচল বন্ধ। শ্রীলংকা ঘুরে বিমান ঢাকা-করাচী সংযোগ রক্ষা করছে। ২রা এপ্রিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা মোট ৬ জন যাচ্ছি লাহোরে একটি জাতীয় সম্মেলনে যোগদান করতে। তাসখন্দ ঘোষণার পর পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা ডেকেছেন এই সম্মেলন। আলোচ্য বিষয়- তাসখন্দ ঘোষণা জাতীয় স্বার্থকে মারাত্মকভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের জোয়ানরা যুদ্ধক্ষেত্রে যে জয়লাভ করেছিল আইউব খা ঁআলোচনার টেবিলে তা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছেন। যাহোক আমরা শ্রীলংকা ঘুরে সকালের দিকে গিয়ে পৌ ঁছালাম করাচীতে। বিমান বন্দরে হাজার হাজার বাঙালী বঙ্গবন্ধু এবং তার দলকে অভ্যর্থনা জানালো। দলের মধ্যে (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, (২) তাজউদ্দিন আহমদ, (৩) আব্দুল মালেক উকিল, (৪) আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ নূরুল ইসলাম চৌধুরী, (৫) এবিএম নূরুল ইসলাম এমএনএ এবং (৬) আমি নিজে। সব বাঙালীর একটাই প্রশ্ন ‘মুজিব ভাই, আমাদের বাঙালীদের কি হবে”। তিনি সবাইকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে বললেন, “দেখ বাঙালী জাতির দাবিতো ন্যায্য দাবী। আমরা পথ খুঁজে পাবই।” আমরা গিয়ে উঠলাম মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সোলায়মান বেবীর বাসা বিখ্যাত “লাখাম হাউসে”। সেখোনেও সারাদিন বহু লোকের আনাগোনা-বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে। সবারই একই প্রশ্ন এই সংকট উত্তরণের পথ কি? এর মধ্যে দুপুরের আহারের পর শেখ সাহেব আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসলেন এবং বললেন আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছুজরুরী আলোচনা আছে। তারপর তিনি সঙ্গে নিয়ে আসা ৬ দফার’ কাগজপত্র ব্যাগ থেকে বের করলেন। আমরা পড়লাম। তিনি আমাদের বিশদ বুঝানোর চেষ্টা করলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর আমি বললাম, “আপনি আমাদের নেতা, বহু দিক বিবেচনা করার পর আপনি এই ৬ দফা প্রনয়ণ করেছেন এবং দেশবাসীর সামনে তা দিতে যাচ্ছেন। মনে হয়, পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষ করে পাঞ্জাব এই ৬ দফা মানবে না।” আমি এর কারণ বিশ্লেষণ করে বলবার চেষ্টা করলাম, “এই ৬ দফা যদি অমননীয় হয় তাহলে এটা সরাসরি ১ দফার দিকেই চলে যাবে। আমরা কি এর জন্য তৈরী হয়েছি?” প্রায় সবাই একই মত প্রকাশ করলাম। তাজউদ্দিন ভাই মুচকি মুচকি হাসছিলেন। জানি না নেতার সঙ্গে তার পূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কি-না। বঙ্গবন্ধু অনেক দিক দিয়ে বিষয়টির উপর আলোকপাত করে বললেন“আজ হোক কাল হোক পূর্ব পাকিস্তান কে একদিন আলাদা হতেই হবে। এ রকম কৃত্রিম ভৌগোলিক অবস্থান,আর্থসামাজিকও সাংস্কৃতিক ভিন্ন অবস্থা নিয়ে দুটা অংশ কতকাল দাড়িয়ে থাকবে। এটা সত্য কথা যে, আমরা দেশবাসীকে এখনও তৈরী করার কাজে হাত দেইনি। তবে বাঙ্গালীরা অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। সংগঠনের মাধ্যমে এটা করা যাবে। “এরপর লাহোরের সম্মেলন সম্পর্কে আলোচনা হল এবং আমরা কোন লাইন গ্রহণ করবো তাও তিনি জানিয়ে দিলেন। এর পরের কথা- পরদিন আমরা লাহোরে গেলাম সরাসরি সম্মেলন স্থানে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনের সামনের বিরাট লনে এই সম্মেলনের আয়োজন। নেতাকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থণা করা হল। আমরা বসলাম। সম্মেলন তখনো শুরু হয়নি। সময় সকাল ৯-৩০মিঃ। সাবজেক্ট কমিটির সভা শুরু হবে। বঙ্গবন্ধু মালেক ভাইকে পাঠালেন সাবজেক্ট কমিটির সভায়। তিনি সেখানে বক্তব্য রাখলেন- এটা যেহেতু জাতীয় সম্মেলন, সেহেতু জাতীয় সমস্যাগুলি আলোচনার মাধ্যমেই এখানে প্রতিফলিত হবে। তাসখন্দ ঘোষণা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বন্যা, অর্থনৈতিক শোষণ, চাকুরীর ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য, মারাত্মক বেকার সমস্যা এগুলিও আমাদের জাতীয় সমস্যা এবং এগুলিও এই সম্মেলনে আলোচিত হবে। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রবেশেরও অনেক সমস্যা আছে- সেগুলিই বা কেন এখানে আলোচনা করা যাবে না। কিন্তু চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর যুক্তি হল- এতগুলো সমস্যা আলোচনা করতে গেলে মূল আলোচ্য বিষয় (তাসখন্দ ঘোষণা) গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোন সমস্যারই আলোচনা হবে না এই কথার পর আওয়ামী লীগের অনমনীয় মনোভাবের ফলে সাবজেক্ট কমিটিতে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের পক্ষে ওয়াক আউট করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সম্মেলন ত্যাগের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার কাগজপত্র আমাদের হাতে দিলেন বিলি করার জন্য। বিখ্যাত ৬ দফা এইভাবেই লাহোরে প্রথম জনগণের হাতে গিয়ে পৌঁছুল। সম্মেলন স্থানের অনতিদূরে মালিক গোলাম জীলানী সাহেবের বাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমার সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রায় ৩/৪ শত পশ্চিম পাকিস্তানী, অবশ্য অধিকাংশই আমাদের আওয়ামী লীগ কর্মী, আমাদের ধাওয়া করে। আমরা দ্রুত হেঁটে জিলানী সাহেবের বাসায় পৌঁছলাম। মালিক জিলানী এবং আজম খান এই দুইজন শেখ সাহেবের দুই পার্শ্বে দেহরক্ষীর কাজ করেছিলেন। জিলানী সাহেবের বাসায় পৌঁছার পর আর এক দৃশ্য। আসলে আমরা সকাল থেকে কেউই চা নাস্তা করিনি। অনেক সকালে উঠে করাচী বিমান বন্দরে ছুটতে হয়েছিল লাহোরগামী বিমান ধরার জন্য। আমরা পাশের ঘরে চা খাচ্ছি তখন ভীষণ গোলমালের শব্দ কানে কানে আসে। ব্যাপার কি? জিলানী সাহেব এসে বললেন ৩/৪ শত লোক এসেছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাদের প্রশ্ন আপনি এত বড় একটা সম্মেলন কেন বানচাল করে দিলেন এবং এর দ্বারা আপনি বিরোধী দলগুলির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্মেলন কেন নষ্ট করে পরোক্ষভাবে আইউব খানকেই সাহায্য করলেন। তারা খুবই উত্তেজিত, বিক্ষুব্ধ এবং বিশৃঙ্খল। পরে অবশ্য তিনি সবারই বক্তব্য শোনার পর তার বক্তব্য দিলেন। ১ঘণ্টাব্যাপী এই বক্তব্যে পূর্ব পাকিস্তানের এবং তারপর সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের নিপীড়িত বঞ্চিত দরিদ্র জনগণের যে করুণ এবং মর্মান্তিক কাহিনী ব্যক্ত করলেন তা শুনে অনেকেই কেঁদে ফেললেন। বিশেষ করে বেলুচিস্তান এবং সীমান্তের কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নেতা নও- আমাদেরও নেতা। আমাদের কথা কেউই তো সাহসের সাথে এমন করে কোনদিন বলেনি। তারপরও তিনি ৬ দফার ওপর সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজগুলিতে ৬ দফা নিয়ে ঝড় উঠতে শুরু করল।
১৯৬৬ সালের জাতীয় পরিষদের শীতকালীন অধিবেশন বসেছে ঢাকায়। আমার একটা প্রস্তাব (Resolution) গৃহীত হল আলোচনার জন্য। বিষয়বস্তু ছিল 'পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আমদানী নীতি (Separate Import policy for East Pakistan)। আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের ওপর তুলনামূলক আলোচনা করে দেখানোর চেষ্টা করলাম যে, দুই অঞ্চলের অবস্থা, বিশেষ করে শিল্প- বাণিজ্যের অবস্থা এবং সমস্যা পৃথক বলেই একই নীতিতে দুই অঞ্চলের সমস্যার সমাধান হবে না। বললাম, দুই পৃথক রোগীর জন্য একই প্রেসক্রিপশন চরতে পারে না। এর ওপর আলোচনার ঝড় উঠলো। আর তার চেয়েও বেশি ঝড় সৃষ্টি হল পশ্চিম পাকিস্তানের চলতে পারে না। এর ওপর আলোচনার ঝড় উঠলো। আর তার চেয়েও বেশি ঝড় সৃষ্টি হল পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলিতে। Pakistan times তো সম্পাদকীয়তে বলেই ফেললো, অধ্যাপক ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগের লোক- আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায় এবং এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমি এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। প্রস্তাবটি ভোটে হেরে গেলেও আমরা পূর্ব পাকিস্তানের করুণ অবস্থা তুলে ধরবার চেষ্টায় মোটামুটি সফল হয়েছি। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো, খায়ের বক্স মারী, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গলসহ বেশ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী এমএনএ এ কথা স্পষ্ট করে আমার কাছে বলেছেন যে, ইনসাফ কায়েম করতে না পারলে চিরদিনের জন্য একটা জাতিকে এভাবে রাখা সম্ভব নয়।
এরপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে শেখ মুজিব যখন ঢাকা সেনানিবাসে আটক, আমরা কয়েকজন প্রত্যেকদিন তার সাথে দেখা করতে যেতাম। অফিসারস মেসে দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হত। কর্নেল এ,বি, নাসেরের ওপরে দায়িত্ব ছিল আমাদের মেহমানদারীর। সেখানে প্রায় দিনই নাসেরও আলোচনায় অংশগ্রহণ করত। শেখ সাহেব বলতেন, নাসের, দেখো, মামলায় আমার কি হবে আমি জানি না কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলছি। দেশের দুই অংশের সম্পর্কটাকে তোমরা এত বেশি নাজুক করে তুলেছো যে যত বেশি টানবে তত শীঘ্র ছিঁড়ে যাবার থাকবে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকে আওয়ামী লীগ পার্লামেণ্টারী পার্টির নির্বাচনে আমি পার্টির চীফ হুইপ হই। অন্য দুইজন ছিলেন জনাব আব্দুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম। ৩রা মার্চ থেকে পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে। স্বভাবতই চীফ হুইপ হিসেবে পরিষদ ভবনে সংসদ সদস্যগণের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আমি খুই ব্যস্ত। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু সংসদ সদস্য ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে নেতা আমাকে তার ৩২ নং রোডের বাসায় ডেকে পাঠালেন। ঐ বাসায় সব সময় লোকজনের অসম্ভব ভীড়, আমি এলেই গাজী গোলাম মোস্তফা আমাকে বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরী রুমে পৌঁছে দিলেন। সেখানে দরজা বন্ধ রেখে বঙ্গবন্ধু আরেকজনের সাথে নীচুস্বরে আলাপ করছিলেন। আমি ঢুকতেই তিনি গাজী সাহেবকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতে বললেন। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি হলেন আলী সাহেব, কোলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার। তাঁদের মধ্যে যা আলোচনা হবার তা পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল। তিনি সালাম জানিয়ে চলে গেলে নেতা আমাকে বললেন, বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপ আলোচনা করে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ওরা সবকিছু সহজভাবে এগিয়ে যেতে দিবে না। হয়তো একটা চরম পরিণতির দিকেই আমরা অনিবার্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই জন্যেই আমি হোসেন আলী সাহেবকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। যদি সে রকম একটা অবস্থার উদ্ভব হয়, তার চিন্তাভাবনা এবং ব্যবস্থা তো আগে থেকে কিছু করে রাখতে হবে। তারপর তিনি আমাকে অন্যান্য প্রস্তুতি কতদূর কি হলো জানতে চাইলে আমি তাকে গৃহীত ব্যবস্থাদি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করলাম।
২৪ শে মার্চ সকাল ৬টা। বাসার টেলিফোন বেজে উঠলো। দিনাজপুর সদর এসডিও আবদুল লতিফ সাহেব অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে জানালেন সৈয়দপুরে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। বাঙালীদের মেরে শেষ করে দিচ্ছে।
এর কয়েকদিন আগে থেকেই গোটা দেশে একটা থমথমে ভাব। একদিকে আইন অমান্য আন্দোলন, অন্যদিকে আলোচনা চলছিল বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়া খাঁর মধ্যে। উত্তেজিত ফেটে পড়েছে সারাদেশ। এর মধ্যে হঠাৎ সৈয়দপুরে বাঙালী- বিহারীদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে তা আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যকে আরো দূরে ঠেলে দেবে। আমি ফোন করলাম জিলা আনসার কমাণ্ডার শরীফুল ইসলাম সাহেবকে। তাকে বললাম রাইফেল ক্লাবে কি কি অস্ত্র এবং গুলি আছে খুব তাড়াতাড়ি বের করে আনুন। বেশ কয়েকটি রাইফেল এবং কয়েক কার্টন গুলি নিয়ে এসডিও সাহেবের জিপে এগিয়ে চললাম সৈয়দপুরের দিকে। সৈয়দপুরের কাছাকাছি যাওয়ার পর স্থানীয় জনগণ আমাদের জানালো যে আসলে বাঙ্গালী-বিহারী দাঙ্গা নয়- সেনানিবাসের মিলিটারীরা সাদা পোষাকে বাঙালীদের নির্বিচারে হত্যা করছে এবং ইতিমধ্যে তারা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেণ্ট মাহতাব বেগ, তার পুত্র এবং আরো অনেক লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। বুঝলাম উচ্চতর মহলে যতই আলোচনা চলুক আসলে মিলিটারীরা দেশে একটি বিশৃঙ্খল ও জঙ্গী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় বা দেশকে আর্মি এ্যাকশন-এর দিকে ঠেলে দিতে পারে। দিনাজপুরে ফিরেই টেলিফোনে শেখ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাঁকে ব্যাপারটা জানাতে তিনি বললেন ওরা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে আলোচনা পণ্ড করার জন্যে। যা হোক তোমরা চেষ্টা করো যাতে সৈয়দপুরের অবস্থা দিনাজপুরে সংক্রমিত না হয়। আমি প্রতিদিনই ঢাকায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করে জানবার চেষ্টা করতাম আলোচনার অগ্রগতি এবং ঢাকার অবস্থা। সেদিন জানতে চাইলে তাঁর মনের হতাশা কিছুতেই চাপা থাকল না।
২৪ এবং ২৫ শে মার্চে সারাদিন আমরা কয়েকজনে মিলে দিনাজপুর শহরের বিহারী এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম যেন বাঙ্গালী-বিহারী সম্প্রীতি কিছুতেই ক্ষুণ্ন না হয়। ২৫ শে মার্চ বিকেলে ই,পি,আর সেক্টর কমাণ্ডার তারেক রসুল কোরেশীর সাথে ফোনে আলাপ করলাম। তিনি বললেনআমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি অবস্থা শান্ত এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যার পর আমি বাসা থেকে বেরোচ্ছি আওয়ামী লীগ অফিসে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ বাইরের ঘরে ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরতেই বঙ্গবন্ধুর সেই ভারী গলা- তিনি দিনাজপুরের অবস্থা জানতে চাইলে সংক্ষেপে জানিয়ে বললাম ঢাকার কি অবস্থা। তিনি বললেন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করো। আরেকবার ঢাকার কথা জানতে চাইলে তিনি আবার বললেন ‘সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাবে’ বলেই ফোন ছেড়ে দিলেন। অন্যান্য দিন অন্ততঃ দু'এক কথায় ঢাকার অবস্থা তিনি জানাতেন কিন্তু আজ কেন কিছুই বললেন না ভেবে মনটা আশঙ্কায় দুলে উঠলো। এরপর আওয়ামী লীগ অফিসে কয়েকজন বসে আছি। অনিশ্চিত ও থমথমে অবস্থা। একটু আগেই নিউ টাউন থেকে ফিরেছি। সেখানকার অবাঙালী নেতাদের খুব উদ্ধত মনে হলো অথচ ইতিপূর্বে কতই না বিনয়ের সাথে আমার সঙ্গে বরাবর ভাল ব্যবহার করেছে। যা হোক রাত তখন ঠিক ১২টা ৩ মিনিট। হঠাৎ গুলির শব্দ। কখনও মনে হয় নিউ টাউন জিলা স্কুলের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুলির শব্দ আরো প্রবল হল। আওয়ামী লীগ অফিসে থাকাটা আমরা নিরাপদ মনে করলাম না। সবাই আপন আপন বাড়ির দিকে দ্রুত রওয়ানা হলাম। বাসায় এসে মোটরসাইকেলটা রেখে টেলিফোনের কাছে এলাম। ভাবলাম এসপি’র কাছ থেকে জানবার চেষ্টা করি প্রকৃত ব্যাপারটা কি, ফোন তুলেই দেখি লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে থানার দিকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। অতিরিক্ত এসপিকে পেলাম তিনিও বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। শুধু এটুকু বললেন মিলিটারীরা ট্রাকে করে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে বেড়াচ্ছে। এমনকি জিলা স্কুলের কাছে রাত্রিকালীন পাহারারত পুলিশের গাড়ীর দিকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি? আরো ধাঁধায় পড়ে গেলাম।
বড় অস্বস্তির মধ্যে ঘুমহীন রাত কেটে গেলো। ভোর রাতে আজানের পরপরই মাইকে প্রচার শুনলাম বেলা ১১ টা থেকে কারফিউ। দিনটি ছিল শুক্রবার।
সকাল সাড়ে সাতটার সময় বারান্দায় বসে আছি। এমন সময় ডিসি’র একজন পিয়ন সালাম জানিয়ে আমার হাতে একটা স্লিপ দিল। তাতে ডিসি (ফয়েজউদ্দিন সাহেব) লিখেছেন আমার বাসায় আমার সঙ্গে চা খেলে আমি খুব খুশী হব। আমি ৮ টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। ইতিপূর্বে ভোর বেলায় আমার মা বলেন যে, তিনি রাতে খুবই খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন। রাস্তায় রাস্তায় কুকুর মানুষের লাশ ছিড়ে খাচ্ছে সুতরাং সবাইকে নিয়ে তখুনি গ্রামের বাড়ি চলে যেত চান। কিন্তু এই অবস্থায় আমি কি করে যাই! তাই আমি, আমার স্ত্রী ও কনিষ্ঠা মেয়েটি বাদে বাসার সকলেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেল। বাসা থেকে বেরিয়ে থানার কাছে গিয়ে ওসিকে বললাম ডিসি’র বাংলোয় যেতে হবে কিন্তু যানবাহন তো নেই। এমনিতেই শুক্রবার দোকান-পাট বন্ধের দিন, তার ওপর কারফিউ ঘোষণা। এমন সময় অতিরিক্ত এসপি গাড়ী নিয়ে থানায় ঢুকলেন। তিনি বললেন, আমার মনটা কিন্তু সায় দিচ্ছে না যে আপনি ডিসি’র বাংলোয় যান। কারণ, পাশেই সার্কিট হাউস। মিলিটারীদের অস্থায়ী হেড অফিস। দেখাই যাক না কি হয় এই মনে করে তাঁর গাড়িতে আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়। ডিসি’র বাংলোর গেট বন্ধ, পাশের সার্কিট হাউসের গেট খোলা। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই গেটের পাহারাদার সৈনিক এমন অভদ্র এবং কর্কশভাবে আমাদের অভ্যর্থণা করে ভিতরে নিয়ে গেল যাতে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। গাড়ী বারান্দায় বেশ কয়েকজন মিলিটারী অফিসার। এক পাশে ডিসি। তিনি এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মেলাতেই শান্ত স্বরে বললেন আপনি কেন এলেন? বলেই মুখ ফিরিয়ে আরেকদিকে চলে গেলেন। আশ্চর্য ব্যাপার! (পরে ডিসি আমাকে বলেছিলেন যে অস্ত্রের মুখে তিনি সেই স্লিপটা লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন)।একটু পরে আরো ২/১ জন আওয়ামী লীগ নেতা এল লেঃ কঃ তারেক রসুল কোরেশী আমাদের নিয়ে বসলেন। তাঁকে সাহায্য করলেন মেজর তারিক আমিন। কোরেশী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঢাকায় আপনাদের শেখ সাহেব প্রেসিডেণ্টের সংগে আলাপে রয়েছেন। আলাপের ফলাফল যাই হোক কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই সামরিক আইন জারী করা হয়েছে। আমি আপনাকে বলছি, আপনার লোকজনকে জানিয়ে দিন, তারা যেন আমাদের সাথে সহযোগিতা করেন। বলেই তিনি অন্যান্যদের চলে যেতে বললেন কিন্তু আমাকে থাকতে বললেন। মিলিটারী অফিসাররা সবাই উঠে চলে গেলে আমি একাই চুপচাপ বসে আছি। পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমাকে থাকতে বললেন কি আরো কিছু আলাপ করার জন্য, নাকি চা খাওয়ানোর জন্য। এই মেজর আর কর্নেল যে কতদিন আমার বাসায় চা খেয়েছ, কত সহজ ব্যবহার করেছে কিন্তু আজকের ব্যবহারের সঙ্গে তার কত প্রভেদ। আজকে মনে হচ্ছে তারা যেন চেনেই না।
যাক, তখন প্রায় সাড়ে ১০টা বাজে। ১১টা থেকে কারফিউ। কারো পাত্তা নেই উঠে চলেই যাব কিনা ভাবছি। একবার উঠেই দাঁড়ালাম অমনি দরজায় স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকটি ভাঙা গলায় হুকুম করলো“বয়ঠো”। আর কি মুশকিল। তার মিনিট পাঁচেক পরে কোরেশী এসে বললো, “আপনি বাসায় চলে যান। বাসাতেই থাকবেন।” তাঁকে বললাম, ১১টা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট, রিকশা পাবার কোন আশা নেই। দয়া করে তোমার গাড়ি করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলে বলতেই “সরি” বলে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। আমার তো ব্যবহার দেখে অবাক হবার পালা। আমি দ্রুত বেরিয়ে হেঁটে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। পরে ক্যাপ্টেন নজরুলের কাছে সমস্ত ব্যাপারটা শুনেছি। নজরুল বাঙালী। তিনি পাশের ঘরেই অসুস্থ বলে মুখে কাপর ঢেকে শূয়ে ছিলেন। ঘটনাটি ছিল আমাকে নিয়ে কি করা হবে।৪/৫ জন মিলিটারী ফফিসার কিছুতেই একমত হতে পারছিল না। মেজর জিলানী নামে একজনের মত ছিল ঝামেলা করে লাভ নেই, এখন রেখে দিয়ে রাতে শেষ করে দেয়া হোক। কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর মত ছিল সৈয়দপুরের সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়া হোক- যা করার সেখানেই আজকে রাতের মধ্যে করা যাবে (ইনিই আমার বাসায় চা খেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি)। শুধু মেজর তারিক আমিনের মত হল আমরা তার সম্পর্কে যখন কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পাইনি তাই এখন অন্য কিছু না করে বাসায় অভ্যন্তরীণ করে রাখা হোক (অথচ কয়েকদিন আগে ছাত্রদের একটা মিছিলের ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড বাদানুবাদ হয়েছিল)। লে; দুররানী নামে একজন অফিসার তাকে সমর্থন করে এবং এই দররানীকেই দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য।
বাসায় আছি। কারফিউ। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। সামনে দিয়ে কয়েক মিনিট পরপর মিলিটারী টহল। একটা অসহ্য অবস্থা। এর মধ্যেও যতটুকু সম্ভব আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা চালাতে লাগলাম। আমি বিশেষ করে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলাম ইপিআর-এর সুবেদার মেজর রউফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কারণ বেশ কয়েক মাস, বিশেষ করে নির্বাচনের পর থেকেই, তার সঙ্গে আমার বহু গোপন বৈঠক হয়েছে। ইপিআর-এ যদিও কিছু বাঙালী অফিসার ছিল কিন্তু কেন যেন আমি তাদেরকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। সেই কারণে সুবেদার মেজর রউফ এবং তার মাধ্যমে দিনাজপুর ও রংপুর জিলার বাঙালি ইপিআর-দের সাথে এই বিষয়ে আমার পক্ষে গোপন যোগাযোগ সম্ভব হয়েছিল। তখন দিনাজপুর ও রংপুর একই সেক্টরের অধীনে ছিল এবং দিনাজপুর ছিল সেক্টর হেডকোয়ার্টার। এই অবস্থাতেই বাসার পেছনের দিক থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে মাড়োয়ারী পট্টিতে এক বাসায় তাঁর সাথে আমার সংক্ষিপ্ত আলাপ হল। আমি শুধু জানতে চাইলাম আমাদের পূর্বপরিকল্পনা ঠিক আছে কিনা এবং সেই মোতাবেক কাজ করতে কোনো বিশেষ অসুবিধা আছে কিনা। তিনি জানালেন সব ঠিক আছে। তখন সময় ২৬ শে মার্চ রাত ৯টা। সিদ্ধান্ত হলো ২৮ শে মার্চ দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে আমরা আমাদের কাজ শুরু করব। ইতিমধ্যে আমার করণীয় সম্পর্কেও তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমার কাজ ছিল দিনাজপুর জেলার পশ্চিম সীমান্তের ইপিআর ফাঁড়ি থেকে বাঙালি ইপিআর-দের উপরোক্ত সময়ের পূর্বেই এক জায়গায় জমায়েত করা। বাসায় ফিরেই আমার স্ত্রীকে বললাম আমাদের দু'জনের একসঙ্গে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় অথচ আমাকে যথাশীঘ্র সম্ভব বাইরে চলে যেতে হবে।
সকাল হল। বাইরের রাস্তায় মিলিটারী টহল। আমি বেলা ৯ টার দিকে আমার স্ত্রী এবং ছোট বাচ্চাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে বাসার পেছন দিয়ে প্রাচীর টপকে রাস্তায় একটা রিকশা নিলাম। রিকশা দ্রুত চালাতে বললাম। প্রথমে যেতে বললাম মুন্সিপাড়া। এই চরম দুর্দিনে জুগলু এবং আব্দুর রহীম সাহেবের খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। হঠাৎ রিকশাওয়ালা আমাকে উর্দুতে বলল প্রফেসার সাহেব, আপনি যত শীঘ্র পারেন টাউন ছেড়ে চলে যান। আমি জানি আপনার খুবই বিপদ। এতক্ষণ এদিকে খেয়ালই ছিল না যে রিকশাওয়ালা অবাঙালি অথচ সেই আমাকে প্রাণ বাচাঁনোর জন্য সরে যেতে বলে। যাহোক, জুগলু এবং রহীম সাহেব নেই, তারা শহর ছেড়ে চলে যেতে পেরেছেন। তারপর শাহ মাহতাবের বাসায় যাই। তাকে আর এক বাসা থেকে খুজে ঁনিয়ে রিকশাওয়ালাকে বললাম কাঞ্চন ঘাটের দিকে যেতে। সে বলল কাঞ্চন কলোণী এবং কাঞ্চন ঘাটে মিলিটারী পাহারা দিচ্ছে। সে এক বাঁধের কাছে আমাদের ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অতিক্রম করে নদী পার হতে বললো। আমি রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম। সে বলল আল্লাহ আপনার হেফাজত করুন।
বাঁধ পার হতেই দেখি নদীর পশ্চিম পাড়ে ২/৩ হাজার লোক লাঠিসোঁটা বল্লম ইত্যাদি নিয়ে জড় হয়েছে। ওরা আমার গ্রামের ও আশেপাশের লোক। ওরা শুনেছে আমাকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবার জন্যই ওরা সমবেত হচ্ছে। তাও আবার লাঠি-বল্লম নিয়ে মিলিটারীর মোকাবিলা- মনে মনে হাসলাম। আমাকে দেখেই ওরা আনন্দে উত্তেজনায় যেন পাগল হয়ে গেল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ সইল না। হঠাৎ কয়েক রাউণ্ড গুলির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ৫/৬ জন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তিনজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল। আর ২ জন গুরুতর আহত। বেশ দূরে একখানা জীপ থেকে নেমে আমাকে লক্ষ্য করেই গুলি। আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম কিন্তু আমারই জন্য কয়েকটা অমূল্য প্রাণ চলে গেল।
এদিকে আমি চলে যাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই মিলিটারীরা টের পেয়ে যায় যে আমি যেভাবেই হোক বাসার বাইরে চলে গেছি। তখনই তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আমার খোঁজে। বিশেষ করে আমার গ্রামের বাড়ি যাবার রাস্তায় কাঞ্চন ঘাটের কাছে যখন তারা আমার সন্ধান পেল তখন আমি কয়েক হাজার লোক দ্বারা পরিবেষ্টিত। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে জীপ থেকে নেমে কয়েক রাউণ্ড গুলি করেই তারা চলে যায়। নদী পার হতে সব কাপড় ভিজে গিয়েছিল। ভেজা কাপড়েই কয়েক মাইল হেঁটে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছি। পৌঁছেই প্রথম কাজ হলো কয়েকজন লোককে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করা। সেতাবগঞ্জের রউফ চৌধুরীকে লিখলাম তুমি সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের সব ক'খানা ট্রাক বিভিন্ন ইপিআর শিবিরে পাঠিয়ে দাও। তাদেরকে নিয়ে রাতের মধ্যে আমার গ্রামের কাছে সমবেত হও। রাত ২/৩ টার মধ্যেই ২/৩ খানা ট্রাকে ভর্তি ইপিআর দেওয়াদিঘী হাটখোলায় হাজির। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হল। তারা সকালের পূর্বেই কাঞ্চন ব্রীজের পশ্চিম পার্শ্বে গ্রামের আড়ালে পজিশন নিল।
২৮শে মার্চ রবিবার। সেই বিশেষ মূহূর্তটি উপস্থিত হল যার জন্য কয়েক মাস কত গোপন আলোচনা, শলাপরামর্শ উত্তেজনা। বেলা তিনটা বাজার পূর্বে প্রথমেই ৬ পাউণ্ডার এর গুলির শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় সৃষ্টি হল যেন। আসলে অপারেশন শুরু হয়েছে বলে ২টা থেকেই। কুঠিবাড়ি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যত অবাঙালি ইপিআর জওয়ান এবং অফিসার ছিল তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে শেষ করতে হয়েছে। কারণ গুলির শব্দ হলেই কয়েক শত গজ দূরে অবস্থান গ্রহনকারী মিলিটারীদের কাছে খবর পৌঁছে যেত। ইপিআর-দের টারগেট ছিল সার্কিট হাউসের পাশের ময়দান এবং বড় ময়দানের মাঝখানে অবস্থিত অফিসারস ক্লাব। এগুলিতেই মিলিটারীরা অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু বিপদ হল, সেখান থেকে গুলি কুঠিবাড়িতে আসছিল আরো দুটি স্থান থেকে। উপরোক্ত স্থান ছাড়াও রাজবাড়ীর কাঁটাপাড়া এবং সুইহারী ডিগ্রী কলেজের ছাদের ওপরেও যে মিলিটারীরা পজিশন নিয়েছিল সেটা ইইআর'রা জানতে পারেনি। তিন দিকের গুলির আক্রমণে তারা অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেল।তখন তারা নতুন একটা কৌশল গ্রহণ কনল। কুঠিবাড়ির পশ্চিম পাশের প্রাচীর ভেঙ্গে তারানদীর বালুর ওপর অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করল। এটা মিলিটারীরা টের পেলনা। এ সময়ে কাঞ্চন ঘাট, বাইশাপাড়া, কাঞ্চন রেলওয়ে ব্রীজের পশ্চিম পার্শ্বে উঁচু লাইনের দু'পার্শ্বের নীচু জায়গায় হাজার হাজার উল্লসিত মানুষের ঢল। তাদের মাথার ওপর দিয়ে গোলাগুলি ছুটছে অথচ তার মধ্যেই নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে নদী পার হয়ে ছুটে যাচ্ছে কুঠিবাড়ির ভেতর। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাগুলির ভারী বাক্সগুলি কয়েকজনে মিলে অনায়াসে নদী পার করে পশ্চিম পাড়ে এনে জমা করছে। সেখানে গোলাগুলিতে ক’জন লোক নিহত হয়। এ যেন জীবনকে বাজী রেখে মহোল্লাসে মেতে ওঠার তীব্র প্রতিযোগিতা।সেখান থেকে রাতের মধ্যে খোশালডাঙ্গা হাটে সব অস্ত্রশস্ত্র ও মালপত্র এনে জড়ো করা হলো।
এর মধ্যেও শহরের কয়েকটি লক্ষ্যে বিশেষ করে উপশহরে (নিউ টাউনে) গোলা নিক্ষেপ চলতেই থাকে। কারণ, মিলিটারী ও অবাঙালি ইপিআর'রা পিছিয়ে এখানেই আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সারা রাতব্যাপী গোলাগুলি চলে।
পরের দিনই দুটো ঘটনা ঘটল। দিনাজপুর শহরের অমিয় কুটিয়ে সিকিউরিটিসহ মেজর রাজা থাকতো সপরিবারে। তার স্ত্রী কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতা জনাব সাদ আহমদ সাহেবের বোন। মেজর রাজা যখন অয়ারলেস সেটের সামনে বসে করাচী এবং অন্যান্য স্থানে খবর পাঠানোর চেষ্টা করছিল, ঠিক সেই সময়ে ইপিআর'রা তাকে ধরে নিয়ে আসে এবং দিনাজপুর হেমায়েত আলী হলের সামনে গুলি করে হত্যা
মেজর তারিক আমিন সকাল বেলা ডিসি'র বাংলোয় এসে তার কাছে দেখা করে প্রাণ ভিক্ষা চায় এবং আশ্রয় চায়। অবশ্য ডিসি’র পক্ষে সেই পরিস্থিতিতে তা করা সম্ভব ছিল না। তার একদিন পরেই শহরের উপকণ্ঠে কসবা এলাকায় নদীর তীরে তাকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়। লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশী জনৈক স্থানীয় চেয়ারম্যান (পরবর্তীতে রাজাকার হিসেবে তাকে কারাগারে দীর্ঘ দিন থাকতে হয়েছিল)- এর সহায়তায় মোহনপুর ব্রীজ পার হয়ে আমবাড়ী দিয়ে রাতের অন্ধকারে পরবর্তীপুর পৌঁছে প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হয়েছিল। তারপর কয়েকদিনের জন্য কাঞ্চন ঘাট থেকে ২ মাইল পশ্চিমে ভবানীপুরে আফতাবউদ্দিন সরকার সাহেবের বাড়িতে সাময়িকভাবে জেলা সদর স্থানান্তরিত হয় এবং জেলা কর্মকর্তাগণ সেখান থেকেই সেই অস্বাভাবিক অবস্থায় যতটা সরকারী কাজকর্ম, নির্দেশনামা জারী করতে থাকেন।
৩১ তারিখে দিনাজপুর ইনিস্টিটিউট প্রাঙ্গণে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (ক) অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী, (খ) গোলাম রহমান, (গ)এ,এম আই জেড ইউসুফ এবং (ঘ) গুরুদাস তালুকদার- এই ক’জনের নামে একটি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করতে হবে। প্রচারপত্রে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের দাবি করা হবে এবং জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানানো হবে। এই প্রচারপত্র ১লা এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত হয় এবং এই সপ্তাহেই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত থেকে দৈনিক ‘কালান্তর' পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।
এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে অবিলম্বে কয়েকটি কাজ করতে হবে। সেগুলি হচ্ছে ভারতে গিয়ে ভারত সরকার এবং আন্তর্জতিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে বাংলাদেশের অবস্থানকে তুলে ধরা; বাংলাদেশের অন্যান্য নেতার সঙ্গে সম্ভব হলে যোগাযোগ স্থাপন করা; এবং আমাদের ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ যুদ্ধরত জনগনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করা। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি ২ রা এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করি। এর পূর্বে দিনাজপুরের ডেপুটি কমিশনার আমার কাছে কিছু নির্দেশ চাইলে আমি তাকে নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী দেইঃ কোন অবস্থাতেই কোন ব্যাংকের স্ট্রং রুম থেকে যাতে নগদ অর্থ এবং সোনা রুপা গয়না লুটতরাজ না হয়; প্রয়োজন না হলে কোন ব্যক্তিকে হত্যা না করা;দেশের ভেতরে সীমান্তের কাছাকাছি খাদ্যশস্য মওজুদ করা যাতে যুদ্ধরত লোকদের খোরাকীর কোন অসুবিধা না হয়।অতঃপর ভারতের উদ্দেশে আমি রওয়ানা হই।
সীমান্তের ওপারেই অবস্থিত রাধিকাপুর স্টেশনে আমাকে অভ্যর্থনা জানান পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়ঞ্জ মহকুমার পুলিশ অফিসার। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল জেলাসদর বালুর ঘাটে। সেখানে এসপি’র অফিসে দীর্ঘক্ষণ সার্বিক পরিস্থিতি, মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণের সংগে পাক সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের কৌশলগত দিক এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলে। অতঃপর এসপি মিঃ হ্যারিস জেমস পশ্চিম বংগের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জী মহাশয়ের একটি বার্তা আমাকে দেন। ঐ বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী আমাকে অবিলম্বে কোলকাতায় পৌঁছে তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি পরদিন স্থানীয় কংগ্রেস এমএলএ- এর সঙ্গে কোলকাতায় পৌছে সরাসরি কংগ্রেস অফিসে যাই। সেখানে আমাকে অভ্যর্থনা জানান শ্রী অরুণ মৈত্র (পরবর্তীতে পশ্চিম বাংলা কংগ্রেস প্রেসিডেণ্ট)। অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয় এবং কিছু আলাপ আলোচনার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ৩৪ ইণ্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে “বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির” অফিস কক্ষে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জী পূর্ব থেকেই উপস্থিত ছিলেন। উষ্ণ আন্তরিকতা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা তাদের প্রধান সমস্যার কথা বললেন- বাংলাদেশের কোন সংবাদই তারা ভালভঅবে পাচ্ছেন না। বিক্ষিপ্তভাবে প্রাপ্ত কিছু সংবাদের ওপর ভিত্তি করে তারা পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারছেন না। সেই অবস্থায় এই অসুবিধা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, আমাদের পক্ষেও পুরোপুরি বলা সম্ভব ছিল না বাংলাদেশের কোথায় কী ঘটছে। সবরকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিশেষ করে সেই দিনগুলিতে আমি ছিলাম দেশের দূরতম এক সীমান্ত জেলা দিনাজপুরে। আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার দেয়া সংবাদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই আমদের জানাবার ছিল না। তবু এর মধ্যে এই সহায়ক সমিতি একটি অফিস করেছেন এবং কিছু চাঁদা আদায় করে বালুঘাট বেনাপোল সীমান্ত বরাবর উদ্বাস্তু এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাচ্ছেন। এই সহায়ক সমিতি সর্বদলীয়ভাবে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়েছিল এবং ১৯৭১- এর শেষ পর্যন্ত এই সমিতি আমাদের প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা দান করেছিল। প্রথম দিনই অর্থাৎ ৪ঠা এপ্রিল তারিখে মুখ্যমন্ত্রী আমার কাছে তার অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এই বলে যে, দু'তিন দিন আগে বাংলাদেশের দুইজন নেতা তার সংগে দেখা কর দিল্লী চলে গেছেন। তারা তাদের আসল পরিচয় না দিয়ে দুটি ছদ্মনাম মাহমুদ আলী ও রহমত আলী বলে চলে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা উপরোক্ত দু'জন নেতা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রকৃত সংবাদ গোপন করেছেন। পরে জানতে পারি তাঁরা ছিলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। শ্রী অজয় বাবু ছাড়াও এই সমিতিতে ছিলেন প্রাদেশিক মন্ত্রী সন্তোষ রায়, ডাঃ জয়নাল আবেদীন, শ্রী কাশীকান্ত মৈত্র, কংগ্রেসের অরুণ মৈত্র, গোপালপুর কমিউনিস্ট পার্টির স্বাধীন গৃহ এবং শ্রী বিজয় সিংহ নাহার প্রমূখ নেতৃবৃন্দ।
আমার থাকবার জায়গা তাঁরা করে দিলেন কীড় স্ট্রীটের এমএলএ ভবনে। তারপর চেষ্টা চলল নেতৃবৃন্দের সাথে সংযোগ স্থাপনের। প্রথম দেখা হল জনাব কামারুজ্জামান সাহেবের সাথে বালিগঞ্জ এলাকার রাজেন্দ্র রোডের নর্দার্ন পার্কের একটি বাড়িতে। পরর্তীতে জানা গেল বাংলাদেশ থেকে আগত উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের জন্য এই বাসাটি সংরক্ষিত ছিল। বাসাটির তিন তলায় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বেতার যন্ত্র ছাড়া যোগাযোগ স্থাপনের অন্যান্য উপকরণ দ্বারাও এটি সজ্জিত ছিল। এর পরে তাজউদ্দিন সাহেব ফিরে এলন দিল্লী থেকে।পরপরই এলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদ সাহেব। প্রথম দিকে নেতৃবৃন্দের জন্য বাসস্থান নির্দিষ্ট ছিল ১০, লর্ড সিনহা রোডে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, এমএনএ, এমপিএ কোলকাতায় পৌঁছে গেছেন। ১০ই এপ্রিল তারিখে ১০ নং লর্ড সিনহা রোডেই নেতৃবৃন্দ এবং অনেক এমএনএ, এমপিএ’দের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনার পর সরকার ও মন্ত্রিসভার কাঠামো এবং সদস্যগণের নাম ঠিক করা হয়। পরবর্তী ১৭ই এপ্রিল তারিখে এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকতার রূপ গ্রহণ করে। সেখানেই স্বাধীনতার সন্দ ঘোষণার পর আমি মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে শপথ পাঠ করাই। শতাধিক দেশী-বিদেশী সংবাদ সংস্থার বেতার-টেলিভিশন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে একটি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রথম আইনানুগ আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং সরকারের মাধ্যমেই সারা বিশ্বের জনগণের নিকট আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য-সহানুভূতি ও সক্রিয় সমর্থন কামনা করা হয়।
এরপরে নেতৃবৃন্দের জন্য বাসস্থান নির্দিষ্ট হয় ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সপরিবারে থাকেন, সিআইটি রোডে আশু বাবুর বাড়ীতে। অবশ্য মন্ত্রী সাহেবরা বরাবর থিয়েটার রোডের অফিসে বসতেন। কোলকাতা মিশন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণার পর সেখানে খন্দকার মোশতাক সাহেবের পররাষ্ট্র বিষয়ক অফিস বসে। আর বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের হিসাব সংরক্ষণের জন্য প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে আমাকে সেখানে বসতে হত। বিদেশী চাঁদা ও সাহায্যের সমন্বয় করতেন মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলী। হোসেন আলী সাহেব, তাঁর স্ত্রী এই মিশনে থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কোলকাতায় ফিরে একটি নতুন দুশ্চিন্তা আমার মনকে আচ্ছন্ন করল। চিন্তা করলাম মুজিবনগরে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠের সংবাদ শুধু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদটি পাক সেনারা কিভাবে গ্রহণ করবে? আমি জানি না এই মুহূর্তে আমার পরিবারের লোকজন কে কোথায়! গ্রামের বাড়ি থেকে আসার সময় শুধু মা এবং স্ত্রীকে বলে এসেছিলাম ‘যাচ্ছি'। কোথায় যাচ্ছি, কখন ফিরবো, আদৌ ফিরব কিনা সে মুহূর্তে সেই চিন্তার একেবারেই অবকাশ ছিল না। শরীরের কোন স্থানে কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বেদনা বোধ হয় না হয় পরে, ঠিক তেমনি সেই সময়ই এই চিন্তা আমাকে ভীত ও আতঙ্কিত তরে তুলল। কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তাঁরও একই অবস্থা। আনন্দ বাজার পত্রিকার মালিক অশোক বাবু তাঁর গাড়ী এবং কিছু পথ খরচ আমার হাতে দিলেন। আমি এবং হেনা ভাই (কামরুজ্জামান সাহেব) রওয়ানা হলাম আপন আপন পারিবারের সন্ধানে ২০শে এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে। রাতে এসে পৌঁছলাম কৃষ্ণনগর ডাক বাংলোয়। সেখানে শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। মনে ভীতি, অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বাইরে এই দুর্যোগের রাত। সেখানেই মধ্যরাতে আমাদের কাছে এসে পরিচয় দিয়ে দেখা করলেন চুয়াডাংগার আওয়ামী লীগ নেতা এবং একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আসহাবুল হক। তাঁর সাথে প্রায় সারারত ব্যাপী আলোচনা হল পশ্চিম সেক্টরে যুদ্ধের কথা। বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে তাঁকে নির্দেশ দিয়ে আমরা পরদিন সকালে রওয়ানা হলাম। মুর্শিদাবাদ জেলার ‘ভাবতা' নামক স্থানে হেনা ভাই-এর পরিবারের সবারই খোঁজ পাওয়া গেল। তিনি অনেকটা নিশ্চিত হন কিন্তু আমার অবস্থা! পরদিন বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবির আমরা পরিদর্শন করলাম। পরিদর্শন মানে উদ্বাস্তুদের দুঃখ এবং সর্বনাশের করুণ কাহিনী শোনা। পরদিন পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে এসে আমরা রাধিকাপুর-ডালিমগাঁও উদ্বাস্তু শিবিরে যাই। দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার অনেক নেতার সাথে দেখা হল সেখানে। স্থির হলো ১লা মে তারিখে বেলা ১০ টায় রাধিকাপুর প্লাটফর্মে আমরা সকলে মিলে সভার করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। ইতিমধ্যে খোঁজ পেয়ে গেলাম আমার পরিবারের। রায়গঞ্জ শহরে এক বাসার বারান্দায় পেলাম আমার স্ত্রী এবং মেয়েদের। ছেলে দু’জন সেখানে ছিল না। তারা সীমান্তের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে অন্যান্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এরা কি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়দিনে কে দুঃখ দুর্গতির মধ্যে দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে তার কাহিনী আমি শুনলাম। তবে অনেক পরিবারের বুকফাটা কাহিনীর তুলনায় এ আর কতটুকু!
পরদিন ১লা তারিখে গেলাম রাধিকাপুরে সভা করতে। গিয়েই শুনলাম এক শিবিরে এক বৃদ্ধা মরণাপন্ন, মৃত্যুর পূর্বে আমাকে একটু দেখতে চায়। এদিকে সভার সময় হয়ে গেছে। তবু গেলাম মৃত্যুপথযাত্রীকে শেষবারের মতো দেখতে। ঠিক বেলা ১০টা যে সময় সভা অনুষ্ঠানের কথা ছিল তখন আমি শিবিরে। ১০ টা বেজে ১৫ মিনিটের সময় সীমান্ত থেকে পাক সৈন্যরা শেলিং শুরু করল। টার্গেট আমাদের সভাস্থল। তাঁরা বোধহয় পূর্বাহ্নেই খবর পেয়ে গিয়েছিল। রাধিকাপুর স্টেশন ঘরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল এবং কয়েকজন লোকও মারা গেল। সেখানে ঐ সভার নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি নিয়ে, উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টিই বিশেষ গুরুত্বলাভ করল। অনেক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা, খাওয়া-দাওয়া অস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
দুই তিন দির পর ফিরে গেলাম কোলকাতায়। সেখানে একটা যোগাযোগের অফিসের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির প্রচেষ্টায় ৩/১ ক্যামাক স্ট্রীটে অফিস ঘর পাওয়া গেল। আমি সেই অফিসের দায়িত্ব নিলাম। আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করলেন ব্যারিষ্টার বাদল রশীদ। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এটাই সর্বপ্রথম সংযোগ রক্ষাকারী অফিস। ক্যামাক স্ট্রীটে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ৪৫ প্রিন্সেস স্ট্রীটে অফিস স্থানান্তরিত করা হয়। আমাকে তখন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন জনাব কামরুজ্জামান সাহেব - আমি অনারারী মহাসচিব। আমাদের সাহায্য করার জন্য এই অফিসেই বসতেন সর্বজনাব আব্দুল মালেক উকিল, মোঃ সোহরাব হোসেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবত, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে, ‘যুব অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন করা হল। এগুলির কাজ ছিল সীমান্ত অতিক্রম করে আসা যুবকদের জন্য আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, ক্লাস নেয়া, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য পিটিসহ অন্যান্য শারীরিক কসরত ও হালকা অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষা করা। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য মটিভেটর নিয়োগ, তাঁবু-বিছানা-বালিশ, কাপড়-চোপড়, রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম ও নিয়মিত রেশন সরবরাহ করতে হয়েছে। শিবির পরিচালকও আমরা নিয়োগ করতাম। মহাসচিব হিসেবে আমাকে এই শিবিরগুলিতে অর্থসহ যাবতীয় সরবরাহ প্রথমে সরাসরি এবং পরে জোনাল কাউন্সিলের মাধ্যমে করতে হত।
এছাড়াও আমাদের দায়িত্ব ছিল সীমান্ত বরাবর উদ্বাস্তু শিবিরগুলির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভারত সরকারসহ বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র এবং সাহায্যদাতা সংস্থার সরঙ্গ যোগাযোগ করা। উদ্বাস্তুদের কার্ড ও অন্যান্য বস্তু সরবরাহের দায়িত্ব আমাদেরই পালন করতে হত। মূল কথা, যেহেতু, এই সময় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, শিল্পী, সরকারী কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরের উদ্বাস্তুদের রিলিফের প্রয়োজন ছিল সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই অফিসকে সবদিকেই দৃষ্টি রাখতে হত।
যুব অভ্যর্থনা শিবির ছাড়াও তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, আসার মুজাহিদ যাঁরা প্রথম থেকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিলেন (কারণ তাঁরা ছিলেন শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল না) তাঁদের শিবিরগুলির দায়িত্বও আমাদের মন্ত্রীকে নিতে হয়েছে, তাঁদের কাপড়-চোপড়, খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় সরবরাহ আমাদেরকেই করতে হয়েছে। এরপর এসেছে ‘যুব শিবির' প্রকল্পটির ধারণা। এর মূল উদ্ভাবক ভারতের তৎকালীন কেন্দীয় শিক্ষা মন্ত্রী ডঃ ত্রিগুণা চরণ সেন। স্থির হল যুব অভ্যর্থনা শিবির থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বাছাই করে এই যুব শিবিরে আনতে হবে। সেখানে উচ্চতর মোটিভেশনসহ মাঝারি ধরনের অস্ত্র পরিচালনা প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেখান থেকে সরাসরি তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে গেরিলা হিসেবে দেশের ভেতরে প্রেরণ করা হবে কিংবা কেউ যদি আরো উচ্চতর ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ করতে চায়, তাঁদের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‘প্রশিক্ষণ শিবির' নামে আরো কয়েকটি শিবির স্থাপন করা হয়। এসব যুব শিবির সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এগুলোতে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও মেজর পর্যায়ের অফিসারবৃন্দ। এগুলির পরিচালনা ও নিয়োগ-এর জন্য গঠন করা হয় ‘Board of Control Youth Camps'। আমাকে এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। সদস্য ছিলেন (১) ডঃ মফিজ চৌধুরী, (২) ক্যাপ্টেন করীম, (৩) শ্রী গৌর চন্দ্র বালা। সচিব ছিলেন তৎকালীন সিএসপি জনাব নুরুল কাদের খান। ডিজি ছিলেন উইং কমাণ্ডার এসআর মির্জা, ডাইরেক্টর ছিলেন আহামদ রেজা। এর অফিস ছিল ৮নং থিয়েটার রোড, মুজিবনগর কেন্দ্রীয় অফিস ভবনে।
কামরুজ্জামান সাহেব এবং আমি প্রায় এই ‘যুব অভ্যর্থনা শিবির' এবং ‘যুব শিবিরগুলি’ পরিদর্শন করতাম। আমাদের সার্বক্ষণিকভাবে একটি হেলিকপ্টার নির্দিষ্ট করা ছিল। চব্বিশ পরগণা জেলার হাসনাবাদ টাকী থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলের আগরতলা সাবরুম পর্যন্ত সীমান্ত বরাবর দীর্ঘ এলাকাব্যাপী এই সমস্ত শিবির স্থাপিত ছিল। সুতরাং এগুলির পরিদর্শন কাজ খুব সহজসাধ্য ছিল না। ‘যুব শিবির’ কিংবা ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হত মুজিবনগর সরকারের বাজেট থেকে। এই হিসাব সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় স্টাফ ছিল, সময় সময় এই হিসাব অডিট করা হত। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে এই অডিটের হিসাব বাংলাদেশ সরকারের নিকট দাখিল করা হয় এবং ব্যাংকে রক্ষিত টাকা বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রত্যর্পণ করা হয়।
৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। স্মৃতিতে বড় উজ্জ্বল হয়ে আছে দিনটি। ৩রা ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। নয় মাসের স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। প্রিন্সেস স্টীটের অফিসে বসে আছি হঠাৎ খবর এলো ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। চারিদিকেই আনন্দ-উৎসব শুরু হয়ে গেল। অতি আনন্দে সবারই চোখ অশ্রুসজল। দীর্ঘ নয় মাসের কত মৃত্যু, কত রক্ত, কত বেদনা ও অশ্রুঘন কাহিনীর সকরুণ স্মৃতি। এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য একটা পরিচয়- জাতি হিসেবে গৌরবময় পরিচয় এনে দিয়েছে। একটা নতুন রাষ্ট্র, একটা নতুন জাতির জন্ম পৃথিবীর বুকে স্বীকৃত
খুব সম্ভব এদিনেই ফোন পেলাম। রিসিভারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের কণ্ঠস্বর। আমার প্রতি নির্দেশ শরণার্থী প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকারের মধ্যে এক্ষণে উচ্চ পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হবে। আমাকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে বালিগঞ্জ বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছলাম। আমার গাড়ি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিএসএফএর এক কর্নেল এসে গাড়ীর দরজা খুলে ধরলে আমি নামার সঙ্গে সঙ্গেই সেলুট করলো। আশেপাশে দাঁড়ানো আরো কয়েকজন অফিসার একই ভাবে সেলুট দিল। সভাঘরের দরজায় আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরা এবং কেন্দ্রীয় জয়েণ্ট সেক্রেটারী শ্রী এ কে রায়। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল- এর আগেও অনেকবার এই অফিসে এসেছি, এদের সাথে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আগের তুলনায় আজকের ব্যবহারে বিশেষ পার্থক্য স্পষ্ট চোখে পড়ে। এর কারণ, আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পক্ষে সরকারী এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এই অফিসে আমার আগমন। আলোচনার টেবিলে বসলাম। দু'পার্শ্বের দুই সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ। আমার সামনে বাংলাদেশের পতাকা টেবিলের স্ট্যাণ্ড দাঁড় করানো। বিপরীতে ভারতের পতাকা। আলোচনার বিষয় ভারতে আগত বাংলাদেশের শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তন। প্রথমে আমি ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য এবং এই সভার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। ভারত পক্ষে আলোচনার সূত্রপাত করেন শ্রী, এ, কে, রায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শরণার্থী কিভাবে ফিরে যাবেন, তার একটা ফর্মুলা উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। আলোচনা অগ্রসর হবার পূর্বেই আমি বললাম, এটা তো সম্পূর্ণ আপনাদের ব্যাপার। কারণ, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন মর্যাদার সঙ্গেই আমি বাংলাদেশের শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠাবো। সুতরাং, ফর্মূলা উদ্ভাবন করে নতুন সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই। আমার এই কথায় হঠাৎ ভারত পক্ষ নীরব হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে তাঁর নির্দেশ লাভের জন্য শ্রী রায় কিছুক্ষণের জন্য সভার কাজ বন্ধ রাখলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি সভায় এসে বললেন প্রধানমন্ত্রী শরণার্থী প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর আনুসংগিক সংক্ষিপ্ত আলোচনা হল। বিভিন্ন স্থান থেকে সুবিধামত শরণার্থীর বাস, ট্রেন এবং অন্যান্য যানবাহনে দেশে ফিরবেন। ফেরার সময় হাঁড়ি, পাতিল, চাল ইত্যাদি এবং কিছু নগদ টাকা প্রত্যেককে দেয়ার সিদ্ধান্তও গৃহীত হল। এক কোটি বাংলাদেশের শরণার্থীকে সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য বহু টাকা ব্যয় এবং এত বড় আয়োজনের ব্যবস্থা এটা একটা সহজ কাজ ছিল না। মিসেস গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল। আর একবার সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অফিসে ফিরে এলাম।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ এবং বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটির অভূতপূর্ব অনুভূতি তখনো সদ্য সজীব। এ অবস্থায় একটা প্রলয়ঙ্কারী ও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে যা দিনাজপুরবাসী কোন দিন বিস্মৃত হবে না। দিনাজপুরের মহারাজাদের তৈরি স্কুল। নাম মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল। বিস্তীর্ণ এলাকা। সামনে বিরাট খেলার মাঠ। বিরাট স্কুল গৃহ, মজবুত এবং দেখবার মত। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কোলকাতা রিপন কলেজের একটি শাখা দিনাজপুরে খোলা হয় এবং এই মহারাজা স্কুলেই সকালের শিফটে সেই কলেজ চলতো। পাক-বাহিনীর আত্মসমপর্ণের পর ৭নং সেক্টরের সব মুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করলে তাদের জন্য কয়েকটি শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে দিনাজপুর স্টেডিয়াম ও মহারাজা স্কুল গৃহ- এই দু'টিই ছিল বড় শিবির। মহারাজা স্কুলের সামনের মাঠে আণ্ডার গ্রাউণ্ড ঘর তৈরি করে উদ্ধারকৃত সমস্ত অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় প্রতিদিন ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে এসে এখানেই জমা করা হতো। সেদিন ৬ই জানুয়ারী। হিলি সীমান্ত থেকে দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র (বিভিন্ন প্রকারের তাজা বোমাসহ) নিয়ে এসে সেগুলো ট্রাক থেকে নামিয়ে মাটির নিচের ঘরে রাখার কাজ শুরু হয়। সময় সন্ধ্যা ৬-৩০ মিঃ। হয়ত অন্যমনস্কতার কারণে তাজা বোমা কারো হাত থেকে পড়ে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এই বিস্ফোরণ এত প্রচণ্ড এবং ভয়াবহ হয় যে সম্পূর্ণ স্কুলগৃহ ধ্বংস হয়ে যায়। স্কুলগৃহের সামনের মাঠটি একটি বিরাট পুকুরে পরিণত হয়। শুধু দিনাজপুর নয় এই শহর থেকে ১৯ মাইল দূরে পাবর্তীপুর শহরেরও কিছু বাড়ীঘরের জানালার কাচ ভেঙ্গে যায়। ৪৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা সেখানে থাকতেন। দুর্ঘটনার পর আহতদের আর্তনাদে এক করুণ এবং মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডাক্তারদের কাছে পাঠানো ও নিহতদের লাশ উদ্ধার কার্যে শহরের হাজার হাজার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তবে পুরো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলা চলে। প্রায় সকলেরই দেহ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। লাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এক জায়গায় জমা করে মোটামুটি হিসাবে ১৬০ জনের মত নিহত মুক্তিযোদ্ধার লাশ সংগ্রহ করে শহরের তিন মাইল উত্তরে সুবিখ্যাত চেহেল গাজী মাজারের একপাশে দাফন করা হয়। ঘটনার ৬/৭ মাস পরে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করার সময় আরো প্রায় ৪০ টি মাথার খুলি পাওয়া যায়। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের যারা বীরের মত জয়লাভ করে স্বাধীনতার রক্তসূর্যকে ছিনিয়ে আনলো তাদেরকে সামান্য একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এরূপ মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল! বীরদের এই সকরুণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সকরুণ মর্মন্তুদ অধ্যায় সৃষ্টি করে রাখবে।
মোহাম্মদ ইউসুফ আলী
নভেম্বর, ১৯৮৪