বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/৩৯
অধ্যাপক সারওয়ার মুর্শেদ
প্রথমে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের একজন পর্যবেক্ষক এবং পরে এ আন্দোলনে একজন সক্রিয় অংশগ্রহনকারী হিসাবে; সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাভিত্তিক খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নকারী গ্রুপের একজন সিদস্য হিসাবে ২৫শে মার্চের বেশ আগেই উপলব্ধি করেছিলাম রক্তপাত হবেই, পাকিস্তানের কাঠামোতে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হলেও তা কাগজের নক্সা হয়েই থাকবে। এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ অনিবার্য। বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবরে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যখন ঘোষিত হল তখন পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে genocide-এর পরিকল্পনাও সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। জাহাজ বোঝাই সমরসম্ভার এবং সাদা পোশাকে বিমানযোগে পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য আমদানী, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে মেশিগান ও কামানের নগ্ন উপস্থিতি। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক অভিযান আসন্ন; এ ধারনাকে আমার মনে দৃঢ়মূল করেছিল।
এ সময়ে একটি চিন্তা আমার মনকে বিশেষ জিজ্ঞাসাসস্কুল করেছিল: বাঙ্গালী জাতি উদ্বেলিত প্রত্যয় ও প্রচণ্ড আবেগে ঐক্যবদ্ধ এবং অগ্নিগর্ভ, কিন্তু একটি সশস্ত্র সংগ্রাম এবং প্রতিরোধের জন্য, সংগঠন এবং আয়োজনের দিক থেকে তৈরি কি? মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দেয়া সহজ ছিল না। চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য তথা কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে ছ’দফার দাবিকে কিছু নমনীয় করা কি তহলে যুক্তিযুক্ত নয়? কিন্তু একই সঙ্গে এও বুঝেছিলাম যে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরার কঠিন ঝুঁকি নেয়া হলেও সেই মুহূর্তে ইতিহাস তার গতি মন্থর করবে। স্বাধীন বাঙালী সত্তার শত্রুরা বাঙ্গালীদের সময় দেবে, এমন চিন্তার নিশ্চিত কোনও ভিত্তি নেই।
সুতরাং গঠনতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনার আড়ালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে যে একটি মৃত্যুযজ্ঞের আয়োজন করছিল এ বিষয়ে বিশ্বজনমতকে অবতিহত করার প্রচেষ্টা আমার কাছে প্রাধান্য পেল। ফরাসী দার্শনিজ জাঁ পল সার্ত্রে, হার্ভার্ড বিশ্ববদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্রুত অর্থনীতিবিদ জন কেথে গলব্রেথ, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী এবং টাইমস ও নিউইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদকসহ আরও অনেকের কাছে এ বিষয়ে আমি তারবার্তা পাঠাই। এ বিষয়ে আরও উল্লেখ্য যে কিসিঞ্জার-নিক্সনের পাকিস্তান সমর্থনের নীতি এবং বাংলার মাটিতে পরাশক্তিসমূহের অস্ত্রের উপস্থিতি এবং পাকিস্থানী শাসকদের বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে তা ব্যবহারের ক্রুর সম্ভাবনা কিভাবে বাংলার মানুষকে বিপন্ন জনগণের বিরুদ্ধে তা’ জানাবার জন্য পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে প্রফেসর হেনরী কিসিঞ্জারকে আমি ১৬ই মার্চ একখানা চিঠি লিখি। চিঠিটির অনুলিপি নিচে সন্নিবেশিত হল:"I am writing to you at a moment of grave peril to my people. President Yahya has moved in guns and Tanks apparently to reinforce his and Mr. Bhutto's Constitutional arguments. There has already been a good deal of wanton killing and move is promised by the situation. The holocaust that seems all but inevitable will destroy many Bengali lives and much else. It is clear to us that this country cannot survive the application of force and that the resulting chaos and instability in wide area was in the subcontinent will benefit neither our friends nor our enemies.
"We want the world to know that a military solutions to our constitutional problem is not only liable to be barren and disastrous but it is unnecessary. A political settlement is possible; provided the Bengali demand for changing the present colonial pattern of the relationship between the two wings was accepted by writing a constitution for the country, which would give them complete control over their economic resources. But of course; Mr. Bhutto; backed by the army and the economic interests responsible for the deprivation of the Bengalis for the post twenty three years; continued to oppose this.
"The situation therefore has the elements of a sophoclean tragedy; with this difference that its denouement would affect the fate of real human beings who number seventy five million. What looms large in one's mind at the moment of the bristling array of weapons to be seen in Bangladesh today and what they augur. These weapons; American; Russian and Chinese in origin are to be used against an unarmed people. Bengalis are united as never before in their history in their resolve to replace the old system of relationships in the country. Paradoxically, this makes the threat of massive use of force by Islamabad more real; for it has no other way of imposing its will on the Bengalis; although every dictate of sanity is against it.
"I should like to appeal to all men of goodwill; and you are a man of goodwill in high office in America; to do all they can to help avert this cruel possibility involving fellow human beings.
"I am writing this letter to you as a teacher and as one who had the great good fortune and honor of knowing you and feel sure that you could sympathies with the human aspect of our crisis. You would eam our eternal gratitude if you would exert your influence and help prevent the threatened mass slaughter of men. Women and children in East Pakistan"
২৫শে মার্চের কালো রাত্রির পর যখন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য নিজের শক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিব।
বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা ছেড়ে কিছু দিন বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকার পর যখন দেখলাম আশ্রয়দানকারীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে তখন একদিন নরসিংদীর পথে ভারত সীমান্তের দিকে রওয়ানা হই। ৪ঠা এপ্রিল কি ছিল সেদিনটি? তিতাসের ওপারে এক মেঘাচ্ছন্ন সকালে যখন আমি পরিবারসহ সিংগারবিল যাওয়ার পথ খুঁজছি দৈবক্রমে আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আমাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে কবি সানাউল হকের বাংলোয় নিয়ে আশ্রয় দেয়। এবং নদীর ওপারে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ওপর যেদিন পাকিস্তানী প্লেন থেকে কয়েক দফা গুলি বর্ষিত হয় সেদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী এবং চার পুত্র কন্যা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলার দিকে রওয়ানা হই। সম্ভবতঃ সেদিনটি ছিল ১৪ই এপ্রিল।
ভারতে অবস্থানকালে আমার তৎপরতাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ (১) পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব পালন; (২) অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে নানা সমাবেশ এবং সেমিনারে বাংলাদেশ আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা; (৩) বাংলাদেশ শিক্ষা সমিতির প্রথমে আহবায়ক; পরে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে প্রয়োজনমত মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে সমিতির স্বতন্ত্র কার্যক্রমে অংশগ্রহন। এছাড়াও এই সময়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের কোন কোন বক্তৃতা ও নীতিবষিয়ক প্রতিবেদনের খসড়া ইংরেজিতে তৈরি করে দিয়েছি বা প্রয়োজনমতো বাংলায় করতেন ডক্টর আনিসুজ্জামান।
বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমার কয়েকটি জায়গায় কিছু স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখানে তা উল্লেখ করব। আসামের বুদ্ধিজীবীো “স্বাধীন বাংলাদেশের তাৎপর্য” বিষয়ে শিলং সরকারী কলেজের মিলনায়তনে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আসাম সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শ্রী ত্রিপাঠী। আমি সে উপলক্ষে যা বলেছিলাম তা’ সংক্ষেপে এই: উপমাহাদেশের দুটি দেশ; ভারত এবং বাংলাদেশ; খুব স্বাভাবিক কারণে পরস্পরের বন্ধু হবে। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর ইতিহাস; সংস্কৃতি ও ভূগোলের দিক দিয়ে যথেষ্ট নৈকট্য সত্বেও ভারত এবং পাকিস্তান স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সমরবাদীর ভারত বিদ্ধেষকে তাদের স্বৈরশাসন এবং অর্থনৈতিক শোষণের স্বার্থে জিইয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার পর নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট এবং ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরিণত কাণ্ডজ্ঞান প্রবুদ্ধ স্বার্থচেতনা এবং পারস্পরিক সম্ভন্ত এবং এই প্রক্রিয়ার ইতিহাসের একটি বড়রকমের বিকৃতি দূর হবে। দু দেশের যৌথ নদনদী। সহজ যাতায়াতের প্রয়োজন অর্থনৈতিক আদান প্রদান ও সহযোগিতার প্রশ্নাতীত যৌক্তিকতারও তাই দাবি করে। বাংলার সশস্ত্র সংগ্রামে ভারতের সহায়তা আমাদের বিপুলসংখ্যাক শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় দান; একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশের অন্য একটি গতন্ত্রকামী মানবগোষ্ঠীর প্রতি এ মহানুভব সমর্থন। এই নতুন সম্পর্কের শুভসূচনা। শুধু একটি কথা ভারত আয়তনে; সম্পদে; শক্তিতে একটি বড় দেশ আর বাংলাদেশ সেসব দিক থেকে ক্ষুদ্র। এ অসমতা যেন দু’দেশের স্বাভাবিক বন্ধুতার পথে কোনদিনও অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে দু’দেশকে সজাগ থাকতে হবে। বক্তৃতা শেষ হলে মন্ত্রী মহোদয় আসন ছেড়ে এসে আমায় অভিন্দন জানিয়ে আমার করমর্দন করেন এবং আমার শ্রোতৃবৃন্দও আমার বক্তব্য ও তার আন্তরিকতা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এক আজব কাণ্ড করে বসে। তারা তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো রিপোর্টে দাবি করে যে বাংলাদেশ থেকে আগত এক নরাধম অধ্যাপক ভারতকে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে হাঙ্গেরী রুপে কল্পনা করে ভারতকে একটি প্রতিবেশী দমনেচ্ছু আগ্রহী শক্তিরুপে চিত্রিত করেছে। পশ্চিম বঙ্গের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি যাঁরা আমাকে জানতেন; আশ্রয়দানকারী সরকারের বিরাগ থেকে সে যাত্রা আমায় রক্ষা করেন।
আরেকটি অন্য ধরনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের এক দরিদ্র মুসলিম পল্লীতে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে। এই স্বল্প শিক্ষিত গরীব মুসলমানদের কাছে পাকিস্তান ছিল একটা বিশ্বাস এবং কল্পনার স্বর্গ; তারা সেখানে কোনদিন যেতে পারবে না; তবুও যে স্থানটি তাদের মনের মধ্যে লুকোন একটি আশ্বাস ও নিরাপত্তা। অনেকক্ষণ বক্তৃতার পরও দেখলাম মানুষগুলো পাহাড়ের মত নীরব নিরুত্তাপ, তাদের চোখে শীতল ক্রোধের কাঠিন্য। কিন্তু এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল যখন আমি তাদের দিকে সঙ্গীনের মত কয়েকটি প্রশ্ন উদ্যত করলাম এবং জানতে চাইলাম ইসলামের কোন নির্দেশ আছে ধর্মের নামে কোনও মুসলমান সৈনিক পিতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ করতে পারে, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী ও শিশু হত্যা করতে পারে? প্রশ্নের পর পাকিস্তানী বর্বরতার কিছু বর্ণনা, তারপর আবার প্রশ্ন করলাম, এরই নাম কি ইসলাম? এই পাকিস্তানই কি আপনার প্রিয় পাকিস্তান? ‘না’ ভঙ্গিতে অনেকগুলো হাত এক সংগে উঠে গেল। আমার সে সন্ধ্যার বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই পাথর গলেছিল; সেই সরল বিশ্বাসী মুসলমানরা বুঝেছিল; কেন বাঙ্গালীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে কার্যক্ষেত্রে মুজিব নগর সরকারের সংগে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল এবং সরকারসংশ্লিষ্ট তৎপরতার বাইরেও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। শুধু একটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করেছি- সেটা হল সংবাদমাধ্যমের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সংগে সহযোগিতা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বলেও আখ্যায়িত করা হয়, ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশ আন্দলোনভিত্তিক তাদের একটা আলাদা অস্তিত্ব বা তাঁদের মধ্যে স্বতন্ত্র রকম সংহতি ছিল বৈকি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি স্বতন্ত্র সংহতির একটি দৃষ্টান্ত।
দিল্লী আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠ করার জন্য The Nature of Bengali Nationalism শিরোনামে আমাকে একটি paper তৈরি করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তবে সে সেমিনারে আমি যোগ দিতে অসমর্থ হই। কিন্তু প্রবন্ধটির জন্য যে কাজ শুরু করেছিলাম তা’ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি অনুমোদিত একটি গবেষণা প্রকল্পের রুপ নেয়। Perspectives on Bengal শিরোনামে রচিত এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও উৎস নিরুপণ করা।
মুজিব নগর সরকার একটি পরিকল্পনা কশিন গঠন করেছিলেন। একটি Long Term একটি Mid term এবং Short term প্ল্যান তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই কমিশন কে। আমি এই কমিশনের একজন। সদস্য ছিলাম। কোন Long term বা mid term প্ল্যান নিয়ে কমিশন সদস্যদের মধ্যে কোনও গভীর বা ধারাবাহিক আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি। তবে কিছু Short term প্ল্যান নিয়ে মত বিনিময় হয়েছেযেমন যুদ্ধশেষে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন বিষয়টি এবং এর কোনও কোনওটি নীতিগতভাবে গৃহীত হয়েছিল। (মনে পড়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন সমস্যা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি সমীক্ষা আমার তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল)। অস্থায়ী সরকার আওয়ামী লীগের পুরো আদর্শগত বর্ণালীর ধারক হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই যদ্ধ জয়ের শেষে এক কোটি শরণার্থীসহ গৃহে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। তার কাছ থেকে কোন দীর্ঘমেয়াদী, এমনকি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরীর ভিত্তিগত দিকনির্দেশ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কার্যতঃ তা পাওয়াও যায়নি। মৌলিক বিষয়ে, আমার বিশ্বাস, কমিশনের সদস্যরাও একমত পোষণ করতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক হবে এমন একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত ছিল কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র ও মিশ্র অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে সে সমাজতন্ত্র সীমাবদ্ধ থাকবে, না ভূমির ব্যক্তি মালিকানা বাতিল বা পুনর্বণ্টনের পথে আরও সুদূরগামী হবে, এ জাতীয় প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের যুদ্ধরত অস্থায়ী সরকার দেননি। সুতরাং কতকগুলো অবিতর্কমূলক স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাতে কমিশন নিজের কাজকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। তার অর্থ এই নয় যে আলাদাভাবে কমিশনের সদস্যরা কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার রুপরেখা বিবেচনা করেননি-কিন্তু তা সহজবোধ্য কারণেই সরকারের দরবার পর্যন্ত পৌঁছেনি।বিজয়ের পর কবে এবং কিভাবে আমি দেশে ফিরে আসি তার সঠিক তারিখ কিছুতেই মনে করতে পারছি না— একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে জেনারেল অরোরার সৌজন্যে তাঁর বিমানে করে ঢাকায় ফিরি। প্রায় দু’দিন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেও যখন ঢাকাগামী কোনও বিমানে জায়গা পেলাম না জানতে পারলাম জেনারেল অরোরা ঢাকায় যাচ্ছেন, তাঁকে অনুরোধ জানান মাত্র তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে নিতে রাজি হন। ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর অধিনায়কদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটাবার এবং কথা বলার একটি অমূল্য সুযোগ আমার এভাবে দৈবাৎ মিলে গিয়েছিল। মনে পড়ে সিলেটের ভারতীয় ছাউনিতে অফিসারদের সঙ্গে জেনারেল আরোরা তাদের মেসে এক মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন। তাঁর মেহমান হিসেবে আমিও এই ভোজে শরীক হই। এ উপলক্ষে আমার কয়েকজন জেনারেল এবং অন্ততঃ একজন এ্যাডমিরালের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁদের কিছু কথা এবং ইঙ্গিত আমাকে বিস্তৃত করেছিল। স্মরণযোগ্য যে স্বাধীনতা লাভের আগের মুহূর্তে ‘আল বদর’ পৈশাচিক নিপুণতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ক’জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল। জাতির হৃদয়ে অনেক শোকের মধ্যে এ শোকটি বড় বেশীরকম আঘাত হেনেছিল। ভারতীয় অফিসারদের কথাবার্তা থেকে আমার মনে হয়েছিল তাঁদের ধারণায় আগেই এ ব্যাপারটি ঘটেনি এবং এ বাঙালীদের গুজব সৃজন কুশলতার আরেকটি প্রমাণ। আমি মরিয়া হয়ে অফিসারবৃন্দকে বলেছিলাম যে দীর্ঘ নিহতদের তালিকায় আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয় অন্ততঃ চারজন অধ্যাপক ছিলেন এবং আমি নিশ্চিত করে জানি তাঁরা পাকিস্তান পরিচালিত আল বদরের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছিল।
বিমান ভ্রমণের সময় জেনারেল অরোরার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে আলাপ হয়। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম; মিত্রবাহিনীর হাতে পাকিস্তানের এত দ্রুত পরাজয়ের কারণ কি। জবাবে তিনি তিনটি প্রধান কারনের উল্লেখ করেছিলেন:
৯ নভেম্বর; ১৯৮৪