বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/৪১
অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান
একাত্তরের র্মাচ মাসে যখন অসহযোগ আন্দোলন তুমুল ভাবে চলেছে এবং ইয়াহিয়া মুজিব আলোচনার প্রহসলীলা তুংগে উঠছে সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা নিষ্ক্রীয় ছিলাম না। আমি অনুভব করেছিলাম যে একটি দুযোর্গ আসছে। সুতারাং আমরা ছেলেমেয়েদের সকল কে আমি সন্নিকটে আনতে চেয়েছিলাম। ঢাকায় আমার বড় মেয়ে মোহাম্মদপুরে তার নিজের বাড়িতে থাকত। এলাকাটি অবাঙ্গালীদের। তাদের বাড়িতে ঢিল পড়ত রাত্রে। কখনো কখনো সরাসরি হুমকী ও তাদের দেয়া হয়েছে। এখবর পেয়ে আমি ১৯৭১ সালের ২২শে মার্চ আমার গাড়ী নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। পথে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তবে বিকেলের দিকে মোহাম্মদপুর এলাকায় আমার মেয়ের বাড়ির কাছে মোড় ঘুরতে গিয়ে একটি অদ্ভুদ দৃশ্য চোখে পড়ল। একটি কাক তড়িতাহত হয়ে মাটিতে মরে পড়ে আছে। আর এক তলা বাড়ির কার্নিশে এক সারি কাক বসে আছে। একটি কাক কা কা করে মৃত কাকটির শরীর প্রায় ছুঁয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। এভাবে সব কটি কাক একটি অর্ধবৃত্তের মতো আবর্ত রচনা করে একে একে উড়ে চলে গেল। কাকগুলো তাদের মৃতের প্রতি শেষ বেদনা নিবেদন করলো। দৃশ্যটি দেখেই আমার ছেলেকে গাড়ি থামাতে বলেছিলাম। আমি গাড়িতে মৃতের গাড়িতে সম্পূর্ণ দৃশ্যটি দেখলাম। সে দশ্যের কুশীলবরা হচেছ কাক এবং রংগমঞ্চ হচ্ছে বাড়ির কার্নিশ এবং গাড়ি চলাচলের রাস্তা। আমি হঠাৎ কেন যেন শংকিত হলাম। শুনেছি ইতর প্রাণীরা পূর্বাহ্নেই অনুভব করে যে সংকট আসছে। আমরা তখন মনে যে হল যে হয়তবা বিপদ শিগগিরই আসবে। সেদিন ছিল ২২শে মার্চ। আমি চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি করে ঢাকায় এসেছিলাম। আমার বড় মেয়ে জামাই এবং তাদের দু’টি সন্তানকে নিয়ে যেতে।
মোহাম্মদপুরে মেয়ের বাসায় পৌঁছে মুনীর চৌধুরী এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম মনে আছে। মুনীর চৌধুরী রাত্রে দেখা করতে এসেছিলেন। পরদিন সকালে সবাইকে নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে যাত্রা করলাম। এবারেও কোন বিঘ্ন ঘটেনি। শুধুমাত্র ব্রীজে ডাইভারশনের কাছে এসে কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের গাড়ি ডাইভারশনের পথে নেমে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় যখন এসেছে তখন উল্টোদিকে থেকে আমাদের মুখোমুখি হর্ন বাজিয়ে একটি আর্মি জীপ উপস্থিত হল। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই পিছিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু জীপটি না এগিয়ে সেও পিছিয়ে গেল এবং আমাদের এগুতে বলল। আমরা যেই একটু এগিয়েছি তখন আবার নেমে এসে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমরা তখন পেছনে চালিয়ে একেবারে বড় রাস্তায় উঠে অপেক্ষা করতে লাগলাম। জীপটিও পেছনে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের এগিয়ে আসতে বললো কিন্তু আমরা ভয়ে এগুলাম না। তখন জীপটি এল, বড় রাস্তায় পড়ল এবং আমাদের গাড়ীর পাশ দিয়ে চললো। আমাদের গাড়ী পেরুবার সময় জীপের মধ্যে কয়েকজনের অট্ট হাসি শুনলাম এবং একটি শূন্য মদের বোতল রাস্তায় এসে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের গাড়ীতে কোন আঘাত লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছে দেখলাম, সারাদেশে একটা কিছু যেন ঘটবে সকালেই তার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বিভিন্ন লোক, শিক্ষক এবং ছাত্র যূথবদ্ধ হয়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কথাবার্তা চলছে। আশা এবং আশাঙ্কা এ উয়ের মিলন ঘটলে যে এক রহস্যময়তার সৃষ্টি হয় তখনকার সময়ে সেই রহস্যময়তা ছড়িয়ে ছিল। শুনলাম পরের দিন ২৪ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং শিক্ষক সম্মিলিতভাবে একটি সভা আহ্বান করেছে যে সভায় ছাত্ররা স্বাধীন বাংল দেশর পতাকা উত্তোলন করবে।
পরের দিন বিকেলে শহরে মিটিং ছিল আমরা সবাই সেখানে গেলাম। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হল। বক্তৃতা করেলেন অনেকে। সভা চলাকালে হঠাৎ খবর এলো সমুদ্র বন্দরে পাকিস্তান থেকে আগত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামানো হচ্ছে এবং বাঙ্গালী শ্রমিকদের সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাদের সংঘর্ষ বেধেছে। আমরা খবর পেলাম যে জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামাতে আপত্তি করায় বাঙ্গালী শ্রমিকদের উপর গুলি চলানো হয়েছে এবং অনেক নিরীহ লোক নিহত হয়েছে। মাঝপথে আমাদের সভা ভেঙ্গ গেল। আমার ছোট মেয়ে এবং জামাতা দেব পাহড়ে থাকত।আমি গাড়ী নিয়ে সেখানে গেলাম এবং তাদেরকে আমার সঙ্গে ক্যাম্পাসে নিয়ে এলাম। দুর্ঘটনা একটা ঘটবে এটা আমরা সকলে অনুমান করেছিলাম। এই দুর্ঘটনার মুহূর্তে আমি আমার ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইনি। সবাইকে তাই একত্রিত করেছিলাম। বড় মেয়েকে তো আগের দিনই ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। পরের দিন ছোট মেয়েকে। যাহোক সেদিন শহর থেকে বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাস ফেরা খুব সহজ হয়নি। আমাদের যাবার পথে ক্যাণ্টনমেণ্ট পড়ে। সেসব রাস্তায় চলাচল বন্ধ ছিল। বড় বড় গাছ কেটে এবং আড়াআড়িভাবে কিছু ট্রাক সাজিয়ে রাস্তার চলাচল কে বিঘ্নিত করা হয়েছে। আমরা বাধ্য হয়ে গ্রামের কাঁচা মাটি এবং খোয়া ফেলানো পথ দিয়ে অনেক সময় নিয়ে রাত প্রায় ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে ফিরলাম। রাত্রিবেলা গ্রামের পথ দিয়েই গিয়েছিলাম। সুতরাং আশেপাশের জঙ্গল এবং বন্যফুলের সমারোহ চোখে পড়েনি কিন্তু তাদের গন্ধ পেয়েছিলাম। একজন ইংরেজ কবি এরকম বর্ণনা করেছেন এভাবে, শংকিত পথে অন্ধকারে ফুলগুলো কোন আশ্বাস আনেনা তাদের সুগন্ধ ক্রমশঃ হারিয়ে যায় পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে।
পঁচিশ তারিখ সারাদিন মানুষের আনাগোনা চলছিল বিভিন্ন এলাকায়। শহর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ এসেছিলেন, সন্ধ্যার দিকে ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস এর একটি প্লাটুন বর্ডারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নিল। গ্রমের লোকেরা এদের জন্য প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা করল। তখন আমাদের সকালের মধ্যে একটি মাত্র বিশ্বাস সমুচ্চারিত যে আমরা বাংলা ভাষাভাষি এক ও অভিন্ন। যারা বাংলায় কথা বলে তাদের সকলেই এখন একত্রিত হবে একটি বিশ্বাসের সচলতায় যে এদেশ আমার। আমার মনে হয় তখন এই বিশ্বাসটি নির্মাণ করতে হয়নি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবেগের অন্তঃসার হিসাবে উৎসারিত হয়েছে। আমরা তখন চিন্তা করেছিলাম না ভবিষ্যৎ আমাদের কি হবে। আমরা একটি প্রবল আন্তরিক ভাবাগের প্রবাহকে আশ্রয় করেছিলাম। সারাদিন বিভিন্ন সময় আমরা ঢাকার সঙ্গে করছি। যোগাযোগের স্থান ছিল দুটো ইত্তেফাক অফিস ও বঙ্গবন্ধুর বাড়ী। কিন্তু সন্ধ্যার একটু পরে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনই ভয় হয়। কিছু একটা ভয়ানক ঘটতে যাচ্ছে এটা অনুভব করছিলাম কিন্তু তা যে কত ভয়াবহ এবং প্রচণ্ড হতে পারে তা আমাদের অনুমান করার সাধ্য ছিল না। বিপদের নম্ভাবনা আমরা ব্যাখ্যা করি ঝড় আসবে বলে। এদেশে আমরা প্রকৃতির তাণ্ডবকে তাই প্রকৃতির উপমা আনি। আমরা বলি ঝড় আসবে, প্রচণ্ড ঝড়, প্রকাণ্ড সব বৃক্ষ উৎপাটিত হবে, লোকেরা ধুলায় আচ্ছাদিত হবে, বন্যায় গৃহাঞ্চল প্লাবিত হবে। আমরা প্রকৃতির উপমা একারণেই দেই যে প্রকৃতির তাণ্ডবের মুখে মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়। সে বিপদ কে রোধ করতে পারে না। সে ভেসে যায় এবং ধ্বংসের লীলা নৈপুণ্যে সে নিশ্চিহ্ন হয়। আমার এক বিদেশী বন্ধু সবসময় বিপর্যয়ের সঙ্গে পাহাড় ভেঙ্গে পড়ার উপমা দিতেন। তিনি ছিলেন জার্মান, হাইডেলবার্গের লোক, চতুর্দিকে সবসময় পাহাড় দেখতেন তাই পাহাড়ের কথাটি তার অনিবার্যভাবে মনে পড়ত। তিনি বলতেন, পাহাড় যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন প্রস্তর খণ্ডগুলো প্রচণ্ড বেগে নিম্নাভিমুখে ছুটতে থাকে। তার গতিরোধ করার সাধ্য কারো থাকে না। পাথরগুলো প্রচণ্ড গতিতে সম্মুখের সমস্ত কিছুকে নিশ্চিহ্ন করে ছুটে চলে, ধ্বংসের অনিবার্যতা তো একেই বলে।২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমরা প্রায় সারা রাত জেগেই কাটিয়েছিলাম। রাত ১টা পর্যন্ত আমরা বিভিন্নজনের বাড়ীতে বসে আলাপ-আলোচনা করেছি কর্তব্য নির্ধারণের জন্য। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে কিছুই নির্ধারণ করতে পারিনি। একটি প্রধান চিন্তা ছিল ক্যাম্পাসে অবস্থানরত বিভিন্ন পরিবার কে কিভাবে রক্ষা করা যায়। এখানে তো সম্ভাব্য ভয়াবহতার চিত্র উদঘাটিত হয়নি। তাই আমরা দ্রুত রাত্রির অবসান চাচ্ছিলাম এবং দিনের আলোয় কর্তব্যের কথা চিন্তা করব ভেবেছিলাম। সেসময়, রুপক করে বলা যায়, আমাদের দক্ষিণ দিকে নিস্তব্ধতা, বাম দিকে নিস্তব্ধতা, আমাদের সম্মুখ ও পশ্চাতে নিস্তব্ধতা। শুধু আমাদের মাথার উপরে আকাশে বাংলা বর্ণমালারা সবকটি অক্ষর ছড়িয়ে আছে। সেখান থেকেই বেদনা এবং প্রতিবাদের শব্দগুলো সংগ্রহ করতে হবে।
রাত্রি কাটালো সুগভীর নিদ্রায় নয়, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়। প্রায়ই জেগে উঠেছি আশংকায় এবং বিমূঢ়তায়। সকালে শয্যা ছেড়ে মাঠে কবুতরের খাঁচার দিকে এগিয়ে গেলাম। এটা আমার রোজকার অভ্যাস। খাঁচার দরজা খুলে গম অথবা ধান মাঠে ছিটিয়ে দেই। কবুতর গুলো প্রচুর পবিত্র শুভ্রতায় শেফালী ফুলের মতো খাদ্য কণার উপর ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। কবুতরের ঘরের দরোজা খুলে দিয়ে মাঠের মধ্যে ধান ছড়িয়ে আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু কবুতরগুলো খাবারের দিকে এগিয়ে এল না। ওরা খাঁচার সামনে একটু ঘুরে ওদের ঘরের ছাদের ওপর বসলো। ১২টির মত কবুতর ছিল, সব কটি প্রায় সাদা, একটি দুটি খয়েরি রঙের। হঠাৎ কবুতর কটি একসঙ্গে উড়তে লাগলো। পাখা ঝাপটিয়ে প্রথম একটি উড়লো, পরে দোতলা বাড়ীর ছাদ পর্যন্ত উড়লো। পরে সব কটি পাহাড়ের মধ্যে ক্রমশঃ সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল। আমি আমার জীবন এ রকম দৃশ্য কখনো দেখিনি। সে মুহূর্তে আমি জানলাম যে, ঢাকায় ভয়ানক কিছু ঘটেছে এবং আমাদের জীবনেও আমরা একটি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে প্রায় লাগোয়া ছিল ক্যাণ্টনমেণ্ট। আমরা রোজই দেখতাম যে হেলিকপ্টার উড়ে ক্যাণ্টনমেণ্টে যাচ্ছে। এবংযাবার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বার কয়েক ঘুরে যাচ্ছে। তাছাড়া কুমিরার দিকে থেকে পাকিস্তানী সৈন্য চলাচলের সংবাদ ও পাওয়া যাচ্ছিল। যদিও প্রথমে কয়েকদিন চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনী কবলিত হয়নি এবং মেজর জিয়া নামক একজন সৈনিকের নাম তখন আমরা শুনেছিলাম যিনি কালুরঘাটে ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছিলেন। কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ষ্টেশন থেকে জিয়ার কণ্ঠে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণাবাণী শুনতে পেয়েছিলাম। সেই মুহূর্তটি আমাদের জীবনের আশা এবং উদ্দীপনার একটি তীব্রতম মুহুর্ত ছিল। যখন চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা এবং সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের অভাব ঠিক সেই মুহূর্তে জিয়ার কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার দাবী একটি বিস্ময়কর মানসিকতার সৃষ্টি করেছিল। আমরা তখনই ভাবতে পেরেছিলাম যে, কোন কিছুই হারিয়ে যায়নি, আবার সবকিছু ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনবরত মানুষের আনাগোনা হচ্ছিল। উপাচার্য ডং মল্লিককে কেন্দ্র করে একটি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের বাসগৃহগুলে কে অরক্ষিত রেখেই ৩০শে মার্চ সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে। কুণ্ডেশ্বরী রাউজান থানার অন্তর্গত। কুণ্ডেশ্বরীর মালিক বাবু নতুন চন্দ্র সিংহ আমাদের সবার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে আনন্দিত হয়েছিল। কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যালয়টি একেবারেই বড় সড়কের পাশে সম্পূর্ণ অরক্ষিত। রাত্রি বেলা প্রায়ই নানাবিধ শঙ্কায় আমাদের জেগে উঠতে হত। এদিকে-ওদিকে সৈন্য চলাচলের সংবাদ শুনতাম। কখনো বিদ্যালয় গৃহটি আক্রান্ত হবে এমন আশঙ্কার খবরও আসতো। শেষ পর্যন্ত সকলের পরামর্শে আমরা কুণ্ডেশ্বরী পরিত্যাগ করে প্রথমে নাজিরহাট এবং পরে কাটাখালি হয়ে রামগড়ে উপস্থিত হলাম। আমরা কুণ্ডেশ্বরী ছাড়লাম ৭ই এপ্রিল তারিখে। সে সময় একটি সিদ্ধান্তে আমাদের আসতে হয়েছিল। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম কোন গ্রামে আত্মগোপন করে থাকব কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় যে সীমান্ত এলাকায় যাওয়াই ভাল। কেননা সেনাবাহিনী আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করছে এবং গ্রামাঞ্চলে গিয়েও আমরা রক্ষা পাব না। কিন্তু সীমান্তে যদি যাই তাহলে প্রয়োজনবোধে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভবপর। রামগড় তখন মেজর জিয়ার প্রতিরোধ কেন্দ্র ছিল। তিনি কালুরঘাট থেকে সরে এসে রামগড়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। রামগড়ে পৌঁছে জিয়াকে প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম। তাঁর চোখে কালো চশমা ছিল এবং মুখ ছিল শ্মশ্রুমণ্ডিত। তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং কখনো কখনো কাউকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আমাদের কারো সঙ্গেই তিনি বিশেষ কোন কথা বলেননি।
পহেলা বৈশাখ তারিখে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ পেলাম। জিয়াউর রহমান আমাদের জানালেন যে, কোন সিভিলিয়ানের তখন আর রামগড় থাকা নিরাপদ নয়। কেননা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী সেখানে এসে পড়বে। আমাদের পরিবার পরিজনদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করে আমি, ডঃ মল্লিক, তৌফিক ইমাম এবং আরো কয়েকজন রামগড়ের সীমানা পেরিয়ে আমরা আগরতলার দিকে রওয়ানা হলাম। এ সময়কার একটি উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, সাবরুমের রাস্তায় একদল ভারতীয় স্কুলের ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ছাত্ররা আমাদের জীপ থামিয়ে জীপের চারদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গান করতে লাগল, “আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে”। সিকান্দার আবু জাফর এই গানটি লিখেছিলেন কিছুদিন আগে তখন এই গানটি তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু অপরিচিত পরিমণ্ডলে শঙ্কিত সময়ের পদক্ষেপে গানটির বাণী আমার কাছে অসাধরণ তাৎপর্যবহ মনে হলো। আমার মনে হলো ঠিক এমন করে হৃদয়ের সর্বস্ব দিয়ে কেউ হয়ত তার জাতির বেদনাকে রুপ দিতে পারেননি। সে মুহূর্তে ইমোশন প্রবল ছিল। তাই হয়ত গানটিকে অসাধারণ মনে হয়েছিল। তবে অসাধারণ তো বটেই তার কারণ, আমাদের সংকটের মুহূর্তে এ গানটি আমদের জন্য সমর্থন ও সহয়তা এনেছিল। আগরতলায় আমাদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি এবং মাহবুব আলম চাষী আগরতলায় একটি বাংলাদেশ মিশন খুলছিলেন। আমাদের পরিজনবর্গ আগরতলায় এসে পৌঁছোয় বিকেলবেলা। প্রথম রাতের জন্য আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম আগরতলায় গ্রাণ্ড হোটেলে। নামটি গ্রাণ্ড কিন্তু কর্ম ব্যবস্থা অত্যন্ত সাধারণ এবং মলিন। হোটলটি ছিল আগরতলায় রাজপরিবারের। সে রাতেই আমাদের সংগে দেখা করেন মওদুদ আহমদ এবং সাদেক খান। একটু বেশী রাতে এম আর সিদ্দিকী সাহেব ও হোটেলে এলেন এবং পরের দিন তিনি কলকাতায় যাবেন বললেন। আমাদের প্রস্তুত থাকতে বললেন। অমেরা এক রাতই গ্রাও হোটেলে ছিলাম। পরের দিন আগরতলায় সরকার নরসিংগড়ে একটি পলিটেকনিক স্কুলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আগর তলায় আমরা অবর্ণনীয় অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অধিকাংশের কাছে বিশেষ টাকা পয়সা ছিল না। পাকিস্তানী মুদ্রার বিনিময়ে হার দাঁড়িয়েছিল ১০০ টাকার স্থলে ভারতীয় ৪০ টাকা। অন্ততপক্ষে পোদ্দারদের কাছ থেকে আমরা এ হারই পাচ্ছিলাম। সে সময় আমার চিন্তা হল কি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ, যাঁরা দেশত্যাগ করে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবী, তাঁদের জন্য অর্থনৈতিক সংগতির কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা। প্যারিসে আমার কিছু পরিচয়ের সূত্র ছিল। একাডেমী ফ্রাঁন্স- এর সদস্য এবং বিখ্যাত ফরাসী বুদ্ধিজীবী এবং কবি পীয়ের ইমানুয়েলকে আমি চিনতাম। তাঁর কাছে আমি একটি দীর্ঘ পত্র লিখি। আমার চিঠি পীয়ের ইমানুয়েল পান ১৭মে তারিখ। ১৯ মে তারিখে ইমানুয়েলের পক্ষ থেকে একখানা টেলিগ্রাম পাই। টেলিগ্রামের ভাষা ছিল নিম্নরুপঃ “পীয়ের ইমানুয়েল আপনার চিঠি পেয়েছে। চিঠির অংশবিশেষ প্যারিসের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশের অনুমতি চাচ্ছি। আশা করি ভবিষ্যতে অবস্থার উন্নতি ঘটবে”। পরবর্তী চিঠিতে প্যারিস থেকে ষ্টিফেন স্পেনডারের ঠিকানা আমার কাছে পাঠানো হয়। তখন তিনি কানেকটিকাটে ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপনা করেছিলেন। বিখ্যাত স্পেনীয় দার্শনিক সালভাদর মাদারিয়গার ঠিকানাও আমি এভাবে পাই। এদের দু’জনের কাছে ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমি চিঠি লিখি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তাদের সহানুভূতি কামনা করি। পীয়ের ইমানুয়েল বিভিন্ন সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্য আবেদন জানান। অবশেষে International Association for cultural freedom এর সভাপতি মিং শেফার্ড ষ্টোন আমাকে জানান যে ফোর্ড ফাউণ্ডেশন আমাদের সাহায্যের জন্য পঁচিশ হাজার ডলার অনুমোদন করেছে। এ টাকা “The writers, scholars, and Intellectuals who have forced out of their land into India “তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে।মে মাসের শেষে আমি কোলকাতায় যাই এবং পাম এভিনিউতে ব্যারিস্টার এ সালামের বাড়ীতে অবস্থান করতে থাকি। সালাম সাহেবের ওখানে বাংলাদেশের তিনজন ছিলাম আমি, মওদুদ আহমদ এবং সাদেক খান। কোলকাতায় আমার সংগে যোগাযোগ করেন আমার পুরনো বন্ধু বোম্বের এ বি শাহ। এ বি শাহ Secularist পত্রিকার সম্পাদক এবং Quest পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন। এ বি শাহ কলকাতায় আসেন ৮ই জুন। সে তারিখে রাত্রে গ্রাণ্ড হোটেলে তাঁর সংগে আমার যোগযোগ হয়। ফোর্ড ফাউণ্ডেশনের প্রদত্ত টাকা যথাযথভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করি। কমিটির সভাপতি হন জাষ্টিস এস এম মাসুদ এবং সদস্য থাকেন অন্নদা শঙ্কর রায়, আমি, ডঃমল্লিক, সুশীল ভদ্র এবং সুশীল মুখার্জী। জাষ্টিস মাসুদ কর্তৃক অনুমোদিত ২১শে জুন তারিখের বুদ্ধিজীবীদের যে তলিকা আমার কাছে আছে তার মধ্যে জুন মাস থেকে দেশ স্বাধীন হবার সময় পর্যন্ত প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে যাঁরা সাহায্য পেয়েছেন তাঁদের নাম আছে এ নামগুলো হচ্ছে ডঃ এ আর মল্লিক, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ সারওয়ার মুর্শেদ, ডঃ মোহা শামসুল হক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ মাহমুদ শাহ কোরায়শী, ডঃ মোশাররফ হোসেন,ডঃ কাজী আবদুল মান্নান, মিঃ ওসমান জামাল, মিঃআলী আশরাফ মাসুদ, মিঃআবু জাফর, অনুপম সেন, ডঃ মোতিলাল রায়, ডঃ বেলায়েত হোসেন, শওকাত ওসমান, বুলবুল ওসমান, গোলাম মোর্শেদ, আবদুল হাফিজ, ডঃফারুক আজিজ খান, ডঃজিয়াউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, বদরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, মাহবুব তালুকদার, সাদেক খান, ডঃস্বদেশ বোস, ডঃমযহারুল ইসলাম মোস্তফা মনোয়ার। এই তালিকায় পরে আরো অনেক নাম যুক্ত হয়েছিল যারা জুন মাসের পর কোলকাতায় এসেছিলেন। সে নাম গুলো আমার কাছে নেই। এদের মধ্যে ডঃ মুসলিম হুদার নাম মনে পড়েছে। আরো ক’জনের নাম মনে পড়ছে তাঁদের মধ্যে একজন ডঃ মফিজউদ্দিন আহমদ, আরেকজন ডঃসফর আলী আকন্দ এবং ডঃ সালেহ আহমদ।
২৫শে জুন এ সাহায্য সম্পর্কে যে বিজ্ঞপ্তি International Association for Cultural এর ভারতীয় শাখার director of programme এ, বি শাহ কর্তৃক পত্রিকায় প্রেরিত হয়েছিল তার হুবহু প্রতিলিপি নিম্নে প্রদত্ত হলো।
INTERNATIONAL ASSOCIATION CULTRAL FREEDOM
For the favor of publication
The International Association for Cultural Freedom has made a special grant of 25,000 to provide assistance to emigre schools, intellectuals and writers from Bangladesh, the grant has been made from the fund for Intellectuals that the Association created in 1968 in the wake of soviel occupation of Czechoslovakia.
The grant will be operated by a Committee for Assistance to Bangladesh Intellectuals format for the purpose by the LACF office in India .the Committee consists of Mr. Justice S.A. Masud of Chancellor of Chittagong University, Professor Syed Ali Ahsan, Head of the Department of Bengali in Chittagong University and former Director of the Bengali Academy in Dacca, professor A .B. Shah, Director of Programmes of the LACIF in India, Mr Sushil Bhadra Mr Sushil Mukherjea, social workers from Calcutta.
The Committee has already provided ad hoc financial assistance to 25 scholars from Bangladesh and is preparing a comprehensive list of others who have emigrated to India. The Committee is also trying to persuade some of the Indian Universities to offer temporary assignments to Bangladesh scholars and secure the cooperation of India publishers to facilitate the publication of their manuscripts.
The Committee is also sponsoring a special issue of Quest, the well know intellectual and cultural journal, to be cdited by Dr. A R Mullick and professor Syed Ali Ahsan.
Scholars, Writers and intellectuals from Bangladesh are requested to contact Mr. Sushil Mukherjea at the Committee's office at p 542 Raja Basanta Roy Road, Calcutta 29.
Director of Progammes, India.
এ সময় মিসেসী লী থ (Lee Thaw) নামক এক ভদ্রমহিলা কোলকাতায় আসেন এবং ওবেরয় গ্রাণ্ড্র হোটেল অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সমিতির (International Refugee Organisation) প্রতিনিধি। তিনি লোককদের জন্য কিছু সাহয্য এনেছিলেন। তার অর্থদানের পাত্র ছিল সৃষ্টিধর্মী লেখক, শিল্পী এবং সাংবাদিক। ৫-৭-৭১ তারিখ আমি মিসেস থ কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে লেখক এবং সাংবাদিকদের একটি তালিকা তাকে প্রদান করি। সে তালিকা অনুসারে যারা পূর্বের সাহায্য সংস্থা থেকে কিছু পাননি এবং সৃষ্টিশীল লেখক, শিল্পী এবং সাংবাদিক তাদের মধ্যে এ অর্থ বিতরণ করা হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ১১জন লেখক, শিল্পী এবং সাংবাদিককে ৫হাজার ৮শত টাকা দেয়া হয়েছিল এবং পরবর্তী পর্যায়ে ২২হাজার ৫শত টাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। যারা সাহায্য পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে শিল্পী কামরুল হাসান, জহীর রায়হান, অভিনেত্রী সুমিতা এবং আরো অনেক ছিলেন। তবে একটি কথা এখানে না বললে অন্যায় হবে তা হচ্ছে লেখক ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ প্রথমে সাহায্য নিয়েছিলেন কিন্তু পরে তার চেয়ে ও দুঃস্থ কোন লেখক এবং সাংবাদিকের আনুকূল্যে অর্থ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
এ সময়ে আরেকটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা কোলকাতায় উপস্থিত হয়। উক্ত সংস্থা বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর সংগে যোগাযোগ করেন। এই সংস্থার নাম ছিল International Rescue Committee সংক্ষেপে I R.C। উক্ত প্রতিষ্ঠান মূলতঃ ইহুদীদের প্রতিষ্ঠান ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপ থেকে যে সমস্ত ইহুদী পালিয়ে আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন, মূলতঃ তাদের সাহায্যের জন্য এ সংস্থাটি গড়ে ওঠে। আমাদের দুর্দশার সময় সংস্থাটি যখন কোলকাতায় আসে তখন এদের পশ্চাদভুমি সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। যাই হোক, জনাব হোসেন আলী এ সংস্থার সংগে ডঃ মল্লিকের যোগসূত্র ঘটিয়ে দেন এবং তিনি বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সকলের সংগে পরামর্শ করে এই অর্থ বরাদ্দ করবার ব্যবস্থা করেন। এই অর্থ সাহায্য পাবার ফলে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রকার সংবাদ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ আর্কাইভস নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হই। আর্কাইভস-এর পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন ডঃ মল্লিক এবং আমি সভাপতি হয়েছিলাম। মোট ১৬ জন ব্যক্তি আর্কাইভস-এর কর্মপরিচালনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র এবং আমার সহকারী হিসাবে আর্কাইভস-এর প্রধান দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক আবু জাফর (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। আর্কাইভস ভারতীয় এবং বিদেশী সংবাদপত্রে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যে সমস্ত খবর প্রকাশিত হত তা সংগ্রহ করতো। এই সংগৃহীত তথ্যাদি নথিবদ্ধ করে একটি হওয়ার পর আমি বাংলাদেশ সরকারের আর্কইভস-এ দিয়ে দিয়েছি। আর্কাইভস এর পক্ষ থেকে একটি রেফারেন্স লাইব্রেরী সার্ভিস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থের অভাব এ পরিকল্পনাটি কার্যকর হয়নি। ডঃ মযহারুল ইসলাম আই আর সি-র কাছ থেকে একটি অনুদান নিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত বিবিধ আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে “লোকলোর” সংগ্রহের জন্য। এই লোকলোর সংগ্রহের কাজে মযহারুল ইসলামকে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়।
এ সময় কোলকাতায় বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশ তথ্যানুসন্ধান কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটির সম্পাদক ছিলেন শ্রী শৈবালকুমার গুপ্ত। মূলতঃ এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে উক্ত দেশকে পুরোপুরি ইসলামী দেশ বানানো। তাঁর মুদ্রিত প্রশ্নাবলীর একটি প্রশ্ন ছিল “বাছিয়া হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা, গৃহদাহ ও লুণ্ঠনের পরিকল্পনা ছিল এমন অনুমান করিবার সংগত কারণ আছে কি? হিন্দু সম্পত্তি লুঠ হইয়া থাকিলে কাহারা করিয়াছে”? আমার সংগে সে সময় ডঃ রমেশ মজুমদারের যোগাযোগ হয় এবং আমি তাঁর এই তথ্যানুসন্ধান ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করি। সৌভাগ্যের বিষয় বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যারা চলে এসেছিলেন এমন সব হিন্দুরা ডঃমজুমদারের সাম্প্রদায়িক অনুসন্ধানের প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা অত্যাচার হয়ে ভারতে আশ্যয় নিয়েছে তারা হিন্দু ও নয়, মুসলমান ও নয়, তারা বাংলাদেশী এবং সকল বাংলাদেশী সম্মিলিত ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত। শেষ পর্যন্ত ডঃ রমেশ মজুমদার তাঁর সাম্প্রদায়িক অনুসন্ধান তৎপরতা বন্ধ করতে বাধ্য হন। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে ডঃ মজুমদারের লোকেরা ক্যাম্পে অবস্থানরত সাধারণ হিন্দুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তারা বুদ্ধিজীবীদের কাছে আসেননি এবং তারা সাধারণ হিন্দুরাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য রেখেছিলেন।
২৩শে জুলাই আমি বাঙালোর শহরের গান্ধী স্মারক নিধির আমন্ত্রণক্রমে বাঙালোরে যাই এবং সেখানে চার দিন অবস্থান করি। বাঙালোর এবং মহীশুরে আমি বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর মোট দশটির মত বক্তৃতা করি। বাঙালোরে গান্ধী স্মারক নিধির প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং তারা বাংলাদেশের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
১লা আগস্ট তারিখে ইন্দো-সোভিয়েত কালচারাল সোসাইটি বাংলাদেশের ওপর একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে আমি প্রধান অতিথি ছিলেন এবং ঔপন্যাসিক নরেন্দ্র নাথ মিত্র সভাপতি ছিলেন।
১৪ থেকে ১৬ই আগস্ট দিল্লীতে জয় প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশর ওপর আন্তর্জাতিক সেমিনার আহ্বান করেন উক্ত সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যর্থাথ বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত করা। উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে ডঃ মল্লিকের নেতৃত্বে দশজন সদস্য দিল্লীতে এসেছিলেন। এদের মধ্যে আমি ছিলাম, ডঃ সারওয়ার মুর্শেদ ছিলেন, ডঃ স্বদেশ বোস, ডঃ মোতিলাল লাল, মিঃ ওসমান, জামাল, মিঃ সাদেক খান, মিঃ মওদুদ আহমদ, মিঃ আলমগীর কবীর ছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসের ১১তারিখ বিখ্যাত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত প্রফেসর গলব্রেইথ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরই অনুরোধক্রমে এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়। সার্কাস এভিনিউতে বাংলাদেশ মিশনে সাক্ষাৎকারটি ঘটে। উক্ত অনুষ্ঠানে ডঃমল্লিক, ডঃ সারওয়ার মুর্শেদ, ডঃআনিসজ্জামান এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। সম্ভবতঃ আরো কয়েকজন ছিলেন আমরা এখন তাঁদের নাম স্মরণ নেই। গলব্রেইথ সাহেব বাংলাদেশ থেকে আগত বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা পেশ করেন। আমরা বিনয়ের সংগে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখান করি। আমরা তাঁকে সবিনয়ে কিন্তু দৃঢ়তার সংগে জানাই আমাদের উদ্দেশ্য হচেছ স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভ করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করা, আমাদের উদ্দেশ্য স্থায়ীভাবে বিদেশে পুনর্বাসন নয়। যখন গলব্রেইথ সাহেব আমাদের সামনে এ প্রস্তাব উপস্থিত করেছিলেন সে সময় আমেরিকার হারভারড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ বিষয় একটি কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির নাম ছিল HARVARD SUMMER SCHOOL COMMITTEE EAST PAKISTAN REFUEES। এখবরটি প্রকাশিত হয় The Harvard Crimson নামক পত্রিকার ৩০ শে জুলাই সংখ্যায়।
২৯ আগস্ট থেকে ৭সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোলাকাতায় মহাজাতি সদন ভবনে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের সপ্তদশ বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে ময়মনসিংহ এর লোকগাথা অবলম্বনে কবি চন্দ্রবর্তী নামক একটি নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়। এ অনুষ্ঠানে অবনীন্দ্র জন্মশবার্ষিকী ও অনুষ্ঠিত হয়। আমি প্রধান অতিথি হিসেবে ২৯ আগস্ট বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন উদ্ধোধন করি। উক্ত সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন আনন্দ বাজার পত্রিকার সম্পাদক এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন উপাচার্য ডঃ অম্লান দত্ত।
এ সময় হার্ভার্ড গ্রুপ- এর পক্ষ থেকে অর্থনীতিবিদ গুস্তাভ পাপানেক কোলকাতায় আমার সংগে যোগাযোগ করেন এবং কয়েকদিন বিস্তারিত আলোচনার পর একটি প্রস্তাব ফোর্ড ফাউণ্ডেশন এর কাছে পেশ করেন। প্রস্তাবটি মেমোরেণ্ডাম আকারে ছিল এবং নাম ছিল ‘ longer term problem of Bengali refugee Intellectuals’। মেমোরেণ্ডামে পাপানেকের স্বাক্ষরের তারিখ হচ্ছে ১লা জুলাই ১৯৭১। পাপানেকের এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। শুধু উচ্চতর গবেষণার জন্য বাংলাদেশের দু’জন শিক্ষককে তিনি আমেরিকার অধ্যয়নের বৃত্তি দিতে সক্ষম হন। পাপানেক তাঁর মেমোরেপ্তাম ফোর্ড ফাউণ্ডেশনের জর্জ জাইগেনষ্টাইন-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন।
কোলকাতায় ওরিয়েণ্ট লংগম্যানস এ সময় ‘বাংলাদেশ ষ্টোরি’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আমার সংগে যোগাযোগ করে এবং আমি তাঁদের সংগে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হই কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে বেশীদূর অগ্রসর হয়নি। আমার সাথে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন টি মেলবুনি আমাকে অস্ট্রেলিয়ায় আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সংগে আমার আলোচনা হয়। ১১নভেম্বরে আমি অষ্ট্রেলিয়ায় যাবার জন্য প্রস্তুত হই। কিন্তু অবশেষে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ায় আমি যাত্রা স্থগিত রাখি। শেষ পর্যন্ত আমার যাওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে, প্রফেসর মেলবুনি অষ্টেলিয়ার মেলবর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ষ্টাডিজ বলে একটি ইনষ্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই ইনষ্টিটিউট শেষ পর্যন্ত হয়নি।
বিখ্যাত ফরাসী সংবাদপত্র La Monde (লা মঁদ) এ সময় আমার সংগে যোগাযোগ করে এবং জানায় যে তারা বাংলাদেশের কবিতার ওপর একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। ১০ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের সংখ্যায় লা মঁদ বাংলাদেশের কিছু কবিতার অনুবাদ এবং আলোচনা পত্রস্থ করেন। সেখানে আমার ‘প্রতিদিনের শব্দ’ কবিতার ফরাসী অনুবাদ মুদ্রতি হয়েছিল। বোম্বই এর Quest পত্রিকা বাংলাদেশ সংখ্যা প্রকাশ করে। উক্ত সংখ্যায় আমার একটি আলোচনা ছিল এবং একটি কবিতা ছিল। আমার প্রবন্ধটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর এবং বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতার আগ্রহ এবং তাৎপর্যের ওপর।
সবশেষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা না বললে আমার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকবে। আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিতভাবে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ এই নামে কতকগুলি কথিকা প্রচার করি। উক্ত কথিকাগুলোর মধ্যে আমি কোরান শরীফ এবং হাদীস থেকে উদাহরণ উপস্থিত করে প্রমান করার চেষ্টা করেছিলাম যে বাংলাদেশের জনগনের প্রতি পাকিস্তানীদের আচরণ সর্বতোভাবে ইসলামবিরোধী। আমার আলোচনাগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল বলে শুনেছি এবং বাংলাদেশের মানুষ সেগুলো শুনেছেন এবং উৎসাহিত বোধ করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি কবিতাও পাঠ করেছি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বেতার কেন্দ্রের দান যথেষ্ট। শুধুমাত্র উচ্চারিত বাণীর সাহয্যে মানুষের চৈতন্যকে যে উদ্বুদ্ধ করা যায় তার প্রমাণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিয়েছিল।আমি স্বাধীনতার সংগে সংগে দেশে ফিরতে পারিনি। তখন সকলেই দ্রুতগতিতে দেশমুখী হচ্ছিলেন তাই ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইন্স এ পর্যায়ক্রমে সকলের হয়েছিল। আমি জানুয়ারি মাসের ১১তারিখে দেশে ফিরেছি। দেশে ফিরে মনে হয়েছিল একটি নতুন প্রত্যুষে আমি যেন নতুন সূর্যোদয় দেখেছি। ঠিক সেই মুহুর্তের মানসিক অবস্থার কথা ব্যাখ্যা করতে পারব না। একটি নতুন চৈতন্যের প্রান্তরে আমি নিজকে উপস্থিত দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।
১৯এপ্রিল, ১৯৮৪