বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১২৩

শিরোনাম সূত্র তারিখ
ভাষা-আন্দোলনকালীন দৈনিক আজাদ-এর দুটি সম্পাদকীয় দৈনিক আজাদ ২২ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২

(১)

তদন্ত চাই

 গতকাল ঢাকার বুকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নিকটে যে শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা যেমন মর্মভেদী তেমনি অবাঞ্চিত। আইন অমান্য, নিয়মভংগ, উদ্ধৃংখলতা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু এই সংগে এ কথাও সত্য যে, আইন অমান্য হওয়ার মত ক্ষেত্র সৃষ্টি করাও কোন গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত নয়।

 বিগত দুই দিনের ঘটনা পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীর সমর্থনে ছাত্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে প্রায় একপক্ষ পূর্বে ধর্মঘট পালন করিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হইয়াছিল। গত পরশু তারিখে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ১৪৪ ধারা জারী করিয়া শোভাযাত্রা ও সভা-সমিতি বন্ধ করিয়া দেন। গতকাল এই ব্যাপারকে কেন্দ্র করিয়া ছাত্র বিক্ষোভ হইয়াছে, টিয়ার গ্যাস ও গুলি চলিয়াছে, কতকগুলি হতাহতও হইয়াছে।

 ১৪৪ ধারা জারী করিবার কোন কারণ ঘটিয়াছে কিনা, এই প্রশ্নই সকলের আগে মনে হয়। কয়েকদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন যখন এখানে আসিয়াছিলেন, তখন ঢাকার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন এবং বিরাট শোভাযাত্রা করিয়াছিল, তখন শহরে শান্তিভংগ হয় নাই। গতকল্য ছাত্র ধর্মঘঁট ও শোভাযাত্রা হইলে শান্তি ভংগের আশংকা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ কতটা নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাইয়াছিলেন, বর্তমান মন্ত্রীসভা দেশবাসীকে তাহা জানাইতে বাধ্য বলিয়া আমরা মনে করি।

 গতকল্যকার ঘটনার মধ্যে গুলি চালাইয়া কতকগুলি ছাত্রকে হতাহত করার ব্যাপার সব চাইতে বড় হইয়া উঠিয়াছে। পাকিস্তানে এরূপ ঘটনা ঘটিতে পারে বলিয়া আমরা কখনও ভাবিতে পারি নাই- দেশের জনসাধারণও আশা করে নাই। গুটিকতক বালক ও যুবক যদি নিয়মবিরোধী কার্য করিয়াই থাকে, এমন কি যদি তাহারা কর্তৃপক্ষকে উত্তেজনার কারণও দিয়া থাকে, তাহা হইলেও গুলি চালাইবার মত সংকটাপন্ন অবসস্থা হইয়াছিল কিনা, তাহা বিশেষভাবে বিবেচ্য, হতাহতদের অনেকের আহত স্থান সম্পর্কে যে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে নির্বিচারে গুলি চালান হইয়াছে বলিয়া আমরা মনে করিতেছি। কেবল টিয়ার গ্যাস ছাড়িয়া জনতাকে ছত্রভংগ করা কি সম্ভব ছিল না? দেহের উর্ধ্বাংগে গুলি চালান সুবিবেচনা সংগত কিনা, অথবা উহা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কিনা, তাহাই আজ আমরা কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। উর্ধ্বাংগে গুলি চালানোর কথা দূরে থাক, মোটেই গুলি চালাইবার প্রয়োজন হইয়াছিল বলিয়া আমরা মনে করিতে পারিতেছি না।

 সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া আমরা মনে করি, একটা নিরপেক্ষ শক্তিশালী ও জনসাধারণের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের লইয়া গঠিত কমিটির দ্বারা এই ঘটনার বিশদ ও প্রকাশ্য তদন্ত হওয়া আবশ্যক। হাইকোর্টের জজ এবং বেসরকারী ব্যক্তিদের লইয়া এই কমিটি গঠিত হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীন দেশের নাগরিকগণের ন্যায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য দেশবাসীর পক্ষ হইতে এই তদন্ত দাবী করিতেছি। তদন্তকালে প্রধানতঃ নিমেণাক্ত বিষয়গুলির বিচার করা আবশ্যক-(১) ১৪৪ ধারা জারী করিবার প্রয়োজন কি ছিল? (২) বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ এলাকার মধ্যে পুলিশের আক্রমণ চলিয়াছিল কি? (৩) গুলি চালাইবার মত অবস্থা ঘটিয়াছিল কি? উপরে আমরা যে তদন্ত দাবী করিয়াছি, উক্ত প্রস্তাব কার্যকরী করিলে সমস্ত ঘটনা এবং জনকয়েক তরুণের মৃত্যুর জন্য কাহারা দায়ী, তাহাও প্রকাশ হইবে বলিয়া আমরা ঘটনা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করিলাম না।

 গতকল্যকর দুর্ঘটনায় যে সমস্ত পরিবার শোকসন্তপ্ত, তাহাদের শোককে আমরা নিজেদের শোক বলিয়া গণ্য করি, আমরা সেই সব পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাইতেছি।

(২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২)

(২)

ভুলের মাশুল

 গত শুক্রবার বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য করার জন্য পাক-গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করিয়া প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন ব্যবস্থা পরিষদে এক বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করেন; উহা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বহু বিলম্বে এবং অবাঞ্চিত ঘটনার পর মন্ত্রিসভা ও ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণের আংশিক শুভবুদ্ধি উদয় হইয়াছে দেখিয়া সকলেই সুখী হইবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকরী করণে মন্ত্রিসভা ও তাদের সমর্থক দল কতটা দৃঢ়তা দেখাইবেন, এ সম্পর্কে জনমনে সন্দেহের অবসান হয় নাই। বিশেষতঃ যেসব ঘটনার পর উক্ত প্রস্তাব পেশ ও গ্রহণ করা হয় উহাই মন্ত্রিসভার উপর জনসাধানণের আস্থা-হ্রাস করিয়াছে।

 প্রস্তাব পেশ কিরবার সময় জনাব নুরুল আমীন বলেন যে, গত বৃহস্পতিবারে সরাকার যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেন তাহা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত দাবীর বিরোধী বলিয়া মনে করার নানরূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। তিনি বলেন যে, সেরূপ বিরোধিতা করার ইচ্ছা সরকারের নাই। ইহাই যদি প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীসভার প্রকৃত বক্তব্য হয়, তাহা হইলে তাহারা ২১শে তারিখের পূর্বেই উহা প্রকাশ না করার কারণ দুয়ে রহস্যরূপে থাকিয়া যাইতেছে। এমন কি ২১শে তারিখের সমাল বেলাতেও এরূপ একটা বিবৃতি মন্ত্রিসভার তরফ হইতে প্রকাশিত হইলে পরবর্তী মর্মন্তুদ ঘটনা হইত না এবং আমাদের বিশ্বাস, কতকগুলি অমূল্য জীবনেরও অবসান হইত না। সুতরাং নানারূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াই থাকে, তাহা হইলে সেজন্য জনসাধারণকে দোষ দেওয়া যায় না।

 শহরে ১৪৪ ধারা জারীর কারণ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, সরকার জানিতে পারিয়াছেন যে, কোনও কোনও লোক শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অচল করিতে চায়। ২২শে তারিখে প্রকাশিত সরকারী বিবৃতিতেও এই মর্মে মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল যে, যে সকল তথ্য আছে তাতে জানা যায়, বেআইনী কার্যকলাপের দরুন আজকের (অর্থাৎ ২১ শে তারিখের) অবাঞ্চিনীয় ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার জন্য দায়ী এমন একদল লোক, যাহাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নাই। কথাটা যদি সত্য হয় তাহা হইলে এতদিন জনসাধানণের নিকট এসব তথ্য যতদূর সম্ভব উদঘাটন করা হয় নাই কেন? যদি পূর্বাহেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার মনোভাব প্রকাশিত হইত এবং দেশবাসীর নিকট রাষ্ট্র-বিরোধীদের কার্যকলাপ প্রকাশিত হইত, তাহা হইলে গুলি চালান বন্ধ হত। ১৪৪ ধারার প্রয়োজন হইত না। মন্ত্রিসভা আজ নিজেদেরে যে অবস্থা করিয়াছেন তাহাকে কেবল সুস্পষ্ট অভিযোগ দ্বারা দেশের জনসাধারণকে স্বীকৃতি বা তাহাদের আস্থা অর্জিত করিতে পারিবেন বলিয়া মনে হয় না। দেশে জনসাধারণ শান্তি ও শৃংখলাকারী বা রাষ্ট্রবিরোধীদের কখনও সহ্য করিবে না। ছাত্রসমাজের দেশাত্ববোধের উপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সুতরাং সরকার আজ তাঁহাদের খোলা ঢেল টেবিলে রাখুন। সব তথ্য হয়ত প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু যথাসম্ভব প্রকাশ করুন। আমরা তাদের এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমাদের ছাত্রসমাজ, আমাদের দেশের জনসাধারণ দুষ্কৃতকারীদের সমূলে উচ্ছেদ করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করিবে না।

 জনাব নুরুল আমীন ও তাঁর মন্ত্রিসভা ভুলের পর ভূল করিয়া চলিয়াছেন। তাঁহার নিজেদের গণনেতা বলিয়া দাবী করেন। সর্বজনবিদিত যে, জননেতা তাহারাই, যাদের পরিপূর্ণ যোগাযোগ আছে জনতার অন্তরের সঙ্গে, সংকটকালে তাঁহারা সঙ্কটকালে তাঁরা.........জনতাকে সুষ্ঠুপথে চালিত করিতে পারেন। এই মাপকাঠিতে জনাব নুরুল আমীন ও তাঁর মন্ত্রিসভার বিচার করিলে তাহাদের সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়, তা নিষ্প্রয়োজন।

 সে যাহাই হোক বর্তমান মন্ত্রিসভার বিচার দেশের জনসাধারণই করিবে। কিন্তু আজ তাহারা যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহার সমাধান তাহাদেরই করিতে হইবে। এখন তাহাদেরই ভুলে যে অবাঞ্চিত পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, উহার সমাধানের জন্যই তাহাদেরই অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। এটা তাহাদের ভুলের মাশুল এবং তাহা দেওয়া হইবে যদি তাহারা অহেতুক প্রেষ্টিজ ত্যাগ করিয়া অনতিবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করেন এবং উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ আস্থাভাজন তদন্ত কমিটি নিয়োগ করেন। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে এবং দেশের কল্যাণের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন পথ আছে বলিয়া আমরা মনে করি না।

(২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২)