বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১৩০

শিরোনাম সূত্র তারিখ
নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা সম্মেলন কমিটি পুস্তিকা ২৫-২৬ জুলাই, ১৯৫৭

পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান হইতে আগত ভ্রাতা ও ভগ্নীগণ!

 আপনারা অনেক কষ্ট স্বীকার করিয়া নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে সমবেত হইয়াছেন। সম্মেলনকে সফল করিয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে আপনারা সকল প্রকার অসুবিধা অবনত মস্তকে গ্রহণ করিয়াছেন। আপনাদের সকলের প্রতি তাই আমার গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

বন্ধুগণ!

 দশ বছর পূর্বে আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি। সংগ্রামের দিনগুলি ছিল আমাদের স্বপ্নে ও কল্পনায় ভরপুর। আমরা পাকিস্তানে এক সোনার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করিতে চাহিয়াছিলাম। আমরা কল্পনা করিয়াছিলাম সুখী সমৃদ্ধ একটি দেশ। আমরা স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম ত্যাগ ও সাধনার ঐশ্বর্য্যে মহিমান্বিত একটি জাগ্রত জাতি। সে জাতি বিশ্বে অধিকার করিবে এই গৌরবময় আসন।

 কিন্তু দশ বছরের স্বপ্ন আমাদের ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া গিয়াছে। দেশবাসীর কল্পনার সৌধ আজ বিধ্বস্ত। অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত ও দিকভ্রান্ত জাতি আজ পথের সন্ধান চায়, সন্ধান চায় মুক্তির।

 সে পথ নির্দেশের পবিত্র দায়িত্ব আজ আপনাদের সকলের উপর। সুদূর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত হইতে শুরু করিয়া চট্টগ্রামের কক্সবাজার পর্যন্ত আমাদের দেশের সকল মানুষ আপনাদের উপর সে মহান দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে। দেশের আহ্বানে আপনারা সাড়া দিয়াছেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক জীবনধারাকে অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য আপনারা যে দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দিয়াছেন সেজন্য আবার আপনাদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধ্যনবাদ।

বন্ধুগণ!

 স্বাধীনতার মর্মকথা সকল দেশে ও সকল কালে প্রায় এক। সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের অবসান, আর্থিক দুর্গতির নিরসন এবং মানুষের সংস্কৃতি ও মননশীলতার উন্নতি ও ব্যাপ্তিই স্বাধীনতার প্রাণকথা। মানুষের জীবন হইতে এই বস্তু দুইটিকে বাদ দিলে মানুষে-পশুতে ব্যবধান তাকে না। তাই মানুষ তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেরণায় যুগে যুগে আত্মহুতি দিয়াছে; নিজের জানমাল কোরবানী করিয়াছে। এমন একটি গুণে গুণান্বিত বলিয়াই বিশ্ব স্রষ্টা পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা মানুষকে বলিয়াছেন- আশরাফুল মখলুকাত। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

 কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ সকল যুগেই নিজদের ভোগলালসা চরিতার্থ করার জন্য মানুষকে গোলাম বানাইয়া স্রষ্টার ‘আশরাফা’কে ‘আতরাফে’ পরিণত করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছে, কিন্তু এই অস্বাভাবিক বিভেদ মানুষ কোন কালেও মানিয়া লয় নাই। এ জন্যই যুগে যুগে মানুষ করিয়াছে বিদ্রোহ। দেশে দেশে স্বাধীনতা আন্দোল ও গণঅভ্যুত্থান সেই বিদ্রোহেরই অপর নাম।

 নিপীড়িত মানুষের ইজ্জত ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই তো সেদিন আমার রসুল আরব মরুভূমির বুকে আজীবন সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন তাঁহার সংগ্রাম ছিল জালেম কোরেশদের বিরুদ্ধে। আরবের মানুষকে কৃতদাসে পরিণত করিয়া কোরেশরা জাজিরাতুল আরবে নির্যাতন-নিপীড়ন ও দুর্নীতির এক বিভীষিকা কায়েম করে।

রাসুলুল্লাহ আবির্ভাব না ঘটিলে সেখানকার ইতিহাস হয়তো মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় হইয়া থাকিত।

 আরবের নিপীড়িত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠা আজও সম্ভবপর হয় নাই, সত্য কথা, কিন্তু রসুলুল্লাহ প্রদর্শিত মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামও তাদের থামে নাই। দেশী ও বিদেশী জালেমদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে জাজিরাতুল আরবের মজলুম জনসাধারণ সংগ্রাম করিতেছে। তাদের পশ্চাতে আছে সারা পৃথিবীর মজলুম জনসাধারণের শুভেচ্ছা ও নৈতিক সমর্থন।

বন্ধুগণ!

 পাক-ভারতের আজাদীর সংগ্রামের ইতিহাস অন্য দেশের সংগ্রামের ইতিহাস হইতে ভিন্ন নয়। যেদিন হইতে বিদেশী শক্তি ভারতে তাদের রাজত্ব কায়েম করে সেদিন হইতেই সেই বিদেশী শক্তির নির্যাতনের যূপকাষ্ঠে প্রাণ দিল ভারতের মুসলমান। প্রাণ দিল ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ সকলে সমানভাবে। সিপাহী বিদ্রোহ স্বাধীনতাকামী জনসাধারনের এক ঐতিহাসিক জাগৃতি, এক গৌরবোজ্জ্বল স্বাক্ষর।

 দিল্লীর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ বার্মায় নির্বাসিত হইলেন। আর তাঁর সঙ্গে প্রাণ দিলেন ঝান্সির রানী, অযোধ্যার বেগম, তাঁতিয়াটোপী, নানা সাহেব, মাওলানা আহমদুল্লাহ এবং আরও লক্ষ লক্ষ নাম না জানা মুসলমান ও হিন্দু।

 পলাশীর প্রান্তরে সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে জীবন দান করেন মীর মদন মোহন লাল। সেদিন বাংলার স্বাধীনতাকামীদের প্রথম এবং মহান পরীক্ষা। কিন্তু কতিপয় দেশদ্রোহীর চক্রান্তে আমাদের স্বাধীনতার রবি অস্তমিত হইল। যাহারা বিশ্বাসঘাতক, যাহারা দেশদ্রোহী তাহাদের কোন ধর্মীয় পরিচয় নাই। তাই অতীতের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বিদেশী শক্তির চক্রান্তে যোগ দেয় মুসলমান মীর জাফর, আগাইয়া আসে হিন্দু উমি চাঁদ, রাজবল্লভ। স্বাধীনতা রক্ষার শপথ নিয়া একদিকে অগ্রসর হইলেন সিরাজ, মোহন লাল ও মীর মদন। অপরদিকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য দেশের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইলেন বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ। বিশ্বাসঘাতকরাই সেদিন জয়লাভ করিল। বিদেশী শক্তির সাহায্যে দেশদ্রোহীরাই প্রমাণিত হইল অধিকতর শক্তিশালী।

 সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমাদের দেশে আবারও কি ঘটিবে?

 বন্ধুগণ! পলাশী যুদ্ধের পর হইতে বৃটিশ সরকার একটি নতুন দেশীয় শোষক শ্রেণী সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। এই শোষকের দলে মুসলমান ছিল নগণ্য; কারণ মেকিয়াভেলির নীতি অনুসারে ইংরাজ পরাজিত মুসলমান সমাজের শিক্ষিত ও সমৃদ্ধিশালী লোকদিগকে পাইকারীভাবে হত্যা করিয়াছিল। মোট কথা ইংরেজ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চিরাচরিত পথ অবলম্বন করিল।

 কিন্তু বিরোধের মধ্যেও ঐক্যের সুর ছিল। সে ঐক্য ধ্বনি শুনাইয়া দিয়া গিয়াছে ওহাবী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ। সে ঐক্যের পতাকা উর্ধে তুলিয়া ধরিয়াছে খেলাফত আন্দোলন। বিদেশী শক্তির সঙ্গে সঙ্গে মীর জাফর, উমিচাঁদের ন্যায় ভারতের গণদুশমন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রও জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আতংকিত হইয়া উঠে। কিন্তু তাহাতে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন থামিয়া যায় নাই। স্বাধীনতার প্রেরণা ও আদর্শ নিয়াই আমরা আমাদের স্বাধীন আভাসভূমি পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ি। ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্ব মজলুম মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি দিতে রাজী হয় নাই। তাই আমরা কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছি। কিন্তু আমাদের সে সংগ্রামের মূল কথা ছিল সর্বপ্রকার অত্যাচারের অবসন ঘটাইয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন করা। স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আদশেই সেদিন ভারতের কোটি কোটি মুসলমান উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল।

বন্ধুগণ!

 স্বাধীনতা আমরা পাইয়াছি। আমাদের স্বাধীন বাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। দুনিয়ার কাছে সে স্বাধীনতার স্বীকৃতিও পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু গত দশ বৎসরেও দেশবাসীর জীবনে কি সে স্বাধীনতার স্বীকৃতি লাভ ঘটিয়াছে? আপনারা শুনিয়া লজ্জিত হইবেন যে আজ পর্যন্ত গ্রামে এমন কথাও শোনা যায় যে দেশের অবস্থা প্রাকস্বাধীনতার আমলেই নাকি অধিকতর ভাল ছিল। পল্লী পরিভ্রমণে সে সত্য নির্মমভাবে চোখের সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া উঠে।

 পাকিস্তান একটি কৃষিপ্রধান দেশ। তার অর্থনীতির মূল ভিত্তি নিহিত কৃষকের জীবন আর কৃষকের জমিতে। বর্তমানে পৃথিবীর কৃষিপ্রধান কোন দেশের অগ্রগতিই সম্ভবপর নয়, যদি না দেশের কৃষি ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।

 আমাদের কৃষি ব্যবস্থা অতিশয় পশ্চাৎপদ। সেই মান্ধাতা আমলের ভাঙ্গা লাঙ্গল আর আধমরা গুরু আজিও পাকিস্তানের কৃষকের একমাত্র পুঁজি। অনাহারে অর্ধাহারে, সে আজ জীবন্মৃত। সরকারি হিসাব মতেই পূর্বপাকিস্তানের কৃষকের ভিতর শতকরা ৩৬ জন হইল ভূমিহীন এবং শতকরা ৪০ জন হইল গরীব কৃষক। এই হিসাব ১৯৪৮ সনের হিসাব। তারপর গত ৯ বৎসর উপর্যুপরি সংকটে আরো কত কৃষক যে জমিহারা হইয়াছে তাহার কোন হিসাব নাই। আমাদের এই প্রদেশের চাষীগণ দুনিয়ার সেরা পাট পয়দা করে; কিন্তু গত দশ বৎসরের ভিতর তাহার ন্যায্য মূল্য তাহারা পায় নাই। উত্তরবঙ্গের পটল, তামাক, দক্ষিণবঙ্গের মাদুর, পূর্ববঙ্গের বেত ও চাটাই শিল্প আজ মরোনোন্মুখ। ইহা ছাড়া, কৃষকের ট্যাক্স ও খাজনার বোঝা বাড়িয়াছে। অনাহার ও দুস্থতাই হইয়াছে আমাদের কৃষকদের নিত্যসঙ্গী এবং কৃষকের দুস্থতার ফলে কৃষি উৎপাদন দিন দিন কমিয়া চলিয়াছে। কৃষির উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলেই ঘুরিয়া ঘুরিয়া তীব্র খাদ্য সংকট আমাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। সুজলা সুফলা পূর্ব পাকিস্তান এবং শস্যভাণ্ডার বলিয়া বিখ্যাত, পশ্চিম পাকিস্তান আজ বিদেশী খাদ্য সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছে।

 বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানীতে আজ আমাদের বৈদেশিক তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হইয়া যাইতেছে, দেশের শিল্পোন্নয়নে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি হইতেছে এবং ভিক্ষার ঝুলি হস্তে আমরা বিদেশের সাহায্য ভিক্ষা করিতেছি।

 মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সরকার কৃষকদের এই দুরবস্থার প্রতিকার করে নাই। আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার পর কৃষকদের মনে নূতন আশার সঞ্চার হইয়াছিল। এই সরকার প্রথম দিকে কয়েকটি প্রসংশনীয় কাজ যথা, গত তীব্র খাদ্য সংকটের সময় লঙ্গরখানা খোলা, সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি, নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং যুক্ত নির্বাচন প্রথা কায়েম করেন। সম্প্রতি এই সরকার সার্টিফিকেট প্রথা রদ করিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছেন।

 কিন্তু কৃষকদিগের মৌলিক সমস্যা যথা, ভূমি সমস্যা, খাজনা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বেকার কৃষকের নিয়োগ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা দেখাইয়াছেন। সময় মত বিদেশ ও দেশের অভ্যন্তর হইতে খাদ্য সংগ্রহ, প্রতিটি মিউনিসিপ্যাল এলাকায় পূর্ণ রেশনিং, গ্রাম্য ঘাটতি এলাকায় সংশোধিত রেশনিং, মওজুত উদ্ধার প্রভৃতি ব্যবস্থাগুলি সময় মত অবলম্বন করেন নাই। ফলে প্রদেশে এখনও তীব্র খাদ্য সংকট বিরাট করিতেছে এবং গরীব কৃষক জনসাধারণের ঘরে অর্ধাহার ও অনাহার চলিতেছে। মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক রচিত ভূমিদখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের যতাবিহিত সংস্কার না করিয়া এই সরকার ঐ আইন চালু করিতেছেন। ইহার ফলে গ্রামে গ্রামে সৃষ্টি হইয়াছে দুর্নীতিপরায়ণ আমলঅ আমিনদের অকথ্য জুলুম ও দুর্নীতির রাজত্ব। বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদের সার্বজনীন দাবী সত্ত্বেও এই সরকার কৃষকদের ঘাড় ভাঙ্গিয়া জমিদারগণকে খেসারত দানের ব্যবস্থাই বহাল রাখিয়াছেন। এছাড়া ২১-দফা মোতাবেক খাজনা হ্রাস প্রাপ্ত হয় নাই, বরং বহুক্ষেত্রে খাজনা বৃদ্ধি হইতেছে।

 আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষক ভাইদের অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের চাইতে উন্নত তো নয়ই, বরঞ্চ বহু ক্ষেত্রে তাহাদের দুরবস্থা আরো বেশী। সেখানে মুসলিম লীগ ও রিপাবলিকান সরকার কৃষকদের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। তাই প্রাক্তন সিন্ধুর বিশ লক্ষ হারী (ভূমিহীন কৃষক) আজও জায়গীরদার জমিদারদের অধীনে গোলামের জীবন যাপন করিতেছে। এবং প্রাক্তন পাঞ্জাবের লাখ লাখ মজলুম কৃষক বর্বর বাটাই ও বেগারী প্রথার চাপে নিষ্পেষিত হইতেছে। পক্ষান্তরে মুষ্টিমেয় তিওয়ানা, মালিক, খিজির, মিয়া, নুন প্রভৃতি জমিদার জায়গীরদার পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ জমি দখল করিয়া ভোগবিলাস করিতেছে।

 মোট কথা, ইহা অবিসম্বাদিত সত্য যে আজ হইতে দশ বৎসর পূর্বে স্বাধীন পাকিস্তান কায়েম হইলেও, পাকিস্তানের জনসাধারণের যারা শতকরা ৮৫ জন সেই কৃষক সমাজ স্বাধীনতার কোন আস্বাদন পায় নাই। তাহারা আজও ভূখা। অনাহারে কৃষকদের পেট আর পিঠ আজ এক হইয়া গিয়াছে।

বন্ধুগণ!

 পাকিস্তান মধ্যবিত্তের অবস্থা কৃষকের চেয়ে বেশী ভাল নয়। খাদ্য মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অগ্নিমূল্য এবং দেশের এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি আজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াচে। সরকারই এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হইতে তাহারা এমন একটি অর্থনীতি অনুসরণ করিলেন যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হইয়া এক অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিল। অবস্থা আজ আয়ত্তের বাহিরে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ফলে দেশের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজের আর্থিক মেরুদণ্ডও ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। এরূপ পরিস্থিতি ঠেকাইবার কোন পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের নেই। ফলে দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনে আজ বিরাটকায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দিয়াছে।

শিক্ষা সংকটঃ

 পাকিস্তানের বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা জীবনে মুসলিম লীগ সরকার এক ধ্বংসাত্মক নীতি অনুসরণ করিয়া চলেন। তাদের শাসনকালে সাত বছরে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যায়তনগুলি হ্রাস পাইয়া অর্ধেক দাঁড়ায়। প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের শিক্ষা-নীতি আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ফলে অনেক শিক্ষক শিক্ষকতা পরিত্যাগ করিয়া অন্য পেশা গ্রহণে বাধ্য হইয়াছেন। গ্রামে বহু স্কুল পাঠশালা গরুর খোঁয়াড় ও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়। মাসের পর মাস শিক্ষকদের বেতন বকেয়ার খাতায় পড়িয়া থাকে। এইরূপ কয়েক হাজার শিক্ষকের প্রায় এগারো মাসের বেতন বকেয়া রাখিয়া তদানীন্তন অর্থ সচিব জনাব গোলাম মোহাম্মদ দেশবাসীর সামনে পেশ করেন এক তথাকথিত উদ্বৃত্ত বাজেট। আশ্চর্যের বিষয়, দেশবাসী আন্দোলন এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকার শিক্ষা জীবনে তাদের ধ্বংসাত্মক নীতি চালাইয়া গেলেন।

 লীগ-যুক্তফ্রণ্ট সরকার সে নীতির কোন পরিবর্তন করেন নাই এবং বর্তমান আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারও সেই নীতিই অনুসরণ করিতেছেন। সোহরাওয়ার্দী সরকার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষা ব্যবস্থা উপর চরম আঘাত হানিলেন ৭৭৭১টি প্রাইমারী স্কুল বন্ধ করিবার পরিকল্পনা করিয়া। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান প্ল্যানিং কমিশনের সভ্য হিসাবে তাহাতে সম্মতি দিয়াছেন। স্বাধীনতা লাভের পরও দেশবাসীকে শিক্ষার আলোক হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিবার পরিকল্পনাকে ধ্বংসাত্মক কার্য্য ছাড়া আর কি বলা যায়?

শিল্পোন্নয়ন:
বন্ধুগণ!

 সদ্য আজাদীপ্রাপ্ত একটি দেশের বিশেষ করিয়া পাকিস্তানের মত একটি অনুন্নত দেশে অর্থনীতর উন্নয়ন নির্ভর করে শিল্প প্রতিষ্ঠায়। খোদাতায়ালা আমাদিগকে প্রচুর সম্পদ দিয়াছেন। কাজেই সরকার পক্ষের যদি যথাযোগ্য প্রচেষ্টা থাকিত তাহা হইলে গত দশ বৎসরে আমাদের এই দেশ বিশেষ অগ্রগতি লাভ করিতে পারিত। স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের দেশে পূর্বাপেক্ষা শিল্পোন্নতি হইয়াছে সত্য। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ইহা যথেষ্ট নহে। সুতিবস্ত্র, সিমেণ্ট, পাট, কাগজ, চিনি প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিল্পের যে অগ্রগতি হইয়াছে তাহাতে এখনও দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানো সম্ভবপর হইতেছে না- বিদেশে রফতানি তো দূরের কথা। অবশ্য আমাদের শিল্পজাত কিছু কিছু মাল বিদেশে রফতানি হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের দেশ শিল্পে প্রভূত অগ্রসর হইয়াছে। লক্ষ লক্ষ লোক আমাদের দেশে বস্ত্র পায় না। অথচ সামান্য কিছু কাপড় বিদেশে পাঠাইয়া সরকার প্রমাণ করিতে চাহিতেছেন যে আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়ন হইয়া গিয়াছে।

 দেশে শিল্পের উন্নতির বিরাট সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমাদের দেশের শিল্পের এই অবস্থার জন্য দায়ী সরকার। আমাদের পাট, তুলা প্রভৃতির বিনিময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হইতে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানীর যে সুবিধা ছিল মুসলিম লীগ সরকার বা লীগ-যুক্তফ্রণ্ট সরকার সে সুযোগ কাজে লাগান নাই। আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারও এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে নূতন কিছু করেন নাই। শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল প্রভৃতির জন্য সরকার নির্ভর করিতেছেন যাহাদের উপর তাহাদের নিকট হইতে সন্তোষজনক সাড়া পাওয়া যায় নাই। অথচ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেও সরকার নারাজ। ফলে আমাদের দেশের শিল্পোন্নতির পথে আজ নানাবিধ বাধা বিঘ্ন উপস্থিত হইতেছে। এবং যাহারা শিল্প গড়িতে চান তাহারা পরিপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা পাইতেছেন না। তাই স্বাধীনতা লাভের দশ বৎসর কাটিয়া গেলেও আমাদের দেশের পশ্চাৎপদতা কাটে নাই।

 আমরা বার বার দাবী করিয়া আসিতেছি পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করা হউক। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার ও যুক্তফ্রণ্ট লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী বিবেচনা করা তো দূরের কথা ইহাকে প্রাদেশিকতা বলিয়া প্রচার করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইগণকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাইগণের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করিবার অপচেষ্টা করিয়াছে।

 আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠিত হওয়ার পরেও দেশকে শিল্পায়িত করার প্রশ্নে পূর্বকার নীতি অনুসৃত হইতেছে। এই সরকার ২১ দফা ওয়াদা অনুসারে দেশকে শিল্পায়িত করার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল। কিন্তু সে ওয়াদা তাঁহারা পালন করেন নাই। তাঁহারা দেশকে শিল্পায়িত করার জন্য কোনরূপ সুষ্ঠু নীতি এখন পর্যন্ত প্রণয়ন করেন নাই।

শ্রমিক সমস্যাঃ

 বন্ধুগণ, মাত্র যে কয়েকটি শিল্প-কারখানা এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সরকারী অব্যবস্থার দরুন তাদের কয়েকটি বছরের অনেক সময় কাঁচামালের অভাবে অসুবিধা ভোগ করে। বিশেষ করিয়া কাপড়ের কলগুলির কথা বলিতেছি।

 শ্রমিক শোষন ধনতান্ত্রিক দেশসমূহের কতটা নীতিগত ব্যাপার। কাজেই শ্রমিক-মালিক তিক্ততা সেসব দেশের নিত্যনৈমিত্তিক কথা। কিন্তু আমাদের দেশের মত একটি অনগ্রসর দেশে যাহাতে শ্রমিক মালিকের তিক্ততা বৃদ্ধি না পায় দেশকে শিল্পায়িত করার শর্ত হিসাবে সরকারের সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

 কিন্তু এ পর্যন্ত কোন সরকারই শ্রমিকদের জীবনধারণের উপযোগী মজুরী, তাহাদের উপযুক্ত বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি কোন বিষয়েই কিছু করেন নাই। ন্যায্য দাবীর জন্য শ্রমিক বৈধ আন্দোলন করিলে সরকার শ্রমিকদের উপর শুধুমাত্র দমন নীতি চালাইয়া গিয়াছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রমিকগণ বর্তমানে যে মজুরী পাইয়া থাকেন তদ্বারা তাহাদের স্ত্রী-পুত্র নিয়া জীবনধারণ করাই কঠিন। বহু ক্ষেত্রে শ্রমিকরা এমন সব বস্তিতে বাস করিতে বাধ্য হয় যাহা মানুষের বাসোপযোগী নয়। বহু ক্ষেত্রেই শ্রমিক আইন ভঙ্গ করিয়া শ্রমিকদিগকে অতিরিক্ত খাটাইয়া লওয়া হয়। পাকিস্তানের শ্রমিকদের অবস্থা সত্যই অবর্ণনীয়।

 বর্তমানে নিত্যব্যবহার্য্য প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই অবস্থায় ২১ দফা ওয়াদা মোতাবেক শ্রমিকদের বেতন ও মাগগী ভাতা বৃদ্ধি করা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের উচিত ছিল। কিন্তু তাহা করা হয় নাই। বরং বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান সরকার শিল্পে শান্তি রক্ষার নামে এক চুক্তি সম্পাদন করিয়া শ্রমিকগণের বৈধ ধর্মঘটের অধিকার হরণ করিয়াছেন। কৃষকদের অবস্থা বর্ণনার সময় আমি বলিয়াছি এবং শ্রমিকদের ব্যাপারে পুনর্বার আমি সেই কথাই বলিতে চাই যে, আমাদের আযাদী লাভের দশ বৎসর অতীত হইয়া গেলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রমিকদের জীবনে স্বাধীনতার ছোঁয়া লাগে নাই। কঠোর পরিশ্রম, মালিকদের জুলুম ও স্ত্রীপুত্রসহ কায়ক্লেশে জীবনধারণ ইহাই পাকিস্তানী শ্রমিকদের নসিব।

দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতাঃ

 এরপর আসে দুর্নীতির কথা।

 স্বাধীনতা লাভের পূর্বেও দেশে দুর্নীতি ছিল। কিন্তু উহা অস্বাভাবিক ছিল না, কারণ বৈদেশিক সরকার বহু প্রকারের দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়া থাকে। তাহাদের শাসন কায়েম রাখার জন্য চাই দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ। তাদের শোষণ কায়েম রাখিতে হইলেও প্রয়োজন দুর্নীতির। কাজেই শাসন ক্ষমতা হাতে রাখার এক বিরাট হাতিয়ার তাদের দুর্নীতি।

 উদাহারণস্বরূপ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের কথা বলা যাইতে পারে। এই ‘মহান ব্যক্তিরা’ যে দেশেই গিয়াছেন সেখানেই দুর্নীতি বাসা বাঁধিয়াছে। তাদের আগমনও দুর্নীতিমূলক এবং তাদের অবস্থানও দুর্নীতিমূলক। আমেরিকার প্রিয় পাত্র চিয়াং কাইশেকের দেশ চীন একদা দুর্নীতিবাজদের আখড় হইয়া দাঁড়ায়। বৃটিশের অধীনে থাকাকালে ভারতেও দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। আজ বৃটিশ, আমেরিকা ও ফরাসীর যুক্ত অভিযানে গোটা মধ্যপ্রাচ্য দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হইয়াছে। যুদ্ধোত্তর জাপান ও তুরস্কও আমেরিকার কল্যাণে দুর্নীতিবাজির আখড়ায় পরিণত হইয়াছে।

 উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তানের শাসকগণও বৃটিশের নিকট হইতে দুর্নীতির পদ্ধতি আয়ও করেন। মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানে দুর্নীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। যুক্তফ্রণ্ট-লীগ কোয়ালিশন সরকারের আমলে উহা আরো প্রসারলাভ করে।

 আওয়ামী-কোয়ালিশন সরকার বহু ঢাকঢোল পিটাইয়া প্রচার করিয়াছিলেন তাঁহারা দুর্নীতির মূল্যোৎপাটন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু অবস্থা বর্তমানে এমন এক স্তরে আসিয়াছে যে, দুর্নীতি আজ প্রায় সমগ্র সমাজ-জীবনকে বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছে।

 দুর্নীতি দমন করা যায় না আমি একথা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নই। সমাজ জীবন হইতে দুর্নীতি দূর করিতে না পারিলে পাকিস্তানের কোন উন্নতি হইতে পারে না। তাই সমাজ জীবন হইতে দুর্নীতি উৎখাত করিবার জন্য আমি সমস্ত পাকিস্তানবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি।

 আমি বিশ্বাস করি যে, সরকার যদি উদ্যোগী হইতেন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেন তাহা হইলে এদেশের সমাজ জীবন ও শাসনযন্ত্রকে তাঁহারা দুর্নীতিমুক্ত করিতে পারিতেন। কিন্তু সরকারী প্রচেষ্টারই অভাব রহিয়া গিয়াছে। তাই দুর্নীতিরোধ সম্পর্কিত সরকারের কথাবার্তা আজ অন্তসারশূন্য প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে।

ব্যক্তি-স্বাধীনতা:

 মুসলিম লীগ সরকার, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলাম আমাদের দেশের ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে বিপর্যন্ত করিয়া গিয়াছিল। আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার প্রথম দিকে রাজবন্দীদের মুক্তি এবং নিরাপত্তা আইন বাতিল করিয়া দিয়া হৃত ব্যক্তিস্বাধীনতা পুনরূদ্ধার করিতে সচেষ্ট হন। তজ্জন্য দেশবাসী তাঁহাদিগকে অসংখ্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

 কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সরকার অর্ডিন্যান্স দ্বারা কেন্দ্রীয় কালাকানুন পুনরায় প্রয়োগ করিয়াছেন। পাকিস্তানের নাগরিকদের পাসপোর্ট ইত্যাদি কাড়িয়া লইয়া এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আটক করিয়া মৌলিক নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করিতেছেন। এ কারণে গণতন্ত্রকামীদের দায়িত্ব শত গুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা আজ তাঁদের কায়েম রাখিতেই হইবে। এজন্য যে কোন মূল্য দিতে হইলেও তাকে করিতে হইবে।

স্বায়ত্তশাসনঃ

 এবার আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি জনসাধারণের সামনে তুলিয়া ধরিতে চাই। পাকিস্তানের যে বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানহেতু আমরা ২১-দফা কর্মসূচীতে এই প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবী করিয়াছিলাম এই দাবী পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শ্রেণীর জনসাধারণের অকুণ্ঠ দাবী। আমাদের এই দাবী আজও পূরণ হয় নাই। আজও শিল্প, বাণিজ্য আবগারী প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ের পূর্ণ দায়িত্ব প্রদেশের নিকট দেওয়া হয় নাই। অথচ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলিতেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে না-কি শতকরা ৯৮ ভোগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইয়াছে। ১৯৫৫ সনে শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন নিয়া দেশে বিতর্কের সময়ে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে হাতে লিখিয়া দিয়াছিলেন যে, মন্ত্রিত্বে থাকাকালে তিনি ২১-দফা মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রচেষ্টা করিবেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়া শহীদ সাহেব কি তাঁহার নিজ হাতে লিখিত সেই দায়িত্বের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন?

 এই প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের ১৯৫৫ সনের অক্টোবর মাসের অধিবেশনে এক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানে জবরদস্তিমূলকভাবে এক ইউনিট গঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান হয় এবং ঘোষণা করা হয়।

 “যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় এবং যখনই যাইবে তখনই ইহা সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত সংগ্রহ করিয়া এবং জনসাধারণে মতামতের পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়া এক ইউনিট পুনর্বিচেনা করিবেন।” এই প্রস্তাব এখানো বলবৎ আছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসিয়াছে আজ দশ মাস। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে জনমত সংগ্রহের কোন প্রচেষ্টা করা হয় নাই। হওয়ার কোন লক্ষণও নাই।

 আমাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতি মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলাম চূড়ান্ত উপেক্ষ প্রদর্শন করিয়াছে। সেজন্য দেশবাসী তাহাদিগকে ক্ষমা করে নাই। আমাদের সেই স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারও আজ উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছে। দেশবাসী উহা বরদাশত করবেন কি?

 প্রসঙ্গত উল্লেখ করিতে চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবীর অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যও স্বায়ত্তশাসন আমরা চাই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মিলিত শক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী হউক।

বৈদেশিক নীতি:
বন্ধুগণ!

 গভীর উদ্বেগের সহিত আমি লক্ষ্য করিতেছি যে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার মুসলিম লীগ সরকার মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক অনুসৃত সামরিক চুক্তিগুলিকে সমর্থন করিয়া আমাদের পাকিস্তানের আজাদী ও সার্বভৌমত্বের সামনে এক বিপন উপস্থিত করিয়াছে।

 মুসলিম লীগ সরকার আমেরিকা বৃটেন প্রভৃতির সাথে যেসব সামরিক চুক্তি অনুষ্ঠান করিয়াছেন, সেসব চুক্তি যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর, শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া আমি সে কথা বলিতেছি না। আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা হইতে দেখিয়াছি যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা সব সময় মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। ১৯শ’ শতাব্দীর শেষ ভাগ হইতে আজ পর্যন্ত আরব জাহানে বৃটিশ শাসকবর্গের কার্যকলাপ হইল একমাত্র প্রতিশ্রুতি ভংগ ও বিশ্বাসঘাতকতার কার্যকলাপ। পলাশীর যুদ্ধের সময় হইতে শুরু করিয়া সাম্প্রতিককালে পর্যন্ত আমাদের প্রতি বৃটিশ শাসকবর্গ যে ব্যবহার করিয়াছে তাহা হইল শুধু বঞ্চনা, শোষণ ও অত্যাচারের কাহিনী। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সময়েও কি বৃটিশ শাসকবর্গের ছলচাতুরীর জন্যই পাকিস্তান “বিকলাঙ্গ ও কীটদষ্ট” রাষ্ট্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করে নাই? আর জাহানের বক্ষে ছুরিকাঘাত করিয়া বৃটিশ ও আমেরিকার শাসকবর্গই কি ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন করেন নাই?

 বলা হইয়া থাকে যে আমাদের দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য আমেরিকার ডলার সাহায্য প্রয়োজন। শর্তহীন বৈদেশিক আর্থিক সাহায্য গ্রহণে আমাদের কোন আপত্তি নাই। বরং সেরূপ সাহায্য আমরা চাই। শর্তহীন সাহায্যই বন্ধুত্বকে গাঢ় করিতে পারে। কিন্তু আমেরিকার শর্তাধীন ডলার সাহায্যে কোন দেশ উন্নতি করিয়াছে, এরূপ কোন দৃষ্টান্ত কেহ দেখাইতে পারেন কি? পক্ষান্তরে, আমরা দেখিয়াছি যে, শত শত কোটি ডলার সাহায্য সত্ত্বেও চিয়াং শাসিত চীনের আর্থিক অবস্থা অবনতির চূড়ান্ত সীমায় পৌছিয়ছিল। তুরস্ক, ইরাক প্রভৃতি দেশ বহুদিন হইতে ডলার সাহায্য পাইতেছে। অথচ আমেরিকার শাসকবর্গের মুখ হইতেই শোনা যায় যে, ঐ সব দেশের আর্থিক সংকট বাড়িতেছে বৈ কমিতেছে না। আমরাও ডলার সাহায্য পাইতেছি ১৯৫৪ সন হইতে। কিন্তু তবুও আমাদের দেশের আর্থিক সংকট দিন দিন গভীর হইতেছে এবং কোটি কোটি সাধারণ মানুষ আজও অনাহারে ও অর্ধহারে থাকিতে বাধ্য হইতেছে।

 ডলার সাহায্য দ্বারা কোন দেশের আর্থিক উন্নতি না হওয়ার প্রধান কারণ হইল যে, যেসব চুক্তি মারফত আমেরিকা ঐ সব সাহায্য দান করে সেসব চুক্তিতে এমন সব শর্ত জুড়িয়া দেওয়া হয় যাহাতে সাহায্যপ্রাপ্ত দেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়। এর প্রমাণস্বরূপ আমি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির শর্তাবলীর কিছু উপস্থিত করিতেছি।

 ১৯৫৪ সনের প্রথম ভাগে ঐ সামরিক সাহায্য চুক্তি অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী আমার তারবার্তার জওয়াবে ঐ চুক্তির কতকগুলি শর্ত জানাইয়াছিলেন। সেগুলি তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সে শর্তাবলীর দুই একটি উদ্ধৃত করিতেছি।

 ঐ চুক্তির শর্তাবলীর চতুর্থ পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে,

 “পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হইতে যেসব কর্মচারী পাইবেন, তাহারা চুক্তি অনুসারে পাকিস্তানে থাকিয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব পালন করিবেন এবং চুক্তি অনুযায়ী প্রদত্ত সাহায্য কিভাবে ব্যবহৃত হইতেছে তাহা পর্যবেক্ষণ করার কর্তৃত্ব ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাইবেন। এই চুক্তি অনুযায়ী কর্মচারীরূপে পাকিস্তানে আগত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণ পাকিস্তান সরকারের সহিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসেরই অংশ বলিয়া গরিগণিত হইবে এবং কূটনৈতিক মিশনের ডিরেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকিবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নির্দেশে পাকিস্তান সরকার উচ্চপদস্থ মার্কিনী, বিমান ও স্থল বাহিনীর অফিসারদিগকে কূটনৈতিক মর্যাদা দান করিবেন।”

 এই শর্ত অনুযায়ী পাকিস্তানে আগত আমেরিকার অফিসারগণ আমেরিকা হইতে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করায় যে “কর্তৃত্ব ও সবাধ সুযোগ” লাভ করিলেন, উহার ফলে স্বাভাবতই আমাদের সেনাবাহিনীর উপর তাহাদের প্রভাব বিস্তার হইতেছে। আমাদের দেশে ঐ বিদেশী অফিসাররা হইলেন, ‘স্বাধীন’! কারণ তাহারা আমাদের দেশে থাকিয়া “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব পালন করিবেন”; “কূটনৈতিক মর্যাদা” ভোগ করিবেন এবং তাহাদের উপর আমাদের দেশের সরকারের কোন এক্তিয়ার থাকিবে না। এমনকি তাহারা সাধারণ অপরাধ করিলেও আমাদের কোর্ট তাহাদের বিচার করিতে পারিবে না। জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আমি জিজ্ঞাসা করিতে যে পাক- মার্কিন সামরিক সাহায্য চুক্তির ঐ শর্তের ফলে যে প্রভাব বিস্তার হইতেছে তাহাতে কি আমাদের সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হইতেছে না? ইহাই কি আমাদের দেশরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার নমুনা? আর আমাদের সেনাবাহিনীর সার্বভৌমত্বই যদি ক্ষুণ্ণ হয়; তাহা হইলে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব থাকিবে কি?

 কিছুদিন পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার আমেরিকার ডলার সাহায্য ও অন্যান্য বৈদেশিক আর্থিক সাহায্য সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায় যে, আমেরিকার সহিত আর্থিক সাহায্যের যতগুলি চুক্তি আমাদের সরকার অনুষ্ঠান করিয়াছেন তাহারা প্রত্যেকটিতেই শর্ত আছে যে, ঐ ডলার সাহায্যের ব্যবহার তদারক প্রভৃতির জন্য আমেরিকার যেসব অফিসার আমাদের দেশে আসিবেন তাহারা সবাই “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মচারী” বলিয়া গণ হইবেন এবং কূটনৈতিক মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করিবেন তাহাদের উপর আমাদের সরকারের এক্তিয়ার খাটিবে না।

 অর্থাৎ আমেরিকার ডলার সাহায্যের সাথে সাথে আমাদের দেশে যে শত শত আমেরিকান অফিসার আসিতেছেন, তাহাদের সমবায়ে প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে একটি ‘স্বাধীন’ সংগঠন গড়িয়া উঠিতেছে, যে সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিকট দায়ী। ইহার দ্বারা আমাদের রাষ্ট্রের মধ্যে অন্য একটি রাষ্ট্রের কি সৃষ্টি হইতেছে না? ইহার পরিণাম দেশবাসীই বিচার করবেন।

 পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির আরও একটি শর্তে পঞ্চম পরিচ্ছেদের ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে;

 “পারস্পরিক সাহায্যের নীতি অনুসারে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনে এমন সব কাঁচা মাল বা আংশিকভাবে নির্মিত দ্রব্যাদির উৎপাদন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি বা যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তর করিবেন যাহা পাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা সম্ভব।”

 জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট আমি আবার জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, চুক্তির ঐ শর্ত দ্বারা কি আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিনষ্ট হইতেছে না এবং আমাদের অর্থনীতির উপর আমেরিকার আধিপত্য বিস্তার হইতেছে না? কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মুখে আমি কেন্দ্রীয় অর্থ সচিব জনাব আমজাদ আলীকে সাক্ষ্য হিসেবেও উপস্থিত করিতেছি। কিছুদিন পূর্বে (গত মে মাসের শেষ ভাগে) পেশোয়ারে ও করাচীতে দুইটি বক্তৃতায় জনাব আজমাদ আলী বলিয়াছেন যে, আমাদের অর্থনীতি দ্রুত আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতেছে এবং তজ্জন্য ভাংগিয়া পড়িতেছে। অর্থ সচিবের এই মন্তব্য সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য কি?

 ১৯৫৪ সনের প্রথমভাগে পাক-মার্কিন সামরিক সাহায্যচুক্তি অনুষ্ঠানের সময়ে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নব নির্বাচিত ১৬৭ জন সদস্য এক প্রকাশ্য বিবৃতিতে ঐ চুক্তি সম্পর্কে বলিয়াছিলেন,

 আমরা মনে করি যে, এই চুক্তির ফলে আমাদের দেশও বিশ্বযুদ্ধ চক্রান্তে জড়াইয়া পড়িবে, আমাদের দেশের ধনসম্পদ ও জনবল আমেরিকার যুদ্ধ ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হইবে এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হইবে।

 এই বিবৃতিতে বহু আওয়ামী লীগ নেতা যথা পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান শিল্প ও শ্রমমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রের বর্তমান শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহম্মদ প্রমুখ নিজ হাতে স্বাক্ষর দিয়াছিলেন।

 যাহা হোক, আমি ইহাই বলিতেছি যে, বৃটেন ও আমেরিকার শাসকবর্গের নীতি ও কার্যকলাপ, বিভিন্ন দেশে আমেরিকার ডলার সাহায্যের ফলাফল এবং সামরিক চুক্তিগুলির শর্তাবলী বিচার বিবেচনা করিয়াই আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করিয়াছিল যে, ঐ চুক্তিগুলো “দেশের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতার পরিপন্থী” এবং আওয়ামী লীগ “সকল প্রকার সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করে”।

 কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমস্ত জানিয়া শুনিয়াও, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুকাল পর হইতে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক অনুষ্ঠিত সামরিক চুক্তিগুলিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করিতে থাকেন। এই কাজ দ্বারা তিনি যেমন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের নীতি ও আদর্শগত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিয়াছেন, তেমনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে ভুলিয়া গিয়াছেন।

 আমি এবং আওয়ামী লীগের বহু কর্মী প্রথম হইতে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঐ কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়াছি। আমরা আশা করিয়াছিলাম, জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজের ভুল বুঝিতে পারিবেন। সেজন্য তাঁহাকে আমরা সময়ও দিয়াছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হয় নাই। তিনি নিজ ইচ্ছা অনুসারে সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত সহযোগিতা করিয়া চলিয়াছেন।

কাশ্মীর ও খালের পানি:

 মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক অনুষ্ঠিত সামরিক চুক্তিগুলি সমর্থনে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি প্রধান যুক্তি প্রদর্শন করিতেছেন যে, ইহাতে আমাদের কাশ্মীর লাভ করার পক্ষে সহায়তা হইতেছে। কাশ্মীরে অবোধ গণভোট অনুষ্ঠিত হউক এবং কাশ্মীর পাকিস্তানে আসুক ইহা আমাদের সকলের অকুণ্ঠ দাবী। ভারত সরকারের বাধা এবং একগুয়েমিপূর্ণ নীতি সত্ত্বেও কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ও আমাদের ঐ দাবী হাসিল করার জন্য যথাযোগ্য পথও আমাদের গ্রহণ করিতে হইবে।

 বাস্তবে দেখা যাইতেছে যে; মুসলিম লীগ সরকার প্রথমবধি বৃটেন আমেরিকার উপর নির্ভর করিয়া ও পরে সামরিক চুক্তিগুলিতে যোগ দিয়া কাশ্মীরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রচেষ্টা সুদীর্ঘকাল যাবৎ চালাইয়া আসিয়াছিলেন, তাহা ব্যর্থ হইয়াছে। জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী আরও দক্ষতার সহিত গত দশ মাস যাবৎ সেই নীতি ও সেই প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছেন। কিন্তু, পর্বত মুষিক প্রসব করিয়াছে। কাশ্মীর যে স্থানে ছিল, সেই স্থানেই আছে।

 উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত ১লা জুন করাচীতে এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার বিশেষ সংবাদদাতার সহিত এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলিয়াছেন, “খালের পানি বিরোধ ও কাশ্মীর সমস্যা আমাদের উপর সাঁড়াশি অভিযানের দুইটি দিক।”... কিন্তু, “আমরা কিছুই করিতে পারি না। ভারত এতই শক্তিশালী যে, আমেরিকাসহ প্রত্যেকেই তাহারা বন্ধুত্ব কামনা করে।”

 এই খেদোক্তির ভিতর দিয়া জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজ নীতির ব্যর্থতা নিজে স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু তবুও কিসের মোহে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই বন্ধ্যা নীতি আঁকড়াইয়া রহিয়াছেন, তাহা তিনিই জানেন।

 আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফর করিতেছেন। সেখানে গিয়া তিনি প্রেসিডেণ্ট আইসেনহাওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মার্কিন সিনেটে বক্তৃতা করেন এবং প্রেসিডেণ্ট আইসেনহাওয়ারের সংগে একটি যুক্ত ঘোষণা প্রকাশ করিয়াছেন।

 যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দী যেসব উক্ত করিয়াছেন এবং যে যুক্ত ঘোষণা প্রচার করিয়াছেন তাহার প্রত্যেকটিতে তিনি আমেরিকা বৈদেশিক নীতির প্রতি সমর্থন জানাইয়াছেন। কিন্তু প্রতিদানে পাকিস্তান কি পাইয়াছে? পাক-মার্কিন যুক্ত ঘোষণার দেখা যায় যে, কাশ্মীর ও খালের পানি বিরোধের মত পাকিস্তানের জীবনমরণ সমস্যাকে প্রেসিডেণ্ট আইসেনহাওয়ার ‘আঞ্চলিক সমস্যা’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করিয়াছেন মাত্র কিন্তু এসব সমস্যায় পাকিস্তানের সমর্থনে তিনি কোন স্পষ্টোক্তি করেন নাই। অথচ জাতিসংঘ নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ দ্বারা কাশ্মীর সমস্যা সমর্থনের কথা বলিয়াছে।

 জনাব সোহরাওয়ার্দী মার্কিন কংগ্রেসে যে বক্তৃতা করেন তাহাতে তিনি কাশ্মীর ও খালের পানি বিরোধ সম্পর্কে উল্লেখ করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আমেরিকার শাসকবর্গের “অনুরোধে” আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দী নাকি তাহার বক্তৃতা হইতে কাশ্মীর ও খালের পানি বিষয়ক, কতিপয় বিষয় শেষ পর্যন্ত বাদ দিয়া দেন। লক্ষ্য করিবার বিষয় যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের বক্তৃতায় জনাব সোহরাওয়ার্দী কাশ্মীর ও খালের পানি সম্পর্কে কোন কথা বলেন নাই।

বন্ধুগণ!

 আমাদের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়া যদি নিজের কথা অবাধে বলিতে না পারেন, সেখানে যদি তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হয়, তাহা হইলে কি ইহাই প্রমাণিত হয় না যে যুক্তরাষ্ট্রের সহিত “বন্ধুত্বের” বিনিময়ে আমরা আমাদের সর্বপ্রকারের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেছি?

 কাশ্মীর পাওয়ার জন্য সম্রাজ্যবাদীদের উপর নির্ভর করার যে নীতি মুসলিম লীগ সরকার অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন এবং যে নীতি বর্তমানে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনুসরণ করিতেছেন; সেই নীতি আজ বাস্তবে বন্ধ্যা ও দেউলিয়া বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।

 ঐ বন্ধ্যা ও দেউলিয়া নীতিতে যে সুদীর্ঘ সময় নষ্ট করা হইয়াছে তাহার সুযোগে ভারত সরকার কাশ্মীরে তাহার অবস্থানকে সুদৃঢ় করিয়া ফেলিতেছে। আমাদের সরকার কাশ্মীরকে ভারতের হাতে তুলিয়া দেওয়ার জন্য দায়ী। পক্ষান্তরে, কাশ্মীর পাওয়ার যুক্তিতে সরকার যেসব সামরিক চুক্তিকে যোগদান করিয়াছেন তাহার শর্তগুলির ফলে পাকিস্তানের আজাদী ও সার্বভৌমত্ব বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে। আমরা কাশ্মীর ও পাইলাম না এবং আমাদের আজাদী ও সার্বভৌমত্বও বিনষ্ট হইতেছে। ইহাই মুসলিম লীগ সরকার ও জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতির ফল!

আমাদের চলার পথ
বন্ধুগণ!

 পরিশেষে আমি ইহাই বলিতে চাই যে যুগ যুগ ধরিয়া আমাদের পূর্বপুরুষগণ মুক্তি ও গণতন্ত্রের যে আদর্শ নিয়া সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন, যে আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হইয়া আমরা পাকিস্তান সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলাম সেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ আজও বাস্তবে রূপায়িত হয় নাই। আমাদের স্বাধীন পাকিস্তান অর্জনের পর দশ বৎসর অতিক্রান্ত হইলেও মজলুম জনসাধারণের জীবনে স্বাধীনতার ছোঁয়াচ লাগে নাই। পাকিস্তানের কোটি কোটি মজলুম নরনারী আজও নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত ও শোষিত।

 স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জনসাধারণের আর্থিক দুর্গতি নিরসনের সওয়াল নিয়াই একদা আওয়ামী লীগ গড়িয়া উঠিয়াছিল। সেই আওয়ামী লীগের নেতারাও আজ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁহাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি খেলাফ করিতেছেন। এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনকে উহার নীতি ও আদর্শ হইতে বিচ্যুত করিয়াছে।

 বার বার প্রতারিত হইয়া দেশের জনসাধারণের মনে সন্দেহ জাগিতেছে এবং তাহারা নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হইতেছেন।

 উপসংহারে আমি বলিতে চাই যে সত্য ও মিথ্যার লড়াই, শোষক ও শোষিতের লড়াই, জমিদার ও প্রজার, সুদখোর মহাজন ও খাতকের লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই, ধর্ম-অধর্মের লড়াই, বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন যেখানেই হইয়াছে তাহাতে যে সমস্ত নেতা ও কর্মী অংশগ্রহণ করিত তাহাদের ত্যাগ, কোরবানী, নির্যাতন ভোগের মাপকাঠিতে সেই সংগ্রাম বা লড়াই ততটা সাফল্য লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছে। উহার নজীর বিশ্বনবী ও তাঁহার ছাহাবদের জীবনের ও বর্তমান নবীন চীনের মুক্তি উন্নতির ইতিহাস আমাদের সম্মুখে মওজুত।

 পাক-ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বহু লোকের বহু ত্যাগ ও কোরবানীর ইতিহাসও আমাদের সম্মুখে মওজুত আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত ত্যাগী দেশ প্রেমিকদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতার পূর্বে অথবা কিছুদিন পরেই আমাদিগকে চিরদিনের জন্য তাহাদের সাধনা ও আদর্শ হইতে বঞ্চিত করিয়া আল্লাহর ইচ্ছায় পরলোক গমন করিয়াছেন। আজ যাহারা পাকিস্তানের কর্ণধার ইহাদের মধ্যে যখনই যে দল ক্ষমতা দখল করিয়াছে তাহাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন যাহারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন প্রকারের কোরবানী বা নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। নির্যাতিত নেতা যেরূপভাবে দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের প্রতি দরদ রাখে যাহারা জীবনে কখনো জালেমের জুলুমে পতিত হন নাই তাহাদের পক্ষে দেশের লোকের প্রতি সেরূপ দরদ রাখা সম্ভবপর নহে।

 তাই আজ আমার মনে হয় যদি মরহুম কায়েদে আজম, মরহুম মওলানা মোহাম্মদ আলী, হেকিম আজমল খাঁ, মওলানা শওকত আলী, মওলানা আজাদ সোবহানী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রভৃতি ত্যাগী মহাপুরুষগণ জীবিত থাকিয়া পাকিস্তানের উভয় অংশের কর্ণধাররূপে শাসন পরিচালনা করিতেন তাহা হইলে আজ দশ বৎসরে আল্লাহর মর্জি পাকিস্তানের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাইত। বিশেষ করিয়া প্রায় দুইশত বৎসরকাল বিদেশী ইংরেজের শাসন ও শোষণের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করিলে পাকিস্তানের বর্তমান কর্ণধারগণ যেভাবে পুনরায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী ও শোষকদের নিকট সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করিবার জন্য সামরিক চুক্তি করিয়া পুনরায় দেশবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন তাহাতে শঙ্কিত না হইয়া উপায় নাই। উপরোল্লিখিত মরহুমেরা রাজনীতি করিতেন দেশ ও জাতিকে দেশী-বিদেশী সকল শ্রেণীর শোষকদের কবল হইতে মুক্ত করিয়া দেশ ও জাতিকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করিবার জন্য। বর্তমানে যাহারা রাজনীতি করেন তাহাদের মধ্যে অধিকসংখ্যক লোকই ক্ষমতা লাভ ও নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য। তাই দেখা যায় ক্ষমতা লাভের পূর্বে যাহাদের বিশেষ কিছু সহায়-সম্পত্তি ছিল না, তাহারাও যখন ক্ষমতায় যান তখন কিছুকালের মধ্যেই নিজের জন্য ২৩ মনজেলা বাড়ী গাড়ী, আত্মীয় স্বজনের চাকুরী, পারমটি, লাইসেন্স ইত্যাদির সাহায্যে নিজ নিজ দলীয় মোসাহেব ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অবস্থা আমূল পরিবর্তন করিয়া ফেলে। ইহা লক্ষ্য করিয়া পর পর বিভিন্ন দল গদী দখল করিবার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করিতে থাকে। দেশ জাতি ধ্বংস হইল কিনা তাহা লক্ষ্য করিবার দৃষ্টিভঙ্গি এখন পর্যন্ত যত দলের লোক ক্ষমতা দখল করিয়াছে তাহাদের মধ্যে সমষ্টিগতভাবে কোন দলের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় নাই। প্রত্যেক দলের নেতারাই প্রতিযোগিতামূলকভাবে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসেল করিতে আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে ও করিতেছে। ইহার প্রতিকার না হওয়ার একমাত্র কারণ পাকিস্তানের মেরুদণ্ড পল্লীবাসীদের ভিতর সত্যিকার কর্মসূচী লইয়া আমরা সংগঠন স্থাপন করিতে পারি নাই। বর্তমানে যে কোন রাজনৈতিক দলই হউক না কেন তাহাদের শাখা, সমিতি, সামান্য যাহা কিছু কায়েম হইয়াছে তাহাতে গ্রাম্য প্রতিনিধি নাই বলিলেই চলে। অধিকাংশই শহরের উকিল, মোক্তার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণীর লোক। গ্রামে বাস করে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ জন লোক, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলেই তাহাদের সংখ্যানুপাত প্রতিনিধি নাই।

 তাই আমার মনে হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অংশে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কৃষক সমিতি অধিক পরিমাণে কায়েম করা প্রয়োজন।

 পূর্ব পাকিস্তানের ৬০ হাজার গ্রামের ৪ কোটি কৃষক, ভূমিহীন, মজুর, বিড়ি শ্রমিক, অন্যান্য ছোট ছোট কারখানার শ্রমিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক, ব্যবসায়ী প্রাইমারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারী কলেজ প্রভৃতির শিক্ষক, মৎসজীবী প্রভৃতির হাড়-ভাংগা পরিশ্রমের ফলেই আজও পাকিস্তান টিকিয়া আছে। তাহাদিগকে বাঁচাইতে পারিলেই পাকিস্তান বাঁচিবে, তাহাদের আন্তরিক সহযোগিতা লাভের দ্বারাই কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি গঠনমূলক কাজে উন্নতি লাভ করা সম্ভবপর। উভয় পাকিস্তানের পল্লীতে ভ্রমণ করিলে দেখা যায় একশত টাকার নোট তো দূরের কথা, দশ টাকার একখানা নোট ভাংগাইতে পঁচিশ ত্রিশ বাড়ী ঘুরিয়াও খুচরা টাকা পাওয়া যায় না। ইহার দ্বারাই পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় দেশের সম্পদ ও অর্থ ক্রমেই বিদেশী শোষক ও দেশীয় চোরাকারবারী, বড় বড় অফিসার, মন্ত্রী, মেম্বার প্রভৃতি কতিপয় অতি অল্প সংখ্যক লোকের নিকট জমা হইতেছে। জীবনে যাহাদের চট্টগ্রাম, লাহোর, ঢাকা, করাচী প্রভৃতি শহর ও বন্দরে ছোট-খাটো বাড়ীও ছিল না তাহাদের মধ্যে অনেকেই আজ ১০/১৫টা বাড়ী উঠাইয়া উচ্চ হারে ভাড়া আদায় করিয়া হাজার হাজার টাকা আয় করিতেছে। ইহাতেও পল্লীবাসীর লোক হিংসার কারণ হইতো না যদি তাহাদের নিকট যে অর্থ আছে সেই অর্থ দ্বারা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া দেশের লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন মজুর ও বেকার যুবকদের কাজের সংস্থান করিয়া দিয়া মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়া দিতেন।

 আমার আন্তরিক বিশ্বাস, আজ সমস্ত পাকিস্তানের চোরাকারবারী ও পারমিট শিকারীদের হাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আছে। এই টাকার কোন হিসাব-নিকাশ সরকারকে দিতে হয় না। ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা নাই, ঢাকা হইতে করাচী বা করাচী হইতে ঢাকা আনা-নেওয়া করিতে কোন ব্যাংকের ড্রাফট গ্রহণ করিতে হয় না, সুটকেস ভরিয়া প্লেনে বা গাড়ী, ষ্টীমারে চড়িয়া পারাপার করা যায়। ইহার ফলে আমাদের মতো অনুন্নত দেশের পক্ষে শিল্প প্রতিষ্ঠান কায়েম করার অপিরহার্য কর্তব্যটি ক্রমেই পিছাইয়া পড়িতেছে। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা যাহারা আমাদের শাসক গোষ্ঠীর পরম বন্ধু তাহাদের তৈরী মাল আমাদের দেশের বাজারে বিক্রি করিয়া কোটি কোটি টাকা মুনাফা লইয়া যাইতেছে। ইহার ফলে দেশ ও জাতির আর্থিক দুরবস্থা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। বিদেশী মুদ্রা একমাত্র কৃষকদের হাড়ভাঙ্গ পরিশ্রমে উৎপাদিত কাঁচামাল দ্বারাই সংগৃহিত হইতেছে, শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশে পৌঁছিয়া ভিন্ন দেশের স্বর্ণ পাকিস্তানের আনার ব্যবস্থা খুবকমই হইতেছে। ইহার জন্য শুধু দুঃখ প্রকাশ করিয়া বসিয়া থাকিলে হইবে না। এই অবস্থার পরিবর্তন করিতে এবং যখন যে দল জনসাধারণের ভোটে প্রতিনিধি হইয়া গদী দখল করিবে তাহারা যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও চোরাকারবারী পারমিট শিকারীদিগকে প্রশ্রয় দিতে না পারে এবং দেশের জনগণের ইচ্ছা ও প্রয়োজনানুযায়ী সুষ্ঠু কর্মসূচী গ্রহণ করিয়া দেশের গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করিতে বাধ্য হয় তজ্জন্য সারা দেশময় গণ-আন্দোলন জোরদার করিতে হইবে। এবং দেশের প্রকৃত দেশদরদী ও চরিত্রবান লোকের যাহাতে জনসাধারণের প্রতিনিধি হইতে পারেন তাহার দায়িত্ব জনসাধারণকে গ্রহণ করিতে হইবে। আমাদের দেশে মোটেই ভাল যোগ্য লোক নাই ইহা বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। ভাল লোক যাহারা আছেন তাহারা নির্বাচন ও প্রতিদ্বন্দিতায় মোটেই অগ্রসর হইতে চান না। ইহার প্রধান কারণ এ দেশের প্রত্যেকটি নির্বাচনে টাকা খরচের যে ছড়াছড়ি দেখা যায় তাহাতে একমাত্র চোরাকারবারী ঘুষখোরেরাই এরূপ টাকা খরচ করিতে পারে। আদর্শবাদী ও সৎ লোক যাহারা আছে তাহাদের পক্ষে বর্তমানে ছেলেমেয়সহ জীবনযাত্রা নির্বাহ করাই কঠিন। তদুপরি নির্বাচনের জন্য ২০/২৫ হাজার টাকা খরচ করা শুধু অসম্ভবই নয় আকাশ কুসুম। তাই চোরাকারবারী ও ঘুষখোর প্রভৃতি শ্রেণীর লোক ২০ হাজার হইতে ৬০ হাজার টাকা খরচ করিয়া যদি জয়লাভ করিতে পারে তাহা হইলে অল্পদিনের মধ্যেই তাহার খরচের টাকা মুনাফাসহ উত্তল করিতে এবং ভবিষ্যতে আর একবার নির্বাচনে প্রার্থী হইলে সে টাকাও অর্জন করিতে সক্ষম হয়। ইহার প্রতিকার করিতে না পারিলে দেশের সৎ ও আদর্শবাদী লোককে আইন সভায় পাঠান কিছুতেই সম্ভব হইবে না।

বন্ধুগণ!

 তাই আজ পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে নূতন আশা ফুটাইয়া তুলিবার জন্য এবং আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শকে রূপায়িত করার জন্য আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত গণতন্ত্রকামী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হইতে আবেদন জানাইতেছি। আমি আবেদন জানাইতেছি যে, কৃষক, মধ্যবিত্ত, শ্রমিক ও অন্যান্য মজলুম জনসাধারণের আর্থিক উন্নতি, সমাজ সংস্কার ও কৃষকের হাতে জমি খাদ্য সংকটের সমাধান শিল্পোন্নয়ন ও শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরী দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, যুক্ত নির্বাচন প্রথাকে সুদৃঢ় করা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমস্ত প্রকার সামরিক জোট হইতে আমাদের দেশকে মুক্ত করিয়া পাকিস্তানকে একটি পূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম ও জনকল্যাণমূলক ফেডারেল রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়া পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতন্ত্রকামীগণ একটি মঞ্চে মিলিত হউন। আমি বিশ্বাস করি যে, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশ ও জনসাধারণের প্রতি যত বিশ্বাসঘাতকতাই করিয়া থাকুক না কেন পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতন্ত্রকামীগণ যদি আজ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হন, তাহা হইলেই পাকিস্তানের মজলুম জনসাধারণের মুক্তি আসিবে এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত হইবে এবং আমাদের পাকিস্তান সেদিন দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র বলিয়া পরিগণিত হইবে।

 সেই মহান দিনের প্রতীক্ষায় আমি রহিলাম। নাছরুম মেনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারীব।

পাকিস্তান জিন্দাবাদ