বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/২৬

শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভায় বাজেটের ওপর বিতর্কে মওলানা ভাসানীর বক্তব্য প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভা ১৯ই মার্চ, ১৯৪৮

 Maulana Abdul Hamid Khan: জনাব সদর সাহেব, দীর্ঘদিন যাবৎ সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের শাসন ও শোষণ হ'তে মুক্তি লাভ করে পূর্ব্ববঙ্গের জনসাধারণ আশা করেছিল যে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে, স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করবে, তাদের হারান গৌরব ফিরে পাবে, তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নতি লাভে সক্ষম হবে কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, বড় আফসোসের বিষয় যে এই হাউসে জনাব অর্থসচিব যে বাজেট পেশ করেছেন তা তিনি জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবে করেননি। গভর্ণর জেনারেলের মনোনীত মেম্বর হিসাবে করেছেন। স্বাধীন দেশে, স্বাধীন পাকিস্তানে স্পেশাল পাওয়ারের মন্ত্রী দ্বারা বাজেট পেশ হবে তা আমরা কখনও আশা করিনি। জনসাধারণের মনের কথা, মনের দুঃখ ও বেদনা বুঝবার তাঁর শাক্তি নাই কারণ জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর আদৌ কোন সংশ্রব নাই। তিনি গভর্ণর জেনারেলের প্রেরিত প্রতিনিধি। জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর মনের কোন মিল নাই। বিংশ শতাব্দীর এই গণতান্ত্রিক যুগে এই স্বাধীন দেশে গভর্ণর জেনারেল স্পেশাল পাওয়ার ব্যবহার করবেন এটা আমাদের ধারণার অতীত।

 তারপর তিনি যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে আমলাতান্ত্রিক ভোগবিলাসের জন্য সব কিছুই করেছেন। কিন্তু দেশের মেরুদণ্ড কৃষক মজুর যারা দিবারাত্র হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রাজস্ব যোগায়, তাদের জন্য কিছুই করেন নাই। শতকরা ৪ জন লোক শহরে বাস করে তাদের পানীয় জলের জন্য ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন কিন্তু ৪ কোটি ৬০ লক্ষ গ্রামবাসীদের পানীয় জলের জন্য কোন ব্যবস্থা করেন নাই। যুক্তবঙ্গে ১৯৪৩-৪৪ সালে পুলিশ খাতে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল ৩ কোটি ২ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা আর আমাদের মাননীয় অর্থ সচিব যে বাজেট উপস্থিত করেছেন তাতে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পুলিশের খাতে ব্যয় বরাদ্দ করেছেন ৩,০৩,৭৭,০০০ টাকা।

 পূর্ব্ব পাকিস্তান যারা হাসিল করেছে তাদের উপরই ইহা রক্ষা করার দায়িত্ব। পূর্ব্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তা করতে বদ্ধপরিকর। পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা শত্রুতা করে ইহাকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করবে, পূর্ব্ব পাকিস্তানের আবালবৃদ্ধবণিতা কৃষক, মজুর, সকলে সংগবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়বে এবং পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। পুলিশের ব্যয় বৃদ্ধি করে স্বাধীন পাকিস্তানকে রক্ষা করার চেষ্টা অত্যন্ত লজ্জাকর বিষয়।

 দেশের শিল্প, কৃষি, নৈতিক চরিত্র ও সর্ব্বপ্রকার উন্নতি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। কিন্তু সেই শিক্ষার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র দুই কোটি কয়েক লক্ষ টাকা। আমি আশা করি মাননীয় অর্থ সচিব সাহেব পুলিশের ব্যয় সঙ্কোচ করে শিক্ষার খাতে যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ করবেন এবং এই বাজেট রহিত করে নূতন আকারে আনয়ন করবেন।

 মাননীয় অর্থ সচিব সাহেব সেদিন বলেছেন যে জমিদারী প্রথা তাড়াতাড়ি উচ্ছেদ করলে এক কোটি লোক মারা যাবে বা তাদের জীবন বিপন্ন হবে। তাঁর ফিগার বুঝতে পারলাম না। পূর্ব বাংলার মোট ৪ কোটি ৬০ লক্ষ লোকের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ কৃষিজীবী। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করলে ১ কোটি লোক কি করে মারা যায়? এটা তিনি কি করে আবিষ্কার করলেন? গরীব কৃষকদের উপর জুট লাইসেন্স ফী বাবদ ২০ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু আপনারা জেনে অবাক হবে যে এই প্রদেশে জমিদারদের কাছে ২ কোটি টাকা সে বাকি আছে। এক ময়মনসিংহ জেলায় ২৬ লক্ষ টাকা সে বাকি। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সমস্ত দিন ঘুমান আর সন্ধার সময় গিয়ে দস্তখত করেন। এই বাকি সে আদায়ের কোন ব্যবস্থা করছেন না। যে সমস্ত গরীব কৃষক কৃষিঋণ নিয়েছে এবং শোধ করতে পারছে না, মাননীয় অর্থ সচিব সার্টিফিকেট দ্বারা তাদের বাড়ীঘর নীলাম এবং জোতজমি ক্রোক করে উক্ত ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু প্রবল প্রতাবশালী জমিদারদের হাতে কড়া লাগিয়ে ২ কোটি টাকা বাকি সেস আদায়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এই হাউসে অনেক মিনিষ্টারের কাছেও লক্ষ লক্ষ টাকা সেস্ বাকি পড়ে আছে। স্বয়ং অর্থ সচিব মাননীয় হামিদুল হক সাহেবেরও হয়ত সেস বাকী আছে। (হাস্য...)। যদি মন্ত্রীরা গরীব কৃষকদের মেরে মন্ত্রীত্ব করতে চান তাহলে তাহারা আর বেশী দিন মন্ত্রীত্ব করতে পারবেন না।

 The Hon'ble Mr. Hamidul Huq Chowdhury: Mr. Speaker. Sir, will you ask the honorable member to take personal responsibility for the statement he has made that a large amount of cess remains in arrear so far as I am concerned?

(At this stage there was uproar in the House).

 Moulana Abdul Hamid Khan: যদি মরণাপন্ন কৃষকদের প্রতি এই ব্যবস্থা করা হয় তাহলে মন্ত্রীমণ্ডলীর সোনার চেয়ার ধ্বংস হবে। কৃষকদের উপর অত্যাচার করে মন্ত্রিত্ব করার অধিকার কারো নাই। আজ আর বৃটিশ শাসন নাই। আজাদ পাকিস্তানে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। প্রত্যেক মানুষ চায় খাওয়া-পরা, রোগ ঔষধ, থাকার ঘর, চলাচলের রাস্তা, ও লেখাপড়ার সুব্যবস্থা এবং এগুলি তাদের সঙ্গত দাবী। আমি আশা করি মন্ত্রীমণ্ডলী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে জনপ্রিয়তা লাভ করবেন।

 Co-operative Department-এর ঋণদান সমিতি সুদের টাকা আদায় করতে কি অত্যাচার না করে? এই Department একটি Bogus Department। গভর্ণমেণ্টের কত টাকা খরচ হচ্ছে কিন্তু বাস্তবিক কোন কাজ হচ্ছে না। এর চেয়ে Trade Society করে Share বিক্রি করে গ্রামে গ্রামে Industry গড়ে তুলবার ব্যবস্থা করলে অনেক ভাল হত।

 বিনা বেতনে Civil Supply Department এ Superintendent-এর পদ পেলেও অনেকে দরখাস্ত করবে। আমি দেখেছি Civil Supply Department-এর ২০০ টাকার কর্মচারীর ঘরে Silk মশারী এবং দরজা জানালায় Silk-এর পর্দা। এরাই এই পাক পাকিস্তানকে নাপাকের Depot-তে পরিণত করেছে। এটা বড়ই আফসোসের কথা। এই নাপাকের Depot উচ্ছেদ করতে হবে। Civil Supply Dept. দুর্নীতিপূর্ণ Department। এই Department-কে উচ্ছেদ করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই house-এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। Muslim League-এর নির্দেশ অনুযায়ী দেশের জনসাধারণ লীগ মনোনীত কলা গাছকেও ভোট দিয়েছে। মুসলিম লীগ প্রার্থী ১ নয় ২ নয় শতকরা ৯৮টি আসন দখল করেছে। জনসাধারণ আপনাদের মুখপানে চেয়ে আছে-জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হবে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হবে, দূনীতিপূর্ণ কণ্ট্রোল প্রথা উঠে যাবে।

 এই পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ টাকার মদ বিক্রি হচ্ছে। মদ বিক্রি করে, হারাম বিক্রির রাজস্ব দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনা হতে পারে না। মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি ছাড়া পাকিস্তানের উন্নতি হতে পারে না। আপনারা জানেন বহু টাকা ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও আসাম গভর্ণমেণ্ট মদ বিক্রি তুলে দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আলহাজ, আশা করি পাকিস্তানে নাপাক ডিপো, মদ-গাজার দোকান, বেশ্যাবৃত্তি এবং দুনীর্তিপূর্ণ Control ব্যবস্থা রাখবেন না। পাকিস্তানে পাক মানুষ বাস করবে। পাক Department থাকবে। মেম্বরদের জন্য ১০ লক্ষ কয়েক হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে কিন্তু প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকগণ আজ ৮ মাস যাবৎ সামান্য ১৫ টাকা বেতনও পাচ্ছেন না। অথচ মন্ত্রীদের বেতন ঠিক মাস মাস আদায় হচ্ছে।

 Mr. Speaker: আপনার সময় হয়েছে, আপনি বসুন।

 Maulana Abdul Hamid Khan: দুটি কথা। প্রাদেশিক গভর্ণমেণ্ট এই যে sales-tax Central গভর্ণমেণ্টের সঙ্গে চুক্তি করে Central Government-Subject করে দিয়ে আসলেন এবং তাদের কাছ হতে মাত্র ১ কোটী টাকা নিবেন বলে স্বীকৃত হলেন, এটা মন্ত্রীমণ্ডলী কোন স্বাধীনতার বলে করলেন? Assembly-র member-দের সঙ্গে পরামর্শ না করে তাঁরা নিজেরা মোড়লী করলেন কোন অধিকারে? আমরা কি Central Government-এর গোলাম? বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের গোলামী করি নাই। ন্যায়সঙ্গত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব। আমরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পাট উৎপাদন করব অথচ Jute Tax, এমন কি Railway Tax, Income Tax, Sales Tax নিয়ে যাবে Central Govt. এই সব taxএর শতকরা ৭৫ ভাগ প্রদেশের জন্য রেখে বাকি অংশ Central Govt. কে দেওয়া হোক। এই বাজেটে মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী যাঁরা আজাদীর জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যিনি পাকিস্তানের জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের memorial-এর জন্য কোন ব্যবস্থা করা হয় নাই। এই দিকে আমি গভর্ণমেণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।