বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৫৫

শিরোনাম সূত্র তারিখ
ভাষা বিতর্কের ওপর লেখা তৎকালীন সময় প্রচারিত প্রবন্ধ নও বাহার ফেব্রুয়ারী ১৯৫২

সকল ভাষার সমান মর্যাদা
আলী আশরাফ

 [ভাষা আন্দোলন কিভাবে লক্ষ্যহারা হইয়া নানা পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এই প্রবন্ধে তাহার সুন্দর প্রমাণ মিলিবে। প্রবন্ধটি ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখের “নও বেলাল” নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। পরে ইহা “পূর্ববাংলা” নামক সাপ্তাহিক পত্রের ১৩ই ফাল্গুন সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হইয়ছে। “নও বেলাল” ও “পূর্ব-বাংলা প্রগতিশীল তরুণ দলের মুখপাত্র। বাংলা ভাষার ইহারা পূর্ণ সমর্থক। কাজেই এই দুইখানি সংবাদপত্রে নূতন কথা শুনায় আমরা সত্যই বিস্মিত হইয়াছি। লেখক যে গতানুগতিক চিন্তা-ধারায় ভাসিয়া যান নাই এবং সমস্যাটির উপর যে কিছুটা নূতন আলোকপাত করিতে পারিয়াছেন, তজ্জন্য আমরা প্রবন্ধটির অংশবিশেষ সংকলিত করিয়া দিলাম]

 ....পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষা” হবে বাংলা ও উর্দু- এ মতই বর্তমানে প্রগতিশীল মহলে প্রচলিত। এবং এ মতবাদ থেকেই দাবীও জানানো হচ্ছে যে (যেমন আওয়ামী লীগ নেতারা জানাচ্ছেন) পূর্ববঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ভাবে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলাভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হোক।

 “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজই আজ বিকশিত হয়ে “বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা চাই”-এই সুস্পষ্ট আওয়াজেরই রূপ ধারণ করেছে। প্রগতিশীল মহল সাধারণভাবে ভাবছেন যে, এটাই হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সমস্যা সমাধানের পথ। কিন্তু সত্যই কি তাতে সমস্যার পরিপূর্ণ ও গণতন্ত্রসম্মত সমাধান হবে? ২১শে ফেব্রুয়ারী যে গৌরবময় সংগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষা পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষা” হলেই কি সে সংগ্রামের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হবে এটাই কি গণতন্ত্র? না, এতে সমস্যার সমাধান হবে না, এটা গণতন্ত্রও নয়। কারণ, যে নীতি অনুসারে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার চাইছি, সে নীতি অনুসারেই অন্যান্যকেও তাঁদের ভাষার অধিকার দিতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ শুধু বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষায় কথা বলে না। পাকিস্তানে শুধু যে বাংলা ভাষাভাষী জনগণই রয়েছে তা নয়, এ রাষ্ট্রের অধীনে আরো রয়েছে সিদ্ধি ভাষাভাষী, পাঞ্জাবী ভাষাভাষী, পুস্তু ভাষাভাষী, বেলুচ ভাষাভাষী ও গুজরাটী ভাষাভাষী জনগণ। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি উপজাতি- যাদের রয়েছে স্থানীয় ডায়লেক্ট, মুসলিম লীগ সরকারও বাংলা, উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পুস্তু, বেলুচী ও গুজরাটী- এই সাতটি ভাষাকে পাকিস্তানের জনগণের ভাষা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বস্তুতঃ পাকিস্তানের রয়েছে পাঁচটি প্রধান প্রধান জাতি- বাঙালী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পাঠান ও বেলুচী। এদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট, স্থায়ী, অবিচ্ছিন্ন বাসভূমি আছে, প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি অর্থনৈতিক জীবন আছে, প্রত্যেকের নিজস্ব মানসিক গঠন ও কৃষ্টি রয়েছে এবং প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ মাতৃভাষা।

 মুসলিম লীগ এই বাস্তব সত্য অস্বীকার করে এক জাতি, এক তমদুন, এক ভাষার প্রতিক্রিয়াশীল যুক্তির অবতারণা করে উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা” করতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে যদি গণতন্ত্রী কর্মীরাও শুধু বাংলা ও উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা” করতে চান, তাহলে সিন্ধিভাষী পুস্তুভাষী, পাঞ্জাবীভাষী, বেলুচীভাষী ও গুজরাটীভাষী জনগণের উপর ঐ দুটো ভাষা চালিয়ে দেয়া হবে। এটাও স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রবিরোধী কাজেই “বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা হোক”- এ দাবী কখনোই পরিপূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত নয়। “অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”- এই দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজ, যে আওয়াজ থেকেই শুধু বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী এসেছে, সেই আওয়াজ আজ পরিত্যাজ্য আন্দোলনের প্রথমস্তরে জনগনের সে আওয়াজ প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু মহান একুশে ফেব্রুয়ারীর এক বৎসর পর যখন জনগনের অভিজ্ঞতা ও গনতান্ত্রিক চেতনা আরও বেড়ে গেছে, তখন আন্দোলনের মূল দাবীরুপে ঐ দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজের কোন আন্দোলনের ব্যপকতা বৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে বাধা হচ্ছে। তার প্রমাণ হলো, সে আওয়াজ সিন্ধিভাষী, প্রভৃতি জাতির গণতান্ত্রিক দাবীকে আমল না দিয়ে শুধু বাংলা ও উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা”র আসনে বসাতে চাইছে এতে ভাষা আন্দোলনের পিছনে সিন্ধিভাষী, পুস্তুভাষী, বেলুচীভাষী, পাঞ্জাবীভাষী প্রভৃতি সারা পাকিস্তানের সাধারন জনতাকে সমাবেশ করা যাচ্ছে না। বরং তারা এর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে। উর্দুকে পূর্ববঙ্গে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার দাবীও অগণতান্ত্রিক। কোন ভাষাভাষী জনগনের উপর অন্য ভাষাকে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপিয়ে দেওয়াটা স্বৈরাচারের অভিব্যক্তি। এভাবে, এক ভাষা অপরের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করলে জনগনের শিক্ষা ব্যাহত হয় ও জাতিগত বিরোধ সৃষ্টি হয়। পূর্ববঙ্গে উর্দু ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা বাধ্যতামূলক করার আওয়াজ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জাতিগত বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই, এ আওয়াজ পরিত্যাজ্য।

 বহু ভাষাভাষী জনগণের অর্থাৎ বহু জাতির মিলনক্ষেত্র পাকিস্তানের ভাষা সমস্যার গণতন্ত্রসম্মত সমাধানের জন্য আমাদের আন্দোলনের মূলনীতি হবেঃ ছোট- বড় প্রত্যেকটি ভাষাভাষী জনগণের প্রত্যেকটি ভাষাকে সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার দেয়া। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ জনগণ যাতে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ পায়, তার জন্য এ আন্দোলনের দাবী হবে নিম্নরূপঃ

 (ক) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন, ঘোষণা, দলিল, প্রভৃতি বাংলা, উর্দু, সিন্ধি পাঞ্জাবী, পুস্তু ও বেলুচী ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। গুজরাটী ভাষাভাষী জনসংখ্যা যদি যথেষ্টসংখ্যক হয়ে থাকে তবে সে ভাষায়ও প্রকাশ করতে হবে।

 (খ) কেন্দ্রীয় আইন সভায় প্রত্যেক সভ্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পারবেন ও দোভাষীরা সেগুলি বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করে দেবেন। (জাতিসংঘে ও সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে চলছে।)

 (গ) প্রত্যেক ভাষাভাষী জনগণের নিজ নিজ বাসভূমির (অর্থাৎ বিভিন্ন প্রদেশের) রাষ্ট্রকার্য্য, আইন আদালতের কার্য সে প্রদেশের ভাষায় চলবে। বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত অন্য ভাষাভাষীরা (যেমন পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষীরা বা পাঞ্জাবের বাঙালীরা) সে সব প্রদেশের আইন- আদালতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পালাবে।

 (ঘ) বিভিন্ন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে সেসব উপজাতীয় ভাষায় আইন-আদালতের কাজ চলবে।

 (ঙ) ছোটু বড় প্রত্যেক ভাষাভাষী জনসমষ্টি ও বিভিন্ন প্রদেশে সংখ্যালঘুরাও নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার অধিকার ভোগ করবে। এই সমস্ত দাবীগুলির সারমর্ম নিয়ে আমাদের আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তিরূপে মূল শ্লোগান বা আওয়া হবে।

“সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই”


আলী আশরাফ নামটি ছদ্মনাম। লেখকের আসল নাম খোকা রায়। তিনি তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।