বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৫৬

শিরোনাম সূত্র তারিখ
আন্দোলনে সরকারী আচরণ সমর্থন করে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য পাকিস্তান প্রচার বিভাগ ৩রা মার্চ, ১৯৫২

ভাষা আন্দোলনের অন্তরালে

নূরুল আমীন

 বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক দাবী দমাইয়া রাখার প্রশ্নই উঠে না। ২১শে ফেব্রুয়ারীর মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে এই সম্পর্কে ঢাকায় এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে সভা ও শোভাযাত্রা করা হয়; স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাহাতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন নাই। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আসল প্রশ্ন নয়, ইহার পশ্চাতে সরকারকে বানচাল করার জন্য বিদেশী দালাল ও অন্যান্যদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নিহিত আছে। আইন অমান্যের উদ্যোক্তাদের যদি ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য না থাকিতে তবে ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হওয়াতেই তাহারা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইত।

 কিন্তু আমরা কি দেখিলাম....।

 গত ৩রা মার্চ রাত্রে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা হইতে জনসাধারণের উদ্দেশে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতাঃ

 দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ আপনাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলিতেছি। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় যেসব ঘটনা ঘটিয়াছে, আমি অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হইয়াছি। আমি আপনাদেরই একজন, আপনারাই আমাকে একজন খাদেম হিসাবে আপনাদের খেদমত করার সুযোগ ও গৌরব দিয়াছেন। আমার বিবেকবুদ্ধি মতে আমার সাধ্যমত আপনাদের খেদমত করাই আমার কর্তব্য। এই কথা হয়তো না বলিলেও চলে যে, প্রত্যেক পাকিস্তানীর জীবন- সে ছাত্রই হউক বা অন্য অন্য কেউ হউক- আপনাদের কাছে যেমন প্রিয় আমার কাছে ঠিক তেমনি প্রিয়। প্রত্যেকটি পাকিস্তানীর জীবন পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ, তাই ঢাকায় দুর্ঘটনায় যে পাঁচজনের জীবন নাশ হইয়াছে তাহাতে আমি জাতীয় ও আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি বলিয়াই মনে করি। ঢাকার সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় যাহারা ভুক্তভোগী তাহাদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, ঢাকার গুলী চালানো সংক্রান্ত ঘটনাবলী যথাসময়ে প্রকাশিত হইবে এবং এ সম্পর্কে কেহ দোষী সাব্যস্ত হইলে তাহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে। যেহেতু অবস্থা ক্রমেই স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে এবং গত কয়দিনের ঘটনার স্থানে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা ক্রমেই প্রকাশিত হইতেছে, এখন এ বিষয়ে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করিবার সময় আসিয়াছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে আমার আগের বক্তৃতায় আপনাদের কাছে অনেক কিছুই খুলিয়া বলিতে পারি নাই। এখন আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করিতে চাই এবং তাহা হইতে আপনারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন যে, সরকার এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছিলেন যেখানে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। কম্যুনিষ্ট, বিদেশী চর এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত অংকুরেই বিনষ্ট হইয়াছে। এই চক্রান্তের পটভূমি, স্বরূপ এবং চক্রান্তকারীদের পন্থা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখন আপনাদিগকে অবগত করান আমার কর্তব্য। এ সমস্ত ব্যাপারে পর্দার আড়ালে থাকিয়া যে সকল শক্তি কাজ করিতেছিল তৎসম্পর্কে আমার পূর্ব বক্তৃতায় কিছু কিছু ইংগিত করিয়াছিলাম।

পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র

 ২১ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব হইতেই সরকার সংবাদ পাইতেছিলেন যে, যাহারা পাকিস্তান পরিকল্পনাকে একটি অভিসম্পাত বলিয়া বিবেচনা করিত, পাকিস্তান অস্তিত্বকে যাহারা পথের কাঁটা বলিয়া মনে করিত এবং পাকিস্তান ধ্বংস করার চিন্তা যাহারা কখনও ত্যাগ করে নাই তাহারা পুনরায় তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। এই দল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও কাজ করিতেছিল এবং কিছুসংখ্যক ছাত্রকে ভুল পথে পরিচালিত করিতেছিল। দেশে উচ্ছৃঙ্খলার সৃষ্টি করিয়া শাসনব্যবস্থাকে জবরদস্তিক্রমে বানচাল করিয়া দিবার জন্য ইহারা ব্যাপক পরিকল্পনা করিতেছিল। তাহারা শধু সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাতের জীবদ্দশায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত এই সকল লোক নীরব ছিল। কায়েদে মিল্লাতের শাহাদাতের পর তাহারা সুযোগের সন্ধান পায়। বাংলাভাষা প্রশ্নটি স্বভাবতঃই সকলের ভাবাবেগ আকর্ষণ করে বলিয়া উহার আড়ালে এই সকল লোক তাহাদের হীন প্রচেষ্টা লুক্কায়িত রাখিবার সুযোগ পায়।

 সবদিক বিবেচনা করিয়া দেখিলে এই কথাই সুস্পষ্ট হইয়া ওঠে যে, প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশনের প্রথম দিন হইতে আরম্ভ করিয়া যত দিন দরকার হয় তত দিন গোলমাল বাধাইয়া রাখিবার পরিকল্পনা করা হইয়াছিল। সরকার খবর পাইয়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক দাবীকে দাবাইয়া রাখিবার কোন প্রশ্নই ইহার মধ্যে ছিল না। ঘটনার মাত্র পক্ষকাল পূর্বেও ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় এই সম্পর্কে সভার অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রা বাহির করা হইয়াছিল। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোথাও কোন হস্তক্ষেপ করেন নাই। ১৪৪ ধারা জারি করিয়া এ ধরনের সভা ও শোভাযাত্রা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় নাই। জেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি লইয়া উহা করা যাইত। কিন্তু কেহ এইরুপ কোন অনুমতি চান নাই। ইহার পরবর্তী ঘটনাবলী হইতে সরকারের প্রাপ্ত সংবাদেরই সুস্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় যে, যে সকল লোক গোলযোগ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করিতেছিল, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি তাদের এই হীন ষড়যন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন লাভের একটি হাতিয়ার ব্যতীত আর কিছুই নহে।

ভাষা-বিতর্ক

 পাকিস্তানের অন্যান্য শুভাকাঙ্খীদের মত আমিও আশা করিয়াছিলাম যে আমাদের দেশবাসী তাহাদের জ্ঞানবুদ্ধি, ইসলাম-প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রতি দরদবোধে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাদ-বিসম্বাদ ভুলিয়া যাইবেন এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে ঐক্যবদ্ধ ঢাকায় সাম্প্রতিক গোলযোগের মত জাতীয় বিপদের প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইবেন। ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুরা সাময়িকভাবে হইলেও কিছুটা সাফল্য লাভ করিয়াছে এবং আমাদের কোমলমতি যুবক ও জনসাধারণের মধ্যে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করিতে পারিয়াছে দেখিয়া আমি দুঃখিত। ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের পিছনে যাহারা আছে তাহাদের কর্মপদ্ধতি ও তাহারা যেভাবে নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, তাহা হইতে অতি সহজেই বুঝা যায় তাহাদের উদ্দেশ্য কি ছিল। জনসাধারণের অনেকেই রাষ্ট্রের দুশমনদের চক্রান্ত বুঝিতে না পারিয়া তাহাদের ফাঁকে পড়িয়াছিলেন বলিয়া আমি মর্মাহত হইয়াছি। আরো বহুদিন পর্যন্ত ইংরেজী ভাষা পাকিস্তানে চালু থাকিতে বাধ্য বলিয়া রাষ্ট্রভাষায় আশু মীমাংসা অত্যাবশ্যকীয় মনে করা হয় নাই। এই অবস্থায় যথা সময়ে স্বাভাবিক অবস্থা বিবর্তনের ভিতর দিয়া এই সমস্যা সমাধান করাই সংগত বিবেচিত হইয়াছিল। আপনারা জানেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আমাদের জাতীয় জীবনে নবীন প্রাণধারা ও নূতন অবস্থার সঞ্চার হইয়াছে এবং ফলে উর্দূ বাংলা উভয় ভাষারই নিত্যপরিবর্তন ঘটিতেছে। উর্দূভাষী ও বাংলাভাষী লোকদের পারস্পরিক মিলনের ফলে দুইটি ভাষার সমৃদ্ধ হইতে এবং এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ব্যবহৃত হইতে থাকায় দুই ভাষাভাষী নাগরিকদের ব্যবধান ক্রমেই দূর হইতেছে। এই জন্যই মরহুম কায়েদে আজম এবং কায়েদে মিল্লাত অযথা তাড়াতাড়ি করিয়া এ সম্পর্কে গণপরিষদের নিকট হইতে কোন সিদ্ধান্ত করানের প্রয়োজন মনে করেন নাই। বাংলাভাষা যথাসময়ে এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হইবে, ইত্যবসরে ইহা স্বীকার করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিভা ও সংস্কৃতির উপযোগী করিয়া তোলার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টাকে সরকার উৎসাহ প্রদান করেন।

 যাহা হউক, গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তৎপ্রতি লক্ষ রাখিয়া আমি ভাষা বিতর্ককে রাজনীতি হইতে পৃথকভাবে বিবেচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং আমার ধারণা অনুযায়ী প্রমাণ করিতে চাই যে ভাষার প্রশ্নটা মোটেই আসল প্রশ্ন নয়, বরং ভাষা বিতর্কের অন্তরালে একটি নিগূঢ় দুরভিসন্ধি রহিয়াছে। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া সরকারকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুর চর এবং দুশমনেরা একটি পরিকল্পনা করিয়াছিল। ২২শে ফেব্রুয়ারী তারিখেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের নিকট সোপারেশ করিয়া আমি ব্যবস্থা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করি। আমার প্রস্তাব পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। যাহারা আইন অমান্যের ষড়যন্ত্র করিয়াছিল ভাষা সমস্যা ছাড়া অন্য কোন বিশেষ মতলব তাহাদের যদি না থাকিত তাহা হইলে এ ব্যবস্থায় তাহারা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইত।

ভীতি প্রদর্শন ও উচ্ছৃঙ্খলতা

 কিন্তু আমি দেখিলাম, যাহারা হাংগামার সূত্রপাত করিয়াছিল তাহারা উক্ত প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার সংগে সংগেই অন্যান্য দাবী উত্থাপন করিতে শুরু করিল। ক্রমে ইহা সবারই নিকট পরিষ্কার হইয়া উঠিল (অবশ্য ইহা শুরু হইতেই সরকারের জানা ছিল) যে, ক্ষমতায় সমাসীন সরকারকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, ভীতি প্রদর্শন ও ষড়যন্ত্র দ্বারা বানচাল করা ব্যতীত হাংগামাকারীদের আর কোন উদ্দেশ্য থাকিতে পারে না। উপরন্তু সরকারকে হিংসাত্মক উপায়ে ধ্বংস করিয়া তৎস্থলে নিজেদের মতলব হাসিলের উপযোগী একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত করিতে চক্রান্তকারীরা চাহিয়াছিল। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, গোলযোগের সময় নারায়ণগঞ্জে একটি শোভাযাত্রায় বিক্ষোভকারীরা খোলাখুলি ‘যুক্ত বাংলা চাই’ বলিয়া ধ্বনি তুলিয়াছিল। দেশ বিভাগের পর এই সর্বপ্রথম অকস্মাৎ তাহারা এইরুপ ধ্বনি উত্থাপন করিতে সাহসী হইল, ইহা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারের নিকট চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনা সংক্রান্ত যেসব তথ্য আছে সেইগুলির সংগে ইহাদের পূর্ণ সামঞ্জস্য রহিয়াছে। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাহারা অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। ইহা সকলেই জানেন যে, তাহারা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণকে ভীতি প্রদর্শন করে এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে দৈহিক নির্যাতনের ভয় দেখাইয়া কিছুসংখ্যক সদস্যকে মুসলিম লীগ পার্টি হইতে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করা হয়। নিজেদের কার্যকলাপের সমর্থনের জন্য স্থানীয় সংবাদপত্রগুলির প্রতিও অনুরুপ ভীতি প্রদর্শন করা হয়। অন্যান্য সংবাদপত্রগুলিকে ভয় দেখাইবার জন্য পরিকল্পনানুযায়ী “মর্নিং নিউজ” পতিকার ছাপাখানা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করা হয়। শাসনব্যবস্থা ব্যাহত করিবার জন্য অনেক সরকারী কর্মচারীকেও অনুরূপভাবে ভয় দেখাইয়া কাজে যোগদানে বিরত করা হয়। হুমকি প্রদর্শন দ্বারা অথবা বলপূর্বক সাধারণ যানবাহন ও দোকান-পাট প্রায় তিনদিন বন্ধ করিতে বাধ্য করা হয়। রেডিও পাকিস্তানের কাজকর্ম বন্ধ করিয়া দেওয়ার চেষ্টা চলে।

 টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা এবং ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। পরিশেষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে বাধ্য হইয়া সরকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বদ্ধপরিকর হন। সুতরাং বিত্তশীল ব্যক্তিগণের নিকট ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রকৃত প্রশ্ন মোটেই ঠিল না, বরং সরকার একদল লোককে দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা বিপন্ন করিতে দিবেন কিনা তাহাই ছিল সত্যিকারের প্রশ্ন। এমতাবস্থায় সরকারের কি করা উচিত ছিল তাহাই বিবেচ্য। এইরূপ হীন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হইয়া পৃথিবীর কোন দায়িত্বশীল সরকার কি ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেন? অতি নগণ্যসংখ্যক লোক জনগণের প্রতিনিধি ব্যবস্থা পরিষদের মুসলিম সদস্যদিগকে ভয় দেখাইয়া বাধ্য করা এবং এইভাবে মুসলিম লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া নিজেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার জন্য চেষ্টায় অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইহা ঘটিতে দিলে আমরা জনসাধারণের নিকট বিশ্বাস ভংগের অপরাধে দোষী হইতাম। যদি দৃঢ়তার সংগে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে জনগণও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের আমরা আপনাদের সামনেও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সামনে নিশ্চয়ই অপরাধী সাব্যস্ত হইতাম। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পতন ঘটান যাইতে পারে। কেবলমাত্র আইনসভার সদস্যগণই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় ভোট দিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিতে পারেন। আইনসভার সদস্যগণ যাহাতে ধীরস্থির ও স্বাধীনভাবে এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত প্রকাশ করিতে পারেন, তাহার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন যেন সর্বপ্রকার ভয়ভীতির বাহিরে থাকয়িা তাহারা কাজ করিতে পারেন। এই রূপ পরিবেশ সৃষ্টি না হইলে গণতান্ত্রিকতার বিলোপ হইয়া উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনই কায়েম হয়। ভয় দেখাইয়া ও উচ্ছৃঙ্খলতার সৃষ্টি করিয়া দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিপন্ন করিবার এই যে ষড়যন্ত্র হইয়াছিল, সরকারের অবলম্বিত ব্যবস্থা ফলে যদিও সাময়িকভাবে সে বিপদের অবসান হইয়াছে তথাপি আমাদের আজাদীর বিরুদ্ধে যে বিপদ দেখা দিয়াছিল এখনও তাহা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় নাই। প্রদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা যেমন করিয়াই হউক আমাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে। আমি আশা করি এই ব্যাপারে সরকার দেশপ্রেমিক সকল পাকিস্তানীরই পূর্ণ সমর্থন পাইবেন। আমি সকল পাকিস্তানীর কাছে আবেদন করিতেছি, সরকারের হাত মজবুত করিতে আগাইয়া আসুন, সমগ্র প্রদেশে আইন ও শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখিতে সরকারকে সাহায্য করুন- দৃষ্কৃতকারীদের আতংক সৃষ্টি, মিথ্যা গুজব প্রচারণা এবং জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির প্রয়াস ব্যর্থ করুন।

ইসলামের আদর্শ

 দেশবাসীর খেদমতে আমার আরও আরজ, আপনারা সীমান্তের ওপারে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন, উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন বর্তমানে আমরা কি সংকটের সম্মুখীন হইয়াছি। শুধু পাকিস্তান নয় বরং ইসলামই আজ নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। আমরা দাবী করিয়া থাকি, জাতিগত, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত ব্যবধান দূর করিয়া ইসলাম একদিন যে স্বর্ণযুগের সূচনা করিয়াছিল, বর্তমানেও ইসলাম তাহা করিতে সক্ষম-যাহার ফলে মানব জাতির জীবনে আসিবে অশেষ সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি। আমরা পাকিস্তানে ইসলামের এই আদর্শই বাস্তবে রূপায়িত করতে চাই। লক্ষ লক্ষ লোকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান হাসিল করিয়াছি শুধুমাত্র ইসলামকে কায়েম রাখিবার জন্যই। বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক অদ্যাবধি ভৌগোলিক বৈচিত্র্যপূর্ণ আমাদের এই পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশকে ইসলাম এক সূত্রে গ্রথিত করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের সংহতি ও সংঘবদ্ধতা শত্রু-মিত্র সকলকেই বিস্মিত করিয়াছে। পাকিস্তান সমগ্র মুসলিম জাহানে নবজীবন আনয়ন করিয়াছে এবং সর্বত্রই ইসলামের এই নবজীবন স্পন্দন অনুভূত হইতেছে। দুনিয়ার নিকট আমাদিগকে প্রতিপন্ন করিতে হইবে যে, যদিও আমাদের পথ প্রদর্শন করার জন্য কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাত আজ আর নাই, তথাপি ইসলাম আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখিয়া আমাদিগকে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করিতে সক্ষম। এই ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বই বেশী। কারণ, এখানে যত মুসলমানের বাস দুনিয়ার আর কোথাও এক জায়গায় এত মুসলমান বাস করে না। সুতরাং বিশ্ব মুসলিমের সংহতি রাখার দায়িত্ব বিশেষভাবে আমাদেরই। মুসলিম জাহানের এই সংকট মুহূর্তে আমরা কি পাকিস্তান ও ইসলামের প্রতি এই গুরুদায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইব? পাকিস্তানের ও মুসলিম জাহানের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে আমরা কোন দিনই পশ্চাৎপদ হইব না।

পাকিস্তান জিন্দাবাদ

(পূর্ব পাকিস্তানের উজীরে আলা জনাব নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতা। ৩রা মার্চ ১৯৫২)[১]

  1. ভাষণটি “মাহে নও"-এর ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, এপ্রিল, ১৯৫২ থেকে উদ্ধৃত।