বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৮৩
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
---|---|---|
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী দিবসে ফজলুল হকের ভাষণ | যুক্তফ্রণ্ট | ১০ই এপ্রিল, ১৯৫৫ |
১০ই এপ্রিল রবিবার
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানের জনসভায়
সভাপতি শেরে বাংলা জনাব এ, কে, ফজলুল হকের ভাষণ
আমার প্রিয় পাকিস্তানী ভাইগণ,
আজ দেশ ও জাতির অতি সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্ত্তে আমি আপনাদিগকে এই “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস” প্রতিপালনে আহ্বান জানাইয়াছি। ইংরাজ শাসনের ১৮২০ সাল হইতে আরাম্ভ করিয়া ১৯৪৬ সাল পযর্ন্ত সোয়া শত বৎসর ধরিয়া পাক-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিকগণ বিভিন্ন আন্দোলনের ভিতর দিয়া যে জীবনাহুতি প্রদান করিয়া আসিয়াছেন তাহারই ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে আমরা আজাদ পাকিস্তান লাভ করিয়াছি। এই আজাদীর সংগ্রামে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক জানমাল কোরবান করিয়া যে ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার স্মরণ করিলে উক্ত ত্যাগী বীরদের জন্য স্বতঃই মস্তক অবনত হইয়া আসে। শাহদত বরণ করিয়া, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়া, কারাবরণ করিয়া এবং যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি বিসর্জন দিয়া আমার লক্ষ লক্ষ দেশবাসী যে আজাদী হাসিল করিয়াছে সেই আজাদীর ফল কি আমরা ভোগ করার সুযোগ পাইয়াছি? কিরূপ আজাদীর জন্য সংগ্রাম করিয়া ঐ সব মনীষীগণ নিজদিগকে কোরবানী কারিয়াছিলেন এবং সেই আজাদী কাহাকে বলে? যাহাতে প্রত্যেকটি মানুষ তাহার জন্মগত গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ করিতে পারে এবং সেই অধিকারের বলে দেশবাসীর জন্য জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনাধিকার প্রাপ্ত হইতে পারে উহারই নাম প্রকৃত আজাদী। আপনারা সকলে সেই আজাদীর জন্যই সংগ্রাম করিয়াছেন, আমরাই সেই আজাদীই চাহিয়াছি। কিন্তু আফসোস আজ পর্য্যন্ত আমরা সেই আজাদীর স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হই নাই। আমাদের আজাদী প্রাপ্তির পর প্রায় ৮ বৎসর উত্তীর্ণ হইয়া চলিল-ইংরাজ জাতির সৃষ্ট ভারত শাসন আইন দ্বারাই আজও আমাদিগকে শাসন করা হইতেছে, আমাদের আজাদ পাকিস্তানের উপযোগী শাসনতন্ত্র আজও আমরা পাই নাই। বিগত ৭ বৎসরের শাসন পাকিস্তানকে প্রায় দেউলিয়া করিয়া ফেলিয়াছে।
অতীতের কথা বেশী ঘাটিয়া লাভ নাই আমি বর্ত্তমান সম্পর্কে এখন আপনাদিগকে কিছু বলিতে চাই। গত বৎসর এই এপ্রিল মাসের ৩রা তারিখে আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভা কায়েম হয় এবং উহার ৫৭ দিন পরই উক্ত মন্ত্রিসভা বাতিল করতঃ গভর্ণর পরিচালিত আমলাতান্ত্রিক শাসন চালু করা হয়। জনসংখ্যার শতকরা সাতানব্বই জনের ভোটে নির্ব্বাচিত আইন পরিষদের সভ্যগণকে সাসপেণ্ড করতঃ আইন সভাকে অকেজো করিয়া রাখা হয়। বহু যুক্তফ্রণ্ট এম,এল,এ-সহ শত শত কর্মীকে নিরাপত্তা আইন বলে গ্রেফতার করিয়া জেলে আটক রাখা হয়, আজও উহাদের অনেকে কারাগারে পচিতেছেন। আমরা জনসাধারণের ভোট লইয়া আসিয়াছি, মানুষ আমাদের দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে, আশা করিয়া রহিয়াছেন আমাদের হাত দিয়া আল্লাহ তাহাদের দুঃখ মোচন করাইবেন। কিন্তু আমরা কোন কাজ করার সুযোগ ও সময়ই পাইলাম না। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনের ফলে পাঞ্জাবে হাজার হাজার লোক মারা যাওয়ার পর দওলতানা মন্ত্রিসভা ডিসমিস করা হইয়াছিল সত্য কিন্তু ৯২ (ক) ধারা জারী করিয়া আইন পরিষদকে অকেজো করিয়া রাখা হয় নাই। কিন্তু আমাদের এই পূর্ব বাংলার বেলায় ঐরূপ অভূতপূর্ব কার্য্য দ্বারা পাকিস্তানের অত্রাঞ্চলের জনগণের মনে ভীষন আঘাত করা হইয়াছে।
যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভা ডিসমিস করিবার পর হইতে আজ পর্যন্ত দশ মাসের বেশী সময় চলিয়া গিয়াছে আমরা এবং আমাদের দেশবাসী তদবধি শামিত্ব পূর্ণমাত্রায় বিরাজ রাখিয়া চলিয়াছি উচ্চপদস্থ সরকারী লোকেরাও এ কথা বহুবার স্বীকার করিয়াছেন। কোথাও কোন গোলমাল বা কোন জরুরী অবস্থা আদৌ দেখা দেয় নাই, তথাপি ৯২ (ক) ধারা শাসনের অবসান হইতেছে না, জনগণের শাসন জনপ্রতিনিধিদের হাতে ফিরাইয়া দেওয়া হইতেছে না। কিছুদিন যাবৎ যুক্তফ্রণ্ট দলের ভিতর বিভেদের অজুহাত দেখাইয়া গণ-শাসনকে দাবাইয়া রাখার প্রচেষ্টা চলিয়াছে। অল্পবিস্তর মতান্তর সব দেশে সব পার্টিতেই থাকে কিন্তু উক্তরূপ মতান্তরের অজুহাতে কোন স্বাধীন দেশে কোনকালে পার্লামেণ্টারী শাসন আটকাইয়া রাখার রীতি নাই। ইউরোপীয় বহু দেশে কোন দলের যথোযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবেই মন্ত্রিসভা পুনঃ পুনঃ ভাঙ্গাগড়া হইয়া থাকে কিন্তু তথাপি ঐ অজুহাতে পার্লামেণ্টারী শাসন হইতে দেশবাসীকে বহির্গত করা হয় না। কোন কোন মহল হইতে সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হইয়ায়ে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট গ্রহণযোগ্য নই বলিয়া এখানে পার্লামেণ্টারী শাসন প্রবর্তন সম্ভব হইতেছে না। এইরূপ অহেতুক উক্তির তাৎপর্য আমি বুঝিতে অক্ষম। কেন্দ্রীয় সরকার বা তাহার নিয়োজিত প্রাদেশিক গভর্ণর যাহাকে আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের আস্থাভাজন বলিয়া মনে করিবেন তাহাকেই আইনানুসারে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আবেদন করিতে পারেন সুতরাং কোন ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য বা কোন ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য নয় ইহা যাচাই করার গভর্ণরের নিকট একমাত্র মাপকাঠি হইতেছে পরিষদ সভ্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি পূর্ব বাংলার সর্ব্বত্র ঘুরিয়া ঘোষণা করিয়াছিলাম। যে যুক্তফ্রণ্ট দলের সভ্যদের ভোট দেওয়া হইলে সেই ভোট আমাকেই দেওয়া হইবে। দেশবাসী আমার সেই আহ্বানে আশাতীত সাড়া দিয়াছিলেন, সুতরাং আমার দেশবাসী আমাকে ত্যাগ না করা পর্য্যন্ত আমি তাহাদিগকে ন্যায়তঃ ও ধর্মতঃ ত্যাগ করিতে পারি না। কিন্তু তাই বলিয়া আমার জন্য পার্লামেণ্টারী শাসন আটকিয়া থাকার কোনই কারণ নাই। প্রাদেশিক গভর্ণর যদি মনে করেন আমাকে ছাড়া অন্য কেহকে দিয়া জনগণের ও পরিষদের গরিষ্ঠসংখ্যক সভ্যদের আস্থাভাজন কোন মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব তিনি বিলক্ষণ তাহা করিতে পারেন। আমি আজ এই প্রকাশ্য সভায় ঘোষণা করিতেছি যে আমি চাই জনগণের আস্থাভাজন পার্লামেণ্টারী শাসন কোন ব্যক্তির জন্য তাহা রহিত হইয়া থাকিতে পারে না কারণ ব্যক্তি চেয়ে দেশ ও জাতি অনেক বড়। যে যুক্তফ্রণ্ট দল শতকরা সাতান্নববইটি ভোট পাইয়া জয়ী হইয়াছে সেই দলকে তথা সাড়ে চারি কোটি পূর্বপাকিস্তান বাসীকে তাহাদের জন্মগত গণতান্ত্রিক শাসনাধীকার হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখার কোন অধিকার কোন সরকারের বা কেহরই নাই।
এতক্ষনে শুধু পার্লামেণ্টারী শাসনের কথা আমি বলিয়াছি এখন উহা হইতেও গুরুতর একটি বিষয়ের কথা আপনাদিগকে বলিব। আপনার জানেন গত বৎসর ২৪শে অক্টোবর তারিখে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল একটি ঘোষণা দ্বারা গণপরিষদ বাতিল করিয়া দিয়া উক্ত ঘোষণায় বলিয়াছিলেন যে জনগণই সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং জনগণের ইচ্ছানুসারেই সব কিছু করা হইবে। সারা দেশের লোক গভর্নর জেনারেলের উপরোক্ত ঘোষণা শুনিয়া বড়ই আশান্বিত হইয়াছিল। গত ১০ই মার্চ্চ তারিখে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে জনাব তমিজদ্দিন খার মামলা পরিচালনার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োজিত কৌসুলি মিঃ ডিমপলক আদালতের নিকট উক্ত সরকারের নির্দ্দেশানুসারে নিবেদন করিয়াছিলেন যে গভর্ণর জেনারেল বর্ত্তমান প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির মাধ্যমে নির্ব্বাচনের সাহায্যে একটি নূতন গণপরিষদ গঠন করিতে ইচ্ছুক রহিয়াছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কতগুলি ঘটনাপ্রবাহের ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন ও আশঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারণ এই যে ইদানীং সরকার সভ্য মনোনয়ন দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র রচনাকারী কমিটি গঠন করিতে চান বলিয়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ পাইয়াছে, আবার এমন কথাও শুনা যাইতেছে যে অর্ডিন্যাসের সাহায্যেও সরাসরি একটি শাসনতন্ত্র জারী করা সম্ভব। এইভাবে জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে যদি কোন শাসনতন্ত্র রচনাকরী কমিটি গঠন করতঃ উহার সাহায্যে বা সরাসরি কোন অর্ডিন্যান্স জারী করিয়া কোন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তাহা হইলে উহা দ্বারা স্বাধীনতার মূলনীতিকেই অস্বীকার করা হইবে এবং উহা কিছুতেই জনগণের গ্রহণযোগ্য হইবে না।
উপরোক্ত দুইটি বিষয়ে বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়া মানুষের জন্মগত নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমি অদ্যকার দিবসটি ঘোষণা করতঃ আমার দেশবাসীকে যথাযথভাবে ইহা প্রতিপালন করিবার অনুরোধ জানাইয়াছি। গভর্ণর জেনারেলের ২৪শে অক্টোবর ঘোষণার ভাষায় চূড়ান্ত ক্ষমতায় অধিকারী আপনারা জনগণই; তাই আপনাদের সমবেত অভিমত জ্ঞাপন উদ্দেশ্যে এই সভার আয়োজন করা হইয়াছে। আপনারা দলমত নির্ব্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়ে সপ্তকোটি কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন গণতন্ত্র বিরোধী কোন কার্য্যকলাপ আমরা এই আজাদ পাকিস্তানে বরদাস্ত করিব না। দেখিবেন আপনাদের সমবেত আওয়াজের ফলে গণতন্ত্র বিরোধী সকল চক্রান্ত ধূলিসাৎ হইয়া যাইবে। মনে রাখিবেন গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বেলুচি, বাঙ্গালী সকলেরই সমান।
যুক্তফ্রণ্টের অন্যতম নেতা মওলানা ভাসানী আজ দেশের বাহিরে। তাঁহার স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন সম্পর্কে সরকারী কোন বাধানিষেধ আছে কিনা তাহা আমার জানা নাই। পাকিস্তানের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তনের সম্পূর্ণ অধিকার মওলানা ভাসানীর রহিয়াছে। প্রকৃতই যদি তাহার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকিয়া থাকে তবে তাঁহার বিচার হইতে পারে কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন সম্পর্কে কোন বাঁধানিষেধ থাকিতে পারে না। ঐরূপ বাঁধা-নিষেধ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমি বহুবার রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানাইয়াছি। আজ পর্যন্ত বহু রাজবন্ধীকে জেলে পচান হইতেছে। ইহার প্রতিবাদ আমি এবং অন্যান্য বহু ব্যক্তি পুনঃ পুনঃ জানাইয়াছি। সরকার আমাদের কথায় কানই দিতেছে না। উপসংহারে আমি পুনরায় আমার দেশবাসীকে আজাদ পাকিস্তানের আজাদ নাগরিক হিসাবে সর্ব্বপ্রকার গণতন্ত্র বিরোধী কার্য্যকলাপের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে আহ্বান জানাইতেছি। আপনারা আজ ওয়াদা করুন এবং সমস্বরে আওয়াজ তুলুন পাকিস্তানের গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্য্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হইব না। আমীন!!
পাকিস্তান জিন্দাবাদ!
যুক্তফ্রণ্ট জিন্দাবাদ!!
গণতন্ত্র জিন্দাবাদ!!!