বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৮৫

শিরোনাম সূত্র তারিখ
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রচারপত্র মাওলানা ভাসানী মে, ১৯৫৫

দেশের ডাক! মুক্তি ডাক!!

পূর্ব-বঙ্গ আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলন

কৃষক-মজদুর, ছাত্র-যুবক, শিল্পী ও ব্যবসায়ী দলে দলে যোগদান করিয়া সুষ্ঠু কর্মসূচী গ্রহণ করুন।
তাং- ২৬শে নভেম্বর, ১০ই অগ্রহায়ণ, শনিবার, কর্মী সম্মেলন
২৭শে নভেম্বর, ১১ অগ্রহায়ন, রবিবার, বিরাট জনসভা

স্থানঃ কাগমারী (টাঙ্গাইল)

 আগামী ১ মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সভা আহবান করিতে হইবে। বর্তমান সরকার ২১ দফা পালন করিতে ধর্ম্মত ও আইনতঃ বাধ্য। বিশ্বাসঘাতকতা করিলে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়িয়া গণ আন্দোলনের ঝড় বহিয়া যাইবে।

 ১। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু সামরিক বিভাগ (নৌ বিভাগের সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে থাকিবে), মুদ্রা প্রস্তুত, বৈদেশিক নীতি (বৈদেশিক বাণিজ্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকিবে); এই ক্ষমতা তিনটি ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা এবং যুক্ত নির্বাচন আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সোপারেশ করিয়া প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ হইতে পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের আসন্ন বৈঠকে প্রস্তাব পাশ করিতে হইবে।

 ২। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে।

 ৩। নূরুল আমিন সরকার ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিবার ব্যবস্থা করিয়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ নামে যে প্রজা উচেছদ আইন করিয়া রাখিয়াছে, সেই আইন বাতিল করিয়া সত্বর আইন সভা আহবান করিয়া বিনা ক্ষতিপুরনে ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আইন পাশ করিতে হইবে। খাজনার হার কম, সার্টিফিকেট প্রথা রহিত, বকেয়া খাজনার সুদ ও নদী সিকস্তি জমির নজরানা মওকুব করিতে হইবে।

 ৪। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি, পাক-বাগদান চুক্তি প্রভৃতি জাতীয় সংহতির পরিপন্থী সাম্রাজ্যবাদী চুক্তি বাতিল করিতে হইবে। গত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত অধিকাংশ পরিষদ সদস্য ওয়াদাবদ্ধ হইয়া সামরিক চুক্তি বাতিলের জন্য যে মর্মে দস্তখত দিয়াছিলেন সেই মর্মে আইন পরিষদে প্রস্তাব পাশ করিতে হইবে।

 ৫। স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের ছাত্রদের বর্তমান বেতনের হার এবং হোষ্টেল খরচ অবিলম্বে হ্রাস করিতে হইবে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন করিতে হইবে।

 ৬। লিকুইডেটেড ও গ্রাম্য সমবায় সমিতিসমূহের খাতক নির্ঘরিত কিস্তিবন্দী মোতাবেক কিস্তির টাকা আদায় করিতে হইবে। ঋণসালিসী বোর্ড কর্তৃক মাফ দেওয়া সুদ (কনট্রিবিউশন) আদায় ও সার্টিফিকেট বন্ধ করিতে হইবে। যাহাদের কিস্তিবন্দী করা হয় নাই তাহাদের জন্য কিস্তি নির্ধারণ করিতেই হইবে।

 ৭। (ক) পাটের মূল্য ন্যূনপক্ষে প্রতিমণ ৩০ টাকা বাঁধিয়া দিতে হইবে। শুধু কয়েকজন ব্যবসায়ীকে পাট বিক্রয়ের লাইসেন্স না দিয়া বহুসংখ্যক ব্যবসায়ী যাহাতে লাইসেন্স পায় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 (খ) পাট জন্মানোর লাইসেন্স ফি ও তামাকের ট্যাক্স রহিত করিতে হইবে।

 (গ) সর্বত্র পাকি (৮০ তোলা) ওজনের প্রবর্তন করিতে হইবে।

 ৮। (ক) বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদানের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে গড়িমসি করা চলিবে না- সত্বর নির্মাণ করিতে হইবে।

 (খ) ২১শে ফেব্রুয়ারীকে কাল বিলম্ব না করিয়া সরকারী ছুটি ঘোষণা করিতে হইবে।

 (গ) বর্দ্ধমান হাউসকে অবিলম্বে বাংলা ভাষার গবেষণাগার করিতে হইবে।

 ৯। (ক) ভিসা প্রথা রহিত করিতে হইবে।

 (খ) সবহারা মোহাজেরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 ১০। ৯২ (ক) ধারার আবরণে ৯৩ ধারা কার্য্যকরী করা চলিবে না। বাংলার যে সমস্ত গণপরিষদ সদস্য ৯৩ ধারা, বেঙ্গল রেগুরেশন এ্যাক্ট ও ফ্রণ্টিয়ার ক্রাইমস আইন পাস করিতে ভোট দিয়াছেন তাহারা সমাজের ও গণতন্ত্রের শত্রু ইহা সবর্বত্র প্রচার করা হইবে।

 ১১। (ক) পাকিস্তান হইবার পর রাস্তাঘাটের অবস্থা অতীব শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে, ইহার আশু সংস্কার চাই।

 (খ) নদী, খাল, বিল ইত্যাদি সংস্কার করিয়া প্রবল বন্যাকে প্রতিরোধ ও সেচের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 (গ) মুসলমানের ওয়াকফ সম্পত্তি ও হিন্দুদের দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর প্রভৃতি সম্পত্তির আয় জনহিতকর কাজে মোটেই ব্যয় হইতেছে না; ইহার প্রতিকার চাই!

 ১২। মাথাভারি শাসন অর্থাৎ গভর্ণর জেনারেল, গভর্ণর, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, কমিশনার ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেতন কম ও পদ লোপ করিয়া নুি বেতনভোগী কর্মচারী ও পুলিশের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে।

 ১৩। শিক্ষিত বেকার, ভূমিহীন কৃষক-মজুরদের জন্য কাজের ব্যবস্থা চাই। রেল, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও শ্রমিকদের ছাঁটাই ও রিভার্সন বন্ধ করিতে হইবে।

 ১৪। বাধ্যতামূলক প্রাইমারী শিক্ষার আইন সত্বর কার্য্যকরী করিতে ও শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাদ্রসা ও কলেজ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করিতে হইবে।

 ১৫। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম অগ্নিমূল্য হওয়ায় চাষী-মজুরদের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই নাই। অতএব লবণ, কেরোসিন তেল, নালী, নারিকেল তেল, হলুদ, মসলা ও লাঙ্গলের ফাল, কোদাল, কাঁচি, পাচন ইত্যাদি তৈয়ার করিবার জন্য লোহা, জমির সার, কাপড়, তাঁতের সুতা, কর্ম্মকারের কাঁসা, পিতল, করাতির করাত, সুতারের হাতুড়ি, বাটাল, রাদা ইত্যাদি যন্ত্রের এবং মাঝিদের জালের সুতা ও ছাত্রদের পুস্তক, কাগজ ও কালির মূল্য কমানোর সত্বর ব্যবস্থা চাই।


 ১৬ (ক) আখচাষীর আখ খরিদের সুব্যবস্থা ও উপযুক্ত মূল্য চাই।

 (খ) তাঁতীদের জন্য বিশেষ সূক্ষ্ম সুতা ও মোটা সুতা আশু সরবরাহের ব্যবস্থা করিয়া তাঁতী সমাজকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিতে হইবে।

১৭। মগ, গাঁজা, ভাং, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারাম কাজ আইন করিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করিতে হইবে।

 ১৮। মুসলমানগণ যাহাতে নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাত ইত্যাদি শরিয়ত সংগত কাজে অবহেলা না করেন এবং সকল শ্রেণীর নাগরিকদের চরিত্র গঠনের জন্য সরকারী প্রচার (তবলীগ) বিভাগ খুলিতে হইবে। হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও অনুরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 ১৯। ঘুষ ও স্বজনপ্রীতিতে দেশবাসী অতিষ্ঠ, সত্বর ইহার স্থায়ী প্রতিকার চাই। শুধু চুনোপুঁটিকে শাস্তি দিলে চলিবে না, বড় বড় রুই-কাতলাকেও কঠোর শাস্তি দিতে হইবে।

 ২০। রেলের তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া কমাইতে হইবে এবং যাত্রীদের জন্য মোছাফেরখানা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 ২১। সামরিক বিভাগে উচ্চ ও নিপদে উপযুক্ত পরিমাণে বাঙ্গালী গ্রহণ করিতে হইবে।

 ২২। গরীব কৃষকদের ঘরদরজা ও নৌকা নির্মাণের জন্য প্রচুর পরিমাণে শাল কাঠ ও টিন সরবরাহ করিতে হইবে।

 ২৩। প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীসংখ্যা ৯ জনের বেশী কিছুতেই রাখা চলিবে না, ডেপুটি মন্ত্রী, পালামেণ্টারী সেক্রেটারী ইত্যাদি ২১ দফার ওয়াদানুযায়ী (মাথা ভারী শাসন মান) মোটেই নিযুক্ত করা চলিবে না।

 ২৪। বর্তমানে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে যে সমস্ত চাউল, ধান, চিনি ইত্যাদি জিনিসপত্র স্বল্প মূল্যে সরকার সরবরাহ করিতেছেন তাহাতে সত্যিকারের গরীব জনসাধারণের উপকার হইতেছে না। বরঞ্চ সরকারের সুষ্ঠু নীতির অভাবে উহাতে চোরাকারবারী ও মোনাফাখোরীদের বৃটিশ ও মুসলিম লীগ আমলের চেয়ে বেশী সুযোগ দেওয়া হইয়াছে। একজন্য সত্বর ইহার প্রতিকারার্থে বিক্রয়ের নির্দিষ্ট দর বাঁধিয়া সুষ্ঠুভাবে সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 বিঃদ্রঃ- কিছু দিনের মধ্যেই গণপরিষদে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাশ হইয়া যাইবে। অতএব, সারাদেশময় আন্দোলন করিয়া যদি ২১ দফা শাসনতন্ত্রে গ্রহণ করাইতে না পারি তাহা হইলে পাকিস্তান ও আমাদের বংশধরগণের সর্বনাশ হইবে। তাই দলে দলে এই সম্মেলনে যোগদান করিয়া ২১-দফাকে বাস্তবে রূপদান করিতে সুষ্ঠু কর্মপন্থা গ্রহণ করিবার জন্য আকুল আবেদন জানাইতেছি।

 *ময়মনসিংহ হইতে মটর বাসে, ঢাকা হইতে লঞ্চ-ষ্টিমারে, সিরাজগঞ্জ ঘাট হইতে লঞ্চ ও নৌকা যোগে যাতায়াত করা যাইবে।

আরজ গোজার
মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী
সভাপতি পূবর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ