বাংলাভাষা-পরিচয়/১৮
১৮
হওয়া, থাকা, আর করা, এই তিন অবস্থাকে প্রকাশ করে ক্রিয়াপদে। আমি ধনী, তুমি পণ্ডিত—এ কথা ইংরেজিতে বলতে গেলে এর সঙ্গে ‘হওয়া’ ক্রিয়াপদ যোগ করতে হয়, বাংলায় সেটা ঊহ্য থাকে।‘রাস্তাটা সোজা’, ‘পুকুরটা গভীর’, যখন বলি তখন সেটাতে তার নিত্য অবস্থা জানায়। কিন্তু ‘বর্ষায় পকুর ঘোলা হয়েছে’— এটা আকস্মিক অবস্থা, তাই হওয়ার কথাটা তুলতে হয়। ওর লোভ হয়েছে, মনে হচ্ছে ওর জ্বর হবে— বাক্যগুলিও এইরকম।
সাবেক বাংলায় বিশেষ্য বা সর্বনাম -শব্দসহযোগে ইংরেজি is ও are -এর অনুরূপ প্রয়োগ পাওয়া যায়: তুমি কে বটো, সে কে বটে, আমি রাজার ঝিয়ারি বটি। অচেতনবাচক শব্দেও চলত, যেমন: ঐ গাছটা কী বটে, এই নদী গঙ্গাই বটে। ‘বটে’ শব্দটা এখনো ভাষায় আছে, বিশেষ ঝোঁক দেবার জন্যে, যেমন: লোকটা ধনী বটে। আবার ভঙ্গীর কাজেও লাগে, যেমন: বটে, চালাকি পেয়েছ! ‘বটে’র সঙ্গে ‘কিন্তু’র যোগ হলে ভঙ্গীটা আরও জমে, যেমন: উনি সর্দারি করেন বটে কিন্তু টের পাবেন। ইংরেজিতে স্বভাব বা অবস্থা বোঝাতে is বা are ব্যতীত বিশেষ্যের গতি নেই, বাংলায় তা নয়। ইংরেজিতে বলাই চাই He is lame. কিন্তু বাংলায় যদি বলি ‘সে খোঁড়া বটে’ তা হলে হয় বোঝাবে, তার খোঁড়া অবস্থাটা একটা বিশেষ আবিষ্কার, নয় ওর সঙ্গে একটা অসংগত ব্যাপারের যোগ আছে। যেমন: ও খোঁড়া বটে কিন্তু দৌড়য় খুব। কিংবা সন্দেহের বিদ্রুপ প্রকাশ করে: তুমি খোঁড়া বটে। অর্থাৎ, খোঁড়া নও যে তা প্রমাণ করতে পারি।
বাংলায় থাকার কথাটা যখন জানাই তখন বলি— আছি বা আছে, ছিলে, ছিল বা ছিলুম। ‘আছিল’ শব্দেরই সংক্ষেপ ‘ছিল’। কিন্তু ভবিষ্যতের বেলায় হয় ‘থাকব’। বাংলায় ক্রিয়াপদের রূপ প্রধানত এই থাকার ভাবকে আশ্রয় করে। করেছে করছে করেছিল করছিল—শব্দগুলো ‘আছি’ ক্রিয়াপদকে ভিত্তি ক’রে স্থিতির অর্থকেই মুখ্য করেছে। সংস্কৃত ভাষায় এটা নেই, গৌড়ীয় ভাষায় আছে। হিন্দিতে বলে ‘চলা থা’, চলেছিল। কাজটা যদিও চলা, তব, থা শব্দে বলা হচ্ছে, চলার অবস্থাতে স্থিতি করেছিল। গতিটা যেন স্থিতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
যে কাজকে নির্দেশ করা হচ্ছে প্রধানত সেই কাজের মূল ধাতুকে দিয়েই ক্রিয়াপদের গড়ন। ‘খা’ ধাতুতে খাওয়া বোঝায়, খাওয়া কাজের সমস্ত ক্রিয়ারূপ এই ধাতুর যোগেই তৈরি। কিন্তু বাংলা ভাষায় অনেক স্থলে কার্যটা ক্রিয়ার রূপ ধরে নি। ক্ষুধা পাওয়া, তৃষ্ণা পাওয়া, প্রতি দিনের ঘটনা; অথচ বাংলায় সেটা ক্রিয়ারূপ নেয় নি, বিশেষ্যের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে বলতে হয়: ক্ষুধা পেল, তৃষ্ণা পেল। হওয়া উচিত ছিল ‘ক্ষধিল’ ‘তৃষিল', কাব্যে এইরকম ক্রিয়ারূপের কোনো বাধা নেই। কিন্তু গদ্যবাংলায় ক্রিয়াপদকে অনেক স্থলে গোটা বিশেষ্যপদের ভার বয়ে বেড়াতে হয়।
বাংলায় দুটো ক্রিয়াপদ জুড়ে ক্রিয়াবিশেষণ গড়ার একটা রীতি আছে। তাতে যে ইঙ্গিতের ভাষা তৈরি হয়েছে তার ভাবপ্রকাশের শক্তি অসাধারণ। সামান্য এই কথাটা ‘রয়ে বসে কাজ করা’ যা বলে তা কোনো বাঁধা সংস্কৃত শব্দে বলাই যায় না। ‘উঠেপ’ড়ে’ ‘উঠেহেঁটে’ কিংবা ‘নেচেকুঁদে’ বেড়ানোতে যে ফুর্তি প্রকাশ পায় সেটার ঠিক উপযুক্ত শব্দ অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের স্বজাতীয় শব্দ: তেড়েফুঁড়ে কেটেছঁটে বেঁচেবর্তে রয়েসয়ে হেসেখেলে। এমন আরও বিস্তর আছে। অনেক স্থলে ঐ জোড়া শব্দের দুটিতে অর্থের সাম্য থাকে না। বস্তুত ওগুলো শব্দযোজনার একরকম খেপামি। ‘বেয়েছেয়ে দেখা’য় যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে বাওয়া এবং ছাওয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। যখন বলি ‘নেড়েচেড়ে দেখতে হবে’ তখন ‘নেড়ে’ শব্দের সহচরটিকে ব্যবহার করা হয় অর্থহীন বাটখারার মতো ওজন ভারি করবার জন্যে। চেয়েচিন্তে কেঁদেকেটে: এরা আছে অনুপ্রাসের গাঁঠ বাঁধার কাজে। এঁটেসেঁটে খেটেখুটে খেয়েদেয়ে ঠেলেঠুলে: এরা ধ্বনির পুনরাবৃত্তিতে মনকে ঠেলে দেবার কাজ করে।
আর-একরকম ক্রিয়াবিশেষণ আছে পদকে দুনো করে দিয়ে। যেমন, ‘জ্বর হবে হবে’ কিংবা ‘জ্বর জ্বর করছে’। মনটা ‘পালাই পালাই’ করে। এর মধ্যে খানিকটা অনিশ্চয়তা অর্থাৎ হওয়ার কাছাকাছি ভাব আছে। ‘লড়াই লড়াই খেলা’ সত্যিকার লড়াই নয় কিন্তু যেন লড়াই। ‘হতে হতে হল না’ অর্থাৎ হতে গিয়ে হল না। এতে যেমন জোর কমায়, আবার কোনো স্থলে জোর বাড়ায়: দেখতে দেখতে জল বেড়ে গেল, হাতে হাতে ফল পাওয়া। সরে সরে যাওয়া, চলে চলে ক্লান্ত, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল, পিছু পিছু চলা, কাছে কাছে থাকা: এই দ্বিত্বে নিরন্তরতার ভাব পাওয়া যায়, কিন্তু একটানা নিরন্তরতা নয়, এর মধ্যে একটা বারংবারত্ব আছে। ‘পাতে-পাতেই মাছের মুড়ো দেওয়া হয়েছে’ বললে মনে হয় সেটা যেন একে একে পরে পরে গণনীয়। ‘পাথরটা পড়ি পড়ি করছে’, কোনো কালেই হয়তো পড়বে না, কিন্তু প্রত্যেক মুহূর্তে বারে বারে তার ভাবখানা পড়বার মতো। ‘আপনি আপনিই তিনি বকে যাচ্ছেন’ বললে কেবল যে স্বগত বকা বোঝায় তা নয়, বোঝায় পুনঃ পুনঃ বকা। এরকম ভাবব্যঞ্জনা কোনো স্পষ্টার্থক বিশেষণের দ্বারা সম্ভব নয়। এ যেন সিনেমায় ছবি নেওয়ার প্রণালীতে পুনঃ পুনঃ অনুভূতির সমষ্টি।
ক্রিয়ার বিশেষণে অর্থহীন ধ্বনি সম্বন্ধে বাংলাশব্দতত্ত্ব বইখানিতে অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি, যেমন: ফস্ ক’রে, চট্ ক’রে, ধপ ক’রে, ধাঁ ক’রে, সোঁ ক’রে, ঢ্যাঁচ্ ক’রে দেওয়া, গ্যাঁট্ হয়ে বসা, ঢিপ্ ক’রে প্রণাম করা। এদের কোনো শব্দই সার্থক নয় অথচ অর্থবান শব্দের চেয়ে এরা স্পষ্ট করে মনে রেখাপাত করে। ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ্দুর, ধু-ধু করছে মাঠ, থই-থই করছে জল: এরা এক আঁচড়ের ছবি।
শারীরিক বেদনাগুলি ইংরেজি ভাষায় অর্থবান শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়, যেমন: throbbing, cutting, gnawing, pricking ইত্যাদি। এরকম দৈহিক উপলব্ধির ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বাংলাভাষায় নেই। বাংলার আছে ধ্বনি: দব্দব্ ঝন্ঝন্, টন্টন্ কন্কন্ কুটকুট্ কর্কর্ তিড়িক্তিড়িক্ ঘিন্ঘিন্ ঝিম্ঝিম, সুড়্সুড়ে্ সির্সির। এই ধ্বনিগুলির সঙ্গে অনুভূতির কোনোই শব্দগত সাদৃশ্য নেই, তবু এই নিরর্থক শব্দগুলির দ্বারা অনুভূতির যেমন স্পষ্ট ধারণা হয় এমন আর কিছুতেই হতে পারে না।
বাংলা ক্রিয়াপদে আর-এক বিশেষত্ব আছে দুটো ক্রিয়ার জোড় দেওয়া, তাদের মধ্যে অর্থের সংগতি না থাকলেও, যেমন: হয়ে যাওয়া, হয়ে পড়া, হতে থাকা, হয়ে ওঠা; করে যাওয়া, করে ফেলা, করে তোলা, করে দেওয়া, করে চলা, করে ওঠা, করতে থাকা। হয়ে পড়া, করে ফেলা-র ভাবটা একই; একটা অক্রিয়, একটা সক্রিয়। আর-একরকম আছে বিশেষ্যের সঙ্গে ক্রিয়ার কিংবা দুই ক্রিয়ার অসংগত যোগ, যেমন: মার খাওয়া, উঠে পড়া, গাল দেওয়া, বসে যাওয়া, ঘুরে মরা, গিয়ে পড়া, খেয়ে বাঁচা, নেড়ে দেওয়া।