বাংলাভাষা-পরিচয়/১৯
১৯
ক্রিয়াপদে দু রকমের অনুজ্ঞা আছে। এক, উপস্থিত ব্যক্তিকে অননুরোধ বা আদেশ করা। আর, উপস্থিত বা অনুপস্থিত কারও সম্বন্ধে ইচ্ছা প্রকাশ করা, যেমন ‘ও করুক’।
হোক যাক চলুক বা করুক প্রভৃতি শব্দগুলিতে ক প্রত্যয় পুরোনো ভাষায় সর্বত্র প্রচলিত ছিল না, যথা: জাউ, মন্দ পবন বহু উদিত হউ চন্দা, মউরগণ নাদ করু।
পূর্বেই বলেছি বাংলাভাষার প্রধান লক্ষণ, তার ভঙ্গীর প্রাবল্য। উপরোক্ত শ্রেণীর ক্রিয়াপদে একটা অনর্থক ‘গে’ শব্দের যোগে যে ইঙ্গিত প্রকাশ করা হয় সেটা সহজ শব্দের দ্বারা হয় না, যথা: হোকগে করুকগে মরুকগে। এতে ঔদাসীন্যে ও ক্ষোভে জড়িয়ে যে ভাবটা ব্যক্ত করে সেটা অন্য ভাষায় সহজে বলা যায় না। কেননা গে শব্দের কোনো অর্থ নেই, ওটা একটা মুদ্রা। ‘হোকগে’ শব্দের ইংরেজি তর্জমা করতে হলে বলতে হয়: Let it happen, I don’t care. ওর সঙ্গে ‘তুমিও যেমন’ যদি যোগ করা যায় তা হলে ভঙ্গিমা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ইংরেজি বাক্যে হয়তো এর কাছাকাছি যায়: Oh let it be, don’t bother. মোটের উপর এই শব্দভঙ্গীর ভাবখানা এই যে, যা হচ্ছে বা করা হচ্ছে সেটা ভালো নয়, সেটা ক্ষতিকর, বা অপ্রিয়, কিন্তু তবু ওটাকে গ্রাহ্য করার দরকার নেই। ‘মরুকগে’ শব্দে এই ভাষাভঙ্গী খুবই স্পষ্ট হয়েছে। এই ছোট্ট বাংলা শব্দটির ইংরেজি প্রতিবাক্য: Hang it, let it go to the dogs.
ইংরেজিতে সাধারণ ব্যবহারের ক্রিয়াপদ অনুজ্ঞায় প্রায়ই এক মাত্রার হয়, যেমন, run, stop, cut, beat, shoot, march, hold, throw. যেখানে যুগ্ম ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয় সেখানে এক মাত্রায় দুটি শব্দ জোড়া লাগে, যেমন: come in, go out, cut down, stand up, run on ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এইরুপ সংক্ষিপ্ত শব্দে আজ্ঞার জোর পৌঁছয়। স্কাউটের বা ফৌজের কুচকাওয়াজে ইংরেজিতে যে-সব আদেশবাক্য আছে এই কারণে সেগুলো জোরালো হয়। যে-সকল শব্দ ব্যঞ্জনবর্ণে শেষ হয় তারা ধাক্কা দেয় জোরে। stand up শব্দ উভয়ে মিলে দুই মাত্রার বটে কিন্তু তাতে দুই ব্যঞ্জনবর্ণের দুটো ঠোকর আছে।
‘দাঁড়াও’ শব্দটাও দুই মাত্রার, কিন্তু তার আগাগোড়া স্বরবর্ণ, তাদের স্পর্শ মোলায়েম। কথাটা ধাঁ করে ছোটে না।
‘তুই’ ‘তোরা’ বর্গের অনুজ্ঞায় এই দুর্বলতা নেই। বোস্ ওঠ্ ছোট্ থাম্ কাট্ মার্ ধর্ খেল্: এগুলি দৌড়দার শব্দ। আদিকালে ভাষায় ‘তু’ ‘তুই’ ছিল একমাত্র মধ্যমপুরুষের সর্বনাম শব্দ। সেটা যদি চলে আসত তা হলে ক্রিয়াপদকে স্বরবর্ণ এমন নরম করে রাখত না, হসন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে তাকে তীক্ষ্ণতা দিত। ‘করো’ হ’ত ‘কর্’। ‘কোরো’ হ’ত ‘করিস’। ‘দাঁড়া’ শব্দ যদিও স্বরবর্ণ বহন করে তবু ‘দাঁড়াও’ শব্দের চেয়ে তার মধ্যে প্রভুশক্তি বেশি। ‘ঘুমো’ আর ‘ঘুমোও’ তুলনা করলে অনুজ্ঞার দিক থেকে প্রথমোক্তটির প্রবলতা মানতে হয়।
চলতি বাংলা ভঙ্গীপ্রধান ভাষা, তার একটা লক্ষণ, ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞায় অসংগত ভাবে ‘না’ শব্দের ব্যবহার। এর কাজ হচ্ছে আদেশ বা অনুরোধকে অনুনয়ে নরম করে আনা।
‘হোক না’ ‘করোই না’ ক্রিয়াপদে ‘না’ শব্দে নির্বন্ধ প্রকাশ পায়, কোনো-এক পক্ষের অনিচ্ছাকে যেন ঠেলে দেওয়া। ‘না’ শব্দের দ্বারা ‘হাঁ’ প্রকাশ করা আর প্রথমপুরুষ-বাচক ‘আপনি’কে মধ্যমপুরুষের অর্থে ব্যবহার একই মনস্তত্ত্বমূলক। যিনি উপস্থিত আছেন যেন তিনি উপস্থিত নেই, তাঁর সঙ্গে মোকাবিলায় কথা বলার স্পর্ধা বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়, এই ভাণের দ্বারাই তাঁর উপস্থিতির মূল্য যায় বেড়ে। তেমনি অনুরোধ জানানোর পরক্ষণেই ‘না’ বলে তার প্রতিবাদ ক’রে অনুরোধের মধ্যে সম্মানের কাকুতি এনে দেওয়া হয়। ‘না’ শব্দের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলাভাষার আর-একটি বিশেষত্ব, যথা: আমি নই, তুমি নও, সে নয়, তিনি নন; আমি নেই, তুমি নেই, সে নেই, তিনি নেই; হই নে, হও না, হয় না, হন না, হয় নি, হন নি।
বাংলা ক্রিয়াপদে নানারকম শব্দ-যোজনায় নানারকম ভঙ্গী। তার কতকগুলি সার্থক, কতকগুলি নিরর্থক। ক্রিয়াপদে এতরকম ইশারা বোধ হয় আর-কোনো ভাষায় নেই।
পড়ল-বা, করলে-বা, শব্দে আশঙ্কার সূচনা। কোনো ক্রিয়াবিশেষণ-যোগে এর ভাবটা প্রকাশ হতে পারত না।এতে যদি ইকার যোগ করা যায় তাতে আর-একরকম ভঙ্গী এসে পড়ে। হলই-বা, করলই-বা: এর ভঙ্গীতে সুরের বৈচিত্র্য অনুসারে ক্ষমাও বোঝাতে পারে, স্পর্ধাও বোঝাতে পারে, উপেক্ষাও বোঝাতে পারে।
হল বুঝি, করল বুঝি, হল ব’লে, করল ব’লে: আসন্ন অপ্রিয়তার আশঙ্কা।
হল যে, করল যে: উদ্বেগ।
হল তো, করলে তো: অপ্রত্যাশিতের সম্বন্ধে বিস্ময়।
আবার ওকেই প্রশ্নের সুরে বদলিয়ে যদি বলা হয় ‘হল তো?’ তা হলে জানানো হয়: এখন তো আর কোনো নালিশ রইল না?
হোক-না, করুক-না, হোক্গে, করুক্গে, মরুক্গে: ঔদাসীন্য।
হলই-বা, করলই-বা, নাই-বা হল, না-হয় হল: স্পর্ধার ভাষা।
হবে-বা, হবেও-বা: দ্বিধা এবং স্বীকার মিশিয়ে।
হবেই হবে, করবেই করবে: সুনিশ্চিত প্রত্যাশা।
করতেই হবে, হতেই হবে, করাই চাই, হওয়াই চাই: ইচ্ছার জোর প্রয়োগ।
হলেই হল: অর্থাৎ হয় যদি তবে আর-কোনো তর্কের দরকার নেই।
হোকগে ছাই, মরুগকে ছাই: প্রবল ঔদাস্য।