২০

 অব্যয়। বাংলা ভাষায় প্রশ্নসসূচক অব্যয় সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করেছি।

 প্রশ্নসূচক ‘কি’ শব্দের অনুরূপ আর-একটি ‘কি’ আছে, তাকে দীর্ঘস্বর দিয়ে লেখাই কর্তব্য। এ অব্যয় নয়, এ সর্বনাম। এ তার প্রকৃত অর্থের প্রয়োজন সেরে মাঝে মাঝে খোঁচা দেবার কাজে লাগে, যেমন: কী তোমার ছিরি, কী-যে তোমার বুদ্ধি।

 তিনটি আছে যোজক অব্যয় শব্দ: এবং, আর, ও। ‘এবং’ সংস্কৃত শব্দ। এর প্রকৃত অর্থ ‘এইমতো’। ইংরেজি and শব্দের অর্থে কতদিন এর ব্যবহার চলেছে জানি নে। পুরোনো কাব্যসাহিত্যে ‘এবং’ শব্দের দেখা পাই নি। আধুনিক কাব্যসাহিত্যেও এর ব্যবহার নেই বললেই হয়। খাঁটি বাংলা যোজক শব্দ ‘আর’, হিন্দি ‘ঔর’। সংস্কৃত ‘অপর’ শব্দ থেকে এর উদ্ভব। ‘এবং’ শব্দ তার অর্থের অসংগতি সত্ত্বেও পুরাতন ‘আর’কে সাধু ভাষা থেকে প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে। তাড়ানো সহজ হয়েছে তার প্রধান কারণ, স্বাভাবিক বাংলায় দ্বন্দ্বসমাসেই যোজকের কাজ সারা হয়ে থাকে। আমরা বলি হাতিঘোড়া লোকলস্কর নিয়ে রাজা চলেছেন। আমরা বলি: চৌকিটেবিল আয়না-আলমারিতে ঘর ঠাসা। ইংরেজিতে উভয় স্থলেই একটা and না বসিয়ে চলে না, যথা: The king marches with his elephants, horses and soldiers. The room is full of chairs, tables, clothes-racks and almirahs.

 বাংলায় যদি বলি ‘রাস্তা দিয়ে চলেছে হাতি আর ঘোড়া’, তা হলে বোঝাবে বিশেষ করে ওরাই চলেছে।

 ‘আর’শব্দের আরও কয়েকটি কাজ আছে, যেমন: আর কত খাবে: অর্থাৎ অতিরিক্ত আরও কত খাবে। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না: অর্থাৎ পনশ্চ দেখা হবে না।

 তোমাকে আর চালাকি করতে হবে না: এ একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। এই শব্দ থেকে ‘আর’ শব্দটা বাদ দিলেও চলে, কিন্তু তাতে ঝাঁজ মরে যায়।

 সাহিত্যে ‘ও’ শব্দটা ‘এবং’ শব্দের সমান পর্যায়ে চলেছে। কিন্তু চলতি ভাষায় ‘ও’ সংস্কৃত ‘চ’এর মতো, যথা: আমি যাচ্ছি তুমিও যাবে, অ্যাঙ যায় ব্যাঙ যায় খল‍্সে বলে আমিও যাব।

 এক কালে এই ‘ও’ ছিল ‘হ’ র‍ূপে, যেমন: সেহ, এহ বাহ্য, এহ তো মানুষ নয়। এই হ অবিকৃত রূপে বাকি আছে সাধ, ভাষায় ‘কেহ’ শব্দে। চলতি ভাষায় ‘কেও’ থেকে ক্রমে ‘কেউ’ হয়েছে। পুরাতন সাহিত্যে ‘কেহ‍ু’ পাওয়া যায়, ‘তেঁহ’ শব্দটা আজ হয়েছে ‘তিনি’। ‘ওহ’ নেই কিন্তু সাধু ভাষায় ‘উহা’ আছে। ‘যেহ’ নেই, আছে ‘যাহা’। এই শেষ দুটি বিশেষণ অপ্রাণী সম্পর্কে।

 যোজক ‘ও’র উৎপত্তি ফার্সি ঊঅ (অন্ত্যস্থ ব) শব্দ থেকে, সুতরাং and’-এর প্রতিশব্দরূপে এর ব্যবহার অবৈধ নয়। কিন্তু তবু ভাষায় ভালো করে মিশ খায় নি। তুমি ও আমি একসঙ্গেই যাব: এ খাঁটি বাংলা নয়। আমরা সহজে বলি: তুমি আমি একসঙ্গেই যাব। কেউ কেউ মনে করেন ‘অপি’ থেকে ‘ও’ হয়েছে, কিন্তু স্বরবিকারের নিয়ম অনুসারে সেটা সম্ভব কি না সন্দেহ করি।

 রাজাও চলেছে সন্ন্যাসীও চলেছে: এ খাঁটি বাংলা। কিন্তু ‘রাজা ও সন্ন্যাসী চলেছে’ কানে ঠিক লাগে না। সে এগোয়ও না পিছোয়ও না: ‘ও’ শব্দের এই যথার্থ ব্যবহার। সে এগোয় না ও পিছোয় না: এ বাক্যটা দুর্বল।

 তুমিও যেমন, হবেও-বা: এ-সব জায়গায় ‘ও’ ভাষাভঙ্গীর সহায়তা করে।

 দেখা যায় ‘এবং’ শব্দটাকে দিয়ে আমরা অনেক স্থানে and শব্দের অনুকরণ করাই। He has a party of enemies and they vilify him in the newspapers. এ বাক্যটা ইংরেজি মতে শ‍ুদ্ধ, কিন্তু আমরা যখন ওরই তর্জমা করে বলি ‘তাঁর একদল শত্রু আছে এবং ওরা খবরের কাগজে তাঁর নিন্দে করে’, তখন বোঝা উচিত এটা বাংলারীতি নয়। আমরা এখানে ‘এবং’ বাদ দিই। He has enemies and they are subsidised by the government. এই বাক্যটা তর্জমা করবার সময় ফস্ করে বলা অসম্ভব নয় যে: তাঁর শত্রু আছে এবং তারা সরকারের বেতনভোগী। কিন্তু ওটা ঠিক হবে না, ‘এবং’ পরিত্যাগ করতে হবে। বাক্যের এক অংশে ‘থাকা’, আর-এক অংশে ‘হওয়া’; এদের মাঝখানে ‘এবং’ মধ্যস্থতা করবার অধিকার রাখে না। তিনি হচ্ছেন পাকা জোচ্চোর, এবং তিনি নোট জাল করেন: ইংরেজিতে চলে, বাংলায় চলে না।

 ‘সে দরিদ্র এবং সে মূর্খ’ এ চলে, ‘সে চরকা কাটে. এবং ধান ভেনে খায়’ এও চলে। কারণ প্রথম বাক্যের দুই অংশই অস্তিত্ববাচক, শেষ বাক্যের দুই অংশই কর্তৃত্ববাচক। কিন্তু ‘সে দরিদ্র এবং সে ধান ভেনে খায়’ এ ভালো বাংলা নয়। আমরা বলি: সে দরিদ্র, ধান ভেনে খায়। ইংরেজিতে অনায়াসে বলা চলে: She is poor and lives by husking rice.

 প্রয়োগবিশেষে ‘যে’ সর্বনামশব্দ ধরে অব্যয়র‍ূপ, যেমন: হরি যে গেল না। ‘যে’ শব্দ ‘গেল না’ ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করে দিল। তিনি বললেন যে, আজই তাঁকে যেতে হবে: ‘তাঁকে যেতে হবে’ বাক্যটাকে ‘যে’ শব্দ যেন ঘের দিয়ে স্বতন্ত্র করে দিলে। শুধু উক্তি নয় ঘটনাবিশেষকেও নির্দিষ্ট করা তার কাজ, যেমন: মধু যে রোজ বিকেলে বেড়াতে যায় আমি জানতুম না। মধু বিকেলে বেড়াতে যায়, এই ব্যাপারটা ‘যে’ শব্দের দ্বারা চিহ্নিত হল।

 আর-একটা অব্যয় শব্দ আছে ‘ই’। ‘ও’ শব্দটা মিলন জানায়, ‘ই’ শব্দ জানায় স্বাতন্ত্র্য। ‘তুমিও যাবে’, অর্থাৎ মিলিত হয়ে যাবে। ‘তুমিই যাবে’, অর্থাৎ একলা যাবে। ‘সে যাবেই ঠিক করেছে', অর্থাৎ তার যাওয়াটাই একান্ত। ‘ও’ দেয় জুড়ে ‘ই’ ছিঁড়ে আনে।

 বক্রোক্তির কাজেও ‘ই’কে লাগানো হয়েছে: কী কাণ্ডই করলে, কী বাঁদরামিই শিখেছ। ‘কী শোভাই হয়েছে’ ভালোভাবে বলা চলে, কিন্তু মন্দভাবে বলা আরও চলে। এর সঙ্গে ‘টা’ জুড়ে দিলে তীক্ষ্ণতা আরও বাড়ে, যেমন: কী ঠকানটাই ঠকিয়েছে। আমরা সোজা ভাষায় প্রশংসা করে থাকি: কী চমৎকার, কী সুন্দর। ওর সঙ্গে একটু-আধটু ভঙ্গিমা জুড়ে দিলেই হয়ে দাঁড়ায় বিদ্রূপ।

 ‘তা’ শব্দটা কোথাও সর্বনাম কোথাও অব্যয়। তুমি যে না বলে যাবে তা হবে না: এখানে না বলে যাওয়ার প্রতিনিধি হচ্ছে তা, অতএব ‘সর্বনাম’। তা, তুমি বরং গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো: এই ‘তা’ অব্যয় এবং অর্থহীন, না থাকলেও চলে। তব, মনে হয় একটুখানি ঠেলা দেবার জন্যে যেন প্রয়োজন আছে। তা, এক কাজ করলে হয়: একটা বিশেষ কাজের দিকটা ধরিয়ে দিল ঐ ‘তা’।

 ‘বুঝি’, সহজ অর্থ ‘বোধ করি’। অথচ বাংলা ভাষায় ‘বুঝি’ ‘বোধ করি’ ‘বোধ হচ্ছে’ বললে সংশয়যুক্ত অনুমান বোঝায়: লোকটা বুঝি কালা, তুমি বুঝি কলকাতায় যাবে। ‘তুমি কি যাবে’ এই বাক্যে ‘কি’ অব্যয়ে সস্পষ্ট প্রশ্ন। কিন্তু ‘তুমি বুঝি যাবে’ এই প্রশ্নে যাবে কি না সন্দেহ করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় ‘বুঝি’ শব্দে বুঝি ভাবটাকে অনিশ্চিত করে রাখে। বুঝির সঙ্গে ‘বা’ জুড়ে দিলে তাতে অনুমানের সুরটা আরও প্রবল হয়।

 যদি, যদি-বা, যদিই-বা, যদিও-বা। যদি অন্যায় কর শাস্তি পাবে: এটা একটা সাধারণ বাক্য। যদি-বা অন্যায় ক’রে থাকি: এর মধ্যে একটু ফাঁক আছে, অর্থাৎ না করার সম্ভাবনা নেই-যে তা নয়। যদিই-বা অন্যায় করে থাকি: অন্যায় করাটা নিশ্চিত বলে ধরে নিলেও আরও কিছ, বলবার আছে। যদিও-বা অন্যায় করে থাকি: অন্যায় সত্ত্বেও স্পর্ধা আছে মনে।

 ‘তো’ অব্যয়শব্দে অনেক স্থলে ‘তবু’ বোঝায়, যেমন: বেলায় এলে তো খেলে না কেন। কিন্তু, তুমি তো বলেই খালাস, সে তো হেসেই অজ্ঞান, আমি তো ভালো মনে করেই তাকে ডেকেছিলাম, তুমি তো বেশ লোক, সে তো মস্ত পণ্ডিত— এ-সব স্থলে ‘তো’ শব্দে একটু ভর্ৎসনার বা বিস্ময়ের আভাস লাগে, যথা: তুমি তো গেলে না, সে তো বসেই রইল, তবে তো দেখছি মাটি হল।

 ‘গো’ শব্দের প্রয়োগ সম্বোধনে ‘তুমি’ বর্গের মানুষ সম্বন্ধে, ‘তুই’ বা ‘আপনি’ বর্গের নয়: কেন গো, মশায় গো, কী গো, ওগো শনে যাও, হাঁ গো তোমার হল কী। সংস্কৃত ‘ভোঃ’ শব্দের মতো এর বহুল ব্যবহার নেই। হাঁ গো, না গো: মুখের কথায় চলে; মেয়েদের মুখেই বেশি। ভয় কিংবা ঘৃণা -প্রকাশে ‘মা গো’। ‘বাবা গো’ শব্দ ভয়-প্রকাশে। ‘শোনো’ শব্দের প্রতি ‘গো’ যোগ দিয়ে অনুরোধে মিনতির সুর লাগানো যায়। ‘কী গো’ ‘কেন গো’ শব্দে বিদ্রূপ চলে: কেন গো, এত রাগ কেন; কেন গো, তোমার যে দেখি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল; কী গো, এত রাগ কেন গো মশায়; কী গো, হল কী তোমার। ভয় বা দঃখ -প্রকাশে মেয়েদের মুখে ‘কী হবে গো’, কিংবা অননুনয়ে ‘একা ফেলে যেয়ো না গো’। ‘হাঁগা’ ‘কেনে গা’ গ্রাম্য ভাষায়।

 শ‍ুধু ‘হে’ শব্দ আহ্বান অর্থে সাহিত্যেই আছে। মুখের কথায় চলে ‘ওহে’। কিংবা প্রশ্নের ভাবে: কে হে, কেন হে, কী হে। অনুজ্ঞায় ‘চলো হে’। মাননীয়দের সম্বন্ধে এই ‘ওহে’র ব্যবহার নেই। ‘তুমি’ ‘তোমার’ সঙ্গেই এর চল, ‘আপনি’ বা ‘তুই’ শব্দের সঙ্গে নয়।

 ‘রে’ শব্দ অসম্মানে কিংবা স্নেহপ্রকাশে: হাঁ রে, কেন রে, ওরে বেটা ভূত, ওরে হতভাগা, ওরে সর্বনেশে। এর সম্বন্ধ ‘তুই’ ‘তোরা’র সঙ্গে।

 ‘লো’ ‘লা’ মেয়েদের মুখের সম্বোধন। এও ‘তুই’ শব্দের যোগে। ভদ্রমহল থেকে ক্রমশ এর চলন গেছে উঠে।

 অব্যয় শব্দ আরও অনেক আছে, কিন্তু এইখানেই শেষ করা যাক।