বাংলা শব্দতত্ত্ব/পরিশিষ্ট/প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ: বিদ্যাপতি

‘প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ’

বিদ্যাপতি

বিদ্যাপতির ন্যায় অমন একজন লোকপ্রিয় কবির পদসমূহ একত্রে পুস্তকাকারে সংগৃহীত হইল,[] তাহার টীকা, অর্থ, পাঠ-বিভেদ ও (স্থানে স্থানে) ব্যাকরণের সূত্র বাহির হইল, তথাপি তাহা লইয়া একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল না, ইহা কেবল বাংলাদেশের জলবাতাসের গুণে। সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁহার যথাসাধ্য যে কথার যেরূপ অর্থ করিয়াছেন, যে শ্লোকের যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, পাঠকেরা কি একবার মনোযোগ করিয়া দেখিবেন না, যে, তাহা ব্যাকরণ-শুদ্ধ হইল কি না, সুকল্পনা-সংগত হইল কি না? সে বিষয়ে কি একেবারে মতভেদ হইতেই পারে না? পাঠকেরা কি সম্পাদকবর্গকে একেবারে অভ্রান্ত দেবতা বলিয়া জ্ঞান করেন, অথবা তাঁহাদের দেশের প্রাচীন— আদি কবিদের প্রতি তাঁহাদের এতই অনুরাগের অভাব, এতই অনাদর যে, তাঁহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার দেয় স্বরূপে যৎসামান্য শ্রম স্বীকার করিতেও পারেন না? বঙ্গভাষা যাঁহাদের নিকট নিজের অস্তিত্বের জন্য ঋণী, এমন-সকল পূজনীয় প্রাচীন কবিদিগের কবিতা-সকলের প্রতি যে-সে যেরূপ ব্যবহারই করুক-না, আমরা কি নিশ্চেষ্ট হইয়া চাহিয়া থাকিব? তাহারা কি আমাদের আদরের সামগ্রী নহে? যিনি এই-সকল কবিতার সম্পাদকতা করিতে চান তিনি নিজের স্কন্ধে একটি গুরুতর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতি পদে সাধারণের নিকটে হিসাব দিবার জন্য তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে পাঠক সাধারণ নিশ্চেষ্ট, নিরীহ-প্রকৃতি, এবং সম্পাদকবর্গও নিজের দম্ভ পাকাইয়া পাকাইয়া একটা অপরিমিত উচ্চ আসন প্রস্তুত করিয়া তুলেন; সেখান হইতে পাঠক বলিয়া যে অতি ক্ষুদ্র-কায়া একদল প্রাণী কখনো কখনো তাঁহাদের নজরে পড়ে, তাহাদের জন্য অধিক ভাবনা করা তাঁহাৱা আবশ্যক মনে করেন না। কবিদিগের কাব্য যিনি সংগ্রহ করেন, তাঁহার সংগ্রহের মধ্যে যদি অসাবধানতা, অবহেলা, অমনোযোগ লক্ষিত হয়, তবে তাঁহার বিরুদ্ধে আমরা অত্যন্ত গুরুতর তিনটি নালিশ আনিতে পারি― প্রথমত, কবিদের প্রতি তিনি অন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন; দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের সহিত তিনি যে চুক্তি করিয়াছিলেন, সে চুক্তি রীতিমত পালন করেন নাই; তৃতীয়ত, পাঠকসাধারণকে তিনি অপমান করিয়াছেন। তিনি তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, অথচ যথাযোগ্য আয়োজন করেন নাই; যথারীতি সম্ভাষণ করেন নাই; এতই কি তাহারা উপেক্ষার পাত্র? “অক্ষরের ভুল হইল হইলই, তাহাতে এমনি কী আসে যায়? অর্থবোধ হইতেছে না? একটা আন্দাজ করিয়া দেও না, কে অনুসন্ধান করিয়া দেখে?” পাঠকদের প্রতি এরূপ ব্যবহার কি সাহিত্যআচারের বিরুদ্ধ নহে?

 শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতি-রচিত পদাবলী পুস্তকাকারে সংগ্রহ করিয়াছেন, অপ্রচলিত শব্দের ও দুরূহ শ্লোকের অর্থ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আমাদের সাহিত্যে এরূপ উদ্যোগ সম্প্রতি আরম্ভ হইয়াছে; অতএব এই উদ্যোগীদের আমরা নিরুৎসাহ করিতে চাহি না; ইহাদের চেষ্টা সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়। কেবল আমরা যথাসময়ে ইহাদের সাবধান করিয়া দিতে চাই। আধুনিক বঙ্গীয় পাঠকগণকে নিশ্চেষ্ট জানিয়া ইঁহারা যেন নিজ কাজে শৈথিল্য না করেন। ইঁহাদের পরিশ্রম ও উদ্যমের পুরস্কার হাতে হাতে যদি-বা না পান বঙ্গ-সাহিত্যকে ইঁহারা ঋণী করিয়া রাখিবেন, ও একদিন-না-একদিন সে ঋণ পরিশোধ হইবেই।

 “যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি, কোহত্র দোষ” সে কথা সত্য বটে; কিন্তু আমাদের আলোচ্য পুস্তকের সম্পাদক নিরলস হইয়া যথাসাধ্য যত্ন করিয়াছেন কি না আমাদের সন্দেহ। রসেটি শেলীর কবিতাসমূহের যে সংস্করণ মুদ্রিত করিয়াছেন, তাহাতে তিনি প্রতি কমা ও সেমিকোলনের উপর মাথা ঘুরাইয়াছেন; ইহাতে কবির প্রতি তাঁহার অসাধারণ অনুরাগ ও সাধারণের সমীপে তাঁহার কর্তব্য পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু এরূপ তুলনা বৃথা। কোনো বিষয়েই যাহাদের সহিত মিলে না, একটা বিশেষ বিষয়ে তাহাদের সহিত তুলনা দিতে যাওয়ার অর্থ নাই। বঙ্গদেশ ইংলণ্ড নহে, এবং সকল লোকই রসেটি নহে।

 শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রাচীন কবিতা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, এজন্য তাঁহাকে উৎসাহ দিয়া তাঁহার কৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা সমূহ লইয়া আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, এরূপ না করিলে কবিতা-সকলের যথার্থ মর্ম বাহির হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। এ বিষয়ে তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা উত্থাপন করা আবশ্যক।

 প্রাচীন কবিতাবলীর টীকা প্রকাশের নানাবিধ দোষ থাকিতে পারে। ১. ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ অর্থ ব্যাখ্যা; ২. সুভাব-বিরুদ্ধ ব্যাখ্যা; ৩. সহজ শ্লোকের প্যাঁচালো অর্থ ব্যাখ্যা; ৪. দুরূহ শ্লোক দেখিয়া মৌন থাকা; ৫. সংশয়ের স্থলে নিঃসংশয় ভাব দেখানো; ইত্যাদি। এই-সকল দোষ যদি বর্তমান পুস্তকে থাকে, তবে তাহা সংশোধন করিয়া দেওয়া আমাদের কর্তব্য কার্য। বিদ্যাপতির পদাবলীর মধ্যে, ঈষৎ হউক, বা অধিক হউক, দুরূহ শ্লোক দেখিলে পাঠকদের সুবিধার জন্য আমরা তাহার অর্থ করিতে চেষ্টা করিব।

 পুস্তকে নিবিষ্ট প্রথম গীতিতে কবি রাধিকার শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তী অবস্থার কথা বর্ণনা করিয়াছেন।

নিরজন উরজ হেরই কত বেরি।
হাসত আপন পয়োধর হেরি।
পহিল বদরি সম পুন নবরঙ্গ।
দিনে দিনে অনঙ্গ উঘারয়ে অঙ্গ। পৃ. ২

 সম্পাদক ইহার শেষ দুই চরণের এইরূপ টীকা করিতেছেন; “প্রথম বর্ষার মতো নূতন নূতন ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতে লাগিল। বদরি (হিন্দি) বর্ষা। নবরঙ্গ শব্দে নারাঙ্গালেবু অভিধানে থাকিলে এই চরণের অন্যরূপ অর্থ হয়। কিন্তু বদরি শব্দের বর্ষা অর্থও সুপ্রসিদ্ধ নহে।” “বর্ষার মতো ভাবভঙ্গী প্রকাশ করা” শুনিলেই কেমন কানে লাগে যে, অর্থটা টানাবোনা। নবরঙ্গ শব্দে নারাঙ্গালেবু অভিধানে থাকিলে কিরূপ অর্থ হয় তাহাও দেখা উচিত ছিল। “প্রথম বর্ষার মতো ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতে লাগিল” এরূপ অর্থ করিলে পুন শব্দের সার্থকতা কী থাকে? যাহা হউক, এ স্থানের অর্থ অতিশয় সহজ, কেবল উপরে উদ্ধৃত চারি চরণের মধ্যে শেষের দুই চরণকে প্রথম দুই চরণের সহিত পৃথক করিয়া পড়াতেই ইহার অর্থবোধে গোল পড়ে। নিম্নলিখিত অর্থটি সহজ বলিয়া বোধ হয়। “রাধা নির্জনে কতবার আপনার উরজ দেখেন, আপনার পয়োধর দেখিয়া হাসেন। সে পয়োধর কিরূপ? না, প্রথমে বদরির (কুল) ন্যায় ও পরে নারাঙ্গার ন্যায়।” নবরঙ্গ শব্দের অর্থ নারাঙ্গা অভিধানে নাই। ‘নাগরঙ্গ’ ও ‘নার্য্যঙ্গ’ শব্দ নারাঙ্গা বলিয়া উক্ত হইয়াছে। কিন্তু নবরঙ্গ শব্দের অর্থ নারাঙ্গা, সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। বিদ্যাপতির আরএকটি পদ হইতে এই একই ভাবের দুইটি চরণ উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি, তাহাতে আমাদের কথা আরো স্পষ্ট হইবে।

পহিল বদরী কুচ পুন নবরঙ্গ।
দিনে দিনে বাঢ়য়ে, পীড়য়ে অনঙ্গ। পৃ. ২২০

 ৩-সংখ্যক পদে সম্পাদক

খেলত না খেলত লোক দেখি লাজ।
হেরত না হেরত সহচরী মাঝ। পৃ. ৩

 এই দুই চরণের অর্থ করিতেছেন: “খেলার সময় হউক বা না হউক লোক দেখিলে লজ্জিত হয় ও সহচরীগণের মধ্যে থাকিয়া একবার দৃষ্টি করে ও তখনি অপর দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে।” “খেলত না খেলত” এবং “হেরত না হেরত” উভয়ের একই রূপ অর্থ হওয়াই সংগত বোধ হয়; উভয়ের বিভিন্ন অর্থ মনে লয় না। “খেলত না খেলত” অর্থে সম্পাদক কহিতেছেন “খেলার সময় হউক বা না হউক” অর্থাৎ খেলে বা না খেলে; তাহা যদি হয় তবে “হেরত না হেরত” শব্দের অর্থ “দেখে বা না দেখে” হওয়াই উচিত; কিন্তু তাহা হইলে কোনো অর্থই হয় না। ইহার অর্থ নিম্নলিখিত রূপ হওয়াই উচিত; খেলে, খেলে না; লোক দেখিয়া লজ্জা হয়। সহচরীদের মধ্যে থাকিয়া দেখে, দেখে না।” অর্থাৎ খেলিতে খেলিতে খেলে না; দেখিতে দেখিতে দেখে না ইহাই ব্যাকরণ-সম্মত ও অর্থ-সংগত।

নয়ন নলিনী দউ অঞ্জনে রঞ্জিত
ভাঙবি ভঙ্গি-বিলাস।   সং ৭, পৃ. ৮

 সম্পাদক “ভাঙবি’ শব্দের অর্থ “প্রকাশ করিতেছে” লিখিয়াছেন। তিনি কহেন “ভাঙ[] বিভঙ্গি-বিলাস এই পাঠ সংগত বোধ হয় না। ব্যাকরণ ধরিতে

গেলে ‘ভাঙবি’ শব্দের অর্থ ‘প্রকাশ করিতেছে’ কোনমতেই হয় না। ‘বি’ অন্ত ধাতু কোনমতেই বর্তমান কাল-বাচক হইতে পারে না। বিদ্যাপতির সমস্ত পদাবলীর মধ্যে কোথাও এমনতর দেখা যায় না। ‘ভাঙবি’ অর্থে ‘তুই প্রকাশ করিবি’ হয়, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তা থাকিলে ‘সে প্রকাশ করিবে’ও হয়, কিন্তু বর্তমান কাল-বাচক ক্রিয়ায় ‘বি’ যােগ বিদ্যাপতির কোনাে পদেই দৃষ্ট হয় না। এমন স্থলে ‘ভাঙ বিভঙ্গি বিলাস’ পাঠ কী কারণে অসংগত বুঝিতে পারা যায় না। রাধিকার নয়ন-নলিনীদ্বয় অঞ্জনে রঞ্জিত, এবং তাহার ভ্রূ বিভঙ্গি-বিলাস। অর্থাৎ বিভঙ্গিতেই তাহার ভ্রূর বিলাস। এ অর্থ আমাদের নিকট বেশ সুসংগত বােধ হইতেছে।

অলখিতে মােহে হেরি বিহসিতে থােরি।
জনু বয়ান বিরাজে চান্দ উজোরি।
কুটিল কটাক্ষ ছটা পড়ি গেল।
মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল।  সং ৯, পৃ. ১০

 সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ এইরূপ করিয়াছেন: ‘কুটিল কটাক্ষের শােভায় চারি দিক এমন শোভিত হইল যেন মধুকর ডামরে (মৌমাছির ঝাঁকে) আকাশ (অম্বর) আচ্ছন্ন হইল। ‘যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন, এবং ‘আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি— ‘অলখিত ভাবে আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করাতে তাহার মুখ উজ্জ্বল চাঁদের ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিল। মুখ যদি চাঁদ হইল, কটাক্ষ সে চাঁদের ছটা স্বরূপ হইয়া পতিত হইতে লাগিল এবং মধুকরের ঝাঁক সে চাঁদের অম্বর অর্থাৎ আকাশ হইল। রাধার মুখের গন্ধে এত মধুকর আকৃষ্ট হইয়াছিল।’ এই গীতেরই মধ্যে মধুপের কথা পুনশ্চ উল্লেখ করা হইয়াছে; যথা—

লীলাকমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি।
চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি। পৃ.১১

 অর্থাৎ ‘লীলাকমলের দ্বারা ভ্রমরকে কিবা নিবারণ করিয়া, চকিতে চাহিয়া চমকিয়া ধনী চলিল।’ ইহাতে কুমারসম্ভবের তৃতীয় সর্গে গৌরীর বর্ণনা মনে পড়ে—

অমর ভূষিত হয়ে নিশ্বাস সৌরভে
বিম্ব অধরের কাছে বেড়ায় ঘুরিয়া,

চঞ্চল নয়ন পাতে উষা প্রতিক্ষণ
লীলা-শতদল নাড়ি দিতেছেন বাধা।

 আমরা ‘লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি’ ইত্যাদি দুই চরণের যে অর্থ করিলাম সম্পাদকের টীকার সহিত তাহার ঐক্য হয় না। তাহাতে আছে— ‘লীলা-কমলে স্থিত ভ্রমর বা বারিবিন্দুর ন্যায় চঞ্চল নয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া চলিল।’ এ অর্থ যে অসংগত, তাহা মনোযোগ করিয়া দেখিলেই প্রতীতি হইবে—

লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি।
চমকি চললু ধনি চকিতে নেহারি।

 ‘লীলা-কমল’ ও ‘চকিতে নেহারি’ এতদূর; এবং মাঝে ‘চমকি চললু ধনি’ এমন একটা ব্যবধান স্বরূপে পড়িয়াছে যে উহাকে একত্র করিতে গেলে অনেক টানাটানি করিতে হয় ও ‘ন্যায়’ নামক একটা যোজক পদার্থ ঘর হইতে তৈরি করিয়া আনিতে হয়। আমরা যে অর্থ দিয়াছি তাহা ইহা অপেক্ষা সহজ। ‘বারি’ শব্দের অর্থ নিবারণ করা অপ্রচলিত নহে। যথা—

‘পুর-রমণীগণ রাখল বারি।’ সং ১২৩, পৃ. ১০৩

 অর্থাৎ পুর-রমণীগণ নিবারণ করিয়া রাখিল।

 ১১-সংখ্যক গীতে সম্পাদক,

‘একে তনু গোরা, কনক-কটোরা
অতনু, কাঁচলা-উপাম।’

 এই দুই চরণের অর্থ করিতে পারেন নাই। তিনি কহিয়াছেন, ‘এই চরণের অর্থগ্রহ হইল না।’ আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি— ‘তনু গৌরবর্ণ; কনক কটোরা[] (অর্থাৎ স্তন) অতনু অর্থাৎ বৃহৎ, এবং কাঁচলা-উপাম, অর্থাৎ ঠিক কাঁচলির মাপে।[]

যব গােধূলি সময় বেলি,
ধনি মন্দির বাহির ভেলি,
নব জলধরে বিজুরি-রেখা দ্বন্দ পসারিয়া গেলি।

সং ১৬, পৃ. ১৭

 সম্পাদক টীকা করিতেছেন: ‘বিদ্যুৎ রেখার সহিত দ্বন্দ্ব (বিবাদ) বিস্তার করিয়া গেল। অর্থাৎ তাহার সমান বা অধিক লাবণ্যময়ী হইল।’ ‘সহিত’ শব্দটি সম্পাদক কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন? ইহার সহজ অর্থ এই—‘রাধা গােধূলির ঈষৎ অন্ধকারে মন্দিরের বাহির হইলেন; যেন নব জলধরে বিদ্যুৎ রেখা দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল।’ ইহাই ব্যাকরণশুদ্ধ ও সুভাব-সংগত অর্থ।

 সম্পাদক ২০-সংখ্যক গীতের কোনাে অর্থ দেন নাই। আমাদের মতে তাহার ব্যাখ্যা আবশ্যক। সে গীতটি এই—

এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ।
শুনইতে মানবি স্বপন স্বরূপ।
কমল যুগলপর চাঁদকি মাল।
তাপর উপজল তরুণ তমাল।
তাপর বেড়ল বিজুরী লতা।
কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা।
শাখাশিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহে নব পল্লব অরুণক ভাতি।
বিমল বিম্বফল যুগল বিকাশ।
তাপর কির থির করু বাস।
তাপর চঞ্চল খঞ্জন যােড়।
তাপর সাপিনী ঝাঁপল মােড়। পৃ. ২১

 ইহাতে কৃষ্ণের শরীরের বর্ণনা হইতেছে। ‘নখ চন্দ্রমালা শােভিত-পদকমলদ্বয়ের উপরে তরুণ তমালবৎ কৃষ্ণের শরীর উঠিয়াছে। পীতাম্বর বিদ্যুতে তাঁহাকে বেড়িয়াছে।[] সে তমাল তরুর শাখাশিখর, অর্থাৎ মুখ, সুধাকর। লাবণ্যই বােধ করি অরুণ ভাতির পল্লব। ওষ্ঠাধর বিম্বফল। তাহার উপর কিরণ অর্থাৎ হাস্য স্থির বাস করে। নেত্র খঞ্জন। কুন্তল, সাপিনী।’

 অন্ধকার রাত্রে রাধিকা অভিসার উদ্দেশে বাহির হইয়াছেন, কৃষ্ণ বিঘ্ন আশঙ্কা করিতেছেন।

গগন সঘন, মহী পঙ্কা;
বিঘিনি বিথারিত উপজয়ে শঙ্কা
দশদিশ ঘন আন্ধিয়ারা;
চলইতে খলই, লখই নাহি পারা।
সব যোনি পালটি ভুললি
আওত মানবি ভানত লোলি।

সং ৩৪, পৃ. ৩৪

 সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ নিম্নলিখিতরূপে করিতেছেন: ‘শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার অনুপস্থিতিতেও তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন ‘লোলে, (লোলি) তুমি যদি (নিরাপদে) উপস্থিত হও (আওত) তাহা হইলে আমি মনে মনে করিব (মানবি) যে, সকল জীবকে (যোনি) দৃষ্টিপাত দ্বারা (পালটি) তোমার প্রভায় নত করিয়া (ভানত) ভুলাইয়াছে (ভুললি)।’ এইরূপ অর্থ কষ্টসাধ্য সন্দেহ নাই, কিন্তু আমরা অন্য কোনো সুলভ অর্থ বা পাঠ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না।’ সম্পাদক স্বীকার করিয়াছেন উপরি-উদ্‌ধৃত অর্থটি কষ্টসাধ্য। আমরা কহিতেছি, উহা ব্যাকরণ-সংগতও নহে। ‘ভুললি’ অর্থে ‘ভুলাইয়াছ’ হয় না, উহার অর্থ ভুলিলি, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তার সহিত যুক্ত হইলে, ভুলিল। ‘মানবি’ শব্দের অর্থ ‘মনে করিব’ নহে, ‘মনে করিবি’ হইতে পারে; বিশেষত উহার কর্তা স্ত্রীলিঙ্গ নহে। আমরা উপরি-উক্ত দুই চরণের এইরূপ অর্থ করি: আওত মানবী, ভানত লোলি। ভানত[] অর্থাৎ ভাবের দ্বারা লোলা, চঞ্চলা মানবী আসিতেছেন। সব যোনি পালটি ভুললি। সকল প্রাণীকে দেখিতে ভুলিলেন। এত অধীরা যে, কাহারো প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে পারিতেছেন না।’

রাধিকা শ্যামকে ভর্ৎসনা করিয়া দূতী পাঠাইতেছেন। দূতীকে কহিতেছেন;

যো পুন সহচরি, হোয় মতিমান্।
করয়ে পিশুন-বচন অবধান।

সং ৭০, পৃ. ৬

 সম্পাদক টীকা করিতেছেন ‘কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ করেন!’ এ টীকার টীকা কে করিবে? অনেক অনেক মতিমান্ দেখিয়াছি, তাঁহারা কাকের কথায় কিছুমাত্র মনোযোগ দেন না। টীকাকার মহাশয় নিজে কী করেন? যাহা হউক, এমন মতিমান্ যদি কেহ থাকেন যিনি কেবলমাত্র কাকের কথাতেই মনঃসংযোেগ না করেন, এক-আধবার আমাদের কথাও তাঁহার কানে পৌছায়, তবে তিনি অনুগ্রহ করিয়া এ রহস্য কি আমাদের বুঝাইয়া দিবেন? বলা বাহুল্য, ইহার অর্থ— ‘যাঁহারা মতিমান্ তাঁহারা পিশুন-বচন অর্থাৎ নিন্দাবাক্যও অবধান করেন।’

 রাধিকা অভিমানভরে কহিতেছেন;

‘কুজনক পীরিতি মরণ-অধীন।’ সং ৮৫, পৃ. ৭৪

 এই অতি সহজ চরণটির টীকায় সম্পাদক কহেন— ‘কুজনের সহিত প্রীতি করিয়া এক্ষণে মরণের বশতাপন্ন হইলাম অথবা কুজনের প্রেম মরণাপেক্ষাও মন্দ।’ এত কথা সম্পাদক কোথায় পাইলেন? ইহার অতি সহজ


 ‘কুজনের প্রীতি মরণের অধীন, অর্থাৎ অধিক দিন বাঁচে না।’

 পুস্তকের এক এক স্থান এমন দুর্বোধ যে, আমাদের সন্দেহ হয়, যে, হয় মূলের হস্তলিপিতে নয় ছাপিতে ছাপার ভুল হইয়া থাকিবে। একটা দৃষ্টান্ত দিই,

হরিণী জানয়ে ভাল কুটুম্ব বিবাদ,
তবহুঁ ব্যাধক গীত শুনিতে করু সাধ।

সং ৮৬ পৃ. ৭৫

 সম্পাদক ইহার টীকা দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই। কিন্তু আমরা ইহার অর্থ খুঁজিয়া পাই না। ইহার ঠিক অর্থ এই— ‘হরিণী কুটুম্ব-বিবাদ উত্তম রূপ জানে তথাপি ব্যাধের গান শুনিতে তাহার সাধ।’ এখানে ‘কুটুম্ব-বিবাদ’ কথাটার কেন ব্যবহার হইল, তাহা কি পাঠকেরা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন? আমাদের বোধ হয় যে, উহা ‘কুটিল নিষাদ’ হইবে। অথবা কূট (অর্থাৎ ফাঁদ) শব্দজ একটা কিছু শব্দ ছিল, তাহাই ভ্রমক্রমে ‘কুটুম্ব’ শব্দে পরিণত হইয়াছে, এবং ‘বিবাদ’ শব্দ বোধ করি, ‘নিষাদ’ হইবে। আর-একটি অক্ষরভুলের উদাহরণ তুলিয়া দিই—

হরি যদি ফেরি পুছসি ধনি তোয়।
ইঙ্গিতে নিবেদন জানাওবি সোয়।
যব চিতে দেখবি বড় অনুরাগ।
তৈখনে জানয়বি হৃদয়ে জনু লাগ।

সং ৯১, পৃ. ৭৮

 বিরহিণী রাধিকা কৃষ্ণের নিকট দূতী পাঠাইতেছেন। পাছে অপমান হইতে হয় এইজন্য প্রথমে ইঙ্গিতে কৃষ্ণের মনের ভাব বুঝিতে দূতীকে অনুরোধ করিতেছেন। রাধিকার ইচ্ছা, তাঁহার প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগ লক্ষিত হইলে তবেই যেন মুখ ফুটিয়া সমস্ত নিবেদন করা হয়। সমস্ত গীতটির এই ভাব। উপরি-উদ্‌ধৃত শ্লোকের চতুর্থ চরণটি বুঝা যায় না। কিন্তু ‘জানয়বি’ শব্দ যদি ‘জানাওবি’ হয় তবে এইরূপ অর্থ হয়— যখনি চিত্তে বড়ো অনুরাগ দেখিবি, তখনি জানাবি; হৃদয়ে যাহাতে লাগে। অর্থাৎ সেই সময় জানাইলেই হৃদয়ে লাগিবে।

 রাধিকা ছল করিয়া সখীদের কহিতেছেন— কাল ঘুমাইয়াছিলাম, এমন সময় এক পুরুষ আসিলেন, তাঁহার অরুণ আঁখি ও লোহিত অধর দেখিয়া ভয়ে আমার কেশপাশ বিশৃঙ্খল হইয়া গেল, কপালে কাজল ও মুখে সিন্দুর লাগিল।

এক পুরুখ পুন আওল আগে।
কোপে অরুণ আঁখি অধরক রাগে।
সে ভয়ে চিকুর চির (চীর?) আনহি গেল।
কপালে কাজর মুখে সিন্দুর তেল।

সং ১০৯, পৃ. ৯৩

 সম্পাদক টীকা করিতেছেন সেই ভয়ে চিকুর (বিদ্যুৎ) চির (দীর্ঘকালের জন্য) অন্যত্র গমন করিল। এ টীকার কি কোনো অর্থ আছে? কোনো কথা নাই, বার্তা নাই, এমন সময় সহসা বিনামেঘে একটা বিদ্যুৎ খেলাইয়া যাইবে কেন, আমরা ভাবিয়া পাই না। চিকুর অর্থে কেশ। রাধিকা বলিতেছেন, সেই পুরুষের ভয়ে তাঁহার চিকুর ও চীর অন্যত্র গেল; এবং বেশভূষার বিপর্যয় হইল।[]

হিম হিমকর-কর তাপে তাপায়লু
ভৈগেল কাল বসন্ত।
কান্ত কাক মুখে নাহি সম্বাদই
কিয়ে করু মদন দুরন্ত।

সং ১২৮, পৃ. ২০৬

 শীতল চন্দ্রের কিরণও আমাকে তাপিত করিল, বসন্ত আমার কাল হইল। কান্ত কাহারাে মুখে সংবাদ লইলেন না, দুরন্ত মদন কী যে করিতেছে। সম্পাদক টীকা করিয়াছেন ‘কান্ত কাকমুখেও সংবাদ পাঠাইলেন না, আমি এই দুরন্ত মদনে কি করিব?’ কাকের সহিত সম্পাদকের বিশেষ সখ্য দেখা যাইতেছে। তিনি কাককে প্রেমের দূত এবং মতিমান্ লােকদের মন্ত্রী বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কাকের বরঞ্চ বুদ্ধিমান বলিয়া একটা খ্যাতি আছে, কিন্তু প্রেমিক বলিয়া তাহার যশ আজ পর্যন্ত শুনা যায় নাই। হিন্দুস্থানীতে ‘ক’ বিভক্তি ষষ্ঠীতে ব্যবহার হয়, অতএব ‘কাক’ শব্দের অর্থ কাহার।

মাধব অবলা পেখনু মতিহীনা।
সারঙ্গ শবদে মদন স কোপিত
তেঞ দিনে দিনে অতি ক্ষীণা।

সং ১৪৯, পৃ. ১২৪

 টাকা উদ্‌ধৃত করি। ‘সারঙ্গ শবদে—হরিণের শব্দ শুনিলে’ হরিণের শব্দ শুনিলেও মদন প্রকুপিত হন মদনের এমন স্বভাব কোনাে শাস্ত্রে লেখে না। সারঙ্গ শব্দের অর্থ যখন ভ্রমর হয়, কোকিল হয়, মেঘ হয়, ময়ুর হয়, তখন মদনকে রাগাইবার জন্য হরিণকে ডাকিবার আবশ্যক?

দক্ষি পবন বহে কৈছে যুবতী সহে,
তাহে দুখ দেই অনঙ্গ।
গেলনুঁ পারাণ আশা দেই রাখই
দশ নখে লিখই ভুজঙ্গ।

 সম্পাদক কহিতেছেন—‘ইহার সম্যক অর্থগ্রহ হয় না।’ চতুর্থ চরণটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য সন্দেহ নাই। ইহার অর্থ এমন হইতে পারে যে, ‘শিবের ভূষণ ভুজঙ্গকে মদন বিশেষরূপে ডরান, এই নিমিত্ত বিরহিণী নখে ভুজঙ্গ আঁকিয়া তাহাকে ভয় দেখাইয়া প্রাণকে আশা দিয়া রাখিতেছেন।’ রাধিকার পক্ষে ইহা নিতান্ত অসম্ভব নহে, কারণ ইতিপূর্বে তিনি রাহু আঁকিয়া বিরহিণীর ভীতিস্বরূপ চাঁদকে ভয় দেখাইতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন।

 কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করিয়া গেলে পর দূতী তাঁহার নিকটে গিয়া ব্রজবিরহিণীদের দুরবস্থা নিবেদন করিতেছেন।

তােহারি মুরলী সাে দিগে ছােড়লি
ঝামরু ঝামরু দেহা।
জনু সে সােনারে কোষিক পাথরে
ভেজল কনক-রেহা।

সং ১৬১, পৃ ১৩৩

 সম্পাদক প্রথম দুই চরণের অর্থ স্থির করিতে পারেন নাই। ইহার অর্থ‘তােমার মুরলী তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিল (ছােড়লি; স্ত্রীলিঙ্গেই) তাহাদের দেহ শীর্ণ মলিন হইয়া আইল। ঝম শব্দের অর্থ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে পরে কহিব।

বড় অপরূপ দেখিনু সজনি
নয়লি কুঞ্জের মাঝে।
ইন্দ্রনীল মণি কেতকে জড়িত
হিয়ার উপরে সাজে।

 সম্পাদক ‘কেতক’ শব্দের অর্থ নির্মলী বৃক্ষ স্থির করিয়া বলিয়াছেন, ‘কিরূপ উপমা হইল বুঝিতে পারিলাম না।’ কেতক শব্দে কেয়া ফুল বুঝিতে বাধা কি? রাধা শ্যাম একত্র রহিয়াছেন যেন কেয়াফুলে ইন্দ্রনীল মণি জড়িত রহিয়াছে।

 পুস্তকের মধ্যে ছােটো ছােটো অনেকগুলি অসাবধানতা লক্ষিত হয়। তাহার কতকগুলি দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করা আবশ্যক। আমাদের মতে এরূপ প্রাচীন কবিতাসমূহ সংগ্রহ করিতে গেলে নিতান্ত সাবধানতার সহিত যথাসম্ভব নিখুঁত করিয়া তােলা উচিত, তিল পরিমাণ দোষ না থাকে যেন।

 ‘কিয়ে’ শব্দের অর্থ ‘কি’। কি শব্দ বাংলায় অনেক অর্থে ব্যবহার হয়। জিজ্ঞাসার স্থলে, আশ্চর্যের স্থলে, যেমন― কি সুন্দর! এবং কিংবা অর্থেও প্রয়োগ হইয়া থাকে। প্রাচীন কবিতাতেও ‘কিয়ে’ শব্দের ঐ কয়টি অর্থ। সম্পাদক মহাশয় স্থানে স্থানে উলটাপালটা করিয়া একটার জায়গায় আর একটা বসাইয়াছেন। দেখিলাম তিনি জিজ্ঞাসাসূচক ‘কি’ শব্দের উপর নিতান্ত নারাজ।

লোচন জনু থির ভৃঙ্গ আকার,
মধুমাতল কিয়ে উড়ই না পার?  সং ৩, পৃ. ৪

 অর্থাৎ, তাঁহার লোচন স্থিরভৃঙ্গের ন্যায়; মধুমত্ত হইয়া সে কি উড়িতে পারিতেছে না? সম্পাদক কহেন ‘যেন মধুমত্ত হইয়া উড়িতে অক্ষম।’

দারুণ বঙ্ক বিলোকন থোর
কাল হোই কিয়ে উপজল মোর?

 নিদারুণ ঈষৎ বঙ্কিম দৃষ্টি কি আমার কাল হইয়াই উৎপন্ন হইল? সম্পাদক কহেন ‘কি বা আমার কালস্বরূপ হইয়া উপস্থিত হইল!’ ইহা অত্যন্ত হাস্যজনক।

চিকুরে গলয়ে জলধারা
মুখশশি ভয়ে কিয়ে রোয়ে আন্ধিয়ারা?

 এখানে ‘মুখশশির ভয়ে আঁধার কি বা রোদন করিতেছে!’ অর্থ করা অপেক্ষা ‘মুখশশির ভয়ে কি আঁধার রোদন করিতেছে?’ বলিলেই কানে ভালো শুনায়।

 সম্পাদক ‘কহসি’ শব্দের এইরূপ টীকা করিয়াছেন—‘কহে (সি সংস্কৃত বিভক্তি)।’ এ কেমন কথা বুঝিতে পারিলাম না। ‘কহে’ তৃতীয় পুরুষ, কিন্তু সংস্কৃতে দ্বিতীয় পুরুষ নহিলে ‘সি’ বিভক্তি হয় না। সম্পাদক এত স্থলে সি-অন্ত ধাতুর ভ্রমাত্মক অর্থ দিয়াছেন যে, উদ্‌ধৃত করিতে প্রবন্ধের কলেবর বাড়িয়া যায়।

চলইতে চাহি চরণ নাহি যাব।  সং ৮, পৃ. ১০

 সম্পাদক ‘যাব’ শব্দের অর্থ বিশেষ করিয়া ‘যায়’ বলিয়া লিখিয়াছেন। ইহা ভবিষ্যৎকাল-বাচক-ক্রিয়া, ইহার অর্থ ‘যায়’ হইতে পারে না। ইহার অর্থ ‘চলিতে চাহিতেছে তথাপি পা চলিবে না।’

 ‘ঝামর’ শব্দে সম্পাদক মেঘ কহিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত পুস্তকের মধ্যে কোথাও ঝামর শব্দ মেঘ অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই; অথচ পদাবলীর মধ্যে পঞ্চাশ জায়গায় মেঘের উল্লেখ আছে।

কহ সখি সাঙরি ঝামরি দেহা।
এবে ভেল বিপরীত, ঝামর দেহা।
পুনমিক চাঁদ টুটি পড়ল জনু
ঝামর চম্পক দামে।
তােহারি মুরলী সােদিগে ছােড়লি
ঝামরু ঝামরু দেহা।
কুবলয়-নীল বরণ তনু সাঙরি
ঝামরি, পিউ পিউ ভাষ।

সং ৫৪, পৃ. ৫০
সং ১৪৭, পৃ. ১২৩

সং ১৪৯, পৃ. ১২৪

সং ১৬১, পৃ. ১৩৩

সং ২১৪, পৃ. ১৭৭





 সর্বত্রই ঝামর অর্থ শুষ্ক মলিন শব্দে উক্ত হইয়াছে। এক স্থলে শ্যামের কেশ বর্ণনায় ঝামর শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, সে স্থলে তাহার অর্থ কৃষ্ণবর্ণ হইতে পারে। সম্পাদক যদি এই পুস্তক ব্যতীত অন্য কোনাে সূত্রে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়া থাকেন যে, ঝামর অর্থে মেঘ, তাহা হইলে আমাদের আর অধিক বক্তব্য থাকে না।

‘আশ নিগড় করি জীউ কত রাখব
অবহ যে করত পয়াণ!’

 সম্পাদক ‘নিগড়’ অর্থে ‘গড়বন্দী করা’ লিখিয়াছেন। সকলেই জানেন নিগড় অর্থ শৃঙ্খল। যাহা হউক, এরূপ ভুল তেমন মারাত্মক নহে; যাঁহারা সংস্কৃত জানেন তাঁহাদের ইহাতে হানি হইবে না।

 সমস্ত পুস্তকের মধ্যে এত অসাবধানতা, এত ভ্রম লক্ষিত হয়, যে, কিয়দ্দূর পাঠ করিয়াই সম্পাদকের প্রতি বিশ্বাস চলিয়া যায়। ইহার সমস্ত ভ্রম যে কেবল সম্পাদকের অক্ষমতা বশত ঘটিয়াছে তাহা নহে, ইহার অনেকগুলি তাঁহার অসাবধানতা বশত ঘটিয়াছে। এমন-কি, স্থানে স্থানে তিনি অভিধান খুলিয়া অর্থ দেখিবার পরিশ্রমটুকুও স্বীকার করেন নাই। এত অবহেলা এত আলস্য যেখানে, সেখানে এ কাজের ভার গ্রহণ না করিলেই ভালাে হইত। আমাদের দেশে পাঠকেরা তেমন কড়াক্কড় নহেন বলিয়া তাঁহাদিগকে বিপথে চালন করিয়া লইয়া যাওয়া নিতান্ত অনুচিত। সম্পাদকের প্রশংসনীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাঁহাকে যে এত কথা বলিলাম, তাহার কারণ বিদ্যাপতির কবিতা আমাদের অতি প্রিয় সামগ্রী, এবং পাঠকসাধারণকে আমরা উপেক্ষণীয় মনে করি না। আমরা এই প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহের উদ্যোগকে উৎসাহ দিই। আমাদের ইচ্ছা, কোনো নিরলস, উৎসাহী ও কাব্যপ্রিয় সম্পাদক পুনশ্চ এই কার্যের ভার গ্রহণ করেন। শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতির উপরেই প্রথম হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত তাহাতে যে-সকল ভ্রম আছে তাহা অনেকটা মার্জনা করা যায়; এখন আশা করি, এ বিষয়ে তাঁহার হাত অনেকটা পাকিয়া আসিয়াছে; অতএব অধিকতর মনোযোগ সহকারে এই দেশহিতকর কার্য তিনি যেন সুচারুতর রূপে সম্পন্ন করিতে পারেন, এই আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা।

 শ্রাবণ ১২৮৮

উত্তর-প্রত্যুত্তর

উত্তর। বিগত শ্রাবণের ভারতীতে লিখিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ বিষয়ক প্রস্তাব পাঠ করিলাম। পাঠান্তে মনোমধ্যে হর্ষ ও বিষাদ উভয়ই উদয় হইল। হর্ষের কারণ প্রস্তাব-লেখক মহাশয় বিশেষ পরিশ্রম করিয়া বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার কর্তৃক সম্পাদিত, বিদ্যাপতির পদাবলী পাঠ করিয়াছেন। এবং টীকাতে যে সমুদায় ভুল আছে তাহা সংশোধন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। গুরুতর পরিশ্রম করিয়া তিনি দুরূহ পদসমূহেরও ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আমাদের বিবেচনায় তাঁহার কৃত ব্যাখ্যা অনেক স্থলে বিশদ হইয়াছে। যে জাতির যে কাব্যের যত প্রকার ব্যাখ্যা হয় সেই জাতির সেই কাব্যের তত গৌরবের কথা। এক-একখানি সংস্কৃত কাব্যের একএকটি পদের নানা প্রকার অর্থ করা যাইতে পারে— ইহা সংস্কৃত ভাষার গৌরবের কথা সন্দেহ নাই। মিল্‌টনে প্যারেডাইস লস্টের অসংখ্য ব্যাখ্যা আছে—প্যারেডাইস লস্ট ইংরাজি ভাষার অমূল্য রত্ন। বিদ্যাপতির এক-একটি পদের নানা প্রকার অর্থ হওয়া আনন্দের কথা। কিন্তু তাহার কৃত পদাবলী পাঠ করিয়া ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের অর্থ করেন, এরূপ পাঠক বা লেখক-সংখ্যা বঙ্গদেশে অল্প― সাধারণত বঙ্গবাসী এ প্রকার কষ্টকর কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে অগ্রসর হয়েন না। সেইজন্য ভারতীর প্রাচীন কাব্য সম্বন্ধীয় প্রস্তাব পাঠ করিয়া আমাদের এত হর্ষ হইয়াছে। আমাদিগের বিষাদের কারণ এই যে, প্রস্তাব-লেখক মহাশয় নিরপেক্ষভাবে প্রচীন কাব্য সংগ্রহের সমালোচনা করেন নাই। তিনি অনেক স্থানে সম্পাদকের অযথা নিন্দা করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে।

 কোনাে ব্যক্তি কোনাে পুস্তকের টীকা করিবার পূর্বে এরূপ প্রতিজ্ঞা করিতে পারেন না, যে, তিনি যাহা লিখিবেন তাহাই নির্ভুল হইবে। আমরা যত দুর কাব্যসংগ্রহ পাঠ করিয়াছি তাহার কোনাে স্থানেই সম্পাদক শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার এ প্রকার প্রতিজ্ঞা করেন নাই, সুতরাং চুক্তিভঙ্গের নালিশ তাঁহার উপর চলে না। কবিদিগের প্রতি অবিচার করার দাবিও করা যাইতে পারে না। কারণ কবিদিগের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভক্তি না থাকিলে সম্পাদক এ কার্যে হস্তক্ষেপ করিতেন কি না সন্দেহ। আমাদের বােধ হয় সাধারণ পাঠকবর্গ সম্পাদক যাহা-কিছু লিখিয়াছেন, তাহাই ভুল-শূন্য এ প্রত্যাশা করিয়া প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ পাঠ করিতে আরম্ভ করেন না। সুতরাং তাঁহারা উক্ত পুস্তকমধ্যে স্থানে স্থানে ভুল ব্যাখ্যা দেখিলে বােধ হয়, বিস্মিত হয়েন না।

 শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার অকাতরে পরিশ্রম করিয়া, মহাজন পদাবলী সংগ্রহ করিয়াছেন। দুরূহ শব্দের অর্থ করিয়াছেন; এমন-কি, লুপ্তপ্রায় পদাবলী সমূহকে মনােহর বেশভূষায় ভূষিত করিয়া, সাহিত্যজগতে আনয়নপূর্বক সাহিত্যপ্রিয় ব্যক্তিমাত্রেরই কৃতজ্ঞতার পাত্র হইয়াছেন। প্রবন্ধে লেখকমহাশয় লিখিয়াছেন, যে, তিনি তজ্জন্য সম্পাদককে উৎসাহ দিলেন। কিন্তু কিরূপে যে তিনি উৎসাহ দিলেন, তাহা আমাদিগের বােধগম্য হইল না। বরং তিনি প্রকারান্তরে সম্পাদককে অলস অমনােযােগ প্রভৃতি বলিয়াছেন। তাঁহার লেখার ভাবে বােধ হইল, যে, সম্পাদকের নিন্দা করিবার অভিপ্রায়েই তিনি লেখনী ধারণ করিয়াছিলেন।[]

 তৎকর্তৃক-সম্পাদিত পদাবলীর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করা তাঁহার অভিপ্রায় ছিল। নতুবা সম্পাদককে লজ্জিত করিবার জন্য এত চেষ্টা কেন? তাঁহার প্রতি এত তীব্র বিদ্রূপ নিক্ষেপ কেন? আমরা বলিয়াছি প্রবন্ধ-লেখক অনেক স্থানে সম্পাদকের অযথা নিন্দা করিয়াছেন, যাহা স্পষ্ট ভুল নহে তাহাকে ভুল প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, এক্ষণে দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইব যে আমাদের কথা সত্য। তিনি লিখিয়াছেন―

‘অলখিতে মােহে হেরি বিহসিতে থােরি।
জনু বয়ান বিরাজে চাঁদ উজোরি।

কুটিল কটাক্ষ ছটা পড়ি গেল।
মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল।

 এই শ্লোকের শেষ ছত্রে সম্পাদক ‘যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন এবং ‘আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? কোনো পদের অনুবাদ করা এক কথা, আর ব্যাখ্যা করা আর-এক কথা। অনুবাদ করিতে হইলে নিজ হইতে শব্দ দেওয়ার সকল সময়ে প্রয়োজন না হইতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা করিতে হইলে অনেক সময়ে নূতন শব্দ প্রয়োগ করিতে হয়; অন্যথা সকল স্থানে ব্যাখ্যা সরল হয় না। পাঠকেরাও উত্তম রূপ বুঝিতে পারেন না। উপরে উদ্‌ধৃত পদটিতে একটি উৎপ্রেক্ষা অলংকার আছে সুতরাং ‘যেন’ শব্দ প্রয়োগ করিয়া সম্পাদক কোনো দোষ করেন নাই। অনেক কৃতবিদ্য সুপণ্ডিত ব্যক্তি সংস্কৃত শ্লোকের ব্যাখ্যাকালে নিজ হইতে অনেক শব্দ যোগ করিয়া দিয়াছেন। উদাহরণ—

‘বশিষ্ঠ ধেনোরনুষায়িনন্তং
আবর্তমানং বনিতা বনান্তাৎ।
পপৌ নিমেষালস পক্ষ্ম পঙ্‌ক্তি
রুপোষিতাভ্যামিব লোচনাভ্যাম্।

রঘুবংশ। দ্বিতীয়ঃ সর্গঃ, ১৯ শ্লোক

 পণ্ডিত নবীনচন্দ্র ইহার এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন—‘রাজ্ঞী সুদক্ষিণা বন হইতে প্রত্যাগত বশিষ্ঠ ধেনুর অনুযায়ী রাজাকে নির্নিমেষ লোচনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তাঁহার স্থির নিশ্চল দৃষ্টি দেখিয়া বোধ হইল যেন, তাঁহার লোচন যুগল বহুকাল উপোষিত থাকিয়া অতি তৃষ্ণার সহিত রাজার সৌন্দর্য পান করিতেছিল। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে ‘অতি তৃষ্ণার সহিত রাজার সৌন্দর্য পান’ কোথা হইতে আসিল? আর একজন পণ্ডিত ইহার টীকা করিয়াছেন, ‘পতি বশিষ্ঠ ধেনুর অনুচর হইয়া বন হইতে প্রত্যাগমন করিতেছেন দেখিয়া রাজ্ঞী অনিমিষ নয়নে তাঁহাকে দেখিতে লাগিলেন। বোধ হইল যেন, তাঁহার নয়ন যুগল এতক্ষণ উপবাসী ছিল এখন তদীয় সৌন্দর্য সুধা পান করিতেছে।’ ‘সৌন্দর্য সুধা’ কোথা হইতে আসিল? বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার টীকা করিতে যাইয়া দুই-একটি নিজের শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া আমাদের প্রবন্ধ লেখক তাঁহাকে বিদ্রূপ করিয়াছেন, কিন্তু এ-সকল টীকা পাঠ করিয়া তিনি কি বলিবেন বলিতে পারি না।

শ্রীযােগেন্দ্রনারায়ণ রায়

 প্রত্যুত্তর অর্থ ব্যাখ্যা করা এক, আর অর্থ তৈরি করা এক। অর্থ সহজ করিবার জন্য তাহাতে নূতন কথা যােগ করা কিছু মন্দ কাজ নহে, কিন্তু মূলে যে কথা নাই সেই কথা যােগ করিয়া অর্থ গড়িয়া তােলা দোষের নহে তাে কী? লেখক আবার পাছে ভুল বুঝেন এই নিমিত্ত স্পষ্ট করিয়া উদাহরণ দিয়া বলিতে হইল। মনে করুন, ‘সময় বসন্ত, কান্ত রহুঁ দূরদেশ’ এই ছত্রটির অর্থ বুঝাইতে গিয়া আমি যদি বলি, ‘বসন্তের ন্যায় এমন সুখের সময়ে, প্রাণের অপেক্ষা যাহাকে ভালােবাসি, সে কান্ত দূরদেশে রহিয়াছেন’, তাহাতে দোষ পড়ে না; যদিও কথা বাড়াইলাম তথাপি কবির ভাবের অনুসরণ করিয়া চলিয়াছি। কিন্তু আমি যদি বলি ‘বসন্ত অতিক্রম করিয়া গ্রীষ্ম আসিয়া পড়িল, তথাপি আমার কান্ত দূরদেশে রহিয়াছেন’ তাহা হইলে অতিরিক্ত কথা ব্যবহারের জন্য আমি দোষী।

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রস্তাব-লেখক
 উত্তর―

‘লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি
চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি।’

 লেখক লিখিয়াছেন ‘লীলা-কমলের দ্বারা ভ্রমরকে নিবারণ’ ইত্যাদি। আমাদের বিবেচনায় সম্পাদকের অর্থই বিশদ হইয়াছে। রাধিকার হস্তে লীলাকমল কোথা হইতে আসিল? তিনি কি ভ্রমর তাড়াইবার জন্য লীলা-কমল হস্তে করিয়া বেড়াইতেন? সম্পাদক ‘ন্যায়’ ‘সহিত’ প্রভৃতি শব্দ ঘর হইতে দেওয়ায় যে মহাপাতক সঞ্চয় করেন নাই তাহা উপরে বলিয়াছি।

শ্রীযােঃ নাঃ রাঃ

 প্রত্যুত্তর- ‘লীলা-কমল’ কোথা হইতে আসিল? তাহা ঠিক বলিতে পারি না, তবে এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে তাহা আনাইতে কবির এক ফোঁটার অধিক কালি খরচ হইয়াছিল কি না সন্দেহ। চণ্ডীদাসের এক স্থানে আছে— ‘চলে নীল শাড়ি নিঙ্গাড়ি নিঙ্গাড়ি, পরাণ সহিতে মাের।’ লেখক তো জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, ‘নীল শাড়ি কোথা হইতে আসিল? ঢাকা হইতে না বারাণসী হইতে? চণ্ডীদাসের সেটা লেখা উচিত ছিল, সন্দেহ নাই, কিন্তু সে বিষয়ে চণ্ডীদাসের হইয়া একটা কথা বলা যায়। এ পর্যন্ত অনেক কবি নীল শাড়ি ও লীলাকমলের অপেক্ষাও অনেক দামী দুষ্প্রাপ্য জিনিস কাব্যে আনিয়াছেন, কিন্তু কোন্ দোকান হইতে আনাইয়াছেন, পাঠকদের উপকারার্থ তাহা লিখিয়া দেন নাই। সংস্কৃত কাব্যে সহস্র স্থানে লীলা-কমলের দ্বারা ভ্রমর তাড়াইবার উল্লেখ আছে।

শ্রীরঃ
 উত্তর―

‘যব গোধূলি সময় বেলি
ধনি মন্দির বাহির ভেলি,
নব জলধরে বিজুরী-রেখা
দ্বন্দ্ব পসারিয়া গেলি।’

এ পদের সম্পাদকীয় টীকাই আমাদের মতে পরিষ্কার ও ভাব-ব্যঞ্জক হইয়াছে। প্রবন্ধ-লেখক যে অর্থ করিয়াছেন তাহা পরিষ্কার হয় নাই। তিনি লিখিয়াছেন, ‘রাধা গোধুলির ঈষৎ অন্ধকারে মন্দিরের বাহির হইলেন। যেন নব জলধরে বিদ্যুৎ রেখা দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল। ‘দ্বন্দ্ব’ শব্দের এখানে অর্থ কি? কাহার সহিত দ্বন্দ্ব করিয়া গেল? সম্পাদক এই স্থানে ‘পুন’ শব্দ পরিত্যাগ করায় ও ‘যেন’ শব্দ নিজ গৃহ হইতে দেওয়ায় প্রবন্ধ লেখক তাঁহার নিকট কৈফিয়ৎ চাহিয়াছেন। কিন্তু তিনি এক্ষণে ‘যেন’ ঘর হইতে দিয়াছেন এবং দ্বন্দ্ব কথাটির যথোচিত সম্মান রক্ষা করেন নাই! অন্যকে যে জন্য নিন্দা করিলাম নিজে সেই কার্যটি করিলে গভীর বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয় না।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর— সম্পাদকীয় টীকা উদ্‌ধৃত করি— ‘বিদ্যুৎ-রেখার সহিত দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল। অর্থাৎ তাহার সমান বা অধিক লাবণ্যময়ী হইল।’ এখানে ‘সহিত’ শব্দ যোজনা করা যে নিতান্ত জোর-জবরদস্তির কাজ হইয়াছে, তাহা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না। আমার অর্থ এই যে— অন্ধকারের কৃষ্ণবর্ণ ও রাধিকার গৌরবর্ণ মিলিয়া কেমন হইল, যেমন নবজলধরের সহিত বিদ্যুৎ রেখার বিবাদ বিস্তৃত হইল। যদি বলি ‘ঈশ্বরে আমি প্রীতি স্থাপন করিলাম’ তাহা হইলে বুঝায়, ঈশ্বরের সহিত আমি প্রীতি করিলাম; তেমনি ‘জলধরে বিদ্যুৎ বিবাদ বিস্তার করিল’ অর্থে বুঝায়, জলধরের সহিত বিদ্যুৎ বিবাদ করিল।

শ্রীরঃ
 উত্তর―

‘এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ।
শুনাইতে মানবি স্বপন স্বরূপ।

···


শাখা-শিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহে নব পল্লবে অরুণক ভাতি।

···


তা পর চঞ্চল খঞ্জন যোড়।
তা পর সাপিনী ঝাঁপল মোড়।’

২০-সংখ্যক গীত

প্রবন্ধ-লেখক ইহার মধ্যস্থ দুই চরণের এই অর্থ দিয়াছেন। ‘সে তমাল তরুর শাখা শিখর অর্থাৎ মুখ, সুধাকর। লাবণ্যই বোধ করি অরুণ ভাতির পল্লবে। পাঁতি শব্দটি কোথায় গেল? ‘লাবণ্যই বোধ করি—’ ইত্যাদি এই ছত্রের অর্থ আমরা বুঝিতে পারিলাম না।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর―‘বোধ করি’ শব্দ ব্যবহার করিবার তাৎপর্য এই যে, যেখানে অর্থ বোধে মনে কোন প্রকার সন্দেহ থাকে সেখানে আমি অসংকুচিত ও অসন্দিগ্ধ ভাব দেখাইতে পারি না। এ অপরাধের যদি কোনো শাস্তি থাকে, তবে তাহা বহন করিতে রাজি আছি।

 
শ্রীরঃ

 উত্তর— আর ‘হাস্য স্থির বাস করে’ কিরূপ বাংলা? শ্রীকৃষ্ণের কুন্তল সাপিনীর ন্যায়ই বা কি প্রকারে হইল? শ্রীকৃষ্ণের চুড়ার কথাই শুনিয়াছি। আমরা যে ব্যক্তির নিকট এই গীতটির ব্যাখ্যা শুনিয়াছি তিনি ইহার আদিরসঘটিত ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। সম্ভবত সেইজন্যই ইহার অর্থ করেন নাই।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর— শ্রীকৃষ্ণের শরীর বর্ণনা করা ভিন্ন অন্য কোন প্রকার গূঢ় আদিরস ঘটিত অর্থ বুঝানো কবির অভিপ্রেত ছিল, তাহা আমি কোনো মতেই বিশ্বাস করিতে পারি না। ‘চঞ্চল খঞ্জন’ ‘যুগল বিম্বফল’ প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ দেখিয়া রূপবর্ণনা বলিয়াই স্পষ্ট অনুমান হইতেছে।

শ্রীরঃ
 উত্তর―

‘গগন সঘন, মহী পঙ্কা
বিঘিনি বিথারিত ইত্যাদি।’

 এই পদে দুই-একটি ছাপার ভুল আছে। ‘ভুললি’ স্থানে ‘ভুলালি ও ‘মানবি’ স্থানে ‘মানব’ হইবে। তাহা হইলেই সম্পাদকের অর্থ থাকিয়া যাইবে। আশ্চর্যের বিষয়, যে, প্রবন্ধ-লেখক একটু চিন্তা করিয়া দেখেন নাই, সম্পাদক এ অর্থ দিলেন কেন। একেবারে সম্পাদকের অর্থকে ভুল বলিয়াছেন; ইহাতে তাঁহার কতদূর বিজ্ঞতার পরিচয় প্রদান করা হইয়াছে, তাহা তিনিই বিবেচনা করুন।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর― আশ্চর্যের বিষয় যে প্রবন্ধ-লেখক একটু চিন্তা করিয়া দেখেন নাই, যে, মূলে ও টীকায় উভয় স্থলেই অবিকল একই-রূপ ছাপার ভুল থাকা সম্ভব কি না? টীকার বন্ধনী-চিহ্নের মধ্যে যে কথাগুলি উদ্‌ধৃত আছে সেগুলির প্রতি লেখক একবার যেন দৃষ্টিপাত করেন।

শ্রীরঃ

 উত্তর― পিণ্ডন শব্দের টীকা না করিয়া প্রবন্ধ-লেখক যে টিপ্পনী করিয়াছেন, আমাদের চক্ষে তাহা ভালো লাগিল না। সম্পাদক-কৃত অর্থ ভালো না হওয়ায় প্রবন্ধ-লেখক যেন আনন্দিত হইয়াছেন। তিনি যেন সম্পাদককে বিদ্রূপ করিবার সুযোগ খুঁজিতেছিলেন এবং সেই সুযোগ পাইয়াই দুইটা কথা শুনাইয়া দিয়াছেন। এপ্রকার লেখায় সাধারণ পাঠকবর্গের বা প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহের বিদ্যাপতি বা চণ্ডীদাসের কোনো লাভ হয় নাই— হইয়াছে, কেবল নিন্দা করিয়া লেখকের মনে সন্তোষ লাভ, আর যদি সম্পাদকের কেহ শত্রু থাকেন, তাহা হইলে তাঁহার মনে শান্তি লাভ।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর― অসম্ভব ও অসংগত উক্তি শুনিলে আমাদের স্বভাবতই হাসি আসে। একজনকে একটা অদ্ভুত কার্য করিতে দেখিয়া বা অদ্ভুত কথা কহিতে শুনিয়া আমরা যদি হাসিয়া উঠি, সে কি বলিতে পারে যে, তাহার প্রতি শত্রুতাবশত আমরা বহুদিন হইতে অবসর খুঁজিতেছিলাম, কখন সে অদ্ভুত কথা বলিবে ও আমরা হাসিয়া উঠিব? হাসি সামলাইতে পারি নাই, হাসিয়াছিলাম। মধ্যে মধ্যে এরূপ বেয়াদবি করিবার অধিকার সকল দেশের সাহিত্য-সমালােচকদেরই আছে।

শ্রীরঃ

 উত্তর― জানয়বি শব্দে ‘য়’ ভুল নহে। আমাদের বােধ হয় ‘ন’ তে আকার দিতে ছাপার ভুল হইয়া থাকিবে। হিন্দীতে যখন ‘দেখায়ব’ ‘লিখায়ব’ প্রভৃতি আছে, তখন জানায়ব বা জানায়বি না হইবে কেন? ছাপার ভুলের জন্য সম্পাদককে দায়ী করা যায় না। বিশেষত বঙ্গদেশে এমন পুস্তক খুব কম যাহাতে ছাপার ভুল নাই। আমাদের আলােচ্য প্রবন্ধেই ছাপার ভুল আছে; ছাপার ভুলের জন্য কোন গ্রন্থকারকে কেহ দোষী করেন না। তবে নিন্দা করিবার অভিপ্রায় থাকিলে সে স্বতন্ত্র কথা।

শ্রীযােঃ

 প্রত্যুত্তর— একে সহজেই দুর্বোধ্য ভাষা, তাহার উপরে ছাপার ভুল হইলে না কি বিশেষ হানি হইবার সম্ভাবনা এই নিমিত্তই আমরা বলি এ-সকল বই ছাপাইতে নিতান্তই পরিশ্রম করা আবশ্যক। সচরাচর প্রকাশিত বাংলা পুস্তকে ভুল থাকিলে তেমন হানি হয় না। প্রাচীন কবিতায়, কোন্‌টা ছাপার ভুল কোন্‌টা নহে তাহা নির্ণয় করা নিতান্তই দুঃসাধ্য। ‘জানায়বি’ এবং ‘জানাওবি’ উভয়ই হইতে পারে, অতএব ‘য়’ এবং ‘ও’ লইয়া আমার বিবাদ নহে— আমার কথা এই যে আকারটি না থাকাতে ছত্রটির অর্থ পাওয়া যায় না।

শ্রীরঃ
 উত্তর—

‘হিম হিমকর তাপে তাপায়লু
ভৈগেল কাল বসন্ত।
কান্ত কাক মুখে নাহি সম্বাদই
কিয়ে করু মদন দুরন্ত।’

 কান্ত কাকের মুখে সংবাদ পাঠাইলেন না পাঠ করিয়া প্রবন্ধ-লেখক অজ্ঞান হইয়াছেন। কাকের মুখে সংবাদ বড়ো আশ্চর্য কথা! লেখক নিশ্চয়ই কলিকাতাবাসী হইবেন, কাকের মুখে সংবাদ দেওয়ার কথা যে বঙ্গদেশের প্রায় সমুদয় স্থানেই (কলিকাতায় আছে কিনা জানি না) প্রচলিত আছে, তাহা তিনি অবগত নহেন। কাকই যে প্রেমের দূত এরূপ নহে; কোকিলও সময়ে সময়ে প্রেমের দৌত্য কার্য করিয়া থাকে। আমরা একটি গীতে শুনিয়াছি― ‘যারে কোকিল আমার বঁধু আছে যে দেশে’ ইত্যাদি। হিন্দুস্থানী ভাষায় ষষ্ঠীতে ‘ক’ বিভক্তি হইতে কোথাও দেখি নাই; ‘কা’, ‘কি’, ‘কে’, ‘ কিস্‌কা’ ‘ কিস্‌কী’ ‘কিস্‌কে’ পড়িয়াছি। হিন্দী ব্যাকরণ ভাষা-চন্দ্রোদয়ে এই তিনটি বই ষষ্ঠীর বিভক্তি নাই। তবে ‘তাক’ হইতে তাহার ‘কাক’ হইতে কাহার টানিয়া বুনিয়া অর্থ করা যায়, কিন্তু তাহার সহিত ব্যাকরণের কোনো সংস্রব নাই।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর― অমঙ্গল-সূচক কাক যে সংবাদ বহন করিতে পারে না এমন আমাদের কথা নহে। কিন্তু কোনো কবি এ পর্যন্ত কাককে প্রেমের ডাক-হরকরার কাজ দেন নাই। এ-সকল কাজ হংস, কোকিল, মেঘ, মাঝে মাঝে করিয়াছে। কাকের না চেহারা ভালো, না গলা ভালো, না স্বভাব ভালো; এই নিমিত্ত কবিরা কাককে প্রেমের কোমল কাজে নিযুক্ত করেন না। ব্যাকরণ-কারেরা যে ভাষার সৃষ্টি করে না, তাহা সকলেই জানেন। বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রভৃতি কবিদের পদাবলীতে যদি শত শত স্থানে যষ্ঠীতে ‘ক’ বিভক্তি ব্যবহার হইয়া থাকে, তবে আমার ব্যাকরণ খুলিবার কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না। ‘কি কহব, রে, সখি, কানুক রূপ।’ ‘সুজনক প্রেম হেম সমতুল।’ ‘প্রেমক রীত অব বুঝহ বিচারি।’ ‘যাক দরশ বিনা ঝরয়ে পরাণ, অব নাহি হেরসি তাক বয়ান।’ এমন সহস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।

শ্রীরঃ

 উত্তর—

‘দক্ষি পবন বহে কৈছে যুবতী সহে
তাহে দুখ দেই অনঙ্গ।
গেলহুঁ পরাণ আশা নেই রাখই
দশ নখে লিখই ভুজঙ্গ।

 প্রবন্ধ-লেখক কৃত এই পদের অর্থ আমাদের বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম হইল না। অনঙ্গ মহাদেবকেই ভয় করিতে পারে, বড় জোর না হয় নন্দীকে ভয় করিবে, কিন্তু সর্পকেও ভয় করিতে হইবে কেন বুঝা গেল না। সম্ভবত ইহার অন্য কোনো অর্থ আছে।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর— আমি যে টীকা করিয়াছিলাম, তাহা উদ্‌ধৃত করি। ‘শিবের ভূষণ ভুজঙ্গকে মদন ভয় করেন, এইজন্য বিরহিনী নখে ভুজঙ্গ আঁকিয়া তাহাকে ভয় দেখাইয়া প্রাণকে আশা দিয়া রাখিতেছেন।’ এই পদটির আরম্ভেই আছে,

‘হিমকর পেখি আনত করু আনন

···


নয়ন কাজর দেই লিখই বিধুন্তুদ’—
ইত্যাদি।

 চন্দ্রকে ভয় দেখাইবার জন্য রাধা রাহু আঁকিয়াছেন, তবে মদনকে ভয় দেখাইবার অভিপ্রায়ে সাপ আঁকা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব নহে। এত দ্রব্য থাকিতে রাধা সাপ আঁকিতে গেলেন কেন? তাহার প্রধান কারণ, তিনি কখনো ArtSchool-এ পড়েন নাই, এই নিমিত্ত তাঁহার পক্ষে নন্দীর ছবি আঁকা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, কিন্তু মাটির উপরে অঙ্গুলি বুলাইয়া গেলেই অতি সহজে সাপ আঁকা যায়। তাহা ছাড়া, মহাদেবের সাপকে যে ভয় করিতে নাই এমন নহে।

শ্রীরঃ

 পুস্তক-মধ্যে ছোটো ছোটো অসাবধানতা সম্বন্ধে লেখক যে-সকল কথা বলিয়াছেন, তাহার কতকগুলির উত্তর দেওয়ার উপযুক্ত পাত্র সম্পাদক স্বয়ং। আমরা কেবল এ সম্বন্ধে দুই-চারিটি কথা বলিব। ‘কিয়ে’ শব্দের অর্থ কি অপেক্ষা কিবা ভালো হয়। ‘কিয়ে’ শব্দের স্থানে কি হয় কিনা, আমাদের সন্দেহ আছে। ‘কিয়া’ শব্দেই হিন্দীতে কি। কিয়ে শব্দে উর্দুতে করিয়াছিল অর্থ হয়। এরূপ অবস্থায় কিয়ে শব্দের অর্থে কিবা ব্যবহার করিয়া সম্পাদক দুষ্কর্ম করেন নাই। আর হাস্যজনক কথা কোথাও দেখিলাম না।

শ্রীযোঃ

 প্রত্যুত্তর—‘কিয়ে’ শব্দের অর্থে জিজ্ঞাসাসূচক ‘কি’ হয় কি না, এ বিষয়ে লেখকের সন্দেহ আছে। কিন্তু কেবলমাত্র ব্যাকরণ না পড়িয়া প্রাচীন কবিতা ভালো করিয়া পড়িলে এ সন্দেহ সহজেই যাইবে। উদাহরণ দেওয়া যাক্।

‘হাম যদি জানিয়ে পিরীতি দুরন্ত,
তব্ কিয়ে যায়ব পাপক অন্ত?’
‘হাম যদি জানিতুঁ কানুক রীত
তব্ কিয়ে তা সঙে বাঁধিয়ে চিত?’

শ্রীরঃ

 যাহা হউক এই প্রস্তাব লইয়া বিবাদ করা আমাদিগের অভিলাষ নহে। আমরা সম্পাদকের পক্ষে বা প্রবন্ধ-লেখকের বিপক্ষে নহি। প্রবন্ধ-লেখক মহাশয় স্থানে স্থানে যে-সকল ভুল বাহির করিয়াছেন তাহার মধ্যে কতকগুলি আমাদের ভুল বলিয়া বিশ্বাস হইয়াছে। তবে প্রবন্ধ-লেখক মহাশয় সম্পাদকের উপর যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব প্রকাশ করিয়াছেন; তাঁহার গুরুতর পরিশ্রমের কথা বিস্মৃত হইয়া প্রকারান্তরে তাঁহাকে অলস ও এ কার্যে অক্ষম বলিয়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে এই কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে অনুরোধ করিয়াছেন— ইহা আমাদের ভালো লাগে নাই। আমরা পূর্বেও বলিয়াছি, এখনো বলিতেছি, যে, লেখার ভাব দেখিয়া আমাদের বোধ হইয়াছে যে, লেখক যেন, দোষ দেখাইয়া আনন্দ লাভ করিবার জন্যই কলম ধারণ করিয়াছিলেন। যেন তিনি কোন কারণ প্রযুক্ত ইতিপূর্বে সম্পাদকের উপর চটিয়া ছিলেন, এক্ষণে সুযোগ পাইয়া এই প্রস্তাবে গাত্রের জ্বালা নিবারণ করিয়াছেন। এপ্রকার লেখার প্রশ্রয় আমরা দিতে পারি না।

 আর সম্পাদকের নিকট আমাদের প্রার্থনা যে, তিনি যেন তাঁহার কাব্যসংগ্রহের দ্বিতীয় সংস্করণে ইহার ভুলগুলি সংশোধন করিয়া দেন। তিনি গুরু পরিশ্রম করিয়া কাব্য সংগ্রহ করিয়াছেন তজ্জন্য বঙ্গবাসী তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ আছে। আর একটু পরিশ্রম করিয়া সামান্য সামান্য ভুলগুলি সংশোধন করিয়া দিলে আমরা তাঁহার নিকট অধিকতর কৃতজ্ঞ হইব।

শ্রীযোগেন্দ্রনারায়ণ রায়

 প্রত্যুত্তর― যৎসামান্য শ্রম-স্বীকার পূর্বক ব্যাকরণ ও অভিধান না খুলিয়া সম্পাদক মহাশয় অসংকোচে টীকা করিয়া যাওয়াতে যে-সকল ভ্রমে পড়িয়াছেন, তাহা যদি সমস্ত উদ্‌ধৃত করিয়া দিই তাহা হইলে সহজেই প্রমাণ হইবে যে, আমি তাঁহাকে যে নিন্দা করিয়াছি তাহা অযথা হয় নাই। আমার প্রতি অন্যায় ও রুচি-বিগর্হিত দোষারোপ দূর করিবার নিমিত্ত ভবিষ্যতে সেইগুলি বিবৃত করিবার মানস রহিল। আমি সাহিত্যের সেবক। সাহিত্য লইয়াই অক্ষয়বাবুর সহিত বিবাদ করিয়াছি, তাহা আমার কর্তব্য কর্ম। সাহিত্য-বহির্ভূত ব্যক্তিগত কোনো কথার উল্লেখ করিয়া তাঁহার প্রতি আমার আক্রোশ প্রকাশ করি নাই; এমন স্থলে যদি কেহ বলেন যে, ‘লেখক কোনো কারণ প্রযুক্ত ইতিপূর্বে সম্পাদকের উপর চটিয়াছিলেন, এক্ষণে সুযোগ পাইয়া এই প্রস্তাবে গাত্রের জ্বালা নিবারণ করিয়াছেন’ তবে তাঁহার শিক্ষার অসম্পূর্ণতা ও রুচির বিকার প্রকাশ পায়। যাহাই করুন, অক্ষয়বাবুর উপর আমার এতখানি বিশ্বাস আছে, যাহাতে অসংকোচে বলিতে পারি যে, তিনি এরূপ মনে করিবেন না। তিনি যে আদৌ এমন কষ্টসাধ্য ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, এবং এই কার্যসাধনে (আমার মনের মতো না হউক তবুও) অনেকটা পরিশ্রম করিয়াছেন, তজ্জন্য তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি, ও পূর্ব প্রবন্ধে যদি যথেষ্ট না করিয়া থাকি তবে মার্জনা চাহিতেছি।

 ভাদ্র ১২৮৮

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পরিশিষ্ট

উপস্থিত-সংখ্যক ভারতীতে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আমার একটি মাত্র বক্তব্য আছে। প্রাচীন-কাব্য-সংগ্রহ সমালোচনায় আমি ‘এ সখি, কি পেখনু এক অপরূপ’ ইত্যাদি পদটির অর্থ প্রকাশ করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহার এক স্থানে অর্থ বুঝিতে গোলযোগ ঘটায় সন্দিগ্ধভাবে একটা অনুমান-করিয়া-লওয়া ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছিল। আর-একবার মনোযোগপূর্বক ভাবিয়া ইহার যে অর্থ পাইয়াছি, তাহাতে আর সন্দেহ করিবার কিছু নাই। কেহ কেহ বলেন এই পদটির আদিরস-ঘটিত গূঢ় অর্থ আছে; কিন্তু তাহা কোন মতেই বিশ্বাস করা যায় না। সহজে ইহার যে অর্থ পাওয়া যায় তাহা অগ্রাহ্য করিয়া ইহার মধ্য হইতে একটা অশ্লীল আদিরস-ঘটিত অর্থ বাহির করা নিতান্ত কষ্টকল্পনা ও অরসিক-কল্পনার কাজ। শ্রীকৃষ্ণের শরীরের বর্ণনাই ইহার মর্ম। প্রথমে পদটি উদ্‌ধৃত করি।

এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ।
শুনাইতে মানবি স্বপন স্বরূপ।

কমল-যুগল পর চাঁদকি মাল।
তা’পর উপজল তরুণ তমাল।
তা’পর বেড়ল বিজুরী লতা।
কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা।
শাখাশিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহে নব-পল্লব অরুণক ভাতি।
বিমল বিম্ব ফল যুগল বিকাশ।
তা’পর কির থির কর বাস।
তা’পর চঞ্চল খঞ্জন যোড়।
তা’পর সাপিনী ঝাঁপল মোড়।

 সকলেই জানেন, দেবতাদের শরীর বর্ণনায় পা হইতে প্রথমে আরম্ভ করিয়া উপরে উঠিতে হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে কবি প্রথমে নখ-চন্দ্র-মালা শোভিত চরণ-কমল-যুগলের বর্ণনা করিয়াছেন, তাহার উপরে তরুণ তমাল স্বরূপ কৃষ্ণের পদদ্বয় উঠিয়াছে। তাহার পর বিজুরী লতা অর্থাৎ পীত বসন সে পদদ্বয় বেষ্টন করিয়াছে; (বিদ্যুতের সহিত পীত বসনের উপমা অন্যত্র আছে, যথা— ‘অভিনব জলধর সুন্দর দেহ। পীত বসন পরা সৌদামিনী সেহ।’)। পদদ্বয়ের বর্ণনা সমাপ্ত হইলে পর পদদ্বয়ের কার্যের উল্লেখ হইল— ‘কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা।’ তাহার পরে বাহুই শাখায় ও তাহার অগ্রভাগে নখরের সুধাকর-পঙ্‌ক্তি ও তাহাতে অরুণভাতি করপল্লব। এইবারে বর্ণনা মুখমণ্ডলে আসিয়া পৌঁছিল। প্রথমে বিম্বফল ওষ্ঠাধর যুগল তাহাতে কিরণ অর্থাৎ হাস্য স্থির রূপে বাস করে। তাহার উর্ধ্বে চঞ্চল-খঞ্জন চক্ষু। ও সকলের উর্ধ্বে সাপিনীর বেষ্টনের ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের চুড়া।

 এখন আমি অসংকোচে ও নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে বলিতে পারি যে, উপরি-উক্ত অর্থই, ঐ পদটির যথার্থ অর্থ। ইহা ব্যতীত অন্য কোনো গূঢ় অর্থ বুঝানো কবির অভিপ্রায় ছিল না।[]

 কার্তিক ১২৮৮

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

  1. ‘প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ’, অগ্রহায়ণ ১২৮১-৮৩ [ইং ১৮৭৪-৭৬] খণ্ডশঃ প্রকাশ। ১। বিদ্যাপতি ২। চণ্ডীদাস ৩। গোবিন্দদাস ৪। রামেশ্বরের সত্যনারায়ণ ৫। মুকুন্দরাম কবিবঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল।
  2. ভাঙ শব্দের অর্থ ভ্রূ।
  3. কনক কটোরা অর্থে সোনার বাটি বুঝায়। বিদ্যাপতির অনেক স্থলে কনক-কটোরার সহিত স্তনের তুলনা দেওয়া হইয়াছে}}
  4. —উ_মা পরিমাণ করা। প্রকৃতিবাদ।
  5. অভিনব জলধর সুন্দর দেহ।
    পীতবসন পরা সৌদামিনী সেহ। সং ১৮, পৃ. ২০

  6. চরণ চল, চিত চল। পৃ. ৩
    অর্থাৎ চরণ চঞ্চল এবং চিত্তেরও চঞ্চল ভাষ। ‘ভাণ’ অর্থে ভাব।
  7. মলিনচিকুর তনুটীরে। সং ১৩৯ পৃ. ১৬
  8. সুরুচি-সম্পন্ন পাঠকদিগের নিকট এ কথাটার উত্তর দিবার আবশ্যক বিবেচনা করিতেছি না। লেঃ―
  9. অপিচ দ্রষ্টব্য “জিজ্ঞাসা ও উত্তর”, ভারতী, জৈষ্ঠ্য-শ্রাবণ, ১২৯০।