বাংলা শব্দতত্ত্ব/প্রাকৃত ও সংস্কৃত

প্রাকৃত ও সংস্কৃত

শ্রীনাথবাবু তাঁহার ‘ভাষাতত্ত্ব’-সমালোচনার প্রতিবাদে[] প্রাচীন বাংলাসাহিত্য হইতে যে-সকল উদাহরণ[] উদ্‌ধৃত করিয়াছেন, তাহাতে স্পষ্টই প্রমাণ হইয়াছে, জনসাধারণ্যে প্রচলিত ভাষা ‘প্রাকৃত’ নামে অভিহিত হইত। মারাঠি ভাষায় এখনো প্রাকৃত শব্দের সেইরূপ ব্যবহার দেখা যায়।

 কিন্তু প্রাকৃত শব্দের এই প্রয়োগ আধুনিক বাংলায় চলে নাই, চলা প্রার্থনীয় কি না সন্দেহ।

 পুরাকালে যখন গ্রন্থের ভাষা, পণ্ডিতদের ভাষা, সাধারণ-কথিত ভাষা হইতে ক্রমশ স্বতন্ত্র হইয়া উঠিল তখন সংস্কৃত ও প্রাকৃত এই দুই পৃথক নামের সৃষ্টি হইয়াছিল। তখন যাহা সংস্কৃত ছিল এবং তখন যাহা প্রাকৃত ছিল তাহাই বিশেষরূপে সংস্কৃত ও প্রাকৃত শব্দে বাচ্য।

 এখনো বাংলায় লিখিত ভাষা কথিত ভাষা হইতে ক্রমশ স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ আকার ধারণ করিতেছে। আমরা যদি ধাতুগত অর্থের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া সাধারণ-কথিত বাংলাকে প্রাকৃত বলি তাহা হইলে লিখিত গ্রন্থের বাংলাকে সংস্কৃত বলিতে হয়। বস্তুত এখনকার কালের প্রাকৃত ও সংস্কৃত ইহাই। কিন্তু এরূপ হইলে বিপাকে পড়িতে হইবে।

 কালিদাস প্রভৃতি কবিদের নাটকে যে-প্রাকৃত ব্যবহার হইয়াছে, তাহা তাঁহাদের সময়ের চলিত ভাষা নহে। চলিত ভাষা প্রদেশভেদে ভিন্ন হয়, অথচ সাহিত্যের প্রাকৃত একই এবং সে-প্রাকৃতের এক ব্যাকরণ। ইহা হইতে অনুমান করা অন্যায় হয় না যে, বিশেষ সময়ের ও বিশেষ দেশের চলিত ভাষা অভিধানে প্রাকৃত শব্দে বিশেষরূপে নির্দিষ্ট হইয়া গেছে; অন্য দেশকালের প্রাকৃতকে ‘প্রাকৃত’ বলিতে গেলে কেঁচোকেও উদ্ভিদ বলা যাইতে পারে।

 যদি প্রাকৃত ও সংস্কৃত শব্দ বাংলা শব্দের পূর্বে বিশেষণরূপে জুড়িয়া ব্যবহার করা হয়, যদি লিখিত বাংলাকে ‘সংস্কৃত বাংলা’ ও কথিত বাংলাকে ‘প্রাকৃত বাংলা’ বলা যায়, তাহা হইলে আমরা আপত্তি করিতে পারি না। কিন্তু সংস্কৃতভাষা ও প্রাকৃত ভাষা অন্যরূপ। প্রাকৃত ভাষা বাংলা ভাষা নহে, বররুচি তাহার সাক্ষ্য দিবেন।

 আষাঢ় ১৩০৮

  1. শ্রীনাথ সেন প্রণীত ভাষাতত্ত্ব গ্রন্থের চন্দ্রশেখর মুখখাপাধ্যায় মহাশয়ের সমালোচনার (বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১৩০৮) গ্রন্থকারকৃত প্রতিবাদ (আলোচনা গ: বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩০৮)।
  2. “৫০।৬০ বৎসর পূর্বে যে সকল বাংলা পুস্তক লিখিত হইয়াছে, তাহাতে পর্যন্ত বাংলাকে প্রাকৃত বলা হইয়াছে। যথা―

    শনির মাহাত্ম্য আছে স্কন্দপুরাণেতে,
    ‘পরাকৃত’ বিনে কেহ না পারে বুঝিতে।
    অতএব পয়ার প্রবন্ধে তাহা বলি,
    একচিত্তে শুন সবে শনির পাঁচালী।

    ―পূর্ববঙ্গে প্রচলিত ‘শনির পাঁচালী’

    বাবু দীনেশচন্দ্র সেনও তাঁহার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ নামক পুস্তকে বলিতে বাধ্য হইয়াছেন, “পুর্বে ভারতের কথিত ভাষামাত্রই, বােধ হয়, প্রাকৃত-সংজ্ঞায় অভিহিত হইত, এবং এই বাংলা- ভাষাকেও প্রাকৃত বলিত। যথা—

    ভারতের পুণ্যকথা শ্রদ্ধা দূর নহে।
    ‘পরাকৃত’ পদবন্ধে রাজেন্দ্রদাসে কহে।

    (২০০ দুইশত বৎসরের প্রাচীন হস্তলিখিত সঞ্জয়কৃত মহাভারত।)”
    —ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে আলােচনা, শ্রীনাথ সেন, বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩০৮, পৃ ১৩৫।