বাংলা শব্দতত্ত্ব/বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত
বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত
প্রবন্ধ-আরম্ভে বলা আবশ্যক যে-সকল বাংলা শব্দ লইয়া আলোচনা করি, তাহার বানান কলিকাতার উচ্চারণ অনুসারে লিখিত হইবে। বর্তমানকালে কলিকাতা ছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর বিভাগের উচ্চারণকে প্রাদেশিক বলিয়া গণ্য করাই সংগত।
আজ পর্যন্ত বাংলা অভিধান বাহির হয় নাই; সুতরাং বাংলা শব্দের দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করিতে নিজের অসহায় স্মৃতিশক্তির আশ্রয় লইতে হয়। কিন্তু স্মৃতির উপর নির্ভর করিবার দোষ এই যে, স্মৃতি অনেক সময় অযাচিত অনুগ্রহ করে, কিন্তু প্রার্থীর প্রতি বিমুখ হইয়া দাঁড়ায়। সেই কারণে প্রবন্ধে পদে পদে অসম্পূর্ণতা থাকিবে। আমি কেবল বিষয়টার সুত্রপাত করিবার ভার লইলাম, তাহা সম্পূর্ণ করিবার ভার সুধী-সাধারণের উপর।
আমার পক্ষে সংকোচের আর-একটি গুরুতর কারণ আছে। আমি বৈয়াকরণ নহি। অনুরাগবশত বাংলা শব্দ লইয়া অনেক দিন ধরিয়া অনেক নাড়াচাড়া করিয়াছি; কখনো কখনো বাংলার দুটা-একটা ভাষাতত্ত্ব মাথায় আসিয়াছে; কিন্তু ব্যাকরণব্যবসায়ী নহি বলিয়া সেগুলিকে যথাযোগ্য পরিভাষার সাহায্যে সাজাইয়া লিপিবদ্ধ করিতে সাহসী হই নাই। এ প্রবন্ধে পাঠকেরা আনাড়ির পরিচয় পাইবেন, কিন্তু চেষ্টা ও পরিশ্রমের ক্রটি দেখিতে পাইবেন না। অতএব শ্রমের দ্বারা যাহা সংগ্রহ করিয়াছি, পণ্ডিতগণের বিদ্যাবুদ্ধির দ্বারা তাহা সংশোধিত হইবে আশা করিয়াই সাহিত্য-পরিষদে এই বাংলা ভাষাতত্ত্বঘটিত প্রবন্ধের অবতারণা করিলাম।
সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা বাংলা ব্যাকরণে প্রয়োগ করা কিরূপ বিপজ্জনক তাহা মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রীমহাশয় ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করিয়াছেন।[১] সুতরাং জ্ঞাতসারে পাপ করিতে প্রবৃত্তি হয় না। নূতন পরিভাষা নির্মাণের ক্ষমতা নাই, অথচ না করিলেও লেখা অসম্ভব।
এইখানে একটা পরিভাষার কথা বলি। সংস্কৃত ব্যাকরণে যাহাকে ণিজন্ত ধাতু বলে বাংলায় তাহাকে ণিজন্ত বলিতে গেলে অসংগত হয়; কারণ সংস্কৃত ভাষায় ণিচ্ প্রত্যয় দ্বারা ণিজন্ত ধাতু সিদ্ধ হয়, বাংলায় ণিচ্ প্রত্যয়ের কোনো অর্থ নাই। অতএব অন্য ভাষার আকারগত পরিভাষা অবলম্বন না করিয়া প্রকারগত পরিভাষা রচনা করিতে হয়।
ণিজন্তের প্রকৃতি কী। তাহাতে ব্যবহিত ও অব্যবহিত দুইটি কর্তা থাকে। ফল পাড়িলাম; পতন-ব্যাপারের অব্যবহিত কর্তা ফল, কিন্তু তাহার হেতু-কর্তা আমি: কারয়তি যঃ স হেতুঃ— যে করায় সে-ই হেতু, সে-ই ণিজন্ত ধাতুর প্রথম কর্তা, এবং যাহার উপর সেই কার্যের ফল হয় সে-ই ণিজন্ত ধাতুর দ্বিতীয় কর্তা। হেতু-র একটি প্রতিশব্দ নিমিত্ত, তাহাই অবলম্বন করিয়া আমি বর্তমান প্রবন্ধে ণিজন্ত ধাতুকে নৈমিত্তিক ধাতু নাম দিলাম।
বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত বর্তমান প্রবন্ধের বিষয়। তাহার মধ্যে কোন্গুলি প্রকৃত বাংলা ও কোন্গুলি সংস্কৃত তাহা লইয়া তর্ক উঠিতে পারে। সংস্কৃত হইতে উদ্ভূত হইলেই যে তাহাদের সংস্কৃত বলিতে হইবে, এ কথা মানি না। সংস্কৃত ইন্ প্রত্যয় বাংলায় ই প্রত্যয় হইয়াছে, সেইজন্য তাহা সংস্কৃত পূর্বপুরুষের প্রথা রক্ষা করে না। দাগি (দাগযুক্ত) শব্দ কোনো অবস্থাতেই দাগিন হয় না। বাংলা অন্ত প্রত্যয় সংস্কৃত শতৃ প্রত্যয় হইতে উৎপন্ন, কিন্তু তাহা শতৃ প্রত্যয়ের অনুশাসন লঙ্ঘন করিয়া একবচনে জিয়ন্ত ফুটন্ত ইত্যাদি রূপ ধারণ করিতে লেশমাত্র লজ্জিত হয় না।
বাংলায় সংস্কৃতেতর শব্দেও যে-সকল প্রত্যয়ের ব্যবহার হয়, আমরা তাহাকে বাংলাপ্রত্যয় বলিয়া গণ্য করিব। ত প্রত্যয় যোগে সংস্কৃত রঞ্জিত শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে, কিন্তু বাংলায় ত প্রত্যয়ের ব্যবহার নাই, সেইজন্য আমরা রঙিত বলি না। সজ্জিত হয়, সাজিত হয় না; অতএব ত প্রত্যয় বাংলাপ্রত্যয় নহে।
হিন্দি পার্সি প্রভৃতি হইতে বাংলায় যেসকল প্রত্যয়ের আমদানি হইয়াছে, সে সম্বন্ধেও আমার ওই একই বক্তব্য। এই প্রত্যয় সম্ভবত হিন্দি বা পার্সি; কিন্তু বাংলা শব্দের সহিত তাহা মিশ্রিত হইয়া ট্যাঁঁকসই প্রমাণসই মানানসই প্রভৃতি শব্দ সৃজন করিয়াছে। ওয়ান প্রত্যয় সেরূপ নহে। গাড়োয়ান দারোয়ান পালোয়ান শব্দ আমরা হিন্দি হইতে বাংলায় পাইয়াছি, প্রত্যয়টি পাই নাই।
অর্থাৎ যে-সকল প্রত্যয় সংস্কৃত অথবা বিদেশীয় শব্দসহযোগে বাংলায় আসিয়াছে, বাংলার সহিত কোনােপ্রকার আদানপ্রদান করিতেছে না, তাহাকে আমরা বাংলা ব্যাকরণে প্রত্যয়রূপে স্বীকার করিতে পারি না।
যে-সকল কৃৎ-তদ্ধিতের সাহায্যে বাংলা বিশেষ্য ও বিশেষণ পদের সৃষ্টি হয়, বর্তমান প্রবন্ধে কেবল তাহারই উল্লেখ থাকিবে। ক্রিয়াপদ সম্বন্ধে বারান্তরে আলােচনার ইচ্ছা রহিল।
এই প্রবন্ধে বিশেষ্য বিশেষণকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছি, ক্রিয়াবাচক ও পদার্থবাচক। ক্রিয়াবাচক বিশেষ যথা, চলা বলা সাঁঁৎরানাে বাঁচানাে ইত্যাদি। পদার্থবাচক যথা, হাতি ঘােড়া জিনিসপত্র ঢেঁঁকি কুলা ইত্যাদি। গুণবাচক প্রভৃতি বিশেষ্য বিশেষণের প্রয়ােজন হয় নাই।
অ প্রত্যয়
এই প্রত্যয়যােগে একশ্রেণীর বিশেষণ শব্দের সৃষ্টি হয়; যথা, কট্মট্ শব্দের উত্তর অ প্রত্যয় হইয়া কটমট (কটমট ভাষা, কটমট দৃষ্টি), টল্মল্ হইতে টলমল।[২]
আসন্নপ্রবণতা বুঝাইবার জন্য শব্দদ্বৈত-যােগে যে-বিশেষণ হয় তাহাতে এই অ প্রত্যয়ের হাত আছে; যথা, পড়্ ধাতু হইতে পড়-পড়, পাক্ ধাতু হইতে পাক-পাক, মর্ ধাতু হইতে মরমর, কাঁঁদ ধাতু হইতে কাঁঁদ-কাঁঁদ। অন্য অর্থে হয় না; যথা, কাটাকাটা (কথা), পাকাপাকা ছাড়াছাড়া ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয়ে পাঠকদের মনােযােগ আকৰ্ষণ করিতে চাই। মনে পড়িতেছে, রামমােহন রায় তাহার বাংলা ব্যাকরণে লিখিয়াছেন, বাংলায় বিশেষণ পদ হলন্ত হয় না। কথাটা সম্পূর্ণ প্রামাণিক নহে, কিন্তু মােটের উপর বলা যায়, খাস বাংলার অধিকাংশ দুই অক্ষরের বিশেষণ হলন্ত নহে। বাংলা- উচ্চারণের সাধারণ নিয়মমতে ‘ভাল’ শব্দ ভাল্ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমরা অকারান্ত উচ্চারণ করি।[৩] বস্তুত বাংলায় অকারান্ত বিশেষ্য শব্দ অতি অল্পই দেখা যায়, অধিকাংশই বিশেষণ; যথা, বড় ছােট মাঝ (মাঝে মেঝাে) ভাল কাল খাট (ক্ষুদ্র) জড় (পুঞ্জীকৃত) ইত্যাদি।
বাকি অনেকগুলা বিশেষণই আকারান্ত; যথা, কাঁচা পাকা বাঁকা তেড়া সােজা সিধা সাদা মােটা মুলা বােবা কালা ন্যাড়া কানা তিতা মিঠা উচা বােকা ইত্যাদি।
আ প্রত্যয়
পূর্বোক্ত আকারান্ত বিশেষণগুলিকে আ প্রত্যয়যােগে নিষ্পন্ন বলিয়া অনুমান করিতেছি। সংস্কৃত শব্দ কাণ, বাংলায় বিশেষণ হইবার সময় কানা হইল, হইতে মড়া হইল, মহৎ হইতে মােটা হইল, সিত হইতে সাদা হইল। এই আকারগুলি উচ্চারণের নিয়মে আপনি আসে নাই। বিশেষণে হলন্ত প্রয়ােগ বর্জন করিবার একটা চেষ্টা বাংলায় আছে বলিয়াই যেখানে সহজে অন্য কোনাে স্বরবর্ণ জোটাইতে পারে নাই, সেই-সকল স্থলে আ প্রত্যয় যােগ করিয়াছে। সংস্কৃত ভাষার ‘স্বার্থে ক’ বাংলায় আ প্রত্যয়ের আকার ধারণ করিয়াছে। ঘােটক ঘােড়া, মস্তক মাথা, পিষ্টক পিঠা, কণ্টক কাঁঁটা, চিপিটক চিঁঁড়া, গােপালক গােয়ালা, কুলক কুলা।
বাংলায় অনেক শব্দ আছে যাহা কখনাে বা স্বার্থে আ প্রত্যয় গ্রহণ করিয়াছে, কখনাে করে নাই; যেমন তক্ত তক্তা, বাঘ বাঘা, পাট পাটা, ল্যাজ ল্যাজা, চোঙ চোঙা, চাঁঁদ চাঁঁদা, পাত পাতা, ভাই ভাইয়া (ভায়া,) বাপ বাপা, থাল থালা, কালাে কালা, তল তলা, ছাগল ছাগলা, বাদল বাদলা, পাগল পাগ্লা, বামন বাম্না, বেল (ফুল) বেলা, ইলিশ ইল্শা (ইল্শে)।
এই আ প্রত্যয়যােগে অনেক স্থলে অবজ্ঞা বা অতিপরিচয় জ্ঞাপন করে, বিশেষত মানুষের নাম সম্বন্ধে; যথা, রাম রামা, শাম শামা, হরি হরে (হরিয়া), মধু মােধো (মধুয়া), ফটিক ফট্কে (ফট্কিয়া)।
দ্রষ্টব্য এই যে, সকল নামে আ প্রত্যয় হয় না; যাদবকে যাদ্বা, মাধবকে মাধ্বা বলে না। শ্রীশ, প্রিয়, পরান প্রভৃতিও এইরূপ। বাংলা নামের বিকার সম্বন্ধে কোনাে পাঠক আলােচনা সম্পূর্ণ করিয়া দিলে আনন্দিত হইব।
স্বার্থে আ প্রত্যয়ের উদাহরণ দেওয়া গেছে, তাহাতে অর্থের পরিবর্তন হয় না। আবার, আ প্রত্যয়ে অর্থের কিছু পরিবর্তন ঘটে এমন উদাহরণও আছে; যেমন, হাত হইতে হাতা (বন্ধনের হাতা, জামার হাতা, অর্থাৎ হাতের মতো পদার্থ), ঠ্যাঙ হইতে ঠ্যাঙা (ঠ্যাঙের ন্যায় পদার্থ), ভাত হইতে ভাতা (খােরাকি), বাস হইতে বাসা, ধোব হইতে থােবা, চাষ হইতে চাষা।
ধাতুর উত্তর আ প্রত্যয়যােগে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বিশেষণের সৃষ্টি হয়। বাঁধ্ ধাতুর উত্তর আ প্রত্যয় করিয়া বাঁধা, ঝর ধাতুর উত্তর আ প্রত্যয় করিয়া ঝরা। ইহারা বিশেষ্য বিশেষণ উভয় ভাবেই ব্যবহৃত হয়। বিশেষণ যেমন বাঁঁধা হাত; বিশেষ্য যেমন, হাত বাঁধা।
দ্রষ্টব্য এই যে, কেবল একমাত্রিক অর্থাৎ monosyllabic ধাতুর উত্তর এইরূপ আ প্রত্যয় হইয়া দুই অক্ষরের বিশেষ্য বিশেষণ সৃষ্টি করে, যেমন ধর্ মার্ চল্ বল্ হইতে ধরা মারা চলা বলা। বহুমাত্রিক ধাতু বা ক্রিয়াবাচক শব্দের উত্তর আ সংযােগ হয় না। যেমন, আঁচড় হইতে আঁচ্ড়া, আছাড় হইতে আছ্ড়া হয় না।
কিন্তু শুদ্ধমাত্র বিশেষণরূপে হইতে পারে; যেমন, থ্যাঁঁৎলা মাংস, কোঁকড়া চুল, বাঘ-আঁচ্ড়া গাছ, নেই-আঁক্ড়া লােক (ন্যায়-আঁকড়া অর্থাৎ নৈয়ায়িক তার্কিক)।
ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বিশেষণের দৃষ্টান্ত উপরে দেওয়া গেল। আ প্রত্যয় যােগে নিষ্পন্ন পদার্থবাচক ও গুণবাচক বিশেষ্যের দৃষ্টান্ত দুই-একটি মনে পড়িতেছে; তাওয়া (যাহাতে রুটিতে তা দেওয়া যায়), দাওয়া (দাবি, অর্থাৎ দাও বলিবার অধিকার), আছ্ড়া (আঁটি হইতে ধান আছড়াইয়া লইয়া যাহা অবশিষ্ট থাকে)।
বিশিষ্ট অর্থে আ প্রত্যয় হইয়া থাকে; যথা, তেলবিশিষ্ট তেলা, বেতালবিশিষ্ট বেতালা, বেসুরবিশিষ্ট বেসুরা, জলময় জলা, জুনবিশিষ্ট নােনা (লবণাক্ত), আলােকিত আলা, রোগযুক্ত রোগা, মলযুক্ত ময়লা, চালযুক্ত চালা (ঘর), মাটিযুক্ত মাটিয়া (মেটে), বালিযুক্ত বালিয়া (বেলে), দাড়িযুক্ত দাড়িয়া (দেড়ে)।
বৃহৎ অর্থে আ প্রত্যয়; যথা, হাঁড়া (ক্ষুদ্র হাঁড়ি); নােড়া (লােষ্ট্র হইতে; ক্ষুদ্র নুড়ি)।
আন্ প্রত্যয়
আন্ প্রত্যয়ের দৃষ্টান্ত: যােগান্ চাপান্ চালান্ জানান্ হেলান্ ঠেসান্ মানান্।
এগুলি ছাড়া একপ্রকার বিশেষ পদবিন্যাসে এই আন্ প্রত্যয়ের ব্যবহার দেখা যায়। ঠকা হইতে ঠকান্ শব্দ বাংলায় সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু আমরা বলি, ভারি ঠকান্ ঠকেছি, অথবা, কী ঠকান্টাই ঠকিয়েছে। সেইরূপ কী পিটান্টাই পিটিয়েছে, কী ঢলান্টাই ঢলিয়েছে, এরূপ বিস্ময়সূচক পদবিন্যাসের বাহিরে পিটান্ ঢলান্ ব্যবহার হয় না।
উপরের দৃষ্টান্তগুলি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য। পদার্থবাচকের দৃষ্টান্তও আছে; যথা, বানান্ উঠান্ উনান্ উজান্ (উর্ধ্ব—উঝ+ আন্) ঢালান্ (জলের) মাচান্ (মঞ্চ)।
আন্+অ প্রত্যয়
আন্ প্রত্যয়ের উত্তর পুনশ্চ অ প্রত্যয় করিয়া বাংলায় অনেকগুলি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বিশেষণের সৃষ্টি হয়।
পূর্বে দেখানাে গিয়াছে, একমাত্রিক ধাতুর উত্তর আ প্রত্যয় করিয়া ক্রিয়াবাচক দুই অক্ষরের বিশেষ্য বিশেষণ সিদ্ধ হয়; যেমন, ধরা মারা ইত্যাদি।
বহুমাত্রিকে আ প্রত্যয় না হইয়া আন্ ও তদুত্তরে অ প্রত্যয় হয়; যেমন, চুল্কান (উচ্চারণ চুলকানাে) কাম্ড়ান (কামড়ানাে) ছটফটান (ছট্ফটানাে) ইত্যাদি।
কিন্তু সাধারণত নৈমিত্তিক ক্রিয়াপদকেই ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বিশেষণে পরিণত করিতে আন্+অ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়; যেমন, করা শব্দ হইতে নৈমিত্তিক অর্থে করান, বলা হইতে বলান।
ইহাই সাধারণ নিয়ম, কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন পড়া হইতে নৈমিত্তিক পাড়া, চলা হইতে চালা, গলা হইতে গালা, নড়া হইতে নাড়া, জ্বলা হইতে জ্বালা, মরা হইতে মারা, বহা হইতে বাহা, জরা হইতে জারা।
কিন্তু পড়া হইতে পড়ান, নড়া হইতে নড়ান, চলা হইতে চলান, ইহাও হয়। এমন-কি, নৈমিত্তিক ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য শব্দ চালা নাড়া পাড়া প্রভৃতির উত্তর পুনশ্চ আন্+অ যােগ করিয়া, চালান পাড়ান নাড়ান হইয়া থাকে
কিন্তু তাকান গড়ান (বিছানায়) আঁচান প্রভৃতি অনৈমিত্তিক শব্দ সম্বন্ধে কী বুঝিতে হইবে। তাকা গড়া আঁচা, হইল না কেন।
তাহার কারণ, এইগুলির মূল ধাতু একমাত্রিক নহে। দেখ্, একমাত্রিক ধাতু, তাহা হইতে ‘দেখা হইয়াছে; কিন্তু তাকান শব্দের মূল ধাতুটি তাক্ নহে, তাহা তাকা, সেইজন্যই উক্ত ধাতুকে বিশেষ করিতে আন্+অ প্রত্যয়ের প্রয়ােজন হইয়াছে। নামধাতুগুলিও আন্+অ প্রত্যয়ের অপেক্ষা রাখে; যেমন, লাথ্ হইতে লাথান, পিঠ্ হইতে পিঠান (পিটোনাে), হাত হইতে হাতান।
মূল ধাতু বহুমাত্রিক কি না, তাহার পরীক্ষার অন্য উপায় আছে। অনুজ্ঞায় আমরা দেখ্ ধাতুর উত্তর ‘ও’ প্রত্যয় করিয়া বলি, দেখাে, কিন্তু তাকো বলি না; তাকা ধাতুর উত্তর ও প্রত্যয় করিয়া বলি তাকাও। গঠন করাে, বলিতে হইলে গড়্ ধাতুর উত্তর ও প্রত্যয় করিয়া বলি গড়াে, কিন্তু শয়ন করো, বুঝাইতে হইলে গড়া ধাতুর উত্তর ও প্রত্যয় করিয়া বলি গড়াও।
আমাদের বহুমাত্রিক ক্রিয়াবাচক শব্দগুলি আকারান্ত, সেইজন্য পুনশ্চ তাহার উত্তর আ প্রত্যয় না হইয়া আন্+অ প্রত্যয় হয়। মূল শব্দটি আট্কা বা চম্কা না হইলে অনুজ্ঞায় আট্কাও হইত না, চম্কাও হইত না। হিন্দিতে পাক্ড়্ শব্দের উত্তর ও প্রত্যয় হইয়া পাকড়াে হয়; সেই শব্দই বাংলায় পাড়া রূপ ধরিয়া পাকড়াও হইয়া দাঁড়ায়।
অন্ প্রত্যয়
দৃষ্টান্ত: মাতন্ চলন্ কাঁঁদন্ গড়ন্ (গঠনক্রিয়া) ইত্যাদি। ইহারা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য শব্দ।
অন্ প্রত্যয়সিদ্ধ পদার্থবাচক শব্দের উদাহরণও মনে পড়ে; যেমন, ঝাড়অন্ বেলুন্ (রুটি বেলিবার) মাজন্ গড়ন্ (শরীরের) ফোড়ন্ ঝোঁঁটন (ঝুঁঁটি হইতে) পাঁচন্।
অন্+আ প্রত্যয়
অন্ প্রত্যয়ের উত্তর পুনশ্চ আ প্রত্যয় করিয়া কতকগুলি ক্রিয়াবাচক বিশেষণের সৃষ্টি হইয়াছে; ইহারা বিয়ে বিশেষ্যও হয়; যেমন, পাওন্ হইতে পাওনা, দেওন্ হইতে দেনা, ফেলন্ হইতে ফেল্না, মাগ্ন্ হইতে মাগ্না, শুকন্ হইতে শুক্না।
পদার্থবাচক বিশেষ্যেরও দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, বাট্না কুট্না ওড়্না ঝর্না খেলনা বিছানা বাজ্না ঢাক্না।
ই প্রত্যয়
ধর্ম ও ব্যবসায় অর্থে: গােলাপি বেগুনি চালাকি চাকরি চুরি ডাক্তারি মােক্তারি ব্যারিস্টারি মাস্টারি; খাড়াই (খাড়া পদার্থের ধর্ম) লম্বাই চৌড়াই ঠাণ্ডাই আড়ি (আড় অর্থাৎ বক্র হইবার ভাব)।
অনুকরণ অর্থে: সাহেবি নবাবি।
দক্ষ অর্থে: হিসাবদ হিসাবি, আলাপক্ষ আলাপি, ধ্রুপদ ধ্রুপদি।
বিশিষ্ট অর্থে: দামবিশিষ্ট দামি, দাগবিশিষ্ট দাগি, রাগবিশিষ্ট রাগি, ভারবিশিষ্ট ভারি।
সূত্র অর্থে: হাঁড়ি পুটুলি কাঠি (ইহাদের বৃহৎ—হাঁঁড়া পোঁটলা কাঠ)।
দেশীয় অর্থে: মারাঠি গুজরাটি আসামি পাটনাই বস্রাই।
স্বার্থে: হাস হাসি, ফাঁঁস ফঁসি, লাথ লাথি, পাড় (পুকুরের) পাড়ি, কড়া কড়াই (কটাহ)।
দিননির্দেশ অর্থে: পাঁঁচই ছউই সাতই আটই নওই দশই, এইরূপে আঠারই পর্যন্ত।
আ+ই প্রত্যয়
ক্রিয়াবাচক: বাছাই যাচাই দলাই-মলাই (ঘােড়াকে) খােদাই ঢালাই ধােলাই ঢােলাই বাঁধাই পালটাই।
পদার্থবাচক: মরাই (ধানের) বালাই (বালকের অকল্যাণ) মিঠাই।
মনুষ্যের নাম: বলাই কানাই নিতাই জগাই মাধাই।
ধর্ম: বড়াই (বড়ত্ব) বামনাই পােষ্টাই(পুষ্টের ধর্ম)।
ই+আ প্রত্যয়
জাল শব্দ ই প্রত্যয়যােগে জালি, স্বার্থে আ— জালিয়া (জেলে)। এইরূপ, কোঁঁদলিয়া (কুঁদুলে) জঙ্গলিয়া (জঙ্গুলে) গােবরিয়া (গুবরে), স্যাঁঁৎস্যাঁঁতিয়া (স্যাঁঁৎসেঁঁতে) ইত্যাদি।
উ প্রত্যয়
চালু (চলনশীল) ঢালু (ঢাল-বিশিষ্ট) নিচু (নিম্নগামী) কলু (ঘানিফল বিশিষ্ট), গাড়ু (গাগর শব্দ হইতে গাগরু) আগুপিছু (অগ্রবর্তী-পশ্চাদ্বর্তী)।
মানুষের নাম: যাদব হইতে যাদু, কালা হইতে কালু, শিব হইতে শিবু, পাঁচকড়ি হইতে পাঁচু।
উ+আ প্রত্যয়
বিশিষ্ট অর্থে, যথা: জলবিশিষ্ট জলুয়া (জোলাে), পাঁঁকুয়া (পেঁকো) জাঁঁকুয়া (জেঁকো) বাতুয়া (বেতে) পড়ুয়া (পােড়ো)।
সম্বন্ধ অর্থে: মাছুয়া (মেছো) বুনুয়া (বুনো) ঘরুয়া (ঘােরো) মাঠুয়া (মেঠো)।
নির্মিত অর্থে: কাঠুয়া (কেঠো) ধানুয়া (ধেনো)
আ+ও প্রত্যয়
ঘেরাও চড়াও উধাও ফেলাও (ফলাও)।
ও+আ প্রত্যয়
বাঁঁচোয়া ঘরোয়া চড়ােয়া ধরােয়া আগােয়া।
অন্+ই প্রত্যয়
মনােযােগ করিলে দেখা যাইবে, অন্ প্রত্যয়ের উত্তর আ প্রত্যয় কেবল একমাত্রিক ধাতুতেই প্রয়ােগ হইয়া থাকে; যেমন, ধর্ হইতে ধর্না (ধন্না), কাঁঁদ্ হইতে কাঁঁদ্না (কান্না)। কিন্তু বহুমাত্রিক শব্দের উত্তর এরূপ হয় না। আমরা কামড়ানা কটকটানা বলি না, তাহার স্থলে কামড়ানি কটকটানি বলিয়া থাকি; অর্থাৎ অন্ প্রত্যয়ের উত্তর আ প্রত্যয় না করিয়া ই প্রত্যয় করিয়া থাকি।
অন্ প্রত্যয়ের উত্তর ই প্রত্যয় একমাত্রিকেও হয়; যথা মাতনি (মাতুনি) বাঁঁধনি (বাঁধুনি) জ্বলনি (জ্বলুনি) কাঁঁপনি (কাঁঁপুনি) দাপনি (দাপুনি) আঁটনি (আঁটুনি)।
মূল ধাতুটি হলন্ত কিংবা আকারান্ত, তাহা এই অন্+ই প্রত্যয়ের সাহায্যে জানা যাইতে পারে। তাকনি না হইয়া তাকানি হইয়াছে, তখন বুঝিতে হইবে মূল ধাতুটি তাকা। এইরূপ, আছড়া চট্কা কাম্ড়া ইত্যাদি।
অন্+ই প্রত্যয়সিদ্ধ অধিকাংশ ক্রিয়াবাচক শব্দই অপ্রিয়ভাব ব্যক্ত করে; যথা, বকুনি ধমকানি চমকানি হাঁপানি শাসানি টাটানি নাকানি-চোবানি কাঁঁদুনি জ্বলুনি কাঁঁপুনি ফোঁঁস্লানি ফেঁপানি গােঙানি ঘ্যাঙানি খ্যাঁঁচ্কানি কোঁচ্কানি (ভুরু) বাঁকানি (মুখ) খিঁঁচুনি (দাত) খ্যাঁঁকানি ঘস্ড়ানি ঘুরুনি (চোখ) চাপুনি চেঁচানি ভ্যাঙানি (মুখ) রগড়ানি রাঙানি (চোখ) লাফানি ঝাঁঁপানি।
ব্যতিক্রম: বাঁধুনি (কথার) শুনানি দুলুনি বুনুনি (কাপড় বা ধান) বাছনি (বাছাই)।
ধ্বন্যাত্মক শব্দের মধ্যে যেগুলি অসুখব্যঞ্জক তাহার উত্তরেই অ+ই প্রত্যয় হয়; যথা, দব্দবানি ঝন্ঝনানি কন্কনানি টন্টনানি ছট্ফটানি কুট্কুটুনি ইত্যাদি।
অ+ই প্রত্যয়ের সাহায্যে বাংলার কয়েকটি পদার্থবাচক বিশেষ্যপদ সিদ্ধ হয়; দৃষ্টান্ত, ছাকনি নিড়নি চালুনি বিননি (চুলের) চাটুনি ছাউনি নিছনি তলানি (তরলপদার্থের তলায় যাহা জমে)।
ব্যক্তি ও বস্তুর বিশেষণ: রাঁধুনি (ব্রাহ্মণ) ঘুম-পাড়ানি পাট-পচানি ইত্যাদি।
না প্রত্যয়
না প্রত্যয়যােগে বর্ণের বিশেষ পরিবর্তন হয় না; পাখা পাখনা, জাব (গোরুর) জাবনা, ফাতা (ছিপের) ফাৎনা, ছােট ছােটনা (ধান)।
আনা প্রত্যয়
বাবুয়ানা সাহেবিয়ানা নবাবিয়ান মুনশীয়ানা। ই প্রত্যয় করিয়া হিঁঁদুয়ানি।
ল্ প্রত্যয়
কাঁঁকড়ােল (কাঁঁকুড় হইতে) হাবল খাবল পাগল পাকল (পাক অর্থাৎ ঘূর্ণাবিশিষ্ট) হাতল মাতল (মত্ত হইতে মাতা)।
র্ প্রত্যয়
বাংলা ধন্যাত্মক শব্দের উত্তর এই র্ প্রত্যয়ে অবিরামতা বুঝায়; যথা, গজ্গজ্ হইতে গজর্ গজর্, বক্বক্ হইতে বকর্ বকর্, নড়্বড়্ হইতে নড়র্ বড়র্, কট্মট্ হইতে কটর্ মটর্, ঘ্যান্ঘ্যান্ হইতে ঘ্যানর্ ঘ্যানর্, কুট্কুট্ হইতে কুটুর্ কুটুর্।
আল্ প্রত্যয়
দয়াল্ কাঙাল্ (কাঙ্ক্ষালু) আঁঠিয়াল্ আড়াল মিশাল।
ল্+আ
মেঘলা বাদলা পাতলা শামলা আধলা ছ্যাৎলা একলা দোকলা চাকলা।
ল্+ই+আ
দীঘলিয়া (দীঘ্লে) আগলিয়া (আগ্লে) পাছলিয়া (পাছ্লে) ছুটলিয়া (ছুট্লে)।
আড়্
জোগাড় লাগাড় (নাগাড়) সাবাড় লেজুড় খেলােয়াড় উজাড়।
আড়্+ই+আ
বাসাড়িয়া (বাসাড়ে) জোগাড়িয়া (জোগাড়ে) মজাড়িয়া (মজাড়ে) হাতাড়িয়া (হাতুড়ে, যে হাতড়াইয়া বেড়ায়) কাঠুরে হাটুরে ঘেসুড়ে ফাঁঁসুড়ে চাষাড়ে।
রা ও ড়া
টুকরা চাপড় ঝাঁকড়া পেটরা চামড়া ছোকড়া গাঁঠরা ফোঁঁপরা ছিবড়া থাবড়া বাগড়া খাগড়া
বহু অর্থে: রাজারাজড়া গাছগাছড়া কাঠকাঠরা।
আরি
জুয়ারি কাঁঁসারি চুনারি পুজারি ভিখারি।
আরু
সজারু (শল্যবিশিষ্ট জন্তু) লাফারু (কোনো কোনো প্রদেশে খরগােশকে বলে) দাবাড়ু (দাবা খেলায় মত্ত)।
ক্
মড়ক চড়ক মােক বৈঠক চটক ঝলক চমক আটক।
আক্ উক্ ইক্
এই-সকল প্রত্যয়যােগে যে ক্রিয়ার বিশেষণগুলি হয় তাহাতে দ্রুতবেগ বুঝায়; যথা, ফুড়ুক্ তিড়িক্ তড়াক্ চিড়িক্ ঝিলিক্ ইত্যাদি।
ক্+আ
মট্কা বোঁচ্কা হাল্কা বো্ঁটকা হোঁৎকা উচক্কা। ক্ষুদ্রার্থে ই প্রত্যয় করিয়া মট্কি, বুঁঁচকি ইত্যাদি হয়।
ক্+ই+আ
শুট্কিয়া (শুট্কে) পুঁঁট্কিয়া (পুঁঁট্কে) পুঁঁচকিয়া (পুঁঁচ্কে) ফচ্কিয়া (ফচ্কে) ছোট্কিয়া (ছুট্কে)।
উক্
মিথ্যুক লাজুক মিশুক।
গির্+ই
গির্ প্রত্যয়টি বাংলায় চলে নাই। তাগাদ্গির প্রভৃতি শব্দগুলি বিদেশী। কিন্তু এই গির্ প্রত্যয়ের সহিত ই প্রত্যয় মিশিয়া গিরি প্রত্যয় বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করিয়াছে।
ব্যবসায় অর্থে ই প্রত্যয় সর্বত্র হয় না। কামারের ব্যবসায়কে কেহ কামারি বলে না, বলে কামারগিরি। এই গির্+ই যােগে অধিকাংশ ব্যবসায় ব্যক্ত হয়; অ্যাটর্নিগিরি স্যাকরাগিরি মুচিগিরি মুটেগিরি।
অনুকরণ অর্থে: বাবুগিরি নবাবগিরি।
দার্
দোকানদার চৌকিদার রঙদার বুটিদার জেল্লাদার যাচনদার চড়নদার ইত্যাদি।
ইহার সহিত ই প্রত্যয় যুক্ত হইয়া দোকানদারি ইত্যাদি বৃত্তিবাচক বিশেষ্যের সৃষ্টি হয়।
দান্
বাতিদান পিকদান শামাদান আতরদান। স্বার্থে ই প্রত্যয়যােগে বাতিদানি পিকদানি আতরদানি হইয়া থাকে।
সই
হাতসই মাপসই প্রমাণসই মানানসই ট্যাঁঁকসই।
পনা
বুড়াপনা ন্যাকাপনা ছিব্লেপনা গিন্নিপনা।
ওলা বা ওয়ালা
কাপড়ওয়ালা ছাতাওয়ালা ইত্যাদি।
তর
এমনতর যেমন্তর কেমনতর।
অৎ
মানৎ বসৎ ঘুরৎ ফেরৎ গলৎ (গলদ)।
ধ্বন্যাত্মক শব্দের উত্তর অৎ প্রত্যয়ে দ্রুতবেগ বুঝায়: সড়াৎ ফুড়ৎ পটাৎ খটাৎ।
অৎ+আ
ধর্তা ফের্তা পড়্তা জান্তা (সবজান্তা)।
তা
বিশিষ্ট অর্থে, যথা: পান্তা নােন্তা তল্তা (তরল্তা, তরল বাঁশ)। আওতা নাম্তা শব্দের ব্যুৎপত্তি বুঝা যায় না।
অৎ+ই
ফির্তি চল্তি উঠ্তি বাড়্তি পড়্তি চুক্তি ঘাঁট্তি গুন্তি।
অৎ+আ+ই
খােল্তাই ধর্তাই।
অন্ত
জিয়ন্ত ফুটন্ত চলন্ত।
মন্ত
লক্ষ্মীমন্ত বুদ্ধিমন্ত আক্কেলমন্ত।
অন্দা (?)
বাসন্দা (অধিবাসী) মাকন্দা (গুম্ফশ্মশ্রুবিহীন)। বলা উচিত এ প্রত্যয়টির প্রতি আমার বিশেষ আস্থা নাই।
ট্
চাপট্ (চৌচাপট্) সাপট্ ঝাপট্ দাপট্।
ট্+ই
চিম্টি।
ট্ট
ভরট্ট (নদীভরট্ট, খালভরট্ট জমি)।
আ+ট্
জমাট্ ভরাট্ ঘেরাট্।
টা
চ্যাপ্টা ল্যাঙ্টা ঝাপ্টা ল্যাপ্টা চিম্টা শুক্টা।
আট্+ই+আ
রােগাটিয়া (রােগাটে) বােকাটিয়া (বােকাটে) তামাটিয়া (তামাটে) ঘােলাটিয়া (ঘােলাটে) ভাড়াটিয়া (ভাড়াটে) বামন্টিয়া (বেঁঁটে)।
অং আং ইং
ভড়ং ভুজং-ভাজাং চোং (নল) খােলাং (খােলং কুচি) তিড়িং। বড়াং, কোনাে কোনাে জেলায় অহংকার অর্থে বড়াই না বলিয়া বড়াং বলে।
অঙ্গ আঙ্গ অঙ্গিয়া
সুড়ঙ্গ সুড়ঙ্গি সুডুঙ্গে কুলঙ্গি ধিঙ্গি ধেড়েঙ্গে বিরিঙ্গি (বৃহৎ পরিবারকে কোনাে কোনাে প্রদেশে ‘বিরিঙ্গি গুষ্টি’ বলে)।
চ চা চি
আল্গচ (আলগা ভাব) ল্যাংচা (খােঁঁড়ার ভাব) ভ্যাংচা (ব্যঙ্গের ভাব) ভাংচি খিম্চি ঘামাচি ত্যাড়্চা (তির্যক ভাব)। আধার অর্থে: ধুনচি ধুপচি খুঞ্চি চিলিচি খাতাঞ্চি মশাল্চি।
ক্ষুদ্র অর্থে: ব্যাঙাচি নলচি (হ কার) কঞ্চি কুচি; মােচা (কলার মােচা, মুকুলচা হইতে মােচা); মােচার ক্ষুদ্র মুচি।
অস্
খােলস্ মুখস্ তাড়স্ ঢ্যাপস্।
ধ্বন্যাত্মক শব্দের উত্তর অস্ প্রত্যয়ে স্থূলতা ও ভার বুঝায়— ধপ হইতে ধপাস্; ব্যাপ্তি বুঝায়, যথা, ধড়াস্ করিয়া পড়া— অপেক্ষাকৃত বিস্তীর্ণ স্থান লইয়া পড়া; খট্ এবং খটাস্, পট্ এবং পটাস্ শব্দের সূক্ষ্ম অর্থভে নির্দেশ করিতে গেলে পাঠকদের সহিত তুমুল তর্ক উপস্থিত হইবে আশা করি।
সা
চোপ্সা গােম্সা ঝাপ্সা ভাপ্সা চিম্সা পান্সা ফেন্সা এক্সা খোলসা মাকড়সা কাল্সা।
সা+ইয়া
ফ্যাকাসিয়া (ফ্যাকাসে), লাল্চে সম্ভবত লাল্সে কথার বিকার, কাল্সিটে— কাল্+সা+ইয়া+টা=কাল্সিয়াটা কাল্সিটে।
আম
অনুকরণ অর্থে: বুড়ামে ছেলেমো পাগ্লামাে জ্যাঠামাে বাঁঁদরামো।
ভাব অর্থে: মাৎলামাে ঢিলেমো আল্সেমাে।
আম+ই
বুড়ামি মাৎলামি ইত্যাদি।
স্ত্রীলিঙ্গে ই
ছুঁঁড়ি ছুক্রি বেটি খুড়ি মাসি পিসি দিদি পাঁঁঠি ভেড়ি বুড়ি বাম্নি।
স্ত্রীলিঙ্গে নি
কলুনি তেলিনি গয়লানি বাঘিনি মালিনি ধোবানি নাপ্তিনি কামার্নি চামার্নি পুরুত্নি মেত্রানি তাঁঁতমি ঠাকুরানি চাক্রানি উড়েনি কায়েত্নি খােট্টানি মুসলমান্নি জেলেনি।
বাংলা কৃৎ তদ্ধিত আমার যতগুলি মনে পড়িল লিখিলাম। নিঃসন্দেহই অনেকগুলি বাদ পড়িয়াছে; সেগুলি পূরণের জন্য পাঠকদের অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।
ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের অধিবাসীরা প্রাদেশিক প্রয়ােগের দৃষ্টান্ত যত সংগ্রহ করিয়া পাঠাইবেন, ততই কাজে লাগিবে।
প্রত্যয়গুলির উৎপত্তি নির্ণয় করাও বাকি রহিল। এসম্বন্ধে যাহারা আলােচনা করিতে ইচ্ছা করেন, তাহারা ডাক্তার হ্যর্নলে-চিত Comparative Grammar of the Gaudian Languages পুস্তক হইতে যথেষ্ট সাহায্য পাইবেন।
প্রত্যেক প্রত্যয়জাত শব্দের তালিকা সম্পূর্ণ করা আবশ্যক। ইহা নিশ্চয়ই পাঠকেরা লক্ষ করিয়াছেন, প্রত্যয়গুলির মধ্যে পক্ষপাতের ভাব দেখা যায়। তাহাৱা কেন যে কয়টিমাত্র শব্দকে বাছিয়া লয়, বাকি সমস্তকেই বর্জন করে, তাহা বুঝা কঠিন। তালিকা সম্পূর্ণ হইলে তাহার নিয়ম আবিষ্কারের আশা করা যাইতে পারে। মন্ত প্রত্যয় কেনই বা আক্কেল শব্দকে আশ্রয় করিয়া আক্কেলমন্ত হইবে, অথচ চালাকি শব্দের সহযােগে চালাকিমন্ত হইতে পারিল না, তাহা কে বলিবে। নি যােগে বহুতর বাংলা স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে— কামাৱনি খােট্টানি ইত্যাদি। কিন্তু বদ্যিনি (বৈদ্য-স্ত্রী) কেহ তাে বলে না; উড়েনি বলে, কিন্তু পাঞ্জাবিনি বা শিখিনি বা মগিনি বলে না। বাঘিনি হয়, কিন্তু উটিনি হয় না, কুকুরনি বেড়ালনি হয় না। প্রত্যয়যােগে স্ত্রীলিঙ্গ অনেক স্থলে হয়ই না, সেই কারণে মাদি কুকুর বলিতে হয়। পাঁঁঠার স্ত্রীলিঙ্গে পাঠি হয়, মােষের স্ত্রীলিঙ্গে মােষি হয় না। এ-সমস্ত অনুধাবন করিবার যোগ্য।
কোন্ প্রত্যয়যােগে শব্দের কী প্রকার রূপান্তর হয় তাহাও নিয়ম করিয়া লেখা আবশ্যক। নিতান্তই সময়াভাব-বশত আমি সে কাজে হাত দিতে পারি নাই। নােড়া শব্দের উত্তর ই প্রত্যয় করিলে হয় নুড়ি; দাড়ি শব্দের উত্তর আ প্রত্যয় করিলে হয় দেড়ে; টোল শব্দের উত্তর আ প্রত্যয় করিলে টুলাে; মধু শব্দের উত্তর আ প্রত্যয় করিলে হয় মােধো; লুন্ শব্দের উত্তর আ প্রত্যয় করিলে হয় লােনা; জ্বল্ শব্দের উত্তর অন্+ই প্রত্যয় করিতে হয় জ্বলুনি, কোঁঁদল শব্দের উত্তর ই+আ প্রত্যয় করিলে হয় কুঁদুলে।
কতকগুলি প্রত্যয় আমি আনুমানিক ভাবে দিয়াছি। সেগুলিকে প্রত্যয় বলিয়া বিশ্বাস করি, কিন্তু শব্দ হইতে তাহাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাদের প্রত্যয়রূপ প্রমাণ করিতে পারি নাই। যেমন, অং প্রত্যয়; ভুজং ভড়ং প্রভৃতি শব্দের অং বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে তাহা বাংলায় চলিত নাই। ভড়্ শব্দ নাই বটে, কিন্তু ভড়্কা আছে, ভড়ং এবং ভড়কের অর্থসাদৃশ্য আছে। তাই মনে হয়, ভড়্, বলিয়া একটা আদিশব্দ ছিল, তাহার উত্তরে অক্ করিয়া ভড়ক্ ও অং করিয়া ভড়ং হইয়াছে। বড়াং শব্দে এই মত সমর্থন করিবে। আমার কাল্না-প্রদেশীয় বন্ধুগণ বলেন, তাঁহাৱা বড়াই শব্দের মূলে বড়াং সর্বদাই ব্যবহার করেন; তাহাতে বুঝা যায় বড়ো শব্দের উত্তর যেন আ+ই প্রত্যয় করিয়া বড়াই হইয়াছে, তেমনই আং প্রত্যয় করিয়া বড়াং হইয়াছে—মূল শব্দটি বড়ো, প্রত্যয় দুইটি আই ও আং।
প্রত্যয়গুলি কী ভাবে লিখিত হওয়া উচিত, তাহাও বিচারের দ্বারা ক্রমশ স্থির হইতে পারিবে। যাহাকে অস্ প্রত্যয় বলিয়াছি, তাহা অস্ অথবা অ-বর্জিত, সা প্রত্যয়টি স+আ অথবা লা, এ-সমস্ত নির্ণয় করিবার ভার ব্যাকরণবিৎ পণ্ডিতদের উপর নিক্ষেপ করিয়া আমি বিদায় গ্রহণ করিলাম।
১৩০৮
- ↑ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, “বাংলা ব্যাকরণ, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা ১৩০৮, প্রথম সংখ্যা।
- ↑ দ্রষ্টব্য এই যে, ধ্বন্যাত্মক শব্দদ্বৈতে সর্বত্র এ নিয়ম খাটে না; যথা, আমরা টকটক লাল বা খটখট রৌদ্র বা টনটন ব্যথা বলি না, সে-স্থলে টক্টকে টন্টনে বলিয়া থাকি। কট্কট্ টল্মল্ জ্বল্জ্বল্, শব্দ হইতে বিকল্পে— কটমট কট্মটে, টলমল টল্মলে, জ্বলজ্বল জ্বল্জ্বলে হইয়া থাকে।
- ↑ বাংলা অ অনেক স্থলেই হ্রস্ব ওকারের ন্যায় উচ্চারিত হয়। আমরা লিখি যত, উচ্চারণ করি যত; লিখি বড়, উচ্চারণ করি বড়ো। উড়িয়ায় বড় বাঙালির বড়-র সহিত তুলনা করিলে দুই অকারের প্রভেদ বুঝা যাইবে।