বাংলা শব্দতত্ত্ব/বাংলা বহুবচন ২
পূর্বে বলা হইয়াছে ‘গোটা' শব্দের অর্থ সমগ্র। বাংলায় যেখানে বলে ‘একটা’, উড়িয়া ভাষায় সেখানে বলে গোটা। এবং এই গোটা শব্দের টা অংশই বাংলা বিশেষ বিশেষ্যে ব্যবহৃত হয়।
পূর্ববঙ্গে ইহার প্রথম অংশটুকু ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গে ‘চৌকিটা’, পূর্ববঙ্গে ‘চৌকি গুয়া’।
ভাষায় অন্যত্র ইহার নজির আছে। একদা ‘কর’ শব্দ সম্বন্ধকারকের চিহ্ন ছিল— যথা, তোমাকর, তাকর। এখন পশ্চিমভারতে ইহার 'ক' অংশ ও পূর্বভারতে 'র' অংশ সম্বন্ধ চিহ্নরূপে ব্যবহৃত হইতেছে। হিন্দি হম্কা, বাংলা আমার।
একবচনে যেমন গোটা, বহুবচনে তেমনি গুলা। (মানুষগোটা), মানুষটা একবচন, মানুষগুলা বহুবচন। উড়িয়া ভাষায় এইরূপ বহুবচনার্থে ‘গুড়িয়ে' শব্দের ব্যবহার আছে।
এই 'গোটা’রই বহুবচনরূপ গুলা, তাহার প্রমাণ এই যে, ‘ট’ সংযোগে যেমন বিশেষ্য শব্দ তাহার সামান্য অর্থ পরিত্যাগ করিয়া তাহার বিশেষ অর্থ গ্রহণ করে— গুলা ও গুলির দ্বারাও সেইরূপ ঘটে। যেমন, ‘টেবিলগুলা বাঁকা’ —অর্থাৎ বিশেষ কয়েকটি টেবিল বাঁকা, সামান্যত টেবিল বাঁকা নহে। কাক শাদা বলা চলে না, কিন্তু কাকগুলো শাদা বলা চলে, কারণ, বিশেষ কয়েকটা কাক শাদা হওয়া অসম্ভব নহে।
এই ‘গুলা’ শব্দযোগে বহুবচনরূপ নিষ্পন্ন করাই বাংলার সাধারণ নিয়ম। বিশেষ স্থলে বিকল্পে শব্দের সহিত ‘রা’ ও ‘এরা’ যোগ হয়। যেমন, মানুষেরা, কেরানীরা ইত্যাদি।
এই ‘র’ ও ‘এরা জীববাচক বিশেষ্যপদ ছাড়া অন্যত্র ব্যবহৃত হয় না।
হলন্ত শব্দের সঙ্গে ‘এরা’ এবং অন্য স্বরান্ত শব্দের সঙ্গে ‘রা’ যুক্ত হয়। যেমন বালকেরা, বধূরা। বালকগুলি, বধূগুলি ইত্যাদিও হয়।
কথিতভাষায় এই ‘এরা চিহ্নের ‘এ’ প্রায়ই লুপ্ত হইয়া থাকে— আমরা বলি বালকেরা, ছাত্ররা ইত্যাদি।
ব্যক্তিবাচক বিশেষ্যপদেরও বহুবচনরূপ হইয়া থাকে। যথা, রামেরা— অর্থাৎ নাম ও আনুষঙ্গিক অন্য সকলে। এরূপ হলে কদাপি গুলা গুলির এয়ােগ হয় না। কারণ রামগুলি বলিলে প্রত্যেকটিই রাম হওয়া আবশ্যক হয়।
ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে এই ‘এরা’ সম্বকারকরূপ হইতে উৎপন্ন। অর্থাৎ রামের সহিত সম্বন্ধযুক্ত যাহারা তাহারাই ‘রামেরা’। যেমন তির্যকরূপে ‘জন’ শব্দকে জোর দিয়া হইয়াছে ‘জনা’, সেইরুপ ‘রামের’ শব্দকে জোর দিয়া হইয়াছে রামেরা।
‘সব’, ‘সকল’ ও ‘সমুদয়’ শব্দ বিশেষ শব্দের পূর্বে বিশেষণরূপে প্রযুক্ত হইয়া বহুত্ব অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু বস্তুত এই বিশেষণগুলি সমষ্টিবাচক। ‘সব লােক’ এবং ‘লােকগুলি’-র মধ্যে অর্থভেদ আছে। ‘সব লােক’ ইংরেজিতে all men এবং লোকগুলি the men।
লিখিত বাংলায়, সফল’ ও ‘সমুদয়’ শব্দ বিশেষ্যপদের পরে বসে। কিন্তু কথিত বাংলায় কখনােই তা হয় না। সকল গােরু বলি, গােরু সকল বলি না। বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এইরূপ প্রয়ােগ সম্ভবত আধুনিককালে গদ্যরচনা সৃষ্টির সময়ে প্রবর্তিত হইয়াছে। লিখিত ভাষায় ‘সকল’ যখন কোনাে শব্দের পরে বসে তখন তাহা তাহার মূল অর্থ ত্যাগ করিয়া শব্দটিকে বহুবচনের ভাব দান করে। লােকগুলি এবং লােকসকল একই অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে।
প্রাচীন লিখিত ভাষায় ‘সব’ শব্দ বিশেষ্যপদের পরে যুক্ত হইত। এখন সে রীতি উঠিয়া গেছে, এখন কেবল পূর্বেই তাহার ব্যবহার আছে। কেবল বর্তমান কাব্যসাহিত্যে এখনাে ইহার প্রয়ােগ দেখা যায়– যথা, ‘পাখি সব করে রব’। বর্তমানে বিশেষপদের পরে ‘সব’ শব্দ বসাইতে হইলে বিশেষ্য বহুবচনরূপ গ্রহণ করে। যথা, পাখিরা সব, ছেলেরা সব অথবা ছেলেরা সবাই। বলা বাহুল্য জীববাচক শব্দ ব্যতীত অন্যত্র বহুবচনে এই রা’ ও ‘এ’ চিহ্ন বসে না। বানরগুলা সব, ঘােড়াগুলা সব, টেবিলগুলা সব, দোয়াতগুলা সব– এইরূপ গুলাযােগে, সচেতন অচেতন সকল পদার্থ সম্বন্ধেই ‘সব’ শব্দ ব্যবহৃত হইতে পারে।
‘অনেক’ বিশেষণ শব্দ যখন বিশেষ্যপদের পূর্বে বসে তখন স্বভাবতই তদ্দ্বারা বিশেষ্যের বহুত্ব বুঝায়। কিন্তু এই ‘অনেক’ বিশেষণের সংস্রবে বিশেষ্যপদ পুনশ্চ বহুবচনরূপ গ্রহণ করে না। ইংরেজিতে many বিশেষণ সত্ত্বেও man শব্দ বহুবচনরূপ গ্রহণ করিয়া men হয়— সংস্কৃতে অনেকা লােকাঃ, কিন্তু বাংলায় অনেক লােকগুলি হয় না।
অথচ ‘সকল’ বিশেষণের যােগে বিশেষ্যপদ বিকল্পে বহুবচনরূপও গ্রহণ করে। আমরা বলিয়া থাকি, সকল সভ্যেরাই এসেছেন— সকল সভ্যই এসেছেন এরূপও বলা যায়। কিন্তু অনেক সভ্যেরা এসেছেন কোনােমতেই বলা চলে না। ‘সব’ শব্দও ‘সকল’ শব্দের ন্যায়। ‘সব পালােয়ানরাই সমান’ এবং ‘সব পালােয়ানই সমান’ দুই চলে।
‘বিস্তর’ শব্দ ‘অনেক’ শব্দের ন্যায়। অর্থাৎ এই বিশেষণ পূর্বে থাকিলে বিশেষ্যপদ আর বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না—‘বিস্তর লােকেরা’ বলা চলে না।
এইরূপ আর-একটি শব্দ আছে তাহা লিখিত বাংলায় প্রায়ই ব্যবহৃত হয় না— কিন্তু কথিত বাংলায় তাহারই ব্যবহার অধিক, সেটি ‘ঢের’। ইহার নিয়ম ‘বিস্তর’ ও ‘অনেক’ শব্দের ন্যায়ই। ‘গুচ্ছার’ শব্দও প্রাকৃত বাংলায় প্রচলিত। ইহা প্রায়ই বিরক্তি-প্রকাশক। যখন বলি গুচ্ছার লােক জমেছে তখন বুঝিতে হইবে সেই লােকসমাগম প্রীতিকর নহে। ইহা সম্ভবত গােটাচার শব্দ হইতে উদ্ভূত।
সংখ্যাবাচক বিশেষ্য পূর্বে যুক্ত হইলে বিশেষ্যপদ বহুবচনরূপ গ্রহণ করে না। যেমন, চার দিন, তিন জন, দুটো আম।
গণ, দল, সমূহ, বৃন্দ, বর্গ, কুল, চয়, মালা, শ্রেণী, পঙ্ক্তি প্রভৃতি শব্দযোগে বিশেষ্যপদ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু ইহা সংস্কৃত রীতি। এইজন্য অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্যত্র ইহার ব্যবহার নাই। বস্তুত ইহাদিগকে বহুবচনের চিহ্ন বলাই চলে না। কারণ ইহাদের সম্বন্ধেও বহুবচনের প্রয়ােগ হইতে পারে— যেমন সৈন্যগণেরা, পদাতিক দলেরা ইত্যাদি। ইহারা সমষ্টিবােধক।
ইহাদের মধ্যে ‘গণ’ শব্দ প্রাকৃত বাংলার অন্তর্গত হইয়াছে। এইজন্য ‘পদাতিকগণ’ এবং ‘পাইকগণ’ দুই বলা চলে। কিন্তু ‘লাঠিয়ালবৃন্দ’ ‘কলুকুল’ বা ‘আটচালাচয়’ বলা চলে না।
গণ, মালা, শ্রেণী ও পঙ্ক্তি শব্দ সর্বত্র ব্যবহৃত হইতে পারে না। গণ ও দল কেবল প্রাণীবাচক শব্দের সহিতই চলে। কখনাে কখনাে রূপকভাবে মেঘদল তরঙ্গদল বৃক্ষদল প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। মালা, শ্রেণী ও পঙ্ক্তি শব্দের অর্থ অনুসারেই তাহার ব্যবহার, এ কথা বলা বাহুল্য।
প্রাকৃত বাংলায় এইরূপ অর্থবোধক শব্দ ঝাঁক, গোচ্ছা, আঁটি, গ্রাস। কিন্তু এগুলি সমাস-রূপে শব্দের সহিত সংযুক্ত হয় না। আমরা বলি পাখির ঝাঁক, চাবির গোচ্ছা, ধানের আঁটি, ভাতের গ্রাস, অথবা দুই ঝাঁক পাখি, এক গোচ্ছা চাবি, চার আঁটি ধান, দুই গ্রাস ভাত।
‘পত্র’ শব্দযোগে বাংলায় কতকগুলি শব্দ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু সেই বিশেষ কয়েকটি শব্দ ছাড়া অন্য শব্দের সহিত উহার ব্যবহার চলে না। গহনাপত্র, তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, জিনিসপত্র, বিছানাপত্র, ঔষধপত্র, খরচপত্র, দেনাপত্র, চিঠিপত্র, খাতাপত্র, চোতাপত্র, হিসাবপত্র, নিকাশপত্র, দলিলপত্র, পুঁথিপত্র, বিষয়পত্র।
পরিমাণ-সম্বন্ধীয় বহুত্ব বোঝাইবার জন্য বাংলায় শব্দদ্বৈত ঘটিয়া থাকে; যেমন, বস্তাবস্তা, ঝুড়িঝুড়ি, মুঠামুঠা, বাক্সবাক্স, কলসিকলসি, বাটিবাটি। এগুলি কেবলমাত্র আধারবাচক শব্দ সম্বন্ধেই খাটে; মাপ বা ওজন সম্বন্ধে খাটে না— গজ-গজ বা সের-সের বলা চলে না।
সময় সম্বন্ধেও বহুত্ব অর্থে শব্দদ্বৈত ঘটে— বার বার, দিন দিন, মাস মাস, ঘড়ি ঘড়ি। বহুত্ব বুঝাইবার জন্য সমার্থক দুই শব্দের যুগ্মতা ব্যবহৃত হয়, যেমন: লোকজন, কাজকর্ম, ছেলেপুলে, পাখিপাখালী, জন্তুজানোয়ার, কাঙালগরিব, রাজারাজড়া, বাজনাবা্দ্য। এই-সকল যুগ্ম শব্দের দুই অংশের এক অর্থ নহে কিন্তু কাছাকাছি অর্থ এমন দৃষ্টান্তও আছে; দোকানহাট, শাকসবজি, বনজঙ্গল, মুটেমজুর, হাঁড়িকুঁড়ি। এরূপ স্থলে বহুত্বের সঙ্গে কতকটা বৈচিত্র্য বুঝায়। যুগ্ম শব্দের একাংশের কোনো অর্থ নাই এমনও আছে। যেমন, কাপড়চোপড়, বাসনকোসন, চাকরবাকর। এ স্থলেও কতকটা বৈচিত্র্য অর্থ দেখা যায়।
কথিত বাংলায় ‘ট’ অক্ষরের সাহায্যে একপ্রকার বিকৃত শব্দদ্বৈত আছে। যেমন, জিনিসটিনিস, ঘোড়াটোড়া। ইহাতে প্রভৃতি শব্দের ভাবটা বুঝায়।
কার্তিক ১৩১৮