বাংলা শব্দতত্ত্ব/বাংলা শব্দদ্বৈত
বাংলা শব্দদ্বৈত
ব্রুগ্মান তাহার ইণ্ডোজাৰ্মানীয় ভাষার তুলনামূলক ব্যাকরণে লিখিতেছেন, একই শব্দকে দুই বা ততোধিকবার বহুলীকরণ দ্বারা, পুনর্বৃত্তি (repetition); দীর্ঘকালবর্তিতা, ব্যাপকতা অথবা প্রগাঢ়তা ব্যক্ত করা হইয়া থাকে। ইণ্ডো-জর্মানীয় ভাষার অভিব্যক্তিদশায় পদে পদে এইরূপ শব্দদ্বৈতের প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইণ্ডোজর্মান ভাষায় অনেক দ্বিগুণিত শব্দ কালক্রমে সংযুক্ত হইয়া এক হইয়া গেছে; সংস্কৃত ভাষায় তাহার দৃষ্টান্ত, মর্মর গর্গর (ঘড়া, জলশব্দের অনুকরণে), গদ্গদ বর্বর (অস্পষ্টভাষী) কঙ্কণ। দ্বিগুণিত শব্দের এক অংশ ক্রমে বিকৃত হইয়াছে এমন দৃষ্টান্তও অনেক আছে; যথা কর্কশ কঙ্কর ঝঞ্ঝা বম্ভর (ভ্রমর) চঞ্চল।
অসংযুক্তভাবে দ্বিগুণীকরণের দৃষ্টান্ত সংস্কৃতে যথেষ্ট আছে: যথা, কালে কালে, জন্মজন্মনি, নব নব, উত্তরোত্তর, পুনঃ পুনঃ, পীত্বা পীত্বা, যথা যথা, যদ্যৎ, অহরহঃ, প্রিয়ঃ প্রিয়ঃ, সুখসুখেন, পুঞ্জপুঞ্জেন।
এই দৃষ্টান্তগুলিতে হয় পুনরাবৃত্তি, নয় প্রগাঢ়তার ভাব ব্যক্ত হইতেছে।
যতদূর দেখিয়াছি তাহাতে বাংলায় শব্দদ্বৈতের প্রাদুর্ভাব যত বেশি, অন্য আর্য ভাষায় তত নহে। বাংলা শব্দদ্বৈতের বিধিও বিচিত্র; অধিকাংশ স্থলেই সংস্কৃত ভাষায় তাহার তুলনা পাওয়া যায় না।
দৃষ্টান্তগুলি একত্র করা যাক। মধ্যে মধ্যে, বারে বারে, পরে পরে, পায় পায়, পথে পথে, ঘরে ঘরে, হাড়ে হাড়ে, কথায় কথায়, ঘণ্টায় ঘণ্টায় এগুলি পুনরাবৃত্তিবাচক।
বুকে বুকে, মুখে মুখে, চোখে চোখে, কাঠে কাঠে, পাথরে পাথরে, মানুষে মানুষে— এগুলি পরস্পর-সংযোগবাচক।
সঙ্গে সঙ্গে, আগে আগে, পাশে পাশে, পিছনে পিছনে, মনে মনে, তলে তলে, পেটে পেটে, ভিতরে ভিতরে, বাইরে বাইরে, উপরে উপরে— এগুলি নিয়তবর্তিতাবাচক, অর্থাৎ এগুলিতে সর্বদা লাগিয়া থাকার ভাব ব্যক্ত করে।
চলিতে চলিতে, হাসিতে হাসিতে, চলিয়া চলিয়া, হাসিয়া হাসিয়া— এগুলি দীর্ঘকালীনতাবাচক।
অন্য অন্য, অনেক অনেক, নূতন নূতন, ঘন ঘন, টুকরা টুকরা— এগুলি বিভক্ত বহুলতাবাচক। নূতন নূতন কাপড়, বলিলে প্রত্যেক নূতন কাপড়কে পৃথক করিয়া দেখা হয়। অনেক অনেক লোক, বলিলে লোকগুলিকে অংশে অংশে ভাগ করা হয়, কিন্তু শুদ্ধ ‘অনেক লোক’ বলিলে নিরবচ্ছিন্ন বহু শোক বোঝায়।
লাল লাল, কালো কালো, লম্বা লম্বা, মোটা মোটা, রকম রকমা— এগুলিও পুর্বোক্ত শ্রেণীর। লাল লাল ফুল, বলিলে ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলি লাল ফুল বোঝায়।
যাকে যাকে, যেমন যেমন, যেখানে যেখানে, যখন যখন, যত যত, যে যে, যারা যারাা— এগুলিও পূর্বোক্তরূপ।
আশায় আশায়, ভয়ে ভয়ো— এ দুইটিও ওই প্রকার। আশায় আশায় আছি, অর্থাৎ প্রত্যেক বার আশা হইতেছে; ভয়ে ভয়ে আছি, অর্থাৎ বারংবার ভয় হইতেছে। অর্থাৎ ক্ষণে ক্ষণে পৃথক পৃথক রূপে আশা বা ভয় উদ্রেক করিতেছে।
মুঠো মুঠো, ঝুড়ি ঝুড়ি, বস্তা বস্তা— এগুলিও পূর্বানুরূপ।
টাটকা টাটকা, গরম গরম, ঠিক ঠিক এগুলি প্রকর্ষবাচক।
টাটকা টাটকা বলিলে টাটকা শব্দকে বিশেষ করিয়া নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।
চার চার, তিন তিন- এগুলিও পুর্ববৎ। চার চার পেয়াদা আসিয়া হাজির, অর্থাৎ নিতান্তই চারটে পেয়াদা বটে।১
গলায় গলায় (আহার), কানে কানে (কথা)—ইহাও পূর্বশ্রেণীর; অর্থাৎ অত্যন্তই গলা পর্যন্ত পূর্ণ, নিতাই কানের নিকটে গিয়া কথা। হাতে হাতে (ফল, বা ধরা পড়া), বোধ করি স্বতন্ত্রভাতীয়। বোধ করি তাহার অর্থ এই যে, যেমনি হাত দিয়া কাজ করা অমনি সেই হাতেই ফল প্রাপ্ত হওয়া, যেহাতে চুরি করা সেই হাতেই ধৃত হওয়া।
নিজে নিজে, আপনি আপনি, তখনই তখনই— পূর্বানুরুপ। অর্থাৎ বিশেষ রূপে নিজেই, আপনিই আর কেহই নহে, বিলম্বমাত্র না করিয়া তৎক্ষণাৎ। সকাল সকাল শব্দও বোধ করি এই-জাতীয়, অর্থাৎ নিশ্চয়রুপে দ্রুতরূপে সকাল।
জল জল, চুর চুল, ঘুর ঘুর, টল টল, নড়, নড়, এগুলি অলন চূর্ণন ঘূর্ণন টলন নর্তন শব্দজাত; এগুলিতেও প্রভাব ব্যক্ত হইতেছে।
বাংলা অনেকগুলি শব্দদ্বৈতে দ্বিধা ঈষদুনতা, মৃদুতা, অসম্পূর্ণতার ভাব ব্যক্ত করে; যথা, যাব যাব, উঠি উঠি; মেঘ মেঘ, জর জর, শত শত, মর মর, পড়ো পড়ো, ভরা ভরা, ফাঁকা ফাঁকা, ভিজে ভিজে, ভাসা ভাসা, কাঁদো কাঁদো, হাসি হাসি।
মানে মানে, ভাগ্যে ভাগ্যে শব্দের মধ্যেও এই ঈষদুনতার ভাব আছে। মানে মানে পলায়ন, অর্থে— মান প্রায় যায় যায় করিয়া পলায়ন। ভাগ্যে ভাগ্যে রক্ষা পাওয়া অর্থাৎ যেটুকু ভাগ্যসূত্রে রক্ষা পাওয়া গেছে তাহা অতি ক্ষীণ।
ঘোড় ঘোড়া (খেলা), চোর চোর (খেলা) এই-জাতীয় অর্থাৎ সত্যকার ঘোড়া নহে, তাহারি নকল করিয়া খেলা।
পেয়াদা আসিয়া হাজির’ তখন একেবারে চার পেয়াদা আসায় বাহুল্যজনিত বিস্ময় প্রকাশ করি। প্রদীপের সমালোচক মহাশয় বলেন, এই স্থলের দ্বিত্ব বিভক্ত-বহুলতা-জ্ঞাপক। অর্থাৎ যখন বলা হয়, ‘তাহাদিগকে ধরিবার এ চার চার জন পেয়াদা আসিয়া হাজির’, তখন সমালোচক মহাশয়ের মতে তাহাদের প্রত্যেকের জন্য চার চার পেয়াদা আসিয়া উপস্থিত ইহাই বুঝায়। আমরা এ কথায় সায় দিতে পারিলাম না। বিহারীবাবুও দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইয়াছেন, একজনের জন্যও চার চার পেয়াদা বাংলাভাষা অনুসারে আসিতে পারে। বিহারীবাবু বলেন, দৃষ্টান্ত অনুসারে দুই অর্থই সংগত হয়। অর্থাৎ এক এবং বিভক্ত-বহুলতা, দু-ই বুঝাইতে পারে। তাহা ঠিক নহে— প্রকর্যই বুঝায়, সেই প্রকর্য একজনের সম্বন্ধেও বুঝাইতে পারে, ভিন্ন ভিন্ন লোকের সম্বন্ধেও বুঝাইতে পারে, সুতরাং উভয়বিধ প্রয়োগের মধ্যে প্রকর্য ভাবই সাধারণ।
এইরূপ ঈষদূনত্বসূচক অসম্পূর্ণতাবাচক শব্দদ্বৈত বোধ করি অন্য আর্য ভাষায় দেখা যায় না। ফরাসি ভাষায় একপ্রকার ব্যবহার আছে যাহার সহিত ইহার কঞ্চিৎ তুলনা হইতে পারে।
ফরাসি চলিত ভাষায় কোনো জিনিসকে আদরের ভাবে বা কাহাকেও খর্ব করিয়া লইতে হইলে কিঞ্চিৎ পরিমাণে শব্দদ্বৈত ঘটিয়া থাকে; যথা, me-mere মে-মেয়ার্, অর্থাৎ ক্ষুদ্র মাতা; মেয়ার্ অর্থে মা, মে-মেয়ার্ অর্থে ছোট্ট মা, আদরের মা, যেন অসম্পূর্ণ মা। bete বেট্ শব্দের অর্থ জন্ত, be-bete বে-বেট্ শব্দের অর্থ ছোট পশু, আদরের পশুটি; অর্থাৎ দেখা যাইতেছে এই দ্বিগুণীকরণে প্রকর্ষ না বুঝাইয়া খর্বতা বুঝাইতেছে।
আর-একপ্রকার বিকৃত শব্দদ্বৈত বাংলায় এবং বোধ করি ভারতীয় অন্য অনেক আর্য ভাষায় চলিত আছে, তাহা অনির্দিষ্ট-প্রভৃতি-বাচক; যেমন, জল-টল পয়সা-টয়সা। জল-টল বলিলে জলের সঙ্গে সঙ্গে আরো যে-কটা আনুষঙ্গিক জিনিস শ্রোতার মনে উদয় হইতে পারে তাহা সংক্ষেপে সারিয়া লওয়া যায়।
বোচকা-বুঁচকি দড়া-দড়ি গোল-গুলি কাটি-কুটি গুঁড়া-গাঁড়া কাপড়-চোপড়— এগুলিও প্রভৃতিবাচক বটে, কিন্তু পূর্বোক্ত শ্রেণীর অপেক্ষা নির্দিষ্টতর। বোঁচকা-বুঁচকি বলিলে ছোটো বড়ো মাঝারি একজাতীয় নানা প্রকার বোঁচকা বোঝায়, অন্য-জাতীয় কিছু বোঝায় না।
মহারাষ্ট্র হিলি প্রভৃতি ভারতবর্ষীয় অন্যান্য আর্যভাষাবিং পণ্ডিতগণ বাংলা ভাষার সহিত তৎতৎ ভাষার শব্দদ্বৈতবিধির তুলনা করিলে একান্ত বাধিত হইব।
১৩০৭