বাংলা শব্দতত্ত্ব/‘পহুঁ’
‘পহুঁ’
বৈষ্ণব কবিদের গ্রন্থে সচরাচর পহুঁ শব্দের দুই অর্থ দেখা যায়, প্রভু এবং পুনঃ। শ্রদ্ধাস্পদ অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় তাঁহার প্রকাশিত প্রাচীন কাব্যসংগ্রহের টীকায় লিখিয়াছেন পহু অর্থে প্রভু এবং পঁহু অর্থে পুনঃ। কিন্তু উভয় অর্থেই পহুঁ শব্দের ব্যবহার এত দেখা গিয়াছে যে, নিশ্চয় বলা যায় এ নিয়ম এক্ষণে আর খাটে না।
দীনেন্দ্রবাবু যতগুলি ভণিতা উদ্ধৃত করিয়াছেন প্রায় তাহার সকলগুলিতেই পহু এবং পহুঁ শব্দের অর্থ প্রভু।[১]
গােবিন্দদাস পহুঁ নটবর শেখর
অর্থাৎ গােবিন্দদাসের প্রভু নটবর শেখর।
রাধামােহন পহুঁ রসিক সুনাহ
অর্থাৎ রাধামােহনের প্রভু রসিক সু-নাথ।
নরােত্তমদাস পহুঁ নাগর কান,
রসিক কলাগুরু তুহুঁ সব জান।
ইহার অর্থ এই, তুমি নরােত্তমদাসের প্রভু নাগর কান, তুমি রসিক কলাগুরু, তুমি সকলই জান। এরূপ ভণিতা হিন্দি গানেও দেখা যায়। যথা:
তানসেনপ্রভু আকবর।
বৈষ্ণব পদে স্থানে স্থানে সমাস ভাঙাও দেখা যায়। যথা:
গোবিন্দদাসের পহু
হাসিয়া হাসিয়া রহু।
কেবল একটা ভণিতায় এই অর্থ খাটে না।
রাধামােহন পহুঁ দুহুঁ অতি নিরুপম।
এ স্থলে পহুঁ-র ভণে অর্থ না হইলে আর কোনাে অর্থ পাওয়া যায় না।
আমি যতদুর আলােচনা করিয়াছি তাহাতে গােবিন্দদাস এবং তাহার অনুকরণকারী রাধামােহন ব্যতীত আর-কোনাে বৈষ্ণব কবিতায় পহু শব্দের এরূপ অর্থ নাই। রাধামোহনেও ভণে অর্থে পহুঁ-র ব্যবহার অত্যন্ত বিরল― দৈবাৎ দুই-একটি যদি পাওয়া যায়।
রাধামােহন পহুঁ তুয়া পায়ে নিবেদয়ে।
এ হলে ‘পহুঁ’ অর্থে পুনঃ এবং অন্যত্র অধিকাংশ স্থলেই পহুঁ অর্থে প্রভু। কিন্তু গোবিন্দদাসের অনেক স্থলে পহুঁ-র ‘ভণে’ অর্থব্যবহার দেখা যায়।
গোবিন্দদাস পহুঁ দীপ সায়াহ্ন, বেলি অবসান ভৈ গেলি।
অর্থাৎ গােবিন্দদাস কহিতেছেন বেলা অবসান হইয়াছে, সন্ধ্যাদীপের সময় হইল। ইহা ছাড়া এ স্থলে আর-কোনােরূপ অর্থ কল্পনা করা যায় না। আরাে এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে।
এক্ষণে কথা এই, কোন্ ধাতু অনুসারে পঁহু-র ভণে অর্থ স্থির হইতে পারে। এক, ভণহুঁ[২] হইতে ভহুঁ এবং ক্রমে পহুঁ হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে—কিন্তু ইহা একটা কাল্পনিক অনুমানমাত্র। বিশেষত, যখন গােবিন্দদাস ব্যতীত অন্য কোনাে প্রাচীন পদকর্তার পদে পহুঁ-র এরূপ অর্থ দেখা যায় না, তখন উক্ত অনুমানের সংগত ভিত্তি নাই বলিতে হইবে।
আমার বিবেচনায় পূর্বোক্তরূপ ভণিতার পহুঁ অর্থে পুনঃ-ই ধরিয়া লইতে হইবে, এবং স্থির করিতে হইবে এরূপ ক্রিয়াহীন অসম্পূর্ণ পদবিন্যাস গোবিন্দদাসের একটি বিশেষত্ব ছিল। ‘গােবিন্দদাস পঁহু,’ অর্থাৎ ‘গোবিন্দদাস পুনশ্চ বলিতেছেন’, এইরূপ অর্থ করিতে হইবে। গােবিন্দদাসের স্থানে স্থানে পহুঁ শব্দের পরে ক্রিয়ার যােগও দেখা যায়। যথা:
গােবিন্দদাস পহুঁ এই রস গায়
অর্থাৎ গােবিন্দদাস পুনশ্চ এই রস গান করেন।
পাঠকেরা আপত্তি করিতে পারেন এরূপ স্থলে পুনঃ অর্থের বিশেষ সার্থকতা দেখা যায় না। কিন্তু প্রাচীন কবিদের পদে একপ্রকার অনিদিষ্ট অর্থে পুনঃ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যথা:
তুহারি চরিত নাহি জানি, বিদ্যাপতি পুন শিরে কর হানি।
রাধামােহন পুন তঁহি ভেল বঞ্চিত।
গােবিন্দদাস কহই পুন এতিখনে জানিয়ে কী ভেল গােরি।
যাহা হউক, গোবিন্দদাস কখনো বা ক্রিয়াপদের সহিত যোগ করিয়া কখনো বা ক্রিয়াপদকে উহ্য রাখিয়া পহুঁ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু সেই সেই স্থলে পহুঁ অর্থে পুনঃ-ই বুঝিতে হইবে। অন্য কোনোরূপ আনুমানিক অমূলক অর্থ কল্পনা করিয়া লওয়া সংগত হয় না।
এই স্থলে প্রসঙ্গক্রমে বলিতেছি, আমার কোনো শ্রদ্ধেয় পূর্ববঙ্গবাসী বন্ধুর নিকট শুনিলাম যে, তাঁহাদের দেশে ‘নিছেপুঁছে’ শব্দের চলন আছে। এবং নববধূ ঘরে আসিলে তাহার মুখে গায়ে হাত বুলাইয়া তাহাকে ‘নিছিয়া’ লওয়া হয়। অতএব এরূপ চলিত প্রয়োগ থাকিলে নিছনি শব্দের অর্থ সম্বন্ধে সংশয় থাকে না।
জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯