বাখতিন/সম্ভাব্য জবাবের নির্মিতি
সওয়াল-জবাব। এই শব্দবন্ধকে বিতর্কসভা আর বিচারালয়ের অনুষঙ্গ ছাড়া ভাবতেই পারি না। যদিও ভারতীয় দর্শনের উপস্থাপনা-পদ্ধতিতে পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ নামক বিন্যাস-প্রতিন্যাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বপক্ষের প্রত্যুত্তর হিসেবে সুপরিকল্পিত ও প্রণালীবদ্ধ ভাবে নির্মিত হয় উত্তরপক্ষ। অতএব নিশ্ছিদ্র যুক্তি ও পিনদ্ধ বিশ্বাস তার মুখ্য অবলম্বন। কিন্তু এইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হয় যে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের যৌক্তিক উপস্থাপনা হিসেবে পরিকল্পিত পূর্বপক্ষও মূলত মীমাংসা-প্রয়াসীর নির্মিতি। ফলে পূর্বপক্ষের বাচনে পদে-পদে প্রচ্ছন্ন থাকে প্রতিবাচন যা নিরাকৃত হওয়ার জন্যেই উত্থাপিত। কারণ, মীমাংসা-প্রয়াসী নিগূঢ় মনস্তাত্ত্বিক কারণে প্রতিপক্ষের হাতে কখনও তেমন অস্ত্র তুলে দেবে না যাকে প্রতিহত করা অসম্ভব। তার মানে, যাকে ভাবছি পূর্বপক্ষের সওয়াল, তার প্রত্যাখ্যান পূর্ব-নির্ধারিত। দার্শনিক প্রতিবেদন নির্মাণ ও বিনির্মাণের এই পরম্পরায় গঠিত হয়ে থাকে। সাহিত্যিক প্রতিবেদনে বিন্যাস-প্রতিন্যাসের এই ধরন হয়তো প্রকাশ্য নয়। কিন্তু প্রচ্ছন্নভাবে, ইশারায়, ব্যক্ত ও অব্যক্তের ধূসর সীমান্তে প্রশ্নমালার বিস্তার ও সম্ভাব্য মীমাংসার প্রতি আগ্রহ ফুটে ওঠে। আসলে আমাদের জীবন নামক পাঠকৃতিও তাই। পর্যায়ে পর্যায়ে কখনও সোচ্চার আর কখনও নিরুচ্চারভাবে জেগে থাকে জিজ্ঞাসার উত্থাপন আর সম্ভাব্য প্রত্যুত্তরের উন্মোচন।
মিখায়েল বাখতিন নেভেল শহর থেকে প্রকাশিত ‘The Day of Art’ নামক একটি পত্রিকার সেপ্টেম্বর, ১৯১৯ সংখ্যায় ‘Art and Answerability’ নামে ছোট্ট প্রবন্ধ লিখেছিলেন। চিন্তা-জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে রচিত হলেও নানা কারণে এই প্রবন্ধটি বাখতিন-চিন্তাবিশ্বে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৮ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যে বাখতিনের চিন্তাজগৎ যখন সংগঠিত হচ্ছিল, বাচন-মূলক সৃষ্টি-প্রকরণ সম্পর্কে নান্দনিক ও দার্শনিক ভাববীজ নানাভাবে অঙ্কুরিত হচ্ছিল। বাচনিক সৃষ্টির অন্তর্বস্তু, উপাদান ও প্রকরণ সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে ভাবছিলেন বাখতিন। ঐসময়কার রচনায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ডস্টয়েভস্কির নন্দন সম্পর্কিত তাঁর বিখ্যাত বইয়ের প্রস্তুতিও চলছিল তখন। নৈতিক দর্শন, বিষয়ীসত্তা, আইন, নন্দনভাবনা: নানা দিকে তাঁর অভিনিবেশ ছিল। ঐ সময়কার যেসব খসড়া উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে কোনো তারিখ বা শিরোনাম পাওয়া যায়নি। বাখতিন বিভিন্ন বিষয়ে নানা সময়ে যা-কিছু ভেবেছেন, সেই সব তাঁর চিন্তার প্রধান আকল্পগুলিকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। এদের বলা যায়, প্রাক্-সন্দর্ভ স্তরের রচনা।
বাখতিনের চিন্তাবিশ্ব সম্পর্কে যাঁরা বিশেষভাবে অবহিত, তাঁদের কাছে ‘Art and Answerability’ শীর্ষক রচনাটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ। এতে ঐক্য-বিষয়ক দুটি ভিন্ন ধারণার বিরোধিতা দিয়ে লেখক তাঁর বয়ান শুরু করেছেন। প্রথম ধরনের ঐক্য হলো যান্ত্রিক; যে-সব অংশ কোনো সমগ্রকে নির্মাণ করে, তাদের পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে দেয় পুরোপুরি বহির্বৃত উচ্চারণ। এরা বিচ্ছিন্ন একক ও ভ্রামণিক; স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই অন্য অংশের পক্ষে নিতান্ত পরবাসীর মতো সুদূর। দ্বিতীয় ধরনের ঐক্যে যান্ত্রিকতা নেই; বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতীতিতে, ধারণার নিরিখে। ব্যক্তি-অস্তিত্বের চিন্তন-প্রক্রিয়ায় যেমন বিবিধ উৎসজাত ভাববীজ সম্পৃক্ত হয়, প্রতিটি অংশ একে অপরের সম্পর্কে সংবেদনশীল এবং মিথষ্ক্রিয়ায় উন্মুখ। বাখতিন লক্ষ করেছেন, শিল্পে অভিব্যক্ত সময় ও পরিসর এমন-এক জগতের ইঙ্গিত দেয় যা বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রতিফলিত সময় ও পরিসর থেকে অনেক স্বতন্ত্র। এই দুইয়ের মধ্যে তিনি বিচ্ছেদ ভেবে নিয়েছেন: ‘When a man is in art, he is not in life and vice versa!’ তাঁর মতে, শিল্প-স্বভাবে এবং মানবব্যক্তিত্বের স্বভাবে কিছুই যথাপ্রাপ্ত নয়; তাই স্বতশ্চল ভাবে এদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত হয় না। সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, দিতে হয় আকার ও চরিত্র, নির্দিষ্ট ধারণাভিত্তিক সমর্থন। মন যেহেতু নির্মিতি-নিপুণ কারুকৃৎ, শুধুমাত্র তারই প্রণালীবদ্ধ সক্রিয়তায় সৃষ্টি হয় ঐক্যবোধ। শিল্প ও জীবনের সম্পর্ক রচিত হয় তখনই যখন কোনো পর্যবেক্ষক মানুষ তা গড়ে তোলে। সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব যখন ঐ পর্যবেক্ষক উপস্থাপনার মধ্যে খুঁজে পায় প্রত্যুত্তর-সম্ভাবনা। আর, সম্ভাবনা মানে যোগ্যতা, অনবরত যোগ্য হয়ে ওঠা।
শিল্পের প্রতিবেদন যেন প্রশ্নমালা আর জীবন সেইসব জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য প্রত্যুত্তর। শিল্প থেকে যে-অভিজ্ঞতা ও প্রতীতি অর্জন করি, জীবনে তার জবাব দিয়ে যেতে হয়। নইলে জীবন উদ্ভাসিত হবে না। ব্যক্তিগত প্রত্যুত্তর-যোগ্যতার এই নন্দন সামূহিক ভূমিকার চেয়ে স্পষ্টত বেশি গুরুত্ব দেয় একক অস্তিত্বের সংগঠনকে। সেইসঙ্গে শিল্প ও জীবনের সম্পর্ক বিষয়ক চিরাগত ধারণা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। নিঃসন্দেহে শিল্প এবং অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সক্রিয়তা; তবে তাদের মধ্যে অন্তত একটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। শিল্প-প্রকরণ সৃষ্টি বা জীবন-সৃষ্টির প্রক্রিয়া একে অপরের জটিল অস্তিত্ব উপেক্ষা করে নিজের কাজকে সরলীকৃত করতে চায়: ‘For it is certainly easier to create without answering for life and easier to live without any consideration for art. Art and life are not one, but they must become united in myself in the unity of my answerability’ (১৯৯৫: ২)।
আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেও বুঝি, শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টারা নান্দনিক দায়বোধের নামে জীবন থেকে উত্থাপিত প্রশ্নমালা সম্পর্কে নিরুত্তর থাকাকে গরীয়ান করেন। তেমনি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন থেকে জীবন নির্বাহ করাটা অধিকাংশ মানুষের কাছে সহজ ও স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব গুরুত্বপূর্ণ যে শিল্প ও জীবন এক নয়; কিন্তু গ্রহীতা সত্তার মধ্যে তাদের অন্যোন্য-সম্পৃক্ত হতেই হবে। এ কেবল আকাঙ্ক্ষা নয়, এ হলো ঔচিত্যের ঘোষণা। গ্রহীতার প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা থেকে উৎসারিত ঐক্যবোধে শিল্প ও জীবন প্রকৃত তাৎপর্যপ্রসূ হয়ে ওঠে। জীবন সাবভৌম ও আত্মদীপ, শিল্প-ও তা-ই। কিন্তু তাদের প্রকাশ ও বিচ্ছুরণ, অবস্থান ও প্রতীতির প্রকরণে রয়েছে আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য।
মাত্র ছ’টি ছোট-ছোট অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত এই বয়ান যেন চিন্তাসূত্র হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে। পরবর্তী কালে যে গভীর মনন-ঋদ্ধ প্রতিবেদন রচিত হবে, বাখতিন এখানে যেন বীজাকারে তার মুখ্য ভাববস্তু উপস্থাপিত করেছেন। নিবিড় পাঠে অন্তর্বৃত অনেকান্তিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। ‘The Architectonics of Answerabiltiy’ বা প্রত্যুত্তরযোগ্যতার নির্মিতিবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহুস্বরিক প্রতিবেদনের উৎস এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ। প্রতীচ্যের অধিবিদ্যার তিনটি প্রধান শাখা—জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র ও নন্দনতত্ত্ব—তখন বাখতিনের চিন্তায় সমন্বিত হয়ে একটি অভিন্ন তাত্ত্বিক আকরণে বিন্যস্ত হতে শুরু করেছিল। শিল্পের অভিজ্ঞতা ও প্রায়োগিক ক্রিয়াকে কীভাবে অন্যান্য ধরনের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়—এ বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণী ভাবনার সূত্রপাত হয়েছিল। সমসাময়িক আরো কয়েকজন চিন্তাবিদ তখন জীবনে শিল্পের ভূমিকা নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে বৌদ্ধিক ঘরানাগুলিতে যে বিপুল আলোড়ন ও পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার সমস্ত অভিঘাত তখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে বিভিন্ন চিন্তা-প্রস্থানে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার প্রতিক্রিয়া অস্বীকার করাও সম্ভব হচ্ছিল না। একদিকে পরস্পরের দার্শনিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখার রক্ষণশীল প্রয়াস এবং অন্যদিকে রূপান্তর-প্রবণ সময়স্বভাবের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা: এর ফলে পারস্পরিক পার্থক্য ও অনন্বয়ের বোধ থেকে বিতর্কও তৈরি হচ্ছিল। প্রকরণবাদীদের সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক সমালোচকদের বিরোধ কিংবা ভবিষ্যবাদী ও প্রতীকবাদী কবিদের বিতর্ক সমকালীন বৌদ্ধিক প্রেক্ষিতের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। এই পরিবেশে বাখতিনের চিন্তাজগতে তৈরি হলো নতুন নতুন বাঁক তৈরির প্রবণতা।
দুই
এই নিবন্ধের শুরুতে যে সওয়াল জবাব, পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি, সারা জীবন ধরে নানাভাবে তাদের সংরূপ নির্মাণ করে যেতে হয়। কিংবা, বলা ভালো, নির্মিতির উপযোগিতা পর্যায়ে পর্যায়ে পরীক্ষা করে অনবরত পুনর্নির্মাণ করতে হয়। বিশেষত যিনি অস্তিত্ব ও চিন্তাকে মূলত নির্মিতি বলে জানান, তাঁর পক্ষে এই প্রক্রিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাখতিন এইজন্যে অগ্রণী চিন্তাবিদ্দের অন্যতম যে তিনি জীবনের নিয়ত নির্মীয়মাণ প্রতিবেদনে একই ধরনের প্রশ্নমালার জন্যে ভিন্নভিন্ন প্রত্যুত্তর সন্ধানে বিরত হননি কখনও। সত্তা ও অপরতার সম্পর্ক কত ধরনের সমস্যার আকর হতে পারে কিংবা পার্থক্য-প্রতীতির ভিত্তিগত বাস্তবতা থেকে কত বিচিত্রভাবে সমরূপতার উদ্ভব হতে পারে—তা উপলব্ধির জন্যে ভিন্ন-ভিন্ন পদ্ধতি নির্ণয়ে কখনও ক্লান্ত বোধ করেননি তিনি। জীবন মানে নিত্য নবায়মান প্রকল্পের সন্ধান—এই অনুভব থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন জিজ্ঞাসার যথার্থ উপস্থাপনায়। আসলে জিজ্ঞাসার ধরন ও নির্যাস খুব একটা বদলে যায়নি, যদিও প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা যথেষ্ট বিবর্তিত হয়েছে। বাখতিনের কাছে সমস্ত প্রত্যুত্তরই মীমাংসা নয়, তবে তেমন সম্ভাবনা জাগিয়ে দেওয়া যে তাঁর অন্বিষ্ট, এ-সম্পর্কে সংশয় নেই কোনো। সম্ভাব্য মীমাংসা বা প্রত্যুত্তরের নির্মিতি-বিজ্ঞান আবিষ্কার করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাখতিনের ভাবনা দার্শনিক মননে উজ্জ্বল যদিও প্রচলিত দর্শন-প্রস্থানগুলির সঙ্গে তাঁর সরাসরি আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার জগৎ ও জীবন থেকে তিনি আহরণ করেন তাঁর নীতিবোধ ও নন্দনের নির্যাস। বাখতিনের মতে নৈতিক সক্রিয়তাকে তত্ত্বগতভাবে উদ্যম বা কৃত্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। উদ্যম-নিষ্পন্ন কর্মের ফল বা পরিণতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন না তিনি, জায়মান নৈতিক কৃত্যের প্রক্রিয়াই তাঁর মতে অভিনিবেশ-যোগ্য। যে-ঘটনাকে সৃষ্টি বা রচনা প্রক্রিয়ায় অনুধাবন করতে পারি, তারই পারিভাষিক নাম উদ্যম বা কৃত্য। তা শারীরিক ক্রিয়া, চিন্তা, উচ্চারণ বা লিখিত বয়ান হতে পারে। উচ্চারণ ও লিখিত বয়ান আসলে অভিন্ন পরিসরের দ্যোতক। সাহিত্যিক পাঠকৃতির প্রণালীবদ্ধ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় লেখক-সত্তার সক্রিয়তা যেভাবে ব্যক্ত হয়, তা নিবিড়ভাবে অনুশীলন করে বাখতিন এই তাত্ত্বিক ধারণায় পৌঁছেছেন। কল্পনা-প্রতিভা দ্বারা নির্মিত ও বহু উপাদানের সমন্বয়ে রচিত শিল্পকর্মে, বিশেষত আখ্যানে, সাহিত্যিক কীভাবে তাঁর প্রকল্পজাত চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নিজের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ সংগঠিত করেন, তা পরীক্ষা করে সত্তা ও অপরতার বহুরৈখিক সম্পর্ক বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা নিয়ে যাঁর চিন্তাজীবনের সূত্রপাত হয়েছিল, তিনি জীবনাবসানের গোধূলি-বেলায় যখন নির্মিতি-বিজ্ঞান নিয়ে নিবন্ধ রচনা করেন, পরিণতির দ্বিবাচনিক দর্পণে সূচনা-মুহূর্তের ভাববীজগুলি বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। সারা জীবন ধরে বাখতিন যা ভেবেছেন বা লিখেছেন, তাদের দার্শনিক ও নান্দনিক তাৎপর্য যেন নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়।
অবশ্যই এর মানে এই নয় যে মধ্যবর্তী দশকগুলিতে বাখতিনের ভাবনায় কোনো নতুন আকল্প দেখা দেয়নি। কিংবা তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত রচনার মূল প্রতিপাদ্য যাচাই করতে গেলে শুধুমাত্র মীমাংসাযোগ্যতার নির্মিতি-বিজ্ঞানকেই ব্যবহার করতে হবে। চিন্তাবিদ হিসেবে যাঁর বহুমাত্রিক হয়ে ওঠার বিবরণ আমাদের বারবার বিস্মিত ও প্রাণিত করে—সমসাময়িক সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে সেই প্রক্রিয়ার নিবিড় দ্বিবাচনিকতা অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। এইজন্যে আলোচকেরা নির্মিতি-বিজ্ঞানকে বাখতিন-অনুশীলনের পক্ষে উপযোগী বহুস্তর-বিন্যস্ত চিন্তাবলয় হিসেবে ভেবে নিয়েছেন। অর্থাৎ বাখতিনের চিন্তাবিশ্বে এই তত্ত্ববীজের উপস্থিতি এমন-এক জটিল ও বিশিষ্ট অবসংগঠন হিসেবে, যার বহুমাত্রিক তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্যে সম্পূর্ণ জীবনও যথেষ্ট নয় যেন। ‘নির্মিতি-বিজ্ঞান’ ও ‘প্রত্যুত্তরযোগ্যতা’—এই দুটি পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ জীবন ও মননের কত দিগন্ত স্পর্শ করে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অস্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন গ্রন্থনায় আমাদের প্রত্যেকের অনন্য অবস্থান থেকে উৎসারিত হচ্ছে প্রত্যুত্তরের যোগ্যতা ও সম্ভাবনা। যা-কিছু আমাদের অপরতার পরিসর হিসেবে ঘিরে রাখে, অনন্ত অনুপুঙ্খময় সেই জগতের সঙ্গে আমাদের আস্তিত্বিক অনন্যতাকে গ্রথিত করি ঐ প্রত্যুত্তরযোগ্যতা দিয়েই। আর, সম্ভাব্য প্রত্যুত্তরের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। বাখতিনের অন্যতম প্রসিদ্ধ মহাবাক্য হলো, আমরা প্রত্যেকেই ‘without an alibi in existence’।
অস্তিত্বের বিপুল পরিসরে নিজেদের অনন্য অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্যে চাই উপযোগী দায়িত্ববোধ। কেননা অনন্যতার উপলব্ধি বা পার্থক্যপ্রতীতি সার্থক হতে পারে যদি সৃষ্টিতে পরিব্যাপ্ত অপরতার পরিসর সম্পর্কে সচেতন হই। সত্তা যতক্ষণ নিজেকে অবশিষ্ট জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত না করছে, ততক্ষণ নিজেকে অনন্য বলে বুঝতেও পারবে না। সময়ে ও পরিসরে আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান সুনির্দিষ্ট। কিন্তু তার তাৎপর্য বুঝতে পারি শুধু নানা ধরনের ও নানা পর্যায়ের সক্রিয়তার প্রত্যক্ষ অনুষঙ্গে। আমরা কেউ একে অপরের অবস্থান পুনরাবৃত্তি করতে পারি না বলে তাকে সুনির্দিষ্ট বলছি। মহাবিশ্বে যেমন প্রতিটি গ্রহ-তারা-উপগ্রহ-ধূমকেতু-ছায়াপথের অবস্থান বিপুল আপেক্ষিকতার প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট, সত্তার অবস্থানও তাই। আবার এই অমোঘতার মধ্যেও অনবরত রূপান্তরিত হচ্ছে অস্তিত্ব। পদার্থ জগতের মতো অন্যান্য মানবিক ও প্রাকৃতিক অস্তিত্বের দৃশ্য ও অদৃশ্য আততিতে সত্তার রূপান্তর ঘটছে অহরহ। তবে সবই ঘটছে প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট অবস্থানের ভিত্তিতে। বস্তুত প্রত্যেকের জীবনেই প্রকৃত উদ্যোগ বা ঘটনার প্রকল্প যেভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেভাবেই সত্তার নিজস্ব সংরূপ সংগঠিত হচ্ছে। এইজন্যে অস্তিত্ব মূলত অনুষ্ঠান, সংগঠন। অপর সব সত্তা ও জগতের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক গ্রন্থনায় একমাত্র সূত্রধার যেহেতু অস্মিতার পরিসর, সব সাফল্য ও ব্যর্থতার জন্যে তাকেই দায়ী থাকতে হয়।
প্রতিটি সত্তা থেকে নিয়ত উৎসারিত সক্রিয়তা অস্মিতা ও অপরতার মধ্যে সর্বদা নিশ্চিত সংযোগ গড়ে তুলতে পারছে, তা কিন্তু নয়। তৈরি হতে-না-হতে হারিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক কিংবা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার অবকাশ দেখা দিতে-না-দিতে স্খলিত হয়ে যাচ্ছে বিন্যাস। এই যে হারিয়ে যাওয়া ও স্খলন, তাদের নিরন্তর অভিঘাতে হয়তো উদ্ভূত হচ্ছে সত্তার সক্রিয়তা। তাহলে সংযোগকে বলতে পারি ঘটমান সম্ভাবনা; অপরতা ও অস্মিতার পারস্পরিক নির্ভরতা কিংবা উন্মুখতার সূত্রে যাকে বুঝি, যাকে চিনি। কিংবা পুরোপুরি বুঝতে বা চিনতে কি পারি কখনো? তাহলে, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নবায়মান জিজ্ঞাসা ও মীমাংসাপ্রয়াসের সূত্রে সংযোগের নির্মাণই জীবন। সমস্ত ব্যক্তিসত্তা ও সমস্ত অপরতার দ্বিবাচনিকতায় যত প্রতিবেদনের আদল তৈরি হচ্ছে, তাদের নির্যাস হলো ঐ সংযোগের অনুভব। আর, অনুভবের প্রকাশকে বলি উচ্চারণ। বলা ভালো, উচ্চারণ কেবল শব্দে বা পাঠকৃতিতে থাকে না; তা থাকে চিন্তায়, উদ্যমে। লেখকসত্তার ধারণা এইসব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। চেতনার পক্ষে অস্মিতা যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, পাঠকৃতির পক্ষে লেখক-স্রষ্টা ততটুকু অপরিহার্য। বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে যখন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, স্বতন্ত্র অস্তিত্বের চেতনাও ব্যক্ত হচ্ছে। ‘আমি’ সর্বনামটি আমি ব্যবহার করতে পারি যখন বাচনকে গ্রহণ করার মতো কোনো একটি ‘তুমি’ উপস্থিত রয়েছে। সম্বোধন মানেই গ্রহীতা-সম্বোধিতের উপস্থিতি; আর, ভাষা মানে সম্বোধ্যমানতার ক্রিয়া ও প্রকরণ। সম্বোধকের অস্তিত্বের কেন্দ্র হলো ‘আমি’ সর্বনামের উপস্থিতি। স্বভাবত উপস্থিতি মানে নির্দিষ্ট পরিসর ও সময়ের ঘোষণা। একই সঙ্গে তা অন্যান্য উপস্থিতি থেকে স্পষ্ট পার্থক্যপ্রতীতিরও উপলব্ধি। এইসব অপর অস্তিত্ব যুগপৎ বস্তু এবং চিহ্ন। সক্রিয় উদ্যমের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সংযোগ তৈরি করে যাওয়া তাই বস্তুবিশ্ব ও চিহ্নবিশ্বে অবধারিত। না লিখলেও চলে, সম্বোধ্যমানতা আর মীমাংসা-প্রয়াসের ক্রিয়াকে অক্ষুণ্ণ রাখাই জীবনের, চেতনার, ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞান।
তিন
যা-কিছু যথাপ্রাপ্ত এবং যা-কিছু সম্ভাব্য, তাদের মধ্যে নিরন্তর বিনিময় চলে বলেই তো জীবনের আর সাহিত্যের পাঠ চূড়ান্ত হয় না কখনও। আসলে সম্বোধ্যমানতা নিয়ত আপেক্ষিক, নিয়ত চলমান। সম্বোধক নয়, সম্বোধিত অপরতাই মুখ্য এবং তা কেবলই নির্মীয়মান। যাকে বলেছি সম্বোধক সত্তা, তাও মূলত ঐ সম্বোধিতের দ্বারা উদ্দীপিত। বাখতিনীয় সত্তা কখনও সম্পূর্ণ নয়, কেননা দ্বিবাচনিক ভাবেই তার অস্তিত্ব বিকশিত হতে পারে। আমাদের জিজ্ঞাসা ও মীমাংসার প্রত্যাশা যত রূপান্তরিত হয়, একদিকে পাল্টে যায় আমির স্বরূপ, অন্যদিকে যাবতীয় অপরতার সঙ্গে অস্মিতার সম্পর্কের নির্মিতি। একটু আগে যে পার্থক্য-প্রতীতির কথা লিখেছি, সত্তা ও অপরতার স্বাতন্ত্র্য তার প্রাথমিক ভিত্তি, অন্য সব পার্থক্য দাঁড়িয়ে আছে এর ওপর। বাখতিন-কথিত কৃত্যের জগৎ হলো অস্মিতা ও অপরতার মূর্ত নির্মিতি—প্রকরণগত ও জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈপরীত্যের অভিব্যক্তি। নির্মিতির ধরন আমাদের উপস্থিতি, অভিব্যক্তি ও অভিপ্রায়ের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। তলিয়ে ভাবলে দেখি, অপরতাই প্রকৃত নিয়ন্তা। গভীরতর অর্থে অপর পরিসর সত্তার বন্ধু; কেননা অপরতা আপাত-গ্রহীতা হলেও আসলে তা সত্তার রূপকার। অপর না থাকলে সত্তার প্রকাশ হত না। বাখতিনের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য নিবিড় অভিনিবেশ দাবি করে, ‘Dialogism celebrates alterity’ (১৯৮৪: ৬৫)। যত রূপান্তরিত হচ্ছি, তত আমার সত্তার গভীরে অন্তঃশায়ী সম্ভাবনা প্রসারিত হচ্ছে। এবং, তা ঘটছে অজস্র কৃত্যের মধ্য দিয়ে। তবু এ কেবল উদ্যমের প্রসার নয়, এ আসলে অস্তিত্বের নানা বৈকল্পিক স্থিতির প্রতিষ্ঠা। এ-সম্পর্কে বাখতিনের মন্তব্য লক্ষ করার মতো: ‘As the world needs my alterity to give it meaning, I need the authority of others to define, or author, myself.’ (তদেব)। সক্রিয় পর্যবেক্ষক হিসেবে যে-সত্তা রয়েছে অস্তিত্বের কেন্দ্রে, জগতের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে গেলে তাকে কখনো নিরেট ও রুদ্ধ হলে চলে না। সত্তার মুক্ত উপস্থিতি মানে তার অভিব্যক্তি কোনো-একটি নির্দিষ্ট ধরনের হবে না; নানা বিকল্পের মধ্যে বিচ্ছুরিত হবে তার নির্মিতি-প্রকরণ, সম্ভাব্য মীমাংসার দিকে যাত্রা। জগৎ যখন সত্তাকে চায়, ঐ মুক্ত স্বভাবের নিরিখ ব্যবহারের জন্যেই চায়। যত বেশি বিকল্প অবস্থানের দর্পণে জগৎ নিজের সঙ্গে সত্তার সম্পর্ককে প্রতিবিম্বিত দেখে, তত তার তাৎপর্য অর্জন হয়ে ওঠে সার্থক। আবার নিজের সত্তাকে রচনা বা সংজ্ঞায়িত করতে চাই যখন, সমস্ত অপরের অনুমোদন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আসলে অনুমোদন নয়, অভিজ্ঞান। কেননা অপর পরিসর ব্যাপ্ত রয়েছে সর্বত্র, তার বাইরে কিছুই নেই। সত্তার সঙ্গে অপরের বন্ধুতা স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত জীবন নিষ্ফল, নিষ্ক্রিয়।
চিন্তাজীবনের সূচনাপর্বে রচিত হলেও ঐতিহাসিক কারণে ‘Art and Answerability’ এবং ‘Toward a Philosophy of the Act’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে ১৯৯০ ও ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ইংরেজি-জানা দুনিয়ার কাছে বাখতিনীয় চিন্তাবিশ্ব বিপুল উৎসাহে পঠিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। বাখতিনের তত্ত্ব-প্রস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণাও দৃঢ় ভিত্তি পেয়ে গেছে। তাই তাঁর চিন্তাজীবনের সূচনাপর্বে রচিত এই দুটি যুগলবন্দি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে তাঁরই ভাবনার দর্পণে ভাববিশ্বের ক্রমিক উন্মোচন ও পুষ্পায়ন পুনঃপরীক্ষিত হওয়ার চমৎকার সুযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এতে কিছু কিছু সমস্যার দিকও আছে। কেননা ইতিমধ্যে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত বাখতিনীয় ভাববিশ্ব দ্বারা এই দুটি প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ প্রভাবিত হওয়াটা অনিবার্য। পূর্ব-নির্ধারিত ধারণার সমর্থন খোঁজার জন্যে গবেষকেরা এই দুটি প্রতিবেদনকেই ব্যবহার করতে পারেন। ফলে বাখতিনের চিন্তাজীবনের সূচনাপর্ব তাঁর পরিণত পর্বের সঙ্গে কীভাবে ও কতখানি দ্বিবাচনিকতায় সম্পৃক্ত—তা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে পারে। এইজন্যে সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে নিয়ত প্রসারণশীল মুক্ত বয়ানের আপাত-স্বাতন্ত্র্যে প্রাগুক্ত দুটি প্রতিবেদনকে গ্রহণ করা। এই নিবন্ধ-প্রয়াসীও মূলত এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
আসলে বাখতিনের চিন্তাবিশ্বে উন্মুক্ততাই কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। তাঁর সমস্ত প্রধান চিন্তাবীজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে মুক্ত পরিসরের প্রতীতি যা নিয়ত সঞ্চরমান ও চূড়ান্তবিন্দু বিহীন। তাই তাঁর চিন্তাবিশ্বে পর্যটন অনন্য এক অভিজ্ঞতা। যে-কোনো বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করি না কেন, শেষ পর্যন্ত ফিরে আসি সেই বিন্দুতেই। তাই এতে কোনো যাওয়া নেই, আসাও নেই। আছে এমন এক অনন্ত বিস্তার যার নিরিখে সত্তা নিজেই নিজেকে নির্মাণ করে অনবরত। অফুরান এই অধ্যবসায়ে কল্পিত এক শীর্ষবিন্দু থাকে হয়তো, কিন্তু তা কেবল কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্যে। কেননা সমগ্রতা বা পূর্ণতার ধারণা কখনো অর্জন করা যায় না। তাই মুহূর্তেই অবসান হয় কাঙ্ক্ষিত সেই পরমতার। বলা ভালো, পরমতাও এক নির্মিতি এবং সেইজন্যে দ্বিরালাপের অন্তহীন প্রক্রিয়ায় সেই নির্মিতিকেও নিরাকৃত হতে হয় কখনো-না-কখনো। স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো একীভূত অভিজ্ঞান সত্তা কখনো অর্জন করতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার জগতে কিংবা দ্বান্দ্বিক চিন্তার অতিশৃঙ্খলিত যৌক্তিক বিন্যাসে সম্পূর্ণতা ও চূড়ান্ততা পুরোপুরি অলীক। অতএব সম্ভাব্য সম্বোধিত গ্রাহক অস্তিত্বের দিকে অনবরত বয়ে যায় জীবন, নতুন নতুন কৃত্য ও উদ্যম নির্মাণের মধ্যে প্রমাণিত হয় জীবনের অস্তিত্ব। জীবজগৎ বিকশিত হয় তারই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত পরিবেশে যার বিচিত্র স্থিতির উদ্দেশে অনবরত প্রত্যুত্তর রচনার ক্ষমতাতেই পরীক্ষিত ও নির্ণীত হয় জীবনের শক্তি, অস্তিত্বের তাৎপর্য।
প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা ও উদ্যমের দর্শন আপাতভাবে দুটি আলাদা খাত ধরে একই মোহনার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। প্রতিবেদনের মধ্যে যেভাবে উপস্থাপিত বা পুনরুত্থাপিত হয় জগৎ এবং বিভিন্ন ঘটনা ও উদ্যমের অভিজ্ঞতায় যেভাবে ব্যক্ত হয় জীবন—তাদের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বহুমাত্রিক ভাবনার সূত্রপাত করেছেন বাখতিন। এসেছে রচনা-প্রক্রিয়া, রচয়িতা, দায়বোধ, নন্দনের নৈতিকতা, সত্তা-বহির্ভূত অথচ সত্তায় সম্পৃক্ত বাহিরের প্রসঙ্গ। আর জেনেছি, কীভাবে কোনো প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েই নির্মাণ করতে হয় চিন্তাবিশ্বের স্থাপত্য। অস্তিত্বের বিপুল মহাপরিসরে তবু হুবহু পুনরাবৃত্ত হয় না কোনো কিছু; অনন্যতা পরাভূত হয় না কিছুতেই। সত্তা ও ভাষা, জগৎ ও মন, যথাপ্রাপ্ত ও সৃষ্টির মধ্যে চলমান দ্বিবাচনিকতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর যাত্রা এভাবেই প্রাথমিক যুগল প্রতিবেদনে শুরু হলো। একদিকে বস্তুবিশ্ব এবং অন্যদিকে চিহ্নবিশ্বের গ্রন্থনা অর্থাৎ অভিজ্ঞতার ক্রম ও উপস্থাপিত অভিজ্ঞতার নির্যাস-ক্রম: এই দুইয়ের অনস্বীকার্য ব্যবধান কীভাবে পেরিয়ে গেলেন বাখতিন? এদের পার্থক্যপ্রতীতিকে মান্যতা দিয়েও কীভাবে এবং কেন সংযোগের সেতু গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারলেন তিনি? এইসব আনুষঙ্গিক জিজ্ঞাসা এবং তাদের মীমাংসাপ্রয়াস সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে তোলে এই যুগল প্রতিবেদন যাতে আমরা নিজেরা ক্রমশ প্রত্যুত্তরযোগ্যতা অর্জন করতে পারি। পৃথিবী-বিখ্যাত বাখতিন-বিশেষজ্ঞ মাইকেল হলকুই Toward a Philosophy of the Act-এর প্রাক্কথন কাব্যিক ভাষায় লিখেছেন: ‘Bakhtin in this volume is seeking to get back to the naked immediacy of experience as it is felt from within the utmost particularity of a specific life, the molten lava of events as they happen. He seeks the sheer quality of happening in life before the magma of such experience cools, hardening into igneous theories, or accounts of what has happened. And just as lava differs from the rock it will become, so the two states of lived experience, on the one hand, and systems for registering such experience on the other, are fundamentally different from each other.’ (1995: X)
অভিজ্ঞতার নগ্ন প্রত্যক্ষতাকে যখন অগ্ন্যুৎপাত জনিত লাভাস্রোত উদ্গীরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়, ভাষ্যকারের নিজস্ব দৃষ্টিকোন অস্পষ্ট থাকে না। ঘটনা যখন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটতে থাকে, পর্যবেক্ষক সত্তা ঘটমান বর্তমানের শরিক; তরল আগুনের স্রোত ও উত্তাপে বিহ্বল হবেন না তিনি। কোনো-না-কোনো ভাবে নিজেকে বিবিক্ত করে নেবেন উত্তাল প্রবাহ ও ঝল্সানো আঁচ থেকে; নইলে তিনি দেখবেন না কিছু। অর্জিত হবে না কোনো অভিজ্ঞতা। বিশেষ জীবনের চূড়ান্তভাবে নির্দিষ্ট অবস্থানের গণ্ডি থেকে অনুভব করতে হয় ঘটনা-পরম্পরার তাৎপর্য। উদ্গীর্ণ লাভাস্রোত জমাট বেঁধে আগ্নেয় শিলাস্তরে পরিণত হয়; কিন্তু লাভা ও শিলা আলাদা। তেমনই অভিজ্ঞতাপুঞ্জ পাথরীভূত হয়ে ক্রমশ নানা ধরনের তত্ত্ববীজে রূপান্তর লাভ করে। একদিকে জীবনের অজস্র যথাপ্রাপ্ত অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে সেইসব অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রণালীবদ্ধ কৃৎকৌশল: এই দুইয়ের পার্থক্য অনস্বীকার্য। আবার সেইসঙ্গে সত্য তাদের দ্বিবাচনিক সম্পর্কও। অভিজ্ঞতা আমাদের তত্ত্বে পৌঁছে দেবেই যেহেতু তত্ত্বকে এড়ানোর কোনো জো নেই। যাঁরা অভিজ্ঞতার ওপর সর্বাত্মক গুরুত্ব দিয়ে তত্ত্বকে খারিজ করতে চান, তাঁদের একবাচনিক তত্ত্ব-বিরোধিতাও স্বভাবে তাত্ত্বিক। এইজন্যে প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা ও উদ্যমের মধ্যে সুড়ঙ্গলালিত সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাখতিনীয় আকল্প অনুযায়ী আমরা এক ধরনের আস্তিত্বিক বিবিক্ততার ইশারা পাই যেন। সময় ও পরিসরে ব্যাপ্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও যৌক্তিকতার বিন্যাস আমার লক্ষ করি কৃত্য বা উদ্যমের জগতে এবং সেই সঙ্গে তাদের তাৎপর্যসন্ধান প্রক্রিয়ায়। এই দুটির সমান্তরাল উপস্থিতি সত্য নিশ্চয়; কিন্তু ঐ উপস্থিতির মধ্যে যে ঐক্য-প্রতীতি ব্যক্ত হয়, তা কখনো আরোপিত নয়। এই প্রতীতিকে সর্বদা ও সর্বত্র প্রণালীবদ্ধ ভাবে অর্জন করতে হয়। এই অর্জনের সূত্রে আসে দায়বোধ ও নৈতিকতার প্রসঙ্গ, কথা ও কর্মের ব্যবধান দূর করে অস্তিত্বের সংগঠনে নন্দন ও দর্শনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করা তোলা। বাখতিনের একটি প্রসিদ্ধ মন্তব্য আরো একবার স্মরণ করা যায়: ‘It is only my nonalibi in being that transforms an empty possibility into an actual answerable act or deed.’ (১৯৯৫: ৮২)।
চার
এই মন্তব্যের নিষ্কর্ষ নিয়ে বাখতিন-বিশেজ্ঞরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। আমরা শুধু লক্ষ করব, শূন্য সম্ভাবনার রূপান্তর ঘটছে প্রকৃত বা বাস্তব কোনো প্রত্যুত্তরযোগ্য কর্মোদ্যমে। তার মানে এই শূন্য রিক্ত নয়; বরং সৃষ্টির প্রাক্-মুহূর্তের মতো গর্ভিত। অস্তিত্বের অন্তহীন পরিসরে সত্তার অনন্যতাই ঐ বিশিষ্ট শূন্যায়তনে বীজাধান করতে পারে। আর, এই বীজতলি থেকে নিরন্তর অঙ্কুরিত হতে থাকে বাস্তব ও সেই বাস্তবের নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবেদন। গ্রন্থনা রচিত হয় জিজ্ঞাসার, অনবরত মীমাংসা-প্রয়াসের বিস্তার ঘটবে বলে। যা কিছু ঘটছে ও ঘটতে পারে, তাদের গ্রন্থনায় রচিত হয় অনন্য জগৎ। এই জগতে অজস্র সমান্তরালতার মধ্য দিয়ে কেবলই উঠে আসতে থাকে ঐক্য-প্রতীতির নবায়মান পথরেখা। এতে অংশগ্রহণ করতেই হয় কেননা সত্তা মানে অংশীদার হওয়ার প্রত্যয়। অংশীদার না হয়ে কোনো উদ্যমে কিংবা চেতনায় পৌঁছানো যায় না। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজস্ব জগতের নির্মিতি-বিজ্ঞানের পথিকৃৎ। যতক্ষণ নতুন নতুন জিজ্ঞাসা উত্থাপন না করছি এবং তাদের মীমাংসা-যোগ্যতা নিজেদের অনন্য অস্তিত্বে পরীক্ষা না করছি—বিষয়ীসত্তা ও বিষয়বোধ অনায়ত্ত থেকে যাবে। এ প্রসঙ্গে বাখতিনের অসামান্য দ্যোতনাগর্ভ মন্তব্য স্মরণ করতে পারি: ‘Life can be consciously comprehended only in concrete answerability. A philosophy of life can be only a moral philosophy. Life can be consciously comprehended only as an ongoing event, and not as Being qua a given. A life that has fallen away from answerability cannot have a philosophy: it is, in its very principle, fortuitous and incapable of being rooted.’ (১৯৯৫: ৫৬)।
বাখতিনের বাচন এখানে দার্শনিক দ্যুতিতে দীপ্যমান। যে-জীবন ঊষর, তাতে কোনো জিজ্ঞাসা থাকে না; অতএব মীমাংসার জন্যে কোনো প্রস্তুতি বা ব্যাকুলতা থাকে না। এই জীবন নিরুদ্যম ও ব্যর্থ, তার শেকড়ে নেই জলের তৃষ্ণা, শাখায়-শাখায় নেই আকাশের প্রত্যাশা। ছিন্নমূল জীবন মীমাংসা-প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুত বলেই তা দর্শনবিহীন নন্দনরহিত। এমন অপ-জীবনের উদ্দেশে প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক উচ্চারণ করেছিলেন ধিক্কার: ‘অসূর্যা নাম তে লোকাঃ অন্ধেন তমসাবৃতাঃ। তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ॥’ অধিবিদ্যাগত অনুষঙ্গ বর্জন করে যদি পুনঃপাঠ করি, আত্মহনন মানে হতে পারে মীমাংসা-যোগ্যতা সম্পর্কে নিস্পৃহ নিরাবেগ নিরেট মানুষের সত্তাবলুপ্তি। আর, তার জন্যেই বরাদ্দ থাকে নিশ্ছিদ্র পারাপারহীন অন্ধকার। এই অপমানুষের উদ্যম নেই, অপরতার অস্তিত্ব সম্পর্কে বোধ নেই। তার এপার-ওপারও নেই; নেই কোনো আরম্ভ কিংবা বিস্তার। জীবনকে সচেতন ভাবে অনুধাবন করতে পারি কেবল চলমান ঘটনা-পরম্পরার নিরিখে, কল্পিত কোনো পরাসত্তার বিভঙ্গ হিসেবে নয়। বাখতিন যখন বলেন, জীবনের দর্শন শুধুমাত্র নৈতিক দর্শন হতে পারে—অস্তিত্বের মর্মমূলে প্রচ্ছন্ন শৃঙ্খলার উপলব্ধির প্রতি তিনি তর্জনি সংকেত করেন। যেহেতু এই বক্তব্যের সঙ্গে তিনি মূর্ত মীমাংসা-যোগ্যতার নিরিখে সচেতন ভাবে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধির বার্তাকে মিলিয়ে নিয়েছেন—কৃত্য বা উদ্যম, তত্ত্ববীজ বা চিন্তাপ্রণালী শুধুমাত্র সর্বাত্মক আস্তিত্বিক উপলব্ধির ভিন্নভিন্ন স্তর না-হয়ে সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও নৈতিক ইতিহাসের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক আধুনিকোত্তর নির্মাণবায়ন প্রবণতা যখন মানবসত্তার সমস্ত আদিকল্প ও আকল্পকে চরম তাচ্ছিল্য ও ঔদ্ধত্য দিয়ে নিরাকরণ করছে, বাখতিনের প্রাগুক্ত মন্তব্যকে আধিপত্যবাদের উদ্দেশে কার্যকরী প্রতিস্পর্ধা বলে পুনঃপাঠ করতে পারি আজ।
যেহেতু মানুষই শুধু জীবন ও বাচনের পাঠ নির্মাণ করতে পারে এবং সম্বোধিত সত্তার উদ্দেশে প্রেরিত বয়ানের দায়ও মানুষের পক্ষেই কেবল গ্রহণ করা সম্ভব—নির্মাণবায়ন প্রবণতাকে প্রতিস্পর্ধা জানানোর জন্যে বাখতিনীয় ভাবকল্পকে নতুন ভাবে কর্ষণ করা যেতে পারে। আজকের আধুনিকোত্তর অধিবাস্তব যখন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অভিনব উৎকর্ষকে ব্যবহার করে শুধু নিশ্চিহ্নায়নের তোড়ে সময় ও পরিসরের অনুষঙ্গকে অবান্তর করে দেওয়ার জন্যে, মানুষের সঙ্গে তার জগৎ-পরিবেশের সমস্ত সম্ভাব্য সম্পর্ক মুছে ফেলার জন্যে—বাখতিনের তত্ত্ব মানুষের নির্বাসন-আশঙ্কাকে প্রতিহত করতে পারে। সাম্প্রতিক উত্তর-মানবতন্ত্রী যুগে এই মানবিক নিষ্কর্ষ পুনঃপাঠ নিছক বৌদ্ধিক কৃত্য নয়; তা আসলে যুদ্ধের ঘোষণা। বস্তুত বাখতিনের আরেকটি মহাবাক্য যেন প্রতিষ্ঠিত হয় এতে; সমস্ত তাৎপর্যই সংঘর্ষ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়। উদ্যম বা কৃত্য শুধু চিন্তা-অনুভূতি-অভিজ্ঞতার উপস্থাপনা মাত্র নয়, তাকে বুঝে নিতে হবে প্রত্যুত্তর হিসেবে। জগতের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ব্যক্তিসত্তা যখন নিজের জন্যে কোনো তাৎপর্য গড়ে নিতে চায়, তার প্রয়াসের প্রণালীবদ্ধ অভিব্যক্তি হলো ঐ উদ্যম। সুতরাং সামাজিক পরিস্থিতি থেকে উৎসারিত জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যে সত্তা নিজেকে যখন নির্মাণ করে, একই সূত্রে তার প্রত্যুত্তর-মূলক বয়ানও নির্মিত হয়ে যায়।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিক অনবরত বদলে যেতে-যেতে ব্যক্তিসত্তার জিজ্ঞাসাকেও সংগঠিত করে। নির্মিতি-সংলগ্ন বিভিন্ন সম্পর্ক-বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সত্তা নিজেকে চিনে নেয় এবং নিজস্ব অস্তিত্বের তাৎপর্যও সৃষ্টি করে। এই সৃষ্টিতে কীভাবে অপরিহার্য অপর সত্তার উপস্থিতি, তা আগেই আলোচিত হয়েছে। এখানে শুধু একথাই বলতে পারি যে উদ্ধত প্রতাপের যাবতীয় রুদ্ধতার চক্রান্ত প্রতিহত হয় নির্মাণের মানবিক দ্বিবাচনিকতায়। এই সূত্রে যত চিহ্নায়ক বা রূপকের কথা ভাবি না কেন, তা সক্রিয় পর্যবেক্ষকের নিজস্ব উপস্থাপনার তাগিদে রচিত হয়। চেতনার পক্ষে অজ্ঞেয় কিছু নেই; আড়াল তৈরি হয় দৃষ্টিক্ষীণতায়, ধারণার একবাচনিকতায়। দেখা মানে হওয়া—চিরাগত অধিবিদ্যার এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে বাখতিন আমাদের জানিয়েছেন: কোনো বস্তুর প্রতীতি সর্বদা পর্যবেক্ষকের সঙ্গে সমান্তরাল। অর্থাৎ কোনো কিছু জানার মানে হলো তাকে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা অর্জন।
সুতরাং কোনো উদ্যম বা কৃত্য জীবনে ও পাঠকৃতিতে সর্বদা দৃষ্টির ঘোষণা, দৃষ্টির নির্মিতিও। জীবন বা বয়ানকে আধিপত্যবাদ যখন রুদ্ধ করতে চায়, অস্তিত্বের প্রকরণ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক অপরতার পরিসরও প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। বাখতিনীয় ভাবকল্প অনুযায়ী সত্তা যখন ‘দৃষ্টির উদ্বৃত্ত’-তে আস্থা প্রকাশ করে, প্রতাপের একবাচনিক স্থিতি প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। ‘দৃষ্টির উদ্বৃত্ত’ মানেই সীমাতিযায়ী অবস্থানে বিশ্বাস ঘোষণা। বহির্জগৎ সম্পর্কে সচেতন মানুষই কেবল তেমন দৃষ্টির অধিকারী। আর, উদ্বৃত্তে বিশ্বাসী হওয়ার ফলে মানবিক পরিসরে একাধিপত্যের আশঙ্কাতেও বিচলিত হয় না পর্যবেক্ষক সত্তা। জীবনের নির্মিতি-প্রকল্প পরাভূত হয় না। সত্তাকে যেহেতু প্রকল্প হিসেবে ভেবে নিতে হয়, তার পুনর্নবায়ন অক্ষুণ্ণ থাকে সর্বদা। প্রতিটি সত্তাই যেহেতু সহযোগী সত্তা অর্থাৎ সত্তার ধারণা অনিবার্য ও নিষ্কর্ষগত ভাবে সামাজিক, সত্তার বয়ান নির্মাণে পারস্পরিক সহযোেগ অব্যাহত থাকে। সর্বত্র ব্যাপ্ত আধুনিকোত্তরবাদী চিন্তা-সন্ত্রাসের পর্যায়েও ঐ সংযোগের মৌল সম্ভাবনা আচ্ছন্ন হতে পারে না। এ কেবল বিশ্বাস নয়, এ হলো আস্তিত্বিক ও সামাজিক তথ্য। এই মৌল তথ্যের বিরুদ্ধে যাওয়া চলে না কেননা হওয়ার বিরুদ্ধে যেতে পারে না কেউ। বলা বাহুল্য, এই হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয় শুধু, এ আসল জৈবিক ও ঐতিহাসিক ভাবে অপরিহার্য।
পাঁচ
বাখতিনের প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা বিষয়ক ভাবনায় তাই ‘যোগ্যতা’ কথাটি শেষ পর্যন্ত সর্বজনীনতার ইঙ্গিত বয়ে আনে। কেননা মানবিক সত্তার প্রকল্পকে নির্মাণ করতে গেলে এই যোগ্যতা শুধু প্রত্যাশিত ঘোষণামাত্র থাকে না। মানবিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হওয়ার পক্ষে এ হলো ন্যূনতম অভিজ্ঞান। নিরন্তর উত্থাপিত জিজ্ঞাসার জবাব তৈরি করতে হবে মানবিক দায়বদ্ধতার তাগিদে। নইলে নিশ্চরিত্র বা লক্ষ্যশূন্য যথাপ্রাপ্ত জগৎ রূপান্তরিত হয়ে কাঙ্ক্ষিত তাৎপর্যের অভিমুখী হবে না। উদ্যমের মধ্য দিয়ে নিজস্ব জগৎ ও তার মূল্য গড়ে তুলতে হবে। কোনো তাৎপর্যই পূর্বনির্ধারিত নয় বা কোনো জগৎই তাৎপর্যের নিরিখে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অজস্র অপরতার সঙ্গে গ্রথিত মানুষই প্রকৃত স্রষ্টা এবং অর্জিত তাৎপর্যের ভোক্তা। নির্মিতির দিক দিয়ে কেউ এগিয়ে বা কেউ পিছিয়ে থাকতে পারে; কিন্তু কেউই সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয় না। তবে ন্যূনতম প্রাক্শর্ত হলো, উদ্যমের নির্মিতিতে নিছক প্রয়োজন নয়—দায়বোধের অভিব্যক্তি ঘটবে।
মূল্যনিরপেক্ষ জীবন যাপন করা কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা ইতিহাসকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না, অস্বীকার করতে পারে না বিশেষ সময় ও পরিসরের অন্তর্বয়নকে। সওয়াল তৈরি করতে করতে আর জবাব খুঁজতে খুঁজতে পার হয়ে যায় জীবন। কতবার বাহির ও ভেতরের সংজ্ঞা ও অবস্থান পালটে যায়, বিভিন্ন অবস্থানের অভ্যন্তরীন সীমানা রূপান্তরিত হয়। তবুও অব্যাহত থাকে মীমাংসা-যোগ্যতা অর্জন করার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াই রচনা করে ব্যক্তি-জীবন ও সামূহিক জীবনের ইতিহাস; উদ্যম ও চিন্তার সন্দর্ভে বারবার পুনঃপঠিত হয় অনন্যতা। মুক্ত ও সমাপ্তিবিহীন জীবনের বহুমাত্রিক সময় ও পরিসরের নির্মিতি-প্রকরণকে অনুধাবন করতে করতে ব্যক্তি-অস্তিত্বের উপকূল-রেখায় পৌঁছে যাওয়া: এই হলো বার্তা। মীমাংসা এক অসমাপ্ত প্রকল্প—এই জেনে সম্ভাব্য প্রত্যুত্তরের জন্যে অনবরত তৈরি হতে থাকা—এরই নাম জীবন।
যখন মনে রাখি যে গভীরতম এই দার্শনিক উপলব্ধিকে বাখতিন ভাষা ও সাহিত্যে অন্যোন্য-সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন কিংবা সত্তা ও অপরতার দ্বিরালাপে যুক্ত করেছিলেন সৃষ্টি, রচয়িতা ও কর্তৃত্ববোধের স্বভাব সম্পর্কিত জিজ্ঞাসাকে—সম্বোধ্যমানতার বহুস্বরিক প্রক্রিয়া আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ করেছেন, ধর্মতাত্ত্বিক ভাবনা ও ধর্ম-নিরপেক্ষ চিন্তাধারাকে বাখতিন একই ভাবে তাঁর চিন্তাবিশ্বের মুক্ত পরিসরে ব্যবহার করেছেন। তবে এ সম্পর্কে বিতর্কেরও অবকাশ আছে। এ সম্পর্কে আর কিছু কথা না-বলে আমরা বরং দীপায়নোত্তর জগতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের প্রেক্ষিতে বাখতিনের রচয়িতা-পাঠকৃতি-প্রত্যুত্তরযোগ্যতা-নির্মিতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রকল্পে নিহিত নতুন ধরনের তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করব। দৈনন্দিন জীবনের বাচনে নিয়ত যেসব বয়ান রচিত হয়ে চলেছে, তাদের সঙ্গে সাহিত্যিক পাঠকৃতিরও নিষ্কর্ষ-সম্পর্কিত আলোচনা থেকে বুঝে নেব, কেন বাখতিনের দার্শনিক নৃতত্ত্বে মানুষ হওয়ার অভিজ্ঞান হলো তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠা। ‘to be human is to mean’—এভাবে বাখতিনের কেন্দ্রীয় আকল্পের অন্তঃসার তুলে ধরে। হলক্যুইস্ট লিখেছেন: ‘Human being is the production of meaning, where meaning is further understood to come about as the articulation of values.’ (১৯৯৫: একচল্লিশ)।
মানুষ যেমন তাৎপর্য সৃষ্টি করে, তেমনই তাৎপর্যও তাকে রচনা করে চলেছে। ইতিহাসের সঙ্গে অপরিহার্য দ্বিবাচনিকতায় মূল্যমানের অভিব্যক্তিও রূপান্তরপ্রবণ মানুষের সঙ্গে অনবরত বদলে চলেছে। পাল্টে যাচ্ছে সম্পর্ক, সত্তার নান্দনিক ও দার্শনিক বৈধতা, উদ্যমের আকরণ ও নির্যাস। এ আসলে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তীব্রতর হয়ে-ওঠা সংঘর্ষের বয়ান। স্বভাবত এই সংঘর্ষ বদলে দিচ্ছে উচ্চারণের অন্তর্বৃত বিন্যাস এবং অপর সমস্ত উচ্চারণের সঙ্গে তার দ্বিরালাপের বৈশিষ্ট্যও। আগেই লিখেছি, আধিপত্যবাদের কৃৎকৌশল প্রত্যাখ্যানের শক্তিও অর্জিত হচ্ছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে। ইতিহাসই যোগান দিচ্ছে দৃষ্টির উদ্বৃত্ত, নিরন্তর মিথষ্ক্রিয়ার উত্তাপ। কোনো বিশেষ সময়পর্বে কিংবা পরিসরে পাঠকৃতিতে তথ্য যে রূপান্তরিত হচ্ছে চিহ্নায়কে কিংবা চিহ্নায়কপুঞ্জও বিশেষ পরিস্থিতিতে তথ্যপুঞ্জে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, তারও নির্ণায়ক ইতিহাস। মনে পড়ে, তাৎপর্যকে বলা হয়েছে বিশিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর সময়বাহিত সম্ভাবনার প্রকাশ (Communal possibility)।
অন্যভাবে বলা যায়, বহু ব্যক্তিসত্তার সমবায়ী উপস্থিতি কোনো বিশেষ কালে-পরিসরে-জনসন্নিবেশে যখন নির্দিষ্ট কিছু জিজ্ঞাসা-প্রকরণ ও সম্ভাব্য মীমাংসা-প্রয়াসের আকল্প নির্মাণ করে নেয়—বিশেষ ধরনের তাৎপর্যসন্ধান ব্যক্ত হয় দার্শনিক ও নান্দনিক উদ্যমে। এমন ঘটে দ্বিবাচনিক সংযোগ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। কোনো কারণেই এই মৌলিক বিধি এড়ানো যায় না। বাখতিন বলেন: ‘to be means to communicate dialogically. When the dialogue ends, everything ends.’ (১৯৮৪: ৮৬)। যেহেতু এই সংযোগ শুধু তথ্যের নয়, চিহ্নেরও অর্থাৎ বাচনের সঙ্গে পরাবাচনের—ইতিহাস-নির্দিষ্ট বস্তুবিশ্ব এবং নির্যাস-কেন্দ্রিক চিহ্নবিশ্ব যুপগৎ বিচার্য। মানুষের ইতিহাসের পক্ষে যাঁরা দাঁড়াতে চান, প্রতিবেদনকে ‘communal engagement’ বলে জেনে বাচনকে ‘দ্বিমুখী কৃত্য’ হিসেবে ব্যবহার করা তাঁদের শিখে নিতে হয়। কৃত্যের এই উভচারিতা সম্পর্কে যিনি অবহিত, তাঁর কাছে প্রত্যুত্তরযোগ্যতা অর্জন করার প্রক্রিয়া ও লক্ষ্য সর্বদা দ্বিবাচনিক। বাচনের উৎসে কারা রয়েছে এবং কাদের উদ্দেশে বাচন উৎসারিত হচ্ছে—এই দুটি পক্ষ সমানভাবে কৃত্যের স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাৎ নির্মাতা এবং নির্মাণের লক্ষ্য: দুটোই প্রতিবেদনের নিয়ামক। তাই আস্তিত্বিক সংগঠনের সঙ্গে উচ্চারণ-বিন্যাসের দায়বোধ তাঁরাই স্বীকার করে নিতে পারেন, যাঁরা নিজেদের সঙ্গে বহির্বৃত জগতে ব্যাপ্ত অপর পরিসরগুলির অনন্যতাও সমানভাবে স্বীকার করেন।
কৃত্য বা উদ্যম (deed) বাখতিনের কাছে বাচন ও ক্রিয়া—দুই অর্থই দ্যোতিত করে। কীভাবে তাৎপর্য উপলব্ধ হতে পারে এবং বাচন হয়ে উঠতে পারে শরীরী বাস্তব—এই জিজ্ঞাসার সূত্রে তিনি রচনাপ্রক্রিয়া, রচয়িতা ও নায়কসত্তার পার্থক্য, সত্তা ও অপরতার ব্যবধান ইত্যাদি প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন। লেখক/প্রতিবেদক বাখতিনের কাছে কোনো একবাচনিক ও স্থিরীকৃত অস্তিত্ব নয়; কৃত্যের সঞ্চালক হিসেবে তা বিশিষ্ট দক্ষতা ও শক্তির পারিভাষিক নাম। তাই স্রষ্টা-লেখক আর লেখক-ব্যক্তি হুবহু এক হতে পারে না। সত্তার পরিচয় ফুটে ওঠে তার প্রকল্পে; ব্যক্তির জৈবিক অবস্থানের সঙ্গে সত্তাকে পুরোপুরি মেলানো যায় না। তেমনি লেখক-স্রষ্টাও বিশিষ্ট উপস্থিতি; কৃত্যের নিরিখে নির্ণীত হয় তার অভিজ্ঞান। সৃষ্টির প্রক্রিয়া যখন চলমান, সাধারণ অবস্থান থেকে লেখক-সত্তা উন্নীত হয় ‘বিশেষ’ অবস্থানে। নানা ধরনের অন্তর্বৃত ও বহির্বৃত সংঘর্ষ আছে সত্তার। তারই মধ্যে স্রষ্টা-প্রতিবেদকের সংঘর্ষ আরও একটু আলাদা। এই সংঘর্ষ যেমন কৃত্যের হয়ে ওঠায় অনুভূত হয়, তেমনি লক্ষ করা যায় সন্দর্ভে বিভিন্ন কুশীলবের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোনের উপস্থাপনায়, বিশেষত নায়কসত্তার রচনায়। পাঠকৃতির মধ্যে বিভিন্ন পরিসরের উপস্থিতি ও উচ্চারণের বহুত্ব যে মূলত উপস্থাপিত দৃষ্টিকোনের বহুত্ব—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্রষ্টা-প্রতিবেদকের সংঘর্ষময় তাৎপর্যসন্ধান এভাবেই পাঠকৃতিকে বহুস্বরিক ও অনেকার্থদ্যোতক করে তোলে।
বাখতিন লিখছেন: ‘The Artist's struggle to achieve a determinate and stable image of the hero is to a considerable extent a struggle with himself’ (১৯৯৫: ৬)।
এই বিষয়টি এমন যা সূক্ষ্ম বা সানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দাবি করে। এখানে যে আত্মগত সংঘর্ষের কথা বলা হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠকৃতিতে তার অভিব্যক্তিও ভিন্ন ভিন্ন। নায়কসত্তায় থাকে কেন্দ্র ও পরিধির টানাপোড়েন, প্রতিবেদক ও অপরতার আততি। কেননা তার অন্বিষ্ট উপস্থিতিতে লেখকস্বরের অনুপস্থিত অস্তিত্ব কখনো কখনো অনতিক্রম্য। লেখক যেহেতু ‘secret legislator of the text’ (১৯৮৪: ৮৯), নায়কসত্তার সার্বভৌমত্ব শুধুই প্রতীয়মান। তবে যখন উত্তমপুরুষ কথকের বয়ানে ঐ সত্তা উপস্থাপিত, প্রত্যুত্তরযোগ্যতা ও নির্মিতি-বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ নানাভাবে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। বাঙালি পাঠকের কাছে রজনী, চতুরঙ্গ, জাগরী, বিবর কিংবা কঙ্কাবতী, পথের পাঁচালী, অন্তঃশীলা, কাঁদো নদী কাঁদো, হারবার্ট, খোয়াবনামা অথবা বিষবৃক্ষ, গোরা, ঘরে-বাইরে, পুতুল নাচের ইতিকথা, গণদেবতা, অন্তর্জলী যাত্রা, অরণ্যের অধিকার প্রভৃতি উপন্যাসে লেখকসত্তা-নায়কসত্তা-কথকসত্তার দ্বিবাচনিক নির্যাস যেভাবে ধরা পড়ে, তা নিবিড় বিশ্লেষণের বিষয়। বাখতিনীয় আকল্প অনুযায়ী প্রাগুক্ত সত্তাগুলির আন্তঃসম্পর্ক ঐসব উপন্যাসে নানা ধরনের জিজ্ঞাসার সমান্তরালতা ও অজস্র মীমাংসা-প্রয়াসে দেখতে পাই। এইসব সত্তার অভিব্যক্তিতে যত বিভঙ্গ লক্ষ করি, সেইসব অন্তঃস্বরের সমারোহ সম্পর্কে অবহিত করে আমাদের। এই সমারোহে চূড়ান্ত মীমাংসা নেই, আছে শুধু মীমাংসা-প্রয়াসের নিরবচ্ছিন্ন আর্তি। নির্মিতির বিবিধ বর্গ হিসেবে এইসব মূলত সত্তা ও অপরতার মৌল পার্থক্য ও সমান্তরালতার যুগলবন্দি। ঐ প্রত্যয়ের নানা অভিব্যক্তি শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে কেবল ‘architectonics of consciousness.’ (তদেব, ৯৪)-এর চূড়ান্তহীন বিচ্ছুরণ নিয়ে।