বাখতিন/মুক্ত বাচনের প্রতীতি

মুক্ত বাচনের প্রতীতি

মিখায়েল বাখতিন। কোনো নিরিখেই নিছক নাম নয় শুধু, নিয়ত বিকাশমান চিন্তাপ্রস্থানের কেন্দ্র। কয়েক বছর আগেও অগ্রণী বাঙালি পড়ুয়ারা বাখতিনকে তত্ত্ববিদদের জমায়েতে নিছক আরো একজন কেউ বলে ভাবতেন। দেবেশ রায়ের পথ-প্রদর্শক বিশ্লেষণের পরে বাংলায় বাখতিন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বই বেরিয়েছে। এবং এই সময় বাখতিন সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এছাড়া আরো কয়েকটি ছোট পত্রিকা বাখতিন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা-ঋদ্ধ প্রবন্ধ ছেপেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই জায়মান চিন্তাপ্রস্থান অনুশীলন করে উপন্যাস-আলোচকেরা নতুন নতুন ভাববীজ নিয়ে আসছেন তাদের প্রতিবেদনে। তবু এত কিছু সত্ত্বেও এখনো তো গেল না আঁধার, এখনো দ্বিধা ও সংশয় কারো কারো পদচারণাকে কুণ্ঠিত করে রাখে। বিশেষত বাঙালি বৌদ্ধিক সমাজের একটি বিচিত্র ব্যাধি একুশ শতকেও অটুট রয়ে গেছে। সব কিছুকেই টুকরো করে দেখতে ও দেখাতে অভ্যস্ত বলে কোথাও সামগ্রিকতার প্রতীতি এদের অনেকের মনেই কিছুমাত্র রেখাপাত করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সর্বগ্রাসী অনিকেত বোধ ও অনবস্থার প্রবণতায় স্বেচ্ছাসমর্পিত হওয়ার ফলে নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শন্য পরিসরে এদের বিচরণ। সব কিছুকে সন্দেহ করার মধ্যে কোনো দার্শনিক প্রণালী ব্যক্ত হয়। না; এদের বয়ানে আত্মিক নৈরাজ্য, চূড়ান্ত অগভীরতা ও একরৈখিক ভাবনার কৃষ্ণ-বিবর শুধু উন্মোচিত হয়। তৃতীয়ত এরা বাখতিনকে অন্য সাধারণ চিন্তা-প্রস্থানের প্রবক্তাদের মতো মনে করেন। এরা ভূলে যান, বাখতিনীয় চিন্তা-প্রকল্প মূলত বহুবাচনিক ও অনেকান্তিক। জীবনের পাঠকৃতি কী বিস্ময়কর ভাবে মুক্ত—এই উপলব্ধির তাৎপর্য কত বিচিত্রভাবে অনুসরণ করা সম্ভব, বাখতিনীয় ভাববীজ সেই সত্য বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। কিন্তু এরা সেকথা মানতে নারাজ।

 আসলে সব ধরনের অগভীর সফরীসঞ্চরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা যথার্থ বাখতিন-অনুশীলন থেকে পাওয়া সম্ভব। জিজ্ঞাসু সত্তা জীবন ও জগতের সঙ্গে কীভাবে তার সম্পর্ক গড়ে তুলবে, সময় ও পরিসরের প্রতীয়মান অবয়বের নির্মোক ভেদ করে কীভাবেই বা গড়ে তুলবে অস্তিত্বের একক ও সামূহিক বোধ—এই অত্যন্ত মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন পাঠও বাখতিন-ভাবনা থেকে পাওয়া সম্ভব। যতক্ষণ এই জরুরি প্রাথমিক কথাটি না বুঝতে পারছি, অন্তত ততক্ষণ ছ’জন অন্ধের হাতি দেখার রূপকটি ফিরে ফিরে আসবে। আধুনিকোত্তর চিন্তাপ্রণালী যখন ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি সমাজে নানা ধরনের জটিল স্ববিরোধিতাও কূটাভাস, অনন্যয় ও মরীচিকা-প্রীতির সূচনা করেছে, বাখতিন-ভাবনাকে উত্তরোত্তর বিকশিত করার স্বার্থে নতুন পুনঃপাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা কেউই ইতিহাসের বাইরে নই; বাখতিনের চিন্তা-প্রবাহও ইতিহাসের নির্মিতি। আবার বাখতিন তাঁর বহুস্বরিক চেতনা দিয়ে ভাবনার ইতিহাসকেও আমূল পুনর্বিন্যস্ত করে নিয়েছেন। তেমনি আমরাও আধিপত্যবাদ-স্পষ্ট নির্মিতিকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ভাবনার জায়মান ইতিহাসকে পুনর্গঠন করতে পারি। এই প্রক্রিয়া যতক্ষণ সচল থাকে, ততক্ষণই আমাদের অস্তিত্ব স্পন্দমান। একটাই শর্ত শুধু; সাহিত্যতাত্ত্বিক-সমাজতান্ত্রিক-দার্শনিক-প্রতিবেদনতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসুদের বহুকৌণিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে অবহিত হয়ে আমরা বাঙালিরাও যেন দেশজ সাংস্কৃতিক স্বভাব ও আন্তর্জাতিক চেতনা-প্রেক্ষিতের দ্বিবাচনিকতার ক্ষেত্রগুল আবিষ্কার করে নিতে পারি।

 এই দ্বিবাচনিকতা ও ডায়লগের প্রামাণিকতা নিয়ে যাঁরা কিছুতেই সংশয় কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, তাঁদের উদ্দেশে একটিমাত্র কথা বলা যেতে পারে। তাঁর যেন বইয়ের পাতায় নিজেদের সীমাবদ্ধ না-রেখে জীবন ও জগতের অন্তহীন আবহে ঐ কেন্দ্রীয় ভাববীজটির তাৎপর্য সন্ধান করেন। যে-তত্ত্ব জীবনকে উদ্ভাসিত করে না, তা কোনো তত্ত্বই নয়। এই নিরিখে বাখতিন অদ্বিতীয় চিন্তাবিদ নন কেবল, তিনি জীবনের আশ্চর্য অনন্যতার আবিষ্কারক ও ভাষ্যকার। তাঁর ভাবনা আজকের চরম উৎকেন্দ্রিক পৃথিবীতে, আক্ষরিক ও রূপক অর্থে, মনঃপীড়ার আরোগ্য হয়ে আসে। জীবনের সম্ভাবনাকে ধ্বংস-গোধূলিতে আচ্ছন্ন হতে দেন না তিনি, সম্ভাবনার নবায়মান নির্মিতি-বিজ্ঞানই তার অন্বিষ্ট। জীবন নামক পাঠকৃতিতে তিনি খুঁজতে চান নিরবচ্ছিন্ন প্রশ্নমালার যথার্থ উত্থাপন এবং তাদের মীমাংসা-যোগ্যতার বিচিত্র কর্ষণ। সত্তা ও সমাজ-সংস্থার মিথস্ক্রিয়া সর্বদা পূর্ব-নির্ধারিত পথে ঘটে না বলে এদের দ্বিবাচনিকতা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা চলে না। প্রতিটি ব্যক্তি-অস্তিত্ব ও সামাজিক-অস্তিত্বের উচ্চারণ একই সঙ্গে প্রাগুক্ত মিথস্ক্রিয়ার ফসল এবং অনন্য, স্বাধীন, চূড়ান্ততাহীন। জীবন-সম্পর্কিত বীক্ষণ বাচনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয় বলে উচ্চারণ ও সত্তা বিষয়ক জিজ্ঞাসা অন্যোন্য-সম্পৃক্ত। বাখতিনীয় ভাববিশ্বে মানবিক অস্তিত্ব অফুরান বিস্ময়ের আকর, কেননা তাতে সমাপ্তি বা চূড়ান্তবিন্দু বলে কিছু নেই। সাম্প্রতিক নির্মাণবায়নের প্রেক্ষিতে বাখতিন-ভাবনার গুরুত্ব তাই অসামান্য। যতক্ষণ এই সত্যের উদ্ভাসন না ঘটছে, ততক্ষণ এই অদ্বিতীয় তত্ত্ববিশ্বের প্রকৃত তাৎপর্য অধরা রয়ে যাবে। বাখতিনের চিন্তা-জীবনে প্রারম্ভিক পর্যায় ও পরিণত পর্যায় অনেক সময় জটিলতা তৈরি করলেও কিছু কিছু কেন্দ্রীয় ভাবকল্প সম্পর্কে আগাগোড়া সচেতন থাকতে হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল জীবনকে চিরনির্মীয়মান প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করার তাগিদ। বিশ্বাস নয় কেবল, সংহত চর্যার কথাও বলতে চান এই জীবন-তাত্ত্বিক: আমাদের পৃথিবীতে কখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয় না। জগতের কোনো কথাই শেষ কথা নয়; বস্তুত এই পৃথিবী সম্পর্কে চূড়ান্ত কথাটি কেউ বলতে পারে না কখনো। এই জগৎ আমরাই তৈরি করেছি অথচ বারবার তা যেন আমাদের মুঠো থেকে ঝরে যায়। অস্তিত্বের মধ্যে যতটুকু এই পৃথিবীকে বুঝি, তার বাইরে এর কোনো উপস্থিতি নেই কোথাও। এ জগৎ মুক্ত এবং স্বাধীন; বর্তমানের দর্পণে এর প্রতিবিম্ব দেখছি যখন, ততক্ষণে সেই মুহুর্তের অবসান হয়ে গেছে। আসন্ন অথচ অস্থির ভবিষ্যতের পটে সত্তা ও জগৎ বিধৃত যেন। উপলব্ধির সব আয়তন উচ্চারণে ধরা পড়ে না; তবু উচ্চারণের নিরন্তর নির্মাণই মানুষের ভবিতব্য।

 এই বিন্দুতে মনে পড়ে মিশেল ফুকোর The Order of Things বইয়ের একটি মন্তব্য: বস্তুবিশ্বের জ্ঞানে ভাষা সম্পৃক্ত নয় আর, ভাষার সম্পর্ক এখন মুক্তির সঙ্গে (Language is no longer linked to the knowning of things, but to men's freedom)। অর্থাৎ ভাষা আর ভাবের স্বচ্ছ মাধ্যমমাত্র নয়; তারও আছে নিজস্ব জীবন ও বিধিবিন্যাস। বাচনের নিবিড়তা ও সূক্ষ্ম ব্যাপ্তির তাৎপর্য পুনরাবিষ্কার আসলে অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসাকে সুসংহত ও প্রণালীবদ্ধ করার জন্যেই আবশ্যিক। এই বক্তব্য-সূত্রে ফুকো অনেকটা পরিমাণে বাখতিনের কাছাকাছি চলে আসেন। বিষয়টি অবশ্য এমন যা খুব সতর্ক ও অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ দাবি করে। এখানে তার অবকাশ নেই। তবে দুরূহ জ্ঞানতাত্ত্বিক বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, শব্দ নিছক জ্ঞানের আধার নয়: এই উপলব্ধি কীভাবে আমাদের শৃঙ্খলমুক্ত করে, তা স্বতশ্চলভাবে স্পষ্ট নয়। বস্তুবিশ্বে গ্রথিত বলেই তো ভাষা কার্যকরী ও বার্তাবাহক হতে পারে; কিন্তু অনস্বীকার্য এই নির্ভরতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা কোথাও রয়ে যায় বলেই পরাভাষার অস্তিত্বও প্রাসঙ্গিক। হয়তো বস্তু-গ্রন্থনার অতিরেক থেকে সংক্রান্তির চেষ্টার মূলে রয়েছে এক ধরনের ক্ষতিপূরণ অর্জনের প্রবণতা; এ যেন যুগপৎ ভাষার নিজস্ব আত্মসমালোচনা ও আত্মদীপ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বয়ান গড়ে ওঠে চেতনা ও অবচেতনার, শাব্দিকতা ও নৈঃশব্দ্যের নিরবচ্ছিন্ন অন্তর্বয়নে। শুধু বস্তুর বহিরঙ্গ জ্ঞানে নয়, তাকে বুঝি বস্তস্বরূপের অনুভূতিতে। প্রতিবেদনের অবচেতন উপকরণ বা নিঃশব্দ পরিসর কি ভাষার শুদ্ধতার উৎস? জানার প্রক্রিয়ায় তবে কি রয়ে যায় অনতিক্রম্য অশুদ্ধতার ছায়া? এইসব কূট প্রশ্নের সহজ মীমাংসা নেই কোনো। তাছাড়া কেবলমাত্র দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের কাছে যাব না মীমাংসার জন্যে; যেতে হবে কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিকদের কাছে। তাদের সৃষ্টিশীল ভাষাচেতনা থেকে সম্ভাব্য মীমাংসাসূত্র খোঁজার জন্যে।

দুই

 বাচনের পরিধি ও কার্যকারিতা নিয়ে যে-সমস্ত সূক্ষ্ম ও জটিল বিতর্ক হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে এখানে স্মরণ করছি: ‘It had to be either made transparent to the forms of knowledge, or thrust down into the contents of the un-conscious.’ (প্রাগুক্ত: ২২৯)। ভাষার কার্যকারিতায় এই যে দ্বিমেরু-বিষম বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হলো, তা থেকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অস্তিত্বতাত্ত্বিক প্রবণতারও ধারণা তৈরি করে নেওয়া যায়। স্বচ্ছ প্রকাশমাধ্যম হিসেবে ভাষা কি কেবল জ্ঞানের অভিব্যক্তির পক্ষে সহায়ক হবে? একসময় তাহলে তা যান্ত্রিক উপস্থাপন রীতিতে শৃঙ্খলিত হয়ে নির্দিষ্ট আকল্পের বাহক মাত্র হয়ে পড়বে। একক বাচন ও সামূহিক বাচনের দ্বিরালাপ যেহেতু অক্ষুন্ন থাকে, সময় ও পরিসরের নতুন গ্রন্থনায় পুরোনো আকল্পগুলি বিনির্মিত হতে বাধ্য। একদিকে বিধিবিন্যাসের রুদ্ধতা এবং অন্যদিকে রূপান্তরের অনিবার্য প্রেরণা, এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ভাষার গভীরে জন্ম নেয় ‘a whole landscape of shadow’ (তদেব: ৩২৬)। এই ছায়া-প্রপঞ্চের তাড়নাতেই কি পরাভাষার উন্মেষ সম্ভব হয়? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য মীমাংসা খুঁজতে গিয়ে ভাষাকেই আশ্রয় করতে হয় আবার। ভাষার আলোয় দেখতে হয় ভাষার বাহিরকেও। ‘বাহির’ বলতে বোঝাতে চাইছি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক-মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গগুলিকে। একথা না লিখলেও চলে যে, এইসব অনুষঙ্গ অনবরত বদলে যাচ্ছে; কখনো সূক্ষ্ম আর কখনো প্রকটভাবে। তাদের চাপ তৈরি হচ্ছে ভাষারই অন্দরমহলে। লক্ষ করলেই বুঝব, অন্তর ও বাহিরের সম্পর্ক বিন্যাসে পরিবর্তন যথার্থই অভ্যাসের ধারাবাহিকতায় বড়ো বড়ো ছেদ ঘটিয়ে দিচ্ছে। তবু ভাষা নিজেরই গভীরে নতুন দিক-নির্ণয়ের চেতনা আবিষ্কার করে নেয়।

 ভাষা প্রতিটি মুহুর্তেই ছেদ ও ধারাবাহিকতার মধ্যে নতুন সেতু রচনার কৃৎকৌশল খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যায়। এক মুহুর্ত থেকে অন্যমুহুর্তের দিকে বয়ে যেতে-যেতে একদিকে নিজের সামাজিকভাবে নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বভাবকে মান্যতা দেয় ভাষা, অন্যদিকে নতুন বার্তার উপযোগী অনন্য উচ্চারণ সৃষ্টির তাগিদে নিজেই ঐ মান্যতার বিরুদ্ধাচারণ করে। এই প্রক্রিয়াটিকে আপাতদৃষ্টিতে খুব জটিল বলে মনে হলেও তা ঘটে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সারা জীবন ধরে যে-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তারই নিরিখে ভাষা ব্যবহারকারী সত্তাকেও চিনে নিই। অর্থাৎ ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতিতেই সত্তার অভিজ্ঞান নির্ধারিত হয়। অভ্যস্ত বাচনের বাঁধাধরা প্রকরণে যারা স্বেচ্ছাবন্দী, তাদের অস্তিত্বও রুদ্ধ। প্রতিবেদনের মধ্যে অস্তিত্বের ঈঙ্গিত মুক্তি সে-ই সঞ্চারিত করতে পারে যার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বতন্ত্র উচ্চারণ নির্মাণের দক্ষতা প্রমাণিত। বলা বাহুল্য, এ এক বিশেষ ধরনের নির্মাণ: কেননা তাতে পূনর্মূল্যায়নের প্রেরণাই মূল চালিকাশক্তি। বাচন মানেই সংযোগের প্রয়াস নিশ্চয়, তবে সেই সংযোগ মূল্যনিরপেক্ষ হতে পারে না কখনো। যতক্ষণ মূল্যায়নের আকাঙ্ক্ষা উচ্চারণের সঞ্চালক না হচ্ছে অন্তত ততক্ষণ অভিব্যক্তি তাৎপর্যবহ ও লক্ষ্যাভিমুখী হবে না। ভাষার নিরপেক্ষতা একটি কথার কথা মাত্র; চিহ্নায়ক ও অন্তঃসারের নিরিখে তা অসম্ভব। ভাষা কখনো উদ্ভাসিত করে আবার কখনো আবৃতও করে। উচ্চারণে অন্তর্বর্তী অন্ধবিন্দুগুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে সমস্ত প্রতিবেদক হয়তো অবহিত নন; কিন্তু তাতে পরাবাচনের সম্ভাবনা নিরাকৃত হয়। না। সত্তা ও জগতের মধ্যবর্তী দৃশ্য ও অদৃশ্য পরিসরের চলমান দ্বিরালাপকে অনুভব করতে পারি একমাত্র বাচন ও পরাবাচনের আততিতে। বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের কাছে আমরা ঋণী এইজন্যে যে, এইসব সূক্ষ্মগভীর ও সুদূরপ্রসারী উপলব্ধিকে আজীবন নিরন্তর অনুশীলন করার প্রেরণা তার কাছে পাচ্ছি।

 বাখতিনের অন্যতম প্রসিদ্ধ মহাবাক্য হলো: ‘Language enters life through concrete utterances’। জীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত আলো-ছায়ার বিন্যাসে যখন প্রতিবেদন গড়ে ওঠে, তাতে বিধি-বিন্যাসের যান্ত্রিকতা ব্যক্ত হয় না কেবল। কারণ, প্রতিবেদন শুধুই প্রণালীবদ্ধ বাচনের ফসল নয়; তা মূলত ঘটনা। অস্তিত্বের বিভিন্ন মাত্রা ছুঁয়ে আসে যে-দ্বিরালাপের ক্রিয়া, প্রতিবেদন তারই প্রতিনিধি। এইজন্যে তা সর্বদা সম্ভাব্য এক উদ্‌ভাসন; একদিকে বাচক ও অন্যদিকে গ্রহীতার উপস্থিতিতে তার অবস্থান নিত্য জায়মান। যতক্ষণ উচ্চারণ সজীব, ততক্ষণই তার আয়ুষ্কাল। ভাষার সংযোগ-ক্ষমতাও এই বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যেহেতু গ্রহীতা বাচকের দ্বিবাচনিক অংশীদার, ভাষা-বয়ান প্রতিবেদনে অপরতার বোধ অন্তঃশায়ী। তাই উচ্চারণ মানে সম্বোধ্যমানতার প্রত্যয়। সম্বোধক ও সম্বোধিতের সম্পর্ক অনবরত রূপান্তরিত হচ্ছে বলেই ভাষায় বিনির্মাণের প্রবণতা স্বতঃসিদ্ধ। বাখতিন/ভোলোশিনোভ রচিত Marxism and the Philosophy of Language বইটির নিবিড় পাঠ আবশ্যিক। তবে বাখতিন-ভাবনা কোনো-একটি বইয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় বলে এবং ভাবকল্পগুলি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঊর্ণাতন্তুর মতো অন্যোন্যসম্পৃক্ত বলে তার অন্য সব বয়ান সম্পর্কেও মনোযোগী হতে হয়।

 বাখতিনের কোনো বক্তব্যই আকস্মিকভাবে উদ্ভূত নয় বলে প্রাগুক্ত সম্বোধ্যমানতা এবং দ্বিবাচনিক উচ্চারণের তাৎপর্যকে সর্বদা বুঝে নিতে হয় নান্দনিক সংযোগের সামগ্রিকতায়। যেহেতু তার মতে প্রসঙ্গ চায় প্রেক্ষিতের সমর্থন, বাচনিক উপাদানের গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে উচ্চারণের বাচনাতিরিক্ত পটভূমির কথাও পরীক্ষা করে দেখতে হয়। উচ্চারণ যুগপৎ ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রক্রিয়া; তবে এই দুইয়ের আনুপাতিক গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে দ্বিরালাপের বহুরৈখিকতাকে অনুধাবন করতে হবে আগে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে। বাখতিন-কথিত আরো একটি কেন্দ্রীয় ভাববীজের কথাও। তা হলো সমান্তরাল পার্থক্য বা ‘simultaneous differences’ সম্পর্কিত। সত্তা যেহেতু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় কখনো, সত্তার উচ্চারণও সহযোগী অপর সত্তার মুখাপেক্ষী। উচ্চারণ আসলে নিত্যনবায়মান সেতু যা সত্তাকে অপরের সঙ্গে সম্পূক্ত করে। অস্তিত্বগত ভিন্নতার জন্যে এই দুটি স্থিতির বীক্ষণে যে দ্বিমেরু-বিষমতা থাকে, তাদের মৌল স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার না করেও উচ্চারণ তাদের মিলিয়ে দেয় আশ্চর্য সমান্তরালতায়। অভিব্যক্ত ও অনভিব্যক্ত বাচনের এই পার্থক্য ও সমান্তরালতা সবচেয়ে সার্থকভাবে কবিতায় ধরা পড়ে। অন্যভাবে বলা যায়, এই হলো কবিতার ঈপ্সিত দ্বিবাচনিক প্রকরণ যাকে কেউ কেউ শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের যুগলবন্দি বলেও বর্ণনা করেন।

 সার্থক ছোটগল্পের বয়ানেও উচ্চারণের এই সম্বোধ্যমানতা স্পষ্ট। প্রসঙ্গ-নিরপেক্ষভাবে কোনো-একটি শব্দের যত মূল্যই থাক বা স্বয়ংপ্রভ বলে তাকে যত মান্যতাই দিই—নিছক আত্মগত নিরিখে তার প্রকৃত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। নিরুচ্চার ও সোচ্চারের সম্পর্ক যখন বিশ্লেষণ করি, বাচনিক নির্মিতির কৃৎকৌশল ও অন্তঃসার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করে নিতে পারি। অর্থাৎ যা কথিত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, উচ্চারণ তা নয়; উচ্চারণ হলো কথিত ও অকথিতের অন্যোন্যসম্পূক্ত সমগ্রতা। কী জীবনে কী শিল্পিত পাঠকৃতিতে অজস্র উচ্চারণে গ্রথিত প্রতিবেদন থেকে আমরা ঐ সমগ্রতাই আশা করি। বলা ভালো, সমগ্রতার প্রতি আভিমুখ্য ও সক্রিয়তা কাঙ্ক্ষিত বলেই সম্বোধক নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্বোধিতকে খোঁজে। সম্বোধ্যমানতা যতক্ষণ অক্ষুণ্ণ থাকছে, ততক্ষণই সৃষ্টিশীলতা। প্রতিবেদন তাই অনবরত পরিস্থিতি নির্মাণ করে; সময় ও পরিসরে ক্রিয়াত্মক হয়ে শেষ পর্যন্ত ‘হাসতে হাসতে হাঁস হলো’-র মতো নিজেই হয়ে ওঠে বিশিষ্ট বাচনিক পরিস্থিতি। বাখতিন অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসায় যথাপ্রাপ্ত স্থিতি বা situatedness-এর ওপর খুব গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রতিবেদনকে ঐ অস্তিত্ববোধের সূত্রে বুঝে নিতে হবে আমাদের। এই স্থিতিতে যুগপৎ সত্তা ও বস্তুবিশ্বের বিভিন্ন স্তর নিজেদের সমান্তরালতা ও পার্থক্য নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উচ্চারণের মধ্যে দেখা যায় অজস্র বিচ্ছুরণ। এই বিচ্ছুরণ সম্বোধক, সম্বোধিত ও অবলম্বিত বিষয় কিংবা বস্তুবিশ্বের মধ্যে বিশেষ ধরনের নাট্য-আবহ তৈরি করে। অস্তিত্বের বহুবাচনিক অন্তর্নাট্য ও মিথষ্ক্রিয়ায় যা কিছু কুশীলব হিসেবে যোগ দেয়, তাদের সমবায়ী স্থিতিতে সমস্ত উচ্চারণ জন্ম নেয়, জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত অধিস্থিতিতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চারণের নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল থাকা সত্ত্বেও অবসান হয় না। অদূরবর্তী কোনো এক পুনরুজ্জীবনের মুহুর্তে তাৎপর্য আবিষ্কারের প্রক্রিয়ায় বাচন আবার ফিরে পায় নবীন উৎস-মুহুর্ত।

তিন

বাখতিন নিবিড় কাব্যিক উচ্চারণে জানিয়েছেন, প্রতিটি তাৎপর্যই মূলত প্রকল্প; তাকে কেউ কখনো চূড়ান্ততায় রুদ্ধ করতে পারে না। একদিকে মানুষের অভিজ্ঞতায় কোনো অন্তিম কথা নেই, অন্য দিকে মানুষের জগতে এমন কিছুই নেই যাকে ‘absolutely dead’ (১৯৮৬:১৭০) বলা যায়। আর ‘Every meaning will have its home coming festival’ (তদেব)। যেন বা নীড়ে ফেরার উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতিটি তাৎপর্য ফিরে আসে উৎসে, এই উপলব্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা ভাষার অন্তর্বৃত দ্বিবাচনিকতাকে অনন্ত করে তোলে। যে-সমস্ত বাচনিক উপকরণ ব্যক্তিগত ও সামূহিক অভিজ্ঞানকে সংগঠিত করে তাদের বুঝে নিতে হয় রূপান্তরশীল সময়ের সঙ্গে অনস্বীকার্য দ্বিরালাপে। সময়-স্বভাবকে যদি স্বীকার না করি, পরিবর্তন অপ্রতিষ্ঠ হয়ে যাবে; যেখানে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই, সেখানে পার্থক্যপ্রতীতিও নেই। আবার পার্থক্য-প্রতীতির অভাবে তাৎপর্য থাকতে পারে না কোথাও। যদি তাৎপর্য না থাকে, জগতের অস্তিত্ব অসম্ভব।

 এভাবে দৈনন্দিন জীবনের অজস্র দ্বিবাচনিকতা ব্যাপকতর ও গভীরতর চিহ্নায়ন প্রকরণের প্রেক্ষিতে সম্পৃক্ত। তাৎপর্যপূর্ণ সম্বোধ্যমানতার অতীত সক্রিয়তার স্মৃতিতে গড়ে ওঠে পরবর্তী সব চিহ্নায়ন প্রকরণ। এইজন্যে বলা হয়, দ্বিবাচনিকতার প্রেক্ষিত অন্তহীন। মহাসময় ও মহাপরিসরের মধ্যে অন্তর্বৃত খণ্ডকাল ও খণ্ডপরিসর দ্বিরালাপের মধ্য দিয়েই প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতায় ফিরিয়ে আনে স্বর ও অন্তঃস্বরের সমারোহ। তাই অতীতকে রুদ্ধ বলা যায় না, কারণ তা শেষ হয়ে যায়নি; বর্তমানও একইভাবে সমাপ্তিহীন। পূর্বসূরিদের জগৎ সাম্প্রতিক প্রজন্মের জগতে অনবরত পুনর্জন্ম লাভ করছে। এই সমান্তরালতা উচ্চারণকে দ্বিস্বরিক করে তোলে। একদিকে বর্তমান অতীতকে সম্বোধন করে, অন্যদিকে অতীতের দ্বারা সম্বোধিত হয়। বর্তমানের মধ্যে অতীতের অনুপস্থিত উপস্থিতি অনুভবগম্য; অতীত চিহ্নায়কদের উপস্থিতিকে কার্যত কখনো চূড়ান্ত করা যায় না। এইজন্যে বাখতিন বলেন: ‘Every word is directed toward an answer and cannot escape the profound influence of the answering word that anticipates.’ (১৯৮১: ২৮০)। এই মন্তব্যটির গুরুত্ব অসামান্য, কেননা এর তাৎপর্য সৃদূরপ্রসারী। তাই এই মন্তব্য নিবিড় পাঠ দাবি করে।

 প্রতিটি শব্দই ছুটে চলেছে সম্ভাব্য প্রত্যুত্তরের দিকে: এর মানে হলো, বাচনমাত্রেই মীমাংসা-গর্ভ। সার্থক উচ্চারণ জন্মসূত্রেই সম্বোধ্যমানতার দ্যোতনা বয়ে আনে। অর্থাৎ সম্ভাব্য গ্রাহকদের সমাজে উদ্ভূত ও পুষ্ট হয়ে মানবকেন্দ্রিক মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে কোনো উচ্চারণ অন্বিষ্টের প্রতি আভিমুখ্য অর্জন করে। সম্বোধক হিসেবে আমরা স্বতশ্চলভাবে আমাদের সম্ভাব্য গ্রাহক-শ্রোতা-সম্বোধিতদের অবস্থানও রচনা করে চলি। আমাদের কথা তাই মূলত বয়ন এবং এই বয়ন রচনার মধ্য দিয়েই আমরা নিজেদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পুনর্গঠনের সক্রিয়তাও অর্জন করে নিই। এমন পুনর্গঠন ঘটে মানব-অস্তিত্বের নিজস্ব সময়ে ও পরিসরে। এইজন্যে বলা হয়েছে ‘We anthropomorphize values.’ (ক্লার্ক ও হলকুইস্ট: ১৯৮৪: ২০৫)।

 মানব সমাজ মানেই মূল্যবোধের পুষ্পায়নের অংশীদারদের সংলগ্নতা। যাকে বাচনের প্রেক্ষিত বলি, তা ঐ সামাজিকতার সূত্রে বিধৃত। এতে রৈখিকতার অবকাশ নেই কারণ দৃশ্য ও অদৃশ্য আয়তনের সংঘর্ষ থেকেই জাগে উচ্চারণ। তাতে সত্তা ও অপরতার সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন সোচ্চার ও নিরুচ্চারের অন্তর্বয়ন ধরা পড়ে। এই অন্তর্বয়ন স্বর ও প্রতিস্বরের সমারোহে সৃষ্ট হয়; অস্তিত্বের বিভিন্ন আয়তনের সমান্তরাল উপস্থিতির মধ্যে পুননির্মিত হয় জীবনের অভিজ্ঞান। তাই কোনো উচ্চারণ-ই বিচ্ছিন্ন এককমাত্র নয়। সত্তার গভীরে একক বাচন ও সামূহিক বাচনের সঞ্চরমান পরিসর থেকেই জেগে ওঠে উচ্চারণের নিজস্ব নন্দন—তার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। বাখতিন তাই লিখেছেন: ‘Every utterance in the business of life is akin to a password.’ (১৯৭৬: ১০৬)।

 এই অনন্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বাইরে থেকে উচ্চারণের উদ্ভব ও বিকাশকে প্রভাবিত করে না, অস্তিত্বের গহনে অন্তর্ভেদী আলো নিক্ষেপ করে সেখানেই সন্ধান করে চিহ্নায়নের উৎস। সত্তা ও অপরতা সম্পর্কে সামাজিক মূল্যায়নের প্রেরণাও তাতে সূক্ষ্মভাবে সম্পৃক্ত থাকে। উচ্চারণের নান্দনিক ও সামাজিক স্বভাবকে আলাদাভাবে দেখাতে ও দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বাখতিনের ভাবনা-প্রস্থান যদি অনুসরণ করি, তাহলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয় যে, নন্দন মূলত সামাজিক সংবেদনারই বিশিষ্ট অভিব্যক্তি। তাই শিল্প-সাহিত্য-উচ্চারণের তত্ত্ব মূলত সৃষ্টির সমাজতত্ত্ব। সংযোগের মধ্যেই সৃষ্টির সার্থকতা; আর, উচ্চারণ অনবরত রূপান্তরিত হয় সংযোগের সামাজিক প্রেক্ষিত অনুযায়ী। ঠিক এখানেই ভাবাদর্শের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাচকের চেতনা ও অবচেতনা ভাবাদর্শে গ্রথিত বলেই তার নিজস্ব উচ্চারণশৈলী বা প্রকাশভঙ্গি সে কখনো বদলাতে পারে না। আবার প্রেক্ষিত ও পাঠকৃতির মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক যেহেতু উচ্চারণের সূত্রেই নির্ণীত হয়ে থাকে, সত্তা ও অপরতার আকরণ ও সংশ্লিষ্ট মূল্য-প্রকরণ আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। উচ্চারণের অনন্যতা সত্ত্বেও তাকে কখনো অনিকেত বা পৌর্বাপর্যহীন বলে ভাবা যায় না। বাখতিনের চিন্তাবিশ্বে জীবন ও তাৎপর্য একই সূত্রে গাঁথা বলে প্রেক্ষিতের রূপান্তরে জীবন ও তাৎপর্য রূপান্তরিত হয়ে যায়। অর্থাৎ জীবন ও তাৎপর্য রুদ্ধ নয়, তা মুক্ত ও স্বাধীন। কিন্তু এই মুক্তি বা স্বাধীনতার অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয় কখনো। সত্তা বা পাঠকৃতির মৌল উপাদান হিসেবে উচ্চারণ কখনো সম্পূর্ণ সার্বভৌম হতে পারে না।

 এর অন্যতম বড়ো কারণ হলো সাংস্কৃতিক রাজনীতির অমোঘ প্রভাব। তার মানে, উচ্চারণেরও রয়েছে নিজস্ব রাজনীতি। সরকারি ও বেসরকারি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবাদর্শের সংঘর্ষ থেকে বিচ্ছুরিত বহুবাচনিক আবহে উচ্চারণ জন্ম নেয়, পুষ্ট হয় ও রূপান্তরের পথে যাত্রা করে। এই প্রক্রিয়ায় সত্তা ও অপরতার বহুস্তর-বিন্যস্ত সম্পর্কের জটিলতাও ব্যক্ত হয় বলে উচ্চারণ-শৈলীকে কখনো একটি পূর্বনির্দিষ্ট আকরণে রুদ্ধ করতে পারি না। অজস্র পার্থক্য-প্রতীতির উপলব্ধিতে উচ্চারণ গড়ে ওঠে বলে ঐ প্রতীতির মধ্যেই সাংস্কৃতিক রাজনীতির নির্যাস প্রতিফলিত হয়। বাখতিন লিখেছেন: ‘The internal politics of a style is determined by its external politics’. (১৯৮১: ২০৪)। অর্থাৎ শৈলীরও রয়েছে নিজস্ব রাজনীতি, অন্তর্বৃত ও বহির্বৃত সংগ্রামের বাধ্যবাধকতা; বিবিধ বিকল্পের সম্ভাবনা থেকে অমোঘ অভিব্যক্তিতে পৌঁছানো। তার মানে, উচ্চারণের যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি উচ্চারণ নিজেই হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট রাজনীতি। আর, এই ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে তার নিজস্ব নন্দন, মুক্তির প্রতীতি। উচ্চারণে অন্তর্বৃত মুক্তি পাঠকৃতির নন্দনকে উত্তীর্ণ করছে মানব পরিসরে মুক্তির উৎসবে। ভাষার জন্ম ও বিকাশ সীমা নিরাকরণের মধ্য দিয়েই ঘটে। প্রসঙ্গের দ্বিবাচনিক ভূমিকা মেনে নিয়েও তা শেষ পর্যন্ত প্রসঙ্গাতীত হয়ে ওঠে। বলেই ভাষার দ্যোতনা রহস্যগর্ভ ও উৎক্রান্তিসূচক। ব্যবহার-বিধি অনস্বীকার্য; কিন্তু সেই বিধি-বিন্যাসকে যদি প্রতি মুহূর্তে প্রত্যাহ্বান না জানায়, তাহলে আকরণগত রুদ্ধতা শুধু শৃঙ্খলই তৈরি করবে।

 শৃঙ্খলা ও সীমানার প্রতি অবহিত থেকেও বাচন অনিবার্যভাবে মুক্তিপ্রয়াসী। আমরা যখন কোনো উচ্চারণে মুগ্ধ ও প্রাণিত হই, শুধু কি শব্দগত অর্থ খুজি? না, আমরা খুঁজি প্রতীতি। বক্তা ও শ্রোতা কিংবা সম্বোধক ও সম্বোধিতের নির্দিষ্ট সময় ও পরিসরে ঐ প্রতীতি নির্ধারিত হয়। আবার আমরা তেমন উচ্চারণও খুঁজি, যার প্রতীতি সর্বজনীন ও সর্বকালীন হতে পারে। অর্থাৎ প্রতীতির প্রক্রিয়াও স্বভাবে দ্বিবাচনিক। শব্দ যখন চিহ্নায়কে রূপান্তরিত হয়, স্বতশ্চলভাবে অনেক প্রথাসিদ্ধ বাধ্যবাধকতা নিরাকৃত হয়ে যায়। অন্তর্বৃত দ্বিবাচনিকতার শক্তিতেই বাচন চিহ্নায়িত হতে পারে। স্থিরতা ও নিশ্চয়তার নামে অচলায়তনকে প্রশ্রয় না দিয়ে সার্থক উচ্চারণ নিজের মধ্যে গতি সঞ্চারিত করে এবং সম্ভাব্য গ্রহীতা-সত্তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্যে অর্জন করে কেন্দ্রাতিগ প্রবণতা

চার

 এই প্রসঙ্গে বাখতিন/ভোলোশিনোভ রচিত Marxism and the Philosophy of Language বইয়ের বক্তব্য বিশেষ প্রণিধান-যোগ্য। এতে অজস্র সম্ভাব্য প্রসঙ্গের কথা বলা হয়েছে, যাদের বৈচিত্র বিস্ময়কর। কিন্তু তা সত্ত্বেও শব্দের অর্থদ্যোতনা পরিবর্তনে তাদের ক্ষমতা অনন্ত নয়। দু’জন বাচক বা সম্বোধকের স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিসরেই শব্দের অর্থপরিবর্তন কার্যকরী হতে পারে। কোনোভাবেই এই ন্যূনতম শর্তটি লঙ্ঘন করা চলে না। একদিকে ব্যাকরণগত প্রণালীবদ্ধ ভাষাবিন্যাস ও তজ্জনিত শব্দার্থের নির্দিষ্টতা এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট নিয়মরহিত প্রেক্ষিতের প্রায় অন্তহীন উপস্থিতি: এই দুইয়ের ব্যবধান অনতিক্রম্য।

 বাখতিন এই ব্যবধান নিরসনের উপায় নিয়ে ভেবেছেন। তার বক্তব্য হলো, শব্দ সর্বদাই সম্বোধিতের প্রতি ধাবমান—‘toward who that addressee might be...each person's inner world and thought has its stabilized social audience that comprises the environment in which reasons, motives, values and so on are fashioned...the word is a two-sided act. It is determined equally by whose word it is and for whom it is meant. As word, it is precisely the product of the reciprocal relationship between speaker and listener, and addresser and addressee. Each act and every word expresses the one in relation to the other.’ (১৯৭৩: ৮৫-৮৬)।

 বাখতিনের এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এতে শাব্দিক বাচনকে চলমান সম্বোধ্যমানতার দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

 সম্বোধকের বাচন গ্রাহকসত্তার উপস্থিতি ছাড়া অকল্পনীয়। সম্ভাব্য কোনো-এক গ্রাহক বা সম্বোধিতের প্রতীতি ছাড়া বাচনের উদ্ভব হতেই পারে না। তার মানে, বাচকের অন্তর্জগৎ যদিবা উদ্ভাসনের সূচনাবিন্দু হয়েও থাকে, স্থিরীকৃত বহির্জগতের অস্তিত্ব না থাকলে ঐ উদ্ভাসন নিরালম্ব হতে বাধ্য। তার মানে উচ্চারণের চাই নিজস্ব সমাজ, বহির্জগতে যার প্রতিষ্ঠা। যুক্তি-লক্ষ্য-মূল্য ইত্যাদি হয়তো অনেকটাই কল্পনা করে নিতে হয়, কিন্তু সেই কল্পনাও বিশিষ্ট এক বাস্তব বা অধিবাস্তব বলে গণ্য হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা হেঁয়ালির মতো শোনায় যদিও, উচ্চারণের পুষ্টি ঘটে এহেন বিপ্রতীপের দ্বিরালাপে। সম্বোধক ও উদ্দিষ্ট সম্বোধিত এই দ্বিরালাপের অংশীদার বলে বাচন কখনো একমাত্রিক হতে পারে না। শব্দ যেখানে পৌঁছাতে চায়, সেই লক্ষ্য সক্রিয়তার গতি ও স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বক্তা ও শ্রোতা, সম্বোধক ও সম্বোধিত, বাচক ও গ্রহীতার পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই উচ্চারণ গড়ে উঠতে পারে। ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক অপরের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পর্কের অভিব্যক্তিই হলো উচ্চারণ। অপরের দৃষ্টিকোন থেকে আপন অস্তিত্বের বাচনিক অভিব্যক্তি যখন তৈরি করতে চাই, আমরা আসলে সময় ও পরিসরে বিধৃত সামাজিক বীক্ষাকেই প্রকাশ করি। তাই বাখতিন শব্দকে সত্তা ও অপরতার সেতু বলে মনে করেছেন।: ‘a world is a bridge thrown between myself and another...it is territory shared by both addresser and addressee.’ (তদেব)।

 এই বক্তব্যের সূত্রে কবিতা ও ছোটগল্পের সংযোগ প্রকরণ সম্পর্কে আমাদের ভাবনা পুরোপুরি নতুন খাতে বয়ে যেতে পারে। বহুস্বরিক উচ্চারণের মধ্য দিয়েই জীবনের কোষে সঞ্চারিত হতে পারে ভাষা। তা যুগপৎ মূর্ত ও বিমূর্ত, সহজ ও জটিল, বাস্তব.ও অধিবাস্তবকে ধারণ করতে পারে: এই বিস্ময়কর উপলব্ধি হয় আমাদের। কোনো কবি বা গল্পকার নিজস্ব ধরনে সম্বোধ্যমানতার নতুন প্রকরণ খুঁজে নিতে চান। ভাষার মধ্যে যা-কিছু যথাপ্রাপ্ত উপাদান সামূহিক বাচন হিসেবে সর্বদাই পূর্বনির্ধারিত ও পূর্বাগত, তাদের ব্যবহারবিধিকে মান্যতা দিয়েও একক বচনের উপস্থাপয়িতা হিসেবে সম্বোধক সর্বদাই নতুন সজীব ভাষার আয়তন নির্মাণ করেন। তা যদি না হত, কোনো নির্দিষ্ট কাব্যভাষা বা গল্পভাষাকে আমরা কখনও অনন্য ভাবতে পারতাম না। এই অনন্যতার মানেই হলো, এইমাত্র এমন একক বাচন সৃষ্টি হয়েছে, যা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বমুহুর্তেও অজানা ছিল। বাচনের মতো তার প্রেক্ষিতও অনবদ্য। আমরা যখন চিহ্নায়ন প্রকরণে চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের দ্বিবাচনিকতা নিয়ে ভাবি, তাতেও একক ও সামূহিক বাচনের দ্বিরালাপ নানাভাবে সক্রিয় থাকে। কোনো কবি বা গল্পকার উচ্চারণের বিশিষ্টতায় বস্তুকে চিহ্নায়কে রূপান্তরিত করেন, সম্ভাব্য পাঠকের কাছে ন্যূনতম কিছু প্রত্যাশা তো থেকেই যায়। চিহ্নায়ন প্রকরণ সম্পূর্ণ ও সার্থক হতে পারে যদি সম্বোধিত জনেরা ঠিকমতো তাতে সাড়া দিতে পারেন—এ তো অনস্বীকার্য। বাচনের অর্থ এভাবে চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়, কেননা তাৎপর্য-প্রতীতিতে আপাতসম্পূর্ণ মাত্র আভাসিত হতে পারে। চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বারবার পুনর্নবায়িত হয় নতুন গ্রাহকের চেষ্টায়, তার এই চেষ্টা আংশিক ও সাময়িক মাত্র। অতএব চূড়ান্ত মুহূর্ত কেবলই নাগাল এড়িয়ে যায়, আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে যায়। নিজেকে কর্ষণ করে ভাষা, নিজের প্রথা-নির্দেশিত সীমাকে নিজেই চূর্ণ করে যায়। এই সূত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিবিড় দ্বিরালাপের আবহ, কেননা তাৎপর্য প্রেক্ষিতের সীমানাকে মান্যতা দিলেও প্রেক্ষিত নিজের সীমাকে অনবরত প্রসারিত করে যায়। এ তো অনিবার্য; কারণ, পরিবর্তমান সময়-স্বভাব অনুযায়ী প্রেক্ষিত বদলে যেতে বাধ্য। প্রেক্ষিতের এই সীমাহীনতাই অনেকার্থদ্যোতনার উৎস। বাচনের নন্দনে তাই অচল অনড় আকরণ নেই, জিজ্ঞাসারহিত ধ্রুববিন্দুও নেই কোনো। আমরা চেতনার ফসল নই কেবল, চেতনাকে নির্মাণও করি। সময়-স্বভাব আমাদের রূপান্তরপ্রবণ নির্মিতি-প্রকরণে প্রতিফলিত হচ্ছে। আর, এই নির্মাণের সূত্রে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন উচ্চারণ আরো একবার বিনির্মিত হবে বলে। তাই মুক্ত ও স্বাধীন সঞ্চরণের প্রতীতি আমাদের সংযোগ প্রকরণে স্বতঃসিদ্ধ। আমরা যখন বাচনের প্রাকরণিক বিধির কথা বলি, তা কেবল নৈরাজ্যকে প্রতিহত করার জন্যে। কিন্তু এইসব বিধি অভ্যস্ত আকরণের সঙ্গে ভাষার নিরন্তর সংঘর্ষকে নিরাকৃত করতে পারে না। এই সংঘর্ষের সূত্রে আমরা পৌছে যাই বাচনের অন্তর্বৃত রাজনীতির ধারণায়। কেননা সংঘর্ষ কখনও নিছক ব্যক্তিগত আততির অভিব্যক্তি নয়, তার পেছনে সক্রিয় থাকে। প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য সামাজিক অভিজ্ঞতার টানাপোড়েন। বাখতিন/ভেলোশিনোভ লিখেছেন: ‘each word...is a little arena for the clash of and criss-crossing differently oriented social accents. A word in the mouth of particular individual is a product of the living interaction of social forces.’ (১৯৭৩: ৪১)।

পাঁচ

বিভিন্ন সামাজিক স্বরের মিথস্ক্রিয়া কিংবা ঘাত-প্রতিঘাত প্রতিটি উচ্চারণের অপরিহার্য আবহ। কোনো বিশেষ মুহূর্তে কোনো একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও একক উপলব্ধি নিঙ্‌ড়ে নিয়ে কথা বলেন না। অজস্র সামাজিক শক্তির জীবন্ত মিথষ্ক্রিয়ার বাচনিক ফসল হিসেবে উদ্ভূত হয় ব্যক্তির উচ্চারণ। প্রতিটি উচ্চারণের পশ্চাৎপট তাই বিপুল ও বিস্তৃত; সেই পরিসরে প্রত্যেকের একক বাচন সমান্তরাল অপরসত্তাদের বাচনের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ও নিবিড় সংঘর্ষে লিপ্ত। তাই যিনি সম্বোধক, তাঁকে বাধ্যতামূলক ভাবে সম্বোধ্যমানতার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতেই হয়। তিনি সর্বতোভাবে সামাজিক উচ্চারণের সূত্রধার; কোনো-একটি মুহূর্তের বিচ্ছিন্ন উচ্চারণে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা প্রবণতার প্রকাশ ঘটে না শুধু। তিনি জটিল ও গতিময় সামাজিক প্রকরণেরও অংশীদার। তবে এমন ভাবার কারণ নেই যে, এতে তাঁর বাচনের মুক্ত ও স্বাধীন সঞ্চরণে কোনো বিঘ্ন ঘটছে। আসলে বাচনের অন্তর্বৃত সাংস্কৃতিক রাজনীতির অংশীদার হিসেবে সম্বোধককে শুধু মনে রাখতে হচ্ছে, ভাষা একই সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের আয়ুধ ও যুদ্ধক্ষেত্র। যে-প্রতিবেদন তার ঈপ্সিত, সেখানেও একই সত্যের বিচ্ছুরণ ঘটছে। তাঁকে সম্বোধিতের অস্তিত্ব ও সম্বোধ্যমানতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রতিটি মুহূর্তে অবহিত থাকতে হচ্ছে; বুঝে নিতে হচ্ছে মুক্তি ও স্বাধীনতা শুধু তার একার প্রাপ্য নয়।

 কোন সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর অস্তিত্বের নিয়ামক এবং কোন বৃহত্তর ঐতিহাসিক অবস্থান ভেতরে ও বাইরে অস্তিত্বের উপরে ছায়াতপ ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা খুবই জরুরি বিষয়। আর, না লিখলেও চলে, এতেই নিঃশ্বাস নিচ্ছে সামূহিক বাচন। একক বাচনের সূক্ষ্মতা ও স্বাতন্ত্র্য ঐ একই প্রেক্ষিতের দ্বিবাচনিক স্বভাব থেকে উৎসারিত হচ্ছে। সাধারণ বিচারে ভাষার বিধি-বিন্যাসে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ থাকলেও জায়মান উচ্চারণের নিরিখে তা নিয়ত-নির্মীয়মান বর্তমানের স্পন্দিত অভিব্যক্তি। এতেই আভাসিত হয় ভবিষ্যৎ এবং পুনরুত্থাপিত হয় অতীতের স্মৃতিসত্তা। বর্তমান বলতে এখানে সময়ের সঙ্গে পরিসরকেও বোঝাতে চাইছি। সময় এবং পরিসরের অজস্র আকল্প থেকে চিহ্নায়ন প্রকরণের নতুন নতুন অনুপঙ্খ ও কৃৎকৌশল আহরণ করে নেয় ভাষা। এখানেই তার বদ্ধতা থেকে মুক্তির দিকে প্রবহমান থাকার শক্তির উৎস।

 ফলে সার্থক বাচনে কখনও নিছক বিবরণ থাকে না, থাকে বিবরণ পেরিয়ে যাওয়ার আর্তি। উদ্বুদ্ধ ও উদ্দীপিত করার আকাঙ্ক্ষা যখন সঞ্চারিত হয় বাচনের কোষে-কোষে, আমরা বলি, উচ্চারণের জন্ম হলো। এ এক নতুন জগৎ যাতে বস্তুবিশ্ব চিহ্নবিশ্বে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই রূপান্তরে নন্দনের প্রেরণা আসলে ভাবাদর্শের প্রবর্তনা, যেহেতু চিন্তাবীজ পুষ্পিত না-হলে বস্তু কখনও চিহ্নায়কের মর্যাদা অর্জন করে না। বাখতিনের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য স্মরণ করা যায়: ‘Everything ideological has semiotic value...The domain of ideology coincides with the domain of signs.’ (তদেব: ১০)। ঘাস থেকে নক্ষত্র, ধুলো থেকে ছায়াপথ—সব কিছুই চিন্তার আকর; তাই অণীয়ান থেকে মহীয়ান চিহ্নায়কে পরিণত হতে পারে। এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নির্ণীত হয় এদের মূল্য। আমাদের বাচনে এদের পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য যখন প্রতিফলিত হয়—সময় ও পরিসরের নির্যাস থাকে স্বাতন্ত্র্যবোধে। তা যুগপৎ ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক, সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক। চিহ্নের পর চিহ্ন জমে ওঠে; চিন্তার সঙ্গে বস্তুবিশ্বের সেতু রচনার নতুন নতুন আকল্প দেখা দেয়।

 সব শেষে যা থাকে, তা হলো উচ্চারণ; অনুভূতি থেকে ভাবাদর্শ অর্থাৎ সত্তা থেকে জগৎ পর্যন্ত তার বিস্তার, তারপর পুস্পায়ন। অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি আমাদের অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎকে একই তালে-লয় গাঁথে। তাই বাচন মানে গ্রন্থনা—এপার আর ওপারের সেতু। মনশ্চর্যা ও ভাবাদর্শের মধ্যে কোনো সীমান্ত নেই, থাকতে পারে না। উচ্চারণের সত্তাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব তাই বাহির ও ভেতরের মধ্যে নিরন্তর যাতায়াতের নিদর্শন। অন্তর্বৃত চিহ্নায়কেরা যেন ডুবুরির মতো; এরা যখন বহিবৃত হতে থাকে, নানাভাবে তাদের অভিব্যক্তি তৈরি হয়। বাস্তব ও রূপকের মধ্যে চিরাগত দেয়ালগুলি ভেঙে পড়ে না কেবল, পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে নব্য সমগ্রতার দ্যোতনা গড়ে তোলে। এই যে পুনর্নবায়ন বা পুনর্গঠন—তাতেই উচ্চারণের নতুন নতুন তাৎপর্যের সম্ভাবনা দেখা দিতে থাকে।

 বাখতিনের ভাষা-ভাবনা ও উচ্চারণতত্ত্ব তাই সাহিত্যিক পাঠকৃতির অনুষঙ্গে বিচার্য নয় কেবল; জীবনের নবায়মান বয়ানের নিরিখে তা অনুশীলনযোগ্য। বাচন রয়েছে মুক্ত অস্তিত্বের কেন্দ্রে; তার প্রতীতি মানে মুক্তি ও স্বাধীনতার উপলব্ধি। এমন উপলব্ধি যাকে সম্বোধ্যমানতার অর্থাৎ দ্বিবাচনিক প্রেক্ষিতের বাইরে অর্জন করা যায় না কখনও। সক্রিয়তার বহুরৈখিক প্রকরণে, নিরবচ্ছিন্ন প্রত্যুত্তর প্রত্যাশার আবহে, আত্ম-অভিজ্ঞান ও জগৎ-সন্ধানের যুগলবন্দিতে চিনি ঐ প্রেক্ষিতকে। জানি, প্রতিটি উচ্চারণ আরও সম্ভাব্য উচ্চারণমালার অনুষঙ্গে তাৎপর্যবহ হয়ে উঠছে। তাৎপর্যকে নতুন করে পাব বলে ক্ষণে-ক্ষণে তাকে হারিয়ে ফেলছি। স্বাধীন মুক্ত সক্রিয়তায় নিজেকে গড়ছি, নিজেকে ভাঙছি। বাখতিন-ভাবনায় মীমাংসার অর্জন নয়, প্রত্যাশাই বড়ো। আর, সূক্ষ্মভাবে এই প্রত্যাশায় প্রচ্ছন্ন রয়েছে। যোগ্যতার অনুভব। সার্থক উচ্চারণের মধ্যে ঐ যোগ্যতাকে নির্মাণ করি আমরা, কী সৃষ্টিতে কী মননে। যোগ্য হয়ে ওঠার অনুভবই সত্তার নান্দনিক জিজ্ঞাসায় ব্যক্ত হতে থাকে; উচ্চারণ তাই চিরদীপ্যমান, চিরনবীন।