বাখতিন/জীবনসন্ধানের তাত্ত্বিক
প্রতিটি তাৎপর্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়: এই উচ্চারণ যাঁর, সেই মিখায়েল মিখায়েলোভিচ বাখতিন জীবন ও তত্ত্বের যুগলবন্দি রচনা করেছেন যেন। সোভিয়েত ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে তাঁর জীবন প্রবাহিত হয়েছে বলে একদিকে তাঁর জীবনযাপন এবং অন্যদিকে তাঁর ভাববিশ্ব বিচিত্র উচ্চাবচতায় তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল। ১৮৯৫ সালের ১৬ নভেম্বর যে-যাত্রার সূচনা হয়েছিল, ১৯৭৫ সালের ৭ মার্চ তাতে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে। বাখতিনের চিন্তাসূত্র অনুযায়ী তাঁর জীবনের ঐ সমাপ্তিও আপাত-সমাপ্তি মাত্র, অন্তত অবসান নয় কোনো। কেননা বাখতিনের জীবন-ব্যাপী সন্ধান ও সংগ্রামের তাৎপর্য মৃত্যুর দ্বিবাচনিক দর্পণে আমাদের কাছে আজ ক্রমশ নতুন প্রতীতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। বাখতিনের তত্ত্ব-ভাবনায় কোনো নির্দিষ্ট ও ধারাবাহিক প্রকরণ নেই, এ নিয়ে আক্ষেপেরও কারণ নেই কিছু। এত অজস্র বিনির্মাণ ঘটেছে বাখতিনের সময়ে ও সমাজে যে, কোনো ধরনের রৈখিকতা তাতে আরোপ করা অসম্ভব। ইতিহাসের ছন্দে যেহেতু তাঁর ব্যক্তিজীবনের লয়ও গাঁথা হয়ে গেছে, বাখতিন বারবার জিজ্ঞাসা ও সত্যকে পরখ করে দেখেছেন। জেনেছেন, এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে প্রবহমান জীবনে অনুসন্ধিৎসাকে অক্ষুণ্ণ রাখাই মানুষের সবচেয়ে বড়ো দায়। রৈখিকতার নিয়ম তাতে বজায় থাকল কি থাকল না এবিষয়ে উদ্বিগ্ন তিনি ছিলেন না কখনো।
অবশ্য এতে গবেষক ও ভাষ্যকারদের প্রচুর অসুবিধে হয়েছে, সংশয়ও জেগেছে নানা রকম। এতবার যিনি নিজেকে ভেঙেছেন, তাঁর কোন্ বিশ্বাসকে প্রধান বলে মনে করব এবং কোনগুলিকে তুলনামূলকভাবে মনে করব অপ্রধান—এবিষয়ে বিখ্যাত পণ্ডিতদের মধ্যে জোর বিতর্ক চলছে। তাছাড়া বাখতিনের চিন্তা যেহেতু নানাধরনের তত্ত্ব-কথার সীমানাকে ছুঁয়ে গেছে, সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে তাঁর বক্তব্য বিচিত্রভাবে গৃহীত ও ব্যাখ্যাত হচ্ছে। অনেক সময় বাখতিনের সামগ্রিক ভাববিশ্ব আড়ালে পড়ে যাচ্ছে, বড়ো হয়ে উঠছে কোনো উজ্জ্বল ও সুনির্বাচিত বিচ্ছিন্ন অংশ। ছ’জন অন্ধের হাতি দেখার বিখ্যাত গল্পটা এখানে হয়তো মনে আসে। সত্যের দ্বিবাচনিক স্বরূপ প্রতিষ্ঠায় যিনি ক্লান্তিহীন ছিলেন, তাঁর তত্ত্ববিশ্বের সঙ্গে জীবনের সমান্তরাল অবস্থান কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ সে-কথা ভালোভাবে তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। স্বভাবত বাখতিনের জীবনব্যাপী আত্ম-উন্মোচন এবং সেই সূত্রে বিশ্ব-উন্মোচন আমাদের মনোযোগের বিষয় হতে পারে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর প্রধানতম বক্তব্য এই যে পার্থক্য ও সমান্তরালতার উপলব্ধি অস্তিত্বের মৌল প্রাক্শর্ত। এর কারণ, বাখতিন জীবন-ব্যাপী অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছিলেন, একটি জগৎ থেকে ক্রমাগত উঠে আসে অনেক জগতের আদল এবং এক জীবনের অন্তরালে রয়ে যায় অজস্র বিকল্প-জীবনের সম্ভাবনা। স্বভাবত এদের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে, তাৎপর্য এক নয়, অনেক। এই অনেকান্তিকতা ভেঙে দিচ্ছে সব রৈখিকতা এবং একবাচনিক আয়তন। ফলে জীবন থেকে যে -প্রতিবেদন গড়ে উঠছে অহরহ, তার মধ্যে একক উচ্চারণ অসম্ভব। দৃষ্টিকোনের ভিন্নতা থেকে অনিবার্যভাবে জেগে উঠছে উচ্চারণের বহুত্ব। বস্তুত সাম্প্রতিক পৃথিবীতে মিখায়েল বাখতিনের মতো খুব কম চিন্তাবিদই পার্থক্যের বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন অস্তিত্বের সমান্তরাল অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। উচ্চারণের বহুত্ব তাঁর বিশ্বাসের বিষয় ছিল না কেবল, তাঁর জীবনের অজস্র আপাত-স্ববিরোধিতা ও কূটাভাসের মধ্যেও অনেকার্থ-দ্যোতনার প্রত্যয় অদ্ভূতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
বাখতিনের ভাববিশ্বে একক অস্তিত্ব যতখানি সত্য, ঠিক ততখানি অনিবার্য অনেকের প্রাসঙ্গিকতা। সম্ভবত এইজন্যে সারা জীবন ধরে তিনি মানবিক বিদ্যার নানা বিচিত্র পথে বিচরণ করেছেন। কোথাও তিনি নব্য-কাণ্টবাদী দর্শনের ঐতিহ্য স্বীকার করে নিয়েছেন, কোথাও মার্ক্সীয় চেতনার অনুষঙ্গে নিজের যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন, আবার কোথাও একধরনের বস্তু-অতিযায়ী চিন্তা দ্বারা প্রাণিত হয়েছেন। সুতরাং অনেকটা মৌলিকস্তরেই, পাঠকৃতির গভীরে, একাধিক বাখতিনের অবয়ব ফুটে উঠেছে; এইজন্যে বাখতিন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দেখা যায় পরস্পর-বিরোধী অবস্থান। আর, এই সংশয়ের জন্যে বরং বাখতিনকে দায়ী করতে হয়। কেননা লেনিনগ্রাদে থাকার সময়ে যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, এমন কয়েক জনের নামের আড়ালে আত্মগোপন করেছিলেন তিনি। অবশ্য এ সম্পর্কেও কোনো নিঃসন্দিগ্ধ অবস্থানে পৌঁছানো সহজ নয় আজও।
একুশ শতকের সূচনাবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আজ একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে বিশ শতকের প্রধান চিন্তাবিদদের মধ্যে বাখতিন অন্যতম নন শুধু, অগ্রণীও। বিশেষত গত কয়েক বছরে মানবিক চিন্তার বিভিন্ন অভিব্যক্তির মধ্যে প্রথাগত সীমানা যখন দ্রুত মুছে যাচ্ছে, সে-সময় বাখতিনের চিন্তা অনুসরণ করে আমাদের মনে হয়, তিনি বুঝিবা মানববিশ্বের এই সম্ভাবনার দিকে সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। সংশয়-পীড়িত এক সময়-পর্বে থেকেও জীবন ও মননের সমাপ্তিবিহীন সন্দর্ভ ছিল তাঁর অন্বিষ্ট। এইজন্যে ভাষাতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ঐতিহাসিক নন্দনতত্ত্ব, সত্তা-সম্পর্কিত দার্শনিক জিজ্ঞাসা—এই সবই তাঁর প্রতিবেদনে আত্তীকৃত হয়েছে। নব্য কাণ্টবাদ, প্রকরণবাদ, ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব যেমন তাঁর কৌতুহল আকর্ষণ করেছে, তেমনি ডস্টয়েভস্কি, গ্যয়ঠে, রাবেলের মতো সাহিত্যস্রষ্টা সম্পর্কে তাঁর মৌলিক বিশ্লেষণ সমালোচনা-তত্ত্বের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক পাঠককেন্দ্রিক সাহিত্যতত্ত্ব, নারীচেতনাবাদ ও আকরণোত্তরবাদী সাহিত্যতত্ত্ব বাখতিনের বক্তব্য পুনঃপাঠ করে নতুন নতুন তাৎপর্য আবিষ্কার করে চলেছে। স্বভাবত আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, বাখতিনের বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রচ্ছন্ন অনেকার্থদ্যোতনার স্বরূপ ঠিক কী যার ফলে নৃতত্ত্ববিদ, লোকতত্ত্ববিদ, ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যতাত্ত্বিকেরা তাঁদের নিজস্ব জিজ্ঞাসার সূত্র ও সমর্থন বাখতিনের বিভিন্ন সন্দর্ভে খুঁজে পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে চাই যদি, তাঁর জীবনের পর্ব থেকে পর্বান্তরে ছেদ ও ধারাবাহিকতার দ্বিবাচনিক সম্পর্ক কীভাবে নানা স্বরন্যাসে ব্যক্ত হলো—তা সতর্কভাবে বুঝে নিতে হবে।
আসলে বাখতিন পৌঁছাতে চান মানবিক চেতনার এক অনন্য সমবায়ী অভিব্যক্তিতে যাকে বলা যেতে পারে ‘দার্শনিক নৃতত্ত্ব’। বিভিন্ন উৎস-জাত স্রোতোধারা এসে মিলিত হোক ঐ মোহনায়, এই চেয়েছেন তিনি। সমস্ত কিছুর ওপরে বাখতিন গুরুত্ব আরোপ করেছেন মানবিক উচ্চারণের সামাজিক স্বভাবে কেননা তার অস্খলিত প্রত্যয় এই যে, কথ্য বা লেখ্য— যে-রূপেই প্রকাশ হোক না কেন, সমস্ত উচ্চারণই উৎসে-বিকাশে-পরিণতিতে সামাজিক। বিপুল ও নিরবচ্ছিন্ন দ্বিবাচনিকতার প্রক্রিয়ায় মানুষের উচ্চারণ লক্ষ্যের দিকে ছুটে যায় এবং খুঁজে পায় ঈঙ্গিত পরিসর। এই প্রক্রিয়া জীবনের পক্ষে অপরিহার্য, তাই সক্রিয় ভাবে যারা তাতে যোগ দেয় কিংবা নিস্ক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে কেবল—নানা উচ্চারণের বহুমুখী বিদূরণে তারা প্রত্যেকে অনিবার্যভাবে সামাজিক প্রতাপ ও আধিপত্যের যুক্তিশৃঙ্খলায় সংযুক্ত হয়ে পড়ে। কোনো প্রতিবেদনকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না, এই হলো বাখতিনের মৌলিক পাঠ। স্বভাবত এই সূত্র অনুযায়ী বাখতিনের নিজস্ব উচ্চারণকেও দেখতে হয় তাঁর সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে দ্বিবাচনিক সম্পর্কের বিন্যাসে। বস্তুত বাখতিনের মহাসূত্র হলো, সত্য দ্বিবাচনিক। যে-সমস্ত প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমরা অন্যদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে চাই, তাদের সুনির্দিষ্ট তাৎপর্য, শক্তি ও গুরুত্ব সর্বদা নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত বা পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। বাখতিনের উচ্চাবচ জীবন-বৃত্তান্তের দিকে যদি তাকাই, এই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা আরও একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাখতিন একে বলেন উচ্চারণের অনিবার্য যথাপ্রাপ্ত স্থিতি। সামাজিক জীবনের জটিল গ্রন্থি এবং দ্বন্দ্বময় ঐতিহাসিক সময় প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে স্বতন্ত্র করে দেয়। বাখতিনও এর ব্যতিক্রম নন।
দুই
ক্যাটেরিনা ক্লার্ক ও মাইকেল হলকুইস্ট-এর অন্তর্দীপ্ত গবেষণার ফলে আমরা বাখতিনের বৌদ্ধিক জীবন সম্পর্কে যে-চমৎকার বইটি পেয়েছি (১৯৮৪), তার ফলে বাখতিন এবং তাঁর চিন্তাবৃত্ত সম্পর্কে পরবর্তী বিশ্লেষণী বিস্তারের পথ সুগম হয়েছে। এক জীবনে জন্ম জন্মান্তর ঘটে যাওয়ার কথা বাঙালি পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথের কাছে শুনেছেন। এই উচ্চারণকে নিছক ভাবুক কবির অতিরেক বলে ধরে নিতে পারেন অনেকেই। কিন্তু যখন লক্ষ করি, বাখতিনের নাটকীয় জীবনপ্রবাহে এই উচ্চারণ অনেকখানি সত্য হয়ে উঠেছিল—বিস্মিত না হয়ে পারি না। চীনা সমাজে বয়স্কজনেরা নাকি এই আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন, ‘আগ্রহ উদ্দীপক (অর্থাৎ ঘটনাসংকুল) সময়ে তোমাদের যেন বাঁচতে না হয়!’ অথচ বাখতিনকে বেঁচে থাকতে হয়েছিল ঠিক সেরকম সময়েরই আবর্তে যখন রুশদেশের সমাজ, বাস্তবতা, ভাবাদর্শ—সমস্ত ভূমিকম্প ও ঝড়ের যৌথ আলোড়নে উথাল-পাথাল হয়ে যাচ্ছিল। রাশিয়ায় যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটছিল, সেই ১৯১৭-তে বাখতিনের বয়স বাইশ; স্পষ্টত বিপ্লবের দিনগুলিতে তিনি এর অনিশ্চয়তা ও উত্তাপ, সংশয় ও স্বপ্ন—সব কিছুর শরিক হচ্ছিলেন। নতুন ধরনের পুনর্নির্মাণের উদ্দীপনাকে বোঝার জন্যে বিপুলভাবে আত্মবিনির্মাণও যে করতে হচ্ছিল তাঁকে, একথা অনুমান করা কঠিন নয়। তারপর এল গৃহযুদ্ধের দুরূহ দিনগুলি; সেই পর্ব শেষ হতে না হতেই দেখা দিল স্ট্যালিনবাদের প্রাথমিক পর্যায়। ত্রিশের দশকে নেমে এল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অন্ধকার এবং তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও জার্মান আক্রমণ। হিমযুদ্ধের পর্বে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্থবিরতা হলো প্রবলতর; স্ট্যালিন-পরবর্তী রাশিয়ায় ক্রুশ্চেভের নয়া জমানাও দেখলেন বাখতিন। আর, মৃত্যুর আগে, ব্রেজনেভের পর্যায়ে রুশ-সমাজে অবসাদের বিস্তারও তিনি দেখে গেছেন। এত সব বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনের পর্ব থেকে পর্বান্তরে পৌঁছানো অবিস্মরণীয়। সুতরাং বাখতিনের উচ্চারণকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ক্রমিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ না-করে উপায় নেই। এ তাঁর গভীর উপলব্ধিতে অর্জিত আবিষ্কার যে, প্রতিটি তাৎপর্যকে আত্মস্থ করতে হয় নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁর ক্রমিক বিবর্তনকে বোঝার জন্যেও চাই সামাজিক ইতিহাসের নিবিড় পরিচয়, প্রেক্ষিতের সঙ্গে সত্যের সম্পর্কের গুরুত্ব বিচার। তাঁর চেয়ে বেশি আগ্রহ-উদ্দীপক, ঘটনাসংকুল সময়ে কে বেঁচেছিলেন আর! তাঁর মতো এত বিচিত্র বিবর্তনের মধ্য দিয়েও আর কাউকে যেতে হয়নি।
বিশের দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার বৌদ্ধিক সমাজে বাখতিন ছিলেন নিতান্ত প্রান্তিক ব্যক্তিত্ব; কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র কয়েকজন সহযোগী বন্ধু ও গুণমুগ্ধ জনের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম মৌল নির্যাস—‘প্রতিটি সত্তাই সহযোগী সত্তা’ আর ‘অস্তিত্ব কখনো স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয়,’ ‘অস্তিত্বকে অপর সত্তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়’—এসব জীবনের দুরূহ পর্বের উপলব্ধি থেকেই আহরণ করেছিলেন তিনি। বস্তুত জীবনকে যে বাখতিন ‘উপন্যাসত্ব’ বলেন এবং বারবার শৈল্পিক প্রতিবেদন ও জীবনের সন্দর্ভকে অভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পর্যবেক্ষণ করেন, এর সূত্রও রয়েছে এখানে। ত্রিশের দশকের প্রথম কয়েক বছর তাঁকে কাজাখাস্তানে রাজনৈতিক কারণে নির্বাসন ভোগ করতে হয়: ১৯৩৬-৩৭ সাল নাগাদ সামান্য সময়ের জন্যে তিনি মোর্দোভিয়ায় একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। অর্থাৎ এই দশকটা তাঁকে কাটাতে হয় বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতায়। এর পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত বাখতিন মস্কোর নিকটবর্তী একটি ছোট্ট শহরে দিন কাটিয়েছেন। সম্ভবত এইজন্যে রুশ বুদ্ধিজীবীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তিনি এড়াতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পরে অবশ্য তিনি মোর্দোভিয়ায় ফিরে যান এবং ১৯৬১-তে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত শিক্ষকতাই ছিল তাঁর জীবিকা। এই উথাল-পাথালের মধ্যেও বাখতিন কিন্তু কখনো বৌদ্ধিক জীবনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হননি। লাগাতার তিনি লিখে গেছেন যদিও তাদের খুব কম অংশই ছাপা হয়েছে। ১৯১৯ থেকে ১৯২৯-এর মধ্যে একটি অখ্যাত সংবাদপত্রে ছোট্ট নিবন্ধ ছাপানো ছাড়া স্বনামে তিনি কিছুই প্রকাশ করেননি। সম্ভবত সোভিয়েত রাশিয়ায় বিশেষ পরিস্থিতি এবং তাঁর অবস্থানগত জটিলতার জন্যে অনিবার্য আড়াল তাঁকে তৈরি করতে হয়েছিল। এই পর্বে ঘনিষ্ঠ বন্ধুজনদের নাম তিনি ব্যবহার করেছেন যাতে রচনা প্রকাশে কোনো অসুবিধা না হয়। অবশ্য এতে বাংলা সাহিত্যের ‘চণ্ডীদাস-সমস্যা’র মতো, কিংবা তার চেয়ে ঢের বেশি জটিল, ‘বাখতিন-সমস্যা’ তৈরি হয়ে গেছে এবং বিশেষজ্ঞরা পুরোপুরি দুটি দিকে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে আরো কিছু বলার আগে বাখতিন সংক্রান্ত অন্যান্য জরুরি তথ্যের প্রতি দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়ায় বাখতিন কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষে দু’তিন জন নাছোড়বান্দা গবেষকের কল্যাণে যেন মৃত্যুর দূরত্ব থেকে ফিরে এলেন তিনি জীবনে। পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এধরনের পুনর্বাসন, বলা ভালো নবজন্ম গ্রহণ, নিতান্ত বিরল ঘটনা। এরপর যা ঘটল, তার মধ্যে যেন প্রচ্ছন্ন রয়েছে রূপকথার দ্যোতনা। যেন বা বিচিত্র ব্যঞ্জনাময় উপায়ে বাখতিনের জীবন তাঁর তত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল: সমাপ্তি বলে কিছু নেই কোথাও, নেই কোনো চূড়ান্ত বিন্দু। তা না-হলে অনেকদিন আগে—সেই ১৯২৯-এই তাঁর জীবন রূঢ় অকাল-সমাপ্তিতে শেষ হতে পারত। ঐ বছর বাখতিনের ডস্টয়েভস্কি-বিষয়ক বিখ্যাত বইটি স্বনামে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই লেনিনগ্রাদের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর মতো বাখতিনকেও গ্রেপ্তার হতে হলো। স্ট্যালিনের শাসনকালে তাঁর একটি মাত্র নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল যদিও সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। ত্রিশের দশকের শেষে বাখতিন রাবেলে সম্পর্কে গবেষণা নিবন্ধ লিখে সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীদের মূলস্রোতে পুনঃপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু নানা অজুহাতে ঐ নিবন্ধের স্বীকৃতি কয়েক বছর পিছিয়ে গেল। এমন কি স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরেও বাখতিনের প্রকাশনাভাগ্য খুব একটা পাল্টায়নি। মোর্দোভিয়ার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে তিনি একটি দু’টি নিবন্ধ মাত্র ছাপতে পেরেছিলেন। সুতরাং ১৯২৯-এর পরে বৌদ্ধিক জগতের কাছে বাখতিন কার্যত ছিলেন অস্তিত্বহীন। ষাটের দশকের গোড়ায় অবস্থাটা নাটকীয়ভাবে বদলে গেল। মূলত তিন-চারজন অনুরাগীর প্রবল চেষ্টায় ১৯৬৩-তে ডস্টয়েভস্কি-বিষয়ক বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোল এবং ১৯৬৫-তে প্রকাশিত হলো রাবেলে-বিষয়ক বইটি। অতিদ্রুত বাখতিন তরুণতর প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠলেন নতুন ভাবনা-প্রস্থানের কৃষ্টি-নেতা। শুরু হলো অতীতের বিলীয়মান দিগন্ত থেকে বাখতিনের পুনরাবিষ্কার এবং তাঁর চিন্তাবৃত্তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ।
কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ায় তাঁর এই বিস্ময়কর পুনর্বাসনের চেয়ে ইংরেজি-জানা দুনিয়ায় আবিষ্কার অনেক বেশি আশ্চর্যজনক। ১৯৬৮-তে রাবেলে ও তাঁর জগৎ প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রতীচ্যের ভাববিশ্বে অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ ঘটে গেল যেন। প্রকৃতপক্ষে গত চল্লিশ বছর ধরে বাখতিনের প্রভাব অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে গেছে। রাশিয়ায় ও বহির্বিশ্বের গবেষকদের অক্লান্ত অধ্যবসায়ে তাঁর বিভিন্ন বই ইংরিজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তাঁর ভাববৃত্ত বিশ্লেষণে ও পুনর্বিশ্লেষণে ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে। সাহিত্যতত্ত্ব ছাড়াও ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বদর্শন, সমাজতত্ত্বের বিচিত্র ক্ষেত্রে এবং নারীচেতনাবাদ, উপনিবেশোত্তর চেতনাবাদ, আকরণোত্তরবাদ প্রভৃতিতেও দেখা যাচ্ছে দিগন্ত-বিস্তারের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বাখতিনের জীবনের নানা অনুপুঙ্খ এবং তত্ত্ব ও প্রয়োগের নানা স্তর পুরোপুরি নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। বস্তুত বাখতিন আজ এক নন, অনেক। তাই লেনিনগ্রাদের দিনগুলিতে বাখতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত পাভেল নিকোলায়েভিচ মেডভেডেভ (১৮৯১-১৯৩৮) ও ভ্যালেনটিন নিকোলায়েভিচ ভোলোশিনোভ (১৮৮৪/৮৫-১৯৩৬) যদিও তিনটে বই-এর রচয়িতা, তাঁদের ঘিরে এখন গড়ে উঠেছে বিচিত্র এক রহস্যবলয়। কেননা মনে করা হচ্ছে যে ঐ বইগুলি আসলে বাখতিনেরই লেখা এবং মেডভেডেভ রচনা-প্রক্রিয়ায় নামমাত্র অংশ নিয়ে থাকবেন। স্বভাবত পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসার আগে দৃঢ় তথ্যের যে জরুরি সমর্থন প্রয়োজন, তা এখন আর পাওয়া সম্ভবই নয়। সুতরাং বাখতিন ও বাখতিনের পত্নী কিছু কিছু সাক্ষাৎকারে যে -সমস্ত ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেইটুকুই আজ আমাদের একমাত্র ভরসা। বিশ ও ত্রিশের দশকে মেডভেডেভ ও ভোলোশিনোভ মোটামুটি সামাজিক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত সমাজের প্রবল বাত্যা-বিক্ষোভে সেইসব খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে। মেডভেডেভ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ১৯৩৮-এ মৃত্যুদণ্ড বরণ করেন আর ভোলোশিনোভ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৬-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাখতিনের প্রথম জীবনের বন্ধু এবং পরিবার-পরিজনের মধ্যে কেউই জীবিত নন। সত্তরের দশকে বাখতিন সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, গবেষকরা বহু চেষ্টা করেও কয়েকটি চিঠি ছাড়া বাখতিনের ডায়েরি বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত নথি খুঁজে পাননি। সেসময় কানায়েভ যদিও জীবিত ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে বিশেষজ্ঞরা বিশেষ কোনো সহযোগিতা পাননি। একমাত্র বাখতিনের শেষ জীবনের কিছু কিছু অন্তরঙ্গ জনের স্মৃতিচারণ ও ব্যক্তিগত রচনার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
তিন
এভাবে অনিবার্যভাবে ক্রমশ গাঢ়তর হয়েছে বাখতিন নামক কিংবদন্তির ছায়া। জীবন ও তত্ত্বকে যিনি নিরন্তর মেশাবার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁর জীবনের তাৎপর্যকে আজ বুঝতে হবে তাঁরই প্রস্তাবিত তত্ত্বের আলোয় এবং ঠিক একই ভাবে তাঁর তত্ত্বের উপযোগিতা সমর্থন করার সূত্র খুঁজতে হবে তাঁরই জীবনের বহুস্বরন্যাসে। জীবনকে যিনি সত্যের নিরন্তর দ্বিবাচনিক অভিব্যক্তি বলে জানেন, প্রতিটি উচ্চারণকে জানেন সামাজিক কণ্ঠস্বরের প্রকাশ হিসেবে, প্রতিটি সত্তাকে যিনি বিশ্বাস করেন অপর কোনো সত্তার সহযোগী বলে এবং লেখকের লিখন-প্রক্রিয়াকেও যিনি সমবায়ী অস্তিত্বের অভিব্যক্তি হিসেবে মনে করেন—ভোলোশিনোভ বা মেডভেডেভের লেখক-সত্তাকে সহযোগী হিসেবে পাওয়াকে তিনিই মর্যাদা দিতে পারেন নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে। ইউরোপীয় তাত্ত্বিকেরা যদিও স্ট্যালিনের আমলের নিপীড়নকে এই আত্মগোপনের জন্যে প্রধানত দায়ী ভেবেছেন, বাখতিনের সমগ্র জীবনের বার্তাকে মনে রাখলে একথা মানা যায় না। সত্তা ও অপরতার দ্বিবাচনিক সম্পর্ক বাখতিনের কাছে স্বতঃসিদ্ধ—কী জীবনে কী মননে কী অভিব্যক্তিতে। দ্বিতীয়ত, যাঁরা মেডভেডেভ ও ভোলোশিনোভের রচনায় মার্ক্সীয় চিন্তার স্পষ্ট প্রকাশ লক্ষ করে অস্বস্তি বোধ করেন এবং বাখতিনের তত্ত্ব-বিশ্বের সঙ্গে ঐ চিত্তার সম্পর্কহীনতা প্রমাণ করতে চান—এর পেছনে প্রধানত তাঁদের প্রতিভাবাদর্শগত অবস্থানই সক্রিয়। বাখতিনের জীবনব্যাপী সন্ধানকে যদি তাঁরই পরিভাষা অনুযায়ী নির্মিতি-বিজ্ঞানের প্রামাণিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে তাঁর চিন্তার সামগ্রিক আকল্পে এমনকি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর-বিপরীত ভাবনার সহাবস্থানও গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বাখতিনের জীবনব্যাপী সন্ধানের সম্ভারের প্রতি দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। নিচের ঐ তালিকা থেকে বাহ্যত যে-বিপ্রতীপের সমাহার স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তারই মধ্যে নিহিত রয়েছে যেন বাখতিনের অন্যতম মহাসূত্রের প্রতি সমর্থন: চূড়ান্ত বিন্দু বলে কিছু জীবনে। মৃত্যু আসলে নেই জীবনের বহমান দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়াকেই সমর্থন করে।
ক. বাখতিনের স্বনামে প্রকাশিত রচনা::1. Art and Answerability: Early Philosophical Essays (trans V Liapunov, ed. M. Holquist and V. Liapunov), University of Texas Press, Austin, Texas, 1990.:2. The Dialogic lmagination: Four Essays (trans. C. Emerson and M Holquist ed. M Holquist), University of Texas Press, Austin, Texas, 1981.:3. Problems of Dostoevsky's Poetics (trans. and Ed. C.. Emerson), University of Minnesota Press, Minneapolis, Minnesota, 1984.:4. Rabelais and His World (trans. H. Iswolsky), Indiana University Press, Bloomington, Indiana, 1984.:5. Speech Genres and other late Essays (trans. V. W. McGee, eds. C. Emerson and M. Holquist), University of Texas Press, Austin, Texas, 1986.:6. ‘Prefaces to Tolstoy’ (trans. C. Emerson in G. S. Morson and C. Emerson eds.), Rethinking Bakhtin: Extensions and Challenges, Northwestern University Prss, Evanston, Illinois, 1989.:7. Toward a Philosophy of the Act (trans, Vadin Liapunov), University of Texas Press, Austin, Texas, 1993.
খ. সহযোগীদের নামে প্রকাশিত::1. P. N. Medvedev: The Formal Method in Literary Scholarship A Critical Introduction to Sociological Poetics (trans. A. G. Wehrle), The Johns Hopkins University Press, Baltimore, 1978.:2. V. N. Voloshinov: Marxism and the Philosophy of Language (trans. L. Matejka and I. R. Titunik), Harvard University Press, Cambridge, Massachussetts, 1986.:3. Freudianism: A Critical Sketch (trans. I. R. Titunik, ed. I. R. Titunik with N. H. Bruss), Indiana University Press, Indianapolis, Indiana, 1987.:4. Bakhin School Papers (ed. A. Shukman), University of Essex, Colchester, 1983.
(এতে রয়েছে মেডভেডেভ ও ভোলোশিনোভ স্বাক্ষরিত কয়েকটি নিবন্ধ)
কোনো সংশয় নেই যে উপন্যাসতত্ত্বের ক্ষেত্রে বাখতিন নতুন দিগন্ত খুলে দেননি। কেবল, তিনি হয়ে উঠেছেন উপন্যাস-তাত্ত্বিকদের মধ্যে অনতিক্রম্য এক শীর্ষবিন্দু। জীবনকে তিনি মনে করেন উপন্যাসত্বের ধারাবাহিক অভিব্যক্তি; এইজন্যে এই শিল্পমাধ্যমে অজস্র উচ্চাবচতাই তাঁর নজরে পড়ে না শুধু, জীবন ও উপন্যাসের সমান্তরাল প্রতিবেদনে তিনি খুঁজে পান অনেকার্থদ্যোতনার প্রতিষ্ঠা। স্বর থেকে স্বরান্তরে যেতে-যেতে অনবরত সমৃদ্ধ হয় জীবন, উপন্যাসের প্রকরণও হয়ে ওঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই জীবনের মতোই উপন্যাসও চিরমুক্ত, সমস্ত সমাপ্তি তাতে আপাত-সমাপ্তি। প্রসঙ্গত বাখতিনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি বিলডুঙ্গস্ রোমান, কার্নিভাল এবং আখ্যানে বহুস্বর সন্নিবেশের ধারণা। তাঁর বিশ্বাসের গভীরে চির জাগ্রত ছিল এই মৌল প্রেরণা যে সত্তা আসলে সমান্তরালতার বোধ আর, সমান্তরালতা হলো অপরতার উপলব্ধি। এই জগতে কেউই নিজে-নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। জগৎ ও জীবন সত্য হয়ে ওঠে শুধুমাত্র অপর সত্তার প্রতীতিতে। এমন কোনো উচ্চারণ নেই যা বৃন্তহীন পুষ্পের মতো নিজের মধ্যে জাগে এবং নিজের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। প্রতিটি উচ্চারণ অনিবার্যভাবে ধাবিত হয় সম্ভাব্য গ্রহীতা হিসেবে উপস্থিত বা অনুপস্থিত অপর সত্তার প্রতি। এইজন্যে কোনো বাচন একান্তিক নয় কখনো, প্রতিটি বাচন মর্মগত ভাবে দ্বিবাচনিক। যেহেতু জীবন এক প্রবহমান উপন্যাসত্বের অন্য নাম, উপন্যাসের সন্দর্ভও আদ্যন্ত দ্বিবাচনিক। সহযোগিতায় পূর্ণ হয় সত্তা আর সহযোগের অভাব তাকে রিক্ত করে কেবলই—এই সত্য যেমন একদিকে উন্মোচন করে উপন্যাস, তেমনি অন্যদিকে জীবনের সার্থকতা প্রমাণিত হয়। ব্যক্তিস্বর ও সামাজিক স্বরন্যাসের দ্বিবাচনিকতায়, বহু উচ্চারণের মধ্যে সঙ্গতির প্রয়াসে।
তবু এই উপন্যাস-ভাবনাই মানুষের ভাববিশ্বে বাখতিনের একমাত্র অবদান নয়। বিশেষজ্ঞদের মোটামুটি সবাই লক্ষ করেছেন যে বাখতিনের প্রতিবেদনে রৈখিকতা বিরল। তাঁর জীবনীকারেরা জানিয়েছেন যে মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি আবার জীবনের প্রথম পর্যায়ের চিন্তাবৃত্ত সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। আসল বাখতিন তত্ত্বের বিন্যাসে যেভাবে তাৎপর্য সন্ধান করেছেন, ঠিক একই ভাবে নিজের জীবনেও খুঁজেছেন। তাঁর কাছে অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসা আর জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা এক ও অভিন্ন হয়ে পড়েছিল। দ্বিবাচনিকতা যেহেতু তাঁর কাছে অস্তিত্বের সারাৎসার, সব-খোলো-চাবির মতো এই পরাতত্ত্বকে তিনি ব্যবহার করেছেন। বাখতিনের চিন্তাধারা অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারি বহমান কালের মাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বর্তমানের একক মুহুর্ত বা অবস্থান তাঁর কাছে যথেষ্ট নয় কখনো। বাখতিন সেই দ্বিবাচনিক জগতের অধিবাসী যেখানে সার্বিক জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি নিজের পথে কেউ কখনো বিকশিত হতে পারে। না। প্রতিনিয়ত আমাদের অজস্র অপর সত্তার সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়, দ্বন্দ্বে-সংগ্রামে যুক্ত হতে হয়। এমনকি নিজেরই সঙ্গে নিজের ব্যবধান তৈরি হয় কখনো কখনো; সেইসব মুহূর্তে নিজেরই মধ্যে অনুভব করি সত্তা ও অপরতার দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়া।
অতএব নিবিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাখতিন-কথিত দ্বিবাচনিকতা আসলে সামাজিক অস্তিত্বের প্রাধান্যকে যথাপ্রাপ্ত বলে স্বীকার করে নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিটি সম্পর্কই সামাজিক সম্পর্ক। কেননা প্রতিটি উচ্চারণই সামাজিক উচ্চারণ। এহেন দ্বিবাচনিক জগতে কোনো তাৎপর্য স্বতশ্চল ভাবে দেখা দেয় না; নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাকে অর্জন করে নিতে হয়। তার মানে, কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি শেষ হয়ে যায় না, ফুরিয়ে যায় না তাৎপর্য। দ্বিবাচনিকতার সীমা নেই কোথাও: এই অনুভূতি-নিবিড় উচ্চারণের সূত্রেই ঐতিহ্য জীবন্ত হয়ে ওঠে সাম্প্রতিক আয়তনে। তেমনি ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাবনাও প্রতিফলিত হচ্ছে আজকের দর্পণে। দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে যে-তাৎপর্য, তাকে চূড়ান্ত বলে ভাবার কোনো কারণ। নেই। পরবর্তী মুহূর্ত-পরম্পরায় বিস্তৃত জীবনের প্রতিবেদনে আবারও নতুন হয়ে উঠতে পারে সব। কিংবা, বাখতিনের চিন্তাসূত্র অনুযায়ী, উঠতে পারে নয়—বলা ভালো, হয়ে উঠবে। স্মৃতি আমাদের সত্তার সূত্রধার, সত্তা যেমন ভবিষ্যতের। চলতে-চলতে পুঞ্জীভূত হতে থাকে কত অজস্র বিস্তৃতির নিঃশব্দ আয়তন, কোনো-এক অদূরবর্তী ভবিষ্যতে পুনর্জীবিত হবে বলে। বাখতিনও তাই জীবনের গোধুলিবেলায় পৌঁছে ফিরিয়ে এনেছিলেন বিস্মৃত তারুণ্যের ভাবনা; আসলে এভাবে, ভাবনার পুনর্নবায়নের মধ্য দিয়ে, তাৎপর্য-সন্ধানের দ্বিবাচনিকতাকে প্রমাণিত করেছিলেন তিনি। বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সমস্ত উত্তাপের সূত্র প্রচ্ছন্ন রয়েছে মানুষের স্মৃতিসত্তায়। উপন্যাসত্বের প্রকাশ হিসেবে যিনি জীবনকে দেখছেন, তার কাছে তাই সব মুহূর্তই নতুন সূচনার মাহেন্দ্রক্ষণ: শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রতিটি ধারাই মোহনায় পৌছে উৎসে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। পুরোপুরি হারিয়ে যায় না কিছুই, প্রতিটি তাৎপর্য গড়ে ওঠে প্রত্যাবর্তনের উৎসব-মুখরতায় যাতে চলমানতা একমাত্র আধেয়।
পাঁচ
স্বনামে কিংবা সহযোগীদের নামে প্রকাশিত রচনাগুলি অভিনিবেশের সঙ্গে যখন পড়ি, সাম্প্রতিক পাঠক-কেন্দ্রিক সাহিত্যতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতাও যেন আরো একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিবেদনের তাৎপর্য মূলত গ্রহীতা পাঠকের ভাবাদর্শগত অবস্থানের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। বস্তুত বাখতিন যে দ্বিবাচনিক সত্যকে জীবনের ও সাহিত্যিক পাঠকৃতিতে অধ্যয়ন করতে চান, তা নিরন্তর বিচরণশীল উচ্চারণের সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। বাখতিনের তত্ত্ববিশ্বে প্রতিবেদন খুব গুরুত্বপূর্ণ; পাঠকৃতির নির্মিতি-বিজ্ঞান সম্পর্কে খুব প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণী পাঠ আমরা বাখতিনের কাছে পেয়েছি। যিনি বলেছেন, অস্তিত্ব আসলে সংগঠন, তাঁর কাছে প্রতিবেদনও মূলত দুটি সামাজিক সত্তার মধ্যবর্তী সেতু। অপরতার সঙ্গে সত্তার নিরন্তর জায়মান দ্বিবাচনিক সম্পর্ক অর্থাৎ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ভাষায়, চেতনায়। বাখতিনের বিখ্যাত সূত্র—চেতনা মানে অপরতার বোধ—এখানে উল্লেখ করতে পারি। এই বোধ যখন ভাষায় প্রতিফলিত হয়, সৃষ্টি হয় নতুন তাৎপর্য। মানবচৈতন্যের বহুরৈখিক ও সৃজনশীল সীমান্ত অঞ্চলে ভাষা নির্মিত ও পুননির্মিত হয়। উচ্চারণ সোচ্চার হোক বা নিরুচ্চার, গ্রহীতা সক্রিয় হোক বা নিষ্ক্রিয়—ভাষার প্রায়োগিক বলয় গড়ে ওঠে ঐ অপর সত্তার প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন উপস্থিতিতে। অস্তিত্বের মতো ভাষাও তাই নিশ্চিত সংগঠন ছাড়া ব্যক্ত হতে পারে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বাখতিনের বইগুলিতে কয়েকটি অন্যোন্য-সম্পৃক্ত মৌলিক ধারণা বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন: সত্তা ও অপর, ঘটনা ও মুক্ত উপসংহার সম্পন্ন ধারাবাহিকতা, চেতনার প্রান্তরেখা ও বহিরঙ্গতা, পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াময় সৃজন-পদ্ধতি ও সামাজিক মূল্যায়ন, একবাচনিকতা ও দ্বিবাচনিকতা ইত্যাদি। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে বাখতিনের চিন্তায় এইসব ধারণা পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে থাকে। এইজন্যে পাঠকের দায়ও বেড়ে যায় অনেকটা কেননা তাঁকে সর্বদা বাখতিনের সামগ্রিক আকল্প সম্পর্কেও অবহিত থাকতে হয়। মনে রাখতে হয় যে বাখতিন প্রচলিত অর্থে কোনো ভাব-প্রস্থানের প্রবক্তা নন। এমনকি তাঁকে অভ্যস্ত আকরণেও বন্দি করা যায় না। অথচ মানবিক নির্মিতির বিশ্লেষণে তিনি আমাদের সত্যকে শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট উপযোগী কৃৎকৌশল উপহার দিয়েছেন।
মননশীলতার সূচনা থেকে পরিণতিতে পৌঁছানো পর্যন্ত নিজের নির্দিষ্ট কয়েকটি কেন্দ্রীয় বিশ্বাসকে বাখতিন বারবার পরখ করেছেন, যুক্ত করেছেন নতুন নতুন বিভঙ্গ। তাই Art and Answerability বইতে নান্দনিক প্রক্রিয়ায় লেখক ও নায়ক সত্তার গুরুত্ব সম্পর্কিত (১৯৯০: ২২) নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, কোনো নান্দনিক প্রক্রিয়া তখনই সাকার হয়ে ওঠে যখন তাতে অন্তত দু’জন ব্যক্তি তাদের সমান্তরাল চেতনা নিয়ে উপস্থিত থাকে। তাঁর মতে, কোনো নিঃসঙ্গ চেতনায় কখনো সত্তার উপলব্ধি হতে পারে না; ব্যক্তি যখন নিজের বাইরে অপর চেতনার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হয়ে ওঠে, তখনই তার মধ্যে তৈরি হয় সত্তার সাংগঠনিক তাৎপর্য সম্পর্কে উপলব্ধি। ঐ বইতে বাখতিন আরো লিখেছেন, আমরা যখন কাউকে দেখি বা জানি, সেই দেখা বা জানা নির্দিষ্ট একটা অবস্থান থেকেই হয়ে থাকে। তার মানে, আমরা যা দেখতে পাই, তা আবার ঐ মনোযোগের কেন্দ্রস্থিত মানুষটি তার নিজের সম্পর্কে দেখতে বা জানতে পারে। না। আমরা যখন পরস্পরের দিকে তাকাই, আমাদের চোখের তারায় দুটি ভিন্ন জগৎ প্রতিফলিত হয়ে থাকে। এই ভিন্নতাকে যদি পুরোপুরি মুছে ফেলতে হয়, পরস্পরের মধ্যে এক ও অভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে মিশে যেতে হবে। প্রত্যেকেই নিজের অবস্থানে অনন্য ও অপরিবর্তনীয় আবার এই মৌলিক উপলব্ধির জন্যেও চাই অপর সত্তার উপস্থিতি। অন্তর্জীবনকে যদি প্রাণবান করে তুলতে চাই, যেতে হবে বহির্বৃত ভিন্ন জগতে অর্থাৎ এক চেতনার স্তরে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, এ যেন চোখের আলোয় চোখের বাহিরকে দেখা এবং বাইরে যখন নিরালোক, সে-সময় অন্তরের গভীরে দৃষ্টিপাত করা। এই বিন্দুতে শুরু হয়ে যায় পাঠকের নিজস্ব পরিসর-সন্ধান এবং সেই সঙ্গে, প্রতিবেদনে অন্য এক পর্যায়ে, প্রমাণিত হয় বিষয়বস্তুর আকরণ থেকে লেখকেরও কৃৎকৌশলে পৌঁছানোর অনিবার্যতা
বাখতিনের চিন্তা অনুসরণ করে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই। তা হলো, সাহিত্যে কিংবা জীবনে কারো আত্মগত অভিজ্ঞতা কখনো সম্পূর্ণ, চূড়ান্ত ও সার্বিক তৃপ্তি-সম্পন্ন হয় না; সত্তার কোনো উপস্থাপনাই সত্যের সমগ্রতাকে তুলে ধরতে পারে না। বাখতিনের অননুকরণীয় ভাষায় ‘I always have a loophole' (তদেব: ৪০) কেননা ‘আমার’ তাৎপর্য সর্বদা পূর্ণতার প্রতীক্ষা করছে। এবিষয়ে আরো বিস্তারিত বয়ান পাই ডস্টয়েভস্কির নন্দন সম্পর্কিত আলোচনায় (১৯৮৪: ২৩২-২৩৬)। তাৎপর্যের চূড়ান্ত প্রতীতি যখন কোনো লেখকের অন্বিষ্ট, তিনি তখন তাঁর রচনায় সানুপুঙ্খ গ্রন্থনার মধ্য দিয়ে এক নায়কের পরিপূর্ণ উপস্থিতিকে তুলে ধরেন। এই উপস্থাপনায় আবিষ্কারযোগ্য কোনো রহস্য থাকে না কোথাও; সমস্ত তাৎপর্য তাই পাঠকৃতিতে নিঃশেষিত হয়ে যায়। নায়কের সব দিক জানার আগ্রহে তাকে লেখক এমনভাবে নিঙড়ে নেন যে পাঠকের কিছুই করার থাকে না আর। ফলে ঐ চরিত্রটি কার্যত মৃত হয়ে পড়ে। বাখতিন এই প্রসঙ্গে ভেবেছেন, মৃত্যুকে তাহলে বলা যেতে পারে ‘the form of aesthetic consumation of an individual’ (১৯৯০: ১৩১)। চিন্তাকে পরবর্তী পর্যায়ে আরো অনেকটা। এই প্রসারিত হতে দেখি। কোনো ধরনের চূড়ান্ত বিন্দুতে বাখতিনের অবিশ্বাস যখন গাঢ়তর হয়েছে, সাহিত্যিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে মৃত্যুর উপস্থাপনাকে গণ্য করা হয়েছে লেখকসত্তার আতিশয্যপ্রবণ নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ হিসেবে। তাই ডস্টয়েভস্কি-বিষয়ক বইতে বাখতিন টলস্টয়কে সমালোচনা করেছেন তাঁর লেখক-দৃষ্টির চূড়ান্ত অতিরেকের জন্যে; বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যু-বর্ণনায় টলস্টয়, বাখতিনের মতে, একবাচনিক সমাপ্তির বার্তা এনে দিয়েছেন। অন্যদিকে ডস্টয়েভস্কি তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নতুন ধরনের লেখক-সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন; আত্মচৈতন্যের মুক্ত সমাপ্তির প্রতি ঐ সম্পর্ক যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। এইজন্যে ডয়েভস্কির ঔপন্যাসিক অণুবিশ্বে দিবাচনিক কল্পনার শিল্পসার্থক অভিব্যক্তি ঘটেছে বলে বাখতিন মনে করেন। যথাপ্রাপ্ত জগতের সঙ্গে মানবসত্তার নিরন্তর সংঘর্ষের ধারণাকে তিনি নান্দনিক নির্মিতির বিষয় করে তুলেছেন: তাঁর ভাষায়, ‘organizing form-and-content center of artistic vision’ (১৯৯০: ১৮৭)। শব্দ বা বাক্য কথনশিল্পের নিয়ন্তা নয়; বরং শৈল্পিক অন্তদৃষ্টি শব্দ ও বাক্যকে সংগঠিত করে মানবসত্তার নিবিড় উপলব্ধিকে মূর্ত করে তোলে।
ছয়
আখ্যানে বিভিন্ন চরিত্রের প্রত্যক্ষ উক্তিতে প্রতিফলিত হয় তাদের স্বরন্যাসের বৈচিত্র্য, জগতের প্রতি তাদের আবেগ ও মনন-জাত প্রতিক্রিয়া। আবার লেখকের পরোক্ষ উক্তিতে ঐসব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন ধরা পড়ে। সুতরাং উপন্যাসের আখ্যানে ভাষা ও চেতনা দ্বিস্বরিক, অবশ্য দ্বিস্বরিক প্রতিবেদনের এই ধারণা আরো বিকশিত হয়েছে Marxism and the Philosophy of Language বইতে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাতে ক্রমশ গভীরতা ও ব্যাপ্তি যুক্ত হতে দেখি। যাই হোক, প্রাথমিক পর্যায়ের ঐ রচনায় বাখতিন এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন: ‘Every word in narrative literature expresses a reaction to another reaction, the author's reaction to the reaction of the hero; that is every concept, image, and object lives on two planes, is rendered meaningful in two value contexts —in the context of the hero and in that of the author (তদেব: ২১৮)। এভাবে তাঁর চিন্তাবিশ্বের প্রথম থেকেই শিল্প ও জীবনের মধ্যবর্তী বিভাজনরেখা ঝাপ্সা হয়ে গেছে। সত্তা ও অপরতার সৃষ্টিশীল অন্যোন্যনির্ভরতা সম্পর্কিত ধারণায় যে নৈতিক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে, তাকে গভীরভাবে পরীক্ষা করা যায় যখন লেখক ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নান্দনিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, ভোলোশিনোভ স্বাক্ষরিত ‘Discourse in the Life and Discourse in Art’ (১৯২৬) নামক নিবন্ধে পুরোপুরি বিপরীত বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে। তখন বাক্-শিল্পের উপলব্ধিতে পৌঁছানোর জন্যে দৈনন্দিন উচ্চারণের বিশ্লেষণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেননা প্রকরণবাদী সমালোচনায় শিল্প-অভিব্যক্তিকে বিশুদ্ধ ভাষাগত নির্মিতি হিসেবে কার্যত বিমূর্তায়িত করে তোলা হচ্ছিল এবং সামাজিক প্রেক্ষিতের চলিষ্ণুতা থেকে তা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। অন্য আরেক ধরনের সমালোচনায় কোনো একক স্রষ্টার ব্যক্তিগত অহং বা মনস্তত্বের দর্পণে প্রতিফলিত হচ্ছিল শিল্পকর্ম। দুটোকেই সমানভাবে ভ্রান্ত মনে করেছেন বাখতিন, কেননা, তাঁর মতে, প্রতিটি নির্মিতি ভাবাদর্শের নির্মিতি এবং বাক্শিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। যেহেতু সৃষ্টিপ্রক্রিয়া মূলত অস্তিত্বের সংগঠন, এক মুহূর্তের জন্যেও ঐ প্রক্রিয়ায় জীবন্ত সামাজিক সংযোগ শিথিল হয় না। প্রতিটি মুহূর্ত মুখর থাকে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সমাজসংবিদের সোচ্চার ও নিরুচ্চার গুঞ্জনে। প্রতিটি ভাবাদর্শবাহিত প্রকরণের মতো বাচনিক শিল্পও “intrinsically, immanently sociological' (১৯৮৭: ৯৫)। প্রথম পর্যায়ের রচনা থেকে ‘Freudianism' শীর্ষক বইতে অন্তর্ভুক্ত ঐ রচনায় পৌঁছাতে-পৌঁছাতে বাখতিনের বক্তব্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাৎপর্য এবার আর অপর (লেখক) দ্বারা নির্মিত নয় যাকে নিস্ক্রিয় গ্রহীতা সত্তার (নায়ক) কাছে দান হিসেবে তুলে দেওয়া যায়। এই পর্যায়ে তাৎপর্য মূলত সামাজিক উপলব্ধি যাকে সৃষ্টিশীল সংগঠনে যোগদানকারীদের সম্পূর্ণ সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফসল বলা যেতে পারে। স্বভাবত এখানে সামাজিক প্রতাপ ও তার বহুস্তরান্বিত কৃৎকৌশল বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী নির্ধারিত হয় সত্য এবং তার প্রাকরণিক কাঠামো। অতএব বাখতিনের তত্ত্ববিশ্বে দ্বিবাচনিক আন্তঃসম্পর্ক বিমূর্তায়িত ধারণা নয় কোনো, বস্তুগত ইতিহাস ও সামাজিক আকরণে নিহিত প্রতাপের যুক্তিশৃঙ্খলা তার চরিত্র ও অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত এবং মেডভেডেভ-স্বাক্ষরিত The Formal Method in Literary Scholarship বইতে প্রকরণবাদী নন্দনের সমালোচনা এবং মার্ক্সীয় সমাজতাত্ত্বিক নন্দনের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এতে প্রকরণবাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু মার্ক্সবাদী তাত্তিকের একপেশে ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বিষয়বস্তু ও প্রকরণের অবিভাজ্যতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সামগ্রিক ভাবাদর্শগত অণুবিশ্বের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে সাহিত্য কীভাবে অন্যান্য প্রকাশ-মাধ্যমের বিচ্ছুরণকে আত্মস্থ করে নেয় এবং আর্থসামাজিক বাস্তবতার স্বরূপকে উন্মোচিত করে—এটা দেখাতে চেয়েছেন বাখতিন/ মেডভেডেভ। রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিকাশের সঙ্গে বাক্শিল্পের জটিল সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাখতিন জীবনের শেষপর্বে ‘মহাসময়’ ও ‘অণুসময়’ -এর যে দ্বিবাচনিক দর্শন উত্থাপন করেছিলেন (১৯৮৬: ৪), তার প্রাথমিক সূত্রপাত হয়েছিল এখানে। ভোলোশিনোভ স্বাক্ষরিত Marxism and the Philosophy of Language (১৯২৯) বইতে ভাষাতত্ত্বের আকরণবাদী (সোস্যুরীয়) ব্যাখ্যা সমালোচিত হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মতাবাদ ও বিমূর্ত বস্তুবাদকে ভাষাবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দু’ধরনের বাধা হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, ব্যক্তির সৃষ্টিপ্রতিভা বা ভাষাগত আকরণে বিপুল ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ—আকরণবাদ তা বিশ্লেষণে অক্ষম। বরং ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার মধ্যে অযৌক্তিক বৈরিতা কল্পনা করে ভাষাচেতনায় নিহিত সত্যকে তা উন্মূল করে দেয়। ভাষা মূলত ভাবাদর্শের চিহ্নায়ন প্রক্রিয়া; প্রতিটি বাচনিক একক আসলে একেকটি চিহ্নায়ক। কিন্তু এদের বিমূর্ত ভাবে, প্রসঙ্গ-বিচ্ছিন্ন করে, বোঝা যায় না; বুঝতে হয় পারস্পরিক সম্পর্কের অন্বয় বা অনম্বয়ে। এইজন্যে ভাষা আলোচনায়ও বাখতিনের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে ঘটনা ও ধারাবাহিকতা, উদ্ভব-প্রক্রিয়া ও মূল্যায়ন, সীমারেখা ইত্যাদির পারিভাবিক প্রয়োগ। তবে তখনই প্রথম একবাচনিকতার বিপ্রতীপে উত্থাপিত হলো দ্বিবাচনিকতার ধারণা। আকরণবাদীদের মতো ভাষাকে বিচ্ছিন্ন, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বাচনিক ও প্রকৃত প্রসঙ্গ থেকে বিচ্যুত, একান্তিক উচ্চারণ হিসেবে ভাবেননি তিনি। তাই এখানে আমরা পেলাম তার মৌলিক বক্তব্য: ‘Any true understanding is dialogic in nature’ (১৯৭৩: ১০২)। ভাষার সঙ্গে চেতনা স্বভাবত সম্পৃক্ত; তাই মানবচৈতন্য সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও পাওয়া গেল: চেতনা অন্তর্বৃতভাবে সক্রিয়, সৃষ্টিশীল ও সামাজিক (‘The individual consciousness is a socio-ideological fact’ (তদেব: ১২)। চেতনা মানে তাৎপর্য, আর তাৎপর্য মানে মূল্যায়ন। বলা বাহুল্য, মূল্যায়ন সম্ভব শুধুমাত্র সামাজিক ও ভাবাদর্শগত অবস্থানের স্পষ্টতায়।
সাত
আমরা যাকে আত্মগত ভাবনা বলি, তার উৎস হলো সেই ‘সীমান্ত অঞ্চল’ যেখানে অন্তর্বৃত অভিজ্ঞতা ও সামাজিক জগৎ পরস্পরের সঙ্গে মেশে। এই মিলন ঘটে চিহ্নায়কের অর্থাৎ শব্দের মধ্য দিয়ে। সুতরাং উপলব্ধি মানে এক ধরনের চিহ্নায়কের সঙ্গে অন্য ধরনের চিহ্নায়কের অন্বয়। ভালোভাবে লক্ষ করলেই বুঝব, কেবলমাত্র চিহ্নায়ক অর্থ বহন করে থাকে। নিজের বাইরে গিয়ে অপরের প্রতীতি করানো তার দায়। যদি কখনো চেতনা থেকে চিহ্নায়ন প্রক্রিয়াকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, তাৎপর্যের পরিসরও শূন্যে মিলিয়ে যাবে। চিহ্নায়কের প্রতি চেতনার সাড়া দেওয়াতে দ্বিবাচনিকতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বহিঃপৃথিবীর অভিজ্ঞতা যখন অন্তর্জগতে আলোড়ন তোলে, প্রতিটি শব্দ থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে সামাজিক স্বরন্যাসের নানা বিভঙ্গ। এই প্রতীতি নিষ্ক্রিয় নয় কখনো, আবার এই সক্রিয়তাতেও নিহিত থাকে বিচিত্র বিপ্রতীপের সন্নিবেশ; একটি বাচন থেকে জেগে ওঠে প্রতিবাচন। এই তত্ত্ববীজকে বাখতিন পরবর্তী কালে, বিশেষভাবে জীবনের শেষ পর্বে, বাচনিক মাধ্যম সম্পর্কিত আলোচনায় আরো বিশদ করেছেন (দ্রষ্টব্য, ১৯৮৬ ৬০-১০২)। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকরণ সামূহিক মিথষ্ক্রিয়াকে নিরন্তর বদলে দেয় বলে বিভিন্ন বাচনিক প্রতিবেদনে উচ্চারণের গতি ও প্রবণতা বিচিত্রগামী হয়ে ওঠে। একে ভোলোশিনোভ/বাখতিন চিহ্নায়কের ‘সামাজিক বহুস্বরিকতা’ (‘Social multiaccentuality’: ১৯৭৩: ২৩) বলেছেন যার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে শ্রেণী-বাস্তবতা অনুপ্রাণিত পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বিবাচনিক আয়তন। প্রতিটি যুগে সামাজিক প্রতাপের নিয়ন্তা শ্রেণী সমস্ত উচ্চারণকে একবাচনিক করে তুলতে চায়, নিজেদের সুবিধা-মাফিক একক তাৎপর্য চাপিয়ে দিতে চায় ভাষার উপর; কিন্তু সত্য যেহেতু দ্বিবাচনিক, প্রতিবাদী ভাবাদর্শ থেকে জন্ম নেয় সংঘর্ষপ্রবণ চিহ্নায়ক। এই প্রসঙ্গে বাখতিন আরো জানিয়েছেন, শব্দ আসলে দ্বিমুখী ক্রিয়া: বক্তা ও শ্রোতা, সম্বোধক ও সম্বোধিত—এই দুই মেরুর বিনিময়-নির্ভর সম্পর্কই শব্দের উৎস। প্রতিটি শব্দ তাই সত্তা ও অপরতার মধ্যে সেতু গড়ে দেয়। অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার উপলব্ধি; নিরন্তর বাচনিক সংযোগের শৃঙ্খলায় প্রতিটি উচ্চারণ তখন হয়ে ওঠে একক মুহূর্তের নির্মাণ।
এই প্রসঙ্গে বাখতিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাচন সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সীমারেখা ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বলে একে অপরের মধ্যে অনেক সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সাহিত্যিক ও সামাজিক পাঠকৃতিতে বক্তার লেখক বা কথক সুলভ আধিপত্য প্রায়ই পরোক্ষ বাচনের স্বরবৈচিত্র্যে ধ্বস্ত হয়ে যায়। এই বক্তব্যকে ডস্টয়েভস্কি-সংক্রান্ত আলোচনায় বাখতিন আরো ব্যাপ্ত, গভীর ও শানিত করে তুলেছেন। সীমারেখায় ক্ষয় যেহেতু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাচনের ক্রমবর্ধমান। দ্বিবাচনিকতাকে স্বতঃসিদ্ধ করে, প্রতিবেদন হয়ে ওঠে দ্বিস্বরিক। একই ধরনের শব্দবিন্যাসে দুটি ভিন্ন প্রকাশযুক্ত কথনক্রিয়ার উপস্থিতি আভাসিত হয় তখন। বাখতিন যেহেতু টলষ্টয়ের তুলনায় ডস্টয়েভস্কিকে উপন্যাস নামক শিল্পরূপের সার্থকতর স্থপতি বলে মনে করেন, ঐ দ্বিস্বরিক প্রতিবেদনকে তিনি প্রিয় ঔপন্যাসিকের সৃজনশীল নির্মিতির প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বস্তুত ‘Marxism and the Philosophy of Language’ বইতে বাখতিনের ধারাবাহিক চিন্তা পরিণতির একটি পর্যায় সমাপ্ত করল যেন। তিনি এই প্রত্যয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন যে প্রতিবেদন ও চেতনার মৌল স্বভাব দ্বিবাচনিক। জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের সমান্তরাল অভিব্যক্তি লক্ষ করতে করতে তিনি এবার তার প্রত্যয়কে উপন্যাসের প্রকরণ বিশ্লেষণে প্রয়োগ করলেন। ডস্টয়েভস্কির আখ্যান-প্রকরণের লক্ষণীয় অভিনবত্ব থেকে নন্দনসূত্র আবিষ্কার করতে গিয়ে বাখতিন নতুন একটি পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন: ‘বহুস্বরসঙ্গতি’ (polyphony)। সমস্ত প্রতিবেদনের বহুস্বরিকতা সম্পর্কে ডস্টয়েভস্কির তীক্ষ্ণ সচেতনতা পর্যবেক্ষণ করেই তিনি এই পরিভাষার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভব করেন। তিনি জানিয়েছেন, ডস্টয়েভস্কি চিত্রিত পাত্র-পাত্রীর প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি চিত্তা অন্তর্বৃতভাবে দ্বিবাচনিক, নানা ধরনের বাচনে তারা অভ্যস্ত, তাদের অস্তিত্ব সংঘর্ষে পূর্ণ। মনে হয় যেন লেখক উপন্যাসশিল্পের নিজস্ব ভাষায় চেতনার সমাজতন্ত্র নির্মাণ করেছেন। বিশেষভাবে তাঁর প্রধান চরিত্রেরা অসমাপ্য দিবাচনিক প্রক্রিয়ার শরিক হয়ে বিষয় ও আঙ্গিকের অবিচ্ছেদ্যতাকে প্রমাণ করেছে। সেই সঙ্গে উপন্যাসের অনেকান্তিকতা কোনো ধরনের বদ্ধ সমাপ্তির অসম্ভাব্যতাকেও দেখিয়ে দিচ্ছে।
একদিকে দ্বিবাচনিক মুক্ত সমাপ্তি আর অন্যদিকে চেতনার ভাবাদর্শগত ভিত্তি: এই দুটি দিক বাখতিন লক্ষ করেছেন ডস্টয়েভস্কির উপন্যাসে। তাঁর মতে, এই মহান লেখকের প্রতিটি চরিত্রের শেকড় ভাবাদর্শে প্রোথিত; তাদের বিশ্ববীক্ষা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অভিন্ন। ঐসব চরিত্রের সামাজিক বীক্ষণে জীবনের নিভৃত মুহূর্তও স্পন্দিত হয়েছে। আসলে ডস্টয়েভস্কি তাঁর যুগের মধ্যে নিহিত দেখেছেন বিভিন্ন ভাবাদর্শবাহী উচ্চারণের আবেগত সংঘর্ষ। লক্ষ করেছেন বিপুল দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ার ছায়ায় সমকালের সমস্ত পরিসর আকীর্ণ। ব্যক্তি ও সমাজের পার্থক্য এবং সমান্তরালতা জনিত মিথস্ক্রিয়ায়—‘he heard both the land, recognised reigning voices of the epoch, that is, the reigning dominant ideas (official and unofficial), as well as voices still weak, ideas not yet fully emerged, latent ideas heard as yet by no one but himself, and ideas which just beginning to ripen, embryos of future world-views.’ (১৯৮৪: ৯০)। এখানে যেমন ‘বহুস্বরসঙ্গতি’ আর বিভিন্ন স্বরের দ্বিবাচনিক সংঘর্ষ বিষয়ক ধারণাকে ব্যবহার করে উপন্যাস-আলোচনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন বাখতিন, তেমনি ‘Discourse in the Novel’ নামক পরবর্তী বিখ্যাত নিবন্ধে তিনি আরো কিছু নতুন তত্ত্ববীজ উত্থাপন করেছেন। এই রচনাটিকে আমরা ভাষা ও চেতনা বিষয়ে বাখতিনের অন্যতম মুখ্য সন্দর্ভ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এখানে তিনি বলেছেন, পরস্পর-বিরোধী ও ভিন্নভিন্ন কণ্ঠস্বরের মিথষ্ক্রিয়া সৃজনী উদ্যোগের উৎস। যদি কোনো উপলব্ধি বিশুদ্ধ গ্রহীতার কাছেও নিষ্ক্রিয় থেকে যায়, তা বাচনকে নতুন কিছু দিতে পারে না। সামাজিক বিন্যাসের ব্যক্ত স্বরে পরস্পরভিন্ন উপকরণের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলেছে, এই নিবন্ধ সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বস্তুত উপন্যাসের প্রতিবেদনে দুটি সমান্তরাল শক্তির সংঘর্ষ নানা অনুষঙ্গে প্রকাশিত হয়ে থাকে বলে অনবরত বিচ্ছুরিত হচ্ছে নানা অর্থের দ্যোতনা। এভাবে এই নিবন্ধে বাখতিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ করেছেন—‘heteroglossia’ বা অনেকার্থদ্যোতনা। পাম মোরিস একে বর্ণনা করেছেন সেই শক্তি হিসেবে যা ‘stratifies and fragments Ideological thought into multiple views of the world’ (১৯১৪: ১৫)। তার মতে, এ হলো ভাষাকে ‘ideologically saturated and stratified’ বলে পর্যবেক্ষণের বিশেষ ধরন। অর্থাৎ ঐ অনেকার্থদ্যোতনার মধ্য দিয়ে আমরা উপন্যাসের ভাষাকে চিনতে পারি সামাজিক সংবেদনার বিশ্বস্ত প্রকাশ হিসেবে।
বহুমুখী সামাজিক অন্তর্বয়নে গড়ে ওঠে প্রতিবেদনের অনেকার্থদ্যোতনা; স্বভাবত তাদের মধ্যে ভাবাদর্শের বিচ্ছুরণও অনিবার্য। কোনো-একটি নির্দিষ্ট সামাজিক বাচন থেকে একান্তিক সত্য কখনো প্রবল হয়ে ওঠে না উপন্যাসে কারণ অপর সব বিশ্ববীক্ষার উপস্থিতিতে প্রতিটি একক স্বরন্যাস আপেক্ষিক সম্পর্কসূত্রে জড়িত। এই পর্যায়ে বাখতিন আবার ফিরিয়ে এনেছেন দ্বিস্বরিক সন্দর্ভের প্রসঙ্গ। অনেকার্থদ্যোতনার পরিসরেও সক্রিয় থাকে আধিপত্যবিরোধী প্রতিবাচন; জেগে ওঠে কার্নিভাল। হাসি ও ব্যঙ্গ হয়ে ওঠে তখন মুক্তিকামী শক্তির প্রতীক। প্রতিবেদনে সামূহিক প্রতাপের সমস্ত সংকেতকে অন্তর্ঘাত করে ঐ কার্নিভাল। মনে রাখা প্রয়োজন, বাখতিনের তত্ত্ববিশ্বে গুরুত্বের দিক দিয়ে দ্বিবাচনিকতার পরেই কার্নিভালের স্থান। Rabelais and His world বইতে বাখতিন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তির সংঘর্ষের পটভূমিতে যখন রাবেলেকে উপস্থাপিত করেছিলেন, সেসময় তাঁর কাছে সরকারি মধ্যযুগ ও লোকায়ত সংস্কৃতির মৌলিক দ্বন্দ্ব বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী লোকায়ত মনন ‘কানির্ভাল চেতনা’র মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল, এই হলো বাখতিনের বক্তব্য। তার মানে, এখানেও চেতনার দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে দ্বিবাচনিক সংঘর্ষ। একদিকে মধ্যযুগীয় প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি অপরিবর্তনীয় জগৎ-বিধির স্থবির অচলায়তনকে চাপিয়ে দিতে চাইছে, অন্যদিকে কার্নিভাল চেতনা দাঁড়াচ্ছে গতি ও পরিবর্তনের চলিষ্ণুতার পক্ষে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাখতিন অনির্দেশ্য কোনো নৈরাজ্যবাদী শক্তিকে ভাষায় উদ্বোধিত করতে চেয়েছেন। বরং তিনি কার্নিভালকে দেখাতে চেয়েছেন তাৎপর্য-প্রতীতির জটিল পদ্ধতি হিসেবে। এটা কিন্তু সাহিত্যের প্রকরণ থেকে উদ্ভূত নয়; বহু শতাব্দী ধরে সঞ্চিত লোক-ঐতিহ্য (যেমন লোক-উৎসব, কথকতা, গাথানাট্য, গোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান ইত্যাদি) থেকে আহৃত উপকরণের সংশ্লেষণে অর্জিত প্রতীকী অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকরণ এর উৎসভূমি। এছাড়া আঞ্চলিক জনজীবনে প্রচলিত ব্যঙ্গ-পরিহাসময় আখ্যান থেকেও কার্নিভালের প্রতীতি হতে পারে। বাখতিন বিশেষভাবে তিনটে প্রাচীন প্রকরণের উল্লেখ করেছেন যাদের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন কার্নিভাল চেতনা ও দ্বিবাচনিকতার উৎস। সাহিত্যে যে-সমস্ত ধূর্ত, বিদূষক, শঠ চরিত্রদের দেখা যায়-তাদের প্রেরণা কার্নিভাল চেতনা। বাখতিনের মতে এই ঐতিহ্যই ঔপন্যাসিক প্রতিবেদনের পূর্বসূরি। লোকায়ত আঙ্গিকের মধ্যে হাস্যরস সক্রিয় ছিল মুক্তিদাতা শক্তি হিসেবে: ‘they feed con sciousness from the power of the direct word, destroyed the thick walls that had imprisoned consciousness within its own discourse.’ (১৯৮১: ৬০)। উপন্যাসে যখন অন্তর্বয়ন হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে কার্নিভাল, প্রশস্ততর হয়। দ্বিবাচনিকতার ক্ষেত্র।
এই পর্যায়ে ‘ক্রনোটোপ’ নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ববীজের অবতারণা করেছেন বাখতিন। এই পারিভাষিক শব্দটির মানে হলো সময় ও পরিসরের পর্যায়ক্রম। শিল্পী মানুষের জীবনকে সর্বদা জগতের নির্দিষ্ট পরিসরে ও সময়ে যথাপ্রাপ্ত অবস্থানে পর্যবেক্ষণ করেন। উপন্যাসের প্রতিবেদনে নায়ক নায়িকা অনৈতিহাসিক নয় কখনো, তেমনি নয় অসামাজিক বা সময়নিরপেক্ষ। মানবিক অস্তিত্বকে ইতিহাসের পরিসরে ও কালের মাত্রায় দেখানোর দায়িত্ব নেয় উপন্যাস। বাখতিন মনে করেন, উপন্যাস প্রকরণের ক্রমবিকাশ প্রধানত হচ্ছে ‘a chronotopic understanding of the human being as satu rated in historical existence.’ (মোরিস: ১৯৯৪: ১৯)। ‘Epic and Novel’ নামক নিবন্ধে বাখতিন কার্নিভাল-চেতনা ও ক্রনোটোপের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। মহাকাব্যের দুর্ভেদ্য জগৎ বদ্ধ উপসংহারে বিন্যস্ত কেননা তা সমসাময়িক বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন চূড়ান্ত অতীতে গ্রথিত; অন্যদিকে উপন্যাসের জগৎ বিকাশমান আর অসমাপ্ত। যেন উতরোল পরিহাসের মধ্য দিয়ে তা বর্তমানকে কেবলই পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিশ্লেষণ করে চলেছে (১৯৮১: ১৭)। ইতিহাসের সন্দর্ভে প্রধান উচ্চারণ হিসেবে যা কিছু একান্তিকভাবে মান্য ছিল বহুদিন, তাকেই দূরীকৃত অপর হিসেবে পরিচিত কার্নিভাল বদলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়া তাই সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তার কিংবা গভীরতার অভিযাত্রায় অনস্বীকার্য।
আশ্চর্য এক জীবন পেয়েছিলেন বাখতিন। ইতিহাসের এত বাঁক-ফেরা একই জীবনে দেখা ও বোঝার সুযোগ বড়ো একটা পাওয়া যায় না। তত্ত্ব ও জীবন তাঁর কাছে তাই হয়ে উঠেছিল অনেকার্থদ্যোতনার দুটি ভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি। জীবনানন্দের ভাষা অনুসরণ করে বলা যায়, একই জিনিসের দু’রকম উৎসারণ। তাঁর জীবনব্যাপী অর্জিত উচ্চারণ-সমবায় থেকে কোনো-একটি বিশেষ বিন্দুকে বেশি গ্রাহ্য বা বেশি উজ্জ্বল বলে গুরুত্ব দেওয়াটা সমীচীন নয়। তাঁর মৃত্যুতেও চূড়ান্ত মীমাংসা হলো না কেননা সমাপ্তি বলে তো কিছু নেই সত্যসন্ধানের ক্ষেত্রে। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, সমস্ত সমাপ্তি আসলে আপাত-সমাপ্তি। দ্বিবাচনিকতার প্রেক্ষিতে সীমা নেই কোনো। এই মুহূর্তে যদি কিছু বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়ও কোনো-এক উদ্ভাসিত ভবিষ্যতে স্মৃতিগ্রথিত হয়ে ফিরে আসবে তাও। পুনর্মূল্যায়ন অব্যাহত থাকবে মুহূর্ত-পরম্পরার জীবনে। অনিশ্চিত এই আধুনিকোত্তর সময়পর্বে এখানেই বাখতিনের চিন্তাবৃত্তের প্রাসঙ্গিকতা।