বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/শিল্পের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার ভালমন্দ


শিল্পের ক্রিয়া প্রক্রিয়ার ভাল মন্দ

 কথা বলা আর কথা শোনা, ভাত রাঁধা আর ভাত খাওয়া, বাসা বাঁধা আর বাসা ভাড়া নেওয়া, গাড়ী চালানো আর গাড়ী চড়া, ছবি দেখা ও ছবি লেখা,—একদিকে রইলো সামগ্রীটার উপভোগ, আর একদিকে রইল ভোগ করবার বস্তুটির প্রস্তুতকরণের নানা প্রকরণ। প্রকরণের সঙ্গে আর্টিষ্টের যোগ, আর যা’ করা হ’ল তার উপভোগের সঙ্গে যোগ হ’ল দর্শকের শ্রোতার এককথায় ভোক্তার। এ যেন একজন নানা উপায়ে উপচারে নৈবেদ্য সাজিয়ে ধরছে, আর একজন সেটা রয়ে' বসে’ ভোগ করে চলেছে—মালী যেন ফুল ফুটিয়ে ধরছে বাগানের মালিকের সামনে। মালাকর মালা গেঁথেই চল্লো—পরের সঙ্গে অপরের মিলনের মালা; গাঁথনীর কৌশল ফুলের পাশে ফুলকে ধরার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে আনন্দ সেইটুকু পেলে মালাকর, আর যারা দুজনে সেই মালায় একের পাশে আরেকে চিরকালের মত ধরা পড়ে' গেল তারা পেল আরেক জিনিস। যা নিজের মালিনীকে পরানো চল্লো না, নিজের ঘরেও ধরে রাখা চল্লো না—পরের জন্যই যার সবখানি এমন যে মালা সে মালা সুকৌশলে গেঁথে চলার কায নিয়ে মালাকর কেমন করে' দিন কাটায় যদি না গাঁথনী করে' চলার মধ্যেই মালাকরের সকল আনন্দ লুকোনো থাকে? যারা আর্টিষ্ট, প্রকরণের সফলতা লাভের তপস্যা তাদের করতেই হয়। কিন্তু এই তপস্যায় যদি কেবলি কঠোর তপ থাকতো অথচ সঙ্গে সঙ্গে কার্য করার আনন্দ না থাকতো, তবে যেমন তেমন করেই কায সারতে চাইতো সবাই, আর তাদের কাযগুলো কলে প্রস্তুত জিনিসের মতো কায দিতো কিন্তু আনন্দ দিতো না। নিয়ম ও প্রকরণ এবং তার কঠোরতাই ফোটে নির্মমভাবে কলের কাযে, আর মানুষের আর্টে অনিয়ন্ত্রিত আনন্দ ও মুক্তির স্বাদ এসে লাগে। আর্টের প্রকরণগুলোতে আনন্দ না মিশলে আর্ট হ’ত ফটোগ্রাফের মতন অসম্পূর্ণ জিনিস। “There is fascination in the technical side of art without which artists would stop short so soon as the excitement he experienced on first tackling his subject has subsided, and our picture galleries would be full of sketches.”

 ছবির বেলাতে যে কথা কবির বেলাতেও ঐ কথা, গায়ক বাদক পাচক চালক নর্তক সবার বেলাতেই এই একই কথা। হাত উঠছে পড়ছে—ঠিক রঙএ ঠিক রঙ মিলিয়ে তালে তালে—এতে একটা আনন্দ বোধ করে শরীর ও মন আর্টিষ্টের। নেচে যে আনন্দ বোধ করে না সে নাচতেই পারে না ভাল করে’। মন চল্লো দুলে শরীর চল্লো তালে তালে, শরীর-মনের এই যে আনন্দের মিলন এই হ’ল আর্টের প্রকরণের চরম সাধনা। Sketch যেমন সম্পূর্ণ ছবি নয়, নিরানন্দ প্রকরণও তেমনি পরিপূর্ণ নয় অসম্পূর্ণ। Sketch যেখানে খসড়া মাত্র দিয়ে খালাস সেখানে তার মধ্যে শুধু তাড়া থাকে, একটা দৃশ্য কি একটি জিনিস তাড়াতাড়ি কাগজে উঠিয়ে কিম্বা বলে' দিয়েই খালাস। এই ভাবের sketchগুলি স্কুলে ছেলের নোট বই যে কায দেয় ঠিক সেই কাজই দেয়। এই sketch আর্টিষ্টের কাযে লাগে ব্যাপারটা শুধু মনে পড়িয়ে দিতে; ফটোগ্রাফও অনেক সময় এ কার্যটা সহজে সম্পন্ন করে কিন্তু যে sketch করার মধ্যে আর্টিষ্টের আনন্দ ধরা থাকে তার ধরন স্বতন্ত্র। ছোট গল্পের মত ছোট ও সামান্য হ’লেও সেটা সম্পূর্ণ জিনিস এবং সেটা লিখতে অনেকখানি art চাই। ছোট হ’লেই ছোট গল্প হয় না, একটুখানি টান দিয়ে অনেকখানি বলা বা বেশ করে কিছু ফলিয়ে বলার কৌশল শক্ত ব্যাপার। আর্টিষ্ট কেন সে শ্রম স্বীকার করতে চায় তার একমাত্র কারণ বলবার এই যে, নানা কারিগরি—তাতে আনন্দ আছে। ফস্ করে' বলা হ’য়ে গেল, যেমন তেমন করে' বলা হ’য়ে গেল, এতে আর্টিষ্টের আনন্দ নেই। মৃগয়া করতে গিয়ে যদি মৃগ এসে আপনিই ধরা দিলে তো শিকারীর আনন্দ একটুও হ’লনা; যারা সঙ্গের সাধারণ লোক তারাই বিনা পরিশ্রমে পড়ে' পাওয়া মৃগমাংস পেট ভরে' খেয়ে আনন্দ করলে। শিকারী তেমন জিনিস পরিবেশন করে সুখ পায় না যা বিনা ফাঁদে ধরা হ’ল। সঙ্গীতের চিত্রের কাব্যের সব শিল্পেরই প্রকরণের দিকটায় খাটুনী আছে—ভাব ও রসকে ফাঁদে ধরার ছাঁদে বাঁধার খাটুনী। কিন্তু সে কলের মত খাটুনী নয়, কলের কুলীর মত নিরানন্দ খাটুনী নয়। শিশু লালন-পালনের মধ্যে দুঃখ ও খাটুনীর দিক একটা আছে কিন্তু সেই খাটুনীতেই আনন্দ। যতনের খাটুনী অযতনের খাটুনী দুয়ের ফল তফাৎ, মায়ের খাটুনী আর ধাইয়ের খাটুনীর মধ্যে ভারী প্রভেদ দেখা যায়। শিল্প সামগ্রী গঠনের উপর খাটা কি ভাবে হ'ল তার ছাপ পড়ে। যেখানে আর্টিষ্ট যতন দিয়ে গড়লে, সেটি যতনের জিনিস হয়ে প্রকাশ পেল। আর যেখানে সে যতন নিলে না গড়তে, শুধু খেটেখুটে কায উদ্ধার করলে সেখানে গড়নটাও বিশ্রী হয়ে রইল। সেদিন দেখলেম আমার নাতনীটি একটি গুটি থেকে প্রজাপতি ফোটানোর প্রথা প্রকরণ না জেনেই একটা অসম্পূর্ণ ডানাভাঙ্গা প্রজাপতি টেনে এনেছে অসময়ে আলোতে। কাঁচা হাতের তাড়াতাড়ি লেখার মত সেটা ভয়ঙ্কর বিশ্রী দেখতে হ’ল। তারপরে সেদিন শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখলেম কত যত্নে কত পরিশ্রমে সৃষ্টি করা পাখীর ডিম বিনা পাখীতে ফোটাবার কল। পক্ষী-মাতার বুকের পরশ, অদ্ভুত ধীরতা, বুদ্ধি এবং অভিনিবেশ সহকারে দিনের পর দিন ধারণার মধ্যে নিয়ে তবে এই কল গড়া হয়েছে। পাখী নিজে যে আনন্দ বোধ করে বাচ্চা ফোটানোর কাযে, সেই আনন্দ সেই যতন দিয়ে গড়েছে মানুষ তার কল, শত শত পক্ষী-শিশুর উপরে ঢেলে দিয়েছে লোহার কল আপনার প্রকাণ্ড স্নেহ। এই কল গড়তে বা গড়বার প্রকরণে যদি কোথাও ভুল থাকতো, কিম্বা শিল্পী আগুনে যেমন তেমন করে' কলটা গড়ে ফেলতো, তবে মায়ের মতো বাচ্চ। না ফুটিয়ে রাক্ষসীর মত কলটা কেবলই ডিম খেতো, একটিও বাচ্চ। ফিরিয়ে দিতো না মানুষকে, কিম্বা ফেরাতো ভাঙ্গা আধপোড়া অসম্পূর্ণ অবস্থায়। যা' কিছু সৃষ্টি কর তার প্রক্রিয়ার মূলে এই যতন না হ’লে কায ব্যর্থ হয়ে যায়, স্মৃষ্টি অসম্পূর্ণ থাকে অশোভন হয়, অচল হয়।

 লাইন টানার প্রকরণ, রং দেবার প্রকরণ ইত্যাদি ভাল না হ’লে সামগ্রীটা যেমন নজরে ধরে না তেমনি সেই লাইন টানার রঙ দেওয়ার সময়ে হাত এবং মনের কোথাও একটু অযতন ঘটলে করা ঠিক মতো হয় ন, মন থেকে মনের কাযটাও পৌছোয়না। ভোঁতা তীর মচকানো ধনুক নিয়ে কে কবে লক্ষ্যভেদ করেছে, অযতনে গাণ্ডীব টেনেও কেউ লড়াই জেতেনি। “Craft is only a means, but the artist who neglects it will never attain his end.——— Such an artist would be like a horseman, who forgets to give oats to his horse.”(—Rodin). যে ঘোড়ার যতন জানে তার হাতে দেখতে দেখতে ছেকড়া গাড়ীর ঘোড়াও সুন্দর হ’য়ে ওঠে, যে মালী গাছে যতন দেয় তার মরা গাছেও ফুল ফোটে। ঘরের যে যতন নেয় না লক্ষ্মীশ্রী তার ঘর থেকে পালায়।

 ভাল করবার, ভাল লেখবার, ভাল আঁকবার, ভাল গড়বার প্রকরণ যে যতন দিয়ে ধরে সেই যথার্থ ভাল গড়ে, আর কলের মতো সে নিখুঁত প্রক্রিয়া দখল করে' চলে। সে চলে ঠিক সেইভাবে যে ভাবে কলের পুতুল নেচে চলে। একদিকে শুকনো প্রকরণ, আর একদিকে যতনমাখা প্রকরণ, শিল্পীর technique এর এই দুটো দিক—নীরস দিক আর সরস দিক। নুড়ির আগাগোড়া নীরস—যতই তার মধ্যে প্রবেশ কর, সে নুড়ি ছাড়া কিছু নয়। আর বাদাম তার খোলার মধ্যে শাঁস লুকোনো রয়েছে। ছেলে যখন বাদাম ভাঙতে আরম্ভ করে' তখন তার মনে বাদাম ভাঙার সঙ্গে বাদাম যে হস্তগত হ’তে চলেছে তার স্বাদ আর ভাঙার আনন্দটুকু থাকে। তাই সে বাদাম ভাঙার কঠিন প্রক্রিয়াতেও রস পায়। আক চিবোতে দাঁতের ব্যথা আছেই, কিন্তু চিবোনোর সঙ্গে সঙ্গেই রস পেতে থাকে মানুষ, কাযে-কাযেই দাঁত চিবিয়ে চলে আনন্দে। একোগুড় পেটুকেই খায়, আর আর্টিষ্টকেই রস পেতে হয় কায আর চলা থেকেই। যারা আর্ট আর্ট করে’ মসগুল অথচ আর্ট সৃষ্টি করে না, তারা পেটুকের মত প্রস্তুত গুড়টাই খেয়ে চলে। আর আর্ট যারা সৃষ্টি করে তারা হয়ত অনেক সময় গুড় খেতেও পায় না। কিন্তু ঐ আকমাড়া কলটা যত্নে ঘুরিয়েই স্ফূর্তি পায় ঠিক ঘোরাবার। শাল যে বুনছে সে বুনেই আনন্দ পাচ্ছে। হাতের ছুঁচ চালানোয় যতন আর আনন্দ, দিনের পর দিন চোখ ঠিকৃরে যাওয়া সূক্ষ্ম কারুকার্য ফুটিয়ে চলায় আনন্দ। এই আনন্দ যদি না তার থাকে, যদি এ শাল সে পরতে পাবে না এই দুঃখই কেবল তার মনে জাগে, যদি শাল বোনার প্রকরণের মধ্যে কষ্টটাই বাজে তার মনে আঙ্গুলে আর চোখে, তবে সে-আর্টিষ্টের হাতের শাল ঘোড়ার গায়ের কম্বলের চেয়ে কদর্য না হয়ে যায় না।

 ফরাসী দেশের প্রসিদ্ধ শিল্পী রোদাঁকে তাঁর ছাত্র প্রশ্ন করেছিলো —“Can an artist get along without technique?” তাতে শিল্পগুরু উত্তর দিলেন, “On the contrary, it is necessary to have consummate technique in order to hide what one knows.... The great difficulty and crown of art is to draw, to paint, to write with ease and simplicity.”(–Rodin.) এখানে কাযের সারল্য ও স্বতঃস্ফূর্তির কথা বলা হ’ল এবং এই দুই গুণ যাতে পৌছোয় কাযে সেই consummate technique বা পরিপূর্ণভাবে প্রকরণের দখলের কথা বলা হ’ল। প্রকরণের সার্থকতা তখনি যখন সেটা নিয়ে সহজভাবে আমরা কায করে' যাই, সেখানে প্রকরণ কাযের শ্রান্তি ব্যক্ত না করে’ স্ফূর্তিটাই দেখায়। কিরকম ছন্দ কসে' বাঁধা হ’ল, কত মাথা ঘামিয়ে গানের সুরটা এবং গানটা লেখায় ধরা হ’ল,—এইটেই যে লেখায় রইলো, বড় লেখা হ’লেও সেটা artistic হ’ল না; কেননা তার মধ্যে লেখার প্রকরণের শুকনো দিকটাই রয়েছে, আর যেখানে যতন এসে আনন্দ এসে প্রকরণের কঠোরতা কর্কশতা মিটিয়ে দিয়ে ভাবের এবং লাবণ্যের প্রসন্নতা প্রকাশ করলে সেখানে ছোট হ’লেও সেটি হ’ল আর্ট। প্রকরণে পূর্ণ অধিকার না হ’লে লেখায় বলায় চলায় কাযে কর্মে স্বতঃস্ফূর্তি গুণটি আসে না, অথচ এই গুণটি সমস্ত বড় শিল্পের একটা বিশেষ লক্ষণ। এত সহজে কেমন করে' আর্টিষ্ট যা বলবার যা দেখাবার তা প্রকাশ করে' গেল এইটেই প্রথম লক্ষ্য করে আমাদের মন বড় শিল্পীর কাযে। শিল্পী কি কঠিন প্রক্রিয়ায় রচনা করেছে তা তো রচনায় রেখে দেয় না, মুছে দিয়ে চলে যায় তার হিসাব, এবং এই কারণে ঠিক সেই কার্যটি নকল করতে চাইলে আমরা ঠকে যাই ঠেকে যাই, হদিস পাইনে কি কি উপায়ে কোন পথ ধরে গিয়ে শিল্পী তার পরশমণি আবিষ্কার করে' নিলে। সুতরাং বলতে হবে একজনের technique অন্যের অধিকারে কিছুতেই আসতে পারে না, সে চেষ্টা করাই ভুল, কেননা তাতে করে' চেষ্টা কাযের ওপরে আপনার সুস্পষ্ট ছাপ দিয়ে যায় এবং আর্টিষ্টের কাজে সেই ব্যর্থ চেষ্টার দুঃখটাই বর্তমান থেকে যায়। যে দেখে তাকে পর্যন্ত পীড়া দিতে থাকে।

 বাঁশী বীণা এ সব তৈরী করার প্রকরণ যেমন স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র, তেমনি এদের বাজানোর প্রকরণও আলাদা আলাদা। বাঁশীর ফুটো ছেড়ে ছেড়ে সুর বার করতে হয়, বীণাতে তারে তারে ঘা দিয়ে ঘাটের পর ঘাট চেপে সুর বার করতে হয়। সাতটা সুর তার ওপর এবং তার মাঝে মাঝে আঙ্গুল খেলিয়ে বেড়ালে। এই তো বাজনার প্রকরণ সামান্য রয়েছে এবং যন্ত্রে আর কণ্ঠে রাগ-রাগিণী ভাঁজবারও বাঁধা প্রকরণ আছে আমাদের— সেগুলো শিখলে সহজেই বাজিয়ে আর গাইয়ে দুই-ই হ'তে পারে মানুষ। নাচের বেলায় ছবিমূর্তি গড়ার বেলায় ঐ একই কথা। সুরের রঙ্গের অঙ্গভঙ্গির কতকগুলো প্রকরণ বাঁধা হয়ে গেছে,—বাঁধা রাস্তার মতো সেগুলো সাধারণের পক্ষে সাধারণভাবে চলাচলের বেশ কাজের পথ। কিন্তু এই বাঁধা রাস্তায় বাঁধা অবস্থাতেই যে চল্লো হাতের কায পায়ের কায গলার কায করে', সে বাঁধন আর বাঁধনের বেদনাটাই প্রকাশ করে' চল্লো কাযে, সে তো কখন আপনাকে প্রকরণিক ছাড়া আর্টিষ্ট বলতে পারে না। প্রকরণের বাঁধন যে দরদ দিয়ে আনন্দ দিয়ে মুক্ত করলে সেই হ’ল গুণী; নীরস প্রকরণিকের সঙ্গে তার তফাৎ হ’ল ঐখানে। গুণী সে বাঁধনের কসন রসিয়ে তুল্লে, লসন পৌছে দিলে কসনে; নর্তকীর কোমরে মেখলার বেড় যেমন, তেমনি techniqueএর বাঁধন শোভা ধরলে আর্টিষ্টের গড়নটিকে ঘিরে ঘিরে। Techniqueএর এই যে সকল দিক যা নিয়ে মানুষের হাতের কাযে আর কলে-কাটা কলে-কোঁদা জিনিসে তফাৎ হচ্ছে, কিছু করতে যাবার পূর্বে এটার বিষয়ে যদি আমরা না ভাবি তবে art জিনিস আমাদের দ্বারা করা শক্ত হয়। হাতের কাগজ হাতের কাযে এমনি করে ছেড়ে দিলাম যে সেটি মনের জিনিস হ’য়ে রইলো, মুখের কথা সুরের বেদনায় এমন করে ভরে দিলাম যে তারা মন থেকে মনে চলাচলি করতে লাগলো, মন দুলিয়ে দিয়ে গেল। প্রত্যেক পা ফেলা এই রকম যখন হ’ল তখন জানলেম নানা শিল্পের নানা প্রকরণে সিদ্ধি লাভ করলেন আর্টিষ্ট। গাছ গাছই রইলো, ফুলও দিলে না ফলও দিলে না সে যেমন, আর্টের প্রকরণগুলো আয়ত্তের মধ্যে এসে গেল অথচ তা দিয়ে কিছু ফলানো গেল না বা কোন কিছুকে ফুলের মতে ফুটিয়ে তোলা গেল না; কেবল প্রকরণেরই প্রতিষ্ঠা করে গেলেম কাযে, এ হ’লে নিষ্ফলা গাছ প্রতিষ্ঠা করা হ’ল।

 প্রকরণের সফলতা তখনই যখন সে কিছুর জননী হ’ল, না হ’লে সে সুন্দরী কিন্তু বন্ধ্যা। রসের জনয়িতা আর্ট, সেই আর্ট-সৃষ্টির প্রকরণ নীরস নিরানন্দভাবে গ্রহণ ও প্রয়োগ যে করলে তার সৃষ্টির প্রয়াস ব্যর্থ হ’ল; নিজের কাযে সে প্রয়াসকেই প্রতিষ্ঠিত করলে, প্রসন্নতাকে নয়,—এমন কায দেখে' মন কোনদিন প্রসন্ন হয় না।  আর্ট স্কুল থেকে যে একেবারেই আর্টিষ্ট বার হয় না তার কারণ আমি দেখেছি—সেখানে ছেলেগুলো খেটেই চলে বাঁধা নিয়মে, খেটে চলার আনন্দ বোধ করবার অবসর কেউ সেখানে দেয় না, কলের মতো হাত হ'য়ে ওঠে পাকা ছবি মূর্তি ইত্যাদি তৈরী করবার প্রকরণে কিন্তু মন থেকে যায় উপবাসী অপ্রসন্ন। বেশী দিন উপবাসে রাখলে পেটের খিদে মরে যায়; বত্রিশ পাটি দাঁত চিবোতে পাকা হয়ে উঠলে, কিন্তু খিদে মরে গেল, এই দুর্ঘটনা ঘটছে আর্ট স্কুলের শতকরা নিরানব্বইটা ছাত্রের। সবাই বার হয় প্রকরণিক হ’য়ে, কচিৎ কেউ সেখান থেকে আসে আর্টিষ্ট হয়ে। মন নেই কাজ করে' চলেছে হাত কলের মত, সে কায দেখে তারি মন খুসী হয় যে ফুলকে ফোটায়নি ফুটতে দেখেনি এবং যার বুকে রস ফোটেনি কোনদিন।

 গড়া হ’য়ে গেলে হাতের কায তো আর্টিষ্টের হাতে থাকে না। অন্যে নিয়ে সেটা উপভোগ করে। আর্টিষ্ট যে জনয়িতা নিজের জনিত আর্ট ভোগ করা তার ধর্ম নয়, তার সৃষ্টি করার প্রকরণের মধ্যে যেটুকু আনন্দ সেই টুকুই আর্টিষ্টের প্রাপ্য, কাযের আরম্ভ থেকে শেষ এইটুকুর মধ্যে তার সমস্তটুকু নিঃশেষ করে' পায় আর্টিষ্ট; সৃষ্টি করা শেষ যেমনি হ’ল অমনি কাযটির সঙ্গে আর্টিষ্টের হাতে কলমে যোগ বিচ্ছিন্ন হ’ল। আর্টিষ্ট এসে পড়ল দর্শকের জায়গায়, সবার পাশে সেও দাঁড়িয়ে চেয়ে দেখলে আপনার কাযের দিকে, অন্যে সেটা নিয়ে গেল কি ফেলে গেল তা দেখবার অপেক্ষা নেই, আর্টিষ্ট সে ফিরে এল নতুন একটা কাযের প্রক্রিয়ার মধ্যে। এই তো হ’ল আর্টিষ্টের প্রতি পলের জীবন—সে শুধু বাঁচে তার কায করে’, চলার মধ্যে যে আনন্দ তাই নিয়ে, আনন্দের সেই এক মুহূর্তে তারি ছাপ পড়ে তার কাযে কর্মে সবদিক দিয়ে, তার সৃষ্টি ছন্দ পায় ছাঁচ পায় ঐ এক বিন্দু আনন্দের কোলে। কলের নাগরদোলায় ছেলেগুলো দুলছে আর মায়ের কোলে ছেলে দুলছে,—এ দুই-ই তো দেখেছি। কল সে দুলিয়ে আনন্দ পাচ্ছে না, কাযেই সে কোঁচ কোঁচ শব্দে জানিয়েই চলেছে সে কথা, আর মায়ে দোলা দিচ্ছে দিনের পর দিন রাতের পর রাত, তাতেও ত দুঃখ রয়েছে কিন্তু বেসুর কোথাও তো নেই। মা গাইছে “আমার ছেলে আমার কোলে, গাছের পাখী গাছে দোলে”, দোলাবার শ্রম সেখানে প্রতিমুহূর্তে সুরে ভরছে, মিটিয়ে দিচ্ছে দুঃখ দোলা দেবার আনন্দহিল্লোল। কলের দোলা সে তো পাত্র বাছে না, তোমাকে আমাকে ছেলেকে বুড়োকে সমানভাবে দুলিয়ে চলে ঝাঁকানি দিয়ে বেসুরে চেঁচিয়ে কিন্তু মায়ের কোলে ছেলের দোলা সে মায়ে মায়ে বিভিন্ন প্রকারের হ’লেও সবার মধ্যে সুর বাজে ব্যথা বাজে না, কাজেই এ রকম দোলানো ক্রিয়ার মধ্যে আনন্দ আছে বলেই সেটাতে ছেলে এবং মা দুজনেই আনন্দ পায়। ছেলের ওজনের একখানা কাঠ কোন মায়ের হাতে দিয়ে তাকে দোলাতে বল—কিছুক্ষণ পরে মায়ের হাত ভেরে যাবে কেননা ছেলে দোলানোর প্রক্রিয়ায় যে আনন্দ কাঠ দোলানোতে সেটি নেই। ছোট মেয়ে কাঠের পুতুল দোলাচ্ছে, সে জানছে কাঠের ছেলেকে ঠিক আপনার ছেলে বলেই, সেলেটখানা দোলাতে দাও সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। হাতুড়ি পেটানোর আনন্দ তখনই পাই যখন পিটে' যে কাযটি করছি সেই কায সম্পূর্ণভাবে মন অধিকার করেছে এবং হাতুড়ি পেটার প্রকরণ সম্পূর্ণভাবে অধিকারে এসেছে আমার। এ না হ’লে কাযে মন কিন্তু হাতে এল না সেটা, কিম্বা হাত পিটেই চল্লো কাজে বসলো না মন,—দুদিক দিয়েই কাযটা ব্যর্থ হয়ে চল্লো। নল রাজার হাতে রথ যেমন চলতো তার ত বর্ণনা পড়েছি এবং সেই ঘোড়া সেই রাশ সেই গাড়ী ছক্কর গাড়ীর কোচম্যানের হাতে কি ভাবে চলে তারও প্রমাণ আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেরই সামনে ধরা আছে। যে গাড়ী হাঁকিয়ে আনন্দ পাচ্ছে এবং যে কোন রকমে সোয়ারি যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে কড়ায় গণ্ডায় ভাড়। চুকিয়ে পেয়েই আনন্দ পাচ্ছে, এই দুয়ের রাশটানার প্রক্রিয়ায় কতখানি তফাৎ তা বেশ বুঝি আমরা। একের স্ফূর্তি রাশের মধ্য দিয়ে ঘোড়াতে পৌঁছোচ্চে, ঘোড়া সুন্দরভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে নেচে চলেছে, আর একের হাতের রাশে ত্বরা পৌঁছোচ্চে, কিন্তু ঘোড়া আর একটুও পাচ্ছে না খুঁড়িয়ে চলেছে কিম্বা চাবুকের চোটে বিশ্রী রকম বেগে দৌড়োচ্ছে ঝাঁকানি দিতে দিতে। যে প্রকরণ সম্পূর্ণ কায়দা না হ’লে কেউ আর্টিষ্ট হ’তে পারে না সেটি হচ্ছে আকার গড়বার বা বলবার করবার সামান্য প্রকরণ নয় সেটি হচ্ছে আনন্দের সঙ্গে কর্ম সাধনের অসামান্য-প্রকরণ।

 অনেকের বিশ্বাস যে মূর্তি গড়বার ছবি লেখবার শাস্ত্রীয় প্রকরণগুলি শিখিয়ে দিতে পারলেই দেশে নানা দিক দিয়ে গানের আর্টিষ্ট মূর্তিমান হয়ে এসে উপস্থিত হবে আমাদের মধ্যে শিল্পের মধ্যে। খেয়াল বলে’ সখ বলে’ জিনিসটাকে বাদ দিয়ে প্রাচীন শিল্পের শাস্ত্রকথিত রূপটার সঙ্গে মান-পরিমাণ ইত্যাদি দিয়ে যুক্ত হওয়াকেই তারা ভাবে আর্ট পুনরায় দেশের মধ্যে ধরে' আনার পন্থা। এই ভাবে অধিগত যেটা হবে সেটা শিল্প হবে না গত শিল্পের প্রাণশূন্য ভাণ হবে মাত্র, তা' তারা বোঝে না। শিল্প এবং তার নিয়ম-প্রকরণ ইত্যাদির সঙ্গে শিল্পীর সখ ও খেয়ালের কতখানি যোগ তা তারা কেমন করে' বুঝবে যারা' শিল্প করে না শিল্পশাস্ত্রই পড়ে মাত্র অভিধান ব্যাকরণ ভাষা পরিভাষা ইতিহাস ভূগোল ইত্যাদি যে ভাবে পড়ে ছাত্ররা,—তাই এরা ভাবে বুঝি ঐ রাস্তা ধরে' চল্লেই ঠিক জায়গায় পৌছে যাবে দেশের শিল্প, এবং সেটা সঙ্করত্ব পরিহার করে' একেবারে বিশুদ্ধ অবস্থায় আমাদের ঠাকুর-ঘরে এসে বসবে। সামান্য একটা কিছু যে গড়তে চেষ্টা করেছে কিম্বা জগতের শিল্পের ইতিহাসে যার একটুমাত্র দখল জন্মেছে সেই বলবে, খেয়াল ও খেয়ালী এরাই হচ্ছে শিল্পের এবং নব নব প্রকরণের জন্মদাতা,–শাস্ত্র নয় শাস্ত্রবাগীশও নয়। যার সখ রইলো তার কাছে শিল্প শিল্প-প্রকরণ সব রইলো, আর যার সখ রইলো না তার কাছে শিল্প রইল না শুধু প্রক্রিয়া শাস্ত্রের বচন ইত্যাদি রইল। কাযেই দেশের শিল্পকে পালনের ভার খেয়ালীর হাতে দিলে তত ভয় নেই যত ভয় খেয়াল যার নেই এমন প্রকরণিক ও শাস্ত্রজ্ঞের হাতে খেয়া-নৌকার হালখানা পড়লে। খেয়ালীদের হাতে পড়ে' ভারত-শিল্পের নিয়ম-প্রকরণিকদের মধ্যে ওলট-পালট ঘটে' ভারত-শিল্প ভারতীয় থাকবে না বিজাতীয় রকম কিছু একটা হয়ে উঠবে এটা সাধারণের কেউ কেউ ভাবছেন এবং সেইজন্য তাঁরা খেয়ালকে বাদ দিয়ে শাস্ত্র এবং তার শিক্ষার সঙ্গে শিল্পশিক্ষার্থীদের জুড়ে কি হয় দেখতে চাচ্ছেন। যথা, “ভারত শিল্পপদ্ধতির নামে শিল্প-সাঙ্কর্য্যের উদয় হইতেছে বলিয়া তাহার কৌলীন্য-রক্ষার জন্য চেষ্টা করা আবশ্যক... কিন্তু তাহাকে রক্ষা করিবার পথ বড়ই বন্ধুর” (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ভারতবর্ষ, ১০ম বর্ষ ২য় খণ্ড ৩য় সংখ্যা)।

 কৌলীন্যের পথ সত্যই বন্ধুর বটে; অল্পই প্রসার সে পথের, ছোট পথ সেটা, কৃত্রিম পথ, জল ধরে' রাখার কুণ্ড বা নালা সেটা, সেই পথে ভারত-শিল্পকে নিতে চাওয়া মানে কি তা জানিনে। খেয়ালমতো যে পথে চলবার কিছু জো নেই সে পথ কখনও কোন শিল্পের পথ হ’তে পারে না, কোন বড় জিনিস উৎকৃষ্ট পথ উদার পথ ছাড়া বন্ধুর পথে চলেনি সঙ্করতাকে ভয় করে’। সঙ্করত্বের ভয় করে’ হিন্দুশাস্ত্রমত ভারত-শিল্পের নিয়মে শিল্পীকে বদ্ধ করলে সঙ্করত্বের হাত থেকে বাঁচাতে পারি শিল্পকে কিন্তু বাঁধা প্রকরণের ভয়ঙ্করত্ব যখন শিল্পের সর্বাঙ্গে জরা আর মৃত্যুর লক্ষণগুলি ফুটিয়ে তুলবে তখন শিবেরও অসাধ্য তাকে শুধরে' রমণীয় করে' তোলা। আর্ট বিষয়ে খেয়ালীর কাছে যেতেই হবে নবযৌবন ভিক্ষা করে'। এর প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত রয়েছে;—আমাদের সঙ্গীতবিদ্যা প্রকরণসার হয়ে যে দশা পেয়েছে এখন তার সঙ্গে প্রাণের যোগ করে' দেওয়া তম্বুর ঋষিরও কর্ম নয়। যদি কেউ সে কাজ করতে পারে তো সে বিদেশের খেয়ালী বা দেশেরই কোন খেয়ালী যার প্রাণে গানের সখ আছে এবং গানের ইতিহাস কছরত শেখার সখের চেয়ে গান গাইবার সখ যার বেশী। বিশ্বকর্মা একজন খেয়ালী তাই বিশ্বের জিনিস তিনি গড়ে’ উঠতে পারছেন এমন চমৎকার সুন্দর করে’—চামচিকে থেকে আরম্ভ করে জম্বুদ্বীপের এবং তারও বাইরের যা কিছু তা! বিশ্বকর্মা যদি শাস্ত্রের নিয়মপ্রকরণ মেনেই চলতেন তবে শুধু দেবমূর্তির কারিগর বলেই বলাতে পারতেন, বিশ্বকর্মা বলে' তাঁকে কোন আর্টিষ্ট পূজা দিত না। বিশ্বকর্মা হিন্দুশাস্ত্রের নির্দেশে বিশুদ্ধ গাছ বা তুলসীগাছেই যদি হাত পাকাতেন তবে কি ভয়ঙ্কর একঘেয়ে জগৎই তিনি বানিয়ে তুলতেন! এবং কবি ও রসিকদের তা হ’লে কি উপায় হ’ত— একটা গাছ দেখলেই সব গাছ দেখার আনন্দ এক নিমেষে চুকে যেত! একটা গাছ বারে বারে, একটি পাহাড় একটি নদী একই সমুদ্র বারে বারে পুনরাবৃত্তি হ’তে হ’তে চলতো আর তার মধ্যে একটি মাত্র মানুষ হয় পুরুষ নয় স্ত্রী নয় দেবতা নয় দেবী থাকতো এবং বর্ণসঙ্করতা আনার ভয়েই বিশ্বকর্মা আলো-ছায়ার মেলামেশায় সঙ্করত্ব দিয়ে দুই সন্ধ্যার রমণীয় ছবি ফোটাতে পারতেন না, হয় থাকতো চোখ-ঠিকরানো আগুনের তেজ নয় থাকতো ভীষণ অন্ধকার বিশ্বছবিটির উপর লেপা।

 শিল্পপদ্ধতির ও প্রকরণের সঙ্করত্ব বাঁচাতে গিয়ে শিল্পে যে ভয়ঙ্করত্বটি এসে পড়বে সেটা ঠেকাবার পরামর্শ শাস্ত্রকারেরা দিতে ভোলেননি। শিল্পীর হাত সব সময়ে শুদ্ধ এই কথা শাস্ত্র বলেছেন। শিল্পী দেবতাই গড়ুন আর বানরই গড়ুন বা দেবতাতে বানরে পাখীতে মানুষে মিলিয়ে খিচুড়িই প্রস্তুত করুন সে যদি শিল্পী হয়, যদি তার প্রকরণের সঙ্গে তার মনের আনন্দভাবের বিশুদ্ধি এ সব জুড়ে দিয়ে থাকে সে, তবে সে বিশুদ্ধ জিনিষই রয়ে গেল। পণ্ডিতের ব্যবস্থামতো গোবর গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে শাস্ত্রের মন্ত্র পড়ে' ধ্যান করে' গড়লেই বিশুদ্ধি আসে না, অন্তরের পূতধারা তারি স্রোত যখন শিল্পীর হাতের কায ধুয়ে দেয় তখনই সে হয় বিশুদ্ধ, ভারত-শিল্প বা আর কোন বিশুদ্ধ শিল্প। হিন্দু শিল্পশাস্ত্র মতে গড়া হলেই বিশুদ্ধ ভারত-শিল্প হবে একথা বলা চলতো যদি ভারতবর্ষ কেবল হিন্দুরই হ’ত—গ্রীক মোগল চীন নেপাল, কত কি নিয়ে যে ভারত-শিল্প হয়েছে তা কে জানে! সুতরাং ভারতবর্ষে যেমন একটি মাত্র ধর্ম নেই তেমনি ভারত-শিল্পে কৌলীন্য বলে' পদার্থ একেবারেই নেই। কেননা ভারতবর্ষ যেমন প্রকাণ্ড বিস্তার নিয়েছে সেই রকম তার আর্টও বিস্তার পেয়েছে শাস্ত্রগত পদ্ধতি ছেড়েই। কোন দেশের কোন শাস্ত্রের কৌলীন্যও তার নেই, সে সহজ নদীর মত সেকাল একাল সব কাল সব দেশ সব মানুষ সব মন সব সমাজের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে, গঙ্গাধারাকে যারা ছোট করে' দেখে তারাই কাশীর গঙ্গাকে কৌলীন্যে মণ্ডিত করে তুলতে চায় পুরাণের প্রমাণ-বলে, তারাই চায় শিল্প বাঁধা প্রকরণের মধ্যে থেকে পুষ্করতীর্থের কুণ্ডের তালের মত বিশুদ্ধ এবং সবুজ হয়ে বর্তমান থাকে চিরকাল। সে সবুজ যে কচি পাতার সজীব সবুজ নয় দূষিত তালের বিষাক্ত সবুজ সেটা ভুলে' যায় তারা।

 শাস্ত্রমতো আমাদের শিল্প কেমন হবে,—হিন্দু ভারত-শিল্প বা মোগল রাজপুত মারাঠা বাঙ্গালী ইঙ্গবঙ্গ হবে কিম্বা আর কিছু হবে, তা আমি জ্যোতির্বেত্তা নই যে ঠিক করে’ বলে’ দেবো; কিম্বা কোন্‌ রূপটা হ’লে ভাল হয় তাও আমার আজকের বলবার কথা নয়, বিষয় হচ্ছে প্রকরণের ব্যাপার নিয়ে। যার আর্টের খেয়াল নেই সে নিজের আর্ট বা অন্যের আর্টে প্রকরণ দখল করাতে যে শ্রম আছে তা নিতেই চায় না। প্রথম চাই খেয়াল বা সখ, তারপর লোক খুঁজে বা শাস্ত্র ঘেঁটে নানা প্রকরণের দখল এবং সবশেষে নিজের মনোমত করে প্রস্তুত করা সামগ্রী সমস্ত। এখানেও পুঁথি পড়ে' চলার চেয়ে হাতে হাতে কারিগরের কাছে এবং নিজে নিজে কাজ করতে করতে প্রকরণে যে জ্ঞান জন্মায় সেটা মূল্যবান। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র দেশী রঙএর যে বইখানা লিখেছেন সেই রকম আরো অনেকগুলো বই হ’লে ক্রমে সেগুলি হয়ত বর্ণশাস্ত্র হয়ে উঠবে। এবং সেই সব রঙ প্রস্তুতের প্রকরণ পাচ্ছেন তিনি কতক পুঁথি থেকে কতক বণিকদের কাছ থেকে। এখন আমাদের কাযে সেটা লাগছে, পরেও কাযে লাগবে, কিন্তু এই বই শাস্ত্র হয়ে ওঠবার পর আজ থেকে এক শত বৎসর পরের শিল্পী হয়ত দেখবে নতুন বর্ণ-বিধান, কিম্বা সে হয়ত নিজেই একটা নতুন বর্ণ আবিষ্কার করবে; সে সময় তাকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের লিখিত বর্ণশাস্ত্রের মধ্যেই থাকতে হবে, না হলে তার জাতিপাত, একথা কি কেউ বলবে, না বর্ণশাস্ত্রে বর্ণসঙ্করত্ব ঢোকাচ্ছে বলে’ তাকে দোষ দেবে? শাস্ত্রকে এভাবে প্রকরণ অর্জনের ব্যাঘাতজনক করে' তুলে' কি ফল তা আর্টিষ্ট আবিষ্কর্তা এবং যাঁরা আচার্য এবং শাস্ত্রকার তাঁরা বুঝবেন, শুধু বুঝবেন না তাঁরা যাঁরা শিল্পের একটা অদ্ভুত কৌলীন্য প্রকাশ করছে;—কাচের বোতলে ভরা ডিস্‌টিল্‌ড্‌ ওয়াটারের চেয়ে স্বচ্ছ সেই কৌলীন্য হলেও সেটা কতটা বড় জিনিষ তা বলতে পারিনে, কিন্তু সেটা বোতলের মধ্যে যাদুঘরের মরা টিকটিকির মতো বিশ্বের হাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে চিরকাল আপনার এতটুকু কৌলীন্যে ডুবে এটা যেন দেখতে পাচ্ছি।

 প্রকরণ চারদিক থেকে অর্জন করতে হয় আর্টিষ্টের তখন বাছবিচার নেই, শুধু সেই প্রকরণ প্রয়োগের সময় কোন্‌টা কিসে খাটবে তার বিচার। ভূ-দৃশ্য আঁকার প্রকরণ দেশীয় এবং শাস্ত্রীয় যে শিল্প তাতে নেই, এ প্রকরণ বিলেত থেকে আনতেই হবে। মানুষের চেহারা—সেখানেও অর্জন করা চাই আঁকার এই প্রকরণ। খালি দেবতা এঁকে ভারত-শিল্পের আভিজাত্য বজায় রেখে চল্লে মানুষ গরু গাছপালা এমন কি পৃথিবীটাই বাদ পড়ে যায়। ভারত-শিল্পের বিশেষত্বই এই এবং ভারতবর্ষেরও বিশেষত্ব সেই। কি সমাজ কি শিল্প কি উচ্চতর জ্ঞানবিজ্ঞান সবার প্রথা প্রকরণ অর্জনের বেলায় সে অকুলীন—একটুও ভয় পায়নি ভারত-শিল্প গ্রীসের স্পর্শে আসতে, অসভ্য পার্বত্যজাতির শিল্পের এমন কি অনার্য আদিম শিল্পেরও স্পর্শে আসতে। সব দিক দিয়ে সে অর্জন করেছে শিল্পপ্রকরণ সামাজিক ব্যবস্থা জীবন যাত্রার পদ্ধতি। হিন্দু ভারতবর্ষের চেয়ে যে বড় ভারতবর্ষ, হিন্দু ভারত-শিল্পের যে বড় ভারত-শিল্প, তাই গড়ে' তোলার প্রকরণ অর্জনের যে আনন্দ তারি মধ্যে ভারতবর্ষ এবং ভারত-শিল্পের মূল যুক্ত হয়েছে বলেই গ্রীস মরে' গেল, ইজিপ্ট চলে' গেল, চীন তার চিরাগত প্রথা প্রকরণের পাঁচিলে বদ্ধ হয়ে মৃতপ্রায় হয়ে রইল যখন তখনো ভারতবর্ষ ভারত-শিল্প ইত্যাদি তৈলকটাহে দশরথের মৃতদেহ যে ভাবে ছিল সে ভাবে রইলো না, সে নতুন থেকে নতুনতর অর্জনের মধ্যে চলে বলে' বেঁচে রইলো। যুগ-যুগান্তরের অর্জন প্রথা প্রকরণ তাকে চেপে মারতে পারলো না, সে আনন্দের সঙ্গে ভাঙতে লাগলো গড়তে লাগলো সৃষ্টির জিনিস। ভারত-সভ্যতার এই বড় দিক,–এই দিক দিয়েই ভারত-শিল্পের মর্যাদা ও মহিমা। যেখানে সখ মিটলো লোকের নতুন নতুন দেখবার নতুন নতুন অর্জন করে' আনবার, সেইখানেই মরলো দেশের আর্ট ও আর্টের নানা প্রকরণ। আবার নতুনে সখ যেখানে নতুনের জন্য একটা বিপরীত উন্মাদনাতে পরিণত হ’ল সেখানেও মরলো শিল্প। এই দুই দিক বুঝে যে খেয়ালী চলে সে-ই consummate technique লাভ করে, এবং আর্টের খোঁজে চলতে পারে সাহসে বুক বেঁধে, না হ’লে খানিক চলে' সে ভয়ে মরে,—হয় পালিয়ে আসে চিরকেলে ঘরটায়, নয় তো গিয়ে আশ্রয় নেয় পরের দ্বারে অধম ভিক্ষুকের মতো। আর্টিষ্ট হ’তে পারা যায় যা হ’লে তার মধ্যে শাস্ত্রজ্ঞান অর্জনটাই একমাত্র উপায় নয়, অনেকগুলো অর্জন চাই অনেক দিক দিয়ে তবেই হয় আর্টিষ্ট; এটা স্পষ্টই বলা হয়েছে অলঙ্কার শাস্ত্রে-শক্তিনিপুণতা লোকশাস্ত্রে কাব্যাদ বেক্ষণাৎ, কাব্যজ্ঞশিক্ষয়া অভ্যাস ইতি হেতুসমুদ্ভবে। প্রথমে চাই শক্তি আর্ট সাধন করবার, তারপর নিপুণতা বা প্রকরণাদির উপর সম্পূর্ণ দখল, তারপর শাস্ত্র কাব্য ইত্যাদির আবেক্ষণ, নানা শিল্পের জিনিষের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে পরিচয়, তারপর গুরুর কাছে রীতিমত শিক্ষালাভ এবং অভ্যাস।

 শাস্ত্রের মধ্যে নানা উপদেশ লিপিবদ্ধ হ’ল কালে কালে, সেটা পড়ে' নিয়ে শাস্ত্রজ্ঞান পেয়ে গেলেন, কিন্তু আকাশে বাতাসে যে সব শিল্পের নানা প্রকরণ—রঙ দেবার প্রকরণ, আলো-ছায়ার রহস্যভেদ করার প্রকরণ—লেখা হচ্ছে দিনরাত, সেগুলোও ত পড়া চাই। লিখিত শিল্পশাস্ত্রের চেয়ে শিল্পীর সঙ্গে বেশী যোগ অলিখিত এবং নতুন নতুন করে' লিখিত শাস্ত্রের। কেবলি শাস্ত্রের মর্ম নয় এই বিশ্বের মর্মস্থানে কি সব লুকোনো আছে তারি মর্ম জানার প্রকরণ হচ্ছে আর্টের প্রকরণ,—নিজের সৃষ্টির সঙ্গে এবং স্রষ্টার সৃষ্টির সঙ্গে যাতে যুক্ত হওয়া যায় সেই অভ্যাসের প্রকরণ জানা, শাস্ত্র-মতে পুতুল কাটার অভ্যাসটা শুধু নয়;—এই হ'ল consummate technique লাভের প্রকরণ। আর্টিষ্টের চলা আনন্দে চলা—হাতুড়ি পিটে কলম চালিয়ে সোনা গালিয়ে হীরে কেটে সুর ভেঁজে তাল ঠুকে, শাস্ত্রের অঙ্কুশ খেতে খেতে ইন্দ্রের ঐরাবতের মত চলা নয়। আর্টের প্রকরণ নিরঙ্কুশ প্রকরণ, আর্টের পন্থা নিরঙ্কুশ পন্থা, এই জন্য বলা হয়েছে “কবয়োঃ নিরঙ্কুশাঃ”।