বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/শিল্পবৃত্তি

শিল্পবৃত্তি
জোর করে করা আর প্রবৃত্তির সঙ্গে করে চলা—এই দুয়ের পার্থক্য শিল্প-কাজে ইতর-বিশেষ ঘটায়। এক দেয় সত্যকার, শিল্প— আর দেয় মিথ্যাকার শিল্পের ভাণ। একটা হাতে-বোন কাথা, এবং অন্যটা কলে-বোন কথা—একটাতে প্রবৃত্তি নিয়ে কাজ হ’ল, অন্তটিতে কুলির খাটুনি নিয়ে কাষ হ’ল! হাতে-সেলাই কাথা সে কলে-বেন। কাথাকে হার মানালে আর্টের দিক দিয়ে। নকল যা তা যতই কেন আসলের ভাণ করুক কোথাও না কোথাও এমন একটা ফাকি থাকে তার মধ্যে যা থেকে ধরা পড়ে যায় তার জাতির খবর।
 প্রবৃত্তি হ’ল মনের এবং তারি অনুসরণ করে মানুষ রকম রকম বৃত্তি বেছে নিতে প্রবৃত্ত হয়। চাণক্যের প্রবৃত্তি নীতিমালার, কালিদাসের প্রবৃত্তি কাব্যকলার অবতারণা করলে জগতে। চাণক্য ও শ্লোকে এবং ছন্দে বল্লেন যা বলবার, কালিদাসও বল্লেন কথা সেই উপায়ে। নীতিকথা সেও রসিয়ে উঠলো কালিদাসের কাছে, আর চাণক্যের কাছে রসের কথা সেও গম্ভীর রকমে নীরস হয়ে উঠলে, কাব্য রইলো না। কবি যে ছন্দ যে ভাষা এবং যে সব মাল-মসলা নিয়ে কায করেন তাই নিয়ে নীতিশিক্ষার গুরুও লিখলেন, কিন্তু সে লেখার স্থান হ’ল ন কাব্যজগতে, নীতি-পুস্তকেই বদ্ধ রইল; যথা—
 “ছেলে—দেখ বাবা কাল পাখী বসে ঐ গাছে।
 বাবা—রুপে কালো, কিন্তু ওর গুণ ভাল আছে॥”

ছেলের মধ্যে রস আছে, সে কালো পাখা দেখেই ভাবে ভোর, কিন্তু ছেলের বাবার মধ্যে নীতি আছে, তাই সে ফস করে নীতি কথা বল্লে। ছেলের কাছে সব পাখীই সুন্দর, গুণে যে তারতম্য আছে সে ত। জানেই না, বাবার কথায় অবাক হয়ে শুধোলে—“কি গুণ উহার বাবা বল না আমায়।” বাবা কোকিলের সম্বন্ধে শকুনতত্ত্ব থেকে কিছুই বল্লেন না কেবল একটু কবিত্বের ভাণ করলেন—“কোকিলের মিষ্টস্বরে শরীর জুড়ায়।”  এইবার ছেলেদের জন্যে একটু কবিতা পড়ে’ দেখা যাক।

“আয়রে পাখী আয়
কালো জামা গায়
আসতে যেতে ঘুঙ্গুর বাজে আমার যাদুর পায়।”

কবির কোকিল আর নীতি-শিক্ষার গুণবান কোকিল কোন্‌টা আসল কোকিল তা স্পষ্ট ধরা গেল,—একটা ছোট ছেলেও এটা বুঝে নিতে বিলম্ব করলে না কথা বলতে ও পড়তে শেখার আগে । প্রবৃত্তির ভেদে শুধু যে দুটো জিনিষকে দুই ছাঁচ দিলে তা নয়, দুয়ের মধ্যে সরস-নীরস আসল-নকল এমনি নানা ভিন্নতা দিলে।

 ছেলে-ভুলোনো ছড়ার বাঁধুনি এক রকম, ভারতচন্দ্রের কবিতার বাঁধুনি অন্য; একজন নামজাদা কবি, অন্যজন এমন যে তাঁর নামও কেউ জানে না অথচ কাব্য-রসে প্রবৃত্তি দুজনেরই—অতএব কাব্য-জগতে আর্ট হিসেবে দুজনের কাযের মধ্যে বাঁধুনীর ভেদাভেদ ভাষার ভেদাভেদ ইত্যাদি নিয়ে উচ্চ-নীচ ভাল-মন্দ এ বিচার করা চলে না, দুজনকেই কবি বলে’ স্বীকার করতে হ’ল। দুজনের দুটো কবিতা পাশাপাশি রাখি—

“ভাল মালা গাঁথে ভাল মালিয়ারে
বনমালি মেঘমালি কালিয়ারে ।”

(বিদ্যাসুন্দর) 

“সায়মণির কোলে রতন মণি দোলে’

কিংবা,

“দোলেরে মাল চন্দনী গোপাল” (ছেলে-ভুলোনো ছড়া)

এর কোন্ কবিকে প্রথম কাকে দ্বিতীয় কাকে তৃতীয় পুরস্কার দেবে রসিক বিচার করে’ ঠিক বলতে পারে না। ফুলের মালা, রতন হার, এবং ফুল চন্দনে মেশানো মালা এক শিল্প-প্রবৃত্তির থেকে তিনই রচা হ’ল কিন্তু ছাঁদ পেলে রুচি অনুসারে, বিভিন্ন রকমের মাল মসলা নিয়ে আর্ট রইল এক, আর্টের প্রকাশ হল বিভিন্ন ছাঁদে।

 নিজের প্রবৃত্তি অনুসারে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে চলার পথ আগলে রয়েছে লোকমত ধর্মমত রাজার হুকুম এমনি অনেক জিনিষ—তট যেমন আগল দেয়, ঝরণার বেগকে নিয়ন্ত্রিত করে চালায়, সেই ভাবের কায চলেছে মানুষের জীবনে, শিল্পী তার প্রবৃত্তি অনুসারে স্বাধীন ভাবে রচনা করে’ যাবার সুযোগ যদি পেয়ে যেতো তবে কথাই ছিল না, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সে যা তা গড়ে’ লিখে’ বলে’ কয়ে’ যেতে পারতো। কিন্তু নিয়মের দ্বারা বিধৃত এই বিশ্বসৃষ্টি, তার মধ্যে শিল্পীও ধরা পড়বে না, ছাড়া থাকবে, চলবে যেমন খুসি, প্রবৃত্তির বশে,—এ হ’তে পারলে না, বিশ্বপ্রকৃতি শিল্পীর মনকে ও কাযকে আলো-ছায়ার রংএর রেখার সুরের ছন্দের নিয়মে বাঁধলে, পাগলের মতো সে যা তা খেয়াল নিয়ে থাকতে পারলে না। শুধু এই নয়, স্থান কাল সমাজ ধর্ম, এক কথায় এক মানুষের প্রবৃত্তি অন্য মানুষের প্রবৃত্তির সংস্পর্শে এসে সুনিয়ন্ত্রিত হ’তে থাকলো, মন হরণের মনোহর রাস্তা শিল্পী এবং শিল্প-রসিক দুয়ে মিলে প্রস্তুত করলে, ঠিক যে ভাবে মাটি ও জল দুয়ে মিলে নদীর খাত প্রস্তুত হয় সেই ভাবের ক্রিয়া বশে শিল্পীর প্রবৃত্তি ও সাধারণের প্রবৃত্তির যোগাযোগ হ’ল।

 যেখানে শিল্পীর প্রবৃত্তির গতি তার আশপাশের দ্বারা আক্রান্ত হ’তে চল্লো, সেখানে বাঁধ ভেঙে বইলো শিল্পীর প্রাণের ধারা; যেখানে আশপাশ তাকে সুন্দর চলতে দিলে দুই তটের মধ্য দিয়ে সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে, সেখানে নদীতে মাটিতে ঝগড়া বাধলো না—নদী চল্লো সুন্দর আঁকবাঁক পেয়ে নদীর দুই কূলে শ্যামশোভা ছড়িয়ে দিয়ে! শিল্পের মূলে রয়েছে শিল্প-বৃত্তির সঙ্গে জাতি ধর্ম ইত্যাদির এই ভাবে সুন্দর মিলন, আর যেখানে ধর্ম বল্লে শিল্পকে, ‘ধর্ম-সঙ্গীতেই বদ্ধ থাক’ কিংবা ‘দেবতা গড়তে থাক’, সেখানে দেশ বল্লে, ‘দেশের মধ্যেই তুমি বদ্ধ থাক’,—সেইখানেই বাঁধ ভাঙলো শিকল কাটলো —এই হ’ল সৃষ্টির নিয়ম শিল্পেরও নিয়ম।

 প্রবৃত্তির বশেই চলেছে মানুষের জীবন নানা বৃত্তি বেছে নিতে নিতে। কোনো কিছুতে প্রবৃত্তি নেই এমন জীব নেই জীবনও নেই। আহারে প্রবৃত্তি গেল মানুষটা উপবাসে রইলো, বাঁচার প্রবৃত্তি গেল সে গলায় দড়ি দিলে, ছবি আঁকতে প্রবৃত্তি মানুষকে চিত্রকরের বৃত্তির দিকে নিয়ে গেল, পড়ার প্রবৃত্তি ছেলেকে পাণ্ডিত্যের দিকে, খাওয়ার প্রবৃত্তি ফলারের দিকে, ধনের প্রবৃত্তি চাকরি থেকে আরম্ভ করে’ জাল জুয়াচুরি যুদ্ধবিগ্রহ জমিদারি এবং রাজ্যলাভের দিকে নিযুক্ত করলে মানুষের সকল অধ্যবসায়কে—কেউ হ’ল রাজা, কেউ কবি, কেউ ধর্মপ্রচারক, কেউ আর্র্টিষ্ট, কেউ বা আর্র্ট-সমালোচক, কেউ ছাত্র, কেউ মাষ্টার, কেউ কেরাণী, কেউ সওদাগর, চোর ডাকাত কত কি!

 সমান প্রবৃত্তি সমান বৃত্তির দিকে চালায় এক দল মানুষকে। সমব্যবসায়ী তারা সমান ভাবের জীবন-যাত্রার পথ ধরে’ চলে, এবং এই ভাবে কবির দল, সাহিত্যিকের দল, কারিগরের দল এমনি নানা দল সৃষ্টি হয়ে যায় নানা পথে নানাপন্থী হয়ে ধর্মপন্থী শিল্পপন্থী কর্মপন্থী কত কি দেখা দেয় তার ঠিক নেই।

 কাযে প্রবৃত্তি নেই অথচ যখন কাজ করতে হচ্ছে শিল্পীকে, তখন দেখা যায় শিল্পকার্য অবনতি পাচ্ছে। নানা দেশের শিল্পের ইতিহাস থেকে এটা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। শিল্পের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, শৈশব অবস্থায় শিল্পকর্মের মধ্যে প্রবৃত্তির প্রেরণা প্রবল ভাবে কায করছে— রং দেবার রেখা টানবার প্রবল প্রবৃত্তি এবং তাই নিয়েই খেলা। যে কোন দেশের পল্লী-শিল্পগুলোর চর্চা করে’ দেখলে দেখি, সেখানে বর্ণ ও রেখার উপর মানুষের একান্ত প্রবৃত্তি পরিষ্কার ধরা যায়। আর্র্টের শৈশব অবস্থায় প্রবৃত্তির প্রবলতা বশে রংএর প্রাচুর্য রেখার সরলতা নিয়ে ঢেলে দিচ্ছে আপনাকে মানুষের মন সরলভাবে খেলার পুতুল, গায়ের কাঁথা, ঘরের ঘটি-বাটি, সাজ-সরঞ্জাম যা নিজের জন্য এবং যা কিছু পাঁচজনের জন্য সমস্ত সামগ্রীর উপরে। রঙ দেবার এবং রেখা টানার প্রবল ইচ্ছা শৈশব অবস্থার শিল্পের মূল লক্ষণ; সেখানে উপাদান বাছে না, মন মাটি ইট কাট সবার উপরে প্রবৃত্তির ছাপ রেখে চলে ঠিক ছোট ছেলে যে ভাবে লাল নীল রঙ পেলে যাতে তাতে মাখায়, আঁচড় টানে সোজা বাঁকা নানা রকম; কতকটা এই ভাবে কাজ করে’ গেল আদিম অবস্থায় মানব শিল্পীরা।

 যে ছেলে-ভুলানো ছড়াগুলো কত কালের তা কে জানে, তার মধ্যেও শিল্পের এই শৈশব অবস্থার রূপটি সুস্পষ্ট ধরা পড়েছে; যথা—

“এক যে গাছ ছিল
লতায় লতিয়ে গেল
তার এক কুঁড়ি হ’ল
ফুল ফুল ফুল ফুটে গেল।”

একটি মাত্র রূপ সে রেখায় লতায় পত্রে পুষ্পে ভরে’ উঠলো। আদিম শিল্পের রংএর হিসেবও এইরূপে ছড়ার মধ্যে ধরা রয়েছে নিখুঁতভাবে; যথা—

“এপারেতে কালো রং বিষ্টি পড়ে ঝম্ ঝম্
ওপারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙ্গা টুক্ টুক্‌ করে।”

যেন নীলাম্বরী সাড়ির কিনারায় চওড়া রাঙ্গা পাড়ের টানটোন।

অথবা—

‘রং নয়তো কাঁচা সোনা,
মুখটি যেন চাঁদের কোণা!”

কিংবা—

“কে বলেরে আমার গোপাল বোঁচা
সুখ সায়রের মাটি এনে নাক করেছি সোজা;
কে বলেরে গোপাল আমার কালো
পাটনা থেকে হলুদ এনে গা করেছি আলো।”

ছেলেবেলায় যে সব মাটি ও কাঠের পুতুল নিয়ে সবাই খেলেছি তার বিশেষত্বই ছিল—আলো করা হলুদ রঙ এবং একবারে ঠিক সোজা নাক, কালো কাপড়ের কিনারায় রাঙ্গা টুক টুকে পাড়, রঙ রেখার পরিষ্কার টানটোন!

 রঙএর দিকে এবং রেখার দিকে শিল্পীর সহজ ও প্রবল প্রবৃত্তি, এরি উপরে মানুষের শিল্পের পত্তন হ’ল এবং এই উৎস যখন ধারা ধ’রে বইতে আরম্ভ করলে তখন শিল্পের যৌবন অবস্থা ধরা যেতে পারে। এই যৌবন অবস্থায় নদীর স্রোতের মতো মানুষের শিল্পে মনোভাব প্রকাশের প্রবৃত্তি, রঙ দেবার প্রবৃত্তি, রেখা টানার প্রবৃত্তি, সুরে বলার ছন্দে বলার প্রবৃত্তি আর উচ্ছৃঙ্খল নেই, একটা একটা ধারা ধরে’ সুসংযত হয়েছে, অবাধ সুন্দর বাঁক ও তট-রেখার মধ্য দিয়ে ঝিক্‌মিক্ করে’ ব’য়ে চলেছে, ভাবের এবং রসের গভীরতা লাভ করতে করতে। তখন শুধু বর্ণের জন্যই বর্ণ নয়, রেখার জন্যই রেখা নয়, এমন কি বলতে পারি কেবল আর্টের জন্যই আর্টও নয়—মানুষের সকল প্রবৃত্তি ধর্ম ও কর্ম কে এনে একসঙ্গে মিলিয়েছে, বাইরের দেখার সঙ্গে অন্তরের দেখার মিলন হয়ে গেছে, সুরের সঙ্গে শাল বোনার কায চলেছে, দেবতার আরতি ঘোষণা করেছে অষ্টধাতুর ঘণ্টা, মন্দিরের বাইরের বিচিত্র কারুকার্য অন্তরের দেবতাকে ঘিরে রয়েছে। বীণার অনেকগুলো ঘাট স্পর্শ করে’ রাগরাগিণী যেমন ভাবে চলে তেমনি চলেছে মানব-সমাজের ঘাটে ঘাটে স্রোত বইয়ে এই যৌবন অবস্থার শিল্প । কোথাও মন্দিরের ঘাটে লাগলো স্রোত-এক রকম তরঙ্গ উঠলো রসের ধারায় ; কোথাও লাগলে স্রোত রাজ-অট্টালিকায় বিলাস-ভবনে—সেখানে আর এক রকম তরঙ্গ উঠলো শিল্পের ধারায় ;—এই রকম নানা বাঁকে বাঁকে আঁকতে বাঁকতে জোয়ার ভাঁটার ছন্দ ধরে’ চলেছে শিল্প দেশের জাতির ধর্মের কর্মের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত হ’য়ে যৌবনাবস্থায় ।

 দেশ কাল ধর্ম জাতি ইত্যাদি ভেদে মানুষের প্রবৃত্তির বেগ এবং সেই সঙ্গে তার শিল্পও নিয়ন্ত্রিত হ’য়ে বিচিত্র পথ অনুসরণ করে’ চলে বিচিত্র ভাবাপন্ন হ’য়ে বিচিত্র রূপে ।

 দেশ বিদেশে শিশু-চরিত্রে যেমন তেমনি পৃথিবীর আদিম জাতিদের মধ্যে যে সমস্ত শিল্প, তাদের মধ্যে একটা মিল দেখা যায় ; সেখানে পূর্ব-পশ্চিম ভেদে ধর্ম ও সমাজপদ্ধতি ভেদে শিল্পকার্য সমূহের তারতম্য বড় একটা সুস্পষ্ট ভাবে বিদ্যমান থাকে না, শুধু শিল্পের ধারা যখন নদী হ’য়ে ব’য়ে চল্লো মানুষের ঘরের কাছ দিয়ে, দেশের বুকের উপর দিয়ে, তখনি দেখি শিল্পের নানারূপ বিভাগ সুনির্দিষ্ট হ’য়ে শিল্পের নানা মন্ত্র তন্ত্র প্রথা প্রণালীর দ্বারা এক এক রকম ছাঁচ পেয়ে চলেছে ।

 আমাদের দেশে বৌদ্ধ হিন্দু মোগল ইত্যাদি—ওদের দেশে গ্ৰীক রোম খৃষ্ট তুর্ক ইত্যাদি নানা ধর্মের নানা টানে যে প্রকার বিভিন্ন ছাঁচ পেলে শিল্প, তাতে করে’ শিল্পের একটা জাতি-বিভাগ স্পষ্ট হ’য়ে উঠলো, অথচ শিল্প হিসেবে তাঁদের মধ্যে আসলে পার্থক্য নেই। নদীর জল সব নদীতেই জল ছাড়া আর তো অন্য পদার্থ নয়—দুধও নয় দইও নয় ক্ষীরও নয় জল মাত্র ; তেমনি শিল্প সব দেশেরই, শুধু রূপ ও নাম মাত্র ভিন্ন হ’য়ে গেছে—দেশ কাল পাত্র ভেদে যেমন যাতে ধারা বইলো তারি হিসেব নিয়ে ।

 নৌকা সব দেশেই নৌকা, রথ সব দেশেই রথ ; কিন্তু বর্মা দেশের নৌকা, বাঙলা দেশের নৌকা, মিশর দেশের নৌকা, গ্রীস দেশের নৌকা, সবার ভিন্ন ভিন্ন গঠন-প্রণালী হয়েছে। ছাঁচ বদলায়, যান বাহন ইত্যাদির উপায় উপকরণ সবই বদলায়, অথচ নৌকা যে সে নৌকাই, রথ যে সে রথই থাকে।

 শিল্প হ’ল এক জিনিষ যা সর্বদেশে সর্বকালে সমান, ছাঁচ হ’ল উপযুক্ত অনুপযুক্ত ভাল মন্দ ভিন্ন ভিন্ন। যেমন মানুষের মনের কতকগুলো প্রবৃত্তি সব দেশেই এক, কিন্তু ধর্মের প্রভাবে সমাজের প্রভাবে স্বতন্ত্র ছাঁচ পেয়ে প্রকাশ পাচ্ছে, শিল্পও ঠিক সেই ভাবে নানারূপে কালে কালে জাতি-ভেদে, সময়-ভেদে, এমন কি শিল্পীতে শিল্পীতে যে একটুখানি চিন্তার শিক্ষা দীক্ষার ভিন্নতা থাকে তার বশেও নতুন নতুন রূপ ও ভাব ভঙ্গি পায়।

 সব বাঁশীই ফুঁয়ে বাজে কিন্তু মেলাতে শিশুর জন্য যে বাঁশী আসে তার তিনটে ফুটো, খুব বর্বর জাতির মধ্যেও তিন সুরের বেশি সুর নেই, অপেক্ষাকৃত সভ্য জাতির বাঁশীতে পাঁচটা ফুটো, জাপানে এখনো সঙ্গীত শাস্ত্রে পাঁচ সুরের হিসেব ছাড়া সাতটা সুর নেই,—এমনি পূব পশ্চিম সব দেশেই একই বাঁশী তার ফুটোর হিসেব নিয়ে নানা রকম সঙ্গীতের রাগ-রাগিণীর স্থষ্টি করে’ চলেছে যেমন, তেমনি শিল্পকলা বড় ছোট নানা রাস্তা ধরে নতুন নতুন রসের সৃজন করেছে। মানুষের মনোভাব দেশকালের আবহাওয়া ইত্যাদি জোয়ার ভাঁটার মতে শিল্পের ধারাকে ছন্দ দিচ্ছে নানা প্রকার, এই হ’ল শিল্পের যৌবনাবস্থার কথা।

 নির্ঝর যেমন আপনাকে রূপান্তরিত করলে নদ নদী খালে বিলে তেমনি মানুষের শিল্পও অন্তরের অন্দরমহল থেকে নির্ঝর বইয়ে বার হ’ল প্রবৃত্তির প্রেরণায় এবং বাহিরের জগতে নান দিকে যে বিরাট রসের সমুদ্র বিচিত্র ছন্দে দুলছে তার দিক থেকে যে প্রেরণা এল তারি বশে জোয়ার ভাঁটা খেলিয়ে চল্লো গ্রামের পাশ দিয়ে, নগরের মধ্য দিয়ে মন্দির মঠ মস্‌জিদ গীর্জা রাজ-অট্টালিকা দীনের কুটীর সব জায়গাতে রকম রকম রস বিলিয়ে; শিল্পের গতি-বিধির মোটামুটি হিসেব এই ছাড়া অন্তরূপ তো মনে হয় না।

 শৈশব ও ভরা যৌবন তার মাঝে কৈশোর অবস্থা। নদী যখন কূলহারা অকূলে মিলতে চলেছে খরস্রোতে, আর সে যখন পর্বত শিখর ছেড়ে ঝরে’ পড়ছে পৃথিবীর দিকে—এর মধ্যে রয়েছে আরো গোটাকতক আঁক বাঁক যার মধ্যে জলের বিচিত্র লীলা।  নদীর ইতিহাস জানতে হয় তার আদি অন্ত এবং মধ্য লীলা নিয়ে ; মানব শিল্পের ইতিহাসও ঠিক এই হিসেবে ধরে’ চর্চা না করলে শিল্পীকে 'সম্পূর্ণভাবে জানা হ’ল না। এই যে তাজমহলটা সৃষ্টি হল আমাদের দেশে, এটার উৎপত্তির কারণ তুরস্ক কি মোগল সভ্যতার উপরে সম্পূর্ণ ভাবে ছাড়া তো যায় না ; যে দেশ থেকে মোগল জাতি তাদের সভ্যতা নিয়ে এল ভারতে, সে দেশেও যাকে আমরা বলি মোগল স্থাপত্য তা ঠিক ঠাক আগ্রা কি দিল্লীর মতো নয়। তাঞ্জের কিম্বা সেকেন্দ্রার কি আগ্রার বা দিল্লীর স্থাপত্য যে প্রবৃত্তির প্রেরণায় মানুষ সৃষ্টি করলে, ঠিক সে প্রবৃত্তি নিয়ে বোগ্দাদ বসোরা কাবুল পারস্য দেশের মানুষ তাদের সমাধি ব! রাজভবনগুলো গড়েনি। একই মোগল শিল্প, কিন্তু তার প্রকাশ হ’ল দেশ কাল ইত্যাদি ভেদে নতুন রকমে । চীন দেশে গিয়ে মোগল শিল্প এক ছাচ পেলে, ভারতে আর এক, ভারতের পশ্চিমে অন্য ছাচ পেলে, আবার পূবে পশ্চিমে গিয়ে আপনার ছাঁচ বদলালে।

 মানুষের প্রবৃত্তির অদল বদল যা ঘটছে মানুষের মনে তা এ জাতের সঙ্গে ও জাতের, এ ধৰ্মের সঙ্গে ও ধৰ্মের, এ সভ্যতার সঙ্গে ও সভ্যতার ধাক্কায় ; তাতে করেই শিল্পের ধারা নতুন নতুন ঢেউ তুলে অগ্রসর হচ্ছে বিচিত্র পথে যৌবন অবস্থায়। মানুষের বয়সের যেমন পুনরাবৃত্তি নেই তেমনি শিল্পেরও পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। শিল্পের সপ্তম আশ্চর্য সে আর একটিবারও ঠিক অমনিটি হ’য়ে দেখা দিতে পারে না, হয়তো অষ্টম আশ্চর্য্য প্রকাশ হবে শিল্প জগতে, কিন্তু সপ্তম সে বরাবর সপ্তমেই থাকবে ।

 কলের শিল্প একটার মতো একলক্ষ স্বজন করে’ চলে কিন্তু যার সঙ্গে মানুষের মনোবৃত্তির যোগাযোগ তার নিয়মে এক জিনিষ দুবার সৃষ্টি হয়ে চলে না। ছেলে যখন কাপিবুক্‌ কপি করছে—তখন খাতার প্রত্যেক পাতায় লিখে চল্লে। “সেবকশ্ৰী” কিন্তু সেই ছেলে বড় হ’য়ে যখন রচনা সুরু করলে তখন নতুন নতুন ছত্র দিয়ে সে খাতা ভৰ্তি করে’ গেল, নতুন নতুন ভাবের টানে লেখা নব নব ছন্দ পেয়ে চল্লো খাত ভরে দিয়ে । কিছু বলতে বা প্রকাশ করতে পারুক বা নাই পারুক কলম চালানোতেই শিশু আনন্দ পায়। শিল্পের শৈশব অবস্থার কথাও এই, সেখানে শুধু হাতের কাজেই শিল্পীর আনন্দ। তাঁতি যখন কাপড়ের কিনারায় নানা রঙএর আঁজী টানে তখন কোন্ রঙএর পাশে কোন্ রঙ মানায় তার একটা হিসেব ধরে’ চলে, কিন্তু এই রঙ এই ভাব জাগায় এ জ্ঞান তার নেই, সেটা হয় যখন তাঁতি কেবল তাঁতি নেই শিল্পীও হয়ে উঠেছে। মেয়েরা কাঁথা বোনে, আমাদের চেয়ে ভাল জানে তার কাঁথার কোথায় কোন সূতো কোন ফুল কোন পাড় দিতে হবে; রঙএর প্রবৃত্তি রেখার প্রবৃত্তি তাদের ঠিক পথে চালায় কিন্তু একটা কাঁথার কায এক ভাব জাগায়, অন্যটা অন্য ভাব, এক রঙ জাগায় বৈরাগ্য অন্য রঙ জাগায় অনুরাগ; এক রেখা করে ঢল ঢল, এক রেখা চলে ছল্ ছল্—এসব কথা হ’ল শিল্পীর।

 শিল্পীর কৈশোর ও যৌবনের কথা হ’ল ভাবযুক্ত শিল্প, এ সময়ে লোকে শাল বুন্‌লে—কাশ্মীরের পদ্ম-সরোবর আপনাকে ধরা দিলে একটুখানি কল্‌কার কাযের মধ্যে। ঠিক যে ভাবে কবির একটি ছত্রে ধরা গেল বিশ্বের বিরাট রহস্য, সেই ভাবে এক টুকরো পাথর সেও রহস্যময় ভাবময় হ’য়ে জীবন্ত হ’য়ে উঠলো, অন্তরের স্বাদ দিতে থাকলো। শৈশবের প্রবৃত্তি প্রবল প্রবাহ নিয়ে শিল্পকে ঝরিয়ে দিলে পৃথিবীর দিকে যেখানে মাটির ঘরে মানুষ বাস করছে, কৈশোরের প্রবৃত্তিরূপ শিল্প ঘর বার দুয়ের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকলো।

 “শৈশব যৌবন দুহুঁ এক ভেল।” যৌবনে শিল্পের অভিসার, মনের সমস্ত প্রবৃত্তি নিয়ে দুঃখের মধ্য দিয়ে সুখের মধ্য দিয়ে অনন্ত রসের দিকে শিল্প-ধারা শতমুখী হয়ে চলেছে সাগর সঙ্গমের পথে—

“নব অনুরাগিণী রাধা কছু নাহি মানয়ে বাধা
একলি করল পয়াণ পন্থ বিপন্থ নাহি মান।”

প্রথম যৌবনে যখন শিল্পের অভিসার পথে বিপথে তখনকার ইতিহাস বড় জটিল, বড় রহস্যময়, বড় অস্থির—তখন শিল্প নিজেকে হারিয়েছে পরের জন্য, নিজের ঘরে আর থাকতে পারছে না শিল্প, পূবের আলো পশ্চিম মুখে হ’য়ে চলেছে দিবাভিসারে আবার পশ্চিমের আলো রাত্রির অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তিমিরাভিসারে চলেছে পূবের আলোর সঙ্গে মিলতে; এই ভাবের অবস্থা শিল্পের—‘নৈহরবাঁ হম্‌কো নহিঁ ভাবে’ (কবীর)। নতুনের বাঁশী শুনেছে শিল্প, বাপের বাড়ীর খেলাঘর আর ভাল লাগছে না। আকবর বাদশাহের সময়কার শিল্পে এর সুস্পষ্ট আভাষ দেখা যায়; ভারত শিল্প মিলতে চলেছে মোগল শিল্পে, খাঁটি তুর্ক শিল্প ধরতে চলেছে ভারতীর ছন্দ, ফতেপুর শিক্‌রীর স্থাপত্য, সুফি কবিদের কবিতা এবং কবীরের সমস্ত চিন্তা এই অভিসারে চলেছে, রাজপুতের মেয়ে বসতে চলেছে দিল্লীশ্বরের পাশে। এই যে মিলনের আগেকার অভিসার-পথ শিল্পের পক্ষে বড় সঙ্কটাপন্ন পথ—সমুদ্র যেখানে নদীর দিকে, নদী যেখানে সমুদ্রের দিকে মিলতে চলেছে সেই মোহানা পার হ’তে নাবিককে সাবধান হ’তে হয়, এ পাকা নাবিক মাত্রেই জানে। অগাধ সমুদ্রে নাবিকের তত ভয় নেই, বন্দরে তো সে একেবারেই নির্ভয়; কিন্তু সমুদ্র আর বন্দর দুয়ের মাঝে চোরাবালি যে আছে তাকেই ভয় নাবিকের। বন্দর থেকে বার হতে বিপদ, বন্দরে প্রবেশ করতে বিপদ—মোগল বাদশার অন্দরে ঢুকতেও বিপদ, সেখান হ’তে বার হ’তেও বিপদ। এই সঙ্কট পেরিয়ে গিয়েছিল এদেশের শিল্প একদিন আকবরের আমলে, মিলন হ’ল গিয়ে সার্থক সাজাহানের সময়ে যখন সত্যকার মোগল-শিল্প দেখা দিলে— তাজমহল। সঙ্গীত-কলার দিক দিয়েও তখন এই মিলন ঘটে’ গেল, অশন বসন ভূষণ কিছুর কোনদিকই বাদ পড়ল না, কিন্তু এই মিলন যখন বিচ্ছিন্ন হ’ল ঔরঙ্গজেবের সময়ে তখন সকল দিকে শিল্পের অবনতি হতেই চল্লো, হাতের কাজে মনের কাজে জড়তা এল, বিষন্নতা এল— বাদশার হুকুমে সঙ্গীত-বিদ্যা গভীর রকমে কবরস্থ করলে কালোয়াৎরা, মোগল স্থাপত্য কতদূর অপদার্থতার মধ্যে নেমে গেল তার নিদর্শন লক্ষ্মৌ নবাবের প্রাসাদ ও ইমামবারাতে ধরা রইলো। এর পর ইউরোপীয় শিল্পের আবির্ভাব হ’ল, মিলতে চল্লো মোগল শিল্প তার সঙ্গে, মিলন সার্থক হ’ল না, লক্ষৌর লা মারটিনিয়ার কলেজের মতো একটা বীভৎস সৃষ্টিছাড়া জিনিষের উৎপত্তি হ’ল।

 মোগল হিন্দু এবং সাহেব এই তিন আর্ট কোন ত্রিবেণীসঙ্গমে গিয়ে মিলতে পারলে না। মোগলের আগে যে সব তুর্কীরা এদেশে বিজেতা হিসেবে এল তারা তুরস্ক শিল্পকেও সঙ্গে আনলে এবং মিলিয়ে দিলে বৌদ্ধ শিল্পের শেষ যে ধারা চলছিল তার সঙ্গে—আজমীঢ়, দিল্লী, জৌনপুর, গৌড়, হায়দ্রাবাদ, বিজাপুর এমনি সব স্থান জুড়ে’ একটা চমৎকার স্থাপত্য শিল্পের আবির্ভাব হ’ল।

 স্থাপত্যকে শিল্প হিসাবে দেখলে মোগলদের তাজমহলের চেয়ে পূর্ববর্তী তুরস্ক শিল্পের অভিযানের নিদর্শনগুলো কোন অংশে কম নয়—আজমীঢ়ের মস্‌জিদ, দিল্লীর কুতুবমিনার, আল্‌তমাসের সমাধি, আলাউদ্দীন খিলিজি ও তোগলক শাহার সমাধি ও মস্‌জিদ্‌, জৌনপুরের অটলা দেবী মস্‌জিদ, আহম্মদাবাদের আবুতোরাবের সমাধি, মোহাফিজ্ খাঁর সমাধি, বীজাপুরের ইব্রাহিম রোজা আদিল শাহার গোল গম্বুজ,—দেখলেই বোঝা যায় যে ভারতের স্থাপত্যের সঙ্গে তুরস্কের স্থাপত্যের পরিণয় সুব্যক্ত ভাবে ঘটেছে, এক ধারার সঙ্গে মিলেছে আর এক ধারা—বাংলার শের শাহের সমাধির গর্ভে লুকোনো দেখি আগ্রার মোগল আমলের তাজবিবির রোজার সুন্দর ছাঁচ, দিল্লীর তোগলক শাহার কবরের গর্ভে নিহিত রয়েছে মোগল বাদশা হুমায়নের সমাধির আদরা, আহম্মদাবাদের আবুতোরাবের সমাধির মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে স্থাপত্য-শিল্পে মোগল আমল যে প্রসার ও শুভ্র স্বচ্ছতা লাভ করলে সেটি।

 এই যে বহির্ভারত এবং অন্তর্ভারত শিল্পের ধারা মিল্লো, তার প্রধান লক্ষণ হ’ল শিল্পের ধারায় পরিষ্কার পারম্পর্য লক্ষিত হ’তে থাকলো; জলের এক ঢেউয়ের সঙ্গে অন্য ঢেউয়ে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হ’ল না, বংশ-পরম্পরায় ছেদ পড়ল না, যদিও স্থান কাল পাত্র বশে তারতম্য হল একটু আধটু মনোভাবের এবং বাইরেরও চেহারার। এমনি মোগল শিল্পের সঙ্গে রাজপুত শিল্পের সংমিশ্রণ—সে ও আর একটা প্রকাণ্ড ইতিহাস। আবার প্রাচীন ভারতের অন্তর যেখানে বহির্মুখী হয়ে চল্লো সেখানের ইতিহাস আরও প্রকান্ড, আরো রহস্যময়।

 মানুষের প্রবৃত্তির, জাতির প্রবৃত্তির গতি ধরে’ যে ভাবে শিল্পের ধারা কালে কালে দেশে দেশে বইলো, সেই অনুসারে শিল্পের চর্চা করে’ চালাতে শিল্পের প্রাণের ছন্দের হিসেব পাই; নিছক পুরাতত্ত্বের দিক দিয়ে গেলে একটা মোটামুটি হিসেব ছাড়া আর কিছু পাওয়া সম্ভব হয় না। প্রাচীন এবং আধুনিক বংশ-তালিকা মিলিয়ে একটা বংশের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্মের তারিখ, মৃত্যুর তারিখ, তাদের নাম ধাম সবই পাই কিন্তু সেই বংশের প্রত্যেক মানুষের সম্পূর্ণ চরিত্র ও ইতিহাস কিছুতে তো ধরা পড়ে না, এবং সেই বংশের মধ্যে যে সাধারণ একটি প্রবৃত্তি যা বংশের সব মানুষকে কেমন তার পরিবারে এক করে’ একটা ভাল বা মন্দ গতি দিয়ে চলেছে তারও হিসেব পরিষ্কার ধরতে পারিনে; শিল্পের চর্চাতেও ঠিক এই ঘটনা ঘটে নিছক পুরাতত্ত্বের দিক দিয়ে শিল্পকে দেখতে গেলে। নিজের প্রবৃত্তি অনুসারে কেউ এ পথে কেউ ও পথে শিল্পের চর্চা করে’ চলব আমরা, তারপর এমন দিন আসতেই হবে যখন এই দুই পথের হিসেব মিলিয়ে তবে শিল্পের পূরোপূরি ইতিহাস সব দেশে রচিত হবে।

 কবির জীবন, সাহিত্যিকের জীবন, গায়কের জীবন, বাদ্যকরের জীবন, চিত্রকরের ও ভাস্করের জীবন স্ব স্ব অন্তরের প্রবৃত্তি নিয়ে একলা নেই—এরা বহির্জগতে থেকেও নানা সমাজ ধর্ম শিক্ষাদীক্ষা ও দেশকালের ধর্ম ও মর্মের সঙ্গে যুক্ত হ’য়ে তবে বর্তমান রয়েছে। তার অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎ ঘিরে নিয়ে চলেছে তাকে বন্দীর মতো। দেশ কাল পাত্র এ সমস্তই গতি দিচ্ছে শিল্পীর মনোবৃত্তি সমস্তকে, এই হ’ল স্বভাবের নিয়ম; যেখানে এর অভাব সেখানেই শিল্পের ধারা হয় একই অবস্থায় জড়বৎ রয়েছে, নয়তো বদ্ধ জলের মতো আস্তে আস্তে মরছে উজ্জীবনী শক্তির স্পর্শ অভাবে।

 জলপ্রপাত মরুভূমির উপর দিয়ে ব’য়ে চলার রাস্তা না পেয়ে যদি বালির উপর ছড়িয়ে পড়লো তো সে শুকিয়ে মরলো, আর যেখানে দেশ তাকে বুক পেতে ধারণ করে’ বইয়ে নিয়ে চল্লো দুই তটের মধ্য দিয়ে, সেখানে নদনদীর স্রোত বইলো। এইভাবে জনসাধারণের প্রবৃত্তি এক এক সময়ে এক এক রসের ধারাকে কখনো বইয়েছে, কখন ব’য়ে চলার বাধাও দিয়েছে।

 ইংরাজ যখন এ দেশে এল সেই সময়ে প্রথম প্রথম দেশের প্রবৃত্তি বিদেশ মুখে ঘুরে দাঁড়ালো, নতুনের মোহে পুরাতনকে পরিত্যাগ করলে। ধর্ম কর্ম শিল্প শিক্ষা দীক্ষা সব দিক দিয়ে আপনার যা সেটা মুছে গেল আমাদের কাছে, বিদেশের যা কিছু তাই রইলো সামনে খাড়া পাহারার মতো। এই যে এক ভাবে পূব ও পশ্চিম মিল্লো, এ মিলন ঠিক মোগল বা তুর্কি যে ভাবে মিলেছিল ভারতের সঙ্গে সেরূপ মিলন হ’ল না—মোগল বা তুর্কের আমলে এক দেশ রাজবেশে এসে আর এক দেশের পাণিগ্রহণ করলে—ঠিক যে ভাবে এখনো রাজপুত তারা ঘোড়ায় চড়ে’ এসে কন্যাকে কেড়ে নিয়ে যায় বিবাহের রাতে সেই ভাবের ক্ষাত্র বিবাহ হ’ল তখন দেশের ও বিদেশের শিল্পে ও মনোভাবে। এক প্রাচ্য জাতি আর এক প্রাচ্য জাতির সঙ্গে মিল্লো, দেখতে দেখতে সার্থক হ’ল সে মিলন, নতুন জাতের শিল্পকলা নতুন ফুলের মতো দেখা দিলে। পূব পশ্চিম যখন মিল্লো তখন বিজেতা ও বিজিত, দাসী ও প্রভু কেবল এই সম্পর্কটুকু নিয়ে মিল্লো, দুজনে পাশাপাশি রইলো বটে কিন্তু ইডেন গার্ডেন ও বিডেন গার্ডেনে রইলো আকাশ পাতাল প্রভেদ। চৌরঙ্গী রইলো নিজের রঙ্গে, চিৎপুর রইলো চিৎপাৎ বাঁশের খাটিয়াতে। এ ভাবে দুই জাতির বাইরে বাইরে মিলনে শিল্পের উৎপত্তি হতেই পারে না। মালা অদল-বদল হ’ল মোগলের সঙ্গে রাজপুতের, পরদেশীর সঙ্গে স্বদেশীর গান্ধর্ব মতে— উৎপত্তি হ’ল তা থেকে ভারত সঙ্গীত-কলার নতুন ধারা। রাখী বাধা হ’ল হাতে হাতে রাজায় প্রজায় এক সভ্যতায়, জন্ম নিলে কল্পনাতীত সুন্দরী কলাসমস্ত। এই ঘটনা মোগল আমলে নয়, তার পূর্বে; তারও পূর্বে কতবার ঘটেছে, কতবার কতদিক দিক দিয়ে মিলন হয়েছে আর্যে অনার্যে, সমতলবাসীর সঙ্গে পর্বতবাসীর, সমুদ্রের এপারের রাজার সঙ্গে সমুদ্রের ওপারের রাণীর। আমাদের ধর্মের ইতিহাস, কর্মের ইতিহাস, শিল্পের ইতিহাস এই সার্থক মিলনের চিহ্নে ভরা রয়েছে।

 তখনকার কালে উপনিবেশ অভিযান যা হয়েছিল তার শেষ হয়েছিল গিয়ে জাতিতে জাতিতে সত্য পরিণয়-সূত্রে বাঁধা পড়ায়। এই নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়েছে কতবার—গ্রীস এল কিন্তু দেশের ঘরে তার বরের আসন পড়ল না, নাদির শা এল ডাকাতি করে’ চলে’ গেল, গ্রীস খাত কাটলে বিজাতীয় প্রথায়, সে খাতে শিল্পের ধারা বইলো না; নাদির শা বানের মতো এল ঘরের জল বার করে নিয়ে গেল, রেখে গেল না কিছু শূন্য ভাণ্ড ছাড়া, বর্গি এলো বাংলায় শুধু চৌথই আদায় করলে, দিয়ে গেল না কিছু খাজনা দেবার ভাবনা ছাড়া,—“বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে!” কিন্তু নবাব এলেন ঢাকায় মুর্শিদাবাদে শুধু রাজত্ব করতে নয় ঢাকাই কাপড় বালু চরের সাড়ী এমনি কত কি নিজেরা পরতে এবং দেশকে পরাতে; বরের আসার ধূমধামে হাতী ঘোড়ার চাপে দু’চারটে মন্দির ভাঙলো, ঘরও উজাড় হ’ল, কিন্তু শেষ হ’ল গিয়ে শিল্পকলার ছাঁদনাতলায় সমস্ত ব্যাপারটা!

 এখন তো কত বুদ্ধমূর্তি চালান যাচ্ছে এদেশ থেকে ইউরোপের যাদুঘরে, কত শাস্ত্র কত পুঁথি কত চিত্র গিয়ে জমা হচ্ছে সেখানে তার ঠিক নেই, কিন্তু বৌদ্ধদের আমলে যে ভাবে একটি মাত্র বুদ্ধ মূর্তি—অথবা মূর্তিও নেই শুধু একখান হাতে লেখা পুঁথি—ধর্মে ধর্মে, চিন্তায় চিন্তায়, শিল্পে শিল্পে মিলিয়ে দিয়েছিল চীন ও ভারতের দুই সভ্যতাকে অটুট ভাবে, সে ভাবের মিলন হ’তে কত দেরি লাগছে আজকের প্রাচ্যে ও আজকের পাশ্চাত্যে! এ দেশকে বুঝতে চাচ্ছে ওরা ও দেশকে বুঝতে চাচ্ছি আমরা বড় কম দিন ধরে’ নয় কিন্তু বাইরে বোঝাপড়া হলে তো হয় না, শুধু পণ্ডিতে পণ্ডিতে মিল্লে তো জাতিতে জাতিতে মিলন হ’ল না বিবাহ সূত্রে।

 দুই ভিন্ন জাতিতে সকল দিকে অন্তরের বোঝাপড়া চলে অন্দরের বাসরে শুধু, সদরে স্কুলে, হোটেলে, হোষ্টেলে, আফিস ঘরে, বায়স্কোপে, ফুটবলের মাঠে এবং সরকারী বেসরকারী গার্ডেন পার্টি ও পর্দা পার্টিতে যতক্ষণ মিলন ততক্ষণ দুই জাতিতে পুরো মিলন ভাব-সাব হ’ল না, শিল্প কলাও নতুন ছন্দটি পেয়ে গেল না। পূব পশ্চিমের মিলন যখন হবে তখন কেমন শিল্পকলা দেখা দেবে তা কে বলতে পারে? কিন্তু পূব পশ্চিম দুই সভ্যতার মাঝে যে অন্ধযুগের পর্দা তা ছিঁড়ে না পড়লে এই সম্পূর্ণ মিলন ঘটা সম্ভব নয় জানা কথা। ওরা বড় আমরা ছোট কি আমরা বড় ওরা ছোট—শিল্প ব্যাপারে এ নিয়ে লড়াই করে’ মিলন হয় না, কাজেই শিল্পও দেখা দেয় না দেশে। লড়ায়ের দিনে যবন এসেছিল এ দেশে এক হাতে কোরাণ অন্য হাতে তলোয়ার নিয়ে কিন্তু লড়াই শেষে যদি তেমনি ভাবেই তারা পাহারা দিতেই থাকতো মনের মিলনের ঘাটিতে ঘাটিতে তবে নিস্ফল হ’ত তাদের রাজশ্রী। ঐ সব আমলে দেশে যে সমস্ত শিল্পকলা সৃষ্টি হ’ল তার মূলে বিজিত এবং বিজেতায়, রাজায় ও প্রজায় মনের মিলন। বাবর থেকে আরম্ভ করে’ পরের পর মোগল বাদশার জীবন-চরিত থেকে দেখা যায়, তার জয় করে নিলে দেশ কিন্তু দেশের কাছেও বাঁধা দিলে মন সত্যি সত্যি এবং ঘরের দেওয়ালে সে কথা লিখে গেল তারা—এইখানেই স্বর্গ এই স্বর্গ। এই ভাবের যখন মিলন জাতিতে জাতিতে হয় তখনি শিল্পের দিক দিয়ে নতুন যৌবন পায় দেশ, একথা মোগল বাদসার সভাপণ্ডিত “ভামিনী-বিলাসের” শেষ শ্লোকে স্পষ্ট করে’ বলে গেছেন—“শাস্ত্রান্যফলিতানি, নিত্যবিধয়ঃ সর্ব্বেহপি সম্ভাবিতাঃ দিল্লীবল্লভ-পাণিপল্লবতলে নীতং নবীনং বয়ঃ।” নব যৌবন পাওয়ার কথা দেশ বাক্য দিয়ে লেখা দিয়ে কত ছন্দে কত সাজে কত স্বরে বলে’ গেল যুগে যুগে কতবার।

 প্রতি বসন্তে গাছ যেমন করে জানিয়ে যায় বছরে বছরে তার ফুল ফোটার ফল ধরার ইতিহাস, তেমনি জানিয়ে গেল দেশের শিল্প এই পরিণয়-কাহিনী পাষাণের অক্ষর দিয়ে। পূবে পশ্চিমে এমনি মিলন আকাশপটে সোনার অক্ষরে লেখার সময় এখনো এসেছে কি না ঠিক বলা যায় না, কিন্তু এই অন্ধকার রাত্রির মধ্যেও বিদ্যুল্লেখায় সুস্পষ্ট পড়া যাচ্ছে—শিল্প বল, সভ্যতা বল, ধর্ম বল, কর্ম বল, সবই জীবন থেকে রস টেনে তবে বাঁচে। গাছ মিল্লো উপযুক্ত মাটিতে, পাতা পেলে বসন্তের আলো বাতাস, তবেই কালে তাতে ফুল ফুটলো ফল ধরলো নব যৌবন পেলে পুরোনো শাখা। দুই ভিন্ন জাতি যেখানে জল আর মাটির মতো মিলেছে সেই গভীরতার মধ্যে জগতের শিল্প শিকড় নামিয়ে দিয়ে বেঁচে থাকে; মরুভূমিতে যেখানে না আকাশের জল, না সমুদ্রের জল মিলতে পারলে মাটির সঙ্গে, কোন শিল্পের কোন ফুল সেখানে ফোটা সম্ভব হ’ল না। আকাশ বর্ষণে প্রবৃত্ত হ’ল, পাত্র নেই জলকে ধরার, কিংবা ধূলো উড়ে’ উড়ে’ আকাশের কাছে রস চাইলে, উপর থেকে তপ্ত বাতাস ছাড়া আর কিছুই এল না—এ হ’লে পৃথিবী নিষ্ফল অপ্রফুল্ল রইলো। শিল্পের উৎপত্তির কথাও এই। চোখে দেখি মরুভূমির পারে আকাশ সে মিলছে, এ শুধু চোখের ভুল, এ মিলন শুধু মরীচিকারই সৃজন করে’ থাকে, যাকে ভুল করে’ অনেকেই সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলজনক শিল্প বলে। বাদলের মেঘ সঙ্গে ঝড় ঝাপটা আনে বটে কিন্তু বর্ষণ যখন সুরু হ’ল তখন পৃথিবী আর আকাশের মধ্যে অগণিত যোগসূত্র রচনা হ’য়ে গেল, ফল্লো তবে ফসল, কিন্তু শিলাবৃষ্টি নামলো দূর আকাশ থেকে, দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হ’ল পৃথিবীর বুক জুড়ে’। মধুকর এল, এ ফুলে ও ফুলে বিয়ে দিয়ে গেল, ফলের ফুলের শোভায় বাগান ভর্তি হ’ল, পঙ্গপাল এল মেঘের মতো বটে কিন্তু দুর্ভিক্ষই বর্ষণ করে গেল চারিদিকে।

 শুধু ভারতবর্ষ নয় সব দেশের শিল্পই এমনি এক একটা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে চলে’ গেছে। একটা থেকে আর একটাতে যাবার মধ্যের পথে এই সব সঙ্কট দেখা দেয়, যে সময় পরিবর্তনের তাড়া বাড়ীওয়ালার নোটিশের মতো আসে—পুরোনো ঘটি বাটি বেচেও যার দেনা শোধ করতে হয়। শিল্পের উৎপত্তির পক্ষে এক একটা প্রতিকূল অবস্থা আসে, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে এই সঙ্কটের সময়েই দেশ নিজের যা ছিল নিজের যেটুকু আছে এবং নিজকে যা পেতে হবে ভবিষ্যতে, তার বিষয়ে চিন্তা করে। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না, শিল্প থাকতে শিল্পের মর্যাদা ঠিক দেয় না লোকে।

 শিল্পের স্থবিরাবস্থা নেই, এই পৃথিবীর মতোই সে প্রাচীনা অথচ চিরযৌবনা। মানব-প্রকৃতি বিশ্ব-প্রকৃতি এই দুয়ের মিলনে শিল্পের উৎপত্তি সুতরাং তার গতি কোন দেশে কোন কালে বন্ধ হবার উপায় নেই। শিল্প যে এক কালের মধ্যেই বদ্ধ থাকবে তারও উপায় নেই। সৃষ্টির একটা অংশ শিল্প, বাতাসের মতো জলধারার মতো মহাকালের সহচর হয়ে মানুষের ক্ষণিক জীবনের মুহূর্তগুলো বর্তমান থাকে, শিল্পকার্য মানুষের অন্তরের এবং বাহিরের প্রকৃতির সাক্ষী স্বরূপ, মূহুর্তে মূহুর্ত্তে নতুন পথ চলতে হয়, নতুন কথা লিখতে হয়, অমৃতের পাত্র পরিপূর্ণ করে’ দিতে হয় বাইরের এবং অন্তরের রসে। যদি স্থপতির শিল্প পাথরকে মাটিকে স্পর্শ করলে, ধূলো হ’ল মধুমান্—“মধুমান্ পার্থিবো রজঃ”, গানের সুর লাগলো গিয়ে বাতাসে, বাতাস মধুময় হ’ল— “মধুবাতাঃ”, শিল্প ভাবসিন্ধুতে রসসিন্ধুতে ডুব দিলে, লবণাম্বু সেও মধুর স্বাদ পেয়ে গেল—“মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ”। শিল্প-প্রবৃত্তি অলৌকিক চমৎকারী কর্ম করতে প্রবৃত্ত করায় শিল্পীকে—বাইরে এনে ফোটাতে অন্তরের মধ্যে যে ফুল গোপন রয়েছে তাকে। চারিদিকের আবহাওয়ায় মধুমাস লাগে যখন ফুল ফল ধরে’ আপনা হতেই তখন গাছের মধ্যে প্রবৃত্তি জাগে প্রকাশের।