বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/সুন্দর
কি সুন্দর এবং কি সুন্দর নয় এ নিয়ে ভারি গোলমাল বাধে যে রচনা করছে এবং যারা রচনাটি দেখছে বা পড়ছে কিংবা শুনছে তাদের মধ্যে; কেননা সবারই মনে একটা করে’ সুন্দর অসুন্দরের হিসেব ধরা রয়েছে, সবাই পেতে চায় নিজের হিসেবে যা সুন্দর তাকেই, কাজেই অন্যের রচনার সৌন্দর্যের হিসেবে সে নানা ভুল দেখে।
নিজের রচনাকে ইচ্ছা করে খারাপ করে দিতে কেউ চায় না, যথাসাধ্য সুন্দর করেই রচনা করতে চায় সবাই, কেউ পারে সুন্দর করতে কেউ বা পারে না। আমার হাতে বাণী দিলে বেসুরে বাজবেই, অকবি যে সে কবিতা লিখতে গেলে মুস্কিলে পড়বেই। কচ্ছপ জলে বেশ সাঁতার দিতো কিন্তু বাতাসে গা ভাসান দেওয়া তার পক্ষে এক নিমেষও সম্ভব হয়নি, অথচ আকাশে ওড়ার মতো কবিতা ছবি ইত্যাদি রচনার ঝোঁক তাবৎ মানুষেরই মধ্যে রয়েছে। গান শুনে মনে হয় বুঝি আমিও গাইতে পারি, মন মেতে ওঠে এমন যে ভুল হয়ে যায় স্বরের পাখী বুকের খাঁচায় ধরা দেয়নি একেবারেই। বালক যখন সুরে বেসুরে তালে বেতালে মিলিয়ে নেচে গেয়ে চল্লো তখন তার সব অক্ষমতা সব দোষ ভুলিয়ে দিয়ে প্রকাশ পেলে শিশুকণ্ঠের এবং সুকুমার দেহের ভাষাটির অপূর্ব সৌন্দর্য, কিন্তু বড় হয়ে ছেলেমো করা তো সাজে না একেবারেই! তবেই দেখা যাচ্ছেও স্থান কাল পাত্র হিসেবে সুন্দর ও অসুন্দর এই ভেদ হচ্ছে নানা রচনার মধ্যে। হরিণ সে বাঁশী শুনে’ ভোলে, সাপ সে বাঁশী শুনে’ ফণা তুলে’ তেড়ে আসে, সাপ-খেলানো বাঁশী সাপের কানে সুন্দর স্বর দিলে, মানুষের কানে হয় তো খানিক সেটা ভাল ঠেকলো, তাই বলে’ বিয়ের রাতে সানাই উঠিয়ে নহবতখানায় সাপুড়ে এনে বসিয়ে দেয় কেউ? অবশ্য রুচিভেদে গড়ের বাদ্যি ঢাকের বাদ্যি বিয়ের রাতে এসে জোটে, ঘুমন্ত পাড়ার কানের শ্রবণশক্তি তেজস্কর পদার্থ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে কনসার্টের দলও অলিতে গলিতে এসে আবির্ভূত হয়; কিন্তু নিজের মনকে প্রশ্ন করে’ দেখ, সে নিশ্চয়ই বলবে যে কিছুক্ষণের জন্য বলেই এ সব সইছে; ঢাকের বাদ্যি থামলেই মিষ্টি—এটা মানুষের মন বলেই দিয়েছে বহুকাল আগে, কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় আকাশ ভরে যে শাখ ঘণ্টা বাজে তার স্বর-মাধুর্য সম্বন্ধে অনয় মত কারও আছে বলে’ তো বোধ হয় না। গড়ের বাছি গড়ের মাঠে সুন্দর লাগে, মন্দিরের শাখ ঘণ্টা দূরে থেকেই ভাল লাগে। সভাস্থলে বীণা বেণু মন্দির, ঘরের মধ্যে সোনার চুড়ির ঝিন্ ঝিন্ স্থান কাল পাত্রের হিসেবে সুন্দর অসুন্দর ঠেকে। মাঠ ছেড়ে গড়ের বাছি যদি ঘরের মধ্যে ধুমধাম লাগায় তবে সে স্থান কাল পাত্রের হিসেব ডিঙ্গিয়ে চলে ও সেই কারণেই ভারি বিজী ঠেকে কানে। মন্দির যখন নদীর ওপার থেকে আরতির ঝনঝন অনেক খানি বাতাস আলো দিয়ে ধুয়ে পাঠায় এপারে তখনি মুন্দর ঠেকে সেটি। সন্ধ্যা-প্রদীপ সন্ধ্যাতার একজন খুব ঘরের কাছে অন্যজন খুব দূরের কিন্তু সুন্দর হিসেবে দুজনে সমান বলে’ আলোর তীক্ষ্ণতা স্তিমিত করে নিয়ে দুজনেই সুন্দর হ’ল মানুষের চোখে!
দখিন হাওয়া শরতের আলো এ সবের মাধুর্যের পরিমাপ তাপমান যন্ত্রের দ্বারা হয় না, মনের বীণায় এরা আপনার সুন্দর পরশ বুলিয়ে দিয়ে জানায় যখন, তখন বুঝি কতখানি মধুর এবং কতখানি সুন্দর এরা। মানুষের মধ্যে যারা ওস্তাদ নয় তারা নিজের হাতে কাঠের বীণাটায় ঘা দিতে থাকে মাত্র, মনে ঘা দেওয়ার কৌশল জানে না তারা। সৌন্দর্য সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার উত্তর মানুষ না পেলে বাহির থেকে, না পেলে তার নিজের ভিতর থেকে, এইজন্তই মনে হয় দেশে দেশে কালে কালে সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে মানুষ ক্রমাগত আলোচনা করে চলেছে। পণ্ডিত থেকে অপণ্ডিত সবাই জানে সুন্দর আছে, কিন্তু কার কাছে কেমনটা সুন্দর কেমনটি নয় এর মীমাংসা হ’ল না আজও। স্থান কাল দুই অমুকুল প্রতিকূল হয় সুন্দর সম্বন্ধে—এটা কতকটা স্থির হয়ে গেছে; কিন্তু পাত্র হিসেবে কার চোখে কি যে সুন্দর এর মীমাংসা প্রত্যেকে নিজেরাই করছি। শাখ ঘণ্টা দূর থেকে একটা সময়ে ভালো লাগলো বলে’ কানের কাছে তাকে যদি কেউ টেনে এনে বলে, শোনে কি মুন্দর, তবে তর্কের ঝড় না উঠে যায় না; এ কথা গড়ের বাছি 'ইমামবারার আজান সবারই সম্বন্ধে খাটে। দূরে থাকার দরুণ অনেক জিনিষ মুন্দর ঠেকে, দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে টেনে আনলেই তাদের সব সৌন্দর্য চলে যায়।
এই যে ব্যক্তিগত মতামত, সুন্দর অসুন্দরকে নিয়ে এই যে সব ছোটখাটো তর্ক-বিতর্ক, যার কোনো শেষ দেখা যায় না, নানা সুন্দরের সৃষ্টি করে করে মানুষ দেখতে চেয়েছে এটিকে নিরস্ত করতে পারে কি না। রচনাকে স্থান কাল পাত্রের অতীত করে দিতে চেয়েছে মানুষ; শোনাবার জন্যে যে সব রচনা তা মানুষ উপযুক্ত ছন্দোবন্ধ মুর-সার ইত্যাদি দিয়ে, দেখাবার জন্য যে রচনা তা যথোপযোগী রংচং ও নান কায়দা দিয়ে সব সময়ে সবার উপভোগ্য ও সুন্দর করার চেষ্টা করে গেল কালে কালে। স্বরকে, সঙ্গীতশাস্ত্রের মধ্যে, কথাকে ছন্দশাস্ত্রে, ছবিকে বর্ণশাস্ত্রের মধ্যে ধরে মানুষ দেখতে চল্লো কি হয়, কিন্তু বাস্তবিক যা সুন্দর তা ধরা গেল না একটা কিছুর মধ্যে, সে বিচিত্রতা ও বিস্তার চেয়ে বাঁধন কাটতে থাকলে বারে বারে। কোন ছবি বর্ণ ছেড়ে খালি রেখার ছন্দ ধরে’ হয়ে উঠলো ভারি সুন্দর, কোন গান শাস্ত্র মতে তাল মান সুর ছেড়ে প্রায় সহজ কথা হয়ে পড়ে’ হ’ল সুন্দর, আবার কোথাও ছবি হয়ে হ’তে চল্লো সুন্দর, তিন শাস্ত্রের পাতা উল্টে পাল্টে এক হয়ে গেল, ছন্দ পেয়ে ছবি অথবা ছবি পেয়ে ছন্দ সুন্দর হয়ে ওঠে, বোঝা কঠিন হ’ল বোঝানও কঠিন হ’ল! রচনাতে স্থান কাল পাত্রের সীমা অতিক্রম করার জন্ত নতুন নতুন উপায়ের সৃষ্টি হয়েই চল্লো। আকাশের চাঁদকে আমরা প্রায় সকলেই সুন্দর দেখি, কিন্তু কি নিয়ে চাঁদ সুন্দর যদি এ প্রশ্ন করা যায় তবেই গোলযোগ বাধে। কেউ বলে চাঁদনী নিয়ে চাঁদ সুন্দর, কেউ বলে তার ছাঁদটী নিয়েই চাঁদ সুন্দর, কেন না অনেক শিল্পী দেখেছি কালে চাঁদ এঁকেছেন অথচ ছবিটির সৌন্দর্যহানি একটুও ঘটেনি। আর্টিষ্ট মানুষের অনেক রকম পাগলামি থাকে, সুতরাং কালে চাঁদের উদাহরণটি সবাই স্বীকার করতে নাও রাজি হতে পারেন। কিন্তু ঠিক এই উপায় দেখেছি প্রকৃতিদেবীও অবলম্বন করেছেন নিজের রচনাতে— সাদা তুষারকে কালে নীলবর্ণ করে’ দেখিয়েছিলেন তিনি আমাকে যতদিন পাহাড়ে বাস করেছিলেম ততদিন—প্রত্যেক প্রভাতে সোনার আকাশপটের মাঝখানে কালো তুষারের ঢেউ, অথচ দৃশ্যপটে একটুও সৌন্দর্যহানি হ’ল না।’
চাঁদনী রাতের বেলায় আমরা বলে’ থাকি, দিব্বি ফুটফুটে রাত, অন্ধকার রাতের বেলায় দিবিব ঘুটঘুটে অন্ধকার তো বলিনে! কিন্তু কবিরা দুটোই যে সুন্দর তার এত প্রমাণ হাতের কাছে রেখে গেছেন যে তা উঠিয়ে লেখা বড় করা মিছে। এই সে দিন একখানা চীনদেশের পাখা আর একখানি জাপানের পাখা হাতে নিয়ে দেখছিলেম,—জাপানের পাখাখানি সাদা, তার উপরে নানা রঙের ছবির বাহার, দিনের আলোয় সুন্দর পৃথিবীর একটুখানি যেন দেখা যাচ্ছে, চীনের পাখাখানি ঠিক এর উল্টো ধরণে আঁকা; অন্ধকার রাত্রির একটি মাত্র প্রলেপ, তার মধ্যে কোন ছবি কি কোন রঙ নেই—স্নিগ্ধ গভীর ঘুমপাড়ানো কালো অথচ ভারি সুন্দর। এই যে সুন্দরকে দেখতে দুই দেশের দুই শিল্পী পাখা মেল্লে, একজন দিনের দুয়ার দিয়ে আলোর মাঝে উড়ে’ পড়ল প্রজাপতির মতো, অন্যজন একেবারে অন্ধকার সাগরে খেয়া দিয়ে চল্লো—এরা দু’জনেই তো দেখে’ গেল দেখিয়ে গেল সুন্দরকে?
যারা ভারি পণ্ডিত তারা সুন্দরকে প্রদীপ ধরে’ দেখতে চলে আর যারা কবি ও রূপদক্ষ তারা সুন্দরের নিজেরই প্রভায় সুন্দরকে দেখে’ নেয়, অন্ধকারের মধ্যেও অভিসার করে তাদের মন। আলোর বেলাতেই কেবল সুন্দর আসেন দেখা দিতে, কালোর দিক থেকে তিনি দূরে থাকেন—একথা একেবারেই বলা চল্লনা,বিষম অন্ধকার না বলে’ বলতে হ’ল বিশদ অন্ধকার—যদিও ভাষাতত্ত্ববিদ্ এরূপ করায় দোষ দেখবেন। কালো দিয়ে যে আলো এবং রঙ সবই ব্যক্ত করা যায় সুন্দরভাবে তা রূপদক্ষ মাত্রেই জানেন। এই যে সুন্দর কালো এর সাধনা বড় কঠিন। সেই জন্য জাপানে ও চীনদেশে একটা বয়স না পার হ’লে কালি দিয়ে ছবি আঁকতে চেষ্টা করতে হুকুম পায় না গুরুর কাছ থেকে শিল্পশিক্ষার্থীরা। যে রচনায় রস রইলো সেই রচনাই সুন্দর হ’ল এটা স্থির, কিন্তু রস পাবার মতো মনটি সকল মানুষেই সমানভাবে বিদ্যমান নেই, কাজেই এটা ভাল ওটা ভাল নয় এই রকম কথা ওঠে। মেঘের সঙ্গে ময়ূরের মিত্রতা, তাই কোন্ একদিন নিজের গলা থেকে গন্ধর্ব নগরের বিচিত্র রঙের তারা-ফুলে গাঁথা রঙ্গীন মালা ময়ূরের গলায় পরিয়ে দিয়ে মেঘ তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলে। মানুষ প্রথম ভাবলে, এমন সুন্দর সাজ কারো নেই। তারপর হঠাৎ একদিন সে দেখলে বকের পাঁতি পদ্মফুলের মালার ছলে সুন্দর হয়ে মেঘের বুক থেকে মাটির বুকে নেমে এল, মানুষ বল্লে, ময়ুর ও বক এর দুইটিই সুন্দর। আবার এল একদিন জলের ধারে সারস পাখী—মেঘ যাকে নিজের গায়ের রংএ সাজিয়ে পাঠালে। এমনি একের পর এক সুন্দর দেখতে দেখতে মানুষ বর্ষাকাল কাটালে, তারপর শরতে দেখা দিলে আকাশে নীল পদ্মমালার দুটি পাপড়িতে সেজে নীলকণ্ঠ পাখী, এমনি ঋতুর পর ঋতুতে সুন্দরের সন্দেশ-বহ আসতে লাগলে একটির পর একটি মানুষের কাছে—সব শেষে এল রাতের কালো পাখী আকাশপটের আলো নিভিয়ে অন্ধকার দুখানি পাখনা মেলে—পৃথিবীর কোনো ফুল, আকাশের কোনো তারার সঙ্গে মানুষ তার তুলনা খুঁজে না পেয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো!
এই যে একটি মানুষের কথা বল্লেম, এমন মানুষ জগতে একটি দুটি পাই যার কাছে সুন্দর ধরা দিচ্ছেন সকল দিকে নানা সাজে নানা রূপে বর্ণে সুরে ছন্দে। ময়ুরই সুন্দর, কলবিঙ্ক নয়, কাক নয় এই কথা যারা বলছে এমন মানুষই পৃথিবী ছেয়ে রয়েছে দেখতে পাই।
সুরের নানা ভঙ্গি দখল না করে’ আমাদের গাইয়ে মুখভঙ্গিটাতেই যখন পাকা হয়ে উঠলো, তখন সভার লোকে দূর ছাই করে’ তাকে গঞ্জনা দিলে, সুরের সৌন্দর্য ফুটলো না, তার চেষ্টায় বটে কিন্তু ঐ মুখভঙ্গি অঙ্গভঙ্গির মধ্যে আর একটা জিনিষ ফুটলো যেটি হয়ে উঠলো একখানি সুন্দর ছবি ওস্তাদের!
আর্টিষ্টদের কেউ কেউ ভুল করে’ বলেন “সুন্দরের সন্ধানী”। সুন্দর যাকে ঘিরে থাকে না সেই বেড়ায় সুন্দরের খোঁজে গড়ের মাঠে, জু গার্ডেনে, মিউজিয়ামে,—এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। সুন্দর কি, সুন্দর কি নয় এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেখা-লেখি এবং সৌন্দর্যতত্বের রসতত্ত্বের যত পুঁথি আছে তার বচন ধরে’ ধরে’ যেন লাঠি হাতে চলা। ততক্ষণ সুন্দর যতক্ষণ কাছে নেই, সুন্দর এলেন তো ও সব ফেলে চল্লো মন স্বচ্ছন্দে অবাধগতিতে সব তর্ক ভুলে’। অজ রাজা যখন নগরে প্রবেশ করেছিলেন তখনকার কথা কার না জানা আছে? ফুল ফুটে গিয়েছিল সেদিন আপনা হতেই। মধুকরের কাছে যে ভাবে হাওয়া এসে মধুর খবর দিয়ে যায় সেইভাবে খবর আসে সুন্দরের যে লোক যথার্থ আর্টিষ্ট তার কাছে, তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় না সুন্দরকে খুঁজে খুঁজে আর্টিষ্টে আর সুন্দরে লুকোচুরির লীলা চলে অনেক সময়ে কিন্তু সে দুই ছেলেতে পরিচয় হবার পরে খেলার মতে, ইচ্ছা করে’ গোপন থেকে পর্দা টেনে দিয়ে খেলা,—তার মধ্যে রস আছে বলেই খেলা চলে। যে সুন্দরকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্ধান করছে তার ছুটোছুটির সঙ্গে এ খেলার তফাৎ রয়েছে।
পিঁপড়ে ছুটোছুটি করে চিনির সন্ধানে কিন্তু মধু আহরণে মৌমাছির ছুটোছুটি সে একটি স্বতন্ত্র ব্যাপার। পিঁপড়ের চিনি সংগ্রহের সঙ্গে তার পেটের যোগ, চিনি না পেলে সে মরা ইঁদুরে গিয়ে চিম্টি বসায় কিন্তু পেট খুব তাড়া দিলেও মাছের আর মাংসের জুস্ দিয়ে মৌচাক ভর্তি করতে চলে না মৌমাছি। মৌমাছি কি খেয়ে বাঁচে এবং আর্টিষ্ট তারাও কি খেয়ে জীবনধারণ করে তার রহস্য এখনো ভেদ হয়নি। শুধু এটুকু বলা যায় যে তারা পিঁপড়ের মতো সুন্দর সামগ্রীকে পেটের তাড়নার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে সুন্দরের সন্ধানে বার হয় না, ফুল ফোটে ওধারে সুন্দর হয়ে খবর আসে বাতাসে তাদের কাছে, চলে’ যায় তার সুন্দরের নিমন্ত্রণে, সন্ধানে নয়। মৌচাকে যেমন মধু তেমনি ছবি মূর্তি কবিতা গান কত কি পাত্রে ধরলে মানুষ সুন্দরকে, ওদিকে আবার বিশ্বজগতে সুন্দর নিজেকে ধরে’ দিলেন আপনা হতেই ফুলে ফলে লতায় পাতায় জলে স্থলে আকাশে কত স্থানে তার ঠিকানা নেই, এত সুন্দর আয়োজন কিন্তু ভোগে এল শুধু দু’চারজনের, আর বাকি অধিকাংশ তারা এ সবের মধ্যে থেকে শুধু সৌন্দর্যতত্ত্বই বার করতে বসে’ গেল। সেই বেজান্ সহরের কথা মনে হয়; উপবনে সেখানে পাখী গাইলো ফুল ফুটলো মুকুল খুল্লো ফল ধরলো পাতা ঝরলো, সবই সুন্দরভাবে হয়ে চল্লো দিনে রাতে, কিন্তু সহরের কোনো মানুষ এগুলো থেকে কিছু নিতে পারলে না, পাথরের চেয়েও পাথর হয়ে বসে রইলো, শুধু দু’চারজন পথিক দুটো একটা হতভাগা ভিখিরী নয় পাগল তারাই কেবল থেকে থেকে এল গেল সেই দেশের সেই বাগানে যেখানে দৃষ্টি-ভোলানো সুন্দরের সামনে মুখ করে’ বসে আছে মুক অন্ধ বধির নিশ্চল মানুষের দল ঘোলা চোখ মেলে।
যার চোখ সুন্দরকে দেখতে পেলে না আজন্ম তার চোখের উপরে জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা ঘষে’ ঘষে’ ক্ষইয়ে ফেল্লেও ফল পাওয়া যায় না, আবার যে সুন্দরকে দেখতে পেলে সে অতি সহজেই দেখে নিতে পারলে সুন্দরকে, কোনো গুরুর উপদেশ পরামর্শ এবং ডাক্তারি দরকার হ’ল না তার, বিনা অঞ্জনেই সে নয়ন-রঞ্জনকে চিনে গেল।
মাটি থেকে আরম্ভ করে’ সোনা পর্যন্ত, যে ভাষায় কথা চলে সেটি থেকে ছন্দোময় ভাষা পর্যন্ত, তারের সুর থেকে গলার সুর পর্যন্ত বহুতর উপকরণ দিয়ে রূপদক্ষেরা রচনা করে’ চলেছেন সুন্দরের জন্য বিচিত্র আসন, মানুষের কাজে কতটা লাগবে কি না লাগবে এ ভাবনা তাঁদের নেই। কাদায় যে গড়ে সে কাদাছানা থেকেই সুন্দরের ধ্যান ধরে’ চলে, না হ’লে গড়ার উপযুক্ত করে’ মাটি কিছুতে প্রস্তুত করতে পারে না সে—এ কথাটা কারিগরের কাছে হেঁয়ালী নয়। চাষের আরম্ভ থেকেই সোনার ধানের স্বপ্ন জমীতে বিছিয়ে দেয় চাষা কিন্তু যার সুন্দরের ধ্যান মনে নেই সে যখন ভাল মাটি নিয়ে বসে যায় এবং দেখে মাটি বাগ মানছে না তার হাতে, তখন সে হয়তো বোঝে হয়তো বোঝে ও না কথাটার মর্ম।
ছন্দ, সুর-সার এবং রঙ প্রস্তুত ও তুলি টানার প্রকরণ সহজে মানুষ আয়ত্ত করতে পারে কিন্তু তুলি টানা হাতুড়ি পেটা কলম চালানোর আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত সুন্দরের ধ্যানে মনকে স্থির রাখতে সবাই পারে না, এমন কি রূপদক্ষ তারাও সময়ে সময়ে লক্ষ্য হারিয়ে ফেলছে তাও দেখা যায়।
যে রচনাটি সর্বাঙ্গসুন্দর তার মধ্যে রচনার কল-কৌশল ধরা থাকে না—কথা সে যেন ভারি সহজে বলা হয়ে যায় সেখানে! এই যে সহজ গতি এ থাকে না যা সর্বাঙ্গসুন্দর নয় তাতে—কৌশল নৈপুণ্য সবই চোখে পড়ে। কবিতা থেকে এর দৃষ্টান্ত দেওয়া চলে, ছবি মূর্তি সব থেকে এটা প্রমাণ করা চলে। কর্ম কোনো রকমে নিষ্পন্ন হ’ল এবং কর্ম খুব হাঁকডাক ধূমধামে নিষ্পন্ন হ’ল—এ দুয়েরই চেয়ে ভাল হ’ল কর্মটি যখন সহজে নিষ্পন্ন হয়ে গেল কিন্তু কর্মের জঞ্জালগুলো চোখে পড়লো না।
হাড় মাসের কত গাঁঠ খিল বাঁধন কসন ইত্যাদি অত্যন্ত জটিল ব্যাপার নিয়ে তৈরি হ’ল মানুষের দেহযন্ত্র, এই সব যান্ত্রিক ব্যাপার যা নিয়ে মানুষটা চলছে বলছে সেগুলো আড়ালে রইলো একখানি পাতলা পর্দার ওপারে তবেই সুন্দর ঠেকলো মানুষটা। আর্গিণ যন্ত্রের ঘেরাটোপ খুলে’ দিয়ে তার ভিতরের কারখানা যদি চোখের সামনে ধরে’ দেওয়া যায় তবে সেটা খুব সুদৃশ্য বলে’ ঠেকে না।
আমি একবার একটা ছাপার কল অনেকক্ষণ ধরে’ দাঁড়িয়ে দেখেছিলেম। যন্ত্রটা একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষের কায একা করছে, মানুষের চেয়ে সুচারু ও দ্রুতভাবে। এতে করে’ ভারি একটা আনন্দ হ’ল, কিন্তু একটি পাখীকে উড়তে দেখে যে আনন্দ তার সঙ্গে সেদিনের আনন্দে তফাৎ ছিল। পাখীর ডানার মধ্যে নানা কল-বল কি ভাবে কায করছে তার খোঁজই নেই, ওড়ার সুন্দর ছন্দই সেখানে দেখা দিয়ে মনকে উড়িয়ে নিয়ে গেল কোন্ দেশে তার ঠিক নেই। সৃষ্টির নিয়মে সমস্ত সুন্দর জিনিষ আপনার নির্মাণের কৌশল লুকিয়ে চল্লো দর্শকের কাছ থেকে এবং এই নিয়মই মেনে চল্লো সমস্ত সুন্দর জিনিষ যা মানুষে রচনা করলে—যেখানে নির্মাণের নানা প্রকরণ ও কৌশল ধরা পড়ে’ গেল। সেখানেই রচনার সৌন্দর্যহানি হ’ল, কলের দিক ফুটলো কিন্তু রসের দিক সৌন্দর্ষের দিক চাপা পড়ে গেল। ঘুড়ি যখন আকাশে ওড়ে তখন যে কলটি তাতে বেঁধে দেয় কারিগর সেটি বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে যায় তবেই সুন্দর ঠেকে ঘুড়িখানির ওড়ার ছন্দ। জাহাজ এমন কি উড়ো কল তারাও দেখায় সুন্দর এই কারণে এবং সবচেয়ে দেখায় সুন্দর গঙ্গার উপরে নৌকাগুলি যার চলার হিসেব ও কল-বল প্রত্যক্ষ হয়েও চক্ষুশূল হচ্ছে না।
সুন্দর জিনিষের বাইরের উপকরণে আর ভিতরের পদার্থে হরিহর আত্মা—যেমন রূপ তেমনি ভাব। বহিরঙ্গ যা তার সঙ্গে অন্তরঙ্গের অবিচ্ছেদ্য মিলন ঘটিয়ে সুন্দর বর্তমান হ’ল। চোখের বাইরে যে পরকলা তার সঙ্গে চোখের ভিতরে যে মণিদর্পণ তার যোগাযোগ অচ্ছেদ্য হ’ল, তখনই সুন্দরভাবে দেখতে পাওয়া গেল বিশ্বের জিনিষ, চশমার কাঁচে আঁচড় পড়লো চোখ রইলো পরিষ্কার, কিংবা চোখের মণিতে ছানি পড়লো চশমা রইলো ঠিক ঠাক, এ হ’লে সুন্দর দেখা একেবারেই সম্ভব হ’ল না।
মৌখিক আত্মীয়তা ভারি বিশ্রী ঠেকে, কেন না, কথা সেখানে শুধু মুখ থেকে বার হচ্ছে, বুক থেকে নয়; কোলাকুলি সেও বাইরে বাইরে ছোঁয়াছুঁয়ি, বুকে বুকে লাগা একে বলতে পারা গেল না। ভারি সুন্দর লাগে যখন মানুষটির সঙ্গে মানুষের হৃদয় বাইরেটির সঙ্গে ভিতরের ভাবগুলি সুন্দর মিল নিয়ে এসে লাগে মনে।
শিল্প-সামগ্রী সংগ্রহের সময়ে একখানা পার্সি কেতাবের খালি মলাট হাতে পড়ে’ সেখানে মলাটখানাই একটা বাইরের এবং ভিতরের সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয় সামনে। এইভাবে কত সমুদ্রের ঝিনুক ফুলের পাপড়ির মতো হাতে পড়েছে, আশ্চর্য বর্ণ আশ্চর্য সৌন্দর্য নিয়ে। প্রত্যেক বারেই লক্ষ্য করেছি চোখ এবং মন দুই-ই আকর্ষণ করেছে বস্তুগুলি। শাস্ত্রে সুন্দরের কতকগুলো লক্ষণ দিয়ে বলা হয়েছে এই হ’লেই হ’ল রমণীয়, কিন্তু শুধু চোখে এবং দূরবীক্ষণ লাগিয়ে ও তারপরে অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখেও সুন্দর সম্বন্ধে শেষ কথা স্বর্গ মর্ত্য পাতালে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আকাশের রামধনুতে যিনি সুন্দর, তিনি রয়েছেন পৃথিবীর ধূলিকণায়, তিনিই রয়েছেন অতলের তলাকার একটুকরো ঝিনুকের ভিতরে বাইরে সমান সৌন্দর্য ও শোভা বিকীর্ণ করে’— হৈ সবমেঁ সবহীতেঁ ন্যারা!