বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/অসুন্দর

অসুন্দর

 মন সুন্দরের দিকে ফিরে ফিরে চায় অসুন্দরের দিক থেকে বারে বারে সরে’ আসে—এই জানা কথা বেশি করে’ জানানো নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু যারি থেকে মন সরে পড়তে চায় তাই অসুন্দর নাও হ’তে পারে— হয়তো আমাদের নিজেদের দেখার ভুলে চোখের সামনে থাকতেও সুন্দরকে চিনতে পারলেম না এমনো হওয়া বিচিত্র নয়। সুন্দরে অসুন্দরে একটা পরিষ্কার ভেদাভেদ নির্ণয় করে’ দেওয়া কঠিন ব্যক্তিগত রুচি ও অরুচির হিসেবে দেখে চল্লে।

 বাইরে থেকে মনের মধ্যে সুন্দর যে পথে আসছে অসুন্দরও সেই পথ ধরেই আনাগোনা করছে। বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগে, আবার বসন্ত রোগ সেও গায়ে লাগে—দুয়ের বেলাতেই শরীরে কাঁটাও দিয়ে ওঠে, কিন্তু মন বিচার করে’ বলে এটা সুন্দর ওটা ভয়ঙ্কর বিশ্রী। দাঁতের বেদনা সুন্দর অবস্থা কেউ বলে না, এখানে ব্যক্তিগত রুচি নিয়ে কথাই ওঠে না, কিন্তু দাঁতগুলি কেমন তার বেলা রুচিভেদে তর্ক ওঠে।

 চলিত কথায় মনের উপরে সুন্দর-অসুন্দরের ক্রিয়া ভারি সহজে বোঝানো হয়েছে। সুন্দরের বেলায় বলা হ’ল, জিনিষটি কি মানুষটি মনে ধরলো, আর অসুন্দরের বেলায় বল্লেন, মনে ধরলো না। প্রথমে বহিরিন্দ্রিয়ের বিষয় পরে মনের বিষয় হয়ে মনে রয়ে গেল সুন্দর, অসুন্দর বাইরের বিষয় হ’ল, কিন্তু মনে তার স্থান হ’ল না, পরিত্যক্ত হ’ল মন থেকে অসুন্দর, মন মনে রাখতে চাইলে না অসুন্দরকে, এই হ’ল নিয়ম।

 মনের প্রহরী পাঁচ ইন্দ্রিয় সুতরাং প্রহরীর ভুলে অনেক সময় সুন্দর দরজা থেকে ফিরে যায় আর অসুন্দর চলে’ যায় সোজা বাসরঘরে! এটা ঘটতে দেখা গেছে দরোয়ান দূর করে’ দিলে পরম বন্ধুকে আর সোজা পথ ছেড়ে দিলে চাঁদা-ওয়ালাকে।

 “হীরা হিরাইলৱা কিচঁড়মে।” হীরা কাদার মধ্যে হারিয়ে রইলো, চোখে পড়লো ঝক্‌মকে কাঁচটা, এমন ঘটনাও ঘটে তো? এবং যাই ঝক্‌ঝকে তাই সোনা নয়—একথাও বলতে হয়েছে রসিকদের যারা সুন্দরের সম্বন্ধে অন্ধ রইলো তাদের শুনিয়ে।

 অসুন্দরের মধ্যে একটা ভাণ থাকে, সুন্দরের কোনরূপ ভাণ থাকে না—এটা লক্ষ্য করা গেছে। মিথ্যার আবরণে অসুন্দর নিজেকে আচ্ছাদন করে’ আসে, সুন্দর আসে অনাবৃত— সত্যের উপরে তার প্রতিষ্ঠা।

 আর্ট যা তা সুন্দর ও সত্য, ভাণ যা তা অসুন্দর এবং অসত্য। আর্ট বস্তুর ও ভাবের সত্যটাই প্রকাশ করে, যা ভাণ তা শুধু বাইরের জিনিষটা দিয়ে ধোঁকা দিয়ে যায়, এই জন্য এককে বলি সুন্দর অন্যকে বলি অসুন্দর, এককে বলি সত্য অন্যকে বলি অসত্য। এমনি সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে নানা মতামত রয়েছে দেখা যায়। মতামত জিনিষটা সময়ে সময়ে খুব কাযে লাগে কিন্তু তার একটা দোষও আছে, সে দুর্গপ্রাকারের মতো ভারি শক্ত বস্তু এবং ভারি সীমাবদ্ধ করে’ দেখায় সুন্দর অসুন্দর সব জিনিষকে; মতগুলো ছোট গণ্ডীর মধ্যে বদ্ধ করে’ দেখায় বলেই মন সেখানে গিয়ে ধাক্কা খায়। তর্ক সৃজনের বেলায় মতামত কাযে আসে, রসসৃষ্টি সুন্দর কিন্তু সৃষ্টির বেলায় মত ধরে’ চলে না। অসুন্দর ধোঁকা দেয়, অসুন্দর ভ্রান্তি জন্মায়, অসুন্দর অমঙ্গলের কারণ ইত্যাদি প্রচলিত মত সত্ত্বেও আমাদের অলঙ্কার শাস্ত্রে ‘সন্দেহালঙ্কার’ এবং ‘ভ্রান্তিমৎ অলঙ্কার’ দুটি অলঙ্কারের উল্লেখ রয়েছে—চলিত কথায় যার নাম ধোঁকা দেওয়া এবং উল্টো বুঝিয়ে দেওয়া। মতামত ধরে’ চল্লে এর মধ্যে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল তিনের একটিও থাকতে পারে না— কিন্তু আর্ট, যার গোড়ার কথা হ’ল সুন্দরকে দেখা ও দেখানো তার সব উপকরণপ্রকরণ ভ্রান্তি উৎপাদন করেই চলেছে, মায়াপুরী সৃজন করে’ চলেছে সুর দিয়ে কথা দিয়ে রঙ দিয়ে, নশ্বরে করেছে অবিনশ্বরের আরোপ। খুব পাকা যাদুকরের চেয়ে আর্ট বেশী ভ্রান্তির সৃজন করছে—বিনা বীজে গাছ ফুল পাতা ফুটিয়ে ধরছে, চাঁদকে করে’ দিচ্ছে মানুষ, মানুষকে করে’ দিচ্ছে চাঁদ! সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের পক্ষে যেগুলো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাধা তাই নিয়ে হচ্ছে রূপদক্ষ সকলের কারবার, সিঁদ দিচ্ছে এরা মতামতের দেয়ালে যে কাঠিটি দিয়ে তার মুখে কালির মতো লেগে আছে এই মতবিরুদ্ধ যা কিছু তা।

 ছেলে একটা কাঠের ঘোড়া নিয়ে খেলতে বসেছে। সত্যিকার ঘোড়ার রঙ গড়ন পিটন সমস্তই এখানে বাদ পড়ে’ গেল অথচ ছেলে বুড়ো সবাই দেখছে সেটিকে নিছক সুন্দর। ছেলে ঘোড়াটা পেয়ে খেলছে সংসারের জিনিষ নয়-ছয় করছে না, হঠাৎ পড়ে’ গিয়ে হাত পা ভাঙ্গছে না, এই জন্য বলতে পারি ঘোড়াটি মঙ্গলের কারণ; কিন্তু সত্য তাকে তো ঘোড়ার মধ্যে কোথাও ধরা যাচ্ছে না, ছেলের কাছে যে সেটা সত্যি ঘোড়া তারও প্রমাণ পাচ্ছিনে কেননা শুনছি ছেলেই দিচ্ছে খেলনাটার নাম ‘বাঘমামা’। মতের বাঁধন অস্বীকার করে’ খেলার ঘোড়া অসুন্দর হ’ল না, সুন্দরই ঠেকলো ছেলের ও ঠাকুরদাদার চোখে।

 সুন্দর সে শুধু শুধুই সুন্দর, এ কারণে সে কারণে সুন্দর নয় এটা যেমন সত্যি তেমনি সত্যি অসুন্দর সে অসুন্দর বলেই অসুন্দর।

“নরা গজা বিশে শয়
তার অর্দ্ধ বাঁচে হয়।
বাইশ বল্‌দা তের ছাগলা
তার অর্দ্ধ বরা পাগলা।”

 এর মধ্যে সত্য অনেকখানি রয়েছে, মঙ্গলের কারণও এটার যথেষ্ট বিদ্যমান, কিন্তু সুন্দর কবিতা তো এটা হ’ল না!

“দ্বাদশ অঙ্গুলি কাঠি, সূর্যমণ্ডলে দিয়া দিঠি।
রবি কুড়ি সোমে ষোল, পঞ্চদশ মঙ্গলে ভাল।
বুধ বৃহস্পতি এগার বারো, শুক্র শনি চৌদ্দ তেরো।
হাঁচি জেঠি পড়ে যবে, অষ্টগুণ লভ্য হবে।”

 পূর্ণ মঙ্গলের আবির্ভাব এখানে একথা অস্বীকার করতে চাইনে, সত্যও আছে ধরে’ নিলেম কিন্তু সুন্দর তাঁর তো দেখা নেই বলতে হ’ল!

 এইবার একটি সুন্দর বচন শোনাই—

“ডাকয়ে পক্ষী না ছাড়ে বাসা
উড়িয়ে বসে’ খাবে করি আশা
ফিরে যায় নিজালয় না পায় দিশা
খনা ডেকে বলে সেই সে ঊষা।”

 ঊষার সহজ সুন্দর বর্ণনা, এর মধ্যে কতটা সত্য কতটা মঙ্গল এ সব মাপতে গেলে এর রসভঙ্গ হয়। বেদেও ঊষার বর্ণনা আছে, সে আর এক ভাবের সুন্দর। অথচ এই খনার বচনের মধ্যে যেমন ঊষা কতক সত্য ঘটনা ধরে বর্ণনা করা হ’ল ঠিক তেমন ভাবে ঋরিরা ঊষার বর্ণনা করলেন না, সেখানে সত্য ও কল্পনা মিলে’ মিশে সুন্দর হয়ে দেখা দিলে। সুতরাং তর্ক-বিতর্ক করে’ সুন্দর-অসুন্দরের ধারণা হওয়া আমার তো মনে হয় অসম্ভব ব্যাপার। ফোটা ফুল গন্ধ নিয়ে সুন্দর, না তার পাপড়িগুলির যথাযথ বিন্যাসটি নিয়ে, না তার ফোটার আদ্যন্ত রহস্য নিয়ে সুন্দর,—এ তর্কের তো শেষ নেই। যাকে বলতে চাই অসুন্দর তার বেলাতেও এই কথা ওঠে—কেন অসুন্দর?

 দীপশিখা সে যেমন ভয়ঙ্কর সত্য তেমনি ভয়ঙ্কর সুন্দর কিন্তু যেখানে সে ছেলের হাত পোড়ালে ঘরে আগুন ধরালে সেখানে সুন্দর বলে’ গৃহস্থ তাকে মনে করলে না। শান্তিনিকেতনে এমনি একটা লঙ্কাকাণ্ড দেখে আমার একটা ছাত্র এতটা মুগ্ধ হয়েছিলেন যে একটি চমৎকার সুন্দর ছবি পরদিনের ডাকেই আমার কাছে এসে পড়েছিল। যদি আর্টিষ্টের নিজের ঘরে এই কাণ্ডটা ঘটতো তবে তিনি নিশ্চয় সুন্দর দেখতেন না অগ্নিকাগুটি। এখানে দেখলেম, সুন্দর তিনি অমঙ্গলের রাজবেশ ধরে’ দেখা দিলেন আর্টিষ্টকে, আর এ কথাও তো মিথ্যা নয় এই ‘রাজবৎ উদ্ধদ্যুতি’ অগ্নিশিখাগুলি তার কাছে সে রাত্রে ভারি অসুন্দর ঠেকেছিল যার ঘরদ্বার পুড়ে ছাই হচ্ছিল। একের পক্ষে যা অসুন্দর হ’ল তার স্বার্থে ঘা দিচ্ছে বলে’, অন্যের পক্ষে তাই সুন্দর হয়ে দেখা দিলে স্বার্থে ঘা দিলে না বলে’। অগ্নিকাণ্ডের ছবিখানা কিন্তু এই দুই মানসিক অবস্থার বাইরের জিনিষ হ’য়ে তবেই সুন্দর হ’ল, যাদের ঘর পুড়লে তাদের কাছে, যাদের ঘর পুড়লো না তাদেরও কাছে। প্রকৃতির মধ্যে আসল ঘর পোড়ার সময়ের যে অমঙ্গলের আশঙ্কা মনকে বিমুখ কচ্ছিলে, ছবির অগ্নিশিখার লেলিহান উজ্জ্বল ছন্দটি থেকে সেটি বাদ গেল, রইলো শুধু দৃশ্যটির সৌন্দর্য ও রস, কাজেই সুন্দর ঠেকলো। এইভাবে আর একটি সদ্য জবাই করা মোরগের ছবি ভয়ঙ্কর সত্যরূপে এঁকে এনেছিল আমার সামনে আমার আর এক ছাত্র। ভারি বিস্ত্রী ঠেকলো সে ছবি, আমার সইলো না মনেও ধরলে না, চোখের কাছে এসেই ঠিকরে পড়লে মাটিতে। এখন যদি বলা যায় এ ছবি নিশ্চয় মুন্দর ঠেকবে অন্যের কাছে, এর জবাব কি দেবো?—হাঁ সুন্দর ঠেকবে এই কথাই কি বলতে হবে না? আমাকে যে ভাবে ছবিটা পীড়া দিলে সে ভাবে অন্যকে নাও দিতে পারে, সুতরাং আমার অসুন্দর অন্যের সুন্দর এটা বলা চল্লো।

 বিশ্বের কতকগুলো জিনিষকে মানুষের মন বিনা তর্কে সুন্দর বলে’ মেনে নিয়েছে, কতকগুলো জিনিষকে বলে গিয়েছে অসুন্দর। কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কতক জিনিষ সুন্দর বলে’ প্রশংসা পেয়েছে, কতক জিনিষ এ পরীক্ষায় এখনো উত্তীর্ণ হয় নি, সেগুলো রয়ে গেছে অসুন্দর। হয়তো দেখবো এই সব অসুন্দর হঠাৎ একদিন পরীক্ষা পাস হ’য়ে গেছে, ওস্তাদের এবং কারিগরের হাতে পড়ে’ তারা মুলুর হ’য়ে উঠেছে, ধূলোমুঠে। হ’য়ে গেছে সোনা-মুঠো!

 বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্যে দুটি তিনটি কারিগর রয়েছে এক ওস্তাদের তাঁবেদার, তারা সকালে আসে সন্ধ্যায় আসে দিনে আসে রাতে আসে— আলো অন্ধকারের অধিবাসের ডালা নানা সাজসজ্জার উপকরণে ভরে’ নিয়ে। সৃষ্টির জিনিষকে নূতন নূতন সুন্দর সাজে সাজিয়ে চলাই তাদের কায। কোনদিন অবেলায় আফিস ঘরে চুপি চুপি ঢুকে’ দেখলে দেখা যায়, সেখানে এসেও এই কারিগর কয়জন অতি অসুন্দর দোয়াত কলম খাতাপত্র টেবেল চেয়ার এমন কি বেহারার ঝাড়নটাকে পর্যন্ত চমৎকার আলো নয়তো চমৎকার ছায়া দিয়ে আশ্চর্য সৌন্দর্য দিয়ে গেছে —সেই আলো-অন্ধকারের রহস্য; তার মাঝে কাল যে হতভাগা বেরাল ছানাটাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিলেম সে এসে ঘুমিয়ে আছে অপূর্ব্ব সাজ ধরে রূপ’ কথার বেরাল রাজকন্যাটির মতো।

 যার মধ্য দিয়ে কোন রহস্য গতাগতি করছে না, যার মধ্যে কোনো বৈচিত্র্য পলকে পলকে বদল ঘটাচ্ছে না এমন জিনিষ যদি কোথাও থাকে তো সেইটিই অসুন্দর একথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে। যা চরিত্রবিহীন তা অসুন্দর। চরিত্র বিষয়ে একেবারে নিঃস্ব এমন কি জিনিষ আছে তা খুঁজে পাইনে; এটুকু বলা যায় যা তার চারিদিকের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন, কটু কি মধু আমাদের কোন স্বাদই দেয় না—তা আমাদের কাছে থেকেও নেই। বিস্বাদ যা তারও একটা স্বাদ আছে, যার চরিত্র নেই একেবারেই, যা কোন স্বাদই দেয় না, এমন কিছু থাকে তো তাকেই বলি অসুন্দর। এর চেয়ে পরিষ্কারভাবে অসুন্দরকে দেখানোই শক্ত, কেননা জগতে সুন্দর অসুন্দর একটা পরিষ্কার ব্যবধান নিয়ে বতর্মান নেই, সুন্দরে অসুন্দরে মিলে এখানে লীলা চলেছে। যার কোন শ্রী নেই তা বিশ্রী এটা ভারি সহজ কথা, কিন্তু একেবারে চরিত্রহীন স্বাদহীন শ্রীহীন তাকে কোথায় খুঁজে পাই তা কি কেউ বলে’ দিতে পারে? আমি কিছুদিন আগে অমসুখে পড়ে আবার আস্তে আস্তে সেরে উঠলেম, সেই সময়ে আমার এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বন্ধু এসে আমার কাযকর্ম ছবি-আঁকা বই-লেখা গানবাজনা গল্পগুজব সমস্ত বন্ধ করে’ আমাকে নিরবচ্ছিন্ন বিস্বাদ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে উপদেশ দিলেন। শুনে’ আমার বুকের রক্ত তার সব রঙ হারিয়ে হোমিওপ্যাথি অষুধের একটি ফোঁটাতে পরিণত হবার যোগাড় হ’ল। দেখলেম ভারি বিশ্রী সেই মনের অবস্থা,—এর চেয়ে অসুন্দর কোন কিছুকে বোধ করিনি আর কোন দিন।

 এই ভাবের অবিচিত্র জীবনযাত্রা অনেক মানুষকে যে নির্বাহ করতে হচ্ছে না তা নয়। একটা কায করতে করতে কায করার স্বাদ ক্রমে ক্ষয় হ’য়ে গেল, তখন কলের মতো কায করে’ চল্লো জীবন্ত মানুষ— আফিসে যায়, সংসারের ভার বয়, ছবি কবিতাও লেখে, কিন্তু কোন কিছুরই স্বাদ পায় না মন-রসনা। ছেলেগুলো নিত্য পাঠশালায় যে যেতে চায় না তার কারণ পড়তে যাওয়া-আসার সঙ্গে পড়ারও স্বাদ পাচ্ছে না ছেলেগুলি, সেই সময়ে তাদের মন উড়ু উড়ু করতে থাকলে এমন যে, তারা দেবতার কাছে নানা অসুন্দর ও অশুভ কামনা জানায়, নিজে হঠাৎ বুড়ো হ’ক, বুড়ো মাষ্টার হঠাৎ মরুক ইত্যাদি ইত্যাদি—যে ক’টি অসুন্দরকে দেখে’ বুদ্ধদেবও ডরিয়েছিলেন, তাদের ভারি সুন্দর দেখলে ছেলেগুলি। শুভ যা তা সুন্দর, অশুভ যা তা অসুন্দর এমনি একটা মত আছে। যখন দেখছি কোন একটি পতঙ্গের কাছে রাত্রির অন্ধকার ভাল ঠেকলো না, সে গিয়ে আত্মবিসর্জন করলে আগুনের কাছে, বলি যে, আগুন তাকে পোড়ায়নি সোনার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল তার দুখানি ডানা। প্রেমের সুন্দর অগ্নিশিখা নয়, এ যে অসুন্দর মৃত্যুর লেলিহান জিহ্বা, সেটা বোঝারও সময় পেলে না পতঙ্গটি—এমনি হতভাগ্য। কিন্তু সতীদাহের বেলায় একথা কোনদিন কেউ বলেনি বরং ওটা দর্শনীয় বলেই দেখতে ছুটতো লোকে। রুচি অনুসারে একই জিনিষ সুন্দর বা অসুন্দর আস্বাদ দেয়। চীনে বাড়ীতে গিয়ে দেখলেম এক সুন্দর কাচের বাটিতে ছেলেরা শুটকি মাছ খাচ্ছে; বাটিটা মুন্দর লাগলো, আহার্যের গন্ধটা কিন্তু চেনা নয় বলেই আমার নাকে ভারি অসুন্দর ঠেকলো। এই ব্যক্তিগত রুচি অরুচি ইত্যাদির উপরে যে রচনা উঠতে পারলে তাই যথার্থ সুন্দর হয়ে উঠলো। মানুষ যখন নিজেই একটি ব্যক্তি তখন এই ব্যক্তিগত রুচি অরুচি লোপ করে’ সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ও নিরপেক্ষভাবে কিছু রচনা করা তার পক্ষে অসম্ভব। রচনার বিষয় নির্বাচন সেও রুচি অনুসারে করে’ চলে মানুষ; যে চা নিজের জন্য প্রস্তুত করা গেল সে আমার রুচি অনুসারে চিনি দুধ না দিয়ে যেমন তেমন পাত্রে খেলেও কারো কিছু বলবার নেই, কিন্তু পরকে যেখানে নিমন্ত্রণ দিচ্ছি সেখানে পরের মুখ অনেকখানি চেয়ে কার্যটি নিষ্পন্ন করতে হয়, না হ’লে ব্যাপার পণ্ড হতেও পারে। ঘরে মেয়ে যেমন তেমন সেজে বেড়াচ্ছে কারো দৃষ্টি পড়ে না সেদিকে, ঘরের মধ্যে একটি বাইরের লোক আসার খবর আসুক তখন মেয়েটাকে সুন্দর করতে তার ঝুঁটি ধরে’ টানাটানি পড়ে’ যায়। মেয়েটা সেজেগুজে মুখ দেখাতে চলেছে এমন সময় কাঁচি দিয়ে যদি তার বেনে খোঁপাটি কেটে দেওয়া যায় তবে যদি মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী হয় তবে একটু কাণাভাঙ্গা সুন্দর পেয়ালাটির মতো চোখেই পড়ে না তার রূপের এই সামান্য খুঁৎ, কিন্তু শুধু সাজের দ্বারাই যাকে সুন্দর দেখাচ্ছে তার পক্ষে বেণী-সংহারের মত এমন দুর্ঘটনা আর কিছু হ’তে পারে না। মেয়েরা সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোন পুঁথি পড়ে না অথচ তাদের হাতে দেখি সাজাবার ও দেখাবার সুন্দর এবং আশ্চর্য কৌশল সমস্ত কেমন করে’ এসে গেছে আপনা হ’তেই।

 সব সুন্দর কাল রচয়িতা আপনাকে গোপন রাখে, অসুন্দর সে নিজেই এগিয়ে আসে। ফুল কতখানি সুন্দর হ’য়ে ফোটে তা সে নিজেই জানে না, প্রজাপতি জানে না যে কতখানি সুন্দর তার গতাগতি, শামুক জানে না যে তাজমহলের চেয়ে আশ্চর্য সুন্দর সমাধি গড়ে’ যাচ্ছে সে! যে কাজে রচয়িতা ‘কেমনটা বানিয়েছি’ এই টুকুই প্রকাশ করে’ গেল সে কায অসুন্দর হ’ল—এর নিদর্শন আমাদের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সেখানে প্রত্যেক পাথর কি কৌশলে একের পর আর স্তূপাকার করে’ তোলা হয়েছে এইটেই দেখা যায়। কারিগর তার তোড়জোড় নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে বুক ফুলিয়ে, কিন্তু তাজমহল সেখানে কারিগর কেমন করে’ পাথরগুলো কোন্ কোন্ খানে জুড়েছে তার হিসেবটিও যতটা সম্ভব মুছে দিয়ে তার সৃষ্টিটাকে এগিয়ে আসতে দিয়েছে সামনে। কাযের থেকে এতখানি আপনাকে লোপ করে’ দিতে যে না পারলে সে অসুন্দর কায করলে। বাড়ীর কর্তা যেখানে অভ্যাগতকে আসন দিলে না, নিজেই গট হ’য়ে জায়গা জুড়ে বসলো, সেখানে উৎসব তার পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে দেখা দিলে না। এই ভাবের অপূর্ণতা ভারি বিশ্রী জিনিষ। বিয়ের রাতে বর-কনেকে উত্তম আসন দিয়ে গুরুজনেরাও নিম্ন আসনে বসেন, সুন্দর রসের নায়ক নায়িকার স্থান অধিকার করে বলেই তারা দুটিতে বরেণ্যদেরও বরেণ্য হ’য়ে বর্তমান হয় সে রাতে।

 বিশ্বের তাবৎ জিনিষের সংস্থানের মধ্যে এই উত্তমাধম বিচারের নিদর্শন স্পষ্ট ধরা যায়। যে আলো দেবে তার স্থান হ’ল উচ্চে, যে সেই আলো পেয়ে সুন্দর হবে তার স্থান হ’ল নীচে। সকল দেশের রঙ্গমঞ্চ থেকে ফুটলাইট এখন উঠে যাচ্ছে যে তার একটা কারণ নীচের আলোতে অভিনেতাদের মুখ ভারি অসুন্দর ঠেকে, সত্যই চোখে পীড়া দেয় ও সৌন্দর্যহানি ঘটায়। তাই আলোককে উত্তম স্থান দিতে চাচ্ছেন অভিনেতারা। প্রকৃতির দৃশ্যের মধ্যে এই উত্তমাধম ইত্যাদির সম্বন্ধে বিচারের ভুল দু’ এক জায়গায় ঘটতে দেখা যায়। সূর্য যখন আপনাকে খুব অনেকখানি সরিয়ে রেখে জল স্থল আলোকিত করছেন তখন বিশ্বরচনা একটা অপরূপ সৌন্দর্য ও সুষমা নিয়ে চোখে পড়ছে, কিন্তু নদীর জলে সূর্য যখন নিজেকেই প্রখরতর করে’ ফোটাচ্ছেন তখন চক্ষের পীড়া উৎপাদন করছেন তিনি। চাঁদ সুন্দর আলো ফেলতে জানে জলে স্থলে বলেই কখনো এমন ভুলটা করে না। প্রদীপের আলো তারার আলো এরা জানে নিজেদের অপ্রধান রেখে আলো দেওয়ার রহস্য, বিদ্যুতের আলো যাকে মানুষ ঘরে আনলে সে এ রহস্য জানে না, চক্ষের পীড়া দেখতে দেখতে জন্মিয়ে দেয়—কাযেই সেই অসুন্দর আলোকে সুন্দর দেখবার জন্যে মানুষ তার উপরে নানা রকম ঘোমটা পরিয়ে দিয়ে চলেছে। বাজারের ছবিগুলির রং চং ও কায়দা কানুন ছবিটাকে পিছনে ঠেলে ফেলে এগিয়ে আসে, সেই কারণে আর্টিষ্টের কাছে ভারি অসুন্দর ঠেকে সেগুলো, কালোয়াতি আসলে গান সুর ইত্যাদিকে ঠেলে কালোয়াতটিকেই ঘাড়ের উপরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করে, সেই জন্যেই তা অসুন্দর। পাতাটি ফুলটি গাছ থেকে খসে’ পড়েছে,—তারা নিজেদের পড়ার ছন্দটি বাতাসের ছন্দে লুকিয়ে রেখে পড়ছে, তাই সুন্দর ঠেকে তাদের গতি। গাছের তাল বাতাস ছিঁড়ে’ ধুপ করে’ পড়ে’ জানাচ্ছে ‘আমি পড়লেম’, তাই ভারি অসুন্দর ও বেতালা তার ছন্দ। জলের মধ্যে ঢিলটা পড়লো, ঢিলটার কেউ খোঁজ রাখে না, কি সুন্দর ছন্দে জল দুলে’ চল্লো তাই দেখে লোকে। বায়স্কোপের মধ্য দিয়ে ফুল ফোটার ফুলের ঘুমের ফুলের জাগরণের ছবি দেখেছি— ভারি বিস্ময়কর দৃশ্য—কি সহজে প্রত্যেক পাপড়ি একটির পর একটি খুল্লো, বন্ধ হ’ল, কত সহজে শিকড়গুলো দৌড়ে চল্লো জলের সন্ধানে, সুন্দরী নর্তকীর মতো চমৎকার তার হাব ভাব, সবই ভাল লাগলো, কিন্তু আসল ফুল ফোটানোর বেলায় ঝরাণোর বেলায় সেগুলো গোপন রইলো। সেই চলাচল ও কৌশলগুলোই বেশী করে’ পড়লো বায়স্কোপের মধ্য দিয়ে চোখে,কাযেই আর্ট হিসেবে অসুন্দর ঠেকলো সমস্তটি আমার কাছে।

 বিশ্ব-রচনার মধ্যে দেখতে পাই সুন্দর আছে অসুন্দরও আছে— ওদিকে কাকচক্ষু নির্মল জল, এদিকে পানা পুকুর। মানুষ এ দুটোকে আলাদা করে’ দেখে বলেই তুলনায় দেখে একটা সুন্দর অন্যটা অসুন্দর, কিন্তু বিশ্ব-রচয়িতা এ দুটিকেই সৌন্দর্য ফোটানোর কাযে লাগাচ্ছেন। রূপদক্ষদের কারবার দেখি সুন্দর অসুন্দর দুইকে নিয়ে। গত বছরের গ্রহণের দিনে শান্তিনিকেতনের পূর্ণিমা উৎসব ফেলে’ একা চলে আসছি, রসিকের হাত ধরে’ সুন্দরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটলো না মনে এই দুঃখ বাজছে সারা পথ, কিন্তু যিনি কবিরও কবি তিনি হঠাৎ এক সময়ে রেলের ধারে ধারে যতগুলি খানা ডোবা ছিল সবাইকে চাঁদের আলোর সাড়ি পরিয়ে আমার চোখের সামনে উপস্থিত করলেন। এই বিস্ময়কর ঘটনা অসুন্দরকে কেমন করে’ সুন্দর করে’ তুলতে হয় তা আমাকে এক মুহূর্তে শিখিয়ে গেল। তারপর দেখলেম আর্টিষ্ট তিনি চাঁদের মুখের সমস্ত আলো মুছে নিলেন, ধরিত্রীর আঁধার-করা ঘরে দেখলেম তাঁর কত কালের হারানো কন্যা ফিরে এল, সূর্যের দেওয়া আলোময় সাজ ছেড়ে শ্যামাঙ্গিনী সেই ঘরের মেয়েটির দিকে চুপ করে’ অন্ধকারে চেয়ে রয়েছেন দেখলেম আমাদের জননী যিনি তিনি। সুন্দর-অসুন্দরে রাসলীলার এই মুহূর্ত গুলি কি অপূর্ব স্বাদই রেখে গেল মনে।